কলাকৌশল
ইতিপূর্বে মার্কসীয় দৃষ্টিকোণ থেকে অনেকে ফ্রয়েডবাদের সমালোচনায় প্রয়াসী হয়েছেন। এইসব সমালোচনা—প্রয়াসের মধ্যে কতকগুলি ব্যর্থ হয়েছে। যেগুলি ব্যর্থ হয়েছে সেগুলি প্রধানত দুরকমের। এই হলো, ফ্রয়েডবাদের সঙ্গে সম্যক পরিচয়ের অভাবটা সমালোচকেরা অন্ধ আবেগ-উত্তেজনা দিয়ে ভরাবার চেষ্টা করেছেন। ফলে, শেষ পর্যন্ত সমালোচকদের মার্কসীয় দৃষ্টিকোণ ব্যাহত হয়েছে, কেননা মার্কসবাদ অন্ধ আবেগ-উত্তেজনার সঙ্গে আপস করতে নারাজ। আবার অপর পক্ষে, কোনো কোনো সমালোচকের মনে ফ্রয়েডবাদের প্রতি মোহপ্রবণতা এমনই প্রবল যে তাঁদের সমালোচনা-প্রচেষ্টা শেষ পর্যন্ত ফ্রয়েডবাদের মধ্যে মার্কসীয় দর্শনের কয়েকটি মূলসূত্র আবিষ্কারের চেষ্টায় পর্যবসিত। (৮) যেন মেহনতকারী জনতার সভায় মার্কস্বাদের মুকুট পরিয়ে ফ্রয়েডবাদের নব্য অভিষেক! শেষ পর্যন্ত উভয় ভ্রান্তিই প্রতিক্রিয়ার সহায়ক: ফ্রয়েডপন্থী প্রথম ভ্রান্তির নমুনা তুলে মার্কসীয় সমালোচনা-মাত্রকেই হেয় প্রতিপন্ন করবার সুযোগ পান, দ্বিতীয় ভ্রান্তির দিকে চেয়ে সুনিশ্চিত সাহস পেতে পারেন। অবশ্য বলাই বাহুল্য, মারাত্মক ফলাফলের দিক থেকে দ্বিতীয় ভ্রান্তিটি সম্বন্ধে আজকের দিনে অনেক বেশি সজাগ থাকা দরকার। কেননা, আজ মার্কিন দেশের শাসক-মহল থেকে সাম্রাজ্যবাদের সমর্থন-প্রয়াসে ফ্রয়েডবাদ প্রচার করবার বহু আয়োজন, তার উপর আজ যদি কোনো কোনো সমালোচক প্রমাণ করতে চান যে ফ্রয়েড নিজে পাকাপোক্ত ডায়ালেটিক্যাল মেটিরিয়ালিস্ট-ই ছিলেন তাহলে সংগ্রামী জনতার মনে বিভ্ৰান্তি সৃষ্টি করে সাম্রাজ্যবাদের ওই প্রচার-প্রচেষ্টাকেই জোরদার সাহায্য করা হবে।
মনে রাখা দরকার, ফ্রয়েড মাত্র এক-আধখানা বই লেখেননি, অজস্র বই লিখেছেন এবং অতো অজস্র লেখার মধ্যে থেকে খণ্ড, বিক্ষিপ্ত উদ্ধৃতি সংগ্রহ করে তাঁকে প্রায় যে-কোনো রকম মতাবলম্বী বলেই প্রমাণ করে দেবার ফাঁক থেকে গিয়েছে। তাই মার্কসীয় দৃষ্টিকোণ থেকে ফ্রয়েডবাদের সমালোচনা করবার সময় অগ্রসর হতে হবে এতো অজস্র রচনার মধ্যে থেকে ফ্রয়েডবাদের মূল প্রতিপাদ্য বেছে নিয়ে। ফ্রয়েডবাদের মার্কসীয় সমালোচনার মধ্যে যেগুলি সত্যিই সার্থক সেগুলির পিছনে এই প্রচেষ্টাই। (৯) কিন্তু এখানেও একটা অসুবিধের দিক আছে। ফ্রয়েডের মূল কথা নিয়ে আলোচনা করবার সময় সাধারণত ঝোঁকটা পড়ে ফ্রয়েডের সিদ্ধান্তগুলিকে যাচাই করবার দিকে। অর্থাৎ ফ্রয়েডীয় কলাকৌশলকে মার্কস্বাদের দিক থেকে সম্যকভাবে বিচার করবার উপর ঝোঁকটা তেমন পড়ে না। অবশ্যই এ-বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই যে ফ্রয়েডের সিদ্ধান্তগুলিকে যাচাই করাটা সমালোচকের একটি প্রধান দায়িত্ব হবে! কিন্তু ঝোঁকটা যদি শুধুই এই দিকে থাকে, অর্থাৎ ফ্রয়েডীয় কলাকৌশলকে উপযুক্তভাবে বিচার না করে যদি শুধু তাঁর সিদ্ধান্তগুলিকেই বিচার করবার উৎসাহে সমালোচনা করা হয়, তাহলে সে-সমালোচনা পূর্ণাঙ্গ মার্কপন্থী হতে পারে না। তাছাড়া ফ্রয়েডপন্থীর দিক থেকে এই সমালোচনাকে তুচ্ছ করবার অজুহাতও থেকে যায়। পুর্ণাঙ্গ মার্কসবাদী সমালোচনা হতে পারে না, কেননা মার্কসবাদ প্রয়োগ-মতবাদের অঙ্গাঙ্গী সম্পর্কে আস্থাবান। তাই প্রয়োগের দিকটুকু বাদ দিয়ে, শুধু মতবাদের উপর নজর রেখে যে-সমালোচনা তা মার্কপন্থী হবে কেমন করে? ফলে ফ্রয়েডবাদের সমালোচনা-প্রসঙ্গে শুধুই ফ্রয়েডীয় থিয়োরীর আলোচনা পর্যাপ্ত নয়, সেই সঙ্গেই ফ্রয়েডীয় প্রাটিসের আলোচনাও হওয়া দরকার। অর্থাৎ সমালোচনা হওয়া দরকার ফ্রয়েডীয় কলাকৌশলেরও। তাছাড়া মার্কসবাদ বিচ্যুতির সম্ভাবনা ছাড়াও, কলাকৌশলের উপর উপযুক্ত ঝোঁক বাদ দিয়ে ফ্রয়েডবাদের সমালোচনা-প্রচেষ্টায় একটা মস্ত বড়ো ফাঁক থেকে যায়। কেননা ফ্রয়েড নিজে বার বার জোর দিয়ে বলছেন, কলাকৌশলটাই তাঁর আসল কথা, সাইকোএ্যানালিসিস্ বলতে প্রধানত ওই কলাকৌশলই বোঝা উচিত—যদিও প্রায় একটা নিয়তির দরুনই সাইকোএ্যানালিসিস্ বলতে শেষ পর্যন্ত হয়ে দাঁড়িয়েছে একটা পুরোপুরি মতবাদ। (১০) আর আজকের দিনে ফ্রয়েডপন্থীরা বলছেন, তাঁদের সকলের সঙ্গে সকলের মতের মিল নেই, অনেক বিষয়েই পরস্পরের মধ্যে বিরোধ। সাইকোএ্যানালিসিস্ বলতে তাই কোনো নির্দিষ্ট সিদ্ধান্তকে না বুঝিয়ে বরং ফ্রয়েডীয় কলাকৌশলটুকুকেই বোঝা উচিত; কলাকৌশলকে সম্যকভাবে বিচার না করে ফ্রয়েডবাদের সমালোচনা করলে তা পাঠকসাধারণের কাছেও শেষ পর্যন্ত এক রকম হেঁয়ালি হয়ে থাকবার ভয়। কেননা, ফ্রয়েডপন্থীদের প্রচার-প্রচেষ্টাতেই সাধারণের ধারণায় ফ্রয়েডের এই কলাকৌশল সম্বন্ধে একটা রহস্য সৃষ্টি করবার দিকে ঝোঁক আছে-সমস্ত ব্যাপারটাই তো ঘটে বন্ধ ঘরের মধ্যে, সাধারণের চোখের আড়ালে। আর শোনা যায়, সাইকোএ্যানালিস্ট কোনো এক আশ্চর্য কৌশলে ওই বন্ধ ঘরটির মধ্যে মানুষের মনের গোপন-গভীর রহস্য উদ্ঘাটন করতে পারেন। তাছাড়া, চিকিৎসা-বিজ্ঞানের সাক্ষ্য তো সত্যিই উড়িয়ে দেওয়া চলে না। তাই আপনার বিচার-বিশ্লেষণে ফ্রয়েডবাদ প্রগতি-মূলকই হোক আর প্রতিক্রিয়া-মূলকই হোক পাঠক-সাধারণ নিশ্চয়ই প্রশ্ন তুলবেন : ফ্রয়েডীয় পদ্ধতির প্রয়োগে রোগী সত্যিই মনোবিকারের লক্ষণ থেকে মুক্তি পায় কিনা? যদি সত্যিই পায় এবং মার্কস্বাদ যদি সত্যিই বিজ্ঞান হয়, তাহলে মার্কসবাদের তরফ থেকে সাইকোএ্যানালিসিসকে খণ্ডন করবার চেষ্টা কেন? কোনো কোনো মার্কপন্থী সমালোচক তাই দুটো কথাকে আলাদা করে নিতে চান। বলতে চান, ফ্রয়েডবাদের মধ্যে যেটা কলাকৌশলের দিক আসলে সেই দিকটা নিয়ে আমাদের সমালোচনা নয়। সমালোচনাটা বিশেষ করে ফ্রয়েডীয় সিদ্ধান্তগুলি নিয়ে, ফ্রয়েডের দার্শনিক মতবাদটা নিয়ে, সমাজতত্ত্ব আর রাজনীতির ক্ষেত্রে এই মতবাদের উপসিদ্ধান্তগুলি নিয়ে। এই রকম চেষ্টার একটি প্রকৃষ্ট উদাহরণ হলো, কড়ওয়েলের রচনা। (১১) কড়ওয়েল বলতে চান, ফ্রয়েড আসলে অনেক গুরুত্বপূর্ণ বৈজ্ঞানিক তথ্যের সন্ধান পেয়েছিলেন, কিন্তু সেগুলি থেকে যখন তিনি তাঁর সিদ্ধান্তে পৌঁছবার চেষ্টা করলেন তখন দেখা গেলো বিজ্ঞান ছেড়ে তিনি পৌরাণিক কল্পনায় বিভোর হয়ে পড়েছেন।
কিন্তু ফ্রয়েড-প্রসঙ্গে এই রকমের একটা ভঙ্গি নেওয়াও ঠিক হবে না। এটা নির্ভুল মার্কসীয় ভঙ্গি হবে না, কেননা এই ভঙ্গির পিছনে মতবাদ আর প্রয়োগের মধ্যে অলীক পার্থক্য-কল্পনা। তাছাড়া, সাধারণের কাছে এটা বিভ্রান্তি সৃষ্টি করবে। কেননা, এর ফলে ব্যাপারটা দাঁড়াবে, যেন ফ্রয়েডবাদের সদর মহলটায় অনেক রকম গোলযোগ আর ভুলচুক থাকলেও অন্দর মহলে আছে আশ্চর্য বৈজ্ঞানিক ঐশ্বর্য। সে-ঐশ্বর্য সাধারণের চোখের আড়ালে, কিন্তু সে দিকে চোখ পড়লে চোখ ঝলসে যাবার অবস্থা। অর্থাৎ এই ভঙ্গির ফলে, ফ্রয়েডবাদ সম্বন্ধে সাধারণের কাছে এই রকম রহস্য সৃষ্টিই করা হবে—ফ্রয়েডবাদের বৈজ্ঞানিক বিচারের দিকে এগুনো যাবে না। তাই কলাকৌশলের কথা বাদ দিয়ে ফ্রয়েডবাদের প্রকৃত মার্কসীয় সমালোচনা সম্ভব নয়। প্রশ্ন তুলতে হবে, ফ্রয়েডীয় কলাকৌশলটা ঠিক কী রকম? প্রশ্ন তুলতে হবে, চিকিৎসা পদ্ধতি হিসেবে তার ব্যবহারিক মূল্য ঠিক কতোখানি। এবং এই সব বিষয় সম্বন্ধে মার্কসবাদীর মন্তব্য কোন্ ধরনের?
অর্থাৎ দেউড়ির বাইরে দাঁড়িয়ে ফ্রয়েডবাদের বিরুদ্ধে আওয়াজ তোলা নয়। ফ্রয়েডবাদের অন্দর মহলটা তাতে এক রহস্যপুরীই হয়ে থাকবার সম্ভাবনা। তাই মার্কস্বাদীকে প্রবেশ করতে হবে ফ্রয়েডবাদের অন্তঃপুরের মধ্যে।
মার্কসবাদী যদি এইভাবে ফ্রয়েডীয় মতবাদের অন্তঃপুর পর্যন্ত অগ্রসর হন, তাহলে দেখতে পাবেন এই অন্তঃপুরের মধ্যে যা-কিছুর আয়োজন তারই উপর পুঁজিবাদী সভ্যতার, পুঁজিবাদী দৃষ্টিভঙ্গির নিঃসন্দেহ স্বাক্ষর। অর্থাৎ ফ্রয়েডীয় কলাকৌশল এবং চিকিৎসা-পদ্ধতি বলে ব্যাপারও বুর্জোয়া সভ্যতার আদর্শ, আকাঙ্ক্ষা আর কায়দাকানুন বহির্ভূত নির্লিপ্ত বিজ্ঞান নামের অপরূপ আর অপূর্ব কিছু নয়।
শুরুতে ফ্রয়েডীয় কলাকৌশলের একটি সংক্ষিপ্ত বর্ণনা দেওয়া দরকার।
সাইকোএ্যানালিস্ট-এর ঘরটা আধো-অন্ধকার। রোগী ঘরে ঢুকে ভিতর থেকে দরজা বন্ধ করে দেবেন: ঘরে কোনো তৃতীয় ব্যক্তি থাকা চলবে না, খোলা ঘরে সাইকোএ্যানালিসিস্ চলে না। রোগী একটা শোবার জায়গায় শরীরটাকে সম্পূর্ণ এলিয়ে দিয়ে চোখ বুজে কথা বলে যাবেন: যে-কোনো কথা মনে আসবে তাই বলে যেতে হবে, সেগুলো যতো অবান্তর, আজগুবি, এলোমেলো বা অশ্লীল মনে হোক্ না কেন, কোনো রকম বিচার-বিশ্লেষণ করা চলবে না। এই ব্যাপারটার নাম ‘অবাধ অনুষঙ্গ’ বা ফ্রি এ্যাসোসিয়েশন। তারপর রোগী চোখ খুলবেন, চিকিৎসক এই সব কথার একটা ব্যাখ্যা দেবেন। রোগী সেই ব্যাখ্যা শুনে নির্দিষ্ট ফী দিয়ে পরে কোনদিন কোন্ সময়ে আবার আসতে হবে তাই ঠিক করে বিদায় নেবেন। এই রকম দিনের পর দিন। তিনশো দিন-কিংবা তারও অনেক বেশি হতে পারে। ফী-র কথাটা জরুরী—ফ্রয়েডীয় কলাকৌশলের একটা অঙ্গ। ফী না হলে চিকিৎসা অসম্ভব। তাছাড়া কাঁচা টাকায় ফী দিতে হবে—নোট চলবে না, চেক চলবে না। দীর্ঘ দিন ধরে চিকিৎসা। এই সময়টার মধ্যে রোগীর মনে কখনো হয়তো চিকিৎসার বিরুদ্ধে তীব্র বিদ্বেষ। এর নাম রেসিটেল্ বা ‘প্রতিবন্ধ’। কখনো আবার চিকিৎসকের প্রতি গভীর অনুরাগ, সত্যিকারের প্রেম। এর নাম ট্রান্সফারেন্স বা ‘সংক্রমণ’। প্রতিবন্ধ বলে ব্যাপারটার ফ্রয়েডীয় ব্যাখ্যা হলো: রোগী এতোদিন পর্যন্ত নিজের মনের কাছ থেকেও যে-সব কথা লুকিয়ে রাখবার চেষ্টা করেছেন চিকিৎসক সেগুলি প্রকাশ করে দিচ্ছেন, তাই অমন রাগ। সংক্রমণ বলে ব্যাপারটার ফ্রয়েডীয় ব্যাখ্যা হলো: শৈশব থেকে রোগীর মনে পিতামাতার প্রতি যে-আবেগ-অনুরাগ উপযুক্ত চরিতার্থতা না পেয়ে সঞ্চিত হয়ে রয়েছে তা চিকিৎসকের প্রতি সংক্রামিত হওয়া। অবশ্য অনেক সময় প্রতিবন্ধকেও নেগেটিভ ট্রান্সফারেন্স বা নেতিমূলক সংক্রমণ বলা হয়—অর্থাৎ পিতামাতার প্রতি শৈশব আক্রোশটা চিকিৎসকের উপর গিয়ে পড়ে। যাই হোক, চিকিৎসক প্রতিদিনই রোগীর কাছে এই প্রতিবন্ধ ও সংক্রমণের প্রকৃত ব্যাখ্যা দিয়ে যাবেন। আর তারপর? শেষ পর্যন্ত কী হবে? চিকিৎসার আসল উদ্দেশ্যটা অবশ্যই রোগীর মনকে সুস্থ স্বাভাবিক করে তোলা। কিন্তু স্বাভাবিক মন বলতে ঠিক কী বোঝায়? ফ্রয়েডীয় মতে এ্যাডজাস্টমেন্ট বা ‘উপযোজন’। অর্থাৎ কিনা, পারিপার্শ্বিক অবস্থার সঙ্গে নিজেকে ঠিকমতো খাপ খাওয়াতে পারা, মানিয়ে নেওয়া কী?
তাহলে, সংক্ষেপে, ফ্রয়েডীয় কলাকৌশলের মূল কথা কী?
১ : বন্ধ ঘর
২ : প্রতিবন্ধ
৩ : ফী-কাঁচা টাকা
৪ : সংক্রমণ
৫ : উপযোজন
৬ : অবাধ অনুষঙ্গ
একে একে এই কটি কথা নিয়ে আলোচনা করলে দেখতে পাওয়া যাবে ফ্রয়েডীয় ক্লাকৌশলের প্রত্যেকটি ক্ষেত্রেই বুর্জোয়া মতাদর্শের কী রকম নির্ভুল স্বাক্ষর!