২. কে ছিল প্রথম মানুষ?

দ্বিতীয় অধ্যায় – কে ছিল প্রথম মানুষ? 

এই বইয়ে অধিকাংশ অধ্যায়ের শিরোনামে একটি প্রশ্ন আছে। আমার উদ্দেশ্য হচ্ছে সেই প্রশ্নটির উত্তর দেয়া, অথবা, অন্ততপক্ষে সম্ভাব্য সবচেয়ে সেরা উত্তরটি দেয়ার চেষ্টা করা, যেটি হচ্ছে বিজ্ঞানের উত্তর, কিন্তু সাধারণত আমি শুরু করব কিছু পৌরাণিক উত্তর দিয়ে কারণ সেগুলো বেশ কৌতূহলোদ্দীপক এবং বর্ণিল এবং বাস্তব মানুষেরা সেগুলো বিশ্বাস করেছিলেন, কিছু মানুষ এখনো তা করেন। 

পৃথিবীর সব দেশেই মানুষ কোথা থেকে এসেছে সেটি ব্যাখ্যা দেয়ার লক্ষ্যে মানব-সৃষ্টি সংক্রান্ত পুরাণ-কাহিনি আছে। গোত্র-ভিত্তিক বহু সৃষ্টি সংক্রান্ত পুরাণ মূলত একটি সুনির্দিষ্ট গোত্রসংশ্লিষ্ট—যেন অন্য কোনো গোত্র ধর্তব্যের মধ্যেই পড়ে না! একইভাবে, বহু গোত্রে যেমন আইন আছে যে তারা কোনো মানবহত্যা করবে না—কিন্তু দেখা যায় এই ‘মানব’ বলতে শুধুমাত্র তারা নিজের গোত্রসদস্য অন্যদেরকেই বোঝায়। অন্য গোত্রের সদস্যদের হত্যা করলে সেখানে কোনো সমস্যা নেই! 

একটি বৈশিষ্ট্যসূচক সৃষ্টি পুরাণের উদাহরণ দেখা যাক, এটি তাসমানিয়ার আদিবাসীদের একটি গোত্রের। মহাকাশে নক্ষত্রমণ্ডলে একটি ভয়াবহ যুদ্ধে মইনি বলে একজন দেবতাকে পরাজিত করেছিল তাঁর প্রতিদ্বন্দ্বী এক দেবতা যার নাম ড্রোমেরডিনার। মইনি নক্ষত্র থেকে তাসমানিয়ায় ছিটকে এসে পড়েন তাঁর শেষনিশ্বাস ত্যাগ করতে। তবে মারা যাবার আগে, চিরন্তিম শয্যার এই জায়গাটি আশীর্বাদপুষ্ট করতে তিনি একটি ইচ্ছা পোষণ করেছিলেন। সুতরাং এর পরিণতিতে তিনি মানুষ সৃষ্টি করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছিলেন। যেহেতু তিনি মৃত্যুপথযাত্রী, বেশ তাড়া ছিল তাঁর এবং তাঁর সৃষ্ট মানুষদের তিনি হাঁটু দিতে ভুলে গিয়েছিলেন [কোনো সন্দেহ নেই আরো বড় নিজস্ব সমস্যা তাঁর মনোযোগ বিক্ষিপ্ত করেছিল], তিনি অন্যমনস্ক হয়ে তাদের ক্যাঙারুর মতো লম্বা একটি লেজও দিয়েছিলেন, তার মানে তারা ঠিকমতো বসতে পারত না। এরপর তিনি মারা যান। মানুষেরা লম্বা ক্যাঙারু লেজ আর কোনো হাঁটু না থাকার ব্যাপারটি নিয়ে তাদের অসন্তোষ প্রকাশ করতে শুরু করে এবং অবশেষে তারা তাদের দুর্দশার কথা জানিয়ে স্বর্গের দেবতাদের কাছে সাহায্য প্রার্থনা করেছিল। 

শক্তিশালী ড্রোমেরডিনার, যিনি বিজয় শোভাযাত্রায় তখনো সারা আকাশ জুড়ে গর্জন করে ঘুরে বেড়াচ্ছিলেন, তাদের সেই প্রার্থনা শুনতে পান এবং সমস্যাটা কী সেটি দেখার জন্যে তিনি তাসমানিয়ায় নেমে আসেন। মানুষের অবস্থা দেখে তাঁর বেশ করুণা হয় এবং তিনি তাদের ভাঁজ করা সম্ভব এমন হাঁটু প্রদান করেন আর সমস্যা সৃষ্টিকারী ক্যাঙারু- লেজটি কেটে দেন, অবশেষে তারা ঠিকমতো বসতে পেরেছিল এবং এরপর তারা সুখে-শান্তিতে বসবাস করতে শুরু করে। 

আমরা প্রায়শই একই উপকথার ভিন্ন সংস্করণের দেখা পাই। খুব বিস্ময়কর নয় কিন্তু বিষয়টি, কারণ মানুষ প্রায়শই খুঁটিনাটি বিষয়গুলো বদলে ফেলত, যখন রাতের বেলা আগুনের [ক্যাম্প-ফায়ারের] চারপাশে বসে পরস্পরের সাথে তারা গল্পগুজব করত। সুতরাং কাহিনিগুলোর স্থানীয় সংস্করণগুলো ক্রমেই মূল কাহিনি থেকে দূরে সরে যেতে থাকে। সেই একই তাসমানিয়ার পুরাণের একটি সংস্করণে, মইনি প্রথম মানুষকে সৃষ্টি করেন আকাশে, যার নাম তিনি দিয়েছিলেন পারলেভার। পারলেভার বসতে পারত না কারণ ক্যাঙারুর মতো তার একটি লেজ ছিল আর ভাঁজ করার মতো কোনো হাঁটু ছিল না। আগের কাহিনিটির মতো প্রতিদ্বন্দ্বী দেবতা ড্রোমেরডিনার এই দুর্দশা নিরসনে সাহায্যের জন্যে হাজির হয়েছিলেন। তিনি পারলেভারকে সত্যিকারের হাঁটু দেন এবং লেজ কেটে বাদ দেন, চর্বি দিয়ে তার ক্ষতটা সুস্থ করেন। পারলেভার এরপর নিচে তাসমানিয়ায় নেমে আসেন আকাশের পথে হেঁটে [মিল্কি ওয়ে]। 

মধ্যপ্রাচ্যের হিব্রু গোত্রের একটিমাত্র দেবতা ছিল, প্রতিদ্বন্দ্বী সব গোত্রের দেবতাদের চেয়ে যারা তাকে সবচেয়ে শ্রেষ্ঠ আর উচ্চতম অবস্থানে আসীন করেছিল। তার নানা ধরনের নাম আছে, যাদের কোনোটাই ব্যবহার করার জন্য তাদের অনুমতি ছিল না। তিনি [ঈশ্বর] প্রথম মানুষকে ধুলা থেকে তৈরি করেছিলেন এবং তার নাম দেন অ্যাডাম [যার মানে শুধুমাত্র ‘মানুষ’]। তিনি ইচ্ছা করেই অ্যাডামকে সৃষ্টি করেছিলেন এমনভাবে যেন অ্যাডাম তাঁর মতোই দেখতে হয়। আসলেই ইতিহাসে বেশিরভাগ দেবতাদের প্রতিনিধিত্ব করেছেন পুরুষেরাই [অথবা কখনো নারীরা], যারা প্রায়শই দানবাকৃতির এবং অবশ্যই অতিপ্রাকৃত শক্তিসম্পন্ন হয়ে থাকেন। 

একটি সুন্দর বাগানে ঈশ্বর অ্যাডামকে রেখেছিলেন, যার নাম ইডেন, যেখানে বহু গাছ ছিল, যে গাছগুলোর ফল খাওয়ার জন্য অ্যাডামকে উৎসাহিত করা হয়েছিল—একটি ব্যতিক্রম ছাড়া। আর অ্যাডামের জন্যে নিষিদ্ধ সেই বৃক্ষটি ছিল, ভালো আর মন্দের বিভেদ জানার জ্ঞানবৃক্ষ মনে কোনো সন্দেহ ছাড়াই ঈশ্বর অ্যাডামকে একা সেখানে রেখে গিয়েছিলেন এই বিশ্বাসে যে, তাঁর নির্দেশ অমান্য করে অ্যাডাম কখনোই এই গাছটির ফল খাবে না। 

তারপর ঈশ্বর অনুধাবন করেছিলেন, অ্যাডাম একাকী, হয়তো নিঃসঙ্গতা অনুভব করতে পারে, তিনি বিষয়টি নিয়ে কিছু করার কথা ভাবেন। এ অবধি, মইনি আর ড্রোমেরডিনারের কাহিনির ক্ষেত্রে যা হয়েছিল, এই পুরাণেরও দুটি সংস্করণ আছে, দুটোই পাওয়া যাবে বাইবেলের বুক অব জেনেসিসে। বেশি বর্ণিল সংস্করণে, ঈশ্বর পৃথিবীর সব প্রাণীকে অ্যাডামের সহযোগী হিসেবে সৃষ্টি করেন, তারপর তাঁর মনে হয়েছিল যেন এখনো কিছু বাকি আছে : একজন নারী! সুতরাং তিনি অ্যাডামকে পুরোপুরি অচেতন করে তাকে কেটে উন্মুক্ত করলেন, বুকের একটি পাঁজর বের করে, তার ক্ষতস্থান সেলাই করে দেন। এরপর সেই পাঁজর থেকে তিনি একটি নারী সৃষ্টি করেন, যেমন করে কোনো গাছের কলম থেকে আপনি ফুল ফোটাতে পারেন। তার নাম তিনি দিলেন ইভ এবং তার স্ত্রী হিসেবে অ্যাডামের সাথে তাকে পরিচয় করিয়ে দিয়েছিলেন। 

দুঃখজনকভাবে, সেই বাগানে দুষ্ট একটি সাপ ছিল, যে ইভের কাছে যায় ও তাকে প্ররোচিত করে ভালো-মন্দ জানার সেই জ্ঞানবৃক্ষ থেকে নিষিদ্ধ ফল পেড়ে অ্যাডামকে দিতে। অ্যাডাম ও ইভ দুজনেই সেই ফল খান, দ্রুত সেই জ্ঞানটি তাঁরা অর্জন করেন, দুজনেই আসলে নগ্ন। বিষয়টি তাঁদের অপ্রস্তুত করে এবং তাঁরা ডুমুরপাতা দিয়ে নিজেদের আচ্ছাদন বানান। যখন বিষয়টি ঈশ্বরের নজরে এসেছিল, ফল খাওয়া ও জ্ঞান অর্জন করার জন্যে তিনি তাঁদের ওপর অত্যন্ত ক্ষুব্ধ হয়েছিলেন, আমার মনে হয় এর কারণ তাঁরা তাঁদের নিষ্পাপতা হারিয়েছিলেন। তিনি দুজনকে বাগান থেকে বের করে দেন এবং তাঁদের ও তাঁদের সব বংশধরদের কঠোর পরিশ্রম আর যন্ত্রণাময় একটি জীবনের শাস্তি দিয়ে অভিশপ্ত করেন। আজ অবধি, অ্যাডাম ও ইভের সেই ভয়ঙ্কর অবাধ্যতাকে বহু মানুষই গভীরভাবেই বিশ্বাস করেন, আদি পাপ বা ‘অরিজিনাল সিন’ নামে। কিছু মানুষ বিশ্বাস করেন যে অ্যাডামের কাছ থেকে আমরা সবাই সেই আদি পাপ উত্তরাধিকার-সূত্রে পেয়েছি [যদিও আবার তাঁদের অনেকেই স্বীকার করেন অ্যাডামের কোনো অস্তিত্ব আসলেই ছিল না] এবং তাঁর অপরাধের ভাগীদার। 

স্ক্যানডেনেভিয়ার নর্স বা নরওয়েবাসীদের [নরওয়েজীয়], যারা ভাইকিং সমুদ্র অভিযাত্রী হিসেবে বিখ্যাত, বহু দেবতা ছিল, গ্রিক ও রোমানদের যেমন ছিল। তাদের প্রধান দেবতা ছিলেন, ওডিন, কখনো যাকে উওটান অথবা উওডেন নামেও ডাকা হয়, যেখান থেকে আমরা আমাদের বুধবারের ইংরেজি ‘Wednesday’ নামটি পেয়েছি [Thursday এসেছে আরেক নর্স দেবতা থরের নাম থেকে। থর ছিলেন বজ্রপাতের দেবতা, যা তিনি তাঁর শক্তিশালী একটি হাতুড়ি দিয়ে সৃষ্টি করতেন]। 

একদিন ওডিন সমুদ্রের বেলাভূমিতে তাঁর ভাইদের সাথে নিয়ে হাঁটছিলেন, তাঁরাও সবাই দেবতা এবং তাঁরা দুটি গাছের গুঁড়ি দেখতে পান। এই গাছের গুঁড়ির একটিকে তাঁরা প্রথম পুরুষ হিসেবে রূপান্তর করেছিলেন, যার নাম দিয়েছিলেন ‘আস্ক’, আর অন্য গাছের গুঁড়িটি থেকে সৃষ্টি করেছিলেন প্রথম রমণী, যার নাম তাঁরা দিয়েছিলেন ‘এম্বলা’। প্রথম পুরুষ ও নারীর শরীর দুটি তৈরি করার পর, দেবতা ভাইরা তাদের প্রাণ উপহার দিয়েছিলেন, এরপর যথাক্রমে তাদের সচেতনতা, মুখাবয়ব এবং কথা বলার ক্ষমতা দিয়ে আশীর্বাদপুষ্ট করেছিলেন। 

আমার প্রশ্ন হচ্ছে, গাছের গুঁড়ি কেন? কেন বরফটুকরো বা বালিয়াড়ি নয়? খুব বিস্ময়কর কি নয় ব্যাপারটি, যদি ভাবেন, এই গল্পগুলো কে প্ৰথম আবিষ্কার করেছিল? এবং কেন? যে মুহূর্তে এসব কাহিনি তাঁরা উদ্ভাবন করতেন, সম্ভবত এইসব পুরাণ-কাহিনির প্রথম আবিষ্কারকেরা জানতেন, এগুলো কাহিনি মাত্র, অথবা আপনি কি মনে করেন, বিভিন্ন মানুষ এই গল্পগুলোর বিভিন্ন অংশ বিভিন্ন সময়ে ও স্থানে সৃষ্টি করেছিল এবং অন্য মানুষেরা তাদের সব একসাথে জড়ো করেছে, হয়তো কিছুটা রদবদল করে, হয়তো না জেনেই যে কাহিনির নানা অংশগুলো মূলত উদ্ভাবিত? 

গল্প শুনতে বেশ মজা লাগে, আমরা সবাই সেগুলো পুনরাবৃত্তি করতে ও ভালোবাসি, কিন্তু যখনই বেশি বর্ণিল কোনো কাহিনি শুনি, প্রাচীন কোনো পুরাণ হোক অথবা আধুনিক কোনো আর্বান লিজেন্ড বা শহুরে রূপকথাই হোক, যা ইন্টারনেটে দ্রুত হাতবদল হচ্ছে, সেগুলো বিশ্বাস করার আগে, পুরোপুরিভাবে অথবা এর কোনো অংশ সত্য কিনা, সেটি জানতে চাওয়া কিন্তু মোটেও সময়ের অপচয় নয়। 

সুতরাং আমরা আবার সেই প্রশ্নটাই আমাদের করি : প্রথম মানুষ তাহলে কে ছিল? এবার এর সত্যিকার এবং বৈজ্ঞানিক উত্তরটা পড়ে দেখুন। 

‘আসলে’, কে ছিল প্রথম মানুষ? 

হয়তো আপনি খুব অবাক হতে পারেন, কিন্তু আসলে কখনোই একজন ‘প্রথম মানুষ’ কেউ ছিল না কারণ প্রতিটি মানুষের একজোড়া পিতামাতা থাকতে হবে এবং সেই বাবা-মা-ও মানুষ! একই ঘটনা খরগোশদের ক্ষেত্রেও ঘটে। কখনোই একটি প্রথম খরগোশ বলে কিছু ছিল না, কখনোই প্রথম কুমির ছিল না, কখনোই প্রথম ড্রাগন ফ্লাই [গঙ্গাফড়িং] ছিল না। প্রতিটি জীবই যার জন্ম হয়েছে তারা এর পিতামাতা যে প্রজাতির সেই প্রজাতির সদস্য [হয়তো খুব সামান্য কিছু ব্যতিক্রমসহ, যা আমি আপাতত এই আলোচনায় উহ্য রাখলাম]। সুতরাং এর মানে অবশ্যই প্রতিটি জীব যাদের জন্ম হয়েছে তারা তাদের পিতামহ/মহী/মাতামহ/মহী যে প্রজাতির সেই প্রজাতির সদস্য হবে। এমনকি প্রপিতামহ/মহী/প্রমাতামহ/মহী যে প্রজাতির সেই প্রজাতিরও এবং এভাবেই চলতে থাকবে অনন্তকাল। 

‘অনন্তকাল’? বেশ, না এটি এত বেশি সরল নয়, যেমনভাবে বলা হল। কিছু ব্যাখ্যার প্রয়োজন আছে এবং একটি চিন্তার পরীক্ষা দিয়ে আমি শুরু করব। থট এক্সপেরিমেন্ট বা চিন্তার পরীক্ষা হচ্ছে আপনার কল্পনায় একটি পরীক্ষা। আমরা যা-কিছু কল্পনা করব, সেটি আক্ষরিক অর্থে সম্ভব নয় কারণ এটি আমাদেরকে সময়ে অনেক অতীতের দিকে নিয়ে যাবে, সেই সময়ে, যখন আমাদের জন্ম হয়নি, কিন্তু এটি কল্পনা করা, আমাদের কিছু গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষা দেয়। 

বেশ, এটা হচ্ছে আমাদের চিন্তার পরীক্ষা। শুধুমাত্র নিচের নির্দেশগুলো অনুসরণ করে আমাদের কল্পনা করতে হবে। 

নিজের একটি ছবি খুঁজে বের করুন। এবার আপনার বাবার একটি ছবি নিন এবং বাবার ছবিটিকে আপনার ছবির উপর রাখুন। এবার আপনার বাবার বাবা, মানে আপনার দাদার একটি ছবিসংগ্রহ করুন, এবার সেটি আপনার বাবার ছবির উপর রাখুন। এরপর আপনার দাদার বাবা, আপনার প্রপিতামহের একটি ছবি রাখুন তার উপর। আপনি হয়তো আপনার প্রপিতা/মাতামহদের কাউকেই কখনোই দেখেননি। যেমন— আমার প্রপিতামহ/প্রমাতামহ, কারোর সাথে দেখা হয়নি, কিন্তু আমি জানি তাঁদের একজন ছিলেন একটি কাউন্টি স্কুলের প্রধানশিক্ষক, অন্য একজন একটি কাউন্টির চিকিৎসক। ব্রিটিশভারতে একজন বন সংরক্ষক ছিলেন, অন্য জন ছিলেন আইনজীবী, ক্রিম খুব পছন্দ করতেন, বৃদ্ধবয়সে যিনি পাহাড়ে ওঠার সময় মারা যান। যাই হোক যদি আপনি না-ও জানেন, আপনার বাবার বাবার বাবা কেমন দেখতে ছিলেন, আপনি তাঁকে অস্পষ্ট একটি চেহারার মানুষ হিসেবে কল্পনা করতে পারেন, চামড়ার ফ্রেমে বাঁধানো অস্পষ্ট হয়ে যাওয়া বাদামি রঙের কোনো আলোকচিত্রের মতো এবং একই কাজ করুন এবার তাঁর বাবার ব্যাপারেও। আপনার প্র- প্রপিতামহ। এভাবে আরো পেছনে গিয়ে প্র-প্র-প্র-পিতামহদের ছবিগুলো একটার উপর একটা জমা করতে থাকুন। আপনি এভাবে পিছনে যেতে পারবেন, এমনকি যখন আলোকচিত্র আবিষ্কার হয়নি সেই সময়েও, কারণ এটি তো চিন্তার পরীক্ষা। 

কত জন প্ৰ-প্ৰ-প্ৰ…পিতামহদের দরকার হবে আমাদের এই চিন্তার পরীক্ষার জন্য? ওহ্, মাত্র ১৮৫ মিলিয়ন বা তার আশেপাশে, এমন সংখ্যক হলেই হবে। শুধু? শুধুমাত্র? ১৮৫ মিলিয়ন একের উপর একটি রাখা আলোকচিত্রের কোনো স্তূপের কথা কল্পনা করা সহজ নয়। কত উঁচু হবে সেটি? বেশ, যদি প্রতিটি ছবি প্রিন্ট করা হয় সাধারণ পিকচার পোস্টকার্ড হিসেবে, একটার উপরে রাখা ১৮৫ মিলিয়ন আলোকচিত্র তাহলে ২২০,০০০ ফুট উঁচু হবে : সেটি একটার পর একটা দাঁড়ানো ১৮০টির বেশি নিউইয়র্কের স্কাইস্ক্র্যাপারের সমান হবে। বেয়ে ওঠার জন্য অনেক লম্বা, যদিও এটি বেয়ে ওঠার সময় পড়ে না যায় [যদিও পড়ে যাবারই কথা], ঠিক আছে, এটাকে নিরাপদে একপাশে কাত করে শুইয়ে দেয়া যাক, বুক-শেলফের একটিমাত্র তাকের মতো ছবিগুলো পাশাপাশি সাজানো হোক। এমন কোনো বুক-শেলফের তাকটি তাহলে কত লম্বা হবে? প্রায় চল্লিশ মাইল। 

বুক-শেলফটির সবচেয়ে কাছের, নিকটবর্তী প্রান্তে আছে আপনার নিজের ছবি। এর সবচেয়ে দূরবর্তী প্রান্তে আছেন আপনার ১৮৫- মিলিয়নতম-প্রপিতামহ। কেমন ছিলেন দেখতে তিনি? তিনি কি একজন বৃদ্ধ মানুষ, পাতলা চুল আর সাদা জুলফিসহ? চিতাবাঘের চামড়া গায়ে জড়ানো কোনো গুহামানব? এমন কোনো চিন্তা পুরোপুরি ভুলে যান। আসলেই আমাদের জানা নেই, কেমন দেখতে ছিলেন তিনি; কিন্তু জীবাশ্ম আমাদের সে বিষয়ে বেশ ভালো একটি ধারণা দিয়েছে। বিশ্বাস করুন বা না করুন, আপনার ১৮৫-মিলিয়নতম-প্র-পিতামহ ছিলেন, একটি মাছ একই ছিলেন ১৮৫-মিলিয়নতম-প্র-পিতামহীও, তাঁদের তাই হতে হবে নয়তো তাঁরা পরস্পর প্রজনন করতে পারতেন না এবং আপনিও এখন এখানে থাকতেন না। 

আসুন, এবার আমরা এই চল্লিশ মাইল লম্বা সেই বইয়ের শেলফটি ধরে হাঁটি, একটার পর একটা ছবি সেখানে থেকে বের করে দেখি। প্রতিটি ছবিই দেখাবে একটি প্রাণীর ছবি, যে তার দুইপাশে থাকা ছবির প্রাণীদের মতো একই প্রজাতির অন্তর্ভুক্ত। প্রত্যেকেই দেখতে এই সারিতে তাদের প্রতিবেশীদের মতো অথবা যথেষ্ট সদৃশ যেমন করে কোনো মানুষ তার পিতা ও পুত্রের মতো দেখতে হয়, কিন্তু তারপরও আপনি যদি স্থিরভাবে বইয়ের শেলফটির এক প্রান্ত থেকে হাঁটা শুরু করেন, আপনি এর একটি প্রান্তে দেখবেন একজন মানুষ আর অন্য প্রান্তে একটি মাছ এবং তার মধ্যে বহু ধরনের মজার সব প্র… প্র-পিতামহরা, যাদের মধ্যে অন্তর্ভুক্ত যেমনটি আমরা একটু পরেই দেখব কিছু প্রাণী, যারা দেখতে নরবানরদের [এইপ] মতো, অন্যরা আবার দেখতে বানরের মতো, কেউ দেখতে শ্রিউ’র মতো এবং এভাবে আরো অনেক। প্রত্যেকেই সেই সারিতে তাদের প্রতিবেশীর মতো একই প্রজাতির প্রাণী, তারপরেও আপনি যদি যে-কোনো দুটি ছবি বাছাই করেন যারা সেই সারিতে বেশ দূরে অবস্থান করছে, পরস্পরের চেয়ে তারা বেশ ভিন্ন দেখতে হবে এবং যদি আপনি মানুষ থেকে সেই সারিটি অনুসরণ করেন যথেষ্ট পরিমাণ পিছনের দিক বরাবর আপনি একটি মাছের দেখা পাবেন। কিভাবে এমনকিছু হতে পারে? 

আসলেই, ব্যাপারটা বোঝা কিন্তু খুব কঠিন নয়। আমরা ধীর পরিবর্তনের সাথে বেশ অভ্যস্ত, যা ছোট ছোট ধাপে, একের পর এক, অনেক বড় ধরনের পরিবর্তন সৃষ্টি করে। আপনি একসময় মায়ের কোলে একটি শিশু ছিলেন, এখন আর সেই শিশু নন। আপনার বয়স যখন আরো বেশি হবে আপনি আবারও দেখতে বেশ ভিন্ন হবেন, কিন্তু প্রতিদিন আপনার জীবনে, যখন আপনার ঘুম ভাঙে, আপনি কিন্তু সেই একই মানুষ যে গতরাতে ঘুমাতে গিয়েছিল—একটি শিশু, ধাপে ধাপে বাড়তে থাকে, শৈশব পেরিয়ে বয়ঃসন্ধিকাল, এরপর তরুণ, পরে মধ্যবয়স্ক এবং পরিশেষে একজন বৃদ্ধ এবং পরিবর্তন এত ধীরে হয় যে এমন কোনো একটি দিন আসে না যখন কিনা আপনি বলতে পারবেন, ‘এই মানুষটি হঠাৎ করেই আর কোলের শিশু নেই এবং এখন সে একপা দুই-পা হাঁটতে-শেখা শিশু হয়ে গেছে।’ এবং পরে এমন কোনো দিন আসবে না যখন আপনি বলতে পারবেন, ‘এই মানুষটি আর শিশু নয় এখন সে তার কৈশোরে।’ এমন কোনো দিন আসবে না যখন আপনি বলতে পারবেন, ‘গতকাল এই মানুষটি মধ্যবয়সী ছিল, এখন তিনি বৃদ্ধ।’ 

এটি আমাদের চিন্তার পরীক্ষাটিকে বুঝতে সহায়তা করে, যা আমাদের ১৮৫ মিলিয়ন প্রজন্ম অতীত অভিমুখে নিয়ে যায়, পিতামাতা, পিতামহ/মাতামহ, প্রপিতামহ/প্রমাতামহ হয়ে অতীতের দিকে যতক্ষণ-না আমরা একটি মাছের মুখোমুখি হই এবং, এরপর আবার ঘুরে সময়ের সাথে সামনের দিকে এগিয়ে যেতে থাকলে, যা ঘটে তা হচ্ছে যখন আপনার মাছ-পূর্বসূরির মাছ-শিশুর জন্ম হয়, তারও সন্তান হয়… এভাবে ১৮৫ মিলিয়ন [ধীরে ধীরে কম মাছ-জাতীয় হয়ে] প্রজন্ম পরে যা রূপান্তরিত হয় আপনি হিসেবে। 

সুতরাং পুরো প্রক্রিয়াটি ধীর, এত ধীর যে আপনি কোনো পার্থক্যই লক্ষ করতে পারবেন না, আপনি যদি হাজার বছর পিছনের দিকে হেঁটে যান অথবা দশ হাজার বছর অতীতে, যা আপনাকে আপনার ৪০০তম- প্র-পিতামহের কাছাকাছি নিয়ে আসবে। অথবা, বরং আপনি হয়তো বহু ছোটখাটো পরিবর্তন সারা পথ জুড়েই লক্ষ করবেন, কারণ কেউই হুবহু তার বাবার মতো দেখতে হয় না, কিন্তু আপনি কোনো সাধারণ প্রবণতা লক্ষ করতে পারবেন না। কোনো প্রবণতা লক্ষ করতে আধুনিক মানুষ থেকে দশ হাজার বছর পূর্বের সময় অবধি আসলে যথেষ্ট লম্বা সময় নয়। দশ-হাজার বছর আগের আপনার পূর্বপুরুষদের ছবি আধুনিক মানুষ থেকে ভিন্ন হবে না, যদি আমরা তার পরিচ্ছদ, চুল আর গোঁফের রীতির উপরি- পার্থক্যগুলো উপেক্ষা করতে পারি। আধুনিক মানুষ থেকে আরেকজন আধুনিক মানুষের যে পার্থক্য, তার চেয়ে আমাদের থেকে সে খুব বেশি ভিন্ন হবে না। 

তাহলে এক লক্ষ বছর আগে কী হবে, যেখানে আপনি আপনার ৪০০০তম-প্র-পিতামহের হয়তো দেখা পাবেন? বেশ, এখন লক্ষ করার মতো কিছু পার্থক্য আমরা দেখতে পাব। হয়তো মাথার খুলির কিছুটা বাড়তি পুরুত্ব, বিশেষ করে ভ্রু’র নিচে, কিন্তু তারপরও সেই পার্থক্যটা খুব বেশি হবে না। এখন সময়ে আরো পিছনের দিকে যাওয়া যাক। আপনি যদি সেই কল্পিত শেলফের প্রথম এক মিলিয়ন বছর পেছনে যান, সেখানে ভিন্ন প্রজাতি হিসেবে চিহ্নিত হবার মতো যথেষ্ট ভিন্ন হবে আপনার ৫০,০০০তম-প্র-পিতামহ, যে প্রজাতিকে আজ আমরা নাম দিয়েছি Homo erectus [হোমো ইরেকটাস], আপনি নিজে যেমন জানেন, Homo sapIens [হোমো সেপিয়েন্স]; হোমো ইরেকটাস আর হোমো সেপিয়েন্স সম্ভবত পরস্পরের সাথে প্রজনন করতে চাইত না, অথবা, যদিও তারা সেটি করে, তাদের সন্তানদের সম্ভবত নিজের সন্তান উৎপাদন করার ক্ষমতা থাকত না-ঠিক যেমন হয় মিউলদের [খচ্চর] ক্ষেত্রে, যাদের গাধা-বাবা আর ঘোড়া-মা থাকে, এরা প্রায় সবসময়ই সন্তান উৎপাদন করতে অক্ষম [পরের অধ্যায়ে আমরা দেখব কেন]। 

আরো একবার, যদিও, সবকিছুই ধীর, ধাপে ধাপে। আপনি হোমো সেপিয়েন্স এবং আপনার ৫০,০০০-তম-প্র-পিতামহ ছিলেন হোমো ইরেকটাস, কিন্তু কখনোই এমন কোনো হোমো ইরেকটাস ছিল না যে হঠাৎ করেই একদিন একটি হোমো সেপিয়েন্স শিশুর জন্ম দিয়েছিল। 

সুতরাং, কে ছিল প্রথম মানুষ এবং কখন কোথায় তারা বসবাস করত, এই প্রশ্নটির কোনো সুনির্দিষ্ট একটি উত্তর নেই। এটি কিছুটা অস্পষ্ট, যেমন—এই প্রশ্নের উত্তরের মতো : কখন থেকে আপনি কোলের শিশু হওয়া বন্ধ করলেন এবং হাঁটতে সক্ষম শৈশবে প্রবেশ করলেন—এরপর কৈশোরে? কোনো একটি পর্যায়ে, সম্ভবত এক মিলিয়ন বছরের কম সময় আগে কিন্তু এক লক্ষ বছরের বেশি সময় পরে, আমাদের পূর্বসূরিরা যথেষ্ট পরিমাণ ভিন্ন ছিল আমাদের থেকে যে, কোনো আধুনিক ব্যক্তি তাদের সাথে প্রজনন করতে সক্ষম হতেন না, যদি তাদের কখনো দেখা হত। 

আমরা হোমো ইরেকটাস কাউকে একজন ব্যক্তি, একজন মানুষ হিসেবে ডাকব কিনা সেটি ভিন্ন প্রশ্ন। কিভাবে আপনি আপনার শব্দ বাছাই করেছেন এটি সেই প্রশ্ন, যাকে বলা যেতে পারে সেমানটিক বা শব্দার্থগত প্রশ্ন। কিছু মানুষ হয়তো একটি জেব্রাকে ডোরাকাটা দাগসহ ঘোড়া ডাকতে পারেন, অন্যরা হয়তো ঘোড়া শব্দটি সংরক্ষণ করবেন সেই প্রজাতির জন্য যাদের উপর আমরা চড়ার জন্য সওয়ার হই। এটি আরেকটি সেমানটিক প্রশ্ন। হয়তো আপনি শুধুমাত্র হোমো সেপিয়েন্স প্রজাতির সদস্যদের জন্যই ‘ব্যক্তি’, ‘পুরুষ’ এবং ‘নারী’ এই শব্দগুলো রাখতে চান। আপনার ওপর সেটি নির্ভর করবে। তবে কেউ আপনার মাছের মতো ১৮৫ মিলিয়ন-তম-প্র-পিতামহকে মানুষ বলে ডাকবে না। কারণ সেটি আসলেই বোকামি, যদিও আপনার সাথে তাকে অবিচ্ছিন্ন প্রজন্মের একটি দীর্ঘ শৃঙ্খল যুক্ত করে রেখেছে, যে শৃঙ্খলের প্রতিটি সংযোগই তার দুই প্রতিবেশী সংযোগের মতো একই প্রজাতির। 

পাথরে রূপান্তর 

এখন, আমাদের দূরবর্তী পূর্বসূরিরা কেমন দেখতে ছিলেন, সেটি আমরা কিভাবে জানতে পারি, আর কিভাবেই-বা আমরা জেনেছি যে তাঁরা কখন বেঁচে ছিলেন? মূলত জীবাশ্ম থেকে। 

জীবাশ্মগুলো পাথর দিয়ে তৈরি। এগুলো হচ্ছে সেই পাথর যারা মৃত প্রাণী বা উদ্ভিদের মূল আকৃতিটি ধারণ করে। বেশিরভাগ প্রাণী মারা যায় কখনোই জীবাশ্ম হতে পারবে না এমন সম্ভাবনা নিয়েই। কৌশলটি হচ্ছে, যদি আপনি জীবাশ্ম হতে চান, তাহলে আমরা সঠিক ধরনের কাদায় বা পলিতে সমাহিত হতে হবে, যে ধরনের কাদা পরবর্তীতে একসময় শক্ত হয়ে ‘পাললিক শিলা’ তৈরি করে। 

এর মানে কী? শিলা বা পাথর তিন ধরনের হতে পারে : আগ্নেয়, পাললিক, মেটামরফিক বা রূপান্তরিত। আমি মেটামরফিক শিলা এখানে আলোচনায় আনব না কারণ সেগুলো মূলত অন্য দুটি প্রকারের যে-কোনো একটি : আগ্নেয় এবং পাললিক, যা পরিবর্তিত হয় চাপ এবং/অথবা তাপে। আগ্নেয় বা ইগনিয়াস শিলা [ল্যাটিন ‘ইগনিস’ শব্দ থেকে, যার অর্থ আগুন] একসময় গলিত ছিল, তপ্ত লাভার মতো যা আগ্নেয়গিরির অগ্ন্যুৎপাতের কারণে বের হয়ে এসেছিল পৃথিবীর গভীর থেকে এবং এটি ঘনীভূত হয়ে শক্ত শিলায় রূপান্তরিত হয় যখন শীতল হয়। যে-কোনো ধরনের শক্ত শিলা ক্ষয়প্রাপ্ত হয়, বাতাসে অথবা পানিতে, তারপর এটি সাগর, হ্রদ কিংবা নদীর তলদেশে তলানি হয়ে জমা হয়। অনেক দীর্ঘ সময় ধরে এই তলানি শক্ত হয়ে স্তর [বা স্ট্র্যাটা] তৈরি করে। যদিও সব স্তরই আনুভূমিক হয়ে শুরু হয়, কিন্তু প্রায়শই তারা কাত হয়ে যায় বা পুরোটা উল্টে কিংবা বিকৃত হয়ে যায় যখন আমরা তাদের বহু মিলিয়ন বছর পর দেখি [দশম অধ্যায়ে আমরা দেখব ভূমিকম্পের সময় কেমন করে এটি ঘটতে পারে]। 

এখন, মনে করুন, একটি মৃত প্রাণী কোনোভাবে ভেসে এসে কাদায় এসে পড়ে, হয়তো কোনো একটি নদীর মোহনায়। যদি কাদা পরে শক্ত হয়ে পাললিক শিলায় রূপান্তরিত হয়, প্রাণীর শরীর হয়তো পচে যাবে, শুধু অবশিষ্ট থাকবে শক্ত পাথর, এর আকারের একটি ছাপ, যা আমরা পরে একসময় খুঁজে পাই। এটি জীবাশ্ম প্রাণীটির এক ধরনের এক ধরনের ‘নেগেটিভ’ চিত্র। অথবা সেই প্রাণীর ফাঁপা ছাপটি ছাঁচ হিসেবে কাজ করতে করে যেখানে নতুন তলানি পড়ে, পরে শক্ত হয়ে প্রাণী শরীরের একটি ‘পজিটিভ’ অনুলিপি তৈরি করে। এটি দ্বিতীয় ধরনের জীবাশ্ম এবং তৃতীয় এক ধরনের জীবাশ্ম আছে, যেখানে প্রাণী-শরীরের প্রতিটি অণু- পরমাণুকে প্রতিস্থাপিত করে পানিতে থাকা খনিজ, যা পরে স্ফটিকীকরণ প্রক্রিয়ায় পাথরে রূপান্তরিত হয়। এটি সবচেয়ে সেরা ধরনের জীবাশ্ম কারণ, ভাগ্য ভালো থাকলে কোনো প্রাণীর আভ্যন্তরীণ খুঁটিনাটি বিষয়গুলোর চিরস্থায়ী অনুলিপি তৈরি করে, ঠিক এর ভিতর থেকে। 

জীবাশ্মদের সময় নিরূপণ করা যেতে পারে। মূলত পাথরে উপস্থিত তেজষ্ক্রিয় আইসোটোপগুলো পরিমাপ করার মাধ্যমে আমরা বলতে পারি তারা কতটা প্রাচীন। আমরা চতুর্থ অধ্যায়ে আইসোটোপ আর পরমাণু সম্বন্ধে জানব। তবে সংক্ষেপে, একটি তেজষ্ক্রিয় আইসোটোপ হচ্ছে এক ধরনের পরমাণু, যা ক্ষয়ীভূত হয়ে ভিন্ন ধরনের একটি পরমাণু তৈরি করে : যেমন একটি, ইউরেনিয়াম-২৩৮ রূপান্তরিত হয়ে সিসা-২০৬ তৈরি করে। যেহেতু আমরা জানি কতক্ষণ সময় লাগে এমনকিছু ঘটতে, আমরা আইসোটোপদের এক ধরনের তেজষ্ক্রিয় ঘড়ি হিসেবে ভাবতে। তেজষ্ক্রিয় ঘড়িগুলো সেই পানির আর মোম-ঘড়ির মতোই, যে ঘড়িগুলো পেন্ডুলাম ঘড়ি আবিষ্কারের আগে মানুষ ব্যবহার করত। পানির ট্যাঙ্কের একটি ছিদ্র থাকে, যেখান থেকে একটি নির্দিষ্ট পরিমাপযোগ্য হারে পানি বের হয়ে যায়। যদি ট্যাঙ্কটি ভোরে পূর্ণ করা হয়, আপনি বলতে পারবেন দিনের কতটা সময় অতিক্রম হয়েছে পানির বর্তমান স্তর পরিমাপ করে। একইভাবে সময় পরিমাপ করা হয় মোম-ঘড়ি দিয়ে। মোম একটি নির্দিষ্ট হারে গলতে থাকে, সুতরাং আপনি বলতে পারবেন কতটা সময় অতিক্রান্ত হয়েছে কতটুকু মোমবাতি এখনো গলেনি সেটি পরিমাপ করে। ইউরেনিয়াম-২৩৮ ঘড়ির ক্ষেত্রেও, আমরা জানি যে অর্ধেক ইউরেনিয়াম- ২৩৮ ক্ষয় হয়ে সিসা-২০৬-এ পরিণত হতে সময় লাগে প্রায় ৪.৫ বিলিয়ন বছর। এটাকেই বলা হয় ইউরেনিয়াম-২৩৮-এর ‘হাফ লাইফ’ বা অর্ধ- জীবন। সুতরাং, পাথরে কত পরিমাণ সিসা-২০৬ আছে সেটি পরিমাপ করে, অবশিষ্ট ইউরেনিয়াম-২৩৮-এর পরিমাণের সাথে তুলনা করা হয়। এখান থেকে আপনি পরিমাপ করতে পারবেন কতটা সময় পার হয়েছে সেই সময় থেকে যখন কোনো সিসা-২০৬ ছিল না, শুধু ছিল ইউরেনিয়াম- ২৩৮। অন্যভাবে যদি বলি, কতটা সময় অতিক্রান্ত হয়েছে ঘড়িটি যখন শূন্যে স্থির হয়েছিল। 

আর কখন ঘড়িটি শূন্যে স্থির হয়েছিল? বেশ, এটি ঘটে শুধুমাত্র আগ্নেয় শিলার সাথে, যার ঘড়িগুলো সব একমুহূর্তে শূন্যে স্থির হয় যখন গলিত শিলা ঘনীভূত হয়ে শক্ত হয়, পাললিক শিলার ক্ষেত্রে এটি ঘটে না, সেখানে কোনো সেই শূন্যে স্থির হবার মুহূর্ত নেই, খুব দুঃখজনক, কারণ জীবাশ্মদের পাওয়া যায় শুধুমাত্র পাললিক শিলার স্তরে। সুতরাং আমাদের পাললিক শিলাস্তরের নিকটবর্তী আগ্নেয় শিলা খুঁজে বের করতে হয় এবং সেটাকেই ঘড়ি হিসেবে আমাদের ব্যবহার করতে হয়। যেমন— যদি একটি জীবাশ্ম এমন পাললিক শিলাস্তরে থাকে যার উপরে ১২০ মিলিয়ন পুরনো আগ্নেয় শিলা এবং নিচে ১৩০ মিলিয়ন বছর প্রাচীন আগ্নেয় শিলা থাকে। আপনি বলতে পারবেন যে এই জীবাশ্মটির বয়স ১২০ মিলিয়ন থেকে ১৩০ মিলিয়ন বছরের মধ্যবর্তী কোনো এক সময়ের। এই অধ্যায়ে উল্লেখিত সব সময়গুলো পরিমাপ করা হয়েছে এভাবে। এইসবগুলো মূলত একটি নিকটবর্তী একটা সময়, একেবারে খুব সুনির্দিষ্টভাবে তাদের গ্রহণ করা যাবে না। 

ইউরেনিয়াম-২৩৮ একমাত্র তেজস্ক্রিয় আইসোটোপ নয়, যা আমরা ঘড়ি হিসেবে ব্যবহার করতে পারি। চমৎকারভাবে বিস্তৃত অর্ধ-জীবনসহ আরো অনেক এমন ঘড়ি আছে। যেমন—কার্বন-১৪-এর অর্ধ-জীবন ৫৭৩০ বছর, মানব-ইতিহাস সংক্রান্ত সময় পরিমাপ করার জন্য যা প্রত্নতত্ত্ববিদদের জন্য উপযোগী। একটি সুন্দর বাস্তব তথ্য হচ্ছে বহু ভিন্ন ধরনের তেজষ্ক্রিয় ঘড়িগুলোর পরস্পরের সাথে সম্পূরক সময় মাপার স্কেলও আছে, সুতরাং পারস্পরিক ফলাফল যাচাই করে দেখার জন্যেও আমরা তাদের ব্যবহার করতে পারি এবং এই প্রক্রিয়াগুলোয় সবসময়ই আমরা একই ফলাফল পেয়েছি। 

অন্য ঘড়িগুলো থেকে খানিকটা ভিন্ন উপায়ে কার্বন-১৪ ঘড়ি কাজ করে। এখানে আমাদের আগ্নেয় শিলার দরকার পড়ে না, বরং জীবিত শরীরের অবশিষ্টাংশ ব্যবহার করা হয়, যেমন—পুরনো কাঠ। এটি আমাদের সবচেয়ে দ্রুততম তেজষ্ক্রিয় ঘড়ি, কিন্তু ৫৭৩০ বছর তারপরও অনেক দীর্ঘ সময় কোনো মানুষের জীবনকালের চেয়ে, সুতরাং আপনি হয়তো জানতে চাইবেন, কিভাবে আমরা জানি কার্বন-১৪-এর অর্ধ-জীবন এটাই-বা কিভাবেই-বা জানি ইরেনিয়াম-২৩৮-এর অর্ধ-জীবন ৪.৫ বিলিয়ন বছর! এর উত্তরটা সহজ। অর্ধেক পরিমাণ পরমাণুর ক্ষয় হবার জন্য সেই সময় অবধি আমাদের অপেক্ষা করার দরকার নেই। আমরা খুব সামান্য পরিমাণ পরমাণুর ক্ষয়ের হার পরিমাপ করতে পারি এবং সেখান থেকে অর্ধ জীবন আমরা গণনা করে বের করতে পারি [এক- চতুর্থাংশ জীবন, শতভাগের এক অংশ জীবন ইত্যাদি]। 

সময়ের সাথে অতীতে….. 

আসুন আরেকটি চিন্তার পরীক্ষা করি। কিছু সঙ্গীদের সাথে নিয়ে আপনি একটি টাইম মেশিনে উঠুন। মেশিনটি চালু করুন এবং প্রায় দশ হাজার বছর অতীতের দিকে যাওয়া যাক। দরজা খুলুন এবং যে মানুষদের সাথে আপনাদের দেখা হবে তাদের ভালো করে লক্ষ করুন। যদি-না ঘটনাক্রমে এখন যেটি ইরাকে আপনি সেখানে গিয়ে থামেন, যারা তখন কেবল কৃষিকাজ আবিষ্কার করার প্রক্রিয়ায় আছে, বেশিরভাগ জায়গায় আমরা শিকারি-সংগ্রহকারীদের [হান্টার-গ্যাদারার] দেখব, যাযাবরের মতো যারা বন্যপ্রাণী শিকার আর ফলসংগ্রহ করতে করতে এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় স্থান পরিবর্তন করত। তারা যা বলবে তা আপনারা কেউ বুঝতে পারবেন না এবং তাদের পরনের কাপড়ও হবে খুব ভিন্ন [যদি কিছু থেকে থাকে]। যাই হোক, আপনি যদি তাদের আধুনিক কাপড় পরিয়ে ও আধুনিকভাবে চুল কেটে দেন, বর্তমান মানুষ থেকে তাদের পৃথক করা সম্ভব হবে না [অথবা আধুনিক মানুষেরা যেমন আজ পরস্পর থেকে ভিন্ন তারা চেয়ে বেশি ভিন্ন কিছু হবে না] এবং তারা আপনার সেই টাইম মেশিনে যাত্রী, যে-কোনো আধুনিক মানুষের সাথে প্রজননও করতে পারবে এবং তাদের মধ্যে থেকে একজন স্বেচ্ছাসেবককে বাছাই করুন [হয়তো তিনি আপনার ৪০০তম প্র-পিতামহ; কারণ? এটাই আনুমানিক সময় যখন তিনি হয়তো জীবিত ছিলেন] এবং আবার টাইম মেশিন নিয়ে আরো দশ হাজার বছর আগে চলে যান, মোট বিশ হাজার বছর আগে, যেখানে সুযোগ আছে আপনার ৮০০তম প্র-পিতামহ/মাতামহের সাথে দেখা হবার। এবার আপনি যাদের দেখবেন তারা সবাই শিকারি-সংগ্রাহক, কিন্তু আবারো তাদের শরীর হবে আধুনিক মানুষের মতো এবং আধুনিক মানুষের সাথে তারা পুরোপুরিভাবে প্রজননক্ষম, তারা প্রজননক্ষম উর্বর সন্তানও উৎপাদন করতে পারবে। আপনাদের সাথে এদের একজনকে আবারও টাইম মেশিনে নিয়ে নিন এবং এরপর আরো দশহাজার বছর অতীতের দিকে যাওয়া যাক। এভাবে চালিয়ে যান, দশ হাজার বছর ব্যবধান দিয়ে অতীতের দিকে, প্রতিটি বিরতিতে একজন করে নতুন আরোহীকে তুলুন, তাকে আরো অতীতের দিকে নিয়ে যান। 

মূল বিষয়টি হচ্ছে যে এক সময়, এ ধরনের অনেকগুলো দশ-হাজার- বছর বিরতির পর, হয়তো যখন আপনি মিলিয়ন বছর অতীতে যাবেন, আপনি লক্ষ করতে শুরু করবেন যে টাইম মেশিন থেকে বের হবার পর যে মানুষগুলোর সাথে আপনার দেখা হচ্ছে তারা সুনির্দিষ্টভাবে আমাদের চেয়ে ভিন্ন এবং তারা আপনার টাইম মেশিনে যাত্রা শুরু করা কোনো আরোহীর সাথে প্রজনন করতে পারবে না, কিন্তু তারা প্রজনন করতে সক্ষম হবে সেইসব সাম্প্রতিক সময়ে যুক্ত হওয়া আরোহীদের সাথে, যারা নিজেরাও প্রায় তাদের মতোই প্রাচীন। আমি সেই একই বিষয়টি আবার উল্লেখ করছি, যা আগেও করেছি—ধীর ক্রমান্বয়ে ধাপে ধাপে পরিবর্তন সহজে নির্ণয় করা সম্ভব নয়, অদৃশ্য অনির্ণেয়, অনেকটা ঘড়ির ঘণ্টার কাঁটার মতো, কিন্তু একটি ভিন্ন চিন্তার পরীক্ষা ব্যবহার করে এবং দুটি ভিন্ন উপায়ে বিষয়টি ব্যাখ্যা করার যৌক্তিকতা আছে, কারণ এটি এমন বেশি গুরুত্বপূর্ণ অথচ এবং বোধগম্য কারণে, বিষয়টি বেশকিছু মানুষের জন্য অনুধাবন করা খুব কঠিন। 

আবার আমাদের অতীতমুখী যাত্রা শুরু করা যাক, আর সেই অতীতের যাত্রায় কিছু বিরতিস্থানের দিকে লক্ষ করা যাক সেই মাছের কাছে পৌঁছানোর আগে পর্যন্ত। ধরুন, আমাদের টাইম মেশিন নিয়ে আমরা এইমাত্র একটি বিরতিস্থানে এসে পৌঁছালাম, যার নাম ‘ছয় মিলিয়ন বছর আগে’। আমরা সেখানে কী খুঁজে পাব? যতক্ষণ আফ্রিকায় থাকা আমাদের উদ্দেশ্য থাকবে, আমরা সেখানে আমাদের ২৫০,০০০ তম-প্ৰ- পিতামহ/মহী-প্র-মাতামহ/মহীদের দেখা পাব [কিছু প্রজন্ম কম-বেশি হতে পারে]। তারা সবাই নরবানর হবে এবং তারা কিছুটা শিম্পাঞ্জিদের মতো দেখতে হবে, কিন্তু তারা শিম্পাঞ্জি নয়। বরং, তারা হবে সেই পূর্বসূরি, যাদের আমরা ভাগ করে নিয়েছিলাম শিম্পাঞ্জিদের সাথে, কিন্তু তারা প্রজনন করতে পারবে সেই আরোহীদের সাথে যাদের আমার টাইম মেশিনে নিয়েছিলাম ‘পাঁচ মিলিয়ন নয়শ নব্বই হাজার বছর আগের’ বিরতিস্থান থেকে এবং হয়তো ‘পাঁচ মিলিয়ন নয় শত নব্বই হাজার বছর আগে’ বিরতি থেকে তোলা আরোহীদের সাথেও প্রজনন করতে পারে, কিন্তু সম্ভবত তাদের সাথে নয় যারা আমাদের সাথে যোগ দিয়ে ‘চার মিলিয়ন বছর আগের’ বিরতিস্থান থেকে। 

আবার আমাদের সেই দশ-হাজার-বছরের লাফ দিয়ে অতীতমুখী যাত্রা শুরু করা যাক, সেই ‘পঁচিশ-মিলিয়ন বছর আগের’ বিরতিতে সেখানে আপনি আপনার [এবং আমার] দেড় মিলিয়নতম-প্র-পিতামহদের খুঁজে পাবেন একটি বেশ নিকটবর্তী আনুমানিক পরিমাণ। তারা নরবানর বা এইপ হবে না কারণ তাদের লেজ থাকবে, আমরা তাদের বানর বলে ডাকতাম, যদিও তারা আধুনিক বানরদের সাথে আমাদের সাথে যতটা তার চেয়ে বেশি সম্পর্কযুক্ত হত না। যদিও আমাদের থেকে খুবই ভিন্ন, আধুনিক বানর কিংবা আমাদের সাথে প্রজনন-অক্ষম, তারা খুব সহজেই প্রজনন করতে পারবে তাদের প্রায় কাছাকাছি সদৃশ আরোহীর সাথে যারা আমাদের সাথে যুক্ত হয়েছে ‘চব্বিশ মিলিয়ন নয়শ নব্বই হাজার বছর আগের’ বিরতি থেকে। ধীর এবং ধীর পরিবর্তন পুরোটা সময় জুড়ে। 

আবার আমরা পেছনে যাই, আরো আগে, একবারে দশ হাজার বছর লাফ দিয়ে, প্রতিটি বিরতিতে লক্ষ করার মতো কোনো পরিবর্তন ছাড়াই। আসুন থামি, দেখি কে আমাদের শুভেচ্ছা জানাতে আসে ‘তেষট্টি মিলিয়ন বছর আগের’ বিরতিস্থলে। এখানে আমরা করমর্দন করতে পারব [বা সেটি কি থাবা বলা উচিত হবে?] সাত-মিলিয়নতম-প্র- পিতামহের সাথে। তারা দেখতে খানিকটা লেমুর বা বুশবেবিদের মতো এবং আসলেই তারা সব আধুনিক লেমুর ও বুশবেবিদের পূর্বসূরি এবং এছাড়াও আমরাসহ সব আধুনিক বানর আর নরবানরদেরও উত্তরসূরি। 

আধুনিক মানুষদের সাথে তারা যতটা সম্পর্কযুক্ত ততটাই তারা আধুনিক বানরদের সাথে সম্পর্কযুক্ত এবং আধুনিক লেমুর বা বুশবেবিদের সাথে তারা এর চেয়ে বেশি সম্পর্কযুক্ত নয়। তারা কোনো আধুনিক প্রাণীর সাথে প্রজনন করতে পারবে না, কিন্তু তারা প্রজনন করতে পারবে ‘বাষট্টি মিলিয়ন নয়শ নয় নব্বই হাজার বছর আগের’ বিরতি থেকে তোলা আরোহীর সাথে। আসুন তাদের টাইম মেশিনে আমন্ত্রণ জানাই এবং আবার দ্রুত অতীতমুখে যাত্রা করি। 

‘একশ পঞ্চাশ মিলিয়ন বছর আগের’ বিরতিস্থলে ৪৫-মিলিয়নতম- প্র-পিতামহের সাথে আমাদের দেখা হবে। তিনি মারসুপিয়াল [যাদের এখন মূলত অস্ট্রেলিয়ায় ও আমেরিকায় কিছু প্রজাতি পাওয়া যায়] ও মনোট্রিম [ডাক-বিলড প্লাটিপাস ও স্পাইনি অ্যান্টইটার, যাদের দেখা যায় অস্ট্রেলিয়া/ নিউ গিনিতে] ছাড়া সব স্তন্যপায়ী প্রাণীদের মহা পূর্বসূরিও। এটি সমানভাবে সকল আধুনিক স্তন্যপায়ীর আত্মীয়, যদিও তাদের মধ্যে অন্যদের চেয়ে কারো কারো সাথে এরা একটু বেশি সদৃশ্যতা বহন করে। 

‘তিন শত আর দশ মিলিয়ন বছর আগের’ বিরতিটি ১৭০- মিলিয়নতম-প্রপিতামহদের আমাদের সামনে উপস্থাপন করবে। তিনিও সব আধুনিক স্তন্যপায়ী, সব আধুনিক সরীসৃপ, যেমন—সাপ, গিরগিটি, কচ্ছপ, কুমির, আর সব ডায়নোসরদের পূর্বসূরি [পাখিসহ, কারণ পাখিদের বিবর্তন হয়েছে বিশেষ ধরনের ডায়নোসরদের থেকে]। এটি সমানভাবে ওইসব আধুনিক প্রাণীদের দূরবর্তী আত্মীয়, যদিও সেটি দেখতে গিরগিটির মতোই বেশি মনে হতে পারে। এর মানে হচ্ছে গিরগিটিরা তার সেই সময় থেকে অনেক কম পরিবর্তিত হয়েছে, যতটা স্তন্যপায়ীরা বিবর্তিত হয়েছে। 

এতক্ষণে টাইম ট্রাভেলে আমরা বেশ অভিজ্ঞতা অর্জন করেছি, আর বেশি দূরে নয় যে আমরা মাছের দেখা পাব যার কথা আমি আগে উল্লেখ করেছি। তার আগে আরেকটা বিরতি নেয়া যাক : ‘তিনশ চল্লিশ মিলিয়ন বছর আগের’ বিরতিস্থানে আমরা আমাদের ১৭৫ মিলিয়নতম-প্ৰ- পিতামহের দেখা পাব। তিনি দেখতে কিছুটা নিউটের মতো, আধুনিক সব উভচর [নিউট ও ব্যাঙ] ছাড়াও এটি স্থলবাসী সব মেরুদণ্ডী প্রাণীরও পূর্বসূরি। 

সুতরাং ‘চারশত সতের মিলিয়ন বছর আগের’ বিরতিতে আপনার সাথে দেখা হবে আপনার ১৮৫-মিলিয়নতম-প্র-পিতামহের সাথে, যে মাছের সাথে ইতোমধ্যে আমাদের পরিচয় হয়েছে। সেখান থেকে আমরা সময়ের আরো পেছনের দিতে যেতে পারি, আরো অনেক দূরবর্তী প্ৰ- পিতামহদের সাথে দেখা করতে পারি, যাদের মধ্যে অন্তর্ভুক্ত নানা ধরনের চোয়ালসহ মাছ, এরপর চোয়ালবিহীন মাছ, তারপর, বেশ, তারপর আমাদের জ্ঞান এক ধরনের অনিশ্চয়তার কুয়াশায় ম্লান হয়ে যায়, কারণ এইসব খুব প্রাচীন সময় হচ্ছে সেই সময় যখন আমাদের হাতে জীবাশ্ম- নমুনার সংখ্যাও কমতে থাকে। 

ডিএনএ জানাচ্ছে আমরা সবাই আত্মীয়… 

যদিও আমাদের কাছে সেই জীবাশ্মগুলো না-ও থাকতে পারে যেগুলো কিনা জানাতে পারে আমাদের আরো প্রাচীন পূর্বসূরিরা কেমন দেখতে ছিল, কিন্তু আমাদের মনে কোনো সন্দেহ নেই যে সব জীবিত জীবই পরস্পরের এবং আমাদের আত্মীয় এবং আমরা আরো জানি কোন আধুনিক প্রাণীগুলো পরস্পরের একটু বেশি নিকটাত্মীয় [যেমন, মানুষ এবং শিম্পাঞ্জি অথবা ইঁদুর] আর কারাই-বা পরস্পরের বেশ দূরের আত্মীয় [যেমন, মানুষ আর কোকিল, অথবা ইঁদুর আর কুমির] কিন্তু কিভাবে আমরা সেটি জানতে পারলাম? পদ্ধতিগতভাবে তাদের তুলনা করে, সবচেয়ে শক্তিশালী প্রমাণগুলো এসেছে তাদের ডিএনএ’র তুলনামূলক বিশ্লেষণ করে। 

ডিএনএ হচ্ছে সেই জিনগত তথ্যভাণ্ডার যা প্রতিটি জীবিত জীব তাদের প্রতিটি কোষে বহন করে। এই ডিএনএ তথ্যগুলো সজ্জিত থাকে অত্যন্ত জটিলভাবে কুণ্ডলী পাকানো উপাত্ত বা ডাটার ফিতায় বা টেপে, যাদের বলা হয় ক্রোমোজোম। এই ক্রোমোজোমগুলো আসলে অনেকটা সেই ধরনের ডাটা টেপের মতো দেখতে, যাদের পুরনো আমলের কম্পিউটারে ব্যবহার করা হত, কারণ যে তথ্য এটি বহন করছে সেটি ডিজিটাল এবং সেটি ক্রমানুসারে এর দৈর্ঘ্য বরাবর সজ্জিত। সেগুলো দীর্ঘ সাংকেতিক বা কোড ‘অক্ষরের’ সুতার মতো, যা আপনি পড়তে ও গণনা করতে পারবেন। প্রতিটি অক্ষর সেখানে আছে অথবা সেখানে নেই, এর কোনো মধ্যবর্তী অবস্থান নেই, আর সেটাই এটিকে ডিজিটাল বৈশিষ্ট্য দেয় এবং সে-কারণেই আমরা বলি ডিএনএ ‘অক্ষর’ দিয়ে লেখা। 

প্রতিটি জিন, প্রতিটি প্রাণী, উদ্ভিদ আর ব্যাকটেরিয়ায়, যেখানেই তাদের আমরা দেখেছি, সেগুলো হচ্ছে সাংকেতিক বার্তা কিভাবে সেই জীবটিকে তৈরি করা যায়, যা লেখা হয়েছে ‘অক্ষর’ দিয়ে। এই বর্ণমালায় বাছাই করার জন্য মাত্র চারটি বর্ণ আছে [ইংরেজি বর্ণমালায় যেমন আছে ২৬টি], আমরা ডিএনএ বর্ণগুলো লিখি A, G, T এবং C, এই চারটি বর্ণ ব্যবহার করে। খুব সামান্য কিছু গুরুত্বপূর্ণ পার্থক্য ছাড়া একই জিনের দেখা মেলে বহু ভিন্ন ভিন্ন জীবের শরীরে, যেমন একটি জিন, যার নাম FoxP2 [ফক্সপি-টু], সব স্তন্যপায়ীদের শরীরে সেটি আছে তো বটেই, এছাড়া আরো অন্য অনেক জীবের শরীরেও এটি দেখা যায়। এই জিনটি ২০০০-এর বেশি অক্ষর দিয়ে সাজানো একটি সুতা। 

আপনি বলতে পারেন ‘ফক্সপি-টু’ জিনটি সব স্তন্যপায়ী প্রাণীর শরীরে একই রকম, কারণ সংকেতটির বেশিরভাগ বর্ণ একই। শিম্পাঞ্জিদের সব বর্ণগুলো পুরোপুরি একরকম নয় আমাদের সাথে এবং ইঁদুরের সাথে যতটা পার্থক্য আছে, তার থেকে অবশ্যই কম। শিম্পাঞ্জিদের এই জিনটির সব ‘অক্ষরগুলো’ আমাদের সাথে মিলবে না। আমাদের জিনটি তুলনা করলে দেখা যাবে, তাদের ফক্সপি-টু জিনের ২০৭৬টি অক্ষরের মধ্যে মাত্র ৯টি অক্ষর আলাদা, আর ইঁদুরের মাত্র ১৩৯টি অক্ষর ভিন্ন। অন্য জিনদের ক্ষেত্রে এই একই ধরনের সজ্জা আমরা লক্ষ করব। এটাই ব্যাখ্যা করে কেন শিম্পাঞ্জিরা আমাদের এত নিকটাত্মীয়, আর ইঁদুর কেন অপেক্ষাকৃত দূরের আত্মীয়। 

শিম্পাঞ্জিরা হচ্ছে আমাদের সবচেয়ে কাছের আত্মীয়, আমাদের কাজিন, আর ইঁদুররা আরো কিছুটা দূরের আত্মীয়। দূরের আত্মীয় মানে, আমাদের দুটি প্রজাতির সবচেয়ে সাম্প্রতিক সাধারণ পূর্বসূরি প্রাণী বহুদিন আগে বেঁচে ছিল। বানররা ইঁদুরদের চেয়ে আমাদের বেশি নিকটবর্তী, কিন্তু শিম্পাঞ্জিদের তুলনায় আমাদের দূরের আত্মীয়। বেবুন আর রিসাস ম্যাকাক উভয়ই বানর, পরস্পরের নিকটাত্মীয়, প্রায় হুবহু তাদের ফক্সপি- টু জিনটি। তারা শিম্পাঞ্জি থেকে যতটা দূরের ঠিক ততটাই আমাদের দূরের আত্মীয়। ফক্সপি-টু জিনে ডিএনএ অক্ষরগুলোর মোট ভিন্নতা যা শিম্পাঞ্জি আর বেবুনের মধ্যে পার্থক্য করে তা প্রায় হুবহু একই রকম [২৪] এই জিনটিতে যে সংখ্যক ডিএনএ অক্ষর বেবুনদের সাথে আমাদের বিভেদ করে [২৩]। খুব সহজেই সবকিছু সঙ্গতিপূর্ণ হয়ে যখন আমরা ডিএনএ-তে উত্তর খুঁজি। 

আর এই ভাবনাটা শেষ করার আগে আরো একটি বিষয়, জিনগতভাবে ব্যাঙরা সব স্তন্যপায়ীদের চেয়ে অনেক দূরবর্তী। প্রত্যেক স্তন্যপায়ীদের এই জিনটি ব্যাঙ থেকে একই সংখ্যক ডিএনএ অক্ষরে ভিন্ন [প্রায় ১৪০] এবং খুব সরল কারণে তারা সবাই ঠিক সমপরিমাণ দূরের আত্মীয়। সব স্তন্যপায়ীরা ব্যাঙের সাথে যে সাধারণ পূর্বসূরি ভাগ করেছিল [৩৪০ মিলিয়ন] তার চেয়ে পরস্পরের সাথে অপেক্ষাকৃত কম সাম্প্রতিকতম সময়ে একজন সাধারণ পূর্বসূরি ভাগ করেছিল [প্রায় ১৮০ মিলিয়ন বছর আগে]। 

কিন্তু অবশ্যই সব মানুষই অন্য সব মানুষদের মতো একই নয় এবং সব বেবুনও অন্য সব বেবুনদের মতো একই নয়, সব ইঁদুরই অন্য সব ইঁদুরের মতো নয়। আমার জিনের প্রতিটি অক্ষরের সাথে আপনার জিনের প্রতিটি অক্ষরের তুলনা করে আমরা দেখতে পারি এবং ফলাফল? আমরা দুজনেই শিম্পাঞ্জির সাথে যতটা অক্ষর ভাগাভাগি করি, আমাদের দুজনের আরো বেশি অক্ষর একই হবে, কিন্তু তারপরও আমাদের দুজনের মধ্যে অক্ষরের কিছু ভিন্নতা আমরা খুঁজে পাব। খুব বেশি নয় আর ফক্সপি-টু জিনটাকে আলোচনার জন্য আলাদা করে বেছে নেবার পেছনে কোনো বিশেষ উদ্দেশ্য নেই, কিন্তু আপনি যদি আমাদের সব জিনে সব ডিএনএ অক্ষরগুলোকে গণনা করেন সেটি আমাদের যে কেউই কোনো শিম্পাঞ্জিদের সাথে যতটা অক্ষর ভাগাভাগি করি, তার চেয়ে বেশি হবে এবং আপনি আমার সাথে যতটা অক্ষর ভাগাভাগি করেন তার চেয়ে বেশি অক্ষর আপনার কাজিনের সাথে ভাগাভাগি করেন। আপনি আরো বেশি অক্ষর ভাগ করে নেন আপনার মা ও বাবা এবং ভাই ও বোনদের সাথে [যদি আপনার তা থাকে]। বাস্তবিকভাবে, কোনো দুটি মানুষ কতটা পরস্পরের নিকটাত্মীয় সেটি তারা যত সংখ্যক ডিএনএ অক্ষর ভাগাভাগি করে তা গণনা করার মাধ্যমে আপনি সমাধান করতে পারবেন। বিষয়টি খুব কৌতূহলোদ্দীপক এবং ভবিষ্যতে আমরা এই বিষয়ে সম্ভবত আরো অনেক বেশি কিছু শুনব। যেমন—পুলিশ হয়তো কাউকে খুঁজে বের করতে পারবে যদি তাদের কাছে তার ভাইয়ের ডিএনএ ‘ফিংগার প্রিন্ট’ থাকে। 

সব স্তন্যপায়ীদের মধ্যে কিছু জিন আছে তারা শনাক্তযোগ্যভাবেই একই [কিছু খুব সামান্য পার্থক্য ছাড়া]। এইসব জিনে কতটা অক্ষর ভিন্ন সেটি গণনা করা বিভিন্ন স্তন্যপায়ী প্রজাতিরা কতটা নিকটাত্মীয় সেটি নির্ণয় করার বেশ উপযোগী একটি উপায়। অন্য জিনগুলো বেশ উপযোগী দূরবর্তী সম্পর্কগুলো নিরূপণে, যেমন—মেরুদণ্ডী ও কেঁচোদের মধ্যে। অন্য জিনগুলো আবার একই প্রজাতির সদস্যদের মধ্যে সম্পর্ক নিরূপণে উপযোগী, যেমন ধরুন আপনি আমার কতটা নিকটাত্মীয় সেটি নির্ণয়ে যদি আপনি আগ্রহী হন এবং যদি আপনি ইংল্যান্ডের হন, আমাদের সবচেয়ে নিকটতম সাধারণ পূর্বসূরি মাত্র কয়েক শতাব্দী আগেই সম্ভবত বেঁচে ছিলেন। যদি আপনি তাসমানিয়ার স্থানীয় হন, অথবা আমেরিকার আদিবাসী হন, কোনো সাধারণ পূর্বসূরি খুঁজে বের করতে তাহলে আমাদের কয়েক লক্ষ বছর আগে যেতে হবে। যদি আপনি কালাহারি মরুভূমির কুঙ সান হয়ে থাকেন, তাহলে আমাদের আরো অতীতে যেতে হবে। 

সব সন্দেহের ঊর্ধ্বে বাস্তব সত্যটি হচ্ছে, এই গ্রহে প্রতিটি প্রাণী ও উদ্ভিদ প্রজাতির সাথে আমরা একটি সাধারণ পূর্বসূরি ভাগাভাগি করেছি। এর কারণ কিছু জিন শনাক্তযোগ্যভাবে সব জীবে একই, প্রাণী, উদ্ভিদ আর ব্যাকটেরিয়ায়। আর সর্বোপরি, জেনেটিক কোডটি, যে অভিধান ব্যবহার করে সব জিন অনূদিত হয়—সমস্ত জীবে, এ যাবৎ যে কয়টি জীবের সাথে দেখা হয়েছে, প্রতিটি জীবেই এটি একইভাবে কাজ করে। প্রতিটি জীবই, আমরা সবাই পরস্পরের আত্মীয়। আপনার পারিবারিক বৃক্ষে সুস্পষ্টভাবে নিকটাত্মীয়, যেমন—শিম্পাঞ্জি বা বানরই থাকবে, সেখানে থাকবে ইঁদুর, বাফালো, ইগুয়ানা, ওয়ালবি, শামুক, ড্যান্ডেলিয়ন, সোনালি ঈগল, ছত্রাক, তিমি, ওমব্যাট ও ব্যাকটেরিয়াও। প্রত্যেকেই আমাদের আত্মীয়, যে প্রজাতিরই সদস্য সেটি হোক-না কেন। যে-কোনো পুরাণ বা কিংবদন্তির চেয়ে এটি কি আরো বিস্ময়কর একটি ভাবনা নয়? আর সবচেয়ে চমৎকার বিষয়টি হচ্ছে আমরা নিশ্চিতভাবে জানি যে এটি আক্ষরিকভাবেই সত্য। 

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *