খাদ্যসংগ্রহ পর্যায়: ক্ষুদ্রপ্রস্তর যুগ
১ ক্ষুদ্রপ্রস্তর যুগের পরিচয়
প্রথমত, এই যুগের মূল পরিচায়ক হল ১ থেকে ৩ সেন্টিমিটার লম্বা সূক্ষ্মদানা পাথরের তৈরি হাতিয়ারের ব্যাপক ব্যবহার। এর ব্যতিক্রমও অবশ্য দেখা যায়। ছোট ছোট হাতিয়ারের সঙ্গে বড়, অন্য ধরনের হাতিয়ারেরও ব্যবহার হয়েছে—এমন সাক্ষ্য কোথাও কোথাও পাওয়া যায়। তবে ছোট ছোট হাতিয়ারের ব্যাপক ব্যবহারই হচ্ছে এই যুগের মূল পরিচায়ক। দ্বিতীয়ত এই যুগ ভূতাত্ত্বিক কালবিচারে ‘আধুনিক’ যুগের। প্লাইসটোসিন যুগের পরে। তবে, এখানে মনে রাখা দরকার যে উচ্চ পুরাপ্রস্তর যুগেই সেই সময়ের হাতিয়ারের সঙ্গে ছোট ছোট হাতিয়ারও তৈরি হচ্ছে—এই উদাহরণ কিছু জায়গা থেকে পাওয়া গেছে। তৃতীয়ত, সাংস্কৃতিক স্তর-পরম্পরা বিচারে ক্ষুদ্রপ্রস্তর যুগের স্থান উচ্চ পুরাপ্রস্তর যুগ ও খাদ্য উৎপাদনকারী সংস্কৃতির মাঝখানে। অবশ্য, একথা মনে রাখতে হবে যে এই স্তরগুলির মাঝে বিভাজন রেখাগুলি খুব জোরালো নয়; সব ক্ষেত্রেই একে অন্যের মাঝে মিশে গেছে।
ক্ষুদ্রপ্রস্তর যুগের হাতিয়ারগুলির একটি বড় বৈশিষ্ট্য হচ্ছে যে, এর একটা বড় অংশ ছোট ছোট লম্বাটে চিলকা (‘ব্লেডলেট’) থেকে করা হয়েছে। বর্তুলাকার ছোট প্রস্তরখণ্ড থেকে এরকম চিলকা ছাড়ানো হয়েছে—তার অজস্র প্রমাণ ক্ষুদ্রপ্রস্তরযুগীয় কেন্দ্রগুলিতে ছড়িয়ে আছে। এই হাতিয়ারগুলি ছোট বলে এদের উপেক্ষা করার কোনও কারণ নেই। বহু ধরনের হাতিয়ার এ যুগে ব্যবহার করা হয়েছে বহু ধরনের কাজে। এত ধরনের হাতিয়ার এবং এত ধরনের কাজের ইঙ্গিত উচ্চ পুরাপ্রস্তর যুগে পাওয়া যায়নি। এই হাতিয়ারগুলি অনেক ক্ষেত্রে একের পর এক কোনও কিছু হাতলের গায়ে আটকে করাত, ছুরি ইত্যাদি কাজে ব্যবহার হত। এর প্রত্যক্ষ প্রমাণ অর্থাৎ এরকম হাতলে আটকানো হাতিয়ার প্রত্নতাত্ত্বিক অনুসন্ধানে পাওয়া গেছে। তীর জাতীয় হাতিয়ারগুলি নিশ্চয়ই ফলা হিসেবে লাগানো হত বাঁশের বা কাঠের সরু লাঠির মাথায়। এরকমভাবে ফলা লাগিয়ে আজকাল ছুতোররা যেমন এক ধরনের তুরপুন ব্যবহার করেন কাঠে ছেঁদা করার জন্য, সেরকম তুরপুনের ফলা হিসেবে ব্যবহার হত এরকম হাতিয়ারও পাওয়া গেছে।
হাতিয়ারের বৈচিত্র্যের কথা বাদ দিয়েও উল্লেখ্য যে এই যুগে মানুষের সাংস্কৃতিক ও শারীরিক সাক্ষ্য অনেক বেশি পাওয়া যায়। সময়ের পরিমাপে, পুরাপ্রস্তর যুগের তুলনায়, এই যুগ অর্বাচীন কালের; তাই সেই সময়ের জিনিসপত্র যে পুরাপ্রস্তরযুগীয় নিদর্শনের তুলনায় অনেক বেশি ধরনের পাওয়া যাবে এ কথা বলাই বাহুল্য। এ ছাড়া, এই যুগের তারিখ একমাত্র রেডিওকার্বন সমীক্ষা পদ্ধতিতেই যথেষ্ট পরিমাণে করা যায়; যে সমস্ত তারিখের জন্য গবেষণাগার বিরল সেই ধরনের তারিখ নির্ণয় এই যুগের জন্য দরকার নেই। এই যুগে শিল্পের নিদর্শন বিশেষ করে গুহাশ্রয়ী চিত্রের নিদর্শন—ভারতবর্ষে অন্তত ব্যাপক। এই যুগের মানুষের দৈনন্দিন জীবনের পরিচয় এই ধরনের চিত্রাবলী থেকেও পাওয়া যায়। বস্তুত, এদের অর্থাৎ ক্ষুদ্রপ্রস্তর যুগের মানুষের সামগ্রিক চিত্রটি আমরা যখন দেখব তখন বুঝব যে, বর্তমানের মানুষও এদের কত কাছাকাছি।
ক্ষুদ্রপ্রস্তরযুগীয় নিদর্শনের ভৌগোলিক ব্যাপ্তি পূরপ্রস্তরযুগীয় নিদর্শনের ভৌগোলিক ব্যাপ্তির চাইতে একটু বেশি হতে পারে। তবে, হিমালয় পাদদেশে যে সমস্ত পুরাপ্রস্তরযুগীয় নিদর্শন আছে সেখানে সর্বত্রই হয়তো ক্ষুদ্রপ্রস্তরযুগীয় নিদর্শন পাওয়া যায়নি। অবশ্য, ‘অন্তরীপ’ অঞ্চলে এর নিদর্শন ব্যাপক এবং সংখ্যায় পুরাপ্রস্তরযুগীয় নিদর্শনের চাইতে অনেক বেশি। ‘অন্তরীপ’ অঞ্চল ছাড়াও গাঙ্গেয় পাললিক ভূমিতে এই যুগের সাক্ষ্য পাওয়া গেছে। পাললিক ভূমিতে সাক্ষ্য এখনও ব্যাপক নয়, তবে ভবিষ্যতে আরও আবিষ্কৃত হবে আশা করা যায়।
পশ্চিমবঙ্গে পাললিক ভূমিতে ক্ষুদ্রপ্রস্তর যুগের কোনও নিদর্শন এখনও পাওয়া যায়নি; বাংলাদেশে লালমাই অঞ্চলেও এই নিদর্শন নেই। ত্রিপুরা ও উত্তরপূর্বের রাজ্যগুলিতে দাবি থাকলেও অবিসংবাদী সাক্ষ্য আছে বলে এখনও জানা যায় না। তবে, পশ্চিমবঙ্গে বীরভূম থেকে মেদিনীপুরের উচ্চ অংশে এর সংখ্যা অগুনতি। সাধারণত চার্ট জাতীয় পাথর ও স্ফটিক পাথরের ব্যবহার বেশি ছিল। যেখানে স্ফটিক পাথরের ব্যবহার বেশি হয়েছে সেখানে অনেক সময় মাটিতে জুঁই ফুলের মতো ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র হাতিয়ার ছড়ানো দেখতে পাওয়া যায়। অযোধ্যা পাহাড়ের ওপর, অযোধ্যাতেই একটুকরো চষা জমিতে পাওয়া স্ফটিক পাথরের একটি বর্তুলাকার টুকরো যেখান থেকে নিপুণভাবে লম্বা, ছোট চিলকে ছাড়ানো হয়েছে, তার কারিগরি নৈপুণ্য পশ্চিমবঙ্গের শিল্পের ইতিহাসে স্থান পাওয়ার যোগ্য। শান্তিনিকেতনে গৃহনির্মাণ অতি ব্যাপক হওয়ার আগে পারুলডাঙা, তালতোড়ের ডাঙা, ডিয়ার পার্ক, বল্লভপুর জঙ্গল এসবের ‘খোয়াই’তে ব্যাপকভাবে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র হাতিয়ার পাওয়া যেত। এই হাতিয়ারগুলিকে সাধারণভাবে ইংরাজিতে ‘মাইক্রোলিথ’ বলা হয়, যা থেকে ক্ষুদ্রপ্রস্তর যুগ কথাটা বাংলায় এসেছে। পশ্চিমবঙ্গের পশ্চিমাংশের প্রায় সব ডাঙা জমিতেই ‘মাইক্রোলিথ’ অল্পবিস্তর ছড়ানো দেখতে পাওয়া যায়। সব সময় যে জঙ্গুলে জায়গাতেই পাওয়া যাবে তা নয়। অনেক জায়গায় জলের ধারে আবার অনেক জায়গায় পাহাড়ের নীচের ঢালে পাওয়া যায়। ঝালদার কাছে যে সব পাহাড় আছে তার প্রায় প্রত্যেকটার নীচের দিকে অনুচ্চ জায়গাটায় একটু খুঁজলেই একসময় মাইক্রোলিথ পাওয়া যেত। দক্ষিণ ভারতে তিউতিকোরিন অঞ্চলে সমুদ্র থেকে কয়েক মাইল ভেতরে পুরনো তটরেখার বালির ভেতর মাইক্রোলিথ পাওয়া যেত। মধ্যপ্রদেশে রেওয়ার কাছে যে সমস্ত গুহাশ্রয়ে চিত্র আছে সেখানেও বালির মধ্যে প্রচুর অপূর্ব সুন্দর মাইক্রোলিথ পাওয়া যেত। হরিয়ানার আরাবল্লী-ঘেঁষা গ্রামের প্রান্তে মাইক্রোলিথ ছড়ানো জায়গা আদৌ বিরল নয়। এদের নিয়ে গবেষণা বিশেষ সুসংবদ্ধ বা ব্যাপক না হলেও, আমাদের চারপাশে এসব নিদর্শন ছড়িয়ে আছে। আমরা দেখতে পাব যে, এই পর্যায় থেকেই কিছু অঞ্চলে ব্যাপকভাবে শারীরিক অবশেষ পাওয়া গেছে। কিছু ক্ষেত্রে সাজানো কবরও পাওয়া গেছে।
কী ধরনের প্রাকৃতিক পরিবেশে ক্ষুদ্রপ্রস্তরযুগীয় সংস্কৃতি ভারতবর্ষে গড়ে উঠেছিল সে সম্পর্কে গবেষণা মোটেই সুদৃঢ় ভিত্তির ওপর প্রতিষ্ঠিত নয়। পশ্চিম রাজস্থান, মধ্যপ্রদেশে শোন আর উত্তরপ্রদেশে বেলান উপত্যকার ক্ষেত্রে অনুমান করা হয়েছে যে ‘আধুনিক’ যুগের শুরুতে বৃষ্টিপাতের মাত্রা বেড়ে গিয়েছিল। অন্য দিকে পশ্চিমবঙ্গ ও বিহারে ছোটনাগপুর অধিত্যকার ক্ষেত্রে এরকম মনে করার কোনও কারণ নেই। বরং মনে হয় যে, আবহাওয়ায় বৃষ্টিপাত কম ও শুষ্কতার মাত্রাই বেশি ছিল। দুর্গাপুরে বীরভানপুর অঞ্চলে, শান্তিনিকেতনে পারুলডাঙা অঞ্চলে পরিষ্কার দেখা যায় যে মাইক্রোলিথ যে স্তরে আছে সেই স্তরটি বায়ুতাড়িত বালিস্তরে ঢাকা। এই বালিস্তর শুষ্কতা ছাড়া এভাবে জমা হতে পারে না। সব মিলিয়ে সমসাময়িক আবহাওয়া ও সামগ্রিক গবেষণার প্রয়োজন রয়েছে। সাধারণভাবে এটা জেনে নেওয়াই ভাল যে, গত ১০,০০০ বছরে অর্থাৎ যখন থেকে ভূতাত্ত্বিক ‘আধুনিক’ যুগ শুরু হয়েছিল তখন থেকে আবহাওয়ার মৌলিক কিছু পরিবর্তন ঘটেনি।
আর্দ্রতা ও শুকতার কিছু তারতম্য বিভিন্ন অঞ্চলে হতে পারে, তবে ওই পর্যন্তই। উদ্ভিজ্জ আবরণ অর্থাৎ জঙ্গল যে শুষ্কতার সময়েও বর্তমানের তুলনায় যথেষ্ট বেশি ছিল তা বুঝতে অসুবিধা হয় না। জায়গা যতই রুক্ষ হোক না কেন সেখানে মানুষ বা তৃণভোজী অনেক জন্তুর প্রভাব যদি বেশি না পড়ে তবে সহজেই যে কয়েক বছরে জঙ্গল গজিয়ে ওঠে তা হয়তো অনেকেই লক্ষ করেছেন। আর, মানুষের হাত পড়ায় এককালের ঘন জঙ্গলও কীভাবে সম্পূর্ণ লোপ পায় তাও নিশ্চয়ই অনেকে জানেন।
ক্ষুদ্রপ্রস্তরযুগীয় কেন্দ্রগুলিতে খননকার্যের ফলে যে সমস্ত জন্তু জানোয়ারের অবশেষ পাওয়া গেছে তা থেকেও এটা মনে করা যায় না যে বর্তমানের সঙ্গে আবহাওয়ার মৌলিক পার্থক্য ছিল; ঘোড়া, গরু, মোষ, ভেড়া, ছাগল আর শুয়োর তো গৃহপালিত অবস্থাতেই পাওয়া গেছে, আর বন্যদের ভেতর আছে নেকড়ে, শেয়াল, বেজি, গণ্ডার, শুয়োর, নীলগাই, বিভিন্ন ধরনের হরিণ, খরগোস, কাঠবেড়ালি, কাছিম, গোসাপ, মাছ, পাখি। যে ভারতবর্ষ আমরা চিনি এই প্রাণীজগৎ তার বাইরে নয়।
২ এই যুগের কালরেখা
বৈজ্ঞানিক অগ্রগতি সত্ত্বেও কালের পরিমাপ, সব সময় সোজা পথে হয় না, অর্থাৎ সব সময় সব তারিখ যে অভ্রান্ত হবেই এমন কথা নয়। সব মিলিয়ে বিচার করে দেখতে হয়। ক্ষুদ্রপ্রস্তর যুগের ক্ষেত্রে যে পদ্ধতিটি বহুল প্রযোজ্য তা রেডিওকার্বন সমীক্ষা পদ্ধতি, কিন্তু যে নমুনার ওপর তারিখ করা হবে তা যদি গোড়াতেই তারিখ করার উপাদান হিসেবে নির্ভরযোগ্য না হয় তবে তারিখ নিয়ে গোলমাল বাধবেই। তা ছাড়া একই ধরনের দুটি কেন্দ্র থেকে পাওয়া তারিখগুলি যদি পরস্পরবিরোধী হয় অথবা একই কেন্দ্র থেকে পাওয়া দুটি তারিখের ভেতর একটি প্রাচীন ও একটি অপেক্ষাকৃত নতুন হয়, তবে কোন তারিখ গ্রহণ করা হবে, কোন তারিখ বাদ দেওয়া হবে তার সমাধান নির্ভর করে প্রত্নতাত্ত্বিকের বিচারবুদ্ধির ওপর, আর কিছুটা প্রত্নতাত্ত্বিকের ‘রাজনীতি’ কী তার ওপর। যদি প্রত্নতাত্ত্বিকের মনে হয় যে বিশেষ অঞ্চলটিতে কোনও সংস্কৃতি বেশি প্রাচীন হতে পারে না, অথবা সেই অঞ্চলটির সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য সম্পর্কে তাঁর শ্রদ্ধাবোধ না থাকে তবে তিনি প্রাচীন বা নতুন তারিখ দুটির ভেতর নতুনটিই বেছে নেবেন। পুরো প্রত্নতাত্ত্বিক পটভূমি চিন্তা করে কোন তারিখটা গ্রহণযোগ্য সেটার দিকে নজর দেবেন না। ভারতবর্ষের প্রত্নতত্ত্ব ও প্রাচীন ইতিহাস চর্চায় তারিখ নিয়ে রাজনীতি হওয়ার দৃষ্টান্ত যে নেই তা নয়। সাধারণত এটা করেছেন প্রথম বিশ্বের কিছু পণ্ডিত যাঁদের তৃতীয় বিশ্বের সংস্কৃতির ইতিহাস নিয়ে মোটেই শ্রদ্ধাভক্তি নেই, অথচ বিভিন্ন কারণে তার চর্চা করতে হয়। আর তৃতীয় বিশ্বেরই সেসব পণ্ডিত যাঁরা বিভিন্ন কারণে প্রথম বিশ্বের পণ্ডিতদের মতে মত দেওয়াই সর্বক্ষেত্রে সমীচীন মনে করেন। বর্তমান অধ্যায়েই এই প্রসঙ্গটির অবতারণা করতে হল, কারণ এই অধ্যায় থেকেই অনেক তারিখ নিয়ে বিতর্ক দেখা যাবে। আমরা আমাদের নিজেদের মতই লিখব, যদিও অন্য পক্ষের যুক্তির ভিত্তিও তুলে ধরা হবে।
উত্তরপ্রদেশে বেলান উপত্যকায় ‘কঙ্করস্তর নম্বর ৪’ বলে একটি কঙ্করস্তর দেখা যায়। এই কঙ্করস্তরে ওই অঞ্চলের প্রাগৈতিহাসিক স্তর-পরম্পরার ক্ষুদ্রপ্রস্তরযুগীয় হাতিয়ার প্রায়ই মেলে। এই স্তরে, কিছু উচ্চ পুরাপ্রস্তরযুগীয় নিদর্শনও থাকতে পারে, তবে যে কঙ্করস্তরে কেবল উচ্চ পুরাপ্রস্তরযুগীয় নিদর্শন পাওয়া যায় সেই ৩ নং কঙ্করস্তরের ওপরে অর্থাৎ সময়ের মাপকাঠিতে পরে এই ৪ নং কঙ্করস্তর। মহাগরা নামক জায়গায় ৪ নং স্তরের ৫টি তারিখ আছে—খ্রিস্টপূর্ব ১১/১২ হাজার থেকে ৮/৯ হাজার বছরের ভেতর। এর ভিত্তিতে দেখা যাচ্ছে যে ভারতবর্ষে ক্ষুদ্রপ্রস্তর যুগ ভূতাত্ত্বিক ‘হলোসিন’ বা ‘আধুনিক’ যুগের গোড়াতেই শুরু হয়েছিল। এগুলি প্রত্যক্ষ তারিখ। কিছু অপ্রত্যক্ষ তারিখও আছে এই অঞ্চল থেকে। যথা, সামগ্রিকভাবে এই অঞ্চলে উচ্চ পুরাপ্রস্তর যুগের তারিখ, মহাগরা ৩ নং কঙ্করস্তর থেকেই দেখা যাচ্ছে, খ্রিস্টপূর্ব ১৭/১৮ হাজার থেকে ২৩/২৪ হাজার বছর। তাই, অপ্রত্যক্ষভাবেও এই অঞ্চলে ক্ষুদ্রপ্রস্তর যুগের সূত্রপাতের যে তারিখ পাওয়া যাচ্ছে তা অসঙ্গত নয়।
অন্য দিকে, কিন্তু এই অঞ্চলেই, উত্তরপ্রদেশে প্রতাপগড় জেলায় সরাই নাহার রাইতে দুটি তারিখের ভেতর একটি ৮৩৯৫ ± ১১০ খ্রিস্টপূর্ব, আর অন্যটি ৯৯০± ১২৫ খ্রি. পূ.। আঞ্চলিক পরিপ্রেক্ষিতে প্রথম তারিখটি মানাই যুক্তিসঙ্গত।
রাজস্থানে ভিলওয়াড়া জেলায় বাগোর গ্রামে ক্ষুদ্রপ্রস্তরযুগীয় সংস্কৃতির প্রথম পর্যায়ের তারিখ হচ্ছে খ্রি.পূ. ষষ্ঠ থেকে চতুর্থ সহস্রাব্দের ভেতর। মধ্যপ্রদেশে হোসংগাবাদের কাছে আদমগড়ে দুটি তারিখের ভেতর একটি খ্রি. পূ. সপ্তম সহস্রাব্দ ছুঁয়ে, আর অন্যটি মাত্র ১০০০ খ্রি.পূ. ছুঁয়ে। দ্বিতীয় তারিখটি গোলমাল হওয়ার একটি কারণ হতে পারে যে এটি না-পোড়া হাড়ের ভিত্তিতে করা। মধ্যপ্রদেশেরই ভীমবেঠ্কা থেকে বেশ কিছু তারিখ আছে। বেশিরভাগই এলোমেলো, তবে খ্রি.পূ. সপ্তম ও পঞ্চম সহস্রাব্দ নিয়েও দুটি তারিখ আছে। আর একটি প্রাচীন তারিখ আছে বিহারের পৈসরা থেকে—খ্রি.পূ. সপ্তম সহস্রাব্দে। এ ছাড়া মধ্যপ্রদেশে শোন উপত্যকায় বাঘের গ্রামের ২ নং প্রত্নতাত্ত্বিক অঞ্চলে এই পর্যায়ের তারিখ খ্রি.পূ. অষ্টম সহস্রাব্দ। সব মিলিয়ে বিক্ষিপ্ত কিছু তারিখ, এটা কিন্তু অস্বীকার করার উপায় নেই যে, ক্ষুদ্রপ্রস্তর যুগের সূত্রপাত ভারতবর্ষে যথাসময়েই হয়েছিল। বস্তুত, আমরা যেখানে ক্ষুদ্রপ্রস্তর যুগের সাক্ষ্য পুরো প্রাগিতিহাসের স্তর-পরম্পরায় পাই সেখানে এই যুগের তারিখ প্রাচীন না হওয়ার কথা আসে না। যেমন, পশ্চিমবঙ্গে পুরাপ্রস্তর যুগ শেষ হওয়ার পর পরই ক্ষুদ্রপ্রস্তর যুগের নিদর্শন পাওয়া যায়। তাই, এই অঞ্চল থেকে প্রত্যক্ষ তারিখ না থাকলেও ক্ষুদ্রপ্রস্তর যুগের সময় এখানে কম হতে পারে না। দক্ষিণ ভারতে তিউতিকোরিন অঞ্চলের যে ক্ষুদ্রপ্রস্তরযুগীয় নিদর্শনের দিকে আমরা দৃষ্টি আকর্ষণ করছি, সময়ের বিচারে তা প্রাচীন না হওয়ার কারণ নেই, কারণ এখানে এই যুগের চিহ্ন প্রাচীন সামুদ্রিক তটরেখার সঙ্গে জড়িত। কারও মতে এটি প্লাইসটোসিন যুগের শেষ পর্যায়েও হতে পারে।
ক্ষুদ্রপ্রস্তর যুগের নিদর্শন নিয়ে যে সমস্যা দেখা দিয়েছে তা হল যে সব নিদর্শনই প্রাচীন নয়। এবং শুধু হাতিয়ার দেখে প্রাচীন, অপ্রাচীন তফাত করা যায় না। এই জাতীয় হাতিয়ার লৌহযুগের সূত্রপাতেও ব্যবহার হত। শান্তিনিকেতনের কাছে কোপাই-এর ওপর রেলের পুল শান্তিনিকেতনের দিক থেকে পেরোবার সঙ্গে সঙ্গেই বাঁদিকে খ্রিস্টপূর্ব অষ্টম-নবম শতকের লৌহযুগ ও তৎপূর্ববর্তী তাম্রপ্রস্তর যুগের নিদর্শন মাটি খুঁড়ে বের করা হয়। বহুদিন পূর্বের (১৯৬৪) খননকার্যে, প্রান্তর পেরিয়ে আসা শোঁ শোঁ হাওয়া ছাড়া, বর্তমান লেখকের যা মনে আছে তা হল লোহার স্ল্যাগ (অর্থাৎ লোহা বানাবার সময় পড়ে থাকা মাটি মেশানো অংশ)-এর টুকরোগুলির পাশে ছড়ানো সাদা কোয়ার্টজ পাথরের বহু ছোট ছোট হাতিয়ার। পরে এই ধরনের সাক্ষ্য বহু জায়গা থেকেই এসেছে। আরও, গোলমেলে কথা হচ্ছে যে বাঁকুড়া-পুরুলিয়ায় কোথাও কোথাও দশম-একাদশ খ্রিস্টাব্দের মৃৎপাত্রের টুকরো ভর্তি মাটির স্তর থেকে এই ধরনের পাথরের হাতিয়ার পাওয়া যাচ্ছে। বৃষ্টির জলে গড়িয়ে দুই সময়ের জিনিস, একই স্তরে জমতে পারে। কাজেই মধ্য যুগের প্রথম পর্যন্ত ক্ষুদ্রপ্রস্তরযুগীয় হাতিয়ারের ব্যবহার ছিল, এটা জোর করে বলার আগে হয়তো আরও পরিষ্কার সাক্ষ্য দরকার, কিন্তু এর সম্ভাবনাও এড়িয়ে যাওয়া যায় না। তা ছাড়া, আন্দামান দ্বীপপুঞ্জে ঊনবিংশ শতাব্দী পর্যন্ত উপজাতীয়রা জাহাজডুবি থেকে পাওয়া কাচের বোতল ভেঙে ‘মাইক্রোলিথ’ বা ক্ষুদ্রপ্রস্তরযুগীয় হাতিয়ারের মতো জিনিস বানাতেন তার প্রত্যক্ষ বিবরণ আছে। অন্য দিকে অনেক প্রত্নতাত্ত্বিক স্তর থেকে ক্ষুদ্রপ্রস্তরযুগীয় হাতিয়ারের অনেক পরবর্তী তারিখ পাওয়া গেছে।
কাজেই, আমাদের মনে রাখতে হবে যে, ভারতবর্ষে ক্ষুদ্রপ্রস্তর যুগের নিদর্শন একদিকে যেমন সুপ্রাচীন অন্যদিকে সেই যুগের পাথরের হাতিয়ারের মতো হাতিয়ার বহু পরবর্তী সময় থেকেও পাওয়া যেতে পারে। শুধু মাটির ওপর ছড়িয়ে থাকা ‘মাইক্রোলিথ’ দেখে সেই ‘মাইক্রোলিথ’ সত্যিকার ক্ষুদ্রপ্রস্তর যুগের, এটা বলা প্রায় ক্ষেত্রেই অসম্ভব।
ভেবে দেখলে এটা কিছু অস্বাভাবিক ব্যাপার নয়। অনেক জায়গায় হয়তো ধাতুর ব্যবহার জানা থাকলেও দৈনন্দিন বহু কাজের জন্য পাথরের ‘মাইক্রোলিথ’ ব্যবহার সহজ ছিল। যেমন, বছর পঞ্চাশ আগেও অনেক দূর গ্রামাঞ্চলে গরিব মানুষ শুধু মৃৎপাত্রের ওপর নির্ভর করেই রান্নাখাওয়া করতেন। এটাও সেরকম কিছু কাজের জন্যে পাথরের ‘মাইক্রোলিথ’ বহুদিন পর্যন্ত ব্যবহৃত হয়ে এসেছিল। পাথরের হাতিয়ার, যদিও এই ক্ষেত্রে মাইক্রোলিথ নয়, খ্রিস্টীয় দশম অব্দ পর্যন্ত ব্যবহার হওয়ার প্রমাণ আছে। কালিঞ্জর দুর্গে প্রাপ্ত একটি মানুষের মূর্তির হাতে পরিষ্কার একটি পাথরের কুড়াল দেখানো আছে। বাংলাদেশের ময়নামতীতে বৌদ্ধবিহার খননের সময় বিহারের কক্ষ থেকে ফসিল কাঠের কুড়াল পাওয়া গেছে, যা পৃথকভাবে দেখলে সবাই নব্যপ্রস্তরযুগীয় বা নিওলিথিক কুড়াল বলবেন।
৩ কিছু বসতি কেন্দ্র
বিহারে, মুঙ্গের অঞ্চলে, খড়গপুর পাহাড়ে পৈসরার পুরাপ্রস্তর যুগের নিদর্শনের কথা প্রথম অধ্যায়ে বলা হয়েছে। বর্তমান অধ্যায়ে পৈসরার ক্ষুদ্রপ্রস্তরযুগীয় নিদর্শনের প্রাচীনত্বের দিকে দৃষ্টি আকর্ষণ করা হয়েছে।
এই ক্ষুদ্রপ্রস্তরযুগীয় বসতির চিহ্ন আসে পৈসরার খননকার্যের ‘বি’ এবং ‘এফ’ অঞ্চল থেকে। ‘বি’ অঞ্চলে হাতিয়ারের বাইরে বিশেষ কিছু পাওয়া যায়নি; এমনকী হাতিয়ারও কম পাওয়া গেছে। মূল নিদর্শন এসেছে ‘এফ’ অঞ্চল থেকে। ওপর থেকে ৬৫-৯০ সে.মি. নীচে এই বসতি স্তর। প্রায় ১০৫ বর্গমিটার জায়গা এখানে খোঁড়া হয়েছে। ইতস্তত ছড়ানো হাতিয়ার আর হাতিয়ার তৈরির নিদর্শন বাদ দিয়ে পৈসরার এই ক্ষুদ্রপ্রস্তরযুগীয় স্তরে যা পাওয়া যাচ্ছে তা আগুন জ্বালানোর চিহ্ন হিসেবে মাটিতে পোড়ার চিহ্ন, পোড়ানোর জন্য গর্ত বা নিচু ছড়ানো জায়গা, আর পুড়ে যাওয়া মাটির গোলা। কিছু জায়গায় পোড়া অংশের আশপাশ থেকে হাতিয়ার তৈরির বহু চিহ্ন পাওয়া গেছে। এ থেকে মনে হয় যে হাতিয়ার তৈরির আগে পাথর গরম করে নেওয়া হত। এটা অস্বাভাবিক ব্যাপার একেবারেই নয়। তবে যা উদ্বেগের কথা তা হচ্ছে পোড়া অংশগুলির সঙ্গে কোনও হাড়গোড়ের অবশিষ্ট জড়িত ছিল না; এ ছাড়া, অস্থায়ী হলেও, কোনও আশ্রয়ের চিহ্ন এখানে পাওয়া যায়নি। অনুমান করা হয়েছে যে, পৈসরায় ক্ষুদ্রপ্রস্তর যুগের বসতি স্বল্পকালের জন্য ছিল।১
বাঁশ বা কাঠের সরু এবং অগভীর করে পোঁতা খুঁটির চিহ্ন এসেছে মধ্যপ্রদেশের সিধি জেলার বাঘোর গ্রামের ২ নং প্রত্নতাত্ত্বিক অঞ্চল থেকে যেখানে একটি খ্রি.পূ. অষ্টম সহস্রাব্দের ক্ষুদ্রপ্রস্তরযুগীয় বসতি খোঁড়া হয়েছে। এ ছাড়া আগুনের চিহ্ন পাওয়া গেছে। এই কেন্দ্রের আর একটি গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার হচ্ছে যে, এখানে বেশ কিছু পাথরের খণ্ড পাওয়া গেছে যেগুলি পেষাইয়ের কাজে ব্যবহার করা হয়েছে বলে ধারণা করা যায়। এ ছাড়া পাথরেরই দুটো গোল চাকতি জাতীয় জিনিস পাওয়া গেছে। কোনও ছিদ্র নেই, তবে দু পাশই ঘষে, সমতল করা। কয়েক টুকরো গেরুমাটিও এই স্তরে পাওয়া গেছে। তা ছাড়া ক্ষুদ্রপ্রস্তরযুগীয় হাতিয়ার বা মাইক্রোলিথ তো আছেই। খুঁটির গর্তের ছাপ যেভাবে ছড়ানো ছিটানো অবস্থায় পাওয়া গেছে তা থেকে অনুমান করা হয়েছে যে, অন্তত পাঁচটি অস্থায়ী আশ্রয় ছিল এখানে। ক্ষেতে পশুপাখি তাড়ানোর জন্য অনেক সময় তোক থাকার জন্য অস্থায়ী একধরনের আশ্রয় বানানোর উদাহরণ এখনও কোনও কোনও অঞ্চলে দেখতে পাওয়া যায়। হয়তো এরকম ধরনের কোনও আশ্রয় ছিল। এই আশ্রয়গুলি যেখানে যেখানে খুঁটির দাগ থেকে অনুমান করা হয়েছে তার সঙ্গে সঙ্গে পাথরের ছোট ছোট টুকরোও বেশি পরিমাণে ছড়ানো পাওয়া গেছে। হয়তো আশ্রয়গুলির মেঝেতে পাথরের টুকরো বিছানো হয়েছিল। বাঘোর ২ নং অঞ্চলের ক্ষুদ্রপ্রস্তরযুগীয় স্তরে কিছু আগুনের চিহ্নও পাওয়া গেছে। তবে, এই স্তরের একটি আকর্ষণীয় সাক্ষ্য হচ্ছে একটি সম্বর হরিণের সামনের পায়ের একটি ও পেছনের দুটি পায়েরই দাগ অর্থাৎ হরিণটির ক্ষুরের ৩টি দাগ। উত্তর-পূর্ব দিক বরাবর সম্বরটি হেঁটে যাচ্ছিল; অনুমান করা যায় তখন এই বসতিটিতে কেউ ছিল না।২
পাথরের ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র হাতিয়ার ব্যবহার করা সংস্কৃতি পর্যায় যে খুব সহজে লোপ পেয়ে যায়নি—পরবর্তী বিভিন্ন যুগেও সাক্ষ্য রেখে গেছে—এর ভাল প্রমাণ পাওয়া গেছে রাজস্থানে ভিলওয়াড়া জেলায় বাগোর (মধ্যপ্রদেশে স্থানটির নাম বাঘোর; রাজস্থানে বাগোর—এই তফাতটি মনে রাখা দরকার, নইলে দুটি নামই এক হয়ে যাবে!) গ্রামের উপকণ্ঠে কোঠারি নামক একটি ছোট নদীর পাশে বালিয়াড়ির এক ঢিবিতে। টিবিটি উচ্চতায় ৬ মি. ও দৈর্ঘ্য-প্রস্থে ২০০ × ১৫০ মি.। এর মাঝখানে ২০ × ১০ মি. জায়গায় মূল খননকার্য করা হয়। তিনটি পর্যায়ের বসতি স্তর এখানে পাওয়া গেছে: প্রথম পর্যায় খ্রি.পূ. ষষ্ঠ সহস্রাব্দের মাঝামাঝি থেকে চতুর্থ সহস্রাব্দের সূত্রপাত পর্যন্ত; দ্বিতীয় পর্যায় এর পর থেকে তৃতীয় সহস্রাব্দের প্রথম এবং আরও পর পর্যন্ত ও তৃতীয় পর্যায় বোধহয় ঐতিহাসিক কালের। খননকারকের তারিখ ছিল: প্রথম পর্যায় খ্রি.পূ. ৫০০০-২৮০০; দ্বিতীয় পর্যায় খ্রি. পূ. ২৮০০-৬০০; তৃতীয় পর্যায় খ্রি. পূ. ৬০০ থেকে ২০০ খ্রিস্টাব্দ। রেডিওকার্বন তারিখগুলির নতুন বিশ্লেষণে আমরা যে তারিখ দিয়েছি মোটামুটি তাই গ্রহণযোগ্য। এটুকু মনে রাখলে যথেষ্ট হবে যে বাগোরে ক্ষুদ্রপ্রস্তরযুগীয় বসতির সুত্রপাত খ্রি.পূ. ষষ্ঠ সহস্রাব্দের মাঝামাঝি পর্যন্ত হতে পারে, আর এর শেষ হয়তো খ্রিস্টীয় দ্বিতীয়-তৃতীয় শতকে এসে থেমেছে।
বাগোর খননকার্যে কয়েক লক্ষ পাথরের ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র হাতিয়ার আর তা বানানোর নিদর্শন পাওয়া গেছে। বসতির সর্বত্রই এই নিদর্শন ছড়িয়ে আছে; তাই মনে করা যায় যে এর সর্বত্রই এই হাতিয়ারগুলি তৈরি করা হত, আর যাঁরা থাকতেন তাঁরা নিজেদের প্রয়োজনমতো হাতিয়ার বানিয়ে নিতেন। সংখ্যায় সবচেয়ে বেশি নিদর্শন পাওয়া গেছে প্রথম পর্যায়ে; সর্বমোটের প্রায় অর্ধেক। চল্লিশ রকমের হাতিয়ার। সবকটিই ছোট ছোট লম্বাটে চিলকা থেকে বানানো। বড় চিলকার ওপর বানানো হাতিয়ার কম। কোনও কোনও হাতিয়ার ৪০ মিলিমিটার পর্যন্ত লম্বা, কিন্তু বেশিরভাগই দৈর্ঘ্যে ১৫ থেকে ২০ মিলিমিটার—৫ থেকে ১০ মিলিমিটারের নিদর্শনও আছে। কোয়ার্টজ পাথর ও চার্ট জাতীয় পাথর দুই-ই ব্যবহার করা হয়েছে; এর ভেতর কোয়ার্টজ পাথরের সংস্থান বসতিটির খুব কাছেই ছিল। এত সময় জুড়ে বসতিটি ছিল; কিন্তু বিভিন্ন পর্যায়ে হাতিয়ারের ধরনে বিশেষ পরিবর্তন ধরা পড়েনি।
প্রথম ও দ্বিতীয় পর্যায়ে বসবাসের একটা গুরুত্বপূর্ণ নিদর্শন হল কিছু বড় পাথরের চত্বর। এই চাতালগুলি বানানো হয়েছিল নদীর ওপার থেকে পাথরের চওড়া টুকরো এনে আর কখনও কখনও এই টুকরোগুলির মাঝখানে নুড়ি দিয়ে ভরাট করে। কিছু কিছু চত্বর প্রায় ২০০ বর্গমিটার জায়গা জুড়ে। কোথাও কোথাও দেখা যাচ্ছে, পাথরের টুকরোগুলি গোল করে সাজানো—৩ থেকে ৫ মিটার ব্যাস নিয়ে। পাতা ইত্যাদি দিয়ে তৈরি গোল ঝুপড়ির চারপাশে পাথর সাজিয়ে চাপা দিয়ে ঝুপড়িগুলিকে একটু মজবুত করা হত—এরকম সম্ভাবনা প্রবল। কোথাও কোথাও ৪০ থেকে ৭০ সে.মি. চওড়া গোলাকার জায়গা পাথর দিয়ে বেদি মতো করা। এদের চারপাশে জন্তুজানোয়ারের হাড় বেশি পাওয়া যাচ্ছে, আর তাই থেকে অনুমান করা যায় যে, এই গোলাকার বেদিগুলিতে মাংস কাটা হত। যদিও বহু পুড়ে যাওয়া হাড় পাওয়া গেছে, তবু কোনও চুলা-জাতীয় নির্দশন পাওয়া যায়নি। একেবারে শেষের, অর্থাৎ ঐতিহাসিক পর্যায়ে, টুকরো টুকরো পোড়ানো ইট ও টালির নিদর্শন পাওয়া যায়। এই পর্যায়ে ৩ মি. লম্বা ও ১ মি. চওড়া, পাথরের টুকরো সাজিয়ে বানানো একটি দেয়ালও পাওয়া গেছে।
সব মিলিয়ে খননকার্যে পাঁচটি কবর পাওয়া গেছে। প্রথম পর্যায়ে একটি; দ্বিতীয় পর্যায়ে তিনটি ও তৃতীয় পর্যায়ে একটি। সব কটি কবরই পাওয়া গেছে বসতির ভেতর। প্রথম পর্যায়ের কবরটি এইরকম: বাঁ হাতের নীচের দিক শরীরের ওপর রাখা কিছুটা; মাথা পশ্চিম দিকে শোয়ানো। কাছাকাছি পাওয়া কিছু হাড়গোড় মৃতের সঙ্গে দেওয়া মাংসের চিহ্ন হতে পারে। দ্বিতীয় পর্যায়ের শরীরগুলি মাথা পুব দিকে রেখে কিছুটা কুঁকড়ে শোয়ানো—হাত আর পা ঘুমন্ত অবস্থার মতো ভাঁজ করা। সঙ্গে খাবার ভরা অনেক মৃৎপাত্র দেওয়া হয়েছিল, তা ছাড়া মাংসের বড় টুকরো, গয়না এবং তামার জিনিস। উদাহরণ হিসেবে বলা যায় যে, একটি কবরে মাথার কাছে আর শরীরের বাঁদিকে রাখা আটটি মৃৎপাত্র ছিল; দুটি তামার তীর শরীরের বাঁদিকে রাখা; এর ভেতর একটি আবার বাঁ হাতের নীচের দিকের ওপর রাখা। শরীরের কাছে একটি বড় জন্তুর পায়ের মূল হাড়; অর্থাৎ কবরের সময় জানোয়ারটির পায়ের দিকের মাংসের বড় টুকরো দেওয়া হয়েছিল। আর একটি করে পায়ের দিকে ও শরীরের বাঁদিকে রাখা চারটি মৃৎপাত্র; মাথার দিকে একটা তামা দিয়ে তৈরি বল্লম, একটা তামারই তীর, আর তলপেটের নীচে কাজলজাতীয় জিনিস লাগাবার সরু তামার জিনিস। এ ছাড়া পায়ের দিকে পোড়ামাটির একটি সুতোকাটা তকলি। গলা ও বুকের ওপর ছড়ানো ৩৬টি পাথরের আর হাড়ের পুঁতি; মৃতের মালার চিহ্ন। মালাটি মূতের সঙ্গেই দেওয়া হয়েছিল। তৃতীয় কবরটি ৮ থেকে ১০ বছরের কোনও বাচ্চার— মাথার কাছে শুধু একটা মৃৎপাত্র রেখে দেওয়া হয়েছিল। তৃতীয় পর্যায়ের কবরটিতে অর্থাৎ ঐতিহাসিক পর্যায়ের কবরটিতে শরীর চিত হয়ে আছে, মাথা উত্তর দিকে দিয়ে উত্তর-দক্ষিণে শোয়ানো; গলায় লোহার একটা কবচের মত জিনিস। আর কিছু নেই।
এখানে উল্লেখ করা যেতে পারে যে, প্রথম পর্যায়ের কবরটি একটি পূর্ণবয়স্কা মহিলার, তৃতীয় পর্যায়ের কবরটিও একটি পূর্ণবয়স্কা মহিলার, আর দ্বিতীয় পর্যায়ে ৩টি কবরের ভেতর একটি বাচ্চার, একটি পূর্ণবয়স্ক পুরুষের, আর একটি পূর্ণবয়স্কা কোনও মহিলার।
প্রথম পর্যায়ে পাথরের (অ্যাগেট, কার্নেলিয়ান এবং গার্নেট পাথর) মাত্র কয়েকটি পুঁতি পাওয়া গেছে। দ্বিতীয় পর্যায়ে এই ধরনের পুঁতি সংখ্যায় বেশি। তৃতীয় পর্যায়ে কাচের পুঁতি ও পাথরের তৈরি পেনডান্ট পাওয়া গেছে। গেরুমাটির টুকরো সব পর্যায়েই আছে। অবশ্যই কোনও অলংকরণের কাজে ব্যবহার হত। কিছু পাথরের জিনিস, মাইক্রোলিথ ছাড়া, সব পর্যায়েই আছে; তবে প্রথম পর্যায়ে পাওয়া যাওয়ার গুরুত্বটা বেশি। প্রথমত, মাইক্রোলিথ তৈরিতে পাথর ভাঙা এবং জন্তুজানোয়ারের হাড়গোড় ভাঙার কাজে লাগতে পারত এরকম অনেক পাথর আছে। এগুলি যে এরকম কাজে ব্যবহার হয়েছে তার দাগও পাওয়া গেছে এদের ওপর। কিছু একেবারে গোলাকৃতি নুড়ি পাথর হয়তো গুলতির গোলা হিসেবে ব্যবহার হত। পেষাই এর কাজে ব্যবহার হত এরকম দু ধরনের পাথরই (অর্থাৎ ‘শিল’ জাতীয় জিনিস এবং বাটনা বাটার উপযুক্ত জিনিস) আছে। দ্বিতীয় পর্যায়ে, ছিদ্র করা অপেক্ষাকৃত বড় ও ভারী পাথর পাওয়া গেছে। এই ধরনের পাথর কোনও ছুঁচলো লাঠিতে লাগিয়ে তাকে ভারী করে বীজ পোতার গর্ত করার জন্য ব্যবহার হত। ‘ঝুম’ চাষ, অর্থাৎ জঙ্গল পুড়িয়ে গাছের গোড়া ইত্যাদি তুলে নিয়ে বীজ বুনে যে চাষ, সেই চাষের কাজে বীজ বোনার গর্ত হত। দ্বিতীয় পর্যায়ে পোড়ামাটির তকলি কাটার জিনিসও পাওয়া গেছে। সুতো তৈরির পরোক্ষ সাক্ষ্য এটা। কী খাওয়া হত তার প্রত্যক্ষ প্রমাণ শুধু জন্তুজানোয়ারের হাড়গোড়। প্রথম পর্যায়ে হাড়গোড় সংখ্যায় খুব বেশি, দ্বিতীয় পর্যায়ে অপেক্ষাকৃত কম, তৃতীয় পর্যায়ে বেশ কম। বেশিরভাগই পোড়ানো এবং ভাঙা; অর্থাৎ আগুনে পুড়িয়েই মাংস খাওয়া হত এবং হাড়ের ভেতরের অংশটুকুর জন্য তা ভেঙে নেওয়া হত। হাড়ের প্রকৃতি বিশ্লেষণ করে জানা গেছে এগুলি গরু, ভেড়া ও ছাগল, দুরকম হরিণ, শুয়োর, শেয়াল, ইঁদুর, নদীর কাছিম এবং গোসাপের অংশ। শেয়াল বসতির আশেপাশে থাকত, আর অন্যগুলি খাওয়া হত। এ ছাড়া মাছের প্রমাণও আছে। ভেড়া ও ছাগলের হাড় দেখে বোঝা যাচ্ছে এগুলি গৃহপালিত বা পোষ মানানো; গরু, বুনো ও গৃহপালিত দুই-ই।
বাগোরের দ্বিতীয় পর্যায়ে মৃৎপাত্রও যথেষ্ট পরিমাণে পাওয়া যাচ্ছে। কিন্তু বর্তমান অধ্যায়ে বাগোরের প্রথম পর্যায়ই ক্ষুদ্রপ্রস্তরযুগীয় সাক্ষ্য হিসেবে গুরুত্বপূর্ণ। সব মিলিয়ে এই পর্যায়ের যে ছবি আসে তা এই: বৃষ্টিপাত অপেক্ষাকৃত কম হয় এবং আশপাশের জমি কিছু পাথুরে, কিছু উর্বর, বাবলা, ঢাক অথবা পলাশ, বুনো কুল ইত্যাদির গাছে ভরা। একটি অঞ্চলে স্থানীয় একটি ছোট নদীর ধারে একটি বালিয়াড়িতে কিছু লোক বসতি করেছিল। বালিজমিতে বসতি করার অর্থ এই যে কাদা হবে না কখনও। পাথর বিছিয়ে জায়গাটা আরও শুকনো রাখা; লতাপাতা গাছ-গাছড়া দিয়ে ঝুপড়ি, চারপাশে পাথর চাপা দিয়ে রাখা। বাইরে উঠোনে কোথাও কোথাও পাথর দিয়েই বেদি করা, যার ওপর হয়তো মৃত জন্তুজানোয়ারদের রেখে তা কাটা হত। হাতিয়ার বলতে বহুরকম ছোট ছোট পাথরের জিনিস; তীর আর ধারালো ‘ব্লেড’, আর ‘ব্লেড’ দিয়েই তৈরি বহু জিনিস। কিছু গরু, আর ভেড়া-ছাগল পোষ মানানো ছিল। যদিও আরও কিছু গরু বুনো ছিল; তা ছাড়া, অন্য বুনো জানোয়ার, যথা হরিণ, শুয়োর ইত্যাদি। নদীর মাছ, মহিষও খাওয়া হত। ভিলওয়াড়া অঞ্চলে ৩০ বছর আগেও হরিণের পাল চরতে দেখা যেত; খাবারের অভাব খ্রি. পূ. ষষ্ঠ সহস্রাব্দের এই মানবগোষ্ঠীর ছিল না—এটা সহজেই মানা যেতে পারে। উদ্ভিজ্জ জিনিসও যে খাওয়া হত তার প্রত্যক্ষ প্রমাণ পেষাই। বাটনার কাজে ব্যবহার করা যেত এমন পাথর। এই পর্যায়ে চাষবাসের কোনও প্রশ্ন আসে না, কিন্তু বুনো শস্য সংগৃহীত হওয়াতে কোনও অসুবিধে ছিল না। মৃতকে কবর দেওয়া হত; পাথর দিয়ে পুঁতির মালাও ছিল। গেরুমাটির টুকরোও যখন আছে তখন অলংকরণও ছিল।
বাগোরের দ্বিতীয় পর্যায়ে তামার ব্যবহার ছিল, মৃৎপাত্র ছিল, বীজ পোঁতার গর্তের জন্য ছুঁচলো লাঠি ভারী করার জন্য পাথর ভরা ছিল, তকলিতে সুতো কাটাও হত। স্পষ্টতই মুদ্রপ্রস্তর যুগের ভেতরে এই পর্যায় পড়ে না—এর সময় অনেক পরে— খ্রি. পূ. চতুর্থ সহস্রাব্দের শেষের দিকে অথবা দ্বিতীয়ভাগে। অথচ, এখানে ক্ষুদ্রপ্রস্তর যুগের ধারা অব্যাহত। সেই পাথরের ছোট ছোট হাতিয়ার, সেই রকমেরই থাকার জায়গা, সেই রকমেরই শিকার করার জানোয়ার, কিছু গরু আর ভেড়া-ছাগল সেরকমই পোষ মানানো। মৃতকে কবর দেওয়ার প্রথাও থেকে গিয়েছিল। তৃতীয় পর্যায়েও ধারাটা রয়ে গেছে, যদিও ততদিনে ভিলওয়াড়ার এই অঞ্চল ঐতিহাসিক যুগের ভিতর। এই ক্ষুদ্রপ্রস্তর যুগের ধারার ক্রমান্বয়তা থেকে বোঝা যায় শুধু ক্ষুদ্রপ্রস্তরযুগীয় হাতিয়ার মিললেই অনুমান করা যায় না যে, এটা সত্যকার ক্ষুদ্রপ্রস্তরযুগীয় এবং পরবর্তী ধারার অংশ নয়। যদিও ভারতবর্ষে অগুনতি জায়গায় ‘মাইক্রোলিথ’ পাওয়া যায়, আমরা জানি না তার কতভাগ সুপ্রাচীন, আর কতভাগ পরবর্তী যুগের। একবার একটা জীবনধারা গড়ে উঠলে এবং প্রকৃতির সঙ্গে যদি তা খাপ খেয়ে যায় তবে সেই জীবনধারা সহজে সম্পূর্ণ পালটায় না। বাগোরে যেমন ক্ষুদ্রপ্রস্তরযুগীয় জীবনধারা বহুদিন অবলুপ্ত হয়নি।৩
বাগোর ধরনেরই সাক্ষ্য এসেছে উত্তর গুজরাটের লংঘনাজ কেন্দ্র থেকে। গুজরাটের এই অঞ্চল দিয়ে সবরমতী, মাহি, ওরসাং ইত্যাদি নদী প্রবাহিত। অঞ্চলটিতে পুরনো বালিয়াড়ি প্রচুর, আর এই বালিয়াড়িগুলির মাঝখানে বৃষ্টির জল জমে গড়ে ওঠে জলাশয়। দেখা গেছে যে, অন্তত তৃতীয় সহস্রাব্দের সময় থেকে এই অঞ্চলটি ‘মাইক্রোলিথ’ অথবা পাথরের ছোট ছোট হাতিয়ার ব্যবহারকারী জনগোষ্ঠীর প্রিয় ছিল। তাদের বহু বসতির নিদর্শন এই অঞ্চলে পাওয়া গেছে। মূল খননকার্যটি হয়েছে লাংঘনাজ নামক জায়গায়। প্রথম পর্যায়ে দেখা যাচ্ছে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র পাথরের হাতিয়ার, অল্প-পোড়ানো মৃৎপাত্রের ছোট ছোট টুকরো, গণ্ডার, নীলগাই, তিন রকম হরিণ ইত্যাদি। গরু, ভেড়া-ছাগল পাওয়া যাচ্ছে না। গণ্ডারের কাঁধের দিকের একটি বড় হাড়ের টুকরো পাওয়া গেছে, যার ওপর পাথর রেখে হাতিয়ার বানানো হত। পরবর্তী পর্যায়ে পাথরের হাতিয়ারের সঙ্গে একটি তামার ছুরি, বীজ পোঁতার গর্ত করার কাজে লাগা ছুঁচলো লাঠির ছিদ্র করা পাথর এবং কালো-লাল মৃৎপাত্র পাওয়া গেছে। তৃতীয় পর্যায় বাগোরের মতো ঐতিহাসিক পর্যায়ের ও এই সময় পাথরের হাতিয়ারের সঙ্গে লোহার ব্যবহারও দেখা যাচ্ছে। সব মিলিয়ে ১২/১৩টি কবর পাওয়া গেছে; কোনটা কোন পর্যায়ের হিসেব মেলানো লংঘনাজের ক্ষেত্রে সোজা নয়। মাথা পূর্ব দিকে রেখে পূর্ব-পশ্চিমে শোয়ানো শরীর। মৃতের সঙ্গে এক ক্ষেত্রে দেখা যাচ্ছে একটি নেকড়েকেও কবর দেওয়া হয়েছে; আর এক ক্ষেত্রে সামুদ্রিক খোলা দিয়ে বানানো পুঁতি। সমুদ্র যেহেতু উত্তর গুজরাট থেকে খুব কাছে নয়, সামুদ্রিক খোলা (‘ডেনটালিয়াম শেল’) দিয়ে বানানো পুঁতিটি তাই আদানপ্রদানের মাধ্যমে বাণিজ্যিক সূত্রে এসেছিল বলে মনে করা যেতে পারে।৪
দুঃখের কথা যে, বেশির ভাগ জায়গাতেই ক্ষুদ্রপ্রস্তরযুগীয় স্তরে খননকার্য করা হয়নি; কোথাও কোথাও খননকার্য করে তারিখ পাওয়া গেছে অনেক পরবর্তী কালের। মির্জাপুরে লেখাহিয়া গুহাশয়ে খনন করে যেমন তারিখ এসেছে খ্রি. পূ. দ্বিতীয় সহস্রাব্দ ও পরের। মির্জাপুরেরই বাঘাইখোর নামক আর একটি আশ্রয় থেকে তারিখ পাওয়া গেছে খ্রিস্টীয় পঞ্চদশ শতকের। যে প্রাপ্ত নিদর্শনের ওপর তারিখ করা হয় তাতেও গোলমাল থাকতে পারে। তবে, একটি প্রাচীন সাক্ষ্য এসেছে মধ্যপ্রদেশে আদমগড় থেকে। এখানে ক্ষুদ্রপ্রস্তরযুগীয় স্তরে খনন করে আনুমানিক ২৫০০০ মাইক্রোলিথ ছাড়া পাওয়া গেছে পোষা কুকুর, গরু, মোষ, ভেড়া-ছাগল আর শুয়োর। বুনো জন্তুর ভেতর গোসাপ, সজারু, ঘোড়া, বিভিন্ন ধরনের হরিণ আর খরগোস। একটি তারিখ খ্রি.পূ. সপ্তম সহস্রাব্দের গোড়ায়; আরেকটি তারিখ অনেক পরের। প্রথমটি সত্য না হওয়ার কোনও কারণ নেই।৫
ক্ষুদ্রপ্রস্তরযুগীয় জীবনযাত্রার বিস্তৃত সাক্ষ্য এসেছে মধ্য গাঙ্গেয় উপত্যকা থেকে। অন্তত তিনটি কেন্দ্রের সাক্ষ্য বিস্তৃতভাবে আলোচনা করা যেতে পারে: চোপানি-মান্ডো, সরাই নাহার রাই ও মহাদহা। তিনটি কেন্দ্রের ওপরই পূর্ণাঙ্গ বিবরণ রয়েছে। সব কেন্দ্রের ক্ষেত্রে তা নেই, যেমন বাগোর ও আদমগড়ের বেলায় খননকার্যকারীরা পূর্ণাঙ্গ বিবরণ প্রকাশ করেননি। মধ্য গাঙ্গেয় উপত্যকার কয়েকটি জেলায়—যথা এলাহাবাদ, প্রতাপগড়, জৌনপুর, সুলতানপুর ও বারাণসী— ক্ষুদ্রপ্রস্তরযুগীয় এবং তার একটু আগের নিদর্শন ছড়িয়ে আছে। ১৯৮০-তে প্রকাশিত একটি বিবরণে এই জেলাগুলিতে এই ধরনের সাক্ষ্য ১৯৮টি জায়গায় পাওয়া গেছে। গঙ্গার পুরনো পলিমাটির নাম স্থানীয়ভাবে ভাংগর। বস্তুত ভাংগরের সবচেয়ে ওপরের স্তরের সবটা জুড়েই ক্ষুদ্রপ্রস্তরযুগীয় এবং তৎপূর্ববর্তী নিদর্শন পাওয়া যায়। অর্থাৎ, এই অঞ্চলে এই সময়েই প্রাগৈতিহাসিক মানুষেরা গঙ্গা উপত্যকায় ছড়িয়ে পড়তে আরম্ভ করেছিল; অন্তত উপত্যকার এই অঞ্চলে। ক্ষুদ্রপ্রস্তর যুগের পূর্ববর্তী সাক্ষ্য এখন পর্যন্ত খুব সীমিত কেন্দ্রে পাওয়া গেছে। এই সাক্ষ্য উচ্চ পুরাপ্রস্তর যুগ আর ক্ষুদ্রপ্রস্তর যুগের মাঝামাঝি; এর হাতিয়ার আকৃতিতে উচ্চ পুরাপ্রস্তরযুগীয়, হাতিয়ারের চাইতে ছোট, কিন্তু ক্ষুদ্ৰপুরাপ্রস্তরযুগীয় হাতিয়ারের চাইতে বড়। এই স্তরটিকে ইংরাজিতে বলা হয় ‘এপি-প্যালিওলিথিক’। তবে এটা যে সব জায়গায় পেতে হবে তার কোনও অর্থ নেই। উচ্চ পুরাপ্রস্তর যুগের সঙ্গে এটা জুড়ে দিলেও কোনও ক্ষতি হয় না। প্রতাপগড়, বারাণসী আর এলাহাবাদ জেলার ৫টি জায়গায় পূর্বোল্লিখিত বিবরণ অনুযায়ী এই স্তরের নিদর্শন পাওয়া গেছে, তবে এই জেলাগুলিতে নিশ্চয় আরও এই নিদর্শন পাওয়া যাবে।
চোপানি-মান্ডো কেন্দ্রটি বর্তমান এলাহাবাদ শহরের ৭৭ কি.মি. পূর্ব-উত্তরপূর্বে, এলাহাবাদ জেলার মেজা মহকুমায় বেলান নদীর একটি পুরনো খাতের বাঁকে। এই খাত ১৫০ মি. বিস্তৃত আর প্রস্থে ১০০ মি.। বেলান উপত্যকা এলাহাবাদ জেলার ভেতর হলেও ঠিক গাঙ্গেয় উপত্যকার ভেতর নয়। এখান থেকেই বিন্ধ্যের বাঘেলখণ্ড অঞ্চলের সূত্রপাত বলা যায়। ১,৫০,০০০ বর্গ মি. কেন্দ্রটির ৬৮০ বর্গ মি. জায়গায় খননকার্য করা হয় এবং মোট ১.৫৫ মি. গভীরতায় নিম্নরূপ পর্যায়ক্রম পাওয়া যায়: (১) এপি-প্যালিওলিথিক বা উচ্চ পুরাপ্রস্তর যুগের একেবারের শেষ পর্যায়; (২) আদি ক্ষুদ্রপ্রস্তরযুগীয় পর্যায় ১ ও ২ এবং (৩) উচ্চ ক্ষুদ্রপ্রস্তরযুগীয় পর্যায়। পাথরের বিভিন্ন হাতিয়ার সব পর্যায়েই যথেষ্ট পরিমাণে পাওয়া গেছে; তবে এই হাতিয়ার ছাড়া যা পাওয়া গেছে সাংস্কৃতিক দিক থেকে তা বেশি আকর্ষক।
কুটির যে ছিল তার প্রমাণ আদি ক্ষুদ্রপ্রস্তরযুগীয় পর্যায় ১-এ প্রথম পাওয়া যাচ্ছে। একটি কুটির পুরো খোঁড়া হয়েছে। তার ব্যাস ৩.৮০ মি., মেঝের চারপাশ ধরে ১২টি খুঁটির দাগ। দুটো খুঁটির মাঝে ব্যবধান ৭০ সে.মি. থেকে ১ মি.। ১০ থেকে ২০ সে.মি. ব্যাসের খুঁটি। আর একটি কুটিরের মেঝেতে পাথরের টুকরো ছড়ানো ছিল। সব জায়গাতেই ক্ষুদ্রপ্রস্তরযুগীয় হাতিয়ার এবং হাতিয়ার তৈরির উপকরণ পাওয়া গেছে। আদি ক্ষুদ্রপ্রস্তরযুগীয় পর্যায় ২ থেকে কয়েকটি কুটিরের নিদর্শনই পাওয়া গেছে। একটির ব্যাস ৩ মি.; চারপাশ ঘিরে পাথরের টুকরো ছড়ানো। অন্য কুটিরগুলিতে এবং হয়তো এই কুটিরটিতেও হাতিয়ার, হাতিয়ার তৈরির পাথর, ভগ্ন নিদর্শন ছোট হাড়ের টুকরো, বেতজাতীয় গাছ-গাছড়ার ছাপমারা পুড়ে যাওয়া মাটির টুকরো ছড়ানো পাওয়া গেছে। ছাইমাটি বোঝাই একটি উনুনও পাওয়া গেছে। খুঁটিগুলো ৫০ সে.মি. থেকে ১ মি. দূর দূর বিন্যস্ত—এদের ব্যাস ১০ থেকে ১৫ সে.মি.।
সবচাইতে বেশি কুটিরের নিদর্শন পাওয়া গেছে চোপানি-মান্ডোর তৃতীয় পর্যায়ে অথবা ক্ষুদ্রপ্রস্তর যুগের শেষ ভাগে। এদের ভেতর কিছু কুটির গোল আর কিছু ডিম্বাকৃতি। গোলগুলির ব্যাস ৩.৫ মি. আর ডিম্বাকৃতিগুলি গড়পড়তা লম্বায় ৪.৭ মি. আর চওড়ায় ৩.৩ মি.। কিছু কুটিরের চারপাশ ঘিরে বড় বড় প্রস্তরখণ্ড রাখা আছে। মেঝেতে হাতিয়ার, প্রস্তরখণ্ড ইত্যাদি প্রচুর ছড়ানো আছে। এ ছাড়া পাওয়া যাচ্ছে অগুনতি হাতুড়িজাতীয় আর নিহাইজাতীয় কাজে ব্যবহৃত হতে পারে এমন বিভিন্ন মাপের পাথর, গুলতিতে ব্যবহৃত হতে পারে এমন পাথরের গোলা, পেষাইয়ের কাজে লাগার মতো পাথর, পুড়ে যাওয়া মাটির চাকলা, হাড়ের টুকরো এবং মৃৎপাত্রের টুকরো। অন্তত দুটি ক্ষেত্রে বেশ বড় নিহাইয়ের পাথর পাওয়া গেছে। এখানে দাগ লক্ষ করলে পরিষ্কার বোঝা যায় যে, চারদিকে মানুষ বসে একই সঙ্গে পাথর ভেঙেছে। একটা নিহাইয়ের ওপরে একটা হাতুড়ি-পাথরও পাওয়া গেছে, আর তার চারপাশে হাতিয়ার তৈরির নিদর্শন ছড়ানো। কুটিরের বাইরে উঠোনে অন্তত চারটি গোল চুলা পাওয়া গেছে। এদের ব্যাস ৮০ সে.মি. থেকে ১ মি., আর গভীরতার গড় ৪০ সে.মি.। পোড়ামাটির টুকরো, ছাইমাটি ইত্যাদি এই চুলাগুলিতে ছড়িয়ে আছে। কুটির এবং চুলা বাদ দিয়ে, কুটিরগুলির বাইরে গোল অথবা ডিম্বাকৃতি পাথর দিয়ে বানানো ৭০ থেকে ৩০ সে.মি. ব্যাসের বেদি জাতীয় চিহ্ন পাওয়া গেছে, এদের চারপাশে বাঁশজাতীয় উদ্ভিদের দাগবিশিষ্ট মাটির পোড়া টুকরো দেখে অনুমান করা হয়েছে যে এই সমস্ত বেদির ওপর বাঁশ ইত্যাদি দিয়ে গোলাজাতীয় জিনিস তৈরি হত, যেখানে শস্য বা অন্য কিছু রাখা যেতে পারে।
এখানে আরও একটি জিনিস লক্ষ করার মতো। যতগুলি কুটিরের চিহ্ন ততগুলি চুলা বাইরের উঠানে নেই। কয়েকটি কুটিরের জন্য একটি চুলা ছিল। মৃৎপাত্র যা পাওয়া গেছে তা হাতে বানানো, ভালভাবে পোড়ানো নয় এবং সহজেই টুকরো টুকরো হয়ে যাওয়া। যে আকৃতি পাওয়া যায় তা বাটি ও ঘটির মতো। বীজ পোঁতার ছুঁচলো খুঁটিতে লাগানোর মতো ছিদ্রযুক্ত পাথরও পাওয়া গেছে এই পর্যায়ে।
চোপানি-মান্ডোতে খননকার্যে পাওয়া সর্বমোট ৪,৬২৪ হাড়ের টুকরোর ভেতর ৪,৪৫৫ টুকরোই তৃতীয় অর্থাৎ সবচাইতে শেষের পর্যায়টিতে পাওয়া। এদের ভেতর গরু ও ভেড়া অথবা ছাগলের উপস্থিতি নির্ণয় করা গেছে। শেষের পর্যায়টিতেই পোড়ানো অথবা পুড়ে যাওয়া চারটি মাটির টুকরোতে পুড়ে যাওয়া ধানের অবশিষ্টাংশ পাওয়া গেছে। এগুলিকে বুনো ধান বলে চিহ্নিত করা হয়েছে। একটিমাত্র পাথরের পুঁতি পাওয়া গেছে শেষ পর্যায়ে, আর বাঁশ/বেত জাতীয় উদ্ভিদের ছাপ লাগা পোড়ামাটির চাকলা দেখে মনে হয় যে, কুটিরগুলির লতাপাতা ইত্যাদি দিয়ে তৈরি দেওয়াল যদি পুড়ে যায় তবে তার টুকরোতে এই সমস্ত লতাপাতার দাগ থাকবে।৬
প্রতাপগড় জেলার পাও মহকুমার মহাদহা (অথবা মহাদহ) প্রতাপগড় শহর থেকে ৩১ কিমি. উত্তর-পূর্বে। এখানে মনে রাখা ভাল যে এই অঞ্চলে, অর্থাৎ প্রতাপগড় জেলা ও গাঙ্গেয় উপত্যকার এই অংশে অন্যত্র নদীর মজে যাওয়া দহ অনেক দেখা যায়। এখন বেশিরভাগ জায়গাতেই এগুলি শুকিয়ে নিয়ে চাষ করা হচ্ছে; তবে নিচু জায়গা বলে এদের সহজেই চিহ্নিত করা যায় এবং কোথাও কোথাও জলও থাকে। এই অঞ্চলেই নেহারি বলে একটি দহের মাটির থেকে বৃক্ষরেণু-পরম্পরা বিশ্লেষণ করা হয়েছে। এই বিশ্লেষণ থেকে মনে হয় যে, মৃত্তিকার দ্বিতীয় স্তরে ক্ষুদ্রপ্রস্তরযুগীয় নিদর্শন যে পাওয়া যায়, সেই স্তরের সমসাময়িক আবহাওয়া প্রথম স্তরের উপ-শুষ্ক অবস্থা থেকে উষ্ণতর ও আর্দ্রতর হয়ে উঠেছিল। এই যুগে হিপোপটেমাস জাতীয় প্রাণীর অস্তিত্ব দেখেও তা মনে হয়। বিস্তৃত উপত্যকায় মাঝে মাঝে পুরনো নদীর দহ আর তার চারপাশে বিভিন্নরকম জন্তুজানোয়ারের বাস। অনুমান করতে অসুবিধে হয় না যে, বিন্ধ্য অঞ্চল থেকে আর তারও পেছনে বিন্ধ্যশ্রেণী থেকে ক্ষুদ্রপ্রস্তরযুগীয় মানুষ এই সমস্ত দহের পাশে বসতি করেছিল। হাতিয়ার তৈরির পাথর উপত্যকায় পাওয়া যায় না। এই পাথর নিশ্চয় বিন্ধ্যাঞ্চল থেকেই এসেছিল। এখন সমস্যাটা হল এরা কি প্রতি বছরে একটা সময়ে উপত্যকায় নেমে আসত, না এখানেই পাকাপাকিভাবেই বসবাস করত? নিদর্শনের বিস্তৃতি দেখে মনে হয় যে উপত্যকাতেই এদের পাকাপাকি বাস ছিল।
মহাদহে বিস্তৃত জায়গা জুড়েই ক্ষুদ্রপ্রস্তরযুগীয় সাক্ষ্য পাওয়া গেছে এবং এর তিনটি অঞ্চলে খনন করে দেখা গেছে যে কেন্দ্রটি তিনটি ভাগে বিভক্ত ছিল। প্রথম অংশটিতে লোক থাকত এবং কবর দিত; দ্বিতীয় অংশে মৃত পশু কাটা হত, আর তৃতীয় অংশ দহটির একেবারে কিনারে। প্রথম অংশটিতে [খননের জায়গা ২১৬ বর্গ মি.] বসতির চিহ্ন কয়েকটি চুলা। চুলাগুলি গোল অথবা ডিম্বাকৃতি। গোলগুলির গড় পরিধি ৪৭ সে.মি.। ডিম্বাকৃতিগুলি গড়ে ৬০ থেকে ৮০ সে.মি. লম্বায়, আর ৪০ থেকে ৭০ সে.মি. চওড়ায়। অগভীর (১২ সে.মি. গভীর) গর্ত করে চুলাগুলি বানানো হত। হাড়ের টুকরো এবং ছাইমাটি পাওয়া গেছে। কোনও কাঠকয়লা না পাওয়াতে অনুমান করা হয়েছে যে এই ধরনের চুলাতে লতাপাতা বা কুটোকাটা দিয়েই আগুন ধরিয়ে মাংস ঝলসানো হত। কবরের সংখ্যা চুলার চাইতে বেশি। ১৫টা কবর আর ১৭টা দেহাবশেষ [খননকারীদের প্রাথমিক হিসেবে] পশ্চিম-পূর্ব এবং পূর্ব-পশ্চিম দুভাবেই শোয়ানো। কবরগুলি কিছুটা ডিম্বাকৃতি। আয়তন লম্বায় ২.০৭-২.৫ মি, চওড়ায় .৬৭-১.০৩ মি, আর গভীরতায় ১৫-৩৫ মি.। অগভীর এই গর্তগুলিতে মাথার দিক থেকে পায়ের দিক পর্যন্ত একটু ঢাল দেখা যায়। শরীর কবরে শোয়ানোর আগে ৪-৬ সে.মি. পুরু করে ধূসর বা কালো ঝুরো মাটি ছড়িয়ে দেওয়া হত। ১৫টি কবরের ভেতর ২টি কবরে ২টি করে কঙ্কাল—একটি নারীর ও অপরটি পুরুষের— পাওয়া গেছে। একটিতে নারীটি পুরুষের ওপর রাখা আর দ্বিতীয়টিতে নারী পুরুষের বাঁদিকে। সব শরীরই লম্বালম্বি শোয়ানো। দুটি হাতই দুদিকে নামানো। শরীরের সঙ্গে হাড়ের গয়না, পোড়া এবং আধপোড়া জন্তুর হাড়, পাথরের হাতিয়ার, হাড় দিয়ে বানানো তীর, শামুকজাতীয় জীবের খোলা ইত্যাদি পাওয়া গেছে। ১৭ জনের মধ্যে ৫টি পুরুষের, ৮টি নারীর; বাকি ৪টি সম্পর্কে কিছু বলা সম্ভব হয়নি।
যেখানে বসে জন্তু জানোয়ারের মাংস ছাড়ানো ও কাটা হত সেই জায়গায় সাক্ষ্য খুব পরিষ্কার। কাটার দাগ অনেক হাড়ে। পোড়ানোর দাগও কিছু হাড়ে আছে, তবে বেশিরভাগই এখানে পোড়ানো হয়নি। এখানে বসেই হয়তো হাড়ের হাতিয়ার আর গয়না বানানো হতো। জানোয়ার যা পাওয়া যাচ্ছে তার ভেতর গরু মোষ, জলহস্তী, হরিণ, শুয়োর আর কাছিম। বেশির ভাগ হাড়ই হরিণের। আর, সব জানোয়ারই বুনো। হাড়ের গয়না সব কটাই হরিণের শিং-এর তৈরি। বানানোর চিহ্নও পরিষ্কার পাওয়া গেছে। গলার আর কানের গয়নাই সব। দহভিত্তিক অংশটুকুতেও প্রচুর জানোয়ারের হাড় (একই রকম), পাথরের হাতিয়ার, গেরুমাটির টুকরো, বাটনা বাটা বা পেষাই করার কাজে লাগে এমন পাথর, ইত্যাদি পাওয়া গেছে। পাখি এবং মাছের হাড়ও পাওয়া গেছে এখান থেকে। এ ছাড়া কয়েকটা ঘোড়ার হাড়ও দেখা যাচ্ছে।৭
মহাদহের মতোই আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্র সরাই নাহার রাই—প্রতাপগড় শহরের ১৫ কি.মি. দক্ষিণ-পশ্চিমে। একটি বড় দহের ধারে। প্রথমত, অনেক বিভিন্ন আকৃতির ছোট ও বড় চুলা পাওয়া গেছে। একটিতে মেঝে পাথর ছড়িয়ে বাঁধানো আর চারদিকে খুঁটি দিয়ে ঘেরা। অবশ্যই এটা একটা ছাত বা চালের নীচে। কবর ১১টি বা তার বেশি খনন করা হয়েছে। ধরন মহাদহের মতোই শরীর শোয়ানোর আগে কিছু ঝুরো মাটি কবরে ছড়িয়ে দেওয়া। পুরুষের ক্ষেত্রে ডান হাত তলপেটের ওপর আড়াআড়ি রাখা, আর মেয়েদের ক্ষেত্রে বাম হাত। পশ্চিম-পূর্ব দিকে করে শোয়ানো। কবরে যা দেওয়া হয়েছে তার ভেতর, পাথরের হাতিয়ার ছাড়া, শামুক জাতীয় জীবের খোলা বা ঝিনুক আছে। বুনো জন্তু জানোয়ারের হাড় অগুণতি। মাছ, কাছিম, শামুক জাতীয় জীব তো আছেই, তা ছাড়া বুনো মোষ, হাঙর এবং হরিণের হাড় পরিষ্কার।৮
উপরে যে তিনটি ক্ষুদ্রপ্রস্তরযুগীয় কেন্দ্রের কথা বলা হল—চোপানি-মান্ডো, মহাদহ এবং সরাই নাহার রাই—তাদের আরও দুটি দিক নিয়ে কিছুটা বিস্তারিত আলোচনা করা সমীচীন। প্রথমত, মানুষের যে সমস্ত কঙ্কাল পাওয়া গেছে তার আলোচনা আর দ্বিতীয়ত, এদের বা গঙ্গা উপত্যকার এই অংশে এই স্তরের তারিখ। এই স্তরেরই আর একটি কেন্দ্র, দমদমা (প্রতাপগড় জেলাতেই) খুঁড়ে বেশ কয়েকটি কঙ্কালসহ কবর বেরিয়েছে। এই কেন্দ্রটির মোট আয়তন প্রায় ৮৭৫০ বর্গ মি.; তম্বুরা নালা নামক একটি নালার দুটি শাখার মিলনস্থলে একটু উঁচু জমির ওপর। এখানে নিদর্শন স্তরের গভীরতা ১.৫ মি.; সবচেয়ে ওপরের স্তরটি ছাড়া সবকটি স্তরই ক্ষুদ্রপ্রস্তরযুগীয়। লেপা এবং এমনি (অর্থাৎ, না লেপা) দু ধরনের চুলা এবং পুড়ে যাওয়া লেপা মেঝে দেখা গেছে। অন্যান্য যা পাওয়া গেছে, তা হল পাথরের হাতিয়ার, হাড় দিয়ে তৈরি জিনিস, শিলনোড়া জাতীয় পাথর, হাতুড়ি ও নিহাই জাতীয় পাথর, পোড়ামাটির চাকলা, জন্তুর হাড় এবং একটি বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ নিদর্শন—পোড়া শস্য। কী শস্য এখনও ঠিক করা যায়নি। যাই হোক, চাষ না করা অর্থাৎ বুনো শস্য হওয়ার সম্ভাবনাই প্রবল। কবর সর্বমোট ৪১টি। দমদমার ৪টি কবরে একটির বেশি কঙ্কাল আছে। একটি কবরে দুটি কঙ্কালের দুটিই পুরুষ; আর একটি কবরে দুটি পুরুষ, একটি স্ত্রী। বাকি দুটি কবরে একটি পুরুষ, একটি নারী।
সরাই নাহার রাই থেকে ১৫টি কঙ্কাল বৈজ্ঞানিকভাবে বিশ্লেষিত হয়েছে। ৭টি পুরুষ, ৩টি নারী স্পষ্ট। পুরুষদের বয়স ১৬ থেকে ৩৪ বছরের ভেতর, তার নারীদের ১৫ থেকে ৩৫। দাঁত এবং হাড় দেখে যে স্বাস্থ্য অনুমান করা যায় তাতে বলা হয়েছে যে এদের স্বাস্থ্য খুবই ভাল ছিল। উচ্চতা পুরুষদের (আনুমানিক) ১৭৪ থেকে ১৯২ সে.মি. নারীদের ১৭৫ থেকে ১৮৮ সে.মি.। মাথার লম্বা ও চওড়ার অনুপাত বের করে যে আকৃতির পরিমাপ বার করা হয় তাতে বলা যায় এটি লম্বা মাথার জনগোষ্ঠী। সরাই নাহার রাই-এর একটি কঙ্কালের পাঁজরায় একটি পাথরের তীর বেঁধা ছিল— তীর বেঁধা অবস্থাতেই কঙ্কালটি পাওয়া যায়। তীরবিদ্ধ হয়ে মৃত্যুর এইটি ভারতবর্ষে প্রাচীনতম নিদর্শন।
মহাদহে বিশদ নৃতাত্ত্বিক বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে সর্বমোট ৩২টি প্রাণী, এর ভেতর ২৮ জনের বয়স ও লিঙ্গ ঠিক করা যায়। ১৭ জন পুরুষ, ৭ জন নারী, ১টি প্রাপ্তবয়স্ক কিন্তু পুরুষ/নারী ঠিক করা যায়নি, আর ৩টি অল্পবয়স্ক যাদের ক্ষেত্রেও পুরুষ/নারী তফাত করা যায়নি। দুটি নারীর বয়স ৫০ বছরের বেশি। ১ জন পুরুষ, ১ জন নারীর বয়স ৩৫-৫০ এর ভেতর। বাকি ১৮ থেকে ৩৪ বছরের ভেতর কয়েকটি উদাহরণ। দাঁত দেখে অনুমান করা হয়েছে যে, খাবারে কার্বোহাইড্রেট, পরিশুদ্ধ শর্করা এবং নরম ও আঠালো খাবারের পরিমাণ কম ছিল। খাদ্যসংগ্রহ পর্যায়ে দাঁত যে রকম হওয়ার কথা তাই। মহাদহে পুরুষেরা ১৯০ সে.মি. পর্যন্ত লম্বা ছিলেন এবং নারীদের উচ্চতা ১৬২-১৭৬ সে.মি. ছিল।৯
তারিখের ভিত্তিতে প্রথম মনে রাখার কথা সরাই নাহার রাই থেকে পাওয়া খ্রি. পৃ. ৯,০০০-১০,০০০ একটি তারিখ। এইটি ছাড়া প্রত্যক্ষ তারিখগুলি অনেক পরের। তাই সমস্যা হচ্ছে: চোপানি-মান্ডো নিয়ে এই অঞ্চলে ক্ষুদ্রপ্রস্তরযুগীয় নিদর্শনের আমরা কী করে কাল পরিমাপ করব। বস্তুত, চোপানি-মান্ডোর ৩ নং পর্যায় অর্থাৎ যাকে ক্ষুদ্রপ্রস্তর যুগের শেষভাগ এবং খাদ্য উৎপাদন বা নব্যপ্রস্তর যুগের আদি পর্যায় বলা হয়েছে তার একটিই তারিখ খ্রি. পূ. চতুর্থ সহস্রাব্দের মাঝামাঝি। মহাদহের ৩টি ক্ষুদ্রপ্রস্তর যুগের তারিখই খ্রি. পূ. তৃতীয়-দ্বিতীয় সহস্রাব্দে। অথচ, এর অন্য একটা দিক আছে। উচ্চ পুরাপ্রস্তরযুগীয় তারিখ এই অঞ্চলেই ১৭,০০০ বছর এবং তার আগে। একটি স্থান (মহাগরা) থেকে উচ্চ পুরাপ্রস্তর থেকে ক্ষুদ্র পুরাপ্রস্তর যুগে উত্তরণের পরিচয় যে স্তরে পাওয়া যাচ্ছে তার কয়েকটি তারিখ ১২,০০০-১০,০০০/৯,০০০ বছরের ভেতর। ক্ষুদ্রপ্রস্তর যুগের সূত্রপাত এই অঞ্চলে প্রাচীন এবং সেই কারণে চোপানি-মান্ডো, মহাদহ, সরাই নাহার রাই, দমদমার অবশেষও প্রাচীন হতে কোনও বাধা নেই। খ্রি. পূ. ৮-১০ হাজার বছর এদের সূত্রপাতের তারিখ বলে মেনে নিতে আপত্তি হওয়া উচিত নয়। প্রাপ্ত কঙ্কালগুলির ওপর নৃতাত্ত্বিক বিশ্লেষণেও অনুমান করা হয়েছে এটি একটি সুপ্রাচীন জনগোষ্ঠী। তবে এও সত্য যে এই ক্ষুদ্রপ্রস্তরযুগীয় সংস্কৃতি এই অঞ্চলে অনেকদিন বেঁচে ছিল। প্রায় দেড় মিটার পর্যন্ত সাংস্কৃতিক অবশেষের চিহ্ন (যথা, মহাদহ ও দমদমায়) দেখে অন্তত তাই মনে হয়। গঙ্গা সমীপবর্তী অঞ্চলে, প্রতাপগড়- এলাহাবাদ- বারাণসী- জৌনপুর- সুলতানপুরের বিস্তৃত ভূমিতে, নদীর পুরনো খাতের দহের চারপাশে গড়ে ওঠা এই ক্ষুদ্রপ্রস্তরযুগীয় সংস্কৃতির সাক্ষ্য ভারতবর্ষের ইতিহাসে অতি গুরুত্বপূর্ণ।
৪ শিল্পের সাক্ষ্য
রাজস্থানে সিরোহী জেলার চন্দ্রাবতী থেকে পাওয়া চ্যালসিডোনি পাথরের তৈরি একটি ক্ষুদ্রপ্রস্তরযুগীয় জিনিস যা থেকে হাতিয়ার তৈরির জন্য লম্বাটে চিলকা ছাড়ানো হয়েছিল, তার ওপর একটি ছোট জ্যামিতিক নকশা খোদাই করা আছে। যা থেকে লম্বাটে চিলকা (বা ইংরেজি ‘ব্লেড’) ছাড়ানো হয় তাকে মূল টুকরো বা ‘কোর’ বলা হয়। ‘চন্দ্রাবতী কোর’ এর ওপর খোদাই করা নকশা গুরুত্বপূর্ণ এই কারণে যে এই ‘কোর’টির ক্ষুদ্রপ্রস্তরযুগীয় ‘কোর’ হওয়াতে কোনও সন্দেহ নেই। অসুবিধা হচ্ছে যে, এই ‘কোর’টি এসেছে ওপরের মাটিতে পড়ে থাকা অবস্থায়—খনন করে পাওয়া যায়নি। এর তারিখ বার করাও সম্ভব হয়নি। কাজেই, আকর্ষণীয় হলেও এর সত্যিকার প্রাচীনত্ব সম্বন্ধে সন্দেহ আছে, কারণ আমরা দেখেছি যে ক্ষুদ্রপ্রস্তরযুগীয় হাতিয়ার ঐতিহাসিক কাল পর্যন্ত ব্যবহার হয়েছিল। এ ছাড়া এই ধরনের নমুনা অন্য কোনও ক্ষুদ্রপ্রস্তরযুগীয় হাতিয়ারের ওপর এখনও পাওয়া যায়নি।১০
এই যুগের যে শিল্পকলার প্রাচীনত্ব সম্বন্ধে কোনও সন্দেহই আসতে পারে না, তা হচ্ছে বিভিন্ন গুহাশ্রয়ে করা অজস্র চিত্রসম্ভার।১১ আগের অধ্যায়ে আমরা দেখেছি যে এই চিত্রকলার সূত্রপাত উচ্চ পুরাপ্রস্তর যুগেও হতে পারে বলে কিছু পণ্ডিতের মত আছে। তবে এই সূত্রপাত যে ক্ষুদ্রপ্রস্তরযুগীয় এবং এর কিছু অন্তত সুপ্রাচীন এ সম্পর্কে কেউ দ্বিমত নন। ক্ষুদ্রপ্রস্তর যুগের অন্য সাধারণ সমস্যাটির মতো, এখানেও সমস্যা হচ্ছে যে, এই চিত্রকলার ধারা ঐতিহাসিক যুগ পর্যন্ত চলেছে এবং বর্তমানেও আমরা অনেক আদিবাসী অঞ্চলে যে দেওয়াল চিত্রণের ধারা দেখি সেই ধারাও এই প্রাচীন ধারার সঙ্গে যুক্ত হতে পারে। তাই, গুহাশ্রয়ে চিত্র থাকলেই যে তা সত্যিকার অর্থে ক্ষুদ্রপ্রস্তরযুগীয় হতে হবে তার কোনও অর্থ নেই।
বিগত কিছু বৎসরে যা বোঝা যাচ্ছে তা হচ্ছে ভারতবর্ষে এই ধরনের শিল্পের বা চিত্রধারার বিস্তৃতি। উত্তর-পশ্চিম এবং উত্তর থেকে সুদূর দক্ষিণ পর্যন্ত এর অজস্র নিদর্শন ছড়িয়ে আছে। কখনও গুহাশ্রয়ের ভেতর, কখনও এমনি পাথরের ওপর, কখনও আঁকা ছবি হিসেবে, কখনও পাথরের ওপর খোদাই করে অথবা আর একটা পাথর দিয়ে ঠুকে ঠুকে—সংখ্যায় অগুণতি এই চিত্রকলার পূর্ণাঙ্গ বিশ্লেষণ বা তথ্যসংগ্রহ এখনও হয়নি। উত্তর-পশ্চিম (যথা বালুচিস্তান) ও উত্তরে (যথা লাদাখ, কারাকোরাম অঞ্চলে), দক্ষিণে ও পূর্বে তো এই শিল্পের নিদর্শন আছেই, কিন্তু যে অঞ্চলে সবচেয়ে বেশি পাওয়া যায় তা হচ্ছে বিন্ধ্য-কাইমুর পাহাড়শ্রেণীর সবটা জুড়ে। বিন্ধ্যারণ্য অপূর্ব সুন্দর ভূমি। যদি গাঙ্গেয় উপত্যকা থেকে ঢোকা যায় তবে ধাপে ধাপে উঠে গিয়েছে এই উচ্চভূমি। মির্জাপুরের ড্রুমন্ডগঞ্জ থেকে রেওয়ার দিকে যদি যাওয়া যায় উঁচু একটা ধাপ বেয়ে ওপরে উঠলে অনেকখানি সমতল বা অধিত্যকা পাওয়া যাবে। বর্তমানে শুষ্ক, পাতলা হয়ে আসা বনভূমি, মাঝে মাঝে বড় বড় পাথরের চাঁই ইতস্তত বিক্ষিপ্ত। কিছুটা কাত হয়ে থাকার জন্য এইসব পাথরের চাঁইয়ের ছায়াতে ছোট ছোট গুহাশয় তৈরি হয়েছে। ঠিক গুহা বলা যাবে না, কারণ এর সামনেটা পুরোটাই খোলা। এরকম গুহাশয়গুলিতে নজর করলেই দেখা যাবে সুবিন্যস্ত চিত্র—হয়তো কালচে লাল রঙে করা ছোট একটি গরুর পাল। নীচে মাটিতে ক্ষুদ্রপ্রস্তরযুগীয় হাতিয়ার। এই হাতিয়ারের স্তরে কখনও রং করা পাথরের টুকরোও পাওয়া যাবে। এই অঞ্চলেই বান্দা জেলায় ডাকাত-দমন বাহিনীর দায়িত্বে থাকা এক তরুণ পুলিশ অফিসার ডাকাত-দমনের ফাঁকে ফাঁকে এমন ৫০০টি গুহাশ্রয় পেয়েছিলেন যেখানে চিত্র আছে। পূর্বে উড়িষ্যাতে ও মধ্যপ্রদেশের রায়গড়ে গুহাচিত্রের কথা আমরা অনেকদিন জানি, তবে সম্প্রতি বিহারের হাজারিবাগে ও নওয়াদা জেলায় এ ধরনের চিত্র অনেক আবিষ্কৃত হয়েছে। মেদিনীপুর, বেলপাহাড়ি ও বাঁকুড়ার ঝিলিমিলির কাছে রাস্তাতে লালজল নামক জায়গাতে গুহাচিত্র পাওয়া গেছে বলে রব উঠেছিল—বস্তুত পশ্চিমবঙ্গে কোথাও এখন পর্যন্ত এই ধরনের চিত্র পাওয়া যায়নি।
এই সমস্ত নিদর্শনের ভেতর মধ্যপ্রদেশে ভীমবেঠকার নিদর্শন খুব বিখ্যাত হয়েছে কারণ একই অঞ্চলে অনেকগুলি উদাহরণ আছে। মধ্যপ্রদেশেরই পাঁচমারি শহরের আনাচে-কানাচে অনেক সহজলভ্য নিদর্শন আছে।
এই শিল্পকলার বিস্তৃত বিশ্লেষণ এখনও হয়নি। আমাদের দেশের শিল্পকলার ছাত্রছাত্রী যাঁরা, তাঁরা একটু উৎসাহী হলে বিভিন্ন গুহাশয়ের চিত্রাবলী সহজেই নথিবদ্ধ করতে পারেন।
চিত্রকলার যে ধারাটি ক্ষুদ্রপ্রস্তরযুগীয় বলে মনে করা যেতে পারে তা বেশিরভাগ জ্যামিতিক ধারায় করা। যেখানে মানুষ আছে সেখানেও অবয়ব আঁকা হয়েছে লাইন টেনে বা কয়েকটি ত্রিভুজ, চতুর্ভুজ, ইত্যাদি দিয়ে। জন্তুজানোয়ারের ক্ষেত্রে সাধারণত লাইনের মাধ্যমেই কিছু সুগোল আভাস আনা হয়েছে, কিন্তু সব সময় নয়। কিছু ক্ষেত্রে জ্যামিতিক ভাবটিই মুখ্য। একেবারে প্রথম পর্যায়ে যে রং ব্যবহার হয়েছে তা লাল, সবুজ এবং হলুদ। মহিলাদের কোথাও কোথাও একটু বিশদভাবে বোঝানো হয়েছে; কোথাও কোথাও প্রায় কাঠির আকৃতিতে। কিন্তু যেভাবেই বোঝানো হোক, এই চিত্রাবলীর একটি বিশেষ বৈশিষ্ট্য হচ্ছে এর গতিশীলতা। ভীমবেঠকার অদূরে লাখাজোয়ার নামক একটি জায়গায় সবুজ রঙে আঁকা লম্বা নাচের দৃশ্য মনে করার মতো—কাঠি-কাঠি সব মানুষ, কিন্তু অতি উৎসাহে যে নাচছেন তা বুঝতে কোনও অসুবিধা হয় না। বহুজনের শিকারচিত্রেও উৎসাহ কম দেখানো হয়নি—মনের আনন্দে সবাই হাত-পা ছুড়ছেন—কেউ কেউ তীর ছুড়ছেন। মাঝখান দিয়ে কয়েকটি হরিণ চলে যাচ্ছে। অনেক ক্ষেত্রেই শিকারের চিত্রে জন্তুটির আকৃতি মানুষের চাইতে বড় করে দেখানো হয়েছে; যেখানে দুদিক থেকে দুজন মানুষ তাকে বল্লমে বিদ্ধ করেছেন সেখানেও। তাড়া খেয়ে মানুষ পালাচ্ছেন তাও আছে। বেশ কিছু ক্ষেত্রে জন্তুগুলি ‘এক্স-রে টেকনিকে’ আঁকা, অর্থাৎ শরীরের ভেতরের অংশ চিত্রিত হয়েছে জ্যামিতিকভাবে কিছু রেখা টেনে। শিকার ছাড়াও কোথাও জালে মাছ ধরা আছে, কোথাও পুঁটুলি-জাতীয় জিনিসে একগোছা ইঁদুর নিয়ে যাওয়া হচ্ছে, কোথাও দুজন বাঁক বইছে, কোথাও কয়েকজন নৌকাতে বইঠা বাইছে; কোথাও এমন সব মানুষ যাদের পুরোহিত/ওঝা জাতীয় লোক ভাবা যায়; কোথাও কুঁড়েঘর। অস্থায়ী আশ্রয়ে দুটি মানবমানবী এবং সম্ভবত একটি নাবালক/নাবালিকা বসা—সামনে খাবার আছে বোঝা যায়—দুটো মাছ খুব স্পষ্ট। শুধু পাথরের হাতিয়ার দেখে দেখে ক্লান্তির পর এই সমস্ত চিত্রে হাতিয়ারের পেছনের মানুষগুলিকে হঠাৎ সামনে পাওয়া যায়। দুটো দল সামনে লাইন বেঁধে দাঁড়িয়ে একে অপরের দিকে তীর ছুঁড়ছে—এও দেখা যায়, তবে খুব কম। সব মিলিয়ে শিকার, জন্তুরা, আর খুব সজীব, গতিশীল কাঠি-কাঠি দেখানো মানুষ—ছবিটাই ছাপিয়ে আসে। কোথাও কোথাও চোখে পড়ে অপেক্ষাকৃত ঘটা করে অজানা আনন্দোৎসবের ছোঁয়া। আশা করি একদিন ভারতীয় শিল্পের ইতিহাসে এই ক্ষুদ্রপ্রস্তরযুগীয় শিল্পধারা নিজ মর্যাদায় তার যোগ্যস্থান লাভ করবে।
৫ ক্ষুদ্রপ্রস্তর যুগের ধারা
ভূতাত্ত্বিক হিসেবে ‘আধুনিক’ যুগের সূত্রপাত থেকেই যে ভারতবর্ষে ক্ষুদ্রপ্রস্তরযুগীয় সংস্কৃতির ধারা গড়ে উঠেছিল সে সম্বন্ধে কোনও সন্দেহ নেই। সত্যি বলতে, উচ্চ পুরাপ্রস্তর যুগ থেকেই, অর্থাৎ ভূতাত্ত্বিক ‘প্লাইসটোসিন’ যুগের শেষ পর্যায় থেকেই এই সংস্কৃতির ধারা বিবর্তিত হতে পারে। অন্য দিকে, খ্রিস্টীয় প্রথম-দ্বিতীয় শতাব্দী পর্যন্ত এই ধারা কোথাও কোথাও টিকে ছিল আমরা তা জানি। কোথাও কোথাও খ্রিস্টীয় অষ্টম-দশম শতাব্দী পর্যন্তও এই ধরনের পাথরের হাতিয়ার ব্যবহারের ধারা থাকলেও অবাক হওয়ার কিছু নেই। সুদীর্ঘ কালব্যাপী অব্যাহত এই ধারা এই সংস্কৃতি পর্যায়ের গুরুত্বের পরিচায়ক। গুরুত্বের আর একটি পরিচায়ক হচ্ছে যত্রতত্র এই সংস্কৃতির নিদর্শন পাওয়া। ‘ভারতবর্ষের অন্তরীপ’ খণ্ডে এর প্রাচুর্য যে কত তা সহজে বোঝা যাবে না। নজর দিয়ে দেখলে দেখা যাবে যে প্রায় সর্বত্রই হাতিয়ার ছড়িয়ে আছে। পশ্চিমবঙ্গের রাঢ় অঞ্চলে মাটির দিকে তাকিয়ে চললে, টাঁড় জায়গাগুলিতে অন্তত কয়েকটি ‘মাইক্রোলিথ’ বা তার চিলকা পাওয়া যাবে না এটা হয় না। আপনি চিনুন আর না চিনুন, আমাদের চারপাশে এই নিদর্শনগুলি আছে। এই ধরনের ব্যাপক উপস্থিতি থেকেও বোঝা যায় খাদ্য সংগ্রহের যে সাংস্কৃতিক ধারা তখন গড়ে উঠেছিল তা পরবর্তী ভারতবর্ষের ইতিহাসে যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ। এ ছাড়া এই পর্যায়ের শিল্পকলায় জীবনধারণের যে চিত্র আছে, অর্থাৎ শিকার করা, মাছ ধরা, ইঁদুর ধরা, উদ্ভিজ্জ খাদ্য সংগ্রহ করা, মৌমাছির চাক ভাঙা ইত্যাদি, তা থেকেও পরবর্তী ভারতের জীবনধারায় এই পর্যায়ের গুরুত্ব ধরা পড়ে। এই গুরুত্ব মানতে আমাদের আপত্তি হওয়ার কথা নয়। কিন্তু গুরুত্বের ধরনটি কী আমাদের বুঝতে হবে।
নিম্ন, মধ্য ও উচ্চ পুরাপ্রস্তর যুগ পেরিয়ে ক্ষুদ্রপ্রস্তর যুগে যে খাদ্যসংগ্রহের ধারা ও রীতি বিকশিত হয়েছিল বর্তমান ভারতবর্ষেও তার ছাপ আমরা একটু মন দিলেই দেখতে পাই। যে জমি থেকে আমাদের ক্ষুদ্রপ্রস্তর পর্যায়ের পূর্বপুরুষরা খাদ্য সংগ্রহ করতেন সেই জমি এখনও আছে, সেই জমি থেকে চাষবাসের বাইরেও অনেকভাবে খাদ্য সংগ্রহ হয়। চাষবাসভিত্তিক গ্রামজীবনের ভেতরেও খাদ্য সংগ্রহের ধারা কীভাবে লুকিয়ে আছে আমরা তা অনেক সময়ই দেখতে চাই না। তবে ধারাটি আছে এবং এখানে আমরা তার কিছু উদাহরণ দিতে পারি।
উদাহরণ ঘরের কাছ থেকেই দিই। পুরুলিয়া জেলায় কুলাবাহালের (হুড়ার কাছে) পাহাড়ি খরিয়াদের সংবৎসরের কাজের একটা হিসেব আমাদের একজন বন্ধু নৃতাত্ত্বিক উপস্থিত করেছেন।
উদ্ভিজ্জ খাদ্য সংগ্রহ: জানুয়ারি-ফেব্রুয়ারি: প্রথম দিকে ইঁদুরের গর্ত থেকে ধান সংগ্রহ, শিকড়, কন্দমূল, গাছের আঠা, বুনো ফল, বুনো শাক; ফেব্রুয়ারি-মার্চ: কন্দমূল ও আঠা, বুনো শাক; মার্চ-এপ্রিল: বুনো ফল, মধু, শাক, কয়েকজাতীয় পোকা; মে-জুন: শাক; জুন-জুলাই: শাক, কয়েকজাতীয় পোকা; জুলাই-অগাস্ট: একই; অগাস্ট-সেপ্টেম্বর: কন্দমূল, শাক, কুকরি নামক বুনো বীজ/শস্য, কয়েকজাতীয় পোকা; সেপ্টেম্বর-অক্টোবর: কন্দমূল, শাক, পোকা; অক্টোবর-নভেম্বর: কন্দমূল, শাক; নভেম্বর-ডিসেম্বর: ইঁদুরের গর্ত থেকে ধান, শামুক; ডিসেম্বর-জানুয়ারি: ইঁদুরের গর্ত থেকে ধান, শামুক, কলা, কন্দমূল, আঠা।
শিকার করে খাদ্য সংগ্রহ: জানুয়ারি-ফেব্রুয়ারি: খরগোস, ইঁদুর, কখনও কখনও শেয়াল, নেকড়ে, ক্কচিৎ-কদাচিৎ ‘হুড়ার’, ফেব্রুয়ারি-মার্চ: খরগোস, কাঠবেড়ালি, উদ্বেড়াল; মার্চ-এপ্রিল: পাখি; এপ্রিল-মে: পাখি, কখনও কখনও ‘ধামন’ সাপ; মে-জুন: একই; জুন থেকে নভেম্বর: গোসাপ; ডিসেম্বর-জানুয়ারি: খরগোস।
বস্তুত, এই তালিকায় জানুয়ারি থেকে মে পর্যন্ত চাষবাসে জনমজুর খাটার কথাও নেই। মে-জুন থেকে নভেম্বর-ডিসেম্বর পর্যন্ত অবশ্য চাষে জনমজুর খেটে রোজগারের কথা, বা এমনি জনমজুর খাটার কথা দেখা যায়। এ ছাড়া অসময়ে ঝাঁটা বানানো এবং মাছ ধরার ফাঁদ বানানোর কথা দেখা যায়।১২
এই তালিকাটি একজন নৃতাত্ত্বিক গবেষণা সূত্রে করেছেন; কিন্তু একটু চোখ খুলে রাখলেই দেখা যায় আমাদের গ্রামাঞ্চলে সর্বত্র এই ধরনের খাদ্য সংগ্রহের ধারা লুকিয়ে আছে। লুকিয়ে না থাকার কোনও কারণ নেই। চৈত্র-বৈশাখ থেকে জনমজুরের ঘরে ধান থাকে না। জনমজুরের কাজও তখন পাওয়া সহজ নয়। মানুষ তো ভাল্লুকের মতো, সাপের মতো নির্জীব হয়ে কয়েকমাস কাটাতে পারে না। তাই, প্রকৃতি থেকে খাদ্য সংগ্রহ করতে হয়, বাধ্য হয়ে বিভিন্নভাবে। এই ধরনের খাদ্য সংগ্রহের প্রক্রিয়া আমাদের সঙ্গে ক্ষুদ্রপ্রস্তর যুগ বা পর্যায় থেকে আছে। ভারতবর্ষের ইতিহাসে এই পর্যায়ের বিশেষ গুরুত্ব হচ্ছে এই।
আমাদের গ্রামজীবনের চারপাশে এবং ভেতরে ক্ষুদ্রপ্রস্তরযুগীয় এই ধারাটি যে বইছে তার কারণ সোজা: শুধু কৃষিজাত উৎপন্নে সবার এমন অংশ নেই যাতে সবার সাংবাৎসরিক প্রয়োজন নির্বাহ হয়। কয়েক বছর আগে বর্ধমান শহরের অদূরবর্তী একটি গ্রামে এমন একজনের সঙ্গে কাজ করেছিলাম যে বছরের বেশ কিছু দিন এখানে ওখানে খাবার সংগ্রহ করে বেড়াত। মেঠো ইঁদুরের গর্ত খোঁজা তার মধ্যে একটা। অনেক সময় কিছু ধান পাওয়া যেত আর ইঁদুর মারতে পারলে মাংস। এই ধরনের খাদ্য সংগ্রহ একান্ত প্রয়োজনেই করত। গ্রামে যে অন্ত্যজ মহিলাকে পুকুরের কাদা ছেনে শামুক-গুগলি খাবারের জন্য খুঁজতে দেখি, যাঁরা জঙ্গলে কন্দমূল খুঁজে বেড়ান, যাঁদের চুপড়ি ভরে বুনো সবজি জোগাড় করতে দেখি তাঁদের এই জীবনযাত্রার উৎস ভারতবর্ষের ক্ষুদ্রপ্রস্তর যুগ।
তবে ভারতীয় হিসেবে এখানে একটি ছোট প্রশ্ন করা যায়। গত তিরিশ বছরে যে প্রকৃতিতে আহরণীয় খাবার যথেষ্ট কমে এসেছে তা বুঝতে অসুবিধে হয় না। যখন— এবং সম্ভবত তা অদূরেই এই খাবার একেবারে ফুরিয়ে যাবে তখন কী হবে? ভাবনাটা আতঙ্কের।
৬ পরিশেষের মন্তব্য
যদিও পুরাপ্রস্তর যুগের তুলনায় সাংস্কৃতিক সাক্ষ্য, মানুষের জীবননির্বাহ এবং থাকার সাক্ষ্য ক্ষুদ্রপ্রস্তরযুগে অনেক বেশি, তবু সমস্ত ভারতবর্ষের দৃষ্টিকোণ থেকে দেখলে দেখব যে, মাত্র অল্প কয়েকটি অঞ্চল থেকেই নির্ভরযোগ্য বিশদ সাক্ষ্য এসেছে। পশ্চিমবঙ্গে বীরভানপুর-এ যে খননকার্য করা হয় সেখানে স্তরনির্ণয় করা ছাড়া বস্তুত আর কিছু হয়নি। পুরো পশ্চিমবঙ্গে শুধু হাতিয়ারের সংখ্যা গোনা আর মাপজোক করা ছাড়া আর কিছু নেই। বিহারে ছোটনাগপুর অধিত্যকাতেও তাই। পৈসরাতে খোঁড়া হলেও, প্রাচীন তারিখ পাওয়া গেলেও, জীবনযাপনের চিহ্ন কিছ অস্পষ্ট। রাজস্থানে বাগোরে এই চিহ্ন অপেক্ষাকৃত স্পষ্ট হলেও এখানে পরিষ্কার বোঝা যায়, ঐতিহাসিক কাল পর্যন্ত ক্ষুদ্রপ্রস্তরযুগীয় সংস্কৃতি কী করে থেকে গিয়েছিল। একদিকে তামার জিনিস, অন্য দিকে পাথরের ছোট ছোট হাতিয়ার— বাগোরের দ্বিতীয় পর্যায় বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ। খ্রি.পূ. চতুর্থ সহস্রাব্দের শেষের দিকে দ্বিতীয়ার্ধের তারিখ; আমরা পরে দেখব ভারতবর্ষে তাম্রশিল্পের বিকাশের ইতিহাসে এই পর্যায়ের গুরুত্ব কতখানি। মধ্যপ্রদেশে শোন উপত্যকার বাঘঘার ২ নং অঞ্চলেও জীবনধারণের পরিচয় পাওয়া যায়, তবু এখানে বসতির ভেতর দিয়ে একটি সম্বর হরিণের হেঁটে যাওয়াটাই বেশি মনে পড়ে। লংঘনাজের চিত্রটি কিছুটা বাগোর দ্বিতীয় পর্যায়ের মতো; বস্তুত গুজরাটে সিন্ধু সভ্যতার সময়ও আশেপাশে ক্ষুদ্রপ্রস্তরযুগীয় সংস্কৃতি ছিল; এর প্রত্নতাত্ত্বিক প্রমাণ মোটামুটি পরিষ্কার। মধ্য গাঙ্গেয় উপত্যকা ও প্রান্তবর্তী বিন্ধ্য-ঘেঁষা বেলান উপত্যকা থেকে ক্ষুদ্রপ্রস্তরযুগীয় যে ব্যাপক সাক্ষ্য আমরা পেয়েছি তা থেকে বুঝতে কোনও অসুবিধা হওয়া উচিত নয় যে, গাঙ্গেয় সংস্কৃতির পেছনে ক্ষুদ্রপ্রস্তরযুগীয় অবদান যথেষ্ট। এর পেছনে আরও সুসংহত গবেষণা হওয়া প্রয়োজন; যে কোনও কারণেই তোক তা হচ্ছে না। বারাণসীর দক্ষিণে জহুরাগঞ্জ নামক গঙ্গাতীরবর্তী একটি প্রাচীন বসতি কেন্দ্রে নদীর খাড়াইয়ের একেবারে নীচের স্তরে একটি ক্ষুদ্রপ্রস্তরযুগীয় নিদর্শন ঊনবিংশ শতাব্দীতেই পাওয়া গিয়েছিল। এর গুরুত্ব আমরা এখন বুঝতে পারি।
প্রত্নতত্ত্বের সোজা হিসেবে প্রথম পুরাপ্রস্তর যুগ, দ্বিতীয় ক্ষুদ্রপ্রস্তর যুগ, তৃতীয় নব্যপ্রস্তর যুগ। প্রথম দুটি ‘যুগ’ খাদ্য সংগ্রহের—দ্বিতীয় যুগটিতে খাদ্যসংগ্রহের প্রকৃতি অনেক বিশদ হল। তৃতীয় যুগটি খাদ্য উৎপাদন বা চাষবাসের যুগ, পশুপালনের যুগ। সংস্কৃতির বিবর্তন এত বইয়ের হিসেব মেনে হয়নি। বিশেষত, ক্ষুদ্রপ্রস্তর যুগ থেকে নব্যপ্রস্তর যুগে রূপান্তরিত হওয়ার সময়। রূপান্তরটি বিভিন্ন অঞ্চলে বিভিন্নভাবে হয়েছে। ভারতবর্ষের অধিকাংশ অঞ্চলেই খাদ্য উৎপাদন পর্যায় ক্ষুদ্রপ্রস্তরযুগীয় খাদ্যসংগ্রহ পর্যায় অবলম্বন করেই এগিয়েছে। বস্তুত, আমরা যে সমস্ত কেন্দ্রের কথা এই অধ্যায়ে দেখেছি, তাতে রাজস্থানের বাগোর এবং মধ্যপ্রদেশের আদমগড়ে গৃহপালিত/বুনো মোষ, গরু, ভেড়া-ছাগল তো আছেই, তা ছাড়া বাগোরের শিল-নোড়া জাতীয় পাথরের টুকরো দেখে মনে হয় বুনো উদ্ভিজ্জ/শস্য আহৃত হত। প্রত্যক্ষ প্রমাণ প্রতাপগড় জেলার দমদমা থেকে পাওয়া গেছে বীজের রূপে। ছুঁচলো লাঠিতে পাথর লাগিয়ে ভারী করে তা দিয়ে ছোট গর্ত করে বীজ বোনার যে ধারা ঝুম চাষে আছে তার প্রত্যক্ষ প্রমাণ হিসেবে ছিদ্রযুক্ত ভারী পাথরের চাকতি দেখি, যেগুলি মধ্য গাঙ্গেয় উপত্যকার ক্ষুদ্রপ্রস্তর যুগ থেকে এসেছে। গৃহপালিত পশু ও বুনো বীজ আহরণ, কোথাও বীজ বোনা—খাদ্য উৎপাদন শুরু হওয়ার ইঙ্গিত পরিষ্কার। ভারতবর্ষের একটি বিশাল অংশে পরবর্তীকালে বিস্তৃত চাষবাস শুরু হওয়ার মূলে এই ছবি—খাদ্য সংগ্রহের ও খাদ্য উৎপাদনের দুটি ধারা মেশানো একটি স্রোত, যেখানে মনে হয় ক্ষুদ্রপ্রস্তরযুগীয় খাদ্যসংগ্রহ ধারার ভেতরই খাদ্য উৎপাদন অথবা চাষবাস এবং পশুপালনের ইঙ্গিত মিশে আছে। এই অংশে ঘটা করে চাষবাস বা মূলত কৃষিসংস্কৃতির প্রসার কখন কীভাবে হল আমরা পরবর্তী একটি অধ্যায়ে তা দেখব। এবং তা থেকে আরও বোঝা যাবে ভারতবর্ষে ক্ষুদ্রপ্রস্তর যুগের গুরুত্ব কতখানি।
.
দ্বিতীয় অধ্যায়
১। পি সি পন্থ ও ভি জয়সোয়াল, পৈসরা: দ্য স্টোন এজ সেটলমেন্ট অভ বিহার, দিল্লি, ১৯৯১, ৭ নং অধ্যায়।
২। জি আর শর্মা ও জে ডি ক্লার্কস., প্যালিও এনভায়রনমেন্ট অ্যান্ড প্রিহিস্টরি ইন দ্য মিডল শোন ভ্যালি, এলাহাবাদ, ১৯৮৩, পৃ. ১৬১-২০৪।
৩। ভি এন মিশ্র, ‘বাগোর : এ লেট মেসোলিথিক সেটলমেন্ট ইন নর্থ ওয়েস্ট ইন্ডিয়া’ ওয়ার্ল্ড আর্কিওলজি, ১৯৭৩, পৃ. ৯২-১১০; জে আর লুকাক্স এবং অন্যান্য, বাগোর অ্যান্ড ভিলওয়ারা: লেট মেসোলিথিক কালচারস অভ নর্থওয়েস্ট ইন্ডিয়া, পুনে, ১৯৮২।
৪। এইচ ডি সাংকালিয়া, এক্সকাভেশনস অ্যাট লাংঘনাজ: ১৯৪৪-৬৩ পার্ট ওয়ান, ‘আর্কিওলজি’ পুনে, ১৯৬৫ ; জুলিয়েট ক্লাটন-ব্রক, ওই, পার্ট টু, ‘দ্য ফনা’ পুনে ১৯৬৫; সফি এরেহার্ডট ও কে এ আর কেনেডি, ওই, পার্ট থ্রি, ‘দ্য হিউম্যান রিমেইনস’, পুনে, ১৯৬৫।
৫। আর ভি জোশি ও এম ডি খারে, মাইক্রোলিথ বিয়ারিং ডিপোজিট অভ আদমগড় রক শেলটারস’, ডি সেন ও এ কে ঘোষ (স.), স্টাডিজ ইন প্রিহিস্টরি, কলিকাতা ১৯৬৬, পৃ. ৯০-৯৫।
৬। জি আর শর্মা এবং অন্যান্যরা, বিগিনিংস অভ অ্যাগ্রিকালচার, এলাহাবাদ, ১৯৮০।
৭। ওই;
৮। জি আর শর্মা, ‘মেসোলিথিক লেক কালচারস অভ দ্য গঙ্গা ভ্যালি’, প্রসিডিংস অভ দ্য প্রিহিস্টরিক সোসাইটি ৩৯ (১৯৭৩), পৃ. ১৯২-৬; দমদমার জন্য, জে এন পাল, ‘মেসোলিথিক সেটলমেন্টস ইন দ্য গঙ্গা প্লেইন’, ম্যান অ্যান্ড এনভায়রনমেন্ট ১৯ (১৯৯৪), পৃ. ৯১-১০১।
৯। কঙ্কালের জন্য মূল দুটি রিপোর্ট, কে এ আর কেনেডি অবং অন্যান্য, মেসোলিথিক হিউম্যান রিমেইনস ফ্রম দ্য গ্যাঞ্জেটিক প্লেইন; সরাই নাহার রাই, কর্নেল, ইথাকা, ১৯৮৬; কে এ আর কেনেডি এবং অন্যান্য, হিউম্যান স্কেলিটাল রিমেইনস ফ্রম মহাদহা: এ গ্যাঞ্জেটিক মেসোলিথিক সাইট, কর্নেল, ইথাকা, ১৯৯২।
১০। ভি এইচ সোনাওয়ানে, ‘অ্যান এনগ্রেভড মেসোলিথিক কোর ফ্রম চন্দ্রাবতী, রাজস্থান,’ বি এম পান্ডে ও বি ডি চট্টোপাধ্যায় (স.), আর্কিওলজি অ্যান্ড হিস্টরি, এসেজ ইন মেমরি অভ শ্রী এ ঘোষ, প্রথম খণ্ড, দিল্লি, ১৯৮৭, পৃ. ৫৩-৫৬।
১১। চিত্রশিল্পের জন্য, এরউইন নিউমেয়ার, লাইনস অন স্টোন, দিল্লি ১৯৯৩ ; এই লেখকেরই, প্রিহিস্টরিক ইন্ডিয়ান রক পেইনটিং, দিল্লি ১৯৮২ (দ্বিতীয় বইটিতে চমৎকার রঙিন চিত্র আছে)।
১২। এই তথ্যের জন্য দীক্ষিত সিনহা, হিল খারিয়া অভ পুরুলিয়া, কলিকাতা, ১৯৮৪।