২. কুলো সিং চা এনে

অন্ধকার থাকতে কুলো সিং চা এনে অভীর ঘুম ভাঙালো। রাতে বেশ বৃষ্টি হয়েছিল। এ সময়টা প্রতি রাতেই বৃষ্টি হয় ইম্ফলে। চাঁদর জড়িয়ে শুতে হয় রাতে। বেশ একটা হিমেল আমেজ।

চান-টান করে তৈরি হয়ে নিল ও। ফাইল-পত্ৰ কুলো সিং সব গাড়িতে তুলে দিলো। কাল বিকেলেই তেল-টেল ভরে গাড়ি ঠিকঠাক করে রেখেছিল। টায়ারগুলোর অবস্থা ভালো নয়।

পথে পটাং করে ফেটে না যায়। দশ বছরের পুরোনো সেকেন্ডহ্যান্ড গাড়ি সস্তায় পেয়ে কিনেছিল। একজন অল্পবয়সি ব্যাচেলারের পক্ষে এ গাড়ি যথেষ্ট ভালো। অন্তত খারাপ মনে হয় নি কখনও।

কিন্তু গাড়ি যখন কেনে, তখন একবারও ভাবে নি যে একজন যুবতী মেয়েকে নিয়ে নাগা-হিল্‌সের মধ্য দিয়ে এতখানি পথ এ গাড়িতে যেতে হবে। ভেবেই বেশ নার্ভাস লাগতে লাগল ওর।

বড় সাহেবের গাড়ি নিয়েই যেতে পারত। কিন্তু তার গাড়ির ইঞ্জিন নামান হয়েছে কালই সকালে। জীপে করে ঝড়ে-জলে এতখানি রাস্তা এই পাহাড়ে, মেয়েদের পক্ষে যাওয়া সত্যিই অসুবিধে।

বড় সাহেবের বাড়ি ঢুকে পড়ল অভী। তখনো সূর্য ওঠে নি। তবে চারপাশ আলো হয়েছে। ঝিরঝির করে হাওয়া দিচ্ছে দেবদারু গাছের পাতায় পাতায়। ওরা সকলে বারান্দাতেই বসেছিলেন। চা খাচ্ছিলেন।

বাবলিকে (যার ভালো নাম দময়ন্তী) অভী একদিন মাত্র দেখেছিল। বড় সাহেবের ছোট ছেলের জন্মদিনে। অনেকের মধ্যে দেখা। হাত জোড় করে নমস্কার করেছিল।

চেহারা এমন নয় যে চোখে পড়ে। বেশ একটু মোটার দিকে, মুখ চোখও যে ভীষণ সুন্দর তা নয়। তবে সব মিলিয়ে বেশ মিষ্টি। অন্যান্য অবাঙালি অতিথিদের সঙ্গে অনর্গল এবং সপ্রতিভ ইংরেজিতে কথা বললেও অভীকে বাংলায় বলেছিল, আপনার কথা অনেক শুনেছি। মাসীমা মেসোমশায়ের কাছে। এই ভিড়ে আলাপ হয় না। পরে একদিন আসবেন। গল্প করা যাবে, কেমন?

বড় সাহেবের এমন সর্বগুণসম্পন্না মোটা এবং মোটামুটি মিষ্টি শালী মেয়ের সঙ্গে বেশি গল্প করে চাকরির সর্বনাশ করে এমন মূর্খ রোমান্টিক অভী কখনোই ছিল না। তাই ওর চেয়ে বেশি আলাপ হয় নি সেদিন।

পোর্টিকোতে গাড়ি ঢুকতেই ওরা সকলে উঠে দাঁড়ালেন। গাড়ির বুট খুলে দিল অভী। স্যুটকেসটা ওঠানো হল। সঙ্গে বিছানা-টিছানা নেই। আসবার সময় প্লেনে এসেছিলেন। তাই বিছানা আনেন নি।

ঘোষ সাহেব বললেন, কোহিমার লাইন খারাপ। ফোনে পাইনি। সকালেও চেষ্টা করব। আশা করি এম, এল, এস হোস্টেলে জায়গা পেয়ে যাবে তোমরা রাত কাটাবার মতো। তাই আর বিছানাপত্রর লটবহর দিলাম না।

মিসেস্ ঘোষ বললেন, অভী দেখে বাবা, সাবধানে নিয়ে যেও। মা-মরা মেয়ে।

তারপর বাবলির দিকে ফিরে বললেন, দেখিস তুই আবার পথে ঝগড়া করিস না, যা ঝগড়াটে মেয়ে তুই।

যাকে একথা বলা হল, সে জবাব দিল না। ওদের প্রণাম করে বাবলি নিজেই সামনের দরজা খুলে বসল।

অভী দরজা বন্ধ করে ঘুরে এসে স্টিয়ারিং-এ বসল। তারপর বাড়ির গেট ছাড়িয়ে ওরা খোলা রাস্তায় এসে পড়ল।

বর্ষার ভোরের মণিপুরের যা নয়ন-ভোলানো দৃশ্য এমন একটা বড় দেখা যায় না। হু হু করে হাওয়া লাগছে চোখে-মুখে। অভী আড়চোখে দেখতে পাচ্ছে ওর সঙ্গিনীর চুল এলোমেলো হচ্ছে। গাল ও কপালময় অনেক ওড়াউড়ি করছে। কিন্তু সে তন্ময় হয়ে পথের দিকে চেয়ে আছে। ওর চোখ দেখে মনে হচ্ছিল পথকে ও নিশ্চয়ই ভালোবাসে।

দেখতে দেখতে ইম্ফল শহর পিছনে ফেলে কাকোকির দিকে এগিয়ে চলল। এ পথে অভীকে কোহিমা অবধি প্রায়ই যাওয়া আসা করতে হয়। আগে বৈরী নাগারা প্রায়ই অতর্কিতে আক্রমণ করত।

অবশ্য ও আসার পর কোনোদিনও দেখে নি, তখন নাকি বাস ও গাড়ির কনভয় যেতো একসঙ্গে সামনে ও পেছনে অনেক আর্মি ট্রাকের এসকর্ট নিয়ে। এখন সেসবও উঠে গেছে।

তবে নানা জায়গায় ভীষণরকম চেকিং হয়। বিশেষ করে নাগাল্যান্ডে ঢোকার মুখে খুজ্‌মাতে। এবং বেরোবার সময়ও।

এ পথের দু’দিকে যা দৃশ্য তা কাশ্মীরের উপত্যকার দৃশ্যকেও ম্লান করে দেয়। আর বর্ষাকালের তো তুলনা নেই। যেদিকে চোখ যায় সবুজ, শুধু সবুজ। মালভূমি থেকে ধীরে ধীরে উঁচু হয়ে ওঠা প্রাচীন অথচ প্রসন্ন সব পাহাড়।

ইম্ফল থেকে বেশ কয়েক মাইল চলে এসেছে ওরা।

ইতিমধ্যে অভীর সঙ্গিনী কেবল একটি মাত্র কথা বলেছেন, আমার জন্যে আপনার মিছিমিছি এত কষ্ট করতে হল।

জবাবে অভী বলেছিল, কষ্ট যে হ’লই, এখনো সে সম্বন্ধে নিশ্চিত হই নি।

কষ্ট হলে নিশ্চয়ই জানতে পারবেন।

উত্তর শুনে অবাক মুখ করে অভীর দিকে চেয়ে, মুখ নামিয়ে সঙ্গিনী চুপচাপ হয়ে গেছিলেন। তারপর আর কোনো কথা হয় নি।

পাহাড়ি পথে একটা বাঁক ঘুরতেই ওপাশ থেকে একটা জীপ এমনভাবে এলো যে একটু হলে অ্যাক্সিডেন্ট হয়ে যেত।

অভী কোনোক্রমে সামলে নিয়ে জানালা দিয়ে মুখ বার করে অপসৃয়মান জীপের ড্রাইভারের উদ্দেশ্যে বলল, শালা।

বলেই, লজ্জা পেয়ে বাবলির দিকে চেয়ে বলল, সরি, ভেরি সরি। একা একা গাড়ি চালাই তো। সঙ্গে ভদ্রমহিলা কেউ থাকেন না। অভ্যেস খারাপ হয়ে গেছে।

বাবলি চোখ তুলে একবার অভীর দিকে তাকালো। তারপর একটা বড় নিঃশ্বাস ফেলল ও, ও খুব ভয়ে পেয়ে গেছিল। তারপর বলল, আমার খুব চা তেষ্টা পেয়েছে।

অভী হাসল। বলল, আমারও; চলুন, সামনেই কাকোকি। সেখানে গরম চা ও সিঙাড়া খাব।

বাবলির মুখে এবার কথা ফুটল। বলল, এখনো আমরা মণিপুরে আছি নাগাল্যান্ডে পৌঁছে গেছি?

অভী বলল, নাগাল্যান্ড এখন কোথায়! পৌঁছতে দেরি আছে। কোহিমা পৌঁছতে পৌঁছতে তো বিকেল হয়ে যাবে।

–পথে কী কী জায়গা পড়বে?

–এই রে। আমি কী আর মুখস্থ করে রেখেছি। দাঁড়ান মনে করে দেখি–।

তারপরই বলল, মোটামুটি মনে আছে। এই ধরুন কানকোপকির পর কারোং তারপর মারাম। মারামের পর তাদূবী। তাদূবীর পর মাও। মাওতে এসে আমরা নাগাল্যান্ডে ঢুকব। মাও-এর পর খুজ্‌মা। খুজ্‌মার পর জাখ্‌মা। জাখ্‌মাতে এ অঞ্চলের আর্মি হেডকোয়ার্টার্স। জাখ্‌মার পর কোহিমা।

বাবলি বলল, নাগাল্যান্ডের সব জায়গার নামই কি মা দিয়ে?

–কেন?

একহাতে স্টিয়ারিং ধরে অন্য হাত নাড়িয়ে অভী বলল, কেন তা জানি। হয়তো ওরা খুব মা ভক্ত বলে।

বাবলি অভীর বলার ধরন দেখে হেসে ফেলল।

দেখতে দেখতে কানকোপকিতে এসে গেল ওরা। চায়ের দোকানের সামনে গাড়ি থামিয়ে অভী গিয়ে বাবলির দরজা খুলল। বাবলি নামল।

দোকানটা অনেক উপরে পাহাড়ের গায়ে। তারপর অভীর সঙ্গে সিঁড়ি বেয়ে বাবলি চায়ের দোকানটায় পৌঁছলো।

এখানে বেশ ঠাণ্ডা। ইম্ফলেও বেশ ঠাণ্ডাই এখন।

তবে এদিকে ঠাণ্ডাটা বেশি। একটা হাওয়া দিয়েছে কনকনে। দোকানের বেঞ্চে বসতে বসতে অভী বলল, কোহিমাতে বেশ ঠাণ্ডা হবে।

মনে হচ্ছে, বলল বাবলি, বলে চাঁদরটা ভালো করে টেনেটুনে বসল।

সিঙাড়া ও চা খেতে খেতে বাবলি হঠাৎ বলল, আমার সিঙাড়া খাওয়া উচিত নয়। না?

অভী অবাক হয়ে বলল, কেন?

না, আমাকে সকলে বলে স্লিমিং করা উচিত।

অভী বলল। না না, আপনি তো মোটা নন।

বাবলি চায়ের প্লেটটা নামাল। নামিয়ে বলল, নই, না? আমার জাস্ট স্বাস্থ্য। ভালো, তাই না? তারপর চা দিয়ে সিঙাড়া গিলে ফেলে বলল, বিনা কারণে মিথ্যা কথা বলেন কেন?

অভী রীতিমত অপ্রতিভ হয়ে পড়ল। এমন যুবতী সে জীবনে দেখে নি যে নিজেকে মোটা বলে প্রচার করে আনন্দ পায়। জবাবে কিছু বলল না ও।

এমন সময় একটা বাস এসে কাকোকির পুলিশ স্টেশনের সামনে দাঁড়াল। .

বাস থেকে পায়জামা-পাঞ্জাবি ও শাল জড়ানো এক বাঙালি ভদ্রলোক নামলেন। বয়স বেশি না।

ভদ্রলোককে দেখেই অভী উঠে দাঁড়াল। চেঁচিয়ে বলল, আরে রাজীববাবু যে, কোথায় চললেন?

ভদ্রলোক দূর থেকেই চেঁচিয়ে বললেন, কোহিমা। আপনি? আমিও তাই। অল রোডস, লিড টু রোম। বাবলি জিজ্ঞেস করল, ভদ্রলোক কে বলুন তো? কোথায় যেন দেখেছি মনে হচ্ছে।

অভী বেশ কৃতিত্বের সঙ্গে বলল, একে নিশ্চয়ই দেখেছেন। কলকাতাতেই থাকেন। ইনি ইয়াং জেনারেশানের একজন বেশ নামকরা সাহিত্যিক। এঁর নাম রাজীবলোচন! এঁর বিখ্যাত উপন্যাস “আশ্চর্যপতন” পড়েন নি?

বাবলি উত্তরে কিছু বলল না। কিছুক্ষণ পর নিচের দিকে চেয়ে খুব আতঙ্কিত গলায় বলল, ওমা, ওই দেখুন আপনার রাজীবলোচন ফুল্ললোচনে এদিকেই আসছেন। আপনি নিশ্চয়ই ওঁকে বলবেন, চলুন না, একসঙ্গে গাড়িতেই যাই। বাসে কেন কষ্ট করে যাবেন? তাই না?

অভী হাসল, বলল, হয়তো বলবো। আমি নিজে না বললেও উনিই হয়তো বলবেন, ওই জন্যই বোধহয় উঠে আসছেন।

বাবলি ফিফিস্ করে আদেশের সুরে বলল, না’ করে দেবেন।

–কেন? অবাক হয়ে অভী শুধালো। একজন তরুণ সাহিত্যিকের সঙ্গে এতখানি পথ যাবেন। আপনার ভালো লাগবে না?

–না, আমি সাহিত্যিকদের মোটেই পছন্দ করি না।

–কেন? অভী অবাক হয়ে শুধালো।

–পরে বলব। বাবলি বলল। ইতিমধ্যে রাজীবলোচন সিঁড়ি বেয়ে ওদের কাছে এসে পৌঁছলেন তাপর সোজা অভীর কাছে এসে বললেন–এখানে কঁচা লঙ্কা পাওয়া যাবে?

কাঁচালঙ্কা?

হ্যাঁ। নিচের দোকানে মিষ্টি খেয়ে মুখ একেবারে মরে গেছে।

দোকানী একটা কালো কালো পুরুষ্ট তেল কুচকুচে কঁচালঙ্কা এনে দিল। রাজীবলোচন কাঁচালঙ্কাটা নিয়ে, লোকে যেমন করে গন্ধরাজ ফুলের বোঁটা ধরে গন্ধ শুঁকতে শুঁকতে পথ হাঁটেন, তেমন করে আঙুলে ধরে চিবোতে চিবোতে সিঁড়ি বেয়ে নামতে লাগলেন।

সিঁড়ির আধাআধি নামতে-না-নামতেই হঠাৎ একটা আলোড়নের শব্দ শোনা গেল। এবং হাতে কঁচালঙ্কা ধরা অবস্থাতেই দোকানদারের খোঁটায় বাঁধা একটা সাদা পাঁঠার গলার দড়িতে হোঁচট খেয়ে অবোধ পাঁঠাটার সঙ্গে, গায়ের শালের সঙ্গে জড়িয়ে গিয়ে রাজীবলোচন ও পাঁঠা (বাবলি তার নাম জানে না) দুজনেই সিঁড়িতে পড়ে হুড়োহুড়ি করতে লাগলেন।

অভী দৌড়ে গিয়ে রাজীবলোচনকে তুলে ধরে বাসের কাছে পৌঁছে দিয়ে এল।

তারপর ফিরে এসে বাবলিকে বলল, এবার নেমে আসুন, চলুন যাওয়া যাক।

বাবলি আস্তে আস্তে নেমে এল, পাঁঠাটার পাশ দিয়ে আসার সময় বাঁ হাত দিয়ে পাঁঠাটার গায়ে একটু আদর করে দিল।

অভী স্টার্ট করল গাড়ি। গাড়িটা দাঁড়িয়ে থাকা বাসটাকে অতিক্রম করে যেতেই বাবলি বলল, “আশ্চর্যপতন”।

অভী প্রথমে বুঝতে পারল না, পরক্ষণেই হো হো করে হেসে উঠল, অনেকক্ষণ ধরে হাসল, বলল, না, আপনি তো সাংঘাতিক মেয়ে।

বাবলি উত্তর না দিয়ে জানালা দিয়ে বাইরে চেয়ে রইল। হাসি থামলে অভী বলল, আপনি সাহিত্যিকদের পছন্দ করেন না কেন?

–এমনিই। ব্যক্তিগত কারণে।

–ওঃ! মানে আমাকে নিশ্চয়ই বলা যায় না।

এবার বাবলি মুখ ঘুরিয়ে বলল, নাঃ, তেমন নয়; তেমন ব্যক্তিগত নয়, মানে আমার, আমার ওদের সকলের ওপর দারুণ অভিমান আছে। রাগও বলতে পারেন।

–কেন? কেন?

–ওঁরা জার্নালিজম করেন, যা দেখেন তারই ছবি আঁকেন। ওঁরা নতুন কিছু সৃষ্টি করেন না। আজকালকার এই আপনাদের মতো তরুণ লেখকরা, ওঁদের কারোরই কোনো গভীর বিশ্বাস নেই–ওঁদের কেবল এক-একটি ক্ষণস্থায়ী ভঙ্গী আছে, জুলপীর পরিবর্তনশীল দৈর্ঘ্যের মতো, তাই এঁদের সম্পর্কে কোনো ইন্টারেস্ট নেই।

অভী বলল, বাবা, আপনি যেমন বাংলা বলছেন, ভয় হচ্ছে আপনিও লেখেন-টেখেন।

বাবলি বলল, লিখি না, তবে হয়তো লিখব কোনোদিন।

–কী নিয়ে লিখবেন?

–ঢোলা প্যান্ট ঢিলে-ঢালা উপর-চালাকিতে বিশ্বাস করে না এমন ছেলেদের নিয়ে। যাদের নিয়ে কেউ লেখে না। ওরকম রিয়্যাল স্মার্ট ছেলেদের নিয়ে লিখব।

বাবলি যখন এসব কথা বলছিল, তখন অভী আড়চোখে অ্যাক্সিলেটারের ওপর চাপিয়ে রাখা পায়ের দিকে চেয়ে নিজের প্যান্টের ঘেরটা দেখে নিল। মাঝামাঝি। আশ্বস্ত হল।

অভী গাড়িটাকে আস্তে করল। একটা সিগারেট ধরালো।

ওরা কারোং পেরিয়ে গেল। পথের পাশে হাট। নাগারা পাহাড় থেকে হরিণ আর শুয়োর মেরে এনে হাটে বসেছে। গাছতলায় পাতা পেতে হরিণ আর শুয়োরের মাংস নিয়ে।

লম্বা লম্বা বাঁশের পাইপ খাচ্ছে। বলিরেখাভরা তামাটে কপালে হাত বোলাচ্ছে।

নাগা ছেলেমেয়েদের পায়ের দিকে চেয়ে থাকতে হয়, কী সুন্দর তামাটে শক্ত সুঠাম পা ওদের। পায়ের যতটুকু দেখা যায়, শুধু বার বার দেখতে ইচ্ছে করে।

–আপনি কিন্তু আসল কথাটা এড়িয়ে গেলেন। অভী বলল। ব্যক্তিগত কারণটা বললেন না। কেন সাহিত্যিকদের অপছন্দ করেন?

–বলতে পারি, যদি আপনি দশজনকে বলে না বেড়ান।

–আমার দশজন নেইই-তো বলব কাকে?

–অপছন্দ করি, এই কারণে যে, কোনো সাহিত্যিকই আমার মতো মোটাসোটা মেয়েদের নায়িকা করে কখনো কোনো গল্প লেখেননি। ওঁদের ভাবটা এমন যে, যত বুদ্ধি আর মেধা সব যেন ফিগার-সর্বস্ব সুন্দরী মেয়েদেরই একচেটে। এতেই মনে হয়, যাদের নিয়ে এঁরা লেখেন, বা যা নিয়ে লেখেন তা তারা নিজেরা দেখেন নি বা জানেন না।

এবার অভী হাসল। বলল, আপনার একটা অবসেশান আছে আপনার মোটাত্ব সম্বন্ধে। আসলে কিন্তু আপনি তেমন মোটা নন। আপনি দেখতে অসুন্দরীও নন।

বাবলি মুখ ঘুরিয়ে বলল, আপনি কি আমার কাছে কিছু চান? এত তোষামোদ করছেন কেন? এই বলে বাবলি অনেকক্ষণ অভীর দিকে চেয়ে থাকল।

অভীও মুখ ঘুরিয়ে বাবলির দিকে তাকাল।

অভীর হঠাৎ মনে হল, হঠাৎ-ই মনে হল যে, এই মোটা-সোটা বেশি। কথা বলা মেয়েটির মতো বুদ্ধিদীপ্ত ও মিষ্টি মুখ ও দেখে নি আর আগে। অথবা এমন মনোযোগ সহকারেও এর আগে আর কারো মুখের দিকে তাকায়নি।

বাবলিও হয়তো উত্তরের প্রত্যাশা করল না।

অভী পথের দিকে চেয়ে গাড়ি চালাতে লাগল। বাবলি জানালা দিয়ে বাইরে চেয়ে রইল।

অনেকক্ষণ, বহুক্ষণ, দুজনের কেউই কোনো কথা বলল না। একেবারে চুপ করে রইল। ক্লান্তিতে নয়, বিরক্তিতে নয়, সেই হিম হিম পার্বত্য আবহাওয়ার প্রসন্ন পরজ ভোরে নিছক এক অর্থহীন ভালোলাগায় দুজনে নিঃশব্দে ঝুঁদ হয়ে রইল।

দেখতে দেখতে ওরা মাও-এ পোঁছল। এখানে মণিপুরের সীমানা শেষ। নাগাল্যান্ড আরম্ভ। ঠাণ্ডা আস্তে আস্তে বাড়ছে। রোদ উঠছে। কিন্তু রোদে দাঁড়ালে ভালো লাগে।

খুজ্‌মা পোঁছতেই গম্ভীরদর্শন নাগা গার্ডরা তন্ন তন্ন করে গাড়ি তল্লাশী করল। ড্যাশ বোর্ডে রাখা বাবলির ক্যামেরাটা আর একটু হলে ওরা বাজেয়াপ্ত করেই ফেলেছিল। অনেক করে তাদের বুঝিয়ে সেটা ফেরত পাওয়া গেল। নাগা গার্ডগুলোর মুখের দিকে চেয়ে মনে হয় জন্ম থেকে এরা কখনো হাসে নি। বাবলি ওদের তল্লাশীর পদ্ধতি দেখে বেশ ঘাবড়ে গেল। ওর মুখ-চোখে ভয়ের ছায়া পড়ল।

খুজ্‌মা থেকে বেরিয়ে কোহিমার আগে অবধি পথের বাঁ দিকে ইন্ডিয়ান আর্মির ক্যাম্প। প্রচুর জোয়ান আছে এ অঞ্চলে। পথে একজন অফিসারের জীপ গেলে আগে পিছনে দুটি করে আর্মি ট্রাকের এসকর্ট। কখন যে কোথা থেকে কে ‘কড়াক পিঙ’ করে দেবে কে জানে?

ওরা কেউই আশা করে নি যে অত সকাল সকাল ওরা কোহিমা পৌঁছে। যাবে। কোহিমার কাছাকাছি আসতেই বাবলি উঃ আঃ করে নানারকম অভিব্যক্তি প্রকাশ করতে লাগল। এখনো দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের চিহ্নস্বরূপ জাপানী ট্যাঙ্ক পড়ে আছে পথের পাশে মূকচিহ্ন গায়ে নিয়ে।

অভী বলল, চলুন, এম-এল-এ’স হস্টেলে মুখ হাত ধুয়ে নিয়ে আমরা সিমেট্রিতে আসব। কোহিমার কবরখানা দেখবার মতো, কত অল্পবয়সী ছেলে যে এখানে শুয়ে আছে তা বলার নয়। আর প্রত্যেকের কবরের উপরে পাথরে কী যে সব লাইন লেখা তা না দেখলে বিশ্বাস হবে না। পড়তে পড়তে চোখ ভিজে ওঠে।

বাবলি বলল, আপনি লোকটা পেসিমিস্ট!

কবরখানা কোনো সুস্থ লোকে দেখে নাকি? যতই সুন্দর হোক না কেন তা, শেষের দিনে তো কবরখানা সকলেরই দেখতে হবে। আমি ওর মধ্যে নেই। তার চেয়ে হাত মুখ ধুয়ে চলুন কোথাও টিপিকাল নাগা খানা খাই।

আমার খিদে পেয়ে গেছে। আমার ভীষণ তাড়াতাড়ি খিদে পায়। সেই কখন চারটে সিঙাড়া খেয়েছি। আপনার পাল্লায় পড়ে দেখছি আমার সযত্নে লালিত মোটাসোটা শরীরটা খারাপ হয়ে যাবে।

নাগাল্যান্ড অ্যাসেমিব্লীর উল্টোদিকে এম-এল-এস হস্টেলে গাড়ি রেখে ওরা হাত মুখ ধুয়ে নিল, অভী বাইরে এসে রোদে দাঁড়িয়ে আরাম করে একটা সিগারেট ধরালো। ততক্ষণে বাবলি শাড়ি পাটে নিল।

বাবলি যখন নতুন শাড়িতে বাইরে বেরোল (বেগুনী আর গোলাপি জংলা কাজের একটা টেরিট শাড়ি পরেছিল) তখন রোদের মধ্যে হঠাৎ ওকে নতুন কোনো মেয়ে বলে মনে হল অভীর।

যেন ওর সঙ্গে এতখানি পথ ও গাড়িতে আসে নি। একটা বেগুনী খদ্দরের স্টোল জড়িয়েছিল বাবলি–মধ্যে কাঁচের চুমকি বসানো। বাইরে এসেই বাগানের একটি বেগুনী ফুল ছিঁড়ে নিয়ে খোঁপায় গুজলো ও, আর সঙ্গে সঙ্গে হাঁ হাঁ করে মালি দৌড়ে এল। বলল, কা কিয়া?

বাবলি ষণ্ডা-গণ্ডা নাগা মালির দিকে ঘুরে দাঁড়িয়ে শর্মিলা ঠাকুরের মতো হাসল। হাসলে, বাবলির গালে টোল পড়ে। তারপরে বলল, যো কিয়া; সো কিয়া।

মালি বলল, আবার, হায় হায়, কা কিয়া?

তারপর বাবলি ওর খোঁপায় হাত ছুঁইয়ে মালিকে দেখিয়ে বাংলায় বলল, তোমার ফুলের এর চেয়ে বেশি ইজ্জত আর কি হতে পারতো? দ্যাখো না, কেমন মানিয়েছে।

মালি মেমসাহেবের কাণ্ড দেখে হতবাক, এমন মেয়েছেলে সে এর আগে দেখে নি বলেই তার কপাল কুঁচকানো দেখে মনে হল। অভীও দেখে নি।

বাবলি অভীর কাছে এসে বলল, চলুন এবার; খিদেয় পেট চুই চুই করছে।

অভী বলল, আপনি একটি পাগলী। রিয়েল পাগলী। বাবলি ওর দিকে একবার তাকালো, আঙুল দিয়ে ফুলটা ঠিক আছে কি না দেখে নিল, তারপর অভীর পাশে হেঁটে চলল।

বাবলি বলল, কোনো ভালো জায়গায় যেতে চাই না। বুঝেছেন স্যার? আমি একেবারে আসল নাগা খাবার খেতে চাই।

–বাজারের মধ্যে যাবেন? ওসব জায়গায় সাধারণতঃ ভদ্রলোকের মেয়েরা যেতে ভয় পান, যাওয়া উচিতও নয়।

বাবলি বলল, আমি ভদ্রলোকের মেয়ে আপনাকে কে বলল? তাছাড়া আমি যথেষ্ট বড় হয়েছি। কি করা উচিত না উচিত আমি বুঝি। মেলোমশায়ের এক্তিয়ার ছেড়ে এসে আর এক পিসেমশায়ের খপ্পরে পড়লাম দেখছি।

যে জায়গাটায় ওরা পৌঁছলো, সেটা সত্যিই নোংরা, দোকানটাও নোংরা। অদ্ভুত পোশাকে অদ্ভুতদর্শন সব নাগারা বড় বড় দা নিয়ে ঘোরাফেরা করছে।

অভী বলল, ব্যাঙ খাবেন? না সাপ খাবেন?

কথাটা অভী ভয় পাওয়াবার জন্যই বলল।

বাবলি উত্তরে খুব উৎসাহের সঙ্গে বলল, ব্যাঙ আগে খেয়েছি; সাপ খাবো, কেমন?

অভী একেবারে নিভে গেল।

অভীর কপাল ভালো, সাপ অথবা ব্যাঙ কিছুই পাওয়া গেল না।

শুয়োরের ডালনা দিয়ে ওরা ভাত খেল, প্রচণ্ড ঝাল। খেতে খেতে দুজনের চোখ দিয়েই জল বেরোতে লাগল–দুজনেই জিভ দিয়ে ফুঃ ফুঃ আওয়াজ করতে লাগল।

খাওয়া-দাওয়ার পর বাবলি বলল, চলুন আমরা বেরিয়ে পড়ি ডিমাপুরের দিকে। এই পচা হস্টেলে থাকবে না। কেমন সঁতসেঁতে ঘরগুলো সব সময় মেঝের কার্পেট থেকে তেলাপোকার গন্ধ বেরোচ্ছে। পৌঁছনো যাবে না ডিমাপুরে আজ?

অভী বলল, এক্ষুণি বেরিয়ে পড়তে পারলে পৌঁছনো যাবে। তবে খুব রিস্কী হবে।

যদি কোনো কারণে গাড়ি খারাপ হয়ে যায় তো সারা রাত পথেই কাটাতে হবে। পথের একপাশে ডিফু নদী, অন্যদিকে খাড়া পাহাড়, সারা রাস্তাই গভীর জঙ্গল।

–দারুণ হবে, বাবলি বলল–ভাবতেই আমার ভালো লাগছে।

অভী অবাক হয়ে বলল, আপনি আশ্চর্য লোক তো।

–আশ্চর্য কেন? অ্যাডভেঞ্চার আপনার ভালো লাগে না?

–তার মানে? আপনি কি চান যে গাড়িটা খারাপ হয়ে যাক রাস্তায়?

বাবলি অধৈর্য গলায় বলল, আহা, কী মুশকিল! আমি কেন বলব? আমার ইচ্ছায় কি আর কিছু হবে? গাড়ির যা ইচ্ছা তাই হবে।

–আমার কিন্তু ইচ্ছা নয় যে, এমন ঝুঁকি নিয়ে এ রাস্তায় এই রকম গাড়ি নিয়ে আমরা যাই।

বাবলি বলল, সকাল থেকেই আমার সন্দেহ হচ্ছে আপনি পুরুষ মানুষ কিনা।

অভীর গলায় রাগ ঝরে পড়ল। বলল, প্রমাণ দিতে পারতাম, কিন্তু দুঃখের বিষয় সবাইকে সব প্রমাণ দেওয়া যায় না।

এবার বাবলি লজ্জা পেয়ে গেল, বলল, আপনি বেশ অসভ্য। মেয়েদের সঙ্গে এভাবে কথা বলে?

অভী বলল, ছেলেদের সঙ্গেও কি কোনো ভদ্রমহিলা এভাবে কথা বলে? বাবলি না দমে বলল, আমি তো বলেছি, আমি ভদ্রমহিলা নই। আমি একজন মেয়ে, জাস্ট একজন মেয়ে।

–তাহলে কি ঠিক হল? যাওয়া হবে?

–চলুন। ডিমাপুরে থাকার কি ব্যবস্থা হবে? দুটো ঘর পাওয়া যাবে তো? না আপনার সঙ্গে একঘরে থাকতে হবে?

বাবলি বলল।

অভী ওর প্রশ্নের দ্বিতীয়াংশকে উপেক্ষা করে বলল, ওখানে সুন্দর বাংলো আছে ফরেস্ট ডিপার্টমেন্টের। একজন বাবুর্চি আছে, লম্বা সাদা দাড়িওয়ালা বদরপুরী মুসলমান। দারুণ রাঁধে। নাম রসিদ আলি। ঘরগুলোও ভালো। আশা করি অসুবিধা হবে না। একটি ঘর পাওয়া গেলে আপনি ঘরে শোবেন–আমি বারান্দায় শোব। ওখানে তো আর এই পাহাড়ের মতো ঠাণ্ডা নয়।

বাবলি বলল, চলুন তাহলে তাড়াতাড়ি। আর দেরি করা ঠিক হবে না। আমার ভাবতেই ভালো লাগছে। রাতে রসিদ আলির হাতের রান্না খাব। এখানে সাপই খাওয়াতে পারলেন না আপনি। কোহিমাতে এলাম, সাপ খেলাম না; আপনি কোনো কর্মের নয়।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *