২. গাছ থেকে নেমে

গাছ থেকে নেমেই খোকন ভেজা কাদা মাটির উপরই শুয়ে পড়তে চাইছিল, বিজলী তাকে থামিয়ে একটু সামনে টেনে নিয়ে যায়। পুরো চরটি মনে হয় একেবারে মাটির সাথে মিশে গেছে। যেখানে তাদের বাড়ি ছিল সেখানে কিছু নেই, ভিটেটা পর্যন্ত বোঝা যায় না। আমিন মোল্লার বাড়িটাও নেই, শুধু বাড়ির ভিটেতে দুই একটা পুঁতে রাখা বাঁশ বাঁকা হয়ে আছে। বাড়ির পাশে কিছু কাঁটা গাছ, সেখানে কীভাবে জানি কিছু কাপড় ঝুলে আছে।

একটু কাছে গিয়ে বিজলী দেখল, আসলে কাপড় নয়, একজন মানুষ উল্টো হয়ে ঝুলে আছে। চোখ দুটো খোলা, সেই ভোলা চোখে তাদের দিকে তাকিয়ে আছে, মানুষটার শরীরে প্রাণ নেই। প্রথমে চিনতে পারেনি এবং বিজলী হঠাৎ করে চিনতে পারল, মানুষটি আমিন মোল্লা। তাবিজ দিয়ে সে চরের সব মানুষকে বাঁচাতে চেয়েছিল কিন্তু সে নিজেকেই বাঁচাতে পারেনি। বিজলী খোকনকে এই দৃশ্যটা দেখাতে চাইছিল না, তাকে আড়াল করে সামনে টেনে নিতে থাকল কিন্তু খোকন হঠাৎ দেখে ফেলল। সাথে সাথে একধরনের অমানুষিক আতঙ্কে চিৎকার করে সে বিজলীকে জাপটে ধরে ফেলল। বিজলীও তাকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে সামনে টেনে নিয়ে যায়, সমুদ্রের তীরে খোলা জায়গাটায় গিয়ে দুজনে ধপাস করে বসে পড়ে। খোকন সাথে সাথে বালুর উপর শুয়ে পড়ে থরথর করে কাঁপতে লাগল। কী করবে বুঝতে না পেরে বিজলী তাকে শক্ত করে ধরে রাখে।

কিছুক্ষণের মাঝে খোকনের কাঁপুনি থেমে গেল, সে চোখ বন্ধ করে কাৎ হয়ে শুয়ে রইল। খোকন কি ঘুমিয়ে গেছে না অজ্ঞান হয়ে গেছে বিজলী বুঝতে পারল না। বিজলী চারপাশে তাকালো, পুরো চরে কোনো বাড়িঘর নেই। বড় বড় দুই চারটি গাছ ছাড়া আর কোনো গাছও নেই। ইতস্তত মানুষ কিংবা গরু বাছুর মরে পড়ে আছে। আকাশে কয়েকটা চিল উড়ছে। যে সমুদ্রটা গত রাতে ভয়ংকর আক্রোশে সবকিছু তছনছ করে দিয়েছে এখন সেটি শান্ত, একটু পরপর ঢেউ এসে কূলে আছড়ে পড়ছে।

বিজলী খোকনের পাশে বসে রইল, তার সমস্ত শরীরটা মনে হয় কেউ ধারালো চাকু দিয়ে ফালা ফালা করে কেটে রেখেছে। বিজলী নিজের হাত-পায়ের দিকে তাকালো, তার নিজের শরীরটাও খোকনের মতো–হাত-পা ক্ষতবিক্ষত, সমস্ত শরীর মনে হয় কেউ খুবলে খুবলে নিয়েছে। এতক্ষণ বুঝতে পারেনি, এখন হঠাৎ করে প্রচণ্ড যন্ত্রণায় সারা শরীর দুমড়েমুচড়ে যাচ্ছে। ক্লান্তিতে তার সমস্ত শরীর ভেঙে যাচ্ছে। বিজলী নিজেও তখন খোকনের পাশে শুয়ে পড়ল। মুহূর্তে তার সামনে সবকিছু অন্ধকার হয়ে যায়।

.

বিজলী কতক্ষণ অচেতন হয়ে ছিল কিংবা ঘুমিয়েছিল সে জানে না। যখন সে চোখ খুলে তাকালো তখন সূর্য ডুবে যাচ্ছে। চারপাশে কেমন জানি এক ধরনের থমথমে পরিবেশ। বিজলীর বেশ অনেকক্ষণ লাগল বুঝতে সে কোথায় আছে। হঠাৎ করে তার সবকিছু মনে পড়ল তখন সে ধড়মড় করে উঠে বসে। তার পাশে খোকন এখনো ঘুমিয়ে আছে, নিঃশ্বাসের সাথে সাথে তার ছোট বুকটা উপরে উঠছে আর নিচে নামছে।

প্রচণ্ড পিপাসায় বিজলীর বুকটা ফেটে যাচ্ছিল, কিন্তু আশেপাশে কোথাও খাওয়ার মতো একটু পানি নেই। বিজলী কিছুক্ষণ নিজের হাঁটুতে মাথা রেখে বসে রইল। এতক্ষণ সে পরিষ্কার করে কিছু চিন্তা করতে পারেনি, এই প্রথমবার সে সবকিছু চিন্তা করতে পারল।

বোঝাই যাচ্ছে, খোকন আর সে নিজে ছাড়া এই চরে আর কেউ বেঁচে নেই। তার বাবা-মা, চরের অন্য মানুষজন, গরু-বাছুর কেউ বেঁচে নেই। এই সমস্ত চরে বেঁচে আছে শুধু তারা দুজন। তাদের সারা শরীর ক্ষতবিক্ষত, একটুখানি নড়লেই প্রচণ্ড যন্ত্রণায় সে শিউরে শিউরে উঠছে। যদি কোনো মানুষ এসে তাদেরকে না বাঁচায় তাদের কী হবে সে জানে না।

ঠিক তখন সে একটা চাপা গুম গুম শব্দ শুনতে পেল, মনে হয় একটা হেলিকপ্টার উড়ে যাচ্ছে। বিজলী অনেক কষ্টে উঠে দাঁড়িয়ে হেলিকপ্টারটা দেখার চেষ্টা করল। হেলিকপ্টারটা উত্তর দিক থেকে তাদের চরের দিকে উড়ে আসছে। বিজলী হাত নেড়ে হেলিকপ্টারটির নজরে পড়ার চেষ্টা করল। হেলিকপ্টারে যারা আছে তারা তাকে দেখতে পাচ্ছে কি না সে জানে না। বিজলী অবশ্যি থামল না, যতক্ষণ হেলিকপ্টারটি দেখতে পাচ্ছিল ততক্ষণ সে হাত নাড়াতে থাকল। হেলিকপ্টারটি চরের উপর দিয়ে একটা পাক খেয়ে আবার যেদিক দিয়ে এসেছিল সেই দিকে চলে গেল।

বিজলী হতাশভাবে মাথা নাড়ে, তাকে নিশ্চয়ই দেখতে পায়নি। দেখতে পেলে নিশ্চয়ই নামত। কিংবা কে জানে হয়তো দেখেছে কিন্তু তবু নামেনি। কেন নামবে? তারা কে? তাদেরকে বাঁচাতে হবে কে বলেছে।

বিজলী আবার গুটিসুটি মেরে খোকনের পাশে শুয়ে পড়ে। প্রচণ্ড সাইক্লোন আর জলোচ্ছ্বাস থেকে রক্ষা পেয়ে এখন হয়তো খিদে আর পানির পিপাসায় তারা মারা যাবে। কোনো একটা বিচিত্র কারণে মরে যাওয়ার ব্যাপারটি এখন আর ভয়ংকর কিছু মনে হচ্ছে না। বরং মনে হচ্ছে মরে যাওয়াটিই বুঝি ভালো। মরে যাওয়াটাই বুঝি শান্তি।

বিজলী খোকনকে জড়িয়ে ধরে মরে যাওয়ার কথা চিন্তা করতে করতে আবার গভীর ঘুমে অচেতন হয়ে গেল।

মানুষের গলার স্বর শুনে বিজলী হঠাৎ জেগে ওঠে। খোকনকে জড়িয়ে ধরে সে বালুর ওপর শুয়ে আছে। মাথার ওপর বিশাল একটা চাঁদ। বেশ খানিকটা দূরে কয়েকজন মানুষ টর্চের আলো ফেলতে ফেলতে এগিয়ে আসছে। বিজলী মাথা তুলে শোনার চেষ্টা করল, শুনতে পেল একজন চিৎকার করে বলছে, কেউ কি আছে এখানে? আছে কেউ?

বিজলীর মনে হলো তার এখন উঠে বসে কিছু একটা বলা উচিত। কিন্তু কী হলো কে জানে সে কিছু বলল না। ছোট ভাইটিকে জড়িয়ে ধরে শুয়ে রইল। কী হবে কথা বলে?

মানুষগুলো চারদিকে টর্চের আলো ফেলতে ফেলতে এগিয়ে আসছে। মনে হয় কাউকে খুঁজছে। চিৎকার করে ডাকছে, আছে কেউ? কেউ আছে এখানে? সাড়া দাও।

বিজলী সাড়া দিল না। কী হলো কে জানে হঠাৎ করে তার দুই চোখ থেকে ঝর ঝর করে পানি বের হয়ে আসে। প্রচণ্ড অভিমানে তার বুকটা ভেঙে যায়? কার বিরুদ্ধে তার এত বড় অভিমান?

টর্চের আলোটা হঠাৎ তাদের উপর এসে পড়ল। আলোটা সাথে সাথে স্থির হয়ে যায়, তারপর হঠাৎ করে সে ধুপধাপ পায়ের শব্দ শুনতে পায়। মানুষগুলো তাদের দিকে ছুটে আসছে। টর্চের তীব্র আলোতে বিজলীর চোখ ধাঁধিয়ে যায়, সে হাত দিয়ে তার চোখ আড়াল করে রাখল। তারপরও সে টের পেল মানুষগুলো তাদের ঘিরে হাঁটু গেড়ে বসেছে। একজন মহিলার উত্তেজিত গলার স্বর শুনতে পেল, বেঁচে আছে! বেঁচে আছে!

একজন মহিলা তার মাথায় হাত রাখল, ফিস ফিস করে বলল, মা, এই যে মা, আমরা তোমাকে নিতে এসেছি। চোখ খুলে একটু তাকাবে? তাকাবে একটু?

বিজলী চোখ খুলে তাকালো না, ঝর ঝর করে কাঁদতে লাগল। টের পেল মহিলাটি তার মাথার নিচে হাত রেখে তাকে বসানোর চেষ্টা করতে করতে নরম গলায় বলল, ভয় নেই মা। তোমার আর কোনো ভয় নেই। আমরা তোমাদের নিতে এসেছি।

একজন মানুষ খোকনকে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখে নিচু গলায় ইংরেজিতে কিছু একটা বলল। অন্য আরেকজন তার উত্তরে কী যেন বলল বিজলী বুঝতে পারল না।

বিজলী তার হাঁটুতে মাথা রেখে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতে থাকে। কাঁপা গলায় বলল, সবাই ভাইসা গেছে। সবাই।

মহিলাটি তার মাথায় হাত বুলিয়ে বলল, তোমরা কেমন করে বেঁচে আছো আমি জানি না। যারা শেল্টারে যায় নাই তাদের কেউ বেঁচে নেই! খোদা তোমাদের বাঁচিয়ে রেখেছেন। খোদা নিশ্চয়ই তোমাদের দিয়ে অনেক বড় কিছু করাবেন, তাই তোমাদের বাঁচিয়ে রেখেছেন।

বিজলী ভাঙা গলায় বলল, আমার মা, বাবা!

মহিলাটি বলল, আমরা আছি। আমরা আছি। তোমাদের কোনো ভয় নেই মা–

ভারী গলায় একজন পুরুষ বলল, মেডিকেল হেল্প দরকার। দেরি করা যাবে না।

পুরুষ মানুষটির কথার উত্তরে আরেকজন কিছু একটা বলল, তার উত্তরে আরেকজন। কেউ একজন ইংরেজিতে কিছু একটা বলল, তখন মহিলাটি কিছু একটা বলল। মানুষগুলো নিজেদের ভেতর নিজেরা কথা বলছে, তাদেরকে নিয়ে কী করবে সেটা ঠিক করছে।

বিজলী চোখ বন্ধ করল। এখন সে আর কিছু চিন্তা করতে চায় না। কিছু না। কী হবে সে জানতে চায় না। সে বেঁচে থাকলে কী হবে আর মরে গেলে কী হবে সেটি নিয়েও তার কোনো মাথাব্যথা নেই। সে বুঝতে পারে তার চোখের সামনে খুব ধীরে ধীরে একটা পর্দা নেমে আসছে। অন্ধকার কালো একটা পর্দা। সেই পর্দা তার সবকিছু ঢেকে ফেলল। সে আর কিছু জানে না।

*

চশমা পরা পাতলা ছিপছিপে একজন মহিলা বলল, আমার নাম সেলিনা। সেলিনা জাহান।

বিজলী গলার স্বরটা আগে শুনেছে। কোথায় শুনেছে ঠিক মনে করতে পারল না।

আমি তোমাদের দুজনকে চর থেকে তুলে এনেছিলাম।

বিজলীর তখন মনে পড়ে গেল, সে এবারে ভালো করে চশমা পরা ছিপছিপে মহিলাটির দিকে তাকালো। সাইক্লোনের পরের রাতে এই মহিলার কথাগুলো মনে হচ্ছিল অন্য কোনো জগৎ থেকে ভেসে ভেসে আসছে।

আমি যখন খবর পেয়েছি চরে দুজন ছেলেমেয়েকে দেখা গেছে–রেস্কিউ হেলিকপ্টারের রিপোর্ট, তখন আমি অন্যদের উপর ভরসা না করে নিজেই চলে গিয়েছিলাম।

বিজলীর মনে হলো এখন তার কিছু একটা বলা উচিত, তাই বলল, আপনি আমাদের জান বাঁচাইছেন।

সেলিনা জাহান মাথা নাড়ল, বলল, না। আমি বাঁচাই নাই। তোমরা নিজেরা তোমাদের জান বাঁচিয়েছ। ঐ চরের আর একজন মানুষও বেঁচে নাই। আমি শুধু তোমাদের চর থেকে তুলে এই হাসপাতালে এনেছি।

সেলিনা জাহান নামের মহিলাটি হাসপাতালের কেবিনটা ভালো করে দেখল। দুটো পাশাপাশি বিছানা। বিছানায় ধবধবে সাদা চাদর। একটা বিছানায় খোকন আধশোয়া হয়ে বসে আছে, অন্য বিছানায় বিজলী। দুজনের হাতে পায়ে শরীরে ব্যান্ডেজ। পরনে হাসপাতালের ঢলঢলে এক ধরনের গাউন।

খুব ব্যস্ত ছিলাম তাই নিজে এসে তোমাদের দেখে যেতে পারিনি। কিন্তু তোমাদের খোঁজ নিয়েছি। ডাক্তার বলেছে তোমরা সুস্থ হয়ে উঠছ। সপ্তাহে খানেকের মাঝে তোমাদের ছেড়ে দেবে।

বিজলী বলল, ছেড়ে দেবে?

হ্যাঁ।

তখন-–তখন–আমরা কই যাব?

সেলিনা জাহান মাথা নাড়ল, বলল, তোমাদের সেটা নিয়ে দুশ্চিন্তা করতে হবে না। আমি ব্যবস্থা করব।

বিজলীর জানতে ইচ্ছে হলো ব্যবস্থাটি কী কিন্তু কিছু জিজ্ঞেস করল না। একটু পর সেলিনা জাহান নিজেই বলল, আমি খোঁজ নিয়েছি। দেশে এখন অনেক অর্গানাইজেশন আছে যারা তোমাদের মতো ছেলেমেয়েদের শেল্টার দেয়।

খোকন হঠাৎ করে বলে বসল, এতিমখানা?

সেলিনা জাহান একটু থতমত খেয়ে গেল, তারপর একটুখানি হাসার চেষ্টা করে বলল, না। এতিমখানা না। এখন দেশে শিশুদের অনেক অর্গানাইজেশন আছে। তারা ছেলেমেয়েদের আশ্রয় দেয়, দেখেশুনে রাখে। দেশী বিদেশী অনেক এনজিও আছে।

বিজলী একটু ইতস্তত করে জিজ্ঞেস করল, আমি আর খোকন এক সাথে থাকতে পারব?

সেলিনা জাহান এক মুহূর্ত দ্বিধা করে বলল, হ্যাঁ, হ্যাঁ পারবে। নিশ্চয়ই পারবে। আমরা মেক শিওর করব যেন তোমরা দুজন এক সাথে থাকতে পারো।

আলাদা আলাদা দুই জায়গায় দুইজনরে নিবে না তো?

না, নেবে না। বয়স অনুযায়ী অনেক জায়গায় ভাগ করে ফেলে–ছেলে আর মেয়ে হিসেবেও অনেক জায়গায় আলাদা করে ফেলে। আমরা দেখব সেটা যেন না হয়। তোমরা দুজন যেন একসাথে থাকতে পার।

বিজলী একটা নিঃশ্বাস ফেলল। হঠাৎ করে কত তাড়াতাড়ি সবকিছু কেমন ওলটপালট হয়ে গেল। এখনো সে সবকিছু ভালো করে কিছু চিন্তা করতে পারে না। এখনো মনে হচ্ছে সে বুঝি একটা ঘোরের মাঝে আছে। মনে হয় সে বুঝি একটা দুঃস্বপ্ন দেখছে। মনে হয় হঠাৎ করে তার ঘুম ভেঙে যাবে আর সে অবাক হয়ে দেখবে সবকিছু আগের মতোই আছে। তার বাবা নির্জীবের মতো বাড়ির বারান্দায় হাঁটুমুড়ি দিয়ে বসে আছেন। মা চুলোর মাঝে শুকনো পাতা কাঠি লাকড়ি খুঁজে দিতে দিতে তাকে বকছেন।

.

গভীর রাতে বিজলীর ঘুম ভেঙে গেল। পাশের বিছানায় খোকন ছটফট করছে, যন্ত্রণার মতো শব্দ করতে করতে বিড়বিড় করে কিছু একটা বলছে। বিজলী লাফ দিয়ে তার বিছানা থেকে নেমে খোকনের কাছে গেল। খোকন ছটফট করতে করতে কিছু একটা বলছে, কথা বলতে বলতে সে হঠাৎ চিৎকার করতে শুরু করে। রক্ত শীতল করা চিৎকার। নিশ্চয়ই ভয়ংকর কোনো একটা দুঃস্বপ্ন দেখছে। বিজলী খোকনকে ধরে ঝাঁকাতে ঝাঁকাতে ডাকতে থাকে, খোকন, খোকন–এই খোকন–

শেষ পর্যন্ত খোকন চোখ খুলে তাকালো, কিন্তু সে কিছু দেখছে। বলে মনে হলো না। শূন্য দৃষ্টিতে বিজলীর দিকে তাকিয়ে চিৎকার করতে থাকে।

বিজলী খোকনকে জড়িয়ে ধরে বলে, খোকন, দেখ কিছু হয় নাই খোকন, এই যে আমি–এই যে আমি–

খোকন আতঙ্কে থরথর করে কাঁপতে থাকে, হাত বাড়িয়ে কিছু একটা ধরার চেষ্টা করে। উঠে বসে বিছানা থেকে নেমে যেতে চায়–অন্য কোনো একটা জায়গায় ছুটে যেতে চায়!

বিজলী কী করবে বুঝতে পারে না। কাঁদো কাঁদো গলায় খোকনকে ধরে রেখে তাকে শান্ত করার চেষ্টা করে, তার শরীরে হাত বুলায়, মাথায় হাত বুলায়, বুকে চেপে ধরে বলে, ভাই আমার, সোনা আমার, খোকন, খোকন সোনা, তুই তাকায়ে দেখ, আমি আছি, আমি আছি এইখানে, এই দেখ–

শেষ পর্যন্ত খোকন শান্ত হলো, বিজলীর দিকে তাকালো, প্রথমবার বিজলীকে চিনতে পারল, তারপর তাকে জাপটে ধরে হাউমাউ করে কাঁদতে লাগল।

বিজলী নরম গলায় জিজ্ঞেস করল, কী হইছে? সোনা আমার। কী হইছে তোর?

আমি দেখছিলাম তুমি ভেসে চলে যাচ্ছ—

না, আমি ভেসে যাই নাই, আমি আছি।

আমি দেখছি, অনেক মরা মানুষ তোমারে টেনে নিয়া যাচ্ছে—

না, আমারে কেউ টেনে নেয় নাই।

খোকন কাঁদতে কাঁদতে বলল, আমি দেখছি আমার পায়ের বুড়া আঙুলে কে জানি কামড় দিয়া ধরছে।

বিজলী খোকনকে শক্ত করে ধরে রেখে বলল, কেউ তোর পায়ে কামড় দেয় নাই। কেউ কামড় দিব না।

খোকন কান্না থামাল, তারপর বিজলীর দিকে তাকিয়ে বলল, বিজলীবু–

বল সোনা ভাই।

তুমি বলো তুমি কোনোদিন আমাকে ছেড়ে চলে যাবা না।

আমি তোরে ছেড়ে কেন চলে যাব? কোনোদিন যাব না।

খোদার কসম?

বিজলী খোকনকে জড়িয়ে ধরে বলল, খোদার কসম।

খোকন তখন একটু শান্ত হলো। বিজলী খোকনকে বিছানায় শুইয়ে তার মাথায় শরীরে হাত বুলিয়ে বলল, তুই এখন ঘুমায়া যা। আমি তোর পাশে বসে আছি।

খোকন তখন গুটিসুটি মেরে শুয়ে পড়ল। বিজলী খোকনের পাশে বসে তার শরীরে হাত বুলিয়ে দিতে থাকে। কিছুক্ষণের ভেতরে খোকন ঘুমিয়ে পড়ে। বিজলী তার ভাইটির পাশে নিঃশব্দে বসে থাকে। তার বুকের ভেতর কেমন জানি খাঁ খাঁ করতে থাকে।

*

নার্স ব্যান্ডেজটা খুলে নতুন ব্যান্ডেজ লাগাতে যাচ্ছিল, ডাক্তার বলল, আর ব্যান্ডেজের দরকার নেই! ঘা শুকিয়ে গেছে।

বিজলী আর খোকন তাকিয়ে দেখল আসলেই তাদের শরীরের ফালা ফালা হয়ে কেটে যাওয়া জায়গাগুলো শুকিয়ে এসেছে।

ডাক্তার খোকনের পিঠে থাবা দিয়ে বলল, ইয়ং ম্যান–দেখছ, তোমরা কত তাড়াতাড়ি ভালো হয়ে গেছ? আমাদের মতো বুড়ো মানুষ হলে ভালো হতে সপ্তাহের পর সপ্তাহ লেগে যেত। বুঝেছ?

খোকন মাথা নাড়ল, কেন বড় মানুষদের ভালো হতে বেশি সময় লাগে সে ঠিক বুঝে নাই। কিন্তু এখন সেটা নিয়ে কথা বলল না। ডাক্তারদের তার ভয় লাগে।

ডাক্তার তারপর বিজলীর দিকে তাকালো, নার্স যখন তার ব্যান্ডেজগুলো খুলছে, তখন ডাক্তার জিজ্ঞেস করল, ইয়ং লেডি। তুমি কেমন আছো?

ভালো।

গুড। তোমরা দুই ভাই-বোন খুব লাকি। আমি রিপোর্ট দেখেছি, ওই চরে একজনও বেঁচে ছিল না–

বিজলীর হঠাৎ করে তার বাবা-মায়ের কথা মনে পড়ল। তার চোখে পানি চলে আসছিল, ডাক্তার সেটা লক্ষ করে তাড়াতাড়ি কথা পাল্টে ফেলে বলল, হাসপাতালের খাবার খেতে পারো?

বিজলী চোখ মুছে বলল, পারি।

আমি জানি তুমি আমাদেরকে খুশি করার জন্য বলছ! আসলে কেউ হাসপাতালের খাবার খেতে পারে না! হাসপাতালে কেন এরকম মসলা ছাড়া বিস্বাদ খাবার দেয় জানো?

বিজলী মাথা নাড়ল, বলল সে জানে না।

ডাক্তার গলা নামিয়ে ষড়যন্ত্রীদের মতো করে বলল, এ রকম বিস্বাদ খাবার দেয় যেন রোগীরা বাড়িতে গিয়ে ভালো করে রান্না করা খাবার খাওয়ার জন্যে তাড়াতাড়ি ভালো হয়ে যায়। কথা শেষ করে ডাক্তার হা হা করে হাসতে লাগল। বিজলী ঠিক বুঝতে পারল না এটা এমন কী হাসির কথা যে এত জোরে জোরে হাসতে হবে। কিন্তু তারপরও সে ভদ্রতা করে একটু হাসার চেষ্টা করল।

ডাক্তার হাসি থামিয়ে পকেট থেকে দুইটা চকলেটের বার বের করে একটা খোনকে, আরেকটা বিজলীকে দিয়ে বলল, নাও। আমার ওয়াইফ তোমাদের দুইজনকে দিয়েছে। আমাকে বলেছে সে তোমাদেরকে একদিন দেখতে আসবে।

বিজলী কী বলবে বুঝতে পারল না, তাই মুখটা হাসি হাসি করে রাখল। এই হাসপাতালের সবাই তাদের কথা জানে, সবাই তাদের দুজনকে আলাদা করে আদর করে। একটু পরে পরে এসে সবাই খোঁজ নিয়ে যায়।

ডাক্তার যখন কেবিন থেকে বের হয়ে যাচ্ছে তখন বিজলি তার সাথে সাথে বের হয়ে এল। ডাক্তার জিজ্ঞেস করল, কিছু বলবে?

বিজলী মাথা নাড়ল। বলল, জি।

বলো।

রাত্রিবেলা খোকন জানি কী রকম করছিল।

ডাক্তার ভুরু কুঁচকে জিজ্ঞেস করল, কী রকম করছিল?

ঘুমের ভিতর ছটফট করে, পাগলের মতো হয়ে যায়। আমি যখন জাগিয়ে তুলি তখনো আমাকে চিনে না। ভয় পায়, চিৎকার করে।

ডাক্তার গম্ভীর মুখে মাথা নেড়ে বলল, অবাক হওয়ার কিছু নেই। তোমরা যত বড় ট্রমার ভিতর দিয়ে গিয়েছ, অন্য যে কেউ হলে ব্রেক ডাউন করত।

বিজলী বলে, খালি আমাকে জিজ্ঞেস করে আমি তাকে ছেড়ে চলে যাব না তো।

এটা খুবই ইম্পরট্যান্ট। তুমি এখন তার একমাত্র অবলম্বন। তোমাকে তার সাথে থাকতে হবে। সব সময় ওর সাথে থাকতে হবে।

রাত্রিবেলা যখন ওই রকম করছিল তখন আমার অনেক ভয় করছিল। মনে হচ্ছিল আর ঠিক হবে না।

না। ভয় পেয়ো না। আমি সাইকিয়াট্রিক ডিভিশনে কথা বলব। তারা দেখে যাবে। তুমি হাসিখুশি থেকো। যেটা হয়ে গেছে সেটা নিয়ে যত কম কথা বলা যায় তত ভালো। সাংবাদিকেরা যেন চলে না আসে। কেউ যেন জানতে না চায় কী হয়েছিল। ঠিক আছে?

বিজলী মাথা নাড়ল, বলল, ঠিক আছে।

.

ডাক্তার আর নার্স চলে যাবার পর বিজলী আর খোকন তাদের বিছানায় বসে একটু একটু করে তাদের চকলেটগুলো খেলো। খুবই মজার চকলেট–বিজলী তাই পুরোটা খেলো না, একটুখানি খেয়ে বাকিটা খোকনের জন্যে রেখে দিল।

বিজলী বলল, খোকন আয়, আমরা একটু বাইরে গিয়ে দেখি হাসপাতালটা কী রকম।

কেউ বকা দিবে না তো?

ধুর! বকা দিবে কেন? আমরা কি পালিয়ে যাচ্ছি নাকি?

চলো তাহলে।

এই হাসপাতালে আসার পর তারা তাদের রুম থেকে খুব বেশি বের হয় নাই। মাঝে মাঝে কী সব পরীক্ষা করার জন্যে এক-দুইবার তাদের বের হতে হয়েছে, পরীক্ষা শেষ হবার পর আবার তাদের কেবিনে নিয়ে এসেছে।

রুম থেকে বের হয়ে দুজন করিডোর ধরে হেঁটে যায়। করিডোরের শেষ মাথায় একটা জায়গায় নার্সদের বসার জায়গা। সেখানে একজন মানুষের গলায় একটা ক্যামেরা ঝোলানো, নার্সদের সাথে কথা বলছে। তাদেরকে দেখে মোটাসোটা একজন নার্স হাসি হাসি মুখে বলল, হাঁটতে বের হয়েছ?

বিজলী মাথা নাড়ল, বলল, জি।

হাঁটো। একটা কেবিনের ভেতর চব্বিশ ঘণ্টা বসে থাকা যায় নাকি?

ক্যামেরা ঝোলানো মানুষটাও মাথা ঘুরিয়ে বিজলী আর খোকনকে দেখল, তারপর নার্সকে জিজ্ঞেস করল, এই দুইজনই কি যারিনা সাইক্লোন থেকে রক্ষা পাওয়া বাচ্চা?

নার্স মাথা নাড়ল, বলল, হ্যাঁ।

মানুষটা ঝট করে ক্যামেরা তুলে ছবি তোলার জন্যে চোখে লাগাল। মোটাসোটা নার্সটা হঠাৎ প্রায় ধমক দিয়ে বলল, কী করছেন? কী করছেন আপনি?

আমি সাংবাদিক, ওদের উপর একটা রিপোর্ট করার জন্যে এসেছি।

নার্সটা গলা উঁচিয়ে বলল, না। খবরদার ছবি তুলবেন না। আমার উপর অর্ডার আছে কেউ এই বাচ্চাদের নিয়ে নিউজ করতে পারবে না। কথা বলতে বলতে মোটাসোটা নার্স উঠে বিজলী আর খোকনের সামনে এসে দাঁড়াল।

সাংবাদিকটা কেমন জানি রেগে উঠল, বলল, কেন? কেন ওদের উপর রিপোর্ট করতে পারব না?

কারণ ওরা ছোট। ওদের উপর রিপোর্ট করতে হলে ওদের গার্জিয়ানদের পারমিশান নিতে হবে।

কে ওদের গার্জিয়ান?

এখন আমরা ওদের গার্জিয়ান। টিএনও ম্যাডাম আমাকে বলেছেন ওদেরকে যেন সাংবাদিকদের থেকে দূরে রাখি।

সাংবাদিক মানুষটা অবাক হবার ভঙ্গি করে বলল, কেউ এরকম কথা শুনেছে? আমরা একটা নিউজ কাভার করতে পারব না?

পারবেন না কেন? একশবার পারবেন। কিন্তু এই বাচ্চাদের সাথে কথা বলতে পারবেন না।

সাংবাদিকটা রাগী রাগী মুখে বলল, আমি আপনাদের উপর রিপোর্ট করব।

নার্সটা হাসি হাসি মুখে বলল, যত ইচ্ছা করেন, কোনো সমস্যা নাই! আপনি হচ্ছেন সাত নম্বর সাংবাদিক। আপনার আগে আরো ছয়জন সাংবাদিক এসেছে! আমি কাউকে ওদের কাছে যেতে দেই নাই। আপনাকেও দিব না।

সাংবাদিকটা খুবই রেগে গটগট করে হেঁটে চলে গেল।

নার্সটা তখন বিজলী আর খোকনের দিকে তাকিয়ে বলল, নাও তোমরা হাঁটো। বুঝেছ, এই সাংবাদিকদের ভেতরে কোনো মায়া দয়া নেই। তোমরা কত কষ্টের ভিতর থেকে এসেছ, এখন সেইটা নিয়ে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে তোমাদের সাথে কথা বলবে! কোনো মানে আছে?

বিজলী আর খোকন করিডোরে হাঁটতে লাগল। নার্সটা গজগজ করতে করতে আবার তার আগের জায়গায় বসে কাগজপত্র দেখতে লাগল।

.

দুই দিন পর সন্ধ্যেবেলা সেলিনা জাহান বিজলী আর খোকনের সাথে দেখা করতে এল। তার হাতে একটা সুন্দর ব্যাগ। ব্যাগটা বিছানার উপর রেখে বলল, আমি তোমাদের জন্য কিছু জামাকাপড় কিনে এনেছি। দেখো দেখি তোমাদের ফিট করে কি না।

বিজলী আর খোকন শেষবার কখন নতুন জামাকাপড় পেয়েছিল মনে করতে পারে না। যদি আগের সময় থাকত আর তখন কেউ যদি তাদের জন্যে নতুন কাপড় কিনে আনত তাহলে তাদের কী আনন্দই না হতো। এখন যা কিছুই হোক, তাদের আনন্দ বা দুঃখ কিছুই হয় না।

সেলিনা জাহান ব্যাগ থেকে তাদের কাপড় বের করে দিল। বাথরুমে গিয়ে প্রথমে খোকন তারপর বিজলী সেই কাপড় পরে এল। সেলিনা জাহান হাসি হাসি মুখে বলল, বাহ্! কী সুন্দর, ফিট করেছে।

সেলিনা জাহান ব্যাগের ভেতরে উঁকি দিয়ে বলল, এর ভেতরে তোমাদের তোয়ালে, টুথব্রাশ, টুথপেস্ট, চিরুনি, স্যান্ডেল সবকিছু আছে। নতুন জায়গায় শুরু করতে যা যা লাগে সব আছে।

নতুন জায়গা? বিজলীর বুকের ভেতরটা ধ্বক করে উঠল।

সেলিনা জাহান মাথা নাড়ল। বলল, হ্যাঁ। হাসপাতাল থেকে তোমাদের রিলিজ করার সময় চলে এসেছে। এখন তোমাদের কোনো একটা ভালো শেল্টারে থাকার ব্যবস্থা করে দিতে হবে। যেখানে দুজন একসাথে থাকতে পারবে। তোমাদের আদর করে রাখবে, লেখাপড়া করাবে। খুব ভালো একটা শেল্টার–

খোকন জিজ্ঞেস করল, শেল্টার মানে কী?

সেলিনা জাহান বলল, শেল্টার হলো বাচ্চাদের থাকার জায়গা। সেখানে অনেক বাচ্চা থাকে, যারা হারিয়ে গেছে কিংবা বাবা-মায়ের ডিভোর্স হয়ে গেছে, কিংবা বাবা-মায়ের বাচ্চা মানুষ করার পয়সাকড়ি নেই এরকম।

বিজলী বলল, ও!

তোমাদের দুজনকে কোথায় রাখা যায় আমি সেটা নিয়ে খোঁজখবর নিচ্ছি। তোমাদের খবরটা মিডিয়াতে চলে এসেছে, কাজেই মোটামুটি অনেকেই জানে। অনেক কষ্ট করে সাংবাদিকদের ঠেকিয়ে রেখেছি। অনেক এনজিও তোমাদের নেয়ার জন্যে খুব আগ্রহ দেখাচ্ছে। আমি মোটামুটি একটা ঠিক করে রেখেছিলাম, তখন আরেকটা অনেক বড় অর্গানাইজেশন যোগাযোগ করেছে। ওদের নাম হচ্ছে হ্যাপি চাইল্ড।

হ্যাপি চাইল্ড?

হ্যাঁ। সেলিনা জাহান মাথা নাড়ল, বলল, তারা শুধু বাচ্চাদের নিয়ে কাজ করে। ওদের অনেক বড় একটা সেফ হোেম আছে, সেখানে অনেক ছেলেমেয়ে থাকে। তারা তোমাদের নেওয়ার জন্যে এতই আগ্রহী যে আমার সাথে কথা বলার জন্যে একজন কাল চলে আসছে।

বিজলী ঠিক বুঝতে পারল না তাদেরকে নেওয়ার জন্যে সবার এত আগ্রহ কেন। সে অবশ্য কিছু জিজ্ঞেস করল না। খোকনকে নিয়ে থাকার জন্য একটা ভালো জায়গা পেলেই সে খুশি।

সেলিনা জাহান বলল, তোমাদের জীবনের উপর দিয়ে অনেক বড় একটা ধকল গিয়েছে। এখনো যাচ্ছে। প্রথম প্রথম তোমাদের অনেক কষ্ট হবে। আস্তে আস্তে দেখো অভ্যাস হয়ে যাবে। পৃথিবীতে অনেক মানুষের জীবনে অনেক কষ্ট হয়, খোদা আবার তাদের জীবনে শান্তি দেন। সুখ দেন। একদিন দেখবে তোমাদের জীবনে সুখ-শান্তি ফিরে আসবে। অবশ্যই আসবে।

বিজলী কোনো কথা বলল না। এই পৃথিবীতে এখন তাদের কেউ নেই। সেলিনা আপা ছাড়া আর কেউ নেই। সেলিনা আপার কথা শুনে তার চোখে পানি চলে আসতে চায়।

.

পরদিন বিকেল বেলা সেলিনা জাহান একজন মানুষকে নিয়ে এল। মানুষটার গলায় টকটকে লাল একটা টাই। বিজলী আর খোকনের দিকে তাকিয়ে বলল, এই যে, ইনি ঢাকা থেকে তোমাদের নিতে এসেছেন। ইনি কাওসার সাহেব।

কাওসার সাহেব বিজলী আর খোকনের দিকে তাকিয়ে বলল, কী খবর তোমাদের? আমরা তোমাদের সম্পর্কে খবরের কাগজে পড়েছি। পড়ে আমাদের মনে হয়েছে তোমাদের সাহায্য করা দরকার। তাই তোমাদের নিতে আমি নিজেই চলে এসেছি।

বিজলী মানুষটার কথা ভালো করে শুনল না, সে সেলিনা জাহানের দিকে তাকিয়ে বলল, আপা, আপনি ভালো করে বলে দিয়েছেন তো যে আমি আর খোকন একসাথে থাকব?

হ্যাঁ, হ্যাঁ, বলে দিয়েছি।

কাওসার নামের লাল টাই পরা মানুষটা মাথা নেড়ে বলল, হ্যাঁ, হ্যাঁ, অবশ্যই এক জায়গায় থাকবে।

বিজলী বলল, এক জায়গায় না, এক সাথে।

মানুষটা জোর করে হাসার চেষ্টা করে বলল, ঐ তো। একই কথা। এক জায়গা মানে এক সাথে।

বিজলী কেমন জানি ভয় পাওয়া চোখে সেলিনা জাহানের দিকে তাকালো। সেলিনা জাহান বিজলীর মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন, তোমার কোনো ভয় নেই বিজলী, আমি আছি। আমি খোঁজ রাখব।

তারপর তার ব্যাগ খুলে একটা কার্ড বের করে বিজলীর হাতে দিয়ে বললেন, এই যে আমার কার্ড। এটা তোমার কাছে রাখো। যখনই দরকার হবে তুমি আমাকে ফোন করো।

বিজলী কার্ডটা নিয়ে শক্ত করে ধরে রাখল।

হাসপাতাল থেকে বের হবার সময় মোটাসোটা নার্সটা বিজলী আর খোকনকে বুকে চেপে ধরে হাউমাউ করে কেঁদে ফেলল।

*

হ্যাপি চাইল্ডের ডিরেক্টরের অফিসঘরটা খুব সুন্দর। বিশাল বড় একটা ডেস্ক, সেই ডেস্কের গদি আঁটা চেয়ারে ডিরেক্টর নাজনীন বসে তার ল্যাপটপে কাজ করছে। ঘরের দেয়ালে পেইন্টিং, বেশির ভাগই ছোট শিশুদের ছবি। ঘরের ভেতর কেমন জানি আরাম আরাম ঠান্ডা।

লাল টাই পরা কাওসার নামের মানুষটা বিজলী আর খোকনকে নিয়ে ডিরেক্টরের ঘরে ঢুকল। নাজনীন চোখ না তুলেই বলল, কী খবর কাওসার?

মানুষটা বলল, ম্যাডাম, সাইক্লোন যারিনা সার্ভাইবার ছেলে আর মেয়েটিকে নিয়ে এসেছি।

নাজনীন এবারে মুখ তুলে তাকালো, বলল, গুড। জব ওয়েল ডান। তারপর প্রথমবার বিজলী আর খোকনের দিকে তাকালো। বিজলী ভাবল এই মহিলাটি এখন তাদের দুজনকে এখানে বসতে বলবে। মহিলাটি কিন্তু তাদের বসতে বলল না। কিছুক্ষণ তাদের দিকে নিঃশব্দে তাকিয়ে থেকে বলল, তোমরা নিশ্চয়ই টায়ার্ড। যাও, একটু রেস্ট নাও।

বিজলী মাথা নাড়ল। নাজনীন তখন একটা কলবেল টিপল, সাথে সাথে ছোটখাটো পাহাড়ের মতো একজন মহিলা ঘরে এসে ঢুকল। হ্যাপি চাইল্ডের ডিরেক্টর নাজনীন মহিলাটার দিকে তাকিয়ে বলল, মর্জিনা। এই দুইজনকে নিয়ে যাও। ছেলেটাকে নর্থ বিল্ডিংয়ে আর মেয়েটাকে সাউথ বিল্ডিংয়ে।

বিজলী চমকে উঠল, দুজনকে দুই বিল্ডিংয়ে নিতে বলছে! খোকন ভয় পেয়ে খপ করে বিজলীর হাত শক্ত করে ধরে ফেলল। নাজনীন ভুরু কুচকে দুজনের দিকে তাকিয়ে বলল, কী হলো? কোনো সমস্যা?

বিজলী বলল, আমরা দুজন একসাথে থাকব।

নাজনীন শীতল গলায় বলল, তোমরা যখন আমাদের অর্গানাইজেশনে থাকতে এসেছ, আমাদের অর্গানাইজেশনের নিয়ম মানতে হবে। তোমাদের জন্য আলাদা নিয়ম করা যাবে না।

বিজলী বলল, কিন্তু সেলিনা আপা বলেছেন আমরা দুজন এক সাথে থাকব। বিজলী লাল টাই পরা মানুষটাকে বলল, বলেছেন না? আপনি তাই বলেছেন না?

কাওসার ইতস্তত করে নাজনীনের দিকে তাকিয়ে বলল, ম্যাডাম ব্যাপারটা হচ্ছে–

নাজনীন বলল, সেলিনা আপা মানুষটা কে?

লোকাল টিএনও।

নাজনীন কেমন জানি রেগে উঠল। বলল, আমার অর্গানাইজেশন কীভাবে চালাব, সেটা আমার একজন টিএনওর কাছ থেকে শিখতে হবে?

বিজলী মরিয়া হয়ে বলল, কিন্তু সেটা তো বলেছেন। কাওসারের দিকে তাকিয়ে বলল, বলেছেন না?

কাওসার আমতা আমতা করে বলল, না, মানে হয়েছে কী–

নাজনীন একটু ঝুঁকে পড়ে বলল, এই মেয়ে, কাওসার কী বলেছে সেটা আমার জানার দরকার নেই। আমি কাওসারের জন্যে কাজ করি না। বুঝেছ? তারপর পাহাড়ের মতো মহিলার দিকে তাকিয়ে বলল, মর্জিনা। নিয়ে যাও এদের।

বিজলী বলল, আমি সেলিনা আপার সাথে কথা বলব। সেলিনা আপা আমাকে বলেছে দরকার হলে তার সাথে কথা বলতে–

কীভাবে কথা বলবে?

আমাকে সেলিনা আপা কার্ড দিয়েছে। সেখানে টেলিফোন নম্বর আছে।

নাজনীন ভুরু কুঁচকে বিজলীর দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইল, তারপর বলল, দেখি কার্ডটা।

বিজলী ব্যাগ থেকে কার্ডটা বের করে নাজনীনের দিকে এগিয়ে দিল। নাজনীন কার্ডটি পড়ল, তারপর টুকরো টুকরো করে ছিঁড়ে তার টেবিলের নিচে ছেঁড়া কাগজের বিনটাতে ফেলে বিজলীর দিকে তাকালো, বলল, এখন?

বিজলী নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারে না। তার গলা থেকে একটা আর্তনাদের মতো শব্দ বের হয়ে আসে। খোকন বিজলীর হাত শক্ত করে ধরে রেখে কাঁদতে শুরু করে দেয়।

হ্যাপি চাইল্ডের ডিরেক্টর নাজনীন হঠাৎ চিৎকার করে বলল, মর্জিনা–

জি ম্যাডাম!

তোমাকে কী বলেছি? নিয়ে যাও এদের।

মর্জিনা দুজনকে ধরে প্রায় শূন্যের উপর দিয়ে ঝুলিয়ে টেনে নিয়ে গেল।

.

কাওসার কিছুক্ষণ মাথা নিচু করে বসে রইল। তারপর মাথা তুলে নাজনীনের দিকে তাকিয়ে বলল, নাজনীন ম্যাডাম, আমরা কি একটু বেশি করে ফেললাম না?

নাজনীন তার ল্যাপটপের দিকে তাকিয়ে বলল, কোন জিনিসটা বেশি করেছি?

এই তো–সবকিছু।

আমার অর্গানাইজেশনে থাকলে আমার নিয়ম মানতে হবে।

কাওসার ইতস্তত করে বলল, কিন্তু—

কিন্তু কী?

তারা তো আমাদের অর্গানাইজেশনে আসতে চায় নাই। আমরা অনেক আগ্রহ দেখিয়ে তাদের এনেছি। আমাকে তো কথা দিতে হয়েছে তাদেরকে একসাথে রাখব।

কীভাবে একসাথে রাখবে?

সেটা আমি ঠিক জানি না। কিন্তু চাইলে নিশ্চয়ই একটা ব্যবস্থা। করা যেত।

কেন তাদের জন্যে আলাদা ব্যবস্থা করতে হবে?

কাওসার একটা উত্তর খুঁজে বের করার জন্যে ছটফট করে উঠল, শেষ পর্যন্ত বলল, ম্যাডাম, আপনি আমাকে বলেছেন যেভাবে হোক এই দুজনকে আনতে হবে। এদের কথা সবাই জেনে গেছে, তাই এদেরকে এখানে রাখতে পারলে আমাদের হ্যাপি চাইল্ডের অনেক বড় ব্রান্ডিং হবে। ডোনারদের এদের উদাহরণ দেখিয়ে বড় ফান্ডিং আনা যাবে।

হ্যাঁ, আমি বলেছি। এর মাঝে কোন কথাটা মিথ্যা? কোন কথাটা ভুল?।

কাওসার বলল, মিথ্যা কিংবা ভুল বলছি না, কিন্তু এই বাচ্চা দুটি যদি এত স্পেশাল হয় তাহলে তাদের জন্যে একটু স্পেশাল ব্যবস্থা করলে দোষ কী?

নাজনীন বলল, কাওসার, তুমি অনেক কথা বলেছ, এখন আমি বলি। এটা সত্যি, এই দুজনকে আমরা আনতে পেরেছি, এটা বিশাল একটা ঘটনা। আমরা এদেরকে বিক্রি করে বিশাল মাইলেজ পাব। খোঁজ নিয়ে দেখো অন্য সব এনজিও এখন মাথা চাপড়াচ্ছে!

তাহলে–

নাজনীন কাওসারকে থামিয়ে বলল, এরা স্পেশাল আমাদের কাছে, কিন্তু সে জন্যে তাদের স্পেশালভাবে দেখতে হবে কে বলেছে? এরা কোথায় থাকত বলো?

কাওসার ইতস্তত করে বলল, একটা চরে।

সেখানে কীভাবে থাকত? খুব হাই ফাঁই নাকি না খেয়েদেয়ে?

খুবই সাধারণভাবে থাকত।

যে ছেলে আর মেয়ে একটা ভাঙা বাড়িতে খেয়ে না খেয়ে দিন কাটাত এখন তারা এখানে দুই বেলা পেট ভরে খাবে। সকালে ব্রেকফাস্ট, এছাড়াও দুইবার স্ন্যাক। প্রতিবছর তাদের নতুন জামা কাপড়। পরিষ্কার বিছানা। ছয় মাস পর পর মেডিক্যাল চেকআপ। যাদের সম্ভব তারা দেশে বিদেশে এডপশানে চলে যাবে। অন্যেরা স্কুলে পড়বে না হয় ভোকেশনাল ট্রেনিং। এখন তুমি বলো সাইক্লোনের কারণে এদের জীবনটা কি এখন ভালো হলো নাকি খারাপ হলো?

কাওসার কী বলবে ঠিক বুঝতে পারল না। একটু ইতস্তত করে বলল, কিন্তু আমরা তো সেটা তাদের দয়া করে দিচ্ছি না। আমাদের ডোনাররা তাদেরকে এভাবে রাখার জন্যে আমাদের ফান্ড দিচ্ছে–

এই ফান্ডটা আগে কত ছিল, এখন কত হয়েছে?

কাওসার মাথা নেড়ে বলল, এখন বেড়েছে। আপনি দায়িত্ব নেওয়ার পর ফান্ডিং অনেক বেড়েছে।

তাহলে তুমি বলো, আমি কি অর্গানাইজেশনটা ভালো চালাচ্ছি না খারাপ চালাচ্ছি?

কাওসার অনেক সাহস করে বলে ফেলল, যদি ফান্ডিংয়ের দিক থেকে দেখি তাহলে ভালো চালাচ্ছেন। কিন্তু যদি ছেলেমেয়েদের দিক থেকে দেখি তাহলে তাহলে

নাজনীন মুখ কালো করে বলল, তাহলে কী?

তাহলে ভালো চলছে না।

তুমি কী বলতে চাইছ?

কাওসার মরিয়া হয়ে বলল, যেমন একটু আগের ঘটনাটা দেখেন। এই ছেলে আর মেয়েটির কথা চিন্তা করেন। তারা কী আনন্দে আছে? নাই। তাদের কী মনে হচ্ছে না যে আমরা তাদেরকে একটা জেলখানায় আটকে ফেলেছি?

নাজনীন কোনো কথা না বলে শীতল চোখে কাওসারের দিকে তাকিয়ে রইল।

কাওসার কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে মাথা তুলে বলল, এই ছেলে আর মেয়েটির জন্য আমার খুব খারাপ লাগছে। আমার নিজেকে খুব অপরাধী মনে হচ্ছে। এই মুহূর্তে ছেলে আর মেয়ে দুটি নিশ্চয়ই এক ধরনের আতঙ্ক অনুভব করছে। আমি তাদেরকে এভাবে না আনলে তারা নিশ্চয়ই তাদের মতো থাকতে পারত।

নাজনীন তার গলার স্বরটা একটু নরম করে বলল, তোমার মন খারাপ করার কিছু নেই কাওসার। বাচ্চাগুলোর উপর যদি কোনো নিষ্ঠুরতা করা হয়ে থাকে তাহলে সেটি করেছি আমি। তুমি কিছু করোনি। তাছাড়া তোমার একটা বিষয় বুঝতে হবে।

কী বিষয়?

তোমার মনে হতে পারে আমি এই ছেলেমেয়েগুলোর সাথে নিষ্ঠুরতা করছি, কিন্তু সেটি সত্যি না। এই বাচ্চাগুলো এসেছে সমাজের সবচেয়ে নিচু অংশ থেকে। পৃথিবীতে বেঁচে থাকতে হলে তাদেরকে অনেক শক্ত হতে হয়। বড়লোকের লুতুপুতু ছেলেমেয়ে হলে তারা একদিনও টিকে থাকতে পারত না। কাজেই ধরে নাও তোমার কাছে যেটা নিষ্ঠুরতা মনে হচ্ছে সেটা তাদের একটা ট্রেনিং। কঠিন পৃথিবীতে বেঁচে থাকার ট্রেনিং।

কাওসার কোনো কথা না বলে নাজনীনের দিকে তাকিয়ে রইল। নাজনীন অনেকটা যন্ত্রের মতো বলল, এই যে ভাইবোনের ব্যাপারটা–এগুলো এই বাচ্চাগুলোর জন্যে একটা বিলাসিতা। সবাই তার নিজের জন্য বেঁচে থাকে। এদেরও নিজেদের মতো নিজেদের টিকে থাকতে হবে। কিসের ভাই? কিসের বোন?

কাওসার এবারেও কোনো কথা বলল না। নাজনীন বলল, বাচ্চাগুলো দেখতে দেখতে ভুলে যাবে কে কার ভাই, কে কার বোন! দুই সপ্তাহ যেতে দাও দেখবে এই ভাইবোনের ভালোবাসা কোথায় ভেসে গেছে!

কাওসার কোনো কথা না বলে উঠে দাঁড়াল, বলল, আমি যাই।

নাজনীন বলল, যাও। চেষ্টা করো ইমোশনাল মেলোড্রামা থেকে বের হয়ে আসতে। নাটকে অভ্যস্ত হয়ে গেলে আসল জীবনে টিকে থাকা কঠিন।

.

রাত্রিবেলা ডাইনিং রুমে বিজলী খোকনকে খুঁজে বের করল। সে আতঙ্কিত মুখে তার বয়সী কয়েকজন ছেলের সাথে বসে ছিল। বিজলীকে দেখে সে ছুটে এসে তাকে জড়িয়ে ধরে হাউমাউ করে কাঁদতে থাকে, ভাঙা গলায় বলতে থাকে, আমি থাকব না, আমি এইখানে থাকব না। থাকব না–

বিজলী তার মাথায় হাত বুলিয়ে আদর করে বলল, কাঁদিস না, খোকন সোনা। কাদিস না। দেখিস সবকিছু ঠিক হয়ে যাবে। সবকিছু ঠিক হয়ে যাবে।

খোকন কাঁদতে কাঁদতে বলল, কেমনে ঠিক হয়ে যাবে? কেমনে?

বিজলী ফিসফিস করে বলল, সেলিনা আপা যখন জানতে পারবে তখন আমাদের এইখান থেকে নিয়ে যাবে। দেখিস তুই আমাদের অন্য জায়গায় নিয়ে যাবে।

সেলিনা আপা কেমন করে জানবে?

জানবে! নিশ্চয়ই জানবে। যখন আমাদের খোঁজ নিবে তখনই জেনে যাবে।

খোকন বিজলীর কথা শুনেও কোনো সান্ত্বনা পেল না। সে বিজলীকে ধরে হাউমাউ করে কাঁদতেই থাকল। ঠিক তখন দুজন আয়া এসে খোকন আর বিজুলীকে টেনে আলাদা করে দুজনকে দুই দিকে নিয়ে গেল। কমবয়সী একজন আয়া ফিসফিস করে খোকনকে বলল, কান্না থামাও। তা না হলে তোমারে অন্ধকার ঘরে খাম্বার সাথে বেন্ধে রাখব। খেতে পাবা না। রাত্রি বেলা জোঁক, বিছা, ইন্দুর আর মাকড়সার সাথে থাকতে হবে। বুঝেছ?

খোকন আতঙ্কিত হয়ে আয়াটির মুখের দিকে তাকিয়ে কান্না বন্ধ করল। একটু পরে পরে এখন শুধু সে হেঁচকি তুলতে থাকে।

.

বিশাল হলঘরে পাশাপাশি রাখা বিছানাগুলোর একটিতে খোকন ঘুমিয়ে ছিল। গভীর রাতে খোকন তার বিছানার ছটফট করতে থাকে, রক্ত শীতল করা আর্তনাদ করে সে বিছানায় উঠে বসে। আশেপাশের বিছানা থেকে ঘুমিয়ে থাকা ছেলেগুলো ভয় পেয়ে জেগে ওঠে। তারা তাকিয়ে দেখে নতুন ছেলেটা বিছানার মাঝে আতঙ্কে দাপাদাপি করছে। তারা কী করবে বুঝতে পারে না।

পাশের বিল্ডিংয়ে ঠিক তখন বিজলী জানালায় শিক ধরে দাঁড়িয়ে ছিল। তার চোখে ঘুম নেই। খোকনকে ছাড়া সে একা কখন ঘুমিয়েছে। মনে করতে পারে না। জানালার শিক ধরে সে নিঃশব্দে কাঁদতে থাকে। ফিসফিস করে বলে, খোদা! এইটা তুমি কী করলে খোদা! কী করলে?

*

গাড়িটা রাস্তায় ওঠার পর মিলি একটা নিঃশ্বাস ফেলে বলল, আমি বুঝতে পারছি না কাজটা ঠিক হচ্ছে কি না।

রায়হান রাস্তায় ফুল বিক্রি করতে থাকা কয়েকটা বাচ্চা থেকে দৃষ্টি ফিরিয়ে মিলির দিকে তাকিয়ে বলল, কেন, কাজটা ঠিক হবে না কেন?

নিজের বাচ্চা হলে এক কথা। কিন্তু অন্যের একটা বাচ্চাকে নিজের বাচ্চার মতো মানুষ করতে গিয়ে যদি ভুল করে ফেলি?

ভুল? ভুল মানে কী?

বাচ্চাটাকে যদি ঠিকমতো আদর না করি? নিজের বাচ্চা হলে যেভাবে আদর করতাম সেভাবে যদি না করি।

রায়হান শব্দ করে হাসল, বলল, তুমি কী যে বলো মিলি! রাস্তায় একটা বিড়াল দেখলে তুমি সেইটাকে আদর করো–আর একটা আস্ত মানুষের বাচ্চাকে আদর করবে না?

একটা বাচ্চাকে চিনি না জানি না যদি তাকে আপন মনে না হয়? যদি বাচ্চাটা আনন্দ না পায়, আমাদের সাথে হ্যাপি না হয়?

শোনো মিলি, জিনিসটা এইভাবে দেখো। আমরা শেল্টার থেকে যে বাচ্চাটাকে আনব তার জীবনে এখন এমন কোনো আনন্দ নেই। কোনোভাবে বেঁচে আছে। আমরা যখন তাকে নিজেদের বাচ্চা হিসেবে বড় করব তখন তার জীবনটা আগের জীবন থেকে ভালো হবেই।

মিলি একটা নিঃশ্বাস ফেলে বলল, আমার আরো একটা ভয় হয়। কী ভয় হয় জানো?

কী?

মনে করো একটা বাচ্চাকে নিয়ে এলাম। আদর করে বড় করলাম, আস্তে আস্তে একেবারে নিজের বাচ্চা হয়ে গেল। তখন কোনো একদিন বাচ্চার আসল বাবা-মা এসে হাজির হলো। দাবি করল এটা তাদের বাচ্চা, তারা নিয়ে যেতে চায়–

রায়হান হাসল, বলল, সেটা হবে না। আমি শেল্টারের ডিরেক্টর নাজনীনকে বলেছি আমরা যাকে এডপ্ট করব তার কোনো আত্মীয়স্বজন থাকতে পারবে না। একেবারে সত্যিকারের অরফান যাকে বলে, সে রকম হতে হবে। নাজনীন বলেছে, সেটি কোনো সমস্যা না। তার বেশিরভাগ বাচ্চা এরকম। কাগজপত্র দেখিয়ে দেবে।

মিলি কোনো কথা না বলে একটা নিঃশ্বাস ফেলল।

মিলি আর রায়হানের বিয়ে হয়েছে এগারো বছর। তাদের কোনো বাচ্চাকাচ্চা নেই, বছর দুয়েক আগে তারা জানতে পেরেছে তাদের বাচ্চা হওয়ার কোনো আশা নেই। কেন বাচ্চা হতে পারবে না ডাক্তার সেটা তাদের বুঝিয়েছে। খুঁটিনাটি মিলি বুঝতে পারেনি, বোঝার চেষ্টাও করেনি। সেই ছোট থাকতে মিলি কল্পনা করত তার নিজের একটা ছোট বাচ্চা হবে, তাকে বুকে জড়িয়ে বড় করবে। যখন জানতে পারল সেটি আসলে কখনো হবে না তখন তার বুকটা ভেঙে গিয়েছিল। অনেক দিন সে নিজের ভেতর নিজে গুটিয়ে ছিল। তখন রায়হান তাকে বুঝিয়েছে একটা ছোট বাচ্চাকে নিজের বাচ্চা হিসেবে মানুষ করতে। মিলি প্রথমে রাজি হয়নি, ধীরে ধীরে শেষ পর্যন্ত রাজি হয়েছে।

রায়হান তখন খোঁজখবর নিতে শুরু করেছে। এমনিতে একটা অনাথ শিশুকে পথ থেকে তুলে এনে নিজের বাসায় বড় করলে কেউ কিছু বলবে না। কিন্তু একেবারে আইন মেনে সত্যি সত্যি অন্যের একটা বাচ্চাকে নিজের বাচ্চা হিসেবে বড় করার অনেক রকম আইনি জটিলতা রয়েছে। সব প্রতিষ্ঠান সেগুলো ঠিকভাবে করতে পারে না। রায়হান খোঁজ নিয়ে জেনেছে, সবচেয়ে নিখুঁতভাবে এই কাজগুলো করতে পারে হ্যাপি চাইল্ড নামে একটা শেল্টার। রায়হান হ্যাপি চাইল্ডের ডিরেক্টর নাজনীনের সাথে কথা বলেছে। নাজনীন তাদেরকে একবার তাদের শেল্টারে গিয়ে বাচ্চাগুলোকে নিজের চোখে দেখে আসতে বলেছে, তাই তারা আজ দেখতে যাচ্ছে।

হ্যাপি চাইল্ড নামের প্রতিষ্ঠানটির ভেতরে কত জায়গা বাইরে থেকে বোঝা যায় না। গেট দিয়ে ভেতরে ঢুকে মিলি অবাক হয়ে গেল। দুই পাশে দুটো বিল্ডিং, একটা বড় করিডোর দিয়ে দুটো এক সাথে লাগানো। মাঝখানে অফিস, পাশে পার্কিং লট। সামনে একটা খোলা জায়গা, মিলি ভেবেছিল দেখবে সেখানে ছোট বাচ্চারা ছোটাছুটি করছে কিন্তু সেখানে কেউ নেই।

মিলি আর রায়হান দোতলায় ডিরেক্টর নাজনীনের বড় অফিসটা খুঁজে বের করল। অফিসের দরজাটা খোলা, রায়হান মাথা ঢুকিয়ে বলল, আসতে পারি?

নাজনীন তার চেয়ার থেকে উঠে দাঁড়িয়ে বলল, আসুন, আসুন। আপনারাই নিশ্চয়ই আমাদের একটা বাচ্চাকে এডপ্ট করার ব্যাপারে এসেছেন। কী চমৎকার!

মিলি আর রায়হান অফিসে ঢুকল। নাজনীনের সামনে রাখা সুন্দর চেয়ারগুলোতে বসল, রায়হান হাতের ফাইলটা টেবিলের উপর রেখে বলল, আসলেই করতে পারব কি না এখনো জানি না। দেখি সম্ভব হয় কি না। আমরা আসলে এ ব্যাপারে কিছুই জানি না। আপনি সাহায্য করেছেন বলে এতদূর আসতে পেরেছি। নাজনীন হাসি হাসি মুখে বলল, কেন সাহায্য করব না? একটা বাচ্চা যদি একটা পরিবার পায় তাহলে তার জীবনটাই তো অন্যরকম হয়ে যায়। কত দুঃখী বাচ্চা এখানে আপনারা চিন্তাও করতে পারবেন না। আমরা একেবারে বুক আগলে রাখি, তারপরও আমরা চাই সবাই একটা পরিবারের সাথে থাকুক। বাবা-মায়ের ভালোবাসায় বড় হোক।

মিলি কিছু বলল না, একটা ছোট নিঃশ্বাস ফেলল। রায়হান বলল, আমরা একটা হাসিখুশি ছোট বাচ্চা চাই। যত ছোট তত ভালো। শুধু একটা ব্যাপার, বাচ্চাটার বাবা-মা ভাই-বোন আত্মীয়স্বজন কিংবা কোনো ধরনের অভিভাবক থাকতে পারবে না। বাচ্চাটা আমাদের নিজেদের বাচ্চার মতো বড় হবে, তারপর হঠাৎ একদিন তার আসল বাবা-মা এসে তাকে নিয়ে যেতে চায় তখন কী হবে?

নাজনীন গম্ভীর মুখে মাথা নাড়ল। বলল, না। এটা কখনোই হবে না। আমাদের এখানে দুই একজন বাচ্চার বাবা-মা, ভাই-বোন কিংবা আত্মীয়স্বজন থাকতে পারে। কিন্তু বেশির ভাগ বাচ্চা পুরোপুরি অনাথ। আপনাদের আমি শুধু সেরকম পুরোপুরি অনাথ বাচ্চাদের দেখাব। যাদের কেউ নেই।

রায়হান বলল, ঠিক আছে।

নাজনীন উঠে দাঁড়িয়ে বলল, আপনারা এক মিনিট এখানে বসেন। আমি দেখে আসি বাচ্চাগুলো রেডি আছে কি না।

নাজনীন তার অফিস থেকে বের হয়ে দ্রুত পায়ে পাশের বিল্ডিংটাতে হাজির হলো। একটা বড় ঘরে টেবিল ঘিরে ছোট ছোট চেয়ার, সেখানে নানা বয়সী বাচ্চা বসে আছে। টেবিলে বই পত্র খাতা কলম, যারা একটু ছোট তাদের সামনে কাগজ আর রং পেন্সিল। যারা আরো ছোট তাদের সামনে খেলনা। নাজনীন অফিসে ঢুকতেই বাচ্চাগুলো ভয়ে কেমন যেন শিটিয়ে গেল। এখানে যারা আছে তারা সবাই এই ভয়ংকর মহিলাটাকে ভয় পায়।

ঘরের কোনায় দাঁড়িয়ে থাকা কমবয়সী আয়াটি এগিয়ে এসে বলল, কিছু বলবেন ম্যাডাম?

হ্যাঁ। দুজন বাবা-মা বাচ্চা দেখতে এসেছেন। তাদের সামনে ভালো হয়ে থাকবি।

জি ম্যাডাম, সব সময়েই তো ভালো হয়ে থাকি। বলে আয়াটি দাঁত বের করে হাসল।

খবরদার গেস্টদের সামনে বাচ্চাদের বকাবকি করবি না, মারধোর করবি না।

জি না, ম্যাডাম। করব না।

নাজনীন তখন বাচ্চাদের সামনে দাঁড়িয়ে বলল, তোমরা কেমন আছো?

বাচ্চগুলো যন্ত্রের মতো বলল, ভালো। ঘরের মাঝামাঝি খোকন বসে ছিল, সে মুখ ফুটে কিছু বলল না। সে ভালো নেই।

নাজনীন এবার ধমক দিয়ে বলল, জোরে বলো।

সবাই এবারে প্রায় চিৎকার করে বলল, ভালো।

গুড। নাজনীন এবারে মাথা ঘুরিয়ে সবগুলো বাচ্চাকে এক নজর দেখে বলল, দুজন বাবা-মা এসেছেন তোমাদের দেখতে। তোমাদের ভিতর যে সবচেয়ে ভালো থাকবে, সবচেয়ে সুইট থাকবে তাকে তারা নিয়ে যাবে। নিজের বাচ্চার মতো আদর করবে, স্কুলে লেখাপড়া করাবে। বুঝেছ?

বাচ্চাগুলো ভয়ে ভয়ে মাথা নাড়ল। আতঙ্ক তাদের বুকের ভেতর ধড়াস ধড়াস করতে থাকে।

নাজনীন হঠাৎ তার মুখটা কঠিন করে বলল, সবাইকে আমি একটা জিনিস সাবধান করে দিই। যদি তারা তোমাদের জিজ্ঞেস করে তোমাদের বাবা-মা কিংবা ভাই-বোন কেউ আছে কি না, তাহলে তোমরা বলবে কেউ নাই। বুঝেছ?

বাচ্চাগুলো খুব ভালো করে বুঝল না, তারপরেও ভয়ে ভয়ে মাথা নাড়ল, বলল, বুঝেছি।

যদি তোমাদের ভেতর কেউ বলে যে তার বাবা-মা কিংবা ভাই বোন আছে আমি তাহলে তাকে খুন করে ফেলব। নাজনীন হুংকার দিয়ে বলল, মনে থাকবে সবার?

বাচ্চাগুলো মাথা নাড়ল। একধরনের ভয়াবহ আতঙ্কে থোকনের বুকের ভেতরটা শুকিয়ে গেল। যে মানুষগুলো তাদের দেখতে আসবে তারা যদি তাকে জিজ্ঞেস করে তাহলে তাকে মিথ্যা বলতে হবে। বলতে হবে বিজলীবু বলে কেউ নাই। তখন যদি তাকে নিয়ে যায় তাহলে সে আর কোনোদিন বিজলীবুকে দেখতে পাবে না। ভয়ে আতঙ্কে খোকন কিছু চিন্তা করতে পারে না।

এই ছেলে, এই– খোকন চমকে উঠল। নাজনীন তার দিকে চোখ লাল করে তাকিয়ে আছে। ভয়ে সে শুকনো মুখে উঠে দাঁড়াল।

মুখটা এরকম পাচার মতো করে রেখেছ কেন? মুখ হাসি হাসি করো।

খোকন মুখ হাসি হাসি করার জন্য প্রাণপণ চেষ্টা করতে থাকে।

নাজনীন ঘর থেকে বের হওয়ার সাথে সাথে সে ধপ করে চেয়ারে বসে পড়ল। তার অনেক কান্না পাচ্ছে। কিন্তু সে এখন কাঁদতে পারবে না। কিছুতেই কাঁদতে পারবে না। তাকে মুখ হাসি হাসি করে থাকতে হবে। যদি তাকে জিজ্ঞেস করে তাহলে তাকে বলতে হবে তার কেউ নাই। বাবা নাই। মা নাই। বোন নাই। বিজলীবুও নাই!

.

মিলি ঘরটার ভেতরে ঢুকতেই তার ঘরের মাঝামাঝি ছয়-সাত বছরের একটা ছেলের সাথে চোখাচোখি হলো। ছেলেটা তার দিকে কেমন জানি অবাক হয়ে তাকিয়ে রইল, মিলিও অবাক হয়ে তার দিকে তাকিয়ে রইল। মিলির মনে হলো এই ছেলেটাকে সে আগে দেখেছে, মনে হলো এই ছেলেটা তার অনেক পরিচিত। হঠাৎ করে মনে হলো এই ছেলেটাকেই সে নিজের পেটে ধরেছিল, মনে হলো সে ছুটে গিয়ে ছেলেটাকে বুকে চেপে ধরে বলে, বাবা আমার! তুই এতদিন কোথায় ছিলি?

কিন্তু সে কিছু করল না, রায়হানের হাত ধরে দাঁড়িয়ে রইল। রায়হান হাসি হাসি মুখে বাচ্চাগুলোর দিকে এগিয়ে যায়। একেবারে সামনে বসে থাকা বাচ্চাটার মাথায় হাত বুলিয়ে বলল, কী নাম তোমার বাবা?

বাচ্চাটি কেমন যেন উত্তেজিত হয়ে বলল, আফজাল! আমার নাম আফজাল। মোহাম্মদ আফজাল হোসেন।

রায়হান হাসি হাসি মুখে বলল, বাহ!

বাচ্চাটি আরো উত্তেজিত হয়ে বলল, আমার বাবা, মা, ভাই বোন কেউ নাই। কেউ নাই। কথাটি শেষ করে সে নাজনীনের দিকে আগ্রহ নিয়ে তাকালো। তাকানোর ভঙ্গি দেখেই বোঝা যায় সে নাজনীনকে বলতে চাইছে যে, সে পরিষ্কার করে বুঝিয়ে দিয়েছে তার বাবা মা নেই।

রায়হান জিব দিয়ে চুক চুক শব্দ করে বলল, আহা রে!

পাশে বসে থাকা আরেকটা ছোট বাচ্চা হাত তুলে বলল, আমারও বাবা মা নাই। ভাই বোন কেউ নাই।

তারা কথা শুনে আরো কয়েকটা ছোট বাচ্চা বলল, আমারও বাবা নাই। মা নাই। বাবা নাই মা নাই।

নাজনীন একটু অপ্রস্তুত হয়ে বলল, হয়েছে হয়েছে। তোমাদের নিজেদের কিছু বলতে হবে না। তোমাদের যেটা জিজ্ঞেস করা হবে শুধু তার উত্তর দাও। ঠিক আছে?

বাচ্চাগুলো সাথে সাথে ভয়ে ভয়ে মাথা নেড়ে সবাই চুপ করে গেল। রায়হান আরো কয়েকটা বাচ্চার কাছে গেল, তাদের সাথে কথা বলল, কারো মাথায় হাত বুলিয়ে দিল, কারো পিঠ চাপড়ে দিল। মিলি রায়হানের পাশে পাশে হেঁটে যেতে থাকল কিন্তু নিজ থেকে কাউকে কিছু জিজ্ঞেস করল না। সে শুধু চোখের কোনা দিয়ে একটু পর পর ঘরের মাঝখানে বসে থাকা ছেলেটিকে দেখতে লাগল। যতবার সে ছেলেটির দিকে তাকিয়েছে অবাক হয়ে দেখেছে ছেলেটিও তার দিকে তাকিয়ে আছে।

রায়হান বেশ কয়েকটা বাচ্চার সাথে কথা বলে মিলির দিকে তাকিয়ে ফিসফিস করে বলল, কী খবর মিলি? তুমি কোনো বাচ্চার সাথে কথা বলবে না?

মিলিও ফিসফিস করে বলল, না।

কেন?

আমি ঠিক করে ফেলেছি।

রায়হান অবাক হয়ে বলল, কী ঠিক করে ফেলেছ?

কে আমার বাচ্চা।

রায়হান অবাক হয়ে বলল, কে তোমার বাচ্চা?

হ্যাঁ।

কোনজন?

দ্বিতীয় সারিতে মাঝখানে বসে থাকা ছেলেটাকে দেখেছ? ছয় সাত বছর বয়স? চেক শার্ট?

হ্যাঁ! দেখেছি।

এইটা আমার ছেলে।

তোমার ছেলে?

হ্যাঁ।

রায়হান অবাক হয়ে বলল, তুমি কিছু জানো না, শোনো না, কোনো খোঁজখবর নাওনি আর সে তোমার ছেলে?

আমার খোঁজখবর নিতে হবে না। আমি এই ছেলেটিকে চাই!

রায়হান কিছুক্ষণ মিলির দিকে তাকিয়ে রইল, তারপর বলল, চলো তাহলে যাই।

যাবার আগে বাচ্চাটার নাম জেনে যাই।

রায়হান বলল, ঠিক আছে। যাও, বাচ্চাটার নাম জিজ্ঞেস করে এসো।

রায়হান একটু দূরে দাঁড়িয়ে রইল, মিলি বাচ্চাগুলোর ভেতর দিয়ে হেঁটে হেঁটে দ্বিতীয় সারির মাঝখানে বসে থাকা বাচ্চাটার কাছে এগিয়ে গেল। কাছে গিয়ে মাথা নিচু করে বাচ্চাটার মাথায় হাত রেখে বলল, তোমার নাম কী সোনা?

বাচ্চাটি কাঁপা গলায় বলল, খোকন।

মিলি আরেকটু ঝুঁকে পড়ল। তারপর নরম গলায় জিজ্ঞেস করল, খোকন তুমি আমার সাথে যাবে?

খোকন মিলির দিকে তাকাল। একটু আগেই তার ভেতরে একধরনের আতঙ্ক ছিল, হঠাৎ করে তার সেই আতঙ্কটি চলে গেছে। এই মহিলাটির চোখ দুটোর দিকে তাকিয়ে মনে হচ্ছে মানুষটি তার অনেক বড় একজন আপনজন। সে মাথা নাড়ল, বলল, যাব।

মিলি খোকনের মাথায় একটা চুমু দিয়ে ফিসফিস করে বলল, ঠিক আছে!

.

মিলি আর রায়হান যাবার আগে নাজনীনকে তাদের পছন্দের বাচ্চাটির কথা বলে গেল। দ্বিতীয় সারির মাঝখানে চেক শার্ট পরে থাকা বাচ্চাটি–যার নাম খোকন।

নাজনীন বলল, অফিসিয়াল কাজকর্ম শেষ করে আগামীকাল তাকে আপনার বাসায় পৌঁছে দেব! আমি নিজেই নিয়ে যাব।

মিলি বলল, থ্যাংক ইউ। থ্যাংক ইউ সো মাচ!

মিলি অবশ্য নিজে গিয়ে পৌঁছে দেবার আসল কারণটা জানত না। যদি জানত তাহলে সে নিশ্চয়ই আতঙ্কে শিউরে উঠত।

পরদিন যখন নাজনীন গাড়িতে করে খোকনকে নিয়ে মিলিদের বাসায় যাচ্ছে তখন সে খোকনকে নিয়ে পেছনে বসল। গাড়ি ছেড়ে দেবার পর সে ফিসফিস করে বলল, খোকন, তুমি জানো আমরা কোথায় যাচ্ছি?

না। কালকে যে একজন মানুষ আর মহিলা এসেছিল মনে আছে?

খোকন মাথা নাড়ল, বলল, মনে আছে।

তাদের কোনো ছেলেমেয়ে নেই। তাই তারা একজনকে নিজের ছেলের মতো বড় করতে চায়। কাল এসে তারা তোমাকে পছন্দ করে গেছে।

খোকন বলল, আর বিজলীবু?

ওরা বিজলীর কথা জানে না। জানলে তোমাকে নিত না।

খোকনের পুরো জগৎটা অন্ধকার হয়ে গেল। কী বলবে বুঝতে পারল না, কোনোমতে বলল, কিন্তু, কিন্তু–

এর মাঝে কোনো কিন্তু নেই। আমরা তোমার জন্যে একটা ফ্যামিলি রেডি করে দিয়েছি। তারা তোমাকে অনেক আদর করে বড় করবে। ঠিক সেরকম বিজলীর জন্যেও একটা ফ্যামিলি রেডি করে দেব। সেই ফ্যামিলিও বিজলীকে অনেক আদর করে বড় করবে।

খোকন ছটফট করে প্রায় হাহাকার করে উঠল, ঝরঝর করে কেঁদে ফেলে বলল, কিন্তু আমি বিজলীবুর সাথে থাকতে চাই।

তুমি তোমার বিজলীবুর সাথে থাকতে পারবে না। মনে করো তোমার বিজলীবু মরে গেছে। সাইক্লোনের রাতে বন্যার পানিতে তোমার বাবা-মা মরে ভেসে গেছে, সেটা তোমার মনে আছে?

খোকন অবাক হয়ে নাজনীনের দিকে তাকিয়ে রইল। নাজনীন বলল, মনে করো তোমার বিজলীবুও মরে ভেসে গেছে। তোমার কেউ নেই। বুঝেছ?

কী বুঝতে হবে খোকন সেটাই বুঝতে পারল না। নাজনীন হাসি হাসি মুখে বলল, তোমার বিজলীবুকেও আমরা কোনো ফ্যামিলির সাথে দিয়ে দেব। তার বিয়ে হবে সংসার হবে, বুঝেছ। তুমি যে রকম হ্যাপি হবে তোমার বিজলীবুও হ্যাপি হবে। তবে–

নাজনীন কথা বন্ধ করে হঠাৎ তার মুখ কঠোর করল। খোকন বিস্ফারিত চোখে নাজনীনের দিকে তাকিয়ে রইল। নাজনীন বলল, তবে তুমি যদি তোমার নতুন ফ্যামিলিকে তোমার বিজলীবুর কথা বলে দাও তাহলে কিন্তু সব শেষ।

শেষ?

হ্যাঁ। তাহলে তোমার বিজলীবুকে খুন করে ফেলব!

খোকন ভয়ে আতঙ্কে পাথর হয়ে গেল। নাজনীন খুবই ঠান্ডা গলায় বলল, কাজেই তোমার বিজলীবু বেঁচে থাকবে নাকি মরে যাবে সেটা নির্ভর করছে তোমার উপর। বুঝেছ?

খোকন মাথা নাড়ল। নাজনীন বলল, তাহলে বুঝেছ তোমাকে কী করতে হবে? মরে গেলেও তুমি তোমার নতুন ফ্যামিলিকে বলবে না যে তোমার একজন বোন আছে। যাকে তুমি বিজলীবু ডাকো। মনে থাকবে?

খোকন শুকনো মুখে মাথা নাড়ল। নাজনীন মুখে হাসি ফুটিয়ে বলল, ভেরি গুড। এই তো, তুমি হচ্ছ আমার গুড বয়। তুমি যদি গুড বয় হয়ে থাকো তাহলে তোমার বিজলীবুও গুড গার্ল হয়ে থাকবে। যদি গুড বয় না থাকো তাহলে তোমার বিজলীবুও গুড গার্ল হয়ে থাকবে না। হয়ে যাবে ডেড গার্ল। বুঝেছ?

খোকন ভালো করে কিছু শুনছিল না, শুনলেও ভালো করে বুঝতে পারছিল না। তার সবকিছু কেমন যেন এলোমেলো হয়ে যেতে থাকে।

নাজনীন খোকনকে নিয়ে যখন মিলি আর রায়হানের বাসায় পৌঁছেছে তখন সন্ধ্যে হয়ে গেছে। কলিংবেল টেপার আগেই মিলি দরজা খুলে দিল। নাজনীন খোকনের হাত ধরে ঘরে ঢুকে মিলির দিকে তাকিয়ে বলল, এই যে আপনার ছেলে।

মিলির বুকের ভেতর জানি কেমন করে উঠল। তার মনে হলো খোকনকে বুকে জড়িয়ে ধরে আদর করে কিন্তু ছোট বাচ্চাটি একেবারে প্রথম দেখাতেই এরকম আদরে হয়তো বিব্রত হয়ে যাবে, তাই সে খোকনের মাথায় হাত বুলিয়েই সন্তুষ্ট থাকল। তার সামনে নিচু হয়ে বসে বলল, খোকন, তুমি তোমার ঘরটা দেখতে চাও?

খোকন কিছু না বুঝে মাথা নাড়ল। মিলি তখন তার হাত ধরে ভেতরে ছোট ঘরটাতে নিয়ে গেল। গত চব্বিশ ঘণ্টা মিলি আর রায়হান মিলে তার ঘরটা সাজিয়েছে। বিছানার উপর রঙিন বেড কভার, কমিক বইয়ের চরিত্র আঁকা কম্বল। মাথার কাছে পড়ার টেবিল, সুন্দর একটা টেবিল ল্যাম্প। ঘরের এমাথা থেকে ওমাথা জুড়ে একটা শেলফ, সেই শেলফে নানা রকম বই। দেয়ালে একটা টেবিল ক্লক, সেখানে একটা বানরের ছবি।

খোকন দরজার সামনে দাঁড়িয়ে অবাক হয়ে ঘরটির দিকে তাকিয়ে রইল। একটু পরে পরে তার বইগুলোর দিকে চোখ পড়ছিল। কত সুন্দর সুন্দর বই, সব তার জন্য? কী আশ্চর্য! খোকনের হঠাৎ করে বিজলীবুর কথা মনে পড়ল।

সে আর কোনোদিন বিজলীবুকে দেখতে পাবে না? কোনোদিন না?

খোকন হঠাৎ ঝরঝর করে কেঁদে ফেলল। মিলি তখন তাকে বুকে জড়িয়ে ধরে বলল, কেন কাঁদছ সোনা? আমরা আছি না? দেখবে তোমার আর কোনো কষ্ট থাকবে না। কোনো কষ্ট থাকবে না।

*

নাজনীন কাওসারের দিকে তাকিয়ে বলল, তুমি এখন গুছিয়ে একটা রিপোর্ট লিখো। চমৎকার একটা কেস স্টাডি হবে।

কাওসার একটু ইতস্তত করে বলল, কী লিখব এই রিপোর্টে?

কেন? লিখবে যারিনা সাইক্লোন থেকে যে ছেলেটি বেঁচে এসেছিল আমরা তাকে শুধু যে আশ্রয় দিয়েছি তা নয়, রেকর্ড সময়ের মাঝে তাকে আমরা এডপশানে দিয়েছি। এখন সে একটা লাভিং ফ্যামিলির সাথে আছে ইত্যাদি ইত্যাদি।

আর তার বোন সম্পর্কে কী লিখব?

সেটা নিয়ে কিছু লিখতে হবে না। যখন সময় হবে তখন লিখবে।

ঠিক তখন বাইরে একটা হইচই-চেঁচামেচির শব্দ শোনা গেল। একটা মেয়ে চিৎকার করছে এবং বেশ কয়েকজন তাকে থামাতে চেষ্টা করছে। নাজনীন ভুরু কুঁচকে বলল, কে চেঁচামেচি করছে?

কাওসার ভালো করে শোনার চেষ্টা করে বলল, মনে হয় বিজলী নামের মেয়েটা।

সে চেঁচামেচি করছে কেন? হোস্টেল থেকে বের হলো কেমন করে? নাজনীন বিরক্ত হয়ে তার কলবেলটা চেপে ধরল, তার আগেই দরজা খুলে ঝড়ের বেগে বিজলী তার ঘরে এসে ঢুকল এবং তার পিছু পিছু কয়েকজন তাকে ধরার জন্যে হাজির হলো।

বিজলীর চুল এলোমেলো, গায়ের কাপড় ছিঁড়ে গেছে, যারা তাকে ধরে থামানোর চেষ্টা করেছে তাদের সাথে ধস্তাধস্তি করে সে ছুটে এসেছে। ঘরে ঢুকেই সে চিৎকার করে বলল, খোকন কই? আমার ভাই খোকন কই?

নাজনীন মুখ শক্ত করে বলল, তুমি এখানে কীভাবে এসেছ? এখন তোমার হোস্টেল থেকে বের হওয়ার কথা না–

যারা তাকে ধরে নিতে এসেছে তাদের একজন বলল, আমরা বলেছি ম্যাডাম। আমাদের কথা শুনে নাই।

বিজলী সামনে কয়েক পা এগিয়ে এসে বলল, খোকন কই? রাতের বেলা খেতে আসে নাই, সকালেও আসে নাই।

নাজনীন কঠিন মুখে বলল, তার যেখানে থাকার কথা সেখানে আছে। তুমি এভাবে চিৎকার করছ কেন?

বিজলী চিৎকার করে বলল, তার কোথায় থাকার কথা?

আমরা বাচ্চাদের এখানে শেল্টার দিই, তারপর কোনো একটা ফ্যামিলির সাথে থাকার ব্যবস্থা করে দিই।

কোন ফ্যামিলি?

কেন? তুমি সেটা জেনে কী করবে?

খোকন আমার ভাই! বলতে গিয়ে বিজলী ঝরঝর করে কেঁদে ফেলল, আমি খোকনরে দেখতে চাই, তারে দেখতে চাই, দেখতে চাই

নাজনীন মাথা নেড়ে বলল, না! তুমি আর তাকে দেখবে না। জেনে রাখো সে খুব ভালো আছে।

নাই! ভালো নাই! বিজলী চিৎকার করে বলল, সে কই আছে। আমারে বলতে হবে। কই আছে খোকন?

নাজনীন একটু হাসির ভঙ্গি করে বলল, তোমাকে বলতে হবে?

হ্যাঁ বলতে হবে।

না বললে তুমি কী করবে?

আমি, আমি– বিজলী কথা শেষ করতে পারল না, হাউ মাউ করে কাঁদতে লাগল।

নাজনীন বলল, সাইক্লোনের সময় তোমার বাবা-মা পানিতে ভেসে গিয়েছিল মনে আছে? ধরে নাও তোমার খোকনও ভেসে গেছে!

বিজলীর মাথাটা কেমন যেন ঘুরে উঠল। তার খোকন পানিতে ভেসে গেছে? মনে হলো হঠাৎ তার মাথার মাঝে রক্ত উঠে গেল। বিজলী কী করছে নিজেই জানে না, হঠাৎ সে পাগলের মতো নাজনীনের দিকে ছুটে এল, তার ধাক্কায় নাজনীনের চেয়ার উল্টে পড়ল। নাজনীন চিৎকার করে ওঠে এবং এর মাঝে বিজলী তার উপর ঝাঁপিয়ে পড়ল, মনে হলো সে বুঝি নাজনীনকে খুন করে ফেলবে।

কাওসার এবং তার পিছু পিছু দুজন গার্ড ছুটে এসে বিজলীকে ধরার চেষ্টা করল। ঝটকা মেরে বিজলী তাদের থেকে নিজেকে মুক্ত করে নেয়। তার মাথার চুল এলোমেলো, চেহারা হিংস্র বাঘিনীর মতো। গার্ড দুজন আবার তাকে ধরে টেনে সরানোর চেষ্টা করে, বিজলী গার্ডের হাতে কামড় দিয়ে নিজেকে ছুটিয়ে নেয়।

নাজনীন কোনোমতে উঠে দাঁড়িয়েছে। তাঁর চোখে-মুখে একধরনের আতঙ্ক। এই ছোট মেয়েটি এরকম বাঘিনীর মতো তাকে আক্রমণ করবে সে জীবনেও কল্পনা করে নাই। নাজনীন তার টেবিলের কোনা ধরে দাঁড়িয়ে চিৎকার করে বলল, ধরো, এই মেয়েটাকে ধরো।

তাকে ধরার জন্যে গার্ডেরা এগিয়ে এল, কিন্তু কেউ তাকে ধরে রাখতে পারল না। বিজলী ঝটকা মেরে আঁচড়ে কামড়ে নিজেকে ছুটিয়ে নেয়, তারপর আবার নাজনীনের দিকে ছুটে গেল।

নাজনীন একটা চিৎকার করে নিজেকে বাঁচানোর জন্যে খোলা দরজা দিয়ে বের হয়ে ছুটতে থাকে, পেছন পেছন বিজলী ছুটে আসে। নাজনীনের দৌড়াদৌড়ি করে অভ্যাস নেই, তারপরও সে করিডোর ধরে ছুটে পালিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করে।

হোস্টেলের অসংখ্য ছেলেমেয়ে জানালা দিয়ে তাকিয়ে দেখল তাদের ভয়ংকর নাজনীন ম্যাডামকে নতুন আসা মেয়েটি ধাওয়া করে নিয়ে যাচ্ছে। তারা দেখল সিঁড়ির গোড়ায় নাজনীন ম্যাডাম হুমড়ি খেয়ে পড়ল এবং নতুন আসা বিজলী নামের ছোটখাটো মেয়েটি তার উপর ঝাঁপিয়ে পড়েছে।

অনেকগুলো গার্ড এসে এবারে বিজলীকে ধরে ফেলল। মোটাসোটা একজন বিজলীর মাথায় একটা ঘুষি মারল এবং তখন বিজলী কেমন যেন টলে উঠে মাটিতে পড়ে গেল, চিৎকার করে বলতে লাগল, খোকন, তুই কই গেলি? খোকন, খোকন–

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *