০৬.
কাল গরমের ছুটি হয়ে যাবে।
আজই শেষ স্কুল ছিল। তারপর লম্বা ছুটি। খুলবে একেবারে জুলাই-এর গোড়ায়। আজকাল ছুটি হবে ভাবতেই আমার ভয় করে। সময়টা ভারী হয়ে থাকে। সময় আর কাটতে চায় না।
আজ আমার আর ক্লাস নেই! শেষ ক্লাস সেরে এসে কতকগুলো হোমওয়ার্কের খাতা দেখার ছিল ইংরিজির, সেগুলো দেখছিলাম টিচার্স রুমে বসে।
বেলা পড়ে এসেছিল, তবুও রোদের তাপ বেশ। স্কুলের মাঠটার দেওয়ালের পাশে পাশে সারি করে বোগোনভেলিয়া লাগানো আছে। মেরী-পামারই বেশি। বিভিন্ন-রঙা ফুলের বিভিন্ন রঙা আভা সেই গরমের বিকেলের রুক্ষ মাঠে একটা বিধুর ছায়া এনেছে। একদল চড়াই ধুলোর মধ্যে, ধুলো উড়িয়ে, ধুলো ছড়িয়ে ওদের ছোটো ছোটো ঠোঁটে কিচকিচ করে কত কী বলছে আর খেলছে।
মালি কালো রাবারের লম্বা পাইপ টেনে এনে মাঠে জল দিচ্ছে। গেটের কাছের বড়ো সোনাঝুরি গাছদুটোর ছায়া ঝুঁকে পড়েছে মাঠের পুব কোনায়।
জানালা দিয়ে বাইরে চেয়ে থাকতে থাকতে আনমনা হয়ে পড়েছিলাম। খাতাগুলো খোলা ছিল সামনে, খোলা পেনটা ধরা ছিল আঙুলে, কিন্তু আমার মন ছিল ঘরের বাইরে; দূরে। মন কোনো বিশেষ জায়গায় ছিল না, ছড়িয়ে ছিল অনেক জায়গায় আলতো হয়ে, উদ্দেশ্যহীন হয়ে।
চমক ভাঙল স্কুলের বেয়ারা রামরতনের গলার স্বরে।
রামরতন বলল, দিদি আপকা কই বাবু বুলা রহা হ্যায়।
আমি চমকে উঠলাম। বললাম, অফিসের বাবু?
ও বলল, না, না, বাইরের বাবু, আপনার সঙ্গে ভেট করতে এসেছে।
কলমটা খোলা থাকায় শুকিয়ে গিয়েছিল। আমি কলম বন্ধ করে রাখলাম, খাতাগুলো মুড়ে রাখলাম।
বুঝতে পারলাম না কে এখানে আসতে পারে আমার সঙ্গে দেখা করার জন্যে বাইরের লোক!
যে দু-বছর জামশেদপুরে এসেছি কখনো কেউ স্কুলে দেখা করতে আসেনি। এখানে রমেন কখনো আসবে না। ও বলে, আমার ভাবতেই খারাপ লাগে যে তোমার সহকর্মীরা আঙুল দেখিয়ে বলবে ওই যে রে নিরুপমা ঘোষের হ্যাজব্যাণ্ড।
তা ছাড়া, রমেনের আমার সঙ্গে কোনো দরকার থাকে না আজকাল; দরকার নেই তো ওর সবরকম খিদে নিবৃত্ত করা ছাড়া আমার আর কোনো প্রয়োজন বা দরকার ওর কাছে নেই এখন আর!
পুরুষ বলতে এখানে আমার হাজব্যাণ্ড রমেন ঘোষ ছাড়া আর তেমন চিনি শুধু সুশান্তকে। সুশান্ত সেদিন আমার প্রতি যেরকম ঠাণ্ডা ব্যাঙের মতো নিরুত্তাপ শীতল ব্যবহার করেছে, তা ছাড়া ও যা দাম্ভিক, ও কখনো আসবে না আমার স্কুলে। আর ও যদি সত্যিই এসে থাকে, ওকে চলে যেতে বলব, দেখা করব না ওর সঙ্গে। কিংবা ও যেমন করেছিল আমার সঙ্গে সেদিন সেরকম করব।
বলব আমার খুব তাড়া আছে!
বলেই, ক্যান্টিন থেকে ওমলেট আর চা আনতে বলব ওর জন্যে। তারপর ও যখন ওগুলো খাবে, ওর সঙ্গে একটাও কথা বলব না, অন্যদিকে চেয়ে বসে থাকব। ওর খাওয়া হলে বলব, এবার আপনি আসুন, কেমন? আমার খুব তাড়া আছে আজ।
সুশান্ত একদিন আমাকে ভীষণ কষ্ট দিয়েছে। সে কষ্ট রমেনের দেওয়া কষ্টের চেয়ে অনেক বেশি। রমেনের দেওয়া কষ্ট, ওর সমস্তরকম স্থূলতা, ওর সমস্ত চরিত্রের ভন্ডামি এসব এখন আমার গা-সওয়া হয়ে গেছে। ওকে আমি এখন শুধু সহ্য করি। ওকে ভলোবাসি না, ওর জন্যে কোনোরকম ফিলিংস নেই আমার। সব কিছু মরে গেছে আমার মনের মধ্যে, যেসব সুগন্ধি ভালোলাগার বীজ আমার বুকের মধ্যে কুসুমিত হয়ে উঠেছিল ওর সঙ্গে আলাপ হওয়ার পর, ওকে সকলের অমতে বিয়ে করার পর; এখন সে-সমস্ত কুসুম শুকিয়ে গেছে। প্রখর তাপে। ওর আত্মসম্মানজ্ঞানহীনতার দারুণ দাবদাহে।
রামরতনকে বললাম, বাবুর কাছ থেকে একটা স্লিপ নিয়ে এসো নাম লিখে। কে বাবু দেখি।
রামরতন চলে গেল।
ও চলে যেতেই আমার হঠাৎ মনে হল কলকাতা থেকে কেউ আসেনি তো? কোনো খারাপ খবর নেই তো? বাবার কথা মনে হলেই খুব দুশ্চিন্তা হয়।
যতক্ষণ না রামরতন ফেরে ততক্ষণ আমি বসে রইলাম।
রামরতন ফিরে এল একটা কার্ড নিয়ে হাতে।
কার্ডটা তুলে নিয়ে দেখি লেখা আছে ইংরিজিতে সুশান্ত বোস। এরিয়া সেলস ইনচার্জ, ইনসাফ এবং ট্রব ইঞ্জিনিয়ারিং কোং অব ইণ্ডিয়া, জামশেদপুর। তারপর ওর ঠিকানা-টিকানা সব দেওয়া আছে।
সুশান্তর নামটা দেখেই আমার বুকের মধ্যেটা খুশিতে চলকে উঠল। কিন্তু পরক্ষণেই মনে পড়ল আমার উচিত নয় ওকে বেশি পাত্তা দেওয়া। ও কী ভেবেছে, আমার কি সুশান্ত ছাড়া আর কেউ নেই যে ও আমার সঙ্গে যেরকম খুশি সেরকম ব্যবহার করবে।
চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়াতেই খেয়াল হল শাড়িটা ক্রাশড হয়ে গেছে। আমি তো জানতাম না আজ সুশান্ত আসবে। যাক এখন আর কিছু করার নেই।
আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে ব্যাগ থেকে চিরুনিটা বের করে চুলটা একটু ঠিক করে নিলাম, মুখে একটু পাউডার পাফটা বুলিয়ে নিলাম আলতো করে, তারপর মাঠ পেরিয়ে বাইরের অফিসের ওয়েটিং হল-এর দিকে এগিয়ে গেলাম!
জানালা দিয়ে দেখতে পেলাম সুশান্ত বসে আছে। একটা সাদা ট্রাউজার, সাদা শার্ট তার ওপরে একটা মেরুনের ওপরে কালো কাজ করা টাই।
সুশান্ত মুখ নীচু করে বসে ছিল।
আমি ঘরে ঢুকতেই উঠে দাঁড়াল। কোনো কথা বলল না।
আমি আশ্চর্য হবার গলায় বললাম, আপনি হঠাৎ এখানে? কী মনে করে?
সুশান্ত হাসবার চেষ্টা করল। বলল, কিছু মনে করে না। এমনিই।
তারপরই বলল, আপনার ছুটি হতে দেরি আছে?
আমি বললাম, কেন বলুন তো?
ও বলল, না, তাহলে একসঙ্গে যেতাম।
সেদিনের সেই প্রচ্ছন্ন অথচ সুগভীর অপমানের কথা আমার মনে ছিল। আমি বললাম, আমার তো যেতে অনেক দেরি হবে।
সুশান্ত হাত দুটো বুকের সামনে আড়াআড়ি করে রেখে আমার দিকে তাকিয়ে বলল, কত দেরি হবে?
আমি বললাম, তা বলতে পারছি না। এক ঘণ্টাও হতে পারে দু-ঘণ্টাও হতে পারে।
সুশান্ত আমার চোখের দিকে একবার তাকাল, তারপর বলল, ওঃ। আচ্ছা ঠিক আছে। আমি তাহলে চলি।
আমি বললাম, আপনি আমাকে কিছু বলতেন?
সুশান্ত বলল, না। তেমন জরুরি কিছু নয়। পরে বললেও চলবে। এখন আসি।
এই বলে সুশান্ত চলে গেল।
সুশান্ত চলে যেতেই আমার সমস্ত মন হাহাকারে ভরে গেল। নিজেকে নিজে খুব বকতে লাগলাম। বলতে লাগলাম, তোমার এই কাঠ-ফাটা জায়গায় সুশান্ত ছাড়া আর কে আছে? ও নিজে যেচে এত দূরে এল অফিস থেকে উলটোদিকে, আর তুমি মিথ্যা গর্বে অভিমানে তাকে তাড়িয়ে দিলে?
আমি ঠিক করলাম, এক্ষুনি স্কুল থেকে বেরিয়ে পড়ে আমি বাড়ি যাব। বাড়ি ফিরে গা-টা ধুয়ে সুশান্তর বাড়ি যাব। আজ বেশ ভাব হয়ে যাবে আবার আমাদের দুজনের। আমি আজ ওকে বলব, ওর কাছে স্বীকার করব যে, আমি কতখানি নির্ভর করে থাকি ওর ওপর। মনে মনে আমি কতখানি নিজের লোক বলে জানি ওকে।
কিন্তু ভয় হল যদি ও তাড়াতাড়ি না ফেরে?
যাই হোক টিচার্স রুমে গিয়ে আমার সেদিন আর খাতা দেখা হল না। তাড়াতাড়ি করে সব কিছু গুছিয়ে নিয়ে আমি ব্যাগটা কাঁধে ঝুলিয়ে বেরিয়ে পড়লাম।
এখন রোদ প্রায় পড়ে এসেছে, তবুও বাস-স্ট্যাণ্ড অবধি হেঁটে যেতে এই বিকেলেও কষ্ট হয়। মাঝে মাঝে মনে হয় রমেন বিয়ের আগে আমাকে যা যা বলেছিল তা যদি সত্যি হত, তো বেশ হত। ও যদি ইতিমধ্যে একটা গাড়ি পেত তাহলে রোদের মধ্যে রোজ আমাকে কষ্ট করে এতখানি যেতে হত না। বিয়ের আগে ও অনেক কথা আমাকে বানিয়ে বানিয়ে বলেছিল বলেই এখন ওর কথাগুলোএমন করে মনে পড়ে বার বার।
স্কুলের গেট থেকে বাইরে বেরিয়েই দেখি সুশান্ত সামনের চায়ের দোকানের বেঞ্চে বসে আছে ত্রিপলের তলায়।
ওই পরিবেশে, ওইরকম ভাঙা ও নড়বড়ে টিনের চেয়ারে সুশান্তর সম্ভান্ত চেহারা ও পোশাক কেমন বেমানান লাগছিল।
ও আমাকে আসতে দেখেই উঠে দাঁড়াল। হাসল। তারপর এগিয়ে এল আমার দিকে। তারপর বলল, বেশিক্ষণ বসিয়ে রাখেননি বলে ধন্যবাদ।
আমি লজ্জা পেয়ে বললাম, আমার দুটো ক্লাস নেওয়ার কথা ছিল, কিন্তু হেডমিস্ট্রেস বললেন যে উনি নিজেই নেবেন।
সুশান্ত আমার চোখের দিকে চেয়ে কথাগুলি রিপিট করল, বলল, তাহলে উনি নিজেই নেবেন?
পরক্ষণেই বলল, মিথ্যা কথা বলতে শিখতে হয়। এরকমভাবে মিথ্যা কথা যারা বলে, তারা সহজেই ধরা পড়ে যায়। তাদের চোখই ধরিয়ে দেয়। কিন্তু মিথ্যা কথা কেন? আমি যদি আপনাকে বিরক্ত করে থাকি এসে, তো বলুন চলে যাচ্ছি।
আমি অন্যদিকে মুখ ঘুরিয়ে হাঁটতে লাগলাম। কথা বললাম না।
সুশান্ত বলল, ওদিকে কোথায় চললেন। আমরা ওদিকে যাব না।
মানে? আমি বললাম।
সুশান্ত বলল, উলটোদিকে চলুন। মোড়ে একটা ট্যাক্সি নিশ্চয়ই পেয়ে যাব। চলুন রিভার্স মিট-এ যাই। আপনি গেছেন কখনো?
না। যাব যাব ভেবেছি। কিন্তু যাওয়া হয়নি। ওরকম জায়গায় একা গিয়ে লাভ কী? একা কি ভালো লাগে?
সুশান্ত হাসল। বলল, আমি কিন্তু প্রায়ই একাই যাই, গিয়ে চুপ করে বসে থাকি। অবশ্য একা থাকতে ভালোবাসি বলেই হয়তো ভালো লাগে।
তাহলে আজকে আমাকে নিয়ে যাচ্ছেন? যদি ভালো না লাগে?
নাও লাগতে পারে। ভালো লাগে কি না তা পরখ করার জন্যেই তো আপনাকে নিয়ে যাওয়া।
মোড় থেকে সুশান্ত একটা ট্যাক্সি নিল। তারপর দেখতে দেখতে ট্যাক্সি জনবহুল জায়গা ছাড়িয়ে নির্জনে এসে পড়ল কিছুক্ষণের মধ্যে।
বড়ো বড়ো শালগাছ-ভরা জায়গাটাতে আমরা এসে পৌঁছোলাম।
সুশান্ত ট্যাক্সিকে দাঁড় করিয়ে রাখল। তারপর আমার পাশে পাশে হেঁটে চলল নদীর দিকে।
সুবর্ণরেখা আর খড়কাই নদী এসে মিশেছে এ জায়গাটাতে। ভারি সুন্দর জায়গা। এখন দু নদীতেই জল নেই বললেই চলে। শুধু মধ্যে দিয়ে তিরতির করে জল বয়ে চলেছে। দু-পাশে গভীর জঙ্গল। সুবর্ণরেখার অন্য পাড়ে জঙ্গলের মধ্যে দু-একটা বাড়ি দেখা যাচ্ছে। গোরুর পাল নিয়ে রাখাল ছেলে জল পেরিয়ে জঙ্গলের গ্রামে ফিরছে।
চতুর্দিকে একটা দারুণ শান্তি। নদীর গেরুয়া বালির ওপরে বড়ো বড়ো গাছের ছায়া লম্বা হয়ে পড়েছে। দূরে নদীর ওপরে স্থানীয় কোনো কলেজের একদল ছেলে গোল হয়ে বসে গল্প করছে, চেঁচিয়ে চেঁচিয়ে গান গাইছে। ওদের এই চেঁচামেচি কিন্তু খারাপ লাগছে না। তাতে জায়গাটার নির্জনতা ও শান্তি যেন আরও বেড়ে গেছে।
সুশান্ত বলল, ভালো লাগছে?
আমি বললাম, খুউব।
বসবেন না? সুশান্ত বলল।
আমি কথা না বলে একটা পাথরের ওপর বসে পড়লাম গাছের ছায়ায়। সুশান্ত আমার সামনে ট্রাউজার পরেই আসনপিড়ি হয়ে বসে পড়ল।
অনেকক্ষণ আমরা কেউই কোনো কথা বললাম না।
সুশান্ত বলল, সেদিন আপনি খুব রেগে গিয়েছিলেন না?
আমি হাসলাম, কথাটাকে উড়িয়ে দিয়ে বললাম, কই না তো? রাগব কেন?
সুশান্ত বলল, কী করব? রাগ করলে করেছেন। আমার সত্যিই তাড়া ছিল সেদিন।
আমি কিছু বললাম না।
হঠাৎ সুশান্ত বলল, একটা গান শোনাবেন?
গান? আমি আকাশ থেকে পড়লাম। আমি যে কোনোদিন গান গাইতে পারতাম সেকথাই যেন আমি ভুলে গিয়েছিলাম। বিয়ের আগে কলেজে ইউনিভার্সিটিতে গাইয়ে বলে আমার রীতিমতো সুনাম ছিল। তবে শুধু রবীন্দ্রসঙ্গীত গাইতাম। তারপর এই আড়াই বছরে রমেন কখনো আমার গান শুনতে চায়নি, একটিও রবীন্দ্রসঙ্গীতের রেকর্ড কেনেনি। আর কিনলেও বা বাজাতাম কী করে? রেকর্ড প্লেয়ার কোথায়?
সুশান্ত আবার বলল, কী? সাধতে হবে বুঝি?
আমি লজ্জা পেলাম, বললাম, কতদিন গাই না, ভুলে গেছি।
ও বলল, ভুলে যাওয়া গানই গান না হয়।
আমি আর কথা না বাড়িয়ে খুব নীচু গলায় গাইলাম,
অশ্রুনদীর সুদূর পাড়ে,
ঘাট দেখা যায় তোমার দ্বারে।
সুশান্ত মন দিয়ে গান শুনল।
তারপর গান শেষ হলে হাততালি দিল, সাধু সাধু বলল না শুধু আমার দিকে তাকিয়ে রইল অনেকক্ষণ।
তারপর বলল, ভারি ভালো লাগল। এমন গলা, গান না গেয়ে আপনি তা নষ্ট করছেন কেন?
কত কিছুই তো নষ্ট হয়ে গেল। শুধু গান বাঁচিয়ে রেখে আর কী হবে?
সুশান্ত আমার দিকে তাকাল পূর্ণ দৃষ্টিতে। বলল, কিছুই নষ্ট হয় না, নিজে নষ্ট না করলে। আপনি নিজে নষ্ট করলে, বলার কিছুই নেই।
প্রথম ‘কিছুই’ কথাটা এমন একটা বিশেষ জোর দিয়ে বলল ও যে, আমার কানে লাগল।
আমি চমকে মুখ তুলে তাকালাম ওর দিকে।
সুশান্ত চোখ নামিয়ে নিল।
সুশান্ত হঠাৎ বলল, রমেনবাবু কেমন আছেন?
আমার মাথায় কে যেন হাতুড়ি মারল। ঠিক এই মুহূর্তে, এই সময়ে, এই পরিবেশে যখন আমার আর সুশান্তর মধ্যে অন্য কেউই নেই, তখন হঠাৎ অন্য একজন লোকের প্রসঙ্গ এখানে টেনে আনার কী প্রয়োজন ছিল জানি না।
অনেকক্ষণ চুপ করে থেকে আমি বললাম, জানি না।
কথাটা বলেই আমার খারাপ লাগল।
আফটার অল রমেন আমার স্বামী, ওর প্রসঙ্গে কোনো অসম্মানসূচক কথা আমার বলা উচিত নয়, বলিওনি কখনো। অন্য কাউকে কখনো বলিনি। কিন্তু সুশান্তর সামনে আমার মিথ্যা ভান করতে ইচ্ছে করল না। কেন জানি না, কিছুদিন থেকেই আমার মনে হচ্ছিল যে, সুশান্তর সঙ্গে সম্পর্কটা আমার ভান করার নয়।
সুশান্ত দূরে তাকিয়েছিল।
আমি বসে বসে ভাবছিলাম যে প্রত্যেক মানুষের জীবনেই দু-একটি সম্পর্ক থাকে যেখানে কোনো বিষয়েই কখনো ভান করতে নেই। ভান বা ভন্ডামি করলে সেই সমস্ত সম্পর্কের শিকড় আলগা হয়ে যায়। এই ভাসমান সতত সঞ্চরমান সম্পর্কভরা পৃথিবীতে যদি অন্তত দু একটি সম্পর্কের মধ্যে কেউ তার মনের শিকড় প্রথিত না রাখে, না রাখে সততায়, তবে তার জীবনময়ই যাযাবরের মতো এ মনে ও মনে ঘুরে বেড়াতে হয় স্থায়ীত্বর মিথ্যা আশায়। আমার মনে হয়, আমার জীবনে সুশান্ত তেমনই একজন লোক, যার সঙ্গে ভান করলে শুধু নিজেকেই ঠকানো হবে।
সুশান্ত আবার বলল, রমেনবাবুর সঙ্গে অনেক দিন দেখা হয় না। ওঁর শরীর ভালো আছে?
আমি এবার বিরক্ত গলায় বললাম, রমেনবাবুর কথা রমেনবাবুই ভালো জানবেন। আপনি গিয়েই তো শুধোলে পারেন। আমাকে বলার মতো কোনো কথাই কি আপনার নেই?
সুশান্ত অবাক চোখে আমার দিকে তাকাল। বলল, আপনার কথা আমি জানি। আমারও রমেনবাবুর প্রতি তেমন কোনো ইন্টারেস্ট নেই। আপনার খবরের জন্যেই রমেনবাবুর খবর নেওয়া। আপনি কি একথা অস্বীকার করেন যে রমেনবাবুর ভালো-মন্দর সঙ্গে আপনার ভালো-মন্দ জড়ানো নেই?
আমি বললাম, না, এখন অবধি অস্বীকার করি না। হয়তো কোনোদিন করব।
এখনও অস্বীকার করেন না বলেই একথা শুধিয়েছিলাম।
যাকগে অন্য কথা বলুন। ও বলল।
আমি বললাম, অন্য কথা নেই। আর কী কথা? সন্ধে হয়ে গেল। চলুন বাড়ি যাই।
সুশান্ত বলল, আর একটু বসুন। আমার খুব খিদে পেয়েছে। আপনারও নিশ্চয়ই পেয়েছে। চলুন ফেরার সময়ে কোয়ালিটিতে কফি খেয়ে যাওয়া যাবে। আপনার কি সত্যিই তাড়া আছে?
আমি বললাম, না। তেমন তাড়া নেই।
মনে মনে বললাম, সুশান্ত তুমি জানো না, তোমার সঙ্গে আমি সারাদিন, সারারাত কাটাতে পারি। তোমার সঙ্গ আমার বড়ো ভালো লাগে। তোমার সঙ্গে আমার আগে কেন দেখা হল না সুশান্ত? তুমি এতদিন কোথায় ছিলে?
সুশান্ত হঠাৎ বলল, আপনার পায়ের পাতাদুটি কী সুন্দর। এমন সুন্দর পা নিয়ে ধুলোর মধ্যে হাঁটা আপনাকে মানায় না।
আমি হাসলাম। বললাম, তাহলে কী করব? উড়ে যাব?
সুশান্তও হাসল। বলল, না, তা নয়, আপনি যদি আমার আপন কেউ হতেন তাহলে আপনার পা আমি মাটিতে পড়তে দিতাম না।
আমি হাসলাম। জানি না সেই হাসিটা কেমন দেখাল। ওকে বললাম, ও প্রসঙ্গ থাক। আমি যখন আপনার আপন কেউ নই তখন আমাকে ধুলো মাড়িয়েই চলতে হবে, কাঁটা পাথর সব কিছুর ওপর দিয়ে। উপায় কী?
সুশান্ত আবার বলল, উপায় আছে কি নেই জানি না। তবে আমার বড়ো খারাপ লাগে। বিশ্বাস করুন, আপনার জন্যে এত খারাপ লাগে যে কী বলব।
আমি বললাম, আমার জন্যে খারাপ লাগার তো কোনো দরকার দেখি না। নিজের দিকে তাকান, নিজের ভালো ভাবুন, দেখবেন আর বাইরের কারও কথা ভেবে নিজের সময় নষ্ট হবে না। সত্যি! আপনার কিন্তু নিজের কথা ভাবার সময় হয়েছে। আপনি যেন কীরকম? নিজের দিকে তাকান না কেন?
তাকাই তো। সবসময়ে তাকাই। নিজের দিকে তাকালে কেবল অন্য একজনকে দেখতে পাই।
আমি চমকে উঠে বললাম, কাকে?
সুশান্ত যেন খুব ভাবনায় পড়েছে, এমনভাবে বলল, তার প্রকৃত স্বরূপ এখনও বুঝে উঠতে পারিনি, তার রূপও নয়। যেই তাকাই ভেতরের দিকে অমনি দেখি কে যেন দৌড়ে গেল হালকা পায়ে বাইরের দিকে। তার অস্তিত্ব দারুণভাবে উপলব্ধি করি, সে যে আছে তা নিশ্চিতভাবে বুঝতে পারি, কিন্তু সে কী এবং কে তা জানতে পারি না।
খুব অস্বস্তিকর অবস্থা, না?
আমি বললাম, হবে। তারপর বললাম, ভালো করে তাকান, তাকে সম্পূর্ণভাবে দেখতে চান তো তাকে নিশ্চয়ই দেখতে পাবেন।
পাব? সুশান্ত বলল।
পরক্ষণেই লাজুক হাসি হেসে বলল, আমারও মনে হয় তাই।
কী মনে হয়? আমি বললাম।
মনে হয় যে একদিন তাকে সমস্ত কুয়াশা ও ধোঁয়ার বাইরে তাকে তার সহজ স্বচ্ছন্দ সম্পূর্ণতায় প্রত্যক্ষ করব।
আমি মুখ নীচু করে বসেছিলাম।
সেই সুবর্ণরেখার পাড়ে, শেষবিকেলের আকাশের সব রং, বনের গায়ের সব পূরবী গন্ধ, রাখাল ছেলের গলার স্বর সমস্ত মিলেমিশে আমার মুখের ভাবনায় আঁকা হয়ে গিয়ে আমার মুখটি একটি প্রসন্ন প্রতিবিম্ব হয়ে উঠল আমার মনের।
সুশান্ত হঠাৎ আমার চিবুকে হাত ছোঁওয়াল।
আমার সারাশরীর, শরীরের সমস্ত অণু-পরমাণু, শরীরের কেন্দ্রবিন্দু, আমার সর্বস্ব সব থর থর করে কেঁপে উঠল সেই আঙুলের আদরের একটু ছোঁওয়ায়।
সুশান্ত বলল, নিজের মনেই, আপনি ভীষণ সুন্দর, আপনার মতো সুন্দর কিছু আমি কখনো দেখিনি।
তারপরই বলল, আপনি এত সুন্দর কেন?
আমি বাচ্চা মেয়ের মতো রাঙিয়ে গেলাম লজ্জায়।
আজ অবধি একথা আমাকে অনেক পুরুষ বলেছে। রমেন বলেছে বহুবার বিয়ের আগে। কিন্তু কেউ এমন করে বলেনি। হঠাৎ আমার মনে হল সুশান্তর মতো এত সুন্দর করে আমার সৌন্দর্যের কথা কেউ কখনো বলেনি। আমার সৌন্দর্য যদি সত্যিই কিছু থেকে থাকে তাহলে সেই সৌন্দর্যর এই প্রশস্তি তার চেয়েও সুন্দর।
আমি হাসছিলাম, আইসক্রিম-খাওয়া বাচ্চা মেয়ের মতো আমি খুশিতে হাসছিলাম; এত খুশি আমি বহুদিন হইনি।
আমি হাসি থামিয়ে বললাম, সুন্দরী মেয়েরা কিন্তু পাজি হয়।
সুশান্ত বলল, জানি না, জানতে চাই না। বলেই সুশান্ত হঠাৎ আমার কোলে মাথা রেখে পা ছড়িয়ে শুয়ে পড়ল।
আমি লজ্জিত হলাম, কিন্তু ভীষণ ভালোও লাগল আমার।
বললাম, এই, কেউ দেখে ফেলবে। কী হচ্ছে?
সুশান্ত বলল, দেখুক না; ওরা দেখুক এসে। দেখে হিংসেয় মরুক।
তারপরই সুশান্ত বলল, জানো আজ অফিসে ভীষণ ঝগড়া করে এসেছি। মনটা বড়ো খারাপ ছিল, কী যে খারাপ, তোমাকে তা বোঝাতে পারব না নিরুপমা।
অফিস থেকে বেরিয়ে কেবলই তোমার কথা মনে হতে লাগল। মনে হল তোমার কোলে মাথা দিয়ে একবার শুলে আমার সমস্ত মন খারাপ চলে যাবে। তাই তুমি কী ভাববে কেয়ার না করে তোমার কাছে দৌড়ে চলে এলাম। তুমি যে নিরুপমা। এল? অন্যায় করেছি?
আমি ওর কপালে হাত রেখে বললাম, না। অন্যায় করেননি।
ও আমার কোলে মাথা দিয়ে শুয়েছিল। আমার কী যে ভালো লাগছিল কী বলব? ওর চরিত্রের মধ্যে রমেনের মতো কোনো ভিক্ষা চাওয়ার ব্যাপার ছিল না। ওর মধ্যে দারুণ একটা আত্মবিশ্বাস ছিল। যাকে ওর নিজের বলে মনে মনে ও মনস্থ করেছে, তা যে নিঃসন্দেহে ওর নিজেরই এই ব্যাপারে ওর মনে কোনো সংশয় ছিল না। আর যা ওরই একান্ত, তাকে নিয়ে ফুরিয়ে যাচ্ছে ফুরিয়ে যাচ্ছে আদেখলেপনাও ছিল না কোনোরকম। ওর কথাই আমার সমস্ত শরীরে যা সুখের হিল্লোল তুলেছিল, আমার মনে যা রাশ রাশ পুঁটিলেখা ফুটিয়ে তুলছিল, জানি না ওর পরশ আমার মধ্যে কোন গভীর আনন্দের ঝড় তুলবে। সে আনন্দের ভার কি আমি সইতে পারব?
সুশান্ত বলল, তুমি আমাকে আপনি বলছ কেন? পালাবার পথ খোলা রাখতে চাও বুঝি? ইচ্ছে করলেই বাতিল করে পালাবে বলে দূরে রাখছ?
আমি হাসলাম। বললাম, মোটেই না।
ও বলল, তবে?
সবাইকে আপনি বলা যায় না। আপনি আমার চেয়ে সবদিক দিয়ে বড়ো। আপনার মতো কাউকে তুমি বলতে আমার ভালো লাগে না।
সুশান্ত একলাফে উঠে বসল। বসেই অবাক হয়ে বলল, আমার মধ্যে গুণের কী দেখলে তুমি? আমি তোমার পায়ের নখের যোগ্য নয়।
আমি বললাম, সেটা আমি বুঝব। আপনি বললে আপনি অখুশি হবেন?
সুশান্ত হাসল। খুব জোরে জোরে হাসল। বলল, আমি এখন দারুণ খুশি। এত খুশি আমি ছোটোবেলা থেকে কখনো হইনি। তুমি যাই-ই করো, যাই-ই এল; আমি অখুশি হব না। কখনো হব না! তুমি দেখো।
তারপর আবার সুশান্ত আমার কোলে শুয়ে পড়ল। শুয়ে পড়েই দু-হাত দিয়ে আমার মুখটা ওর মুখের কাছে নামিয়ে আনল। কিন্তু ঠোঁটে চুমু খেল না। প্রথমে ও আমার দু-চোখে আলতোভাবে চুমু খেতে লাগল।
আমি হাসতে হাসতে বললাম, ও কী? অন্ধ হয়ে যাব যে।
সুশান্ত বলল, অন্ধ হবে না, তোমার দিব্যদৃষ্টি হবে; তুমি আমাকে আমার সত্যিকারের আমার চেয়ে অনেক বেশি সুন্দর দেখবে।
তারপর সুশান্ত উঠে বসে আমার চোখে মুখে বুকে হাজার চুমু খেল।
একটু বিরাম দিয়ে সুশান্ত ওর দু-হাতের তেলোর মধ্যে আমার মুখ ধরল, বলল, আমি আজকে ঔরঙ্গজেব হয়ে গেলাম। ভাবছি, ট্যাক্সি-ড্রাইভারকে আজ একটা জায়গির দিয়ে দেব।
তারপরই বলল, তোমার কিছু চাই নিরুপমা? জাহাঁপনার কাছে তুমি কিছু চাইবে না?
আমি হাসছিলাম। আমি যেন কেমন হয়ে গিয়েছিলাম। সম্পূর্ণ আত্মবিস্মৃত। সুশান্তর মধ্যে যেন কী একটা ছিল–কোনো জাদুকরের জাদুর মতো, অজগরের চাউনির মতো, কিন্তু তাতে কোনো ভয় ছিল না। শুধু আকর্ষণ ছিল।
সুশান্ত আবার বলল, বল না? তোমার কিছু চাই না?
আমি খুব হাসতে হাসতে কাঁপতে কাঁপতে বলেছিলাম, জাহাঁপনাকে চাই।
সুশান্ত আমার ডান হাতটা ওর ঠোঁটের কাছে তুলে নিয়ে চুমু খেয়ে বলেছিল, আমি তোমার! আমি চিরদিনের তোমার।
.
০৭.
ছি: ছিঃ এ আমি কী করলাম, কেমন করে করলাম?
ভালো হক, খারাপ হোক, রমেন আমার স্বামী। এখনও সে আমার স্বামী। আমি তার বিবাহিতা স্ত্রী। স্বামী থাকতেও অন্য পুরুষের সঙ্গে এরকম সম্পর্ক যে রাখে তাকে কি কেউ ভালো বলে? লোকে জানতে পারলে কী বলবে?
ফেরার সময়ে ট্যাক্সিতে বসে আমি নিজেকে নিজে অভিশাপ দিচ্ছিলাম।
সুশান্ত আমার হাতটা ওর হাতে নিয়ে চুপ করে বসেছিল। কোনো কথা বলছিল না।
দেখে মনে হচ্ছিল ও আনন্দের ভারে ক্লান্ত হয়ে গেছে।
আমি হঠাৎ বললাম, আজ আর বিষ্টুপুর যাব না বুঝলেন? দেরি হয়ে গেছে এমনিতেই। ও হয়তো অফিস থেকে ফিরে আমার জন্যে অপেক্ষা করবে। অন্য একদিন যাব এখন, কেমন? না কি আপনি রাগ করলেন?
সুশান্ত চশমার আড়ালের গভীর কালো চোখ দুটি তুলে তাকাল আমার দিকে। বলল, ঠিক আছে। তুমি যেমন বলবে।
সুশান্তকে এখন দেখে ভাবাই যাচ্ছিল না যে একটু আগেই ও প্রগলভ হয়ে গিয়েছিল, অত কথা বলছিল, আমাকে অমন পাগলের মতো আদর করছিল। এখন দেখে মনে হচ্ছে ও নিউক্লিয়ার ফিজিকস-এর প্রফেসর বুঝি, এক্ষুণি কোনো তত্ত্ব নিয়ে পড়বে।
সুশান্তর এই চেহারাটাই আমার ভালো লাগে। ওর গাম্ভীর্য ওর সম্ভ্রান্ত ঋজু চেহারা, ওর গলার স্বর এসব মিলিয়ে মনে হয় এরকম কোনো ছেলে যে-কোনো মেয়ের দায়িত্ব নিতে পারে সারাজীবনের। এরকম কারও ওপর নির্ভর করলে শুধু নিজে সুখী ও নিশ্চিত হওয়াই যায় না, নিজে সম্মানিতও হওয়া যায়। মাথা উঁচু করে দশজনকে বলা যায় যে, এই যে, ইনি আমার স্বামী। যেদিন রমেনের সঙ্গে ওর কারখানায় গিয়েছিলাম, সেদিনের কথা আমার বারে বারেই মনে হয়, মন পড়ে যায়। সেদিন সত্যিই লজ্জা করছিল আমার। আমার স্বামী যদি গরিব হত তাতে আমার কোনো লজ্জা ছিল না। আমি অমন চালিয়াত পরিবারে মানুষ হইনি। আমরা নিজেরাও কিছু বড়োলোক ছিলাম না কখনো; কিন্তু চিরদিনরই সম্ভ্রান্ত ছিলাম। টাকা ছিল না; কিন্তু সম্মান ছিল; সতোর সরলতার পরিচয় ছিল। নিজের অসম্পূর্ণতার জন্যে যদি কোনো অপমানের সম্মুখীন হতে হয়, সে অপমান আমি হাসিমুখে সইতে রাজি ছিলাম। কিন্তু অন্য একজনের কৃত ও অকৃত কর্মের সমস্ত দায়িত্ব আমি যেহেতু তাকে একদিন বিয়ে করেছিলাম তাই আমার ওপর বর্তাবে একথা ভাবতেই আমার খারাপ লাগছিল। সবসময়ে খারাপ লাগত।
সেদিন শেফালি যেভাবে আমাকে ম্যানেজিং ডিরেক্টরের কাছে যাবার জন্যে বলছিল তাতে আমার রীতিমত অপমান লেগেছিল। রমেনও যদি ওই কোম্পানির একজন ডিরেক্টর কি নিদেনপক্ষে একজন কেউ-কেটা হতো তাহলে কি ওরা আমাকে অমন করে তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করতে পারত?
কিন্তু কোনো উপায় ছিল না। সেখানে নিরুপমা চৌধুরি কেউ নয়, সেখানে সে গিয়েছিল রমেন ঘোষের স্ত্রী হিসেবে। মিসেস রমেন ঘোষ হিসেবে। ইশ রমেন যদি ও যেমন, তেমন না হত! ও যদি এমন করে আমাকে এ জীবনে না ঠকাত!
হঠাৎ সুশান্ত বলল, তুমি বলেছিলে না গরমের ছুটিতে কলকাতায় যাবে বাবার কাছে? কবে যাবে?
বললাম, যাব তো নিশ্চয়ই। তবে দেখি কবে যাই। যাওয়াটা তো সমস্যা নয়। যে কোনোদিন সকালের স্টিল এক্সপ্রেসে চেপে বসলেই হল।
সুশান্ত বলল, তা ঠিক।
তারপর অনেকক্ষণ চুপ করে থাকার পর বলল, তোমার কাছে আজ না গেলেই ভালো হত।
কেন? ওকথা বলছেন কেন? আমি শুধোলাম।
না। তুমি চলে গেলে খুব খারাপ লাগবে। তোমার সঙ্গে আজ যে ঘনিষ্ঠতা হল তা না হলেও খারাপ লাগত, তবে এখন আরও বেশি খারাপ লাগবে। জানি না তুমি লক্ষ করেছ কি, আমার কোনো বন্ধু-বান্ধব নেই। চিরদিনই আমি একলা। তার প্রধান কারণ আমার পছন্দ অপছন্দটা বড়ো বেশি, রুচিজ্ঞানটাও বড়ো বাড়াবাড়িরকমের তীব্র। আমার যাকে তাকে মোটে পছন্দ হয় না। বলার মতো কোনো কথা না থাকলেও ঘণ্টার পর ঘণ্টা আজে-বাজে আলোচনা করে সময় নষ্ট করাকে ক্রিমিনাল অফেন্স বলে মনে হয় আমার। তার চেয়ে নিজের ঘরে বসে পড়াশুনো করা অনেক ভালো। বান্ধবীর বেলাতেও তাই। তুমি নিশ্চয়ই লক্ষ করেছ যে আমার একজনও বান্ধবী নেই। কেন জানি না তোমাকে প্রথম দিন দেখার পর থেকেই এত কষ্ট পেয়েছি। কত যে কষ্ট পেয়েছি তা তুমি কখনো জানতেও পারবে না।
আজ যে তোমার স্কুলে গিয়ে পৌঁছেছিলাম সে কি এমনি এমনি? অফিসের ব্যাপারে মন খারাপ করে তোমার কথা মনে হল প্রথম। আজ ভেবেই গিয়েছিলাম, তোমাকে খোলাখুলিভাবে কিছু বলব। ভেবেছিলাম, এভাবে কেউ বাঁচতে পারে না।
আমি বললাম, আপনার ভয় করে না, বিবাহিতা মেয়েকে ভালোবাসতে? আপনি জানেন, রমেন আপনাকে জড়িয়ে ফেললে তার পরিণাম কী হবে?
কীসের পরিণাম?
দুর্নাম। লোকসমাজের কাছে ছিঃ ছিঃ, তারপর হয়তো অর্থদন্ড। জেলও তো হতে পারে।
তা পারে, সবই হতে পারে।
তবে? সব জেনেশুনে আপনি কেন এমন করছেন?
কী করব এল? আমি যে তোমাকে ভালোবেসে ফেলেছি। এর পরে তো আমার আর করণীয় কিছুই নেই। ভালোবাসার ভান করিনি। সত্যিসত্যি ভালোবেসে ফেলেছি। এর জন্যে যদি শাস্তি কিছু পেতে হয়, এটা যদি দোষ বলে গণ্য হয়, তবে শাস্তি পাব। ওসব শাস্তিকে ভয় করি না। একমাত্র ভয় অন্য শাস্তিকে।
কোন শাস্তি? আমি শুধোলাম।
সুশান্ত বলল, তোমার কাছে শাস্তি। যাকে ভালোবেসে এত কষ্ট, সে যদি সে ভালোবাসা গ্রহণ না করে, তার চেয়ে শাস্তি আর কিছু নেই।
আমি বললাম, একথা সত্যি যে আপনি আমার জন্যে অনেক কষ্ট পেয়েছেন? আশ্চর্য! আগে বলেননি কেন? কেন বলেননি?
কী বলব? বলে সুশান্ত হাসল।
আমি বললাম, বলতেন; যা বলার।
সুশান্ত আবার হাসল। বলল, আমি কখনো তোমাকে এসে বলতে পারতাম না যে, আমি তোমাকে ভালোবাসি। জীবনটা তো যাত্রা নয়। একথা আজ বলা চলে কিন্তু সেই প্রথম প্রথম দিনে যেত না। তা ছাড়া, ভালোবাসা কি কেউ কখনো মুখে বলে বোঝাতে পারে? আর একজনের প্রতি অন্য জনের মনোভাব, তার জন্য কনসিডারেশান, তার জন্যে কিছু করা, তার পাশে দাঁড়ানো, তার বিপদে ঝাঁপিয়ে গিয়ে পড়া, তার জন্যে সব সময়ে ফিল করা এই তো ভালোবাসা। এ যে করে, সে ভালো নিশ্চয়ই বাসে। একথা মুখে বলে কী লাভ হত এল? বরং জোলো লাগত পুরো ব্যাপারটাই। তা ছাড়া আমরা কেউ কলেজের ছাত্র নই যে অমন নাটক করতে পারতাম ভালোবাসা নিয়ে।
দেখতে দেখতে বাড়ি এসে গেল।
সুশান্তর বাড়ির সামনেই ট্যাক্সি ছেড়ে দিলাম।
সুশান্ত নামার সময়ে আমার হাতে একটু চাপ দিয়ে নামল। বলল, যখনই একা লাগবে, মন খারাপ লাগবে চলে এসো। এরকম নিরাপদ ব্যাচেলারের বাড়ি ভূ-ভারতে নেই। বিপদ যদি কখনো ঘটে, তুমি চাও বলেই ঘটবে। অন্য পক্ষের ইচ্ছায় কখনোই তা ঘটবে না। এইটুকু কথা তোমাকে দিতে পারি। তুমি যদি আমার সামনে বসে থাকো, তোমাকে যদি আশ মিটিয়ে দেখতে পারি তাহলেই আমার ভারি আনন্দ হবে। বুঝেছ? বেশি চাই না।
আমি বললাম, বুঝেছি।
ট্যাক্সি থেকে নেমে আমি বাড়ির দিকে হেঁটে চললাম।
আমার ভারি ভালো লাগছিল সেই সন্ধেবেলায়। মনে হচ্ছিল আমি যেন কোনো ফাস্ট ইয়ারে পড়া মেয়ে হয়ে গিয়েছি। সমস্ত শরীর পাখির মতো হালকা, মন জুই ফুলের মতো সাদা।
একসময়ে আমি যেন উড়ে গিয়ে পৌঁছোলাম বাড়ির দরজায়।
আশ্চর্য। রমেন আজ এখনও আসেনি!
মুখী এসে দরজা খুলল। হাতের ব্যাগটা বিছানায় ছুঁড়ে ফেলে অনেকক্ষণ অন্ধকার ঘরে শুয়ে থাকলাম।
মুখী এসে বলল, দিদিমণি, চা-জলখাবার খাবেন না?
আমি বললাম, তুই খেয়ে নে।
সুশান্তর সঙ্গে একঘণ্টা কাটিয়ে আমি আনন্দে বিবশ হয়ে গিয়েছিলাম। আমার সমস্ত শরীর আনন্দের ভারে ভারী বলে মনে হচ্ছিল। রমেন আমাকে একঘণ্টা ধরে নগ্নাবস্থায় আদর করলেও সে ভালোলাগার ক্লান্তি এমন আশ্চর্য সুখময় হত না।
আনন্দে আমার চোখ বেয়ে জল গড়াতে লাগল। বালিশে মুখ গুঁজে আমি বিড় বিড় করে বললাম, সুশান্ত তুমি ভারি ভালো। সুশান্ত তুমি ভীষণ ভালো।
আমি বোধহয় ওইভাবেই ঘুমিয়ে পড়েছিলাম।
কলিংবেলটা অনেকক্ষণ ধরে বাজছিল। ঘুম ভেঙে ধড়মড়িয়ে উঠে দৌড়ে গিয়ে দরজা খুলতেই দেখি, পুলিশ।
পুলিশের দারোগা হিন্দিতে বললেন, এটা রমেন ঘোষের বাড়ি?
আমি বললাম, হ্যাঁ! কী ব্যাপার?
উনি বললেন, রমেনকে এক জুয়ার আড্ডায় গ্রেপ্তার করা হয়েছে। কাল কাঠগড়ায় ওঠানো হবে, উকিল মোক্তারের বন্দোবস্ত যেন করি।
আমি ওদের একটু বসতে বলে মুখীকে দিয়ে সুশান্তকে ডেকে পাঠালাম।
সুশান্ত একটা বাড়িতে-কাচা পায়জামা-পাঞ্জাবি ও রাবারের চটি পরে এসে সব শুনল, তারপর কাগজে লিখে নিল।
আমি চুপ করে সোফায় বসেছিলাম।
দারোগাবাবু অসভ্যর মতো আমার দিকে বার বার তাকাচ্ছিলেন।
সুশান্ত বলল, থ্যাঙ্ক ইউ। এবার আপনারা আসতে পারেন। কাল কোর্টে আমরা জামিনের ব্যবস্থা করব।
দারোগাবাবু উঠে দাঁড়ালেন। তারপর সাঙ্গোপাঙ্গ নিয়ে চলে গেলেন। আমার বুক ফেটে কান্না আসছিল। রমেন যে আমার স্বামী–1 সুশান্তর কাছে সে এমনভাবে রোজ রোজ ছোটো না হয়ে গেলে আমার পক্ষে তাকে আবার সম্মান করা সম্ভব হত; সুশান্তও হয়তো খুশি হত। সুশান্ত আমাকে ভালোবাসুক আর না বাসুক এখন ও-ই তো আমার একমাত্র বল-ভরসা। একজন অসহায়া অবলা মেয়েকে লোকে যেমন করে দয়া করে, আমাকে ও বুঝি, তেমনি করে দয়া করে ভালোবেসেছে; কৃপা করেছে।
লজ্জায় অপমানে আমার মাথা কাটা যেতে লাগল। চোখ দিয়ে ঝরঝর করে জল পড়তে লাগল।
সুশান্ত মুখীকে বলল, মুখী তুমি আজ রাতে দিদিমণির কাছে থেকো। তোমার বরকে বোলো বাইরের ঘরে শুয়ে থাকতে।
তারপর আমার দিকে ফিরে বলল, এখনও চান খাওয়া কিছু হয়নি? কখন হবে?
মুখী ঘর থেকে চলে গেলে সুশান্ত আমার কাছে এসে বলল, কী করবে বল? কোনো চিন্তা কোরো না। ভালো করে চান করো তো। চান করে ঘুমোও। কাল আমি রমেনবাবুকে ছাড়িয়ে আনব। কোনো ভাবনা নেই।
আমার গলা বন্ধ হয়ে আসছিল, আমি বললাম, আমাকে কি কাল কাঠগড়ায় দাঁড়াতে হবে?
সুশান্ত আমার মাথায় হাত রাখল। বলল, পাগলি! তোমায় কেন দাঁড়াতে হবে? তোমার কিছুই করতে হবে না। তুমি যেমন স্কুল যাও, যাবে। ভালো করে খেয়ে-দেয়ে যেয়ো। না খেয়ে যেয়োনা যেন, এই গরমে লু লেগে যাবে। তারপর বলল, রমেনবাবুর জন্যে যা ব্যবস্থা করার তা আমি করব। ওঁর কারখানাতেও তো একবার জানাতে হবে।
আমি বললাম, আমি ফোন করে দেব স্কুল থেকে।
সুশান্ত বলল, তাই দিয়ে, কিন্তু অত বিস্তারিত বোলো না। শুধু বোলো যে ও অফিস যাবে না।
তারপর বলল, কোনো চিন্তা নেই, তুমি স্কুল থেকে ফিরে দুপুরের খাওয়ার সময়ে তোমার বরকে দেখতে পাবে। হল তো। তারপর বলল, একবার হাসো তো দেখি?
রমেনের জন্যে লজ্জা, অপমান এবং সুশান্তর জন্যে ভালোলাগা সব মিলিয়ে এক অদ্ভুত হাসি ফুটে উঠল আমার মুখে।
আমার মাথায় আর একবার হাত রেখে সুশান্ত বলল, দরজাটা বন্ধ করে দিয়ে এবার চান করে খেয়ে নাও। লক্ষ্মী সোনা মেয়ে। যদি আমার কথা না শোনো, তাহলে খুব বকব কিন্তু।
সুশান্ত চলে গেলে দরজা বন্ধ করে বন্ধ-দরজায় মুখ রেখেই আমি অনেকক্ষণ ঝর ঝর করে কাঁদলাম।
আমার নড়তে ইচ্ছা করছিল না।
আমার স্বামী আমাকে আর কোন কোন অসম্মানের সম্মুখীন করাবে জানি না।
রমেনের ওপর রাগে আমার গা জ্বলে যাচ্ছিল।
আর সেই সঙ্গে আমার মন বার বার বলছিল যে অনেক অনেকদিন কেউ আমাকে এমন করে আদরে, বকে, ভয় দেখিয়ে নাইতে-খেতে বলেনি। মারা যাবার পর কেউই বলেনি।
সুশান্ত! তুমি আমার মরে-যাওয়া মা?
সেদিন রাতে আমি সিরিয়াসলি ভাবছিলাম যে, রমেন সম্বন্ধে কী করা যায়।
কিছুদিন আগে ফ্যাক্টরিতে মদ খেয়ে মাতলামি করে মারধোর খেয়ে এল। আজ জুয়াড়িদের সঙ্গে প্রেপ্তার হল, কাল কী করবে তা ও-ই জানে। আমার আর ওর সঙ্গে একমুহূর্তও থাকতে ইচ্ছে করে না। গা ঘিনঘিন করে; ঘেন্নাও করে।
অথচ ও যখন অসহায়ের মতো ঘুমিয়ে থাকে, ওর কপালের পাশে চুলগুলো লেপটে থাকে, মাঝে মাঝে ঘুমের মধ্যে শিশুর মতো আমার কোমরে বুকে হাত তুলে দেয়, তখন ওকে দেখে মায়া হয়।
এ আমার কপালের দোষ যে, আমি অত সহজে ঠকেছিলাম।
ও আমাকে প্রথম থেকে শেষ অবধি ঠকাবে বলেই মনস্থির করেছিল। ওর মতো মেরুদন্ডহীন, পরনির্ভর অপদার্থ অথচ চালিয়াত ছেলেদের যে কোনো বিবেক বা কর্তব্যজ্ঞান বা আন্তরিকতা থাকে না, তা আমি জানতাম না। ও আন্তরিকভাবে আমাকে ঠকিয়েছিল, জেনেশুনে ও আমার সর্বনাশ করেছিল নিছক আমার শরীরটা চিরদিনের মতো পাওয়ার আশায়।
আমি হয়তো ওর জুয়াখেলার নতুন কোনো পণ ছিলাম। যেমন করে তোক, মিথ্যা কথা বলে, প্রবঞ্চনা করে ও আমাকে জিততে চেয়েছিল। জিততে চেয়েছিল, যেন-তেন-প্রকারেণ।
কিন্তু আমি তো আন্তরিকই ছিলাম। ও যতখানি আন্তরিকতার সঙ্গে আমার সঙ্গে অভিনয় করেছিল, আমি তার চেয়েও বেশি আন্তরিকতার সঙ্গে ওকে ভালোবেসেছিলাম।
আমার মতো মেয়ে সহজে কাউকে ভালোবাসে না, ভালোবাসতে পারে না; কিন্তু একবার ভালোবেসে ফেললে বহমান ভালোবাসাকে গুটিয়ে ফেলার কোনো ক্ষমতাই যে আমার মধ্যে নেই। আমার পরিণতি, আমার সমস্ত জীবন, সমস্ত ভবিষ্যৎ কি সত্যি সত্যিই রমেনের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে গেছে? আমি কি সে বাঁধন ছিঁড়তে পারি না? সত্যিই কি পারি না?
বাঁধন হয়তো ছিঁড়তে পারি। আইনের পাতায় যেসব প্রতিবিধানের কথা লেখা আছে, সেসব কথা খুব সহজে বলা আছে। করলে খুবই সহজ। কিন্তু যে-কথা আইনের বইয়ে লেখা নেই, লেখা থাকে না, তেমন অনেক কথাও তো আছে?
এই সবে আড়াই বছর হল বিয়ে হয়েছে আমার। কত গর্ব, মায়ের সঙ্গে এ নিয়ে কত ঝগড়া, বন্ধুদের সঙ্গে কত মজা, বিয়ের দিন রানির মতো সেজে সিংহাসনে বসা সবই কি এত তাড়াতাড়ি ভুলে যাব? সেদিন বাড়িসুষ্টু লোকের মতের ওপর আমার মতের জয় হয়েছিল। সেদিন সিংহাসনে বসে আমি নিজেকে সত্যিই এক দারুণ প্রতাপশালিনী কোনো রানি বলে ভেবেছিলাম–ভেবেছিলাম মুখ-নীচু করা দিদিরা, মা এবং অন্যান্য কাছের লোকেরা আমার কাছে কী নিদারুণভাবে হেরে গেল। আমার মতের কাছে, আমার জেদের কাছে।
সেদিন যে বড়ো গর্বভরে সকলের সঙ্গে ঝগড়া করেছিলাম। নিজেকে বলেছিলাম যে, বাড়িসুষ্ঠু সকলে একদিন জানবে, বুঝবে যে আমার বুদ্ধি সকলের চেয়ে বেশি। বলেছিলাম, রমেনের মতো স্মার্ট ছেলে জীবনে খুব উন্নতি করবে। ভেবেছিলাম বেচারা আমাকে বড়ো ভালোবাসে–আমাকে পেলে ও জীবনে সম্পূর্ণ হবে, নিজে অনেক বড়ো হবে। আমার এই গর্ব, আমার এই অল্পবয়েসি মেয়ের শরীর ও মনের, আমার আত্মত্যাগের, ওকে বিয়ে করতে গিয়ে আমার যে লড়াই করতে হল সকলের সঙ্গে এ সব কিছুর যোগ্য সম্মান দেবে ভেবেছিলাম, রমেন; আমাকে!
ভেবেছিলাম ও আমার মুখ রাখবে। ও যে এমন করে আমাকে ধুলোয় ফেলবে কখনো ভাবিনি।
কিন্তু কিছুই তো হল না।
হল না, তবুও আজ আমি একা একা বাড়ি ফিরব কী করে? একা বাড়ি ফিরে আমি কাউকে বলতে পারব না। বলতে পারব না যে বাবা, আমাকে ঠকিয়েছে একটা ঠগ, বাবা আমি একজন অকর্মণ্য কুড়ে, জুয়াড়ি মাতালের পাল্লায় পড়েছিলাম। আমি আমার সব খুইয়ে, আমার সুন্দর মনের মধ্যে যা ছিল, আমার নরম প্রথম যৌবনের সুগন্ধি শরীরে যা ছিল, তোমার ব্যাঙ্কে, তোমার সিন্দুকে যা ছিল, দাদাদের যা ছিল, সব খুইয়ে আমি আবার তোমাদের কাছেই ফিরে এসেছি।
কখনো, কখনো, কোনোদিনও বলতে পারব না, বাবা! রমেন ভালো নয়। বাবা, রমেনের কোনো ভবিষ্যৎ নেই। বাবা, রমেন একজন মানুষ হিসেবেও মানুষ নয়, পুরুষের কোনো গুণ নেই ওর মধ্যে।
না, না, না। তা আমি বলতে পারব না। ফিরে যেতে পারব না আমি। তার চেয়ে এই নরকও আমার ভালো। আরও দেখব। অনেক তো দেখলাম, আরও দেখব। এক এক করে আমার সমস্ত মিষ্টি-দুষ্টু ইচ্ছেগুলো হালকা বেগুনি কোনো চন্দ্রমল্লিকা ফুলের পাপড়ির মতো ছিঁড়ে ছিঁড়ে ফেলব।
আমার জীবন এখন মরুভূমি হয়ে গেছে। সেখানে শুধুই গরম, তৃষ্ণা, শুধুই কাঁটাঝোঁপ; বেদুইন ডাকাত। সেখানে ছায়া নেই, শান্তি নেই; স্বস্তি নেই।
তবুও এ আমার ভাগ্য, আমার মরে যাওয়া মায়ের আশীর্বাদ, তাঁর ক্ষমার মমতার ফুল, আমার একমাত্র মরূদ্যান, আমার ছায়া; আমার ঠাণ্ডা হাওয়া, আমার মুক্তি : সুশান্ত।
সুশান্ত, ও আমার সুশান্ত, তুমি আমাকে কখনো ছেড়ে যেয়ো না। তোমার কাছে গর্ব করার মতো আমার কিছুই নেই। তুমি সবদিক দিয়ে আমার চেয়ে বড়ো। তুমি যথার্থ পুরুষমানুষ। তুমি সভ্য, তুমি সৎ, তুমি নরম এবং তুমি কঠোর।
তুমি আদর করতে জানো, বকতেও জানো তুমি যাকে ভালোবাসো, তাকে প্রখর তাপ থেকে আড়াল করে রাখতে জানো। তোমার বুকে মুখ রাখলে আমার মনে হবে এ আমার পরমনিশ্চিন্ত স্যাংচুয়ারি। এখানে কোনো শেফালি, কোনো রমেন, রমেনের সহকর্মীর মতো কোনো সেন আমাকে অপমান করতে সাহস পাবে না। তোমার পরিচয়ে শুধু আমি পরিচিত হব–আমার সমস্ত আমিত্ব, আমার সমস্ত গুণ, আমার রূপ সব আমি তোমাকে সমর্পণ করে রিক্ত, নিঃস্ব হয়ে মুক্ত হতে চাই সুশান্ত।
সুশান্ত, তুমি আমাকে বাঁচাবে।
আমার সেই আশ্চর্য রাজকীয় নিঃস্বতার নৈবেদ্য তুমি কি প্রসন্নমনে, নিঃশেষে গ্রহণ করবে সুশান্ত?
আমি শুধু খন্ডমাত্র, অংশমাত্র, আমি অপূর্ণ, অপরিপ্লুত। সুশান্ত, ও সুশান্ত, আপনি কি আমাকে সমগ্রতায় ভরে দেবেন, পরিপূর্ণ করবেন? পরিপ্লুত করবেন? আপনি কি নির্দ্বিধায় আমার সমস্ত শরীর, সমস্ত মনকে অক্লেশে, আনন্দে, আক্ষেপহীনতায় গ্রহণ করবেন?
করবেন কি? সুশান্ত? আপনি?
সুশান্ত। তুমি কি করবে।
.
০৮.
আজ কোনো ক্লাস হল না।
মেয়েরা ক্লাসরুম সব সাজিয়েছিল নানারকম ফুল দিয়ে। একটা অ্যাসেমব্লির পর ক্লাস ডিসলভড় হয়ে গেল।
টিচার্স কমনরুমে আজ সকলে বসে জমিয়ে গল্প করছিলেন। আবার কবে সকলের সঙ্গে দেখা হবে–কতদিন পর।
মিসেস চাহাল স্বামীর কাছে যাবেন ব্যাঙ্গালোরে গরমের ছুটিতে, সেখান থেকে উটিতে বেড়াতে যাবেন। ওঁর চোখ-মুখ আনন্দে ঝকঝক করছিল। ছুটির পর উনি আর ফিরে আসবেন না। ব্যাঙ্গালোরেই কোনো চাকরি দেখে নেবেন। ওখানে ভালো ভালো স্কুল-কলেজ আছে। তা ছাড়া মিসেস চাহালের বিদেশি ডিপ্লোমা আছে। ওঁর চাকরি পেতে অসুবিধা হবে না।
আমি তো চাকরি করব ভাবিনি কখনো–যদি কখনো করতাম তো নেহাত স্বাবলম্বনের জন্যে করতাম। নিজের পছন্দমতো শাড়ি কেনার জন্যে বাবা-মাকে বা মেজদাকে কিছু দেওয়ার জন্যে করতাম। কাউকে কিছু দিতে পারলে আমার খুব ভালো লাগে। মেজদা আমার জন্যে অনেক করেছে–আজকালকার দিনে মায়ের পেটের দাদারা সাধারণত এরকম করে না!
আমাকে লেখাপড়া শেখানো, আমার দিকে সবরকম দৃষ্টি রাখা, কীসে আমার ভালো হবে, না হবে সেই চিন্তা করা, সবই করেছে। আমার সব দাদাদের মধ্যে মেজদাকে আমি সবচেয়ে ভালোবাসি। মেজদাই জোর করে আমাকে এম এ ক্লাসে ভরতি করিয়ে দিয়েছিল। অনেক কান্ড করে। কারণ সময় পেরিয়ে গিয়েছিল তখন ভরতি হবার।
অনেক বন্ধু-বান্ধবদের দাদাদের দেখলাম, তাঁরা নিজেদের চাকরি এবং চাকরির পর বন্ধু বান্ধব আজ্ঞা এসব নিয়েই দিন কাটাতেন, তাঁদের বোনেরা কী করছে না করছে, তাদের কিছু অভাব আছে কি নেই, কী তাদের ইচ্ছা-অনিচ্ছা এ নিয়ে কখনো তাঁরা মাথা ঘামাতেন না। আমার যা হয়েছে, যতটুকু হয়েছে, সবই মেজদার জন্যে। মেজদার ইনিশিয়েটিভে।
চাকরি এখন করছি প্রয়োজন বলে। কিন্তু ভগবানই জানেন, কোনো মেয়েরই প্রয়োজনে পড়ে, দায়ে ঠেকে চাকরি করতে ইচ্ছা করে না। স্বাবলম্বনের জন্যে হয়তো সকলেরই ইচ্ছা করে, কিন্তু চাকরি না করলে যখন চলে না, তখন সেই চাকরি আনন্দজনক নয়।
মিনাদি পানের বাটা খুলে পান খাচ্ছিলেন। পান মুখে পুরে অনেকখানি জর্দা ফেললেন মুখে, তারপর হাসতে হাসতে আমাকে বললেন, তুই কোথায় যাচ্ছিস রে নিরু?
আমি বললাম, আমি আর কোথায় যাব? কলকাতা যাব একবার। বাবার শরীরটা ভালো না। তা ছাড়া মেজদার বিয়ের কথা হচ্ছে। বিয়ে হলে এই ছুটির মধ্যেই হবে হয়তো। তাহলে বিয়েতে মজা করে আসব।
তারপর বললাম, আপনি? আপনি কোথায় যাবেন?
মিনাদি পান খেতে খেতে হাসলেন, বললেন, এখনও বিশ্বাস নেই। তবে আমার হাজবেণ্ডের বুড়ো বয়সে প্রেম জেগেছে। বলছে, ছেলে-মেয়েদের সবাইকে কলকাতায় আমার দাদার কাছে রেখে আমাকে নিয়ে একা দার্জিলিং যাবে পনেরো দিনের জন্যে। বলছে মাউন্ট এভরেষ্ট কি উইণ্ডামিনারে উঠবে–হানিমুন করবে না কি আবার। ঢং দ্যাখ না? বলেই, মিনাদি নিজেই হেসে উঠলেন।
মিনাদির কথায় আমরা সকলেই হেসে উঠলাম।
নমিতাদি বললেন, মুখে যাই এল না কেন, আসলে তুমি খুশিতে ডগমগ মিনাদি। মিনাদি নমিতাদির দিকে মুখ ফিরিয়ে বললেন, কেন হব না রে খুশি? বর আদর করে, মাথায় করে, নতুন করে হানিমুনে নিয়ে গেলে কার না ভালো লাগে বল? তা ছাড়া আমার বরের বাহান্ন বছর বয়স বলে কি ভাবিস বুড়ো হয়ে গেছে? অনেকের চেয়ে জোয়ান আছে।
বলেই, চোখ-মুখ নাচিয়ে এক দারুণ ভঙ্গি করলেন।
সকলে হো হো করে হেসে উঠল।
নমিতাদি বললেন, ছেলে-মেয়েদের ছেড়ে বেড়াতে যেতে কষ্ট হয় না তোমার?
মিনাদির মুখটা গম্ভীর হয়ে গেল।
ঢোঁক গিলে বললেন, হয় না বললে মিথ্যা বলা হয়। এখন তো ওরা বেশ বড়োই হয়েছে। কিন্তু বড়ো হয়ে গেছে বলেই বুঝতে পারি, বুঝতে কষ্ট হলেও বুঝতে পারি যে, ওরা আমার কেউ নয়। আমাদের কেউই নয়। ওরা সব একুশ বছরের অতিথি। ওরা আমাদের জন্যে ভাবে না, ওদের মনে কোনো মায়া-দয়া কিছু নেই।
ওদের জন্যে অনেক করেছি, আর কী করব? সবাইকে লেখাপড়া শিখিয়ে দেব–যাতে যে যার পায়ে দাঁড়াতে পারে। নিজেদের সুখ সম্বন্ধে যখন ওরা এতই সচেতন, তখন নিজের নিজের সুখ নিজেরা দেখে নিক। ওদের জন্যে, ওদের মানুষ করতে তো সারাজীবনই গেল, আর আমাদের জীবনের বাকি আছে কী? এখনও যদি শেষবেলায় একটু আনন্দ না করে নিই, তো কবে করব বল? মেয়ে-জামাই কি ছেলে-বউ কি আমাকে মাথায় করে নিয়ে দেশ দেখিয়ে বেড়াবে? তাদের কাছে বাবা-মা তো তখন বোঝা। এই আজকালকার ছেলে-মেয়েদের কাছে। কোনো সুখের ভরসা রাখি না।
একথার পর সমস্ত টিচার্স রুমে একটা নিস্তব্ধতা নেমে এল। কেউই কোনো কথা বললেন না। সবাই চুপ করে নিজের ভাবনা ভাবতে লাগলেন।
হঠাৎ আমার মরে-যাওয়া-মা এবং রুগ্ন বাবার কথা মনে হল। মনটা বড়ো হু-হুঁ করে উঠল।
আমার মা-বাবা মিনাদির মতো ছিলেন না। তাঁরা কিন্তু ছেলে-মেয়েদের মুখ চেয়েই ছিলেন; আছেন। চিরদিন তাঁরা বিশ্বাস করেছিলেন যে, তারা তাঁদের সুখী করবে, তাঁদের খুশি করবে। সেই প্রজন্ম অন্যরকম ছিল। এ প্রজন্ম একেবারেই অন্যরকম।
ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখলাম প্রায় বারোটা বাজে।
আমি উঠলাম, সকলের কাছে বিদায় নিয়ে বেরিয়ে পড়লাম।
বাড়ি ফিরেই দেখি রমেন এসে বসে আছে।
শুনলাম, সুশান্ত ওকে পৌঁছে দিয়েই চলে গেছে।
কাল থেকে ও দাড়ি কামায়নি!
খোঁচা খোঁচা দাড়ি হয়েছে রমেনের। যে-প্যান্ট-শার্ট পরেছিল কাল, তাই পরেই আছে।
পা-ছড়িয়ে বসবার ঘরের সোফায় বসে সিগারেট খাচ্ছে। পাশের অ্যাশট্রেতে সিগারেট স্থূপীকৃত হয়ে আছে।
ভেবেছিলাম, আমাকে দেখে ও লজ্জা পাবে। কিন্তু আমাকে দেখেই ও কিছুই হয়নি এমন গলায় বলল, কী ব্যাপার? স্কুল ছুটি হয়ে গেল?
আমিই লজ্জা পেলাম ওর নির্লজ্জতা দেখে।
আমি বললাম, তোমাকে কে বলল?
রমেন উত্তর দিল, সুশান্ত বলল, এখন তো তার কাছ থেকেই আমার তোমার খবর সব জানতে হয়।
আমি চুপ করে রইলাম।
রমেন আবার বলল, তোমাকে আমি বলেছিলাম না যে, আমাদের ঘরোয়া ব্যাপারে বাইরের লোককে ডাকবে না।
আমি জবাব দেবার মতো কিছু ভেবে পেলাম না।
অবাক হয়ে ওর মুখের দিকে চেয়ে রইলাম।
আমার বয়েস বেশি হয়নি, কিন্তু এপর্যন্ত মানুষ কম দেখিনি! কিন্তু রমেনের মতো মানুষ হয়, হতে পারে, এপর্যন্ত আমার ধারণার বাইরে ছিল।
রমেন আবার কৈফিয়ত চাওয়ার গলায় বলল, কী? জবাব দিচ্ছ না যে?
আমি বললাম, ওকে খবর না দিলে কাকে দিতাম? আমাদের জানাশোনা কে আছে ধারে কাছে? ও গিয়ে ছাড়িয়ে না আনলে তো জেলে পচতে।
পচতাম, পচতাম। তাতে তোমার কী? তাতে ওরই বা কী?
একথার কোনো জবাব হয় না। তাই এবারেও আমি চুপ করেই রইলাম।
অনেকক্ষণ পর আমি জিজ্ঞেস করলাম, তুমি জুয়া খেলেছিলে কেন?
রমেন আমার মুখের দিকে চোখ মেলে তাকাল।
ওর চেহারাটা সত্যিই সুন্দর। মাঝে মাঝে এখনও ওকে সুন্দর দেখায়। তবে শুধু চেহারার সৌন্দর্যে কেউ তো সত্যিকারের সুন্দর হয় না, যদি না মনের সৌন্দর্য থাকে। তাই ওর ভগবানের দেওয়া সুন্দর মুখে, ওর গড়ে-তোলা অসুন্দর মনের একটা ছাপ কালো-ছায়ার মতো সবসময়ে লেগে থাকত আজকাল।
ওর দিকে চাইলেই সে ছাপটা আমার চোখে পড়ত।
রমেন বলল, টাকার জন্যে।
টাকা যা পাও সারামাস কাজ করে, তার ওপর আমি যা পাই তাতে কি আমাদের দুজনের ভদ্রভাবে চলে যাওয়া উচিত নয়? চলে না কি?
সে জন্যে নয়। টাকার দরকার, ধার শোধ করার জন্যে।
কীসের ধার?
তোমার হরিকাকার কাছ থেকে ধার করেছিলাম কিছু টাকা। এখন সেই বুড়ো রোজ তাগাদা দিয়ে চিঠি দিচ্ছে। জামাই-এর সঙ্গে এমন ব্যবহার কেউ করতে পারে যে, তা ভাবতে পারি না।
আমি বললাম, কাকা তাগাদা করছেন তাঁর মেয়ের বিয়ে এসে গেছে বলে! তা ছাড়া বিয়ের পর পরই আমাকে না জানিয়ে চোরের মতো আমাদের বাড়ির লোকের কাছে টাকা ধার করতে তোমার সম্মানে বাধল না? ও স্যরি! তোমার সম্মান বলে কিছু থাকলে তো লাগবে।
রমেন বলল, টাকাটা নিয়েছিলাম তোমারই সুখের জন্যে।
আমার সুখের জন্যে?
হ্যাঁ। এই যে রেফ্রিজারেটরটা দেখছ এ তোমার কাকার কাছ থেকে ধার নেওয়া টাকায়। তুমি বিয়ের আগে আগে আমাকে বলতে না, একটা ছোটো ছিমছাম দুজনের মতো ফ্রিজ তোমার খুব পছন্দ?
আমি বলতাম, সে তো অনেক কিছুই বলতাম। ছিপছিপে সাদা স্ট্যাণ্ডার্ড হেরাল্ড গাড়ি, আরও কত কী বলতাম! সবচেয়ে বেশি যা চাইতাম তা সৎ, পরিশ্রমী ও ভদ্র স্বামী। তাই যখন হল না, তখন আর অন্য কিছু দিয়ে কী হবে? সেকথা আজ আর বলে লাভ কী? তুমিও অনেক কিছু আমাকে বলেছিলে, বিয়ের পরই তোমার লিফট হবে, তুমি দারুণ ফ্ল্যাট পাবে কোম্পানির, গাড়ি পাবে, কত কী-ই তো তুমি বলেছিলে।
কত মিথ্যা স্বপ্নই তখন দেখেছিলাম। তুমিই দেখিয়েছিলে। অন্য সমস্ত ইচ্ছাগুলোই যখন মিথ্যা হল, তুমি শুধু ফ্রিজটাই সত্যি করতে গেলে কেন। তাও আবার আমারই কাকার কাছ থেকে টাকা ধার করে। ছিঃ ছিঃ আমি ভাবতে পারিনি, তুমি এত ছোটো, তুমি আমাকে এমন করে ঠকাবে সবদিক দিয়ে, আমার এমন করে সর্বনাশ করবে তুমি রমেন।
তারপর বললাম, কেন তুমি এমন করলে বল? আমি তো তোমার কোনো ক্ষতি করিনি, তবে, আমার জীবনটা একটা মস্ত ধাপ্পার মধ্যে দিয়ে এমন করে নষ্ট করে দিলে কেন? বল? বল?
আমার কী হল জানি না, আমি ঝরঝর করে কাঁদতে লাগলাম। অনেকদিন আমি কাঁদি না অমন করে। আমার দেওয়ালে মাথা ঠুকে কাঁদতে ইচ্ছা করল। হয়তো বুকের মধ্যে অনেক কান্না জমে ছিল কোনো উৎসমুখের অপেক্ষায়, যে-উৎসে তা উৎসারিত হতে পারে।
আজ আমার কান্না থামতে চাইল না সহজে।
রমেন আমাকে বসে বসে দেখতে লাগল।
আমি ঠোঁট কামড়ে কাঁদছিলাম, যাতে শব্দ না হয়।
রমেন আমাকে দেখে হাসছিল, ওর মুখে একটা অদ্ভুত কুটিল হাসি ফুটে উঠেছিল।
কিছুক্ষণ পর আমি বললাম, তুমি আজই এই ফ্রিজ বিক্রি করে দাও। আজই এ বিক্রি করে সে টাকা নিয়ে কাকার ধার শোধ করো।
রমেন হাসল, বলল, পুরোনো ফ্রিজ কে কিনবে? তা ছাড়া বিক্রি হলেও কতই বা দাম পাওয়া যাবে এর? আর বিক্রি করব বললেই তো বিক্রি হবে না। বিক্রি যদি হয়ও তো এখন একহাজারের বেশি দাম পাওয়া যাবে না।
একটু পরেই রমেন হেসে উঠল একটু চুপ করে থেকে।
বলল, একটা রাস্তা আছে। যে কোনো দামে এটাকে বিক্রি করা যেতে পারে। এক্ষুণি। আমি এমন একজনকে জানি সে এর জন্যে যে কোনো দাম দিতেই রাজি আছে।
আমার মাথার মধ্যে ঝাঁ-ঝাঁ করতে লাগল। আমি বললাম, কে সে?
রমেন অর্থপূর্ণ হাসি হাসল, বলল, সে একজন আছে।
আমি বললাম, হেঁয়ালি অন্য সময় কোরো। তোমাকে এই আমার আলটিমেটাম। আজকের মধ্যে এই ফ্রিজ বিক্রি করে আমার কাকার ধার শোধ করতে হবে তোমার। তোমার লজ্জা করে না? তুমি সর্বক্ষণ স্টেট এক্সপ্রেস সিগারেট খাচ্ছ, কথায় কথায় ট্যাক্সি চড়ো, তোমার ভাব দেখলে মনে হয় তুমি যেন কোথাকার রাজা-মহারাজা! কিন্তু একবারও মনে পড়ে না তোমার যে, এত ধার বাজারে। পৃথিবীর সব লোকের কাছে ধার। এই ধার-করা-চালিয়াতি করতে তোমার লজ্জা করে না?
করে না। কখনো করবে না। যারা বোকা, যারা ইডিয়ট তারাই আমাকে ধার দেয়। যারা দেয় তারাও জানে এবং আমিও জানি যে এ ধার কখনো শোধ হবে না। শোধ যখন দেবই না তখন ও নিয়ে মনোকষ্ট পেয়ে কী লাভ? ধার করি আর যাই-ই করি তোমাকে তো অসুখী রাখিনি?
আমি বললাম, না। পরমসুখে রেখেছ। দু-বেলা ভাত খাওয়ালেই তো সুখ। ধারের টাকায়, জুয়ার টাকায় আমাকে ট্যাক্সি চড়ালে, নটরাজে খাওয়ালেই সুখ। তুমি তো তাই মনে করো। মনে আমার কত যে সুখ তা আমিই জানি।
বলেই, আমি উঠে এলাম বসবার ঘর থেকে। ঘরে এসে বিছানায় শুয়ে পড়লাম। আমার কিছুই ভালো লাগছিল না।
দুপুরের দিকে রমেন দাড়ি-টাড়ি কামিয়ে সেজেগুজে কোথায় যেন বেরোল।
ফিরে এল যখন তখন সন্ধে হয়ে গেছে।
এসেই বলল, ফ্রিজটা বিক্রি করে এলাম।
আমি অবাক হয়ে বললাম, কততে বিক্রি করলে? কার কাছে?
রমেন হাসতে লাগল, হাঃ হাঃ করে। বলল, চার হাজারে। যততে কিনেছিলাম তার দু গুণ দামে। এখনও পৃথিবীতে অনেক গাধা আছে। যারা পেরেমে বিশ্বাস করে।
তারপর রমেন বলল, বিয়ের পর থেকে তোমাকে তো কিছুই দিইনি। এবার তোমাকে এই টাকায় একটা গয়না বানিয়ে দেব।
আমি বললাম, কাকার টাকা শোধ দেবে না?
নিশ্চয়ই। শোধ দেবার পর যা থাকবে তাই দিয়ে বানিয়ে দেব।
আমি বসে বসে এলপাথাড়ি ভাবছিলাম। ভাবছিলাম কার কাছে গিয়ে রমেন এত তাড়াতাড়ি এই পুরোনো ফ্রিজ বিক্রি করে আসতে পারে, আর কে এমন সত্যিসত্যিই বোকা লোক যে এই ফ্রিজ চার হাজার টাকায় কিনল?
ব্যাপারটা বুঝতে পারলাম পরদিন সকালে।
সুশান্ত একেবারে ভোরেই এসে হাজির এ বাড়িতে। যে পায়জামা-পাঞ্জাবি পরে শুয়েছিল, তা পরেই।
এসেই ও রমেনকে একটা খাম দিল। বলল, আপনি যা চেয়েছিলেন। দশ টাকার নোট আছে, চার হাজার। কালই ব্যাঙ্ক থেকে তুললাম।
রমেন বলল, থ্যাঙ্ক ইউ। আপনি আমার বড়ো উপকার করলেন। তারপর বলল, ফ্রিজটা পাঠিয়ে দিই এক্ষুণি?
সুশান্ত বলল, না, না, এখানেই থাক না। পরে নিয়ে যাব একসময়। আমার এক বন্ধু একটা ফ্রিজের খোঁজ করছিল, তাকে দেখাব। তার পছন্দ হলে তখন নিয়ে গেলেই হবে।
আর তার পছন্দ না হলে?
বলে রমেন হাসি হাসি মুখ করে তাকাল সুশান্তর দিকে।
সুশান্ত বলল, না হলে পড়েই থাকবে। কখনো হয়তো কারও পছন্দ হবেই। যতদিন না হয় আপনারাই ব্যবহার করুন। আমার তো ফ্রিজ আছেই একটা।
আমি কোনো কথা বললাম না, চুপ করে বসে থাকলাম।
সুশান্ত অস্বস্তি বোধ করছিল, একটু পরই বলল, উঠি!
আমি বললাম, আপনার কত খরচ হল কাল? জামিনে খালাস করার জন্যে রমেনকে?
সুশান্ত বলল, ও কিছু না।
আমি দৃঢ় গলায় বললাম, কিছু না হলেও এখুনি এই ফ্রিজের টাকা থেকে তা আপনি কেটে নিন।
রমেন বলল, আহা। সুশান্তবাবু যেন আমাদের পর। তুমি এমন ছোটো মনের লোকের মতো কথা বলছ কেন নিরু? বলেই খামটাকে রাখল।
আমি অবাক হয়ে রমেনের দিকে তাকিয়ে রইলাম।
তারপর সুশান্তকে বললাম, না বলুন, কত খরচ হয়েছে?
সুশান্ত তবু উত্তর দিল না। মুখ নীচু করে রইল।
সুশান্ত বলল, আমি কি আপনাদের পর?
আমার বেশ রাগ হয়ে গিয়েছিল।
বললাম, নিশ্চয়ই। পর ছাড়া আর কী?
সুশান্ত কোনো উত্তর দিল না। বলল, চলি এখন।
রমেন বলল, ও কী বসুন, এত ভোরে এলেন, চা খেয়ে যান এককাপ।
সুশান্ত বলল, নাঃ, বাড়ি গিয়েই খাব, অফিসের জন্যে তৈরি হই গিয়ে। আজ একটু তাড়াতাড়ি যেতে হবে।
সুশান্ত চলে যেতেই, রমেন আমার মুখের দিকে তাকাল। একদৃষ্টে তাকিয়ে রইল। আমার মুখের ভাব বোঝার চেষ্টা করতে লাগল। আমি তা বুঝতে পেরে মুখ তুললাম না।
রমেন বলল, তোমার মেজোকাকাকে দু-হাজার টাকা দেব। বাকি দু-হাজার আমার। আমার স্ত্রীর সঙ্গে একজন ক্যাবলা লোককে প্রেম করতে দিচ্ছি তার ট্যাক্স।
আমি চমকে উঠলাম, বললাম, রমেন, মুখ সামলে কথা বল।
রমেন হাসল। বলল, আমার অভ্যেসই নেই সামলে কথা বলার। তবে তোমাকে সাবধান করে দিচ্ছি। মিষ্টি মিষ্টি কথা বোলো। বলল, ইতি-উতি চাও তো চাও। কিন্তু বাড়াবাড়ি কোরো না। আমার কাছে একটা স্প্রিং-নাইফ আছে। দুজনকেই শেষ করে দেব।
আমার চোখ দিয়ে জল বেরোতে লাগল।
আমি বললাম, ছিঃ ছিঃ, কী ভাষা তোমার, তোমার কী কাজ? তুমি না ইঞ্জিনিয়র, তুমি না লেখাপড়া শিখেছ, তুমি না আমার স্বামী। তুমি তো এমনিতেই অনেক কষ্ট দিয়েছ আমায়, অনেক অসম্মান করছ প্রতিমুহূর্তে, তবু এ আবার নতুন কী পথ, নতুন কী ছল তোমার মাথায় এল।
আমি মনে মনে বলছিলাম, রমেন, তুমি আমার যা ছিল সব কেড়েছ। আমার বাপের বাড়ির স্নেহছায়ার আশ্রয়, আমার যুবতী শরীরের সব ফুল, আমার অল্পবয়েসি মনের সব সাধ। তোমাকে আর কিছু কাড়তে দেব না। আমার নতুন পাওয়া সুশান্তকে আমি কাড়তে দেব না। এটুকু জেনো রমেন, এ জীবনে কেউ কারও প্রতিই এমনি আকৃষ্ট হয় না; যখন কেউ সত্যিকারের আকৃষ্ট হয়। তুমি ছল করেছিলে, তুমি ভন্ড, জোচ্চোর, তুমি ভালোবাসার কী বুঝবে?… তোমার কাছে একদিক দিয়ে আমি ঋণী।
ভালোবাসার সস্তা স্মার্ট অভিনয়ের মধ্যে দিয়ে আজ আমি একটু একটু বুঝতে পারি ভালোবাসার মানে কী। কাউকে সত্যিকারের ভালোবাসলে গায়ে কেমন কাঁটা দিয়ে ওঠে। বুঝতে পারি ভালোবাসলে কেউ কাউকে ঠকায় না, ভালোবাসার জনের জন্যে হাসিমুখে সে নিজে ঠকে।
মনে মনে দাঁত চেপে নিজেকে বললাম, তুমি আমার সব কেড়েছ রমেন, তুমি আমার শেষের অবলম্বন সুশান্তকে কাড়তে পারবে না।
আমি বললাম, রমেন আরও কটা দিন আমাকে দয়া করো, তোমার পায়ে পড়ি আমাকে দয়া করো। এখন আমার বাড়ি ফেরার উপায় নেই। এখন ফেরার চেয়ে, বাড়ি ফিরে আমি তোমাকে ছেড়ে এসেছি বলার চেয়ে, আমার আত্মহত্যা করা ভালো। আরও কিছুদিন তোমার সঙ্গে আমাকে থাকতে দাও। রমেন, তুমি আমার সঙ্গে এমন ব্যবহার কোরো না। তোমার পায়ে পড়ি রমেন।
রমেন তবুও হাসতে লাগল। বলল, লোককে কষ্ট দিয়ে আমার দারুণ আনন্দ লাগে। বিশেষ করে তোমার মতো কোনো সুন্দরী মেয়েকে। এতদিন জানতাম, তুমি বোকা। আজ দেখছি তোমার চেয়েও বোকা লোক পৃথিবীতে আছে। ভালো। অনেকদিন বাদে একটি ভালো ভালোবাসায়-জরজর মুরগি পাকড়েছি। তোমার সামনে এর পালক ছিঁড়ব আমি এক এক করে। তুমি দেখো। সুশান্ত বোস জানে না, কার ঘরে সে খাপ খুলতে এসেছে।
রমেনের সঙ্গে আমার আর কোনো কথাই বলতে ইচ্ছে করছিল না।
আমি ওঘর ছেড়ে উঠে শোবার ঘরে চলে গেলাম।
রমেন মুখীকে আবার চা দিতে বলে খুক খুক করে কাশতে কাশতে সিগারেট খেতে লাগল।
একটু পরে রমেন তৈরি হয়ে কারখানায় গেল। যাবার আগে আলমারি খুলে ওর ড্রয়ারে টাকা রাখল। দেখলাম একমুঠো টাকা নিয়ে প্যান্টের হিপ পকেটে গুঁজে নিল যাবার সময়ে। কত টাকা; তা ও-ই জানে।
রমেন চলে যেতেই আমি চান করে তৈরি হয়ে নিলাম। তারপর দশটা নাগাদ বেরিয়ে পড়লাম।
সুশান্তর অফিসটা বিষ্টুপুরে।
বাস থেকে নেমে খুঁজে খুঁজে জিজ্ঞেস করে যেতে যেতে অনেক সময় লাগল।
অফিসটা বিরাট। ঝকঝক তকতক করছে। সুন্দরী একজন পারসি মেয়ে রিসেপশনিস্ট বসে আছে রিসপেশানে।
সুশান্তর নাম বলতেই, ও ইন্টারকমে কথা বলল সুশান্তর সঙ্গে, আমার নাম বলল, তারপর বলল, উনি একটু ব্যস্ত আছেন। পনেরো মিনিট যেন আমি বসি, যেন চলে না-যাই।
চলে যাবার জন্যে আমি আসিনি। তাই বসলাম।
আজ রমেন যা বলল, তাতে আমার সত্যিই ভয় করতে লাগল। এখন থেকে সুশান্তর সঙ্গে বাড়িতে দেখা করব না আর। বাড়িতে দেখা করতে বড়ো ভয় করে–ওর বাড়িও আমাদের বাড়ির কাছে।
তা ছাড়া রমেনের পক্ষে আমাদের পেছনে চর লাগানোও অসম্ভব নয়।
আমি আমার জন্যে ভয় পাই না। আমার যা হবার হবে। আমার যা হয়েছে এর চেয়ে বেশি আর কী হবে? কিন্তু আমার জন্যে সুশান্তর যদি কোনো বিপদ ঘটে, তো সে দুঃখ রাখার জায়গা থাকবে না আমার।
কিছুক্ষণ পর একজন সাহেব ও একজন পাঞ্জাবি ভদ্রলোক একটি চেম্বার থেকে বেরোলেন, তাদের পেছন পেছন সুশান্তও বেরোল, বেরিয়ে রিসেপশান অবধি এসে আমাকে সঙ্গে করে নিয়ে ভেতরে গেল।
ঘরের ভেতরে ঢুকতেই দরজাটা বন্ধ হয়ে গেল। দরজায় ডোর-ক্লোজার লাগানো ছিল।
একটা সাদা গ্রিলের এয়ারকণ্ডিশানার চলছিল ভেতরে।
সুশান্ত একটা চেয়ার টেনে আমাকে দু-হাতে ধরে বসাল, তারপর আমার গ্রীবায় আলতো করে একটা চুমু খেল।
আমি লজ্জায়, ভালোলাগায় মরে গেলাম।
সুশান্ত নিজের চেয়ারে গিয়ে বসল, বসে বলল, তোমার সঙ্গে আমার সম্পর্কটা এত তাড়াতাড়ি ঘনিষ্ঠ হয়ে গেল যে বলার নয়। নিজেই নিজেকে বিশ্বাস করতে পারছি না।
তারপরই বলল, একমিনিট বোসো, আমি এই চিঠি ক-টা একটু সই করে দিই, নইলে ডাক ধরতে পারবে না।
সুশান্ত আমার সামনে বসেছিল। ও মুখ নীচু করে বসে খসখস করে চিঠি সই করছিল। তার আগে একবার করে চোখ বুলিয়ে নিচ্ছিল চিঠিগুলোতে।
আজ ও একটা নীলের ওপর সাদা ডোরাকাটা টাই পরেছিল। চওড়া কলারের সাদা শার্ট, মোটা ফ্রেমের কালো চশটা, সুন্দর টাইয়ের সঙ্গে ম্যাচ-করা নীল কাফলিংকস। সুশান্তকে ভারি সুন্দর দেখাচ্ছিল। এবং খুব বুদ্ধিমান বলে মনে হচ্ছিল।
তবে? রমেন যে বলছিল ও বোকা। বলছিল ও পাঁঠা, মুরগি, আরও কত কী বলছিল। সত্যি! রমেন একটা ক্যারেকটার। অন্য কেউ হলে ওকে নিয়ে হাসা যেত। কিন্তু ও যে আমার স্বামী।
টেলিফোনটা বাজল। সুশান্ত ফোনটা তুলল। কার সঙ্গে যেন ইংরিজিতে কথা বলছিল। কোনো কাস্টমার হয়তো কমপ্লেন করছিলেন, তাকে নরম গলায় বোঝাচ্ছিল সুশান্ত, দোষ স্বীকার করছিল; ক্ষমা চাইছিল অন্যায়ের জন্যে।
সেই লাইন কেটে যাবার পরই, ইন্টারনাল বোর্ডের লাইন ট্যাপ কার সুশান্ত মিস্টার কাপুর বলে কাকে যেন চাইল। তারপর দেখলাম, সুশান্ত অন্য লোক। দেখলাম ও রমেনের চেয়েও হিংস্র। কিন্তু ওর রাগের ঘোড়ার রাশ ওর নিজের হাতে।
কত ভদ্রভাষায়, আস্তে আস্তে অথচ দৃঢ়তার সঙ্গে কাউকে গালমন্দ করা যায় তা দেখছিলাম। শেষে সুশান্ত বলল, এর পরে যদি এরকম করো তাহলে জানব যে তুমি আমাদের কোম্পানির মতো বাজে কোম্পানিতে চাকরি করতে চাও না।
বলেই ফোনটা ছেড়ে দিল।
ফোন ছেড়ে, চিঠি সই শেষ করে বলল, তারপর? এল? কী মনে করে? হঠাৎ অফিসে?
আমি বললাম, আপনার সঙ্গে ঝগড়া করতে এলাম।
সুশান্ত হাসল। একটা চারমিনার সিগারেট ধরাল। বলল, তোমার মতন একজন মেয়ের সঙ্গে আমি ঝগড়া করতে রাজি নই! কোনোদিনও রাজি নই।
আমি শক্ত গলায় বললাম, আপনার কি পয়সা বেশি হয়েছে?
বেশি কথাটা রিলেটিভ। আমার প্রয়োজন যা তার তুলনায় হয়তো বেশিই। কিন্তু তা বলে সস্তা নয়। আমাকে অনেক খেটে রোজগার করতে হয়। বাবা ঠাকুরদা বা শ্বশুরমশায় কিছু রেখে যাননি আমার জন্য। রেখে গেলেও তা নিতাম না হয়তো। আর কী বলব?
এমনভাবে পয়সা নষ্ট করার কি মনে হয়? রমেনের কথায় আপনি চার হাজার টাকা দিলেন? আপনার তো ফ্রিজ আছেই, তবু কেন এমন করলেন।
সুশান্ত হাসল। বলল, ওটা তো যা-তা ফ্রিজ নয়, ওটা যে নিরুপমার ফ্রিজ। তাই দাম বেশি হবে বই কী।
আমি বললাম, ভালো হচ্ছে না। সবসময়ে ঠাট্টা ভালো লাগে না।
সুশান্ত গম্ভীর গলায় বলল, ঠাট্টা করছি না নিরুপমা। সত্যি কথাই বলছি।
আমি যা করেছি জেনেই করেছি। তুমি বল? অন্যায় করেছি?
নিশ্চয় অন্যায় করেছেন। আমি বললাম।
তাহলে করেছি। কী শাস্তি দেবে দাও?
আমি লজ্জা পেলাম, বললাম আমি আবার কী শাস্তি দেব?
হঠাৎ সুশান্ত অন্য স্বরে বলল, নিরুপমা, তুমি এত বোকা কেন?
মানে?
মানে তুমি নিজেকে ভালবাসো না কেন? তুমি নিজের জীবনকে ভালবাসো না কেন? তুমি কি বিশ্বাস করো যে পুনর্জন্ম আছে? পুনর্জন্ম যখন নেই, যখন আমাদের একটাই এবং একইমাত্র জীবন তখন সে জীবনে তোমার নিজের কোনো অধিকার নেই নিজেকে ঠকাবার। তোমার নিজের জন্যেই তোমাকে বাঁচতে হবে। বাঁচার মতো বাঁচতে হবে।
বাঁচতে তো চেয়েছিলাম।
এখন কি মরে গেছ? বাঁচার উপায় কি নেই?
জানি না। হয়তো আছে।
হয়তো নয়। নিশ্চয়ই আছে।
কে বাঁচাবে?
তুমি নিজে বাঁচাবে নিজেকে। অন্য কেউ কি কাউকে বাঁচাতে পারে? কখনো পারে না। যার বাঁচার, সে নিজে বাঁচে, যার মরার সেও নিজেই মরে।
আমি বললাম, বিশ্বাস করুন! আমার আর বাঁচতে ইচ্ছে করে না।
সুশান্ত বলল, অনেক সময়ে আমারও করে না। কিন্তু সেটা সাময়িক। বাঁচতে হবে বই কী। আমার জন্যে আমার, তোমার জন্যে তোমার। আমাদের সকলেরই বাঁচতে হবে।
আমি বললাম, এসব বড়ো বড়ো কথা। আমি আপনাকে সাবধান করে দিতে এসেছি।
সুশান্ত চোখ বড়ো বড়ো করে বলল, কী ব্যাপার?
আমি সব বললাম, ও সব শুনে হেসে উঠল হো হো করে। বলল, দারুণ ইন্টারেস্টিং ব্যাপার তো।
আমি বললাম, আপনার ভয় করছে না?
সুশান্ত উত্তর দিল না। হাসতে লাগল। তারপরই বলল, তুমি কলকাতা যাবে কবে?
আমি বললাম, আমি তাড়াতাড়ি গেলে কি আপনি সুখী হন?
সুশান্ত বলল, হই।
আমি কথা বললাম না।
খারাপ লাগল ওর কথাটা।
ও বলল, দুটি কারণে সুখী হই। প্রথমত, তুমি তোমার বাবার কাছে যাচ্ছ বলে, আর দ্বিতীয়ত, তুমি দূরে গেলে তোমাকে আরও বেশি করে ভালোবাসতে পারব বলে।
আমি হাসলাম। বললাম, কাছে থাকলে বুঝি বেশি করে ভালোবাসা যায় না?
ও বলল, যায়। তবে সেটা হচ্ছে স্থূল ব্যাপার। দূরের ভালোবাসাটা অনেক সূক্ষ্ম।
আমি বললাম, তাই বুঝি?
সুশান্ত আমার দিকে একদৃষ্টে তাকিয়েছিল। ও হঠাৎ বলল, তুমি কি জানো, তোমার প্রভাব আমার ওপর কতখানি–তুমি কি জানো, যে তোমার মতো মেয়ে সারাদেশ ছেঁচে পাওয়া যায় না। তুমি কি কখনো জেনেছ যে তুমি কী?
বললাম, রমেনও কলকাতার স্কাইরুমে বসে এরকম কথা বলেছিল আমাকে। রমেন আমাকে চেয়েছিল। আপনিও কি তাই চান? আপনারা পুরুষরা কি সবাই একরকম? যা চান তা পেয়ে গেলে, আপনাদের তা ধুলোয় ফেলতে, তা মাড়িয়ে যেতে একটুও কি বাধে না?
সুশান্ত হাসছিল। ও হঠাৎ গম্ভীর হয়ে গেল। ওর মুখে কেমন একটা বিষাদ এসে বাসা বাঁধল।
ও বলল, না। রমেন যা চেয়েছিল তোমার কাছে আমি তা চাই না। আমি আসলে কিছুই চাই না; চাওয়ার মতো। আমি যা চাই, তা আমার জন্যে নয়। কেন এবং কী চাই তা তুমি হয়তো একদিন বুঝতে পারবে। যদি না বোঝো, তাহলেও ক্ষতি নেই। তোমার মনে আমার সম্বন্ধে যেরকম খুশি একটা ধারণা করে নেবে।
তার জন্যে দুঃখ নেই। আমার জন্যে ভেবো না। আমি আজও তোমার জীবনে কোনো সমস্যা নই; কখনো হবও না।
এমনসময়ে একটা ফোন বাজল।
সুশান্ত বলল, বড়োসাহেব ডাকছেন। তুমি বোসো একটু।
আমি বললাম, না। আমি উঠব।
উঠবে? সুশান্ত বলল। তারপর বলল, এখন তো স্কুল ছুটি। মাঝে মাঝে ফোন কোরো সময় পেলে। তোমার যদি মন খারাপ লাগে। বলেই একটা কার্ড দিল সুশান্ত।
ও উঠে দাঁড়াল। আমি উঠে দাঁড়ালাম।
হঠাৎ সুশান্ত আমার ডান হাতের পাতাটা ঠোঁটের কাছে তুলে চুমু খেল। বলল, তোমার মতো সুন্দর হাত আমি কারও দেখিনি।
আমি কিছু বললাম না। বলতে ইচ্ছে হল যে, এ হাতে এমন করে চুমুও কেউ খায়নি। সকলের সব জিনিস দেখার চোখ থাকে না। ছেলেদের চোখ মেয়েদের হাতের দিকে চাইবার অবকাশ পায় না।
ঘর থেকে বেরিয়ে আমি বললাম, আমি যেজন্যে এসেছিলাম, তা আবার বলে যাই।
সুশান্ত ঘড়ির দিকে একবার তাকিয়ে বলল, বল?
আমি বললাম, আপনাকে এমন করে ঠকতে দেব না আমি আর। এতে আপনি কার উপকার করছেন? নিজের অপকার করা ছাড়া এতে লাভ কী?
সুশান্ত বলল, একটা কথা বলব?
আমি দাঁড়িয়ে পড়ে বললাম, বলুন।
ও বলল, আমি তোমাকে যেমন করে ভালোবাসি, তুমি যদি তেমন করে কোনোদিন কাউকে ভালোবাসো, কোনোদিনও; সেদিন জানবে যে, ভালোবাসার জনের জন্যে ঠকার সুখ কী এবং কতখানি।
একটু থেমে বলল, চালাক লোকেদের একরকমের আনন্দ, বোকালোকদের অন্যরকমের। আমি বোকালোক। আমি বোকাই থাকতে চাই। তুমি যদি কখনো আমার মতো করে কাউকে ভালবাসো, সেদিনই আমার কথার মানে বুঝতে পারবে। আজ এ আলোচনা থাক।
বলেই, ও চলে গেল। আমার দিকে হাত তুলল, বলল দেখা হবে।
ওর অফিস থেকে বেরিয়ে আমার মনে হল আমার সব গোলমাল হয়ে গেল।
ও সত্যি সত্যিই চালাক না ভীষণ বোকা এখনও বুঝতে পারলাম না।
কখনো কি বুঝব?
.
০৯.
আমি রমেনকে ভালোবাসি না।
যাকে ভালোবেসে একদিন এত কান্ড করেছিলাম, নিজের জেদের জন্যে সকলের অমতে লড়েছিলাম, তার জন্যে কি আমার আর কোনো বোধই অবশিষ্ট নেই? যাকে আমার শরীরের স্বর্গ ও মনের ময়ূর-সিংহাসনে তখন সম্মানিত অতিথি হিসেবে এনে বসিয়েছিলাম, তার প্রতি আজ কি আমার কোনো দুর্বলতা নেই?
জানি না। আমি নিজেকে বুঝতে পারি না। কেউই কি সম্পূর্ণভাবে পারে?
রমেন খারাপ বলে তাকে আজ ত্যাগ করা কি আমার ন্যায় হবে? আমার কি উচিত হবে না যে আমার সমস্ত শক্তি দিয়ে তাকে সুস্থ-স্বাভাবিক জীবনে ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করা? রমেন সুস্থ ও স্বাভাবিক না হলে আমার সন্তানের পিতৃত্বের অধিকার ও কোনোদিনও পাবে না। সে অধিকার আমি মরে গেলেও তাকে দেব না–যতদিন না ও নিজেকে শোধরাচ্ছে। আমাকে নিয়ে ও যা-খুশি করুক–বাঁধা পড়েছি আমি নিজের জালে নিজের দোষে। কিন্তু আমার অনাগত আমিকে আমার প্রথমযৌবনের সমস্ত দুষ্ট ও মিষ্টি ইচ্ছেগুলোকে আমার নাভিমূলের সঙ্গে সংযুক্ত আমার জরায়ুর মধ্যে সঞ্জাত আমার স্বপ্নের কাউকে আমি রমেনের কদর্যতার শিকার হতে দেব না। আমার মধ্যের অদেখা, অনামা, অননুভূত ছোট্ট আমিটাকেও যদি ও এমন করে কলুষিত করে ফেলে তাহলে কাকে নিয়ে আমি বাঁচব? কোন গর্বে ভর করে আমি বেঁচে থাকব তারপর?
রমেন ইচ্ছে করলেই ভালো হতে পারত। ভালো হওয়ার সব উপাদান ওর মধ্যে ছিল, কিন্তু যে একবার ঠগি হয়ে গেছে, ছল-চাতুরি মিথ্যাচার যার মজ্জায় মজ্জায় বাসা বেঁধে গেছে, সে সমস্তরকম ন্যায় ও মেহনতের পথকে ভয় করে। যা সহজে চুরি করে লোক ঠকিয়ে পাওয়া যায় তার জন্যে কোন বোকা পরিশ্রম করে? রমেন সেইসব চালাক লোকেদের দলে পড়ে; যারা এইরকম বোকামিতে বিশ্বাস করে না।
রমেন যদি আজ অথবা ভবিষ্যতে কোনোদিনও নিজেকে শুধরে ফেলে, নিজের মধ্যের ঠগিটাকে ঠ্যাঙাড়ের দল দিয়ে নিগৃহীত করায় তাহলে আমি হয়তো রমেনের সঙ্গেই সবচেয়ে সুখে ঘর করব। কারণ রমেনের ভালো হওয়ার সঙ্গে যে আমার জেদ, আমার আত্মসম্মান, আমার সমস্ত অস্তিত্বর প্রশ্ন জড়িয়ে আছে। রমেনকে নিয়ে সুখী হতে পারলে আমি আর কাউকেই চাই না। এমনকী সুশান্তকেও নয়।
রমেন আজ এমনভাবে আমাকে অপমানিত, বঞ্চিত, ক্ষুব্ধ করেছে বলেই তো সুশান্ত এসে আমার মনের দরজায় দাঁড়িয়েছে। রমেনকে নিয়ে সুখী হলে হয়তো আমার মনে আর কেউ অত সহজে ছায়া ফেলতে পারত না। আমার মন অন্তত দারুণভাবে তাকে প্রতিহত করতে চেষ্টা করত–এমনভাবে তাকে স্বেচ্ছায় বরণ করত না। আমার সব অশান্তি, সব দ্বন্দ্বর মূলে রমেন। রমেন আমার জীবনের শনি; অথচ ও-ই আমার বৃহস্পতি, আমার চন্দ্র, আমার বুধ। আমার ও-ই অমঙ্গল এবং আমার সর্বমঙ্গল।
আজ সকাল থেকেই আকাশে মেঘের আনাগোনা। বুরুঝুরু করে একটা হাওয়া বইছে। এতদিন পরে অবশেষে জামশেদপুরে বৃষ্টি হবে।
এই আকাশের মেঘলা ঠাণ্ডা মিষ্টি হাওয়ায় মনটা কেমন উদাস উদাস লাগে। সকাল থেকেই কেমন কুঁড়েমি লাগছিল। কিছুই করতে ভালো লাগছিল না।
রমেন কারখানায় চলে গেছে অনেকক্ষণ। অনেকক্ষণ গড়িমসি করে প্রায় বারোটা নাগাদ চান করতে গেলাম। অনেকক্ষণ ধরে চান করলাম আজকে। মাঝে মাঝে আমার নিজেকে পরির মতো পরিষ্কার করতে ইচ্ছে করে। পবিত্র করতে ইচ্ছে যায় সমস্ত শরীর, কুমারী মেয়েদের মতো। কিন্তু আমি তো আর কুমারী হতে পারব না।
চান করে উঠে জামাকাপড় পরে কী করব কী করব ভাবছি, এমনসময়ে দরজায় কে যেন কড়া নাড়ল।
দরজা খুলে দেখি সুশান্ত। ওকে দেখে আমি চমকে উঠেছিলাম। ভালো লেগেছিল খুব। বলেছিলাম, আপনি? অসময়ে?
সুশান্ত লজ্জা পেয়েছিল। বলেছিল, এই খেতে এসেছিলাম বাড়িতে, ভাবলাম, দেখে যাই তুমি কী করছ?
আমি বললাম, বসুন।
সুশান্ত সোফায় বসেছিল। বসেই বলেছিল, তুমি আমার সামনে এসে বোসো। তোমাকে একটু ভালো করে দেখি।
আমি বলেছিলাম, আমি কি দেখার মতো? দেখে কি আশ মেটেনি?
দেখার মতো কি না সে তো যে দেখবে সে বুঝবে। আর আশ কি এত সহজে মেটে?
আমি কথা না বলে ওর সামনে এসে বসেছিলাম।
ও একদৃষ্টে আমার চোখের দিকে চেয়েছিল, তারপর দু-চোখের মণিতে কী যেন খুঁজছিল। ওর কী যেন হারিয়ে গিয়েছিল–এমনভাবে ও চাইছিল আমার চোখে, যেন কোনো হারানো জিনিস ও খুঁজে পাবে।
আমি কথা বলছিলাম না কোনো। অবাক হয়ে সুশান্তর দিকে তাকিয়ে ছিলাম। সুশান্ত একটা ব্রাউন রঙের সুট পরেছিল।
হঠাৎ সুশান্ত বলেছিল, নিরুপমা, তুমি আমাকে পছন্দ করো?
আমি একটুক্ষণ চুপ করে ছিলাম।
ও বলেছিল, কী পছন্দ করো না, না?
আমি চোখ তুলে বলেছিলাম, আপনি জানেন না?
ও অবুঝের মতো বলেছিল, আমি জানি না। জানলেও আমি তোমার নিজের মুখ থেকে শুনতে চাই!
আমি ওর চোখের দিকে চেয়ে বলেছিলাম, করি। খু-উ-ব করি।
তারপর ও বলল, তুমি আমার জন্যে রমেনবাবুকে ছাড়তে পারো? পারো নিরু?
আমি চুপ করে ছিলাম। অনেকক্ষণ কথা বলিনি কোন।
সুশান্ত অন্যদিকে মুখ ঘুরিয়ে ছিল। যেন, কথাটা বলে খুব অপরাধ করেছে।
অনেকক্ষণ পর আমি বলেছিলাম, আমাকে একটু সময় দিন। আপনি আমাকে বুঝুন একটু। আপনি…।
সুশান্ত আমার কাছে উঠে এসেছিল, এসে আমাকে উঠিয়ে নিয়ে ওর বুকের মধ্যে টেনে নিয়েছিল। আমার ভীরু বুক ওর সবল ঋজু বুকে মুখ লুকিয়ে ছিল। আমার খুব জোরে জোরে নিশ্বাস পড়ছিল।
আমাকে আর কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে আমার সিঁথিতে ওর থুতনি রেখে সুশান্ত বলেছিল, আমি জানতাম নিরু, আমি জানতাম। তুমি মানুষটা বড়ো নরম। বড়ো ভালো মেয়ে তুমি। তুমি কাউকে কষ্ট দিতে পারো না, কষ্ট দিতে চাও না, তাই তো সমস্ত কষ্ট তোমার নিজেকে একা বইতে হয়। তোমাকে আমি সম্মান করি। তোমাকে ভালোবাসি। তোমাকে ভালোবাসি বলেই বলছি, কখনো এমন কিছু কোরো না যাতে তোমার মন সম্পূর্ণভাবে সায় না দেয়। আমি তোমার মন বুঝি। কী? বুঝি না আমি?
তার পর একটু থেমে, আমার ঠোঁটে ওর নিজের ঠোঁট চেপে ধরে অনেকক্ষণ আমাকে আদর করল সুশান্ত। আমার মনে হচ্ছিল আমি এক্ষুনি ভেঙে পড়ব, নিজেকে সামলাতে পারব না বুঝি। ছিঃ ছিঃ সে বড়ো লজ্জার হবে। মরে গেলেও আমি সুশান্তকে বলতে পারব না যে, তোমার আদর আমার ভালো লাগছে। সুশান্তর ছোঁওয়া আমাকে একমুহূর্তের মধ্যে পাগল করে তোলে–অথচ রমেন কাছে এলে আমার শরীর আড়ষ্ট হয়ে যায় আজকাল। সুশান্তর মধ্যে কী আছে, আমি জানি না।
হঠাৎ সুশান্ত বলল, নিরুপমা, তোমাকে তোমার সম্পূর্ণতায় দেখতে চাই। এরকম টুকরো টুকরো তোমাকে নয়। তোমার অনাবৃত অখন্ড তুমিকে। কী? আপত্তি? আমার প্রার্থনায় আপত্তি?
আমার সমস্ত শরীরে কাঁটা দিয়ে উঠল। লজ্জায়; আবার ভালোলাগাতেও।
সুশান্ত আবার বলল, কী? দেখতে দেবে না? দেখাবে না?
আমি মুখ নীচু করে বললাম, ওইসব ভালো না। আমার ইচ্ছা করে না। আমার ভীষণ লজ্জা করে। আমার কী আছে দেখাবার মতো?
সুশান্ত বলল, আমার কিন্তু খুব ভালো লাগত। আমি কিন্তু খুব খুশি হতাম। আমাকে খুশি দেখতে চাও না তুমি?
আমি সুশান্তর মুখে আমার ডান হাতের আঙুল চাপা দিয়ে বললাম, চাই; চাই।
আমার মন বলল, তোমাকে আমি সবসময়ে খুশি দেখতে চাই সুশান্ত। তুমি অমন করে বোলো না।
তারপর অনেকক্ষণ চুপ করে থেকে আমি বললাম, শুধু দেখাই কিন্তু। আর কিছু না। ঠিক তো?
সুশান্ত আমাকে বুকের মধ্যে জড়িয়ে ধরেই বলল, বেশ। শুধুই দেখা। তুমি দেখো; আর কিছুই না। তারপর বলল, নিরুপমা, তুমি আমাকে ভরসা করতে পারো। জোর করে কিছু পাওয়ায় কখনো আমি বিশ্বাস করিনি। তোমার যা ইচ্ছা করে না তা আমি কখনো চাইব না। সেই ইচ্ছাবিরুদ্ধ পাওয়ার দাম অন্যদের কাছে কী জানি না, কিন্তু আমার কাছে সে পাওয়া সম্পূর্ণ মূল্যহীন।
আমি বললাম, আপনি দাঁড়ান এখানে। আমি শোবার ঘরে যাচ্ছি।
সুশান্ত শুনল না। আমার সঙ্গে সঙ্গে শোবার ঘরে এল। তারপর আমাকে নিজ হাতে পরমযত্নে অনাবৃত করল।
আমার দু-বুকে চুমু খেয়ে সুশান্ত বলল, তুমি কী সুন্দর নিরুপমা। তুমি কী দারুণ সুন্দর।
শাড়ি আমি খুলে রেখেছিলাম। সুশান্ত শায়াটাকে টেনে নামাতে যেতেই আমি চোখ বন্ধ করে ফেললাম। আমি চোখ বন্ধ করেই বললাম, আমি খুলে দিচ্ছি। বলে, চোখ বন্ধ অবস্থাতেই শায়াটা টেনে নামালাম আমি।
কিছুক্ষণ পর সুশান্ত আমার নাভিতে চুমু খেল। তারপর নাভির নীচে।
আমি দু-পা জোড়া করে শুয়েছিলাম। পুরুষজাতকে বিশ্বাস নেই। এমনকী সুশান্তকেও না।
কিন্তু সুশান্ত কথার খেলাপ করেনি কোনোরকম। আশ্চর্য!
ও শুধু বলতে লাগল, নিরুপমা, আমি জীবনে কখনো কোনো অনাবৃত যুবতীকে দেখিনি। বিশেষ করে; যাকে আমার সবচেয়ে বেশি ভালো লাগে তাকে। তুমি কী সুন্দর নিরুপমা! তোমাকে প্রথমদিন দেখার পর থেকেই তোমার শরীর সম্বন্ধে একটা কল্পনা করতাম। তুমি জানো না, কতদিন তোমাকে তোমার নগ্নতায় স্বপ্ন দেখেছি। সত্যি বলছি কত দিন। আমি তো ভগবান নই নিরুপমা, আমিও তোমারি মতো রক্ত-মাংসের একজন মানুষ। একজন অতিসাধারণ মানুষ। কিন্তু বিশ্বাস করো, তুমি আমার সেই সুগন্ধি স্বপ্নের চেয়েও সুন্দর তোমার সবই সুন্দর নিরুপমা। নিরুপমা, নিরুপমা, বলতে বলতে সুশান্ত আমার সমস্ত শরীরে চুমু খেতে লাগল।
আমার শরীরকে আমার বড়ো ভয়। ভয় হল, আমি নিজে যদি আমার সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করে বসি। আমি তো সুশান্তর মতো সংযমী নই।
আমি হঠাৎ বলে উঠলাম, আর সুশান্ত, আর না। আজকে আর না। উঠুন, প্লিজ উঠুন।
সুশান্ত লক্ষ্মী ছেলের মতো সরে গেল।
আমি বললাম, বসবার ঘরে যান, আমি আসছি।
ও বসবার ঘরে চলে গেলে আমি জামাকাপড় পরে ড্রেসিং টেবলের সামনে চুলটা টিপটা ঠিক করে নিয়ে ওঘরে গেলাম।
সুশান্ত একটা ঘোরের মধ্যে বসেছিল। আমাকে দেখামাত্রই বলতে লাগল, কী সুন্দর, তুমি কী সুন্দর! তারপর আমার হাতটা ওর হাতে নিয়ে বলল, ছোটোবেলা থেকে আজ অবধি এত সুন্দর কিছু আমি দেখিনি। সত্যি নিরুপমা।
আমি হাসলাম। বললাম, আপনি অনভিজ্ঞ তাই একথা বলছেন। যে-কোনো মেয়েই এমন সুন্দর। সব মেয়ের শরীরই একরকম। আমার কি এমন বিশেষ কিছু আছে, যা অন্যদের নেই? আপনি কখনো কাউকে এমনভাবে দেখেননি তাই বলছেন।
তারপর সুশান্তর থুতনি ধরে নেড়ে বললাম, বোকা কোথাকার। এত বয়স হয়েছে এখন পর্যন্ত কচি খোকা–কিছুই জানেননি, কিছুই দেখেননি।
সুশান্ত তখনও সেই ঘোরের মধ্যে বসেছিল। ও ঘোরের মধ্যে থেকেই হাসল। বলল, ভাগ্যিস বোকা ছিলাম, নইলে আজ কি নিরুপমাকে দেখতে পেতাম! জানো নিরু, আমার নজরটা চিরদিনই উঁচু–এর জন্যে আমি চিরদিন গর্বিত। আজ আমি ভগবানে বিশ্বাস করলাম। যিনি ফুল গড়েন, প্রজাপতি গড়েন, হলুদ-বসন্ত পাখি গড়েন, তুমি তাঁরই হাতের গড়া। তুমিও তো একটা পাখি। একটা দারুণ পাখি নিরু। আজ আমি সত্যিই প্রাপ্তবয়স্ক হলাম।
আমি হাসলাম। বললাম, বকে গেলেন বলুন। আমিই বকিয়ে দিলাম আপনাকে।
সুশান্ত হাসল। বলল, জীবনের এক বিশেষ ক্ষেত্রে আমি কিশোর ছিলাম। তুমি আজকে আমাকে যুবক করলে। নিরুপমার দয়ায় আজ আমি নিরুপম হলাম।
একটু চুপ করে থেকে সুশান্ত বলল, তুমি একদিন তোমার সম্পূর্ণ তুমিকে দিয়ে দেবে আমায়? একটুও বাকি না রেখে? কোনো দারুণ ক্ল্যারিওনেটের মতো তোমাকে আমি খুশি মতো বাজাব। সেদিন শুধু দেখা নয়–যা আমার মন চাইবে, যা আমার শরীর চাইবে তা-ই করব। দেবে? সেদিন তুমিও আমাকে আমার চাওয়ার মতোই তীব্রতায় চাইবে তো? ঠকাবে না, ফাঁকি দেবে না আমাকে?
আমি কুঁকড়ে গেলাম। বললাম, আমার ওসব ভালো লাগে না। বিশ্বাস করুন, ইচ্ছা করে না। আপনি কি কখনো আমাকে জোর করবেন?
সুশান্ত খুব আশাভঙ্গতার চোখে তাকাল আমার দিকে।
তারপর বলল, না। কখনো না। তোমার ইচ্ছার বিরুদ্ধে কোনো ইচ্ছাই খাটাব না আমি। তুমি দেখবে, তোমার সব ইচ্ছার দাম আমি কেমন করে দিই। একদিন তুমি দেখতে পাবে।
তারপর হঠাৎ সুশান্ত বলল, নিরুপমা, আমাকে অন্য দশজন পুরুষ বলে ভাবলে ভুল করবে। আমি বলছি না যে অন্যদের চেয়ে আমি ভালো, শুধু বলছি যে, আমি অন্যরকম। আমাকে তুমি কখনো ভুল বুঝো না।
আমি বললাম, আমি জানি সুশান্ত। আমি জানি আপনি কী! আমি যা দিতে পারি না তা চেয়ে আপনি আমাকে কখনো দুঃখ দেবেন না। যখন সময় হবে, যদি হয়, তাহলে আপনা থেকেই দেব, আপনার চাইতে হবে না কিছু আমার কাছে। আপনি কিছু চাইলেন অথচ আমি দিতে পারলাম না একথা ভাবতেই আমার ভীষণ খারাপ লাগবে।
তারপর এক সময়ে আমার কপালে চুমু খেয়ে সুশান্ত চলে গিয়েছিল। ঠিক সেদিনই রাতে এক দারুণ ঘটনা ঘটল। রমেন কারখানা থেকে ফিরে চান-টান করে বসবার ঘরে সোফায় বসেছিল। রমেনের মুখে ওর চিরাচরিত দুর্বিনীত অসভ্য ঔদ্ধত্যের বদলে কেমন যেন একটা অসহায়তা ছিল। এমন অসহায়তা আমি কখনো দেখিনি ওর মুখে আগে।
ইদানীং ওর সঙ্গে আমি বড়ো একটা কথা বলি না প্রয়োজন ছাড়া। কথা বলতে ইচ্ছাও করে না। তবুও শোবার ঘরের খাটে বসে চুল আঁচড়াতে আঁচড়াতে বসবার ঘরের দরজার মধ্যে দিয়ে ওর মুখের দিকে চেয়ে কী একটা দারুণ কষ্টে আমার বুক ভরে গেল। আমার মন বলতে লাগল, এই হতভাগা লোকটার আমি ছাড়া কেউই নেই। পৃথিবীর আর সকলেই ওকে দূর-ছাই করে। আমিও ওকে ত্যাগ করলে ওর কী হবে ভাবতে পারি না আমি। তা ছাড়া ওর আজকের এই হঠাৎ-অসহায়তা দেখে আমার মন বলতে লাগল যে, সুশান্তর সঙ্গে আমার ঘনিষ্ঠতা ও কোনো সিকসথ সেন্সে আঁচ করতে পেরেছে? আমার খুব ভয় হল যে, ও কি জেনে গেছে যে আজ দুপুরে সুশান্ত এখানে এসেছিল? সুশান্ত আজ এমন কিছু দেখে গেছে, ওর অনভিজ্ঞ রোমাঞ্চিত আঙুলে স্পর্শ করে গেছে, যা এতদিন রমেনের একারই ছিল। একমাত্র রমেনের।
জানি না। ওর দিকে চেয়ে থাকতে থাকতে আমার মনের মধ্যে কে যেন ছিঃ ছিঃ করে উঠল। কে যেন বলে উঠল, তুমি খুব খারাপ হয়ে গেছ নিরু। তুমি কি খারাপ হয়ে গেছ?
চুল বাঁধা সেরে আমি বসবার ঘরে গেলাম। তারপর ক্যাজুয়ালি জিজ্ঞেস করলাম, তুমি চা খাবে?
রমেন মুখ নামিয়েই ছিল। মুখ না তুলেই বলল, না।
আমি বললাম, তোমার কী হয়েছে?
আমার মন যত নরম করে, যত দরদভরে একথাটা শুধোতে চাইল, মুখ তেমন করে শুধোল না। মনের উষ্ণতা মুখের কথায় প্রতিফলিত হল না।
আমার নিজের ওপর খুব রাগ হল। মন যা বলতে চায়, মুখ তা অকপটে বলে না কেন? এই বাধা কোথা থেকে আসে? ভেবে পেলাম না।
আমি এবার ওর কাছে গিয়ে বসলাম, বললাম তোমার মন খারাপ? কেন? কী হয়েছে বলবে না আমাকে?
রমেন কোনো কথা না বলে ওর হাতটা বাড়িয়ে দিয়ে আমার হাতে রাখল।
আমি মুখ তুলে দেখলাম ওর দু-চোখ জলে ভরা।
আমার বুকের মধ্যে কে যেন একশো ছুঁচ ফুটিয়ে দিল একসঙ্গে।
আমি ওর আরও কাছে সরে গিয়ে বললাম, কী হয়েছে রমু, তোমার কী হয়েছে আমাকে বল।
রমু বলে ডেকে, আমি নিজেই অবাক হয়ে গেলাম। কত দিন; কত দিন যে ওকে এ নামে ডাকিনি! আমি ভুলেই গিয়েছিলাম যে রমেনের একটা আদরের নাম ছিল। আমারই দেওয়া।
রমেন খুব আস্তে আস্তে বলল, আমি তোমাকে খুব কষ্ট দিই, না নিরু?
আমি ওর চোখে জল দেখে নিজেকে সামলাতে পারলাম না, ওর প্রতি আমার কঠোর না হওয়ার কোনো কারণ ছিল না; কিন্তু আমি ওর প্রতি কঠোর থাকতে পারলাম না। আমার নিজের দু-চোখও কেন জানি না জলে ভরে গেল। ওর বিরুদ্ধে আমার পুঞ্জীভূত সমস্ত অভিযোগ আমি সেই মুহূর্তে ভুলে গেলাম।
আমি বললাম, কষ্ট কীসের? আমার তো কোনো কষ্ট নেই।
তারপর গলাটা পরিষ্কার করে নিয়ে বললাম, আমার নিজের জন্যে কোনো কষ্টই নেই। যতটুকু কষ্ট তা তোমার জন্যে, তোমাকে দেখে। তুমি এরকম হয়ে গেলে কেন?
রমেন বলল, আমার দোষ। আমারই দোষ নিরু। তোমাকে আমি যেমন করে রাখতে চেয়েছিলাম তেমন করে রাখতে যে পারিনি, পারি না যে, সেটা কি আমার কম দুঃখ। আমি নিজেও কি শালা জানি, কেন আমি এরকম হয়ে গেলাম? তোমার হয়তো মনে আছে যেদিন তুমি আমাদের ফ্যাক্টরিতে গিয়েছিলে সেদিন আমি মাতাল হয়ে মারামারি করে এসেছিলাম। তুমি আমাকে মাতাল অবস্থায় বাড়ি ফিরতে দেখেছিলে, আমি বমি করেছিলাম, কামিনদের সঙ্গে নোংরামি করেছিলাম। কিন্তু কেন তা করেছিলাম তুমি কখনো ভাবোনি। ভাবার প্রয়োজনও বোধ করোনি।
আমি বললাম, না। সত্যিই ভাবিনি। তুমি বল, কেন করেছিলে? আমাকে বল!
রমেন বলল, তোমাকে সেদিন ওখানে নিয়ে গিয়ে তোমাকে যে কতখানি অপমান করেছিলাম তা তুমি যখন সেনের সঙ্গে মোটরসাইকেলে করে চলে গেলে সেই মুহূর্তেই বুঝতে পেরেছিলাম। দুঃখে রাগে আমার হাত কামড়াতে ইচ্ছা করছিল। আমি ভেবে পাইনি কী করে সে দুঃখ ভোলা যায়। তাই অমন করেছিলাম। আমি জানি যে, তুমি বলবে যে ওরকম করে কোনো দুঃখই ভোলা যায় না। কিন্তু আমি আর কী করব তখন ভেবে পাইনি।
তারপর একটু চুপ করে থেকে রমেন বলল, চলো নিরু, আমরা এদেশ ছেড়ে চলে যাই। বিয়ের আগে তোমাকে যা যা বলেছিলাম, মানে আমার সম্বন্ধে, তার একবর্ণও মিথ্যা ছিল না। কিন্তু বিয়ের পর সেই কোম্পানির ইউনিয়নের কর্তার এক লোক মালিকের ইচ্ছানুযায়ী এসে রাতারাতি আমার ওপরের পদে বহাল হল। আমার সমস্ত ভবিষ্যৎ সেদিন শালা পুরোপুরি অন্ধকার হয়ে গেল। তাই সে চাকরি ছেড়ে দিতে বাধ্য হলাম। তোমাকে একথা তখন বলিনি, কারণ বললেও তুমি হয়তো বিশ্বাস করতে না। আমি জানতাম, আমার কথাগুলোর ওপর তোমার ছেলেমানুষ মন কতখানি ভরসা করেছিল। আমি আমার নিজের কেস সমর্থন করে সেদিন এবং তারপরেও কখনো কোনো কথা বলিনি। আমি তোমার আত্মীয়স্বজন তোমার যারা প্রিয়জন তাদের কাছ থেকে টাকা নিয়ে তাদের সঙ্গে খারাপ ব্যবহার করে সবরকমভাবে চেষ্টা করেছিলাম যাতে তোমার মন আমার থেকে সরে যায়। তুমি জানো না নিরু, তুমি আমার কত আদরের। আমার কারণে তোমার এই কষ্ট আমার দেখতে ভালো লাগে না আর। অথচ উপায় নেই কোনো।
আমি বললাম, কোনোই কি উপায় নেই?
আমার কানে ওর বারবার উচ্চারিত শালা কথাটা বাজছিল।
এদেশে আমি আর থাকব না নিরু। এখানে সহায়সম্বলহীন মামা-মেসোহীন বাঙালি ছেলেদের কোনো ভবিষ্যৎ নেই। চোরে বদমাইসে দেশটা ভরে গেছে। খুঁটির জোর ছাড়া এখানে কিছু করার নেই। প্রথমে আমি একা চলে যাব। তারপর ওখানে ভালো করে সেটল করে তোমাকে নিয়ে যাব। যে করে হোক আমার পাঁচ-সাত হাজার টাকার দরকার। দরকার হলে চুরিও করতে হবে।
আমার খুব খারাপ লাগল।
বললাম, চুরি করতে হবে কেন? আমার সেভিংস অ্যাকাউন্টে হাজার তিনেক টাকা হবে আর আমার গয়না বন্ধক দেব বা বিক্রি করব। তুমি যদি মনস্থির করেই থাকো, তাহলে তুমি যা বলছ তাই-ই হবে।
তারপর একটু চুপ করে থেকে আমি বললাম, বিশ্বাস করো, এরকম গ্লানির জীবন ভালো লাগে না। তুমি জামশেদপুরে চাকরি নিয়ে এলে বলেই আমি এলাম। কলকাতায় যে স্কুলে ছিলাম তাতে আমার মাইনে অনেক বেশি ছিল। এখনও সবিতাদি আমাকে ফিরে আসতে বলেন সবসময়ে। বলেন, উনি আমাকে খুব মিস করেন। তুমি যতদিন না আমাকে নিয়ে যাও সেখানে, ততদিন বাবার কাছেই থাকব। বাবাকেও দেখাশুনো করতে পারব। আমি তো আর দাদাদের ঘাড়ে বোঝা হয়ে থাকব না, নিজের রোজগারেই নিজে থাকব। অবশ্য দাদারা টাকা না দিলেও কিছুই মনে করবেন না, বরং ভালোবেসেই রাখবেন। তবু তোমার সম্মানের জন্যেই টাকা দেব আমি। বিয়ের আগে একরকম থাকে, বিয়ের পরে মেয়েদের সম্মানটা তাদের স্বামীর সম্মানের সঙ্গে যে কতখানি জড়ানো থাকে তা আশা করি তুমি বুঝতে পারো; বোঝো।
রমেন চিন্তিত মুখে বলল, বুঝি, সবই বুঝি। তারপর হঠাৎ বলল, গয়না তো তুমি বাড়িতে রাখোনি? লকারে রেখেছ না? লকারের চাবি তোমার কাছে?
আমি বললাম, আছে। টাকাটা তোমার কবে দরকার?
যত তাড়াতাড়ি সম্ভব। অসুবিধা না হলে কালই। জব ভাউচার আমি ইতিমধ্যেই জোগাড় করে ফেলেছি। পাসপোর্ট আমার করাই আছে। টাকাটা পেলে কলকাতায় গিয়ে কালই প্যাসেজ বুক করব। ভিসা-করে। যত তাড়াতাড়ি সম্ভব।
আমি বললাম, কই? জব ভাউচারের কথা তো তুমি আগে কখনো বলনি? পাসপোর্টের কথাও না।
রমেন বলল, তুমি শুনতে চাইলে তো বলব। তারপরই মুখ ঘুরিয়ে বলল, কেন? তুমি কি আমাকে সন্দেহ করো?
আমি লজ্জিত হলাম। বললাম, ওরকম করে বলছ কেন?
না। সন্দেহ করছ, তাই বললাম।
আমি বললাম, তুমি কলকাতা গেলে তো আমিও তোমার সঙ্গে যেতে পারি। আমার তো স্কুল বন্ধই হয়ে গেছে। আমি তো এমনিতেই যেতাম। কতদিন বাবাকে দেখি না।
রমেন বলল, বাড়ি ফাঁকা রেখে দুজনে একসঙ্গে যাওয়া কি ঠিক হবে? আমি প্যাসেজ ট্যাসেজ ঠিকঠাক করে ফিরে আসব, তারপর এ বাড়ি ছেড়ে দিয়ে এখানের পাট চুকিয়ে একেবারে ফিরে যাব। একসঙ্গে যাব দুজনে কলকাতা তখন। এ কটা দিন তুমি এখানে থাকো। কেমন?
আমি বললাম, বেশ! তুমি যা বলবে।
রাতে শোবার ঘরের আলো নিবিয়ে যখন রমেনের পাশে শুলাম তখন অনেক রাত হয়ে গেছে। বাইরে জ্যোৎস্না ফুটফুট করছে। জ্যোৎস্নার একটা বড়ো ফালি এসে পড়েছে বিছানার ওপর।
রমেন পায়জামা পরে খালি গায়ে শুয়েছিল। অনেক অনেকদিন পর আমি ভালোবেসে নিজের থেকে রমেনের বুকে হাত রাখলাম। আমি খাওয়ার আগে ভালো করে গা ধুয়েছিলাম। সারাগায়ে পাউডার মেখেছিলাম। কেন জানি না, রমেনের কথা ভেবে মনটা খারাপ লাগছিল। সত্যিই যদি ও মনে করে এদেশে ওর জন্যে কোনো ওপেনিং নেই, তাহলে যাকই না অন্য দেশে। বেচারা! আমি হয়তো সত্যিই ওকে কখনো বুঝিনি।
আমি বললাম, রমু বাবু, মুখটা এদিকে ফেরান।
রমেন পাশ ফিরে শুয়ে আমাকে জড়িয়ে রইল।
আমি ওর বুকের চুলে বিলি কাটতে কাটতে বললাম, কতদিন-কতদিন পরে তুমি আমাকে নিয়ে যেতে পারবে বলে মনে করো?
রমেন বলল, তিন-চার মাস। তার মধ্যেই চাকরি ও অ্যাপার্টমেন্ট দেখে নেব। ওখানে ছোটো গাড়ি কেনারও অসুবিধা নেই। তবে বেশ ঠাণ্ডা জায়গা।
আমি বললাম ক্যানাডাতেই যাবে বলে ঠিক করেছ?
ও বলল, জব-ভাউচার তো ওইখানেরই। মনট্রিল-এর একটা ইঞ্জিনিয়ারিং ফার্মে।
ওখানে টিচিং লাইনে আমিও তো কোনো কোর্স করে নিতে পারব? কী? পারব না?
রমেন বলল, নিশ্চয়ই পারবে।
আমার ভাবতেই ভালো লাগছে। তুমি একটু গুছিয়ে নিলে আমরা আমাদের নিজেদের গাড়িতে কিন্তু বেড়াতে বেরোব। আমাকে নায়াগ্রা ফলস দেখাবে তো?
রমেন আমাকে চুমু খেয়ে বলল, সব দেখাব।
এইটুকু বলেই রমেন কেমন অন্যমনস্ক হয়ে গেল। আমাকে ছেড়ে দিল।
কলকাতা থেকে ফিরবে কবে?
কিছুদিনের মধ্যেই ফিরতে পারব বলে মনে করি।
বাবার সঙ্গে দেখা কোরো কিন্তু। বাবাকে বোলো যে, আমি যাবার সময় বাবার জন্যে আম নিয়ে যাব।
রমেন বলল, বলব।
আমি একটু পরে বললাম, ও মা, সরি! তোমার তো উঠতেও হবে আমাদের বাড়িতেই। ওখানে তো তোমার ওঠার কোনো জায়গাই নেই এখন।
তোমাদের বাড়িতে আবার কী উঠব? কোনো হোটেলে-টেটেলে থাকব। কয়েকটা তো দিন আর রাত।
থাকলেই পারতে। এতদিন পরে কলকাতা যাচ্ছ, বাবা কি দাদারা কি অখুশি হতেন?
না। তা না। আমার ভালো লাগে না।
বললাম, যা ভালো মনে করো।
আমার চুপ করে শুয়ে থাকতে থাকতে ভাবতে খুব ভালো লাগছিল। আমার স্বামীর নিজের অ্যাপার্টমেন্ট। কত তলায় হবে কে জানে? বেশ একটা টেরাস থাকবে। পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন কিচেন, সঙ্গে ছোটো প্যান্ট্রি, গ্যাস তো থাকবেই, একটা ইলেকট্রিক কুকিং রেঞ্জও নিশ্চয় থাকবে। ওখানে তো আর চাকর রাখা যাবে না। সব কাজ নিজেদেরই করতে হবে। রমেন যা কুঁড়ে ও তো ঘরের কাজ কিছুই করবে না। ভাবতে ভালো লাগছিল, তারপর একসময়ে আমাদের একটি বাচ্চা হবে। ততদিনে আমার পড়াশোনা শেষ করে ফেলব। তখন চাকরিও ছেড়ে দেব। সবসময়ে বাচ্চাকে দেখাশোনা করব। সেটাই তখন আমার একমাত্র কাজ হবে। সব, সব, এ সমস্ত কিছু আমার ভাবতে ভীষণ ভালো লাগছিল।
কিন্তু তারপরই একটা আশ্চর্য ব্যাপার ঘটল। রমেন যখন আমাকে আদর করছিল, চরম আদর; ঠিক সেই সময়ে আমার চোখের সামনে থেকে রমেনের মুখটা অদৃশ্য হয়ে গিয়ে সেখানে সুশান্তর মুখটা ভেসে উঠল। আমি চোখ বন্ধ করে ফেললাম। সেই মুহূর্তে সেই বন্ধ চোখের অন্ধকারে ভেসে আমি সুশান্তকে সব কিছু দিয়ে দিলাম–একজন মেয়ে কোনো পুরুষকে ভালোবেসে তাকে তার সবচেয়ে যা দামি দান দিতে পারে, তাই-ই দিয়ে দিলাম।
রমেন ক্লান্তিতে, ভালোলাগায়, পাশ ফিরে শিশুর মতো ঘুমোচ্ছিল।
আমার সে রাতে ঘুম এল না।
অনেক কথা ভিড় করে এল মনে।
আমার মন নিশ্চিতভাবে নিঃশব্দে বলল, আমি রমেনকেও ভালোবাসি এবং সুশান্তকেও। অথচ আশ্চর্য! এই দুই ভালোবাসা কত অন্যরকম। এ দুই ভালোবাসাই সত্যি। অথচ কত বিভিন্ন এদের রূপ, এদের প্রকৃতি। একজন মেয়ে কি একসঙ্গে দুজনকে ভালোবাসতে পারে না? পারে না কি? আমার ভালোবাসা কি এতই সীমিত যে একজনকে দিয়েই তা নিঃশেষে ফুরিয়ে যাবে? সুশান্তকে দেওয়ার মতো আমার কিছুই কি বাকি থাকবে না? কিছুমাত্র না?
কিন্তু জামশেদপুরের পাট চুকিয়ে কলকাতা চলে গেলে তো সুশান্তর সঙ্গে দেখা হবে না? হবে না কেন? ওকে বলব কলকাতায় ট্রান্সফার নিতে। তারপর যখন ক্যানাডায় চলে যাব তখন? তখন কি সুশান্তকে ক্যানাডাতেও যেতে বলব? ঈশ-শ কী শখ আমার? এ-ও চাই ও ও চাই। দরকার নেই। রমেন আমার স্বামী। রমেন যদি আমাকে আমি যেমন করে চাই তেমন করে সুখী করে, তাহলে আমি আর সব কিছুই ছাড়তে পারব। এমনকী সুশান্তকেও।
রমেন নিঃসাড়ে ঘুমোচ্ছিল।
রমেনের পিঠে হাত রেখে মনে মনে বললাম, তুমি ভালো হও রমেন, তুমি ভালো হও। তোমার ভালো হওয়া না-হওয়ার ওপর আমার সমস্ত জীবন, আমার সমস্ত চাওয়া-পাওয়া, আমার পুরো অস্তিত্ব নির্ভর করছে। ভালো হবে তো রমেন? রমু বাবু?
.
১০.
পরদিন খুব ভোরে আমার ঘুম ভেঙে গেল।
এখনও সূর্য ওঠেনি। রাতে একপশলা বৃষ্টি হয়েছিল। বেশ একটা মিষ্টি ঠাণ্ডা আছে সকালে। শোবার ঘরের জানালায় দাঁড়িয়ে দেখলাম সাধু সাহেব কুকুর নিয়ে বেড়াতে বেরিয়েছেন। কাপুর সাহেবের বাংলোর পিছনের লনে গোরু দুইছে ওঁদের মালি।
অনেকক্ষণ আমি চুপ করে জানালায় দাঁড়িয়ে রইলাম।
দিন এখনও আরম্ভ হয়নি, মানে দিনের ব্যস্ততা। গতরাত আর আজকের দিনের মধ্যে এই একফালি ঊষার আভাসের গর্ভবতী নিস্তব্ধতার কোলে একা দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে অনেক কিছু ভাবছিলাম।
আমার জীবনেও এক নতুন ভোর হতে চলেছে। জানি না, এই নতুন দিন আমার জন্য কী বয়ে আনবে। ভালোই আনবে আশা করি। ভালোই আনা উচিত। ছোটোবেলা থেকে ভালো করেছি, ভালো ভেবেছি, কখনো কাউকে ঠকাইনি, ঠকাবার ভাবনাও ভাবিনি। আমার কেন খারাপ হবে? খারাপ হয়তো হয়েছিল কিছুদিনের জন্যে কিন্তু সেটা একটা অপসৃয়মান অবস্থা। জীবনে কোনো কিছুই ফেলা যায় না। হয়তো এই খারাপ অবস্থার মধ্যে দিয়ে বেশ কিছু সময় কাটালাম বলেই আজ ভালোর চৌকাঠে এসে দাঁড়িয়েছি। অবিমিশ্র খারাপ বা ভালো বলে কিছু নেই। যাদের জীবনে কেবলই সুখ বা কেবলই অসুখ তাদের জীবন বোধহয় বড়ো একঘেয়ে, আনইন্টারেস্টিং।
তোমাকে আমি বাতিল করেছিলাম রমেন, তোমাকে হয়তো সত্যিকারের যাচাই না করেই। তোমাকে যেদিন গ্রহণ করেছিলাম আমার সরল অপাপবিদ্ধ মনে, সেদিনও যাচাই করিনি। জীবনে কখনো কোনো কিছুকে আমি সন্দেহের চোখে দেখিনি, যুক্তি, অবিশ্বাস, বিচার-বিবেচনা ইত্যাদি কষ্টিপাথরে আমি আমার হৃদয়সঞ্জাত কোনো বোধকে, কোনো অনুভূতিকেই যাচাই করে তেতো করতে চাইনি। সে বাঁচা বড়ো সাবধানির মতো বাঁচা। তার চেয়ে অসাবধানি মৃত্যু ভালো। শুভ্র, অকলঙ্ক সাবলীল হাঁস যেমন প্রথম ভোরে শিউলিতলা দিয়ে দুলতে দুলতে গিয়ে তার কমলা-পায়ে কমলা-রঙা শিউলি ফুলের গালচে পেরিয়ে এক সমর্পণী বিশ্বাসে ভর করে পুকুরের জলে ঝাঁপিয়ে পড়ে, তখন পুকুর তাকে বিনিময়ে কী দেবে অথবা দেবে না সেকথা ভেবে সে ঝাঁপায় না। ঝাঁপিয়ে পড়ার আনন্দে, নিজের মনে নিজের স্বগতোক্তির প্যাঁকপ্যাঁকানিতে সে শরৎ-সকালে নিজেকে সর্বাঙ্গীনভাবে সার্থক করে। পুকুরের মধ্যে যদি কোনো অপূর্ণতা থাকে, তার যদি কিছুই দেয় না থাকে হাঁসটিকে, সে লজ্জা বা সংকোচ তো পুকুরেরই, তাতে হাঁসের হলুদ ঠোঁটের হাসি মোছে না; বোধহয় মোছে না।
আমি নিরুপমা চৌধুরি, ছোটোবেলা থেকে এমনি এক হাঁসের মতো জীবনের পুকুরে বাঁচতে চেয়েছি, সাঁতার কাটতে চেয়েছি। দুঃখ বা সুখ সবকিছুকেই চেষ্টা করেছি হাঁসের গায়ের জলের মতো গড়িয়ে ফেলতে। পৃথিবীর জলে যাতে গা না ভেজে তারই চেষ্টা করেছি সাধ্যমতো। আমি সবসময়ে মনে করতে চেয়েছি যে, একজন মানুষের সমস্ত দুঃখ, কষ্ট, অশান্তি সত্ত্বেও কেবলমাত্র বাঁচার আনন্দের জন্যেই তার বেঁচে থাকা উচিত। আমি কি ভুল ভেবেছি? জানি না।
সত্যি কথা বলতে কী সুশান্তর সঙ্গে আলাপ হওয়ার আগে আমার মনে হত না বাইরের এই দৃশ্যমান জগতে আমিও একজন গণ্য লোক। আগে, এই নিরন্তর জীবনযাত্রা, যাতে আমি সবসময়েই উপস্থিত ছিলাম; এই অনাদিকাল থেকে প্রবাহিত ও আমার সম্পর্ক-সংশ্লিষ্ট প্রবহমান জগতে আমি কোনো ক্ষণিকের অতিথির মতো নিরুত্তাপ উদাসীনতায় সব কিছু অমনোযোগের সঙ্গে প্রত্যক্ষ করতাম। আমার কখনো মনে হত না, মনে হয়নি যে, এই দৃশ্যাবলিতে, এই বিভিন্ন অঙ্কের নাটকে ক্ষুদ্র হলেও আমারও একটি বিশেষ সিদ্ধান্ত-নির্দেশক পটভূমিকা আছে। চিরদিনই চালিত না হয়ে, এই জগৎকে আমার অভিমত, খুশি ও ইচ্ছা দ্বারা চালিত করার অধিকারটুকুই যে আমার আছে শুধু তাই-ই নয়, সেই অধিকারের জবরদখল নেওয়াও যে আমার কর্তব্য এমন কথা আমার কখনো মনে হয়নি আগে।
সুশান্তই প্রথমে আমার দু-চোখে চোখ রেখে বলেছিল, তোমাকে তোমার নিজের জন্যেই বাঁচতে হবে, অন্য কারও জন্যে নয়, তোমার নিজের জন্যে, নিজের কারণে। বলেছিল, তুমি নিজে তোমার কাছে চরমসত্য, পরম-অনুভূতি। তোমার নিজের পরিপ্রেক্ষিতে আর সবকিছুই, সকলেই তুচ্ছ। সেই তোমার মধ্যের আশ্চর্য নীরব অথচ প্রচন্ড বা’য় তুমিকে না চিনতে পারলে, না ভালোবাসলে তোমার বেঁচে থেকে লাভ কী? বলেছিল, তোমার জগতে তুমিই সবকিছুকে আবর্তিত, চালিত ও নির্ধারিত করবে। বাঁচবে, শুধু তোমার নিজেরই শর্তে; নিজের সুখের জন্যে। পৃথিবীর অন্য কেউই–স্বামী, পুত্র, প্রেমিক, বাবা, মা, অন্য কেউই যেন তোমার এই সুস্থ স্বাভাবিক মানসিকতার প্রতিবন্ধক না হয়।
হঠাৎ মনে হল, সুশান্ত কি এত কথা বলেছিল? মনে পড়ে, হাসি পেল। নাঃ ও এত কথা মুখে বলেনি, কিন্তু চোখে বলেছিল। মুখের কথায় আমরা কেই বা কতটুকু বলতে পারি? মুখে শুধু বক্তব্যর আভাসমাত্র দেওয়া যায়। মূল বক্তব্য শ্রোতাকে নিজেকেই নিজের মনে মনে, মনের কানে শুনে নিতে হয়।
ঠিক বলেছিল সুশান্ত।
রমেন ওঠার আগেই আমি চান করে নিলাম। তারপর পেছনের বারান্দায় চা নিয়ে বসলাম।
পেঁপে গাছে কতগুলো শালিক এসে বসে কিচিরমিচির করছিল। ভোরের নরম রোদ একফালি রুক্ষ ঘাসওঠা জমিতে পড়েছে। সোনাঝুরি গাছের ডালগুলো এদিকটাতে ঝুঁকে আছে। বেশ ছায়াচ্ছন্ন থাকে জায়গাটা দুপুরবেলায়। এই জায়গাটা আমার বড়ো প্রিয় জায়গা। আমার একা বসে ভাবার জায়গা।
প্রত্যেক মেয়েরই বাড়ির মধ্যে কোনো-না-কোনো একটা বিশেষ জানালা, বারান্দার কোনো বিশেষ কোণ এমনি প্রিয় থাকেই–যেখানে এককাপ চা নিয়ে এসে বসে আমার মতো লক্ষ লক্ষ মেয়ে তাদের সংসারের অনেকানেক ঝামেলা ও অশান্তি ভুলে যেতে চেষ্টা করে। একচিলতে নীল আকাশে হঠাৎ চোখ পড়ে যায়–ঘুরে ঘুরে ওড়া কোনো চিলের তীক্ষ্ণ ডাক সেই-সেই মুহূর্তে চমক তুলে যায় বুকের মধ্যে তার শৈশবের, কৈশোরের, তার যৌবনের অনেক স্মৃতি মুহূর্তের মধ্যে ঝিলিক মেরে যায় মাথার মধ্যে। কোনো স্নেহময় বাবার মুখ, দারিদ্রক্লিষ্ট মায়ের মিষ্টি ক্ষমাময় হাসি, কোনো বিস্মৃত উত্তীয়র সুস্থ উজ্জ্বল চোখ তখন মনের কোণে আসা যাওয়া করে।
ক্ষণকালের জন্যে।
পরমুহূর্তেই চায়ের কাপ খালি হয়ে যায়, সংসারের, স্বামীর, ছেলে-মেয়ের অথবা জীবিকার প্রতি কর্তব্যের ডাক আসে। শূন্য চায়ের কাপ এবং শূন্য মন নিয়ে আকাশের হাতছানি ছেড়ে চিলের ডানার গন্ধ মন থেকে মুছে ফেলে তাকে আবার ঘরের মধ্যের অন্ধকারে ফিরতে হয়। সব মেয়েকে। যে মেয়েদেরই মন আছে। এমনি করেই।
রমেন উঠে পড়েছিল।
মুখী আজ সকাল-সকাল এসেছিল। কাল ওকে বলে রেখেছিলাম যে আমরা সকাল-সকাল চা-জলখাবার খেয়ে ব্যাঙ্ক খুললেই ব্যাঙ্কে যাব।
রমেন বাথরুম থেকে চান করে শিস দিতে দিতে বেরিয়ে এল। তারপর ঘরে গেল জামাকাপড় পরতে। জামাকাপড় পরে এসে চা খেল।
ব্যাঙ্ক খোলার সঙ্গে সঙ্গেই প্রায় আমরা গিয়ে হাজির হলাম। কিন্তু টাকা তুলতে গিয়ে এক বিপত্তি হল। আমার সেভিংস ব্যাঙ্কে তিনহাজার পঁয়ত্রিশ টাকা ছিল। একহাজার টাকা তুলব শুনে কাউন্টারের ভদ্রলোক বললেন, তাহলে অ্যাকাউন্ট বন্ধ করতে হবে। সেভিংস ব্যাঙ্ক থেকে ওভাবে টাকা তোলা যায় না। অগত্যা অ্যাকাউন্টটাই বন্ধ করতে হল। রমেনকে একশো টাকার ত্রিশটা নোট দিয়ে, আমি আমার হাত ব্যাগে পঁয়ত্রিশটা টাকা রাখলাম। মাইনে পাব আবার স্কুল খুললে। তাই ভালোই হল এই টাকাটা পেয়ে।
ব্যাঙ্কেই এত সময় লেগে গেল যে বলার নয়। তারপর সেখান থেকে লকারে গেলাম। লকারে থাকার মধ্যে কিছুই ছিল না। একটা কাপড়ের বটুয়ায় গয়নাগুলো ছিল। অনেকদিন পর গয়নাগুলোখুলে দেখলাম।
এই পেণ্ডেন্টটা বড়দি ও বড়ো জামাইবাবু দিয়েছিলেন। আমাকে সঙ্গে করে নিয়ে রাসবিহারী অ্যাভিন্যুর দোকান থেকে আমার পছন্দমতো কিনে দিয়েছিলেন। আর এই দুলটা ছোড়দির দেওয়া। এটা নিয়ে আমার বাসিবিয়ের দিন, মানে যেদিন রমেনের সঙ্গে আমাদের বাড়ি ছেড়ে চলে এলাম সেদিন অনেক কান্ড হয়েছিল। সবাই মোটামুটি ভালো প্রেজেন্টেশান দিয়েছিলেন। সুবীরদার সে সময়ে চাকরিটা ছিল না। বিলিতি কোম্পানির ভালো চাকরিটা গিয়েছিল মাস ছয় আগে। উনি নিরুপায় ভাবে চাকরি খুঁজে বেড়াচ্ছিলেন। আমাকে ছোড়দি সবচেয়ে বেশি ভালবাসত। স্বাভাবিক। আমরা পিঠোপিঠি ছিলাম। অথচ আমার বিয়েতে ছোড়দি একটা সামান্য দুল ছাড়া কিছু দিতে পারল না বলে ছোড়দির মনে খুব কষ্ট ও লজ্জা হয়েছিল। যদিও এর কোনো মানে হয় না। কিন্তু মানে না হলেও মেয়েদের মনে এমন অনেক কিছু হয় যা পুরুষরা কখনো বোঝে না।
বিয়ের দিন ছোড়দি ওই দুল সকলের সামনে দিল না। বলল, আমার লজ্জা করে। আমি জানি, বিয়ের ধুমধামের মধ্যে ছোড়দি বাথরুমে গিয়ে কেঁদেছিল। বাসিবিয়ের দিনও ছোড়দি ছিল না। বাসিবিয়ের দুপুরে আমি বললাম, তুই কী রে ছোড়দি? আমার সঙ্গে তোর কি দেনা পাওনার সম্পর্ক? আমাকে যদি তুই কিছুই না দিতিস তাতেই বা কী হত? তা ছাড়া তুই কি আমাকে কিছুই দিসনি? কত আদর করে তুই আর সুবীরদা বেড়াতে নিয়ে গিয়েছিস, কত জায়গায় কত কত খেয়েছি, মজা করেছি আর এখন সুবীরদার অসুবিধে আছে বলে তুই এরকম করবি? সুবীরদা জানলে কী ভাববে বল তো? আমাদের কত খারাপ ভাববে। ছোড়দি বলেছিল, ওর জন্যেই তো আমার কষ্ট। ও যখন পেরেছে সকলকে ও এত আনন্দ করে দিয়েছে, খাইয়েছে যে, সে বলার নয়। এখন ওর চোখের দিকে তাকাতে আমার কষ্ট হয় রে নিরু। যে লোকের জন্য করে, লোককে ভালোবেসে সে-ই একমাত্র জানে, সে যখন আর করতে পারে না তখন তার মনে কী হয়।
ছোড়দি কাঁদতে কাঁদতে নিজের হাতে দুলটা পরিয়ে দিয়েছিল আমার কানে।
ছোড়দির জন্যে আমি এই আড়াই-তিন বছরে প্রায় কিছুই করতে পারিনি। সুবীরদার জন্যেও না। তবু সেইসব ঐতিহাসিক গয়নাগুলোকে আজ আমি রমেনের হাতে তুলে দিলাম। কারণ রমেন আমার স্বামী। একজন মেয়ে এই একটি প্রাপ্তির বিনিময়ে পৃথিবীর অন্য সব ক্ষেত্রে হাসিমুখে সর্বস্বান্ত হতে রাজি থাকে। যদি রমেনরা শুধু এই কথাটা বুঝত, পুরোপুরি বুঝত, তাহলে কোনো দুঃখের কারণ ছিল না।
গয়নাগুলোর দাম সবসুদ্ধ কত হতে পারে আমার ধারণা ছিল না। তবে বিয়ে ও বউভাতের প্রেজেন্টেশান ও আমাদের বাড়ি থেকে যে গয়না দেওয়া হয়েছিল তা নিয়ে পনেরো হাজার টাকার মতো হবে কম করে। সেদিন আমার যা কিছু জাগতিক সম্পত্তি ছিল সব নিঃশেষে রমেনের হাতে তুলে দিয়ে বাড়ি ফিরলাম ওর সঙ্গে।
অনেক অনেকদিন পর দুজনে একসঙ্গে খেতে বসলাম।
মুখী ঝিঙেপোস্ত, মুগের ডাল আর ছানার ডালনা করেছিল।
খেতে খেতে রমেন কেমন অন্যমনস্ক হয়ে যাচ্ছিল বারবার।
আমি বললাম, ও কী? ভালো করে খাও। কী হয়েছে তোমার? কারখানার কথা ভাবছ?
ও বলল, না, শালার চাকরিই যখন করব না তখন ভাবনা কীসের? একটা ক্যাজুয়াল লিভের দরখাস্ত ছেড়ে দিয়ে চলে যাব। তারপর যা হবার হবে।
আমি শুধোলাম, তোমার এ মাসের মাইনে নেবে না? আজ তো তেইশ তারিখ।
রমেন বলল, নিশ্চয়ই নেব। কলকাতা থেকে ফিরে আসি।
আমি হেসে বললাম, হ্যাঁ বাবা, মাইনে না নিলে মুশকিল। এ মাসটাই মুশকিল। আমি তো মাইনে পাব সেই স্কুল খুললে। প্রায় পৌনে দু-মাস পরে।
কথাটা বলতে আমার লজ্জা করল, এপর্যন্ত রমেনকে কখনো আমি টাকার কথা বলিনি। এমনকী সংসারের টাকার কথাও নয়! কিন্তু এ মাসে না বলে উপায় ছিল না।
রমেন বলল, জানি। আমার কি দায়িত্ব বলে কিছু নেই?
রমেন সেদিন কলকাতা গেল না। বিকেলে কার কার সঙ্গে যেন দেখা করতে বেরিয়েছিল। ফিরল অনেক রাত করে। মুখে গন্ধ পেলাম।
রমেন বলল, সেনের বাড়ি গিয়েছিলাম।
আমি বললাম, সেন তো মদ খায় না।
রমেন বলল, সেন খায় না, সেনের বন্ধু-বান্ধব খায়। তারা এসেছিল। ওরা সকলে মিলে আমাকে ফেয়ার-ওয়েল দিল। সেনের হাতে ছুটির অ্যাপ্লিকেশানটাও দিয়ে এলাম।
আমি বললাম, ছুটির অ্যাপ্লিকেশন কেন? তুমি তো বললে চাকরি ছেড়ে দেবে?
রমেন বলল, যে ক-দিন কাজ না করে মাইনে পাওয়া যায় শালাদের কাছ থেকে।
প্রথম প্রথম রমেনের মুখে শালা কথাটা বড়ো ধাক্কা দিত। আজকাল শুনতে শুনতে অভ্যস্ত হয়ে গেছি।
আমার মনে অনেক কথা এসে ভিড় করছিল। নানারকম অবয়বহীন ভয়। আবার ঘেঁড়ামেঘের মতো তা উড়েও যাচ্ছিল। এখন আমার রমেনকে বিশ্বাস করতে হবে পুরোপুরি–বিশ্বাস না করার জন্যেই হয়তো রমেন চিরদিন নিজেকে এমন করে আমার কাছে গুটিয়ে রেখেছিল। যা বলতে চেয়েছিল, চেয়েছে আমার কাছে তার উলটোটাই বলেছিল, বলে এসেছে চিরদিন। যে ভুল করেছি, যে দুঃস্বপ্ন দেখেছি তা আমি ভুলে যাবার চেষ্টা করব। এখন রমেনকে বিশ্বাস না করলে আমি নিরুপায়। রমেনকে, রমেনের মধ্যের ভালোত্বকে, সতোকে আমার বিশ্বাস করতেই হবে।