বাসটা এয়ারলাইনস্ অফিসের কাছাকাছি এসেছে বলে টের পাচ্ছিল চয়ন। ঠাসা ভিড়ের মধ্যে সে শক্ত হয়ে দাঁড়িয়ে। একটু আগে সে একজনের কব্জিতে ঘড়ি দেখতে পেয়েছিল। বিকেল পৌনে ছটা। সাড়ে ছ’টার মধ্যে গোলপার্কের কাছে মোহিনীদের বাড়িতে তার পৌঁছোনোর কথা। পৌঁছে যাবে বলে আশাও করছিল সে। সবই ঠিক চলছিল। বাস পাওয়া, বাসে ওঠা, পৌনে ছটা—এসব মিলিয়ে মিশিয়ে বিকেলটা ভালয় ভালয় কেটে যাচ্ছিল প্রায়।
কিন্তু হল না। ভ্যাপসা গরমে সেন্ট্রাল অ্যাভেনিউয়ে চলন্ত ডবলডেকারের নিচের তলায় মানুষের গায়ে সেঁটে থেকেও সে আচমকা চোখের সামনে সেই নির্ভুল কুয়াশা দেখতে পেল। ঘন সাদা কুয়াশা। দুটো সরু রেল লাইন সেই কুয়াশায় উধাও হয়ে গেছে। আবছায়া একটা সিগন্যাল পোস্ট! ঝিক করে সিগন্যাল ডাউন হল। কুয়াশার ভিতরে কিছু দেখা যায় না। শুধু একটা রেলগাড়ির এগিয়ে আসার শব্দ পাওয়া যায়। ঝিক ঝিক ঝিক ঝিক।
বাঁ হাতের বুড়ো আঙুলটা আপনা থেকেই কেঁপে কেঁপে ওঠে চয়নের। ঝিক ঝিক ট্রেনের শব্দের সঙ্গে এক তালে।
আঙুলটা কেঁপে উঠতেই আতঙ্কিত চয়ন প্রাণপণে ভিড় কাটিয়ে দরজার দিকে এগিয়ে যেতে চেষ্টা করতে থাকে। দুর্বল শরীরে সে এক অসম্ভব চেষ্টা। তার চারদিকে মানুষের দেয়ালে ফাটল ধারনার জন্য যে শক্তির দরকার তা তার এমনিতেই নেই। তার ওপর শরীরে যে কাঁপন উঠে আসছে সেটা ইতিমধ্যেই তার শরীরের আনাচে কানাচে সতর্কবার্তা পাঠিয়ে দিয়েছে। সমস্ত শরীর হাড়িকাঠে ফেলা বলির পাঁঠার মতো নির্জীব আত্মসমর্পণের দিকে ঢলে পড়ছে।
একটু নামতে দিন! একটু নামতে দিন দাদা! কাতর কণ্ঠে একথা বলতে বলতে চয়ন প্রাণপণে চেষ্টা করছে দরজার দিকে যেতে। দরজা বেশী দূরেও নয়। তিন চার ফুটের মধ্যে। তবু মনে হয়েছে কী ভীষণ দূর!
নামবেন! তা এতক্ষণ কী করছিলেন। বলে কে একজন ধমক দেয়।
বাধ্য হয়েই চয়ন তার অভ্যস্ত মিথ্যে কথাটা বলে, আমার বমি আসছে ভীষণ! একটু নামতে দেবেন!
এই কথাটায় বরাবর কাজ হয়। বমিকে ভয় এবং ঘেন্না না পায় কে? ভীড়ের মধ্যে একটু ঢেউ ঢেউ খেলে যায়। মানুষের শক্ত শরীরগুলো নমনীয় হয়ে যেতে থাকে।
যান দাদা যান! তাড়াতাড়ি এগিয়ে যান।
অনেক সময় হয়, এই কাঁপন ওঠার সঙ্গে সঙ্গে খোলা হাওয়ায় দম নিলে কাঁপনটা ধীরে ধীরে কমে যায়। সেটা ক্কচিৎ কদাচিৎ। কিন্তু অভ্যাসবশে চয়ন এই অবস্থাটা দেখা দিলেই খোলা হাওয়ার দিকে ছুটে যায়।
আজ কোনও সৌভাগ্যসূচক দিন নয় তার। স্টপে নেমেই সে বুঝতে পারে, বাঁ হাত ঝিঁঝি ধরার মতো অবশ হয়ে আসছে। কাঁপন ছড়িয়ে যাচ্ছে সর্বাঙ্গে। সে চোখে কুয়াশা দেখছে। শ্রবণ ক্ষীণ হয়ে এল। সে একজন অস্পষ্ট পথচারীকে বলল, দাদা, একটু হেলপ করবেন? আমি এপিলেপটিক—
কে শুনল বা বুঝল কে জানে! ডান হাতটা বাড়িয়ে সে একটা কিছু ধরার চেষ্টা করল। কিছু ধরল কিনা বোঝা গেল না। তবে এ সময়টায় তার সব শক্তি জড়ো হয় ডান হাতের মুঠোয়।
এ সময়ে তার ডান হাত বড় বিপজ্জনক। মুঠো করে কিছু ধরলে আর তা ছাড়ানো যায় না, যতক্ষণ না জ্ঞান ফিরছে। একবার অজ্ঞান হওয়ার মুহূর্তে সে কণিকার ডান হাত চেপে ধরেছিল। তারপর অজ্ঞান হয়ে গিয়েছিল। কণিকার আতঙ্কিত চিৎকারে বাড়ির লোক ছুটে আসে এবং দৃশ্যটা দেখে তারাও ভয়ংকর ঘাবড়ে যায়। মুঠো থেকে কণিকার কজি ছাড়াতে না পেরে তাদের কেউ কাপড় কাচার কাঠের মুগুড় দিয়ে মেরে চয়নের ডান হাত ভেঙে দিয়েছিল।
ভাঙা হাত জোড়া লেগেছিল যথাসময়ে। চিকিৎসার খরচও দিয়েছিল কণিকার অভিভাবকেরা। কিন্তু টিউশনিটা ছাড়তে হয়েছিল চয়নকে। দেড়শ টাকার টিউশনি!
এখন সেন্ট্রাল অ্যাভেনিউয়ের ভিড়ে সেরকমই কিছু আবার ঘটতে পারত। মুঠোয় কিছু ধরতে পারেনি ভাগ্যিস। জ্ঞান হারানোর আগে সেই ক্ষীণ সান্ত্বনা নিয়ে সে খাড়া থেকে কাটা গাছের মতো পড়ে গেল।
তারপর কুয়াশা আর কুয়াশা। একটা রেলগাড়ির ঝন ঝন শব্দ। তারপর সব মুছে যাওয়া।
জ্ঞান ফেরার পর বেশীর ভাগ সময়েই সে একটা পরিচিত দৃশ্য দেখতে পায়। চারদিকে মানুষের পা। অনেক ওপরে মানুষদের মুখ। অনেক মুখ। সব ক’টা চোখ তার ওপর নিবদ্ধ। আর টের পায়, তার মাথা মুখ সব জলে ভেজা। ভেজা জামায় জল, ধুলো, কাদা।
কলকাতায় এবার বৃষ্টি হচ্ছে খুব। ফুটপাথের জল সহজে শুকোয় না। একটা ছোট্ট জমা জলের গর্তে তার মাথাটা পড়েছে আজ। পা থেকে চপ্পল খসে পড়েছে কোথায়!
কে যেন বলল, কেমন লাগছে? উঠতে পারবেন?
মানুষকে তার খুব খারাপ লাগে না। এদের মধ্যে ভাল আছে, মন্দ আছে, দয়ালু আছে, উদাসীন আছে। কিন্তু কোনও মানুষ হঠাৎ এরকম পড়ে গেলে সকলেই জড়ো হয় চারপাশে। সবাই খারাপ নয়, এটাই যা একটা ভাল ব্যাপার।
চয়ন তার দুর্বল শরীর শোয়া অবস্থা থেকে টেনে তোলে, আগে লজ্জা করত। আজকাল তেমন লজ্জা করে না। এরকম তার অভ্যাস হয়ে গেছে।
একজনের দিকে চেয়ে সে স্তিমিত গলায় জিজ্ঞেস করে, কটা বাজে?
সোয়া ছটা।
তার মানে মোহিনীদের বাড়িতে যাওয়ার সময় নেই নাকি? যাওয়াটা খুব দরকার। মোহিনীর কাল ইংরিজি সেকেন্ড পেপারের পরীক্ষা। মোহিনীর বাবা গত পরশু একটু হুঁশিয়ার করে দিয়েছিলেন।
সে উঠে বসার পর ভিড়টা পাতলা হচ্ছে।
কে একজন তার হাতের ওপরের দিকটা ধরে বলল, উঠতে পারবেন তো! তাহলে ধীরে ধীরে উঠে পড়ুন।
পারল চয়ন। আগে পারত না। আজকাল পারে। বাধ্য হয়ে পারতে হয়। তবে এই সময়টা এত দুর্বল লাগে যে মাথাটা অবধি ঘাড়ের ওপর লটপট করতে থাকে। হাত পা সব অবশ। শরীর জুড়ে ঝিঁঝির ডাক।
আমাকে ওই দেয়ালটায় ঠেস দিয়ে দাঁড় করিয়ে দিন।
পারবেন তো?
পারব। আমার প্র্যাকটিস আছে।
বলবান লোকটি তাকে দেয়ালের গায়ে দাঁড় করিয়ে বলে, ট্যাক্সি নেবেন?
উদ্বেগের মাথায় চয়ন তাড়াতাড়ি বলে, না না। ট্যাক্সি লাগবে না।
বাড়ি যাবেন কি করে?
চয়ন বাড়ির কথায় শিহরিত হল। তার যদি সেরকম একটা বাড়ি থাকত যেখানে অসুস্থ শরীরে ট্যাক্সি নিয়ে গিয়ে নামলেই বাড়ির লোক ছুটে আসবে, ভাড়া মেটাবে এবং ঘরে নিয়ে গিয়ে শুইয়ে দেবে?
আছে। এখনও মা আছে। ছুটে আসতে পারবে না বা ঘরেও নিয়ে যেতে পারবে না। তবু একমাত্র মা-ই ‘কি হল কি হল’ বলে চেঁচাবে। কাঁদবেও।
চয়নের সেই অর্থে বাড়ি নেই। দাদার বাড়িতে সে আর মা একরকম জোর করে আছে। একটা সুতোর মতো সম্পর্ক ঘরে আছে বটে, কিন্তু সেটা ঠিক থাকা নয়। উঠি-উঠি যাই-যাই ভাব সবসময়ে। দাদা আর বউদির ভয়, আর বেশীদিন থাকলে বাড়িটার ওপর তার এবং মায়ের একটা দাবী বা স্বত্ব দাঁড়িয়ে যাবে। তাই আজকাল তাদের তাড়াবার জন্য উঠে পড়ে লেগেছে তারা!
দেয়ালে ঠেস দিয়ে খানিকক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকে চয়ন। পারবে কি? মোহিনীর কাল ইংরিজি পরীক্ষা! যাওয়াটা দরকার।
যে লোকটা তাকে ধরে তুলেছে সে এখনও দাঁড়িয়ে, বাকিরা চলে গেছে।
লোকটা ভাল প্রকৃতির। বলল, ট্যাক্সি ভাড়া না থাকলে বলুন না, দিচ্ছি। সংকোচের কারণ নেই।
চয়ন মাথা নেড়ে বলে, না। এরকম আমার প্রায়ই হয়।
চিকিৎসা করিয়েছেন?
হোমিওপ্যাথি করাই! এটা ঠিক সারবার অসুখ নয়।
জানি। আমার ছোট বোনটার আছে।
লোকটাকে লক্ষ করে চয়ন! বেঁটে মতো, স্বাস্থ্যটা পেটানো, মাথায় একটু টাক আর গোঁফ, রংখানা কটা আর মুখে একটা সদাশয় ভাব আছে। বেশ লোক।
কোন দিকে যাবেন?
সাউথে।
সাউথ তো অনেক বড়। সাউথে কোথায়?
গোলপার্কের কাছে।
সেখানেই বাড়ি?
না, টিউশনি করতে যাই।
এ অবস্থায় সেখানে গিয়ে কি হবে? পড়াতে পারবেন?
পারব। আজ আর অজ্ঞান হবো না। দিনে একেবারের বেশী হয় না।
তার মানে কি দিনে একবার করে হয়? তাহলে তো সাংঘাতিক কথা!
না, রোজ হয় না। এক দুই সপ্তাহ পরে হয়। কখনও তারও বেশী গ্যাপ যায়।
আমার বোনটার মতোই। কি করেন?
টিউশনি।
আর কিছু নয়?
না। আর কি করব?
আমি সাউথের দিকেই যাব। আমার সঙ্গে যেতে পারেন।
তারও দরকার নেই। একাই পারব। একটু রেস্ট নিলেই হবে।
আপনার স্ট্যামিনা আছে মশাই। আমার বোনটার যেদিন অ্যাটাক হয় সারাদিন আর উঠতে পারে না। শুয়ে থাকতে হয়।
আমার শুয়ে থাকলে চলে না।
তা বলে—লোকটা একটু ইতস্তত করে কথাটা অসমাপ্ত রাখে।
চয়ন চোখ বুজে ঘন ঘন বড় শ্বাস নিতে থাকে। একমাত্র বড় বড় শ্বাসই তাকে তাড়াতাড়ি স্বাভাবিক করে তোলে। একটু সময় লাগে, এই যা।
লোকটি দাঁড়িয়ে আছে এখনও। দয়ালু লোক। চয়ন চোখ মেলতেই বলে, কিছু খাবেন? এ সময়ে একটু গরম দুধ-টুধ খেলে ভাল হয়। কিন্তু দুধ এখানে বোধহয় পাওয়া যাবে না। অন্য কিছু খাবেন?
চয়ন লাজুক মুখে মাথা নেড়ে বলে, না না। এখন কিছু খেতে পারব না।
খুব দূর্বল লাগছে?
একটু লাগে।
পকেটে একটা নাম-ঠিকানা লেখা কাগজ রাখবেন। এপিলেপটিকদের ওটা রাখা দরকার।
চয়ন জবাব দেয় না। নাম-ঠিকানা লেখা কাগজ পকেটে রাখলেই বা কি লাভ হবে? কলকাতার পথচারী জনসাধারণের ওপর তার আস্থা অনেক বেশী। পথেঘাটে এই রকম প্রায়ই হয় তার। তবু দুবারের বেশী তার পকেটের টাকা-পয়সা খোয়া যায়নি। গেছেও সামান্যই। সেটা না ধরলে কলকাতার অনাত্মীয় জনসাধারণই তার দেখভাল করেছে। ঘন ঘন শ্বাস নিতে নিতে মাথা কিছু পরিষ্কার হল। লোকটা তার মুত্রে দিকে নিবিড় চোখে চেয়ে আছে। একটু লজ্জা করছে চয়নের। লোকটি একটু বেশীই দয়ালু! সে বলল, এবার আর ভয় নেই। আমি চলে যেতে পারব।
আমিও দক্ষিণেই থাকি। যাদবপুরে। একসঙ্গে যেতে আপত্তি আছে?
লাজুক চয়ন বলে, না না, আপত্তি হবে কেন! তবে ট্যাক্সির দরকার নেই।
দরকার থাকলেও পাওয়া যাবে কিনা সেটাই বড় কথা। আপনি আর একটু জিরিয়ে নিন বরং। এখনও হাঁফাচ্ছেন। টিউশনিতে কি আজ না গেলেই নয়?
কাল আমার ছাত্রীর পরীক্ষা। না গেলে কথা হবে।
ছাত্রীর বাবা খুব কড়া ধাতের বুঝি?
লজ্জিত চয়ন মাথা নেড়ে বলে, তা নয়। তবে টিউটরের তো অভাব নেই। সামান্য কারণে হয়তো ছাড়িয়ে দিতে পারে।
ক’টা করছেন?
তিনটে।
আমি আপনার মতো বয়সে দিনে ছ’-সাতটা করতাম। ভাল রোজগার ছিল। পরে হোম টিউটোরিয়াল খুলি। এখন চাকরি করি বলে টিউটোরিয়াল তুলে দিতে হয়েছে। আসুন, অন্তত একটু চা খেয়ে নেওয়া যাক। তাতেও খানিকটা কাজ হবে আপনার।
লোকটার কব্জির ঘড়িটা বিরাট বড়। সেটা লক্ষ করছিল চয়ন। সাড়ে ছটা বাজে। আর দেরী করলে যাওয়াটা অর্থহীন হয়ে যাবে। সে মাথা নেড়ে বলে, আমার দেরী হয়ে যাবে।
বলতে একটু কষ্ট হল তার। লোকটা তার জন্য এতটা দরদ দেখাচ্ছে, মুখের ওপর না বলতে লজ্জা করছে। কিন্তু উপায় নেই।
লোকটা বুক পকেট থেকে একটা ছোটো নোটবই বের করে বলে, আপনার ঠিকানাটা অন্তত দিন। একজন সাধুর একটা মাদুন পেয়েছি। বোনটাকে ধারণ করিয়েছি গত পরশু। যদি উপকার পাওয়া যায় তবে আপনাকেও একটা জোগাড় করে দেবখন। কতরকম মিরাকল্ আছে মশাই। কী থেকে কী হয় কে জানে। আমার ঠিকানাটাও জেনে রাখুন। এই যে এল, আই. সি. বিল্ডিংটা দেখছেন এর চারতলায় মেশিন ডিপার্টমেন্টে আমি চাকরি করি। আশিস বর্ধন আমার নাম। এবার আপনার ঠিকানাটা আমায় বলুন।
চয়ন ঠিকানাটা বলল। তারপর অতিশয় সংকোচের সঙ্গে জানাল, বাড়িটা আমার দাদার। সেখানে—
সেখানে কী?
মানে সেখানে আমার বন্ধু বা পরিচিতরা ঠিক ওয়েলকাম নয়। আমি যদি বাড়িতে না থাকি তবে আমার বউদি খুব একটা পাত্তা দেন না।
লোকটি হাসল, বুঝেছি। আপনি কোন সময়টায় অ্যাভেলেবল্?
দুপুরবেলাটায় থাকি। বেলা বারোটা থেকে তিনটে।
লোকটা নোটবই পকেটে রেখে বলল, আশা করি আবার দেখা হবে। আপনি সংকোচ বোধ করছেন, নইলে আপনাকে গোল পার্ক অবধি পৌঁছে দিতাম। চলি।
লোকটা বোধহয় তাকে রেহাই দিতেই ভিড়ে অদৃশ্য হয়ে গেল। যেন একটু স্বস্তির শ্বাস ছাড়ল। মানুষের ভালবাসা, সহানুভূতি গ্রহণ করতে আজকাল তার লজ্জা হয় না বটে, কিন্তু খুব বেশীক্ষণ সে সইতে পারে না। শুধুই নতমস্তকে কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করে যেতে যেতে সে আজকাল হীনমন্যতায় ভোগে। মানুষের জন্য উল্টে যদি কিছু করতে পারত সে!
ভাগ্যক্রমে পরের বাসটা দু’ মিনিটের মধ্যেই পেয়ে গেল চয়ন। কষ্ট করেই সে এল, নাইন বাসের দোতলায় উঠল। এ বাসটা এসপ্লানেডে কিছুটা যাঁকা হয়। ভাগ্য সুপ্রসন্ন থাকলে বসার জায়গা পেয়েও যেতে পারে। অজ্ঞান হয়ে যাওয়ার পর জ্ঞান ফিরলে তার বড্ড ঘুম পায়। এখন পাচ্ছে। চোখ জুড়ে আসছে বারবার! বসতে পারলে সে একটু ঘুমিয়ে নেবে!
আশিস বর্ধন নামটা তার মনে থাকবে। সে সহজে কিছু ভোলে না! না নাম, না মখ। তার স্মৃতিশক্তি চমৎকার। কিন্তু লোকটা যদি হুট করে তাদের বাড়িতে হাজির হয় তাহলে অপমানিত হওয়ার সম্ভাবনা আছে। তার একজন উপকারী বন্ধু তার আরও বেশী উপকার করতে উপাযাচক হয়ে তাদের বাড়িতে গিয়ে অপমানিত হয়ে আসবে ভাবতেই সে সংকোচে মরে যাচ্ছে!
আগে অবশ্য ব্যাপারটা এরকম ছিল না। ভাল না হোক, বউদি অন্তত খুব খারাপ ব্যবহার বা অপমান করত না কাউকে। কিন্তু গোলমাটা পাকাল পাড়ার পটু।
মাস ছয়েক আগে তার দাদা আর বউদি মিলে তুমুল চেঁচামেচি আর অশান্তির পর চয়নকে আর মাকে বাড়ি থেকে তাড়িয়ে দেওয়ার ব্যবস্থা করে। বাড়িটা দাদার এবং দাদার পয়সাতেই মোটামুটি সংসার চলে। কিছু করার ছিল না তাদের। এক দিদি থাকে উল্টোডাঙা হাউসিং-এ, সেখানেই যেতে হত তাদের। গিয়ে কী হত কে জানে? তবে পোঁটলা-পুঁটলি বাক্স নিয়ে একরকম পালিয়ে বাঁচতে চেয়েছিল তারা। কিন্তু সদর খুলে বেরোতেই এক বিপরীত দৃশ্য! সামনে পল্টু দাঁড়ানো, পিছনে পাড়ার বিস্তর ছেলে এবং কয়েকজন মহিলাও।
পল্টুই এগিয়ে এসে মাকে বলল, মাসীমা, ঘরে যান। চয়নদা, তুমিও ভিতরে যাও। আমরা না বললে খবদার বাড়ি ছাড়বে না।
পল্টু পাড়ার মোড়ল গোছের। তার ক্লাব আছে। মাঝে মাঝে রক্তদান শিবির, নাটক ইত্যাদি করে। তার প্রবল দাপটে পাড়ায় সাট্টার ঠেক আর দিশি মদের আস্তানা উঠে গেছে। পলিটিকাসও করে।
ভয়ে চয়ন তার মাকে নিয়ে দরজাতেই দাঁড়িয়ে রইল। ন যযৌ ন তস্থো অবস্থা।
তাদের পাশ কাটিয়ে পটু ঘরে ঢুকে সোজা দাদার গলায় হাত দিয়ে চেপে ধরল দেয়ালে, এ পাড়ায় বাস করতে চান? যদি চান তাহলে এবার থেকে মা আর বেকার ভাইকে বাড়ি থেকে বের করে দেওয়ার চেষ্টা করবেন না। করলে আপনাকেও এ বাড়ি ছাড়তে হবে। কথাটা আপনার বউকেও বুঝিয়ে দেবেন।
কথাটা বেশ নাটুকে এবং বীরত্বব্যঞ্জক বটে, কিন্তু ঝামেলা অত সহজে মেটেনি। বউদি ঝাঁপিয়ে পড়ল পল্টুর ওপর। তারপর অকথ্য গালিগালাজ। পাড়ার লোক ভিড় করে এল। পন্টুর বীরত্ব নিয়েও প্রশ্ন উঠল। পারিবারিক ব্যাপারে বাইরের লোকের নাক গলাননা কতটা যুক্তিযুক্ত তা নিয়েও কথা হতে লাগল। তবে মোটামুটি জনসাধারণের চাপে তারা রয়ে গেল দাদার বাড়িতে। সম্পর্কটা খুবই খারাপ হয়ে গেল এর পর। দাদা পন্টুর এই হামলা নিয়ে প্রবল আন্দোলন করতে লাগল। এমন কি গুণ্ডা লাগানোর চেষ্টাও করেছিল।
দাদার হাতে ছেলেবেলায় বিস্তর মারধর খেয়েছে চয়ন। বড় হওয়ার পর খায়নি। কিন্তু পল্টুর হামলাবাজির পর সেই রাতেই দাদা তাকে একটা লাঠি দিয়ে খুব পেটায়। সে অজ্ঞান হয়ে গিয়েছিল মার খেয়ে। পরে শুনেছে, বউদি একটা কৌটো ছুঁড়ে মেরেছিল মাকে।
এর পরও তারা আছে। বাড়িটা ছোটো এবং পুরোনো। এ বাড়িতে তারা ভাড়া থাকত একসময়ে। পরে বাড়িওলার কাছ থেকে দাদা সস্তায় কিনে নেয়। বাড়ি কেনার পর থেকেই দাদার ভয়, বেশী দিন এ বাড়িতে থাকতে দিলে চয়নের দাবী জন্মে যাবে।
এই ঘটনার পর থেকেই চয়নকে কেউ খুঁজতে এলে বউদি ভীষণ চেঁচামেচি করে। চয়নের নামও সহ্য করতে পারে না দুজন।
আশিস যেন অসময়ে গিয়ে হাজির না হয়, হে ভগবান! এইটুকু বলে এসপ্লানেড়ে একটা সীট পেয়ে বসেই ঘুমিয়ে পড়ল চয়ন। গভীর ক্লান্তির ঘুম।
গোল পার্ক টার্মিনাসে কন্ডাক্টর ডেকে তুলে দিল তাকে। মোহিনী তাকে দেখে আঁতকে উঠে বলে, কী হয়েছে চয়নদা! পড়ে গিয়েছিলেন নাকি? জামাকাপড় তো কাদায় মাখামাখি।
চয়ন যথাসাধ্য গম্ভীর হয়ে বলে, রাস্তা যা পিছল।
ইস, ভেজা জামাকাপড়ে থাকবেন?
কিছু হবে না। রোজ তো বৃষ্টিতে ভিজছি, এত জামাকাপড় পাবো কোথায়?
বাবার ধুতিটুতি কিছু দেবো?
চয়ন শিহরিত হয়ে বলে, না না। কিছু লাগবে না।
এ বাড়িতে বিকেলে দুখানা মাখন টোস্ট পাওয়া যায়। এক কাপ চা। কখনও কখনও অবশ্য টোস্টের বদলে বিস্কুট। আজ টোস্ট দুখানা তার বড় দরকার। খিদে পেয়েছে।
সে এক গ্লাস জল চেয়ে খেল এবং পড়াতে লাগল।
চয়নদা, আপনাকে কিন্তু অসুস্থ দেখাচ্ছে। ফ্যাকাসে লাগছে খুব। পড়ার মাঝখানে বলে ফেলে মোহিনী।
মৃগী রোগের কথা শুনলে এরা হয়তো আর রাখবে না তাকে। কণিকার বাড়ির তিক্ত অভিজ্ঞতা সে তো ভোলেনি। ভাঙা ডান হাতখানা তার আজও কমজোরি। ভারী জিনিস তুলতে পারে না।
সে মুখে একটু হাসির ছদ্মবেশ ধারণ করে বলল, না না, শরীর ঠিক আছে।
মোহিনীর বয়স পনেরো। বিপজ্জনক বয়স। এই বয়সে মেয়েরা বড় চঞ্চল হয়। চয়ন এসব জেনেছে টিউশনি করতে করতেই। তাই আজকাল সে তার কিশোরী ছাত্রীদের চোখের দিকে চায় না। জীবনের জটিলতা যত কম হয় ততই ভাল।
মোহিনী একটু উসখুস করে ‘এক মিনিট আসছি’ বলে উঠে গেল।
কিছুক্ষণ বাদে মোহিনীর মা এলেন। হাতে এক গ্লাস কমপ্ল্যান আর দুটো টোস্ট।
মোহিনী বলছিল তোমার নাকি কি হয়েছে?
চয়ন বড্ড অপ্রতিভ হয়ে বলে, তেমন কিছু না। পিছল রাস্তায় একটা আছাড় খেয়েছি।
খুব লেগেছে?
সামান্য। জামাকাপড় নষ্ট হয়েছে জলকাদায়। অবশ্য শুকিয়েও গেছে এতক্ষণে।
শরীর ভাল আছে তো?
আছে।
এটা খেয়ে নাও।
চয়ন কৃতজ্ঞতায় মরমে মরে গেল। কিন্তু খিদের মুখে কী যে চমৎকার লাগল তার খাবারটুকু! বুকটা ঠাণ্ডা হল, জুড়িয়ে গেল।
পড়ায় সে ভালই। ইংরিজি আর অঙ্ক দুটোই ভাল পারে বলে টিউশনির অভাব হয় না। তবে বেশী টাকা দাবী করতে ভয় পায়।