২. ইহুদি সমস্যা

২. ইহুদি সমস্যা

ইহুদিদের যে অবস্থা সেটির গুরুত্বকে কেউ অস্বীকার করতে পারবে না। যেখানেই তারা গ্রাহ্য করার মতো সংখ্যায় বসবাস করে, সেখানেই তারা কমবেশি নির্যাতিত। আইনের কাছে তাদের সমতার কথা কিতাবে আছে, কিন্তু কার্যত নেই। সেনাবাহিনী কিংবা সরকারি-বেসরকারি মাঝারি পর্যায়ের কোনো পদে প্রবেশের ব্যাপারেও তাদের ওপর নিষেধাজ্ঞা আছে। তাদের ব্যবসা থেকেও বাইরে রাখার একটা চেষ্টা করা হয় এই বলে— ‘ইহুদিদের কাছ থেকে কিনবেন না!

সংসদে, সভা-সমাবেশে, সংবাদপত্রে, মিম্বরে, রাস্তায় ও ভ্রমণে তাদের ওপর হামলা হয়। এমনকি কিছু কিছু হোটেল এবং বিনোদনের জায়গাগুলোয় তাদের ঢুকতে দেওয়া হয় না। প্রতিদিনই এ ধরনের ঘটনা অসংখ্য হয়ে উঠছে। নিপীড়নের ধরন বিভিন্ন দেশ এবং সামাজিক পরিসর ভেদে ভিন্ন। রাশিয়ায় ইহুদি গ্রামগুলোর কর আরোপ; রুমানিয়াতে কয়েকজনের মৃত্যুদণ্ড; জার্মানিতে তাদের মাঝে মাঝে বেশ মার খাওয়া; অস্ট্রিয়ায় ইহুদিদের স্বাভাবিক জীবনযাপনের ওপর ইহুদিবিদ্বেষীদের সন্ত্রাস; আলজেরিয়া ভ্রাম্যমাণ আন্দোলনকারী; প্যারিসে তথাকথিত সেরা সামাজিক মহল থেকে তাদের দূরে রাখা, ক্লাবগুলো থেকে তাদের বাদ দেওয়ার মতো ব্যাপার ঘটেছে। ইহুদিবিদ্বেষী অনুভূতির এমন ছায়া অসংখ্য; কিন্তু এটি ইহুদিদের কষ্টের একটি বিশ্রী বিভাগ তৈরি করার কারণ হতে পারে না।

আমি আমাদের পক্ষ থেকে এ ব্যাপারে সহানুভূতিশীল আবেগ জাগিয়ে তুলতে চাই না। এটা হবে বোকামি, নিরর্থক এবং ইহুদিদের জন্য অমর্যাদাকর একটি প্রচেষ্টা। ইহুদিদের কাছে বরং নিচের প্রশ্নগুলো উত্থাপন করে আমি নিজেকে সন্তুষ্ট করব। এটা কি সত্য নয় যে, যেসব দেশে আমরা গুনায় আনার মতো সংখ্যায় বাস করি, সেসব দেশে আইনজীবী, চিকিৎসক, প্রযুক্তিবিদ, শিক্ষক এবং অন্যান্য পেশায় থাকা কর্মচারীরা দিন দিন আরও অসহনীয় পরিস্থিতির মধ্যে পড়ছে? এটা কি সত্য নয় যে, ইহুদি মধ্যবিত্তরা মারাত্মকভাবে হুমকির সম্মুখীন? এটা কি সত্য নয় যে, বিত্তবান ইহুদিদের বিরুদ্ধে সাধারণ মানুষের আবেগকে উস্কে দেওয়া হচ্ছে? এটা কি সত্য নয় যে, অন্য যেকোনো সর্বহারা শ্রেণির চেয়ে আমাদের দরিদ্ররা আরও বেশি কষ্টের মধ্যে আছে? আমি মনে করি যে, এই বাহ্যিক চাপ নিজে থেকেই সর্বত্র অনভূত হচ্ছে। আমাদের অর্থনৈতিকভাবে উচ্চ শ্রেণির লোকজন এ কারণে অস্বস্তিতে আছে, আমাদের মধ্যবিত্তদের মধ্যে অব্যাহত ও গুরুতর উদ্বেগ আছে, আমাদের নিম্নবিত্তরা আছে চরম হতাশায়।

আসলে, সবকিছুই এক ও অভিন্ন উপসংহারের দিকে ঝুঁকছে, যা বার্লিনের সেই ক্ল্যাসিক বাক্যাংশে স্পষ্টভাবে উল্লেখ করা হয়েছে: ‘য়ুডেন রাউস!’[৯]

[৯ য়ুডেন রাউস: এর মানে হচ্ছে ‘ইহুদি খেদাও’ কিংবা ‘ইহুদিরা বেরিয়ে যাও। ১৯৩৬ সালে জার্মানির অডলফ হিটলারের প্রচারণা বাহিনী এই নামে একটি বোর্ড গেম চালু করেছিল।]

এখন সম্ভাব্য সংক্ষিপ্ত আকারে প্রশ্নটি রাখব: আমরা কি এখন ‘বেরিয়ে যাব’ এবং কোথায় যাব?

নাকি, আমরা এখনো থাকব? থাকলে তবে তা আর কতদিন?

যেখানে আছি প্ৰথমে সেখানে থাকার বিষয়টি আমরা মীমাংসা করি। আমরা কি আরও ভালো দিনের আশা করতে পারি, আমরা কি আমাদের আত্মাকে ধৈর্য ধরিয়ে রাখতে পারি, এই পৃথিবীর রাজপুত্ররা ও জনগণ যতদিন না আমাদের দিকে আরও বেশি করুণা নিয়ে ঝুঁকছে ততদিন পর্যন্ত কি আমরা ধার্মিকভাবে নিজেকে সমর্পিত করে অপেক্ষায় থাকতে পারি? আমি বলি যে, আমরা অনুভূতির এই স্রোতের পরিবর্তন আশা করতে পারি না। এবং কেন না? এমনকি অন্যান্য কিছুর মতো আমরা রাজকুমারদের হৃদয়ের কাছাকাছি থাকা সত্ত্বেও তারা আমাদের রক্ষা করতে পারেনি। তারা আমাদের প্রতি খুব বেশি অনুগ্রহ দেখিয়ে কেবল জনপ্রিয় ঘৃণা (পপুলার হেট্রেড) অনুভব করবে। এখানে ‘খুব বেশি’ বলতে আমি প্রতিটি সাধারণ নাগরিক এবং প্রতিটি জাতি অধিকার হিসেবে যতটা দাবি করে, তারচেয়ে কমই বুঝিয়েছি। যে জাতিগুলোর মধ্যে ইহুদিরা বাস করে তারা সবাই গোপনে বা প্রকাশ্যে ইহুদিবিদ্বেষী।

সাধারণ মানুষের কোনো ঐতিহাসিক অনুধাবন নেই এবং প্রকৃতপক্ষে তা থাকতেও পারে না। তারা জানে না যে মধ্যযুগের পাপ এখনো ইউরোপের জাতিগুলোর ওপর ঘুরে বেড়াচ্ছে। ঘেটো আমাদের যেভাবে গড়ে তুলেছে আমরা তাই। আমরা অর্থায়নের দিক থেকে প্রাধান্য অর্জন করেছি, কারণ মধ্যযুগীয় পরিস্থিতি আমাদের এদিকেই নিয়ে গিয়েছিল। এখন আবার একই প্রক্রিয়ার পুনরাবৃত্তি হচ্ছে। আমাদের আবার অর্থায়নে বাধ্য করা হচ্ছে। অর্থনৈতিক কার্যকলাপের অন্যান্য শাখার বাইরে রেখে এখন তা করা হচ্ছে শেয়ারবাজারে। শেয়ারবাজারে থাকার ফলে আমরা নতুন করে অবজ্ঞার সম্মুখীন হয়েছি। একই সাথে আমরা প্রচুর পরিমাণে মধ্যমেধার জন্ম দিচ্ছি যাদের নিষ্ক্রমণের (কাজে লাগানোর) কোনো উপায় নেই। ক্রমবর্ধমান সম্পদের মতো এটিও আমাদের সামাজিক অবস্থানকে বিপন্ন করছে। শিক্ষিত ইহুদিরা এখন অনর্থক দ্রুত সমাজতান্ত্রিক হয়ে উঠছে। তাই আমরা নিশ্চিত যে শ্রেণিগুলোর মধ্যে লড়াইয়ে আমরা খুব মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হব, কারণ আমরা সমাজতান্ত্রিক ও পুঁজিবাদী উভয় শিবিরে সবচেয়ে উদ্ভাসিত অবস্থানে দাঁড়িয়ে আছি।

সমাধানের পূর্ববর্তী প্রচেষ্টাগুলো

ইহুদিদের সমস্যা সমাধানে আগে যে কৃত্রিম উপায়গুলো অবলম্বন করা হয়েছিল সেগুলো হয় খুবই নগণ্য, যেমন উপনিবেশ স্থাপনের প্রচেষ্টা, নয় তো ছিল ইহুদিদের বর্তমান বাসস্থানে তাদের কৃষকে রূপান্তরিত করার প্রচেষ্টা। কয়েক হাজার ইহুদিকে অন্য দেশে সরিয়ে নিয়ে কী ফল এসেছে? হয় তারা তাৎক্ষণিকভাবে দুর্দশায় পতিত হয়েছে, নয় তো ধনী হয়েছে। এবং তারপর তাদের এই উন্নতি ইহুদিবিদ্বেষের জন্ম দিয়েছে। দরিদ্র ইহুদিদের নতুন জেলায় সরিয়ে নেওয়ার এই প্রচেষ্টা সম্পর্কে আমরা ইতিমধ্যেই আলোচনা করেছি। সরিয়ে নেওয়ার এই প্রচেষ্টা, প্রকৃতপক্ষে তাদের শোষণ ও বঞ্ছনার অবসান না ঘটালে, স্পষ্টতই অপ্রতুল এবং নিরর্থক; কারণ এটি কেবল সমাধানকে বিলম্বিত ও স্থগিত করে এবং সম্ভবত অসুবিধাগুলো আরও বাড়িয়ে দেয়।

ইহুদিকে যে বা যারাই কৃষকে রূপান্তরের চেষ্টা করবে সে একটি ভীষণ ভুল করবে। একজন কৃষকের একটি ঐতিহাসিক শ্রেণি রয়েছে, যা তার পোশাক দ্বারা প্রমাণিত, যে পোশাক তারা শতাব্দীকাল ধরে পরিধান করছে; এবং তার হাতিয়ার দ্বারা প্রমাণিত, যা তার প্রাচীনতম পূর্বপুরুষদের দ্বারা ব্যবহৃত হয়েছে। তার লাঙ্গল বদলায়নি; সে তার জামার মধ্যে বীজ বহন করে; যুগ যুগ ধরে সে একই ধরনের মাড়ানি দিয়ে ফসল মাড়াই করে; কিন্তু আমরা জানি এসবই আধুনিক যন্ত্র দিয়ে করা যায়। কৃষিকাজের ব্যাপারগুলো এখন একেবারেই যন্ত্রপাতির কাজ। বৃহৎ ভূসম্পত্তির অধিকারী যেভাবে ছোটদের গ্রাস করে একইভাবে আমেরিকাও অবশ্যই ইউরোপকে গ্রাস করবে। ফলে কৃষক হচ্ছে বিলুপ্তির পথে থাকা একটা ধরন। যখনই তাকে কৃত্রিমভাবে সংরক্ষণ করা হয়, তখন তা করা হয় রাজনৈতিক স্বার্থে, তা করা হয় এই কারণে যে সেও সেভাবেই থাকতে চায়। পুরোনো ধাঁচে আধুনিক কৃষক তৈরি করা অযৌক্তিক এবং প্রকৃতপক্ষে অসম্ভব। সভ্যতাকে এক কদমও বিপরীত দিকে নিতে বাধ্য করার মতো কেউ সম্পদশালী বা শক্তিশালী নয়। সেকেলে প্রতিষ্ঠানগুলোর নিছক সংরক্ষণ একটি স্বৈরাচার শাসিত রাষ্ট্রের সব ধরনের স্বেচ্ছাচারী পদক্ষেপ প্রয়োগের দিক থেকে যথেষ্ট গুরুতর।

তাহলে পুরোনো দিনের মতো কৃষক হওয়ার আকাঙ্ক্ষা সম্পন্ন বুদ্ধিমান ইহুদিদের এই কারণে কৃতিত্ব দেব? কেউ হয়তো তাদের বলতে পারে— ‘এই যে আড়ধনুক নাও, আর এখন যুদ্ধে যাও!’ কী? আড়ধনুক নিয়ে? যেখানে অন্যদের কাছে আছে রাইফেল এবং দূরপাল্লার বন্দুক? এই পরিস্থিতিতে ইহুদিদের যখন কৃষক বানানোর চেষ্টা করা হয় তখন তাদের উত্তেজিত হতে অস্বীকার করাটা একেবারেই ন্যায়সঙ্গত। আড়ধনুক একটি সুন্দর অস্ত্র, যা আমাকে শোকাতুর অনুভূতির সঙ্গে অনুপ্রাণিত করে যখন এই অস্ত্রের প্রতি উৎসর্গ করার মতো যথেষ্ট সময় আমার হাতে থাকে; কিন্তু এটি এখন জাদুঘরের অধিকারের অন্তর্গত। হ্যাঁ, এখনো নিশ্চয়ই এমন জেলাও আছে যেখানে মরিয়া ইহুদিরা বাইরে যায়, বা যেকোনো মূল্যে বাইরে যেতে চায় এবং জমি চাষ করে এবং সামান্য পর্যবেক্ষণেই দেখা যায় যে এই জেলাগুলো— যেমন জার্মানির হেসের ছিটমহল এবং রাশিয়ার কিছু প্রদেশ— ইহুদিবিদ্বেষের প্রধান স্থল।

ইহুদিদের যারা লাঙ্গল ধরিয়ে দেয় সেই বিশ্ব-সংস্কারকরা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একজন ব্যক্তিকে ভুলে যায়, যার নাকি এই বিষয়ে অনেক কিছু বলার আছে। এই ব্যক্তিটি হচ্ছেন কৃষিবিদ এবং এই কৃষিবিদ একেবারেই যথার্থ। ভূমিকর, ফসলের ঝুঁকি, সস্তা শ্রমের জন্য চাপ সৃষ্টিকারী বড় মালিক এবং বিশেষ করে আমেরিকান প্রতিযোগিতা, সব মিলে তার জীবনকে যথেষ্ট কঠিন করে তোলে। এ ছাড়া, ভুট্টার ওপর শুল্ক অনির্দিষ্ট হারে কেবল বাড়তেই থাকবে, তা হতে পারে না। কিংবা উৎপাদকদের অনাহারে থাকতে দেওয়াটা চলতে পারে না; তার রাজনৈতিক প্রভাব প্রকৃতপক্ষে ক্রমবর্ধমান এবং তাই তার প্রতি একটু বেশি মনোযোগ দিতে হবে। এসব সমস্যা খুবই পরিচিত, তাই আমি তাৎক্ষণিকভাবে এগুলোর কথা উল্লেখ করলাম। ইহুদি সমস্যার সমাধানে অতীতের প্রচেষ্টাগুলো যে কতটা অর্থহীন ছিল, আমি কেবল তা স্পষ্টভাবে বোঝাতে চাইলাম। যদিও সেগুলো ভালো উদ্দেশ্য থেকেই নেওয়া হয়েছিল। গতিপথ পাল্টে দেওয়ার এই প্রক্রিয়া কিংবা আমাদের সর্বহারা শ্রেণির বৌদ্ধিক স্তরের কৃত্রিম এক উদ্যমহীনতা দিয়ে এই সমস্যার সমাধান করা যাবে না। আত্তীকরণের অনুমিত অব্যর্থ উপায় ইতিমধ্যেই অবলম্বন করা হয়েছে। আমরা এই পদ্ধতিগুলোর কোনোটি দিয়েই ইহুদিবিদ্বেষ দূর করার ক্ষেত্রে উত্তম কোনো ফল পাইনি। যতক্ষণ না এর কারণগুলো দূর হচ্ছে ততক্ষণ এটির অবসান হবে না। কারণগুলো কি দূর করা সম্ভব?

ইহুদিবিদ্বেষের কারণ

মেজাজ, কুসংস্কার এবং সংকীর্ণ দৃষ্টিভঙ্গির কারণে যে ইহুদিবিদ্বেষ সে নিয়ে এখানে আমরা আর কথা বলব না; এখানে শুধু রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক কারণগুলোর মধ্যে নিজেদের সীমাবদ্ধ রাখব।

আধুনিক ইহুদিবিদ্বেষকে আগেকার দিনের ইহুদিদের ওপর যে ধর্মীয় নিপীড়ন-নির্যাতন সেসবের সঙ্গে গুলিয়ে ফেলা উচিত হবে না। মাঝে মাঝে কিছু দেশে ধর্মীয় কারণে ইহুদিবিদ্বেষের ঘটনা ঘটে না তা নয়, তবে আক্রমণাত্মক আন্দোলনের মূল স্রোত কিন্তু এখন পরিবর্তিত হয়েছে। প্ৰধানত যে দেশগুলোতে এখন ইহুদিবিদ্বেষ প্রবল সেগুলোতে ইহুদিদের মুক্তির ফলে তা হচ্ছে। যখন সভ্য দেশগুলো বৈষম্যমূলক আইনের অমানবিকতার বিরুদ্ধে সচেতন হয় এবং আমাদের অধিকার প্রদান করে, তখন আসলে অনেক দেরি হয়ে গেছে। আমাদের পুরোনো বসতিতে আমাদের অক্ষমতা দূর করা আর সম্ভব ছিল না। কারণ, বিস্ময়কর যে, আমরা ঘেটোতে থাকার সময় বুর্জোয়া জনগণের মধ্যে বিকশিত হয়েছিলাম এবং আমরা মধ্যবিত্তদের সঙ্গে তীব্র প্রতিযোগিতায় নামতে এটি থেকে বেরিয়ে এসেছি। তাই, আমাদের মুক্তি আকস্মিকভাবে আমাদের এই মধ্যবিত্ত বৃত্তের মধ্যে এনে ফেলেছে, যেখানে নিজেদের টিকিয়ে রাখতে গিয়ে আমরা ভেতরগত এবং বাইরের দ্বিগুণ চাপের মধ্যে পড়ে গেছি। খ্রিস্টান বুর্জোয়ারা সমাজতন্ত্রের জন্য আমাদের ছুড়ে ফেলতে অনিচ্ছুক হবে না; যদিও তাতে তাদের অবস্থার খুব বেশি উন্নতি হবে না।

একই সময়ে, আইনত ইহুদিদের যে সমানাধিকার একবার যেখানে স্বীকার করা হয়েছে, তা প্রত্যাহার করা যাবে না। এটা শুধু এই কারণে নয় যে তা প্রত্যাহার করা হলে এই যুগের চেতনার বিরোধিতা হবে, বরং এটি অবিলম্বে ধনী-দরিদ্র সব ইহুদিকে নাশকতাকারী দলগুলোর মধ্যে নিয়ে যাবে। এতে আমাদের যে ক্ষত তা সারাতে কার্যকর কিছুই হবে না। পুরোনো দিনে আমাদের ধনরত্ন জব্দ করা হয়েছিল। এখনকার দিনে আমাদের অস্থাবর সম্পত্তি কীভাবে জব্দ করা হবে? এগুলো তো নিতান্তই কাগজে মুদ্রিত যেগুলো অন্য কোথাও কিংবা বিশ্বের অন্যত্র গচ্ছিত আছে, সম্ভবত তা আছে খ্রিস্টানদের কোষাগারে। হ্যাঁ, এটা অবশ্যই ঠিক যে, রেলওয়ে ও ব্যাংকের শেয়ার ও ডিবেঞ্চারে এবং শিল্প উদ্যোগের সমস্ত বিবরণ আয়করের প্রক্রিয়ার মাধ্যমে জানা সম্ভব এবং যেখানে প্রগতিশীল আয়কর প্রক্রিয়া বলবৎ আছে সেখানে আমাদের সব অস্থাবর সম্পত্তি অবশেষে জব্দ করে রাখা সম্ভব; কিন্তু এসব পদক্ষেপ শুধু ইহুদিদের বিরুদ্ধে নেওয়া যাবে না। সে যা হোক, এই ধরনের পদক্ষেপ কোথাও নেওয়া হলে সেটির তাৎক্ষণিক পরিণতি হবে গুরুতর অর্থনৈতিক সংকট। এই সংকটে প্রথমত ইহুদিরা ক্ষতিগ্রস্ত হলেও তা কোনোভাবেই ইহুদিদের মধ্যেই সীমাবদ্ধ রাখা যাবে না। ইহুদিদের কাছ থেকে পাওয়ার অসম্ভাব্যতা তাদের ঘৃণাকেই আরও বাড়িয়ে দেয়। জাতিগুলোর মধ্যে ইহুদিবিদ্বেষ দিনে দিনে ঘণ্টায় ঘণ্টায় বাড়তে থাকে; প্রকৃতপক্ষে, এটি বাড়তে বাধ্য, কারণ তা বাড়ার কারণগুলো বিদ্যমান থাকে এবং সেগুলোকে অপসারণ করা যায় না। এর দূরবর্তী কারণ হলো মধ্যযুগে আমাদের আত্তীকরণের ক্ষমতা হারানো; আর এর নিকটবর্তী কারণ হলো আমাদের মধ্যমেধার উৎপাদন বাড়াবাড়ি রকমের বেড়ে যাওয়া, এই মধ্যমেধা না ওপর, না নিচ— কোনোদিকেই নির্গত হওয়ার কোনো পথ পায় না। অর্থাৎ বলা যায়, কোনো দিকেই নির্গত হওয়ার কোনো স্বাস্থ্যকর পথ নেই। যখন আমরা ডুবে যাই, তখন হয়ে উঠি বিপ্লবী সর্বহারা, বিপ্লবী সব দলের অধীন কর্মকর্তা এবং একই সময়ে, যখন আমরা ভেসে উঠি বা জেগে উঠি, তখন এই জেগে ওঠা আমাদের পকেটের ভয়ানক শক্তিরও উত্থান।

ইহুদিবিদ্বেষের প্রভাব

আমরা যে নিপীড়ন সহ্য করি তাতে আমাদের বোধোদয় হয় না, কারণ আমরা সাধারণ মানুষের চেয়ে একটুও ভালো নই। এটা সত্য যে আমরা আমাদের শত্রুদের ভালোবাসি না; কিন্তু যে নিজেকে জয় করতে পারে সে আমাদের এই ত্রুটির জন্য একাই আমাদের ভর্ৎসনা করতে সাহস পায়। নিপীড়ন স্বভাবতই নিপীড়নকারীর বিরুদ্ধে বিদ্রোহী করে তোলে এবং আমাদের এই দ্রোহ আমাদের ওপর চাপ আরও বাড়িয়ে দেয়। এই চিরাচরিত চক্র থেকে পালানো অসম্ভব।

‘না!’ কিছু নরম হৃদয়ের স্বপ্নদ্রষ্টা (ভিশনারি) বলবেন— ‘না, এটা সম্ভব! মানবতার চূড়ান্ত পরিপূর্ণতার মাধ্যমে সম্ভব।’

এই দৃষ্টিভঙ্গির সেন্টিমেন্টাল বোকামি বিবেচনায় রাখার কি প্রয়োজন আছে? মানবতার চূড়ান্ত পরিপূর্ণতায় যে উন্নত অবস্থা তার ওপর যে ব্যক্তি আশা রাখবে সে প্রকৃতপক্ষে একটি ইউটোপিয়ায় ভরসা করবে!

আমি আগে আমাদের ‘আত্তীকরণের’ কথা উল্লেখ করেছি। আমি এক মুহূর্তের জন্যও এটা বোঝাতে চাই না যে আমি এমন একটি সমাপ্তি চাই। প্রতিটি অধঃপতন সত্ত্বেও আমাদের জাতীয় চরিত্র ঐতিহাসিকভাবে অত্যন্ত বিখ্যাত, বিনাশকে কাম্য করে তোলার ক্ষেত্রেও এটি অত্যন্ত চমৎকার। আমরা হয়তো পারিপার্শ্বিক জাতিগুলোর মধ্যে নিজেদের সম্পূর্ণরূপে মিশিয়ে নিতে সক্ষম হব যদি তারা আমাদের দুই প্রজন্মের জন্য শান্তিতে থাকতে দেয়; কিন্তু তারা আমাদের সেই শান্তি দেবে না। অল্প সময়ের জন্য তারা আমাদের সহ্য করবে এবং তারপর তাদের শত্রুতা বারবার ছড়িয়ে পড়বে। বিশ্ব আমাদের সমৃদ্ধির মাধ্যমে কোনো না কোনোভাবে প্ররোচিত, কারণ এটি বহু শতাব্দী ধরে আমাদের দরিদ্র-পীড়িতদের মধ্যে সবচেয়ে ঘৃণ্য হিসেবে বিবেচনা করতে অভ্যস্ত ছিল। অজ্ঞতা এবং হৃদয়ের সংকীর্ণতার কারণে তারা এটি খেয়াল করেনি যে সমৃদ্ধি আমাদের ইহুদিধর্মকে দুর্বল করে এবং আমাদের বিশেষত্ব ম্লান করে দেয়। এটা আমাদের ওপর সেই চাপ, যা আমাদের পিতা-মাতার মূলে ফিরে যেতে বাধ্য করে; এটা কেবল সেই ঘৃণা যা আমাদের বেষ্টন করে এবং আমাদের আরও একবার আগন্তুক করে তোলে।

এভাবে, আমরা পছন্দ করি বা না করি- আমরা এখন আছি এবং এরপরও থাকব— একটি ঐতিহাসিক গোষ্ঠী যাদের সবার মধ্যে সন্দেহাতীতভাবে রয়েছে সাধারণ বৈশিষ্ট্য।

আমরা একজন মাত্র, আমাদের শত্রুরা, আমাদের অসম্মতিতেই আমাদের এক করেছে, যেমনটি ইতিহাসে বারবার ঘটেছে। দুর্দশা আমাদের একই বন্ধনে বেঁধে দিয়েছে এবং এইভাবে একত্রিত হয়ে আমরা হঠাৎ আমাদের শক্তি আবিষ্কার করতে পেরেছি। হ্যাঁ, একটি রাষ্ট্র গঠনের জন্য আমরা যথেষ্ট শক্তিশালী এবং প্রকৃতপক্ষে, একটি আদর্শ রাষ্ট্র গঠনের জন্য প্রয়োজনীয় মানুষ এবং বস্তুগত সম্পদ আমাদের রয়েছে।

তাই মোটামুটিভাবে যেটিকে ‘মানব উপাদান’ বলে অভিহিত করা হয় তা তুলে ধরার জন্য এটি উপযুক্ত জায়গা; কিন্তু পরিকল্পনার বিস্তৃত রূপরেখা, যার ওপর সবকিছু নির্ভর করে, তা চিহ্নিত না হওয়া পর্যন্ত তা তুলে ধরা ঠিক হবে না।

পরিকল্পনা

সারবস্তুর বিবেচনায় পুরো পরিকল্পনাটি একেবারে সহজ, কারণ এটি এমন হবে যাতে সবাই বুঝতে পারে।

বিশ্বের একটি অংশে আমাদের সার্বভৌমত্ব মঞ্জুর করা হোক, একটি জাতির ন্যায্য প্রয়োজন মেটানোর জন্য এই বিশ্ব যথেষ্ট বিশাল; বাকিটা আমরা নিজেরাই করতে পারব।

একটি নতুন রাষ্ট্র গঠন হাস্যকরও নয়, অসম্ভবও নয়। আমাদের এই সময়ে দরিদ্র ও কম শিক্ষিত এবং যে কারণে আমাদের চেয়ে দুর্বল জাতিগুলোর মধ্যে এ ধরনের প্রক্রিয়া আমরা দেখেছি। এই জাতিগুলোর অধিকাংশ সদস্য মধ্যবিত্ত শ্রেণির নয়। ইহুদিবিদ্বেষের চাবুক খাওয়া সব দেশের সরকার আমরা যে সার্বভৌমত্ব চাই তা পেতে আমাদের সহায়তা করতে আগ্রহী হবে।

পরিকল্পনাটি, নকশায় সহজ, কিন্তু বাস্তবায়নে জটিল, দুটি সংস্থা তা বাস্তবায়নে কাজ করবে; ইহুদি সোসাইটি (দ্য সোসাইটি অব যিউস) এবং ইহুদি কোম্পানি (যিউয়িশ কোম্পানি)।

ইহুদি সোসাইটি বিজ্ঞান ও রাজনীতির ক্ষেত্রে প্রস্তুতিমূলক কাজ করবে, যা ইহুদি কোম্পানি পরবর্তীতে বাস্তবে প্রয়োগ করবে।

ইহুদি কোম্পানি দেশান্তরী হতে উদ্যোগী ইহুদিদের (ডেপার্টিং যিউস) ব্যবসায়িক স্বার্থের পরিসমাপ্তিকারী এজেন্ট হবে এবং নতুন দেশে ব্যবসা ও বাণিজ্যের ক্ষেত্রে কাজ করবে।

ইহুদিরা হঠাৎ করে নতুন দেশে চলে যাবে তা আমাদের কল্পনা করা উচিত নয়। এটি ক্রমান্বয়ে, অব্যাহতভাবে হবে এবং বহু দশক ধরে চলতে থাকবে। সবচেয়ে দরিদ্ররা প্রথমে ভূমি ও অবকাঠামো উন্নয়নের কাজ করতে যাবে। আগে থেকে ঠিক করা একটি পরিকল্পনা অনুযায়ী তারা রাস্তা, সেতু, রেলপথ এবং টেলিগ্রাফ স্থাপনা নির্মাণ করবে। নদী শাসন, নিজস্ব বাসস্থান নির্মাণ, নিজেদের শ্রম বিনিয়োগ, ব্যবসা-বাণিজ্যের ক্ষেত্র তৈরি, বাজার তৈরি এবং বাজারে নতুন বসতি স্থাপনকারীদের আকৃষ্ট করার কাজ করবে তারা। কারণ প্রতিটি মানুষ স্বেচ্ছায়, নিজের খরচে এবং নিজের ঝুঁকিতে যাবে। তারা সেখানে ভূমিতে শ্রম দেবে এবং এর মূল্য বাড়িয়ে দেবে। ইহুদিরা শিগগিরই বুঝতে পারবে যে, পূর্ববর্তী বসতভূমিতে যেখানে শুধু ঘৃণা ও অপমান ছিল সেখানকার চেতনা থেকে এখানে একটি নতুন ও স্থায়ী ক্ষেত্র খোলা হচ্ছে।

আমরা আজ যে রাষ্ট্র পেতে চাই তা সেভাবে গড়ব না, যেভাবে হাজার বছর আগে গড়া যেত। সভ্যতার পুরোনো পর্যায়ে ফিরে যাওয়া বোকামি, যেমনটা অনেক জায়নবাদীরা করতে চায়। ধরুন, উদাহরণ স্বরূপ, আমাদের বন্য জন্তু অধ্যুষিত একটি অঞ্চল পরিষ্কার করতে হবে, কাজটি কিন্তু পঞ্চম শতাব্দীর ইউরোপীয়দের মতো করে করা ঠিক হবে না। একটি একটি করে ভালুক তাড়াতে আমাদের বর্শা-বল্লম ব্যবহার করলে হবে না। আমরা শিকারের জন্য সক্রিয় ও বৃহৎ একটি দল গঠন করব এবং বন্যপ্রাণীদের একসঙ্গে তাড়িয়ে দেব। জন্তু তাড়াতে আমরা বনাঞ্চলের মাঝখানে একটি জেলিগনাইট (নাইট্রিক অ্যাসিড) বোমা নিক্ষেপ করব।

নির্মাণ অভিযান পরিচালনার জন্য আমরা হ্রদের তীরে প্রচুর পরিমাণে বাজি ও স্তূপ ব্যবহার করব না, এখনকার মানুষ যেভাবে তা করে আমরা তা সেভাবেই করব। প্রকৃতপক্ষে, আমরা নির্মাণ করব আগে থেকে ঠিক করা পদ্ধতি অনুযায়ী আরও সাহসী এবং আরও সুশৃঙ্খলভাবে। কারণ এখন আমাদের কাছে এমন অর্থ রয়েছে যা এখনো অন্যদের নেই।

অর্থনৈতিক মাপকাঠিতে সর্বনিম্ন অবস্থানে থাকা অভিবাসীরা ধীরে ধীরে উচ্চ পর্যায়ে থাকা লোকদের অনুসরণ করবে। এই মুহূর্তে যারা হতাশার মধ্যে দিন কাটাচ্ছে তারা আগে যাবে। তারা মধ্যমেধার লোকদের দ্বারা পরিচালিত হবে, যা আমরা ব্যাপকভাবে উৎপাদন করি এবং যারা সর্বত্র নিগৃহীত হয়।

এই পুস্তিকা ইহুদি প্রশ্নে একটি সাধারণ আলোচনার সূত্রপাত ঘটাবে, কিন্তু এর মানে এই নয় যে তা নিয়ে ভোটাভুটির আয়োজন হবে। এই জাতীয় ফলাফল একেবারে গোড়াতেই কারণটিকে নষ্ট করে দেবে এবং ভিন্নমতাবলম্বীদের অবশ্যই মনে রাখতে হবে যে আনুগত্য বা বিরোধিতা সম্পূর্ণভাবেই স্বেচ্ছাকৃত। যে আমাদের সঙ্গে আসবে না সে যেন পেছনে থাকে।

যারা আমাদের সাথে যোগ দিতে ইচ্ছুক তারা সবাই আমাদের ব্যানারের পেছনে এসে দাঁড়ান এবং কণ্ঠ, কলম ও কাজ দিয়ে আমাদের স্বার্থে লড়াই করুন।

যে সব ইহুদি আমাদের রাষ্ট্রের ধারণার সঙ্গে একমত তারা নিজেদের সেই সোসাইটির সঙ্গে সংযুক্ত করবে, যে সোসাইটি আমাদের জনগণের নামে যে সরকার তার সঙ্গে চুক্তি ও আলোচনার ব্যাপারে অনুমোদিত হবে। এভাবে এই সোসাইটি রাষ্ট্র-সৃষ্টিকারী শক্তি হিসেবে সরকারের সঙ্গে তার সম্পর্কের ক্ষেত্রে স্বীকৃত হবে। এই স্বীকৃতির মাধ্যমেই কার্যত তৈরি হবে রাষ্ট্র।

শক্তিগুলো একটি নিরপেক্ষ ভূখণ্ডের ওপর আমাদের সার্বভৌমত্ব স্বীকার করার ব্যাপারে সম্মতি জানালে ইহুদি সোসাইটি সেই ভূমি দখলের জন্য আলোচনা শুরু করবে। এখানে দুটি ভূখণ্ড বিবেচনায় আনা হয়েছে: ফিলিস্তিন ও আর্জেন্টিনা। উভয় দেশেই উপনিবেশ স্থাপনে গুরুত্বপূর্ণ পরীক্ষা-নিরীক্ষা করা হয়েছে, যদিও তা করা হয়েছে ইহুদিদের ক্রমান্বয়ে অনুপ্রবেশ করানোর ভুল নীতির মাধ্যমে। অনুপ্রবেশ প্রক্রিয়ার পরিণতি খারাপ হতে বাধ্য। এটি সেই অনিবার্য মুহূর্ত পর্যন্ত চলতে থাকে যখন স্থানীয় জনগণ এই অনুপ্রবেশকে নিজেদের জন্য হুমকি মনে করে এবং সরকারকে ইহুদিদের আরও আগমন বন্ধ করতে বাধ্য করে। অভিবাসন চালিয়ে যাওয়ার সার্বভৌম অধিকার না থাকলে এই ধরনের অভিবাসন পদক্ষেপ নিরর্থক

ইহুদি সোসাইটি ভূখণ্ডের বর্তমান অধিকারীদের সঙ্গে আলোচনা করবে। যদি এই পরিকল্পনার প্রতি তাদের বন্ধুভাবাপন্ন বলে প্রমাণিত হয় তবে এটিকে ইউরোপীয় শক্তির সুরক্ষার অধীনে আনা হবে। আমরা ভূমির বর্তমান মালিকদের প্রচুর সুবিধার প্রস্তাব দেব, জনসাধারণের ঋণের অংশ গ্রহণ করব, যানবাহনের জন্য নতুন রাস্তা তৈরি করব, যা দেশটি আমাদের উপস্থিতি প্রয়োজনীয় করে তুলবে। আমরা আরও অনেক কিছু করব। আমাদের রাষ্ট্র তৈরির ব্যাপারটি পার্শ্ববর্তী দেশগুলোর জন্য হিতকর হবে, কারণ ভূখণ্ডের একটি অংশের উন্নয়নের ফলে আশপাশের এলাকাগুলোর মূল্য অসংখ্য উপায়ে বৃদ্ধি পায়।

ফিলিস্তিন নাকি আর্জেন্টিনা?[১০]

[১০ ফিলিস্তিন ও আর্জেন্টিনার পাশাপাশি কেনিয়াতেও ইহুদি বসতি স্থাপনের একটি আলোচনা ছিল। লেখক এখানে তা উল্লেখ করেননি।]

আমরা কি ফিলিস্তিন নাকি আর্জেন্টিনাকে বেছে নেব? আমাদের যা দেওয়া হয়েছে এবং ইহুদি জনমত যা বেছে নিয়েছে তাই আমরা নেব। এই দুটি বিষয় বিবেচনায় নিয়ে সিদ্ধান্ত নেবে ইহুদি সোসাইটি। আর্জেন্টিনা বিশ্বের সবচেয়ে উর্বর দেশগুলোর একটি, বিশাল এলাকাজুড়ে বিস্তৃত, জনসংখ্যা বিরল এবং জলবায়ুও বেশ মৃদু। আর্জেন্টিনা প্রজাতন্ত্র তার একটি অংশ আমাদের ছাড় দেওয়ার মাধ্যমে যথেষ্ট মুনাফা অর্জন করবে। ইহুদিদের বর্তমান অনুপ্রবেশ অবশ্যই আর্জেন্টিনার জন্য কিছুটা অসন্তোষ সৃষ্টি করেছে। অনুপ্রবেশের সঙ্গে আমাদের নতুন আন্দোলনের অন্তর্নিহিত পার্থক্য সম্পর্কে এই প্রজাতন্ত্রকে আলোকিত করা প্রয়োজন। ফিলিস্তিন আমাদের চিরস্মরণীয় ঐতিহাসিক বাড়ি। ফিলিস্তিনের নামই আমাদের জনগণকে আকৃষ্ট করবে বিস্ময়কর শক্তির সঙ্গে। মহামহিম সুলতান যদি আমাদের প্যালেস্টাইন দিতেন, আমরা বিনিময়ে দায়িত্ব নিতে পারতাম তুরস্কের পুরো অর্থায়নের। আমাদের সেখানে এশিয়ার বিরুদ্ধে ইউরোপের প্রাচীরের একটি অংশ তৈরি করা উচিত, বর্বরতার বিপরীতে সভ্যতার আউটপোস্ট। নিরপেক্ষ রাষ্ট্র হিসেবে আমাদের ইউরোপের সবার সঙ্গে যোগাযোগ রাখা উচিত, যা আমাদের অস্তিত্বের নিশ্চয়তা দেবে। রাষ্ট্রের ভেতরে থাকা খ্রিস্টীয় পবিত্র স্থানগুলোকে আলাদা এলাকা হিসেবে স্বীকৃতি ও মর্যাদা প্রদানের মাধ্যমে সুরক্ষা দিতে হবে, যেমন সুরক্ষা জাতিগুলোর জন্য আইনের মাধ্যমে দেওয়া হয়। আমাদের অস্তিত্ব দিয়ে এই দায়িত্ব পালনের জন্য আমাদের একটি গার্ড অব অনার গঠন করা উচিত। এই গার্ড অব অনার হবে আঠারো শতকের ভোগান্তির পর ইহুদি সমস্যা সমাধানের মহান প্রতীক।

চাহিদা, মধ্যস্থতাকারী ও বাণিজ্য

আমি আগের অধ্যায়ে বলেছিলাম, ইহুদি কোম্পানি নতুন দেশে ব্যবসা- বাণিজ্যের আয়োজন করবে।’ আমি এখানে সেই বিষয়ে কয়েকটি মন্তব্য যুক্ত করব। আমার প্রকল্পের মতো প্রকল্প সাংঘাতিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয় যদি ‘ব্যবহারিক’ লোকেরা এর বিরোধিতা করে। এই ‘ব্যবহারিক’ লোকেরা এখন একটি নিয়ম হিসেবে দৈনন্দিন রুটিনের খাঁজে নিমজ্জিত মানুষ ছাড়া আর কিছুই নয়। তারা পুরোনো ধারণার একটি সংকীর্ণ বৃত্ত থেকে বেরিয়ে আসতে অক্ষম। তারপরও তাদের প্রতিকূল মতামত অনেক ওজন বহন করে এবং একটি নতুন প্রকল্পের যথেষ্ট ক্ষতি করতে পারে, যতক্ষণ না এই নতুন জিনিসটি ‘ব্যবহারিক’ লোকেদের এবং তাদের সেকেলে ধারণাকে বাতাসে ছুড়ে দেওয়ার মতো যথেষ্ট শক্তিশালী হচ্ছে।

ইউরোপীয় রেলপথ নির্মাণের প্রথম দিকে কিছু ‘ব্যবহারিক’ লোকের মতামত ছিল যে নির্দিষ্ট লাইন তৈরি করা বোকামি, ‘কারণ ডাক-গাড়িগুলো ভরার মতো পর্যাপ্ত যাত্রীও নেই।’

তারা সত্যটি উপলব্ধি করতে পারেনি- যা এখন আমাদের কাছে একেবারে স্পষ্ট— যে ভ্রমণকারীরা রেলপথ তৈরি করে না, বরং উল্টো, রেলপথই যাত্রী তৈরি করে; সুপ্ত চাহিদা অবশ্যই বিবেচনায় নিতে হয়।

একটি নতুন দেশে— যে দেশ এখনো অধিগ্রহণ ও আবাদ করা হয়নি ব্যবসা-বাণিজ্য কীভাবে তৈরি হবে, তা বোঝার অক্ষমতাকে রেলওয়ের প্রয়োজনীয়তা সম্পর্কে ‘ব্যবহারিক’ ব্যক্তিদের সন্দেহের সঙ্গে তুলনা করা যেতে পারে। একজন ‘ব্যবহারিক’ ব্যক্তি যেভাবে নিজের মতামত জানাতে পারে তা হচ্ছে: ‘মানলাম যে অনেক স্থানেই ইহুদিদের বর্তমান পরিস্থিতি অসহনীয় এবং দিন দিন তা আরও খারাপ হচ্ছে; এটাও না হয় মানা গেল যে তারা দেশত্যাগ করতে চায়; এমনকি এটাও ঠিক যে তারা একটি নতুন দেশে যেতে চায়; তারা কীভাবে সেখানে তাদের জীবিকা নির্বাহ করবে এবং তাদের উপার্জনটাই বা কী হবে? সেখানে গেলে তারা কী নিয়ে বেঁচে থাকবে? অনেক লোকের ব্যবসা-বাণিজ্য তো একদিনে কৃত্রিমভাবে তৈরি করা সম্ভব নয়।’

এর জবাবে আমি বলব: কৃত্রিমভাবে বাণিজ্য সংগঠিত করার সামান্যতম উদ্দেশ্যও আমাদের নেই এবং আমাদের অবশ্যই একদিনে এটি করার চেষ্টা করাও ঠিক হবে না। কিন্তু, একদিনে কৃত্রিমভাবে ব্যবসা-বাণিজ্য সংগঠন অসম্ভব হলেও, এটি গড়ে তোলার চেষ্টা তো সম্ভব। বাণিজ্যকে উৎসাহিত করা হয় কীভাবে? চাহিদার মাধ্যমেই তো তা করা হয়। চাহিদা থাকলে, মাধ্যম তৈরি হলে, ব্যবসা-বাণিজ্য নিজে থেকেই প্রতিষ্ঠিত হবে।

যদি ইহুদিদের মধ্যে তাদের অবস্থার উন্নতির জন্য সত্যিকারের আন্তরিক চাহিদা থাকে; যদি মাধ্যম— ইহুদি কোম্পানি— তৈরি করা হয় এবং তা যদি পর্যাপ্ত শক্তিশালী হয় তাহলে বাণিজ্য নিজেই নিজেকে নতুন দেশে স্বাধীনভাবে প্রসারিত করবে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *