সে দিন সন্ধ্যেবেলা গভর্নর হাউজ থেকে রাস্তায় বেরিয়ে আলি কেনানের মনে হলো বিগত একটা বছরের জীবন সে যেনো স্বপ্নের মধ্যে কাটিয়েছে। সে ছিলো ভোলার তামাপুকুর গ্রামের এক অখ্যাত অভাজন আলি কেনান। গভর্ণর হাউজের সু উচ্চ গম্বুজের দিকে তাকিয়ে তার অবাক লাগে কি করে এই আলিশান অট্টালিকায় প্রবেশ করে গভর্ণর সাহেবের সবচেয়ে পেয়ারের মানুষ হয়ে উঠেছিলো। গল্পের মতো মনে হয়, স্বপ্নের মতো লাগে।
তার সেদিনটির কথা মনে পড়ে গেলো; যেদিন গাঙের গভীর পানি থেকে পাঁজা কোলা করে ডুবন্ত গভর্ণর সাহেবকে ডিঙ্গিতে উঠিয়ে নিয়েছিলো। আলি কেনানেরা সাত ভাই যদি সেদিন জানের ঝুঁকি নিয়ে গভর্ণর সাহেবকে বাঁচাতে ছুটে না আসতো ঐ গাঙের পানিতেই তার ভবলীলা সাঙ্গ হতো। আজ এ কথা কে বিশ্বাস করবে। ওই পূর্ব পাকিস্তানের গভর্ণর সাহেব তাকে চূড়ান্ত অপমান করে এক কাপড়ে বলতে গেলে একরকম. উলঙ্গ অবস্থায় শহরের মাঝখানে ময়লা আবর্জনার মতো ছুঁড়ে দিলেন। হায়রে আল্লা তোমার রাজ্যে এতো অবিচার! আর মানুষ এতো অকৃতজ্ঞ হতে পারে!
এখন আলি কেনানের প্রধান সমস্যা সে যাবে কোথায়? ভোলায় নিজ গ্রামে ফিরে যাওয়ার কথা স্বাভাবিকভাবেই মনে এসেছে। কিন্তু সত্যি সত্যি ব্যাপারটা ঠাণ্ডা মাথায় চিন্তা করে দেখে তার শিরার রক্ত চলাচল একরকম বন্ধ হয়ে আসার উপক্রম। হ্যাঁ, সে ভোলায় ফিরে যেতে পারে বটে। আর যদি ফিরে যায় মানুষ কাল হোক, পরশু হোক একদিন জেনে যাবে লাট লাহেব তাকে পাছায় লাথি দিয়ে তাড়িয়ে দিয়েছে। তখন অবস্থাটা কি দাঁড়াবে? তার ভাই বেরাদরেরা যে সকল মানুষকে বিপদে ফেলেছে, শাস্তি দিয়েছে তারা তো আর বসে থাকবে না। আলি কেনানের সমস্ত কীর্তি তার চোখের সামনে খসে খসে পড়বে। সমস্ত জমি জমার পাল্টা দখল শুরু হয়ে যাবে। দুজন মানুষের লাশ তারা চরের মধ্যে পুঁতে রেখেছে। তারা জ্যান্ত হয়ে বদলা দাবি করবে। থানার দারোগা, খাশ মহালের কর্মচারী, মহকুমার এসডিও এতোকাল অনন্যোপায় হয়ে আলি কেনানের আবদার দাবি পূরণ করতে এগিয়ে এসেছে। এখন সকলে পিঠ ফিরে দাঁড়াবে। আলি কেনান স্পষ্ট দেখতে পায় তার সৌভাগ্যের নক্ষত্র ডুবে গেছে। এখন তামাপুকুর গ্রামে ফিরে যাওয়া মানে এক পাল নেকড়ের মধ্যে উলঙ্গ হয়ে দাঁড়ানো। ভোগান্তিটা যদি শুধু একা আলি কেনানের হতে কোনো কথা ছিলো না। আলি কেনান জানে পুরুষের ভাগ্য এরকমই। কিন্তু সে চোখ মেলে দেখতে পারবে না তার বুড়ো বাপকে গ্রামের মানুষ অপমান করছে, ভাইদের কোমরে দড়ি পরছে, চাষের জমি বেহাত হয়ে যাচ্ছে। অসহায়ের মতো এসব দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখার বদলে আলি কেনানের মরে যাওয়া অনেক ভালো। তাছাড়া আরো একটা ব্যাপার আছে। আলি কেনান নিজেকে এতোদিন পরিবারের সৌভাগ্যের প্রতীক বলে মনে করে এসেছে। আজকে দূর্ভাগ্যের জ্যান্ত প্রতিমূর্তি হিসেবে কিভাবে আত্মীয় স্বজনের সামনে কালোমুখ দেখাবে। তার বদলে আলি কেনানের পক্ষে চলন্ত ট্রেনের নিচে আস্ত শারীরখানা পেতে দেয়া অনেক সহজ হবে। আলি কেনান যেই মায়ের পেটে নমাস ছিলো সেখানে যেমন ফেরত যেতে পারে না, তেমনি পারে না ভোলার তামাপুকুর গ্রামে ফিরে যেতে। আত্মীয় স্বজনদের অনেককেই সে ঢাকা শহরে পিয়ন দারোয়ানের চাকুরিতে বহাল করেছে। ওদের কারো কাছে যাওয়ার কথা তার মনের ধারে কাছেও ঘেঁষেনি। কেননা তাদের কাছে আলি কেনানের পজিশন ছিলো গভর্ণর সাহেব নন, স্বয়ং আইয়ুব খানের মতো। সুতরাং ওদের কাছেও সে যেতে পারে না।
গভর্ণর-হাউজে জন্মানো খোলস পরিবর্তন করে নতুন খোলস জন্মাতে মোটামুটি তিন মাসের মতো সময় লেগেছে। এরই মধ্যে আলি কেনান মেসে বসবাস করেছে। সদঘাট লঞ্চ টার্মিনালে ঘুমিয়েছে। শহরের পার্কে বসে বসে আত্মহত্যার কথাও চিন্তা করেছে। কিন্তু আজ লঞ্চ থেকে নামা যাত্রীর কাছ থেকে টাকাটি আদায় করতে পারায় আলি কেনানের চোখে নতুন করে বাঁচার স্বপ্ন ভীড় করে।
আলি কেনানের মত মানুষ ভাংবে অথচ মচকাবে না। পৃথিবীতে এখনও তার বাঁচবার যথেষ্ট উপায় আছে। তার জামা কাপড় একদম ছিঁড়ে গিয়েছিলো গভর্ণর সাহেবের অনুকরণে দ্বিতীয়বার চাদেও মতো সুন্দর করে দাড়ি রাখতে আরম্ভ করেছিলো। আজ শখ, বিলাস উচ্চাকাঙ্খগুলো তাকে মুখ ভ্যাংচাতে আরম্ভ করেছে। মুখে দাড়ির জঙ্গল হয়ে গেছে। জামা কাপড় ছিঁড়ে এমন এক দশা হয়েছে ইচ্ছা করলে আলি কেনান এখন ভিখিরিদের সারিতে গিয়ে দাঁড়াতে পারে। একটি পানের দোকানের আয়নায় আলি কেনান আরেকবার তার চেহারা সুরত ভালো করে দেখে নিলো। ময়লা ত্যানা পাজামা পাঞ্জাবি, মুখে একমুখ দাড়ি উসকো-খুসকো জট বাঁধা মাথার চুল। আগুনের ভাটার মতো জ্বলজ্বলে চোখের দৃষ্টি সব মিলিয়ে তাকে পাকা দরবেশের মতো দেখাচ্ছে। নিজেকে ঠিক ভিখিরি হিসেবে কল্পনা করার চেয়ে এ অনেক ভালো। একবার নিজের সম্পর্ক যখন নিশ্চিত হলো, কোত্থেকে সাহস এসে তাকে নতুন জীবনের পথে ছুটিয়ে নিয়ে গেলো।
চোখের সামনে যে রেস্টুরেন্ট পড়লো, সরাসরি ঢুকে গেলো। টেবিলে একটা থাবা দিয়ে বেশ গম্ভীর স্বরে উচ্চারণ করে বসলো, দে তর বাপরে একটা ট্যাহা দিয়া দে। আলি কেনান তার চোখদুটি ক্যাশে বসা লোকটির চোখের ওপর রাখলো। মানুষটি বেশ লম্বা চওড়া মাথায় কিস্তি টুপি এবং মুখে চিকন করে কাটা দাড়ি। লোকটি একটা বাক্যও উচ্চারণ না করে ক্যাশ খুলে একটা টাকা তার হাতে দিলো। আলি কেনানের হাত কাঁপছিলো। পা টলছিলো। শরীরের অবাধ্য স্নায়ুর আন্দোলন থামাবার জন্য তাকে কিছু একটা করতে হবে। তাই বললো,
আল্লাহ, তরে অনেক দিব।
এভাবে প্রথম দিনেই সে তেরো টাকা সংগ্রহ করে ফেললো। প্রথম দিনের আদায় হিসাবে মন্দ না। সব দোকানদার দেয়নি। তার জন্য আলি কেনান দোকানদারদের দোষ দেয়না। নিজের অন্তনিহিত দুর্বলতাকে দায়ী করে। সে খতিয়ে খতিয়ে হিসেব করে তার গলার আওয়াজটা অস্বাভাবিক রকমের দুর্বল ছিলো। প্রয়োজনীয় জোর সে প্রয়োগ করতে পারেনি। কিংবা দোকানে এতো ভীড় ছিলো যে তার আওয়াজ মালিকের কানে পৌঁছুতেই পারেনি। কালে কালে এসকল ছোট খাটো দোষত্রুটি সংশোধন করে নেয়া যাবে। মানুষতো তাকে টাকা দেয়ার জন্য বসেই আছে। সে নির্দেশ দিতে জানে। এমন নির্দেশ দিতে হবে যাতে অন্তরাত্মা পর্যন্ত কাঁপিয়ে তুলতে পারে। আলি কেনানের সৃজনী শক্তি আছে, একথা স্বীকার করতে হবে। সে ভেবে দেখলো এই দরবেশী জীবনের সঙ্গে খাপখাইয়ে নেয়ার মতো একটা আশ্রয়ও খুঁজে বের করতে হবে। কথায় বলে আস্তানা না পেলে মস্তান হয় না। ফুলতলির ওদিকে গতকাল সে একটা বাঁধানো কবর দেখেছে। চারপাশের দেয়ালের ঘেরটা বেশ বড়ো। অনায়াসে একজন মানুষের ঘুমোনোর পক্ষে যথেষ্ট। ঝড়বৃষ্টি হলে অসুবিধে হতে পারে। হ্যাঁ তা একটু হতে পারে বৈকি। তবে এখন আশ্বিন মাস। নীল নির্মেঘ আকাশ, আরামসে আলি কেনান এখানে রাত কাটাতে পারে। আর ভাগ্য যদি প্রসন্ন হয় কালে কালে একটা চালা উঠিয়ে নেয়া অসম্ভব নাও হতে পারে। সেই রাত থেকে আলি কেনান ফুলতলির কবর স্থানে বসবাস আরম্ভ করে দেয়। যারা দেখেছে এক আধটু কৌতূহলী হয়ে তাকিয়েছিলো কোনো প্রশ্ন করেনি। এ ধরনের ঘটনাতে হামেশাই ঘটে। দরবেশ ফকির ওরা তো সবখানে মাটি খুঁড়ে জন্মায় আর মানুষ তাদের মেনে নিতে অভ্যস্ত। একটা বখাটে ছেলে শুধু বলেছিলো, দরবেশ বাবা যতোদিন ইচ্ছা থাকবার পারবা, আমাকে মাসে মাসে পঁচিশ ট্যাহা খাজনা দেওন লাগবো। আগে বাগে কয়্যা রাখলাম। তুই কুন গাঞ্জাখোর বেটা ট্যাহা চাস? আলি কেনানও সমান তেজের সঙ্গে জবাব দিয়েছে, না ঠেকলে চিনবার পারবিনা আমি কে? ছেলেটি প্রায় তেড়ে এসে বলেছিলো, তোর দওবেশগিরি পাছা দিয়া হান্দাইয়া দিমু। এই হানে থাকতে অইলে মাসে মাসে পঁচিশ ট্যাহা দেওন লাগবো। এনিয়ে আলি কেনানের সঙ্গে হাতাহাতি হওয়ার উপক্রম। আরেকটি যুবক হস্তক্ষেপ করায় অধিক দূর গড়াতে পারলো না। হাত ধরে ছেলেটিকে নিবৃত্ত করে বললো,
আবে কালাচান, আল্লাহ কার ভিতরে কি মাল ভইরা থুইছে কইবার পারবি? এটা তো নতুন কোনো কথা নয়, চোরগুন্ডারা ফকির দরবেশকে বেশী ভক্ত করে। সুতরাং আলি কেনান ফুলতলির বাঁধানো কবরটিতে পাকা ঠিকানা পেতে বসলো। আলি কেনানের বিচরণ ক্ষেত্র অনেক দূর বিস্তৃত হয়েছে। কোনো কোনো দিন সে বাংলা বাজার সদরঘাট অঞ্চলে টাকা তুলতে যায়। কোনোদিন কমলাপুর, আবার কোনো দিন নওয়াবপুর। টিপু সুলতান রোড হয়ে নারিন্দা অবধি সমস্ত এলাকাটিকে সে তার নিজের জমিদারি বলে মনে করতে আরম্ভ করেছে। একেকটি এলাকায় সে পনেরোদিন অন্তর একবার দর্শন দেয়। পূর্বের মতো টেবিলে থাবা দিয়ে বলতে হয় না, ‘তর বাপরে একটা ট্যাহা দিয়া দে।’ এখন তার দাবি করার পদ্ধতিটাও অনেক সহজ হয়ে পড়েছে। যে শুধু তার উপস্থিতিটুকু জানিয়ে দেবার জন্যে উচ্চারণ করে, তর বাপরে…। বাক্য ব্যয় না করে দোকানদার একটি টাকা এগিয়ে দেয়। কেউ কেউ বেশীও দেয়। সে আপত্তি করে না, কিন্তু এক টাকার কম অর্থ আলি কেনান গ্রহণ করে না।
সময় গড়িয়ে যাচ্ছে। আলি কেনানের অভিজ্ঞতার ভাণ্ডার সমৃদ্ধ হচ্ছে। সে কবরের চার কোণে চারটি ত্রিকোণাকার লাল নিশান টাঙিয়েছে। কবরটিকে আপাদমস্তক লাল শালুতে ঢেকে দিয়েছে। প্রতি সন্ধ্যায় মোমবাতি জ্বালায়। কবরের এই আকস্মিক শ্রীবৃদ্ধিতে কিছু কিছু গাঁজাখোর, চণ্ডু খোর ভীড় করতে আরম্ভ করেছে। আলি কেনান লাল শালুর একটা লুঙ্গী এবং একটা আজানুলম্বিত আলখাল্লা বানিয়ে নিয়েছে। গলায় বড় বড় দানার কাঠের মালা পরেছে। দুটি লোহার শেকল কাঁধের পাশ দিয়ে ঘুরিয়ে কোমর অবধি ঝুলিয়ে দিয়েছে। এখন মাঝে মাখে তার জজবার ভাব হয়। সে সময়ে আলি কেনান অনেকটা ভাবের আবেশে কি গাঁজার নেশায় বলা মুশকিল, গেয়ে ওঠে :
হেই মানুষ জনম গুনাহগার
ভবনদী কেমনে দিবি পার
সময় থাকতে গুরুর পন্থা ধর
বাবা বু আলি কলন্দর
বাবা বু আলি কলন্দরা।।
একদিন আলি কেনান লক্ষ্য করে একটা কুকুর ছানা কুই কুঁই করে কবরের চারপাশে ঘুরছে। পয়লা তার ইচ্ছে হয়েছিলো হারামজাদা কুত্তার বাচ্চাটার একটা ঠ্যাং ল্যাংড়া করে দেয়। কুত্তার বাচ্চার দুঃসাহস তো কম নয়। পরক্ষণে তার মনে একটা মৌলিক ভাবনা জন্মায়। জখম না করে কুকুর ছানাটিকে একটু করো পাউরুটি খেতে দেয়। এভাবে দুচারদিন যেতে না যেতে কুকুর ছানাটি তার ভীষণ ন্যাওটা হয়ে পড়ে। প্রতিদিন সে নদীতে গোসল করতে যাওয়ার সময় কুকুরছানাটিকে সঙ্গে নিয়ে যায়। আপন হাতে রগড়ে রগড়ে সারা গা পরিষ্কার করে। একদিন বাজার থেকে লাল এবং সবুজ রঙের গুড়ো কিনে আনে। একটা গামলাতে সে রঙ ভাল করে গুলে নিয়ে কুকুর ছানাটির পিছনের দিকে সবুজ এবং সামনের দিকে লাল রঙ লাগিয়ে দেয়। তখন শিশু কুকুরটিকে আশ্চর্য সুন্দর দেখাতে থাকে। আলি কেনান একদৃষ্টে নিজের শিল্প কর্মের দিকে তাকিয়ে থাকে। আশ মেটে না। আবার দোকানে যেয়ে সুন্দর পেতলের শিকল এবং ঘণ্টি কিনে আনে। চামড়ার বেল্টের সঙ্গে জুড়ে আটটি ঘণ্টি গলায় ঝুলিয়ে দেয়। কুকুরটি চলতে ফিরতে টুং টুং আওয়াজ করে। এই ছোট্ট শিশু জন্তুটির এত সব ছলা কলা দেখে আলি কেনানের আনন্দ আর ধরে না।
একদিন আদায়ে বের হবার সময় কুকরি ছানাটিকেও সঙ্গে নিয়ে যায়। এই বিচিত্র জন্তু দর্শন করে শহরের শিশুরা তার পিছু পিছু অনুসরণ করে, হাত তালি দেয়। দেখা গেলো কুকুর ছানা নিয়ে যাওয়ার একটা বাস্তব সুবিধেও আছে। দোকানদারদেও আর তর বাপরে… বলে জানান দিতে হয় না। ঘণ্টির শব্দ শুনে সকলে আপনি মনোযোগী হয়ে ওঠে। আলি কেনান রোজ সকালে একটু বেলা করে কুকুর ছানাটি সঙ্গে নিয়ে শহরের পথে হেঁটে যায়। টুংটুং ঘণ্টির আওয়াজ হয়, লোকজন পিছন পিছন হল্লা করে। নতুন একটা চমৎকার জীবন লাভ করে কুকুর ছানাটি মাঝে মাঝে আনন্দে নেচে উঠে। আলি কেনানের অসম্ভব ভাল লাগে। তবে এই নতুন জীবনের সঙ্গে গভর্ণর সাহেবের জীবন বিনিময় করতে সে রাজি হবে না। গর্বে তার চোখে জল এসে যায়। কোনো মানুষের সাহায্য ছাড়া এই নতুন জীবনটিকে আপন প্রাণের ভেতর থেকে ফুঙ্কার দিয়ে মন্ত্রবলে জাগিয়ে তুলেছে।
কিছুদিন পর তার মনে অন্যরকম একটা ভাবনা আসে। এভাবে রোজ রোজ কুকুর নিয়ে ঘুরলে লোকজনের চোখে ওজন কমে যেতে পারে। এতোকাল ঘুমের মধ্যে ছিলো, এদিকটা সে চিন্তা করেনি। সে অনুভব করলো একজন কাউকে প্রয়োজন যে শিকল ধরে সঙ্গে সঙ্গে কুকুরটিকে নিয়ে যেতে পারবে।
সেদিন সন্ধ্যেবেলা বহাদুর শাহ পার্কের পাশ দিয়ে হেঁটে আসছিলো। সে খুব ক্লান্ত হয়ে পড়েছিলো। পুরো নওয়ারপুর এলাকাটা চক্কর দিতে হয়েছে। আলি কেনান ভেবেছিলো পার্কে ঢুকে একটু জিরিয়ে নেবে। ঢুকেই দেখতে পেলো, একটা ছেলে লম্বা হয়ে পাথরের বেঞ্চির ওপর ঘুমিয়ে আছে। পরনের জামাটি শতছিন্ন । ক্লিষ্ট মলিন মুখ পেটের চামড়া গিয়ে পিঠে লেগেছে। কতদিন খায়নি কে জানে! এরকম কতো ছেলেই তো এভাবে শুয়ে থাকে। আলি কেনান হাঁক দিলো, এ্যাই শালা চোর। ছেলেটি ভয়ে ভয়ে শোয়া থেকে উঠে কাঁপতে কাঁপতে বললো :
মুই চোর নই। মোর বাপ মাকে তালাক দিয়া আবার হাঙ্গা বইছে। হের লাইগ্যা মুই বাপের উপর রাগ কইরা চইল্যা আইছি। চাইর দিন কিছু খাইনাই। আন্নে মোর বাবা, মোরে দুগা খাইবার দেন। আলি কেনান জানতে চাইলো,
তোর বাড়ী কই শালা?
মোর বাড়ি হাতিয়া। ছেলেটি ভীষণ ভয় পেয়েছে। কিন্তু দুটো খাওয়া পাওয়ার আশাও ছাড়েনি। আলি কেনান বললো, শালা তুই চোর । ছেলেটি তার পায়ের উপর আছার খেয়ে বললো, মুই চোর নই । মোর পেটে ভুখ।
আলি কেনান নির্দেশ দিল,
শালা খাড়াইয়া কথা ক। ছেলেটি কাঁপতে কাঁপতে উঠে দাঁড়ায়। আলি কেনান তার হাতে কুকুরের শিকলটি ধরিয়ে দিয়ে বললো, শালা চল। সেদিন থেকে আলি কেনানের পেশায় সহায়তা করার জন্য কুকুর ছানার পাশাপাশি একটি মানব শিশুও তার সঙ্গে যোগ দিলো।