০৬.
কলকাতার কাছাকাছি কত কী থাকে! বোধন দু-চারবার যে টেঙরায়, গরচা রোডে, গড়িয়ায় যায়নি তা নয় তবে জায়গাগুলো তার কাছে তেমন চেনা নয়। আজ বোধন গিয়েছিল বেহালার দিকে। বঁড়শে-টঁড়শে পেরিয়ে। একটা কেমিক্যাল কারখানায় লোক নেবে বলে কাগজে বেরিয়েছিল কবে তাও বোধন জানে না। দুম করে একটা চিঠি পেল বোধন। এমপ্লয়মেন্ট এক্সচেঞ্জ থেকে। বোধন কাউকে কিছু বলেনি, সকালে মা অফিস বেরোবার আগেই বেরিয়ে পড়েছিল। গিয়ে পৌঁছতেই ঘণ্টা দুইয়ের কাছাকাছি। তবে যাওয়াই সার। কারখানা নতুন। বছর দুয়েকের। নামেই কেমিক্যাল, আসলে ব্লিচিং পাউডার, মেঝে পরিষ্কারের লিকুইড সোপ, গুঁড়ো সাবান, লেখার সস্তা কালি, কারবলিক অ্যাসিড এই সব তৈরি করে। বোধনকে দাঁড়াতে হয়েছিল ঘণ্টা দেড়েক। তারপর যা হয়, একবার ডাকল, মুখ দেখল, দু চারটে ফালতু কথা; শেষে পরে জানিয়ে দেব।
বোধন কাছাকাছি একটা দোকান খুঁজে কিছু খেতে ঢুকল। টিনের চালার দোকান। হাতে-গড়া রুটি, আলুর দম, পাউরুটি, ডিমের ওমলেট, চা পাওয়া যায়। হাতে-গড়া রুটি আলুর দম খেয়ে বোধন নাক চোখ মুছতে লাগল। কী ঝাল রে, বাবা। বাসি সোনপাপড়ি ছিল, তাই একটা মুখে দিয়ে সামলাল নিজেকে। চা খেল। তারপর বড়লোকি মেজাজে পাশের দোকান থেকে পান মুখে দিয়ে একটা সিগারেট ধরাল।
এখানে-ওখানে নানান গাছ, মাঝেমাঝে জংলা ঝোপ। গাছের ছায়ায় পাথরের ওপর বসে বোধন কিছুক্ষণ জিরিয়ে নিচ্ছিল। সিগারেট শেষ করে উঠবে। বাস ধরতে মিনিট আট দশ হাঁটতে হবে তাকে। বোধন এদিক-ওদিক তাকাচ্ছিল। এসব জায়গা এখনও পুরো শহর হয়নি। আধা শহর হয়েছে কিনা তাতেও সন্দেহ আছে। পুকুর, ভাঙা মন্দির, বেলগাছ, নিমগাছ আরও কতরকম কী চোখে পড়ে। রোদও চড়া নয়, তাত নরম, আকাশ নীল। একটু হাওয়া দিচ্ছিল। আরাম লাগছিল বোধনের। অলসভাবে সিগারেটটা শেষ করতে লাগল।
সাইকেলে কে একজন আসছিল। খাটো ধুতি, গায়ে জামা, কোমরের কাছে গামছা বাঁধা। লোকটা যেতে যেতে বোধনকে দেখল। চলেই যাচ্ছিল। থামল হঠাৎ। নেমে পড়ল। ফিরে এল বোধনের কাছে।
দেখল বোধনকে। নিতাই নাকি?
বোধন অবাক। লোকটাকে দেখছিল। মাথা নাড়ল।
নাম কী?
নাম বলল বোধন।
এখানে আসা হয়েছিল কেন?
চাকরির কথা বলল বোধন।
লোকটা বলল, নিতাই, নিতাই মনে লাগল। জামাইয়ের ছোট ভাই। থানা থেকে শালাকে হুলিয়া করেছে। ভাবলাম হারামজাদা ফেরারি হয়ে বসে আছে এখানে। চলি!
লোকটা আবার সাইকেলে চেপে চলে গেল। বোধন অনেকক্ষণ লোকটাকে দেখল। নির্ঘাত পাগল।
বোধন উঠে পড়ল। বাস ধরতে হবে।
ঝোপঝাড়, গাছপালা, কখনও রোদ কখনও ছায়া দিয়ে আসতে আসতে বাতাসের দমকা গায়ে লাগার পর বোধন হঠাৎ অনুভব করল, কোথায় যেন শীতের গন্ধ লেগেছে। মাথার ওপর আকাশে অনেক উঁচুতে চিল উড়ছে, কাছাকাছি মেঘ নেই, রোদের রং অন্যরকম, কুলগাছের তলায় জোড়া শালিখ, নয়নতারার জঙ্গলে কত না প্রজাপতি।
বোধনের হঠাৎ মনে পড়ল নভেম্বর মাসের আজ তিরিশ হয়ে গেল। কাল বাদ দিয়ে পরশু বিনুর কাকার ফিরে আসার কথা। অফিসের কাজে বিনুর কাকা বাইরে গিয়েছেন। ফিরে এসে বোধনকে নিজের কলকাতার অফিসে নিয়ে যাবেন। একটা চাকরি হয়ে যেতে পারে! কথাবার্তা বলা আছে।
.
বাস রাস্তায় পৌঁছে বোধন দাঁড়াল।
জায়গা ছিল। বোধন বসতে পারল।
হাই উঠছিল। জানলা ঘেঁষে বসতে পারলে হয়তো চোখ বুজে ঘুম দিত। বোধন বাসের লোকজন কণ্ডাক্টরকে দেখছিল। টিকিট করাও হয়ে গেল।
আরে–এই–এই যে!
বোধন তাকাল। চেনাচেনা লাগল। তারই বয়েসী ছেলে হাত তুলে নিজেকে চেনাচ্ছে।
কী খবর? বোধন বলল।
এই তো। তোমার?
আমারও সেই রকম। এদিকে কোথায়?
একটা কাজে এসেছিলাম।
যাক তবু তোমরা কাজে আস। আমি ভাই অকাজে ঘুরে বেড়াই। কী করছ?
তেমন কিছুই না, বোধন বলল, এই সামান্য কিছু। আসলে বাসের মধ্যে চেঁচিয়ে কিছুই করছি না বলতে লজ্জা করল বোধনের। তা ছাড়া ছেলেটাকে মুখচেনা লাগলেও তার নাম, কিংবা ও যে কে তা মনে করতে পারছিল না! তুমি কী করছ?
পোলট্রি, ডেয়ারি, ফিশারি যা পারছি। এদিকে আমাদের এক মহাজন থাকে; মানি ম্যাটার্স…। তার কাছে এসেছিলাম। লেগে আছি, ভাই। পেটটা চলে যাচ্ছে। ফ্যামিলি বার্ডেন কম–তাই টিকে আছি। নয়তো মরে যেতাম। তোমার আর সব খবর ভাল?
চলছে। আজকাল আর কে ভাল থাকে!
একটু থেমে ছেলেটি আবার বলল, জয়ন্তর খবর শুনেছ?
জয়ন্তর নাম মনে পড়ল বোধনের। কলেজে একই সঙ্গে পড়ত। এই ছেলেটিও তা হলে কলেজের একজন হবে।
জয়ন্ত কানাডা চলে গিয়েছে। লেগে থেকে থেকে বাগিয়ে ফেলল ঠিক। ওর এক দিদিও আছে কানাডায়। জয়ন্ত লাকি, ভাই। তুমি ওরকম একটা চেষ্টা করলে পারতে। নাইজেরিয়া সোমালিল্যান্ড কোথাও হয়ে যেত। আমি একটা লাগিয়ে রেখেছি। যদি চান্স পাই কেটে পড়ব। দূর, এখানে, ঘোড়ার ঘাস কেটে কী লাভ!
বাসের মধ্যে এত কথাবার্তা ভাল লাগছিল না বোধনের। সবাই শুনছে। নিজেদের ব্যাপার দশজনের সামনে চেঁচিয়ে বলার কী আছে! বোধন জানলার দিকে মুখ ঘুরিয়ে নিল।
আরও তিন চার স্টপ এগিয়ে ছেলেটি নেমে গেল। চলি। এখানে একটা কাজ সেরে ফিরব।
পরের স্টপে বোধন জানলার দিকে জায়গা পেল। কোথায় এল বাস সে জানে না। তবে এখনও ট্রাম দেখা যাচ্ছে না।
ছেলেটিকে আবার মনে পড়ল বোধনের। কলেজে নিশ্চয় পড়ত তাদের সঙ্গে। নাম যে কী বোধনের মনে এল না। হয়তো ছেলেটিও নাম ভুলে গেছে বোধনের। এই রকমই হয়। বোধন তার ছেলেবেলার সব বন্ধুর কথা মনে রাখতে পারেনি, মানিকতলার অনেকের কথা তার একবারও মনে পড়ে না। দু-চার জনের কথা নিশ্চয় পড়ে। যেমন হারীত। হারীতের বাড়িতে এখনও দু-এক মাস অন্তর যায় সে। বড় ভাল ছেলে। হরীত বায়ো-কেমিস্ট্রি নিয়ে রিসার্চ করছে। দু বছরের স্কলারশিপ পেয়েছে হারীত।
এই হারীত সেদিন একটা অদ্ভুত কথা বলেছিল। সে নাকি বোধনের দিদিকে একদিন এসপ্ল্যানেডে দেখেছে। সঙ্গে একটা বাচ্চা ছেলে। ট্রাম ধরার জন্যে দাঁড়িয়েছিল।
অন্য কেউ বললে বোধন বিশ্বাস করত না। হরীত বলেছিল বলেই সে বিশ্বাস করেছিল। একটু সন্দেহ তখনও ছিল, আজও আছে। কথাটা বাড়িতে কাউকে বলেনি বোধন। বলে লাভ কী! দিদিকে সবাই ভুলে গিয়েছে। মা, বাবা, চুয়া। দিদির কথা কেউ বলে না। মা কখনও নয়। বাবার মুখ থেকে কথাই শোনা যায় না তো কী বলবে! আর চুয়া? সে নিজেকে নিয়েই ব্যস্ত। বাড়িতে যতক্ষণ থাকে মার মুখের ভয়ে এটা-ওটা নাড়াচাড়া করে, নয়তো সে নিজের মতন। বাড়ির ওপর তার বিরক্তি, ঘেন্না বোঝা যায়। চোখের ওপর দেখতে দেখতে কেমন পালটে গেল। রোজই বাড়ির বাইরে যায়। কোথায় ঘোরে কে জানে,বলে গানের টিউশনি করে, থিয়েটারে রিহার্সাল দেয়। মা তেমন কিছু বলে না, এক-আধ দিন গালাগালি দেয় অবশ্য, কিন্তু অত বড় মেয়েকে মা আর কী বলবে! যাকে কিছুই দিতে পারে না মা–একটা ভাল শাড়ি না, জামা না, জুতো না, না পারে মেয়েকে আলাদা করে এক শিশি শ্যাম্পু কিনে দিতে। তাকে মা কোন লজ্জায় বলবে, না, তুমি বাড়িতে বসে থাকো। চুয়া যা করছে তাতে তার হাতে কিছু অন্তত আসে। তাতে চুয়ার নিজের দরকার সামান্য মেটে। আর দায়ে-অদায়ে মা নিজেও তো দু-চার টাকা চায়।
হারীত বলছিল, দিদি গোলগাল হয়েছে। ছেলেটাও দেখতে ভাল। বদ্যিনাথের রং ছিল কুচকুচে কালো। কিন্তু চোখা চেহারা ছিল। দিদির ছেলের চেহারা ভাল হতেই পারে। তবে বেটা নিশ্চয় কালো হবে। বোধনের হাসি পেল, আবার কষ্টও হল। দিদিকে একবার কি সে দেখতে পায় না? কত সময় কত পুরনো লোকের সঙ্গে আচমকা দেখা হয়ে যায়, যেমন আজই হল। দিদির সঙ্গে বোধনের যদি এইরকম দেখা হয়ে যেত!
আচ্ছা, দিদিই বা এমন নিষ্ঠুর কেন? সে কেন মা বাবাকে চিঠি লেখে না। কেন আসে না একবার? এলে কি মা তাকে তাড়িয়ে দেবে? দিদি কোনও খোঁজই করে না নিজের মা বাবা-ভাই-বোনের। দিদি মা বাবার খোঁজ করতে পারত। পুরনো কথা এতকাল কেউ মনে করে রাখবে না। মার অফিসের কথা দিদি জানে, দিদি অন্তত মার অফিসের ঠিকানায় চিঠি দিয়ে খবর নিতে পারত। সে নেয় না। হয়তো ভুলে যেতে চায়, ভুলেই গিয়েছে।
মেয়েরা মাকে কি তেমন ভালবাসতে পারে না? বিনুর বেলাতেও তাই দেখছে বোধন। আগে অত বুঝতে পারত না। এখন বুঝতে পারছে, বিনু তার মার ওপর তলায় তলায় খুশি নয়। মুখে সে হুট করে কিছু বলে না, কিন্তু ভেতরে বোঝা যায়।
কদিন আগে বিনু তাকে মুশকিলে ফেলেছিল। কী কথায় ফট করে বলল, মা তোমাকে ডিউটি দেয়নি?
ডিউটি কীসের?
কাকা থাকবে না, কানপুর যাচ্ছে। মাকে কদিন গার্ড দিতে বলেনি?
বোধন থতমত খেয়ে গেল। তার মানে?
বাঃ, মা এখন তোমার ওপর দারুণ খুশি। সেদিন যা উপকার করেছ মার। তুমি না থাকলে ফিট হয়ে মরে পড়ে থাকত!
কথাটা ঠিক না; আবার একেবারে মিথ্যেও নয়। যদি এমন হত, বিনুর মা মোমবাতি ধরিয়ে আসতে গিয়ে পড়ে যেতেন তবে কাপড়-চোপড়ে নির্ঘাত আগুন লেগে যেত। বাড়িতেও তো তখন কারুর থাকার কথা ছিল না।
ফিটে কেউ মরে না। তবে কাপড়ে-চোপড়ে আগুন লেগে গেলে বিপদ হত। ওই জন্যে বলে, ফিটের রুগির ভয় জলে আর আগুনে।
ঠোঁটে তাচ্ছিল্যের ভঙ্গি করল বিনু। তারপর বলল, তা বাবা, এখন তুমি মার বেশ পেটোয়া হয়েছ। তোমার ওপর কত কী বলব-দাঁড়াও, হ্যাঁ কনফিডেন্স।
বোধন হাসল।
হাসছ? বিনু যেন বিরক্ত।
হাসব না তো কী করব! আমার ওপর কারও কোনও কনফিডেন্স নেই।
বিনু আড়চোখে দেখল বোধনকে। তারপর খাতার ওপর ডট পেন দিয়ে কিছু লিখল, হাত আড়াল করেই। বোধন দেখল না। পড়া থামিয়ে গল্প করছিল বিনু, আবার কিছু লিখে নিচ্ছে ভেবে বোধন মনে মনে সেদিনের কথাটা ভাবতে লাগল। বিনুর মা মেঝেতে পড়ে আছেন, পায়ের দিকের কাপড় অগোছালো, হাত মুঠো, পায়ের পাতা বাঁকা, দাঁতে দাঁত লেগে রয়েছে–এই দৃশ্যটা সে ভুলতে পারে না। আবার ওরই সঙ্গে সে ভুলতে পারে না, বিনুর মার বুকে কাপড় নেই কোথাও, আধ-খোলা জামা ঘামে-জলে ভিজে নীচের জামা স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। গলার তলার দিকের বুক দেখা যাচ্ছে। বোধন সেদিন থেকে কতবার যে এই দৃশ্যটা মনে মনে দেখেছে। কেন? বিনুর মা বয়েস হলেও সুন্দর বলে?
মা তোমায় না সেদিন বলছিল ভাল শালকরের কাছে দুটো শাল দিয়ে আসতে? বিনু বলল।
হ্যাঁ। দিয়ে দিয়েছি তো?
বড় কাঁচিটাও ধার করিয়ে এনে দিয়েছ?
তাও দিয়েছে বোধন। কিন্তু এসব কথা আসছে কেন? এটা ঠিক, বিনুর মা আগে যেমন বোধনকে কুনজরে দেখতেন না তেমন খুব সুনজরেও নয়। নিস্পৃহ ভাব ছিল। এখন সেটা নেই। বিনুর মা তাকে আজকাল স্নেহই করছেন। দু একটা সাংসারিক কাজকর্মের কথা বলেন। বোধন করে দেয়।
বিনু হঠাৎ বলল, মার এই ফিটের ব্যারামটা কবে থেকে, জান?
বলেছ তো, পুরনো।
পুরনো মানে কত পুরনো জান না তো?
না, কেমন করে জানব।
বিনু কিছু ভাবল। পরে একদিন বলব।
কথা পালটাবার জন্যে বোধন বলল, মাসিমাকে বলেছি, কাকাবাবুকে বলে আমায় একটা চাকরি জুটিয়ে দিতে।
জানি।
তোমার কী মনে হয়? কাকাবাবু চেষ্টা করলে নিশ্চয় হবে।
বিনু ঘাড় হেলাল। হবে বই কী!
বোধন খুশি হল। তুমি একটু তাগাদা মেরো না, প্লিজ।
বিনু হাসল না। লেখার ওপর থেকে হাত সরাল। তারপর কাগজটা এগিয়ে দিল বোধনের দিকে।
বোধন দেখল, বিনু জড়িয়ে জড়িয়ে লিখেছে: আই ডু নট লাইক মাই মাদার।
.
০৭.
জগৎ অনেকক্ষণ থেকে উসখুস করছিল। দোকান বন্ধ করে বাড়ি চলে যেতে চায়। আবার একবার তাগাদা দিল বোধনকে।
বোধন বলল, কী করবি বাড়ি গিয়ে? এমনিই বলল, কিছু না ভেবেই।
ঘুমিয়ে লেব। আজ আমার লাইট গার্ডের ডিউটি আছে। জগৎ এই রকমই। ন তার মুখে কমই আসে, সবই ল সুকুমারদা মাঝেমাঝে জগৎকে খেপায়: এই জগা, ধর তুই বিয়ে করলি–তোর বউয়ের নাম নিভারানী। তখন তুই কী করবি? জগৎ বলবে না; সুকুমারদাও ছাড়বে না। শেষে সুকুমারদা জগৎকে মাস্টারের মতন ন-এর উচ্চারণ শেখাবে: নবাব নন্দন, নিত্য নব নর্তকী নাচাইয়া আছ খাশা! বল শালা। তারপর যতরকম হাসি মশকরা।
বোধন বলল, নে তবে–দোকান বন্ধ কর। বোধনেরও শরীর ভাল লাগছিল না। মাথা ধরে আছে, গা ম্যাজম্যাজ করছে। ঠাণ্ডা লেগে গিয়েছে। দেখতে দেখতে শীতও আসছে।
জগৎ দোকান বন্ধ করতে লাগল।
সুকুমারদা দিন দুই হল কলকাতায় নেই। বর্ধমানে গিয়েছে। বর্ধমান শহর থেকে খানিকটা তফাতে সুকুমারদাদের বাড়ি। পাকা বাড়ি। তার কতটুকু বাসযোগ্য আছে কে জানে। সুকুমারদার মা আর কিছুতেই ছেলেবউয়ের কাছে থাকবে না। বউ বজ্জাত, বউ সহবত জানে না, বউ শুধু সাজন-গোজন আর সিনেমা শিখেছে।
রোজ বাড়িতে অশান্তি, খিচির-মিচির, মা বলে তুই আমার বেটা হয়ে থাক। বউ বলে তুমি আমার স্বামী না, তবে? ধুর শালা, সুকুমার অত ঝাটে নেই। বেশ চলো তুমি বর্ধমানে, জ্ঞাতিগোষ্ঠী তো আছে, তা ছাড়া না না করেও দু-চার বিঘে জমি। চলো তোমায় বর্ধমানেই রেখে আসি, অতই যখন তোমার ইচ্ছে।
বর্ধমানের বাড়িতে মায়ের থাকার ব্যবস্থা সেরে সুকুমারদা ফিরবে। বোধনকে দোকান দেখাশোনা করতে বলে গিয়েছে। কাল পরশু নাগাদ ফিরে আসবে সুকুমারদা।
জগৎ দোকান বন্ধ করে চাবি দিল বোধনকে। বোধন চাবি আর খুচরো বিক্রির বাইশ তেইশটা টাকা সুকুমারদার বউয়ের হাতে তুলে দিয়ে বাড়ি চলে যাবে। কাল দোকান খোলার সময় জগৎ গিয়ে চাবি আনবে।
জগৎ চলে গেল। বোধনও আর দাঁড়াল না। নাক গলা জ্বলে যাচ্ছে। মাথা ভার। কপাল যেন ছিঁড়ে পড়ছে। দুটো বড়ি না খেলেই আর নয়। সকালে চারটে কিনেছিল, দুটো খেয়েছে।
রোজই যেমন হয় আজও সেইরকম হল। অন্ধকার হয়ে গেল ঝপ করে। মধ্যে কদিন এই সময়টায় আলো থাকছিল, যাচ্ছিল রাত্রের দিকে–দশটার পর। আবার পুরনো খেলা শুরু করেছে।
সুকুমারের বাড়ি দূর নয়। মিনিট আট দশের রাস্তা। অন্ধকার দিয়ে গলি দিয়ে হাঁটছিল বোধন।
যেতে যেতে একটা হাসি-হুঁল্লোড় শুনল। তাকাল বোধন। দুধের ডিপো আর বটোর কয়লার দোকানের পাশে একফালি জমির ওপর যে বাড়ি তৈরি হচ্ছে সেখানে জনাচারেক ছেলে বসে। দিশি মদের গন্ধ আসছে যেন। বোধন বুঝতে পারল, কচার দল। কচা সকালে পাড়ার রিকশাঅলাদের ইউনিয়ন করে, সেলফ মেড নেতা। ভোটে মস্তানি করার পর থেকে কচার স্ট্যাটাস হয়েছে। রিকশা-নেতা কচা তার রেট বেঁধে দিয়েছে: রিকশা প্রতি রোজ পঁচিশ পয়সা। রিকশা ইউনিয়ন করে করে কচার লোভ বেড়ে গিয়ে সে বাজারের সবজি এবং মাছঅলাদের দিকে হাত বাড়াতে গিয়েছিল সেখানে জোর ধাক্কা খেল, গোপাল আরও বড় কর্মী, কচাকে বেদম মারল। দুটো পটকা ফাটিয়ে কচা আবার যেমন কে তেমন।
এক সময় বোধন এদের ভয় করত। এখন করে না। কারণ, এরা পাড়ার লোকের প্রত্যেকের গা শুঁকে জেনে নিয়েছে, কার কত দুর দৌড়? বোধনের পেছনে সুকুমারদা আছে, কাজেই সে নিশ্চিন্ত।
কচারা বোধনকে দেখতে পেল কি না কে জানে, কিছু বলাবলি করল নিজেদের মধ্যে নিচু গলায়– তারপর শেয়ালের ডাকের মতন তিন চারটে গলা কেয়া হুয়া গাইতে লাগল।
বোধন তাকাল না। কচারা বোধনেরই সমবয়েসী। পাড়ার ছেলে। তবু বোধন কোনওদিনই ওদের সঙ্গে মেলামেশা করেনি। ভাল লাগে না। বোধনরা যখন মানিকতলা থেকে এখানে প্রথম এল তখন কচা স্কুলের পড়া ছেড়ে দিয়ে বাসস্ট্যান্ডের কাছে চায়ের দোকানে বসে বসে রকবাজি করে। তার সাকরেদ ছিল বস্তির কটা চ্যাংড়া। বোধনকে নতুন পেয়ে কচা পেছনে লেগেছিল। খিস্তি করত। পায়ে পা লাগিয়ে ঝগড়াও বাধাল একদিন, ঘঁষোঘঁষি খামচাখামচি হল দুজনে, তারপর মনুয়া কোত্থেকে উড়ে এসে দু-চারটে লাথি কষাতেই সব শান্ত। বোধন তখন থেকেই ওই লোফার লোচ্চাটাকে ঘেন্না করে।
এরাও কিন্তু বেশ আছে। রিকশাঅলাদের কাছ থেকে পয়সা নেয়, দোকান থেকে এটা ওটা ঝাড়ে, ছিনতাই করে তেঁতুলতলার দিকে, একটা ঝামেলা বাধিয়ে দিতে পারলেই দু পয়সা। পুলিশ কত বার ধরে নিয়ে গিয়েছে, আবার ছেড়েও দিয়েছে।
বোধন সুকুমারের বাড়ির কাছাকাছি পৌঁছতেই গায়ের ওপর রিকশা এসে পড়ল।
কিছু বলতে গিয়েও বলতে পারল না বোধন। বউদি বাসে।
আমি তোমার কাছেই যাচ্ছিলাম। বোধন বলল–কোথায় যাচ্ছ?
চাবি এনেছ। দাও। বোধন দোকানের চাবি আর টাকা দিল। যাচ্ছ কোথায়?
শ্যামাদের বাড়ি। আমার নেমন্তন্ন আছে।
ফিরবে কখন?
ক-ত আর! নটা।
আচ্ছা যাও।
রিকশা চলে গেল। বউদি যে কী মেখেছিল কে জানে, সস্তা ভারী গন্ধ ছড়িয়ে গেল বাতাসে।
.
বাড়ি ফিরে বোধন দেখল, মা ফেরেনি। চুয়াও বাড়ি নেই। বাবা দরজা খুলে দিল।
দরজা খুলে বাবা আবার নিজের জায়গায় চলে যাচ্ছিল।
মা ফেরেনি?
না।
এতক্ষণে ফিরে আসার কথা মার। প্রায় আটটা বাজতে চলল। ফিরতে দেরি হবে বলে গেছে?
আমায় কিছু বলে যায়নি। শিবশংকর বললেন।
চুয়া?
বেরিয়েছে। শিবশংকর নিচু হয়ে মাটিতে কী যেন দেখছিলেন।
বোধন ঘরে ঢুকে অন্ধকারে প্যান্ট ছাড়ল। লুঙ্গি পরে বাথরুমে চলে গেল। ফিরে আসার সময় আবার বাবাকে দেখল। টেবিলের সামনে বাবা বসে আছে। ছোট ময়লা লণ্ঠন জ্বলছে সামনে। জানলা খোলা। বাবার সামনে আধ-ছড়ানো তাস। মাটির ভাঁড়। বিড়ি আর দেশলাই। যখন বাবার হাতে ক্রস ওয়ার্ড থাকে না বা ওইরকম কিছু–তখন বাবা তাস নিয়ে বসে পেশেন্স খেলে। মা দু চক্ষে তাস খেলা দেখতে পারে না। মা না থাকলে বাবা লুকিয়ে তাস খেলে।
বোধনের হঠাৎ মনে হল, বাবা বসে বসে পেশেন্স খেলছিল, তারপর দরজায় কড়া নাড়ার শব্দ শুনে প্রথমে ভেবেছিল মা, মা ভেবে ভয় পেয়ে তাস গুটোতে গিয়ে মাটিতে ছড়িয়ে ফেলেছে কয়েকটা। অথচ পরেই বাবা বুঝতে পেরেছিল মা নয়। সিঁড়িতে মার পায়ের শব্দ হলে বাবা বুঝতে পারে, আর কড়া নাড়ার শব্দ বুঝবে না! আসলে ভুল হয়ে গিয়েছিল বাবার।
বাবার এই ছেলেমানুষিতে বোধনের হাসি পেল, মায়াও হল। মেঝেতে পড়ে থাকা বাকি কটা তাস তুলে দিতে দিতে বলল, মার এত দেরি হচ্ছে কেন?
আটকে পড়েছে কোথাও। কলকাতার যা হালচাল।
হয়তো মিছিল বেরিয়েছে। …তুমি বিকেলে চা খেয়েছ?
জবা করে দিয়েছিল।
কেন, চুয়া?
চুয়া বিকেলের আগেই চলে গিয়েছে।
চুয়ার আজ নিশ্চয় কোনও থিয়েটার আছে। অফিস ক্লাবে। এই পাড়ারই কে একজন সেদিন বলছিল, তাদের অফিসের থিয়েটারে চুয়াকে পার্ট করতে দেখেছে। আরে, বোধন তোমার বোন কি অ্যামেচার প্লে করে! স্টেজে দেখে তাই মনে হচ্ছিল। তবে রংচং মেখে ড্রেস পরে নেমেছিল তো! চিনতে পারছিলাম না। প্রোগ্রামে আবার নাম লেখা অর্চনা। …তা ভালই করেছে। স্টেজ ফ্রি।
চুয়ার ভাল নাম অর্চনা।
বোধন হঠাৎ বলল, চা খাবে?
চা? তুই করবি?
করি। আমার জ্বরজ্বর লাগছে। এ-পি-সি খেয়ে গরম চা খাব। আলোটা একবার নিচ্ছি। বোধন রান্নাঘরে ঢোকার আগে লণ্ঠনটা তুলে নিল। কুপি জ্বালিয়ে নিয়ে আবার এসে রেখে দিল টেবিলে। রান্নাঘরে চলে গেল।
কেরোসিন স্টোভে চায়ের জল চড়িয়ে দিয়ে বোধন বাইরে আসতেই কড়া নড়ে উঠল। মা এসেছে। মা জোরে জোরে কড়া নাড়ে। থামে না। বেশ বোঝা যায় মা অধৈর্য।
বোধন বাবার দিকে তাকাল। শিবশংকর তাস লুকিয়ে ফেললেন।
দরজা খুলে দিল বোধন।
সুমতির পায়ে যেন জোর নেই, দম ফুরিয়ে গিয়েছে। কোনও রকমে চটি ছেড়ে হাঁফাতে হাঁফাতে এগিয়ে এসে টেবিলের সামনে চেয়ারে বসে পড়লেন। ছেঁড়াখোঁড়া ময়লা চামড়ার ব্যাগটা ফেলে দিলেন টেবিলের ওপর। পায়ের কাপড় হাঁটু পর্যন্ত তুলে নিলেন। ক্লান্ত, রুক্ষ, অবসন্ন চেহারা। ঘাম জমেছে মুখে। হাঁ করে শ্বাস টানছিলেন।
বোধন জিজ্ঞেস করতে যাচ্ছিল তোমার এত দেরি? জিজ্ঞেস করল না। মা আগে দম নিয়ে সামলে নিক।
সুমতি জল চাইলেন মেয়েকে ডেকে।
চুয়া নেই। বলে শিবশংকর বোধনের দিকে তাকালেন। বোধন জল আনছিল।
কোথায় গিয়েছে ও? সুমতি স্বামীর দিকে তাকালেন।
আজ বোধ হয় হাতিবাগান।
বোধ হয় কী! ঠিক করে বলতে পারো না! সব কথায় বোধ হয়।
শিবশংকর চুপ করে থাকলেন। যে-মানুষটা এইমাত্র বাড়ি ঢুকল তাকে চটাতে চান না।
বোধন জল এনে দিল।
সুমতি ছেলেকে দেখলেন। আগে খেয়াল হয়নি হয়তো, এখন হল। জল খেয়ে হাঁফ ফেললেন। তুমি আজ বাড়িতে যে?
বোধন জবাব দিল না। এ সময় বাড়িতে থাকাটা যেন তার মস্ত অপরাধ হয়ে গিয়েছে।
সুমতি আঁচলে মুখ মুছে একটু হাওয়া খেতে লাগলেন। বোধন রান্নাঘরে চলে গেল।
শিবশংকর নিচু গলায় বললেন, আজ বাসের গণ্ডগোল ছিল?
কোন দিন না থাকে! ছ্যাঁচড়ামির শেষ নেই। যেমন স্টেট তেমনি প্রাইভেট।
এই জায়গাটাও দূর…!
সুমতি কান করলেন না। রান্নাঘরে ও কী করছে?
চা। ওর জ্বর জ্বর লাগছে। চা দিয়ে ওষুধ খাবে।
সুমতি বড় করে শব্দ করে শ্বাস ফেললেন। আজ ঘটকবাবু এসেছিলেন দোকানে।
শিবশংকর গলা পরিষ্কারের শব্দ করলেন। ঘটক? কেন?
মেয়ের বিয়ে। কটা ভাল শাড়ি কিনতে এসেছিলেন। আঠাশে অঘ্রানে বিয়ে।
কেমন আছে সব?
ভাল। আরও গোলগাল দেখতে হয়েছেন। মাথার চুল পেকেছে। শরীর ভাঙেনি।
ঘটক আমার চেয়ে দু বছরের ছোট ছিল।
তোমার কথা বাদ দাও। তুমি ছোট থাকলেই বা কী হত, আর বড় হয়েই বা কী হয়েছে। দেখলাম তো, কেমন সুখেশান্তিতে আছে। মেয়ের বিয়ে দিচ্ছে। সবাই মিলে ব্যাঙ্ক থেকে জমি কিনেছে তারাতলায়। বাড়ির কাজ বলল অর্ধেক হয়ে গিয়েছে। এখনও চার পাঁচ বছর চাকরি বাকি। সুমতির গলা কেমন ক্ষোভে দুঃখে কাতর হতাশ শোনাচ্ছিল।
বোধন চা করতে করতে মা বাবার কথা শুনছিল। স্পষ্টই শুনতে পাচ্ছিল সব।
শিবশংকর প্রথমটায় জবাব দিলেন না; পরে চাপা গলায় যেন বললেন, তা ভগবান আমার…।
ভগবান ভগবান কোরো না– সুমতি ধমকে উঠলেন; রুক্ষ গলায় বললেন, ভগবান তোমায় কোলে বসিয়ে দুধ-ভাত খাওয়াবে! যেমন কর্ম করেছ তার ফল ভোগ করছ! ভগবানকে ঝেটা মেরে লাভ কী।
শিবশংকর মুখ নিচু করে নিলেন। মাটির ভাঁড়ে ছাই দেখছিলেন।
একটু চুপ করে থেকে সুমতি বললেন, ভদ্রলোকের মতন তো থাকোনি, থাকলে অদৃষ্টে এমন হত না। ঘটকবাবুর মতন তুমিও চাকরি করতে পারতে। আরও দু এক বছর থাকত রিটায়ার করার। ব্যাঙ্কের চাকরি এখন রাজার চাকরি। কত রকম সুবিধে। বাড়ি আমারও হতে পারত। ..নাও, যেমন কর্ম করেছ। এখন তার ফল ভোগো।
শিবশংকর মুখ ফসকে বললেন, পুরনো কথা সকলেই ভুলে যায়।
মানে? সুমতি খেপে উঠলেন। ভুলে যায় মানে কী! তুমি বলতে চাইছ, বিয়ের পর আমায় কত সুখে রেখেছিলে–এই তো? মুখে রাজভোগ তুলে দিয়েছ, না? লজ্জা করে না তোমার বলতে। বিয়ের পর রেখেছিলে তো এক দশ ঘরের বাড়িতে। দেড়খানা ঘরে বন্দি থেকে ঝিয়ের মতন সারাদিন তোমাদের সংসারে গতর দিয়ে খেটেছি আর ছেলেপুলে নিয়ে নেটা ঝামটা খেয়েছি।
শিবশংকর কথা থামাবার জন্যে বিব্রত হয়ে উঠলেন। না না, আমি তা বলিনি।
বলোনি আবার কী! গোড়াটা ভুলে যাও। বলার সময় কবে গোঁফে আতর মেখেছিলে সে-গন্ধ আমায় শোঁকাতে এসেছ! কে তোমায় আতর মাখতে বলেছিল! যেমন ছিলে তেমন থাকলেই পারতে। আমি কি তোমায় মানিকতলার বাড়ি ভাড়া করতে পায়ে ধরেছিলাম! তুমি তোমার মা বোনের জন্যে করেছিলে, আমার জন্যে নয়। তখন ভেবেছিলে পয়সা কামাচ্ছ, আর কী! খাও দাও, বগল বাজাও…। চাল চালিয়াতির কমতি তো করোনি। সে তুমি করেছ, তোমার মায়ের ঘটা করে শ্রাদ্ধ করেছ, বোনের চোখের জল মুছিয়েছ! আমার কী করেছ? দুটো গয়না গড়িয়ে দিয়েছিলে! সে গয়নাও তোমাদের জন্যে বেচে তোমাদের পেটে দিয়েছি।
শিবশংকর আর কথা বললেন না।
বোধন চা নিয়ে এল। রাখল টেবিলে। বাবা অধোবদন হয়ে বসে আছে। লজ্জা, কুণ্ঠা নতুন করে আর বাবাকে আড়ষ্ট করে না। বাবা এমনিতেই আড়ষ্ট। প্রত্যহ দুবেলা বাবা এই দীনতা সহ্য করে নির্বিকার, সহিষ্ণু হয়ে উঠেছে। বাবার অধোবদন মূর্তিটা এখন নাটকের দৃশ্যের মতন মনে হয়, যেন এই ভঙ্গিটুকু এই মুহূর্তের মানানসই ভঙ্গি। বোধন দুঃখের চেয়ে যেন বিরক্ত এবং ক্রুদ্ধ হল। বাবা কেন নিজেকে বাঁচাতে পারে না! কেন এত নির্বিকার, সহিষ্ণু! অচেতন।
তোমায় চা দেব? বোধন বলল মাকে।
না।
চা রেখেছি।
কাপড় না ছেড়ে খাব না।
বোধন মুখের সামনে দাঁড়িয়ে থাকার জন্যে বোধ হয় সুমতি আপাতত থেমে গেলেন। তাঁর সমস্ত মুখে বিরক্তি, রাগ, উত্তেজনা।
সুমতি উঠে পড়লেন। ভেতরে ভেতরে রাগে ফুঁসছেন।
ঘরে গিয়ে সুমতি ডাকলেন, আলো দাও। একটা মোমবাতি ছিল অর্ধেক। র্যাকের ওপর ছিল। জ্বালিয়ে দিয়ে যাও।
বোধন র্যাক খুঁজল; পেল না। এদিক-ওদিক দেখল।
শিবশংকর খুব নিচু গলায় বললেন, এটা দিয়ে এসো। ছোট টেবিল বাতিটা ঘরে আছে–নিয়ে এসো জ্বালিয়ে নেব।
বোধন লণ্ঠন তুলে নিয়ে মার ঘরে গেল।
সুমতি অন্ধকারে শাড়িটা ছেড়ে ফেলেছেন। পরনে নোংরা, ময়লা সায়া। গায়ের জামাও খুলে ফেলে নীচের জামাটা খুলছিলেন। বিশাল জামা। নোংরা, চিট। দুর্গন্ধ ভেসে আসছিল মার শরীর থেকে, ময়লা আর ঘামের। বোধন মাকে দেখল। কী মোটা, বীভৎস চেহারা মার।
ছোট টেবিল-বাতিটা খুঁজে নিয়ে লণ্ঠন রেখে চলে আসছিল বোধন। শুনল, মা আপন মনে ঝাঁঝালো গলায় বলছে, এত মানুষ রোজ যায়, আমি কোন পোড়া কপাল নিয়ে বেঁচে আছি! আমি কেন যাই না! …একদিন যাব, তারপর দেখব–তোমরা কেমন চোখের জলে নাকের জলে হও।
কথাটা শুধু বাবাকে নয়, তাদের সকলকে শুনিয়ে বলা।
বোধন বাতি এনে টেবিলের ওপর রাখল। ছোট টেবিল বাতি। শিবশংকর দেশলাই জ্বেলে দিলেন। বাতি জ্বালিয়ে দিয়ে বোধন রান্নাঘরে গেল। তার চা ঠাণ্ডা হয়ে যাচ্ছে! গরম গরম খাবে ভেবেছিল। মার চা ঢাকা দিয়ে রাখল। বড়ি দুটো ঘরে। শার্টের পকেটে। খেয়ে নিতে হবে। বাড়িতে ঢুকলে মাথা আরও ধরে যায়।
রান্নাঘর থেকে চা নিয়ে বেরিয়ে আসছিল বোধন–মা একটা ময়লা শাড়ি গায়ে জড়িয়ে বাথরুমে যাচ্ছে। যেতে গিয়ে থামল, বাবার দিকে তাকাল। তারপর বোধনের দিকে।
আমার ব্যাগে মুড়ির ঠোঙা আছে। দাও তোমার বাবাকে।
সুমতি বাথরুমে চলে গেলেন লণ্ঠন হাতে করে।
বোধন টেবিলের ওপর চা রেখে মার ব্যাগ খুলল। সস্তা ফোম লেদারের ব্যাগ। অনেক পুরোনো। ময়লা হয়ে গিয়েছে, মুখের কাছটায় ভেঁড়া, কাঁধে ঝোলাবার স্ট্র্যাপটার একদিকে সেফটিপিন দেওয়া।
ব্যাগ খুলল বোধন। এক ঠোঙা মুড়ি।
মা মাঝে মাঝেই অফিস থেকে ফেরার সময় ওই পাড়া থেকে ঝালমুড়ি, ভুট্টা, বাদামভাজা, কাঁচা পেয়ারা টুকটাক নিয়ে আসে। ঝালমুড়িটা প্রায়ই। ওটাই সন্ধের জলখাবার। অন্য কোনও জলখাবার থাকে না।
বোধন ঝালমুড়ির ঠোঙাটা বাবার সামনে রাখল।
শিবশংকর মাথা নাড়লেন। খাবেন না।
বোধন বুঝতে পারল। ভাবল একটু। ঠোঙা খুলে নিজে এক মুঠো নিয়ে মুখে দিল।
ভাল করেছে। বোধন বলল।
শিবশংকর কিছু বললেন না।
বাথরুমে মা জল ঢালছে। গা ধুচ্ছে। গা ধুয়ে সামান্য জিরাবে, তারপর রাত্রের সামান্য কিছু রান্না।
লোকটা মাকে খুব খাতির করে ঝালমুড়ি করে দেয়, বোধন আর এক মুঠো নিল। সে চাইছিল, বাবা দু মুঠো খাক। যদি না খায়, মা আবার যে কী করবে কে জানে!
শিবশংকর কিছুই বললেন না। তাঁর বসা বিষণ্ণ চোখ যেন ছলছল করছিল।
বোধন খুব মৃদু গলায় বলল, মা চটে যাবে। একটু খাও।
শিবশংকর মাথা নাড়লেন। তিনি খাবেন না।
.
০৮.
বিনু এক হাতে অনেকগুলো চুড়ি পরেছিল। তার রোগা লিকলিকে হাতে চুড়িগুলো ঢলঢল করছে। হাত নাড়লেই শব্দ হচ্ছিল। ইচ্ছে করেই শব্দ করছিল বিনু।
বোধন বলল, এত চুড়ি পরেছ কেন? ঠাট্টা করেই বলল।
ইচ্ছে হল।
তোমার?
বিনু ভুরু বেঁকাল যতটা পারে, আমার কত সোনা আছে, জানো?
বোধন হেসে ফেলল। না। কত?
পঁচিশ ভরি। …এসব আমার বাবার দেওয়া।
বোধন এবার খানিকটা অবাক হল। বলল, তোমার হাতে অত বড় বড় দেখাচ্ছে।
মার হাতের মাপে তখন হয়েছিল। করিয়ে রেখেছিল বাবা। বড় হয়ে আমি পরব।
আচ্ছা!
বিনু তার মেয়েলি গরম ভেস্টটা আলগা করল। কাল পরশু শীত পড়ল। আজ আবার কমে গেল। আমার গরম গরম লাগছে।
বোধনের লাগছিল না। বিনুর লাগতে পারে গরম। দু তিন প্রস্থ জামা। বোধনের জামার তলায় গেঞ্জিও নেই। ঠাট্টা করে বোধন বলল, সোনার গরম।
বিনু এবার আড়চোখ করে বোধনকে দেখল! হাসি হাসি ঠোঁট। বলল, এ আর কী গরম! পরে দেখবে।
বোধন মাথা চুলকে নিল। রগড় করেই। তারপর বলল, নাও, অঙ্কটা করো।
বিনু ডট পেন ফেলে দিয়ে দু হাত ছড়িয়ে আলস্য ভাঙল। তুমি অত মাস্টারি কোরো না তো! কী হবে অঙ্ক করে! একটা গাড়ি যত জোরে যায়–যাক। আমার বয়েই গেল! ভেলোসিটির নিকুচি করেছে।
বাঃ, পড়বে না?
ধ্যুত, পড়ে ঘোড়ার ডিম হবে। …ভাল লাগে না।
কী করবে তবে? বোধন সরলভাবে বলল, হালকা গলায়।
বিনু চোখ বুজে ভাবল যেন, তারপর বলল, বিয়ে।
বোধন থমকে গিয়েছিল, পরে হেসে উঠল! জোরে, বেশ জোরে।
বিনু বলল, হাসছ কেন! বিয়ে তো আমার ঠিকই করা আছে।
বোধনের হাসি তখনও থামেনি। কোথায়?
দিল্লিতে। …আমরা আগে দিল্লিতে ছিলাম জানো তো? বাবা মারা যাবার পরও কিছুদিন ছিলাম। তারপর কাকা কানপুরে এল। সেখান থেকে কলকাতায়।
না-জানার কারণ নেই বোধনের। এসব কথা তো উঠেই থাকে যখন-তখন। বিনু এখনও দু চারটে হিন্দি বুলি মিশিয়ে দেয় বাংলার সঙ্গে। দিল্লিতে বছর সাত পর্যন্ত ছিল বিনু। তারপর কানপুরে তিন চার বছর। শেষে কলকাতায়। তিন জায়গার জল বিনুকে আর যাই করুক পড়াশোনায় মতি দেয়নি।
বোধন মজার গলায় বলল, তোমার কি দিল্লিতেই বিয়ে হচ্ছে?
বিন্দুমাত্র আড়ষ্ট হল না বিনু, যেন তার কোনও মেয়ে বন্ধুর সঙ্গে ব্যক্তিগত কথা বলছে, বলল, হচ্ছে তো! রাজুর পড়াশোনা সব শেষ। চাকরিও পেয়ে গিয়েছে। এখনই আয় নশো। চণ্ডিগড়ে পাঠিয়ে দিলে আরও বাড়বে, কোয়ার্টার পাবে।
বোধন অবাক হয়ে যাচ্ছিল। বিনু বরাবরই সাদামাটা, সরল, সোজাসুজি কথা বলে। কিন্তু নিজের বিয়ের কথা, যে ছেলের সঙ্গে বিয়ে হবে তার কথা যেভাবে বলছিল এমন করে কোনও মেয়ে বলতে পারে কোনও ছেলের সামনে সে জানত না। বিনু কি সত্যি কথা বলছে? মিথ্যেই বা কেন বলবে? বোধনের কেমন কৌতূহল হল। যে-ছেলেটির কথা বলল বিনু সে নিশ্চয় বিনুর চেনাজানা। কতটা চেনাজানা?
চেনা ছেলের সঙ্গে বিয়ে হচ্ছে তবে? বোধন সরল গলা করে বলল।
বাঃ, আমার ইনু মাসির ছেলে তো রাজু। একসঙ্গে খেলেছি, ঘুরে বেরিয়েছি। রাজু কানপুরে এসেছে দু বার। কলকাতায় একবার। কলকাতা একেবারে লাইক করে না।
বোধন খানিকটা ঘাবড়ে গেল। মাসির ছেলের সঙ্গে বিয়ে হয় কী করে? নিশ্চয় নিজের মাসি নয়। কিংবা হতেও পারে। আজকাল কত কী লোকে মানে না।
বইয়ের পাতা ওলটাল বোধন অকারণে। হাসল। আজ কি তাহলে তোমার বিয়ের গল্পই হবে? অঙ্কটা করবে না?
মাথা নাড়ল বিনু। ভাল লাগছে না।
বিয়ের তো দেরি আছে, বোধন মজা করে বলল।
না না, কে বলল। জানুয়ারির লাস্টেই হয়তো বিয়ে। বলে বিনু হাতের চুড়ি দেখাল। এই সব চুড়ি ভেঙে আবার গড়তে দেওয়া হবে। সেই জন্যেই তো পরেছি। দুদিন বাড়িতে পরে নিই।
বোধন বই বন্ধ করল। তা হলে আর আমি বসে থেকে কী করব? উঠি?
ইস! উঠবে মানে! মা ফিরুক। বিনু ভুরু কোঁচকাল।
মাসিমা কোথায় গেলেন?
সামনের বাড়িতে। লম্বুর বউয়ের শরীর খারাপ হয়েছে–ডাকতে এসেছিল লম্বুর মা।
লম্বু? লম্বুটা কে?
লম্বুকে চেন না? ও-বাড়ির ছেলে। বাঁশের মতন লম্বা। আমরা লম্বু বলি।
বোধন গলা ছেড়ে হো হো করে হেসে উঠল। ফণীদার দারুণ নাম দিয়েছে তো বিনু।
বোধন বলল, ফণীদা শুনলে তোমায় মারবে।
একেবারেই নয়! লম্বুদা আমার কত ভালবাসে। দেখলেই হাসে।
বোধন কথা পালটাল। মাসিমা অনেকক্ষণ গিয়েছেন।
আসবে এখুনি। বোসোনা। যাবে কোথায়? বলে বিনুকী ভেবে আচমকা জিজ্ঞেস করল, আচ্ছা, তুমি এই সন্ধেবেলাটা ঠিক করে নিলে কেন? সকালে কী কর?
বোধন খানিকটা অবাক হল। বলল, আমি ঠিক করব কেন! তোমরাই করেছ! মাসিমা বললে, শীতের দিন, সকালে হুড়োহুড়ি হয়, তোমার কলেজ থাকে…।
বিনু বললে, আর সন্ধেবেলায় লোডশেডিং হয়…।
হয় তো! মাঝে মাঝে দু চার দিন ভাল থাকে একটু, আবার হয়। আজ এখনও হয়নি।
টুকলে তো! এই বার হবে।
হতে পারে যে বোধন জানে। লোডশেডিং হলে বিনু একটা বড় টেবিল ল্যাম্প এনে টেবিলে বসিয়ে দেবে। কাকা কিনে এনেছেন চাঁদনি থেকে। বাতিটা দেখতেই বড়। আলো তেমন হয় না। পড়াশোনার গরজ এমনিতেই বিনুর নেই, আলো চলে গেলে একেবারেই থাকে না। তখন শুধু আজেবাজে গল্প। বোধনের নিজের তাতে আক্ষেপের কিছু নেই। সে এত কম বোঝে যে পড়ানোর ব্যাপারটা যত কম হয় ততই তার সুবিধে।
বিনু সামান্য চুপচাপ ছিল। এবার বলল, মা খানিকটা ভিতু গোছের। কাকার ফিরতে দু তিন দিন দেরি হয়। বুধবার শুক্রবার তো হবেই। তোমায় মা এই সময়টায় সন্ধেবেলায় হাতছাড়া করতে চায় না।
কথাটা বোধনের কানে লাগল। কেন! তুমি তো বাড়িতেই থাকো!
দূর, আমার ওপর কি ডিপেন্ড করা যায়! মার ওই রকম হলে আমিই ভয় পেয়ে যাই।
বোধন জানে, এর মধ্যেও বিনুর মার আবার একদিন ফিট হয়েছিল। রাত্রে! বিনুর কাছে শুনেছে। তারপর আর হয়নি, বলল, রোগটা সারানো যায় না?
কই! সারছে কই! আগে আরও বেশি বেশি হত। যখন-তখন। বাবা মারা যাবার পর থেকেই শুরু। কাকা আগে তো আমাদের বাড়িতে ঠিক থাকত না। কাছাকাছি থাকত। বাবা মারা যাবার পর আমাদের সঙ্গে থাকে। কাকাই মার সব দেখাশোনা করত। মা তখন যেখানে সেখানে ফিট হত। খেতে বসে, বাথরুমে, কাজ করতে করতে…! মুখে থুতু উঠত গেঁজার মতন, মুখ নীল হয়ে যেত। কত ওষুধপত্র খেয়েছে। কিছু হয়নি।
বড় বাজে রোগ। তোমায় বলেছি না, আমার পিসির হত। বিধবা হয়ে এল পিসি তার পর থেকেই। মেয়েদেরই হয় এটা।
হয়! মার আগে যত হত, এখন আর হয় না। বয়েস বাড়লে নাকি কমে যায়। মা তখন ছিপছিপে ছিল। এখন তো মোটাসোটা হয়ে গিয়েছে। রোগা শরীরেই নাকি বেশি হয়। তখন কিন্তু ফিটের পর এত শরীর খারাপ হত না। আজকাল হয় কম, কিন্তু একবার হলে একদিন দেড়দিন সামলে উঠতে লাগে।
বোধন কোনও কথা বলল না। বিনুর মার ফিট হয়ে পড়ে থাকার দৃশ্য আবার তার চোখের মধ্যে ভাসতে লাগল। এলোমেলো শাড়ি, বুকে কাপড় নেই, জামা ভিজে, নীচের জামা আঁট হয়ে আছে।
আচমকা বোধনের মনে হল, সে যা মনে মনে দেখছে বিনু যেন তা বুঝতে পেরে তার দিকে তাকিয়ে আছে। বোধন তাড়াতাড়ি বলল, পিসিকে দেখতাম একাদশী-টেকাদশী হলেই এ-রকম বেশি হত। বোধ হয় উইকনেসের জন্যে।
বিনু মাথা নাড়ল! মা একাদশী করে না! …মার অন্য ব্যাপারে হয়। বেশি ভাবলে, রাগ হলে, দুশ্চিন্তা করলে। মা বড় অদ্ভুত। কখনও চেঁচামেচি করবে না, ছটফট করবে না, যা হবে সব পুষে রাখবে। তারপরই ওই রকম। সেদিন তো তাই হল। আমার বড় ডাক্তার দেখাবার কথা উঠল। কাকা নানা করছিল; কাজ ছিল কাকার। মা রেগে গেল। কাকা তখন বলল, বেশ ব্যবস্থা করবে।
বোধন এই খবরটা জানত না।
বিনু আপন মনে হাত থেকে চুড়ি খুলতে লাগল। এক হাত থেকে খুলে অন্য হাতে পরছিল। নিচু মুখেই বলল, একটা কথা বলছি কাউকে বলবে না?
বোধন অবাক।
প্রমিস করো।
করলাম।
বিনু অর্ধেক চুড়ি অন্য হাতে পরে নিল। মা আমার তাড়াতাড়ি বিয়ে দিয়ে দিতে চায় এই জন্যেই। রাজু আমায় দেখবে। খুব ভাল রাজু। আমায় কী যে ভালবাসে!
বোধন বিনুর মুখ দেখছিল। রোগা, কালচে মুখ, টানা টানা চোখ, কিন্তু কী সুন্দর দেখাচ্ছে বিনুকে। সারা মুখে মালিন্য নেই, জটিলতা নেই, একেবারে সরল, স্নিগ্ধ।
বিনু কেন যেন মুখ নামিয়ে নিল, বলল, আমাদের অনেক ইয়ে রয়েছে। তুমি বুঝবে না। মা আমার বিয়ে দিয়ে নিশ্চিন্ত হতে চায়। আমার বিয়ে হয়ে গেলে মার মাথা থেকে বোঝা নেমে যাবে। মা বাঁচবে।
বোধন চুপ করে থাকল। সে এ বাড়িতে আসা-যাওয়া করতে করতে অনেক কিছু দেখছে। অনুমান করতে পারছে। নিজেকে সামলে নিয়ে বোধন বড় করে নিশ্বাস ফেলল। তারপর খানিকটা যেন ঠাট্টার গলায় বলল, তোমার বিয়ে হয়ে গেলে আমার লোকসান হবে। ফাঁকিতে পঞ্চাশটা টাকা পাচ্ছিলাম। আর পাব না।
বিনু বলল, পাবে না। আর কাকাও তোমায় কোনওদিন চাকরি করিয়ে দেবে না। কাকা পারে, তবু দেবে না। মা কাউকে এতটুকু ভালবাসলে কাকা সহ্য করতে পারে না।
বোধন বিনুকে অপলকে দেখছিল।
.
০৯.
সুমতি হাত বাড়িয়ে টাকা দিলেন।
বোধন অবাক হয়ে গেল। মা ভুল করেনি তো?
কোলের ওপর ব্যাগ রেখেই সুমতি আবার একবার ছোট করে হাই তুললেন। চোখের তলা ছল ছল করছে। পাতা ফোলা। মুখটাও ফুলে আছে।
বোধন টাকাটা দেখছিল। পঞ্চাশ টাকার নোট। বাজারের জন্যে পাঁচ টাকাই বরাদ্দ, কোনওদিন বাড়তি কিছু আনতে হলে দু-এক টাকা বাড়ে। আবার যখন টানাটানি থাকে তখন কমেও যায়।
সুমতি বাকি চাটুকু খেয়ে নিলেন।
মুদির দোকানে যেতে হবে। মুখে বলব,না লিখে নিবি? সুমতি বললেন।
মনে থাকবে, বলো।
সুমতি বলতে লাগলেন: তেল, মুগের ডাল, আখের গুড়, গায়েমাখা সাবান একটা, সস্তার কাপড় কাঁচা গুঁড়ো সাবান, একশো সোড়া, এক প্যাকেট ধূপ।
মুদি শেষ করে সবজি বাজারের ফর্দ ধরলেন সুমতি। আলু, আদার পরই জিজ্ঞেস করলেন, গাঁয়ের চাষিদের কাছ থেকে একটা ফুলকপি নিতে পারবি না? তোরা দরদাম করতে পারিস না। রেবারা টালিগঞ্জ বাজারে এক টাকা পাঁচ সিকেতে কপি কেনে! শীত পড়ে গেল, এখনও কপির অত দাম হবে কেন?
বোধনের হাসি পাচ্ছিল। মা শাকসবজি যখনই কিছু আলাদা করে আনতে বলে–গাঁয়ের চাষিদের কথা মনে করিয়ে দেয়। চাষিরা তো গাঁয়েরই, কলকাতার কবে হল? তবে এ গাঁ তো খালের পাশে, না হয় নারায়ণপুর আর কেষ্টপুর। তারা চালাক হয়ে গিয়েছে।
সবজি বাজারের ফর্দ মা আরও টুকটাক বলল। দেখিস না যদি চিংড়ি মাছ পাস। ঘোট ঘোট বাগদা!
অনেক দাম নেবে। বোধন বলল, আঠারো কুড়ি।
তোদের কাছে সবাই দাম নেয়। রেবা বলছিল, বারো চোদ্দ করে বেচে তাদের বাজারে। এ বাজারে কি সবই গলাকাটা…?
মা, তোমার সব কিছুতেই রেবা, চুয়া বলল, সামান্য বিরক্ত হয়েই, কাছেই ছিল চুয়া, রেবা মাসি পাঁচ বললে পাঁচ, সাত বললে সাত। টালিগঞ্জের বাজারটা কি রেবা-মার্কেট! নিজে একদিন বাজারে গিয়ে দেখো না…।
মেয়ের বিরক্তি সত্ত্বেও সুমতি রাগ করলেন না। বললেন, ওদের দিকের বাজার ভাল। সস্তা। এখানে সব ডাকাত।
শিবশংকর খবরের কাগজের পাতা ওল্টাচ্ছিলেন। আজ রবিবার। অন্যদিন পাঠকবাবু কাগজ পড়া শেষ করে অনেকটা বেলার দিকে পাঠিয়ে দেন শিবশংকরকে। চোখ বুলিয়ে ঘণ্টা খানেক পরে সেটা ফেরত পাঠাতে হয়। টানাটানির সংসারে সুমতি খবরের কাগজের জন্যে বাড়তি খরচ করতে নারাজ। শিবশংকর যে ক্রস ওয়ার্ডের জন্যে ইংরেজি কাগজ কেনেন সেটা ছেলেমেয়ের কাছে চেয়ে চিন্তে। স্ত্রীর মন বুঝে যে দু-এক টাকা না নেন তাও নয়। এনট্রি ফি-র বেলাতেও তাই।
রবিবারের কাগজের ব্যাপারটা আলাদা। ওটা বোধনের।
কাগজ পড়তে পড়তে শিবশংকর বললেন, চিংড়ি মাছ এখন ফরেনে চালান যাচ্ছে। বাজারে মাছ আসবে কোথায়? ক বছর আগেও সাত-আট টাকায় ভাল বাগদা, দশ টাকায় গলদা পাওয়া যেত মানিকতলা বাজারে। বলে স্ত্রীর দিকে তাকালেন।
সুমতি বললেন, সবই বিদেশে যাচ্ছে; এ-দেশে আর থাকছে কী! ভাবলে মাথা গরম হয়ে যায়। …হ্যাঁ গো, তোমার মনে আছে–যে বছরে আমরা রাজকেষ্টবাবুদের বাড়ি ভাড়া নিলাম–তখন চার পাঁচ টাকায় অঢেল বাজার হত না? পাঁচ ছ জনের সংসার দুবেলা হেসেখেলে চলে যেত। চার টাকা সাড়ে চার টাকায় বড় বড় পারসে মাছ, সোয়া তিন টাকায় সরষের তেল কিনেছি, খাঁটি তেল, চিনি সাত সিকে। আর এখন–যেমন কয়লা তেমনি তেল ডাল চিনি, সেই রকম শাকসবজি। মানুষ বাঁচবে কী করে?
বাঁচাতে চাইছে না তো বাঁচবে! শিবশংকর বললেন।
বোধন কদাচিৎ, কালেভদ্রে মাকে এমন সহজ,নরম, শান্ত মেজাজে দেখতে পায়। ঘুম থেকে উঠেও মার মুখচোখ প্রসন্ন থাকে না, কেমন এক বিরক্তি, অবসাদ, রুক্ষতা নিয়ে দিন শুরু করে মা, সারাদিন সেটা বাড়ে–বেড়েই যায়–জ্বর বাড়ার মতন, তারপর রাত্রে মা প্রায় বিকারগ্রস্ত রোগীর মতন হয়ে থাকে। আজ মা অন্য রকম। কেন কে জানে! বোধনের ভাল লাগছিল।
সুমতি মেয়েকে বাজার আর মুদিখানার জিনিসপত্র গুছিয়ে দিতে বললেন। একসঙ্গে আনবি, না আলাদা আলাদা!
একসঙ্গেই আনি, বোধন বলল। তেল, ডাল, সাবান–মুদিখানার ফর্দ যতই হোক–সবই দুশো আড়াইশো গ্রামের ব্যাপার, কাজেই অসুবিধের কিছু নেই। এবাড়িতে এভাবেই জিনিসপত্র আসে, দিন দুই তিন চলার মতন। মাসকাবারি বাজার আগে আসত, বাবার আমলে। এখন আর কেমন করে আসবে!
চুয়া রান্নাঘর থেকে সরষের তেলের শিশি, গুড় আনার জন্যে ছোট টিফিন কৌটো, এটা-ওটা এনে বাজারের থলি সমেত বোধনের হাতে দিল।
চা কিন্তু নেই আর, চুয়া বলল।
চা আনিস, সুমতি মাথার চুল মুঠো করে এনে নাকে গন্ধ শুকলেন, নিজেই নাক কোঁচকালেন। একশো বেসম আনিস তো খোকা, মাথা ঘষব!
বোধন মার চুল দেখছিল। কত চুল পেকে গিয়েছে মার। এখন বুড়ি বুড়ি মনে হয়। অথচ এমন কি বয়েস মার! পঁয়তাল্লিশ ছেচল্লিশ হবে। বিনুর মা মার একেবারে সমবয়সী না হলেও কাছাকাছি তো নিশ্চয়। অথচ বিনুর মার পাশে মাকে অনেক বড় দেখাবে! সচ্ছলতা আর নেই নেই-এর এই তফাত বোধ হয়। একজন যতটা সম্ভব নিজেকে রাখতে পারে, অন্য জন পারে না।
বোধন চলে যাচ্ছিল, শিবশংকর স্ত্রীর দিকে তাকালেন, পাঁচটা সিগারেট হবে না?
সুমতি প্রথমে স্বামীর দিকে তাকালেন–তারপর ছেলের দিকে। তোর বাবার ভিক্ষে চাওয়ার বহর দেখছিস! আনিস। একটা গোটা প্যাকেটই আনিস। .. বলে আবার স্বামীর দিকে তাকালেন, তুমি চুরুট খেতে পারো না? আমাদের ক্যাশের দাসবাবু ছোট ছোট চুরুট খায়। পাঁচ পয়সা না কত যেন। দিনে তিন চারটেতেই কুলিয়ে যায়। তোমার যত বিড়ি-ফিড়ির নেশা। তাও আবার নিবিয়ে নিবিয়ে খাওয়া। কী দুর্গন্ধ। অতই যদি নেশার প্রাণ–পান-জরদা খাও। খোকা, পান আনবি, সুপুরি। অর্ধেক দিন মুখে পান দিতে পারি না।
বোধন আর দাঁড়াল না। বেলা হয়ে যাচ্ছে। আজ রবিবার। সবাই হেলেদুলে বাজারে যাবে। মাংসের দোকানে লাইন মারবে, মাছ নিয়ে কাড়াকাড়ি করবে, কপি কিনবে উবু হয়ে বসে, বেগুন টিপবে। খাবার শখ সকলেরই। সাধ্যও অনেকের আছে নিশ্চয়, নয়তো দামের জিনিস বিকোয় কেমন করে? ঘুষবাবুরা সংখ্যায় বাড়ছে মানুষ বাড়ার মতন। একটা স্ট্যাটিসটিক্স থাকলে হত। গভর্নমেন্ট কেন ঘুষবাবু ওভারটাইম বাবুদের হিসাব রাখে না।
দোতলা থেকে বোধন নীচে নেমে গেল।
পঞ্চাশটা টাকা মা ঝপ করে বের করে দিল এটাই আশ্চর্যের। কোথথেকে পেল মা। পরশু দিনও বলেছিল, তিন মাসের ভাড়া বাকি পড়ে গেছে। সরকারি বাড়ি বলে কোনও তাগাদা নেই। এখানে অনেকে পাঁচ সাত এমনকী এক বছরের ভাড়া বাকি রেখেও দিব্যি বসে আছে। গ্রাহ্যই করে না। ভাবটা এমন, সরকারি বাড়ির আবার ভাড়া কী? কাগজে মাঝেমাঝে বেরোয় লাখ কয়েক টাকা নাকি বাকি পড়ে আছে গভর্নমেন্টের হাউসিংয়ে। বেড়ে আছে সব। গৌরী সেনের বাচ্চা।
মা এতটা সাহস পায় না। সামান্য চাকরি, সহায় বলতে কেউ নেই, মাস কয়েকের ভাড়া যদি জমে যায় আর দেওয়া হবে না। তখন যদি তাড়িয়ে দেয় বাড়ি থেকে একেবারে রাস্তায়।
এই পঞ্চাশটা টাকা মা নিশ্চয় বাড়তি পেয়েছে। কখন কোথায় টাকা কেটেছিল ফেরত দিয়েছে, কিংবা বাড়তি ডি-এ পেয়েছে হুট করে। হয়তো আরও পেয়েছে কিছু। এরকম দু-চার বার মার বরাতে জুটে যায়।
টাকা হাতে এসেছে বলে কি মার মন ভাল? না, তা মনে হয় না। অন্য কারণে হতে পারে, বা এমনিও হতে পারে। প্রত্যহ দুবেলা মানুষ কত আর মন মুষড়ে থাকবে। বোধনদেরও তো এক একদিন মন বেশ ভাল থাকে। অথচ তার কি মন ভাল থাকার কথা?
বোধন?
দাঁড়াল বোধন। তাকাল। গৌরাঙ্গ।
দেখতেই পাস না? গৌরাঙ্গ বলল, তোর জন্যেই দাঁড়িয়ে আছি।
দারুণ চড়িয়েছিস! বোধন হাসল। গৌরাঙ্গ হালকা সবুজ আর হলুদ মেশানো সোয়েটার চাপিয়েছে গায়ে। পুরো হাতা। খুব শীত পড়ে গেছে, তাই না? বোধন ঠাট্টা করল।
নারে, শো দিচ্ছি।
দে।
চা চলবে?
চলতে পারত। কিন্তু বাজার? দেখছিস তো?
রাখ। দশ মিনিটে তোর বাজার উঠে যাবে না। চল, মেঘার দোকান থেকে দু গ্লাস মেরেনি। তোর সঙ্গে কথা আছে।
কিছু আসে যায় না পাঁচ দশ মিনিটে। আজ রবিবার। মার কোনও তাড়া নেই। নিজের হাতে সব রান্নাবান্না করবে। অন্য দিন তাড়াহুড়োর মাথায় কিছু মা রান্না করে, কিছু চুয়া। জবাদিও করে দেয়। আজ জবাদি নীচের তলা থেকে ফিরে এলে কাজকর্ম শুরু হবে সংসারের। বাটনা বাটা, তরকারি কোটা জবাদি সামাল দেবে মাকে। চুয়া বসবে কাপড় কাঁচা নিয়ে। আজ মা আর চুয়ার শাড়ি, জামা, সায়া কাঁচার দিন। তার সঙ্গে টুকটাক আছে। মুশকিল হল এ বাড়িতে কাপড় জামা শুকোতে দেবার জায়গা নেই। হয় ছাদে যাও, না হয় খাবার জায়গাটুকুতে কিংবা জানলার শিক বেঁধে ঝুলিয়ে দাও। বড় বিশ্রী ব্যাপার।
মেঘার চায়ের দোকানে চা খেয়ে বোধন আর গৌরাঙ্গ সামান্য তফাতে দাঁড়াল। রাস্তার ওপর বেঞ্চি ভরতি, এদিক-ওদিকেও চায়ের খদ্দের দাঁড়িয়ে।
গৌরাঙ্গ বলল, তোকে একটা খবর দি। বলাইবাবু-কে চিনিস তো?
বলাই সিংহ?
মাথা নাড়ল গৌরাঙ্গ। কাল একটা দরকারে বলাইবাবুর কাছে গিয়েছিলাম। আমাদের একটা কেস ওঁর কাছে পড়ে আছে চার মাস ধরে। তা কথায় কথায় বলাইবাবু বললেন, ওঁদের ফার্মে ঝামেলা বেঁধে আছে। জনা দুয়েক লোককে হটাবেন। তারা গণ্ডগোল করছে বড়। উনি আমার চেনা-জানা ভাল লোকের কথা বললেন। পাড়ার ছেলে-ছোকরা হলে ভাল হয়। বললেন, আমার ছোট অফিস। চাকরি যদি দিতে হয়–আমি চেনাশোনা পাড়ার ছেলেকে দেব। তাতে আমার স্যাটিসফেকশন আছে। …তোর কথা আমার তখনই মনে পড়ল।
বোধন পাড়ার বলাই সিংহীকে চেনে। তাঁর অফিস আছে তাও শুনেছে। কিন্তু কীসের অফিস জানে না। বলল, বলাই সিংহীর কিসের অফিস?
ক্লেম রিকভারি। মেইনলি ওরা রেলের সঙ্গে কাজ করে। রেলের কাছে পাওনা ক্লেম আদায় করে দেয়। গভর্নমেন্ট ক্লেমও করে।
বোধন তেমন কিছু বুঝল না। বলল, আমায় চাকরি দেবে কেন?
কেন দেবে না? তুই কোয়ালিফায়েড। স্কুল ফাইন্যাল পাশ করেনি এমন লোক দিয়েও কাজ চালায় যখন তখন তোর কেন হবে না? তা ছাড়া তুই পাড়ার ছেলে। তোর কোনও বাজে ব্যাপার নেই। সবাই বলবে, তুই শালা গুড বয়।
বোধন হাসল। গুড বয়?
মেঘার দোকানের বাচ্চাটা চা দিল।
গৌরাঙ্গ চায়ে চুমুক দিয়ে বলল, আমি কথাটা বলি? যদি বলিস আজই সন্ধেবেলায় যেতে পারি বলাইবাবুর কাছে।
বেশ, বল। আমার আর কী! যা হয় একটা পেলেই হল।
মাইনে কিন্তু কম।
কত?
ঠিক জানি না। তবে ওয়ান টুয়েন্টি ফাইভ কি থার্টি ফাইভ হবে। অফিস লালবাজারের মুখে। কম মাইনের জন্যেই অফিসে গণ্ডগোল চলছে।
বোধন চা খেতে খেতে বলল, গণ্ডগোলের মধ্যে আমার ঢোকা কি উচিত হবে? তারপর আমাকেই ওরা দালাল বলবে। মারধোর করবে।
গৌরাঙ্গ তাচ্ছিল্যের মুখ করল। যা রে শালা, মারধোর করকে অত সোজা! মালিক যদি কাউকে তাড়ায় সে তারা বুঝবে। ইট ইজ নট ইওর ফল্টা…যাক গে, সে বলাইবাবু বুঝবে। তোর কী? তোকে চাকরি দিলে তুই করবি। না দিলে করবি না।
যুক্তিটা বোধন মেনে নিল। তার সত্যি কোনও দোষ থাকে না।
চা-খাওয়া শেষ হলে গৌরাঙ্গ তাকে সিগারেট দিল।
দু বন্ধু বাজারের দিকে হাঁটতে লাগল। গৌরাঙ্গ হঠাৎ বলল, পাড়ার খবর জানিস?
কেন, কী হয়েছে?
গণ্ডগোল চলছে! পলুদের ধরে নিয়ে গিয়েছিল পুলিশ। রজনীরা গিয়ে থানা থেকে ছাড়িয়ে এনেছে। এবার শান্তদের সঙ্গে লাগবে। ভেতরে টেনশন।
কবে ধরেছিল পলুদের?
পরশু রাত্তিরে। কাল সকালে ছেড়ে দিয়েছে।
শুনিনি। তবে পুলিশের গাড়ি কাল দেখছিলাম। বোধন দূরে তাকাল। বাজার দেখা যাচ্ছে। রাস্তায় এখন শুধু বাজার-যাত্রী।
গৌরাঙ্গ বলল, তুই ভেবে দেখ বোধন; এক শালা দমদম লাইনে ছিনতাই পার্টির লিডার। আরেক শুয়ারের বাচ্চা দুবার ডাকাতির কেসে ফেঁসেছে। দুই বানচোতই এখন পাড়ার লেতা। জমেছে ভাল।
বোধন হেসে বলল, বেশি বলিস না, তোকেই ফাঁসিয়ে দেবে!
যা রে শালা, আমায় কী ফাঁসাবে! …নে তুই আলু পটলে চলে যা–আমি একবার ঠনঠনিয়া যাব। মাসির বাড়ি। …তা হলে ওই কথা রইল। বলে হাত নেড়ে চলে যাচ্ছিল গৌরাঙ্গ, হঠাৎ ডাকল বোধনকে। বলল, তোর বোনকে বলবি, অত রাত করে যেন না ফেরে। বাস স্টপের পাশে তেঁতুলতলাটা ক্রিমিন্যালদের আড্ডা হয়ে গিয়েছে! সেদিন মিনিবাসে একসঙ্গে ফিরেছি। ওকে রিকশা করে নিয়ে এসেছি। …কোথায় যায় ও?
বোধন যেন ঘা খেল। থিয়েটারের শো ছিল বোধ হয়!
তোর বোন থিয়েটার করে! বলিস কী রে! জানতাম না তো!
.
বাজার থেকে বাড়ি ফিরে এসে বোধন দেখল, বাড়িতে খুব হাসাহাসি চলছে। মা হাসছে, বাবাও। চুয়াও হাসছিল। জবাদি মাথার কাপড় কপাল পর্যন্ত টেনে ঘর ঝাঁট দিচ্ছে। কী নিয়ে হাসাহাসি তা অবশ্য বোধন বুঝল না। কিন্তু এ বাড়িতে এমন উদোম হাসি নমাসে ছমাসেও বড় শোনা যায় না।
বোধন মুদির বাজার টেবিলের ওপর নামিয়ে রাখল, সবজি বাজার রেখে এল রান্নাঘরের কাছে।
সুমতি শাড়ি, সায়া একপাশে জড়ো করে রাখছিলেন। কাঁচাকাচিতে দেবেন। চুয়া জানলার কাছে দাঁড়িয়ে।
বোধন বলল, মা, আমি কিন্তু দেড় টাকা বেশি খরচা করে ফেলেছি। সেরকম মাছে এক টাকা বাঁচিয়েছি।
কী কিনেছিস?
সত্যনারায়ণ গরম শিঙাড়া ভাজছিল। জিলিপিও গরম ছিল। মিলিয়ে দেড় টাকার নিয়েছি। বোধন জানে মা গরম জিলিপি খেতে খুব ভালবাসে!
সুমতি বললেন, ভালই হয়েছে। বলে স্বামীকে দেখালেন, তোর বাবাকে খাওয়া। কী মানুষ নিয়ে ঘর করলাম ভগবানই জানেন।
বোধন কিছু বুঝল না। মা হাসি-খুশি মুখে কথা বলছে; রাগ নেই জ্বালা নেই, বরং চোখভরা কৌতুক।
কেন? বাবা?
সুমতি আঙুল দিয়ে টেবিলের দিকটা দেখালেন। তোর বাবা গায়ে দেবার শাল তৈরি করেছে। দেখ। চুয়া, দেখা তো খোকাকে।
চুয়া টেবিলের সামনের চেয়ার থেকে একটা রংচঙে কী তুলে নিল। নিয়ে উঁচু করে বুকের কাছে। নিয়ে মেলে ধরল। বোধন অবাক হয়ে দেখল, বাড়িতে যত পুরনো ছেঁড়া পেঁজা শাল ছিল বাবা তার আস্ত জায়গাটুকু কেটে নিয়ে অন্য শালের সঙ্গে জুড়েছে। বাদামি, কালো, সবুজ সব মিশিয়ে সে এক বিচিত্র চেহারা হয়েছে।
সুমতি হাসতে হাসতে বললেন, এই জিনিস গায়ে দিয়ে কাল শুয়েছিল। বলে বাড়িতে থাকে, ওটা গায়ে দিয়ে শীত কাটিয়ে দেবে।
বোধন হাসতে পারল না। শীত পড়ছে। মা কবেকার একটা রং-মরা মেয়েলি সস্তা শাল গায়ে জড়িয়ে অফিস যায়। বাবা খদ্দরের মোটা চাদর গায়ে জড়িয়ে বসে থাকে। বোধনের একটা কালো রংয়ের সোয়েটার আছে–যা আর পরা যায় না। আর চুয়া বাইরে আসা-যাওয়া করে বলে সেদিন একটা নতুন কী কিনেছে। সস্তার জিনিস। হয়তো তাকে কেউ দিয়েছে।
বাবা অব্যবহার্য পুরনো জিনিস জোগাড় করে শীত বাঁচাবার চেষ্টা করছে। সামনেই শীত। এই শীত কি যাবার?
.
১০.
বোধন ঘুমিয়ে পড়েছিল। ঘুম ভাঙার পরও তার মনে হচ্ছিল, এখন মাঝরাত। সবই অন্ধকার হয়ে আছে। মা বাবা তাদের ঘরে ঘুমোচ্ছে; বোধন নিজের ক্যাম্প খাটে শুয়ে। এই আচ্ছন্নতা কয়েক মুহূর্তের মধ্যে কেটে গেল, তাকাল বোধন। চুয়া শাড়ির পায়ের দিক ঠিক করে নিচ্ছে।
খেয়াল হল বোধনের, এখন দুপুর। হয়তো বিকেল হয়ে আসছে। সে চুয়ার বিছানায় শুয়ে কাগজপত্র পড়তে পড়তে ঘুমিয়ে পড়েছিল।
তেষ্টা পাচ্ছিল বোধনের। এক গ্লাস জল খাওয়াবি?
চুয়ার তখনও যেন কিছু বাকি। আমার দেরি হয়ে যাচ্ছে… বলতে বলতে বাইরে চলে গেল চুয়া।
বোধন শুয়েই থাকল। খাওয়া-দাওয়া শেষ করতে বেলা হয়েছে। মা আজ তিন চার রকম রান্না করছিল, সাধারণ রান্না। খেতে বেশ হয়েছিল। মাছ-টাছ মা একসময়ে সত্যি ভাল রাঁধত, এখন কালেভদ্রে সেরকম রাঁধে।
জল এনে দিল চুয়া।
বোধন উঠে বসল। জল খেল। কোথায় যাচ্ছিস?
আজ আমার টানা রিহার্সাল! চুয়া বলল। তাকের ওপর রাখা আয়নায় মুখ দেখতে দেখতে কপালের চুল ঠিক করল।
কোথায়?
অনেক দূর যেতে হবে–সেই ভবানীপুর, বলতে বলতে চুয়া মুখে একটু পাউডার মাখল, মুছল। কোথা থেকে লিপস্টিক বার করে ঠোঁট রং করতে লাগল।
তুই আজকাল লিপস্টিকও চালাস?
বা, ঠোঁট ফাটে না?
আজ কোন অফিসের থিয়েটার?
বললাম না রিহার্সাল। অফিসের নয়, আমাদের ক্লাবের।
তোর আবার কোন ক্লাব?
চুয়া নাম বলল। বোধন শোনেনি নামটা, জানেও না। তার কোনও আগ্রহ নেই জানার। বোধন বোনের সাজগোজ দেখছিল। মন্দ দেখাচ্ছে না চুয়াকে। পিঠময় চুল ছড়ানো। বিনুনি করেনি। শাড়িটা নির্ঘাত মার। চওড়া পাড়। পুরনো নিশ্চয়? মার একসময় ভাল ভাল শাড়ি ছিল, তার দু-একটা ছেঁড়া পেঁজা হয়েও থেকে গেছে এতদিন।
শোন, বোধন বলল, তুই একেবারেই রাত করে ফিরবি না। পাড়ায় একটা গণ্ডগোল বাধতে পারে। গৌরাঙ্গ বলছিল।
চুয়া লিপস্টিক রাখল। বাধলে আর কী করব! তা বলে সন্ধের মধ্যে বাড়ি ফিরতে পারব না।
বোধন বিরক্ত হল। কেন পারবি না? একটা ঝামেলার মধ্যে পড়ে গেলে তখন কী হবে?
চুয়া তৈরি। গায়ের শাল নিল। তার ব্যাগ। বলল, এত লোক আসছে যাচ্ছে তারা ঝামেলায় পড়ছে নাকি? অত ভয় করলে কলকাতায় চলাফেরা করা যায় না।
বোধনকে তেমন গ্রাহ্য করল না চুয়া, চলে গেল। সদর দিয়ে যাবার সময় চেঁচিয়ে বলল, জবাদি, দরজা বন্ধ করে দিয়ো৷।
বাড়িতে কারও গলা পাওয়া যাচ্ছে না। মা নিশ্চয় ঘুমোচ্ছ। বাবা কোথায়? বাবাও কি শুয়ে আছে? জবাদি বাসনপত্ৰ মাজতে বসেছে। বাসন মেজে, ঘর মুছে চলে যাবে জবাদি। কটা বাজল? এ-ঘরে ঘড়ি নেই। মার একটা টাইমপিস আছে। সেটা কোনও রকমে চলে। মার নিজেরও ঘড়ি নেই, বাবার একটা ঘড়ি ছিল। সেটা বোধ হয় কোনও সময়ে বেচে দেওয়া হয়েছে।
জানলার আলোর দিকে তাকিয়ে বোধন সময় অনুমানের চেষ্টা করল। শীতের দুপুর। আলো দেখে কিছু আন্দাজ করা যায় না। তবে তিনটে হবে। খাওয়াদাওয়া শেষ করতেই তো দেড়টা বেজে গিয়েছিল। তারপর এক দেড়ঘণ্টা নিশ্চয় কেটেছে।
তক্তপোশ ছেড়ে উঠে পড়ল বোধন। বাইরে এক নাগাড়ে কাক ডাকছে। মাঝে মাঝে চড়ুইয়ের কিচকিচ। জবাদি বাসন মাজছে, তার শব্দও এক আধবার কানে আসছে। একবার বাথরুম যেতে হবে। জবাদি বাসন মেজে না বেরুলে যাওয়া যাবে না।
বোধনের একটা সিগারেট খেতে ইচ্ছে হল। আজ যখন বাবার জন্যে এক প্যাকেট সস্তা সিগারেট কিনল বোধন তখন নিজের জন্যেও খুচরো তিনটে কিনেছিল। দুটো শেষ হয়েছে, একটা আছে। বাবা যদি না জেগে উঠে বাইরে এসে বসে থাকে এতক্ষণে বোধন একটা সিগারেট খেতে পারে জানলার সামনে দাঁড়িয়ে। দেশলাই রান্নাঘরে পাবে।
ঘরের বাইরে এল বোধন। খাবার জায়গাটায় আগাগোড়া শাড়ি সায়া জামা মেলা, শুকোচ্ছে সব। টেবিলটা আড়াল পড়ে গিয়েছে।
বোধন শুকনো, আধ-শুকনো জামা কাপড় সরিয়ে রান্নাঘরে গেল। জবাদি কল খুলে বাসন ধুচ্ছে। জল পড়ার শব্দ হচ্ছিল।
দেশলাই নিয়ে ফিরে আসার সময় বোধন দেখল, মার ঘরের দরজা অর্ধেক ভেজানো। বাবা এখনও ওঠেনি। দুপুরে বাবা বড় একটা ঘুমোয় না, শুয়ে থাকে, না হয় খুটখাট কিছু একটা করে। এখন কোনও রকম সাড়াশব্দ পাওয়া যাচ্ছে না।
আজ তারা সকলেই কার মুখ দেখে যে উঠেছিল কে জানে! এমন ভাল দিন যদি মাঝে মাঝে আসত তবু বোঝা যেত বাড়িতে কিছুটা শান্তি আছে। কিন্তু আসে কোথায়?
ঘরে এসে বোধন জামার পকেট থেকে সিগারেট বার করে ধরাল। ধরিয়ে জানলার সামনে গিয়ে দাঁড়িয়ে বাইরে তাকাল। রোদ একেবারেই জ্বলজ্বল করছে না; মানে, তাত নেই। রং আছে, আর খানিকটা পরে রং-ও মরে আসবে। নীচের মাঠটুকুতে মন্টু-টন্টুরা ক্রিকেট খেলছে। বাচ্চা বাচ্চা ছেলে। পাখিও ওদের সঙ্গে ভিড়ে গেছে। ফ্রক দুলিয়ে ছুটছে, বল কুড়োচ্ছ। হাসি পেল বোধনের। খেলুক। আজকাল মেয়েরাও ক্রিকেট ফুটবল খেলছে ভাল।
বাচ্চা বয়েসটাও বেশ ভাল। কোনও ঝাট ঝামেলা নেই, দুশ্চিন্তা নেই। বোধনরাও ওই বয়েসে শুধু নয় ওর চেয়েও বড় বয়েসে পাড়ার মধ্যে ক্রিকেট খেলছে। একবার তো তার বল লুফতে গিয়ে লাইট পোস্টের সঙ্গে ধাক্কা লেগে নাকই ফেটে গেল। গলগল করে রক্ত। কিছুতেই রক্ত বন্ধ হয় না। হাসপাতালে গিয়ে নাক প্লাগ করতে হল। মার সে কি অবস্থা তখন, ভয়ে তটস্থ, একদিকে কাঁদছে অন্য দিকে বোধনকে গালাগাল দিচ্ছে। বোধন তখন একেবারে কচি খোকাটি নয়, ক্লাস সেভেন এইটে পড়ে। মা ছেলেকে কোলের কাছে নিয়ে শুয়েছিল সারারাত। বাবা পরের দিনই ভাল ডাক্তারের কাছে নিয়ে গেল। তখন থেকে বোধনের নাকের হাড় সামান্য বেঁকে আছে। থাকুক। কী আর করা যাবে।
সংসারে তখন সবই অন্যরকম ছিল। সকাল শুরু হত ঝরঝরে চেহারায়। বাবা চা খেয়ে বাজারে চলে যেত, কি কাজ করত বাড়িঘরের, মা বাসি কাপড় বদলে সংসারের কাজ নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়ত, দুধ জ্বাল দিচ্ছে, চাল মেপে নিচ্ছে, দিদি টুকটাক ফাঁই ফরমাশ খাটছে। বাবা বাজার নিয়ে আসার সঙ্গে সঙ্গে আরও যেন জোর কদমে ছুটতে লাগল সংসার। বাবা বাজার ফিরতি জিলিপি, কচুরি না হয় রুটি-মাখন নিয়ে আসত। জলখাবারের সঙ্গে দুধ। দুধ খাওয়া নিয়ে মার সঙ্গে লড়াই। মার তখন মরার ফুরসত থাকত না। বাবা দাড়ি কামাতে ব্যস্ত। শীতকাল হলে তেতলার চাতালে। দাড়ি কামাতে কামাতে মার সঙ্গে কথা বলত।
মা তখন কেমন ছিমছাম ছিল। পরিষ্কার গায়ের রং, আধোভারী চেহারা, হলুদ আর টিয়া-সবুজ শাড়ি পরতে বেশি ভালবাসত মা, ছোট ছোট হাতের জামা পরত, চেপ্টা মোেটা বিনুনি খোঁপা থেকে আধঝোলা হয়ে পড়ে থাকত কাঁধে কাজ করতে করতে যখন-তখন চা খেত গরম করে। বাবার সঙ্গে ঝগড়াও করত, কেন, টিফিনে দুটো টোস্ট খেয়ে পয়সা বাঁচিয়ে আমায় রানি করছ নাকি? কখন দু মুঠো ভাত নাকে মুখে গুঁজে ছোট, টিফিনে ভাল করে খেতে পারো না। ডিম খাবে, কলা খাবে…। যাতে উপকার তাই খাবে। বাবা গোঁফ ছাঁটতে ছাঁটতে নাক কুঁচকে বলত, কলা আমার সহ্য হয় না। তা হলে একটা মিষ্টি খেয়ো৷ ঘরে বাইরে কত মিষ্টি খাব। বাবার গলায় হাসি।
সেই মা কোথায় হারিয়ে গেল, কোথায় যেন মরে গেল সেই বাবা। যা জীবন্ত ছিল তখন, আজ তা মৃত। এখন মাকে দেখলে কেউ বলবে না মা কোনওদিন স্বাস্থ্যবতী, সুশ্রী, সাদামাটা বউ ছিল বাড়ির। মাকে এখন বিশ্রী মোটা, ফোলা, খড়ির মতন সাদাটে, কাঁচা পাকা চুলের এক বুড়ির মতন দেখায়।
সবই দুর্ভাগ্য! বাবা, মা, ছেলে মেয়ে সকলের দুর্ভাগ্য। বাবার যদি চাকরি না যেত, দুর্ঘটনা না ঘটত আজ সংসারের এ অবস্থা হত না। তারা মোটামুটি সুখ-স্বচ্ছন্দে থাকতে পারত। অন্তত আজ যেভাবে আছে–এর চেয়ে নিশ্চয় ভাল। মা ঠিকই বলে বলে বাবার হাত ধরে এ বাড়িতে শনি ঢুকেছে, এ-আর ছাড়বে না।
সিগারেট শেষ হয়ে এসেছিল। বোধন আরও দু-একটা টান দিল, দিয়ে জানলার বাইরে ফেলে দিল। ভাল লাগছিল না। আজ সন্ধের দিকটা তার ফাঁকা। বিকেলেও কিছু করার নেই। কোন দিন বা থাকে। তবু অন্য দিন সুকুমারদার দোকানে গিয়ে বসে থাকা যায়। আজ রবিবার। দোকান বন্ধ। সুকুমারদাকে বাড়িতেও পাওয়া যাবে না, বউদিকে নিয়ে চাঁপাতলায় গিয়েছে শ্বশুরবাড়ি। পাড়ার বন্ধুদের মধ্যে আর যারা দু একজন–তারাও কেউ বসে থাকবে না পাড়ায়, কেউ সিনেমায় গিয়েছে, কেউ বা আড্ডা মারতে বেরিয়ে পড়েছে।
বোধনের হঠাৎ মানিকতলার কথা মনে পড়ল। কত দিন যাওয়া হয়নি। মাস আড়াই তো হবেই। আজ গেলে হয়। আশিসকে নিশ্চয় পাওয়া যাবে। আশিস খুব ঘরকুনো। তা ছাড়া ওর বাড়িতে একটা আড্ডাখানা আছে। পূর্ণ, টুকুনসবাই জমায়েত হয়। বোধন নিশ্চয় কাউকে পেয়ে যাবে। তা ছাড়া আজকের কাগজে সে দু তিনটে বিজ্ঞাপনের মধ্যে একটা বিজ্ঞাপন দেখে সন্দেহ করছে, কে পি ওয়ার্কস আশিসের মামাদের হবে। রাবারের কারখানা আশিসের মামাদের ছিল, ওই রকম– নারকেলডাঙ্গায় না রাজাবাজারে। রবিবারের একটা ইংরিজি কাগজ বোধন নেয় চাকরির বিজ্ঞাপন দেখার জন্যে। আজকের কাগজে সে কে পি ওয়ার্কস দেখেছে। চাকরিটার খোঁজ নেওয়া দরকার। গৌরাঙ্গ বলাইবাবুর কথা বলেছে–সেটা এখনও জলে পড়ে, কথাবার্তা বলুক গৌরাঙ্গ। তারপর যদি ডাক পড়ে বোধনের নিশ্চয় যাবে। দু একটা টাকা হয়তো অন্যদের কাছে কিছু নয়–বোধনদের কাছে তার দাম আছে।
না, আজ আর এ-পাড়ায় নয়, মানিকতলাতেই যাবে বোধন। বাস ভাড়া তার কাছে আছে। তা হলে আর দেরি করা কেন, বেরিয়ে পড়লেই হয় হাত মুখ ধুয়ে।
বোধন বাইরে এল। জবাদি রান্নাঘরে ঢুকছে। বাবার গলার আওয়াজ পাওয়া যাচ্ছিল ঘরে।
বাথরুমের দিকে যেতে যেতে বোধন বলল, আমি চোখে মুখে একটু জল দিয়ে আসছি। তুমি শুকনো শাড়িগুলো তুলে নাও না, জবাদি। হাঁটা যায় না।
বাথরুম থেকে ভিজে মুখে বেরিয়ে বোধন দেখল, জবাদি শাড়ি তুলে নিচ্ছে। বাবার গলা পাওয়া যাচ্ছিল ভেতরে।
কদিন ছুটি নাও না, বাবার গলা! ঘুমটুম হলে, বিশ্রাম নিলে সেরে যাবে।
এত ঘুমোই, আর কত ঘুমোব।
কোথায় ঘুমোও! ছটফট করো সারারাত। সাউন্ড স্লিপ দরকার। বয়েস বেড়েছে পরিশ্রম হচ্ছে…।
আর পারি না। শরীরের মধ্যে কেমন যেন হয়। মাথা তুলতে ইচ্ছে করে না, ঘাড় টনটন করে। একদিন হুট করে মরে যাব।
পাগল! …মরে যাবে!
মরেই তো আছি। না হয় বরাবরের জন্যে মরব। তোমার মতন খোঁড়া, অকর্মণ্য মানুষটার তখন কী হবে তাই ভাবি।
বোধন আর দাঁড়াল না, সরে গেল।