উৎসবরাত্রির পরবর্তী সকালটায় সংসারের চেহারাটা থাকে যেমন শ্রীহীন তেমনি অরুচিকর। এ যেন শত্রুপক্ষের সৈন্য-অধ্যুষিত শহর। সৈন্যরা চলে গেছে, কিন্তু যথেচ্ছ রেখে গেছে তচনচ করা অসম পদচিহ্নের স্বাক্ষর।
অথচ চাঙ্গা হয়ে উঠে তখুনি আবার সব ঠিক করার উৎসাহও কারও থাকে না। মিটে গেছে তো কাজ, নিভে গেছে তো সমস্ত বাড়তি আলো, আবার তবে এখুনি ওঠাবার কি আছে?
উৎসব-ক্লান্ত রাত্রির শেষে অলস ঘুমে আচ্ছন্ন প্রাণীগুলো যখন চোখ খুলেই একবার আজকের হালকা মাথাটার অপূর্ব সুখ অনুভব করে ফের পাশ ফিরে ঘুমোয়, তখন তাদের দেখে মনে হয়, জীবনে বুঝি ওদের এইটা ছাড়া আর কোন কাজ ছিল না, অতএব জীবনের সব কর্ম সমাধা হয়ে গেছে, এবার নিশ্চিন্তে অনন্ত নিদ্রা দিতে পারে।
কিন্তু ঘুম থাকে না গৃহিণীর। সংসারের যিনি কর্ণধার।
তিনি জানেন গত দিনের চাইতেও আজকের কর্তব্যকর্ম অনেক কঠিন! আজ জোয়ার নেই, শুধুই ভঁটা।
সকলকে চালাতে হবে নিরুৎসাহের ভাটা ঠেলে ঠেলে। আজ কাউকে কোনও কাজ বললেই
বাড়ির লোকেরা ক্লান্তির চরম অভিব্যক্তি দেখাবে, এবং মাইনে করা লোকেরা মেজাজের চরম নমুনা দেখাবে।
এ ছাড়া প্রত্যেকের মুখেই শুনতে পাওয়া যাবে, তারা কিছুই দেখে নি, কিছুই খায় নি।
কারণ?
কারণ আবার কি, তারা তো শুধু খেটেছে। অতএব আবার ভাল খাওয়াও এবং বকশিশের লোভ দেখিয়ে তবে তাদের কাজে নামাও! চোখ রাঙিয়ে কাজ আদায় করার দিন এখন চলে গেছে। কী দাসদাসী, কী পরিজন, সবাইকে তোয়াজ করতে হবে। নচেৎ ছাদের এঁটোকলাপাতা সন্ধ্যা অবধি উড়বে, এখানে সেখানে স্তূপীকৃত মাটির খুরি-গেলাসগুলো সারাদিন কাকে ওলটাবে, আর গতরাত্রের পাতা শতরঞ্চি আর অস্থায়ী বিছানাগুলো আবার আজ রাত্রের দরজায় পৌঁছবে!
যায়, সবাই শিথিল হয়ে যায়। এমনিতেই উৎসব-অন্তে এরকমই হয়ে থাকে, আর দীপকের বৌভাতের রাত্রের ব্যাপার তো আরওই।
রাত তিনটে সাড়ে তিনটেয় সবাই ঘুমিয়েছে। ভোরবেলা কে উঠবে?
কিন্তু উঠলেন। জয়াবতী উঠলেন।
মনে পড়ল আজ অমিতা কিছু পারবে না, অমিতা বিছানায় পড়ে।
সঙ্গে সঙ্গে প্রাণটা হাহাকার করে উঠল, অমিতা কি আর কোনদিনই তেমন করে পারবে? তেমন করে করবে? জয়াবতীকে বেলা আটটা অবধি বিছানার কোমল স্পর্শ অনুভব করতে দিয়ে সংসারের চণ্ডীপাঠ থেকে জুতো সেলাইয়ের কাজে আত্মনিয়োগ করবে?
না না, ভগবান জয়াবতীর সব সুখ কেড়ে নিলেন!
জয়াবতী উঠলেন, সাবধানে নিঃশব্দে, অমিতার পাশ থেকে! সে ঘুমোচ্ছে অঘোরে।
উঠে এসে একবার চারিদিক দেখলেন, এখুনি যদি কেউ ঝাটা ন্যাতা আর জলের বালতি নিয়ে নেমে না পড়ে তো আজকের আহার আয়োজনের বারোটা বেজে যাবে। ডাকলেন চাকর কেষ্টকে। বাবা বাছা বলেই ডাকলেন, সে একটা উ ধরনের শব্দ করে আবার পাশ ফিরল।
আশ্চয্যি! যত সুখ আমার দেখেছে! বলে পুরনো চাকর হরিকে ডাকলেন বেশ উষ্ণ ভাবেই। উত্তরে হরি গায়ে চাদরটা ভাল করে টেনে নিয়ে জড়ানো গলায় যা বলল তার অর্থ এই দাঁড়ায় তার মাথায় অসহ্য যাতনা তার কোমরে অসম্ভব বেদনা, অতএব
তোরা ভেবেছিস কি? এই বাড়ি কি তবে আমি পরিষ্কার করব? প্রায় ডুকরে কেঁদে উঠলেন জয়াবতী, সবাই যে যার আয়েস করে ঘুমোতে থাকলেন, যত জ্বালা আমার! কী চোরদায়েই আমি পড়েছি!
এই সবাইটা অবশ্য চাকরবাকর নয়, লক্ষ্যস্থল আরও ব্যাপক। সেজ আর ঘোট দুই জা আছে, অছেন বড় ননদ আর ভাগ্নী, জায়েদের আইবুড়ো মেয়েরাও আছে।
সকলেই ঘুমে অচেতন। কেন? কেন?
এমন কি নতুন বৌয়ের ওপরও রাগ এসে গেল জয়াবতীর। রোদ উঠে দালান ভরে দিল, ফুলশয্যার কনে এখনো বরের ঘরে শুয়ে! ছি ছি ছি! জয়াবতীরা এ রকম করতে পারতেন?
বিয়ের দুচার বছর পর পর্যন্তও যে জয়াবতী কাক-কোকিল ডাকার আগে উঠে পড়ে আপন শয়নমন্দির ত্যাগ করে যেখানে সেখানে এসে পড়ে থেকেছেন, এতদিন পরেও সেটা মনে পড়ে গেল।
নতুন বৌ তার কোন্ কাজে এখন লাগবে সে কথা স্মরণ না করেই রাগে জ্বলতে থাকলেন জয়াবতী। জ্বলতে জ্বলতে সেজ এবং ছোট জায়ের ঘরের সামনাসামনি দাঁড়িয়ে সশব্দ স্বগতোক্তি করে উঠলেন, রাত করে ঘুমিয়েছে সবাই, আমিও কিছু সন্ধ্যে থেকে ঘুমুচ্ছি না। আমার ওপর দিয়ে যে কী ঝড় বয়ে গেছে, আমি জানি আর ভগবান জানেন।
ভগবান অবশ্য সমর্থন কি প্রতিবাদ কিছুই জানালেন না। বন্ধ দরজাগুলি থেকেও কোনও সাড়া এল না।
জয়াবতী স্বর আর একটু উচ্চগ্রামে তুললেন, আমারই বা কী দায়! আমি আমার অসুখ মেয়ের কাছে শুয়ে পড়ে থাকিগে। যেখানে যেমন আছে থাকুক পড়ে। দরকার সকলেরই আছে, ভাত সবাই খাবে, আমি একাই খাব না!
আরও হয়তো কিছু বলতেন, কিন্তু বাধা পড়ল। কোন্ ঘর থেকে যেন অতনু উঠে এল রাঙা রাঙা চোখে। বলল, কাকীমা! ওখানে কে একটা মেয়ে বোধহয় আপনাকে খুঁজছে।
মেয়ে! এই সকালবেলা জয়াবতীকে খুঁজছে! ভয় পেয়ে গেলেন জয়াবতী, কি রকম মেয়ে?
অতনু ব্যস্ত হয়ে বলে, না না, এমন কেউ না। এই ঝিটিয়ের মেয়ের মত!
অ্যাঁ, ঝিয়ের মেয়ে!
ভয় চরমে ওঠে। ভূতের বাঘের সাপের সব কিছু ভয়ের বাড়া ভয়ের ছায়া দেখতে পেলেন জয়াবতী।
তাহলে নির্ঘাৎ মাগী আসতে পারবে না বলে খবর পাঠিয়েছে! ও অতনু, আমি কি করি বাবা! …কে রে কে? লতিকা? কী? কী খবর শুনি।
মা বলল আসতে পারবে না, জ্বর–গা হাত পা ব্যথা–পেটের অসুখ—
ফিরিস্তি বড়, তার মানে অন্তত দিনতিনেকের মত!
বিয়ের বকশিশ, তত্ত্বর পাওনা, সবই যখন পাওয়া হয়ে গেছে, আর এত কষ্টর দরকার কি?
জয়াবতী ভয়ঙ্কর স্বরে বলেন, তোদের ওসব মিছে কথা আমি শুনতে চাই না। মাকে বলগে যা, যেতে বলেছে, নইলে চাকরি থাকবে না।
না থাকে না থাকবে! বছর এগারোর মেয়েটা একান্ন বছরের মুখের ওপর ঝঙ্কার দিয়ে ওঠে, তা বলে তো আর মরে মরে কাজ করতে পারবে না? না পোষায়, আপনারা লোক দেখ।
খরখর করে চলে যায় সে, ছিটের ফ্রক দুলিয়ে।
অতনু সামনে, নচেৎ বোধকরি ডাক ছেড়েই কাঁদতেন জয়াবতী, একটু সামলালেন। কিন্তু কথা যা বললেন ডুকরে কেঁদে ওঠার মতই।
দেখলে অতনু দেখলে! কী সব আসপদ্দা হয়েছে! ওই আমার একটা রুগী মেয়ে কাল থেকে–খাওয়া না-দাওয়া সহসা জয়াবতীর আক্ষেপোক্তি চাপা পড়ে যায় একটা ডুকরে ওঠা কান্নার তীক্ষ্ণ তীব্র শব্দে।
টানা করুণ সুর। অমিতার গলা বলে চেনবার উপায় নেই।
সর্বনাশ করেছে! ছুটে এগিয়ে গেলেন জয়াবতী।
.
মুহূর্তে ঘরে ঘরে দরজা খুলে যায়। বিয়ের বর ফুলের আর সিঁদুরের দাগে কলঙ্কিত গেঞ্জিটা গায়ে দিয়েই ছুটে বেরিয়ে আসে, কনে ভয়ে ভয়ে দরজার কাছে এসে দাঁড়ায়।
আবার সেই প্রশ্ন
কি হয়েছে মা, কি হয়েছে?
অমিতার চুল এলোমেলো, কাপড় এলোমেলো, চোখ রাঙা, চোখভর্তি জল। ভাঙা ভাঙা গলায় কাঁদছে সে, আমায় ফেলে সবাই চলে গেল। ডাক্তার আমায় ওষুধ দিল না!
সম্পূর্ণ উন্মত্ততা! সম্পূর্ণ উন্মাদিনীর চেহারা!
দেবে মা, ওষুধ দেবে।–জগন্ময় বলেন, আমি এই তোমার সেজকাকামণিকে পাঠাচ্ছি, ভাল ডাক্তার ডেকে আনতে। খুব ভাল ওষুধ দেবেন তিনি, ভাল হয়ে যাবে তুমি।
উন্মাদিনী ফ্যাল ফ্যাল করে তাকায়, বাপের হাতটা চেপে ধরে শিথিলকণ্ঠে বলে, সেদিন যে ডাক্তার ওষুধ দিল! সব কষ্ট সেরে গেল। সে কবে চলে গেল বাবা?
কার কথা বলছ মা? অতনুর? এই তো, এই তো সে তোমার মার কাছে দাঁড়িয়ে, দেখতে পাচ্ছ না?
ওঃ আচ্ছা! বলে যেন পরম শান্তিতে ঘুমিয়ে পড়ে অমিতা।
নিশ্চিন্তের নিঃশ্বাস ফেলে সবাই।
কিন্তু কতক্ষণের জন্যেই বা? ক্ষণপরেই ভুরু কুঁচকে ওঠে অমিতার, ঠোঁট কাঁপতে থাকে, নাকের ডগা ফুলে ফুলে ওঠে। পূর্ণ বিকারের লক্ষণ।
ব্যস আবার কান্না!
সক্কলে কেন আমায় জ্বালাতন করছে বাবা?
সেজকাকা এগিয়ে এসে ভরাট গলায় ধমকের সুরে বলেন, কই তোমাকে জ্বালাতন করছে?
ও মা গো, আমায় বকছে! চীৎকার আরও তীব্র হয়ে ওঠে, সব্বাই আমাকে ধরছে, আমার ঘর অন্ধকার করছে।
ভিড় ছাড়ো, ভিড় ছাড়ো সবাই। জগন্ময় বলেন, আর বিজয়, তুই একবার আমাদের ডাক্তারবাবুর কাছে গিয়ে অবস্থা বুঝিয়ে, কোন স্পেশালিস্টকে আনাবার ব্যবস্থা কর ভাই! আমার তো আর হাত পা উঠছে না।
আমার সেই ছেলেটা! পাগলিনী চেঁচিয়ে ওঠে, কোথায় গেল সে?
ছেলেটা! সবাই মুখ চাওয়াচায়ি করে।
ছেলেটা কে মা অমি?
সেই যে–খুব ভাল ছেলেটা! বিয়ে হল, টোপর পরল—
ও দীপুকে ডাকছ? আয় দীপু সরে আয়। এই তো, এই যে! তোমার ভাই, ছোট ভাই।
চোখভর্তি জলসুদ্ধু খিলখিলিয়ে হেসে ওঠে অমিতা, হ্যাঁ হ্যাঁ, ভাই ভাই! আমি বড্ড ভুলে যাই, না বাবা?
দীপকের হাতটা শক্ত করে চেপে ধরে খানিকক্ষণ আবার চুপ করে থাকে অমিতা, তারপর আস্তে আস্তে বলে, একটা ডাক্তার এসেছিল সে কোথায় গেল রে? আমায় খুব ভাল ওষুধ দিলে, সব কষ্ট কমে গেল। ওকে বল না রে, তোমার পায়ে পড়ি, আর একটু সেই ওষুধ দাও।
জয়াবতী কাতরভাবে অতনুকে বলেন, তাই দেবে নাকি বাবা আর একটু?
অতনু মাথা নেড়ে বলে, পাগল হয়েছেন। ডাক্তার আসুক।
.
মহাশ্বেতা সেজমামীকে গিয়ে বলে, দেখেছ তো, ঘুরিয়ে ফিরিয়ে ওই অতনু! এ সব অন্য পাগল! বইতে পড়ি তত ঢের!
সেজমামী এক ঢিলে দুই পাখী মারার কায়দায় বলেন, আমরা অবিশ্যি বই পড়ি না ঢের, তবে কিছু বুঝি বইকি। আর আজই নতুন বুঝছি না, অনেক কাল থেকেই বুঝছি। সেই এতটুকু বেলা থেকে ওই অতনুদা অতনুদা! ভাবে দেখাত যেন কিছুই না, এমনি ভাই-বোনের মত, কিন্তু জগতের আর সবাই তো অন্ধ নয়! অতনু এসে দাঁড়াল তো-মেয়ের মুখে চোখে যেন ইলেকট্রিক লাইট জ্বলে উঠল! কোথায় না কোথায় আছে, যেই অতনুর গলার সাড়া পেল, সেইমাত্র যেন হঠাৎ না জেনে এসে পড়েছে এইভাবে এসে হাজির। সব সময় কিছু আর দৈবাৎ হয় না। তবু সত্যি কথা বলব, অতনু ছেলেটা চিরকালই সভ্য শান্ত। তা নইলে একটা লোক-জানাজানি কাণ্ড না হয়ে যেত না।
আর আমাদের বড়মামীটিকেও বলি–মহাশ্বেতা ঠোঁট উল্টে বলে, যেন ন্যাকা চণ্ডী! যেন দুনিয়ার হালচাল কিছুই জানেন না! বিধবা মেয়ে পাগল হয়ে পরপুরুষের নাম করছে তো তাকে সামনে ধরে দিতে হবে!
সেজমামী বলেন, এদিকে সংসারের বুদ্ধিতে তো কিছু কাঁচা দেখি না। সংসারে কে কাজটি করছে, আর কে আরামটি করছে, তার হিসেব কষতে তো নিক্তি হাতে নিয়ে বসে আছেন! এই আজই সকালে দেখলে তো?
দেখলাম বইকি! বলেই চুপ করে যায় মহাশ্বেতা। কারণ ছোট মামীকে আসতে দেখা যাচ্ছে।
ছোটমামী শত্রুপক্ষের কি মিত্রপক্ষের বোঝা শক্ত, তাই ছোটমামীকে একটু এড়িয়ে চলে মহাশ্বেতা।
কিন্তু মামারবাড়িতে মহাশ্বেতার শত্রুপক্ষ মিত্রপক্ষের প্রশ্ন কেন?
কেন, তার উত্তর অতীব প্রাঞ্জল। এ প্রশ্নের উত্তর বহুদিন আগে বিদ্যাসাগর দিয়ে গেছেন। বড়মামী জয়াবতীই চিরদিন ননদ ননদাই, ভাগ্নে ভাগ্নী, আত্মীয় কুটুম্বকে যথাযথ আদর আপ্যায়ন করে এসেছেন, তাই। মহাশ্বেতার যে ভাল ঘরে বিয়েটা হয়ে উঠেছিল, সেও বলতে গেলে বড় মামা মামীর সাহায্যে সহায়তায়। পাত্রপক্ষের চাহিদা অনুযায়ী খরচ করবার সামর্থ্য মহাশ্বেতার বাবার ছিল না। জগন্ময় দিয়েছিলেন পণের নগদ টাকাটা, আর জয়াবতী নিজের দুখানা ভারী গহনা।
এই পাওয়ার ভারটা মন থেকে ঝেড়ে ফেলা শক্ত। ঋণের জ্বালা বড় জ্বালা! আবার যে ঋণ শোধাও যায় না, ভোলাও যায় না, তার আগুন তুষের আগুনের মত! গুমে গুমে পোড়, আর ঋণদাতাকেই সেই ভস্মের কালি মাখাতে চায়।
মহাশ্বেতা জানে বড়মামী না থাকলে সেজমামী ছোটমামী তাকে কোনদিন ডেকে এক গেলাস জলও খাওয়াবে না, তাই যত কিছু খোসামোদ তাদের খাতেই ব্যয় করে।
বিজয়ের বৌ নন্দা এসে বলে, মহাশ্বেতা, তুমি আজ সকালেই নাকি চলে যাবে?
মহাশ্বেতা সনিশ্বাসে বলে, না গিয়ে তো উপায় নেই। ছেলের আজ থেকে পরীক্ষা শুরু। তবে এ বাড়ির যা অবস্থা দেখছি, ইচ্ছে হচ্ছে না যে যাই।
নন্দা অগ্রাহ্যভরে বলে, অবস্থা আর কী এমন? মানুষের অসুখ করে না?
করবে না কেন? মহাশ্বেতা করুণাঘন কণ্ঠে বলে, স্বাভাবিক অসুখ হলে কে আর এত ভাবত? এ যা হলো, তাতে বড়মামীর জীবন তো চিরদিনের মত মহানিশা হয়ে গেল।
নন্দা আর একবার তাচ্ছিল্যের ভঙ্গী করল, চিরদিনের মত আবার কি? হিস্টিরিয়া হয় না কারুর? দেখনি কখনো?
কি জানি ভাই ছোটমামী, তোমার বাপের বাড়ির মস্ত সংসার, বিরিঙ্গী গুষ্টি, তুমি অনেক দেখে থাকবে, আমরা তো কই এতখানি বয়সে এমনধারা হিস্টিরিয়া দেখি নি। আর এখনো সেই অতনু অতনু করছে তো?
নন্দা উদাসীন মুখে বলে, কি জানি ভাই অত দেখি নি। তবে অতনুকে ওখানে ঘুর ঘুর করতে দেখলাম বটে। হয়, হিস্টিরিয়াতে ওই রকম হঠাৎ একজনের ওপরই ঝোঁক হয়।
তা হবে। বলে মহাশ্বেতা সেজমামীকে মধ্যস্থ মানে, তোমার কি মনে হয় সেজমামী? লোকলজ্জাই যদি ঘুচে গেল, তবে আর পাগল হওয়ার বাকী রইল কি?
নন্দা গম্ভীর মুখে বলে, পাগল আর এ জগতে কে নয়?
কথাটা এমন একটি উচ্চাঙ্গের দার্শনিক ভাবাশ্রিত যে, ওর ওপর আর কথা চলে না। তবে প্রশ্ন একটা থেকে যায় যে, তাহলে ধরে নিতে হবে জগতের সবাই লোকলজ্জামুক্ত।
ওদের কথার মাঝখানে হি হি করে হাসতে হাসতে এসে দাঁড়ায় বাড়ির রাঁধুনী বামুন মেয়ে।
আজ তার নিত্য কাজের ছুটি। কারণ আজও যজ্ঞির দরুন বামুনদেরই একজনের বাঁধবার কথা। তাই ছুটির আনন্দে গড়াতে গড়াতে এসে বলে সে, দিদিমণির কাণ্ডখানা শুনেছ সেজমা?
কিগো, আবার কি? নতুন কি?
বিছানায় শুয়ে শুয়ে আঙুল নাড়ছে আর গান গাইছে।
গান গাইছে!
কথাটা এমনভাবে উচ্চারণ করলেন সেজগিন্নী যে মনে হওয়া স্বাভাবিক, অমিতার গান গাওয়ার মত অঘটন ইতিপূর্বে আর কখনো ঘটেনি। বামুন মেয়ে বাকী বক্তব্য শেষ করে, আমি যেই গিয়ে জানলায় উঁকি দিয়েছি, অমনি এই মারে তো এই মারে। বলে কি, কে? কে ওখানে? পুলিশে দেব তা জানো? আমার ঘরে যে আসবে তাকেই পুলিশে ধরিয়ে দেব। বলেই আবার গান।
মহাশ্বেতা সন্দিগ্ধভাবে বলে, কী গান গাইছে?
তা জানি না বাপু!
যাই তো শুনে আসি। বলে অঙ্গ তুলে উঠে পড়ে মহাশ্বেতা। সঙ্গে সঙ্গে তার সেজমামীও। সকৌতূহলে বলেন, আহা, পাগল ছাগল যা হয় হোক, তবু তো একটু গাইছে। গান তো ভুলেই গিয়েছিল। যাই তো শুনিগে একটু।
মূলকথা, কোন ধরনের গান এখন পাগলিনীর কণ্ঠ থেকে উচ্চারিত হচ্ছে সেটা অবশ্য শ্রোতব্য। ব্যাপারটা বিশেষ কৌতূহলের বইকি। কে বলতে পারে সেই গানের ভাষার মাধ্যমেই পাগলিনীর হৃদয়ের আরও কোনও জটিল রহস্য উদঘাটিত হয়ে পড়বে কিনা। দ্রুত একতলার ভাড়ার ঘর থেকে দোতলায় শোবার ঘরের দিকে ধাবিত হন তারা।
কিন্তু হায় হায়, অভিযান নিরর্থক।
অমিতা একা বিছানায় শুয়ে গাইছে কিনা–এবার কালী তোমায় খাবো!
আর গুনগুনিয়েও মোটেই নয়, রীতিমত উচ্চস্বরে। যদিও গলাটা ভেঙে গেছে, সুরটা এবড়ো খেবড়ো লাগছে। কিন্তু দেখা যাচ্ছে, লাইন ভুলে যায় নি সে। মহোৎসাহেই গাইছে ও তোর ডাকিনী যোগিনী দুটো তরকারি বানিয়ে খাব, আর মুণ্ডমালা কেড়ে নিয়ে অম্বলে সম্বরা দেব!
চিরপরিচিত এই রামপ্রসাদী গানের থেকে পাগলিনীর হৃদয়রহস্যের কোন কিছু আবিষ্কার করতে সমর্থ না হয়ে মহাশ্বেতা এদিক ওদিক তাকিয়ে দেখে। না, আশেপাশে কেউ নেই। বোধকরি জয়াবতী তখনো ঝিকামাইয়ের ঝড় ঠেলে স্নান সেরে উঠতে পারেন নি, পুরুষরা এদিক ওদিক নানা কাজে ব্যাপৃত।
সাহসে ভর করে ঘরে ঢুকে পড়ে মহাশ্বেতা। সেজমামীকেও একটা চোখটেপা কৌতুকের ইশারা করে ঘরে ঢুকতে নির্দেশ দিয়ে এগিয়ে গিয়ে বলে, ও কী বিচ্ছিরি গান গাইছিস অমি? একটু ভাল গান গা না? আগে তো কত ভালবাসার গান-টান জানতিস!
হঠাৎ পাগলিনী বিছানায় উঠে বসে হি হি করে হেসে উঠে বলে, এই যে! পেয়ে গেছি। ডাকিনী যোগিনী দুটোকে পেয়ে গেছি! এইবার তরকারি বানাই
বলা বাহুল্য শেষ অবধি আর দাঁড়িয়ে শোনবার সাহস হয় না দুজনের কারুরই। তড়াক করে উঠে বসা দেখেই পালিয়ে প্রাণ বাঁচায়। তাদের পিছনে পাগলিনীর উচ্ছ্বসিত হাসি যেন তাড়া করে ছোটে।
একটু আগেই সেজমামী সেজকর্তাকে বলছিলেন তোমরা যাই বল বাবু, আমার তো মনে হচ্ছে সাজা পাগল। এবং আরও যা মনে হচ্ছিল সেটা বলতে পারেন নি সেজকর্তার বিরক্তিব্যঞ্জক ভ্রূকুটিতে। কিন্তু এখন পিছনের ওই ভাঙা গলার উচ্চহাসি যেন বুকটাকে হিম করে দিয়ে নিঃসংশয় করে দিল তাকে।
ওদের ছুটে নেমে আসা, আর হাসির ধ্বনি, আবার বাড়ির অনেককেই একে একে ওই ঘরের আনাচেকানাচে টেনে আনে। বিয়ে উপলক্ষে আসা দেশান্তরের আত্মীয়-আত্মীয়াও আছেন কেউ কেউ, আছে চাকরবাকর, বাড়ির ছোট ছেলেপুলে।
দুঃখে কাতর বিষাদে ম্লান হয়ে নয়, সকলেই একটা কৌতুক কৌতূহলের দৃষ্টি নিয়ে দেখতে থাকে, এই গতকালও এমন সময় যে মানুষটা সমস্ত সংসারটায় চরকির মত ঘুরে কাজ করে বেড়াচ্ছিল শান্ত হাসি মুখে, আজ সে কেমন অদ্ভুত ভঙ্গিতে আঙুল নাড়ছে, পা নাড়ছে, উঠছে বসছে, শুয়ে পড়ে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছে।
পাগলের মত কৌতূহলোদ্দীপক আর কী আছে?
পাগলের পাগলামীর ভিতর থেকে মানুষ সত্যই যেন কোন্ অজানিত রহস্যলোকের বার্তা আবিষ্কার করতে চায়। তাই সমুদ্রে ডুবুরি নামিয়ে মুক্তা তোলার মত, অনর্থক কৌতূহলের প্রশ্নকে নামিয়ে নামিয়ে দেখে কোথায় গিয়ে ঠেকে। কোন প্রশ্নের হাতে উঠে আসে সেই রহস্যের মুক্তা।
কিন্তু সব নতুনই ক্রমশ নতুনত্ব হারায়, সব কৌতূহলেরই নিবৃত্তি আসে।
পাগলের চমকপ্রদ আচার আচরণে বেশিক্ষণ আর নতুনত্ব খুঁজে পায় না কেউ, যে যার আপন কাজে চলে যায়।
পৃথিবী বরং থেমে যেতে পারে, কিন্তু মানুষের দৈনন্দিন চাকা থেমে পড়বে না। তাই নিতান্ত প্রিয়জনবিয়োগেও শ্মশানের খাট আনার সময় ভাবতে বসে মানুষ কিছু খাদ্যবস্তু জোগাড় করে রেখে গেলে ভাল হত। নইলে এসে কি খাওয়া হবে?
অমিতা যদি কাল রাত্রে মারাই যেত, কজন আর নাওয়া খাওয়া বন্ধ করে পড়ে থাকত? যারা থাকত, তারাই বা কদিন থাকত?
আর এ তো শুধু অমিতার মাথাটা খারাপ হয়ে গেছে!
.
ক্রমশ সবাই চলে যায় দৈনন্দিন কাজে।
কাছে বসে থাকে শুধু নতুন বৌ আর দীপক। কার জন্যে কে বসে আছে, সে ব্যাখ্যা না করাই উচিত। পৃথিবীর সব রং মুছে ফেলেই বা লাভ কি?
জয়াবতী বলে গেছেন আমি এক্ষুনি আসছি। কিন্তু অনেকক্ষণ হয়ে গেছে আসছেন না। দূরে কেষ্ট আর হরির সঙ্গে তার বচসার আওয়াজ শোনা যাচ্ছে।
এখন অমিত মুহুর্মুহু ঘুমোচ্ছে আর জাগছে।
মহাশ্বেতা দাঁড়িয়ে দেখে বলে, আমার পিস-শাশুড়ি ঠিক এমনি করেন, এই ঘুমোন, এই জাগেন। ইচ্ছে হচ্ছে বসে থাকি এখন, কিন্তু কি করব, যেতেই হবে আজ।
আবার হঠাৎ জেগে উঠল অমিতা। যেমন ধড়মড় করে ওঠে তেমনি উঠল ডাক্তার কোথা গেল? ডাক্তার? আমার কাছে একটু বসতে পারে না? এত কি কাজ তার? নতুন বৌ, ডাক্তারকে ডেকে আন না ভাই!
নতুন বৌ নতুন বরকে কি যেন ইশারা করে, তারপর সহসাই বলে ওঠে, ওই যে আসছেন।
সত্যিই ডাক্তার আসেন।
দুজন।
এ বাড়ির গৃহচিকিৎসক, ও আর একজন ভারী ভারী বয়স্ক ডাক্তার। মনোরোগের চিকিৎসক।
কাছে বসে শান্তগলায় বলেন, কই দেখি হাতটা।
আমাকে মারবে, আমাকে মারবে! বলে বালিশে মাথা ঘষটাতে থাকে অমিতা।
আবার ঘরে রথ দোলের ভিড়।
আবার এক ঝাপট নতুনত্ব পাওয়া যাচ্ছে।
কেউ তোমাকে মারবে না! মারবে কেন, তুমি এত লক্ষ্মী মেয়ে!
তুতিয়ে পাতিয়ে নাড়ি দেখেন ডাক্তার, দেখেন বুক পিঠ। আলো ফেলে ফেলে দেখেন চোখের মণি। তারপর এদিকে সরে এসে বলেন খুব একটা ভয়ের কিছু দেখছি না আমি, সাময়িক হিস্টিরিয়া বলেই মনে হচ্ছে। তবে কোন রকমেই যেন উত্তেজিত না হয়। যা চাইছে সাধ্যমত সেটা পূরণ করবেন। ওষুধ দিচ্ছি আমি।
কিছু তো চাইছে না ডাক্তারবাবু জগন্ময় কাঁদো কাঁদো গলায় বলেন, শুধু কাঁদছে!
কাঁদছেন তো আপনি ডাক্তার মৃদু হাসেন, রোগীর সামনে আদৌ উতলা হবেন না, আর, ঘরে ভিড় করবেন না। এক-আধজন যাকে ও পছন্দ করে, তেমন কেউ কাছে থাকুন। তিনি খাওয়ান, ওষুধ দিন।
কি খাবে? কষ্টে অশ্রু সংবরণ করেন জগন্ময়।
লিকুইড খাক না হয় আজ! খাওয়ায় বাধা কিছু নেই, যা খেতে চাইবে দেবেন। কথা হচ্ছে, কোন কিছুতেই বাধা দেবেন না, প্রতিবাদ করবেন না। কাকে কাছে পেতে চায়? মাকে? নাকি আপনাকে? আপনার যা অবস্থা দেখছি, আপনার না থাকাই ভাল, অবিচলিত থাকতে পারবেন না। সেরে যাবে, দুচার দিনের মধ্যেই সেরে যাবে। এক্টা খারাপ, এই যা একটু
দেখছেন তো ডাক্তারবাবু, এই বয়সে বিধবা
হ্যাঁ সে তো দেখছিই। তবে অনুরোধ করছি এ ধরনের কথা আদৌ ওর সামনে বলবেন না। কেমন থাকে খবর দেবেন। আর ওই যা বললাম, এত লোক নয়, ভিড় সরান। শুধু মা
শুধু মা! ডাক্তার বলে গেছেন শুধু মা!
কিন্তু কে চায় মাকে?
অমিতা যে কেঁদে বালিশ ভাসাচ্ছে, না না, ও আমার মা নয়, ও মহাদির মা!
জয়াবতীও কাঁদতে শুরু করেন, আমি তোর মা নই অমি?
না, তুমি মহাদির মা! খাব না আমি তোমার হাতে, খাব না!
কবে কার হাতে খাবে? আর না খেয়ে কি করে বাঁচবে কাল থেকে উপোসী মানুষটা?
নতুন বৌয়ের হাতে খাবে? দীপকের হাতে? কাকাদের হাতে?
না না না, আমি খাব না।
দুধ নয়, চা নয়, ওষুধ নয়, কিছু খাবে না অমিতা।
মহাশ্বেতা টেপা মুখে বলে, কাল থেকে তো দেখছি অতনুর ওপর ঝোঁক করছে, তাকেই নয় ডাকো।
জয়াবতী একবার ভাগ্নীর মুখের দিকে তাকিয়ে বিরস গলায় বলেন, সে পরের ছেলে, তার ওপর আর কত জুলুম করব? এতক্ষণ থেকে ডাক্তার আসা দেখে তবে বোধহয় বাছা নাইতে খেতে বাড়ি গেল।
আহা, খাওয়া তো এখানেও একমুঠো হতে পারত–মহাশ্বেতা স্নেহে গলে গিয়ে বলে-কাল তো কিছুই খায় নি। মাছ দই চারিদিকে তো তোমার থই থই! খেতে বললেই হত। না না, ওকেই ডেকে পাঠাই।
থাক মহা! বলেন জয়াবতী।
কিন্তু মহা থাকে না, সে ততক্ষণে কেষ্টাকে পাঠিয়ে দেয় ও বাড়ি।
পরের ছেলেকে নিয়ে আর জ্বালাতন কেন? জয়াবতী বলেন, ও তো আর আমার জন্যে কলকাতায় বসে থাকবে না, হয়তো আজই চলে যাবে।
আহা একবারও যদি একটু খাইয়ে দিতে পারে, প্রাণটা তবু রক্ষে হয় অমিতার। বিগলিত স্নেহে বলে মহাশ্বেতা।
.
তা বারেবারেই মহাশ্বেতার জয়।
তার অনুমানই ঠিক। পরের ছেলের হাতেই তখনকার মত প্রাণটা রক্ষা হল অমিতার। দুধ . একটু খেলো।
অতনু এসে প্রায় ধমক দেয়, কি হচ্ছে কি? না খেলে ডাক্তারবাবু এসে গলায় নল দিয়ে খাইয়ে দেবেন, তা জানো?
ও আমায় বকছে। বলে চোখ মুছতে থাকে অমিতা।
হ্যাঁ বকবে, সবাই তোমায় বকবে! অতনু বলে, না খেলেই বকবে।
তবে তুমি থাক! অভিমানে ভাঙা গলায় বলে অমিতা, তুমি বসে থাক, আমি খাব, ঘুমোব, চুপ করে থাকব।
আর কি, এখানে বসে থাকব! আমার আর খেয়ে দেয়ে কাজ নেই! অতনু বলে, সবাইয়ের কত কষ্ট হচ্ছে, মেসোমশাই কাল থেকে খাওয়া দাওয়া করেন নি, এ সব বুঝতে পারছ না?
আমি কি করব? আমার কি দোষ? আমায় কেন বকছ?
বলেছি তো সবাই বকবে। বলে অতনু সরে এসে বলে, শুনুন মাসীমা, বেশি আদর করে কথা বলবেন না, স্নেহ দেখালে আরও বেড়ে যাবে এই হচ্ছে এসব রোগের নিয়ম। ওর যেন কিছু হয়নি এই ভাব দেখাবেন।
জয়াবতী কেঁদে বলেন, আমরা তো দেখাব, ও যে এলোমেলো বকছে বাবা!
ঠিক হয়ে যাবে। ভাববেন না, ডাক্তারের সঙ্গে কথা হল। বললেন ভয়ের কারণ নেই।
তাই বল বাবা! মেয়ের দিকে তো চাইতে পারছি না আমি। কী মেয়ে কী হয়ে গেছে!
অধীর হবেন না, অধীর হবেন না।
ও কি, তুমি চলে যাচ্ছ বাবা?
যাই।
থাক না বাবা, দীপুর সঙ্গে বসে দুটো খাবে। কাল তো কিছুই খাওয়া হয় নি, সারারাত জাগা, কী কষ্টই পেলে?
অনেক বেশি কষ্ট আপনারা পাচ্ছেন মাসীমা! খাবার জন্যে কী? ওখানে বৌদি
বৌদিকে বোলো মাসীমা ছাড়লেন না। দেখছি, অমি তবু তোমাকে একটু ভয় করছে, অনেক দিন দেখে নি বলে হয়তো। আর একবার যদি ধমকে টমকে আর একটু খাইয়ে যেতে পারো!
অতনু কি যেন ভাবে।
ভয়ঙ্কর একটা দ্বিধার সঙ্গে যেন লড়াই করে, তারপর সহসাই নিতান্ত সহজ স্বরে বলে, ঠিক আছে থাকছি আমি। দেখি সারাদিন একটু ওয়াচ করে, ডাক্তারকে একটা রিপোর্ট দেবারও কথা রয়েছে। দীপু কোথায়?
কি জানি কোথায়! বলে জয়াবতী এই বেলা বারোটায় পূজোর ঘরে গিয়ে ঢোকেন।
দীপু কোথায়’ বলে খোঁজ করলেও দীপুকে কি অতনু খুঁজে বেড়াতে গেল?
না, কী দরকার অতনুর দীপুকে!
অতনু যদি এখন কাউকে খোঁজে তো সে নিজেকে। হ্যাঁ, ওই নীল রঙের পর্দা ফেলা ঘরটার দুর্নিবার আকর্ষণ এড়িয়ে অতনু এদিকের ঘরে এসে বসল নিজেকে খুঁজতে। পুরনো আমলের গেরস্থ বাড়ি, বাইরেটা কিছু বা গোছালো, ভিতরটা যেমন তেমন অগোছালো। একান্নবর্তী পরিবারের রীতি অনুসারে, কর্তাদের আয় উন্নতি যা হয় সেটা জানতে পারে গিন্নীদের বাপের বাড়ির দিক। বাড়ির লোক যদি কিছু টের পায়, সে হচ্ছে অপর পক্ষের ব্যক্তিগত বিলাসিতার বহর। সংসার নামক এজমালী জায়গাটা কিছুই জানতে পারে না। ভোগ করতে পায় না কারুর কোন আয় উন্নতির উপস্বত্ত্ব।
তাই এ বাড়ির কর্তাদের রোজগারপাতি যথেষ্ট হলেও, বাড়ির ভিতরে সেই পুরনো আমলের বিবর্ণ গৃহসজ্জা। লম্বা দালানে জায়গার অভাব নেই, কিন্তু বসবার মত গোছালো কোন ব্যবস্থা কোথাও চোখে পড়ে না। যত্র তত্র ছড়ানো ছিটানো না একটা টুল, একটা বেতছেঁড়া আরাম কেদারা, একটা তেপায়া চৌকী।
এখান থেকেই একটা টুল সংগ্রহ করে ও ঘরে জানলাটার কাছে টেনে নিয়ে বসল অতনু। বসল নিজেকে খুঁজতে।
অতনু কেন এখানে রইল? জয়াবতীর অনুরোধে? নিরুপায়তায়?
ওটুকু অনুবোধ এড়াবার ক্ষমতা তার ছিল না? নম্র দৃঢ়তায় যদি বুঝিয়ে দিতে পারত আজই তাকে চলে যেতে হবে, বাড়িতে না খেলে দাদা বৌদি মনঃক্ষুণ্ণ হবেন, সত্যিই কি আর বুঝতেন না জয়াবতী?
নিরুপায়তা নয়, লোভের হাতে আত্মসমর্পণ করে বসেছে অতনু। হ্যাঁ, যে লোভের আক্রমণে অনেক অনেক মাইল অতিক্রম করে ছুটে এসেছে তুচ্ছ একটা উপলক্ষকে আঁকড়ে ধরে।
আজও এই তুচ্ছ উপলক্ষটা আঁকড়ে এ বাড়িতে বসে রইল অতনু। এখানে বসে থাকবে, এদের সঙ্গে ঘরের ছেলের ভূমিকা নিয়ে সহজভাবে খাবে দাবে, হয়তো বা গা গড়িয়ে বিশ্রামও করবে, আর ওই এক বেপরোয়া পাগলিনী চীৎকার করে উঠলে তার কাছে গিয়ে তাকে বকবে, সান্ত্বনা দেবে, ওষুধ খাওয়াবার জন্যে খোসামোদ করবে। কী অদ্ভুত পরিস্থিতি!
আর এ পরিস্থিতিকে স্বেচ্ছায় বরণ করে নিয়েছে অতনু।
আচ্ছা, সহজ স্বাভাবিক ধারার বদলে এরকম একটা অদ্ভুত অস্বাভাবিক ঘূর্ণির মধ্যে পড়ে কি অতনু খুশি হয়েছে? কৃতার্থ হয়েছে? ভাগ্যকে ধন্যবাদ দিচ্ছে?
এটা তো সত্যি, এহেন একটা এলোমেলো কাণ্ড না হলে হয়তো অমিতার সঙ্গে দেখাই হত না। হয়তো বা দূরে থেকে সকলের মাঝখান থেকে একবার দেখা হত, চোখাচোখি করবারও সাহস হত না। বিধবা অমিতাকে কে অনুমোদন করত পুরনো বন্ধুর সঙ্গে মেলামেশা করতে? কেউ করত না। দেশ এখনো এত উদার হয় নি।
হয়তো এই জগন্ময়ই অতনুকে বাইরের ঘর থেকে বিদায় দিতেন অন্দরের দরজা আড়াল করে দাঁড়িয়ে। হয়তো এই জয়াবতীই স্নেহে বিগলিতভাব বজায় রেখেও ঠায় বসে থেকে পাহারা দিতেন অতনুর চঞ্চল দৃষ্টিকে, আশাতুর হৃদয়কে।
আজ ওঁরা বিপদে পড়েছেন।
তাই জগন্ময় বলছেন, তুমি থাক বাবা। জয়াবতী বলছেন, তুমি যদি পারো একটু খাওয়াতে। সংসারের আরও সদস্যরা ওসব কিছু না বলুন, তেমন কিছু বলছেনও না।
আর অতনু পরমোল্লাসে এর সুযোগ নিচ্ছে।
নিজেকে খুঁজে খুঁজে এই আবিষ্কারই করে অতনু, এমন একটা অঘটনের মাঝখানে এসে পড়ে সে যতটা ব্যথিত হয়েছে, পুলকিত হয়েছে তার চেয়ে বেশি।
বিধাতার আশীর্বাদে ভিতরটা কেউ দেখতে পায় না এই রক্ষে।
তবু সকালে একবারের জন্যে বাড়ি গিয়েই বৌদির প্রবল জেরার মুখে পড়তে হয়েছিল।
ঢুকতে না ঢুকতেই বৌদি মহোৎসাহে এগিয়ে এলেন মুখ বিষণ্ণ করে।
ব্যাপার কি ঠাকুরপো? ওদের অমিতার নাকি হঠাৎ কী অদ্ভুত অনাসৃষ্টি অসুখ করেছে? ওমা, এই তো কাল সন্ধ্যাবেলা দিব্যি নেমন্তন্ন খেয়ে এলাম ওদের বাড়ি থেকে, দেখলাম অমিতা কনে সাজানোর কাছে বসে আছে। কখন কী হল?
অতনুকে উত্তর দিতে হয়েছিল। বলতে হয়েছিল, কখন কি হল তা আর আমি কি করে জানব? লোকজন চলে যাবার পর গোলমাল শুনলাম দীপু বলল দেখতে
তা হ্যাঁ ঠাকুরপো, মানুষ এমন বিনা নোটিশে হঠাৎ পাগল হয়? ডাক্তার মানুষ তোমরাই জানো!
রোগ অসুখ যে হঠাৎ কি ভাবে হয় বা হতে পারে, সে কথা ডাক্তারের পক্ষেও বলা শক্ত। আমি অন্তত বলতে পারি না।
বৌদি মুখ করুণ করে বললেন, আহা দেখ দিকি কাণ্ড! তুমি সেই দূর দূরান্তর থেকে এলে একটু আমোদ আহ্লাদ করতে, আর এই ব্যাপার! যতই হোক ছেলেবেলার বন্ধু! দেখে তো মনটায় কষ্ট হচ্ছে।
অতনু গম্ভীরভাবে উত্তর দিয়েছিল, দেখে কষ্ট সকলেরই হচ্ছে। ছেলেবেলাকার বন্ধু না হলেও।
সে তো বটেই। তবে কি না– বলেই বৌদি হঠাৎ করুণ মুখটাকে হাসিতে উদ্ভাসিত করে বলে উঠলেন, অবিশ্যি এই গোলমালে বাল্যসখীকে একটু দেখতে পেলে। তা নইলে
আপনার দৃষ্টিটা খুব সুদূরপ্রসারী সন্দেহ নেই।
তা ভাই সত্যি ভিন্ন মিথ্যে বলি নি। তবে এও বলব, আজই তোমার চলে যাওয়া উচিত হয় না। বৌদি উদগত হাসি চেপে বলেন, শুনছি নাকি কাল থেকে কেবল তোমাকেই আঁকড়াচ্ছে, তোমার কাছে ভিন্ন খাচ্ছে না, কাজেই আর দুদিন না দেখে
দেখতে তো যান নি একবারও, এত কথা শুনলেন কার মারফৎ?
শোনো কথা! পাড়ার লোকের ঘরের খবর আবার কেউ কাউকে শুনিয়ে যেতে হয় নাকি? সে খবর বাতাসে ভাসে, বুঝলে?
বুঝলাম! বলে স্নানের উদ্যোগ করতে যাচ্ছিল অতনু, ঠিক সেই সময় আবার মহাশ্বেতার প্রেরিত চাকর ছুটে ডাকতে গিয়েছিল।
অতনু বোধকরি সবলে সমস্ত সঙ্কোচ কাটিয়েই বলল, চল যাচ্ছি।
বৌদি বললেন, দেখলে তো?
কিন্তু শুধুই কি বৌদি? অতনু টের পাচ্ছে, আড়ালে আড়ালে সকলেই ওই কথা বলাবলি করছে–দেখলে তো? সত্যি এ আবার কেমন লোগ! মা নয়, বাপ ভাই নয়, একটা পরপুরুষের জন্যে আকুলতা অস্থিরতা!
কিন্তু কি করে টের পাচ্ছে অতনু? কেউ কি বলে গেছে ওকে? না বলে কে যায়? হয়তো বা অতনুর বৌদির কথাই ঠিক, বলতে কাউকে কিছু হয় না। যে কথা অনেকের মুখে আলোচিত হয়, সে কথার রেশ বাতাসে ভাসে।
অতনু কি তা হলে চলে যাবে? এই লোকলজ্জার হাত থেকে মুক্তি নিয়ে? আর সেই চলে
যাওয়ার হতাশাতেই উন্মাদিনী স্তিমিত হয়ে যাবে, শান্ত হয়ে যাবে।
কিন্তু চলে যাবার শক্তি অর্জন করবে অতনু কোন শক্তির জোরে?
আচ্ছা, অমিতার একি হল? এমন করছে কেন ও? অতনুর এই দীর্ঘদিনের অদর্শনের অবকাশে ও কি এইভাবে নিজেকে ধ্বংস করছে বসে বসে?
লোকে তো তা বলছে না।
সবাই তো বলছে এত লক্ষ্মী মেয়ের এ কেমন ধারা! এত শান্ত মেয়ের এ কী ব্যবহার! বলছে, এ সংসার মাথায় করে রেখেছিল অমিতা। বলছে, অমিতার বুদ্ধি বিবেচনার তুলনা হয় না, তুলনা হয় না ভব্যতা আর সংযমের। বিধবা হয়ে পর্যন্ত অমিতা নাকি চুলে কোনদিন গন্ধতেল দেয় নি, গায়ে মাখে নি সৌখিন সাবান। খাওয়া দাওয়ায় এত কৃচ্ছসাধন নাকি এ যুগের বিধবাদের মধ্যে দুর্লভ। আর সেই যে একদিন দামী আর সৌখিন শাড়িটা অঙ্গ থেকে বিসর্জন দিয়েছিল, তদবধি ওই ইঞ্চিপাড় হাফ শাড়ি ছাড়া দুইঞ্চি পাড় পুরো শাড়ি একখানা পরে নি কোনদিন।
এমন মেয়ে, এমন স্থিতধী আর আত্মস্থ মেয়ে, সে কি করে এমনতর কাণ্ড করছে! ভেবে কূলকিনারা পাচ্ছে না অতনু। ভেবে পাচ্ছে না নিজের ভূমিকা কতটুকু বিস্তৃত করবে? বকবে? ধমকাবে? ডাক্তারের মত কঠিন হবে?
জানলা দিয়ে দুপুরের রোদের প্রচণ্ড হলকা আসছে, আসছে ধূলো, অতনুর খেয়াল নেই। হঠাৎ পিছন থেকে ডাক পড়ল, এই দেখসে বাবা, আবার এক কাণ্ড!
জয়াবতী ডাকছেন আর্তচীৎকারে।
কী?
কোন্ ফাঁকে উঠে গিয়ে এই দুর্দান্ত রোদ্দুরে ছাতে ঘুরে বেড়াচ্ছে।
সে কী? ব্যস্ত হয়ে এগোয় অতনু।
আর সে কী! জয়াবতী কপালে করাঘাত করে বলেন, আমার এই কপালটা একবার তোমাদের ওই ডাক্তারী ছুরি দিয়ে চিরে দেখাতে পারো অতনু? দেখি তার ভেতর কী আছে?
পরে দেখবেন। এখন আসুন। বলে অতনু ছাতে ছোটে।
হ্যাঁ ছুটবে।
সে ডাক্তার, তার অধিকার আছে। তার কর্তব্য রোগীর ভাল মন্দ দেখা।
জয়াবতী ভারী শরীর নিয়ে সিঁড়ি ভাঙতে হাঁপান, আর হাঁপাতে হাঁপাতে বলেন, পূজো করে উঠে ঠাকুরের চরণামৃত একটু মাথায় বুলিয়ে দেবো বলে নিয়ে এসে ঘরে ঢুকে দেখি মেয়ে নেই। সর্বশরীর তো হিম হয়ে গেল আমার। চেঁচিয়ে কেঁদে উঠতে যাচ্ছিলাম, বলি সর্বনাশের চরম করে বুঝি বাড়ি থেকে পালিয়ে গেছে। কী গুরুর রক্ষে, নতুন চাকরটা এসে বললে, দিদিমণি ছাতে উঠেছে। ছোঁড়া কালকের দরুন জগ বালতি সব নামাতে গিয়েছিল–
কিন্তু জয়াবতীর এত কথা শুনছে কে? তার অর্ধেক সিঁড়ি ওঠার আগেই তো অতনু ছাতের জমিতে।
প্রকাণ্ড ছাত, একেবারে তারও সীমান্তে দাঁড়িয়ে রুক্ষ এলোকেশী।
এই রোদে ছাতে এসেছ কেন?
দ্রুত পায়ে সামনে গিয়ে প্রবল সুরে প্রশ্ন করে অতনু, তোমার মা ভেবে অস্থির হচ্ছেন।
হঠাৎ স্রেফ পাগলিনীর হাসি হেসে ওঠে অমিতা, আমার মা আমার জন্যে ভেবে অস্থির হচ্ছেন? হি হি হি! খুব একটা মজার কথা শোনালে বটে ডাক্তার!
মার জন্যে তোমার কষ্ট হয় না? রূঢ় স্বরে প্রশ্ন করে অতনু।
কষ্ট? হি হি হি! মার জন্যে কষ্ট! তুমি তো বেশ দয়ালু!
এই সময় ধড়ফড় করতে করতে কোনমতে উঠে এসেছেন জয়াবতী। বলেন, এই রোদে ছাতে কেন মা অমি?
অমিতা এলোচুলের গোছা আঙুলে জড়াতে জড়াতে বলে, বোদ পোহাচ্ছি।
এই কি রোদ পোহানোর সময় মা? চল নীচে চল। দেখছ না অতনুদা তোমায় ডাকতে এসেছে! না গেলে বকবে।
আঁচল দিয়ে কপালের ঘাম মুছতে থাকেন জয়াবতী।
পাগলিনী অপরূপ এক ঠোঁটের ভঙ্গী করে বলে ওঠে, ইয়ে বিল্লি হিল্পী দিল্লী। বকবে! ও আমায় বকবে! ভারী সাহস ওর! যাব না আমি নীচে। দেখি তো কী করে!
অমিতা, পাগলামী কোর না। নীচে চল। এটা ছাতে বেড়াবার সময় নয়। নীচে না যাবে তো জোর করে নিয়ে যাওয়া হবে। অতনু বলে।
আহা সত্যি! হেসে গড়িয়ে পড়ে অমিতা, কর না একটু জোর! দেখি তুমি কেমন পালোয়ান।
অতনু কালা, অতনু নির্বিকার!
অতনু ডাক্তার। অতএব ধমক দিতে পারে অতনু। বলতে পারে, হচ্ছে কি? এ রকম যা ইচ্ছে করলে ডাক্তারবাবু এসে ইলেকট্রিক শক লাগিয়ে জব্দ করে দেবেন তা জানো?
অমিতা মুখ বাঁকিয়ে বলে, ডাক্তার হয়ে আবার ডাক্তারের ভয় দেখাচ্ছে। নিজের নেই কানাকড়া ক্ষমতা! আমি যাবো না। আমি রাস্তা দেখব–আলসের ধারে গিয়ে ঝোঁকে অমিতা।
হাঁ হাঁ করে ছুটে যান জয়াবতী, মেয়েকে জড়িয়ে ধরে কেঁদে উঠে বলেন, অতনু, বুঝি কী সর্বনাশই করে!
আঃ। ঝটকা মেরে নিজেকে ছাড়িয়ে নেয় অমিতা।
অতনু জয়াবতীকে ইশারায় নিষেধ করে ব্যাকুলতা প্রকাশ করতে। নীচু গলায় বলে, ওসব কথা মাথায় ঢোকাবেন না। তারপর গলার স্বর উঁচু করে বলে, যাবে তো চলো, নইলে আমরা চলে যাচ্ছি। তুমি রোদে ঝলসাও বসে বসে।
সত্যিই ঝলসাচ্ছে অমিতা। রুক্ষ চুল বাতাসে উড়ছে, শুকনো মুখ রোদের দাহে তামাটে হয়ে উঠেছে, ঘাম ঝরছে কপাল বেয়ে। সেই ঝলসানো মুখে হঠাৎ কাঁদো কাঁদো গলায় কথা কয়ে ওঠে অমিতা, ঝলসাবোই তো। ঝলসে ঝলসেই তো মরব। আমায় তো কেউ ভালবাসে না? ছাতের আলসেয় ফের ঝেকে অমিতা।
জয়াবতী আবার দুহাত দিয়ে আগলে ধরতে যান, বাসে মা, সবাই ভালবাসে তোমায়। তুমি আমাদের চোখের মণি, বুকের হার, তোমায় ভালবাসবে না? এই দেখ এতখানি বেলা, এখনো জল মুখে দিই নি, তোর জন্যে ঘুরে মরছি।
মার হাতটা আবার ঠেলে দেয় অমিতা। কান্না ছেড়ে হাসে। মরছ কেন? যাও না, খাওগে। এদের বিয়ে বাড়িতে কত মিষ্টি কত খাবার! আহা তোমায় বুঝি দেয় নি কেউ?
অতনু গম্ভীরভাবে বলে, কে দেবে? কেউ দেখে ওঁর খাওয়া? তুমি এই রকম আহ্লাদ করে বেড়াবে, আর উনি উপোস করে বেড়াবেন? যাও না, দাও না গিয়ে ভাল করে খেতে। কাল থেকে খান নি।
ওমা! আহা-আহা মরে যাই, চল চল। সিঁড়ির দিকে দৌড় দেয় অমিতা।
ও অতনু, কী হবে? ও যে পড়ে যাবে! জয়াবতীও দৌড়ন। দৌড়তে দৌড়তে ডুকরে ওঠেন।
পড়বে না!
অতনু চাপা দৃঢ় স্বরে বলে, আপনি একটু কম অধীর হোন, ওসব মাথায় ঢুকিয়ে দেবেন না। চলুন, সত্যিই বসে পড়ে বলুন আপনাকে খেতে দিতে।
কী যে বল বাবা!
জয়াবতী বলেন, আর আমার সে কপাল হয়েছে! নইলে সেই মেয়ে এই হয়! পূজো করে উঠে এসে দাঁড়াতেই মুখের সামনে চায়ের গেলাস, জলখাবারের রেকাবী ধরে দিয়েছে। ভাত খেতে একটু বেলা হলে, কোথা থেকে জোগাড় করে এনে হাতে তুলে দিয়েছে ঘোলের শরবৎ, মিছরীর পানা। ও যেন মা, আর আমি মেয়ে হয়ে গিয়েছিলাম অতনু!
ততক্ষণে পাগলিনী তরতরিয়ে নেমে গেছে।
অতনু আর জয়াবতী আস্তে আস্তে নামছেন।
অতনু একবার জয়াবতীর মুখের দিকে তাকায়। বোধকরি বিরক্তি গোপন করা অসম্ভব হয়ে ওঠে, তাই গম্ভীর বিরক্ত কণ্ঠে বলে, বেশ করেছিলেন। এখন যান সেই ভাবেই খান গে। সহজ ব্যবহার করতে চেষ্টা করুন। অবিরত আক্ষেপ করবেন না ওর সামনে। দেখুনগে হয়তো খাবার গুছিয়ে বসে আছে ইতিমধ্যে।
.
আশ্চর্যের কথা, অতনুর কথাই সত্যি হয়ে দাঁড়ায়।
হয়তো অতনু ডাক্তার বলেই। ডাক্তার নইলে রোগীর মনস্তত্ত্ব কে বুঝবে?
নীচে নেমে এঘর ওঘর করে জয়াবতী দেখেন তার শোবার ঘরের সামনে দাঁড়িয়ে আছে অমিতা, জয়াবতীকে দেখে হাতছানি দিল মিটিমিটি হেসে।
কাছে গিয়ে দেখেন কোথা থেকে না কোথা থেকে এক থালা মিষ্টি জোগাড় করে বসিয়ে রেখেছে ঘরের মাঝখানে, জলের কুঁজোটাই নামিয়ে রেখে দিয়েছে তার পাশে!
জয়াবতীকে দেখেই চোখ টিপে ব্যস্ত আর চুপিচুপি স্বরে বলে, খেয়ে ফেল খেয়ে ফেল, নইলে কেড়ে নেবে।
অমি, তুই আবার আমায় হাতে করে খেতে দিলি? জয়াবতী ঊ্যাক করে কেঁদে ফেলেন। চোখ মুছে বসে পড়ে বলেন, এত কি আমি খেতে পারি মা? আয় না, আমার সঙ্গে তুইও খা।
ওমা, কী বোকা! আমায় বলছে খেতে। ছুটে বেরিয়ে যায় পাগলী।
.
দেখলে? দেখলে ছোট বৌ?
সেজগিন্নী বলে ওঠেন, কাল থেকে তো মেয়ে স্বর্গ মর্ত্য এক করছে, এখন দেখলে? ভাড়ার উটকে টেনেহিঁচড়ে মিষ্টির কাড়ি নিয়ে কি রকম ছুট দিল? সে দিকে তো জ্ঞান টনটনে যে, মায়ের পূজো সারা হয়ে গেছে, জল খেতে দিতে হবে।
নন্দা গম্ভীর ভাবে বলে, ভালই তো, মাথার সাড় ফিরছে।
সে তো দেখতেই পাচ্ছি। সেজগিন্নী উঠে যান, তাড়াতাড়ি ঘরে গিয়ে সেজকর্তাকে বলেন, সেয়ানা পাগল বোঁচকা আগল!
সেজকর্তা গম্ভীর মুখে বলেন, কথাটা বড় পচা পুরনো।
যা খাঁটি তাই পুরনো! এই শুনলাম মেয়ে নাকি গলদঘর্ম হয়ে রোদ্দুরে ছাতে বেড়াচ্ছে, মা টেনে আনতে যাচ্ছেন। আবার এক্ষুনি মার জন্যে জলখাবারের থালা সাজাতে বসল।
কী করতে বসল? সেজকর্তা তীব্র প্রশ্ন করেন। ওই তো বললাম, খাবারের থালা সাজাতে। মস্ত একখানা থালা নিয়ে এত সন্দেশ, এত দরবেশ, এত পান্তুয়া, এত
তা ওটাও তো খেয়ালের ঝোঁক।
ওই আনন্দেই থাক। বলে সেজগিন্নী মুখ বাঁকান। আর পরক্ষণেই বলেন, আর তোমার ভাজের পায়েও কোটি কোটি প্রণাম। অতনু অতনু করে যা আদিখ্যেতা দেখাচ্ছেন?
যাক বড়গিন্নীর বরাত ভাল! যে দুর্লভ প্রণাম ভাগ্যে একটা জোটে না সেই প্রণাম কোটি কোটি।
এখন হাসছ পরে বুঝবে। বলে রোষভরে চলে যান সেজগিন্নী।
নীচের তলায় তখন বিজয় ব্যস্ত হয়ে গত কালকের ডেকরেটারের বিল মেটাচ্ছিল, কারণ বিয়ের উৎসব বাবদ কর্তৃত্বটা তারই অধিকারে এসেছিল।
পাওনাদাররা চলে যেতেই বিজয় স্ত্রীর কাছাকাছি এসে বলে, অতনু রয়েছে না?
হুঁ।
কোথায়? কোথায় রয়েছে?
কি জানি! ওপরের কোনও ঘরে। নন্দা স্বভাবসিদ্ধ তাচ্ছিল্যের ভঙ্গিতে বলে।
বিজয় বিরক্ত স্বরে বলে, কোনও ঘরে বলে গা ভাসিয়ে দিলে যে? নিশ্চয় ওই ঘরেই।
নন্দা অমায়িক মুখে বলে, সেটাই স্বাভাবিক, আর সেটাই উচিত।
উচিত।
নয় কেন, ডাক্তার বলে গেছে, ও যা চাইবে তা দিতে।
ডাক্তারের পক্ষে বোঝা সম্ভব ছিল না ওর চাহিদা কি, তাই বলেছে। বাস্তবিক এমন একটা বিশ্রী ব্যাপার হল?
ব্যাপারকে অবিরত ঢাকা দিয়ে দিয়ে সুশ্ৰী করে রাখতে গেলেই, একদিন সে বিশ্রী মূর্তিতে আত্মপ্রকাশ করে বসে। তোমাদের উচিত ছিল ওর আবার বিয়ে দেওয়া। আর ওই অতনুর সঙ্গেই দেওয়া। আশ্চর্য, কারুর যে কেন মাথায় আসে নি? হিস্ট্রিটা যখন সকলেরই জানা ছিল।
তোমারও ছিল!
আমি কি জন্যে বলতে যাব? আমি কে? সংসারে আমার কথা দাঁড়াচ্ছে কোথায়?
বিজয় গম্ভীরভাবে বলে, কথাকে দাঁড় করাতে হয়। সেটা নিজের ক্যাপাসিটি। তুমি এত বেশি–এই সেরেছে, আবার বড়দি আসছেন যে!
নন্দা ভুরু কুঁচকে বলে, বড়দি তো ছিলেনই। শুধু সকালে আশ্রমে গিয়েছিলেন, গুরুজয়ন্তী উৎসবে। আজই দিনটা পড়েছে বলে কত আক্ষেপ করে গেলেন।
তা না হয় গেলেন। কিন্তু গুরুজয়ন্তী কি?
কেন, গুরুর জন্মোৎসব! আসছে বছর সুবর্ণ জয়ন্তী হবে বলে এখন থেকেই তোড়জোড় চলছে।
বিজয় বলতে যাচ্ছিল, একটা মহারাজ টহারাজ বনে গেলে মন্দ হত না। কিন্তু বলা হল না, বড়দি এসে গেছেন।
বড়দি অর্থাৎ অমিতার বড়পিসিমা, মহাশ্বেতার মা। মহাশ্বেতার মতই করুণাময়ী।
কাছে এসেই করুণ কণ্ঠে বলেন, হ্যারে, মেয়েটার মাথাটা ঠাণ্ডা হয়েছে? নাওয়া খাওয়া করেছে?
কোথায়? বিজয় মাথা নাড়ে।
ওমা বলিস কি? তেমনিই চলছে? ডাক্তার আসে নি?
এসেছিল।
কি বলল?
বলল আর কি, বলল হিস্টিরিয়া।
বড়দি মাথা নেড়ে বলেন, কিন্তু আজকাল তো বাপু আর হিস্টিরিয়া হতে দেখি না! হ্যাঁ সে ছিল বটে আগে, ঘোমটা দেওয়া বৌ ঝি তোলপাড় কাণ্ড করত, লোকলজ্জার মাথায় লাঠি বসাতে। কিন্তু একালে–।
হ্যাঁ একালে মেয়েদের ঘোমটা উড়ে যাওয়া, আর ঘরের খাঁচা ভেঙে বাইরে বেরোনোর প্রথা প্রবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে হিস্টিরিয়াটা দেশ থেকে বিদায় হয়েছে বটে, নন্দা খুব অমায়িক গলায় বলে, তবু সব জিনিসের মতই কোথাও না কোথাও একটু জের তো থাকবেই।
বড়দি বিস্ময় দৃষ্টি মেলে বলেন, ঘোমটার সঙ্গে, রাস্তায় বেরোনোর সঙ্গে রোগ-অসুখের কী হোটবৌ?
ওর কথা ছেড়ে দাও বড়দি, বলে বিজয় বড়দির অলক্ষ্যে বৌকে একটি শাসনদৃষ্টি নিক্ষেপ করে বড়দির সঙ্গে সঙ্গে এগিয়ে যায়।
.
বড়দি অবশ্য হুড়মুড়িয়ে একেবারে কালকের সেই ঘরেই ঢোকেন, দেখেন অমিতা খাটের ওপর পা ঝুলিয়ে বসে আঙুলে আঁচল জড়াচ্ছে।
বড়দির পরনে চওড়া লালপাড় গরদ শাড়ি, কপালে মস্ত সিঁদুরটিপ, সিঁথেয় চওড়া করে সিঁদুর ঢালা।
তিনি অমি, কেমন আছিস মা? বলে ঘরে ঢুকতেই অমিতা তাড়াতাড়ি উঠে এসে বলে, ওমা, কাদের কনেবৌটি গো? বাঃ, খাসা মুখখানি তো!
বড়পিসিমা সভয়ে পিছু হঠে বলেন, ও কী কথা অমি? সত্যিই কি তুই বদ্ধ উন্মাদ হয়ে গেলি?
অমিতা আরও কাছে এসে হেসে উঠে বলে, ও কনে, তোমার হাতে সুতো কই? কাজললতা কই?
বড়পিসিমা চেঁচিয়ে উঠে বলেন, ও বড়বৌ, মেয়ে এসব কি বলে গো? একেবারে বেহেড পাগল হয়ে গেল?
ঘরের দরজায় এসে দাঁড়ায় অমিতার সবছোট ভাইটা, দাঁড়ায় সেজগিন্নীর মস্ত বড় মেয়েটা।
সে বিরক্তি মাখানো মুখে চাপা গলায় বলে, আপনাদের এই সব কাণ্ডর কোনও মানে . পাওয়া যায় না পিসিমা! মেজদির সামনে এসব কথা বলার দরকার কি?
পিসিমা অবাক বিস্ময়ে বলেন, ওমা, তুই যে আমায় অবাক করলি সবিতা, সামনে পিছনে আবার কি? মন্দ কথা কিছু বলেছি?
না খুব ভাল কথা! চলুন ও ঘরে গিয়ে বসি গে।
তুই থাম। বলে বড় পিসিমা আবার এগিয়ে যান, কিছু খেয়েছিস রে অমি?
হ্যাঁ! অমিতা অনেকখানি ঘাড় হেলিয়ে বলে, কত কী! হাতী ঘোড়া, সাপ ব্যাং মাছ—
ছি ছি, ও কথা বলতে নেই মা! চুপ করো চুপ করো।
সবিতা আবার বলে ওঠে, পিসিমা! চলুন না ও ঘরে।
এ তো আচ্ছা জ্বালা করল! পিসিমা বলেন, মেয়েটাকে দেখব বলে আমি গুরুভগ্নীদের অনুবোধ এড়িয়ে ছুটে এলাম!
সবিতা বিব্রতভাবে বলে, তা আপনি ভাতটাত খাবেন তো?
শোন কথা, আশ্রম থেকে আমি পেসাদ না খেয়ে এসেছি? দুবেলা পেসাদের নেমন্তন্ন। …অমি মা, আমার সঙ্গে যাবি আশ্রমে? সন্ধ্যেআরতি দেখিয়ে আনব।
হঠাৎ অমিতা সবাইকে চমকে দিয়ে চীৎকার করে উঠল, ওরে বাবা রে, আমাকে ধরে নিয়ে গিয়ে বলি দিতে চাইছে! তারপর সুরু হল কান্না।
আবার অমিতা গলা ভাঙল, চোখ ফুলিয়ে ঢোল করল। তাকে নাকি বেঁধে নিয়ে হাঁড়িকাঠে চড়ানো হচ্ছে।
ডাক্তারকে আর একবার কল দেওয়া হোক। বললেন সেজকর্তা, এভাবে তো বাড়তে দেওয়া যায় না।
জগন্ময় বসে পড়ে বললেন, যা পারো তোমরা কর ভাই!
জয়াবতী সারাদিনের পর অবেলায় একটু ঘুমিয়ে পড়েছিলেন, এই করুণ আর্তনাদে ধড়মড়িয়ে উঠে ছুটে এলেন। হাঁপিয়ে কেঁদে বলে উঠলেন, উপোস করে শরীরের ভেতরটা তোর জ্বলে খাক হয়ে গেল অমু, একটু কিছু খা, শরীর ঠাণ্ডা হবে।
অমিতা কেঁদে উঠে বলল, এই হাঁড়িকাঠটা থেকে আমায় একটু বার করে দাও না গো! · এক্ষুনি আমায় কেটে শেষ করে দেবে।
দীপুকে ডেকে আনবো অমি? তোমার সেই ছোট ভাইটি? টোপর পরলো বিয়ে হল।
না না, ও ভাল ছেলে লক্ষ্মী ছেলে, ও এখন শুধু সিনেমা দেখবে।
তবে নতুন বৌকে ডাকি?
না না! অমিতা ভাঙা গলায় বলে, ও আসবে না, ও শুধু নেমন্তন্ন খাবে। আমি মরে যাব, আমাকে কেটে ফেলবে।
তা পাগলে তো অর্থহীন অসংলগ্ন কথাই কয়।
জয়াবতীও বোধকরি মেয়ের সঙ্গে সঙ্গে পাগল হয়ে গেছেন, লোকলজ্জা ভুলেছেন, নইলে হিতাহিতজ্ঞানশূন্য হয়ে বলে বসেন, অতনুকে ডাকব অমু?
সঙ্গে সঙ্গে অনুচ্চারিত একটা ছিছিক্কারে ঘরের বাতাস ধাক্কা খেয়ে ওঠে। বিজয় জয়াবতীর দিকে একটা জ্বলন্ত দৃষ্টি নিক্ষেপ করে ঘর থেকে বেরিয়ে যায়। কিন্তু সবাইকে অবাক করে আশ্বস্ত করে অমিতা চেঁচিয়ে ওঠে, ওকে কেন? ও পরের বাড়ির ছেলে। তোমার লজ্জা করে না?
.
ও পাশের ঘরে পরের বাড়ির ছেলে আর ঘরের ছেলেটা দুজনে বসে ছিল মুখোমুখি। অতনুর হাতে একটা জ্বলন্ত সিগারেট শুধু হাওয়ায় পুড়ে পুড়ে ক্ষয় হচ্ছে।
এতক্ষণে সেটাকে ঠুকে ছাই ঝেড়ে অতনু বলে, আমাদের দেশের মহিলাদের কবে যে সত্যিকার বুদ্ধিসুদ্ধি হবে! পৃথিবীতে কত আশ্চর্য এলো, কিন্তু সপ্তম আশ্চর্য দেখার বাসনার আর এঁদের নিবৃত্তি হল না। ক্রমাগত ওঘরে উঁকি দেবার দরকারটা কী, তাই বল দিকি? ওর চিকিৎসাই হচ্ছে একা চুপচাপ শান্তিতে থাকতে দেওয়া, তা নয় সবাই যেন জু-গার্ডেনের জু দেখতে এসেছে। কৌতূহলের শেষ নেই, উঁকিমারার শেষ নেই। বোঝে না এতে আরও ক্ষেপে যাবে।
আপনি গিয়ে বারণ করে আসুন না।
আমি?
দীপক বীরত্বব্যঞ্জক স্বরে বলে, কেন নয়? আপনি ডাক্তার, আপনার রাইট আছে রোগীর সম্পর্কে ব্যবস্থা দেবার।
ওরে বাবা! অতনু বিষণ্ণতার উপর সূক্ষ্ম একটু হাসির চাদর বিছিয়ে দেয়। বলে, রাইট নিয়ে তেড়ে গিয়ে অন্ধ তমসাচ্ছন্ন চিত্তে লাইট জ্বালাতে গেলে ভীষণ ফাইট হয়ে যাবে।
অতনুর কথার ধরনই এই।
একমাত্র বাড়িতে বৌদি বাদে সমান সমান সকলের সঙ্গেই সে পরিহাসে সরস করে কথা বলে।
দীপক ম্লান মুখে বলে, এখন মনে হচ্ছে, এই গরমে এই সব বিয়ে ফিয়ের ব্যাপার না। বাধালেই হত। গরমে বেশি খেটেখুটেই তো এইটি হল!
অতনু বলে, থামো বিবেকী পুরুষ! আর আত্মঅপরাধের ভারে পীড়িত হতে হবে না।
আর মনে মনে বলে, সে পীড়ন যে ভোগ করবার সে করছে। বলে, আমিই মূল, আমিই কারণ!
কিন্তু ওদিকে কান্নার সুর ক্রমেই করুণতর হচ্ছে।
নাঃ বিপদ করলে!
উঠল অতনু, বলল, চল দেখি।
এ ঘরের দরজায় তখনো সপ্তমাশ্চর্য দর্শনার্থীর ভিড়।
অতনুকে পৃষ্ঠবল করে দীপক বলে, এই দেখ, আবার সবাই এখানে গোলমাল করছ? অতনুদা বলছেন, ডাক্তার বলে গেছে চুপচাপ থাকতে দিতে।
অতনু উপস্থিত সকলকে অবাক করে দিয়ে বেশ উচ্চবরোলে বলে ওঠে, আমি কিছু বলিনি রে বাবা! শুধু বলছিলাম অতদূর থেকে ছুটে এলাম তোর বিয়ের নেমন্তন্ন খেতে, তা সে তো ডকে উঠল, তোর গায়িকা বৌয়ের দুখানা গানটানও যে শুনব, হিংসুটি অমিতা তার আদায় রাখল না।…মিছিমিছি কেঁদে বাড়ি মাথায় করছ কেন বল তো অমিতা? তার থেকে সুস্থির হয়ে বসে নতুন বৌয়ের গান শোন না।
অতনুর এই চড়াগলায় বুঝি কাজ হয়, পাগলীর কান্না থামে। সে ভাঙাগলায় বলে, আমায় কি কেউ গান শোনায়? আমায় শুধু ভয় দেখায়, বলে মন্দিরে নিয়ে গিয়ে বলি দেবে।
অতনু গম্ভীর ভাবে বলে, সেটা অনেক দিন সারা হয়ে গেছে। এক জন্তু দুবার বলি হয় না।…যা দিকি দীপু, তোর বৌকে–এই যে মাসীমা, আপনার বৌমাকে একবার ডাকুন দিকি, একটা গান শোনা যাক।
জয়াবতী শঙ্কিত দৃষ্টিতে নীচু গলায় বলেন, এ ঘরে?
হ্যাঁ, এ ঘরেই তো। অতনুর কণ্ঠস্বর প্রবল। গান শুনলে মন ভাল হয়।
কৃতাৰ্থমন্য দীপক ছোটে বৌয়ের বাজনাটা এনে হাজির করতে। আর ভাবতে ভাবতে যায়, চিরদিন শুনে এসেছি নারী মমতাময়ী, নারী করুণাময়ী, কি বাজে কথাই শুনে এসেছি! দয়া মায়ার কিছু যদি ওদের মধ্যে থাকে! মায়া মমতা করুণা সহানুভূতি যেটুকু যা আছে পৃথিবীতে, ওই পুরুষ মানুষের মনের মধ্যেই আছে।
এই গানের প্রস্তাব কোন মহিমময়ীর রসনা থেকে উচ্চারিত হত?
নতুন বৌ কুণ্ঠিত মুখে এসে দাঁড়ায়।
অতনু উদাত্ত স্বরে বলে, এই যে গায়িকা এসো এসো, বাড়ির আবহাওয়াটা একটু ভাল কর দিকি।
হ্যাঁ, যত পারে সপ্রতিভ হবে সে, তাছাড়া আর উপায় নেই।
বৌ গায়, এ পথ গেছে কোনখানে গো কোনখানে তা কে জানে!
এমন কিছু ওস্তাদ নয়, তবু গলাটি মিষ্টি, ধরনটি নরম, সত্যিই যেন বাড়ির উৎকট আবহাওয়াটার উপর একটা স্নিগ্ধ স্পর্শ বুলিয়ে যায়।…গানের পর গান চলে। পাকা গাইয়ে নয় যে, একটার বেশি দুটোর অনুরোধ এলেই গলাভাঙার অজুহাত দেখাবে। দেখা যায় ডাক্তার অতনুর বুদ্ধিতে কাজ হয়েছে, অমিতা শান্ত মুখে বসে আছে হারমোনিয়ামের কাছে।
কেউ বসে থাকে, কেউ দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে শোনে, কেউ একটু দাঁড়িয়ে চলে যায়। গান শুনে তো আর পেট ভরবে না কারুর।
জগতের আদিমতম সত্য পেট, শাশ্বত সত্য ক্ষুধা। এরা কোনদিন কখনো বিভোর হয়ে যেতে দেবে না মানুষকে।
শিল্পে নয়, সঙ্গীতে নয়, সাহিত্যে নয়, ঈশ্বরোপলব্ধির অনির্বচনীয়তায় নয়, মহৎ জীবনের আহ্বানে নয়, রোগে শোকে দুঃখে হতাশায় নয়। কোন কিছুতেই বিভোর হয়ে থাকা চলবে না। অদৃশ্য এক রজু মনের পিছু থেকে টানতে থাকবে–খাওয়া দাওয়া হয়নি, খাওয়ার ব্যবস্থা হয়েছে তো?
খাবার দেরি হয়ে যাবে, খাওয়ার সময় উৎরে গেছে, না হলে আর একটু বসতাম।
.
চলে গেল প্রায় সবাই।
চলে গেলেন বড়পিসিমা আশ্রমে, গুরু জয়ন্তীর সন্ধ্যেআরতি দেখতে। জয়াবতী উঠে গেলেন গতকালের মিষ্টি কোথাও জমা হয়ে পড়ে আছে কি না দেখতে! যে গরম, আজ বাদ কালই তো ফেলা! তাছাড়া কোন ফাঁকে কোথায় পাচার হয়ে যাবে।
আপাতত মেয়ে আগলানোর থেকে মিষ্টি আগলানো বেশি জরুরী মনে হল জয়াবতীর।
আর তাকিয়ে দেখলেন এই গানের মূছনার মধ্যে কখন শুয়ে পড়ে অঘোরে ঘুমোচ্ছে সে। কটা গান শুনেছিল? কখন ঘুমিয়ে পড়ল? অত গভীর ঘুম এখুনি কি ভাঙবে?
.
কিন্তু ভাঙল।
যখন গান সেরে বৌ মিষ্টি হেসে উঠে গেল। আর দীপক উঠে গেল বাজনাটা রেখে আসার ছুতোয়। ওর নববিবাহিতারপশ্চাদ্ধাবনের ভঙ্গী দেখে অতনু একটু হাসল। নতুন বর কনে আর প্রেমিকা প্রেমিকা কত গল্পই না বানায়, কত ছুতোই না আবিষ্কার করে!
কিন্তু শুধুই কি নতুনেরা?