ঋতু চক্রে মানুষের শীতকাল পৌষ মাঘ। অগ্রহায়ণে অধর ধরা ছাড়া করে। জীবের শীত শুরু জন্মাষ্টমীর দিন থেকে। ওই দিন থেকে জীবদের স্নান বন্ধ। ফাল্গনের মাঝামাঝি পর্যন্ত। আবার শুরু ফাল্গনের শুক্লা প্রতিপদের দিনে। সেই স্নান হবে অবশ্যই গঙ্গার জলে। দু-চার-ছ মাইল থেকেও গোপেরা বাথানের মতো, ওই দিন সব জীবদের গঙ্গায় স্নান করাতে নিয়ে আসবে। বলতে পারো, ওই দিন জীবদের স্নানযাত্রা।
এই শ্রাবণে গঙ্গায় জীবদের স্নান করানোয় বড় বিপদের ঝুঁকি। ভাসিয়ে নিয়ে যেতে পারে। জীবেরাও সহজে নামতে চায় না। যদু সে বিষয়ে সাবধানী। জীবদের জলের ধারে রাখে। নামতে দেয়। না। মালসা বা শানকিতে করে জল ছিটিয়ে দেয়, জীবেরা জলের ধারে বসেও পড়ে। বিশেষ করে মহিষীরা। ওদের গায়ে বড় জ্বালা।
যদু সে কথা ভাবছে না। গোপদের পাড়া, গ্রামের পশ্চিম সীমানার শেষ পাড়া। তারপরে উঁচু শস্যের জমি। জমির ধারে চওড়া রাস্তা। রাস্তাও নীচেও কিছু শস্যের জমি। তারপরে আরও নাবালে ঘাসের মাঠ। মাঠ পেরিয়ে চর। যদু রাস্তার ওপরে এসে পড়ল। ওর চোখের সামনে ভাসছে জটার মুখ। চোখে, শিকারকে চক্রে বাঁধা শিকারির বাঘের দৃষ্টি। কালো বেঁটে গুলি ভাটা শক্ত চেহারার জটা। কালী ঘোষের ছোট ছেলে। বিয়ে করেছে চার বছর। জটার বিয়েতে যদু বরযাত্রী গিয়েছিল দেবপাড়ায়। জটার বউ জটার থেকে ঢ্যাঙা। পুরুষ্টু বিহারি গাভির মতো। এখন দুই ছেলের মা। তবু জটার ছোঁকছোঁকানি চিরকালের। যদু জানে। দু বছর আগেও একসঙ্গে বাথানে গিয়েছিল দক্ষিণে। বৈশাখ মাস। বড়গাছি গ্রামের পুব দিকে মাথাভাঙা বিল। বিলের আরও পুবে জলঙ্গী নদী। বিল আর নদীর মাঝামাঝি বিরাট বাথানের ড্যারা করা হয়েছিল।
যদুর চোখের সামনে সেই ঘটনা ভাসছে। বৈশাখ মাসের শেষ মঙ্গলবার বড়গাছির বাগদিদের কালী পূজা হয়। পূজায় ভারী ধুমধাম। পাঁঠা বলি হয়। বাউড়ি বাগদিরা আসে আশেপাশের গ্রাম থেকে। সারারাত্রি ধরে পূজা। মেলা বসে যায়। মদের র্যালা। আন মেয়েমানুষের চোরা ভিড়। টাকা দিলেই মেলে। জটা দুধ বিক্রির টাকা কিছু সরিয়ে রেখেছিল। যদু ওর সঙ্গে। জটা মদ খেয়েছিল। যদুকে খেতে বলেছিল। খায়নি। কোনও কালেই খায়নি। কিন্তু মজা লেগেছিল। মানুষের রং-ঢং ক্ষ্যাপামি পাগলামি দেখতেও অনেক সময় ভাল লাগে। ভাল লাগেনি একটা ব্যাপার। জটা একটা চোরা ঘুসকির সঙ্গে দরদাম করেছিল। যদু বলেছিল, তুই শালা বিষ্টার নেশা করা গোরু। চেরটাকাল এই কইরে এলি। বিয়ে কইরেও তোর নষ্টামি গেল না।
জটার কী হাসি! ওরে যদু, মেয়েমানুষের স্বাদ পাস নাই, তাই এ কথা বইলচিস। এক বার পেইলে আর ছাইড়তে পাইরবি না। বল, তোর জন্যে একটা কচি বকনা ছুঁড়ি ধরি। এক বার খোড়, দেইখবি শালা কী জিনিস। তারপরে চেরকাল তোরও খুঁইড়তে ইচ্ছে কইরবে।
যদুর জীবনের পাঠ ঠাকুরদার কাছে। ভাব পীরিতি কী জিনিস, মনে মনে জানে। আর যাই হোক, টাকা দিয়ে বেশ্যার সঙ্গ করার কথা ভাবতে পারে না। বলেছিল, না, আমি ও সবে নাই। জটা তখন মত্ত। দরদাম করা মেয়েমানুষটাকে নিয়ে বাথানের কাছাকাছি অন্ধকারে গিয়েছিল। জটার কাছে ও সব নতুন কিছু না। আরও কয়েক বার ও সব করতে দেখেছে। বড়গাছিতে যদু কেবল বলেছিল, বাথানের মাটি ছুঁস না, দূরে যা।
মেয়েমানুষের স্বাদ? বড় নেশা, তাইনা রে জটা? ঘরবার একাকার করেছিস। তারপরে তুই গদাধর ঘোষের নাতনিকে শিবের পোড়োয় নিয়ে গিয়ে খেয়েছিস। তুই গোপের ব্যাটা। আমিও গোপের ব্যাটা। গোপ হয়েও তুই গোপ চিনিস নাই। এই বার চিনবি।
যদু রাস্তা ছেড়ে নীচের চাষের জমির আলে পড়ল। শালি চাষ ভাল হয়েছে। যেন ফোঁস ফোঁস করে সবুজ ডগা মাথা চাড়া দিয়ে উঠেছে। বৃষ্টির জল ভাল পেয়েছে। বান বন্যা না হলে, ঘরে ঘরে ভাল ফসল উঠবে। এই নীচের জমিকে ভয়। ভয়ের কারণ গঙ্গা। শ্রাবণ চলছে। নদী এখনও দূরে। ভাদ্র– কোনও কোনও বছর আশ্বিন পর্যন্ত না গেলে, ভয় কাটে না। ওপরের ঢলে গঙ্গা আচমকা বিশাল আর ভয়ংকরী হয়ে উঠতে পারে। তখন খেতে খেতে, কতখানি খাবে, কেউ বলতে পারে না।
যদু উত্তর-দক্ষিণের দূর বিস্তৃত ঘাস মাঠের ওপর এসে পড়ল। ঘাস মাঠের উঁচু দিকে একটা চালা ঘর। ঘাটদারের ঘর। খেয়া পারানির পয়সার লেনাদেনা ওখানে। ঘাটের ডাক নিয়েছে যদুদের গ্রামের বামুন নটবর চক্রবর্তী। খেয়া পারাপারের নৌকা ছাড়াও চারটি চাপের নৌকা আছে তাদের। গোরু মোষের গাড়ি পারাপারের ভাড়া পায় ভাল। যদু দেখল, একটা চাপের নৌকা এসে ভিড়েছে। গাড়ি নামাচ্ছে ওর বাবা আর পঞ্চানন। ঠাকুরদা নৌকার দড়ি টেনে ধরে আছে। গাড়ি নেমে এল। বলদ দুটো জল থেকে উঠে, সারা গায়ের চামড়া কাঁপয়ে জল ঝাড়ছে। বাবা গেল ঠাকুরদার কাছে। মোটা খুঁটি পোঁতা আছে। বাবা দড়ি নিয়ে, চাপের নৌকা খুঁটিতে বাঁধছে। পঞ্চানন নৌকায় উঠে হুঁকো কলকে আর একটা বড় ঝোলা নিয়ে নেমে এল। ঠাকুরদা বলদ দুটোকে গাড়িতে জুতল।
যদু কাছাকাছি এসে পড়ল। বাবা ঠাকুরদা পঞ্চানন তখন গাড়িতে উঠে বসেছে। যদুকে তারা দেখতে পেল। ঠাকুরদা বলল, এখন এলি? দেরি হইয়ে গেছে।
হ, একটু দেরি হইয়ে গেল। যদু দক্ষিণে মুখ ফিরিয়ে নিজেদের জীবদের লক্ষ করল, গোরু বাছুরকে আজ অল্প চান করাব। মোষগুলানকে গা মেইজে নাইয়ে, তাড়াতাড়ি আইসচি। পঞ্চু, তুই ভাত খেইয়ে বলা হীরা আর তোপার ভাত লিয়ে আয়।
গাড়ি ঘরের পথ ধরল। যদু এক বার উত্তরের দিকে তাকাল। কালী ঘোষের জীবেরা ওই দিকে চরছে। উত্তর দক্ষিণে যত দূর চোখ যায়, বিরাট গোরু বাছুর মোষের বাহিনী। ভেড়ার পাল একটু ওপর দিকে উঠে আছে। জলবৃষ্টিকে ওদের খুব ভয়। রোদ ঝুঁজ সইতে পারে। জল পারে না। মেঘলা আকাশ। বৃষ্টির ফোঁটা গায়ে পড়লেই বা বাঁ ডেকে গ্রামমুখো ছুটবে।
জটা কি চরে এসেছে? চোখে পড়ছে না। ওদের সত্তরটি প্রাণী। তার মধ্যে নটি মোষ। ওদের গোয়ালের ছবি যদুর চোখে ভাসছে। ও উত্তরে ফিরল। বলা হীরা তোপাকে চোখে পড়ছে না। প্রায়। আধ মাইল হেঁটে নিজেদের প্রাণী চোখে পড়ল। বলা হীরা তোপা, তিনজনেই বসে আছে। ভাবছে, ওদের কেউ দেখতে পাচ্ছে না। তোপাটাও বিড়ি টানছে। তাঁ, যদু অনেকক্ষণ বিড়ি তামাক কিছুই টানেনি। অসুস্থ গাইটিকে শুশ্রূষা করে, মৌজ করে তামাক টানবে ভাবছিল। তা আর হয়নি। যদু হক দিল, হ্যাঁ-অই র্যাহা হা।’…
তৎক্ষণাৎ একপাল জীব ওর দিকে মুখ তুলে তাকাল। কেউ কেউ এগিয়ে এল ওর কাছে। তিন ভাইও লাফিয়ে উঠল। যদু জীবদের মধ্যে ঢুকে পড়ল। যদু সকলের গায়ে মাথায় আস্তে চাপড় মারছে। এই চাপড়ে সংকেত আছে। সবাই জলের দিকে এগিয়ে গেল। ওদের চার কুড়ি তিন প্রাণী। বাদে চৌদ্দটি ভেড়া। মইষী আছে এগারো। তারাই আগে যদুর সঙ্গ নিল। যদু ভাইদের দিকে তাকিয়ে বলল, মালসা শানকি লিয়ে আয়।
স্নানপর্ব শুরু হল। যদু মইষীদের জলের কাছে নিয়ে গেল। চটানে চর। ভাঙা উঁচু পাড় না। তবু সাবধানের মার নেই। স্রোতের টান দুরন্ত। যদু হাঁটু জলে দাঁড়াল। মইষীরা ওর কাছে এগিয়ে এল। এগারোর মধ্যে চারটি জলে বসে পড়ল। যদু গামছা থেকে লুড়া বের করে, মইষীদের গায়ে জল ছিটিয়ে মাজতে লাগল। সে যেখানে দাঁড়িয়ে, সেটাই সীমানা। তার বেশি দূরে কোনও প্রাণী যাবে না। বলা হীরা তোপা হাঁটু জলে নেমে, গাই-গোরুদের গায়ে জল ছিটিয়ে দিতে লাগল।
মেঘলা আকাশ। পুবে বাতাসে মেঘ উড়ে চলেছে। বেলা বোঝা যায় না। কিন্তু সময়ের বিচারে বেলা বুঝতে ভুল হয় না। স্নানপর্ব শেষ হতে হতে, বেলা চলে যায় পশ্চিমে। স্নানের পর, জীবেরা নতুন উৎসাহে ঘাসে মুখ নামিয়ে চরতে লাগল। যদু যখন ফিরছে, পঞ্চানন তখন বলা হীরা তোপার ভাত নিয়ে এল।…।
মধ্য রাত পেরিয়ে গিয়েছে। আকাশের অবস্থা একই রকম। মেঘলা আকাশ, রাত নিকষ কালো। ব্যাঙের ডাক ভেসে আসছে। তার সঙ্গে ঝিঁঝির। জোনাকি জ্বলছে টিপটিপ। পুবের ভেজা বাতাস বড় উতলা।
যদু রান্নাঘরে, চাটাইয়ের ওপর বসে আছে। দরজা খোলা। ওর দুই চোখও খোলা। খালি গা। ঘরে আলো নেই। বাড়ির সবাই ঘুমোচ্ছে না। মা খুড়ি খুড়ো আর দুর্গা ছাড়া সবাই অসারে ঘুমোচ্ছে। গোটা গ্রাম ঘুমোচ্ছে। মাঝে মাঝে হঠাৎ, কাছে পিঠে কুকুর ডেকে উঠছে। যদু দেশলাইয়ের কাঠি জ্বালিয়ে একটা বিড়ি ধরাল। বাঘ যেন শিকারকে চক্র দিয়ে, শেষ মাত্রায় এসে দাঁড়িয়েছে। এইবার ঝাঁপ। যদুর চোখের দৃষ্টি সেই রকম। বিড়িতে ঘন ঘন টান দিল। অঙ্গার থেকে থেকে জ্বলে, ঘর যেন আলো করে দিচ্ছে। যদু মাটিতে ঘষে বিড়ি চেপে নেভাল। চাটাইয়ের ওপর রাখা এক গাছা দড়ি আর ধারালো দা। তুলে নিয়ে উঠে দাঁড়াল। ঘরের বাইরে এসে নিঃশব্দে শিকল তুলে দিল। দুই ঘরের দিকে এক বার তাকিয়ে দেখল। ঘরের ভিতরে, বাইরের দাওয়ায় সবাই ঘুমিয়ে নেই। মা খুড়ি দুর্গা ঘরের ভিতরে। খুড়ো নিশ্চয় দাওয়ায় শুয়ে জেগে আছে। ভাইগুলোরও কেউ কেউ দাওয়ায়, ঠাকুরদার সঙ্গে ঘুমোচ্ছে।
যদু গোয়ালের দিকে দেখল। উত্তরের দিকে গিয়ে, ফণীমনসার বেড়া ফাঁক করে রাস্তায় পড়ল। চৌকিদার ডেকে গিয়েছে এক ঘণ্টা আগে। যদু উত্তর-পশ্চিমে গেল। অন্ধকারে একেবারে মিশে গিয়েছে। কিন্তু ও সব দেখতে পাচ্ছে। অন্ধকারে ছিল। অন্ধকারে চলেছে। নিশ্বাস পর্যন্ত যেন পড়ছে না। বাঁশঝাড়, বাদাড় পেরিয়ে, গোপ পাড়ায় মেঘ। পুবে শিবের পোড়। পাড়ার পুবের সীমানায় কালী ঘোষের বাড়ি। যদু সেই বাড়ির সামনে এসে দাঁড়াল। গোয়াল ঘর চেনা। চারদিক খোলা। বেড়া নেই। বাঁশঝাড় আছে। গোয়ালের পিছনে একটা ডোবা। বাড়ির সামনের দিকে দুটো জোয়াল নামানো গাড়ি।
যদু সব দেখতে পাচ্ছে। গোয়ালের প্রাণীদের পালে বাঘ পড়ল। যদু হাতের দা দিয়ে ঝপঝপ গোরু বাছুর মোষের দড়ির বন্ধন খুলে দিল। প্রাণীরা জানে, তা হলে বুঝি চরতে যাবার সময় হল। এ বার দুধ দোহন হবে। কিন্তু এমনভাবে ছাড়া পেলে, কেউ ঘরে থাকতে চায় না। হুড়মুড় করে সব বেরিয়ে পড়ল। বাঁশঝাড়ের পাশ দিয়ে, ডোবার ধার দিয়ে, শিবের পোড়োর দিকে প্রাণীরা ছুটল। যদু দড়ি দিয়ে কয়েকটির গায়ে ঝাপটা মারল। তারা অন্ধকারে কোথায় ছুটছে, জানে না। কয়েকটি ডাকাডাকি শুরু করল। তখনই বাড়ির ভিতর থেকে চিৎকার ভেসে এল, অই গো, গোরু বাছুররা সব বেরয়ে পইড়েচে। ওঠ, ওঠ, দ্যাখ কোন শালা সর্বনাশ কইরল।
যদু শিবের পোড়োর কাছাকাছি, গাছের আড়ালে অন্ধকারে ঘাপটি মেরে দাঁড়াল। জটার চিৎকার শোনা গেল, অই বাবা, সব বেরয়ে পইড়েচে। জগা বেরয়ে আয়।
পুব পাড়ার অনেক মানুষের গলা শোনা গেল। দু-তিন জন প্রাণীদের পিছনে ছুটছে। ডাকছে, অই সোনা যাদুরা, আয়। র র। হা হা।
জটার গলা। এই দিকেই আসছে। বেশ কয়েক প্রাণী শিবের পোড়োয় এসে পড়েছে। না, যদু কখনও প্রাণীদের গায়ে হাত দেবে না। জটার চিৎকার এগিয়ে এল, জগা তুই পশ্চিমে যা। হারু কোতায় রে?
দূর থেকে হারুর গলা ভেসে এল, আমি ডোবার ওপারে বাঁদাড়ে।
এমন অবস্থায় গোপদের মাথার ঠিক থাকে না। বাতি লাঠি নেবার কথা মনে থাকে না। জটারও নেই। যদু দেখল, জটার বেঁটেখাটো গুলিভাটা মূর্তি। এইদিকেই আসছে। ও হাতের দা নামিয়ে রাখল। জটা গাছের কাছে। যদু ডাল, জটা৷
কে?’ জটা থমকে দাঁড়াল।
যদু বলল, আমি যদু। ইচ্ছা করেই বলল। জটা শেষ বারের মতো জেনে যাক, কে ওকে সংহার করল। নাম বলেই, চকিতে জটার গলায় দড়ির ফাঁস পরিয়ে, শক্ত ঝাপটায় মাটিতে আছড়ে ফেলল। মাটিতে না ফেললে জটা হাত দিয়ে যদুকে ধরবার চেষ্টা করত। জটা কোনও শব্দ করার আগেই, যদুর হাতের দড়ির গিঁঠ শক্ত হল। জটার কোমরের ওপর ওর এক পা চেপে ধরা। জটা হাত তুলতে চেষ্টা করল। পারল না। সামনের মাটি খামচে ধরল। যদু অপেক্ষা করল কয়েক মুহূর্ত। যখন নিশ্চিন্ত হল, জটার শেষ নিশ্বাস বেরিয়ে গিয়েছে, তখন ফাস খুলে, দড়ি গুটিয়ে নিল। পা দিয়ে জটাকে চিত করে দেবার মুহূর্তে, গলা দিয়ে অস্ফুট একটা শব্দ বেরোল। যদু নিচু হয়ে জটার বুকে হাত দিল। নাকে হাত দিল। শেষ। মেয়েমানুষের বড় স্বাদ। নিশায় পড়েছিলি। নোলা এত বড়, যদুর বোনকেও তুই এই শিবের পোড়োয় ফেলে ছিঁড়ে খুঁড়ে খেয়েছিস।
যদু দা তুলে নিয়ে, নিঃশব্দে দ্রুত বাড়ি ফিরল। রান্নাঘরের শিকল খুলে ঘরে ঢুকতে যাবে। চাপা স্বর ভেসে এল, যদু ফিরলি?
খুড়োর ছায়ামূর্তি এগিয়ে এল। যদু বলল, হ্যাঁ। শুইয়ে পড়গা খুড়া। জটার অক্ত তোমাকে খাওয়াতে পাইরলাম না। তার জন্যে দুঃখ নাই। আত পোয়ালে সব খবর পাবা। আমি এখন ঘুমাব।’
যদু দা রেখে দিল উনোনের ধারে। দড়িগাছা ঝুলিয়ে দিল খড়ের চালের নীচে, মাটির দেওয়ালে বাঁশের ওপর। দরজা খোলা রইল। যদু চাটাইয়ের ওপর এলিয়ে পড়ল। হাঁ, ভারী ঘুম পাচ্ছে।
পাবারই কথা। সেই দুপুর থেকে এই রাত্রি পর্যন্ত, যদু কোনও কাজ ফেলে রাখেনি। প্রাণীদের স্নান করিয়ে ফিরে খেতেও পারেনি। খেতে পারেনি আরও চার জন। যদু স্নান করে ফিরে এসে, প্রাণীদের খাবারের জন্য খড় কাটতে বসেছিল। ওর না-খাওয়া বাপ ঠাকুরদার নজরে পড়েনি। খড় কেটে, আবার ঘাস চরায় গিয়েছিল। বলা হীরা তোপাদের সঙ্গে প্রাণীদের ঘরে ফিরিয়ে এনেছিল। বাপ খুড়ো মায়ের সঙ্গে দুধ দুইয়েছে। সব দিন সে দুধ নিয়ে যায় না। আজ গিয়েছিল। বাড়িতেও ময়রার লোকেরা দুধ নিতে আসে দূর দূরান্তর থেকে। নিজেরাও পৌঁছোয় গঙ্গার ওপারে কয়েক জায়গায়। যদু ভেবেছিল, তখন জটার সঙ্গে খেয়া পারানির সময় দেখা হতে পারে। হয়নি। জটা বেরোয়নি। বাড়ি ফিরতে রাত প্রায় আটটা বেজেছিল। মায়ের কাছে শুনেছিল, সাঁঝ ঘনাঘন জটা এই বাড়ির উত্তরের বাঁশঝাড়ের পাশ দিয়ে গিয়েছে। বাড়ির দিকে তাকিয়েছিল বাঁশঝাড়ের আড়াল থেকে। আন্দাজ পেতে এসেছিল, কী ঘটেছে। কিছু বুঝতে পারেনি। ঠাকুরদা তখন উঠোনে বসে আপন মনে গলা খুলে গান করছিল, ও হে হরি! গদা চক্র আজা বেশ/ ফেইলে আইসবে কি এ দেশ। তোমার গোধন চরা বেন্দাবনে/ ছুঁতে পাব কি ওই ছিচরণে।’….
হ, জটা নিশ্চয়ই নিশ্চিন্ত হয়ে ফিরেছিল। ভেবেছিল দুর্গা প্রাণের ভয়ে বাড়িতে কিছু জানায়নি। পশুকে দোষে মানুষ। খারাপ কাজ করলে বলে, পশুর মতো কাজ করেছে। কিন্তু পশু কখনও তার জীবধর্মের বাইরে যায় না। মানুষই তার জীব ধর্ম নষ্ট করে। তখন সে পশু না, বলো মানুষ জাতির গায়ে পচা ঘা। সেই পচা অঙ্গ নষ্ট করো। জটা ভাবতে পারেনি, ওর শমন ঘনিয়ে এসেছে। ওর প্রাণে ভাব ভালবাসা নেই। পিশাচের নেশা ছিল ওর রক্তে। কিন্তু মায়ের চোখে কেমন একটা সন্দেহ আর সংশয় ছিল। জিজ্ঞেস করেছিল, কী করবি তুই যদু?’
দেইখতে পাবা। যদু মায়ের কাছ থেকে সরে গিয়েছিল।
মা কিন্তু ওকে ছাড়েনি। বলেছিল, শোন যদু, আমার পেটের ছেলে হইয়ে তুই এমন পাপ করিস না, আমাকে গলায় দড়ি দিতে হবে।
আমার কাজের পরে যদি তাই মনে হয়, মা তুমি গলায় দড়ি দিও। যদুর গলায় দূর আকাশের মেঘের বাজ বেজেছিল।
যদু রাত্রেও খায়নি। তখন সংহার তার প্রাণে কঠিন মূর্তি ধারণ করেছিল। পর্ব শেষ না করে, দাঁতে কিছু কাটতে পারেনি। জানত মা, খুড়ি, খুড়ো, কেউ দাঁতে কিছু কাটেনি। মেয়েকে নিয়ে ইজ্জতের ভয়, ভবিষ্যতের ভয়। সেই সঙ্গে যদুকে নিয়েও ভয় ছিল। ও মুখ ফুটে কারোকে কিছু বলেনি। কিন্তু সব কিছু ছকে রেখেছিল। সেই সংহার-পর্ব শেষ করে, আর জেগে থাকতে পারেনি। জ্বালা জুড়ানো ঘুমের কোলে ঢলে পড়েছিল।
জীবদের খাওয়ানো দোহনের জন্য ঘুম ভাঙার কথা ভোর রাত্রে। কিন্তু ঘুম ভাঙল মায়ের ডাকে। মা ওর গায়ে ধাক্কা দিয়ে ডেকে তুলল। যদু উঠে বসে মায়ের মুখের দিকে তাকাল। বাইরে ভোরের আলোয় ফরসা। মায়ের চোখের তারা দুটো যেন ফেটে বেরিয়ে আসছে। ঘন নিশ্বাসে বুক ওঠা-নামা করছে। কোনও রকমে ডাকল, যদু।
যদুর এক মুহূর্ত লাগল ঘুমের ঘোর কাটতে। রাত্রের কথা মনে পড়ল। তারপরে দেখল, মা থরথর করে কাঁপছে। যদুর বুকে হাত রাখল। মায়ের ঠোঁটও কাঁপছে। চোখে টলটল করছে জল। গলার স্বর নেই। ফিসফিস করে বলল, যদু, জটাকে কে শিবের পোড়োয় খুন কইরেছে।
যদু মায়ের চোখের দিকে তাকাল। মা ছেলের চোখাচোখি অপলক। মায়ের স্বর তেমনি ফিসফিসে, যদু, তুই?
ক্যানে মা, তা’লে কি তুমি গলায় দড়ি দেবে? যদুর স্বরে নিস্পৃহতা।
মা জানু পেতে বসে, দু হাত বাড়িয়ে যদুকে বুকে টেনে নিল, কতকাল তোকে বুকে নিই নাই যদু। তুই আমার পাপনাশা ব্যাটা। আমি ক্যানে গলায় দড়ি দেব বাবা।’
মায়ের ভেজা স্বর ডুবে গেল। যদুর গায়ে পিঠে হাত ফিরতে লাগল। যদু বলল, মা, এ ছাড়া আমার আর উপায় ছিল না।
কিন্তু তোকে নিয়ে টানা হ্যাঁচড়া হবে না ত?’ মায়ের স্বরে উদ্বেগ, গাঁয়ে পুলিশ এইসেচে। তোর বাপ ঠাকুদ্দা সেখেনে গেচে। গোটা গাঁ, আশপাশে হুলুস্থুল পইড়ে গেছে।’
যদু মায়ের গায়ের ঘ্রাণ, অনেক দিন এত কাছ থেকে পায়নি। মায়ের এমন স্পর্শও না। যদুর মনের মধ্যে এক অভূতপূর্ব অনুভূতির আলোড়ন হচ্ছে। ও বুঝতে পারছে না, সবকিছুর পরে, এখন কেন ওর বুকে মোচড় দিচ্ছে। চোখে জল আসছে। মায়ের হাঁটুতে হাত রেখে বলল, যদি ধরা পড়ি, ফাঁসি যাব। তার বাড়া আর কী হবে? তবে মা, একটা কথা বলি, হত্যে করা পাপ। জটাকে ক্যানে, কোন মনুষ্যিকে হত্যে করার কথা জেবনে ভাবি নাই। কিন্তু জটা যে পাপ কইরেছিল, আমি থাইকতে পারি নাই। খুড়ো জটার অক্ত খেইতে চেইয়েছিল। আমি ওর বুকের অক্ত লিয়ে আইসতে পাইরতাম৷ এ কি কখনও সয়? আমার বোনকে ও হাঁস মুরগির মতন শেয়াল মুখে কইরে নিয়ে যাবে? তবু মা, এই তোমাকে ছুঁইয়ে।
দিন কাল বইদলেচে। তুই ধরা পইড়লে, আমি পেরানে বাঁইচব না যদু। আর শোন, ক্যানে তোকে কাল বার বার জিগেস কইরচি, কী কইরবি তুই? এমন পাপ করিস না, আমাকে গলায় দড়ি দিতে হয়? এখন খুইলে বলি বাপ, আমার কেমন সন্দ হইয়েছিল, তুই শোধ নেবার জন্যে, জটার বোনকে–।’..
মায়ের গলা দমকা কান্নায় ডুবে গেল। শরীর কাঁপিয়ে ফুঁপিয়ে উঠল। যদু মায়ের হাঁটুতে মুখ রেখে, নিচু আর্তস্বরে ডেকে উঠল, অই গো মা, আমি তোমার পেটে জইম্মেচি।’….
আঃ আঃ হা হা।’ মা যদুর মাথায় মুখ চেপে কেঁদে উঠল। কান্নায় ভেঙে পড়া স্বরে বলল, তোকে আমি পেখম পেটে ধইরেচিরে যদু। তুই আমার অতন ধন বাপ। এখন ঠাকুর গিরিগোবদ্ধনকে বলি, আমার কুচিন্তার ক্ষ্যামা দাও। আমার মুখে যেন কুট না হয়।
যদু মায়ের হাঁটু থেকে মুখ না তুলে বলল, না মা, তমার কখনও কুট হবে না। ঠাকুর সব বোঝেন।
ননীবালা কখন দরজার সামনে এসে দাঁড়িয়েছে, মা ছেলে টের পায়নি। সে এ বার ঘরে ঢুকে এল। তার চোখেও জল। অথচ একটা ত্রাসের ছায়া দুই চোখে। দুজনের সামনে বসে, দুজনের গায়ে হাত দিল। যদু মুখ তুলে তাকাল। খুড়ি বলল, বাড়ির ছেলেগুলান কালী ঘোষের বাড়ি থেকে ফিরে এইসেচে। তোমাদের এভাবে দেইখলে ওদের মনে নানা কথা গাইবে।
হ্যাঁ, আমি উঠি। যদু মাথার কাছে রাখা গামছা দিয়ে নিজের মুখ মুছল, মা ভয় পেইয়ো না। যা ঘইটবার ঘইটেচে। সাজা যদি আমার কপালে থাকে, হবে। ও মা, আমি তোমার পেটের হুঁ, আমি তোমাকে খেতে চাব না। কিন্তু ক্যানে তোমার মনে ওই কুচিন্তা এইসেছিল, তা আমি আন্দাজ কইরতে পারি।
মা যদুর দিকে জলভরা চোখে তাকাল। ছেলে মায়ের চোখের দিকে তাকিয়ে ম্লান হাসল, না, আর একটা কথাও জিগেস কইরবা না। খুড়ি ঠিক বলেছে, বলা হীরা তোপারা যেন কিছু বুইঝতে না পারে। বাপ ঠাকুদ্দা গেচে কালী ঘোষের বাড়িতে। এখনও দুধ দোয়া, গাই গোরু মোষদের খাওয়ান বাকি। আমি উঠি। খুড়ো একলা পাইরবে না।
মা বলল, আমিও দুইতে যাই।
খুড়ি। যদু খুড়ির দিকে তাকাল। চোখে ওর জিজ্ঞাসা।
খুড়ি যেন এই ডাকে, যদুর চোখে এই চাহনিটির অপেক্ষায় মরছিল। যদুর মায়ের মতোই যদুর মাথা বুকে চেপে ধরল, তোর মা, যদু, দিদি আমরা এমন, এক দিনের তরে মনে হিংসে কইরতে পারি নাই। আজ কইরচি, তোর মতন ছেলে ক্যানে পেটে ধইরতে পারলাম না। খুড়ির গলার স্বর কান্না ভেজা।
যদুর চোখে মুখে কোনও সুখের ঝলক নেই। বলল, শান্ত থাক খুড়ি। আমার ভাই বলা তোপা কি খারাপ? আমাদের বোনটা কি খারাপ? আমি গদাধর ঘোষের নাতি। মন শান্ত রাখ। আমি কাজে যাই। ভাইগুলান লইলে চরে যেইতে পাইরবে না। পেরানিরা ছটফট কইরবে। ওদের চরে পাটিয়ে, আমিও কালী ঘোষের ঘর যাব। ওদের পেরানিগুলানের কী হল, দেইখতে হবে। দুগগা কেমন আছে?
ভাল না বাবা। পেটে বড় যন্তন্না,..হাইটতে পাইরচে না।’ খুড়ি যদুকে ছেড়ে দিল।
যদু অন্যমনস্ক চোখে ঘরের বাইরে এল। উঠোনের ওপর, গোয়ালের নীচে, দুধেল গাই মইষীরা সার সার দাঁড়িয়ে। বাছুরগুলো নিচু গোয়ালের সামনে, খোলা জায়গায় খুঁটিতে বাঁধা। ডাকাডাকি করছে, মা-আঁ অ্যাঁ। মায়েরাও সাড়া দিচ্ছে। যেন স্পষ্টই বলছে, র বাপ, দোয়া হোক।’..খুড়ো একটা মহিষীকে দোয়াচ্ছে। বলা হীরা তোপা দুইতে পারে। তবে এখনও তেমন চৌকস হয়নি। ওরা প্রাণীদের খাবার তৈরিতে লেগে গিয়েছে। কোনও কোনও গাইয়ের সামনে খাবার দেওয়া রয়েছে। না দিলে দুধ দুইতে দিতে অশান্তি করে। দুটো গাইয়ের পা বাঁধা। দুটোই বড় দুষ্টু। প্রথম বিয়োনি গাই। দুইতে গেলেই লাফ ঝাঁপ দেয়। চাট মারে। নিজের বাচ্চাদেরও কাছে ঘেঁষতে দিতে চায় না। দুধের পাত্র লাথি দিয়ে ফেলে দেয়। অথচ একুশ দিন বিয়েন হয়েছে। পাঁচ দিনের গাঁজা দুধ গঙ্গায় দিয়ে আসা হয়েছে। প্রথম দোয়ানো দুধ গাঁজা দুধ। ও দুধ রাখতে নেই। একুশ দিন হয়ে গেল তার মধ্যে একটার চব্বিশ দিন। তবু দুষ্টুমি যায়নি। যদু ওদের দোয়। যদুকে ভয় পায়। ওটাও দরকার। শাসন করতে হয়। বাবা পারে না। খুড়ো রেগে গিয়ে ঠ্যাঙাতে আরম্ভ করে। ঠেঙিয়ে কি বশ করা যায়?
ভূপা আর পানু পশ্চিমের নিচু গোয়ালের কাছে দাঁড়িয়ে, গুড়াকু দিয়ে দাঁত মাজছে। আসলে বলা হীরা তোপার সঙ্গে জটার খুনের বিষয় গল্প করছে। দুর্গা নিশ্চয়ই ঘরে। মা একটা বালতি নিয়ে, গোয়ালের ধারে গাই দোয়াতে বসল।
সব গোরু মোষের গলায় ঘন্টা বাধা। ভঁস মাছি গেলেই, ল্যাজ মাথা নাড়ানোর সঙ্গে, ঘণ্টা বেজে উঠছে। ঘণ্টার সঙ্গে শাঁখের পিছনের সরু অংশ ঘণ্টার সঙ্গে বাঁধা। খারাপ নজর যেন না লাগে। কারোর গলায় কড়ির মালা। নানা রঙের পুতির হার। মহিষীদের শিং সিঁদুরে রাঙানো। সকলের পাছায় একটা করে তীরের দাগ আছে। যাদের যেমন পছন্দ। আগুনে পুড়িয়ে ছ্যাকা দিয়ে তীরের দাগ করা। চিহ্ন একটা রাখতে হয়। অন্যেরা নানা রকম দাগ দেয়।
যদু পুবের ঘরের দাওয়ার সামনে গেল। দোহনের পাত্র সব সেখানে। পরিষ্কার করে ধোয়া। এ সব কাজ মা খুড়ি দুর্গার। রাত্রেই সেরে রাখতে হয়। দুর্গা গত রাত্রে নিশ্চয়ই এ কাজ পারেনি। যদু একটা বালতি নিয়ে, খুড়োর পাশে মহিষীর কাছে গিয়ে বসল। সামনেই তেল-জলের পাত্র। দু হাতে তেল-জল মেখে নিল। খুড়োর হাত থমকে রয়েছে মহিষীর বাঁটে। তাকিয়ে আছে যদুর মুখের দিকে।
যদু তাকাল। অধরের দুচোখে বিস্ময়। যেন অলৌকিক কিছু দেখছে যদুর দিকে তাকিয়ে। যদু মহিষীর পালানে তেল-জলের হাত দিয়ে একটু চেপে বোলাতে লাগল, খুড়ো কী দেখ? ৫৭৮
তোকে৷’ অধরের মুখে অলৌকিক বিস্ময়ের ঝলক। চোখেও। বলল, তুই আমাকে সত্যি পাপীর অক্ত খাইয়েছিস যদু।
যদু মহিষীর পালানে আস্তে আস্তে চাপড় মারল, মইষীর দুধ পলকে যাবে। দোও।
.
মায়ের মনে ক্যানে অমন কু জেইগেছিল? কারণ আছে।
যদু এ বছরেই বৈশাখে বাথান নিয়ে বেরিয়েছিল। বামুনপাড়ার হৃদয়নাথ ঠাকুর প্রতি বছর, বাথান যাত্রার সময় মেঘ বৃষ্টি ঝড়ের ভবিষ্যৎ বলে দেয়। এ বছর বৈশাখে অতি বৃষ্টির কথা ছিল। পাঁজিতে নাকি বলেছে। অতএব, যাত্রা দক্ষিণে না। অতি বৃষ্টি হলেও, দক্ষিণে উঁচু জায়গা আছে। তবু গাঁয়ের সব গোপেরা সাব্যস্ত করেছিল, নদীর ওপারে যাবে। সেখানে আরও বেশি উঁচু জায়গা আছে। মনেও স্বস্তি থাকে। গঙ্গাও বৈশাখে অনেক ক্ষীণা। টান থাকে। প্রাণীদের ভেসে যাবার ভয় থাকে না। তা ছাড়া, গত অগ্রহায়ণে মায়াদোলের মাঠে, গোরুর মড়ক লেগেছিল। সে মাঠ ঠ্যাকারের মাঠ। অশুভ জায়গা। যদুদের সাতটি গোরু বাছুর মরেছিল। খারাপ বিষাক্ত ঘাস ছিল। ঘাস দেখে সবসময় বোঝা যায় না। বুঝতে বুঝতেই, সকলের মিলিয়ে প্রায় সাতাশ জীবের প্রাণ গিয়েছিল।
গত বৈশাখের বাথানে বাবা ঠাকুরদা গিয়েছিল। আর গিয়েছিল বলা, হীরা। অধর বাড়িতে ছিল। দু-একজন বড় মানুষকে বাড়িতে থাকতেই হয়। কাছাকাছি থাকলে বাড়ি যাতায়াত করা যায়।
যদুরা ছিল পাঁচ জন। অন্যান্যদের মিলিয়ে বাথানে সবসুদ্ধ লোক ছিল এগারো জন। জটাও ছিল। তবু যদুরা সংখ্যায় বেশি ছিল। সেই কারণে, কয়েক ঘরের একজন করে লোক ছিল। যদুদের সঙ্গে রাখালি ব্যবস্থা ছিল। তারা অন্যদের বাথানও সামলাবে। চুক্তি নগদে হয় না। একটা কি দুটো গোরুর দুধ রোজ হিসাবে পাওয়ানা হয়।
সব মিলিয়ে প্রায় আড়াই শো গোরু বাছুর মহিষ। তার সঙ্গে ষাট-সত্তরের মতো ভেড়া। ভেড়া আর বাছুরদের নৌকোয় পার করাতে হয়। ভেড়া জলে নামতে চায় না। বাছুরদের ভেসে যাবার ভয় থাকে। বাকি সব প্রাণী সাঁতার কেটে পার হয়। তাদের সঙ্গে লাঠি নিয়ে দু-চার জনকে সাঁতরাতে হয়।
বৈশাখের মাঠে ধুলা উড়িয়ে প্রাণীরা যাত্রা করেছিল। জলে নামবার আগে তিন মাইল উত্তরের উজানে যেতে হয়েছিল। তিনটি নৌকার ব্যবস্থাও ছিল সেখানে। প্রাণীদের পায়ের খুরের আঘাতে ধুলা উড়ছিল। গলার ঘণ্টাগুলির শব্দ ছড়িয়ে পড়ছিল দূরান্তরে। ডাকাডাকির বহরও কম না। সব মা বাচ্চাদের ডাকে। বাচ্চারা ডাকে মাকে। এক মায়ের বাচ্চা ভুল করে অন্য মায়ের কাছে গেলে গুঁতিয়ে তাড়ায়। তখন হুড়োহুড়ি ডাকাডাকি বেশি পড়ে যায়।
গদাধর কোনও দিন গোপদের মোড়লি করেনি। অনেক বার তাকে মোড়ল করতে চেয়েছে গোপেরা। গদাধর হাত জোড় করে বলেছে, ও সব আমার পোষায় না। কিন্তু তার কথাতেই সাব্যস্ত হয়েছিল, বাথান যাবে পূর্বস্থলী হয়ে, বেলগাছির রেল লাইন পেরিয়ে, কুমিরপাড়া, হিসি, বড়গাছি, কালেছাতলা মাড়িয়ে নিমদেয়। ভাল কথায় বললে, নিমদহ। নিমদেয় কেন? না, জায়গা উঁচু। আর সেখানে বিরাট জলাশয় আছে। আধ ক্রোশের মতো লম্বা, আঁকাবাঁকা জলাশয়। লোকে বলে, ওইখান দিয়ে আগে গঙ্গা বহে যেত। নদীর মতিগতি বোঝে, এমন লোক সংসারে নেই। কবে কোনকালে, নিমদে থেকে গঙ্গা অনেক পুবে সরে গিয়েছে। কিন্তু তার এক টুকরো ফালি পড়ে আছে। লোকে নদীই বলে। তবে জলে টান নেই। পারাপারের সাঁকো আছে দুটো। নৌকাও পারাপার করে। জল থাকে বারো মাস। মাছও মেলে মন্দ না। চাষেরও সুবিধা।
যদু ঠাকুরদার পিছনে লেগেছিল। তোমার শউড় বাড়ির গাঁ ত, তাই নিমদেয় যেইতে চাও।
গদাধর হেসেছিল, তোর ঠাগমা মইরে গেচে। নিমদে কি আর সেই নিমদে আছে? এখন কে বা কার খোঁজ রাখে? ত বাথান লিয়ে কত বার গেচি। শউড় বাড়ির টানে নয়। পেরাণীদের মুখ চেইয়ে।
যদু তা জানত। বুড়ো ঠাকুরদার পেছনে লাগতে ভাল লাগে যে। কিন্তু ঠাকুরদার অন্যমনস্ক চোখের দিকে তাকিয়ে দেখেনি। শোনেনি দীর্ঘশ্বাস।
যদুও নিমদেয় গিয়েছে কয়েক বার। নিমদেয় ঠাকুরদার শ্বশুরবাড়ি যাবার জন্য না। গিয়েছে বটে, আসল কারণ যাবার জন্য না। জামালপুরের ধর্মরাজের মেলায় যাওয়া বৈশাখী পূর্ণিমায়। জামালপুর যেতে হলে নিমদে দিয়ে যেতে হয়। নিমদে জামালপুর পাশাপাশি গ্রাম। ধর্মরাজের মেলায় বিস্তর পাঁঠা বলি হয়। কত শত, গুনে ঠাহর করা ভার। গোটা মেলার থান রক্তে ভেসে যায়। মানুষও রক্তে মাখামাখি করে। যেন রক্ত দিয়ে হোলি খেলে। তার ওপরে আবার বলির পাঁঠা নিয়ে মারামারি লাঠালাঠি হয়। এ ওরটা ছিনিয়ে নিয়ে চায়। তবে ধর্মরাজের কাছে কোনও বাগদি বাউরিরাই কেবল না, গোপদের মধ্যেও কেউ কেউ মেতে যায়। তবে ধর্মরাজের কাছে কোনও জাতিপাতি নেই। হাঁড়ি ডোমেরা ধর্মরাজের থানে, অন্য দিকে সরে শুয়োর বলি দেয়। আর এক দিকে মুসলমানরাও পেছিয়ে থাকে না। তারাও ধর্মরাজের কাছে বলি দেয়। মুসলমান কখনও বলি দেয় না। তারা জবাই করে। কিন্তু ধর্মরাজের কাছে আলাদা ব্যাপার। দেবতা বড় জাগ্রত। সবাই তার দয়া চায়।
বাথান নিয়ে তিন মাইল উত্তরে গিয়েছিল। নৌকায় বোঝাই হয়েছিল ভেড়া আর বাছুর। গদাধর ছাড়া আরও সাত জন ছিল নৌকায়। প্রাণীদের জলে নামিয়ে, তাদের সঙ্গে তিন জন জলে নেমেছিল। যদু, জটা আর সুরীন মোড়লের ছেলে বাঁকা। প্রাণীদের সঙ্গে প্রথম নেমেছিল যদু। দক্ষিণ দিক সামলানো দরকার সবথেকে বেশি। স্রোতের টান দক্ষিণে। নৌকা তিনটি ছিল উত্তরে। হাল মাঝিরা সাবধান। নৌকা যেন প্রাণীদের ঘাড়ের ওপর এসে না পড়ে। একটু দূরত্ব বজায় রেখে চলতে হয়। ভেড়া আর বাছুরগুলো নৌকা থেকে ডাকতে আরম্ভ করেছিল।
ভোর ভোর যাত্রা করেও, রোদ উঠেছিল ঝাজিয়ে। যদু জলে ছিল। তখন রোদের ঝুঁজ পায়নি। দৃষ্টি তখন ভারী সতর্ক। কোনও প্রাণী যেন আলাদা টানে ভেসে না যায়। মাঝে মাঝেই চিৎকার করতে হচ্ছিল, ওই জটা, বাঁকা ভাই, সাইমলে।
যত সামালই দাও, সব প্রাণী এক রকম না। কেউ দুর্বল। সে গা ভাসিয়ে রাখে। দলছুট হয়ে দক্ষিণের টানে ভেসে যায়। তখন লাঠি উঁচিয়ে, দুরন্ত সাঁতারে তার গতি রোধ করতে হয়। কেউ কেউ দুষ্টামি করে। কারোর গায়ে গিয়ে পড়ে। পড়লেই সে সরে যাবার জন্যে দক্ষিণেই ফেরে। প্রাণীদের ঠিক রাখার জন্য, সাঁতার কাটতে কাটতে চিৎকার করতে হয়। সামাল সামাল! ওই র্যা বেটি, আর এদিকে আসিস না।…হাই দ্যাখ দ্যাখ, বলদটা কার ঘাড়ে চাইপচে–ওই র্যা ব্যাটা ঠিক থাক।
লাঠি উচিয়ে সাঁতার দিয়ে ভয় দেখাতে হয়। কিন্তু তাদের মাঝখানে যাওয়া চলে না। তা হলে নিজের প্রাণ নিয়ে টানাটানি। যদুর রাগ হয়েছিল জটার ওপর। ওর সব কিছুতেই বিটলেমি আর বদমাইশি। একটা মহিষীর ল্যাজ ধরে দিব্যি গা এলিয়ে ভেসে পার হচ্ছিল। যদু হাঁক দিলে, বড় জোর চিৎকার করে জবাব দিচ্ছিল, সব ঠিক পার হইয়ে যাবে, ভাবিস না।’
শালা! কিছুতেই নিজের মতলব ছাড়ে না। রোদ চলকানো গঙ্গার জলে, যদু মাঝে মাঝে ডুব দিয়ে, কোমর পর্যন্ত জাগিয়ে তুলছিল। রুপোলি জল ছিটকে উঠছিল। হা হা শব্দ করছিল। শব্দের দরকার। প্রাণীরা নিজেদের সামলে রাখে। নির্ভয়ে জল কেটে পাড়ি দেয়। যদু লক্ষ রেখেছিল বিশেষ করে গাভিন গোরু মহিষীদের ওপর। তারা নিজেরাই সাবধান থাকে। শান্ত হয়ে নদী পার হয়। কারণ তারা জানে, পেটে তাদের বাচ্চা আছে। সব প্রাণীকেই বাথানের সামিল হতে হয়। নিতান্ত রুণ খোঁড়া ব্যায়োয় ভোগাদের রেখে যেতে হয়। তারা সাঁতরাতে গিয়ে ডুবে যেতে পারে। অনেক সময় রুণদেরও নৌকায় তুলে পার করতে হয়।
পূর্বস্থলীতে উঠে, নিমদেয় পৌঁছুতে, পরের দিন দুপুর হয়ে গিয়েছিল। সূর্যাস্ত হয়েছিল বড়গাছি পৌঁছে। সেদিনকার মতো বাথানের জারা হয়েছিল সেখানেই। বড়গাছির মাঠের আলগুলোতে ঘাস ছিল বিস্তর। তাবৎ দুধেল প্রাণীদের দুধ দুইয়ে, বেলেরহাট ইস্টিশনে গাড়ি ধরে যেতে হয়েছিল কাটোয়া। সবাই না। চার জন গিয়েছিল। সেদিনের রাত্রের মতো খাবার চাল ডাল ঘর থেকেই নিয়ে বেরোনো হয়েছিল। পথে আসতে আসতে, সারাদিনে চিবোবার জন্য মুড়ি গুড়ও ছিল। দুধ বিক্রির হিসাবপত্র। টাকা পয়সা, সব ছিল বাঁকা আর যদুর বাবা শ্রীবাসের কাছে। পরের দিন ভোরে আবার দুধ দুইয়ে, দাইহাটায় সব দুধ বিক্রি হয়ে গিয়েছিল। বড়গাছির গ্রামেও বিক্রি হয়েছিল। দুপুরে নিমদেয় পৌঁছে ড্যারায় রান্না চেপেছিল। নিমদেয় পৌঁছে প্রাণীরা জলাশয় দেখে, আগে সব সেখানে ছুটে গিয়েছিল। বিশেষ করে মহিষীরা গা ডুবিয়ে বসেছিল।
পুব-দক্ষিণে বিশাল মাঠ। গাছ আছে বেশ কয়েকটি। যদু গাছতলায় খানিক বিশ্রাম করে, জলে গিয়ে নেমেছিল। সাঁতার কেটে অনেকখানি গিয়েছিল। বাঁ দিকের উঁচু রাস্তার ধারে, অনেকখানি ফাঁকা। গ্রাম নেই। গ্রাম ডান দিকে। বাঁ দিকে ফাঁকা পেরিয়ে, গ্রাম দুদিকে। গঙ্গার ফালি কিনা কে জানে। এই সুদীর্ঘ আঁকাবাঁকা জলাশয়টির জন্য নিমদেকে কেমন সুন্দর লাগে। বাঁধানো ঘাট নেই। বড় গাছের গুঁড়ি বা তাল গাছ দিয়ে ঘাট। ঘাটে ঘাটে মেয়ে পুরুষরা স্নান করে। কাপড় কাঁচে, বাসন ধোয়। গোপ আছে কয়েক ঘর। যদুদের গ্রামের মতো না। অন্যান্য চাষিবাসিদেরও গোরু মোষ আছে। তাদের স্নান করায়। হেঁটে বেড়ানোর থেকেও, জলে আস্তে আস্তে সাঁতার কেটে, গ্রামের লোকদের দেখতে ভাল লাগে।
গত বৈশাখে যদু দুপুরে জলে নেমে সাঁতার কেটেছিল। অনেকখানি যেতে যেতে, মেয়ে পুরুষদের স্নান, কাপড় কাঁচা, বাসন ধোয়া দেখছিল। কত দূরে গিয়েছিল, ঠিক করতে পারেনি। হঠাৎ চোখে পড়েছিল, মাঝখানের জলে সাঁতার কেটে আর একজন ওর কাছাকাছি। তার মুখে মাথায় জল লাগেনি। তখনও ডুব দেয়নি। চুলের গোছা আঁট করে বাঁধা ছিল চুড়োর মতো। নাকে চিকচিক করছিল নাকছাবি। মুখোনি ফরসা। নাক মুখ কাটা কাটা, ধারালো গোছের। কালো চোখ টানা। ভুরু জোড়াও যেন কালি বকের উড়ন্ত ডানার মতো। শরীর জলের নীচে। ডান কাঁধে বেগুনি রঙের শাড়ির আঁচল নিশ্চয় শক্ত করে কোমরে বাঁধা ছিল। গলার নীচে, মাঝে মাঝে কাঁধ অবধি দেখা যাচ্ছিল। থেকে থেকে হাত উঠলে, কবজিতে রোদে জলে ঝিলিক দিচ্ছিল কাচের চুড়ি। কিন্তু জল ছিটকে উঠছিল না একটুও। কেবল তাকে ঘিরে, জলের তরঙ্গ খেলছিল। বয়স কত? সধবা না আইবুড়ো?
আইবুড়ো, সন্দেহ ছিল না। না হলে, হাতে কেবল কাচের চুড়ি থাকত না। শাখা লোহা থাকত। টেনে বাঁধা চুলের চুড়োয়, সিঁথিও দেখা যাচ্ছিল। সিঁদুরের দাগ ছিল না। মুখোনি ধারালো বটে, হাসি নজর বেশ তরতরে। কচি মুখ দেখলে বোঝা যায়। যেমন বকনা দেখলে চোখের ভুল হয় না। যদু থমকে গিয়েছিল। সে থমকায়নি। তাকিয়েছিল যদুর দিকেই। চোখে মুখে হাসি। যদু জানত, সে জলাশয়ের গভীরতা তেমন নেই। বর্ষাকালে বাড়ে। জলের ভিতর তার শরীরের আন্দোলনে, তরঙ্গ যদুর গায়ে এসে লেগেছিল।
সাহস তো খুব! অল্প বয়সি মেয়ে। অচেনা পুরুষকে ভয় নেই? ক্রমেই যে কাছে আসছিল। মুখের টিপে রাখা হাসির ঠোঁট ফাঁক হয়েছিল। ঝকঝকে দাঁত দেখা গিয়েছিল। যদু বুঝতে পারেনি, কোন পাড়ের মেয়ে। বাঁয়ের না ডাইনের। বুঝতে পারার কথা না। সে কোন দিক থেকে এসেছিল, একেবারে নজর করেনি। তার নজর ছিল ডাইনে বাঁয়ের ঘাটে। সামনে যে একটি মেয়ের মাথা ভেসে আসছিল, খেয়াল করেনি। ও অবাক হয়ে ডাইনে বাঁয়ের ঘাটের দিকে তাকিয়ে ছিল। ভরা দুপুরের ঘাট। ভিড় তেমন ছিল না কোনও ঘাটেই। যারা ছিল, তাদের মধ্যে বাঁ দিকের একটা ঘাটে দুই-তিন স্ত্রীলোক। তারাই যদুদের দিকে তাকিয়েছিল। নিজেদের মধ্যে কিছু বলাবলি হাসাহাসিও করছিল।
ঠিক ভেবেচি, গঙ্গার ধ্যেরে ভূত। জলে বেশ তরঙ্গ তুলে মেয়েটি বলেছিল। হেসেছিল খিলখিল করে। যদুর মুখে জল ছিটিয়ে দিয়েছিল। দিতে গিয়ে নিজের ফরসা মুখেও কয়েকটি কণা ছিটকে লেগেছিল। মুক্তা বিন্দুর মতো জলের কণা চিকচিক করছিল।
ডাঙার পথে বা ঘরের দরজা উঠোনে হলে এক কথা। জলেও কেউ এমন করে কাছে ভেসে আসে? গোপের ব্যাটা যদু। প্রথমে কেমন অলৌকিক ঘটনা মনে হয়েছিল। গঙ্গার ধ্যেরে ভূত’ শুনে চমকে উঠেছিল। নিজেদের মধ্যে বলাবলি হয়, সেটা আলাদা কথা। অন্য লোকে বললে গায়ে বাজে। কিন্তু সে এমন করে বলেছিল, বলে হেসেছিল, যদুর বেজেছিল। তবে গায়ে না। অন্য কোথাও, বাজের সুরটাও বেজেছিল অন্য রকম। তা ছাড়া আবার জল ছিটিয়ে দিয়েছিল যদুর মুখে, সে কি কেবল সাহস? না, তার ওপরে কিছু। তবু যদু একটা কথাও বলতে পারেনি। হাসবে কি না, তাও ঠিক করতে পারেনি। হাসিই যে পায়নি। কেবল মনে ঠাসা কৌতূহল। তার সঙ্গে, ওই কথা হাসির একটা তাল বাজছিল।
আজ এইলে?’ কয়েক হাত দুরে, ভেসে থেকে সে জিজ্ঞেস করেছিল।
যদুকে তখন জবাব দিতেই হয়েছিল, হ্যাঁ।
চিনতে পাইরচ না, না কি? মেয়ের কালো টানা ভুরু কুঁচকে উঠেছিল।
চিনবে কেমন করে? এমন ঘটনাও ঘটে? জলে ভাসতে ভাসতে এক রূপসী এসে জিজ্ঞেস করছে, চিনতে পারছ? মাথায় সব তালগোল পাকিয়ে গিয়েছিল যে! মেয়েটি যে ডাগর, যদু দেখেছিল। সে জলের নীচে দু পা নাচিয়েছিল দুরন্ত। জলে ভেসে উঠেছিল তার কাঁধ ছাড়িয়ে, শক্ত বাঁধনে আঁচল। জড়ানো বুক। ওই হাঁ, ছেউটি কড়ে বুক জোড়া ভেজা আঁচলে লেপটে ছিল। যদুর চোখ খেয়েছিল। জলে না তরঙ্গ রক্তে লেগেছিল। গৃহস্থের মেয়ে না সে? ভয় ছিল না? অচেনা বিদেশি পুরুষের সামনে, এত অনায়াস হয়েছিল কেমন করে? ঘর সমাজের চোখ রাঙানির রেয়াত ছিল না?
নিশ্চয় ছিল। নইলে বাঁ দিকের ঘাটে, দুই-তিন স্ত্রীলোকের দিকে তাকিয়ে হেসেছিল কেন? কথায় সংকেত ছিল, মেয়ে কোনও অচেনার সঙ্গে কথা বলেনি। না হলে ভুরু কুঁচকে জিজ্ঞেস করবে কেন, চিনতে পারছ না? না, যদু পারেনি। কেমন করে পারবে? যদি কোনও দিন দেখেও থাকে, তবু পারেনি। পারে নাকি কেউ? ভর দুপুরে, জলে ভাসতে ভাসতে আচমকা মুখোমুখি এক মেয়ে। ছেউটির গায়ে ডাগরির লক্ষণ।
অই, ভর হয়েছে নাকি?’ ঝপাৎ করে যদুর চোখে জল ছিটিয়ে দিয়েছিল। কাচের চুড়িতে ঝিলিক। বেজেছিল ঠিঠিন। আবার হেসেছিল খিলখিল, সত্যি চিনতে পাইরচ না?
জলের ঝাপটায় যদু ঝাপসা দেখেছিল। জোর ঝাপটায় নাকেও জল ঢুকেছিল। জানা চেনা হলে, যদুও ছাড়ত না। হাত দিয়ে চোখ মুখের জল মুছেছিল, না।
তা ক্যানে পাইরবে? গঙ্গার ধ্যেরে ভূত!’ বাঁ দিকের ঘাটে মুখ ফিরিয়ে আবার খিলখিল হাসি। স্বর চড়িয়ে বলেছিল, চিনতে পাইরচে না। বাথানের গাই হলে পাইরত।
হাঁ, কথাটা মিথ্যা বলেনি। নির্যাস সত্যি। পাছায় তীরের ছাপনা থাকলেও, গোপের ছেলে নিজেদের প্রাণীকে চিনে নিতে পারে। জলের মেয়ে সে কথাও জানত। ঘাট থেকে অস্পষ্ট হাসির টুকরো ভেসে এসেছিল। যদুর বুকে তাল। মনে তখন অস্বস্তি। সত্যি, গঙ্গার ধ্যেরে ভূত বটে। এত কথার পরেও চিনতে পারছিল না কেন?
যাগগা, চিনতে য্যাখন পার নাই, চেনা দিতে চাই না। মেয়ের টানা কালো চোখের তারা এক মুহূর্ত স্থির। মন ব্যাজারে ঠোঁট ফোলানো। জলের ওপর দু হাত ভাসিয়ে, পিছন ফিরেছিল। টেনে তোলা চুলের নীচে ফরসা ঘাড় গলা জেগেছিল।
যদুর প্রাণে তখন হায় হায়। চলে যাও ক্যানে? গঙ্গার ধ্যেরে ভূতটাকে অকূলে ভাসিয়ে যাচ্ছ যে। এতটাই যখন বললে, একটু ধরতাই দিয়ে যাও। না, মেয়ে তখন নিজের চারপাশে তরঙ্গ তুলে, ঘাটমুখী। গোপের ব্যাটা যদু। থাকতে পারে নাকি? পিছু পিছু যায়নি। যেখানে ছিল, সেখানেই ভাসছিল। কিন্তু, মনের আগল খুলে গিয়েছিল। জিজ্ঞাসা আটকে থাকেনি। জিজ্ঞাসার রকমটা ভিন্ন, তা গঙ্গার ধ্যেরে ভূত মন কলা পোড়া খেইয়েচে।
বটে?’ জলের তরঙ্গ উলটে গিয়েছিল। মেয়ে যদুর দিকে ফিরেছিল। আবার হেসেছিল খিলখিল। মন কলা পুড়িয়ে খেইয়েচে? মনে পইড়চে না?’ আবার হাসি, মান তবে, গঙ্গার ধ্যেরে ভূত তুমি?
যদু সেই প্রথম দ্বিধা করে হেসেছিল। মেয়ে জিজ্ঞেস করেছিল, ক্যানে কীসে এমন মন কলা পোড়া খেইয়েছে?
জলে ভাসতে ভাসতে এত কথা বলা যায় নাকি? জিজ্ঞাসাবাদের জবাব? বলেছিল, সেই ভোর রাত্তিরে দোয়ানি সেইরে বড়গাছি থেনে এইসেছি।
ত কী?’ মেয়ের রোদ লাগা ফরসা মুখে, মুক্তা কণা শুকিয়ে গিয়েছিল। ঠোঁটে টেপা হাসি, তাতে মন কলা পোড়া খাবার কী আছে? বে’র জন্যে মেয়ে দেখা হচ্ছে বুঝি?
যদু তখন কিঞ্চিৎ সহজ। হেসেছিল। না। তা কাদের–কোন বাড়ির–?’
ঘাটে এস। যদুর কথা শেষ না করতে দিয়েই, হংসীর সেই প্রথম ডুব।
ডুব তো ডুবই। আর দেখা দিল না। যেন বড় মাছে ঘাই, তরঙ্গ তুলে ডুব দিয়েছিল। যদু জলের দিকে তাকিয়েছিল। হাঁ, মেয়ে। তা মানুষ তো? যদু যেন চক্ষে হারাচ্ছিল। দম আগলে মেয়েটা ঠিক, মানুষের মতোই ছিল। যদুরই মনের গতিকে দম শেষ হয়ে আসছিল। মাত্র সাত-আট হাত দূরে, ভুস করে জেগে উঠেছিল এক রাশ চুল। রুপোর মতো ছিটকে গিয়েছিল জলের কণা। মেয়ে ফিরে তাকিয়েছিল যদুর দিকে। মুখ ঢাকা ভেজা চুলের রাশি। তার ফাঁকে চোখ পঁত দেখা যাচ্ছিল, কই, এলে না?’
যদুর মনে দ্বিধা। ঘাটের দিকে তাকিয়েছিল। এক স্ত্রী তখন পিঠে ভেজা চুলে, শুকনো গামছার ঝাপটা মারছিল। যাবে নাকি? থাকতে পারে নাকি? ভালো মন্দ যা-ই বল, মেয়ে যে ডাক-পাড়া বকনার মতো। সে চলে গেলে, বৃষ থাকতে পারে? যদু মেয়ের দিকে সাঁতার দিয়েছিল। দেখে, মেয়ে পিছন ফিরে আবার ডুব। মেয়ে জলে ভাসে। সাঁতার দিলে ডুব সাঁতার। যদু ধীরে ধীরে এগিয়েছিল। মনে দ্বিধা থাকলেও, ভরসাও ছিল। নিমদে গ্রাম। আত্মীয় বাড়ি আছে। চেনা লোকের অভাব নেই। কিন্তু মেয়ে উঠছিল না কেন? দম বন্ধ হয়ে যাবে না?
যাচ্ছিল, তবে যদুর দম। দ্বিতীয় ডুবে মেয়ে তখন ঘাটের কাছাকাছি জেগে উঠেছিল। যদু নিজেও জানত না, ওর সাঁতারের গতি বেড়েছিল। জলের পাছায় বাঁধা কালো হাঁড়ির মতো। ঘাটের কাছাকাছি পৌঁছুবার আগেই, মাটি পেয়েছিল পায়ের তলায়। মেয়ে তখন ঘাটের স্ত্রীদের বলছিল, চিনতে পারে নাই গো বউদি।
ঘাটের সেই রমণী তখন চুলে ঝাপটা থামিয়ে তাড়াতাড়ি গামছা দিয়ে ঘোমটা টেনেছিল। ভেজা শাড়ির আঁচল গুছিয়ে, শরীর ঢেকে সহবত হয়েছিল। প্রথম বিয়ানো দেখছে সে প্রথম বিয়ানো দুধেল কালী গাভি। হেসে তাকিয়েছিল অন্য দুজনের দিকে, অন্য দুজনের বয়স কিছু বেশি। কিন্তু ভেজা শাড়ি সাব্যস্ত করে, সধবারা হেসেছিল। তারপরে একসঙ্গে সকলের চোখ যদুর দিকে।
যদুরও তখন মনের মেঘে চিরিক চিরিক বিদ্যুৎ হানছিল। তাই তো, চেনা চেনা লাগে কেন? একজন মেয়ের দিকে তাকিয়ে হেসেছিল, তোর বাপ খুড়োর নাম বলিস নাই?
বইলব ক্যানে? মেয়ের জবাব এক দিকে। ভুরু কোঁচকানো নজর যদুর দিকে। দু বছর আগে যে দেখেচে, সে চিনতে পারে না? আমি যদি অত দূর থেকে চিনতে পারি, আর একজন পারবে না?
মেয়ে তখনও কাঁধ অবধি জলে ডুবিয়ে রেখেছিল। যদুর মনের মেঘে বিশাল বিজলি মালা ঝিলিক দিয়েছিল। কড়াৎ করে বাজ পড়েছিল বুকে। বুকে পড়া বাজটা আসলে, হঠাৎ খুশির হাসি, অ, মাদেব খুড়োর–?’
এত-অ-অ-ক্ষণে! মেয়ে জলে বুক তুলে দাঁড়িয়ে ছিল। খয়েরি ডোরা শাড়ির বন্ধন আঁট। শুক্লা ত্রয়োদশী কিংবা চতুর্দশী। ভেজা শাড়ি জোড়া ডাসায় লেপটে। কালি বকের ডানা ভুরু কুঁচকেই ছিল। ধনুকের মতো। কালো তারা তীরের মতো লক্ষ্যভেদে যেন উদ্যত, যাক, মাদেব ঘোষের কী ভাগ্যি, দিসারার গদাধর ঘোষের বড় নাতির তাকে মনে পইড়েচে।
যদুর চোখে তখন ভেলকি দেখার বিস্ময়। দু বছর আগে দেখা, রোগা রোগা, ফ্রক পরা একটি মেয়ে ওর চোখে ভাসছিল। এমনও হয়? দু বছরে এতখানি মাথা চাড়া দেওয়া? একেবারে, সেই কী বলে– সত্যি, ডাক পাড়া বকনার মতো। শরীরে যদিও তখন কচি কাঞ্চন লতার কৈশোর, তবু দেখ, মরিয়া হয়ে বেড়ে ওঠার লক্ষণ বড় দুরন্ত। উঠোনের ঘর কেটে এক্কা দোক্কা খেলত মেয়ে। খেলতে খেলতে মায়ের ডাকে ছুটে যেত ঘরের কাজে। দৌড়ে গিয়ে বাছুর বাঁধত। এঁটো থালাবাসন নিয়ে ধাঁ ছুট ঘাটে। এগারো-বারো হবে তখন। দু বছরে এ কি মায়া? কোন গুণিনের জাদুতে এমন হয়? যদু সেই জাদুর অন্ধিসন্ধি জানে না। কারণ প্রকৃতির লীলাটা ওর শরীরেও যে জাদু করেছে, নিজের লক্ষ নেই। কেমন করে চিনতে পারবে, এ সেই মহাদেব ঘোষের রোগা প্যাংলা মেয়েটা? যদু ঘাটের দিকে তাকিয়ে হেসেছিল, চিনতে পারি নাই।
তা সত্যি কথা বাবা।ঘাটের ওপর থেকে এক সধবা হেসে বলেছিল, কী করে চিনবে? মেয়েদের বাড় এইরকম। বাড় লাইগলে, তার আর ধরন নাই। দেইখতে দেইখতে এতখানি।
যদু আবার তাকিয়েছিল মেয়ের দিকে। মেয়ে তখন কাচের চুড়ি বাজিয়ে ভেজা চুলের গোছা টেনে নিংড়াচ্ছে। ঘাড় কাত করে, কালো চোখের তারা হানছিল যদুর মুখে, কিন্তু আমি দূরে থেকে চিনতে পেইরেচি। তা হ্যাঁ বাবা, বাড়ির খবর সব ভাল ত?’ ঘাট থেকে মহাদেব ঘঘাষের স্ত্রী জিজ্ঞেস করেছিল, তোমার বাপ ঠাকুদ্দা মা খুড়ি ভায়েরা? গাই গোরু মোষগুলানের রোগ তাপ নাই ত?
মেয়ে হঠাৎ হাতের থেকে চুল ছেড়েছিল। ঘাড়ের এক ঝাপটায় ফিরিয়ে দিয়েছিল পিঠে, অই গো মা, ঘাটে দাঁড়িয়ে আত্মকুটুম্বিতে করবে কি?
বাড়ি গিয়ে কথা হবে। গামছা মাথায় কালো বধূ যদুর দিকে এক বার দেখেছিল। তারপরে মেয়ের দিকে। দুজনের চোখে কি কোনও ইশারা ছিল?
যদুর লজ্জা করেছিল, আমি এখন বাথানের ড্যারায় যাব। সেখেনে রান্না বইসেচে।
তাতে কী হয়েছে বাপ? ঘঘাষের বউ বলেছিল, বাথান নিয়ে বেরিয়েচ। ড্যারায় ত রোজই খাবে। এ বেলাটা আমাদের বাড়িই এস। বাপ ঠাকুদ্দা কিছু বললে, খুড়ির কথা বলো। আমাদের বাড়িতে তো তুমি নতুন না। পরের বাড়ি না, ঠাকুদ্দার শউড় বাড়ি। আমি তোমার ঠাকুদ্দার শালার ব্যাটার বউ, এস।
হাঁ, নতুন না। কিন্তু যদুর কাছে নতুন লেগেছিল। এক মেয়েই যে সব পুরনোকে ভাঙচুর করে দিয়েছিল। যদু তাকিয়েছিল মেয়ের দিকে। মেয়ে তখন গাছকোমর বাঁধা ভেজা শাড়ি পায়ের দিকে নামিয়ে সাব্যস্ত। যদুর দিকে না তাকিয়ে, জল ভেঙে ঘাটে উঠেছিল। যদু তখনও থমকে। মনে ধন্দ।
নামটাও তো ছাই মনে পড়ছিল না। মেয়ে উঁচু ডাঙায় উঠে এক বার পিছন ফিরে তাকিয়েছিল। দেখেছিল যদুর দিকে। তারপরে অদৃশ্য। কিন্তু কী গুণ করে গিয়েছিল। কেবল চোখে হেনে যায়নি। হেনে, যদুর প্রাণ বিধিয়ে নিয়ে গিয়েছিল। কালো বধূও উঠতে আরম্ভ করেছিল। মহাদেব ঘোষের বউয়ের কাখে কলসি। আর একজনের হাতে বালতি। তাকেও যদু চিনতে পেরেছিল। মহাদেব ঘোষের ছোট ভাই ভবতারণের বউ। বয়স যদুর খুড়ির মতোই। সে ডেকেছিল, এস যদু।
আসবে কী, যদু তো চলেই গেছিল। তবু কী লজ্জা বলো দেখি? যদু পুবের দিকে এক বার তাকিয়েছিল। যেন বাথান ড্যারা দেখবার চেষ্টা করেছিল। তারপর আস্তে আস্তে উঠেছিল। গায়ে মাথায় জল, বৈশাখের রোদে শুকোতে আরম্ভ করেছিল। মহাদেব ঘোষের বাড়ি ঢুকে মনে হয়েছিল, সেই বাড়িতে প্রথম পা দিয়েছে।
জাতে গোপ বটে। পয়মন্ত চাষির সংসার। উঠোনের এক ধারে দুটো ধানের মরাই। তিনটি বড় ঘর। ঘরের উঁচু দাওয়া। খড়ের চাল নেমে এসেছে দাওয়া থেকে। দক্ষিণের ঘরের পিছনে ছোট গোয়াল দেখা যায়। দুটো মোষের বলদ ম্যাচলায় মুখ ডুবিয়ে তখনও জাব চিবোচ্ছিল। বাকি দুই-চার বলদ গাই বোধ হয় চরাতে নিয়ে গিয়েছিল। গোয়ালের পিছনেই ছিট-গঙ্গা। ছিট-গঙ্গার ঢালুতে মাথা তুলে দাঁড়িয়ে ছিল গোটা কয়েক মানকচু গাছ। বাড়ির সীমানার আশেপাশে গোটা আটেক নারকেল গাছ। দুই পেয়ারা। হাঁ, কচি কচি কালচে সবুজ ছোট ছোট পেয়ারা ফলেছিল। আম গাছও ছিল গোটা তিনেক। সব কটিতেই আম ধরেছিল। পেয়ারা থেকে আমের আকার বড় হয়েছিল। কাছাকাছি গোটা চারেক কলা গাছ। একটিতে নিটোল দীর্ঘ কঁচকলার ছড়া ঝুলছিল। মাটির পাঁচিল দিয়ে ঘেরা বাড়ি। বাঁশ দড়ির মই ঝাঁপ। হাত দিয়ে মাথার ওপর তুলে ঢুকতে হয়। প্রাণীরা ইচ্ছামতো ঢুকতে বেরোতে পারে না।
যদু যাদের সঙ্গে ঢুকেছিল, তারা সব কে কোথায় আড়ালে চলে গিয়েছিল। পুবের দাওয়ায় ল্যাংটা আধ-ল্যাংটা কয়েকটি ছেলেমেয়ে ভাত খাচ্ছিল। যদুর সামনে এসে দাঁড়িয়েছিল মহাদেব ঘোষ। খালি গা, হাঁটুর একটু নীচে খাটো ধোয়া ধুতি। রোগা লম্বা শক্ত মানুষ। যদুর বাবা শ্রীবাসের থেকে বোধ হয় একটু বড়। মাথার ধূসর চুল তেলতেলে। গোঁফ দাড়ি কামানো, মুখও তেল চিকন। যদুর দিকে তাকিয়ে, গালে ভাঁজ ছড়িয়ে হেসেছিল, এস গো যদু, এস। ঘণ্টাখানেক আগে জামালপুর থেকে আইসছিলাম। দেখি, পুবে বেজায় ধুলো উইড়চে। আই, ভাবি ঝড় উইটল নাকি? না, দেখি বাথান আইসচে। তোমরা আইসচ বুঝি নাই। বোশেখে তোমরা ত এদিকে পানে বাথান নিয়ে আস না।
এবারে এলাম, চক্কোত্তি ঠাউর পাঁজি দেইখে বইলেছে, এবারে অতি বিষ্টির লক্ষণ।যদু কথা বলতে বলতে, মহাদেবের দুই পায়ে দু হাত ছুঁইয়ে, কপালে ঠেকিয়েছিল, তাই সবাই মিলে সাব্যস্ত কইরলে, ঝুঁকি লেবে না। উঁচু ডাঙায় যাবে।
নমস্কারে প্রীত মহাদেব, যদুর গায়ে হাত ছুঁইয়েছিল, বেঁচে থাক বাবা, তোমাদের গোয়াল ভততি আরও জীবধন বাড়ুক। পিসে এইসেচে?
হ্যাঁ, এইসেচে’ যদু বলেছিল। পিসে হল গদাধর। যদুর ঠাকুরদা। যদু কিছু বলবার আগেই, দক্ষিণের দাওয়া থেকে, ঘড়ঘড়ে পুরুষ স্বর শোনা গিয়েছিল। কে? গদাধরের লাতি? কই, দেখি?
দেইখবে, পরে দেইখবে। মেয়ের গলা শোনা গিয়েছিল, গা মাথা মুছে, শুকনো কাপড় পরুক আগে। বাথান নিয়ে এইসেচে। গঙ্গায় নাইতে এইসেছিল। মা ধরে নিয়ে এইসেচে।
যদু দক্ষিণের দাওয়ায় তাকিয়েছিল। ঘরের দেওয়ালে ঠেসান দিয়ে বসেছিল মহাদেবের বাবা অক্রূর ঘোষ। গদাধরের থেকেও চার-পাঁচ বছরের বড়। ঠাকুরদা থেকে অনেক বেশি জবুথবু জড়। মেয়ে নেমে এসেছিল উঠোনে। শুকনো একটি গামছা, জল কাঁচা একখানি ধুতি হাতে। যদুর কাছে এসে হাত বাড়িয়ে দিয়েছিল। যদু মেয়ের হাত থেকে গামছা কাপড় নিয়েছিল। দেখেছিল, মেয়ের গায়ে তখন লাল পাড় শাড়ি। ভেজা মাথা থেকে কপালে গালে শাড়িতে জল পড়ছিল টুপিয়ে। ঠোঁটের কোণে চোরা হাসি। প্রথম দেখেছিল মহাদেবের দিকে। তারপর এক পলক যদুর চোখে চোখ। পিছন ফিরে, চলে গিয়েছিল পুবের ঘরে। মহাদেব পশ্চিমে হাত দেখিয়ে বলেছিল, যাও, ওখানে কাপড় ছেইড়ে এস।
পশ্চিমে, ঘরের পিছনে বেড়ার আড়াল করা এক টুকরো জায়গা। সেখানে গোটাকয়েক ইট পাতা। ছোট একটা ঢালু খানা কাটা। এমন কিছু আবরু না। ঘর করতে বউ-ঝিদের আসা যাওয়া হয়। যদু গামছা দিয়ে মাথা মুছেছিল। জল তেমন ছিল না। শুকনো ধুতিটা পরে, নিজের ধুতিটা নিংড়ে ফিরে এসেছিল। মহাদেব তখন দক্ষিণের দাওয়ায়, এদিকে হ্যাঁ, এখানে এস। ভেজা কাপড় গামছা রাখ। কই র্যা উমি, তেল দে।’
উমি–হাঁ, যদুর মনে পড়েছিল। মেয়ের নাম উমা। পুবের দাওয়া থেকে নেমে দু হাতে দুটো ছোট পিতলের বাটি হাতে এগিয়ে এসেছিল। এক বাটিতে সরষের তেল। আর একটায় নারকেল তেল। গরমে আর গায়ে তেল মাখতে ইচ্ছা করেনি। বৈশাখের বাথানে, কেউ গায়ে তেল মাখে না। তেল মাখতে ইচ্ছা করে অগ্রহায়ণে। বাথান নিয়ে চলতে চলতে, শীতের বাতাসে গা চড়চড় করে। খড়ি ওঠে। তখন একটু তেল মাখতে ইচ্ছা করে। নারকেল তেল সঙ্গে থাকে না। বাড়িতেও মাথায় নারকেল তেল মাখে না। ফলে, তেলের সঙ্গে সম্পর্ক কম। নাইতে যাবার আগে বড়জোর হাতের তালুতে একটু সরষের তেল নিয়ে মাথায় ঘষে নিলেই যথেষ্ট।
যদু নারকেল তেলের বাটিতে পাঁচ আঙুলের ডগা ছুঁয়েছিল। কালি গোখরো কিলবিল চুলে দু হাত দিয়ে ঘষেছিল। উমা তাকিয়েছিল বাবার দিকে। বাবা তখন তার নিজের বাবার কাছে গিয়ে দাঁড়িয়েছে। উমার চোখ ফিরেছিল যদুর চোখে। নারকেল গাছে বাতাসের ঝরঝর শব্দ। দুটো পাখির ডাক ভেসে আসছিল। কু-উ-উ। কোতায়? ডাহুকের লম্বা ডাকে কেমন একটা জিজ্ঞাসা থাকে। যেন জিজ্ঞেস করে কে? অথবা কোতায়? উমার ধনুক ভুরুর নীচে কালো তারার জোড়া তীর। সেই তীরে যদুর প্রাণ বেঁধা। না, এ বাড়িতে সে কখনও আসেনি। মনে হয়েছিল, নতুন এক বাড়িতে এসেছে। যেখানে সব নতুন। সারা জীবনে কুড়ি বছর বয়সে একেবারে নতুন বাড়িতে। নতুনের সামনে। মন প্রাণ বেবাক নতুন। দামাল গোপের ব্যাটা, ডাক-পাড়া বকনার পিছনে আসা একটা সাজোয়ান বৃষ। কোনও দিকে তার তল জ্ঞান থাকে না। যদু তার নিজের প্রাণকে দেখছিল। কালো জোড়া তীরের ঝিলিকে।
দাওয়ায় উঠে এস। উমা নিজে দাওয়ায় উঠেছিল। ঠোঁটের কোণে চোরা হাসি। ভেজা চুল থেকে তখনও জল টুপিয়ে পড়ছিল। লাল পাড়ের শাড়িতে ঢাকা গা। ছেউটির সদ্যোন্নত বুকে জলের ফোঁটা লেপটে ছিল।
হ্যাঁ, সেজো পিসের বড় ছেলে। মহাদেব তার বাবার কাছে নিচু হয়ে বলেছিল, বাথান লিয়ে নিমদের মাঠে ড্যারা কইরেচে। পিসেও এইসেচে। দিসারার বামুন ঠাকুর পাঁজি দেখে বইলেচে, এবারে অতিবিষ্টি হবে। সেজন্যে আর দক্ষিণে যায় নাই। গঙ্গা পেরিয়ে এদিকে এইসেচে।
মহাদেবের বাবা অক্রূরের মাথায় দু-চার গাছা সাদা চুল। ভুরুর চুলও সাদা। খালি গায়ে লেংটির মতো এক টুকরো বস্ত্র। ডান হাতের রোগা ডানায় শিথিল সুতোয় দুটো মাদুলি। হাঁটুর ওপর দু হাত রেখে বসে ছিল। মহাদেবের দিকে চোখ দুটোর নজর ঠিক নেই, হ্যাঁ, গদাধর এখনও পারে। আমার বোনটা মইরেচে, কিন্তু সে এখনও জোয়ান আছে। আমার থেকে বছর কয়েকের ছোট। তা হোক। সময়কালে রাইয়ের নিদেন হইয়েছিল। লইলে গদাধর আবার একটা বে’ কইরতে পাইত।
উমা খিলখিল করে হেসে উঠেছিল ঘরের দরজায় দাঁড়িয়ে। উঠোন থেকে উমার মায়ের হাসিও ভেসে এসেছিল, হ্যাঁ, তুমি যেতে শালার দোজবেরে বউ আইনতে। বরযাত্তির যেতে।
মহাদেব যদুর দিকে তাকিয়ে হেসেছিল। যদুও হেসেছিল। উমার মা দক্ষিণ দাওয়ার কাছে এগিয়ে এসে, যদুর ভেজা কাপড় আর গামছা নিয়ে গিয়েছিল। উঠোনে তখনও বেশ রোদ। পুবের কোণে নারকেল গাছ। উত্তরে ঘরের খুঁটি। দুইয়ের সঙ্গে দড়ি বাঁধা। উমার মা সব ভেজা শাড়ি গামছা দড়িতে মেলে দিচ্ছিল।
বুড়ো অক্রূর ঘোষ দাঁতহীন মাড়ি দেখিয়ে হাসল, তা কি আর যেতাম? তা যেতাম না। তবে আমার বোন রাই গদাধরের ভারী সোহাগী বউ ছিল। রাইয়ের খুব দাপট ছিল।
এখন আশীৰ্বাদ দাও বাবা, তোমার ব্যাটার বউরাও যেন পিসির মতন যেতে পারি। উঠোন থেকে উমার মা বলেছিল। তার চুলও তখন ভেজা। গায়ে ছিল নীল পাড় শাড়ি।
যদুর চোখ ঘরের দরজার দিকে। উমা সেখানে ছিল না। কিন্তু ঘরের ভিতর থেকে সে যদুর দিকেই তাকিয়ে ছিল। এ সব কেমন করে হয়? নিমদের ছিট-গঙ্গার বুক থেকে, ঘরের দরজায় টেনে নিয়ে গিয়েছিল এক মেয়ে। বাথানের ড্যারা থেকে, মোষের মতো জলে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল যদু। তা, তখন কে জানত, এমন ঘটনা ঘটবে? সে কি দৈব? যদি দৈব, তার মতিগতি এমন কেন? মেয়ে কেন এমন করে হাসে? ওই রকম চোখে তাকায়। পুরুষের প্রাণে কেন বেঁধে। মন কেন মাতে? সে সব কি সত্যি ঘটছিল? অপ্রাকৃত অলৌকিক কিছু না তো?
উমা ঘরের এক কোণে সরে গিয়েছিল। আবার তৎক্ষণাৎ ফিরে এসেছিল। কাঠের ফ্রেমে বাঁধানো ছোট একখানি আরশি, গুটিকয় দাঁড় ভাঙা এক চিরুনি। যদুর দিকে বাড়িয়ে দিয়েছিল, মাথা আঁচড়েনাও।
যদুকে দেইখেচি তো কত বার।’ অর মুখ তুলে, ভুরু কুঁচকে ডান দিকে তাকাল। নজর ঠিক নেই। চোখ উঠোনের দিকে, যদু ওর ঠাকুদ্দার মতন হইয়েছে।
যদু হাতে আরশি চিরুনি নিয়ে উমাকে দেখছিল। বৃষের তল জ্ঞান নেই। উমা তখন উঠোনে নেমে গিয়েছিল। মহাদেব বলেছিল, এখন কি আর দেইখতে পাবে?
তা ক্যানে পাইরব?’ অর আবার ফোগলা মুখে হেসেছিল, চখের মাথা খেইয়েচি। সে কোতায়?
অই, কী বিভ্রান্তি। যদু নিচু হয়ে আরশি চিরুনি রেখে, অকুরের দু পায়ে দু হাত ঠেকিয়ে, কপালে ছুঁইয়েছিল। অক্রূর হাত বাড়িয়ে পেয়েছিল যদুর চুলের গোছা। নরম রোগা অসাব্যস্ত হাত। মাথা থেকে মুখে ঘাড়ে বুকে হাত দিয়ে দেখেছিল, ঠাণ্ডা শরীল, গদাধরের মতন চওড়া পোক্ত। বেঁচে থাক দাদা। বউমা তোমাকে ধরে নিয়ে এইসেচে, ভাল কাজ কইরেচে। তুমি গদাধর ছাড়া আর কে এইসেচে?
বাপ আর দুই ভাই। যদু দেখছিল, উঠোনে কেউ নেই।
অক্রূর যদুকে ছেড়ে দিয়ে বলেছিল, সবাইকে এক বার আইসতে বোলো। দিসারার খবর সব ভাল ত? জীবধনরা সব ভাল?
আঁজ্ঞা। যদু আরশিতে এক পলকে নিজের মুখ দেখেছিল, একটা মইষী কাল থেনে পাতলা নাইদচে। বুঝতে পাইরচি না, গঙ্গা পেরবার সোময়, জলে কিছু গিলে খেইয়েছিল কি না। রাত্রে বড়গাছি। থেনেই শুরু হইয়েচে।
অক্রূরের স্বরে উদ্বেগ ফুটেছিল, দুধেল?
অল্প বেস্তর দিচ্ছিল। এখন শুকবারই কথা। মাস ছয়েক বাদে গাভিন হতে পারে।’যদু মুখের সামনে আরশি তুলে, মাথায় চিরুনি চালিয়েছিল। নেহাত ভেজা চুলে তেল পড়েছিল। না হলে সেই চিরুনি চুলে গলত না। গোটা কয়েক টানেই কোনও রকমে সাব্যস্ত করা। আরশিতে এক জনকে দেখতে পেয়েছিল। মহাদেবের বড় ছেলে দা আর এক গাছা দড়ি নিয়ে ঢুকেছিল। যদু তাকে চিনতে পেরেছিল, কার্তিক। যদুর থেকে বছর চারেকের বড়। হাতে পায়ে কাদা দেখে মনে হয়েছিল, মাটি ঘেঁটে এসেছে।
কার্তিক রান্নাঘরের দরজার কাছে গিয়ে দাঁড়িয়েছিল। সেই ঢলঢলে শরীর, কালো বউটি কার্তিকের। রান্নাঘরে কে ছিল, যদু দেখতে পায়নি। কার্তিক সেখান থেকে দক্ষিণের দাওয়ার কাছে এসে পঁড়িয়েছিল। যদুর সঙ্গে চোখাচোখি, দুজনেই হেসেছিল। কার্তিকের মুখে কয়েক দিনের আকাটা গোঁফ দাড়ি। মাথার পাতলা চুলে গায়ে মুখেও কাদা লেগেছিল। বলেছিল, বাথান আইসতে দেইখেচি। বোশেখে ত এদিকে বাথান লিয়ে বিশেষ আসে না। আমি গেছিলাম জ্যাঠার একটা ভাঙা ঘর সারাতে। বস, একটা ডুব দিয়ে আসি। ৫৮৬
উমা উঠোনে এসেছিল। মাথার চুলে একটা গামছা জড়ানো। সেটাকে চুলের গোছা সুদ্ধ নিংড়ে, জল বের করেছিল। লাল পাড় শাড়ি তখন আবার গাছকোমরে জড়ানো। চুলের গোছা থেকে গামছা খুলে নিয়ে, চুল ছড়িয়ে দিয়েছিল পিঠে। তারপরে গামছার ঝাপটা, দু হাত তুলে। ঝাপটা চুলে। দোলা বুকে। যদু আরশি চিরুনি কোথায় রাখবে, ঠিক করতে পারছিল না। হাতে নিয়েই উঠোনে নেমেছিল, চল কাত্তিকদা, তোমার সঙ্গে ঘাটে যাই।’
না বাবা, তুমি এখন ঘাটে যেয়ো না। রান্নাঘরের দরজায় উমার মা এসে দাঁড়িয়েছিল, বেলা অনেক হইয়েচে। আমি তোমার আর কাত্তিকের বাবার ভাত বেড়েচি। ঠারপো এখনও আসে নাই। এ বার আইসবে। এলে কাত্তিককে আর ওর খুড়োকেও দিয়ে দেব।
উমা তখন পুবের ঘরের দাওয়ার ওপরে, এই, ওঠ শিগগির। তিনটেতে সেই কখন খেতে বইসেচে, এখনও পাতে ভাত।
ভাত থাকবারই কথা। যদু ঢোকার পর, সবাই খাওয়া ভুলে তার দিকে তাকিয়ে ছিল। তারপরে এক সময়ে, দুটিতে মারামারিও লাগিয়েছিল। দুষ্টু গাই গোরু বলদরাও ওই রকম করে। পাশাপাশি খেতে গিয়ে, শিং গুঁতোগুতি। মাটির ম্যাচলা উলটে দেয়। তখন দু-চার ঘা দিতে হয়। উমা গিয়ে পড়তেই, মারামারি থেমেছিল। দুটিই উমার খুড়ির ছেলে। বছর তিনেকের মেয়েটি কার্তিকের। তা বউয়ের আজ্ঞা ভাল বলতে হবে। তিন বছরের মধ্যে, আর গর্ভধারণ করেনি। কথাটা যে মুহূর্তে ভেবেছিল, ঠিক তখনই উত্তর-পশ্চিম ভিটার ঘর থেকে ওঁয়া ওঁয়া কান্না ভেসে এসেছিল। সাত-আট বছরের একটি মেয়ে, সে-ঘর থেকে বেরিয়ে এসেছিল। কোলে তার চার-পাঁচ মাসের শিশু। বলেছিল, অ বউদি, তোমার মেয়ে থাইকচে না।
যাহবাবা! ভাবতে না ভাবতেই জবাব মিলেছিল। সাত-আট বছরের মেয়েটিকেও চিনতে ভুল করেনি যদু। ও উমার ছোট বোন লক্ষ্মী। ঠিক যেন সেই ছেলেবেলার রোগা রোগা ফ্রক পরা উমা। গায়ের রংটা একটু মিয়োনো। নাক বোঁচা। উমার বয়সে নিশ্চয় রংটা খুলবে। রান্নাঘর থেকে উমার খুড়ির গলা শোনা গিয়েছিল, এখানে দিয়ে যা।
আমি যাব আর আইসব। কার্তিক মই ঝাঁপের দিকে বাড়িয়েছিল, যদু, তুমি বাবার সঙ্গে বসে যাও।
কার্তিক বেরিয়ে গিয়েছিল। লক্ষ্মী যদুর দিকে তাকিয়ে হেসেছিল। যদু ভাবছিল, তবু কার্তিকের বউয়ের আজ্ঞা ভালো বলতে হবে। বছুরকে বিয়োনি না। যদু জিজ্ঞেস করেছিল, ভাল আছ নক্কী?
সাত-আট বছরের ডাগর চোখে মেয়েটি যেন ভারী লজ্জা পেয়েছিল। কেবল ঘাড় কাত করে, রান্নাঘরে গিয়ে ঢুকেছিল। যদু দেখেছিল, উমা ভাইদের কেমন ধাই ধাই দু ঘা চাপিয়েছিল। অবশিষ্ট ভাত দুজনকে হাতে করে খাইয়ে দিয়েছিল। এঁটো বাসন এক পাশে রেখে, ঝটিতি জল ন্যাতা দিয়ে দাওয়া মুছেছিল। কার্তিকের মেয়ে আর ছেলে দুটি তখন উঠোনে নেমে এসেছিল। যদুর হাতে তখনও আরশি চিরুনি। উমা দাওয়া মুছে, প্রায় দৌড়ে গিয়েছিল উত্তর-পশ্চিমের ঘরে। দুটো চটের আসন এনে পেতে দিয়েছিল পুবের দাওয়ায়। হা রে ভোলা মন তোর। মেয়ে তোকে জল থেকে টেনে এনেছে বলে অমন করে তাকিয়ে থাকতে হয়? কী করবে যদু? উমা যখন রোষভরে ভাইদের ধাই-পেটা করে খাওয়াচ্ছিল, তখনও কালো জোড়া তীরে যদুকে বিধেছিল। তখনও ঠোঁটের কোণে হাসি ছিল কেমন করে। রোষ-খুশ এক মুখে, একসঙ্গে কেমন করে খেলে? দাওয়া মুছতে মুছতে, ছুটে গিয়ে আসন এনে পাততে পাততে, সেই জোড়া তীরে যদুর প্রাণ নিয়ে ফিরছিল।
এস, আমরা বসে যাই। মহাদেব উঠোনে নেমে এসেছিল।
উমা তখন দুটো কাঁসার বড় জল-ভরা গেলাস বসিয়ে দিয়েছিল আসনের সামনে। যদু মহাদেবের সঙ্গে পুবের দাওয়ায় উঠেছিল। উমা এগিয়ে এসে যদুর হাত থেকে আরশি-চিরুনি নিয়ে ফিক করে হেসেছিল, এ কি লক্ষ্মণের ফল নাকি?
যদু বিব্রত হেসেছিল। একে বিব্রত বলে না। নিশি পাওয়া মানুষের হাসি। উমার মা দুটো কাসার বগি-থালা নিয়ে এসেছিল রান্নাঘর থেকে। চেঁকি ছাটা লাল চালের ভাত। এক পাঞ্জা উঁচু স্তূপ। ধোঁয়া বেরোচ্ছিল। পাতের এক পাশে পেঁয়াজ কাঁচা লঙ্কা দিয়ে কাঁচা পোস্ত বাটা। উমার খুড়ি নিয়ে এসেছিল দুটো জাম বাটির মতো বড় বাটি। কড়াইয়ের ডাল ভরতি। উমা তখন যদুর পিছনে। কিন্তু মনে হচ্ছিল, সে যেন সামনে দাঁড়িয়ে আছে। ক্যানে? না, উমার জোড়া তীর পিছনেও বিধছিল। তবে জীবের প্রাণ। গরম ভাত, কাঁচা পোস্ত বাটা দেখেই জিভে জল আসছিল। উমার মা অ্যালুমিনিয়ামের একটা ছোটখাটো গামলা আর হাতা নিয়ে এসেছিল। মিঠে ডিংলির তরকারি।
বে’থা হইয়েচে ত?’ মহাদেব আসনের ওপর উটকো হয়ে বসেছিল। যেমন অভ্যাস। তা আসন পাতো, আর চাটাই দাও।
উমার মার মাথায় ঘোমটা ছিল খাটো। ভুরু কুঁচকে উমার দিকে তাকিয়েছিল। যদুর মুখের গ্রাস তখন ভরতি। মা যেন একটু ঝংকার দিয়ে উঠেছিল, কেমন কথা বল? আমার পিসে শাউড়ের বাড়িতে যাগ কমমো আমাদের বাদ দিয়ে কখনও হইয়েচে নাকি? যদুয় বে হলে, নেমতন্ন পেতে না?
অ্যাঃ, যা বইলেচ কার্তিকের মা। মহাদেব হাঁটুর ওপর থেকে হাত তুলে, নিজের বুকে ছুঁইয়েছিল, জেতের বদনাম কি আর সাধে দেয়? আশি বছর না হলে, আমাদের বুদ্ধি খোলে না। যদুর দিকে তাকিয়ে হেসেছিল। আবার হাঁটুর ওপর বাঁ হাত। খাবার সময় মাটিতে হাত রাখতে নাই। হা-ভাতে হয়।
যদুর পিছন ফিরে দেখতে ইচ্ছা করছিল। পারেনি। এক প্রাণ খাচ্ছিল। আর এক প্রাণ পিছনে পড়ে ছিল। সে জোড়াসনে বসেছিল। বাঁ হাত কোলের ওপর। মহাদেব হাসতে হাসতেই বলেছিল, তবে সোময়ও হইয়েচে।
তা হইয়েচে।’ উমার মা যদুর পাতের দিকে চোখ রেখেছিল, অই গো ছোট, চাডডি ভাত নিয়ে আয়। গলা তুলে বলেছিল রান্নাঘরের দিকে তাকিয়ে। আবার স্বামীর দিকে মুখ ফিরিয়েছিল, সোময় হইয়েচে, এ বার হবে। আমরাও ত দেইখচি। তা যা দিনকাল, ছেলের বাপেরা ভাবে, মেয়ের বাপ ট্যাকার মোতলা নিয়ে বসে আছে। গোপদের ঘরে আগে এমনটা ছিল না। বামুন কায়েতদের দেখে তাদেরও এখন নজর উঁচু হইয়েচে।
যদুর গলায় ভাত আটকেছিল। কুড়ি বছরের জীবনে, এমন ফিক ব্যথার মতো কষ্ট তো আর কখনও হয়নি। এই যদি পরিণাম, তবে ওই কঁচপোকা মেয়ে? ধনুক বাঁকিয়ে, তীর হেনে, গরিবের প্রাণ তুলে নিয়ে এলে কেন? ক্ষুধা নষ্ট হয়ে গিয়েছিল। ছিট-গঙ্গার বাদাড় থেকে ডাহুকের ডাক ভেসে আসছিল, কে-এ-এ?
হাঁ, বাথান নিয়ে বেরিয়ে, এমন স্বাদের রান্না কপালে জোটে না। মুড়ি চিড়ে চিবিয়েছিল বড়গাছি থেকে পথে আসতে। তবু খিদে কম পায়নি। যদু মহাদেব, দুজনেই আরও ভাত নিয়েছিল। মিঠে ডিংলের তরকারিটি ঝাল ঝাল, বেশ হয়েছিল। কিন্তু মনে তখন কষ্ট। একই দিনে, অল্প সময়ের। ফারাকে, যদুর জীবনে সেই প্রথম এক অজানা মন ভোলানো সুখ। মন পোড়ানো কষ্ট।
অ উমি, দাঁড়িয়ে থাকিস না মা। ওর মা বলেছিল, পান তামাক সাজগা যা।
উমা সামনে এসেছিল। ঠোঁটে সেই হাসি। জোড়া তীরে বেঁধানো প্রাণ নিয়ে কী নির্দয় গরব, বাবা, তোমার বোনের বরকে যেন কী বল?’
কী বলি?’ মহাদেব ভুরু কুঁচকে, অবাক জিজ্ঞাসু চোখে মেয়ের দিকে তাকিয়েছিল। বাপ বেটিতে চোখাচোখি। তারপরেই মহাদেবের হা হা হাসি, গঙ্গার ধ্যেরে ভূত।
উমাও খিলখিলিয়ে হেসে তাকিয়েছিল যদুর দিকে। ছুটে চলে গিয়েছিল উত্তর-পশ্চিমের ঘরে। যদুর মনের কষ্ট যেন ভাসিয়ে দিয়েছিল। কিন্তু তা ক্ষণেকের জন্য। এমন মন কেমন করা আগে জানা ছিল না। টেনে নিয়ে এলে। অথচ রাখবে না। থাকবেও না। এই কি তোমার স্বভাব? যদুর জীবনে যেমন ঘটেনি। তার তো সেই প্রথম। সে প্রাণে মরবে না। মরণ তত সহজ না। কিন্তু নিমদের মেয়ে, ছিট-গঙ্গার পারের উমি, আনকোরা প্রাণ ধারালো তীরে বিধলে।
তোমার মেয়ে বড় মুখ ফাজিল হইয়েচে। উমার মা হেসেছিল। গাভির মতো তাকিয়েছিল ছুটে যাওয়া মেয়ের দিকে।
মহাদেব খাওয়ার শেষে হাত চাটতে চাটতে বলেছিল, গদাধরকে গঙ্গার ধ্যেরে ভূত বইললে, সে খুব খুশি হয়।
যদুর মনে পড়েছিল, জলে উমার প্রথম কথা, ঠিক ভেবেচি, গঙ্গার ধ্যেরে ভূত। পুরনো কথায় কি নতুন সুরের ব্যঞ্জনা। খুশি তো ছাড়। কী সুরে যে বেজেছিল কথাটি। বাজছিল তখনও। বাজবেও চিরদিন। যদু মহাদেব খেয়ে ওঠার পর কার্তিক স্নান করে এসেছিল। ভবতারণও ঢুকেছিল। বলেছিল, অনন্ত কাটোয়ায় থেকে গেছে। টাকা লিয়ে ও সন্ধেয় ফিরবে।
অনন্ত কার্তিকের ছোট, মহাদেবের ছেলে। যদুকে দেখে বলেছিল, অ, বাথান লিয়ে তা’লে তোমরা এইসেচ? দেইখলাম বটে।
সকলের খবরাখবর নিয়ে সে দক্ষিণের দাওয়ায় বসেছিল। যদুর হাতে উমা জল-ভরা ঘটি ধরিয়ে দিয়েছিল। গলার স্বর ছিল নিচু, আচিয়ে পুবের ঘরে এস।
অমন মেয়ে, এমন করে কোনও দিন যদুকে ডাকেনি। না, যদুকে রাগে কিংবা তুমি চলে যাও, অমন করে ডাকলে সে ফিরতে পারে না। মুখ ধুয়ে, ঘটি দাওয়ায় রেখেছিল। পরনের ধুতি আর মাথার চুলে হাত মুছেছিল। পুবের ঘরে গিয়ে দেখেছিল, কার্তিক কুলুঙ্গির সামনে দাঁড়িয়ে মাথা আঁচড়াচ্ছে। উমা ঘরের মাঝখানে। বাঁ হাতে হুঁকা। ডান হাতে পানের খিলি। পানের খিলিটি যদুর দিকে বাড়িয়ে দিয়েছিল, বাবার সামনে ও হুঁকো টানবে না। বাবাকে আলাদা হুঁকো কলকে দিয়েছি। তোমার জন্যে আলাদা। বাবা খুড়ো কেউ এ ঘরে আইসবে না। তুমি হুঁকো নিয়ে এ ঘরে বস।
সেইজন্যে নিচু স্বরে পুবের ঘরে ডাক। সহবত। গুরুজনের সামনে তামাক খাওয়া চলে না। কার্তিক হেসেছিল, বিড়ি খাবে?
বিড়ি ক্যানে খাবে?’ উমার ভুরু ধনুক বাঁকা হয়েছিল, আমি তালে কষ্ট করে তামাক সাইজতে গেলাম ক্যানে? তোমার আজকাল তামাকে অরুচি হইয়েচে। সবারই কি হয়?’ কথা কার্তিকের সঙ্গে। চোখ যদুর দিকে।
যদু মুখে পান পুরে হেসেছিল, আমার দুটোই চলে। বাথান লিয়ে চইলতে, ঘরের বাইরে কাজে কমমে, বিড়ি চলে।
যদি সিরগেট চাও, তাও দিতে পারি।’ কার্তিক দড়িতে ঝোলানো একটা জামার পকেট থেকে, দুটো মচকানো সিগারেট বের করেছিল।
যদু উমার হাত থেকে হুঁকা নিয়েছিল, ওই কাগজ মোড়া জিনিসে স্বাদ পাই না।
কার্তিক আবার জামার পকেটে সিগারেট দুটো রেখে, ঘর থেকে চলে গিয়েছিল। ঘরের এক পাশে ছোট একটা তক্তপোশ। তেলচিটে মাদুর ছড়ানো তার ওপর। মাটির দেওয়ালের জানালা দিয়ে অন্য বাড়ির গাছপালা ঘরের চাল, ছিট-গঙ্গার উঁচু পাড় দেখা যাচ্ছিল। যদু হুঁকা হাতে, উমার দিকে তাকিয়ে ছিল। লাল পাড় খোলা চুল, সে-মেয়েকে জলের মেয়ের থেকে ডাগরি দেখাচ্ছিল। খোলা চুল ঘন কালো না। একটু যেন খয়েরির ছোপ। মেয়ে দেখছিল যদুর খালি গা বুকের দিকে। তারপরে চোখে। চোখে চোখ পড়তে, যদু কথা বলতে চেয়েছিল। তার আগেই মেয়ের মুখে ছটা। নাকের নাকছাবিতে ঝিলিক। গঙ্গার ধ্যেরে ভূত! যাও, তক্তায় বসে তামাক খাও।
যদু আবার কথা বলতে চেয়েছিল। উমা তার আগেই ঘরের বাইরে। যদু হুঁকা হাতে দাঁড়িয়ে ছিল। চোখ দরজার দিকে। মুখের কথা মুখেই নিঃশব্দে বেজেছিল, ক্যানে এমন ডেকে নিয়ে এলে?’ ডেকে আনতে পারো। এমন করে কেন? ডাক তো যদু জীবনে কত শুনেছে। অমন করে কেউ কোনও দিন ডাকেনি। যে-ডাক রাখবার জন্যে না, সে ডাকে ডাকলে কেন? যে ডাকের মুখে, বিদায়ের সুর বেজে ওঠে, সে ডাকে কেন ডাকলে না?নই বাছুরের গায়ে নিজের দাগে দেগে দিলে। কোনও কালে তোমার বাথানে ঠাই দেবে না। সর্বনাশ তো করেছিল জলের বুকে। তখনও যদি চিনতে পারত, ও মেয়ে উমি, মাদেব ঘোষের বেটি, তা হলেও বুঝি মনের দশা এমন হত না।
তাই বা কী করে ভাব যদু? জল থেকে ঘরে তুলে নিয়ে এসেও, তার মুখের হাসি, চোখের দেখায় কোনও হেরফের হয়নি। ক্যানে? আগেও দেখেছে। যদুও দেখেছে। তবে সে বারের দেখায় কী ঘটেছিল? কেন অপ্রাকৃত অলৌকিক মনে হয়েছিল?
যদু জানত না। যদু প্রকৃতি প্রাণীর মধ্যে ঘোরে। প্রকৃতির লীলা বুঝত না। জলে নেমেও কোন মনে ছিল। মেয়েকে দেখার পর থেকেই, একটা গোটা জীবনে, মনে কী ক্রিয়া শুরু হয়েছিল। কী কষ্ট। অচেনা অজানা কষ্ট। হুঁকা টানবে কে?
অই, তুমি হুঁকো হাতে এক ঠায় দাঁড়িয়ে আচ?উমা ঘরে ঢুকে অবাক চোখে তাকিয়েছিল, কলকের আগুন নিবে যায় নাই?
কলকের আগুন নিভচে, আবার জ্বলবে। কিন্তু তুমি কী আগুন জ্বালিয়েছিলে নির্দোষী ড্যাগরাটার বুকে? সে আগুন কি নিভবে? ভরা পেট মানুষ। মুখে পান। হাতে হুঁকা। শোয়া বসার ঠাই ছিল ঘরের মধ্যে। অথচ যেন পথের হদিস খোয়ানো লোকটা দাঁড়িয়েছিল, পথের চিহ্নহীন খা খা মাঠে। মেয়ের চোখের দিকে তাকিয়ে, কথা বলতে গিয়ে চোট। বেকুবের মতো হেসেছিল, কিছু ধরা বোঝা গেল না।
কীসের ধরা বোঝা? উমা চকিতে দরজার বাইরে এক বার দেখেছিল, তোমার চখেও দেখচি সেই। ভয় লেগে আচে। কী বল তুমি? কীসের ধরা বোঝা?
উমার কালো তীর চোখে জিজ্ঞাসা। জিজ্ঞাসা ছিল যদুর চোখেও, তোমাকে।
আমাকে?’ মেয়ের হাত উঠেছিল বুকে, আমাকে কীসের ধরা বোঝা?’
যদু কাকে কী বলছিল? জলের বুকে যদুকে দেখে, মেয়ে তার নিজের প্রকৃতিতে বিকশিত হয়েছিল। নই বকনা কেন ডাক পাড়ে, সে কি জানে? ডাক আসে তার প্রকৃতি থেকে। না ডেকে পারে না। যদু সম্মোহিত হয়েছিল। সেটা তার প্রকৃতি। উমাকেও প্রকৃতিই সম্মোহিত করেছিল। ওর সম্মোহনের প্রকাশ আর এক রকম। ও কি তা জানত? সেই না জানা জিজ্ঞাসাই যদুর মুখে ফুটেছিল, আমাকে এমন। কইরে তো কেউ কখনও ডাকে নাই?
ধনুক ভুরুর নীচে কালো তীর জোড়া স্থির হয়ে ছিল। হঠাৎ কথা বলতে পারেনি। কার মাথা থেকে কলকে তুলে নিয়ে দেখেছিল। কারণ যদুর চোখের দিকে তাকাতে পারছিল না। ফরসা মুখে লাল ছটা। লেগেছিল। কলকের মধ্যে আঙুল ঢুকিয়ে টিকে উসকে দেখেছিল।, আগুন ছিল তখনও। তাড়াতাড়ি হুঁকার ডগায় কলকে বসিয়ে দিয়েছিল, টান, এখনও আগুন আছে। যদুর চোখের দিকে না তাকিয়ে। দরজার কাছে এগিয়ে গিয়েছিল। বাইরে পা বাড়াবার আগে, ফিরে তাকিয়েছিল। সাজানো হাসিতে, ছেউটিরও মনে সংকটের ছায়া, তা আমি কী জানি। আমিও কারুকে আগে এমন করে ডাকি নাই।
যদু দেখেছিল, দরজা ফাঁকা। উমা নেই। মনে হয়েছিল, হঠাৎ বুকের মধ্যে একটা পাখি খুশিতে ডানা ঝাপটা দিচ্ছিল। সে হুঁকা তুলে টেনেছিল ভুড়ুক ভুড়ুক। নিভু নিভু টিকের আগুন জ্বলে উঠেছিল। উমার। গলা শুনতে পেয়েছিল, হ্যাঁ, যাই। খুড়িকে বল, কাকার ঠাই কইরেচি।
বাইরের কথা শেষ হতে না হতেই, উমা আবার পুবের ঘরে। যদু হুঁকা থেকে মুখ তোলবার অবকাশ। পায়নি। উমার চোখের জোড়া তীরে তখন যদুর প্রাণ ধরা ঝিলিক, ডেইকেচি। বেশ কইরেচি। গঙ্গার ধ্যেরে ভূত!
চড়ুই ফুড়ুক ঢুকেছিল। দুই ডাক দিয়েই, ফুড়ুক পালিয়েছিল। চড়ুইটা যেন যদুর চোখে মুখে ঝাপটা দিয়ে গিয়েছিল। এমন তার হতভম্ব ভাব। তারপরে হুঁকার ছিদ্রে মুখ চেপে ঘন ঘন টান। টান টান কেবল। টান। শেষে বারে বারে লম্বা সুখ টান।
.
কোতায় গেচিলি তুই?’ শ্রীবাস অবাক চোখে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করেছিল, সেই কখন নাইতে গেচিস, ভাত ঘঁড়িতে পইড়ে আচে। হীরা তোপা দেইখতে গিয়ে পায় নাই।
বিশাল মাঠ জোড়া বাথান। বৈশাখের বেলায়, ছায়া তখন লম্বা। আকাশটা সারা বেলা রোদে পুড়ে, মাত্র একটু লাল হয়েছিল। প্রাণীরা এক জায়গায় জড়ো হয়ে ছিল না। মাঠের আলের, আরও দূরান্তরে যত ঘাস ছিল, সবখানে ছড়িয়ে ছিল। দুজন গোপ রাখালি করছিল। হীরা তোপা ছিল না। ঠাকুরদা গাছতলায় বসে হুঁকা টানছিল। যদুকে দেখে মুখ তুলে তাকিয়েছিল। যদুর চোখ ছিল পেটের অসুখে। খোঁড়া মইষীর দিকে, নাইতে গিয়ে ঘাটে ঠাকুদ্দার শালার ছেলে মাদেব ঘোষের বউয়ের সঙ্গে দেখা। সে খুড়ি ডেকে লিয়ে গেল বাড়িতে। খাইয়ে ছাইড়লে।
বোঝ। শ্রীবাস রুষ্ট মুখে বলেছিল, আর আমরা ভাবি ছেঁড়া গেল কোতায়?
যদু খোঁড় ব্যামো মইষীটার দিকে এগিয়ে গিয়েছিল। গোরু মোষের অসুখ হলেই খোড় ব্যামোতা সে সর্দি-কাশি জ্বর পেট খারাপ, যাই হোক, খোঁড়াবে। মইষীটার পায়ের কাছে পাতলা মলে ছড়াছড়ি। তখনও মলত্যাগ করছিল। বড় দুর্গন্ধ ছাড়ছিল। মাছি ভ্যান ভ্যান করছিল মইষীর মলদ্বারে, পাছায়, মাটিতে। ল্যাজ নাড়িয়েও মাছিগুলোকে তাড়াতে পারছিল না।
যদুর কথা শুনেই, গদাধরের চোখে জিজ্ঞাসা ফুটে উঠেছিল। সেই সঙ্গে হাসিতে ভাঁজ খেলেছিল তার মুখে, অরে সালা, তুমি এখন আমার শাউড় বাড়ির দিকে নজর দিয়েচ?
লজজর দিই নাই ঠাকুন্দা। যদু চিন্তিত মুখে ফিরে এসেছিল গাছতলায়। গদাধরের দিকে তাকিয়ে। হেসেছিল, বইলোম যে, ছিট-গঙ্গায় নাইতে গেছিলাম। তোমার সম্বদীর বড় ব্যাটার বউ বাড়িতে ডেকে নিয়ে গেচিল। তা খাটটা ভালই হইয়েচে।
দিসারার আরও দুই গোপ বসে ছিল গাছতলায়। দুজন একটু দূরে দুধের বড় বড় পাত্র মাটি দিয়ে মাজছিল। সময় আর বেশি নেই। মায়ের কাছ থেকে দূরে সরিয়ে রাখা, খুঁটিতে বাঁধা বাছুরগুলো। ডাকছিল। দিনের আলো থাকতে থাকতেই দুইতে হবে। গদাধরের চোখে মুখে কৌতূহল, কী খাটন। হল?
কড়াইয়ের ডাল, পাজ কাঁচানঙ্কা দিয়ে কাঁচা পোস্ত বাটা। ডিংলের ঝাল তরকারি। যদু বলেছিল।
গদাধর হুঁকায় দু বার টান দিয়ে, গম্ভীর মুখে জিজ্ঞেস করেছিল, তা ডেকে লিয়ে গিয়ে যতন আত্মি কইরেছিল ত?’
তা লইলে কি গদাধর ঘোষের নাতি ও বাড়িতে পাত পাইততে যেত?’ যদু হেসেছিল।
শ্রীবাস দুটো কাঠের পাত্রে তেল জল ঢালছিল। যদু আর গদাধরের দিকে তাকিয়ে হেসেছিল। কোনও কথা বলেনি। যদু গাছতলায় রাখা একটা বোঁচকা খুলেছিল। ছোট একটা টিনের কৌটা আর দেশলাই বের করেছিল। শ্রীবাসের দিকে এক বার তাকিয়ে দেখেছিল। শ্রীবাস মুখ ফিরিয়ে নিয়েছিল। যদু দোহন পটের আগে, এক বার বিড়ি টানার মনস্থ করেছিল। হাঁড়িকুড়ি ডেয়ো ঢাকনা থালা সব ধোয়া হয়ে গিয়েছিল। মাটি কেটে, অস্থায়ী কাঠের উনোন থেকে ধোঁয়া উঠছিল তখনও। গোটা দুয়েক বাঁশের ফাড়ে কাপড় গামছা জামা বোঁচকাবুচকি ঝুলছিল। গদাধর পাশে বসা একজনের হাতে হুঁকা তুলে দিয়েছিল, অক্কুর ঘোষ কেমন আছে?
তোমার থেনে অনেক বুড়া হইয়ে গেছে। যদু বিড়ির কৌটা দেশলাই কোমরের কাপড়ের কষিতে গুঁজেছিল। তারই ভেজা ধুতি, শুকিয়ে যাবার পরে উমি এনে দিয়েছিল। চোখের সামনে ভাসছিল উমির মুখ। বলেছিল, চখে ছানি পইড়েচে। চখে ভাল দেইখতে পায় না। আমার গায়ে মাথায় হাত দিয়ে বইলেচে, তোমাদের আরও জীবধন বাড়ুক। আর বইলেচে, গঙ্গার ধ্যেরে ভূত বইললে তুমি খুশি হতে।
গদাধর হেসেছিল। হাসতে হাসতেই একটা দীর্ঘশ্বাস বুক থেকে উঠে এসেছিল। তার চোখে ভাসছিল দুটি ভাসা চোখ, একটু বোঁচা নাকে নাকছাবি, মুখে সরস হাসি।
যদুর চোখে ভাসছিল লাল পাড় শাড়ি পরা, ফরসা রং, চোখা নাক, টানা কালো চোখ, এলোচুল উমির মুখ। চলে আসবার আগে সে বাড়ির বাইরে রাস্তায় দাঁড়িয়েছিল। বলেছিল, রোজ আইসতে হবে।’…
যদু প্রাণীদের দিকে পা বাড়িয়ে বলেছিল, সবাই তোমার কথা জিগেস কইরেচে, যেতে বইলেচে। মাদেব ঘোষ বইলেছে, তাদের মাঠে যেন বাথানের ড্যারা করি। আমাদের সব্বাইকে নেমন্তন্ন কইরেচে। দশ জনকেই।
হাঁ, বলেছিল। তাদের মাঠে বাথান নিয়ে গেলে, গোবর চোনার সার হবে। দশজনকে নিমন্ত্রণ করে খাওয়াবার কথা সেই কারণে। গদাধর বলেছিল, হ্যাঁ, জাতব্যবসা ছেইড়ে ওরা চাষি হইয়েচে। জমি জিরেত ভালই কইরেচে। ওদের লজর এখন উঁচু। আমাদের সঙ্গে আর কখনও লতুন কইরে কুটুম্বিতে কইরবে না। তা না করুক, আমাদের মাথা চেরকাল ওদের থেনে উঁচু থাইকবে। আর বাথানের ড্যারা করার মতনজমি ওদের নাই। হ্যাঁ, দশ জনের জমির সঙ্গে, ওদের জমিতেও বাথান ড্যারা হতে পারে। তবে তার জন্যে যদি চাল ডাল তেল নুন দিতে চাইত, নিতাম না। অন্যে দিলে আলাদা কথা। কুটুমের ঘর থেকে দিতে এলে, সেটা আমাদের বেইজ্জত করা হত। ত হ্যাঁ, নিমদেয় ও অনেক বার বাথান লিয়ে এইসেছে, ওদের জমিতেও থেইকেচি। কোনও দিন বাটা খাটায় নাই। ঘরে ডেকে লিয়ে গেচে।…তা। হবে গা বছর দশেক আগের কথা। সে বার মেড়তলা থেকে নিমদেয় গেছিলাম বাথান লিয়ে। আষাঢ় মাস। অক্কুর ঘোষের শালি জমিতে দুটো দুষ্টু গোরু ঢুকে, চারা নষ্ট কইরেছিল। বাপ ভাই ব্যাটা সব লাঠি নিয়ে তেড়ে মাইরতে এইসেছিল। গোরু দুটোকে খুব মেইরেছিল, আর বেঁধে লিয়ে গেছিল। তা আমার ঘরের সন্তান তোমাদের ক্ষতি কইরেচে, তোমরা মাইরতেই পার। আষাঢ়ের চারা নষ্ট করা–তা কি সয়? কারুরই সয় না। ত্যাখন জামাই গদাধর যায় নাই, দিসারার গোপ গদাধর গেচিল ট্যাকা লিয়ে। হাত জোড় কইরে গিয়ে দাঁড়িয়েছিলাম। এই লাও ট্যাকা, পেরানি দুটোকে ফিরে দাও। তা পেরায় বিঘে খানেক জমির চারা লষ্ট হইয়েছিল। ছ মোন ধানের দাম কড়ায় গণ্ডায় আদায় কইরেছিল। ওভেনে কুটুম্বিতে খাটে না। তা ওরকম আমাদের গুনাগার দিতেই হয়। পরে অব্যশি অঙ্কুর টাকা ফেরত দিতে এইসেছিল। না, ওটি হবে না। আমার জীব তোমার ক্ষেতি কইরেচে। তোমরা লতুন কইরে আষাঢ়ে বীজতলা কইরেচ, ধান হবে কি হবে না, ঠিক নাই। ও ট্যাকা ফেরত লিতে পাইরব না। লিই নাই। সে বারে গোদ্বিতীয়ায় আমাদের সবাইকে অঙ্কুর নতুন কাপড় গামছা দেচিল। তা দেচ বেশ কইরেচ, কিন্তু মাথা নোয়াতে পারি না। ক্ষেতি ক্ষেতিই। ওভেনে খাতির নাই। কেউ করে না…।’
গদাধর বলেই চলেছিল। যদু তখন প্রাণীদের আড়ালে গিয়ে বিড়ি ধরিয়েছিল। গদাধরের সব কথা সে শোনেনি। তবে ঘটনা তার জানা ছিল। বিড়ি টানতে টানতে সে ছিট গঙ্গার ধারে গ্রামের দিকে তাকিয়েছিল। এত দূর থেকে মহাদেব ঘোষের বাড়ি দেখা যায়নি। কী করলে বল দিকিনি? এমন কখনও হয়নি। মন-প্রাণ কেড়ে রেখে দিলে। দিয়ে আবার বলেছিলে, রোজ আইসতে হবে। বাথান নিয়ে বেরিয়েছে গোপের ছেলে। রোজ সে যাবে কেমন করে? বাথান যদি না-ই থাকত, তবু কি রোজ যাওয়া যেত? যাওয়া যায় না। অথচ মনেতে মন নাই। প্রাণে নাই প্রাণ। এ কী গেরোয় ফেলে যদুকে? এমন করে সব কেড়ে নিতে আছে? যদু জীবনে জানত না। কিন্তু সে বুঝতে পারেনি, সেও মেয়ের প্রাণ-মন কেড়ে নিয়ে এসেছিল। সেও তো জীবনে আর কারুকে জল থেকে ডেকে, ঘরে নিয়ে যায়নি। সেও যে মনের কষ্টে তোমাকে দুষছিল, তা জানতে না। তোমরা দোষাদোষি করছিলে। কে হাসছিল, তাকে দেখতে পাওনি। প্রকৃতি ডেকেছিল দৈবকে। দৈব তোমাদের মিলিয়েছিল। এখন মেয়ে পুরুষ, যদু তা জানত না। উমিও জানত না। সংসারের কোনও যদু-উমিই কোনও কালে জানতে পারে না। এখন মেয়ে পুরুষ তোমরা তোমাদের জীবলীলা কর। দৈব আর ধর্ম–মানুষের ধর্ম, দুইয়ে মিলে জীবন।
যদু তা জানত না। উমিও জানত না। সংসারের কোনও যদু উমিই কোনওকালে জানতে পারে না। কিন্তু জীবলীলা বহতা নদীর মতো। সে কখনও থামে না। সে ভাঙে গড়ে বদলায়। তুমি হাস, রাগ, কাঁদ, অবাক হও। ছোট তোমার জীবন। মহাজীবন নিরন্তর।