২. উঠে যাওয়া নখ

বুড়ো আঙুলের উঠে যাওয়া নখটা খুব ভোগালো নুহাকে। দিন কয়েক বাইরে বের হওয়াও বন্ধ হয়ে গেল। এই সময়ে তাকে একদিন চমকে দিলো অয়ন। গভীর রাতে ফোন করে বলল, আপনার সাথে কিছুক্ষণ কথা বলতে চাই।

অয়নের ফোন নেই নুহা জানে। প্রয়োজনে মাঝে মধ্যে এর ওর নম্বর থেকে ফোন করে সে। কিন্তু এত রাতে কখনো অয়নের সাথে তার ফোনে কথা হয়নি। তাছাড়া খানিকটা তন্দ্রাচ্ছন্ন নুহা অয়নের ঠান্ডায় বসে যাওয়া গলাও হঠাৎ চিনতে পারল না। বিরক্তি মেশানো গলায় বলল, কে?

অয়ন বলল, আমি।

আমি কে?

অয়ন।

অয়ন! কী রে? এতরাতে?

এমনি। ঘুম আসছিল না।

কেন? ঘুম আসছিল না কেন?

জানি না কেন।

মন খারাপ?

অয়ন উত্তরটা দিতে কিছুক্ষণ সময় নিলো। তারপর বলল, উঁহু।

মন খারাপ কেন বল?

মন খারাপ বলিনি তো!

তোকে আমি চিনি না ভাবছিস?

চিনিস?

হ্যাঁ, চিনি।

কতটুক চিনিস?

পুরোপুরির চেয়ে একটু কম।

একটু কম কেন?

সবকিছুতেই একটু কম থাকা ভালো, তাহলে আগ্রহটা থাকে। পুরোপুরি চিনে ফেললে সমস্যা, তখন আগ্রহটা শেষ হয়ে যায়!

তুই কি জানিস, তুই বড়দের মতো করে কথা বলিস?

আমি তো বড়ই!

তুই বড়? আমার চেয়ে চার মাস নয় দিনের ছোট তুই।

তারপরও আমি তোর চেয়ে বড়।

কীভাবে?

মেয়েরা সবসময় ছেলেদের চেয়ে বড় হয়।

সবসময়?

হুঁ, সবসময়। দেখিস না, ছেলেদের বিয়ে হয় তাদের চেয়ে বয়সে অনেক অনেক ছোট মেয়েদের সাথে। আর মেয়েদের দেখ? এই এটুক ছোট ছোট মেয়েদেরও কত বড় বড় লোকের সাথে বিয়ে হয়। ধর, তুই যাকে বিয়ে করবি, দেখা গেল সেই মেয়ে এখন ক্লাস টু-থ্রিতে পড়ছে। এমনও হতে পরে সে এখন তার মায়ের কোলে বসে ফিডার খাচ্ছে। হা হা হা!

নুহা জলের কলরোলের মতো হাসছে। কিন্তু অয়নের কেন জানি আরো মন খারাপ হয়ে গেল। সে বলল, আর তুই যাকে বিয়ে করবি সে এখন কি করছে?

সে এখন কী করছে, তা জানি না। তবে আমার জন্য গত দু’বছরে যে পরিমাণ বিয়ের প্রস্তাব এসেছে, শুনলে তুই ভিরমি খেয়ে যাবি। কই তোর জন্য একটাও বিয়ের প্রোপোজাল এসেছে? তুই না আমার চেয়ে চার মাসের বড়? শোন আমার জন্য যে বিয়ের প্রস্তাবগুলো আসছে তার মধ্যে চল্লিশ বছরের এক আংকেলও আছেন! এখন বোঝ, আমি তোর চেয়ে কত বড়?

নুহা আবারো হা হা হা করে হেসে উঠল। এই হাসি আগের হাসির চেয়েও তীব্র। কিন্তু অয়নের কেন যেন কোনো আনন্দ হচ্ছে না। সে এখানে এমন শরীর কাঁপানো হাসির কিছুই খুঁজে পাচ্ছে না। বরং তার বুকের ভেতর কোথায় যেন চিনচিন করে একটা সূক্ষ্ম ব্যথা হচ্ছে। সেই ব্যথায় তার শ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে।

অয়ন বলল, রাখি আমি?

কেন, রাখবি কেন? তোর মন খারাপ কেন সেটাই তো এখনো বললি না।

আমি আসলে জানি না আমার কেন মন খারাপ!

বাসায় কিছু হয়েছে?

উঁহু।

তাহলে?

অয়ন অনেকক্ষণ চুপ করে রইল। কদিন থেকেই তার ভেতরে ভেতরে একটা সুপ্ত কিন্তু তীব্র ইচ্ছা ক্রমশই জেগে উঠছে। তার খুব জানতে ইচ্ছে হচ্ছে, নুহা যদি তার অসুখের বিষয়টা জানে, তাহলে কী করবে সে? কিন্তু অয়ন এখনই নুহাকে জানাতে চায় না। সে আরো নিশ্চিত হয়ে নিতে চায়। যদিও অনু বা সালমা বেগম কেউই এখনো তাকে কিছুই বলেনি। আদৌ বলবে কি-না তাও অয়ন জানে না।

তবে গতকাল সুফিয়া বেগম কিছু কথা বলেছেন অয়নকে। ভোরবেলা অনু অফিসে চলে যেতেই সুফিয়া বেগম অয়নকে বললেন, শুনলাম তোর না-কি অসুখ। কিন্তু আসার পর তো দেখছি শুধু নাক ডেকে ঘুমাচ্ছিস?

অয়ন কথা বলল না। মৃদু হাসলো। সে এই মানুষটাকে পারতপক্ষে ঘাটায় না। বরং খানিকটা ভয়ই পায়। সুফিয়া বেগম আবার বললেন, কী হয়েছে। তোর?

কিছু হয়নি তো!

সর্দি, কাশি? না ডায়রিয়া? এগুলো এখন সবার হচ্ছে।

উঁহু।

মাথা ব্যথা?

নাহ।

চোখে কম দেখিস? এই বয়সে কিছু ছেলে মেয়ে মাথাব্যথা আর চোখে কম দেখার ভান ধরে। আসলে তো কিছু না। সবই চশমা নেয়ার ধান্ধা।

অয়ন চুপ করে মৃদু হাসলো।

শরীরে কোনো সমস্যা? ব্যথা আছে কোথাও?

না।

সুফিয়া বেগম অয়নের কপালে হাত দিয়ে বললেন, কই জ্বরও তো নাই? তো শরীরে ব্যথা নাই, জ্বরজারি নাই, পাতলা পায়খানা নাই। দিব্যি সুস্থ একটা ছেলে। তা তোর মা গতকাল ফোন দিয়ে অমন হাউমাউ করে কাঁদলো কেন?

মা আপনাকে ফোন দিয়ে হাউমাউ করে কেঁদেছে?

হ্যাঁ কেঁদেছে। তার ছেলের না-কি কি বড় অসুখ হয়েছে, কেঁদে-কেটে অস্থির। এত জিজ্ঞেস করলাম কী হয়েছে, তা বলল না। আসলে হয়েছে কী, তিন মেয়ের পর শেষ বয়সে এসে একটামাত্র ছেলে তো, সর্দি লাগলেও মনে হয় কি-না কি হয়েছে! কথায় আছে না, এক মায়ের এক পুত, মইরা গেলে টুককুরুত। তোর মায়ের হয়েছে সেই অবস্থা বুঝলি? তুই কিন্তু আবার চিন্তা করিস না। সব ঠিক আছে। এই বয়সে আবার ছেলে মানুষের অসুখ বিসুখ কি!

সুফিয়া বেগমের এইটুকু কথায়ই অয়ন অনেক কিছু বুঝে ফেলল। একদিন নানান কিছু দেখেশুনে সে বুঝতে পারছিল, কিছু একটা হয়েছে তার। কিন্তু এখন সে পুরোপুরি নিশ্চিত হয়ে গেল যে তার খারাপ কোনো অসুখই হয়েছে। তবে অয়ন জানে না, তার সেই খারাপ অসুখটি কি? কিংবা সেটি আসলে কতটুকু খারাপ? তার ধারণা, ভালো চিকিৎসা করালেই সে সুস্থ হয়ে উঠবে। কিন্তু সেই ভালো চিকিৎসার খরচটা আসলে কত? নিশ্চয়ই সেটি অনেক টাকার ব্যাপার। এখন এই টাকাটা জোগাড় করাটাই আসল সমস্যা। এই নিয়েই হয়তো সালমা বেগম আর অনু সারাক্ষণ ভয়ানক দুশ্চিন্তায় থাকেন।

দুশ্চিন্তায় থাকার অবশ্য যথেষ্ট কারণও রয়েছে। যে বাড়িতে চাল, ডাল, তেল, নুনের দাম কেজিতে দুয়েক টাকা বেড়ে গেলেই দুশ্চিন্তায় সবার মাথা খারাপ হয়ে যায়, সে বাড়িতে কারো চিকিৎসার জন্য যদি হঠাৎ লাখ লাখ টাকার প্রয়োজন হয়ে পড়ে, তখন পরিস্থিতিটা কী হবে, তা সহজেই অনুমেয়। অনু আর সালমা বেগমের এমন উৎকণ্ঠিত, বিচলিত অবস্থাটা তাই অয়ন বুঝতে পারছে। কিন্তু অয়নের ধারণা টাকার ব্যবস্থা হয়ে যাবে। তার চিকিৎসাও হয়ে যাবে। এই নিয়ে এত দুশ্চিন্তার কিছু নেই।

অয়ন কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে নুহাকে বলল, আচ্ছা নুহা, আমার যদি কখনো বড় কোনো অসুখ হয়, বা ধর বড় কোনো বিপদ হলো, তোর কী তখন আমার জন্য খারাপ লাগবে?

এটা কী ধরনের কথা হলো অয়ন?

কেন, এমন হতে পারে না?

পারবে না কেন? সেটা তো যে কারো হতে পারে। আমারও হতে পারে। শোন অয়ন, সেদিন সন্ধ্যায় তোকে অনেক অন্যরকম লাগছিল। কিন্তু আজ কেমন বাচ্চাদের মতো কথা বলছিস তুই।

আমি মনে হয় বাচ্চাই নুহা। সবাই তাই বলে।

কী হয়েছে তোর বল তো?

কিছু হয়নি। হঠাৎ মনে হলো, আমার যদি কখনো বড় কোনো কিছু হয়ে যায় তখন আমার কাছের মানুষেরা কেমন করবে?

সবাইকেই এভাবে জিজ্ঞেস করছিস?

নাহ্। তোকেই প্রথম।

কেন? আমিই কি তোর সবচেয়ে বেশি কাছের মানুষ?

নুহার এই প্রশ্নে অয়ন থমকে গেল। আসলেই তো। সে নুহাকেই কেন সবার আগে এই কথাটি জিজ্ঞেস করলো? সে তো আরো অনেককেই জিজ্ঞেস করতে পারতো! মা, অনু, তনু, বেনু, আরো কত কেউ আছে। কিন্তু সে সবার আগে নুহাকেই কেন কথাটা বলল? না-কি মা, অনু, তনু, বেনুর ব্যাপারে সে নিশ্চিত। সে জানে তার কিছু হয়ে গেলে তারা কেমন ব্যাকুল হয়ে যাবে। কিন্তু নুহার ব্যাপারে সে নিশ্চিত নয়। সে জানে না, তার কিছু হলে নুহার কেমন লাগবে। আর এই জন্যই সে জানতে চাইছে, নিশ্চিত হতে চাইছে। কিন্তু নুহার ব্যাপারে এই নিশ্চিত হওয়াটা তার কাছে এত জরুরি কেন?

অয়ন বলল, নাহ্, হয়তো কাছের মানুষদের মধ্যে তুই দূরের বলেই তোকে আগে জিজ্ঞেস করা।

আমি দূরের মানুষ?

আমার তো খুব বেশি কাছের মানুষ নেই রে। ওই মা আর আপুরা, তার বাইরে তুই।

অয়ন?

হু।

তোর কী হয়েছে আমাকে একটু সত্যি করে বলবি?

হ্যাঁ বলব। তবে এখন না। কয়েকটা দিন যাক। আর তোকে তো বলতেই হবে। সামনে তো অনেক কাজ।

কিসের কাজ?

যখন বলব, তখনই জানতে পারবি।

তুই এমন কেন অয়ন?

অয়ন জবাব দিলো না। ঠিক এই মুহূর্তে অয়নের মাথায় অদ্ভুত এক চিন্তা কাজ করছে। তার সত্যি সত্যি মনে হচ্ছে, তার যদি বড় কোনো অসুখ হয়ে থাকে, তবে তা খুব একটা খারাপ হবে না। বরং তখন সে জানতে পারবে, কে তাকে কতটা ভালোবাসে, কার কাছে তার গুরুত্ব কতটা!

তার বন্ধুরা তখন কে কী করবে তার জন্য? শিক্ষকরা কী করবে? নুহা কী করবে? আত্মীয়-স্বজন, বন্ধু-বান্ধব সবাই নিশ্চয়ই খুব অবাক হয়ে যাবে শুনে! তাকে কী সবাই দেখতে আসবে? কান্নাকাটি করবে কেউ কেউ? তার চিকিৎসার জন্য নানান ক্যাম্পেইনিং হবে? সকলের চোখের আড়ালে, মনোযোগের বাইরে থাকা অয়ন কী হুট করেই সকলের চোখের সামনে চলে আসবে? সবার ভাবনা, আলোচনা, মনোযোগের কেন্দ্রবিন্দু হয়ে উঠবে?

কী আশ্চর্য, বিষয়গুলো ভেবে অয়নের ভেতরে ভেতরে কেমন একটা উত্তেজনাও কাজ করছে! মানব মন আসলেই বিচিত্র, রহস্যময়ও বটে।

নুহা বলল, তুই ঘুমাবি না অয়ন?

হ্যাঁ ঘুমাবো।

শোন, এখন শুয়ে পড়। কাল আমরা কথা বলব। আমি কাল থেকে আবার বের হতে পারব।

আচ্ছা।

নুহা ফোন রাখতে গিয়ে হঠাৎ বলল, আচ্ছা, এত রাতে এটা কার ফোন থেকে ফোন দিলি তুই?

আমার ফোন।

তোর ফোন! তুই ফোন কিনেছিস? কে কিনে দিয়েছে?

কে আবার? বড়’পু।

কি ফোনরে?

অয়ন ফোনের মডেল বলল। শুনে ভারি অবাক হলো নুহা। অয়নদের অবস্থা সে জানে। এত দাম দিয়ে অয়নকে হঠাৎ ফোন কিনে দিলো কেন অনু আপু?

আচ্ছা। ফোনটা ভালো, কিন্তু হঠাৎ এত টাকা দিয়ে তোকে ফোন কিনে দিলো কেন আপু?

জানি না তো!

সত্যি জানিস না? না-কি লুকাচ্ছিস?

আরে ধ্যাৎ, লুকাবো কেন?

তাহলে বলছিস না কেন? অনু আপু তোকে এত দাম দিয়ে ফোন কিনে দিলো। তাও আবার তোর পরীক্ষার আগে আগে। ব্যাপার কী বল তো? এই এত এত দিনে, কত কত অনুরোধ। কিন্তু কখনোই একটা সস্তা, কম দামি ফোনও দেননি। আর ঠিক পরীক্ষার আগে আগেই এত দামি একটা ফোন কিনে দিলেন কেন আপু? ঘটনা কি? না-কি মিথ্যে বলছিস? অন্য কোনো ঘটনা নেই তো?

নুহার কথার উত্তরে কিছু একটা বলতে গিয়েও অয়ন বলার মতো কিছুই খুঁজে পেল না। তার আচমকা মনে হলো, আসলেই তো! এই বিষয়টি তো সে ভাবেনি। ফোনটা পেয়ে এত আনন্দিত হয়ে গিয়েছিল সে যে এত কিছু ভাবেইনি। কিন্তু নুহা তো ঠিকই বলেছে। তার পরীক্ষার আগে তো পৃথিবী উল্টে গেলেও অনু তাকে ফোন কিনে দিবে না। তার উপর এত দামি ফোন? তনুর বাচ্চা হতে গিয়েই কত কত টাকা চলে গেল অনুর। ধারও করতে হলো বিস্তর। দুই মাসের বাসা ভাড়া অব্দি বাকি পড়ে গেল। তার ওপর অসুস্থ হয়ে পড়লো অয়ন, সেখানেও খরচ। সামনে অয়নের পরীক্ষা, সেখানে খরচ। এরমধ্যে এতগুলো টাকা খরচ করে তাকে ফোন কিনে দেয়ার ঘটনা এখন রীতিমতো অবিশ্বাস্য লাগতে লাগল অয়নের কাছে। তার হঠাৎ মনে হলো, এই ফোনের সাথে বড় ধরনের কোনো একটা ঘটনা আছে। ঘটনাটা সে ধরতে পারছে না। তার অসুস্থতা নিয়ে, চিকিৎসার টাকা জোগাড় নিয়েও যেখানে সবাই সারাক্ষণ দুশ্চিন্তায় থাকে, সেখানে, সেই পরিস্থিতিতেই তাকে এমন একটা ফোন কিনে দেওয়ার ঘটনা স্বাভাবিক নয়। একদমই স্বাভাবিক নয়। বরং অস্বাভাবিক ঘটনা। কিন্তু সেই অস্বাভাবিক ঘটনাটি আসলে কী!

*

অফিসে অনুর সমস্যার একটা সমাধান বের করে ফেললেন আলতাফ হোসেন। কিন্তু সমাধানটা শুনে অনু কেন যেন আনন্দিত হতে পারল না। বরং তার মনে হলো, আলতাফ হোসেন যেমন সমাধান বের করে ফেলেছেন, তেমনি সমস্যাটাও আসলে তিনিই তৈরি করেছেন।

আলতাফ হোসেন তাকে রুমে ডেকে বললেন, অনু, আপাতত একটা সমাধান বের করা গেছে।

অনু আগ্রহ নিয়ে জানতে চাইলো, কী সমাধান ভাইয়া?

আমরা পাঁচ দিনের জন্য একটা সার্ভে টিম নিয়ে আবার ফিল্ডে যাব। যতটা সম্ভব ফিল্ড থেকেই ক্রস চেকের রিপোর্ট আর আমাদের আগের রিপোর্টের সাথে চেক করে একটা রিপোর্ট করে ফেলব। আসলে গ্যাপটা কেন হয়েছিল, কোথায় হয়েছিল, সেটা দেখাবো।

কিন্তু ম্যানেজমেন্ট কি এতে রাজি হবে ভাইয়া?

সেটা আমার দায়িত্ব। আপনি টেনশন করবেন না। তবে একটা সমস্যা আছে।

কী সমস্যা ভাইয়া?

আমাদের খরচ কমাতে হবে। ট্রান্সপোর্ট, অ্যাকোমডেশন, ফুড এইসব ক্ষেত্রে কস্ট রিডাকশন করতে হবে। আসলে যত কম খরচে সম্ভব কাজটা প্রোপারলি শেষ করতে হবে। কারণ অফিস এই খরচটাই করতে চাইছিল না। অনেক ঝামেলা করে অফিসকে রাজি করানো গেছে। অফিস এমনকি ট্রান্সপোর্টের জন্য আলাদা কোনো গাড়িও দিবে না। বাসে যেতে হবে। তবে আমি আমার গাড়িটা নিয়ে যাব। ধরুন আপনি আর আমি আমার গাড়িতে চলে গেলাম দু’দিন আগে। বাকি টিম দুই দিন পরে বাসে চলে এলো।

আমরা দুজন আলাদা যাব কেন ভাইয়া? সবাই একসাথে গেলেই ভালো হতো না?

পুরো টিম পৌঁছানোর আগেই আগেভাগে গিয়ে কিছু বিষয় রেডি করে ফেলতে হবে আমাদের। ওগুলো আপনি আর আমি ছাড়া তো অন্য কেউ পারবে না অনু।

আলতাফ হোসেনের কথাবার্তা খুবই স্বাভাবিক। পরিস্থিতি বিবেচনায় বরং তার প্রতি অনুর কৃতজ্ঞ বোধ করা উচিত। অনুর চাকরিটিই হয়তো বাঁচিয়ে দিলেন তিনি। এই মুহূর্তে চাকরি চলে গেলে অনুকে আক্ষরিক অর্থেই অথৈ সমুদ্রে পড়তে হতো। কিন্তু অনু কেন যেন আলতাফ হোসেনের প্রতি কৃতজ্ঞ হতে পারছিল না। বরং তার ভেতর ভেতর অন্য একটা ভাবনা জেগে উঠে তাকে সতর্ক করে দিচ্ছিলো।

অনু বলল, ভাইয়া, আমাদের সাথে যেহেতু গাড়ি আছে, আমরা তো টিম থেকে আরো দুয়েকজন নিয়ে যেতে পারি। ওখানে ওরা আমাদের কাজেও হেল্প করতে পারবে আবার দুজনের বাসের টিকেটের খরচও বেঁচে যাবে।

হুম। কিন্তু আরেকটা সমস্যা আছে অনু। প্রথমত অ্যাকোমডেশন। এটাতেই সবচেয়ে বেশি খরচ যায় আমাদের। আমরা এবার চাইলেই আগের মতো পুরো টিম নিয়ে কোনো রেস্ট হাউজ বা হোটেলে উঠতে পারব না। তাদের জন্য হয়তো লোকালি কোথাও থাকা-খাওয়ার ব্যবস্থা করে নিতে হবে। আর আপনি আর আমি হয়তো আমাদের জন্য আলাদা কোনো ব্যবস্থা করে নেবো।

আলাদা ব্যবস্থা?

আপনি চিন্তিত হবেন না। আমার উপর ছেড়ে দিন। আশা করছি, ভালো কোনো ব্যবস্থাই হবে। আর আমরা যেহেতু আগেভাগে যাচ্ছি, সো দেখেশুনে সিদ্ধান্ত নেয়ার সুযোগ তো থাকছেই।

জি ভাইয়া।

আলতাফ হোসেনের কথা সত্য। তবে পরিস্থিতি আন্দাজ করে অনু খানিক দমে গেল। অন্য সময় হলে হয়তো তার মনে কোনো সংশয় থাকত না। কিন্তু এবার থাকছে। সে আসলে সেদিন রাতের আলতাফ হোসেনকে মাথা থেকে তাড়াতে পারছে না। অধিকন্তু বিষয়টা তার মনের ভেতরে কেমন কাঁটা হয়ে বিধে খচখচ করছে।

দিনের বাকিটা সময় অনু আর তার কাজে মন বসাতে পারল না। দুপুরে লাঞ্চের সময় আলতাফ হোসেন বললেন, ধরে নিন আপনি আর আমি শুক্রবারেই রওয়ানা করে যাচ্ছি। আর বাদ বাকি সবাই না হয় রবিবারে পৌঁছে যাবে। আপনাকে আজকেই একটা অ্যাপ্রোক্সিমেট বাজেট রেডি করে ফেলতে হবে। আমি ডিটেলস প্ল্যান পাঠিয়ে দিচ্ছি।

অনু মৃদু স্বরে বলল, আচ্ছা।

কিন্তু ডেস্কে ফিরে অনুর স্বস্তি হচ্ছিল না। বাজেট করতে গিয়েও কাজে পুরোপুরি মনোযোগ দিতে পারছিল না সে। অনুর ডেস্কের ঠিক উল্টো দিকেই বসে হাসান। হাসান কাজ করে আলাদা প্রজেক্টে। কিছুটা চুপচাপ মৃদুভাষী ধরনের মানুষ সে। বয়সে অনুর সমবয়সি বছরখানেকের ছোট হলেও অফিসে হাসানের পদ অনুর চেয়ে বড়। হাসান হঠাৎ অনুকে বলল, আপনি কি কোনো কারণে আপসেট?

অনু চমকে যাওয়া গলায় বলল, না তো। কেন বলুন তো?

আপনি ডাইনিংয়ে ফোন রেখে এসেছিলেন। আমি নিয়ে এসে আপনার পাশে রেখে দিলাম। আপনি খেয়ালই করলেন না। আর এখন অনেকক্ষণ থেকে ফোনটা বাজছে।

অনু বিব্রত ভঙ্গিতে ফোনটা দেখলো। অয়ন ফোন করেছে, অনু কিছুটা অবাক হয়েই ফোনটা ধরলো। অয়ন বলল, আপু শামীম ভাই তনু আপুকে অনেক মেরেছে।

অনু ফোনের ভলিয়ুম কমাতে কমাতে বসা থেকে উঠে দাঁড়ালো। মুখের কাছে হাত নিয়ে অনুচ্চ গলায় বলল, কী হয়েছে?

শামীম ভাই তনু আপুকে আজ খুব মেরেছে।

কেন?

তনু আপু কাউকে কিছু বলেনি। কিন্তু মাথা ফেটে রক্ত বের হচ্ছে।

শামীম কই?

শামীম ভাই বের হয়ে গেছে।

আর তনু?

মা তনু আপুকে নিয়ে হাসপাতালে যাবে। কিন্তু…

আচ্ছা। তুই এক কাজ কর, আমার রুমের আলমারির উপরে একটা ছোট লাল পার্সের মতো ব্যাগ রাখা আছে। ওটার ভেতর কিছু টাকা থাকার কথা। একটু দেখতো।

তুই আসতে পারবি না?

দেখছি।

অনু ফোন রেখে চুপচাপ কিছুক্ষণ বসে রইল। তার মাথার বা দিকটায় চিনচিন করে তীক্ষ্ণ ব্যথা হচ্ছে। গরমও লাগছে ভীষণ। উঠে দাঁড়াতে গিয়ে মুহূর্তের জন্য মনে হলো, মাথা ঘুরিয়ে পড়ে যাবে সে। কিন্তু পড়লো না। কোনো মতে সামলে নিলো। তারপর ওয়াশরুমে গিয়ে দীর্ঘসময় নিয়ে চোখে মুখে পানির ঝাঁপটা দিলো সে। তারপর আয়নার দিকে তাকিয়ে রইল নিস্পলক। এলোমেলো চুল, কালি পড়ে যাওয়া চোখের কোল, প্রসাধনীবিহীন মুখ। কিন্তু তারপরও আয়নার ওই মেয়েটার জন্য খুব মায়া হতে লাগল অনুর।

অনু অবশ্য তখনই বের হতে পারল না। বের হতে হতে তার সন্ধ্যা হয়ে এলো। এর মধ্যে অয়ন বার কয়েক ফোন করেছে। কিন্তু অনু ধরার মতো অবস্থায়ই ছিল না। তাকে তিন তিনবার বাজেট করে আলতাফ হোসেনকে দেখাতে হলো। প্রথম দুবারে প্রচুর কাটছাট, যোগ-বিয়োগের পর তৃতীয়বারের বাজেট জমা নিলেন আলতাফ হোসেন। তারপর পাঠিয়ে দিলেন ফাইনাল অ্যাপ্রুভালের জন্য। হাসপাতালে পৌঁছাতে পৌঁছাতে আটটা বেজে গেল অনুর। তনুর মাথার আঘাত তেমন গুরুতর না হলেও খাটের কোণায় লেগে অনেকখানি কেটে গিয়েছে। রক্তও গিয়েছে প্রচুর। তনুকে মাথায় ব্যান্ডেজ বাঁধা দেখে অনুর অবশ্য তেমন খারাপ লাগল না। তার মনে হলো মাথায় সাদা ধবধবে ব্যান্ডেজ বাধা তনুকে দেখতে সুন্দর লাগছে। তার এই সুন্দর লাগার কারণ ব্যান্ডেজ। সিনেমার নায়িকাদের মাথায় ব্যান্ডেজ বাঁধা থাকলে তাদের এমন সুন্দর দেখায়!

ডাক্তার চেয়েছিলেন তনুকে অন্তত একটা রাত হাসপাতালে রেখে দিতে। কিন্তু তনু থাকতে চাইল না। অনেক বুঝিয়েও রাখা গেল না তাকে। আসলে ভেতরে ভেতরে প্রচণ্ড অপরাধবোধে ভুগছে সে। তার কারণে আবার কতগুলো। টাকা খরচ হয়ে গেল অনুর। তার ওপর এখন একটা রাত হাসপাতালে থাকলে খরচ আরো বেড়ে যাবে। অনুও অবশ্য খুব একটা জোরাজুরি করল না।

বাসায় ফিরে গভীর রাতে তনুর ঘরে গেল অনু। তনু তখন হাফসাকে ঘুম। পাড়িয়ে দেয়ালে হেলান দিয়ে বসেছিল। ঘরে ঢুকেই আলো জ্বালালো অনু। তনু সাথে সাথেই আর্তনাদের মতো করে বলল, লাইটটা জ্বালাস না আপু। প্লিজ।

অনু বাতি নিভিয়ে দিয়ে তনুর পাশে গিয়ে বসলো। তনু অপরাধীর মতো গলায় বলল, আমি খুব সরি আপু।

সরি কেন?

আবার এতগুলো টাকা নষ্ট করলাম তোর।

অনু অন্ধকারে বিছানা হাতড়ে একটা বালিশ খুঁজে নিয়ে নিজের পিঠের নিচে দিলো। তারপর বলল, কী হয়েছিল?

সকাল থেকেই শরীরটা খারাপ লাগছিল। বিছানা থেকে নামতে গিয়ে মাথাটা হঠাৎ কেমন করে উঠল। মনে হলো চারপাশে সবকিছু বনবন করে ঘুরছে। সামলাতে পারলাম না, মাথা ঘুরিয়ে পড়ে গেলাম একদম খাটের কোণায়। কিন্তু এইটুকুতে এতখানি কেটে যাবে…।

শামীম কী আজকাল প্রায়ই তোর গায়ে হাত তোলে?

তনু অবাক হবার ভঙ্গিতে বলল, শামীম আমার গায়ে হাত তুলবে কেন আপু?

পুরুষ মানুষের গায়ে হাত তোলার কারণ তো ওই একটাই, তারা পুরুষ মানুষ। আর সব কারণগুলো তো শুধুমাত্র অজুহাত।

না আপু, শামীম কিছু করেনি। তুই তো জানিসই ও কেমন মানুষ?

আমি জানি বলেই বলছি। তুই এতদিন লুকিয়ে রেখেছিস দেখে আমি ইচ্ছে করেই কিছু জানতে চাইনি। তোকে বিব্রত করতে ইচ্ছে হয়নি।

তনু চুপ করে রইল। অনুও। দুজনের মাঝের অন্ধকারটা যেন ক্রমশই গাঢ় হচ্ছিল। অনেকক্ষণ পর তনু খুব মৃদু গলায় বলল, আমার ওপর তোর অনেক রাগ না আপু?

রাগ? কেন?

ওভাবে কারো কথা না ভেবে শামীমকে বিয়ে করে ফেললাম!

এই এত বছর আগের কথা আজ কেন?

আমার আজকাল খুব মরে যেতে ইচ্ছে করে আপু। মনে হয় সুইসাইড টুইসাইড করে ফেলি। শুধু হাফসার মুখের দিকে তাকিয়ে কিছু করতে পারি না।

মরে যেতে ইচ্ছে করে কেন?

খুব, খুব অপরাধী লাগে নিজেকে। তোর জীবনটা আমি নষ্ট করে দিলাম। সাথে আমার জীবনটাও।

আমার জীবন নষ্ট হয়েছে কে বলল? আর তুই কিভাবে আমার জীবন নষ্ট করবি?

করেছি। আমি জানি তুই কখনোই আমাকে কিছু বলবি না। কোনোদিনই না। আসলে কাউকেই বলবি না।

তনু দীর্ঘশ্বাস ফেলে কিছুক্ষণ চুপ করে রইল। তারপর বলল, তুই যখন নিজের কথা বাদ দিয়ে আমাদের সবার কথা ভাবছিলি, আমি তখন সবার কথা বাদ দিয়ে শুধু নিজের কথা ভাবলাম। কী অকৃতজ্ঞ আমি! সেই ওইটুকু বয়সেই যদি ওভাবে শামীমের সাথে সম্পর্কটায় না জড়াতাম, কারো কথা না শুনে, না ভেবে ওভাবে পালিয়ে বিয়ে করে না ফেলতাম, যদি তোর সাথে আমিও একটু একটু করে সংসারের হাল ধরার চেষ্টা করতাম, তাহলে সবকিছু অনেক অন্যরকম হতে পারতো।

অনু এই প্রসঙ্গে কিছু বলল না। সে বলল, শামীম কি টাকা-পয়সা কিছু চাইছে?

না আপু। টাকা চাইবে কেন?

টাকা মানুষ যে-কোনো কারণে চাইতে পারে, কারণ না থাকলেও।

না আপু, ও কিছু চায়নি।

মিথ্যে বলছিস কেন? মা সব শুনেছে বাইরে থেকে।

তনু জানে, এই কথা সে লুকিয়ে রাখতে পারবে না। তারপরও অনুর কথার কোনো জবাব দিল না সে। চুপ করে রইল। অনু বলল, কত টাকা চাইছে?

বাদ দে না প্লিজ। আমার আর ভালো লাগছে না। মনে হচ্ছে, আমি হচ্ছি সেই মানুষ যে কারো দিকে চোখ তুলে তাকানোর অধিকার রাখি না। কারো সাথে আদর, আবদার, ভালোবাসার কথা বলার অধিকার রাখি না। আহ্লাদ করার অধিকার রাখি না। আমি সবার কাছে সব অধিকার নিজেই হারিয়েছে। আমার প্রতিটা মুহূর্ত কাটে ভয়ে। মনে হয়, আমি যে এই কথাটা তাকে বলব, এটা বলার কোনো মুখ কি আমার আছে? নিজেকে পৃথিবীর সবচেয়ে ভীত সন্ত্রস্ত মানুষ মনে হয় আমার। আমি সবসময় সবাইকে ভয় পাই। এই বুঝি কেউ আমার কথায়, আচরণে কষ্ট পেল। অয়নের কথা আমি ভাবতে পারি না-রে আপু। আমার চিন্তা-ভাবনা সব ফাঁকা হয়ে যায়। বুকের ভেতরটা ভেঙে-চুরে যায়। কিন্তু আমি কাঁদতে পারি না, আমি অয়নের কাছে গিয়ে বসতে পারি না। আমার সাহস হয় না। মনে হয় সেই অধিকারটাও আমার নেই। মনে হয় কেউ যদি বলে, এখন কাঁদছিস কেন? তখন তো কারো কথা ভাবিসনি! কেউ যদি বলে…। আপুরে! এই যে তিন সাড়ে তিন মাসের হাফসা, ওকেও আমি ভয় পাই জানিস? আমার ভেতরের অপরাধবোধ আর অক্ষমতা আমাকে শেষ করে দিচ্ছে আপু। আমি আর পারছি না।

অনু চুপ করে বসে রইল, তনুর কথার কোনো জবাব দিল না। তারপর অন্ধকারেই তনুর হাত খুঁজে নিয়ে হাতটা তার হাতের মুঠোয় চেপে ধরলো। তনু কিছুক্ষণ তার হাতটা নির্জীব ফেলে রাখলো অনুর হাতে। তারপর ধীরে অনুর হাতটা শক্ত করে চেপে ধরলো। তারপর বসে রইল নিথর, নিজীব। যেন আবছা অন্ধকার ক্যানভাসে খানিক গাঢ় কালো কালিতে আঁকা একজোড়া বিমূর্ত স্থির ছায়ামূর্তি। সেই স্থির ছায়ামূর্তি দুজনের যে প্রাণ আছে তা কেবল প্রাণ দিয়েই অনুভব করা সম্ভব। চোখ দিয়ে নয়। পাঁচ বছর বয়সের ব্যবধানের দুজন নারী, দুটি বোন এই আবছা অন্ধকারে কোনো কথা না বলেও, কোনো শব্দ না করেও যেন অবিরাম বলে যেত লাগল বুকের ভেতর জমিয়ে রাখা শত সহস্র অব্যক্ত কথা। সেই কথায় দুঃখ আছে, অভিমান আছে, অভিযোগ আছে, স্মৃতি-বিস্মৃতি আছে। কেবল আনন্দ নেই, আশা নেই, আলো নেই।

*

আলতাফ হোসেন অনুকে ফোন দিলেন রাত দু’টায়। পরপর তিনবার। ধরবে না ধরবে না করেও জরুরি কিছু ভেবে অনু তৃতীয়বারে ফোন ধরলো। আলতাফ হোসেন বললেন, ঘুমিয়ে পড়েছিলেন? এতরাতে ফোন দিয়েছি বলে কিছু মনে করেননি তো?

অনু ঘুমায়নি তখনো। অয়নের পাশে বসে ছিল এতক্ষণ। অয়নের শরীরটা একটু খারাপ করেছে। জ্বরটা এসেছে আবার। অনু অয়নের পাশ থেকে উঠতে উঠতে বলল, না না, বলুন ভাইয়া।

আসলে কাজের কথা বলার জন্যই ফোন করেছি।

জি ভাইয়া।

আমরা ফ্রাইডেতে কখন রওয়ানা করব বলুন তো? আসলে সন্ধ্যার আগে আগে পৌঁছে যেতে পারলে ভালো। গাইবান্ধা শহর থেকে সামান্য দূরে, এই ধরুন পাঁচ ছয় কিলোমিটার। আমার বন্ধুর বিশাল বড় দোতলা বাড়ি। আমরা ওখানেই থাকব। থাকা খাওয়ার ফার্স্টক্লাস ব্যবস্থা। আর আমাদের তো সাথে গাড়ি আছেই।

আলতাফ হোসেনের কথা শুনে অনু আরো দমে গেল। সে বলল, আগের বার আমরা পুরো টিমটা যেখানে ছিলাম, ওখানে থাকা যাবে না, ভাইয়া? ওখানকার সবাই তো আমাদের খুব পরিচিত।

ওটা আসলে অনেক আগে থেকে বুকিং দিয়ে রাখতে হয়। আচ্ছা, বাই এনি চান্স, আপনি কী আমার বন্ধুর ওখানে থাকতে ভয় পাচ্ছেন না-কি? হা হা হা। ভয় পাবেন না, আমার বন্ধু ওখানে একা থাকে না, সে তার ফ্যামিলি নিয়েই থাকে। হা হা হা।

অনু মিন মিন করে বলল, না ভাইয়া, ভয় পাবো কেন!

সত্যি কথা হচ্ছে অনু ভয় পাচ্ছিল। কিন্তু এই ভয় দূর করার কোনো উপায়। সে খুঁজে পাচ্ছিল না। পেল না নির্দিষ্ট দিনে গাইবান্ধা যাওয়ার আগ অব্দিও।

.

তারা গাইবান্ধা শহরে পৌঁছালো শুক্রবার সন্ধ্যা সাতটায়। ছোট্ট শহর ছেড়ে সরু রাস্তা ধরে আলতাফ হোসেনের বন্ধুর বাসা অব্দি যেতে আরো মিনিট কুড়ি পথ। চারপাশে গাছপালা ছাওয়া দোতলা বাড়িটা মূল রাস্তা থেকে সামান্য ভেতরে। সামনে শ্যাওলা পড়া বিশাল উঠোন। অনু হাঁটতে গিয়ে পিছলে পড়ে যাচ্ছিল। আলতাফ হোসেন শেষ মুহূর্তে খপ করে তার হাত ধরে ফেললেন। কিন্তু এই স্যাঁতসেঁতে উঠোন আর নির্জন বাড়ি অনুর মাথায় কুটকুট করে কামড়ে চলা এতদিনকার ঘুণপোকাটাকে আরো তীক্ষ্ণ করে তুলল। বাড়ির ভেতরটা যেন আরো শুনসান। কোথাও কেউ নেই। একজন মাঝবয়সি কাজের মহিলা এসে দরজা খুলে তাদের বসতে দিলো। আলতাফ হোসেনের বন্ধু বা বন্ধুর স্ত্রীকে কোথাও দেখা গেল না। অনু সাধ্যমতো চেষ্টা করছে তার অস্বস্তি লুকাতে। কিন্তু পারছে না। আলতাফ হোসেনের বন্ধু সোহরাব এলো মিনিট কুড়ি পর। তিনি এসেই বারবার দুঃখ প্রকাশ করলেন। অনু এতক্ষণে বুঝে গিয়েছে, এ বাড়িতে আর কেউ থাকে না। সোহরাব থাকলেও তা নিয়মিত নয়। মাঝেমধ্যে হয়তো আসেন। তবে তা নির্দিষ্ট কোনো কাজে বা বেড়াতে। বিষয়টি ভেবে অনুর মেরুদণ্ড বেয়ে একটা শীতল স্রোত বয়ে গেল। নিজের অজান্তেই সে তার হাতব্যাগটা শক্ত করে চেপে ধরলো।

সোহরাব বললেন, আমার শ্বশুর আজ দুপুরেই হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়লেন। আমার স্ত্রী-বাচ্চাদের নিয়ে গেছেন সেখানে। এই জন্যই বাড়িটা এত ফাঁকা ফাঁকা লাগছে। তবে সকাল নাগাদ ওরা চলে আসবে। আর সে নেই বলে ভাববেন না যে আপনাদের থাকা বা খাওয়ায় কোনো অসুবিধা হবে! যেই ঝি টাকে দেখলেন, সেই ছোটবেলা থেকে সে এ বাড়িতে। একবার রান্না খেলে এ জীবনে আর ভুলতে পারবেন না।

অনু সামান্য হাসলো কেবল, কিছু বলল না। তাকে দোতলায় একটা ঘর দেয়া হয়েছে। ঘরে পরিপাটি করে গোছানো বিছানা। পায়ের কাছে পাতলা কাঁথা ভাঁজ করে রাখা। ঘরের সাথেই বাথরুম, দখিন দিকে বড় জানালা। জানালাগুলো বন্ধ। অনু একটা জানালা খুললো। রাত কত হয়েছে কে জানে! তবে বাইরে বিস্তীর্ণ ফসলের মাঠ। সেই মাঠে যেন কোনো এক অপার্থিব সময়ের আলো। অনু মাথা তুলে তাকালো। মাথার উপরে নাম না জানা গাছের পাতার ফাঁকে ঝকঝকে মেঘমুক্ত আকাশ। আকাশে বিশাল চাঁদ। অনুর মুহূর্তের জন্য মনে হচ্ছিল, দুঃখ, দুশ্চিন্তাবিহীন কোনো এক অপার আনন্দময় পৃথিবীতে সে বেড়াতে এসেছে। কিন্তু পরমুহূর্তেই দখিনা এলোমেলো উন্মাতাল হাওয়ার সাথে নানান দুশ্চিন্তা উড়ে এসে তাকে জাপটে ধরলো। যেন মনে করিয়ে দিলো, সে এক অজানা অচেনা জায়গায়, এক অস্বস্তিকর অনিশ্চিত সময়ের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে। সে জানে না, এই রাতে তার ভাগ্যে কী রয়েছে। আবার এই রাত এড়ানোর কোনো উপায়ও তার জানা নেই।

অনু সময় নিয়ে গোসল সারলো। তারপর খেতে গেল। খাবার টেবিলে খুব একটা কথা বলল না সে। আলতাফ হোসেন বললেন, দেখেছেন আকাশে কী একটা চাঁদ উঠেছে?

সোহরাব বললেন, দক্ষিণ দিকে নদী আছে। এখন তো নদীর পানিও ভরভরন্ত। চাইলে রাতে নৌবিহারও করা যায়।

আলতাফ হোসেন অনুর দিকে তাকিয়ে বললেন, কি অনু? যাবেন না-কি?

অনু বলল, না ভাইয়া। আজ থাক। কাল না হয় সবাই আসলে তখন। হবে।

আলতাফ হোসেন বললেন, শোনেননি, আজকের কাজ কালকের জন্য ফেলে রাখতে নেই?

অনু বলল, খুব টায়ার্ড লাগছে ভাইয়া, মাথাটাও ব্যথা করছে।

আলতাফ হোসেন বললেন, এই বয়সে এত অল্পতেই টায়ার্ড হলে হবে অনু? এখন তো এনার্জির সময়। হা হা হা। যেন খুব মজার কোনো কথা বলেছেন, এমন ভঙ্গিতে তিনি হাসলেন। সেই হাসিতে আলাদা কিছু ছিল কি-না অনু জানে না, তবে তার সারা শরীরজুড়ে কেমন অস্বস্তিকর এক অনুভূতি বয়ে গেল। অনু যতটা সম্ভব তড়িঘড়ি করে উঠে বেসিনে হাত ধুতে যেতেই আলতাফ হোসেন বললেন, এভাবে খাওয়া শেষ না করেই উঠে যাচ্ছেন কেন?

অনু বলল, মাথাটা খুব ধরেছে ভাইয়া। কাল কথা হবে।

সোহরাব বললেন, চা টা খেয়ে যান, মাথা ধরা কমবে।

অনু জোর করে মুখে সামান্য হাসির ভাব ফুটিয়ে বলল, আমার এমনিতেই চায়ের খুব একটা অভ্যাস নেই।

অনু হাত ধোয়া শেষ করে তোয়ালে হাত মুছছিল। এই সময়ে আলতাফ হোসেন অনুকে ডাকলেন। তার গলাটা কেমন অচেনা লাগল অনুর কাছে। অনু ফিরে তাকাতেই বললেন, চায়ের অভ্যাস নেই, এটার অভ্যাস আছে?

আলতাফ হোসেনের সামনে একটা কাঁচের বোতল। অনু কখনো মদ খায়নি। কিন্তু টেবিলের ওপরের ওই জিনিসটা চিনতে তার অসুবিধা হলো না। সে ভেতরে ভেতরে বড়োসড়ো একটা ধাক্কা খেলো। তবে বাইরে সেটি বুঝতে দিলো না। যেন চোখে কিছু পড়েছে, এমন ভঙ্গিতে অনু আবারো বেসিনের দিকে ঝুঁকে চোখে মুখে পানি ছেটালো। তারপর বলল, সবকিছুতে কি সবার অভ্যাস হয় আলতাফ ভাই?

আলতাফ হোসেন বললেন, আজকের রাত থেকেই না হয় অভ্যাসটা শুরুর হয়ে যাক, অনু। এমন সুযোগ হেলায় হারাবেন কেন?

অনু কিছুক্ষণ চুপ করে আলতাফ হোসেনের চোখের দিকে তাকিয়ে রইল। তারপর মৃদু হেসে বলল, যেদিন অভ্যাস হবে, সেদিন আপনাকে জানাবো ভাইয়া।

আলতাফ হোসেন বললেন, অত অপেক্ষা করার কী দরকার? আজই না হয় তোক। সবকিছুই তো প্রথমবারের মতো একদিন শুরু করতে হয়। দেখেছেন, কী সুন্দর জোছনা, নদী থেকে উড়ে আসা এমন বিশুদ্ধ দখিনা হাওয়া, আর এই নির্জন রাত। শুরু করার জন্য এর চেয়ে ভালো সময় আর কই পাবেন অনু?

অনু বলল, কে জানে, হয়তো এর চেয়েও ভালো কোনো সময় আসবে, আশা করতে দোষ কী?

আলতাফ হোসেনকে আর কিছু বলার সুযোগ না দিয়েই অনু দোতলার সিঁড়ি বেয়ে নিজের ঘরে চলে এলো। ঘরের দরজা যে খুব একটা মজবুত এমন নয়, তবে উপরে এবং মাঝামাঝি দুটো সিটকিনি লাগানোর ব্যবস্থা আছে। অনু। দুটোই লাগালো। তারপর বাতি বন্ধ করে চুপচাপ বিছানায় বসে রইল। আলতাফ হোসেন কোনো একটা নির্দিষ্ট মানসিক অবস্থার মধ্য দিয়ে যাচ্ছেন সেটি নিশ্চিত। কিন্তু এই পুরো পরিস্থিতি ইচ্ছাকৃতভাবে তৈরি করার মতো মানুষ আলতাফ হোসেন, এটি ভাবতে অনুর কষ্ট হচ্ছে। যদিও সে জানে, কষ্ট হলেও এই পরিস্থিতি এখন বাস্তব এবং এখন এটিকে সে কীভাবে মোকাবিলা করবে, তা ঠিক করতে হবে তাকেই।

অনুর একবার মনে হলো, এখানে এভাবে চলে আসাটা তার ঠিক হয়নি। কিন্তু সাথে সাথেই আবার মনে হলো, না এসেই বা কী করার ছিল তার? সে তো আসার আগে আর কম ভাবেনি! হাজারটা বিকল্প ভেবেছে, কিন্তু উপায় ছিল না।

ঠিক এই মুহূর্তে দরজায় নক হলো। পরপর দুইবার। অনু প্রথমে সাড়া দিলো না, চুপচাপ বসেই রইল। আলতাফ হোসেন আবারো নক করলেন।

তারপর বললেন, অনু, ঘুমিয়ে পড়লেন না-কি?

অনু ইচ্ছে করেই ঘুম জড়ানো কণ্ঠে বলল, শুয়ে পড়েছি ভাইয়া। মাথাটা খুব ব্যথা করছে।

আলতাফ হোসেন বললেন, ভেতরে নিশ্চয়ই গরম পড়ছে বেশ। বাইরে আসুন। চলুন ছাদে গিয়ে কিছুক্ষণ বসবেন। খোলা হাওয়ায় মাথা ধরা সেরে যাবে।

অনু বলল, এখন আর বের হবো না ভাইয়া। আপনারা যান। আমি একটু ঘুমাই। তাছাড়া কাল অনেক কাজও আছে। খুব ভোরে উঠতে হবে।

ভোরে উঠতে হবে না অনু। চাইলে আপনি কাল কাজে নাও যেতে পারেন, আমি সব ব্যবস্থা করে রেখেছি।

অনু কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বলল, ভাইয়া, প্লিজ, এখন আর না। একটু ঘুমাই।

আলতাফ হোসেন এবার যেন কিছুটা জোরই করলেন। বললেন, আরে আসুন না। আসুন, আসুন। আমি বলছি আসুন, ছাদে কিছুক্ষণ বসে থাকব। আর, দু’ঢোক খেলে দেখবেন মাথা ব্যথা কই পালাবে! আসুন, আসুন।

অনু এবার আর জবাব দিলো না। আলতাফ হোসেন আরো বার দুয়েক দরজায় নক করলেন। দাঁড়িয়েও রইলেন কিছুক্ষণ। তারপর যেন কিছুটা রেগে গিয়েই উঁচু গলায় বললেন, সবকিছুতেই আপনার বাহানা অনু, এত বাহানা কেন আপনার? জীবনে এত বাহানা থাকলে চলে না, উন্নতিও হয় না। আমিই তো আপনাকে ডাকছি, অন্য কেউ তো না। এইটুকু সেন্স আপনার থাকা উচিত। কৃতজ্ঞতাবোধ বলেও একটা ব্যাপার আছে!

অনু কী করবে বুঝতে পারছে না। তার মন আর কিছুতেই সায় দিচ্ছে না। কোনো ভরসাও পাচ্ছে না সে এখন। আলতাফ হোসেন চলে গেলে অনু শুয়ে পড়লো। একটু যেন ঘুম ঘুমও এলো তার চোখে। তবে সেই ঘুম ভাবটা খুব বেশিক্ষণ রইল না। তিনি আবার আসলেন ঘণ্টাখানেক পর। এবার দরজার কড়া নাড়লেন আরো জোরে। অনু অবশ্য চুপ করেই রইল। ভেতর থেকে কোনো সাড়া শব্দ না পেয়ে আলতাফ হোসেন উঁচু গলায়ই অনুকে ডাকলেন। তারপর বললেন, আরে আপনাকে ছাদে যেতে হবে না, দরজাটা খুলুন। আপনার ঘরেই না হয় কিছুক্ষণ বসে গল্পগুজব করে যাই। আর মদ না খান, চা তো এটলিস্ট খেতে পারেন! আমি ঢাকা থেকে কফিও নিয়ে এসেছি। দুই চুমুক খেয়ে দেখেন, মাথাব্যথা দৌড়ে পালাবে।

অনু আলতাফ হোসেনের কথার কোনো জবাব দিলো না। গুটিশুটি মেরে অন্ধকারে চুপচাপ শুয়ে রইল। আলতাফ হোসেন অবশ্য খুব বেশি যন্ত্রণা করলেন না। তিনি সামান্য কিছুক্ষণ অপেক্ষা করে চলে গেলেন।

আলতাফ হোসেন তৃতীয়বার আসলেন রাত একটার দিকে। এবার আর দরজায় ভদ্রতাসূচক মৃদু নক করলেন না, সশব্দে থাবা বসালেন। তারপর কেমন অদ্ভুত গলায় বললেন, আপনি ঘুমান নাই আমি জানি। জেগে জেগে ঘুমানোর ভান, হ্যাঁ?

অনুর কেবল চোখের পাতা লেগে এসেছিল। সে আতঙ্কগ্রস্তের মতো উঠে বসল। আলতাফ হোসেন বললেন, সব বুঝেই তো আসছেন। না বুঝে তো। আসার কথা না। এখন এত ঢং করছেন কেন?

অনু বালিশের তলা হাতড়ে তার হ্যান্ডব্যাগটা শক্ত করে চেপে ধরলো। আলতাফ হোসেন বললেন, এইসব নখড়া আমি বুঝি বুঝলেন? রাজি না হলে তো আসতেন না। এখন এত রংঢং করার সময় আমার নাই। দরজা খোলেন। রাতের বেশি আর বাকি নাই।

আলতাফ হোসেন আরো জোরে শব্দ করলেন দরজায়। সেই শব্দে পুরো বাড়িটিই যেন কেঁপে উঠল। সামান্য দম নিয়ে তিনি বললেন, টাকা কত লাগবে বলেন? টাকা-পয়সা নিয়ে চিন্তা করছেন? এটা কোনো ব্যাপার না। কত লাগবে খালি বলেন?

আলতাফ হোসেনের কথা বলার ভঙ্গিটাই কেমন অচেনা লাগছিল অনুর। এতক্ষণে কারণটা ধরতে পারল সে। সম্ভবত মদ খেয়ে কিছুটা মাতাল হয়েছেন। তিনি। আলতাফ হোসেন বললেন, পার নাইট রেট কত আপনার? কত করে। খাটেন? বলেন আমাকে। তার চেয়ে বেশিই দিবো। জোর করে কিছু করতে ভালো লাগে না আমার। আপসে না হলে মজা কী বলেন?

দরজায় দ্রিম দ্রিম থাবা পড়ছে, অনুর হাত-পা ঠান্ডা হয়ে আসছে। এতদিন ধরে অফিসে অমন সুন্দর সুন্দর কথা বলা সেই মানুষটাই অচেনা অজানা এক নির্জন বাড়িতে একটি মেয়েকে একা পেয়ে এমন ভয়ংকর হয়ে যেতে পারেন! দিনের ঝলমলে আলোয় থাকা সেই মানুষটা এই রাতের অন্ধকারে এমন করে খোলস ছেড়ে বেরিয়ে আসতে পারেন, অনুর এখনো তা বিশ্বাস হচ্ছে না। তার মনে হলো, ঝলমলে আলোয় নয়, বরং ঘুটঘুঁটে অন্ধকারেই কেবল মানুষের। সত্যিকারের চেহারাটা চেনা যায়।

আলতাফ হোসেন বললেন, আপনি কি আমাকে দিয়ে জোর করাতে চাইছেন? আপনার কি ধারণা এই দরজা আমি খুলতে পারব না?

অনু বিছানা থেকে নামলো। তারপর ধীর পায়ে দরজার কাছে গিয়ে দাঁড়ালো। অন্ধকারেই চোখ বন্ধ করে বার কয়েক নিঃশ্বাস নিলো। তারপর ঠান্ডা, স্পষ্ট গলায় ডাকলো, আলতাফ ভাই।

আলতাফ হোসেন দরজায় আরেক দফা আঘাত করতে গিয়েও আচমকা থেমে গেলেন। যেন কান পেতে শোনার চেষ্টা করছেন, অনু কী বলে। তারপর রুদ্ধশ্বাস গলায় বললেন, বলুন অনু, বলুন?

অনু নির্লিপ্ত গলায় বলল, আপনি বলবেন, তাই হবে আলতাফ ভাই।

আলতাফ হোসেন যেন নিজের কানজোড়াকে বিশ্বাস করতে পারছেন না। তিনি কয়েক মুহূর্ত চুপ করে রইলেন। তারপর জড়ানো, উচ্ছ্বসিত গলায় বললেন, আমি জানতাম অনু, আমি জানতাম। আপনাকে দেখেই আমি বুঝেছিলাম, এই বয়সেও বিয়ে শাদি হয়নি…। তাছাড়া এতগুলো মানুষের সংসার চালান। ওই ক’টা বেতনের টাকায় কী হয়?

আলতাফ হোসেন মুহূর্তকাল থেমে কেমন গা ঘিনঘিনে ভঙ্গিতে বললেন, আমার আপনারও তো একটা শখ আহ্লাদ আছে, আপনিও তো একটা মানুষ। তাছাড়া, এইসব তো আর অদরকারি জিনিস না, শরীরের চাহিদা তো কম বেশি সবারই থাকে। তাই না? আপনার বয়সও তো কম হয় নাই। কী বলেন, হ্যাঁ? হা হা হা।

অনুর মাথা ঝিমঝিম করছে, গা গোলাচ্ছে। মনে হচ্ছে যে-কোনো সময় সে বমি করে দিবে। আলতাফ হোসেন তুমিতে নেমে এলেন। বললেন, দরজাটা খোলো অনু। রাতের আর বেশি বাকি নেই। এই সুন্দর রাতটা এভাবে যাবে বলো?

অনু কথা বলল না। চুপচাপ অন্ধকারে দাঁড়িয়েই রইল। যেন শক্তি সঞ্চয় করছে। নিজেকে সঁপে দেয়ার কিংবা বাঁচাবার। আলতাফ হোসেন অধৈর্য হয়ে উঠেছেন। তিনি আলতো করে দরজায় শব্দ করে বললেন, কী হলো অনু? তুমি কোনো চিন্তা করো না। তোমার সব দায়িত্ব আমার। চাকরি নিয়েও চিন্তা করো না। পরের প্রজেক্টেও তোমার চাকরি কনফার্ম। আর টাকা-পয়সা নিয়ে ভেবো না। প্রয়োজনে তোমাকে আমি আমার আরেকটা স্ত্রীর মতো করে রাখবো। কোনো চিন্তা করো না। এখন থেকে তোমার সব চিন্তা আমার। দরজাটা খোলো, খোলো অনু। খোলো।

অনু আচমকা শীতল গলায় বলল, আপনি সারাহ নামের কাউকে চেনেন আলতাফ ভাই?

আলতাফ হোসেন প্রথমে যেন অনুর কথাটা বুঝতে পারলেন না। তিনি বিভ্রান্ত হয়ে গেলেন, কোন সারাহ?

আপনার বড় মেয়ে আলতাফ ভাই, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ে?

আলতাফ হোসেন মুহূর্তেই থমকে গেলেন। তারপর বিচলিত গলায় বললেন, এখানে সারাহ আসলো কোত্থেকে? ওহ, তুমি সারাহর কথা ভেবে ভয় পাচ্ছ? ও তো মাঝে মধ্যে অফিসে আসে, কিছু জেনে টেনে ফেলবে?

না আলতাফ ভাই। তাহলে?

বিকেলে গাড়িতে সারাহ আপনাকে বারবার ফোন দিচ্ছিলো। আপনাদের বাবা-মেয়ের কী সুন্দর একটা ছবি সেট করা কলারে! আপনাদের কথা শুনে বুঝলাম, মেয়েকে অসম্ভব ভালোবাসেন আপনি, তাই না?

আলতাফ হোসেন অনুর কথা কিছুই বুঝতে পারছেন না। তিনি অস্থির গলায় বললেন, হ্যাঁ বাসি। কিন্তু এখানে তুমি সারাহকে নিয়ে আসছ কেন অনু?

কারণ সারাহর ফোন নম্বরটা আমার কাছে আছে আলতাফ ভাই। তখন গাড়ি থেকেই নিয়েছিলাম। আপনি কি চান, সারাহ জানুক, তার বাবা আসবে সেই আপনি না, যাকে সে চেনে। তার বাবা আসলে এই আপনি, যাকে সে চেনে না। কিন্তু আজ চিনবে!

আলতাফ হোসেন প্রথম বিষয়টা বুঝতে পারলেন না। তারপর হড়বড় করে বললেন, তুমি এসব কী বলছ, অনু?

আমি বলছি, আমার মোবাইল ফোনে এই মুহূর্তে সারাহর নামটা ডায়াল লিস্টে আছে। আমি তাকে শোনাতে চাই তার বাবার কণ্ঠ, তার বাবার কথা। তার বাবা কী সুন্দর সুন্দর কথা বলতে জানে! আমি তাকে দেখাতে চাই, তার বাবার আসল চেহারাটা আসলে কী? আমি মরে গেলেও সেটা তাকে জানিয়ে যেতে চাই। কিন্তু আপনি কী চান, সে তা জানুক?

আলতাফ হোসেনের কয়েক মুহূর্ত লাগল বিষয়টা বুঝতে। ঝট করে সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে গেলেন তিনি। যেন নেশাগ্রস্ত মাতাল কোনো মানুষের মুখে প্রবল ঠান্ডা জলের ঝাঁপটা দেয়া হয়েছে। তিনি কেমন দিশেহারা গলায় বললেন, অনু!

অনু বলল, আলতাফ ভাই, আপনাকে এতটা জঘন্য মানুষ ভাবতে আমার কষ্ট হয়। আমি বিশ্বাস করি, আপনি এতটা খারাপ মানুষও না। আপনার কোনো একটা সমস্যা যাচ্ছে। সেই সমস্যাটা আগে আপনার বুঝতে পারা উচিত।

আলতাফ হোসেন কোনো জবাব দিলেন না। চুপ করে দাঁড়িয়ে রইলেন দরজার ওপাশে। অনু বললেন, আমি জানি না, আপনি কী সিদ্ধান্ত নিলেন। আপনার মেয়ে আপনার এই চেহারাটা জেনে ফেলবে, এটি আপনার কাছে তেমন লজ্জাজনক বা গুরুত্বপূর্ণ কিছু মনে নাও হতে পারে। আপনি তারপরও আমার উপর জোর করতে পারেন। এই বাড়িতে দুটো পুরুষ মানুষ, তারা চাইলে আমি দরজা আটকে নিরাপদ থাকতে পারব না। তবে আলতাফ ভাই, আমি আরো একটা উপায় ভেবে রেখেছি। আমার হাতে একটা চাকুও আছে, এটা সবসময়ই থাকে আমার ব্যাগে। আমি একা মেয়ে মানুষ, বাবা নেই, স্বামী নেই, বড় ভাই নেই, টাকা-পয়সা নেই, এই বয়সেও বিয়ে শাদি হয়নি। সবাইই আমাকে আপনার মতোই সহজলভ্য ভাবে। ভাবে, চাইলেই হয়তো সুযোগ নেয়া যাবে। তাই সাথে সাথে রাখি। কিন্তু অন্যকে আঘাত করার সাহস আমার নাই, ভাই। তবে নিজেকে তো অন্তত করতে পারব!

অনু থামলো। তার বুক হাপড়ের মতো কাঁপছে। শরীর বেয়ে ঘাম নামছে। দরজার ওপাশে আলতাফ হোসেন চুপ। এপাশে অনুও। এপাশে অন্ধকার, ওপাশে আলো। এপাশে শিকার, ওপাশে শিকারি। মাঝখানে পলকা এক দরজা। সেই দরজার এপার-ওপার, আলো অন্ধকার, জিগীষা ও জিঘাংষা এক অদ্ভুত হিসেবের, সমীকরণের, অনুভূতির তীব্র বাঅয় অথচ গভীর নৈঃশব্দ্যে ডুবে রইল।

*

নুহার সাথে বেনুর দেখা হয়ে গেল বাসে। বেনু বহুদিন পরে ঢাকায় এসেছে। মাদারীপুর থেকে ঢাকা যে খুব দূরের পথ তা নয়। কিন্তু আসার পথে পদ্মা পার হয়ে আসতে হয়। ঝামেলাটা এখানেই, ফেরিতে বাস ট্রাকের অপেক্ষমান লম্বা সারি থাকে। সেই সারি পেরিয়ে ফেরিতে উঠতে উঠতে ঘণ্টা দুয়েক লেগে যায়। ভাগ্য খারাপ হলে আরো বেশি। তারপর ফেরিতে নদী পার হতেও দীর্ঘসময়। বেনু এসেছে মাওয়া ঘাট হয়ে। গুলিস্তান নেমে মোহাম্মদপুরের বাস। বাসেই নুহার সাথে দেখা। তাদের সিট পড়েছে পাশাপাশি।

নুহা বলল, আপু, আপনাকে কতদিন পর দেখলাম!

বেনু অবশ্য নুহার কথার জবাব দিলো না। কেবল ঠোঁট ফাঁক করে সামান্য হাসির ভাব করলো সে। নুহা একটু অবাকই হলো। বেনুর সাথে তার খুব যে দেখা সাক্ষাৎ বা কথাবার্তা হয়েছে এমন নয়। অয়নের বোন বলেই এমন হঠাৎ দেখা হয়ে যাওয়ায় সে খানিকটা আলাদা করেই আগ্রহ দেখিয়েছিল। কিন্তু বেনুর এমন নির্লিপ্ত আচরণে বেশ দমে গেল নুহা। বেনু কী কোনো কারণে তাকে চিনতে পারেনি? চিনতে না পারলেও তো মানুষ অন্তত কথাবার্তা বলে, চেনার চেষ্টা করে। নুহা চুপচাপ জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে রইল। তবে এই ফাঁকে আড়চোখে সে বেশ কয়েকবার বেনুকে খেয়ালও করেছে। বেনুর পাশে যাত্রীদের যাতায়াতের পথে বিশাল একটা ব্যাগ রাখা। দাঁড়িয়ে থাকা যাত্রীরা এই ব্যাগ নিয়ে ভারি বিরক্ত। বেনু বারবার ব্যাগটাকে টেনে আরো কিছুটা তার দিকে নিয়ে আসার চেষ্টা করছে। নুহার হঠাৎ কী মনে হলো, সে খানিকটা ঘুরে বেনুকে বলল, আমাকে চিনতে পারেননি আপু? আমি নুহা। অয়নের সাথে পড়ি।

বেনুর যেন সময় লাগল নুহার কথা বুঝতে। সে কিছুক্ষণ নুহার দিকে তাকিয়ে রইল। তারপর নুহার হাতটা হাতের মধ্যে নিয়ে বলল, অয়নের সাথে তোমার দেখা হয়?

নুহা অবাক গলায় বলল, হ্যাঁ, হয়।

শেষ কবে দেখা হয়েছে?

এই তো গতকালই।

অয়ন কেমন আছে?

হ্যাঁ, ভালোই তো!

ভালো?

হ্যাঁ।

নুহার কাছে বেনুকে কেমন অস্বাভাবিক লাগতে লাগল। সে বলল, কেন আপু? কোনো সমস্যা?

না, না। কী সমস্যা হবে?

সেটাই তো। ওর সাথে তো আমার রোজই কোচিংয়ে দেখা হয়।

ও রোজ কোচিংয়ে আসে?

হ্যাঁ, রোজই তো আসে।

বেনু কথা বলল না। নুহাই আবার বলল, আপু?

হুঁ।

কিছু একটা হয়েছে, আমাকে বলবেন প্লিজ?

নাহ্। কিছু হয়নি।

নুহা প্রসঙ্গ পাল্টালো, আপনি এই এত বড় ব্যাগ নিয়ে একা একা ওই অতদূর থেকে চলে এসেছেন আপু?

বেনু একবার নুহার দিকে তাকালো। আরেকবার ব্যাগটার দিকে। তারপর ব্যাগটা টেনে আরো কিছুটা নিজের দিকে আনার চেষ্টা করলো। কিন্তু নুহার কথার জবাব দিলো না। নিঃশব্দে তাকিয়ে রইল সামনে। নুহাও আর কিছু জিজ্ঞেস করলো না। রাস্তায় প্রচণ্ড জ্যাম। বাকিটা সময় চেনা দুজন মানুষ অচেনার মতো পাশাপশি বসে রইল।

বাস থেকে নেমে রিকশা নিলো বেনু। নুহাও রিকশা খুঁজছে। কিন্তু পাচ্ছে না। ঝিরিঝিরি বৃষ্টি শুরু হয়েছে। চলে যাবার ঠিক আগ মুহূর্তে হঠাৎ নুহাকে ডাকলো বেনু। তারপর নুহার কাঁধে হাত রেখে বলল, আমার আচরণে তুমি মন খারাপ করো না। পরে কোনো একদিন তোমার সাথে অনেক কথা হবে। আজ একটু শরীরটা ভালো নেই আমার।

নুহা বলল, মন খারাপ করিনি আপু।

বেনু বলল, অবশ্যই করেছ। তোমার জায়গায় থাকলে আমিও করতাম।

নুহা কথা বলল না। বেনু বলল, যাই নুহা?

নুহা ঘাড় কাত করে সায় দিলো। কিন্তু বাকিটা সময় বেনুকে মাথা থেকে তাড়াতে পারল না সে। সন্ধ্যাবেলা অয়ন কোচিংয়ে এলো না। নুহা ভারি অবাক হলো। সে ভেবেছিল, কোচিং শেষে অয়নকে আজকের ঘটনাটা বলবে। রাতে অয়নকে ফোন করলো নুহা। কিন্তু অয়ন ফোন ধরলো না। কেমন একটা অস্বস্তি নিয়েই ঘুমাতে গেল সে। অয়ন ফোন করলো পরদিন ভোরে। তার গলা ভারি। থেমে থেমে কাশছেও।

অয়ন বলল, হঠাৎই পাগলের মতো জ্বর, একশ চার উঠে গেল।

তা আমাকে জানাবি না?

তোকে জানালে কী হতো?

এটা কী ধরনের কথা অয়ন?

অয়ন চুপ করে রইল। নুহা বলল, গতকাল বেনু আপার সাথে দেখা হয়েছিল।

কোথায়?

বাসে। আচ্ছা, বেনু আপার কি কিছু হয়েছে? কেমন যেন অন্যরকম লাগছিল। কোনো সমস্যা?

কই? না তো!

নাহ্, মানে আমার কেন যেন মনে হলো। তোর কথা খুব জিজ্ঞেস করছিল। আর অতবড় একটা ব্যাগ নিয়ে অতদূর থেকে একা চলে এসেছেন। কেমন লাগল আমার। দেখে মনে হলো, কান্নাকাটিও করেছেন!

আরে ধুর। ও তো অমনই, পাগল।

তুই আজকাল আমার কাছে কিছু লুকাচ্ছিস, তাই না অয়ন?

তোর কাছে? আমি? ধুর! তোর কাছে আমি কেন কিছু লুকাবো?

লুকাচ্ছিস।

শোন, মানুষ বন্ধুর কাছে কিছু লুকায় না, লুকায় প্রেমিকার কাছে। বন্ধুর কাছে লুকানোর মতো কিছু থাকে না। তুই তো আমার বন্ধুই, প্রেমিকা তো না।

অয়ন হাসলো, কিন্তু নুহা হাসলো না। সে ফোন কানে চেপে ধরে বসে রইল। অয়ন বলল, আজও কোচিংয়ে যেতে পারব বলে মনে হচ্ছে না রে! ভালো ঠেকলে কাল হয়তো দেখা হবে।

নুহা বলল, আচ্ছা।

.

অনু যাওয়ার আজ চতুর্থ দিন। সে আসতে আরো দু’দিন বাকি। বেনু এসেছে গতকাল। তাকে এখুনি কিছু জানাতে নিষেধ করেছিল অনু। অফিসের ট্যুর থেকে ফিরে নিজেই বেনুকে ফোন করবে ভেবেছিল সে। কিন্তু সালমা বেগম অতটা অপেক্ষা করতে পারছিলেন না। খবর পাওয়ার ঘণ্টাখানেকের মধ্যে ঢাকার বাস ধরেছে বেনু। বেনুর হাজবেন্ড আরিফুল থাকে গ্রিসে। ঢাকার ছোট ব্যবসায় লাভ তেমন হচ্ছিল না বলে মনের মধ্যে সবসময়ই একটা অশান্তি ছিল তার। এমনিতেও আরিফুল উচ্চাভিলাষী ছেলে। বেশি উপার্জনের আশায় নানান বিকল্প খুঁজতো। কিন্তু তাতে লাভ বিশেষ হয়নি।

আরিফুলের কয়েকজন বন্ধু থাকে গ্রিসে। তাদের আয়-উপার্জনও মোটামুটি ভালো। এদিকে দেশে রাজনৈতিক অস্থিরতার কারণে আরিফুলের ব্যবসায়ও তখন বেশ মন্দা। সবকিছু মিলিয়ে আরিফুল হঠাৎ গ্রিসে চলে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলল। মাদারীপুরের বাড়িতে তার বাবা-মা, ভাই-বোনের বিশাল পরিবার। যাওয়ার আগে বেনুকে সে রেখে গেল সেখানে। কিন্তু গ্রিস গিয়ে আরিফুল পড়েছে ভয়াবহ বিপদে। তাকে যে ভিসা দেয়া হয়েছে, তাতে ওয়ার্ক পারমিট নেই। ফলে সেখানে কোনো কাজ করতে পারল না সে। গ্রিসের অর্থনৈতিক অবস্থাও তখন খুব একটা ভালো না। এই অবস্থায় ওই বিদেশ বিভূঁইয়ে উপার্জনহীন একজন মানুষকে বন্ধুবান্ধবও বেশিদিন ঘাড়ে তুলে রাখতে চায় না। কিন্তু আরিফুলের উপায় নেই। সে এখন দাঁতে দাঁত চেপে, বন্ধু বান্ধবের অবহেলা-উপেক্ষা সহ্য করে হলেও টিকে থাকার প্রাণপণ চেষ্টা করছে, যদি কোনো উপায়ে একটা কাজের ব্যবস্থা করা যায়। কিংবা ওয়ার্ক পারমিট বের করা যায়।

বেনু ঘরে ঢুকেই সোজা সালমা বেগমের ঘরে চলে এলো। সালমা বেগম তখন জোহরের নামাজ পড়ছিলেন। বেনু তার হাতের ভারি ব্যাগটা রেখে সালমা বেগমের পাশে দাঁড়িয়ে রইল। সালমা বেগম নামাজের সালাম ফেরাতেই বেনু জলের মতো লুটিয়ে পড়লো তার কোলে। সালমা বেগম দু’হাতে মেয়েকে বুকের সাথে চেপে ধরে চুপচাপ বসে রইলেন।

বেনু ফিসফিস করে ডাকলো, মা।

সালমা বেগম জবাব দিলেন না। যেন প্রাচীন কোনো পাথরের ক্ষতবিক্ষত মূর্তির মতো তিনি স্তব্ধ, শীতল, স্থির। বেনু আবার ডাকলো, মা, ও মা?

সালমা বেগম কেবল আরো খানিকটা শক্ত করে বেনুকে বুকের সাথে চেপে ধরলেন। কথা বললেন না। তবে তার চোখের কোল গড়িয়ে কী আশ্চর্য এক শান্ত, গভীর অথচ উষ্ণ জলের ধারা নেমে এলো!

বেনু চাপা গলায় বলল, আমার বিশ্বাস হয় না মা।

সালমা বেগম নির্বাক বসেই রইলেন। বেনু বলল, আমি আল্লাহর কাছে ভিক্ষা চাইব মা। আমি পাঁচ খতম কোরআন মানত করব। আরিফুল বিদেশ যাওয়ার আগে আমাকে কিছু টাকা দিয়ে গেছিল, আমি সেই টাকা এতদিনেও খরচ করি নাই, যদি বড় কোনো বিপদ আপদে পড়ি! সেই টাকা আমি নিয়ে আসছি মা। একটা গরু কিনবো, আল্লাহর নামে অয়নের জানের বদলে জানের ছদকা দিবো মা। আল্লাহ চাইলে সব সম্ভব, সব। কিচ্ছু হবে না মা। তুমি দেইখো, কিচ্ছু হবে না। আল্লাহর কাছে দিনরাত ভিক্ষা চাইব মা।

অয়নের সাথে বেনুর দেখা হলো সন্ধ্যাবেলা। অয়নের আজকাল খুব ঘুম হচ্ছে। বিছানায় শুলেই ঘুমে চোখ জড়িয়ে আসে। সে ঘুম ভেঙে দেখলো বেনু তার পাশে বসে আছে। চোখ মেলে তাকিয়ে আবছা অন্ধকারে বেনুকে চিনতে তার একটু সময় লাগল। সে মৃদু হাসলো। তারপর বলল, কখন এলি?

সেই কখন! তোর ঘুম তো আর ভাঙে না।

হ্যাঁ। আজকাল কী যে হয়েছে, খালি ঘুম পায়। পরীক্ষা সামনে, আর দেখ জ্বর-ঠান্ডা লেগেই আছে। একটুও পড়তে পারি না জানিস?

আগে জ্বর ভালো হোক। শরীর ভালো হলে অনেক পড়তে পারবি।

কিন্তু তখন তো আর সময় থাকবে না।

সময় থাকবে না কেন?

পরীক্ষা চলে আসবে যে!

চলে আসলে আসুক। এত ভাবতে হবে না। পরীক্ষা আসবে, যাবে, আবার আসবে। এতে এত টেনশনের কিছু নাই।

সেই রাতে অয়নের আবার জ্বর এলো। বমিও হলো বার কয়েক। এই ঘটনায় সবচেয়ে বেশি অস্থির হয়ে গেল বেনু। অয়নকে নিয়ে কী করবে ভেবে। পেল না সে। মাথায় পানি দিলো। সারা শরীর মুছিয়ে দিলো। রাত জেগে নামাজ পড়লো। নামাজ শেষে সারারাত জায়নামাজে করুণ সুরে কোরআন পাঠ করলো সে। সালমা বেগম দিশেহারা অবস্থায় ফোন করলেন অনুকে। অনু বলল ভোরে ডাক্তারের কাছে নিয়ে যেতে। ডাক্তার অবশ্য জ্বর দেখে বিশেষ কিছু বললেন না। সাধারণ প্যারাসিটামলই খেতে দিলেন। অয়নের জ্বর নেমে গেল পরদিন রাতেই।

সেই রাতে বহুদিন বাদে আবার শামীম এলো। শামীমের একহাতে বাজারভর্তি ব্যাগ, আরেক হাতে খাসির আস্ত মাথা। তনুর কপাল ফাটিয়ে দিয়ে সেই যে লাপাত্তা হয়ে গিয়েছিল শামীম, তারপর আর এ বাড়িতে আসেনি। অবাক ব্যাপার হচ্ছে, আজ এতদিন পর বাড়িতে ঢুকে তার ভাবখানা এমন যে এ বাড়িতে কখনো কিছু হয়নি। এমনকি তনুর সেই ঘটনার কথাও যেন সে জানে না। স্বভাবসুলভ বিগলিত ভঙ্গিতে সাথে আনা খাসির মাথা আর মুগডাল নিয়ে রান্না ঘরে ঢুকে গেল সে। শামীমের রান্নার হাত ভালো। অত রাতে সে। নিজ হাতে মুগডাল দিয়ে খাসির মাথা রান্না করলো। তারপর অয়নকে ঘুম থেকে। ডেকে উঠিয়ে খেতে বসালো। অয়ন খেলোও। বহুকাল পর যেন তৃপ্তি করে খেলো সে। খাবার টেবিলে তনু, বেনু আর মায়ের সাথে নানান গল্পও হলো। তার পরের দিনটাও ভালো কাটলো অয়নের। কিন্তু তাকে ঘর থেকে বের হতে দিলো না বেনু।

অনু এলো সন্ধ্যার পরপর। তার চোখে মুখে স্পষ্ট ক্লান্তি। লম্বা গোসল সেরে সামান্য কিছু খেলো সে। টানা কয়েকদিন গ্রামের মাঠে-ঘাটে ছোটাছুটি আর জল কাদায় পায়ের কেডসের মতো জুতোজুড়া নোংরা হয়ে আছে। অনেক করে ধোয়ার পরও বিশ্রি গন্ধটা যেন যাচ্ছিলই না। একটু খোলা হাওয়া মেলে দিলে সকাল নাগাদ হয়তো শুকিয়ে ফুরফুরে হয়ে যাবে। জুতোজোড়া এনে বারান্দার রেলিংয়ের সাথে ঝুলিয়ে রাখলো অনু। আর ঠিক সেই মুহূর্তেই বহুদিন পর আবার সেই গা ঘিনঘিনে আতঙ্কটা ফিরে এলো তার। অবচেতনেই যেন ঘাড় ঘুরিয়ে তাকালো অনু। পাশের বাসার দোতলার জানালাটা হাট করে খোলা। ফিনফিনে পাতলা পর্দা মৃদু হাওয়ায় দুলছে। ভেতরে সম্ভবত একটা টেবিল ল্যাম্পের আলো জ্বলছে। সেই আলোয় পর্দার গায়ে একটা দীর্ঘ ছায়ামূর্তি স্পষ্ট। ছায়ামূর্তিটা দেখতে যে কী ভীষণ ভয়ংকর! অনুর বুকটা মুহূর্তেই যেন ধক করে কেঁপে উঠল। সে তড়িঘড়ি ছুটে এসে অয়নের পাশে বসলো। বার দুই জোরে বুক ভরে নিঃশ্বাস নিলো। অয়ন বলল, তুই এত তাড়াতাড়ি চলে এলি?

অনু নিজেকে সামলে নিয়ে বলল, খুব তাড়াতাড়ি হয়ে গেছে?

আমার তো মনে হলো এই গতকালই গেলি।

ভালো সময় তাড়াতাড়ি যায়।

ভালো সময় কেন?

আমি না থাকলে তোর সময় ভালো যায়। এইজন্য মনে হচ্ছে গতকাল মাত্র গেলাম।

অয়ন হাসলো, তোর মতো করে তো কেউ বকাঝকা করে না। অবশ্য বেনুটা এসেই ঝামেলাটা পাকালো।

কী ঝামেলা?

সারাক্ষণ পাশে এসে বসে থাকে। আর এটা সেটা বলে।

আর জ্বর?

জ্বর কী?

জ্বর এসে কোনো ঝামেলা পাকায়নি?

তা একটু পাকিয়েছে। কিন্তু যতটা না জ্বর ছিল তার চেয়ে বেশি মা আর বেনুটা ঝামেলা করলো।

কী ঝামেলা?

এই যে বাইরে বের হতে দেয় না। সারাক্ষণ ঘরের ভেতর আটকে রাখে। আগে জ্বর হলেও আমি কলেজে যেতাম। কত জ্বর লুকিয়ে খেলতে গেছি। বাইরে না বের হতে পারলে ভাল্লাগে বল?

বাইরে এত কী?

বাইরে এত কী জানি না। কিন্তু ঘরে আমার ভাল্লাগে না। সারাক্ষণ কেমন। একটা দমবন্ধ লাগে।

ঘরে দমবন্ধ লাগে?

হ্যাঁ লাগে। এই যে ঘরে আমি সারাক্ষণ ড্রইংরুমে থাকি। ধর শুয়ে আছি, এই সময়ে কেউ এলো, কলিংবেলের শব্দ শুনে সাথে সাথেই উঠে আমাকে বিছানা গুছিয়ে ভেতরের কারো ঘরে চলে যেতে হবে। তারপর ধর বাড়িওয়ালা আসলো। তার সাথে বাড়িভাড়া, এই বিল, সেই বিল, এই সমস্যা, সেই সমস্যা নিয়ে আমাকেই কথা বলতে হবে। কত মিথ্যা কথাও যে বলতে হয়! আরো কত লোক যে আসে! তারপর বিছানা এলোমেলো করে রাখা যাবে না, টেবিল এলোমেলো রাখা যাবে না। কেউ এসে দেখলে কী বলবে, এমন করে থাকা যায় বল? নিজের একার একটা ঘর হলে না হয় ঘরে থাকতে ভালো লাগে। ড্রইংরুমে থাকতে কার ভাল্লাগবে? এই জন্যই আমার ঘরে থাকতে ইচ্ছে করে না, বাইরেই ভালো।

অয়নের কথা শুনে অনু কেন যেন কিছু বলতে পারল না। তার হঠাৎ মনে হলো, নিজের একটা ঘরের স্বপ্ন বোধহয় পৃথিবীর সব মানুষেরই থাকে। মানুষ চেতনে অবচেতনে সেই স্বপ্ন বুকের মধ্যে আলগোছে পুষে বেড়ায়। জীবন জুড়েই যে অজস্র স্বপ্ন সে দেখে, যে অসংখ্য স্বপ্নের পেছনে সে ক্লান্তিহীন ছুটে বেড়ায়, সেই সকল স্বপ্নের গভীরেও সবচেয়ে তীব্রভাবে যে স্বপ্নটি রয়ে যায়, সেই স্বপ্নটি হচ্ছে নিজের একটি ঘরের স্বপ্ন।

অনুরও কী নিজের একার একটা ঘরের স্বপ্ন নেই? একদম নিজের একটা ঘর। অনু দীর্ঘশ্বাস ফেলতে গিয়েও সামলে নিলো। এই স্বপ্নটা নিয়ে সে ভাবতে চায় না। হয়তো জগতের সকল মেয়েরই এই স্বপ্নটা থাকে, কিংবা সকল মানুষেরই। তবে সেই স্বপ্নে ওই নিজের ঘরের ভেতর নিজের একটা মানুষের স্বপ্নও থাকে। ঘরটার মতো সেই মানুষটাও হবে কেবল তার একার, নিজের। অনুর ঠোঁটে কেমন অদ্ভুত মৃদু এক টুকরো হাসি ফুটে উঠল, মানুষ কী অদ্ভুত প্রাণী! সে তার নিজেকে একা কখনো পরিপূর্ণ ভাবতে পারে না। তার পরিপূর্ণ হয়ে উঠতে গেলে লাগে আরো একজন মানুষ। একজন নিজের মানুষ।

অনু থম মেরে বসে রইল। কতকাল এসব নিয়ে ভাবে না সে। আজ অয়নের ওই নিজের একটা ঘরের কথা শুনে তার ভাবনাগুলো মুহূর্তেই কেমন এলোমেলো হয়ে গেল। অয়নের এই বয়সটা বুকের ভেতর অজস্র স্বপ্ন পুষে রাখার বয়স। এই বয়সের স্বপ্নগুলো হয় ঝলমলে আলোর মতো উজ্জ্বল, বাধাহীন, রঙিন। হয়তো এমন অজস্র স্বপ্ন অনুর নিজেরও ছিল। কিংবা কে জানে, হয়তো ছিলই না কখনো!

অনু বলল, কাল বাইরে যাস।

তুই বলছিস?

অনু মৃদু হাসলো, হ্যাঁ।

অয়ন আচমকা বলল, একটা কথা জিজ্ঞেস করি আপু?

অনু জিজ্ঞাসু চোখে ঘাড় কাত করে সায় দিলো। অয়ন বলল, আমাকে হঠাৎ এত দামি একটা ফোন কেন কিনে দিলি?

অনু মুহূর্তখানেক চুপ করে থেকে বলল, একটা দৃশ্য দেখার জন্য।

অয়ন অবাক গলায় বলল, কী দৃশ্য?

যেই মুহূর্তে তুই ফোনটা পেলি, ওই মুহূর্তে ফোনটা হাতে পেয়ে তোর কী রিঅ্যাকশন হয়, সেই দৃশ্য।

ধ্যাৎ! এটা কিছু হলো? সত্যি করে বল।

সত্যি করেই বললাম।

অনু আলতো হাতে অয়নের মাথার চুলগুলো এলোমেলো করে দিয়ে উঠে দাঁড়ালো। অয়ন সামান্য মাথা উঁচু করে অনুর দিকে তাকালো। অনু অস্ফুট স্বরে বলল, কাল না সারাদিন বাইরে বাইরে ঘুরবি? এখন তাহলে কিছু একটা খেয়ে ঘুমিয়ে পড়।

অয়ন কিছু বলল না। অনুর দিকে তাকিয়ে রইল কেবল। অনুর ওই প্রায় নির্বিকার চোখ, মুখ, ঠোঁটের ভেতর সে যেন হঠাৎ দেখতে পেল অসংখ্য অচেনা অজানা অগোছালো অক্ষর। কিন্তু অনেক চেষ্টা করেও সেই অক্ষরগুলো সাজিয়ে গুছিয়ে পরিপূর্ণ কোনো গল্প বানাতে পারল না অয়ন।

*

নুহার সাথে অয়নের দেখা হলো চারদিন পর। অয়নের অবশ্য মনে হচ্ছে, চারদিন নয়, তাদের দেখা হয়েছে কম করে হলেও চার মাস পর। কোচিং শেষে রাস্তা লাগোয়া ফুচকার দোকানের সামনে দাঁড়িয়ে কথা বলছিল তারা। অয়ন বলল, তোকে কেমন অন্যরকম লাগছে নুহা।

নুহা হাসলো। তার এই হাসিটা শিউলি ফুলের মতো। মুহূর্তেই যেন চারপাশে ঝলমলে এক শুভ্রতা ছড়িয়ে দেয়। সে বলল, অন্যরকম কেমন?

তা তো জানি না।

না জানলে বুঝলি কি করে যে অন্যরকম?

অনেক কিছু না জেনেও বোঝা যায়, যায় না?

হুম যায়।

কী কী যায়?

এই যে তুই অসুস্থ, সেটা না জানলেও তোকে দেখলেই বোঝা যায়।

যায়?

হুম, যায়। কী হাল হয়েছে শরীরের দেখেছিস?

অয়ন হাসলো, জবাব দিলো না। নুহা বলল, তুই এবার ভালো একটা ডাক্তার দেখা অয়ন।

ডাক্তার দেখিয়ে কী হবে?

কী হবে মানে? অ্যাটলিস্ট তোর এই যখন তখন জ্বরটা কেন হচ্ছে তা তো বুঝতে পারবি! তুই জানিস, মামা বলে, সব বাজে রোগের বেসিক সিম্পটম হচ্ছে ঘন ঘন জ্বর।

তোর কি মনে হয়, আমার বাজে কিছু হয়েছে?

নুহা হাতের খাতা দিয়ে অয়নের মাথায় আলতো মারলো। তারপর বলল, তুই দিন দিন খুব স্যাডিস্ট হয়ে যাচ্ছিস।

অয়ন কিছু বলতে যাচ্ছিল, এই মুহূর্তে তার পাশে একটা বাইক এসে থামলো। বাইকের পেছনে শামীম বসা। অয়ন বলল, আপনি এখানে ভাইয়া?

শামীম মৃদু হেসে বাইক থেকে নামলো। অয়ন বলল, ফুচকা খাবেন?

শামীম মুহূর্তের জন্য নুহার দিকে তাকালো। তারপর এমনভাবে চোখ। ফিরিয়ে নিলো, যেন এই সময়ে এখানে আসা তার ঠিক হয়নি। সে বিব্রত

ভঙ্গিতে বলল, না না। তোমরা খাও।

অয়ন বলল, কোথাও যাচ্ছিলেন?

শামীম বলল, হুম, তোমাকে দেখে থামলাম।

কোনো দরকার ভাইয়া?

না না, তেমন কিছু না। তোমরা আগে খাওয়া শেষ করো। আমি দাঁড়াই।

অয়ন কিছু বুঝলো না। সে নুহার দিকে তাকালো। নুহার চোখে মুখে স্পষ্ট অস্বস্তি। শামীম বলল, তোমার কোচিং তো শেষ, না?

অয়ন আর কিছু খেলো না। সে হাত ধুতে ধুতে বলল, হ্যাঁ।

এখন তো আর কোনো কাজ নেই?

না।

তাহলে আমার সাথে একটু যেতে পারবে?

কোথায়?

এই তো, কাছেই। বেশিক্ষণ না, এই ধরো ঘণ্টাখানেকের মধ্যে চলে আসতে পারবে।

অয়ন নুহার দিকে তাকাতেই নুহা মাথা নেড়ে সায় দিলো। অয়নের অবশ্য একটুও যেতে ইচ্ছে করছে না। কিন্তু না গিয়েও উপায় নেই। সে নুহাকে একটা রিকশা ঠিক করে দিয়ে শামীমের সাথে গেল।

শামীম বলল, চেষ্টা তো কম করলাম না। কিন্তু চাকরি-বাকরির তো কিছু হলো না অয়ন। এখন এভাবে আর কতদিন বসে থাকব বলো? তাই বন্ধু বান্ধবরা কয়েকজন মিলে ঠিক করেছি একটা বিজনেস শুরু করব।

অয়ন বলল, কিসের বিজনেস ভাইয়া?

এই ধরো বইয়ের।

বইয়ের? অয়ন খুব অবাক হলো।

হু, ধরো কোনো স্কুল বা কলেজের পাশে বইয়ের দোকান দিলাম। সাথে খাতা, কলম, ফটোকপি এইসবও থাকল।

কিন্তু স্কুল-কলেজের পাশে তো এমনিতেই অনেক বইয়ের দোকান থাকে ভাইয়া! তাছাড়া এইসব জায়গায় দোকান ভাড়া পাওয়াও তো খুব কঠিন। আর। টাকাও লাগে অনেক।

এটাই সমস্যা অয়ন। আমার ক্যাশ ক্যাপিটাল নাই। ক্যাশ ক্যাপিটাল থাকলে ব্যবসা কোনো ব্যাপারই না। আমাদের ব্যবসার আইডিয়াটা কিন্তু খারাপ না। বরং বেশ ভালো আইডিয়া। এই ধরো ক্লাসের বই যেমন থাকবে, সাথে গল্প উপন্যাসের বইও থাকবে। বাচ্চাদের কার্টুন, কমিকসের বই থাকবে। তারপর ধরো বাচ্চাকাচ্চাদের স্কুলে নিতে মায়েরা আসে। তাদের জন্য রান্নার বই থাকবে। রূপচর্চার বই থাকবে। মহিলাদের ম্যাগাজিন থাকবে।

কিন্তু ভাইয়া, অনেক টাকার ব্যাপার তো! আপনিই তো বললেন, আপনার কাছে টাকা নেই?

সেইজন্যই তো বন্ধু-বান্ধব মিলে দিচ্ছি। ধরো আত্মীয়-স্বজন কেউ হেল্প করতে পারলে ভালো হতো। আমার এক বন্ধুর শ্বশুর তাকে দুই লাখ টাকা দিচ্ছে। সে সেই টাকা এই ব্যবসায় লাগাবে। কিন্তু আমার তো সেই কপালও নেই। আমার আছে শ্রম আর সময়। আমি সেটাই দিবো, অন্যরা পয়সা।

শামীম দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলে কিছুক্ষণ চুপ করে রইল। তারপর আবার বলল, অবশ্য এই ব্যবসার একটা সুবিধাও আছে। বই বাকিতে এনেও ব্যবসা করা যায়। বিক্রি হলে টাকা দিবো, বিক্রি না হলে বই ফেরত। এমন সুবিধা আর কোনো ব্যবসাতে নেই, বুঝলে?

অয়ন মাথা নাড়লো।

.

অয়ন বাসায় ফিরল রাত নটায়। শামীম তাকে এক কার্টুন মোটা মোটা বই ধরিয়ে দিয়েছে। সেই বই দোতলায় ওঠাতে তার নাভিশ্বাস অবস্থা। অনু ছুটে এসে অয়নকে ধরলো। তারপর বলল, এগুলো কী অয়ন?

শামীম ভাইয়ের বই।

শামীমের বই? অনু ভারি অবাক হলো, শামীমের বই মানে? শামীম কই?

ভাইয়া আজ আসবে না, তার বন্ধুর বাসায় থাকবে। তারা বন্ধুরা মিলে না কি বইয়ের বিজনেস করবে।

অনু সরু চোখে অয়নের দিকে তাকালো। অয়ন ঘটনা খুলে বলল। কিন্তু অনু তাতে আশ্বস্ত হতে পারল না। সে তনুর ঘরে গেল। তনু তখন হাফসাকে খাওয়াচ্ছিল। অনু বলল, শামীম তোকে কিছু বলেছে?

কোন বিষয়ে?

বিজনেসের বিষয়ে?

টাকা চাইছিল। তুই তো জানিসই আপু। তোর কাছ থেকে টাকা নিয়ে দিতে বলছিল

হুম। কিন্তু সে না-কি অয়নকে বলেছে যে সে বইয়ের বিজনেস করবে? অয়নকে দিয়ে এক কার্টুন বইও আনিয়েছে আজ।

তনু আধশোয়া হয়ে হাফসাকে খাওয়াচ্ছিল। অনুর কথা শুনে সে উঠে। বসলো। কি বলছিস আপু? বইয়ের বিজনেস? পাগল নাকি?

সেটাই তো! এই সময়ে কেউ বইয়ের বিজনেস করে? মানুষ বই পড়ে আজকাল?

আমি জানি না আপু। ও তো আমাকে কখনোই কিছু বলে না।

অনু আর কথা বাড়ালো না। সে ঘরে ফিরে চুপচাপ বসে রইল। তার কেন যেন মনে হচ্ছে আরো বড়সড় কোনো একটা ঝামেলা হতে যাচ্ছে। কিন্তু সেই ঝামেলাটা কী তা সে ধরতে পারছে না।

.

রাতে কখন ঘুমিয়ে গেল অয়ন নিজেই টের পেল না। তার ঘুম ভাঙলো ভোরে। সালমা বেগম বসেছিলেন অয়নের বিছানার পাশে। অয়ন মায়ের দিকে তাকিয়ে হাসলো, তুমি এখানে কী করো?

কিছু না।

তাহলে এত সকালে এখানে বসে আছ যে!

এমনি, তুই ঘুমের মধ্যে কী সব বলছিলি।

কী বলছিলাম?

সব বোঝা যায় না, কিছু কিছু বোঝা যায়। পরীক্ষা নিয়ে কী সব বলছিলি, নুহার কথা বলছিলি।

অয়ন ভারি লজ্জা পেল, ঘুমের মধ্যে নুহার কথা কী বলছিল কে জানে! সে উঠতে উঠতে বলল, আমার ফোনটা একটু চার্জে দিয়ে দাও না। রাতে বন্ধ হয়ে গিয়েছিল।

সালমা বেগম ফোন চার্জ দিয়ে দিলেন। অয়ন বাথরুম থেকে এসে ফোন খুলতেই দেখে নুহার মেসেজ, তুই ফিরেছিস?

মোবাইল ফোনের স্ক্রিনে দুই শব্দের ছোট্ট একটা মেসেজ। কিন্তু অয়নের কেন যেন মনে হলো সকালটা হঠাৎ সুন্দর হয়ে গেছে। সে ইচ্ছে করেই এক শব্দের মেসেজ পাঠালো, হু।

অয়ন ভেবেছিল নুহা ফোন করবে। কিন্তু নুহা আর ফোন করলো না। দুপুর অব্দি অপেক্ষা করে শেষে অয়নই ফোন দিলো। নুহা ফোন ধরেই বলল, মা’র সাথে নানু বাড়ি যাচ্ছি, তোকে পরে ফোন দিচ্ছি।

অয়ন কী ভাবলো, আর কী হলো! অয়ন যতটা নুহাকে নিয়ে ভেবেছিল, নুহা তার কিছুই ভাবেনি। সে ব্যস্ত ছিল তার নানু বাড়ি যাওয়া নিয়ে। অয়নের মনটা আবার থম মেরে রইল। দুপুর গড়িয়ে বিকেল হলো, বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যা। নুহা ফোন করলো রাতে। অয়ন তখন চুপচাপ বসেছিল বিছানায়। তার পাশে মা আর অনু। অয়নের খুব ইচ্ছে করছিল ফোনটা ধরতে। কিন্তু অনুর সামনে নুহার সাথে কথা বলার বিপদ সে জানে। মা আর অনু কী কী সব কথা বলল সেসব অয়নের কানেই ঢুকলো না। সে অপেক্ষা করছিল তাদের চলে যাওয়ার। তারা গেল অনেক রাতে। তবে অয়ন জানে, তাকে না জানিয়ে চুপিচুপি রাতে আবার মা এসে তার পাশে বসে থাকবে। সে মাঝেমধ্যে টের পায়। কিন্তু ধরা দেয় না। আজও মা আসবে কি-না কে জানে! যদি আসে, তাহলে অত রাতে কারো সাথে ফোনে কথা বলতে দেখলে নির্ঘাত বকবে!

অয়ন তখনই ফোন দিলো। নুহা বলল, তুই কাল কখন ফিরলি রে? খুব টেনশন হচ্ছিল।

এইটুকু কথা, অথচ অয়নের আবারো কী যে ভালো লাগল! সে বলল, টেনশনের কী আছে!

ওভাবে গেলি, তারপর থেকে ফোন বন্ধ। তাছাড়া লোকটাকে আমার ভালো লাগেনি।

ও তো শামীম ভাই। তনু আপুর হাজবেন্ড।

ও, আচ্ছা। কিন্তু কেমন করে যেন তাকালো!

ধুর বোকা।

বোকাই ভালো। শোন নানু হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়লো। আমার ফিরতে কিছু দেরি হবে। তারপর বড় খাঁলারা সবাই এসেছেন আমেরিকা থেকে। কটা দিন থাকতেই হবে।

অয়নের মন আরো খারাপ হয়ে গেল। সে বলল, ক’দিন লাগবে?

এই ধর সপ্তাহখানেক?

পরীক্ষা সামনে রেখে এতদিন?

কী করব বল? নানু বেঁচে থাকতে সবার এমন গেট টুগেদার আর কবে হবে কে জানে! তুই কিন্তু কোচিং থেকে নোটসগুলো নিয়ে রাখিস।

আমি তো যেতে পারি না রোজ। মা, অনু আপু যেতে দেয় না। এখন আবার বেনু এসে জুটেছে।

তাও ঠিক, শরীরের দিকে একটু খেয়াল রাখিস, একদম কেমন হয়ে যাচ্ছে।

অয়ন কথা বলল না। চুপ করে রইল। নুহা বলল, অনেক রাত হয়ে গেছে, এখন ঘুমিয়ে পড়।

অয়নের ফোন রাখতে ইচ্ছে করছিল না। আবার কিছু বলতেও ইচ্ছে হচ্ছিল না। তার মনে হচ্ছিল নুহা আরো কিছুক্ষণ তার সাথে থাকুক। ফোনের ওপাশে কেবল ফোন কানে চেপে ধরে বসে থাকুক, এর বেশি কিছু নয়। কোনো কথা নয়, শব্দ নয় কেবল ওই থাকাটুকুই। এই থাকাটুকুই কেমন একটা অদ্ভুত ওম ছড়ায় বুকের ভেতর। সে মৃদু গলায় বলল, তুই ঘুমিয়ে পড়বি এখন?

না না, ঘুমাবো কেন? বাসাভর্তি লোকজন। বললাম না, সব কাজিনরা এসেছে। আমার বড় খাঁলার ছেলে, আদিল ভাইয়া, হি ইজ জাস্ট আ জিনিয়াস। আর এত হাসাতে পারে, এত এত। তোর পেটে খিল ধরে যাবে। আমরা এখন বড় খাঁলা আর মামার সাথে বাজিতে লুডু খেলবো। আদিল ভাইয়া আর আমি এক দলে। আমার অবশ্য হারলেও ভয় নেই, আদিল ভাইয়া তো আছেই।

নুহা হাসছে। অয়নের মনে হচ্ছে কোথায় যেন ভাঙা তীক্ষ্ণ কাঁচের মতো বিধে যাচ্ছে একটা সূক্ষ্ম যন্ত্রণা। সে বলল, রাখি তাহলে?

নুহা যেন রাখার অপেক্ষায়ই ছিল। সে সাথে সাথেই বলল, আচ্ছা, রাখছি তাহলে অয়ন।

সেই সারাটা রাত অয়নের আর ঘুম হলো না। একটা বিশ্রি অস্থিরতা ভেসে বেড়ালো শরীর জুড়ে। এই প্রথম অয়ন পুরোপুরি নিশ্চিত হলো, নুহাকে সে ভালোবাসে। খুব কাছের বন্ধু হিসেবে না, অন্য কোনোভাবে ভালোবাসে সে। কিন্তু এইভাবে ভালোবাসতে সে চায়নি।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *