২. খাওয়া-খাওয়ি
ভোরবেলা দরজায় টুংটাং শব্দ শুনে টুনি দরজা খুলে দেখল দরজার সামনে একটা ছেলের হাত ধরে একজন মহিলা দাঁড়িয়ে আছে। কয়দিন থেকে টুনি একটা নতুন জিনিস শুরু করেছে, কোনো মানুষ দেখলেই সেই মানুষটা কী রকম হতে পারে সেটা কল্পনা করা শুরু করে। বেশিরভাগ সময়ই তার কল্পনার সাথে মিলে না, যাকে ভালো মনে করে সে পাজি বের হয়ে যায়, যাকে রাগী মনে হয় দেখা যায় সে হাসি-খুশি, তারপরও টুনি হাল ছাড়ে নাই।
এবারেও দরজার সামনে দাঁড়ানো মহিলা আর ছেলেটাকে দেখে টুনি কল্পনা করতে শুরু করে দিল, মহিলার বয়স তেত্রিশ, ছেলেটির বয়স আট বছর তিন মাস। মহিলার নাম নাজিলা নাশওয়ান। ছেলেটার নাম সিমদান। চেহারা দেখে নাম মেলানো খুব কঠিন– শুধু কঠিন নয় প্রায় অসম্ভব। তবুও টুনি চেষ্টা করে যায়। মহিলা ব্যাংকে চাকরি করে, অস্থির টাইপের। অল্পতেই বিচলিত হয়ে যায়। ছেলেটাকে আদর দিয়ে একটুখানি নষ্ট করে ফেলা হয়েছে। দিন-রাত ইউটিউবে কার্টুন দেখে টুনি মহিলাটা এবং তার ছেলে সম্পর্কে আরও কিছু কল্পনা করতে পারত কিন্তু তার আগেই মহিলা বলল, “এটা জোবেদা খানমের বাসা না?”
টুনির এক মুহূর্ত লাগল মনে করতে যে জোবেদা খানম আসলে তাদের দাদি (কিংবা নানির) নাম। বহুদিন এই বাসায় কেউ তাকে এই নামে ডাকে না।
টুনি বলল, “জি এটা জোবেদা খানমের বাসা।“
মহিলাটা বলল, “জোবেদা খালা বাসায় আছেন?”
টুনি বলল, “আছেন। আপনি বসেন, আমি দাদিকে ডেকে দিই।”
“আমার নাম স্বর্ণা। বল শ্যাওড়া পাড়া থেকে স্বর্ণা এসেছে।”
নামটা মিলল না। টুনি অবশ্য এতে বেশি হতাশ হলো না–নাম– মিলিয়ে ফেলা এত সহজ না। অন্যগুলো মিলে কি না দেখা যাক।
টুনি ভেতরে গিয়ে দাদিকে খবর দিল। দাদি তার ঘরে বসে একটা বই পড়ছিলেন, মুখ তুলে বললেন, “স্বর্ণা এসেছে?”
টুনি মাথা নাড়ল ৷
“একা, নাকি সাথে আর কেউ আছে?”
“একটা ছোট ছেলে আছে।”
“যা, তাহলে এখানে ডেকে নিয়ে আয়।”
যারা একটু ঘনিষ্ঠ দাদি তাদের ভেতরে ডেকে নিয়ে আসে। অবশ্য দাদির সাথে ঘনিষ্ঠ না এরকম মানুষ খুব কম।
স্বর্ণাকে দেখে দাদি হাসি হাসি মুখে বললেন, “আরে স্বর্ণা! কতদিন পরে তোমাকে দেখছি। এই বুঝি তোমার ছেলে? ওরে বাবা! কত বড় হয়ে গেছে! বয়স কত হলো?”
“সাত।”
টুনি মনে মনে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল, ছেলের বয়সটাও মিলল না। সে ভেবেছিল আট বছর তিন মাস।
দাদি হাত বাড়িয়ে বললেন, “এসো দাদা এসো, কাছে এসো। কী যেন নাম তোমার?”
ছেলেটা মুখ শক্ত করে বলল, “সুমন।” কিন্তু দাদির কাছে যাওয়ার কোনো চেষ্টা করল না। নামটাও মিলল না।
“স্বর্ণা দাদির বিছানার পাশে বসতে বসতে বলল, “খালা, আপনি কেমন আছেন?”
দাদি বললেন, “আমি তো ভালোই আছি। যত বয়স হচ্ছে শরীর তত ভালো হয়ে যাচ্ছে, কিছু বুঝতে পারছি না!”
“বাহ্! কী চমৎকার। আজকাল তো উল্টো ব্যাপার। যাকেই জিজ্ঞেস করি তারই হয় ব্লাড প্রেসার না-হয় ডায়াবেটিস।”
দাদি হাসলেন, বললেন, “এই জন্য কখনো ডাক্তারের কাছে যেতে হয় না। ডাক্তারের কাছে গেলেই ডাক্তার কিছু একটা রোগবালাই বের করে ফেলবে।
স্বর্ণাকে একটুখানি অবাক এবং অনেকখানি দুশ্চিন্তিত দেখা গেল, বলল, “আপনি ডাক্তারের কাছে যান না? মাঝে মাঝে চেকআপ করান না?”
“মাথা খারাপ! রোগবালাই নাই, খামাখা ডাক্তারের কাছে কেন যাব? আগে কিছু একটা হোক তারপর যদি যেতেই হয় তাহলে যাব।”
স্বর্ণা মাথা নাড়ল, বলল, “না খালা। মাঝে মাঝে চেকআপ করাতে হয়। আমি চেকআপ করিয়েছিলাম বলেই তো আমার কোলেস্টেরল ধরা পড়ল। এখন গরুর গোশত, ডিমের কুসুম বন্ধ। দুই বেলা ওষুধ।”
দাদি হাসি হাসি মুখে বললেন, “এই জন্যই তো ডাক্তারের কাছে যেতে চাই না, প্রথমেই খাওয়া-দাওয়া বন্ধ করে দিবে।” দাদি আবার ছেলেটার দিকে তাকালেন, বললেন, “মাশাআল্লাহ্ তোমার ছেলেটা কত ফুটফুটে হয়েছে –“
“ফুটফুটে?” স্বর্ণা প্রায় আর্তনাদ করে বলল, “কী বলছেন আপনি? শুকিয়ে কাঠ হয়ে গেছে। ফুঁ দিলে উড়ে যাবে।”
টুনি ভালো করে তাকাল, একটু শুকনো সত্যি কিন্তু মোটেই ফুঁ দিলে উড়ে যাওয়ার মতো শুকনা না। আজকাল সবার ঘরে থলথলে মোটা মোটা বাচ্চা, সেই তুলনায় এই বাচ্চাটা যথেষ্ট ভালো।
স্বর্ণার মনে হলো কথা বলার জন্য তার প্রিয় একটা বিষয় পেয়ে গেল, চোখ কপালে তুলে হাত নেড়ে মাথা ঝাঁকিয়ে বলতে শুরু করল, “খালা, আপনি চিন্তা করতে পারবেন না এই ছেলে নিয়ে কী সমস্যা।”
দাদিকে সমস্যা নিয়ে খুব দুশ্চিন্তিত মনে হলো না। হাসি হাসি মুখে জিজ্ঞেস করলেন, “কী সমস্যা?”
“খেতে চায় না। একবারে কিচ্ছু খেতে চায় না।’
“এটা খালি তোমার সমস্যা না। এটা সবার সমস্যা। এই বাসার ছেলেমেয়েরাও কি খেতে চায় ভেবেছো?”
টুনির মনে হলো এই বাড়ির মেয়ে হিসেবে তার একটু প্রতিবাদ করা দরকার। সে মাথা তুলে বলল, “নানি, আমরা খেতে চাই না এটা ঠিক না। শান্ত ভাইয়া একাই আমাদের দশজনের সমান খেয়ে ফেলে।”
“সেগুলি সব অখাদ্য-কুখাদ্য। ভালো জিনিস তোরা মুখে তুলতে চাস না।”
“দাদি, তুমি যদি মনে করো পৃথিবীতে ভালো খাদ্য মানে করলা ভর্তা, ঢেঁড়স ভাজি আর কচুর লতি তাহলে সেগুলি কে খেতে চাইবে?”
স্বর্ণা বলল, “না খালা, আমি মোটেও শাকসবজির কথা বলছি না। এই সুমন কোনো খাবার মুখে তোলে না। ফ্রায়েড চিকেন দেন, পিৎজা দেন, হ্যামবার্গার দেন, নুডলস দেন, আইসক্রিম দেন, কেক দেন, কিচ্ছু খাবে না। খাবার যেন তার কাছে বিষ!”
টুনি এবারে ভালো করে ছেলেটার দিকে তাকাল। তার মা যখন তার সম্পর্কে বলছে তখন মনে হলো সে ব্যাপারটা বেশ উপভোগ করছে। সে যে কিছু খায় না সেটা তার কাছে অনেক বড় একটা অহঙ্কারের ব্যাপার ৷
স্বর্ণা বলতে থাকল, “সকাল থেকে যুদ্ধ শুরু হয়ে যায়। আমি খাবারের থালা নিয়ে সুমনের পিছনে পিছনে ছুটতে থাকি, সেও মুখ বন্ধ করে ছুটতে থাকে। অনেক সাধ্য-সাধনা করে যদি এক চামচ খাওয়াতে পারি তাহলে সেটা আমার সাত পুরুষের ভাগ্য।”
টুনি তাকিয়ে দেখল, সুমন তার মায়ের কথাটাকে নিজের প্রশংসা হিসেবে নিয়েছে। তার মুখে এখন রীতিমতো গৌরবের চিহ্ন। হাসি হাসি মুখ।
স্বর্ণা মাথায় থাবা দিয়ে বলল, “কারো কাছে মুখ দেখাতে পারি না। সবাই ভাবে আমার ছেলেকে আমি খেতে দেই না! অথচ আমি দিন-রাত চব্বিশ ঘণ্টা আমার ছেলের পিছনে লেগে থাকি। খাবার নিয়ে পিছনে পিছনে ঘুরি, ছেলে খাবার মুখে তুলে না। শেষ পর্যন্ত কি করি জানেন?”
দাদি জিজ্ঞেস করলেন, “কী করো?”
“ভাত, ডাল, মাছ, মাংস ব্লেন্ডারে পিষে ফেলি। পুরোপুরি লিকুইড। তারপরে গ্লাসে করে মুখ হাঁ করিয়ে গলায় ঢেলে দেই।”
“তখন খায়?”
“মাথা খারাপ হয়েছে আপনার? নিজে নিজে খাবে? কক্ষনো না। জোর করে খাওয়াতে হয়। হাসপাতালে যেভাবে জোর করে খাওয়ানো হয় অনেকটা সেই অবস্থা।”
দাদি অবাক হয়ে ছেলেটার দিকে তাকালেন। ছেলেটা বেশ অহঙ্কারের একটা হাসি দিল। টুনিও ভালো করে ছেলেটাকে লক্ষ করল, এক-দুই বছরের ছোট বাচ্চাদের বেলায় এরকম গল্প শুনেছে। কিন্তু সাত বছরের বড় একটা ছেলের বেলার যে এরকম হতে পারে সে কখনো কল্পনা করেনি। সে মনে মনে যেটা ভাবছিল, দাদি তখন সেটাই স্বর্ণাকে বললেন।
দাদি বললেন, “স্বর্ণা, আসলে তুমি মনে হয় বিষয়টাকে বেশি সিরিয়াসলি নিয়েছো। যে বাসায় খাওয়া-দাওয়া আছে সেই বাসায় কখনো কোনো বাচ্চা না খেয়ে মারা যায় নাই। তোমার উচিত জোর না করা। তাহলেই সে নিজে নিজে খাওয়া শিখবে।”
স্বর্ণা মাথা নাড়ল, “কোনোদিন শিখবে না। নিজে নিজে খেতে দিলে খাবেই না।” স্বর্ণা তার ছেলের দিকে তাকিয়ে বলল, “তাই না সুমন? খাবি?”
সুমন সগৌরবে মাথা নাড়ল, বলল, “নাহ্। খাব না। আমার খেতে ভালো লাগে না।”
স্বর্ণা বলল, “শুনেছেন? শুনেছেন খালা– কী বলল?”
দাদি মাথা নাড়লেন, বললেন “শুনেছি।”
টুনির যথেষ্ট শোনা হয়েছে। স্বর্ণা আর তার ছেলের নাম আর বয়স নিয়ে যেটা কল্পনা করেছিল সেগুলো মেলেনি কিন্তু অন্য সবকিছু মিলে গেছে। ছেলেটা হালকাভাবে বখে যাওয়া। মা অস্থির টাইপের, অল্পতেই বিচলিত।
টুনি যখন ঘর থেকে বের হয়ে যাচ্ছিল তখন দাদি বললেন, “টুনি। এই বাচ্চাটাকে সাথে নিয়ে যা। তার সাথে একটু খেলাধুলা কর।”
বখে যাওয়া বাচ্চাদের নিয়ে খেলাধুলা করা খুব সহজ না। কিন্তু সেটা তো আর মুখ ফুটে বলা যায় না, তাই সে কিছু বলল না। ছেলেটার দিকে তাকিয়ে বলল, “এসো সুমন, আমরা খেলি।”
“কী খেলবে?”
“তুমি যেটা খেলতে চাও।”
“আমি কিছু খেলতে চাই না।”
“ঠিক আছে। তাহলে সেটাই খেলব। কিছু খেলতে না চাওয়ার খেলা।”
সুমন অবাক হয়ে বলল, “সেটা কেমন করে খেলে?”
“আমার সাথে এসো। তাহলে দেখবে।”
সুমন শেষ পর্যন্ত কৌতূহলী হয়ে টুনির সাথে গেল।
তিন তলায় টুনি টুম্পা, রিমকি আর পিয়ালকে পেয়ে গেল। তারা
একটা কার্ড বোর্ডের বাক্সে মিতুলকে ঢুকিয়ে চিৎকার করে তাকে টেনে নিয়ে যাচ্ছিল। টুনিকে অপরিচিত একটা ছেলেকে নিয়ে ঢুকতে দেখে সবাই থেমে গেল। টুম্পা জিজ্ঞেস করল, “এইটা কে টুনি আপু?”
“এর নাম হচ্ছে সুমন। সুমন তোদের সাথে একটা নতুন খেলা খেলতে এসেছে।
বাচ্চারা নতুন খেলার কথা শুনে যথেষ্ট উত্তেজিত হয়ে উঠে জিজ্ঞেস করল, “কী খেলা? কী খেলা টুনি আপু?”
“খেলাটার নাম হচ্ছে, কিছু খেলতে চাই না। “
“কিছু খেলতে চাই না! এটা আবার কী রকম খেলা?”
“খুবই সোজা। যে এটা খেলতে চায় তাকে এই কার্ড বোর্ডের বাক্সে ঢুকিয়ে সবাই মিলে চিৎকার করবি, খেলতে চাই না, খেলতে চাই না, আমি কিছুই খেলতে চাই না।”
“এইটাই খেলা?”
“এইটা দিয়ে শুরু। তারপর আরও অনেক কিছু হবে।”
“আর কী হবে?”
“সব আমি বলে দিব নাকি? তোরা নিজেরা চিন্তা করে বের কর।
একটু পরেই খেলা শুরু হয়ে গেল। খেলার অনেক রকম ডালপালা বের হলো। কে খেলবে না, কেন খেলবে না, কী খেলবে না, খেললে কী শাস্তি দেওয়া হবে, এইটুকুন পর্যন্ত মোটামুটি শান্তিপূর্ণভাবে খেলা হলো কিন্তু যখন বিনা কারণে শাস্তি দেওয়া শুরু হয়ে গেল তখন খেলাটি ধীরে ধীরে জঙ্গি রূপ নিতে থাকে। খেলাটা যখন মোটামুটি যথেষ্ট জঙ্গি হয়েছে তখন নিচ থেকে ঝুমু খালা এসে জানাল সুমনকে তার মা ডেকে পাঠিয়েছে। টুনি এবং তার সাথে অন্যরাও নিচে নেমে এলো।
টুনি দেখল স্বর্ণা দাঁড়িয়ে আছে চেহারার মাঝে খানিকটা অস্থির ভাব। সুমনকে দেখেই তার কাছে গিয়ে বলল, “বাবা, আমাকে এখনই মানিকগঞ্জ যেতে হবে।”
সুমন মুখ ভোঁতা করে রীতিমতো ধমক দিয়ে বলল, “না, তুমি যাবে না।”
স্বর্ণা অপরাধীর মতো বলল, “আমাকে যেতেই হবে বাবা।”
“না, আমি মানিকগঞ্জ যাব না। মানিকগঞ্জ আমার ভালো লাগে না!”
“ভালো না লাগলেও যেতে হবে বাবা।
“না, আমি যাব না।”
“আমিও তো যেতে চাচ্ছিলাম না। হঠাৎ করে তোর বাবা ফোন করল, ইমার্জেন্সি–’
“না, না, আমি যাব না। “
টুনি রীতিমতো মুগ্ধ চোখে পুরোপুরি বখে যাওয়া ছেলে কেমন হয় সেটা দেখতে লাগল।
হঠাৎ করে দাদি বলে বসলেন, “স্বর্ণা, তুমি তোমার ছেলেকে এখানে রেখে মানিকগঞ্জ চলে যাও। আমাদের বাচ্চা-কাচ্চারা ওকে নিয়ে খেলাবে, ব্যস্ত রাখবে।”
টুনি মনে মনে দোয়া করতে লাগল যেন স্বর্ণা রাজি না হয়, এই বখে যাওয়া ছেলেকে সারাদিন দেখে রাখা কঠিন ব্যাপার হবে।
কিন্তু স্বর্ণা কেমন যেন নিমরাজি হয়ে গেল। বলল, “কিন্তু আপনারা তো ওকে খাওয়াতে পারবেন না।”
“কেন খাওয়াতে পারব না? আমি আমার ছেলে-মেয়েকে খাওয়াই নাই, নাতি-নাতনিকে খাওয়াই নাই?”
স্বর্ণা বলল, “তাহলে তো খুবই ভালো হয়। খাওয়ানোর জন্য একটু জোর করতে হবে। যদি ইউটিউবে একটা ভয়ের সিনেমা দেখানো হয় তখন মুখে খাবার তুলে দিলে খেয়ে নেয়।”
“তুমি চিন্তা কোরো না- নিশ্চিন্ত মনে যাও। ফিরে যাওয়ার সময় তোমার বাচ্চাকে নিয়ে যেয়ো।
“আমার ফিরতে ফিরতে কিন্তু অনেক রাত হবে।”
দাদি বললেন, “কোনো সমস্যা নাই। আমরা আছি।”
টুনি একটা বিশাল দীর্ঘশ্বাস ফেলল। এইটা হচ্ছে দাদির সমস্যা। দুনিয়ার সব মানুষের দায়িত্ব নিয়ে বসে থাকেন!
ঠিক যখন স্বর্ণা তার ছেলেকে টুনিদের হাতে দিয়ে বের হয়ে গেল তখন টুনির মাথায় হঠাৎ করে একটা বুদ্ধি উঁকি দিয়ে গেল। দরজাটা বন্ধ করে সে সুমনের দিকে তাকিয়ে বলল, “সুমন, তোমার খেতে ভালো লাগে না, তাই না?”
সুমন মাথা নাড়ল ৷
টুনি হাসি হাসি মুখে বলল, “কী আনন্দ! তোমার আর খেতে হবে না।”
“খেতে হবে না?”
“না, যতদিন তুমি এই বাসায় থাকবে তোমার কিছু খেতে হবে না।”
সুমন শুকনো মুখে বলল, “কিছু খেতে হবে না?”
“না, তোমাকে আমরা কোনো খাবার দিব না। কী মজা! তাই না!”
সুমন দুর্বলভাবে মাথা নাড়াল। কিন্তু তাকে দেখে মনে হলো না ব্যাপারটা তার কাছে খুব মজার ব্যাপার মনে হচ্ছে। সে খেতে চাইবে না, সবাই তাকে সাধ্যসাধনা করে খাওয়ানোর চেষ্টা করবে সে এটাতেই অভ্যস্ত। কিন্তু তাকে খেতেই দেবে না। এটা তো সে একবারও চিন্তা করে নাই।
টুনি চোখ বড় বড় করে বলল, “এতদিন তোমার কত কষ্ট হয়েছে! তোমার আম্মু তোমাকে জোর করে খাইয়েছে। এখন কোনো জোরাজুরি নাই, কোনো খাওয়া-খাওয়ি নাই। কী মজা, কী আনন্দ!”
সুমনকে ঠিক আনন্দিত দেখা গেল না। ঠিক তখন দেখা গেল ঝুমু খালা একটা ট্রেতে করে কিছু নাশতা নিয়ে এসেছে। টুনিকে জিজ্ঞেস করল, “কী হলো, মেহমান কই?”
টুনি সুমনকে দেখিয়ে বলল, “এই যে ছোটজন। ওর আম্মু চলে গেছেন। রাত্রে এসে নিয়ে যাবেন।”
ঝুমু খালা খাবার ট্রেটা টেবিলে রেখে বলল, “ঠিক আছে তোমরা খাও। বাচ্চাটারে কিছু খাইতে দাও।”
টুনি আঁতকে ওঠার ভান করে বলল, “না না ঝুমু খালা। সর্বনাশ!”
ঝুমু খালা অবাক হয়ে বলল, “কী সর্বনাশ?”
“সুমন একেবারে খেতে পছন্দ করে না। সুমনকে একেবারে খেতে বোলো না। সে আজকে কিচ্ছু খাবে না।”
“কিচ্ছু খাইব না?”
“না। এখন নাস্তা খাবে না। দুপুরে ভাত খাবে না। বিকালেও নাস্তা করবে না। রাত্রেও কিছু খাবে না। তাই না সুমন?”
সুমন শুকনো গলায় ঢোঁক গিলল, কোনো কথা বলল না। টুনি বলল, “তুমি তাড়াতাড়ি সব নাস্তা নিয়ে যাও। খাবার দেখলেই সুমনের খুব খারাপ লাগে।”
ঝুমু খালা খাওয়া নিয়ে বিশাল একটা লেকচার দেওয়ার জন্য রেডি হচ্ছিল কিন্তু টুনির মুখে দুষ্টুমির চাপা হাসি দেখে বুঝে গেল যে এটা একধরনের নাটক, কাজেই ঝুমু খালা সাথে সাথে নাটকে অংশ নিয়ে নিল। বলল, “সেই কথাটা আগে বলবা তো! ঠিক আছে, আমি নাস্তাগুলো নিয়ে যাই। এর সারাদিন সারারাত কিচ্ছু খেতে হবে না।”
টুনি ট্রের দিকে তাকিয়ে চোখ বড় বড় করে বলল, “নিয়ে যাওয়ার দরকার নাই, এইখানে রেখে যাও ঝুমু খালা। আমি একটু খাই, অন্যদেরকেও বলো। এই খাবারগুলি খুবই টেস্টি মনে হচ্ছে!” তারপর জিভে লোল টানার মতো শব্দ করল, “উ ম-ম-ম!”
ঝুমু খালা টেবিলে খাবার ট্রেটা রেখে ভিতরে অন্যদের ডাকতে গেল। টুনি একটা ডালপুরি নিয়ে তার ঘ্রাণ শুঁকে চোখ বন্ধ করে এক কামড় খেয়ে মুখে ইয়াম ইয়াম জাতীয় একটা শব্দ করতে লাগল। ডালপুরিটা এমনভাবে চাবাতে লাগল যে দেখে মনে হতে লাগল এর চাইতে সুস্বাদু খাবার পৃথিবীতে আর কিছুই নাই। টুনি ডালপুরিটা আরেক কামড় খেয়ে আবার আনন্দের একটা শব্দ করে চোখ বন্ধ করল। চোখের কোনা দিয়ে দেখল সুমন কেমন জানি লোভ নিয়ে তার দিকে তাকিয়ে আছে।
ঝুমু খালা ভেতরে গিয়ে বাসায় অন্য বাচ্চাদের নিশ্চয়ই এখানকার নাটকটার একটা ইঙ্গিত দিয়েছে কারণ কয়েক মিনিটের ভিতর ভিতর থেকে বাচ্চারা “ডালপুরি ডালপুরি! কেক কেক! আইসক্রিম আইসক্রিম!!” বলে চিৎকার করতে করতে ঘরে ঢুকে গেল। তারপর কাড়াকাড়ি করে খেতে লাগল!
একজন ডালপুরিতে একটা কামড় দিয়ে বলল, “আ হা হা হা–”
একজন কেকে একটা কামড় দিয়ে বলল, “উহ হু হু হু…”
একজন এক চামচ আইসক্রিম মুখে দিয়ে বলল, “উম ম ম ম…“
সুমন বিস্ফারিত চোখে তাকিয়ে রইল, খাবার যে এভাবে খাওয়া যায় সে কোনোদিন এটা আগে দেখে নাই। সে ধরেই নিয়েছিল এটা জোর করে খাওয়ানোর একটা বিষয়।
নাস্তা শেষ করে সবাই চলে যাওয়ার পর সুমনকে নিয়ে বাচ্চারা আবার খেলতে গেল। কানামাছি এবং লুকোচুরি মিলিয়ে একটা বিপজ্জনক খেলা আবিষ্কার করা হয়েছে, সেটা খেলতে খেলতে দুপুরের খাবার সময় হয়ে গেল। ঝুমু খালা টেবিলে খাবার দিয়েছে এবং বাচ্চারা কেউ কেউ টেবিল ঘিরে, কেউ কেউ এখানে-সেখানে ছড়িয়ে- ছিটিয়ে খেতে বসেছে। সুমন ঠিক কী করবে বুঝতে না পেরে ঘরের এক কোনায় দাঁড়িয়ে আছে।
ঝুমু খালা সবাইকে প্লেট দিয়ে সুমনকে জিজ্ঞেস করল, “তুমি একটা থালা নিবা?”
সুমন কিছু বলার আগেই টুনি বলল, “না না ঝুমু খালা, সুমনকে প্লেট দিও না। সুমন খাবে না।”
ঝুমু খালা জিজ্ঞেস করল, “তুমি কেমন করে জানো হে খাইব না?”
“আমি জানি। ওর আম্মু বলেছেন, সুমন খেতে পছন্দ করে না। তাই না সুমন?”
সুমন কোনো উত্তর দিল না। টুম্পা ভুরু কুঁচকে বলল, “না খেলে খিদে লাগবে না?”
টুনি বলল, “উঁহু। সুমনের খিদে লাগে না। তাই না সুমন?”
সুমন এবারেও কোনো উত্তর দিল না।
ঝুমু খালা মুখে একটা গাম্ভীর্যের ভান করে বলল, “আমি বলি কী, সুমনকে একটা প্লেটে একটু খাবার দেই। সে খাবারটা নিয়ে বসে থাকুক। ইচ্ছে না হলে খেতে হবে না।”
টুনি মাথা নাড়ল, বলল, “কিন্তু সুমন তো নিজে নিজে খেতে পারে না। সবসময় তার আম্মু খাইয়ে দেয়। তাই না সুমন?”
ঝুমু খালা বলল, “আজকে চেষ্টা করে দেখা যাক, নিজে নিজে পারে কি না।”
টুনি মাথা নাড়ল, বলল, “পারে না। পারবে না।“
কয়েকজন বলল, “পারবে। পারবে।”
অন্যরা বলল, “না, পারবে না। পারবে না।”
তখন “পারবে” এবং “পারবে না” এই দুই দলে ঝগড়া লেগে গেল।
এই প্রচণ্ড ঝগড়ার মাঝখানে ঝুমু খালা সুমনের হাতে একটা প্লেটে ভাত, মুরগির মাংস আর সবজি তুলে দিল। কেউ সরাসরি তাকাল না কিন্তু সবাই চোখের কোনা দিয়ে দেখল সে গপগপ করে খেতে শুরু করেছে।
.
স্বর্ণার ফিরে আসতে বেশ রাত হলো। স্বর্ণা যখন তার ছেলেকে নিতে এসেছে সে অবাক হয়ে দেখল তার ছেলে রীতিমতো ভদ্র মানুষের মতো ডাইনিং টেবিলে বসে খাচ্ছে। স্বর্ণা হাঁ করে তাকিয়ে থেকে কিছু একটা বলতে যাচ্ছিল, দাদি চোখের ইশারায় তাকে নিষেধ করলেন।
মাকে দেখে সুমন একটু লজ্জা পেয়ে বলল, “আম্মু তুমি কখন আসবে তো জানি না। তাই নিজে নিজে খেয়ে নিচ্ছি।“
স্বর্ণা ঢোঁক গিলে বলল, “খেয়ে নিচ্ছিস? নিজে নিজে?” সুমন বলল, “হ্যাঁ আম্মু।”
“গুড। গুড। ভেরি গুড। কোনো অসুবিধা হচ্ছে না তো?”
“অসুবিধা? না আম্মু অসুবিধা কেন হবে?” সুমন আরও একটু ঝোল নেওয়ার জন্য তার প্লেটটা ঝুমু খালার দিকে এগিয়ে দিল!