কী হয়েছে ভজুর মনে। বাড়ির খিড়কির দরজার কাছে এসে থমকে দাঁড়াল ভজু। রথীনের মুখটা মনে পড়ছে। কঠিন শক্ত মুখ। বীর বিপ্লবী হতে পারবে না ভজু, ও পথে কোনও টান নেই তার। কিন্তু ওই পথেই দাদা গিয়েছেন। তাই রথীন বুঝি দাদার প্রাণের চেয়েও বড়। রথীন নির্ভীক তাই দাদার বুক ভরে ওঠে।
হঠাৎ পশ্চিম দিকে ফিরে ভজু হনহন করে চলতে আরম্ভ করল। আশেপাশে দেখল না, মানল না অন্ধকার, বাতাসের আগে চলল। এসে দাঁড়াল একেবারে গঙ্গার ধারে।
হু হু করে হাওয়া ছুটে এসে ভরে দিল তার চোখ মুখ। উঁচু মাটির খাড়া ধারের নীচে সদ্য। জোয়ার আসা গঙ্গা ছলাৎ ছলাৎ করে যেন তাকে ডাক দিল, চল চল।
অন্ধকারের মধ্যেও পরিষ্কার দেখা যায় উত্তরে হাওয়া একটা তীব্র স্রোতের রেখা। ঢেউয়ের মাথাগুলো আচমকা চকচক করে হেসে উঠছে। অন্ধকারে আকাশ গঙ্গা মেশামেশি।
খোলা আকাশের নীচে অবাধ হাওয়ার একটা গোঙানি প্রেতের আঁ আঁ শব্দে ছুটে আসছে। গায়ে। গায়ে ঘেঁষা গাছগুলো সুযোগ পেয়ে কানে কানে কানাকানি করে মরছে। মাথার উপর দিয়ে একটা পাখি উড়ে গেল সড় সড় করে। নিশুতি রাতে কপাটে কার টোকা পড়ার মতো কোথায় একটা অর্থময় শব্দ হচ্ছে টুক টুক ঠুক।
এক পাল শেয়াল ডেকে উঠল, কয়েক হাত দূরেই। চকিতে বুঝি চকচক করে উঠল জন্তুগুলোর চোখ। একটা তীব্র গন্ধ মাতাল করে দিচ্ছে সব কিছুকে।
গঙ্গার দূর-দূরান্তে মিশে যাওয়া শব্দের মধ্যে যেন ভজু শুনতে পেল, কে ডাকছে মৃন্ময়ী…মৃন্ময়ী। আপনা থেকেই কপালকুণ্ডলার কথা মনে পড়ে গেল তার। অমনি তার চোখের সামনে ভেসে উঠল একটি মুখ। একটি থেকে আর একটি, তারপর আর একটি। তার মনে হল, বুঝি সেও একদিন কাউকে এখানে, এই পাড়ের নীচে ওই তীব্র স্রোত ও পাক খাওয়া অতল জলে রেখে গিয়েছে। এ সমাজ ও সংসারের দিশেহারা প্রাণে সে আজ আবার তাকে নতুন করে ডাকতে এসেছে। এ সংশয়াকুল জীবন সে আর সইতে পারছে না।
ওই দূরে দক্ষিণে অন্ধকারের বুকে অন্ধকার চেপে বসবার মতো শ্মশানে বড় বড় গাছ-গাছালির মাথা দেখা যায়। সেদিকে তাকিয়ে চকিতে আবার রথীনের কথা মনে পড়ে গেল তার। অমনি সেদিকে চলল সে। রথীন বীর। ভজন শুধু ভজু। তবু, সেও কি পারে না যেতে শ্মশানে। পরীক্ষা কেন, এমনি অকারণেই কি আসা যায় না ঘুরে। না-ই রইল মেহালিঙ্গন, এ প্রাণ কি পারে না। ভয়ের মুখে লাথি মারতে।
উঁচু পাড়ের সরু পথে শুকনো পাতা মড়মড়িয়ে উঠল তার দৃঢ় পদক্ষেপে। হাওয়া বুঝি তার পিছে পিছে ছুটে এল, ওরে যাসনি যাসনি।
কিন্তু যাবে। পাগলা নিশিতে পেয়েছে আজ তাকে। শুধু রথীন নয়, সেও পারে। জীবনের পরীক্ষার ক্ষেত্রে ফেল বলে কোনও কথা নেই তার।
তবু আবার সেই মুখ। এক দুর্বোধ্য চিন্তায় জট পাকিয়ে গেল তার মগজ। সংস্কারাচ্ছন্ন মন। বলতে লাগল, মৃন্ময়ী মরেনি। সে আজও বেঁচে আছে। তার বন্দিনী আত্মা এখনও শ্মশানের। চারদিকে ছটফট করে ঘুরে মরছে। সে আজ তাকেও মুক্ত করে আনবে। মুক্তি দেবে হঠকারী নবকুমারকে। হতাশ করবে শত শত বছরের প্রতীক্ষারত নারীমাংসলোলুপ তান্ত্রিক কাপালিককে।
পায়ের তলায় কী যেন মড়মড় করে ভেঙে গেল। ভজু তাকিয়ে দেখল, শ্মশানের মাঝখানে এসে দাঁড়িয়েছে সে। পায়ে কাদার মতো ঠেকছে। বোধহয় মড়া পুড়িয়ে চিতায় কারা জল ঢেলে দিয়ে গিয়েছে। চারদিকে বড় বড় গাছের বেড়া। মাঝখানে ঘোর অন্ধকার। হাওয়া বাধা পাচ্ছে, তাই উন্মাদ হয়ে উঠেছে।
কিন্তু কোথায় রথীন। চারিদিকে তাকিয়ে দেখল ভজু। শেয়ালগুলো অবাক হয়ে নির্ভয়ে দাঁড়িয়েছে তার কাছকাছি। মাথার উপর ঝাপটা দিচ্ছে গৃধিণী।
কোথায় লিখতে হবে নাম। উপুড় হয়ে হাতিয়ে খুঁজে পেল একটা কলসি ভাঙা। ভাবল, নিজের। পুরো নামটাই লিখবে সে। না, তা হলে যে সব জানাজানি হয়ে যাবে। সে লিখল শ্রী।
তারপর শ্মশানের বাইরে এসে দাঁড়াল। ঘামে ভিজে ওঠা শরীরটা মুহূর্তে হাওয়ায় জুড়িয়ে গেল। আরামে বুজে এল চোখ। নেমে গেল ঢালু পাড় বেয়ে নীচে। গণ্ডুষ ভরে জল নিয়ে ছিটা দিল চোখেমুখে। মনটা ঠাণ্ডা হয়ে এল। ভাবল রথীন হয়তো চলে গিয়েছে। দাদার বুক আরও ভরে উঠবে গর্বে।
বাবার কথা মনে পড়ল ভজুর। নিঃশেষিত বাবা। কার উপর নির্ভর করবেন তিনি আজ। দাদা তার নিজের পথে ছুটে চলেছেন দুর্বার বেগে। তিনি ফিরবেন না। বকুলমা কতদিন আর এ সংসার আগলাবেন, এ যে চারদিক থেকে ত্রিশঙ্কুর অবস্থা। আর তার নিজের রাস্তা-ই বা কোথায়।
গঙ্গার দূর বুকে বোবার মতো তাকিয়ে রইল সে। মনের উত্তেজনা হঠাৎ অনেকখানি নেমে গিয়েছে। মৃন্ময়ীর ভাবনা তার হৃদয়ের গোপন স্থলে বেজেছে নিজের বিয়ের কথা ভেবে। তার এ দিশেহারা প্রাণে কাউকে দরকার। কাউকে চাই। দাদা, রথীন, বাবা, বকুলমা, যাক যে যার পথে। সে যাবে তার নিজের পথে, কেন এত ভাবনা কেন মনের এত বাড়াবাড়ি। কীসের মান অভিমান। দাদার সঙ্গী সে হবে না। বিবাদ করবে না সে বাবার সঙ্গে। বাঁধা থাকবে না বকুলমার কাছে। কোন প্রতিযোগিতায় মাতবে না সে রথীনদের সঙ্গে। সে স্থির হতে চায়, স্থিতি চায়, জীবনের ভাঙা ছড়ানো খোলটাকে ফেলে নতুন নৌকায় যাত্রা শুরু করবে সে। তার সমস্ত বেদনা যন্ত্রণা রাগ অসি নিয়ে সে একজনের কাজে নিজেকে সঁপে দেবে।
ছলাৎ করে ছিটকে জল লাগল তার গায়ে মুখে। হঠাৎ শীত করে উঠল তার। দেখল কাপড়টা অনেকখানি ভিজে গিয়েছে। যেন নতুন করে মনে পড়ল, সে শ্মশানে বসে আছে। তাড়াতাড়ি উঠে দাঁড়াল। ভাবল, কালকে হয়তো রথীন জীবনে আর এক ধাপ এগিয়ে যাবে। তাতে তার কী। হয়তো সেও পারে রিভলভার দিয়ে শত্রুর মাথার খুলি উড়িয়ে দিতে। কিন্তু সে কাজ তো সকলের জন্য নয়। বিপ্লবী বাহিনীতে যোগ দিয়ে সে দাদার মেহ কাড়তে পারবে না। না-ই বা ভাবলেন দাদা ভজুর ভাল মন্দর কথা। একলা জীবনেই সে এগিয়ে যাবে।
হাওয়া অনেকখানি পড়ে এসেছে। ম্লান হয়ে এসেছে আকাশের তারা। ভজুর চোখে শ্মশানটাকে মনে হল যেন প্রেতের মূর্তি ধরা বহুরূপীটা ধরাচুড়া ছেড়ে নিতান্ত ভালমানুষের মতো পড়ে আছে। অন্ধকার হালকা হয়ে গিয়েছে। সবই পরিষ্কার দেখা যায়।
গঙ্গা নিঃশব্দ। ঢেউ কম। জোয়ার কানায় কানায় ভরে গিয়েছে। আকণ্ঠ সুধা ভরা যা সে তো নির্বাক। যার নেই, তারই তো নাচানাচি বেশি। শব্দ বেশি, খালি কলসির।
ভজু বিদায় নেওয়ার আগে একবার গঙ্গার দিকে তাকাল। গঙ্গা সমুদ্র হয়ে উঠেছে। তারই জীবনের ভবিষ্যতের মতো কুলহীন, অথৈ। সেই পারাপারহীন অসীমের মাঝে আর কিছু নয়, কেবল একটি মুখ বারবার নানারূপে ভেসে ভেসে উঠল। টাবু টুবু গঙ্গার গুনগুনানি যে বাজতে লাগল অনর্গল সানাইয়ের সুরে।
কত কথা ছিল মনে। কত ছিল ভাববার, কত হিসাব-নিকাশ, জীবনের সমস্ত শিক্ষা দীক্ষা নিয়ে আড়ম্বরের যুক্তি-তর্ক। সব ভাসিয়ে অন্ধকারে এই মুহূর্তে শুধু একটি মুখ ছড়িয়ে গেল সারা আকাশে। অবলীলাক্রমে সে পরীক্ষায় পাশ করে এসেছে স্কুলে কলেজে, কিন্তু কোনও বিশ্বাস দানা বেঁধে ওঠেনি সেদিন। কী হওয়া উচিত ছিল, জানত না সে কথা। আজ হঠাৎ জীবন গঙ্গার মোহনায় এসে সে পথ হারিয়েছে। হারানো পথে কেবল একটি মুখ। গলিতে চলিতে ছলিতে সে মোরে, কেবুলি ডাঁইড়ে রয়। এই হল বাঙালির গান। বুঝি গঙ্গার কাছে অঙ্গীকার করে গেল ভজু অস্ফুট গলার, আমি বে করব। এ অবিশ্বাস ও অনাদরের সংসারে আমি তাকেই চাই। সে আমার প্রাণের সই হবে। আমি সোহাগ কাড়াব তার কাছে।
তারপর সে ফিরে চলল। জীবনের অথৈ সমুদ্রে সে চলল বুঝি তার মৃন্ময়ীর সন্ধানে। মধ্য রাত পেরিয়ে, শ্মশান মাড়িয়ে চলল যেন এ শতাব্দীর এক অভিশপ্ত আত্মার ছায়া।
.
পরদিন সকালে কারখানাটার চা খাওয়ার ছুটির ভিড় লেগেছে ভজুর দোকানে। মজুর মিস্তিরির ভিড়।
রাস্তাটা লাল ধুলোয় ভরে গিয়েছে। পুব ধারের মাদার আর কুরচি গাছের পাতাগুলো পড়েছে ঝরে। হাওয়ায় উড়ছে সব। ধুলো আর পাতা। বেসামাল হচ্ছে মানুষ। সকলের নাক চোখ সর্বক্ষণই কুঁচকে থাকে। সামনের আমগাছগুলোতে বোল ধরেছে। গন্ধ ছড়াচ্ছে বাতাসে। কচি কচি আমও হয়েছে, ঝরে পড়েছে তলায়। কুড়োচ্ছে কতকগুলো পাড়ার ছেলেমেয়ে।
গাছগাছালির ফাঁকে পুবে দেখা যায় সেই পুরনো বাড়িটা। উঁচু জমিতে মস্ত বাড়ি। ভাঙা ভাঙা, মেটে আর শেওলা রং। তারও পরে মন্দিরের একটা চুড়া।
ভজু এক মনে চা তৈরি করে চলেছে। তার মধ্যেই কথা বলছে খদ্দেরদের সঙ্গে, পয়সা নিচ্ছে। কিন্তু যারা চা খাচ্ছে তারা জানে ভজু চাওয়ালা নয়, বাবু। বাবুর দোকান। লেখাপড়া জানা এক মহা দিগগজ, নিরহঙ্কারী দিলদার মানুষ। বামুনের ছেলে। ভদ্রলোক। নারায়ণবাবুর ভাই। নেকো হালদারের ছেলে ভজন। ভজু, উন্নাসিক ভজু, ব্যাটা যেন ভজুলাট। একথাও বলে অনেকে।
ঘরের বাইরে ভিড় খদ্দেরদের। ভেতরেও ভিড়, নামধারী নারায়ণের সাঙ্গোপাঙ্গোদের। খদ্দের তো বটেই, তারাও চা নিয়ে বসেছে। কিন্তু কে চা খাবে! এক মহাবিস্ময়ে সকলে স্তব্ধ, নির্বাক। উদ্বেগাচ্ছন্ন। বিমূঢ়। ঘটনার শুরুতেই এরকম একটা বাধা, সবাইকে উৎকণ্ঠিত করে তুলেছে। হীরেন, কৃপাল এবং আরও কয়েকজন এসেছে। তারাও শুনেছে ঘটনাটা রথীনের মুখে, এবং শুনে হয়তো তারা ভাবছে ভবিষ্যতে তাদের নিজেদের পালা এলে কী কৈফিয়ত নারায়ণদার কাছে দেবে।
নারায়ণ প্রথমটা বিশ্বাস করতে পারেননি। কেন না তিনিও ছিলেন কাল রাত্রে ওই কারখানা পাঁচিলের শেষে গঙ্গার ধারে বটতলার অন্ধকারে। রথীনের সত্য পরীক্ষার জন্য নয়, রথীনের প্রাণের জন্য তাঁর গভীর উৎকণ্ঠা। হয়তো বিপ্লবীবাহিনীর আঞ্চলিক অধিনায়ক হিসাবে এ হৃদয়-চাঞ্চল্য মতি-বিরুদ্ধ। কিন্তু তিনি চুপ করে থাকতে পারেননি। রথীনের অদেখা আড়ালে তিনি তাকে চোখে চোখে রেখেছিলেন। কিন্তু রথীন বলছে সে আর একজনকে দেখেছে। সেই আর একজন নাকি সম্ভবত মাতাল ছিল অথচ যেন ভদ্রবেশী। লোকটা টলছিল কিন্তু ভীষণ তাড়াতাড়ি আসছিল। রথীন ভেবেছিল, লোকটা তারই পেছন পেছন আসছে। সে ভয় পেয়েছিল। তাই সে তার কাজ শেষ করে ঊর্ধ্বশ্বাসে ছুটে পালিয়েছিল।
নারায়ণ যেখানে ছিলেন, সেখান থেকে খালি শ্মশানের ফেরার রাস্তাটাই দেখা যায়। তিনি দেখেছিলেন রখীন ছুটে আসছে। ভেবেছিলেন, ভয় পেয়েছে হয়তো কোনও কারণে। কিন্তু অন্য কোনও লোককে তিনি দেখতে পাননি। বিশ্বাসও করতে পারেননি প্রথমটা।
কিন্তু তিনি স্বচক্ষে দেখে এসেছেন চিতার পাশে মস্ত বড় করে লেখা রয়েছে শ্রী। যেন লেখক আরও কিছু লিখতে চেয়েছিল অথচ না লিখে শ্রীর পরে খামখেয়ালি ভাবে একটা লম্বা লাইন টেনে দিয়েছে। কে সেই লোক। বিস্ময়ে উদ্বেগে সন্দেহে নারায়ণের শান্ত মন অস্থির হয়ে উঠল। এ অঞ্চলের সমস্ত মানুষের মুখ তাঁর চোখের সামনে পর পর ভেসে উঠল। এমন কী পরিচিত পুলিশের গুপ্তচরও তার থেকে বাদ গেল না। তবু মন স্থির হতে চায় না।
রথীনকে আবার জিজ্ঞেস করলেন, রথী, সে মাতাল কী করে বুঝলে তুমি?
রথীন তো চিন্তাচ্ছন্ন। সে ড়ুবে গিয়েছিল চিন্তায়। হঠাৎ সুপ্তোখিতের মতো বলল, অ্যাঁ। কেন কী। আমার মনে হল লোকটা বিড়বিড় করছিল, আর খুব টলছিল।
ভজু বাইরে চা তৈরি করতে করতে না হেসে উঠে পারল না। অকারণ হেসে উঠে সে তার এক খদ্দেরকে বলে উঠল, তুই ব্যাটা গোঁফটা তো খুব জোর তৈরি করেছিল।
যাকে বলল, সে গাল গোঁফ হাতিয়ে বলল, গোঁফ কোথা দেখলেন বাবু। আমার তো গোঁফ ওঠেনি।
তাই নাকি। ভজু তাড়াতাড়ি নিজেকে সামলে নিল। বলল, আমাকে মাইরি ভূতে পেয়েছে। তুই বাঙালির ভাইপো না?
বাঙালির ভাইপো অবাক মুখে তাকিয়ে বলল, আজ্ঞা হাঁ।
কিন্তু ঘরের দুশ্চিন্তাচ্ছন্ন লোকগুলোর নজর এদিকে ছিল না। তারা দেখতে পেল না ভজুর চাতুরী। তাদের পরস্পরের মধ্যে নানান আলোচনা চলছিল। কেউ ভাবছিল, এটা নিশ্চয় গুপ্তচরের ব্যাপার। কারও ধারণা, চোর ডাকাতের কোনও কারসাজি বুঝি এটা। রথীন বিশেষ করে ভাবছিল তবিদ্ মদন ভট্টাচার্যের কথা। ভট্টাচার্য নাকি প্রায় মদ খেয়ে শ্মশানে যান দেবীর ধ্যান করতে।
নারায়ণ ভাবছিলেন অনেকের কথা। ভাবতে ভাবতে, ভজুর মুখটা তাঁর চোখের সামনে আসতেই তিনি থমকে গেলেন। অকারণ, তবু থমকে গেল মনটা, অসম্ভব, তবু মন নড়তে চাইল না। অপলক চোখে তিনি তাকিয়ে রইলেন ভজুর দিকে। স্বভাবে মনে ভাবনায় অস্থির, জীবনে দিশেহারা ভজু। তিনি জানেন তাঁর ভাইটিকে খানিকটা। জানেন ওর অবিশ্বাসী মনটার কথা, এ সমাজের ও সংসারের আবর্তে ওর তিক্ত অসুখী হৃদয়টার কথা। জেনেও তিনি নিরুপায়। তাঁর নিজের বিশ্বাস মত ও পথ আছে। ভজুর তা নেই। এ জীবনে ভাইয়ের সঙ্গে তাঁর যোগাযোগের নেই কোনও সূত্র। তবু বোঝেন খানিকটা তাকে। সংশয় থেকেও কেমন করে যেন মনটা বারবার বলে উঠল, কাল রাতে ভজুই গিয়েছিল শ্মশানে। ভজু অবিশ্বাসী, কিন্তু দুঃসাহসী। মনের অন্তস্রোতের গতি বড় বিচিত্র। ও পরিষ্কার প্রত্যাখ্যান করেছে নারায়ণকে, ঘোষণা করেছে তোমার পথ তুমি দেখো। কিন্তু নারায়ণ জানতেন, সেখানেই শেষ নয়, ভজুর মনে আরও কিছু আছে। প্রাণ গেলেও সেকথা ও বলবে না। শোনবার অবকাশ তাঁরই বা কোথায়।
ভাবলেন, এখুনি জিজ্ঞেস করবেন ভঙুকে ডেকে। কিন্তু ডাকলেন না। এত লোকের মাঝখানে সে কোনও কথা বলবে না, তিনি তা জানতেন। নিজেকে এ ভাবনা থেকে মুক্ত করে নারায়ণ আলোচনায় চলে এলেন, বললেন, শোনো সব, আমার মতে এ ভাবে ভেবে কোনও লাভ নেই। আর আমার বিশ্বাস, কালকে রাতের সে লোক কখনও আমাদের শত্রু নয়। তবু রথীনকে আজ আবার পরীক্ষা দিতে হবে। একটা সুটকেশ নিয়ে রথীনকে আজ যেতে হবে শ্মশানে। তার মধ্যে থাকবে দুটো রিভলভার। বিশ্বাস ও সাহস, দুই-ই পরীক্ষা দিতে হবে। পারবে রথীন।
রথীন একটু বিস্মিত হল মনে মনে। মুখে তা ফুটতে দিল না। বলল, পারব দাদা।
আর কোনও কথা বলবার অবসর না দিয়েই নারায়ণ গম্ভীর গলায় বললেন, আগামী কাল কৃপালের পরীক্ষা।
কৃপাল নিশ্চুপ। তার নীরবতায় ইচ্ছা অনিচ্ছা কোনওটাই বোঝা যায় না।
হীরেন তাড়াতাড়ি বলল, মদের দোকানে পিকেটিং করার একটা ডেট ফিকসড করে ফেললে হত নারায়ণদা।
নারায়ণ একটু দ্বিধাভরে বললেন, করতে হলে কারখানা ছুটির দিন করতে হবে। কিন্তু মজুরদের সঙ্গে একটা ক্ল্যাশ হয়ে যেতে পারে। তা ছাড়া, আমি তো ভাই থাকতে পারব না। আমি বোধহয় কয়েকদিনের জন্য বাইরে যাব।
হীরেন কিছুদিন ধরেই লক্ষ করে দেখছে জাতির চরিত্র গঠনের এ ধরনের কাজেকর্মে নারায়ণদার কেমন একটা উদাসীনতা। তিনি সবসময় অন্য কিছু চিন্তা করছেন। তিনি স্বরাজ লাভের অন্য পথ ধরেছেন। বিশেষ ফেব্রুয়ারি মাসে বদৌলিতে ওয়ার্কিং কমিটির ডিসিশনের পর থেকে তিনি অন্যদিকে আরও এগিয়ে গিয়েছেন। এমন কী, বদৌলির ডিসিশনকে বলেছেন কাপুরুষতা। ব্যায়াম সমিতিগুলোর দিকে তার ঝোঁক বেশি। কতকগুলো অদ্ভুত অদ্ভুত ছেলের সন্ধানে তিনি ঘুরছেন। পরিষ্কার বোঝা যাচ্ছে, তিনি গান্ধীজির পথ থেকে নিজেকে সরিয়ে নিচ্ছেন। এ বড় বেদনার ও দুঃখের কথা। তাদের পথপ্রদর্শক নেতা নারানদা আজ সন্ত্রাসবাদের ভয়াবহ পথে চলেছেন।
হীরেনের পক্ষে এটা ধর্ম লঙ্ঘনের সমিল। তবু মদের দোকানে পিকেটিং করার ব্যাপারে তারও খানিকটা দ্বিধা আছে। এক কথা, এখুনি গ্রেপ্তার হওয়ার সম্ভাবনা। আর মজুরদের সঙ্গে যদি মারামারি হয়। এই মজুর চরিত্রটা সম্পর্কে ভেবে সে কোনও কুলকিনারা পায় না। ওরা নিজেরা যেমন ওদের ভাল-মন্দ বোবে না, তেমনি বুঝতেও দেয় না কাউকে। অথচ নিজেদের একটা নৈতিক অধঃপতনে বাধা দিতে গেলে ওরা লাঠি মারতে আসে। তবে হ্যাঁ, একথাও ঠিক যে, আমরা ওদের দূরে সরিয়ে রেখেছি। অস্পৃশ্যতাই হচ্ছে তার প্রমাণ। আমাদের যেতে হবে ওদের কাছে, অধিকার দিতে হবে ওদের মন্দিরে প্রবেশের, এক জায়গায় বসে খাওয়ার। হৃদয়ের আর একটা দরজা খুলে দিতে হবে ওদের জন্য। ভালবাসার দরজা।
হীরেনের ভাবনার ফাঁকে রথীন বলল, দাদা, সুনির্মল আমাদের সঙ্গে আসতে চায়। নারায়ণ যেন কী ভাবছিলেন। চমকে উঠলেন একটু। আনমনা। ভাবের ঘোরে বললেন, কে সুনির্মল?
আমার বন্ধু, স্কুলে পড়ে।
নারায়ণ বললেন, নিয়ে এসো তাকে আমাদের এখানে। আজ নয়, কাল রাতে, আটটার সময়। এখন তোমরা সব যাও। বিকেলে সমিতিতে আসতে কেউ ভুলো না।
চলে গেল সবাই একে একে। নারায়ণ বসে রইলেন। ভাবছিলেন ভজুর কথা। তিনি নিঃসন্দেহ হয়েছেন কাল রাতে ভজুর যাওয়া সম্পর্কে। এখন তাঁর মনে পড়ছে, কাল অনেক রাতে তিনি যখন তন্দ্রাচ্ছন্ন, তখন ভজু ফিরেছে বাড়িতে। কোথায় গিয়েছিল সে অত রাত্রে! বকুলমাকে পৌঁছে দিয়ে আসতে তো কোনওদিন রাত কাবার হয় না।
এ-সব কথার সঙ্গে নারায়ণের একবারও বকুলমা-এর সকালবেলার কথাটা মনে পড়ল না। মনে পড়ল না বকুলমা বলেছিলেন, সাহার দোকান থেকে আড়াই মন চাল আনিয়ে দিতে। সাহার দোকানের হিসাবটা নাকি তার বাবার পায়ের কাছে পড়ে রয়েছে। সেটা দেখে সাহাকে টাকা মিটাতে বলেছিলেন। নারায়ণের সেকথা খেয়াল নেই। খেয়াল নেই, ঘরের তহবিল শূন্য। শূন্য বাবার পকেট, শুন্য ভাঁড়ার। কে জানে বকুলমার হাতও শুন্য কি না।
দোকানে খদ্দেরের ভিড় কমে গিয়েছে। রয়েছে দু একজন পশ্চিমা খদ্দের। গায়ে তাদের নীল কুর্তা। তারা রেলরোড় মজুর। আর রয়েছেন বুড়ো গোলক চাটুজ্যে! এক হাতে হুঁকো, অন্য হাতে চায়ের গেলাস। এ-পাড়ারই লোক। ঠিক বুড়ো নন, তবে বয়সটা নাবির দিকেই। সবসময়ই ঝিমোন আফিমের নেশায় অথচ নিপুণ অভিনেতার মতো তাঁর গল্প বলার কথা এ অঞ্চলে বিখ্যাত। বুড়ো গপ্পে। গল্প সব উদ্ভট, অদ্ভুত এবং অশ্রুতপূর্ব তো বটেই। তিনি হুঁকো ও চায়ের গেলাস নেড়ে নেড়ে পশ্চিমা মজুর দুজনকে তাঁর এক পশ্চিমা বন্ধুর গোঁফের গল্প বলছিলেন। বলছেন যে ভাষায়, সে ভাষার কোনও মা বাপ নেই। বলছেন সেই গোঁফের খিদমদগারই ছিল চারজন। একদিন নাকি সেই বন্ধু গোঁফে তেলজল লাগিয়ে আঁচড়ে জানালা দিয়ে ছড়িয়ে দিয়েছিলেন। গোঁফ পড়েছিল একেবারে জানালা বেয়ে বাইরের মাটিতে। গোঁফের মালিক শুয়েছিলেন জানালার নীচে খাটে। তখন এই পথ দিয়ে যাচ্ছিল এক ঘরনা ঘরের ছেলে। সে ভাবল, অমন যার কেশের বাহার, না জানে সে অওরত কতই খুবসুরত। লোভ সামলাতে না পেরে বেচারি সেই চুলের গোছা আলগোছে। ধরে মিঠে গলায় যেমনি ডেকেছে, হে সুন্দরী। আর অমনি–
আর বলার দরকার ছিল না। পশ্চিমা মজুর দুটি হাসতে হাসতে মাটিতে লুটিয়ে পড়ল। খাপছাড়াভাবে হাসছিল ভজু নিজের কাজ করতে করতে।
বাইরের হাওয়া মত্ত। খোয়া বাঁধানো রাস্তার জমা ধুলো উড়ছে। লাল সুরকির মতো ধুলো ছড়িয়ে পড়ছে গাছে গাছে পাতায় পাতায়, কেরোসিনের ল্যাম্পপোস্টের চিমনিতে, আকাশে আর মানুষের চোখে মুখে। সামনের আম গাছটায় ধুলো লাগা মস্ত মাকড়সার জালটায় রোদ পড়ে লাল দেখাচ্ছে।
লাল হয়ে উঠেছে নারায়ণের মুখ। ভজুর দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে বুকটা মুচড়ে উঠল তাঁর। ভাবতে আরম্ভ করলে যে রেহাই নেই। এ সংসারের সঙ্গে নিজেকে কোনওরকমে বাঁধতে না চেয়েও মানুষগুলোর জন্য মায়া যে কাটানোনা যায় না। ওই যে ভজন দাঁড়িয়ে আছে, নিজের জীবন সম্পর্কে অনিশ্চিত অসহায়। মনে মনে ও দাদাকে যা-ই ভাবুক না, নারায়ণ তো জানেন ভজন তাঁর বুকের কতখানি জুড়ে আছে। সত্য এ কতখানি নিয়েই তাকে তাঁর পথে পাড়ি দিতে হবে। জীবন প্রতীক্ষা করে আছে অন্যত্র। হৃদয়ের এ সম্বলটুকু দরিদ্রের। এটুকুতে ভজুর কিছু আসবে যাবে না, খোঁজেরও দরকার নেই।
কিন্তু ভজুকে তো বাঁচতে হবে। তাঁর ভাবনামতো ভজু যদি সত্যই গত রাত্রে শ্মশানে গিয়ে থাকে, সে যে সত্যি উদ্বেগের কথা। জীবনের অকারণ খেয়ালে অপঘাতে প্রাণ দেওয়ার তো কোনও অর্থ হয় না।
নারায়ণ ডাকলেন, ভজু?
ওই ডাকের জন্য প্রতীক্ষা করছিল ভজু শঙ্কিত মনে। প্রতীক্ষা করছিল, তবু চমকে উঠল! মুখ ফেরাল না। হাতে কাজ নেই যে ব্যস্ত হয়ে উঠবে। তবু জল ন্যাকড়া দিয়ে টেবিল মুছতে মুছতে বলল, কী বলছ?
নারায়ণ গম্ভীর গলায় বললেন, কাছে আয়, শুনে যা।
ভজু বুঝল, কাছে যেতে হবে। ওই মানুষটির কোনও কথাই জীবনে অবহেলা করা চলবে না। কিন্তু শুনবে ভজু। কাল রাত্রে সে এক বিচিত্র খেলায় মেতেছিল। হ্যাঁ খেলাই তো। আজ সকালে সেটা হাস্যকর মনে হচ্ছে। সে যেন অনেকদিন আগের কথা। এখন তার সামনে একটা পথই খোলা আছে, একটা বিশেষ কাজের পথ। সে পথে সে মনে মনে অনেকক্ষণ পা চালাতে শুরু করেছে। না, তার এখন কোনও মান অভিমান নেই।
সে দাদার কাছে এসে দাঁড়াল। কাছে এসে তার দাঁড়াবার ভঙ্গি দেখে নারায়ণ মনে মনে আরও স্থির হলেন ভজু সম্পর্কে। জিজ্ঞেস করলেন, হ্যাঁ রে ভজন, কাল রাতে তুই শ্মশানে গিইছিলি?
ভজু কিছুমাত্র দ্বিধা না করে বলল, শ্মশানে। আমার বয়ে গেছে।
জবাব শুনে নিঃসন্দেহ হলেন নারায়ণ ভজুর শ্মশান যাওয়া সম্পর্কে। সে যদি না যেত তবে, এতক্ষণে নানান কৌতূহলিত প্রশ্নে ব্যতিব্যস্ত করে তুলত। কেন, কী ব্যাপার, কখন এবং কী হয়েছে, এমনি হাজারো জেরা চলত তার। এক কথায় এরকমভাবে সবটা উড়িয়ে দিত না।
নারায়ণ বললেন, বয়ে যাক আর যাই হোক, এ ভাবে যাওয়া তোর ঠিক হয়নি। বিপদ আপদের কথা বলা তো যায় না। আমি জানি তোর সাহসের কথা। তোর সাহস রথীনদের মতো পরীক্ষার অপেক্ষা রাখে না। আমার মনে আছে সেই সাহেবের গাড়িতে ঢিল মারার কথা। দলের কেউ পারল না, আমিও না। তুই হঠাৎ মেরে বসুলি।….
দাদার মুখ থেকে এ স্বীকারোক্তি সহ্য করতে পারছিল না ভজু। তার সাহসের প্রতি দাদার এ অসীম আস্থার কথা শুনে এক অদ্ভুত অনুভূতিতে হঠাৎ তার বুকটার মধ্যে টনটন করে উঠে চোখ ফেটে জল বেরিয়ে আসতে চাইল। না, সে শুনতে চায় না। তার সহ্য হচ্ছে না।
নারায়ণ বলছিলেন, তোর মতো সাহস আমাদের একটা ছেলেরও যদি থাকত…
ভজু তাড়াতাড়ি বলে উঠল, ও-সব কথা বাদ দাও দাদা। তোমাকে একটা কথা বলব আজ।
নারায়ণ বললেন, বল।
ভজু বলল যেন খেয়ালি ছেলের খানিকটা আবদারের মতো তুমি তো বাপু বে, টে করবে না কিন্তু আমি এবার করব।
নারায়ণ এক মুহূর্ত অবাক হয়ে হা হা করে হেসে উঠলেন। বললেন, সত্যি? আমার হুকুমের অপেক্ষায় আছিস বুঝি? বললে বিশ্বাস যাবি না, একথা আমি কতদিন ভেবেছি। অবস্থা গতিকে বলতে পারিনি। তুই যেদিন খুশি বে কর ভজু, তা হলে আমাদের সংসারটার রূপ খুলবে।
ভজু হাসতে পারল না। দাদার হাসিটা যেন তার বুকের মধ্যে কেমন ঝনঝন করে বাজতে লাগল। এ হাসি অভিশাপ না আশীবাদ সে বুঝতে পারল না। কিন্তু আর নয়, সে নিজের পথে এগিয়ে যাবেই।
দাদা যদি প্রতিবাদও করতেন, তা হলেও সে থামত না। গোলক চাটুজ্যের বোধকরি তখনও মৌতাত কাটেনি। তাই বসেছিলেন। বললেন, কী গো, ভাই দুটির এই ফুর্তি কীসের। আমাদের একটু সন্দেশ-টন্দেশ দাও।
নারায়ণ বললেন, ভজু বে করবে ঠাকুরদা। বটে। গোলক চাটুজ্যে নিভুনো হুঁকোয় বার কয়েক টানে বললেন, তবে শোনো বলি এক বের ঘটনা।
ভজু তাড়াতাড়ি বলল, এখন আর থাক ঠাকুরদা। গোঁফের গল্প যা শুনিয়েছ, তাতেই তোমার এক কাপ চা পাওয়ানা হয়ে গেছে।
বটে। খুশি মনে চোখ বুজে নিরস্ত হলেন ঠাকুদার।
নারায়ণের চোখে আচমকাই এই মুহূর্তে ভেসে উঠল এক কিশোরীর মুখ। গঙ্গার ধারের পাঠকবাড়ির মেয়ে। সে আজ আট ন বছর আগের কথা, একহারা ছিপছিপে ফরসা ফরসা মেয়েটি, টানা টানা চোখ। পান পাতার মতো মুখের কাটুনি। মাথায় এত চুল যে, চারটে বেণি পাকিয়ে মস্ত খোঁপাটা ঝুলত যেন কতকগুলো কালনাগিনী জড়াজড়ি করে আছে। কাঁচা অবুঝ মেয়ে। তার ঠাকুরমা নাকি কোন্ দিন বলেছিল, কার সঙ্গে তোর বে বসতে মন চায়। নাতনি বলেছিল, নেকো হালদারের বড় ছেলের সঙ্গে। মন চাইবে বই কী। অমন টুকটুকে শিবঠাকুরের মতো ছেলে। সে নিয়ে পাড়ায় কত হাসাহাসি ঠাট্টা তামাশা হয়েছে। তারপরে সে কথা শেষ পর্যন্ত বিয়ের আলোচনার স্তরে এসে পড়েছিল। নারায়ণের তখন কৈশোরের সীমা প্রায় অতিক্রান্ত। মনটা ছিল কাঁচা। সেই কাঁচা মন তারও কাঁচামিঠে হয়ে উঠেছিল। মনের কাছে অছিলা করে কারণে অকারণে বার বার যেতেন গঙ্গার ধারের পাড়ায়। কিন্তু নেকো হালদার হয়ে পড়েছিলেন কালা আর যোবা। যেন শুনতে পাননি কিছু বলেননি কিছু। অতএব চুকে গেল ব্যাপারটা।
ব্যাপারটা হাসির। কিন্তু নিজের কাছে অস্বীকার করা যায় না, এ হাসির মাঝে কোথায় যেন একটা সূক্ষ্ম বেদনাবোধ ছিল। নারায়ণ তাকে তারপরে কয়েকবার দেখেছেন। চকিতে, পলকে। শরীরের সঙ্গে সে মেয়ের রূপ আরও বেড়েছে। বড় হয়েছে। তাকে দেখলে খালি নারায়ণের মনে পড়ে যায় বুড়ি পাঠক গিন্নির কথা, নাতনি আমার শিব গড়ে যেন নেকো হালদারের বড় ব্যাটাটি।
না, সে ভুল কথা। মনে হয়েছিল বটে নেকো হালদারের বড় ছেলে। কিন্তু তাতে প্রাণ প্রতিষ্ঠা হচ্ছিল অন্যজনের। সে যে আরেকজন।
হঠাৎ হওয়ায় মড়মড় করে উঠল ছিটেবেড়ার ঘর। এলোমেলো করে দিল দোকানঘটা। চালায় জমানো, ধুলো ঝরে পড়ল। দুলে দুলে উঠল মাকড়শার জাল ও বুল।
গাছে গাছে শব্দ উঠল সাঁই সাঁই। অস্থির ডালপালা থেকে আকাশে উড়ে গেল শঙ্কিত পাখির দল। ঝড়ে পড়ছে শুকনো আমের বোল। আমের বোল কালচে হয়েছে। ছোট ছোট আম ধরেছে, কাচের দুলের সবুজ পাথরের মতো। কোনও কোনও গাছে কচি কচি পাতা ধরেছে। শুনে অ উড়ছে খড়খড় করে।
ফাঁকা রাস্তাটার উপর দিয়ে চলেছে একটা গরুর গাড়ি। আপন মনে গান ধরেছে পশ্চিমা গাড়োয়ান। অলস বদল দুটো চলেছে ঝিমিয়ে চোয়াল নাড়তে নাড়তে।
সবাই চুপচাপ। যেন সকলেই কথা বলতে ভুলে গিয়েছে। কেবল গোলক চাটুজ্যে চা পেয়ে খুশিতে গান ধরলেন ভাঙা ভাঙা কাঁপা অলস গলায়।
শতেক বরষ পরে বঁধুয়া আওলা ঘরে
রাধিকার অন্তরের উল্লাস
উল্লসিত হাওয়া উড়িয়ে নিয়ে গেল সেই গান। হাওয়া দুর্বার। যেন কালবৈশাখীর গোমরানির ইঙ্গিত পাওয়া যায়।
.
বৈশাখের মাঝামাঝি। অনেক রাত। কত রাত, কে জানে। ঝড় উঠছে। ধীরে লুকিয়ে। যেন এ বিশ্বের ঘুমের সুযোগে বায়ুকোণে কারা দল বেঁধে ষড়যন্ত্রে মেতে উঠেছে। অরই ইঙ্গিত হঠাৎ হাওয়ায় সড়সড়ানিতে, আকাশের দুরাগত গোঙানির মধ্যে, বিদ্যুতের সর্বনাশা চমকে, ঘুটঘুট্টি অন্ধকারের করাল গ্রাসে। যেন বহুদূর থেকে একটা বিরাট ব্যাটালিয়ন আসছে কামানের গোলা ছুড়তে ছুড়তে। এ যেন তারই দুম দুম শব্দ, তারই ঝলকানি, তারই কালো ধোঁয়ার রাশি।
চক্ষের পলকে শুরু হয় ঝড়ের তাণ্ডব। আকাশে কে হাসছে বিকট অট্টহাসি। গাছ গাছালির মুণ্ডুগুলো ধরে কে যেন মাটিতে ঠুকে দিচ্ছে। চটপট শব্দে ছিটকে আসছে জল।
অন্ধকারে মিশে গিয়েছে নেকো হালদারের একতলা বাড়িটা। ঢেকে গিয়েছে মেঘ অন্ধকার ও গাছের মধ্যে।
কাঁপছে থরথর করে ভজুর চায়ের দোকানটা। চালার টিনটা দুলে উঠছে। চড়চড় করে উঠছে বেড়ার বাঁশ। বন্ধ দরজাটা যেন কোন অশরীরীর ঠেলায় পাক খাচ্ছে। ঠকঠক করে নড়ছে খড়ি দিয়ে লেখা কাঠের বোর্ডটা।
ভজু জেগে রয়েছে তার ঘরের মধ্যে। সিগারেট খাচ্ছে। নতুন খাওয়া ধরেছে। ছাদের হুকের সঙ্গে ঝোলানো একটা আগের আমলের কেরোসিন বাতি। বাড়িতে বলে ওটাকে ফটিক বাতি। বাতিটা জ্বলছে কিন্তু কমানো। সেই আলোয় দেখা যায় ঘরটা আর শুধু ভজুর নেই, আর একজন রয়েছে। নতুন খাটে ফুল ছড়ানো বিছানায় শুয়ে রয়েছে ভজুর পরশু দিনের বিয়ে করা বউ। আজ ফুলশয্যার রাত। বাড়িতে অনেক লোকজন রয়েছে অন্যান্য ঘরগুলোতে, কেবল বাবার ঘরটা ছাড়া। এসেছে সম্পর্কের মাসি, পিসি, কাকা, মামারা। এসেছে বোন তার ছেলেমেয়ে নিয়ে, স্বামীর সঙ্গে। অনেকে এসেছে, ভজু তাদের অনেককেই চেনে না। ফুলশয্যার উৎসবের বাড়ি।
উৎসব শেষ। লোকজন সব ঘুমুচ্ছে অন্যান্য ঘরে। আড়িপাতনির দল ফিরে গিয়েছে, ঢলে পড়েছে ঘুমে। অনেক রাত, তা ছাড়া দুর্যোগ। বাইরে শুধু ঝড়ের তাণ্ডব।
ভজু আলমারির পাশে, দেওয়ালে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। সে যেন অবাক হয়েছে। হতভম্ব। সারা মুখে একটা অসহ্য যন্ত্রণার ছাপ। কেন, তা সে জানে না। তার বুকের মধ্যে দারুণ অস্থিরতা, একটা অসীম শূন্যতার হাহাকার। নিজেকে সে কিছুতেই যেন বুঝতে পারছে না। হাতে সিগারেট নিয়ে সে অপলক চোখে তাকিয়ে আছে বিছানার দিকে।
নতুন খাট। পুরু বিছানায় ছড়ানো ফুল। গন্ধে ভরে রয়েছে সারা ঘর। খাটে শুয়ে রয়েছে যুঁই ভজুর বউ। যুঁই ঘুমিয়ে পড়েছে। কাত হয়ে এলিয়ে পড়ে আছে। শ্যামাঙ্গিনী যুঁই, স্বাস্থ্যবতী, দীর্ঘ দেহ। ঘুমন্ত চোখের পাতা একটু খোলা রয়েছে। চোখের খোলা জায়গা যেন খেত অপরাজিতার দুটো পাপড়ি। নাকটি সরু, টিকলো। তাতে ছোট একটি নাকচাবি। কপালের সিন্দুর সরু রেখায় গিয়ে মিশেছে সিঁথিতে। রেখাটা মাঝখানে এঁকে বেঁকে গিয়েছে। খসে গিয়েছে ঘোমটা। আধখানা বালিশ জুড়ে ভেঙে রয়েছে মস্ত খোঁপা, খোঁপার মালা। সারা মুখে ক্লান্তি কিন্তু তৃপ্তির আবেশ মাখানো। আলতা মাখানো হাসি হাসি ঈষৎ উন্মুক্ত ঠোঁটের ফাঁকে দেখা যায় সাদা দাঁতের সারি। শান্তিপুরের চুমকি দেওয়া রঙিন কাচের মতো শাড়ি আলুথালু। বিস্ত যুঁই। এলোমেলো। মাঝারি ঘরের মেয়ে। তবু অলঙ্কার পেয়েছে কম নয়। কিন্তু সেসব গায়ে নেই। ভজুর ভাল লাগে না। তাই খুলে রেখেছে।
যুঁই ঘুমুচ্ছে নিশ্চিন্তে, নিঃসন্দেহে। বাঁ হাতখানি এলিয়ে পড়ে আছে ভজুর পরিত্যক্ত স্থানে। ভরা প্রাণের ঘুম। টেরও পাচ্ছে না বাইরে ঝড়ের তাণ্ডব।
ভজু তাকিয়ে আছে। বিন্দু বিন্দু ঘাম জমে উঠেছে সারা মুখে। মুখটা লাল হয়ে উঠেছে আগুনের মতো। তার কটা চোখ জোড়া জ্বলছে ধকধক করে।…হ্যাঁ, এই তো সেই মেয়ে, যাকে সে কিছুদিন আগে চেয়েছিল। একে নিয়েই তো সে আজকের আধখানা রাত কাবার করেছে সোহাগের বন্যায়। চুমোয় ভরে দিয়েছে মেয়েটাকে, কথা বলেছে কত। জীবনের অদম্য কৌতূহল চিনে নিয়েছে ওর প্রতিটি অঙ্গ, অনুভব করেছে, আগুন জ্বলে উঠেছে তার শরীরের প্রতিটি কোষে কোষে।
এখনও জ্বলছে। দপদপ করছে প্রতিটি শিরা উপশিরা। কিন্তু বুকটার মধ্যে হাহাকার করছে। সেখানে তো একটুও ভরেনি। হ্যাঁ, সত্য সে একেই চেয়েছিল, তাতে ভুল হয়নি। কিন্তু মনের মধ্যে কে চিৎকার করছে, না আমি একে চাইনে, এর কাছে নিজেকে আমি কেমন করে সঁপে দেব।
তবে সে কাকে চেয়েছিল। মন ফিরে বলে, একেই। কিন্তু এখন মনে হচ্ছে, আর চাইনে। কাউকেই না। তার যে মনের সঙ্গে মনান্তর। চাওয়া পাওয়ার কোনও কিছুর ঠিক নেই। মন যেন এক সর্বনেশে যন্ত্রবিশেষ।
তবে এ সংসারে তো মানুষ তার পথে বিশ্বাস নিয়ে চলে। চলে গিয়েছেন অর দাদা। এ উৎসবে আজ নারায়ণ অনুপস্থিত। তাঁর মত পথ ও বিশ্বাস আছে। তাঁর ডাক এসেছে, তিনি মুহূর্তে ছুটে গিয়েছেন। ভজু তাকে আটকাতে পারেনি। আটকাতে পারবে না বিশ্ব, স্নেহ, আদর ভালবাসা।
বাবা যথাপূর্বং মাতাল হয়ে আছেন নিজের ঘরে। কেউ তাকে নিরস্ত করতে পারবে না। বিরক্ত করতে পারবে না গিয়ে কেউ। প্রাণ চাইলে আরও মদ খেতে পারেন। টাকা পেলে মামলা করতেও যাবেন।
বকুলমাও নিজের চিন্তায় স্থির। ভজু বিয়ে করে নাকি তাঁর ছুটির দিন এগিয়ে দিয়েছে। তিনিও এবার বিদায় নিয়ে চলে যাবেন।
শুধু তুষ্ট নয় ভজু। তার তুষ্টি নেই। এ যুগটাই তার কাছে বিশ্বাসঘাতকতার যুগ। এ যুগের শিক্ষিতের অভিশপ্ত জীবন নিয়ে সে দাঁড়িয়েছে। জীবনে সে কিছু চেয়ে উঠতে পারেনি, তবুও চেয়েছিল। এ অস্থিরতার মাঝখানে সে মূঢ় হয়ে উঠেছে। আগুন লেগেছে তার বোব অস্থির অনুভূতিময় প্রাণে। সে জানে না আগামীকাল তার জীবন কোন খাতে বয়ে চলবে অথচ একটা সন্দেহ উঁকি মারছে, এক দারুণ ব্যর্থতার মুখোমুখি দাঁড়িয়েছে সে।
বাইরে কড়কড় করে মেঘ ডাকছে, বাজ পড়ছে। বাতাসের শাসানি আর মুষলধারে বৃষ্টির ঝাপটা আছড়ে পড়ছে।
যুঁই হাসছে। তার স্বপ্নাচ্ছন্ন মুখে আর ঠোঁটের কোণে বিচিত্র হাসি। মৃন্ময়ীর হাসি। কী কথা আছে তার মনে। কেন হাসছে।
মনে পড়ছে, দাদা নেই। আর যুঁই হাসছে। দাদা চলে গিয়েছেন, বাবা মাতাল হয়ে পড়ে আছেন, বকুলমা ছুটির ভাবনায় বিভোর হয়েছেন, আত্মীয়-স্বজনেরা সারাদিন খেয়েছেন, হেসেছেন, এখন নিভাবনায় ঘুমুচ্ছেন আর যুঁই হাসছে। ভজুকে নিয়ে একটা খেলায় মেতেছে সবাই। নিষ্ঠুর নির্বিকার ভাবে।
গলার কাছে ঠাণ্ডা একটা কি স্পর্শ করতেই চমকে উঠল ভজু। মালা। সাপ নয়, বিয়ে নয়, ফুলের মালা। টান দিয়ে সেটাকে খুলে ফেলে দরজা খুলে বাইরের দালানে বেরিয়ে এল সে।
দালানের দরজা জানালা সব বন্ধ। হালদার মশাইয়ের ঘর থেকে উঁকি মারছে আলো। ভজু নিঃশব্দে অস্থির পায়ে সে ঘরে গিয়ে ঢুকল। চিন্তার সমস্ত স্নায়ুগুলিকে নিষ্পেষিত করতে চায় সে।
হালদার পড়ে আছেন বিছানায়। আধখানা শরীর প্রায় তক্তপোশের বাইরে ঝুলে পড়েছে। খেয়াল নেই। মাথার বালিশের কাছে মদের বোতল।
কিছুমাত্র দ্বিধা না করে ভজু মদের বোতলটা তুলে নিল হাতে। চকিতে একবার থমকাল। বুঝি একবার ভদ্র শিক্ষিত মন চমকে উঠল। কিন্তু ভাবনার অবসান চাই, বিশ্রাম চাই। সে নির্ভয়ে গলায় ঢেলে দিল মদ। একটা অসহ্য ঝাঁজে বুক জ্বলে গেল, তিক্ত স্বাদে বমির উঁকি উঠে এল। জ্বালা করে উঠল পেটের নাড়িগুলো। সামলে নিয়ে আবার ঢালল। তারপর বেরিয়ে এল।
ভজু দেখতে পেল না বকুলমা দীর্ঘ দালানেরই এক অন্ধকার কোণে পাষাণ প্রতিমার মতো দাঁড়িয়ে আছেন। তাঁরও চোখে ঘুম ছিল না। এক ভয়াবহ সর্বনাশের নাটক তিনি দেখছেন দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে।
নিজের কথা ভাবতে ভাবতেই তিনি এ দৃশ্যের সামনে পড়ে গিয়েছেন। ভজুর বিয়ের কথারম্ভের দিন থেকে তিনি ভাবতে আরম্ভ করেছেন। নিজেকে তাঁর সবটুকু বোঝ কোনওদিনই পুরো হয়ে ওঠেনি। মনে হয়, সংসারের থেকে ছুটি তিনি চেয়েছিলেন, বলেছেন মুখ ফুটে। এখন দেখছেন, তার জন্য মন তৈরি হয়নি। দিশেহারা হয়ে উঠেছেন। মনে হচ্ছে, পেটের শত্রুর মতো ভজু আচমকা বিয়ে করে বকুলমাকে আজ তাড়িয়ে দিতে চাইছে। রক্তক্ষয়ী অভিমানে পুড়ে যাচ্ছে বুকের মধ্যে। সেদিন রাত্রে পৌঁছে দেওয়ার পথে একথাই ভাবছিল ভজু। কিন্তু বকুলমাকে বলেনি। বলবে না বলেই বলেনি। কিন্তু কী অপরাধ করেছেন বকুলমা। কাকে নিয়ে কাদের নিয়ে তিনি থাকবেন।
জীবনে কি তিনি চেয়েছিলেন, আগে যেমন বোঝেননি, আজও জানেন না। অথচ একটা অসহ্য আফসোসে আজ ভরে উঠছে তার বুক। এত নিঃস্ব নিজেকে তাঁর কোনও দিন মনে হয়নি। বছরের পর বছর ভজন নারায়ণকে রান্না করে খাইয়েছেন, দেখেছেন। কেউ জানে না, শ্বশুরের দেওয়া অলঙ্কার গোপনে বিক্রি করে করে হালদারের যাবতীয় খরচ জুগিয়েছেন। হালদার কোনওদিন এ বিষয়ে একটু কৌতূহলও প্রকাশ করেননি। তাতে আসে যায়নি কিছু বকুলমায়ের। জিজ্ঞেস করলেই নিজেকে বরং তার অপ্রতিভ মনে হত। নিঃসাড়ে, এমনি নিঃশেষ করে দেওয়ার মধ্যে তাঁর শাস্তি ভরা ছিল। তবু তার বৈধব্যের অন্তস্থলে একটা ক্ষীণ অগ্নিস্রোত প্রবাহিত ছিল। মাঝে মাঝে সেই স্রোতের তীব্রতা তাঁকে আনমনা করে দিয়েছে, ঘুম কেড়ে নিয়েছে, অদৃশ্যে কে যেন ভেংচেছে। তখন বলেছেন ছুটি চাই, চলে যেতে চাই কোথাও।
কোথায়? কোথাও নয়। সে যে শুধু মুখের কথা। এসব ছেড়ে তিনি কেমন করে যাবেন। কয়েকদিন আগে নারায়ণ চলে যাওয়ার সময় বলে গেল। তিনি বললেন, যাও। ভজন অনুমতি চায়নি, খালি একবার বলেছে, আমি বিয়ে করব। তিনি বলেছেন, করবি বই কী বাবা।
কেবল হালদার অবুঝ শিশুর মতো হাত পেতে প্রায়ই বলেন, বকুলফুল, কয়েকটা টাকা…
কোত্থেকে, কেমন করে আসবে, তা বলতেন না। বকুলমা টাকা এনে দিতেন, দিয়েছেন, দিচ্ছেন। হালদারকে দেখবে, কে খোঁজ করবে তাঁর দুবেলা, তাঁর খাওয়া শোয়ার। নারায়ণ ফিরে এসে আবার কাকে ডাকবে। ভজনের চায়ের দোকানের ঘুগনিকে তৈরি করে দেবে।
তিনি তো চাননি এ-সব ছেড়ে যেতে। কে চেয়েছে বৃন্দাবনের ঠাকুরের চরণ দর্শন করতে। সে চরণ যে তার বুকেই ছিল। আজও তো তিনি তাই এত রাত অবধি সব দেখে বেড়াচ্ছিলেন। সবশেষে চলেছিলেন হালদারের ঘরে, সব গোছগাছ করে দিতে, তল্লাস নিতে।
কিন্তু এ কী দেখলেন তিনি। ভজু মদ খেয়ে এল বাপের বোতল থেকে। কেন, কী হয়েছে ভজুর। নিরালায় সইয়ের সঙ্গে যখন তিনি কথা বলবেন, কী জবাব দেবেন তিনি। কেন এমন সর্বনাশে মাতল ভজু।
নতুন করে আবার বুঝলেন তাঁর হাতের রশি ঝিলে হয়ে গিয়েছে। সব কিছু ছিটকে বেরিয়ে গিয়েছে তাঁর হাত থেকে। মনে হচ্ছে, এ ঝড়ের রাতের অন্ধকারে বকুলমা যেন নিশাচরী প্রেতিনী একটা। অমঙ্গলের ছায়ার মতো বুঝি তিনি এ বাড়ির কোণে কোণে ঘুরছেন। তাঁকে পালাতে হবে।
ভজু দালান ঘরের একটা জানালা খুলে দিয়েছে। ঝড় থেমে এসেছে। বৃষ্টি হচ্ছে। ভজুর মনটা হঠাৎ যেন নৌকার ছেড়া পালের মতো হু হু করে উড়ছে। মাথাটা ভারী হয়ে এসেছে, কিন্তু ইচ্ছে করছে গলা ছেড়ে গান করতে। সে বিড়বিড় করছে, বলছে, আমি ভয় করব না, ভয় করব না।
সে বলছে মনে মনে, তবে তাই হোক, তাই হোক।
কাল রাত পোহালে আমি যাব আমার দোকানে। বলব যুঁই, আমার ঘুগনি তৈরি করে দাও। নতুন বউ অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকবে। ভাববে সে একটা শিক্ষিত চা-ওয়ালার বউ। তবে তাই থাকবে না। ভজু দোকান করবে। স্টেশনের ধারে করবে হালফ্যাশনের রেস্টুরেন্ট। মুদি সাহা এসে টাকা চাইতে দ্বিধা করবে, এ সংসারের পাওনাদারেরা মুখ কাঁচুমাচু করে দাঁড়ানে। যুঁইয়ের টাকায় সে বড় রেস্টুরেন্ট খুলবে। নাম দেবে যুঁই রেস্তোঁরা। না যুঁই কেবিন। ভাল শোনাচ্ছে না। কাফে দ্য যুঁই দিলে কেমন হয়। কিন্তু বউয়ের নামটা দিলে লোকে কী বলবে।
ভজু হাহা করে হেসে উঠল সশব্দে, চড়া গলায়। তারপরে হঠাৎ বেসুরো গলায় গেয়ে উঠল, আমি ভয় করব না ভয় করব না।…
বকুলমা কান্না চেপে, তীব্র চাপা গলায় ড়ুকরে উঠলেন। ছুটে এসে হাত ধরলেন ভজুর। ডাকলেন, ভজু, ভজন কী হয়েছে তোর বাবা?
ঝড়ের শেষ ঝাপটা হুড়মুড় করে ঢুকে পড়ল জানালা দিয়ে। ফুলশয্যার ঘরে ছত্রাকার হয়ে গেল ফুল আর মালা। নতুন বউ শিউরে জেগে উঠে বসল।
হালদারের হাতের মদের বোতল মেঝেয় পড়ে বেজে উঠল ঝন ঝন করে। কেবল ভজন যেন জেদী গলায় চিৎকার করতে লাগল, আমি ভয় করব না!…
.
বৎসরান্ত হল। ঘুরে গেল আরও একটা বছর ভবিষ্যতের কথা ভাবতে ভাবতেই। তারও পরের বছরটা কাটল তোড়জোড় করতেই। ভজনের নতুন দোকান খোলার তোড়জোড়।
হয়তো এত বিলম্ব ঘটত না। কিন্তু চারিদিকে এমন সব বিশৃঙ্খলা গত বছর ঘটতে আরম্ভ করেছিল যে দিশেহারা ভজন কিছুই স্থির করতে পারেনি। সে অনেক প্ল্যান আর প্রোগ্রাম ভেঁজেছে, ইচ্ছে বলে বস্তুটা মুখ লুকিয়ে পড়েছিল কোথায়। ইতিমধ্যে যুঁইয়ের একটি ছেলে হয়েছে।
গত বছরের গোড়া থেকেই দাদা নারায়ণ অনুপস্থিত। ভজনের বিয়ের পর তিনি এসেছিলেন কয়েক মাসের জন্য। বাড়িতে থাকতেন নিতান্ত অল্প সময়। কথা প্রায় কারও সঙ্গেই বলতেন না। যদি কখনও বলতেন, সে কথার সুরে মনে হত, এক খাপছাড়া বিষাদ ভর করেছে তাঁর গলায়। যুঁই একটু কাশলে বলতেন, ভজু, বউমার শরীরটা খারাপ করেছে রে।ভজনের ছেলেটিকে নিয়েও তাঁর উৎকণ্ঠার অন্ত ছিল না। কিন্তু সে উৎকণ্ঠার মধ্যে একটা ছাড়া ছাড়া ভাব। যেন চোখের উপর রয়েছে, তাই, নইলে এ-সব তাঁর কিছুই আসতে যেত না। বাইরের জীবনে তাঁর এত ব্যস্ততা ছিল অথচ ঘরে ঢুকলে মানুষটাকে আর চেনা যায় না। বাইরে তিনি কঠিন, নিয়মানুবর্তিতার প্রতিমূর্তি। সে বাইরেটা সাধারণের মধ্যে নয়, দলের মধ্যে। কখনও বা অত্যন্ত নরম ও মিষ্টি। কখনও ভয়ঙ্কর, কখনও মাটির মানুষ।
কিন্তু ঘরে ছিলেন যেন একটা বৈরাগীর মতো। আড়ো আড়ো ছাড়ো ছাড়ো। কে গেল, কে এল, কি হল না হল, তাতে তাঁর কিছুই আসত যেত না। এতটা তো ছিল না। এখন কেন? ভজন বিয়ে করেছে বলে? এমনি সন্দেহ উঁকি মেরেছে ভজনের মনে। কেউ সুখি হয়নি। দাদা নয়, বকুলমাও নয়। যেন এদের তাড়িয়ে দেওয়ার জন্যই সে মতলব করে যুইকে ঘরে এনেছে। আগে আগে কত কথাই বলতেন নারায়ণ ভজনকে। এখন সেসব নেই। ভাল, ভাল তোমাদের এমনি মতিগতি। এ বেয়াড়া নিয়মে খাপ খাওয়াতে পারবে না তা বলে ভজু। সে রইল আর নিজের মনে যেন খানিকটা গোঁজ হয়ে।
এমনি অবস্থায় একদিন হঠাৎ গভীর রাত্রে বাড়ির চারিদিকে শোরগোল শুনে ভজন ঘুম ছেড়ে উঠে দেখল, তাদেরই দরজায় লোকজন দাঁড়িয়ে, টর্চ লাইটের আরও জ্বলছে কয়েকটা, অতর্কিতভাবে অন্ধকার ঝোপঝাড়ে জ্বলে উঠছে আলল, কীসের সন্ধানে। বাড়ির চারদিকে লোকজন।
ভজনের হকচকানিটা কাটলে, সে দেখল, লোকজন নয়, পুলিশ ঘেরাও করছে তাদের বাড়িটা। জানালা দিয়ে এ দৃশ্য দেখা মাত্র ভজন ছুটে গেল আলো নিয়ে দাদার ঘরে। দেখল দাদা নেই, দরজা খোলা। ঘরটা ছত্রাকার হয়ে রয়েছে। পালিয়েছেন নারায়ণ। কিন্তু কেমন করে, কোনখান দিয়ে। বাইরে দেখল খিড়কির দরজাও বন্ধ। পাঁচিল টপকে? কিন্তু বাইরে তো পুলিশ।
ভাবতে ভাবতেই তাদের দরজায় করাঘাত পড়ল। ভজন তাড়াতাড়ি যুঁইকে নিয়ে ঘরটা ঠিক করে দরজা খুলে দিল। তার জিজ্ঞাসার কোনও জবাব না দিয়েই পুলিশ ঢুকে পড়ল বাড়ির মধ্যে। বেরিয়ে এলেন হালদার। পুলিশ আরম্ভ করল খানা তল্লাশি রাত্রি দুটো থেকে ভোর পাঁচটা পর্যন্ত। অশি আর জিজ্ঞাসাবাদ তারপর চলে গেল সবাই।
সেই চলে গিয়েছেন নারায়ণ, আর আসেননি। গত বছর মেদিনীপুরে ম্যাজিস্ট্রেট হতার তিনদিন পরে আবার একবার হিংস্রভাবে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল পুলিশ এ বাড়িতে ভোর রাত্রে। হালদারের মেয়ে, ভজনের বোনের তখন প্রসব হয়েছে। বাড়িতে আঁতুড় ঘর। সেই ঘরের কাপড়চোপড়ের মধ্যে চালান করে দেওয়া হয়েছিল নারায়ণের পরিত্যক্ত কাগজপত্র। বিছানার কাছে বসেছিলেন বকুলমা।
এ দেশি পুলিশ অফিসার সঙ্কোচ করেছিল আঁতুড়ঘরে ঢুকতে। কিন্তু ঢুকেছিল সাহেব অফিসার নিঃসঙ্কোচে, অবলীলাক্রমে। তার ইচ্ছে ছিল, প্রসুতির বিছানাটা উলটে দেখবে সে।
কিন্তু বকুলমা ভজনকে ডেকে বলেছিলেন, সাহেবকে বলে দে, মেয়ে আর শিশুর যদি কোনও ক্ষতি হয়, তবে সাহেবকেই তা শোধ দিতে হবে।
সাহেব থমকে গিয়েছিল। এক গৌরাঙ্গী মহিলা, তার দিকে চেয়ে না থাকলেও দেওয়ালের দিকে ফেরানো তাঁর বিশাল দুই চোখের তীব্র কটাক্ষ যেন বিঁধছে তাকেই। তিনি বসেছিলেন প্রসূতির গায়ে হাত দিয়ে, এক পিঠ চুল এলিয়ে। সাহেব অফিসারটির মনে হল, বাংলা পোশাকে তাঁর সামনে বসে রয়েছে বুঝি শিল্পী রুবেনের মডেল। কিন্তু ভেতরে ভেতরে আর জ্বলে উঠছিল একটি নেটিভ মেয়েমানুষের এরকম স্পর্ধা দেখে, আবার একটা ভয়ও ঘিরে ধরেছিল তার মনে। পরে তার সমস্ত রাগটা গিয়ে পড়ল বাঙালি অফিসারের উপর। ধমকেছিল যে, সে কেন বলেনি একটা জমাদারনিকে নিয়ে আসার কথা।
কয়েকদিন পর আবার হামলা হয়েছিল ভজনের দোকানে। কিছুই তারা পায়নি, মাঝখান থেকে লাভ হয়েছিল, বুড়ো গোলক চাটুজ্জে ছাড়া দু তিনদিন দোকানে খদ্দের আসা ছেড়ে দিয়েছিল।
দিন পনেরো পর সংবাদ এসেছিল নারায়ণ গ্রেপ্তার হয়েছেন। বন্দি হয়ে আছেন আলিপুরের প্রেসিডেন্সি জেলে।
এ সময়ে ভজনের জীবনও একটা যেন মোড় নিতে বসেছিল। মনে হয়েছিল, একটা বিশ্বাস এসেছে তার মনে। নারায়ণের ফেলে যাওয়া কাজ তাকেই শেষ করতে হবে, একথাটা যেন প করে জ্বলে উঠেছিল তার বুকের মধ্যে। রীতিমতো সমিতিতে যাতায়াত আরম্ভ করেছিল সে। তার উপর অনেকের বিশ্বাস ছিল, শ্রদ্ধা ছিল তার সাহসিকতার উপর। কিছুদিনের জন্য চায়ের দোকানের ব্যবসা প্রায় উঠে যেতে বসেছিল। রথীন সুনির্মল এরা তার সহকর্মীর মতো, ছায়ার মতো ঘুরত তার সঙ্গে।
কিন্তু বেশিদিন গেল না। কয়েকটা ঘটনার জন্য থামতে হল ভজুকে। এ সময়টাতে কয়েক মাস অনুপস্থিতির পর যুঁই এল বাপের বাড়ি থেকে।
এ সে যুঁই নয়, যার ঠোঁটে ভজন দেখছিল মৃন্ময়ীর হাসি। এ সে যুঁই নয়, ফুলশয্যার রাতের ঘুম ঘোরে যার সারা মুখে ছিল ক্লান্তি ও তৃপ্তির আবেশ মাখানো। সেই উৎসবের রাত পোহাতে যুঁইয়ের মনে হয়েছিল, সুখের স্বপ্ন দেখতে দেখতে সে এক ভিড় করা নরকে এসে হাজির হয়েই। সেদিন বাড়িতে অনেক লোক, কিন্তু চুপচাপ। একটা ফিসফিসানি ও টেপা হাসি ছড়িয়ে পড়েছিল ঘরে ঘরে, উঠোনে পাতকোর পৈঠায় খিড়কির দরজায়। যুঁইয়ের মুখটা যেন জ্বলন্ত প্রদীপ ফুঁ দিয়ে নিভিয়ে দেওয়ার মতো হঠাৎ অন্ধকার হয়ে গিয়েছিল। সে অন্ধকারে এক অসহ্য বিস্ময়ের ছটফটানি। সে যেন ভুলে গিয়েছিল, কোথায় এসেছে সে, কী হয়েছে তার। টের পেল না, ভেতরে তার কয়েকদিন আগের কুমারী কিশোরীটি নিঃশব্দে হাহাকার করে কেঁদে উঠেছে।
কিন্তু আশ্চর্য ক্ষমতা তার। সে কাঁদেনি। বাপের বাড়ি গিয়ে বলেনি কোনও কথা। জিজ্ঞাসা করেনি কাউকে কিছু। দিন চলে গিয়েছে। গভীর রাত্রে ঘুম থেকে উঠে অবাক হয়ে তাকিয়ে থেকেছে ঘুমন্ত ভজনের মুখের দিকে। সে মুখ ঘুমন্ত নয়, জাগ্রত নয়, যেন জ্বরের ঘোরে আচ্ছন্ন। কেন? কী হয়েছে? যুঁইকে কি তার ভাল লাগেনি! কী তোমার ভাল লাগে, কোনওদিন তো তুমি বলোনি, জানাওনি আগে। যুঁইয়ের যা ছিল, সে তো সবই নিয়ে এসেছে। সে নিজে ছাড়া তার তো আর কিছু ছিল না। নিজেকে তত তার কোনওদিন মন্দ মনে হয়নি; তার সবটুকু তোমারই জন্য নিয়ে সে বসে আছে। তবে? তবে তোমার কী হয়েছে?
বছর ঘুরে গিয়ে ছেলে এল যুঁইয়ের কোলে, কিন্তু নিজেকে সঁপে দেওয়া তার হল না। সেই অস্থির মানুষটিকে ভালবেসেছে সে, কিন্তু সে ভালবাসা জয় করতে পারেনি তাকে। সে হল যেন পটে আঁকা বিষাদ রাগিণীর মতো।
সেই সময় বাপের বাড়ি থেকে এসে সে দেখল, বিশৃঙ্খল সংসার। শ্বশুর আরও নিস্পৃহ, ভাসুর জেলবন্দি। বকুলমা বিষণ্ণ ও বিরক্ত। চায়ের দোকান বন্ধ। স্বামী কী এক দুর্বোধ্য অস্থিরতায় ছটফট করে ঘুরছে। হয়তো অতিরিক্ত মদ খাওয়া শুরু হয়েছে।
সেইদিনই বিকেলে সে ঘুগনি তৈরি করে দিল দোকানের জন্য। ভজন এক মুহূর্ত নিবার্ক থেকে তাড়াতাড়ি গিয়ে দোকান খুলে বসল।
মাথা চাড়া দিয়ে উঠলেন হালদার। তাঁর বোতল থেকে ভজনের মদ খাওয়ার কথা জানতে পেরে ফুলশয্যার পরদিন তাঁর গোঁফে গোঁফে একটা অদ্ভুত হাসি খেলে গিয়েছিল। তারপর থেকে প্রায়ই দেখা যেত, আঁর মদের বোতল কেমন করে রোজই ভজনের ঘরে চলে যায়। ভজনও সে বোতর অভ্যর্থনা করতে কার্পণ্য করেনি। কিন্তু সেটা বেশিদিন চলেনি। আবার আপনা থেকেই সে থেমে গিয়েছিল। বিশেষ বাড়িতে পুলিশের হামলার পর থেকেই এদিকে একেবারে ঢিলে দিয়েছিল সে।
সেবারে যুঁই ফিরে আসতেই হালদার ধরে বসলেম ভজুকে। অনেক নথিপত্র ঘেঁটে বার করলেন খানকয়েক কাগজ। কাগজগুলো কয়েকটা বেনামা দলিলের নকল। আসলগুলো সংগ্রহের আশ্বাস দিয়ে তিনি ভজন্কে মামলা করতে বললেন। এ বিষয়ে যুঁইকে প্ররোচিত করতে ছাড়লেন না।
বকুলমা আচমকা সংসারের সমস্ত দায়িত্ব যুঁইয়ের হাতে তুলে দিয়ে বিদায় নিয়ে চলে গেলেন নিজের সংসারে। তাঁর কর্তব্য ফুরিয়েছে। আজ আর তার অভাবে অচল হয়ে থাকবে না সংসার। যতদিন দরকার ছিল, ততদিন ছিলেন।
সমস্ত ব্যপারগুলো এমনভাবে ঘটে গেল যে, ভজন কিছুদিন অসাড় হয়ে রইল একেবারে। এদিকে সংসার অচল। তারপরে হঠাৎ একদিন সে দোকানে বসে বাঙালির সঙ্গে মদ খেল। খেয়ে বাড়িতে এসে চিৎকার করে জানিয়ে দিল, সে নিচু জাতের এটো খেয়েছে।
হালদার ভেবেছিলেন, এই সুযোগ। তিনি যেমনি কথাটা আবার পাড়তে এলেন, ভজন পরিষ্কার বলে দিল, কোথায় মন্তর দিচ্ছ? পরের পেছনে লাঠি দেওয়া, ভজুর দ্বারা হবে না বুঝেছ? যাদের পরামর্শ দাও, তাদের বলোগে, আমাকে বলো না।
এতদিন পরে প্রকৃতপক্ষে হালদারের জীবনের সমস্ত আশা নিভে গেল। আর একবার স্ত্রীর মুখ মনে পড়ল। সেই দুর্জয় হাসি ভরা মুখ। সে হাসি যেন তাকে চিনা সাকাওয়ালার শাণিত ছুরি বেষ্টনীর মধ্যে আটকে রাখল। নিপুণ খেলোয়াড়ের মতো আর বেরিয়ে আসতে পারলেন না। এমন কী, তার বকুলফুলও চলে গিয়েছেন। এক ফোঁটা মদের জন্যও কারও দ্বারস্থ হওয়া চলবে না। নারায়ণ তো কবেই ফাঁকি দিয়ে পালিয়েছে। একটু আশা যদিও হয় যে, সে যদি পুলিশের হাতে লাঞ্ছনায় আবার মোড় ফেরে। কিন্তু সে অনেক দূরের কথা। আর আছে বউমা যুঁই। কিন্তু সে ভজুর স্ত্রী। ইচ্ছা থাকলেও স্বামীর অমতে সে কিছুই করতে পারবে না।
নিজের উপরে হালদারের বিরক্তির সীমা ছিল না। দিবারাত্র তাঁর সুযোগ সন্ধানের মাঝে, তিনি আশা করেছিলেন, সুরথ বন্দ্যোপাধ্যায়ের সহযোগিতায় কোনও একটা দিক দিয়ে নিজের অবস্থার পরিবর্তন করবেন। সে সময়ে কাউন্সিলে প্রতিনিধিত্বের প্রতিযোগিতায় বন্দ্যোপাধ্যায় এসেছিলেন তাঁর কাছে। কিন্তু ভজনের জন্য সেই ভদ্রলোককে তাঁর পূর্ণ সম্মানটুকু পর্যন্ত তিনি দিতে পারেননি। দেশবন্ধুর স্বরাজী প্রতিনিধিকেই হালদার আশ্বাস ও ভরসা দিয়েছিলেন যার সঙ্গে তাঁর নিজের সম্পর্কে কোনও কথাই চলে না। এই প্রতিনিধি যুবক অবিবাহিত ডাঃ প্রধান চন্দ্র রায়। দেশবন্ধুর নামাঙ্কিত জয়তিলক এঁর কপালেই ছিল।
কথা দিয়েছিলেন এঁকে হালদার এবং মর্যাদা রেখেছিলেন কথার। কিন্তু হালদারের কপালে ক্ষোভের রেখা এঁকেবেঁকে উঠল, নিজেকে শুধু ধিক্কার দিলেন। নিশ্বাসে নিশ্বাসেই আয়ু ক্ষয়ে গেল তাঁর এ বয়সের প্রতিক্ষিত বসন্তের।
সেই সময়টাতে ভজনও উঠে পড়ে লাগল তার নতুন দোকানের জন্য। একটি একটি করে গহনা দিয়ে নিজেকে নিরাভরণা করেছে যুঁই। তাতে তার প্রাণে আফসোস ছিল না, সে তার গচ্ছিত সমস্ত কণাটুকুও তুলে দিয়েছে ভজনের হাতে। দেবতার পুজো দেওয়ার মতো দিয়েছে। ভজনও খরচ করেছে তার ধূলিকণাটুকু। ভাৈটের সময় স্বরাজী দলের কাছ থেকেও সে কিছু পেয়েছিল। সবই ঢেলে দিল সে তার দোকানের পায়ে। দোকান প্রতিষ্ঠার পরও কেটে গিয়েছে তিনটি বছর।
.
ভজন গাইছে, ড়ুব দে রে মন জয় কালী বলে। গাইছে না, জড়ানো গলায় অদ্ভুত সুরে আবৃত্তি করছে। হঠাৎ মনে হয় একটা কোলা ব্যাঙ বর্ষার আভাস পেয়ে উল্লাসে ডাক ছেড়েছে।
বাংলার দক্ষিণে জেলার উত্তর মফস্বলের একটা জংশন স্টেশন। ভজুদের বাড়ি থেকে আধমাইলটাক উত্তরে। সন্ধ্যাবেলার ভিড়ে চারদিক গুলজার। তার মাঝখানে ভজনের গলার স্বর কারও কানে গেল না।
শীতের আমেজ পড়েছে। শীত আসছে। হাওয়া নেই। রেল ইঞ্জিনের ধোঁয়া, রাস্তার ধুলো, আশেপাশের দোকান ও বাড়ির উনুনের ধোঁয়া যেন ভারী কুয়াশার মতো ছড়িয়ে রয়েছে। আকাশে তারা উঠেছে, ঝাপসা অস্পষ্ট।
স্টেশনের তিনটে প্ল্যাটফর্মেই আলো জ্বলে উঠেছে। যাত্রীর ভিড় আর কোলাহলে মুখরিত স্টেশন। সামনের প্ল্যাটফর্মে মৌরসী পাট্টা গেড়েছে কতকগুলি বিদেশি ভবঘুরে ভিক্ষুক। পুলিশের শাসানি আর রুলের গুতো ওদের তাড়াতে পারেনি। সারাদিনের পর ওরা এসে জড়ো হয়েছে মেয়ে পুরুষ জোয়ান বাচ্চার দল। শুরু হয়েছে দৈনন্দিন চেঁচামেচি, পাওয়া না পাওয়ার হিসেব নিকেশ। এ সময়টাতে ট্রেনে যাতায়াত বেশি, বেশি তাই যাত্রীর ভিড়। কলকাতার চাকুরে দৈনিক যাত্রীরা ফিরছে। ব্যস্ত পশ্চিমা কুলিরা ছুটাছুটি করছে এদিকে সেদিকে।
এক নম্বর প্ল্যাটফর্মের গায়ে প্রশস্ত রক। প্ল্যাটফর্মের সঙ্গে পার্টিশন দিয়ে সেটা এমন ভাবে ভাগ করা হয়েছে যেন রকটার সঙ্গে স্টেশনের কোনও কারবার নেই। কেন না রকটা সিঁড়ি, রাস্তার উপরেই। কাজেই স্টেশনে দরকার থাক বা না থাক, এ ছুটির সময়ে ও সন্ধ্যাবেলার ঘরছাড়া মানুষের দল এই রকের উপরে বসে বসে কেউ বাদাম ভাজা চিবোচ্ছে, কতকগুলো হয়তো প্রবাসী ছেলে পার্টিশনের রেলিং এর উপর ঝুঁকে রয়েছে গাড়ি দেখবার জন্য। কারখানার পশ্চিমা প্রবাসী মজুরেরা কয়েকজন এককোণে বসেছে গামছা পেতে। গান ধরেছে সরু তীব্র গলায়, টেনে টেনে, কাঁপিয়ে কাঁপিয়ে। কোলাহলের মাঝে এ গানের সুর যেন মৃত্যু কলরবের মধ্যে কার টেনে টেনে কান্নার মতো। রকের উত্তরদিকে চায়ের দোকান দক্ষিণ ঘেঁষে টিকিট ঘর। তার পাশ দিয়ে উঠে গিয়েছে ওভার ব্রিজে ওঠার কাঠে সিঁড়ি। সিঁড়িটা এমনভাবে পাঁচিলের আড়ালে পড়ে গেছে, তার নীচেই রাস্তা-মুখো খোলা রকটা উইংস-এর পরেই যেন প্রশস্ত নাট্যমঞ্চ। এখুনি কে নেমে আসবে, কিছুই বোঝা যায় না। তুমি যখন ভাবছ, এবারে এক রূপসী মেয়ে নেমে আসবে তখন দেখা গেল রেল কলোনি ঘুরে একটা বিড়াল নিরাপদে এল রকে।
রকের নীচেই রাস্তা। ইট ভাঙা খোয়া বাঁধানো রাজপথ। পথের ধারে, স্টেশনের গা ঘেঁষে দাঁড়িয়ে রয়েছে তিনটি ছাকরা ঘোড়ার গাড়ি। জোড়া হিসেবে ছটা ঘোড়ার দুটো মাদী। সে দুটোই সবলা। তাদের চোখের পল্লবগুলো বড় বড়, চকিত চাউনি, উৎকর্ণ কান নড়ে নড়ে উঠছে, ঝাপটা মারছে লেজ দিয়ে। মদীগুলো রুগ্ন, ঘেয়ো, চোখগুলোতে পিচুটি ভরা। মাছির দৌরাত্ম্যে চোখ বুজে খালি ঝিমোচ্ছ। তা বলে সাজগোজের বহর কম নয়। ঘোড়ার গলায় চামড়ার বকলেস কচকে ঘুঙুরের মালা, তার উপরে দুপয়সাওয়ালা রঙিন চট ফেসোর মালা পরিয়েছে যাত্রার দলের সং-এর মতো। ছাই দিয়ে মাজা ঝকঝকে বিলিতি লোহার শিরস্ত্রাণ রয়েছে মাথায়।
ঘোড়ার জলদানিটার পাশে পাঁচিলের গায়ে লেখা রয়েছে ইংরাজিতে ফাইভ হর্স ক্যারেজে। রকের সিঁড়ির উত্তর পাঁচিলে লেখা আছে ট্যাক্সি ক্যাব স্ট্যান্ড ফর থ্রি। ভুনু গাড়োয়ানের মতে ট্যাসি ইসূটেন্ডটা কোম্পানি ফালতু রেখেছে। ওটাও ঘোড়ার গাড়ির আস্তানা করলেই ঠিক হত।
কারণ, এ শহরে পাঁচখানার বেশি ঘোড়ার গাড়ি আছে, ট্যাক্সি বোধহয় একখানার বেশি নেই। অবশ্য কল মিলের সাহেব সুবোদের আছে প্রাইভেট গাড়ি। তার জন্য আছে প্রাইভেট আস্তানা। পার্থক্যটা যাকে বলে বাজারি আর ঘরোয়া।
ট্যাক্সিটার চেহারাও বাজারের মতো। দাঁত খিচোনো বুড়োর মতো হেড় লাইটের দুটো ড্যাবা অথচ ঝাপসা দাগ ধরা চোখে যেন গাড়িটা উলটোদিকের দোকানগুলোর দিকে তাকিয়ে আছে। ওয়াটার-পুফের হুড়টায় তালি পড়ে পড়ে এখন এখন আর ওয়াটার নয়, ওটা তালি প্রুফ হয়ে গিয়েছে। কাছাকাছি কয়েকটা চটকল আছে বলে সপ্তাহের শেষে কদিন গাড়িটাকে কম দেখা যায়। যে সব সাহেবের গাড়ি নেই, তারা কোনও কোনও ছুটির দিন এই গাড়িটাতে কলকাতা যায়। তা ছাড়া তেমন দু একটা বিয়ে অথবা মরণাপন্ন রোগীকে গাড়িটা কালে ক্কচিৎ বয়ে বেড়ায়। বাদ বাকি দিন, এখানকার মতোই ধুলো মলিন জঞ্জালের মতো পড়ে থাকে।
আরও খানিকটা উত্তরে একটা মোটর গাড়ি দাঁড়িয়ে রয়েছে। দেখে মনে হয় রাস্তার ধারে একটা পান বিড়িওয়ালার চৌকো গুমটিঘর। ওটা বাস। গাড়িটার লাল রং, গায়ে সাদা অক্ষরে লেখা রয়েছে পুষ্পময়ী। এখানে বাস রুট বলে কিছু নেই, অন্যান্য গাড়ির মতো ওটা রিজার্ভেই চলে।
ট্যাক্সি ড্রাইভার রোজকার মতোই সন্ধ্যাবেলা অনুপস্থিত। বড় গাড়িটার ড্রাইভার নীচে দাঁড়িয়ে হর্ন টিপছে আর চিৎকার করছে। জনা তিনেক লোক জুটেছে তার এতক্ষণে। সেই পরিমাণে চিৎকার। করছে ঘোড়ার গাড়ির গাড়োয়ানেরা।
চিৎকার ও সন্ধ্যাবেলার ভিড়ে সমস্ত অঞ্চলটাই যেন একটা বাজার হয়ে উঠেছে। রাস্তার অপরদিকে, পশ্চিমে কতকগুলো সারি সারি দোকান। সবই প্রায় ময়রার ও পানবিড়ির দোকান। সেই দোকানগুলিতেও ভিড়।
তার মধ্যে যে দোকানটি এক নজরে চোখে পড়ে, সেটা একটা এখানকার আমলের হালফ্যাশনের রেস্টুরেন্ট। স্টেশনের ঠিক উলটোদিকেই রাস্তার সবচেয়ে বড় সাইনবোর্ডটায় লেখা রয়েছে, শ্রীমতী কাফে। সেই সাইনবোর্ডটা যেন অল্পবয়সী গেঁয়ো বরের মাথায় একটা মস্ত টোপরের মতো হয়েছে। হরফগুলো প্রায় এক ফুট লম্বা। খুব ভাল করে লক্ষ করলে দেখা যায়, কাফে কথাটার ঠিক পরেই ছোট্ট করে পেন্সিল দিয়ে লেখা রয়েছে র। লেখক রসিক নিঃসন্দেহে, সাহসীও বটে। শ্রীমতী কাফের নীচে ছোট করে লেখা রয়েছে, স্থাপিত ইং ১৯২০ সাল।
কাফের সামনে চওড়া বারান্দা। বারান্দার পরেই সুদৃশ্য দরজাটা দেখবার মতো। ঘরটার সামনের দিকে দেওয়াল নেই, দুটো বড় বড় পাল্লার দরজা। মেহগিনি কাঠের ফুল কাটা দরজা। নকশা কাটা আলমারির মতো দরজার উপরের অর্ধেক কাচ লাগানো। কাচের চারপাশে ফ্রেমের কারুকার্য সুরুচিসম্পন্ন। সেই কাচের দুদিকে বাংলা ও ইংরাজিতে লেখা রয়েছে, শ্রীমতী কাফে। ভিতরে আসুন। পোঃ শ্রীভজনানন্দ হালদার। চৌকাটের গায়ে ডান কোণের দেওয়াল ঘেঁষে কাউন্টার।
ঘরটা মাঝারি। দেওয়ালের ফুট তিনেক, তিনদিকে পাথর দিয়ে বাঁধানো। তাতে চাঁদমালার রং-এর নকশা। তার উপরেই দেওয়ালের সঙ্গে গাঁথা রয়েছে ঘরটার তিনপাশ জুড়ে খেত পাথরের টেবিল। দরজা বরাবর দেওয়ালে একটা পুরনো আমলের দেওয়াল ঘড়ি। ঘড়িটা দামি। সেটাও মেহগিনি কাঠের নিখুঁত নকশাকাটা ফ্রেমের মধ্যে। চোখ সওয়া রুপোর গোল পাতের উপর সময়ের অফ লেখা রয়েছে। পেন্ডুলামে দুলছে একটা নরকঙ্কালের মুণ্ডের ছবি। ঘড়িটার ঠিক উপরেই গদা চক্র ও শখ পদ্মধারী একটা নারায়ণের ছবি রয়েছে। আরও কতকগুলো বিলিতি প্রিন্টিং রয়েছে। সবই মনোরম ল্যান্ডস্কেপ। এগুলো রঙিন তা ছাড়া বিলিতি অনুকরণের কয়েকটি দেশি ল্যান্ডস্কেপের ছবি রয়েছে সসের কাজ করা। আর দুখানি বিলিতি আয়না রয়েছে দুদিকে।
ঘরটার তিনদিকে সারি সারি ফোল্ডিং চেয়ার পাতা। ইলেকট্রিকের তিনটি বাতি জ্বলছে দুধের মতো সাদা চিনেমাটির শেডের মধ্যে। শেডের গায়ে লেখা রয়েছে শ্রীমতী কাফে। সেই আলো পিছলে পড়ছে লাল চকচকে মেঝের উপর।
পেছনে রয়েছে আর একটা ফালি ঘর। সেটার সরঞ্জাম ও আয়োজন, সবই যেন সামনের ফয়াকে সব দিয়ে ধুয়ে ফকিরের মতো পড়ে আছে। বলা চলে, রঙ্গমঞ্চের আড়ালে রঙ ও ধড়াচূড়া হাঙ্গ একটা অবহেলিত অন্ধকার জায়গা। এ-ঘরটায় রেস্টুরেন্টের নিজস্ব সরঞ্জাম কিছু কিছু থাকে। ঘটার ধরন ধারণ দেখে মনে হয়, এ ঘরটাকেও মালিক সাজাবার একটা ব্যর্থ চেষ্টা করেছিল। কলের মুখ লাগানো জলের পিপে রয়েছে এক কোণে। একটা লম্বা সরু টেবিলে ছড়ানো রয়েছে কয়েকটা এঁটো চিনে মাটির প্লেট, পিয়াজ কুঁচো, পাঁউরুটির গুঁড়ো, ঘুগনির শুকনো দানা। টেবিলের তলায় রয়েছে এলোমলো কয়েকটা খালি বোতল। মদের বোতল।
তার পেছনের ঘরটাতেই রান্না হয়। এটা ঠিক ঘর নয়, টিনের শেড আর ছিটে বেড়া দিয়ে বিরে নেওয়া একটা অন্ধ খুপরি বিশেষ। মেঝেটা কাঁচা, এবড়ো-খেবড়ো। একদিকে ঘুঁটে আর কয়লা, একটা মাটির জলের জালা, কাপ প্লেট ধোয়ার জায়গা, অন্যদিকে উনুন। উনুনের পাশে জাল আলমারিতে খাবার ঢাকা দেওয়া রয়েছে।
ঘরটার পেছনের কোলেই কাঁচা নর্দমা। পেছন দিকে যেতে হলে ঝাঁপের ফাঁক দিয়ে লাফিয়ে নর্দমাটা পেরুতে হয়। নর্দমার পাশে স্তূপাপাকার হয়ে আছে নোংরা রাবিশ। কারণ নর্দমাটার পরেই যে থমকানো অন্ধকার ছোট জায়গাটুকু রয়েছে, তারপরের এলোমেলো চালাগুলো স্থানীয় বাজারের আলো এখানে এসে পড়ার কোনও সম্ভাবনা নেই। কেবল সন্ধ্যাবেলার গোলমাল শোনা যাচ্ছে। বাজারের কলকোলাহলের মধ্যে আশ্চর্যরকমভাবে দু একটা গলা পরিষ্কার শোনা যাচ্ছে। মনে হচ্ছে, কাছে দাঁড়িয়েই কেউ যেন বলছে, সুদের কারবারে বাপ পিতা মো কেউ নেই। আসলটা তো ফাঁকি, সুদটা হল হকের ধন। আরও সাড়ে তেরো গণ্ডা চাই। তারপরেই একটা ঝনাৎকার শোনা যায় এক গোছ কাঁচা পয়সার।
বলতে ভুল হয়ে গিয়েছে, ঘড়িটার ডানদিকে রয়েছে দেশবন্ধু সি. আর. দাশের একখানা ছবি। ছবিটার নীচে লেখা রয়েছে রবীন্দ্রনাথের সেই বিখ্যাত মর্মোক্তি :
এনেছিলে সাথে করে মৃত্যুহীন প্রাণ
মরণে তাহাই তুমি করে গেলে দান।
আর একটা বড় ফ্রেমের মধ্যে ছোট ছোট চারখানা ছবি রয়েছে। র্যাফেলের মা ও ছেলে, মেরী মাতা, রবীন্দ্রনাথ ও সিরাজদৌল্লা। এ চতুষ্টয়ের এক সমাবেশ কেন, তা এ কাফের মালিক ভজনানন্দ ছাড়া অন্যের পক্ষে বলা শক্ত।
ভজনানন্দ, ভজন, ভজু, নেকো হালদারের ছেলে, গ্রাজুয়েট, নারান হালদারের ভাই ভজুলাট। সবাই জানে, তার সব বিষয়েই একটা বিশেষ বক্তব্য থাকে। তার শিক্ষার প্রতি সকলের সম্রম আছে, কিন্তু একটা দোষে সব মাটি করেছে। ভজন আর সে ভজু নেই। সে আজ মদ্যপ, চবিবশঘণ্টা তাকে মদ রাহু গ্রাস করে রাখে। এ অঞ্চলের শিক্ষিত ও মাননীয় কয়েকজন সুরাসক্ত ব্যক্তি মারাত্মক পোড় খেয়েছে তার কাছে। একসঙ্গে মদ খেতে গিয়ে ভদ্রলোকদের হাঁড়ি ভেঙে দিয়েছে হাটের মাঝে। তা ছাড়া সে চিরকাল দুর্বিনীত, দুমুখ, তাই বন্ধুহীন।
অনেকদিন থেকেই আজ তার ভজুলাট নাম সার্থক হয়েছে। এই যে সে মাতাল হয়ে ঘুরছে কাফের ভিড়ের মধ্যে, তাতে তার জীবনের প্রতি যত্ন অবহেলাই থাক, মনের তলায় শৌখিন মানুষটা আজ স্বাধীনভাবে আত্মপ্রকাশ করেছে। তার সিল্ক টুইলের কলারবিহীন, শক্ত আমেরিকান কাফের খাটো জামা (খাটো জামা-ই বর্তমানের ফ্যাশান), কালো সরু পাড়ের কোলে জলচুড়ি আঁকা দিলি ধুতির লুটনো কোঁচা, তার তলায় আন্ডার-ওয়্যারের আভাস। পায়ে গ্রেসকিডের জু্তো, গলাবন্ধের কাছে একটি মাত্র পানপাতার ছাঁচে সোনা বোতাম, কানের উপর থেকে নিখুঁত করে কামানো মুখ, আজকে আর এসব তার এখন-তখনের জন্য নয়, সর্বক্ষণের। আজকে তারকা চিহ্নিত ম্যাগনাম সাইজ ক্যাপস্টান তার তীক্ষ্ণ রক্ত রেখায়িত ঠোঁটের একটা অঙ্গ হয়ে গিয়েছে। ভজুলাট বাজারে গেলে, বেচনেওয়ালারা বলে, এতক্ষণে এল একটা খানেওয়ালা।
মনে হতে পারে ভজনের পরিবর্তন হয়েছে। এটা যদি পরিবর্তন হয়, তবে তা অভাবিত নয়। জীবনে তার নতুন করে কোনও ছন্দ বাঁধা হয়নি, পেছনে গড়ে ওঠেনি একটু নিরাপত্তা। তার অসহায় মনের বেগ একটা বন্ধু পাখির মতো নিরুদ্দেশের পথে উড়ে চলেছে। যুক্তি তর্ক কারণ অকারণ তার কাছে তুচ্ছ। অনেকদিন আগের শ্মশান থেকে ফেরার সেই অভিশপ্ত জীবটিই যেন আজও ছুটে চলেছে। সেদিন সে ভেবেছিল, একজনকে তার চাই, যার কাছে নিজেকে সঁপে দিয়ে শান্তি পাবে। তার জীবনের অদৃশ্য লোক থেকে উঠে আসা সমস্ত সংশয়কে ঘুচিয়ে দেবে।
কিন্তু রাত পোহাল না ফুলশয্যার, পথের আলো হঠাৎ বেঁকে গেল অন্যদিকে। সেদিকে তাকিয়ে শিউরে উঠে সে দেখল, তার পথ হারিয়েছে। সেই রাতেরই উন্মাদনার পরিণতি এই শ্ৰীমতী কাফে।
ভেবেছিল সে এর নাম দেবে যুঁই কেবিন। কিন্তু আসল যুঁইয়ের যেমন সাড়া ছিল না, তেমনি কোনও সাড়া পেল না ভজন নিজের মনে। আশ্চর্য। অতীতে বা ভবিষ্যতেও যার কোনও ভালবাসার পাত্রী নেই, বর্তমানেও যুঁইকে ভালবাসা দিতে গিয়ে যা থিতিয়ে গেল, তার সেই অস্থির মনটাকে একটা ঝাপসা চেহারায়, কে যেন হাতছানি দিয়ে ডেকে নিয়ে চলেছে। তার কোনও স্পষ্ট মূর্তি নেই, হাসি নেই, চোখ নেই, শব্দ নেই। তার কোনও নাম নেই। শুধু ভজন যখন নিজের সঙ্গে কথা বলে, তখন বলে, কে তুমি শ্রীমতী। জীবনটা তো ছেড়ে দিয়েছি তোমারই হাতে। আর তোমার কী চাই।
এই শ্রীমতী কাফে তার সেই কল্পলোকের শ্রীমতী। শ্ৰীমতীর পেছনে ফ্যাশনদুরস্ত কাফে কথাটা জুড়ে দিয়ে এটাকে সে রেস্টুরেন্ট করেছে। কিন্তু এ শুধু তাই নয়। একে সে সাজিয়েছে তার সর্ব উজাড় করে। এরই পায়ে ঢেলে দিয়েছে সে তার সব ধূলিকণাটুকু, তার অস্থির প্রাণের মমতা বিবেক ও বুদ্ধি। এই তার প্রিয়া ও প্রেয়সী, তার জীবন। মানুষের কিছু না থাক তবু কিছু চাই। সেই কিছু তার শ্রীমতী কাফে।
অন্য কোনও কিছুতে তার গর্ব নেই, গর্ব তার শ্রীমতী কাফেকে নিয়ে। আর সত্যি বলতে কি কলকাতার এ দূর শহরতলীতে এরকম আর একটা দ্বিতীয় রেস্টুরেন্ট নেই। বাহুল্য হবে না একে অদ্বিতীয় বললে। দশ বারো মাইলের মধ্যে সবাই চেনে শ্রীমতী কাফেকে।
ভজন বলে, পরাধীন যখন থাকতেই হবে তখন তার মধ্যে আর নতুন বেড়াজালের সৃষ্টি না করে একদিকের স্বাধীনতা তো বজায় রাখা যাবে। বড় সাহেব ছোট সাহেবের দয়াও নেই, চোখ রাঙানিও নেই। এখানে লাট বেলাট যা-ই বলো, সবই ভজন।
ছেলে ছোকরারা সুযোগ পেলে শ্রীমতী কাফেতে এসে একটু ফষ্টিনষ্টি করে খাওয়াটাকে একটা বিশেষ কিছু মনে করে।
প্রতি মুহূর্তে একে বোয়া মোছর অবসর নেই। শ্রীমতী কাফে সবসময় ঝকঝকে তকতকে, ফিটফাট ভজুলাটের ফুটফুটে বিবিটির মতো পোশকি বাহারের জেল্লায় উজ্জ্বল। একে ভজু নিজের হাতে সাজায়, দাঁড়িয়ে থেকে পরিষ্কার করায়। সময়েতে জল ন্যাতাটি নিজের হাতে বুলোলে তার স্বস্তি হয় না। মফস্বলবাসী অনেকের শ্রীমতী কাফেতে হঠাৎ ঢোকা যেন এক মহা ফ্যাসাদ ছিল। কেননা এর পরিবেশ ও সজ্জা এক মুখে আমন্ত্রণের হাসি আর মুখে গাম্ভীর্য নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। যেন এখানে ঢোকার আগে খদ্দেরকে তার ক্লাশটা বেছে নিতে হবে।
তা ছাড়া স্বয়ং ভজুলাট কাউন্টারে। তার মস্ত চেহারা ও চোখ দেখেও কাউকে কাউকে পিছিয়ে যেতে হয় বই কী। এমন অনেক অল্পবয়সী ছেকরা আছে, যারা স্রেফ চোরের মতো খেয়ে উঠে পড়ে। সেটা শ্ৰীমতী কাফের দোষ নয়, খদ্দেরের ভাগ্য।
স্থানীয় অনেকে অবশ্য এটাকে ভজুলাটের চাটের দোকান আখ্যা দিয়েছে। ভজু বলে, চাটের দোকান হতে পারে কিন্তু কোন্ রসের, সে জানে রসিকজনেরা। তা ছাড়া সাধ্যি থাকে, ব্যাটারা মদের পাট নিয়ে একবার এসে প্রমাণ করে দিয়ে যাক এটা চাটের দোকান। সত্যি, তেমন সাহস ছিল না। চাটের দোকান আখ্যাদাতাদের।
.
শ্ৰীমতী কাফেতে এখন সন্ধ্যাকালীন ভিড় লেগেছে। ভিড় করেছেমফস্বলের শৌখিন যুবকেরা। রামপাখির মাংস খাবে, অর্থাৎ মুরগির। যাকে বলে ফাউলকারি। স্থানীয় হিন্দু ভদ্রলোকদের সেজন্যও একটা বিদ্বেষ ছিল শ্রীমতী কাফের উপর। একে তো ভজুলাট মাতাল, তায় আবার তার দোকানে যত ম্লেচ্ছ খাবারের কারবার। এ ব্রাহ্মণ অধ্যুষিত অঞ্চলে অনেক যুবকের কাছেও ভজুলাটের দোকান রীতিমতো পরিত্যাজ্য। বাজি ধরে মুরগির মাংস খেয়ে শ্রীমতী কাফের কোলে অনেকে অন্নপ্রাশনের ভাত রেখে গিয়েছে। অভিভাবকেরা ছেলেদের শ্রীমতী কাফেতে আসার কথা শুনলে রীতিমতো কণ্টকিত হন। একে তো জাত নেই, ছেলেরা এখানে এলে নাকি আবার একেবারে বিগড়ে যায়। তা ছাড়া আছে পাঁঠার মাংস, ভজন বলে মটন কারি। চপ, কাটলেট, ঘুগনি, তেল ঝালের রসান দেওয়া মুখরোচক সব খাবার। ভজন আর কিছু না হোক, জনসনার আদিম রুচিটা সে বোঝে। খাবার তৈরি করে সে নিজের হাতে। এ হাতটার কেউ বদনাম করতে পারেনি আজও।
খদ্দের ছাড়া অখদ্দেরেরও ভিড় হয়েছে। হীরেন আর কৃপাল তাদের দৈনন্দিন সন্ধ্যাকালীন আড্ডা জমিয়েছে যথাপূর্বং নস্যির টিপ বাগিয়ে ধরে। পয়সা দিয়ে কিছু খাওয়া দূরে যাক, উলটে দু কাপ চা খেয়ে যাবে বিনা পয়সায়।
পেছনের ঘরে, জলের পিপের সামনে চওড়া বেঞ্চিটাতে আশ্রয় নিয়েছে একটি ইউ পির ছেলে। আশ্রয় নেয়নি, আত্মগোপন করেছে। কানপুর থেকে কিছু রিভলভারের পার্টস নিয়ে আসতে হয়েছে। তাকে তার দলের কাজে। ছোটখাটো ছেলেটি, শক্ত শরীরে কলিদার পাঞ্জাবি আর পায়জামা পরা একটা রুক্ষ সহজ সৌন্দর্য রয়েছে তার। নাম তার সুজ সিং। এসে পৌছতেই এ অঞ্চল থেকে বেরুবার তার সমস্ত পথ পুলিশ আটকে ফেলেছে। নিশ্চয়ই সংবাদ পেয়েছে পুলিশ তার আসার কথা। রথীন সুনির্মলের দল কোথায় রাখি কোথায় রাখি করে আর কোথাও ঠাঁই পেল না, এনে তুলেছে শ্রীমতী কাফেতে। তবে সুরজ সিং হল অন্তরালের মানুষ। তার সঙ্গে শ্রীমতী কাফের এ খোলা রঙ্গমঞ্চের কোনও সম্পর্ক নেই।
এ-সব অখদ্দেরের ব্যাপারে ভজনের হাত নেই, এটা আবার শ্রীমতী কাফের ভাগ্য। ভজন বলে, এরা অখদ্দের নয়, অখাদ্যের দল। এরা বললে শোনে না, দুর্ব্যবহার করলে আপনি কেটে পড়বে। কিন্তু সেটুকু ভজন, আর যাদের সঙ্গে হোক ওদের সঙ্গে পারবে না করতে। এসেছেন গোলক চাটুজ্যে মশাই যথারীতি তার থেলো হুঁকোটি হাতে নিয়ে। তাঁর বয়স ও সঙ্গী থেলো কোটিকে এ যুগের শ্রীমতী কাফের দুর্জয় স্টাইল যেন চোখ রাঙিয়ে শাসায়। যেন বলতে চায়, আদ্যিকালের বুড়োটার কি একটু লজ্জাও করে না। চাটুজ্যে মশাই এ-সব ফ্যাশান দেখে হাসেন আর মনে মনে বলেন, যতই তোমার গা জ্বলুক, ঘরের গিন্নি বিবি সাজলে কি আর মানুষটা বদলায়। দোকানটা যে গাঁয়ের ভজুলাটেরই। তাঁর লাট-মেজাজি পড়শি নাতির।
সন্ধ্যাকালের এ জমাটি আসরে তিনি কেঁদেছেন মাছ ধরার গল্প। গল্প তো নয়, সে যেন গান ধরা। ধরলে আর ছাড়েন না, শ্রোতারা বিশ্বাস করুক বা না করুক, না শুনে উঠতে পারে না।
রাস্তার হট্টগোলের সঙ্গে মিশে গিয়েছে শ্রীমতী কাফের কলকোলাহল। রাস্তার আর দোকানের ভিড় যে একাকার হয়ে গিয়েছে। কেবল পুষ্পময়ীর হর্নের গাধা চেঁচানোর মতো শব্দ ও গাড়োয়ানদের বিচিত্র ভাষার চিৎকার রাস্তার গণ্ডগোলকে বাড়িয়ে তুলছে বেশি করে।
ভজন মুখ গুঁজে পড়েছিল টেবিলের উপর। মুখ তুলে সে তাকাল টেবিলের দিকে। শ্ৰীমতী কাফের মালিক। টানা চোখ জোড়া তার লাল হয়ে উঠেছে। চাউনিটা ঢুলুঢুলু। টেবিলের উপর ছড়ানো কতকগুলো পয়সার দিকে চোখ তুলে তাকাতে গিয়ে দৃষ্টিটা তার ট্যারা হয়ে উঠল। এমনিতেই তার ঠোঁট দুটো যেন রক্ত রেখায় বেঁকে থাকে। এখন অ্যালকোহলের চড়া ডিগ্রিতে তার গালে আর ঠোঁটে যেন রক্ত ফেটে পড়েছে। এ বয়সেই মেচেতা পড়েছে তার চোখের কোলে। কপালে পড়েছে দুটো সুস্পষ্ট রেখা।
সন্ধ্যার ঝোঁকেই পানের মাত্রাটা একটু বেশি হয়ে গিয়েছে। মাথাটা দুলছে যেন হাওয়ায়। বাইরের দিকে তাকিয়ে হঠাৎ হেসে উঠে বলে উঠল,
এই কুয়াশাচ্ছন্ন সন্ধ্যাকালে
তারা জ্বলে কার ভালে।
তারপর আপন মনে জিজ্ঞাসা করল কার ভালে হে!
নিজেকে দেখিয়ে বুক ঠুকে বলল, এই আমার ভালে, ভজুলাটের বুয়েছ বাছা।
পরমুহূর্তেই টেবিলে একটা চাপড় মেরে হাঁক দিল, বি-শে।
ভেতর থেকে বেরিয়ে এল বিশে। বিশ্বনাথ। শ্রীমতী কাফের চাকর। খাবার পরিবেশন আর কাপ ডিস ঘোয়া তার কাজ। লোকটার বিশাল শরীরে ছোট একটা মাথা যেন বসিয়ে দেওয়া হয়েছে। মুখটা দেখলে গরুড় পাখির চেহারা মনে পড়ে যায়। ছোট্ট ছোট্ট চোখ দুটোতে তার নিয়ত ব্যস্ততা। এদিকে ও-দিকে দেখে আর চোখ পিটপিট করে, থেকে থেকে জিভ দিয়ে ঠোঁট চাটে।
ভজনের ডাকে কে সাড়া দিল না, নিঃশব্দে কাছে এসে দাঁড়াল।
ভজন রক্ত চোখ কুঁচকে বলল, কী খাচ্ছিলি ভিতরে বসে?
বিশে চকিতে একবার সকলের দিকে তাকিয়ে অদ্ভুত সরু গলায় বলল, মাইরি বলছি, কিছু খাইনি ঠাকুর।
ব্যাপারটা নতুন নয়, মিথ্যেও নয়। বিস্ময়ের কিছু ছিল না, কয়েকজন হেসে উঠল খালি।
বিশের কাজে বিশেষ গণ্ডগোল ছিল না। একটা কারবারেই সব মাত করে দিয়েছে। ভজন অনেক সময় তাকে রেগে বলে, ব্যাটা হাড় হা-ভাতের বাচ্চা। সত্যি, বিশ যেন সবসময়েই নামার রাত্রিচর ছুঁচোটার মতো নোলা ঠুকঠুকিয়ে বেড়াচ্ছে। কতদিন ভজন তাকে ধরে ফেলেছে এটা সেটা খাওয়ার সময়। ধরা পড়লে বিশে বলে, এটু চোখ দেখছিলুম। ডিসে ঘুগনি বেড়ে দেওয়ার সময় যে দু এক ফোঁটা পড়ে যায় বিশে সেটুকুও বাদ দেয় না। চপ কাটলেটের ভাঙা টুকরে পড়ে থাকলে তো কথাই নেই। তবুও তাকে খেতে দিতে ভজনের কার্পণ্য ছিল না।
বিশের কথায় বিশ্বাস হল না ভজনের। বলল হা দে দিকিনি আমার মুখে।
বলে সে খাড়া নাকটা বাড়িয়ে দিল। বিশে বারকয়েক ঢোক গিলে হা দিল।
অমনি ভজন মত্ত গলায় চিৎকার করে উঠল, হারামজাদা মদ খেয়েছিস?
বিশে যেন ছ মাসের শিশুর মতো ড়ুকরে ককিয়ে উঠল, মাইরি ঠাকুর, মাইরি খাইনি। কিস করো। তুমি নিজে মদ খেয়েছ তাই তোমার নাকে—
তাই আমার নাকে গন্ধ লেগেছে? বলে ভজন তাকে টেনে গিয়ে গেল গোলক চাটুজ্যের কাছে। বল, ঠাকুরদার পায়ে হাত দিয়ে বল, কিছু খাসনি।
বিশে খুন করতে পারে, কিন্তু বামুনের পায়ে হাত দিয়ে মিছে কথা বলে জ্যান্ত নরকযন্ত্রণা ভোগ করতে পারবে না। থমকে দাঁড়িয়ে একটা ভীত নেড়িকুকুরের মতো চোখ পিটপিট করতে করতে জিভ দিয়ে ঠোঁট চাটতে লাগল সে। কুঁইকুই শব্দের মতো তার গলায় খালি শোনা গেল, এটুল চকের টুকরো—মাইরি…।
গোলক চাটুজ্যে তার আপিমের নেশায়-বোজা চোখ তুলে বললেন, এটা ওকে ছেড়ে দাও দাদা। ফের চুরি করে খেলে রাক্ষসটাকে তাড়িয়ে দিয়ে।
তুমি তাই বলছ দাদু?
হ্যাঁ দাদা।
যা ব্যাটা, বামুনের কথা আর ঠেললুম না। বলে সকলের দিকে তাকিয়ে বলল, মাতাল হতে পারি, তা বলে এ শর্মাকে ফাঁকি দিতে এখনও আর এক জম্মো ঘুরে আসতে হবে। বেটা রোজ চুরি করে খাবে, এও কি আমার ছিরিমোতি কাফের কপাল?
চাটুজ্যে বললেন, তবে শোনো বলি এক খাইয়ের গল্প।
কয়েকজন তাড়াতাড়ি বাধা দিয়ে বলল, মাছের গল্পটা তো শেষ হয়নি।
হয়নি? হুঁকো মুখে চাটুজ্যে খলখল করে হেসে উঠলেন। চোখ বুজে বললেন, সে মাছ বুঝি এখনও খেলছে? ভুলে যাই। সাঁজবেলায় মৌতাত কি না।
অমনি এক কাপ চায়ের অর্ডার হয়ে যায় তাঁর জন্য। হুঁকো নিভে গেলেও চায়ের কথা শুনে উৎসাহের ধোঁয়া আপনি ছাড়তে আরম্ভ করেন চাটুজ্জে, তা পরে, মাছ তো সেই খেলতে লেগেছে, খেলতেই লেগেছে। কী রে বাবা! এ যে যশোদার নন্দদুলালের চেয়েও এক কাঠি সরেস, খেলা আর থামে না। সন্ধে হয়ে গেল, রাত হল, অন্ধকার নেমে এল, জোনাকি পিটপিট করতে লাগল চারদিকে, ঝিঝি ডাকতে লাগল। ঘেমে জল হলুম। মাছ আর ওঠে না। পরে…। তপ্ত চায়ের কাপে একটা চুমুক দিয়ে মুহূর্ত চুপ থেকে হঠাৎ বললেন, মাছ যখন উঠল, হেঁ হেঁ কী বলব ভায়া পুকুরে একফোঁটা জল নেই।
হাসির হর্রা পড়ে গেল। সত্যি মিথ্যে যাচাইয়ের কোনও প্রশ্ন নেই এখানে। শ্রোতাদের কাছে এটুকু পড়ে পাওয়া যোলো আনা।
এ-দিকে যাদের মন নেই তারা হল হীরেন আর কৃপাল। আর একজন জুটেছে, নাম তার ললিত মুখুজ্যে। সে একজন ঘোরর মুসলিম বিদ্বেষী। কংগ্রেসের প্রতি তার কোনও সমর্থন নেই। তবু নিজের যুক্তিগুলোকে শানাবার জন্য ঘোরে সে এদেরই পেছনে পেছনে।
হীরেন আর কৃপালের আলোচনার বিষয়বস্তু হল, সাম্প্রতিক অবস্থা। দুবছর মদের দোকানে পিকেটিং-এর ফল অত্যন্ত গুরুতর হয়েছিল। শুধু পুলিশ নয়, শ্রমিকরাও পর্যন্ত তাদের লাঠি নিয়ে তাড়া করেছে। হীরেনের কপালে লাঠি পড়েছিল একটা বুড়ো ধাঙড়ের। সে প্রায় পনেরোদিন কুঁচুড়ার হাসপাতালে ছিল। হাসপাতাল ফেরত ব্যাণ্ডেজ বাঁধা অবস্থায় তাকে কৃপাল সভামঞ্চে নিয়ে যেতে চেয়েছিল, হীরেন যায়নি। গৌরববোধ দুরের কথা, তার রীতিমতো লজ্জা করেছিল।
মদের দোকানে পিকেটিং-এর কথা সেইজন্য চাপা ছিল। হীরেন সম্পূর্ণভাবে আত্মনিয়োগ করেছে। হরিজন সেবায়। তাদের আজকের আলোচনার বিষয় হল মিউনিসিপ্যাল নির্বাচন।
কৃপাল বলল এক টিপ নস্যি নিয়ে, ভোট তো তোমার হরিজনেরা দেবে না, দেবে ভদ্রলোকেরা। দেশবন্ধুর ফাইভ বিগ গাস বলে তুমি ঠোঁট ওলটালে কী হবে, প্রধান রায়কে আনিয়ে বক্তৃতা দেওয়াতে তোমার আপত্তি কী?
হীরেনের চোখে মুখে একটা শান্ত বুদ্ধিমত্তার ছাপ। সে তুলনায় কৃপালকে মনে হয় খানিকটা আমুদে ও অবাচীন। যেন তার প্রতিটি মুহূর্ত ফুর্তির হাওয়ায় ঠাসা। তার কথায় কোনও গাম্ভীর্য বা তীব্রতা নেই, আছে উত্তেজনা, উচ্ছ্বাস ও গলার জোর।
হীরেন বলল নাক কুঁচকে, প্রধান রায়ের কথা আসছে কী করতে, আমি বুঝি না। তোমার ওই সারদা চৌধুরীকে দাঁড় করানোর ব্যাপারেই আমার আপত্তি আছে। লোকটা যদি কংগ্রেসের সভ্যও হত, তবু না হয় কথা ছিল। ব্রিটিশ সরকারের পা-চাটা সে চিরকাল। তাকে তুমি
কৃপাল মনে মনে গরম হয়ে উঠল। বলল, তোমার সারাম ঘোষই বা কী একেবারে সাধুপুরুষ। সারদাবাবুর সম্পর্কে তো আমাদের কমিটিরও মত আছে। আপত্তি খালি তোমারই। কী হয়েছে, না, নসীরাম ধার্মিক। ধম্মে ধম্মে করেই তুমি গেলে। কংগ্রেসের সভ্য তো সেও নয়।
হীরেন বলল, তা হলে আমার কথা বলাই বৃথা। কমিটি যখন মতামত দিয়েছে কিন্তু নসীরামও দাঁড়াবেন। আমরা সমর্থন করি বা না করি, উনি একলাই সব করবেন বলছেন।
মাঝখান থেকে ললিত তড়বড় করে চেঁচিয়ে উঠল, বিজয় বাঁড়ুজ্যে ইজ দি ফিটেস্ট ম্যান আমি বলছি। এই সারা জেলায় যদি কোনও খাঁটি হিন্দু থেকে থাকে, হিন্দুর সম্মান যদি কেউ রাখতে পারে, তবে বিজয় ব্যানার্জি। আমি তোমাদের কাছে অ্যাপিল করছি যে—
কৃপাল প্রাণপণে চেঁচিয়ে উঠল, ভোট ফর–সারদা চৌধুরী।
অমনি একটা হট্টগোল পড়ে গেল। শ্রীমতী কাফের সবাই আগামী মিউনিসিপাল নির্বাচনের আলোচনায় মেতে উঠল নিজেদের মধ্যে। দেখা গেল, তিনজন প্রার্থী সম্পর্কে অদ্ভুত সব কেলেঙ্কারীজনক ফিরিস্তি দিতে আরম্ভ করেছে সবাই। অর্থাৎ ঠগ বাছতে গাঁ উজাড় গোছের ব্যাপার।
ওদিকে ভজন নেমে গিয়েছে রাস্তায়। একটা ঘোড়ার গাড়ির কাছে গিয়ে চেঁচাতে আরম্ভ করেছে, অ্যাই ঘেয়ো পঙ্খীরাজের বাবা, নেবে আয়। নেবে আয় বলছি।
পঙ্খীরাজের বাবা অর্থাৎ ভুনু গাড়োয়ান। ভুনুকে এ অঞ্চলের গাড়োয়ানদের সর্দার বলা যায়। সন্ধ্যার ঝোঁকেই ভাঁড়খানেক তাড়ি গিলে সে তখন থেকে চেঁচাচ্ছে কিন্তু এ পর্যন্ত একজন আরোহীও তার জোটেনি। অন্যান্য গাড়িগুলো ইতিমধ্যে দু-একবার সোয়ারি নিয়ে যাতায়াত করেছে, আরোহীরা ভুনুর অবস্থা দেখে আর কাছে এগোয়নি। মাতাল গাড়োয়ানের গাড়িতে উঠে প্রাণটা আর দিতে ইচ্ছে করে কার।
ভুনু এলিয়ে পড়েছিল, গাড়ির ভেতরে আসনের উপর। ভজনের ডাক শুনে সে নেমে এল তার বিশাল শরীরটা নিয়ে। তাড়ির নেশায় তার মুখটা বিস্ফারিত হয়ে উঠেছে। চোখ দুটো লাল। বলল, পঙ্খীরাজ মতো কহো লাটবাবু, এ আমার রাজারানী আছে।
রাজারানী! ভজন হা হা করে হেসে উঠল। তার মত্ত হাসিতে রাস্তার লোক জুটে গেল সেখানটায়। অন্যান্য গাড়ির গাড়োয়ানেরা এসে ভিড় করল মজা দেখবার জন্য।
ভজন সবাইকে ঘোড়া দুটোকে দেখিয়ে বলল, ঘেয়োনি নয় চুলকোনি নয়, এই যে রাজারানী।
বাই হেসে উঠল। ঘেয়ো মরদা ঘোড়াটার গায়ের চামড়া কেঁপে কেঁপে উঠল। রাতেও কয়েকটা মাছি কামড়ে পড়ে রয়েছে তার গায়ে। মাদি ঘোড়াটা চোখ পাখিয়ে কান খাড়া করে ল্যাজের ঝাপটা দিল কয়েকবার। বোধ হয় রাজারানীর নাম শুনে তারা সচকিত হয়ে উঠেছে।
ভুনু তার মত্ত ক্রুদ্ধ চোখে একবার তাকাল শ্রীমতী কাফের দিকে কিন্তু সেটাকে গালাগাল দেওয়ার হঠাৎ কোনও ভাষা খুঁজে পেল না সে।
ভজন দুই হাত জোড় করে বলল, কোন্ মুলুকের রাজারানী বাবা! আরবের না অস্ট্রেলিয়ার?
ভুনু নিরুত্তরে গাড়ির উপরে গিয়ে বসল। ভজন এখানে আসা অবধি প্রায় রোজই তার পেছনে একবার করে লাগে। আবার সময়তে ডেকে নিয়ে খাওয়ায়ও। লোকটাকে ভুনু ভাল বোঝে না। কিন্তু তার রাজারানীর উপর বিদ্রূপ কটাক্ষ সে সহ্য করতে পারে না। লাটবাবুকে ডেকে কোনওদিন সে তার গাড়িতে ওঠাতে পারেনি। তার মনের সবচেয়ে দুর্বল স্থানটিতে ভজন পা দিয়ে থেতলে কথা বলে। আর তাও কি না এতগুলো লোকের সামনে। তারই সামনে দাঁত বের করে হাসছে অন্যান্য কোচোয়ানেরা। আজকের ব্যাপারটা তার কাছে এতই হৃদয়হীন মনে হল যে, সে একটা কথা পর্যন্ত বলতে পারল না। লাগাম হাতে দিয়ে সে খালি চিবিয়ে চিবিয়ে বলল, লাটবাবু, ওই বাহার ভড়ংওয়ালা ঘরটা তোমাকে খিলায়, আর এই ঘোড়া আমাকে খিলায়। এ আমার রাজারানীর বাড়া, বুঝেছ? বলে সে লাগামে এক হ্যাঁচকা টান দিতেই ঘোড়া দুটো মুখে মুখ ঠেকিয়ে রাস্তায় উঠে এল। তারপর চাবুকের শিস্ শুনে আচমকা ছুটতে আরম্ভ করল।
সবাই হেসে উঠল, কিন্তু ভজন আর হাসল না। সে ডাকল, ভুনু, ফিরে আয়। শুনে যা।
ভুনু শুনতে পেল সে ডাক। সত্যি, ওই গলার স্বর যেন তার মনটাকে কেমন একরকম করে বেঁধেছে। লাটবাবু তাকে ঘৃণা করে না, এটা সে বিশ্বাস করে। তবু সে ফিরল না। কেবল তার গাড়ির চাকা ও ঘোড়ার পায়ের শব্দ ভেসে এল পেছন থেকে।
ভজন হঠাৎ ধমকে উঠল, ব্যাটারা দাঁত বার করে হাসছে, হটাও সব।
সবাই সরে পড়ল এ-দিকে ও-দিকে। ভজন ফিরে এল তার ঘরে। শ্রীমতী কাফেতে। ভুনুর বাহার ভড়ং কথাটা বারবার তার কানের মধ্যে বাজতে লাগল যে বহু মানুষের বিদ্রূপাত্মক হাসির মতো। একি শুধু বাইরের ভড়ং। শ্রীমতী কাফের কি আর কিছুই নেই।
রাত্রি বাড়তে আরম্ভ করেছে। খালি হয়ে গিয়েছে শ্রীমতী কাফে। রয়েছে শুধু হীরেন আর কৃপাল। রাস্তা ফাঁকা হয়ে যাচ্ছে। বাইরের ধোঁয়াটে ভাবটা অনেকখানি পরিষ্কার হয়ে এসেছে। ধুলো আর ধোঁয়ার ছড়াছড়ি এখন নেই সন্ধ্যাকালের মতো। পূর্ব উত্তর ঘেঁষা একটা হাওয়া বইছে। ঠা আর জলো হওয়া।
আকাশে হেমন্তের পাতলা কুয়াশা। মেঘ করেছে আকাশে। ম্লান মুখগুলো দেখা যাচ্ছে শুধু বড় বড় তারার।
কৃপাল বলল হীরেনকে, তা হলে তুমি কাল যাবে কলকাতায়?
হীরেন চমকে উঠল। সে যেন কীসের ভাবে সর্বদাই তন্ময়। বলল, হ্যাঁ যাব। আগামী সপ্তাহে প্রফুল্ল থোষ আসবেন এখানে। সভাঁটা প্রধানত অস্পৃশ্য বিরোধিতার উপরেই হবে।
কৃপাল বলল, সে জানি। কিন্তু তোমার কী হয়েছে বলে তো। বাড়িতে কোনও গণ্ডগোল হয়েছে নাকি?
হীরেন বলল, না তো? তারপর একটু চুপ করে থেকে হঠাৎ অত্যন্ত গম্ভীর গলায় সে বলতে আরম্ভ করল, সম্প্রতি তুমি দেশের কথাটা ভেবে দেখেছ! অশ্য আমি বিশ্বাস করি গান্ধীজি নিশ্চয়ই এ অচল অবস্থা দূর করবেন। কিন্তু আমরা তাঁর আদর্শ থেকেও অনেক সরে যাচ্ছি। টেররিস্টদের কথা বাদ দাও, তারা শিগগিরই ঠাণ্ডা হয়ে যাবে। কিন্তু, নবীন গাঙ্গুলী নাকি রুশ বিপ্লবের কথা বলতে আরম্ভ করেছে, টেররিজম সে সুবিধে করতে পারল না।
কৃপাল বলল, তা যদি বলল, তবে জহরলালও তো বিলেত থেকে ফিরে এসে রুশ বিপ্লবের কথা বলছেন।
হীরেন এক মুহূর্ত দ্বিধা করে জবাব দিল, কিন্তু তিনি কমিউনিস্ট পার্টি বলে একটা আলাদা সংগঠন করার কথা বলেননি। ওয়ার্কস অ্যান্ড পেজেন্ট পার্টি কি তুমি বলতে চাও এ দেশের মাটিতে কিছু করতে পারবে? এ দেশকে যারা বোঝেনি তারাই বিদেশিদের আন্দোলনের অনুকরণ করতে চাইছে। গান্ধীজির আদর্শকে এরা কেউ বোঝেনি। আমরা নিজেরাই তার জন্য দায়ী। আমরা আমাদের সততাকে বজায় রাখতে পারিনি কৃপাল। ভেবে দেখো, দুহাজার গজ সুতো না কেটেও আমাদের অনেক মহারথী কমিটির সভ্য হওয়ার সুযোগ নিয়েছে।
এবার কৃপালের আঁতে ঘা লাগল। কয়েক বছর আগে গান্ধীজি কংগ্রেসকে এরকম একটা নির্দেশ দিয়েছেন যে, মামে দু হাজার গজ সুলত না কাটলে কেউ কমিটিতে যেতে পারবে না। কৃপাল এভাবে আর যোগ্যতা যাচাই করতে পারেনি। সে কমিটির সভ্য হয়েছে মহকুমা কংগ্রেসের মাসে দুহাজার গজ সুতো না কেটেও। তা বলে কি সে কোনও কাজই করেনি! তার কি কোনও যোগ্যতাই ছিল না।
সে বিকৃত মুখে তীব্র গলায় বলে উঠল, এরকম প্যাঁচ কষছ কেন বল তো? তোমার মতলবটা কী?
হীরেন তাড়াতাড়ি কৃপালের হাত ধরে বলল, ছি ছি ছি, আমি তোমাকে কিছু বলিনি। আমি বলছি, আমরা গান্ধীজির আদর্শ কেউ অনুসরণ করতে পারিনি। আমরা তাঁর নির্দেশ মতো গণ আন্দোলন গড়ে তুলতে পারছি না। সাইমন কমিশনের ইতরোমি দেখে গান্ধীজি সাম্রাজ্যবাদীকে আর একবছর মাত্র সময় দিয়েছেন, তার পরেই পূর্ণ স্বাধীনতার আন্দোলনে আমরা ঝাঁপ দিতে যাচ্ছি। এই একবছরের মধ্যে আমাদের তৈরি হতে হবে। অহিংসার পথে আমাদের সমস্ত দমননীতির বিরুদ্ধে দাঁড়াবার জন্য প্রস্তুত থাকতে হবে। কৃপাল, তুমি জানো, আমি-ওভায়রুদের কাছেও যাই। তাদের অশিক্ষা ও অস্পৃশ্যতার অভিশাপ মোচনের জন্য…
থাম্ মাইরি থাম। ভজন হঠাৎ দুহাত তুলে, আধবোজা চোখ মেলে জড়ানো গলায় বলল, একটা কথা তোরা আমাকে বলতে পারিস?
একটু সঙ্কুচিত হয়ে হীরেন কলল, বল!
তোদের খাওয়া আসে কোত্থেকে বলতে পারিস। তোদের পিণ্ডি গিলতে দেয় কে, বল। বলে যা। বলতে বলতে সে উঠে দাঁড়াল। কৃপাল আয় হয়েন মুখ চাওয়াচায়ি করে উঠে দাঁড়াল।
কৃপাল বলল, আবার আমাদের পেছনে কেন বাবা। রাত হয়েছে, এবার আমরা যাচ্ছি।
তাই এসো বাবা। যাবার আগে চারটে পয়সা দিয়ে যাও। অনেকবার তো গিলেছ চা।
হীরেন তাড়াতাড়ি পকেট থেকে পয়সা বার করে দিল। এ ব্যাপারে রাগের কোনও প্রশ্নই ছিল না। কেননা, ভজনকে তারা চিনত। কিন্তু তার মুখের চিন্তাচ্ছন্ন ভাবটা কাটল না। ছোট একটা থলের মধ্যে তার তুলল আর তলি, খান দুয়েক প্রাচীন সংস্কৃত ও পালি ভাষার বই বগলে নিয়ে সে রাস্তায় এসে দাঁড়াল। কৃপাল চলে গেল। হীরেন তখনও রাস্তায় দাঁড়িয়ে রইল।
রাত নিঝুম। রাস্তা খালি। দূরে দূরে জ্বলছে কেরোসিনের টিমটিমে বাতি। বড় বড় গাছগুলো দাঁড়িয়ে আছে বোবা নিশ্চল নিশাচরের মতো। রাত একটু বেশি হয়েছে। পুলিশের চোখে পড়লে আবার কৈফিয়ত দেওয়ার জন্য হয় তো থানায় যেতে হবে। তা ছাড়া, গুপ্তচর ওত পেতে আছে কয়েকদিন, শ্রীমতী কাফের পেছনে আত্মগোপনকারী ওই ছেলেটার জন্য। কী নাম তার? সুরজ সিং। তার সঙ্গে কথা বলেছে হীরেন। আশ্চর্য ছেলেটার কী অদ্ভুত ধারণা। কখনও বলছে, হ্যাঁ, গীতায় আমার বিশ্বাস আছে, নরনারায়ণই আমার পথদ্রষ্টা। আবার বলছে, রুশ রেভলিউশনের মতো আমরাও শ্রমিক আন্দোলন করব। বলে, মীরাট কন্সপিরেসি সাকসেস হলে স্বাধীনতা পাওয়া যেত। বলে মুজঃফর আমেদ, ডাঙ্গে…
না! সে পথে নয়। চড়ার বুকে এসে গঙ্গার বান বেশি লাফালাফি করে। আমাকে যেতে হবে আরও তলায়, সেই যুগ যুগান্তরে হারিয়ে যাওয়া ভারতের আত্মার সন্ধানে। যেখানে অস্পৃশ্যতা নেই, অশিক্ষা নেই, যেখানে করুণাময় আমাদের সকলের হৃদয়ে সমানভাবে অধিষ্ঠিত। সেই হবে আমাদের নবভারতের জয়যাত্রা। সে নিশি পাওয়া স্বপ্নাচ্ছন্নের মতো অন্ধকারে পথ চলতে আরম্ভ করল।
ভজন ড্রয়ার খুলে সমস্ত পয়সা পকেটে নিয়ে হঠাৎ হেসে উঠল। হাসি পেল তার হীরেনের পয়সা চারটের জন্য। বলল, ব্যাটা আমার পরে রাগ করেছে বোধ হয়।
ডাকল, বিশে।
বিশে এল। তেমনি সন্ত্রস্ত, সঙ্কুচিত। শরীরটা এমন শক্ত যে দেখলে মনে হয় যেন মার খাওয়ার ভয়ে বেঁকে আছে সবসময়।
আর কিছু খেয়েছিস?
সরু গলায় তাড়াতাড়ি বললে বিশে, না, মাইরি বলছি না।
মাইরি বলাটা তার অভ্যাস। অভ্যাসটা পাত্রপাত্র মানে না। আপনি বেরিয়ে আসে মুখ দিয়ে। ভজন পকেট থেকে চারটে পয়সা বের করে তাকে দিয়ে বলল, নে ব্যাটা চারটে পয়সা। ও আমার হজম হবে না। তোর তো গরহজমের বালাই নেই।
বিশে প্রথমটা ভয়ে ভয়ে হাতটা মুঠো করতে পারল না। যেন বিষ দিয়েছে কেউ তার হাতের চেটোয়। তারপর হঠাৎ হি হি করে হেসে বলল, খাবার জন্য দিলে ঠাকুর? ময়রায় দোকান যে অ্যাকোন বন্ধ হয়ে গ্যাচে।
সে-কথার কোনও জবাব দিল না ভজন। বাড়ির কথা ভাবছে সে। যুঁই এখানে নেই। কিছুদিন হল সে বাপের বাড়ি গিয়েছে তার তৃতীয় সন্তানের জন্ম দিতে। তার বিবাহিত জীবনের আজ সাত বছর, ইতিমধ্যেই তৃতীয় সন্তানের জন্ম দিতে চলেছে যুঁই।
যুঁই। হয়তো এখন ঘুমোচ্ছ। না, ঘুমোচ্ছে না, ওর বাপের বাড়ির সেই দোতলার দক্ষিণ সীমান্তের ঘরটায় খাটের উপর কাত হয়ে শুয়ে আছে হয়তো। চোখ মেলে তাকিয়ে আছে বাগানের অন্ধকারে। হয় তো কষ্ট হচ্ছে, ঘুম নেই চোখে। চোখের কোল বসে গিয়েছে, এলিয়ে পড়েছে হাত পা। অসহ্য ক্লান্তি তার। হয় তো গৌর নিতাই তার দুই ছেলে ঘুমোচ্ছে কোলের কাছে পড়ে। আর যুঁই ভাবছে। থেমে গেল ভজনের মন। ভাবল, না, আমার কথা ভাববে না যুঁই, ভাবছে তার অভিশপ্ত জীবনের কথা। তার জীবনের বঞ্চনা আর লাঞ্চনার কথা। তার বুদ্ধি ছিল, হৃদয় ছিল, সর্বোপরি তার যৌবন আজও আছে। সমস্তটাই ব্যর্থ হয়েছে তার আর একটা ব্যর্থ মানুষের হাতে পড়ে।
অ্যালকোহলের মত্ততা ঝিমিয়ে আসছে ভজনের। হু করে একটা নিশ্বাস পড়ল। ব্যর্থ। নিজের সঙ্গে তার বোঝাপড়া কোনও দিনই হল না। কিন্তু যুঁই হয় তো কিছু চেয়েছিল। গ্র্যাজুয়েট স্বামী পেয়েছিল সে, নিজের তার কিছু শিক্ষা ছিল। কিন্তু আজ। নিঃশব্দে, বিনা প্রেিদ সে আত্মদান করেছে একটা মাতালের কাছে। অপমান, ঘৃণায়, অভিশাপে জ্বলে উঠেছে তার বুকের মধ্যে!
ধ্বক করে উঠল ভজনের প্রাণটা। সে অভিশাপ বুঝি সারা জীবন পুড়িয়ে মারবে তাকে। যুঁইয়ের সেই অপলক চাউনি, নীরবতা আর ক্লান্তি। প্রতিবেশিনী বউদের সঙ্গে কোথাও তার পার্থক্য নেই। সকলের মতো সেও অসুখী, সংসার রঙ্গমঞ্চে বধূবেশে সেও অভিনয় করে চলেছে। প্রেয়সী আর মায়ের ভূমিকায় নিখুঁত অভিনয়। তার চেয়ে যুঁই কি তাকে ছেড়ে যেতে পারে না!
অমনি তার বুকের মধ্যে কে যেন চিৎকার করে উঠল, না না, পারে না। এ হয় তো ভালবাসা নয়, তবু এ ব্যর্থ জীবনে সে নিষ্কৃতি দিতে পারবে না যুঁইকে। নিরত অষ্টপ্রহর তার যুঁইকে চাই। এ যে তার মনের ও দেহের স্বভাব।
টেবিলের উপর হাতাতে হাতাতে ভজন বলে উঠল,
এ
ফুল ফোটার হল না অবকাশ
কুঁড়ির ঝরে ব্যর্থ দীর্ঘশ্বাস।
চমকে উঠল ভজন। মনে হল কে যেন তার নাম ধরে ডাকছে। কিন্তু কেউ না। হাসল ভজন। ভাবল, কে ডাকবে। দাদা তো জেলে। কদিন গিয়ে দেখে এসেছে সে আলিপুরে। বাবা হয় তো এখনও পাথরের মূর্তির মতো বাইরের বারান্দায় আরাম কেদারায় চুপ করে বসে আছেন। যেন সারাদিনই দুঃস্বপ্ন দেখেন। যেন খনার কাহিনীর সেই জিহীন মিহিবের মতো তিনি নিঃশব্দ, এক জোড়া চোখে শুধু দেখেন সব। আর বকুলমা। এতক্ষণ হয় তো চলে গিয়েছেন ভজনের ভাত বেড়ে রেখে। যুঁইয়ের চলে যাবার পর থেকে আবার আসতে হয়েছে। আশ্চর্য পরিবর্তন বকুল মায়ের! তাঁর সে গাম্ভীর্য আজকাল আর নেই। তার সশব্দ হাসির তীব্র ঝঙ্কার যেন মানুষের বুকে বেঁধে। তার সঙ্গে পোশাকেও পরিবর্তন হয়েছে। সাজতে যে তিনি এত ভালবাসতেন, তা কে জানত। কথায় কথায় তিনি গান গেয়ে ওঠেন। কেবল মাঝে মাঝে দেখা যায়, হালদারের কাছে বসে বসে, এক নাগাড়ে টানা সুরের মতো তিনি ভজনের মায়ের কথা বলে যান। তাঁর সইয়ের কথা। তাদের যৌবনের কথা।
তাল নেই, লয় নেই এ জগতের। ভজন হাতের ঝাপটায় মনের ভাবনাকে ঝরিয়ে দিতে চাইল। টলতে টলতে পেছনের ঘরে গিয়ে বেঞ্চির তলা থেকে বার করল বোতল। শুন্য সব কটাই, কেবল একটাতে একটুখানি আছে। সেটুকু গলায় ঢেলে দিল সে।
সুরজ সিং বলল, শুনহেন।
অর্থাৎ শুনুন। বাংলা বলতে শিখেছে সে। বয়সের চেয়েও মুখটা তার কাঁচা মনে হয়। মনে হয় কিশোর বালক।
ভজন ঘাড় কাত করে বলল, বলহেন।
একটু অপ্রস্তুত হল সুরজ। বলল, হামার মিল চার্জটা–
তার হাতে কয়েকটা টাকা চকচকিয়ে উঠল। ভজন ভ্রূ কুঁচকে একবার টাকা কটা দেখে বলল, কোথা পেলে!
সুনির্মল দিয়েছে।
সুনির্মল। হেসে উঠল ভজন। ও তো বাপের পয়সা চুরি করে দিয়েছে। ওটা কাউকে দিয়ে দিয়ো। আর তোমার মিল চার্জটা আমার ব্যয়ের অঙ্কে লেখা থাকবে। সাহেব মারা দলের কাছ থেকে শ্রীমতী কাফে পয়সা নেয় না।
সুরজ সব কথা না বুঝে একটা বোকা বনে দাঁড়িয়ে রইল। ফিরে যেতে যেতে ভজন আবার বলল, চলি, সূর্যি, এবার চাঁদ হয়ে রাত জাগো। চারিদিকে বড় বিছে আরশোলার ভিড়। বুঝেছ? একটু সাবধানে থেকো।
তারপর বিশেকে বলল, বিশে, খোকাবাবুকে খেতে দে।