২. ইন্দিরা মার্গের এই বাড়ি

ইন্দিরা মার্গের এই বাড়ির সেই বিশেষ ভাবে তৈরি বারান্দায় চেয়ারে শরীর এলিয়ে আকাশের দিকে তাকিয়ে তিনি মায়ের মুখ কল্পনা করছিলেন। আজকাল প্রায়ই মুখগুলো ঝাপসা হয়ে যাচ্ছে। মা চলে গেছেন অনেককাল আগে। কিন্তু এখনও তার বোধগম্য হল না কেন মা তাতার কথা শোনার পর অমন আঁতকে উঠেছিলেন। এবং তারপরেই নিজের সমস্ত ইচ্ছা বিসর্জন দিয়ে আশাকে অনুমতি দিয়েছিলেন এগিয়ে যেতে? তারপরে কখনই তিনি তাকে সংসারী করার চেষ্টা করেননি। তাতা তাকে প্রায়ই রসিকতা করে বলতেন, তোমার সঙ্গে নটরাজের বিবাহ হয়ে গিয়েছে, মনে রেখ।

প্রায় সেইরকম বিশ্বাস করে নিয়েছিলেন তিনি। আশা চেয়ার ছেড়ে ওঠার কথা ভাবলেন। এক গ্লাস জল চাই। কমলা কিংবা শ্রীনিবাসকে ডাকলেই ছুটে আসবে। কিন্তু আজ আশার কোনো শব্দ উচ্চারণ করতে ইচ্ছে করছিল না। রাতের আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে নিজের প্রয়োজন অতিক্রম করা যায়। ওই মেঘেরা যেভাবে শরীর পরিবর্তন করে সারা আকাশ জুড়ে নেচে বেড়ায় তা দুচোখ ভরে দেখে যেতে বড় ভাল লাগে তার।

তাতার কাছে তার হাতে-কলমে নাচ শেখা শুরু হল। এ এক অপূর্ব আনন্দ। বৃদ্ধের জীর্ণ শরীর যেন শুধু তার জন্যেই কথা বলতে শুরু করল। অত্যন্ত ভাগ্যবতী না হলে ওই প্রতিভাবান মানুষের সংস্পর্শে সে আসতে পারত না। নিঃস্বার্থভাবে জ্ঞানের ভাণ্ডার তিনি উন্মুক্ত করে দিচ্ছিলেন তার কাছে। মনে হচ্ছিল এক জীবনে এসব শিখে ওঠা যাবে না। তাতা তার অন্য শিষ্যদের কথা বলতেন। যারা শিষ্যত্ব গ্রহণ করেছিল। সেই সব দেবদাসীর গল্প বলতেন যারা নৃত্যকেই জীবনে বাঁচার একমাত্র পথ বলে মনে করত। তাতা যাদের কাছে শিক্ষা পেয়েছেন সেই সব পূর্বসূরীর কথাও বলতেন। প্রতিটি শব্দ, নৃত্যের প্রতিটি ব্যাখ্যা আশা মনের মধ্যে গেঁথে নিচ্ছিল। আর প্রতি রাত্রে খাতায় লিখে রাখত। সেসব খাতা এখনও রয়েছে কিন্তু পৃথিবী থেকে সেই ভাল মানুষেরা কখন যেন উধাও হয়ে গেছে!

মাঝে মাঝে তাতার ইচ্ছে হলে আশাকে নিয়ে বাইরে বের হতেন। মাঠে দাঁড়িয়ে মায়ের ডাক শুনে ছুটে আসা বাছুরের শরীরের ছন্দ লক্ষ্য করতে বলতেন। লজ্জাবতী গাছের ডালে আঙুল রেখে ওদের কুঁকড়ে যাওয়া এবং শেষে ডালগুলোর মাথা নুইয়ে নেওয়া দেখিয়ে নকল করতে বলতেন। এ এক অপূর্ব অভিজ্ঞতা। তাতা বলতেন আমাদের চারপাশের যে জগত সেখানেই নৃত্যের সব উপকরণ ছড়ানো আছে। যে শিল্পী সে ওই জীবন দেখে নিজেকে তৈরি করে নেয়।

একদিন তাতা তাকে পুঁটুলি বেঁধে নিতে বললেন। তাতার ছেলেদের আপত্তি ছিল। কিন্তু বৃদ্ধ একবার যা সিদ্ধান্ত নিতেন তা বদল করতেন না। অতএব গরুর গাড়ি ডেকে আনা হল। ছেলেরা চেয়েছিল সঙ্গে পরিবারের কেউ যাক। অন্তত নাতি নানা গেলেও নিশ্চিন্ত হতে পারে তারা। কিন্তু তাতা কাউকেই সঙ্গে নিতে চাননি। কেন চাননি তা পরে বুঝতে পেরেছিল আশা। দুজনে গরুর গাড়ির ছই-এর মধ্যে বসে দীর্ঘ পথ অতিক্রম করে কুম্বাকোনামে পৌঁছেছিল। সমস্ত পথ তাতা চোখ বন্ধ করে শুয়েছিল। আর তার পায়ে হাত বুলিয়ে দিচ্ছিল আশা। পৌঁছাবার মুখে তিনি উঠে বসলেন, আমরা এখন যার কাছে যাচ্ছি সে ঈশ্বরের দাসী। নাচ আছে তার রক্তে। কিন্তু ঈশ্বর ছাড়া অন্য কারো সামনে সে কখনো নাচেনি। মনে রেখ প্রকৃত গুণীর সান্নিধ্যে সব সময় তোমার অন্তরকে শক্তিমান করবে। তা তিনি যদি কিছু না দিতে চান তবুও তুমি কিছু পাবে।

আশা অবাক হয়ে দেখল এত কষ্ট করে তাতা যাঁর কাছে এলেন তার বয়স পঁচাত্তর তো হবেই। শরীর বেশ ভারী, চুলে কালো ছোপও নেই। কিন্তু তিনি তাতাকে গাড়ি থেকে নামতে দেখে ছুটে এলেন বাইরে। তাতা মাটিতে দাঁড়ানো মাত্র হাঁটু মুড়ে বসে দুটো হাত বুকে জড়ো করে নমস্কার জানালেন। পরে, অনেক পরে আশা জেনেছে মহিলা একমাত্র ঈশ্বরকেই মাটিতে কপাল ঠেকিয়ে প্রণাম করেন। অভিবাদন সেরে উঠে দাঁড়িয়ে বৃদ্ধা বললেন, আমার কি সৌভাগ্য!

কেমন আছ পুষ্প? তাতা জিজ্ঞাসা করলেন সস্নেহে।

 তাঁর আশীর্বাদে এখনও বেঁচে আছি তাতা। আসুন ভেতরে আসুন।

বাড়িটা ছোট। কিন্তু ভেতরে ঝকঝকে বাঁধানো উঠোন রয়েছে। হাত-পা ধাওয়ার পর তাতা পরিচয় করিয়ে দিলেন, এর কথাই তোমায় বলেছিলাম। আর পুষ্প, এর নাম আশা। এই বয়সে ওই মেয়ে আবার নাচ শেখাতে বাধ্য করেছে।

আপনাকে কেউ বাধ্য করতে পারে না তাতা। নিশ্চয়ই এই মেয়ের ক্ষমতা আছে যার জন্যে আপনি রাজি হয়েছেন। বৃদ্ধা সস্নেহে আশার মাথায় হাত বুলিয়ে দিলেন।

জলযোগ শেষ হলে তাতা বললেন, আমরা এত দূরে এলাম তোমার নাচ দেখতে পুষ্প!

আমার? চমকে উঠলো পুষ্প।

হ্যাঁ। এই মেয়েকে আমি আমার যা কিছু অভিজ্ঞতা দিয়ে যেতে চাই। কিন্তু যেটা আমি নিজে কখনও পারব না সেটা ও তোমার মধ্যে দেখুক। তাতা মাথা দোলাতে দোলাতে বললেন।

লজ্জায় যেন কুঁকড়ে গেলেন বৃদ্ধা, না-না, এ আদেশ করবেন না।

উঁহু, তোমার অভিনয়, ভঙ্গি আর অভিব্যক্তি আর কারো মধ্যে আমি দেখিনি।

কিন্তু এখন যে আমার বয়স হয়ে গেছে। পুষ্প প্রতিবাদ করার চেষ্টা করলেন।

 যে তিনটি বিষয়ের কথা বললাম তা কোনো সময় থামিয়ে দিতে পারে না পুষ্প।

বেশ কাতর চোখে বৃদ্ধা তাতার দিকে তাকালেন। বোঝা যাচ্ছিল তিনি আর অমান্য করতে পারবেন না। পুষ্প মন্থর ভঙ্গিতে চলে গেলেন ঘরের ভেতর। তারপর আসন সুষ্ঠু ভেঙ্কটেশ্বরের ছোট্ট একটা মূর্তি সযত্নে বা নিয়ে এলেন বারান্দায়। একটু সময় নিলেন নিজেকে তৈরি করতে। তারপর আভূমি নত হয়ে দেবতাকে প্রণাম জানালেন। আজ্ঞা নিলেন তাতার কাছ থেকে। তারপর শুরু করলেন।

ওই শরীর, যার সর্বাঙ্গে বয়স জেঁকে বসেছে, আশার কল্পনা কিছুতেই কাজ করছিল না তিনি কীভাবে সক্ষম হবেন। পুষ্প সেই পদ শুরু করলেন যেখানে কৃষ্ণের জন্যে বিরহিণী রাধার আর্তি ফুটে উঠেছে। সেদিন আশা যা দেখেছিল তা এক মুহূর্তের জন্যেও মন থেকে মুছে যায়নি। এখনও চোখ বন্ধ করলে বৃদ্ধার সেই নাচ ভেসে ওঠে। সমস্ত শরীরে শিহরন বয়ে গিয়েছিল তার। দ্যাখো, দেখে শেখো, এই দেখার জন্যেই তোমার জন্ম হয়েছিল। নিজেকে প্রায়ই এই কথা বলতেন তিনি যখনই পুষ্পর কথা মনে পড়ত। নাচের একটি অংশের কথা বিশেষ করে মনে পড়ে যেখানে রাধা এক সহচরীর জন্যে অপেক্ষা করছেন যে কৃষ্ণের বার্তা বহন করে আনছে। শুধু নাকছাবির ওঠা নামা এবং চাহনিতে সেই আর্তি এবং উদ্বেগ ফুটিয়ে তুললেন পুষ্প। কোথাও কোনো মাসল নড়ল না। এই হল প্রকৃত শিল্পীর কাজ। তাতা বলতেন, সবাই নাচে কিন্তু কেউ কেউ শুধু নাচের মাধ্যমে নিজের জগৎ তৈরি করে নিতে পারে।

পাণ্ডানুল্লুর ফিরে আসার পর প্রতিটি দিন শেষ হত আর আশার মনে হত সে ঢেউ-এর ওপরে ভেসে বেড়াচ্ছে। দিনে পনের ঘন্টা অনুশীলন আর ব্যাখ্যা শোনা। সে টের পেত বিশাল কলসির তলায় যেন একটু একটু করে জল জমছে। আর তখনই ঈশ্বর তাকে ভাগ্যহীনা করলেন। এক প্রত্যুষে সে বিছানা ছেড়ে মাটিতে পা দিতেই খবর পেল মা চলে গেছেন। গ্রাম থেকে খবর আসতে, সময় লেগেছে। কিন্তু কাকা তার জন্যে মায়ের দেহ রেখে দিয়েছেন। চিৎকার করে কাঁদতে কাঁদতে সে ছুটে গিয়েছিল তাতার দরজায়। বৃদ্ধ সংবাদটা সম্ভবত আগেই জেনেছিলেন। দুহাতে আশার মাথা বুকে টেনে নিয়েছিলেন। শুধুই কান্না। অনেকক্ষণ কেউ কোনো কথা বলেনি। বৃদ্ধের শুকনো খাঁচার মতো বুকে মুখ রেখে যে শান্তি খুঁজেছিল আশা তার স্মৃতি আজও স্পষ্ট। নিজের বাবাকে খুব অল্প বয়সে হারিয়েছিল সে। কিন্তু তার মধ্যে সে সত্যিকারের পিতাকে খুঁজে পেয়েছিল।

তাতা বলেছিলেন, মন শক্ত রেখো। তোমার মায়ের শরীর তোমার জন্যে অপেক্ষা করছে। যদি পৌঁছে তাঁকে দেখতে না পাও তবু ভেঙে পড় না। পৃথিবীতে সব সময় কষ্ট সইবার জন্যে তৈরি থাকতে হয়। যত তোমার বয়স বাড়বে তত তোমার চেয়ে বয়স্করা বয়স্কতর হবে।

কিন্তু আমার যে কেউ রইল না! ডুকরে উঠেছিল আশা।

সে কী! তোমার নাচ রইল। তোমার নটরাজ রইল। নাচ আর নটরাজের বয়স কখনও বাড়ে না। একদিন তুমি তাদের ছাড়িয়ে যাবে কিন্তু তারা নয়।

সেই সকালেই পাণ্ডানুল্লুর থেকে রওনা হয়েছিল আশা। কিন্তু মায়ের শরীর দেখার সুযোগ পায়নি আর। সেই গ্রাম, সেই বাড়ি একই আছে শুধু তার জন্যে সব সময় ভাবত যে মানুষটা তাকে আজ খুঁজে পাওয়া যাবে না। মৃতদেহ সংরক্ষিত রাখার কোনো বৈজ্ঞানিক সাহায্য না পাওয়ায় কাকা মুখাগ্নি করেছেন। মায়ের খাট, জামাকাপড়, পুরনো ছবি আর তখনও ঘরময় ভেসে বেড়ানো মা গন্ধ নিয়ে কয়েকদিন অঝোরে কেঁদে গেল আশা। তাকে কাঁদতে দিয়েছিলেন কাকা। মায়ের কাজ শেষ হয়ে যাওয়ার পর সে যখন আবার তাতার কাছে ফিরে যেতে প্রস্তুত তখন কাকা কথাটা বললেন। মারা যাওয়ার কয়েকদিন আগে মা নাকি আবার ব্যস্ত হয়ে উঠেছিলেন আশার বিয়ে নিয়ে। একে ওকে ডেকে বলতেন। এবং সেই সুবাদে একটি সুপাত্রের সন্ধান পেয়েছিলেন। ছেলেটি শিক্ষিত। এম. এ পাশ করে স্কুলে শিক্ষকতা করছে। সুদর্শনও। মায়ের এই শেষ ইচ্ছার মূল্য নিশ্চয়ই আশার দেওয়া উচিত। কী জবাব দেবে বুঝতে পারেনি আশা। তখনও চারপাশে মায়ের স্মৃতি এত প্রকট এবং এত বেদনাময় যে চট করে মায়ের বিরোধিতা করতে পারল না সে। কিন্তু কাকা যে তার নীরবতাকেই সম্মতির লক্ষণ ধরে নিয়ে পাত্রপক্ষকে খবর পাঠাবেন তা কে জানত!

সেটা জানতে পেরেই ফুঁসে উঠল সে। কিন্তু তখন ব্যাপারটা এত দূরে এগিয়ে গেছে যে কাকা নিজের এবং পারিবারিক সম্মানহানির ভয়ে খেপে উঠলেন। গৃহস্থের মেয়ে হিসেবে যতটা নাচ শেখা দরকার তার অনেক বেশি শেখা হয়ে গেছে। তাছাড়া নাচ ওকে ভবিষ্যতে কী দেবে? একমাত্র দেবদাসীরাই যৌবনে এই বৃত্তি বাঁচিয়ে রাখে। দেবদাসী লোপ করার বিল যখন উনিশশো দশ সালে পাশ হয়ে গেল তখনই ভরতনাট্যম বিরাট ধাক্কা খেল। সেই উকিল, যার নাম কৃষ্ণ আয়ার, তিনি এগিয়ে না এলে কী হত বলা যায় না। তার মুখে আশা আয়ারের কথা শুনেছে। ভদ্রলোক নাকি মেয়েদের সাজে সেজে মঞ্চে ভরতনাট্যম পরিবেশন করতেন যাতে এই নাচ সম্পর্কে সাধারণ মানুষের ধারণা স্পষ্ট হয়। দেবদাসী নৃত্য মানেই একধরনের পতিতাদের দ্বারা মনোরঞ্জনের নাচ নয়, তাই প্রমাণ করতে উঠে পড়ে লেগে গেলেন ভদ্রলোক। ভরতনাট্যমকে পুনঃপ্রতিষ্ঠিত করার জন্যে মানুষটি নিজেকে উৎসর্গ করেছিলেন। পাত্রপক্ষ কাকাকে জানিয়েছেন, পুত্রবধূ করতে তারা সম্মত কিন্তু পাত্রীকে ওই নাচ বাদ দিতে হবে।

আর এই শর্ত আরও খেপিয়ে তুলল আশাকে। এরা ভাবে কী! কে বলেছে সময় পাল্টে গেছে? কৃষ্ণ আয়ারজীকে তখন যে বিরোধিতার সামনে দাঁড়াতে হয়েছিল তার নিদর্শন তো আজকেও। লন্ডনের মিস টেনান্ট যদি এগিয়ে এসে জনমত তৈরি করতে সাহায্য না করতেন এবং উনিশশো সাতাশ সালে মাদ্রাজে সর্বভারতীয় কংগ্রেস সম্মেলনে সমাজ সংস্কারকদের সামনে সঙ্গীত সম্মেলনের ব্যবস্থা যদি আয়ার না করতেন তাহলে কী হত কে জানে। উনিশশো বত্রিশ সালের ডিসেম্বর মাদ্রাজের মুখ্যমন্ত্রীর সম্মানে একজন দেবদাসীর দ্বারা ভরতনাট্যমের ব্যবস্থা হল। খবরের কাগজে এই নিয়ে প্রচুর বিতর্ক হয়। এর এক বছর আগে আয়ার সাহেব কল্যাণী কন্যাদের দিয়ে প্রথম মঞ্চে নাচিয়েছিলেন। এক বছর বাদে তার পুনরাবৃত্তি করেন। এবং সেই থেকে সমস্ত বিরোধিতাকে নস্যাৎ করে ভরতনাট্যম তার স্বমহিমায় প্রতিষ্ঠিত হল। তাতা এসব কথা তাকে বলেছিলেন। কিন্তু জীবনে এর বিপরীত ছবি দেখতে পাচ্ছে সে।

আশা স্পষ্ট জানিয়ে দিল সে কিছুতেই নাচ ছাড়বে না। বস্তুত মায়ের কাজ শেষ হয়ে যাওয়ার পর সে নিয়মিত অনুশীলন করে যাচ্ছিল। বিরোধ যখন তুঙ্গে তখন কাকা এলেন তার ঘরে। আশা তখন অনুশীলন করছে। দরজায় দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে শেষ পর্যন্ত চলে গেলেন তিনি। ওই প্রথম তাঁর মনে হল কোনো আত্মমগ্ন মানুষকে বিরক্ত করা ঠিক নয়। কিন্তু সেদিন তিনি নৃত্যরত আশার মধ্যে কী দেখেছিলেন তিনিই জানেন, কারণ বাড়ির সবাইকে উদ্বিগ্ন রেখে কাকা ফিরে এসেছিলেন পরের দিন। এসে জানিয়েছিলেন বিবাহ বাতিল করে দিয়ে এসেছেন তিনি। পাত্রপক্ষকে কী কারণ দেখিয়েছিলেন তা কোনোদিন জানা হয়নি আশার।

পাণ্ডানুল্লুরে ফিরে যাওয়ার দিন ঠিক করতে করতে বেশ সময় চলে গিয়েছিলেন। কাকা যখন তাকে নিয়ে পাণ্ডানুল্লুরে পৌঁছালেন তখন আশা জানত না তার জন্যে কী অপেক্ষা করছে। সেই ভোরেই সমস্ত গ্রাম যেন প্রাণহীন। রাস্তায় লোক নেই। ঘরদোর বন্ধ। এমন কী মাঠে গরুগুলোও ডাকছে না। তার বাড়ির সামনে পৌঁছাতে হল না। দূর থেকেই ওরা দেখতে পেল সমস্ত গ্রামের মানুষ বাড়ির সামনে মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে রয়েছে। কাকা দাঁড়িয়ে পড়লেন সহসা, আর বুঝতে একটুও অসুবিধে হল না আশার। সে ছুটে গেল মানুষের ভিড় বাঁচিয়ে দরজায়।

তাতা শুয়ে আছেন মাদুরে। তাঁর ছেলেরা কাঁদতে কাঁদতে শবযাত্রার আয়োজন করছে। মেয়েরা কাঁদছে সুর করে। নানা পিল্লাই বসে আছে তার ঠাকুর্দার মাথার পাশে। তার চোখ বন্ধ। দরজায় দাঁড়িয়ে সেই মুখের দিকে তাকিয়ে অবশ হয়ে গেল আশা। পৃথিবীর সব কিছু বিস্মরিত হয়ে শুধু মনের পর্দা জুড়ে ওই মুখ। সে তার মায়ের মৃতদেহ দ্যাখেনি। বস্তুত পিতার মৃত্যুর সময় তার বোধ পরিস্ফুট হয়নি। এখন তাতার মুখের দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে তার মনে হল প্রকৃত সন্ন্যাসীর অভিব্যক্তি এই রকম হওয়া উচিত। কোথাও কোনো সঙ্কোচন নেই। একটি মাসলও নড়ছে না। জীবনের সমস্ত আসক্তি ত্যাগ করে নিজেকে সবকিছুর উর্ধ্বে তুলে নেওয়ার সক্ষমতা এখন তাতার মুখে। কোনো সুখ অথবা দুঃখ হাজার চেষ্টা করলেও তাকে স্পর্শ করতে পারবে না।

মাঝে মাঝে শহরেও অদ্ভুত কাণ্ড ঘটে। জ্যোৎস্নার রাত্রে একজোড়া সাদা লক্ষ্মীপ্যাঁচা উড়ে আসে কোনো গোপন আস্তানা থেকে। এসে বসে ব্যালকনির রেলিঙে। বসে থাকে চুপচাপ। ওরা সম্ভবত এখন আশাকে ভয় পায় না। এই এখনই ওরা এল। দুটো পাখি যাদের দেখতে কখনই তার খারাপ লাগে না। সাদা রঙের আভিজাত্য এবং সারল্য সমস্ত খুঁত ঢেকে দিতে পারে। আশা নড়ে বসলেন। এখনও তাতার সেই মুখ সামনে। সারা জীবন ধরে চেষ্টা করে গেছেন নাচের বিশেষ মুহূর্তে ওই অভিব্যক্তি ফুটিয়ে তুলতে। কিন্তু না তার নাকে স্পন্দন শূন্য হয়েছে, না গালের কাঁপুনি। কীভাবে মুখের সমস্ত বোধ অসাড় করে আর একটি অর্থ ফুটিয়ে তোলা যায় তা তিনি আজও বুঝে উঠতে পারলেন না।

তাতার মৃত্যু তার জেদ আরও বাড়িয়ে দিয়েছিল। পর পর দুজন গুরুর কাছে শিক্ষা নিলেন তিনি। এবং তারপর মাদ্রাজের মিউজিয়াম থিয়েটারে তাঁর প্রথম নৃত্যপ্রদর্শনীর আয়োজন হল। আর সেই সূত্রেই তীর্থনারায়ণের সঙ্গে তার আলাপ। মাদ্রাজে তীর্থের নাচের স্কুল ছিল। এক কালে সে তাতার কাছে কিছুদিন নাচ শিখেছিল। আশার কথা কানে এসেছিল। সে এগিয়ে এসে প্রস্তাব দিয়েছিল একক নৃত্যের অনুষ্ঠান করার জন্যে। প্রতিটি শিক্ষার শেষে একটা সময় আসে, যখন শিক্ষার্থী নিজেকে প্রকাশ করতে চায়, তীর্থের প্রস্তাব এল আশার সেই সময়ে। অন্তত দশ বছরের বড় ছিল তীর্থ। কিন্তু মেদহীন শরীরে একটা তকতকে ভাব থাকত সব সময়। কাকার আশীর্বাদ নিয়ে সম্মতি জানাল সে। জীবনে প্রথমবার দর্শকের সামনে নিজের নাচ দেখাতে যাওয়ার আগে খুব নার্ভাস হয়ে গিয়েছিল আশা। তীর্থ তাকে সান্ত্বনা দিত। মাত্র মাসখানেকের আলাপেই তীর্থ তার সঙ্গে এমন ব্যবহার করতে আরম্ভ করল যেন সে অনেক দিনের চেনা। উৎসাহ দেখাবার উৎসাহে সে আশাকে অনেক কথা বলত। সমবয়স্ক মানুষের সান্নিধ্যে এত পুলকিত সে কখনও হয়নি। এবং এই প্রথম মনে হয়েছিল পৃথিবীতে তার নিকট কোনো আত্মীয় নেই। বয়সের কারণে কাকাকে সব জায়গায় সে পায় না। তাছাড়া যেসব জায়গায় প্রিয়স্মৃতি জড়ানো সেখানে প্রিয়মানুষটির মৃত্যুর পরে ফিরে যাওয়ার কথা চিন্তা করত না সে। ফলে তীর্থের ওপর তার নির্ভরতা বাড়ল। তীর্থ যখন বলল, তোমার মতো মেয়ের সন্ধানে ছিলাম আমি যে ভরতনাট্যমকে ভারতবর্ষের সব প্রান্তে ছড়িয়ে দেবে। তখন কী ভালই না লেগেছিল।

পুরনো গয়না, হলুদ রঙের ফুল, কালো কাপড়ে ব্যাক স্টেজ সাজিয়ে তাতে কমলা রঙের আলো আর বিশেষ ছাঁদের কোরানাডু শাড়ি নিয়ে সে উপহার দিল অনুষ্ঠানটি। অনামী একজন নৃত্যশিল্পীর নাচ দেখতে তেমন ভিড় হয়নি। কিন্তু তীর্থ শহরের কিছু নামী মানুষ এবং দামি খবরের কাগজের সাংবাদিকদের উপস্থিত করতে পেরেছিল। অনুষ্ঠানের শেষে যে হাততালি পড়েছিল তা ছড়িয়ে পড়ল সমস্ত ভারতবর্ষে। তারপর থেকে আর তাকে পেছন ফিরে থাকতে হয়নি। তাতা এবং আরও বিখ্যাত দুই গুরুর যোগ্য শিষ্যা হিসেবে তাকে মেনে নিল পণ্ডিত সমাজ। প্রচলিত ভরতনাট্যম থেকে তার নাচ কিছুটা আলাদা। তার কাছ থেকে পাওয়া ক্লাসিক্যাল ফর্মের সঙ্গে নিজস্ব বুদ্ধির প্রয়োগ তাকে এই স্বাতন্ত্র্য এনে দিল। আর তখনই শুরু হল তীর্থের সঙ্গে মনোমালিন্য।

তাতা তাকে একদিন বলেছিলেন, কখনও শুধু অর্থের জন্যে নাচবে না। আরও ভাল থাকা-পরার জন্যে লালসা যেন তোমাকে নাচতে বাধ্য না করে। কখনই ভেব না যে সব শিখে গেছ। নিজেকে শিক্ষিত না করা পর্যন্ত তুমি স্বাচ্ছন্দ থেকে দূরে থাকবে। আর কে না জানে শিক্ষার কখনও শেষ। নেই। কথাগুলো মেনে নিয়েছিল আশা। তাই যখন তীর্থ সাফল্যের গন্ধ পেয়ে একের পর এক অনুষ্ঠান করতে চাইল সে আপত্তি করল। তীর্থ বলেছিল, লোহা গরম থাকতে থাকতে আঘাত করতে হয়। এখন তোমার নাম সব কাগজে বড় জায়গা নিচ্ছে। এই সময় অনুষ্ঠান করলে হু হু করে টিকিট বিক্রি হবে, এটা বুঝছ না কেন?

আশা মাথা নেড়েছিল, না। আমার তো বেশি টাকার প্রয়োজন নেই। আর তেমন যদি দরকার কখনও হয় তাহলে আমি অন্য কাজ করব। কিন্তু নিজেকে সম্পূর্ণ তৈরি করার আগে নেচে টিকিট বিক্রি করতে পারব না।

ক্ষিপ্ত হয়ে তীর্থ বলেছিল, তুমি একটা পাগল।

নটরাজ যেন এই পাগলামি আমাকে চিরকাল দিয়ে থাকেন। তীর্থ তাকে অনেক অনুনয় করেছিল। শেষ পর্যন্ত, বলেছিল, আমার কথা তোমাকে শুনতেই হবে। আমার ইচ্ছের কোনো দাম নেই তোমার কাছে?

নিশ্চয়ই আছে। কিন্তু আমার আদর্শের বিনিময়ে নয়।

আমাদের দুজনের আদর্শ আলাদা হতে পারে না। যেখানে আমি আমার সব কিছু তোমার জন্যে নিয়োগ করছি সেখানে তুমি আমাকে অমর্যাদা করতে পার না। তাছাড়া এসব আমি করছি আমাদের ভবিষ্যতের জন্যে।

আমাদের ভবিষ্যৎ?

নিশ্চয়ই। তুমি কী বুঝতে পার না আমি তোমাকে নিয়েই–একটা ঠোঁট টিপল তীর্থ, কীভাবে বলা যায় আমি তোমাকে ভালবাসি।

বোধে ছিল কিন্তু সেই প্রথম নিজেকে প্রকাশিত করল তীর্থ। আর সমস্ত শরীর মন এক অজানা অনুভূতিতে ঝঙ্কার দিয়ে উঠল। এই প্রথম কোনো পুরুষ তাকে স্পষ্ট ভালবাসার কথা বলল। মুখ নামিয়েছিল আশা। এরপরে তীর্থ যা চাইছে তা না করা কী উচিত হবে। কিন্তু সেই মুহূর্তেই তীর্থ উচ্চারণ করল, ভেবে দ্যাখ আমি যদি এগিয়ে এসে তোমার অনুষ্ঠানের আয়োজন না করতাম তাহলে কোথায় থাকতে তুমি! তুমি যত বড় গুণীই হও না কেন যদি ঠিকমতো উপস্থাপিত না হতে পার তাহলে কখনই প্রথম সারিতে উঠে আসতে পারবে না। এ ব্যাপারে আমার ভূমিকা ভেবে দ্যাখ।

আর মন স্থির করতে ইতস্তত করেনি আশা। সে তীর্থের মুখের দিকে তাকাল, তোমার প্রতি

[পরের দুই পেজ মিসিং]

এই সময় কমলা এল তাকে সাহায্য করতে। তিনি উদাস গলায় জিজ্ঞাসা করলেন, হ্যাঁরে কমলা, আমি কি এবার বুড়ি হতে চললাম?

থমকে দাঁড়াল কমলা। আয়নায় সে আশাকে দেখল। সঙ্গে সঙ্গে তার মাথা দুলল। প্রতিবাদে বলল, যে বলবে তার চোখের ছানি কাটাতে বলল। এমন শরীর শুধু অপ্সরারাই পেয়ে থাকেন।

অঙ্গরা? থমকে গেলেন আশা।

নিশ্চয়ই দেবীদের চেহারা তো ভাল নয়, কয়েকজনকে বাদ দিলে আর সবাই খুব আটপৌরে, দেবতাদের আনন্দ দিতে তাই অপ্সরাদের সৃষ্টি। তাদের চেহারার সঙ্গে কার তুলনা। তুমি যেদিন স্বর্গে যাবে সেদিন ঠিক উর্বশীর চাকরি থাকবে না।

ঠোঁট কামড়ালেন তিনি। আজকাল কমলাও মন-জোগানো কথা বলে। কিন্তু উর্বশী? কী নাচ নাচত সে? দেবতা ছাড়াও যে মহিলা ঘন ঘন মুনি-ঋষিদের শরীরের সঙ্গ পাওয়ার জন্যে ছটফট করত সে বড় নাচিয়ে হতেই পারে না। উর্বশীর সঙ্গে তার তুলনা করে বেচারা কমলা তাকে ছোটই করল।

কিন্তু সাজ সম্পূর্ণ হওয়ার পর নিজের দিকে তাকিয়ে চমকৃত তিনি। সেই বালিকা যার হাত ধরে মা নিয়ে গিয়েছিলেন গ্রামের শিক্ষকের কাছে যাতে নিয়মিত অসুস্থতা থেকে মেয়ে মুক্তি পায় নাচ শিখে, সে কখন হারিয়ে গিয়েছে। তার বদলে এক অনির্বচনীয় আনন্দ সামনে দাঁড়িয়ে। টার্নার ওর নাচ দেখে একবার লিখেছিল আশার শরীর যেন ইস্পাত এবং সিল্কের মিশ্রণ। শুধু মুখের গড়নে কিছু ভ্রান্তি আছে। তা থাক। ঈশ্বর ওঁর শরীর গড়তে এত ব্যস্ত ছিলেন যে মুখের সৌন্দর্য সঠিক করতে সময় পাননি।

হ্যাঁ। আশা মাথা নাড়লেন। তার চোয়াল একটু বেশি চওড়া। ঠোঁট বেশ পুরু। খুঁটিয়ে দেখলে তবেই এসব নজরে পড়ে। নইলে পঁচিশ বছর ধরে তার কাছে ছবিতে নামার প্রস্তাব আসছে কেন। এখনও কেউ কেউ তাকে নায়িকা করতে চান। মানুষগুলোর কিছুতেই খেয়াল হয় না যে তিনি পঞ্চাশে পৌঁছে গেছেন। অবশ্য এই সাজে দেখলে তা খেয়ালে আসার কথাও নয়। আজকাল বাইশে পৌঁছেই মেয়েরা কোমরে পাশবালিশের মতো চর্বি জমিয়ে নেয়। বিয়ের পর কাঁধ পিঠ থেকে শুরু করে সর্বত্র প্লাবন ডেকে আনে। শরীর রাখতে তো পরিশ্রম করতে হয়; তাতে এদের অনীহা। এরা কী করে সুন্দর থাকবে। সঙ্গে নিয়ে আসা নটরাজের মূর্তির সামনে দাঁড়িয়ে তিনি চোখ বন্ধ করলেন। চোখের পর্দায় এখন নটরাজের মুখ। মুখ ক্রমশ মিশে গেল মনে। সঙ্গে সঙ্গে জগৎ বিস্মৃত হয়ে গেলেন। এখন তার সমস্ত শরীরে নাচ। সমস্ত শরীরে নটরাজের স্পর্শ। ঈশ্বর যেন দেখে নিচ্ছেন তাঁর সৃষ্টিকে।

কাশ্মিরী শালে শরীর জড়িয়ে আশা গাড়ি থেকে নামলেন। ভিড় সরিয়ে উদ্যোক্তারা তাকে নিয়ে গেল মঞ্চের পাশে। নাচের আগে একটি ছোট্ট অনুষ্ঠান। তার পদ্মভূষণ প্রাপ্তি উপলক্ষে উদ্যোক্তারা একটা সংবর্ধনা দিতে চান। এ ধরনের প্রস্তাব আগে জানানো হয়নি তাঁকে। আশা মিস্টার আয়ারের দিকে তাকালেন। মিস্টার আয়ার বুঝে গেলেন। তিনি বললেন, মিস রাও নাচের অনুষ্ঠানে এসে ঈশ্বরের আরাধনা করেন, সেখানে নিজের সংবর্ধনা নেওয়ার প্রশ্নই ওঠে না।

উদ্যোক্তারা হকচকিয়ে গেল। একজন মন্ত্রী এসে অপেক্ষা করছেন এই উপলক্ষে। সমস্ত আয়োজন সম্পূর্ণ। উপহার হিসেবে আসামের নিজস্ব কিছু শিল্পসামগ্রী আনা হয়েছে। কিন্তু উইংসের পাশ থেকে ওঁকে নাড়ানো যাবে না। শেষ পর্যন্ত মিস্টার আয়ার প্রকাশ করলেন ঘটনাটা। শোনার পর উদ্যোক্তাদের নেতা মঞ্চে গিয়ে ঘোষণা করলেন, আমরা শ্রীমতী আশা-রাও এর নৃত্যানুষ্ঠান শুরু করার আগে কেন্দ্রীয় সরকার কর্তৃক পদ্মভূষণ হিসেবে তার স্বীকৃতির জন্যে একটি সংবর্ধনানুষ্ঠানের আয়োজন করেছিলাম। মাননীয় সমাজকল্যাণ মন্ত্রী এই উপলক্ষে এসেছিলেন। কিন্তু নীতিগত কারণে আশাদেবী এই সংবর্ধনা নিতে অস্বীকার করেছেন। কেন্দ্রীয় সরকারকে তিনি কয়েকটি বিষয়ে নিজের বক্তব্য জানিয়েছেন। তার উত্তর না পাওয়া পর্যন্ত তিনি এই সম্মান গ্রহণ করতে রাজি নন। অতএব অনুষ্ঠানটি বাতিল করতে হল, কিন্তু সেই সঙ্গে আমি আশাদেবীকে অনুরোধ করছি ভরতনাট্যম সম্পর্কে তাঁর মুখ থেকে আমরা দুচার কথা শুনতে চাই। সঙ্গে সঙ্গে প্রেক্ষাগৃহ করতালিতে সোচ্চার হল।

ঘোষণা কানে আসা মাত্র চকিতে মিস্টার আয়ারের দিকে তাকালেন আশা। চাপা গলায় বললেন, এর পরের অনুষ্ঠানে এই ধরনের ঘটনা যাতে আর না ঘটে তা দেখা আপনার কর্তব্য হবে। তারপর শালটাকে খুলতে গিয়ে মত পরিবর্তন করলেন। উদ্যোক্তারা তখন হাসিমুখে এগিয়ে এসেছে তাকে মঞ্চে নিয়ে যাওয়ার জন্যে। আশা শাল এমনভাবে জড়িয়ে নিলেন যাতে দর্শকরা শুধু তাঁর মুখ দেখতে পায়। তিনি মঞ্চে ঢোকামাত্র আবার করতালি শুরু হল। মাইকের সামনে পৌঁছে তিনি কয়েক সেকেন্ড সময় নিলেন। তারপর সামান্য মাথা ঝুঁকিয়ে বললেন, এই প্রেক্ষাগৃহে যাঁরা আমার চেয়ে বয়স্ক তাদের নমস্কার এবং অন্যান্যদের অভিবাদন জানাচ্ছি। আমি একজন সামান্য নৃত্যশিল্পী। বক্তানই। ভরতনাট্যমের তত্ত্ব নিয়ে পণ্ডিতরা আলোচনা করতে পারেন, আমার সে যোগ্যতা নেই। আপনারা আমার নাচ দেখতে এসেছেন এটা খুব আনন্দের কথা। আমি শুধু এই বিষয়েই কয়েকটা কথা বলতে পারি। আশা চোখ বন্ধ করলেন, প্রায় তিন হাজার বছর ধরে ভরতনাট্যম তার স্বকীয়তা বজায় রেখে বেঁচে আছে। হাতের মুদ্রায় ফুল তার পাপড়ি মেলে, আঙুলের ডগায় পাখি তার ডানা মেলে। শরীর কেঁপে ওঠে কখনও অহঙ্কারে কখনও সমর্পণে। মুখের প্রতিটি পেশী কথা বলে, চোখের অভিব্যক্তি তার সঙ্গে সঙ্গত করে। কিন্তু সমস্ত মুখ এই মুহূর্তে যে অভিব্যক্তি প্রকাশ করল পরের নিঃশ্বাস তার বিপরীত অর্থ ছড়িয়ে দিল। কিন্তু এই নাচ কখনই সম্পূর্ণ নয় যদি তার সঙ্গে কবিতা অথবা গান এসে না যুক্ত হয়। একটি গাড়ির চাকা, ইঞ্জিন, স্টিয়ারিং যেমন আলাদা ভাবে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এবং তারা একত্রিত হতেই গাড়ি চলে, তেমনি ভরতনাট্যমের নাচ গান ও বাজনা অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত। দুঃখের কথা, এই মুহূর্তে ষাট কোটি মানুষের দেশ ভারতবর্ষে প্রকৃত উঁচুমানের ভরতনাট্যম শিল্পীর সংখ্যা মুষ্টিমেয়। একমাত্র তামিলনাড়ু যেখানে শতকরা দশ ভাগ মানুষ এই ঐতিহ্যবাহী নাচকে অনুধাবন করতে পারেন, কিন্তু তার বাইরে সমস্ত দেশে এর প্রকৃত সমঝদার পাওয়া দুর্লভ ঘটনা। ভারতবর্ষের যে সব বড় শহরে আমি নাচতে গিয়েছি সেখানেই দেখেছি একমাত্র বুদ্ধিজীবী এবং শিল্পসচেতন মানুষরাই অনুষ্ঠান দেখতে আসেন। এঁরা নাচ দেখে চমৎকার সুন্দর বাহবা ইত্যাদি বিশেষণ প্রয়োগ করেন। অনেক সমালোচক কাগজে প্রশংসা অথবা নিন্দা লিখে থাকেন। কিন্তু কী করে তারা এসব কাজ করেন! আত্ম-অহঙ্কারে তাঁরা ভুলে যান এই নাচের সঙ্গে যে গান গাওয়া হয় তার ভাষা জানা না থাকায় অর্থ বোঝা সম্ভব হচ্ছে না। গানের অর্থ বোঝা না গেলে শিল্পী তার নাচে ঠিক কি ফুটিয়ে তুলছে তা শুধু অনুমানেই ধরতে হচ্ছে। মূকাভিনয় দেখলে নিজের ইচ্ছেমতন কল্পনা করে নেওয়া যায়। কিন্তু শিল্পী যেখানে গানের মধ্যে দিয়ে বলা একটি বিশেষ ভাবকে ফুটিয়ে তুলছেন সেখানে তার কল্পনা কী করে পৌঁছাবে। তিনি শরীরের কয়েকটি ভঙ্গি, হাতের মুদ্রা, যতি এবং অভিব্যক্তি বুঝতে পারেন, কিন্তু কোন কারণে সেগুলো ঘটছে তা স্পষ্ট হতে পারে না। হিব্রু ভাষায় তোলা কোনো ছবি দেখতে গিয়ে আমরা যেমন মূলের বিশভাগ অনুধাবন করতে পারি, এও তেমনি।

আমি জানি শুধু একটি নাচ বোঝার জন্যে অপরিচিত ভাষা শিখে নেওয়া বাস্তব ব্যাপার নয়। যখন মাত্র বিশভাগ বুঝেও আপনারা এইভাবে আমাদের নাচ দেখতে সময় দেন তখন সেটাকে আমি ঈশ্বরের আশীর্বাদ বলেই মনে করি।

পরের দিন খবরের কাগজে ঐ নিয়ে লেখালেখি হয়েছিল। মানা হচ্ছে ভরতনাট্যমের সঙ্গে দক্ষিণী ভাষায় গানও কবিতা বলা হয়ে থাকে এবং সে সব অনেকেরই বোধগম্য হয় না কিন্তু এসব উল্লেখ করে আশা রাও কী দর্শকদের অজ্ঞানতাকে খোঁচা দিতে চেয়েছিলেন। তার কথার মধ্যে যে জ্বালা ছিল তা তো অনেকেরই কানে বেজেছে। অতএব এর পরে যে নৃত্য তিনি পরিবেশন করেন তার সমালোচনা করতে দ্বিধা আসে। শুধু বলা যেতে পারে তার অভিব্যক্তি, মুদ্রা এবং শরীর সঞ্চালন চমকপ্রদ, এই বয়সেও। নাচ মানুষের কোনো একটি বিশেষ প্রয়োজনে সৃষ্টি হয়নি। প্রায় চব্বিশশো বছর আগে ভরত নাট্যশাস্ত্রে এই কথাটি স্পষ্ট করে গেছেন। তিনি লিখেছেন, নাচের প্রয়োজন হয়েছিল সৌন্দর্য সৃষ্টির তাগিদ থেকে। যেহেতু সর্ব শ্রেণীর মানুষ নাচ দেখতে ভালবাসে তাই এর পবিত্রতা অনস্বীকার্য। নাচ আনন্দের উৎস। বিবাহ, শিশুর জন্ম, এমন কী জামাতার আগমনেও মানুষ নৃত্যকে ব্যবহার করে থাকে। বেঁচে থাকার সবরকম আনন্দের সঙ্গে যখন নাচ মিশে রয়েছে, তখন ভাষা বোঝার অক্ষমতা বড় অন্তরায় হয়ে উঠতে পারে না।

বক্তৃতা শেষ করে গ্রীনরুমে চলে গিয়েছিলেন তিনি। পর্দা ফেলে শেষবার মঞ্চ দেখে নিচ্ছিলেন। মিস্টার আয়ার। নাচের জন্যে শেষ মুহূর্তের প্রস্তুতি সেরে নিচ্ছিলেন আশা। মিস্টার আয়ার গিয়ে তাঁকে জানালে তিনি আসবেন মঞ্চে। এই সময় উদ্যোক্তাদের একজন ছুটে এল মিস্টার আয়ারের কাছে। ট্রাঙ্ককল এসেছিল হোটেলে, অপারেটার খবর রেখে সেই লাইনটাকে আবার প্রেক্ষাগৃহে ট্রান্সফার করে দিয়েছে। দ্রুত পা ফেলে অফিসঘরে ঢুকে টেলিফোন ধরলেন মিস্টার আয়ার। একটু বাদে ও পাশে শ্রীনিবাসের গলা পাওয়া গেল। সে বলল একটু আগে দিল্লি থেকে টেলিফোন এসেছিল। তারা জানিয়েছে যে পদ্মভূষণ উপাধিদানের অনুষ্ঠানে আশা রাও-এর সহশিল্পীরা অতিথি হিসেবে উপস্থিত থাকতে পারেন কিন্তু তাদের সবাইকে একই মর্যাদা দেওয়া সম্ভব নয়। নানা পিল্লাই-এর কোনো চিঠি বা খবর এখনও এসে পৌঁছয়নি।

রিসিভার নামিয়ে রেখে এক মুহূর্ত চিন্তা করলেন মিস্টার আয়ার। এখন আশার স্টেজে আসার সময় হয়ে গিয়েছে। এই সময় তাকে খবরটা জানানো ঠিক হবে কিনা বুঝতে পারলেন না। ব্যাপারটা আশা সহজভাবে নিশ্চয়ই নেবেন না। এবং তার ফলে যদি নাচ খারাপ হয়ে যায়? আবার তিনি তো পরে জানতেই পারবেন কখন আয়ার খবরটা পেয়েছিলেন। ফলে প্রশ্ন করতেই পারেন, তখনই সেটা ওকে জানানো হয়নি কেন?

দোটানায় না থেকে মিস্টার আয়ার সোজা এগিয়ে গেলেন গ্রিনরুমের দিকে। সেখানে কিছু উৎসাহী কর্মীর ভিড়। তাদের সরিয়ে দরজায় টোকা দিতে কমলা সেটা খুলল। ঘরের ভেতর ঢুকে রুমালে মুখ মুছলেন মিস্টার আয়ার। উঠে দাঁড়ালেন আশা, সব ঠিকঠাক আছে?

আজ্ঞে হ্যাঁ, মিস্টার আয়ার বললেন বটে কিন্তু তার মুখে অন্য ছাপ ফুটল।

বলুন। চোখ চোট ছোট করলেন আশা।

শ্রীনিবাস টেলিফোন করেছিল।

 সঙ্গে সঙ্গে উজ্জ্বল হলেন আশা, নানার খবর এসেছে?

আজ্ঞে না। দিল্লি জানিয়েছে আপনার প্রস্তাব মেনে নেওয়া সম্ভব নয়। বলেই ফেললেন আয়ার। তারপর দেখলেন আশা বাসন্তীকে ইঙ্গিত করলেন তাঁকে অনুসরণ করে স্টেজে যেতে। আয়ারের পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় একমুহূর্তে দাঁড়িয়ে বললেন, ওদের জানিয়ে দিন আমি উপাধি গ্রহণ করতে অক্ষম।

রাত্রে হোটেলে ফিরে তিনি যখন বিশ্রাম নিচ্ছেন তখন কমলা জানান শাস্ত্ৰীজী এবং বিজয়লক্ষ্মী তাঁর সঙ্গে কথা বলতে চান। ব্যাপারটি অভিনব। সঙ্গীত এবং নৃত্যবিষয়ক আলোচনা ছাড়া এই মানুষ দুটি কখনই তাঁকে বিরক্ত করেন না। এমন কী তার ব্যক্তিগত ব্যাপারে কথা বলতে কখনই ওঁদের দেখা যায়নি। শাস্ত্ৰীজী মাদ্রাজের মানুষ নন, কিন্তু দীর্ঘকাল এই প্রদেশে বাস করে নিজেকে চমৎকার মানিয়ে নিয়েছেন। তিনি কথা বলেন কম, বাজানোর সময় যেন সুরদেবীকে তাঁর হাতে ভর করেন।

তিনি আজ বিপরীত আচরণ করলেন। সোজা নিজের ঘর থেকে বেরিয়ে শাস্ত্রীজী এবং মিস্টার আয়ার যে ঘরে আছেন সেখানে চলে এলেন। গিয়ে দেখলেন শ্রীমতী বিজয়লক্ষ্মী সেখানে বসে কথা বলছেন। ওঁকে দেখে তিনজনই অপ্রতিভ। শাস্ত্ৰীজী বললেন, আপনি কেন এলেন, আমরাই তো দেখা করব বলেছিলাম।

আশাকে ছেড়ে দেওয়া চেয়ার তিনি গ্রহণ করলেন না। একথার জবাব দেওয়ার আগ্রহও দেখা গেল না। তিনি হাসিমুখে তাকালেন যেন এই সবই অতি সাধারণ ঘটনা।

শাস্ত্ৰীজী বললেন, আমি কখনও আপনার ব্যক্তিগত ব্যাপারে কথা বলিনি। কিন্তু এবার পরোক্ষে জড়িয়ে আছি বলেই না বলে পারছি না। আপনাকে অনুরোধ করছি যাতে ওই সিদ্ধান্ত গ্রহণ না করেন। আপনার প্রতি ভারত সরকার যে সম্মান দেখিয়েছেন তা সমস্ত দেশের মানুষের হয়ে দেওয়া। সামান্য অভিমানের কারণে তা প্রত্যাখ্যান করবেন না।

একবার চোখ ছোট হল তাঁর, নিমেষের জন্যে, তারপর মুখ স্বাভাবিক।

শ্ৰীমতী বিজয়লক্ষ্মী বললেন, আপনি আমাদের যে সম্মান দিয়েছেন তাতেই আমরা গর্বিত। কিন্তু সেই কারণে আপনি বঞ্চিত হলে আমাদের লজ্জার সীমা থাকবে না।

মাথা নিচু করলেন আশা, তারপর বললেন, জীবনের কিছু কিছু অনুভূতি এত কোমল যে তা নিয়ে কথা বলতে গেলে ভেঙে চুরমার হয়ে যেতে পারে। মোহিনী আট্টমে কর্ণের একটা উক্তি আমার খুব ভাল লাগে, আমি আমার মায়ের স্নেহ থেকে বহুদূরে চলে এসেছি। ঠিক তাই। আপনাদের প্রতি শ্রদ্ধা রেখেই বলছি, যা চলে গিয়েছে তাকে আর টেনে আনতে বলবেন না।

শাস্ত্ৰীজী মুখ তুললেন। তাঁর চোখে বিস্ময়। আশা বললেন, আমরা আগামীকাল এমন একটা অনুষ্ঠানে যোগ দিতেভারতবর্ষের আর এক প্রান্তে যাব যা ইদানীং অভিজ্ঞতায় নেই। নিউইয়র্ক, লন্ডন, কলকাতা, দিল্লির কথা ভুলে যান। মনে করবেন আমি একটি পূজায় যাচ্ছি। তিনি কথা শেষ করে বেরিয়ে যেতে যেতে থমকে দাঁড়ালেন, এই পূজায় মাথা নিচু করার আনন্দ যে কোনো পুরস্কারের চেয়ে অনেক গুণ বেশি মূল্যবান।

মিস্টার আয়ার বলে উঠলেন, কিন্তু পাণ্ডানুল্লুর থেকে আর কোনো চিঠি আসেনি এখনও!

 না আসুক! রক্তের অধিকার যে কেউ কেড়ে নিতে পারে, কিন্তু সুরের অধিকার? আমি ওই মাটিতে না পৌঁছালে শান্তি পাব না আয়ার সাহেব। আপনি সমস্ত ব্যবস্থা করে ফেলুন। নমস্কার। লম্বা ছিপছিপে শরীরটি ঋজু পায়ে হেঁটে বেরিয়ে গেল ঘর থেকে।

.

গৌহাটি শহরের জন্যে কোনো বিশেষ টান আশার নেই। আসলে হোটেলের ঘরে ঢুকে গেলে সেই শহরের কোনো বিশেষ আকর্ষণ না থাকলে কখনই বাইরে পা বাড়াননি তিনি। খোদ নিউইয়র্কে তিনি সময় কাটিয়েছেন ঘরে কিংবা ব্যালকনিতে যখন রিহার্সাল বা অনুষ্ঠান করতে হয়নি। অনর্থক ঘোরাঘুরি তার কখনই ভাল লাগেনি। রাত্রে যে সব শিল্পকীর্তি আলোয় সাজিয়ে সুন্দর করে তোলা হয় তা দেখার আগ্রহ মনেই আসে না। আর ওই সব ছাড়াতো পৃথিবীর সমস্ত শহর মোটামুটি একই চরিত্রের। আজ হোটেলের বিছানায় শরীর এলিয়েই তাঁর কলকাতার কথা মনে পড়ল। পাণ্ডানুল্লুর থেকে ফিরে কলকাতায় আসতে হবে। অনেক কাল পরে কলকাতায় যাওয়া। অথচ এক সময় প্রায় প্রতি বছরই তাকে যেতে হত ওই শহরে। সবাই বলত কলকাতার সমঝদারের বাহবা পাওয়া একটা অন্য অভিজ্ঞতা। সেখানকার রসিকরা সঙ্গীত নৃত্য নাটক নিয়ে মশগুল থাকেন। নিজের অভিজ্ঞতা অন্য কথা বলেনি। কিছুদিন আগেও ওই শহরে শীত পড়লে বড় বড় অনুষ্ঠান হত। সমস্ত ভারতবর্ষের গুণী শিল্পীরা সেই সব সম্মেলন যোগ দিতেন। অনেক বছর আগে ওই রকম এক সম্মেলনে পৌঁছে। মাইহারের আলাউদ্দিন খাঁ সাহেবের দর্শন পেয়েছিলেন তিনি। তখন তার পরিচয় সবে ছাড়তে শুরু করেছে। খাঁ সাহেব তখন সবার শ্রদ্ধার পাত্র। রবিশঙ্কর কিংবা আলি আকবর সে সময় নিজস্ব জায়গা। তৈরি করে নিয়েছেন। খাঁ সাহেবের পা ছুঁয়ে প্রণাম করতেই সেই স্নিগ্ধ হাসি বৃদ্ধের মুখে ছড়িয়ে পড়েছিল। কোনো কথা বলেননি। কিন্তু সেই হাসিটিকে আশীর্বাদের মতো গ্রহণ করেছিলেন আশা।

কলকাতার কথা মনে পড়লেই আর একটা স্মৃতি চলকে ওঠে তার। তখন কত বয়স, তিরিশ হলেও হতে পারে। মাদ্রাজ থেকে ট্রেনে চেপে হাওড়া স্টেশন, সেখান থেকে উদ্যোক্তাদের গেস্ট হাউসে। তার সঙ্গী শিল্পীদের রাখা হয়েছিল কাছাকাছি হোটেলে। তখনই কমলা তাঁর সঙ্গে। আশা শুনেছিলেন এককালে নাকি ওই কলকাতায় রাজা জমিদার অথবা বাবুদের আগ্রহে বড় আসর বসত। সেই সব মানুষেরা ছিলেন প্রকৃত সমঝদার। কিন্তু অনুষ্ঠানগুলোয় তাদের ইচ্ছাই শেষ কথা ছিল। এই অনুষ্ঠান অবশ্য সেইধরনের নয়। তবে একজন রঈস আদমী এর উদ্যোক্তাদের একজন। ওরা কলকাতায় এসেছিল অনুষ্ঠানের একদিন আগে। বিকেলবেলায় একটি লোক এল সেই রঈস আমীর দূত হিসেবে। কমলা তার সঙ্গে কথা বলে এসে নিবেদন করল, আজ যেহেতু অনুষ্ঠান নেই তাই ওই রঈস আদমী চাইছেন আশা তার বাগানবাড়িতে আয়োজিত নৃত্যানুষ্ঠানে যোগ দিক। এর জন্যে টাকা পয়সার কথা চিন্তা করতে হবে না। আশা সম্মতি দিয়েছিলেন। কারণ তিনি ভেবেছিলেন আগামীকালের অনুষ্ঠানের মতো এটি আর একটি অনুষ্ঠানমাত্র। ভদ্রলোক যেহেতু অর্থবান তাই আলাদা ব্যবস্থা করেছেন মাত্র।

সন্ধের পর গাড়ি এল। ওঁরা যখন কলকাতার উপকণ্ঠে পৌঁছালেন তখনও মনে কোনো সন্দেহ জাগেনি। বিশাল গেট পেরিয়ে অন্ধকার বাগান ডিঙিয়ে ওঁদের গাড়ি থামল যে বাগানবাড়িতে তার কোথাও কোন শব্দ নেই। মাটিতে পা দিয়েই প্রথম অস্বস্তি টের পেয়েছিলেন আশা। বারান্দায় দুজন কর্মচারি হাতজোড় করে দাঁড়িয়ে তাদের সম্ভাষণ জানিয়েছিল। তারপর সসম্ভ্রমে নিয়ে গিয়েছিল দুটো ঘর ডিঙিয়ে একটা বিশাল হলঘরে। সেখানে পৌঁছে চমকে উঠেছিলেন আশা। এত সুন্দর সাজানো হল তিনি এর আগে কখনও দ্যাখেননি। পায়ের তলায় নরম সুদৃশ্য কাশ্মিরী কার্পেট। দেওয়ালে প্রায় ছাদ ছোঁওয়া চমৎকার বাঁধানো রঙিন ছবি। ছাদের মাঝখানে পুরনো কাচের ঝাড়বাতির আলো থেকে স্বপ্ন গলে পড়ছে। কিন্তু সেই সুরম্য ঘরে কোনো মানুষ নেই। এ কেমন অনুষ্ঠান যার কোনো দর্শক নেই? সেই দুজন কর্মচারি তাদের ঘরের একপ্রান্তে বসবার ব্যবস্থা করে দিয়ে চলে গেলেন। এবং তখনই আশার মনে অস্বস্তি ক্রমশ বাড়তে লাগল। তিনি কমলাকে ইশারায় কাছে ডাকলেন, ওদের বলো এখানে আমার নাচার ইচ্ছে নেই।

কমলার মুগ্ধ চোখ চারপাশ দেখছিল। চমকে জিজ্ঞাসা করল, ওমা, কেন?

জায়গাটাকে বড় অপবিত্র লাগছে। আশার মুখে কথা শেষ হবার সঙ্গে সঙ্গে এক বিশাল শরীরের প্রৌঢ় ঘরে ঢুকলেন। টকটকে লাল গায়ের রঙ, পাঞ্জাবি এবং ধুতিতে আভিজাত্য, আঙুলের হিরে আলো ফিরিয়ে দিচ্ছে। ঘরে ঢুকেই তিনি নমস্কার করলেন, আমার এই ক্ষুদ্র কুটিরে আপনি এসেছেন বলে কৃতার্থ হয়েছি। গতবার যখন কলকাতায় এসেছিলেন তখন আপনার নাচ আমি মঞ্চে দেখেছি। কিন্তু মুশকিল হল, যা সত্যি ভাল তা জনতার সঙ্গে ভাগ করে নিতে আমার মোটেই ইচ্ছে করে না। এতে আমি তৃপ্তি পাই না। তাই এই আসরের আয়োজন।

যৌবন তার রশ্মি গুটিয়ে নিচ্ছে মানুষটার মুখ থেকে এবং সেই সঙ্গে তার অপকীর্তির চিহ্ন রেখে যাচ্ছে গাঢ় রেখায়। কিন্তু আশা চট করে কিছু বলতে পারলেন না। রঈস মানুষটি নীরবতাকে দ্বিধা বলে মনে করলেন না, না না কোনো সঙ্কোচ করবেন না। আমার এই জলসাঘর আপনার মতো গুণীর ছোঁয়া পেয়ে এসেছে গত একশ বছর ধরে। ভারতবর্ষের এমন কোনো বড় শিল্পী নেই যিনি এখানে এসে অনুষ্ঠান করেননি। আমাদের বংশের কণ্ঠে সঙ্গীত নেই, কিন্তু রক্তে রয়েছে। কথা শেষ করে তিনি খানিকটা হেঁটে আশার উল্টো দিকে সাজিয়ে রাখা তাকিয়ায় হেলান দিয়ে বসলেন। যেন এই ঘরে তিনি যা বলবেন তা পালন করা হবে। আশা অবাক হয়ে মানুষটাকে দেখছিলেন। বসামাত্র একজন ভৃত্য রুপোর রেকাবিতে পানীয়ের বোতল এবং জাপানি গ্লাস এনে তার সামনে সযত্নে রাখল। ইশারায় ভৃত্যকে চলে যেতে বলে রঈস মানুষটি অবলীলায় বোতলের পানীয় গ্লাসে ঢেলে বললেন আমি জানি নাচ শেষ হবার আগে অনেকেই পান করেন না। কিন্তু আপনারা সবাই চুপচাপ কেন? নিন, শুরু করুন।

আশার গলা থেকে একটা শব্দ ছিটকে উঠল, না।

না মানে? ঠোঁটের কাছে পৌঁছবার আগেই গ্লাস থেমে গেল। সবিস্ময়ে রঈস আদমি বললেন, না মানে?

এই রকম নোংরা পরিবেশে আমি নাচতে পারি না। আশা দৃঢ় গলায় বললেন।

নোংরা পরিবেশ? আপনি আমার জলসাঘরকে নোংরা জায়গা বলছেন?

নিশ্চয়ই। যেখানে একটি পুরুষের মনোরঞ্জনের জন্যে সঙ্গীত নৃত্য এবং পানীয় একসঙ্গে কাজ করে সেখানে পবিত্রতা থাকতে পারে না। আমি এতে অভ্যস্ত নই।

আচ্ছা! মানুষটি উঠে বসলেন, আপনি অজ্ঞতাবশত এই কথা বললেন বলে আমি কিছু মনে করছি না। কিন্তু জেনে রাখুন এই জলসাঘরে আপনার চেয়ে অনেক বেশি গুণী, ভারতীয় সঙ্গীতাকাশের অনেক বড় বড় নক্ষত্র অনুষ্ঠান করেছেন আমার সামনে, আমার পিতা এবং পিতামহের সামনে। আপনি বলুন ঠিক কত টাকা পেলে আপনার এই অস্বস্তি দূর হবে?

টাকা? রাগে ঘেন্নায় উঠে দাঁড়িয়ে সঙ্গীদের দিকে তিনি ইঙ্গিত করে বললেন, আপনি যদি ভেবে থাকেন টাকা দিয়ে আশা রাওকে কিনতে পারবেন তাহলে ভুল করছেন। আপনার জলসাঘরের নটী হবার জন্যে আমাকে ভাঁওতা দিয়ে এখানে এনেছেন বলে আমি আগামীকালের অনুষ্ঠানও করব না।

রঈস মানুষটি হাসলেন, বাঃ। আগামীকালের অনুষ্ঠানের সঙ্গে আজকের ফারাকটা কোথায়?

 সেটা নিজেই বুঝে নিন।

আমি বুঝতে অক্ষম। আগামীকাল আপনি কয়েক হাজার মানুষের সামনে একটা প্রেক্ষাগৃহে অনুষ্ঠান করবেন আর এখানে একটি মানুষের সামনে আপত্তি থাকছে কেন? সেই হাজার মানুষের মধ্যে নব্বই ভাগ চোখে নোংরা দৃষ্টি থাকতে পারে। সেই সব দর্শকের নিরানব্বই ভাগেরই নৃত্য সম্পর্কে কোনো বোধ নাও থাকতে পারে। তারা শুধু আপনার দেহসৌষ্ঠব দেখতে এলে নিজেকে অপবিত্র ভাববেন না? আর সবার বিনোদন করে আপনি তো টাকাও নিচ্ছেন। তাই না? প্রশ্ন করে মানুষটি ঠোঁটে এমন একটা হাসি আনলেন যা দেখে আপাদমস্তক জ্বলে গেল আশার। তাঁর সঙ্গীরাও এবার উঠে দাঁড়িয়েছে। আর একটা ইঙ্গিত পেলেই ফিরে যাবে সবাই। কিন্তু শহরের এই উপকণ্ঠ তাঁদের পরিচিত নয়। ফিরে যেতে হলে এঁর সাহায্য দরকার। যেন ভুলিয়ে ফাঁদে নিয়ে আসা হয়েছে বলে মনে হচ্ছিল তাঁর। কিন্তু সেই সঙ্গে ওই প্রশ্নের জবাব দেওয়ার প্রয়োজন বোধ করলেন তিনি!

মাথা উঁচু করে জবাব দিলেন আশা, আমি যে নাচ শিক্ষা করেছি তা ঈশ্বরের কাছে নিবেদনের জন্যে। যখনই আমি নাচি তখনই আমার সামনে ঈশ্বর থাকেন। কোনো একটি সাধারণ মানুষের মন ভোলাবার জন্যে নাচার আগে যেন আমার মৃত্যু হয়। হাজার মানুষের কথা বললেন, আমাদের শাস্ত্রে তো জনতাকে ভগবান বলা হয়েছে। এক হাজার অপবিত্র মানুষ একত্রিত হলেও সবাই একই ধারায় চিন্তা করে না। তাদের সামনে নাচলে আমার মনে কোনো বিশেষ ব্যক্তির ছায়া পড়ে না। তাদের মিলেমিশে এক করে ঈশ্বর সামনে এসে দাঁড়ান। আর টাকা? ঈশ্বরের পূজা দিতে গেলেও দক্ষিণার প্রয়োজন হয়। আপনি এবারে আমাদের ফিরে যাওয়ার ব্যবস্থা করে দিলে উচিত কাজ করবেন।

মানুষটি কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে আশাকে লক্ষ করলেন। তারপর বললেন, রাতের শেষ প্রহরে এই জলসাঘর থেকে শিল্পীর ফিরে যাওয়াটা নিয়ম হয়ে দাঁড়িয়েছিল। প্রথম প্রহরেই যদি আপনি চলে যেত চান আমি বাধা দেব না, কিন্তু পাঁচজনের কাছে অপমানিত হব। তা হই কিন্তু আমার আপনার সঙ্গে কথা বলতে বেশ ভাল লাগছে। সত্যি কথা বলতে কী এর আগে কোনো শিল্পীকে এমন বিচক্ষণ কথা বলতে শুনিনি। আপনি বললেন নাচের সময় ঈশ্বর আপনার সামনে থাকেন। কোন ঈশ্বর? এককালে সুতনুকা নামের দেবদাসী তাঁর প্রিয়তম মানুষ দেবদত্তের জন্যে নেচে কি অপবিত্র কাজ করেছিল? যে কোনো সুন্দর জিনিস সৃষ্টি মানেই ঈশ্বরের আরাধনা। আর সেই আরাধনায় দুজনে তো একসঙ্গে অংশ নিতে পারে। আপনি ঈশ্বরের সামনে যা নিবেদন করেছেন তা কী পূর্ণতা পাবে যদি দর্শক উপস্থিত না থাকে?

আশা এর উত্তর দিলেন না। কারণ তাঁর মনে হচ্ছিল মানুষটি অনর্থক কথা বাড়িয়ে তার ফিরে যাওয়াটাকে বিলম্বিত করার চেষ্টা করছে। তিনি কোনো ব্যক্তির সামনে নাচতে পারেন না। ঈশ্বর ছাড়া আর কারো প্রীতি তিনি কামনা করেন না। বড় অনুষ্ঠানে যাঁরা দর্শক হিসেবে আসেন তারা নিজস্ব পরিচিতি হারিয়ে শুধুই দর্শক হয়ে যান। সেই মানুষগুলোর সামনে নাচলে মনে কোনো বিশেষ প্রতিক্রিয়া ওঠে না। আশা কিছুটা উদ্ধত ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে ছিলেন যদিও তিনি জানতেন সাহায্য ছাড়া এই জলসাঘর থেকে বেরুনো প্রায় অসম্ভব।

রঈস মানুষটি হঠাৎ বললেন, আপনি তো ভরতনাট্যমে নাচেন! আমি শুনেছি আপনার গুরুর কথা। হ্যাঁ, যে গুরুর কাছে আপনি বাল্যকালে শিক্ষা নিয়েছিলেন। তাই আগ্রহ ছিল দেখতে আপনার মধ্যে তার ছায়া কতটুকু! না, তাঁর নাচ আমি দেখিনি।

আশা প্রশ্ন না করে পারল না, আপনি তাতার নাচ দ্যাখেননি অথচ আমার মধ্যে তাতার ছায়া দেখতে চাইছেন! কথাটা খুব অসংলগ্ন হয়ে গেল না?

তাতা? কে তাতা? ওহো, আপনি সেই পাণ্ডানুল্লুরের মহাগুরুর কথা বলছেন? না না, তিনি নন। শুনেছি আপনার গ্রামের এক উদাসীন শিক্ষকের কাছে আপনার নাচের দীক্ষা হয়েছিল। কথাটা কি মিথ্যে?

মানুষটি প্রশ্ন শেষ হওয়ার আগেই সর্বাঙ্গে কাঁপুনি ছড়িয়ে পড়ল। গুরু বলতে এখন শুধু তাতার মুখই মনে আসে। কিন্তু গ্রামের সেই মানুষটি, যার কাছে মা অসুস্থতা সারাতে নিয়ে গিয়েছিল, যিনি তাঁকে ভরতনাট্যমের ইতিহাস শোনাতেন দুটো হাত বুকের ওপর ভাঁজ করিয়ে রেখে। তাঁকে দাঁড়িয়ে থাকতে হতো প্রথম দিকে ওই ভঙ্গিতে এবং এখন মনে হয় ভিত তৈরি হয়ে গিয়েছিল সেই অবস্থায় নিজের অজান্তে। শুধু শরীরের সঞ্চালন নয়, মনের পরতে পরতে নাচ সম্পর্কে আগ্রহ ছড়িয়ে দিয়েছিলেন সেই শিক্ষক। প্রথমে যা শুধু বক্তৃতার মতো নীরস মনে হত তাই এক সময়ে রক্তে মিশে গিয়েছিল। অনেক পরে তাতার কাছে শিক্ষা গ্রহণের সময় ওই মিশে যাওয়াটাকে অনুভব করেছিলেন আশা। কিন্তু যে মানুষটির নাম তাঁর গ্রামের বাইরে কেউ জানত না, যাঁর কথা এখন কারো স্মরণে নেই তাঁর প্রসঙ্গ এই রঈস মানুষটি জানল কী করে? শিক্ষকের আত্মীয় বা ঘরের লোকজন কেউ ছিল না। মানুষটি মারা গিয়েছিল নিঃশব্দে, দুর্ঘটনা না আত্মহত্যা তা নিয়ে সেই সময় প্রশ্ন উঠেছিল। কিন্তু এখন সেসব ঘটনা কারো মাথায় আসে না। কিন্তু আশা যেন নিজের সামনে সেই শিক্ষককে দেখতে পেলেন। তিনি চিৎকার করে বলছেন, আমি ব্যায়াম করিয়ে আপনার মেয়ের শরীর সারাব? ওকে নিয়ে যান কোনো ব্যায়ামাগারে। এটা নাচ শেখার জায়গা।

সম্মোহিতের মতো মাথা নাড়লেন আশা, হ্যাঁ। কিন্তু তাঁর কথা আপনার কাছে পৌঁছালো কী করে?

তাঁর স্ত্রীর কাছে শুনেছি।

তাঁর স্ত্রী? চমকে উঠলেন আশা। সেই বাউণ্ডুলে মানুষটিকে সে আশৈশব একা দেখে এসেছিল।

হ্যাঁ। এই শহরে আছেন তিনি। যদি ভরতনাট্যমের কথা বলেন তাহলে বলব আমার দেখা যে কোনো শিল্পীর চেয়ে এই মহিলা অনেক বড়, অনেক বেশি গুণী।

কী নাম তার? আশা যেন বিশ্বাস করতে পারছিলেন না।

নাম বললে তো চিনতে পারবেন না। তিনি কোনো বারোয়ারী অনুষ্ঠান নাচেন না। তিনি নাচতেন বেঁচে থাকার জন্যে। তাঁর সামনে যারা দেবতা হিসেবে উপস্থিত থাকতে তাদের শরীর ছিল রক্ত মাংসের।

কী বলছেন আপনি?

বিন্দুমাত্র মিথ্যে বলছি না। আমার দেখা ভরতনাট্যমের শ্রেষ্ঠ শিল্পী এই কলকাতায় একজন সাধারণ বাঈজী হিসেবে দীর্ঘদিন বাস করে এখন জরাগ্রস্ত।

কিন্তু আপনি বললেন তিনি আমার সেই শিক্ষকের স্ত্রী?

সেটাও সত্য। জীবন বড় অদ্ভুত বেনিয়মে চলে।

তিনি আমার নাম জানলেন কী করে?

তার স্বামীর কাছেই জেনেছিলেন হয়তো। আমি এর বেশি কিছু জানি না। রঈস মানুষটি হাসলেন, আমার সময় নষ্ট হচ্ছে। যান আপনারা, আমার কর্মচারিরা আপনাদের পৌঁছে দেবার ব্যবস্থা করছে। এই কে আছিস। শেষের শব্দ তিনটে যেন বিরক্তির সঙ্গে উচ্চারণ করলে মানুষটি।

আশার সঙ্গীরা কর্মচারিকে দেখামাত্র পা বাড়াচ্ছিল। কিন্তু আশা দাঁড়িয়ে রইলেন। যে কথাগুলো এইমাত্র তিনি শুনলেন তার সঙ্গে নিজের স্মৃতি মেলাতে পারলেন না। পরবর্তী সময়ে তিনি অনেক ভেবেছেন এ ব্যাপারে। কে তার গুরু? সেই শিক্ষক না তাতা? যে শিশুকে হাতেখড়ি দিয়ে অক্ষর লিখতে শেখায়, না যে পরবর্তীকালে তাকে নির্মাণ করে? এর স্পষ্ট উত্তর আজ পর্যন্ত পাওয়া গেল না। সেই গৃহশিক্ষকের একটা ডাকনাম তার কাছে অস্পষ্ট আছে। অনেকেই তো ওঁকে পাগলা মাস্টার বলে ডাকত। সমাপদ থেকে অর্ধমণ্ডলী যিনি তাঁকে পৌঁছে দিয়েছেন তার মুখটাও আজ ভাল করে মনে পড়ে না। কিন্তু তার স্ত্রী, সত্যি যদি কেউ থেকে থাকে, এই মানুষটি তাঁকে শ্রেষ্ঠ ভরতনাট্যম শিল্পী হিসেবে সম্মান জানাচ্ছেন। কৌতূহল ক্রমশ ফণা তুলছিল। ভরতনাট্যমের যাঁরা গুণী শিল্পী তাদের শ্রেষ্ঠত্ব নিয়ে বিচার করা বোকামি। কিন্তু হঠাৎই যদি কাউকে শ্রেষ্ঠ বলা হয় তাহলে কৌতূহল জাগে বৈকি। দ্বিতীয়ত, সেই শিক্ষকের ব্যক্তিজীবন জানার আগ্রহ তীব্র হল। তৃতীয়ত, সেই মহিলা কীভাবে তার নাম জানলেন সেটাও জানতে ইচ্ছে করছিল। আশা দেখলেন মানুষটি ঘর ছেড়ে চলে যাচ্ছেন। তিনি ডাকলেন, শুনুন!

মানুষটি ঘুরে দাঁড়ালেন। এবং এতক্ষণে আশার বিশ্বাস জেগেছে খুব সাধারণ শ্রেণির মাতাল এবং লম্পটের দলে ইনি পড়েন না। অন্তত নাচ-গান সম্পর্কে স্বচ্ছ ধারণা এঁর আছে। আশা বললেন, যদি কিছু মনে না করেন তাহলে সেই মহিলার ঠিকানাটা একটু বুঝিয়ে দেবেন? আমি তাঁর সঙ্গে দেখা করতে চাই।

বিস্ময় ফুটে উঠল মুখে, রঈস মানুষটি জিজ্ঞাসা করলেন, আপনি তার সঙ্গে দেখা করবেন? কেন?

সেটা আমার ব্যক্তিগত ব্যাপার। আপনার অসুবিধে আছে?

বিন্দুমাত্র নয়। কিন্তু—! এক মুহূর্তে দ্বিধা নিয়ে তিনি বললেন, কিন্তু সেই পরিবেশে আপনার যাওয়া সঙ্গত হবে কি না ভেবে দেখুন। আপনার রুচিতে লাগতে পারে।

তার মানে? আশা কথাটার অর্থ স্পষ্ট বুঝতে পারছিলেন না।

আপনাকে বলেছি তিনি বাঈজীর জীবন যাপন করতেন। যদিও এখন তার বয়স হয়েছে কিন্তু তিনি সেই পরিবেশেই আছেন যেখানে মানুষ নৃত্যগীত এবং শরীর উপভোগ করতে যায়।

ও! আশা শুধু এই শব্দটি উচ্চারণ করতে পারলেন।

কিন্তু সত্যি আপনি যেতে চাইলে আপনার নিরাপত্তার দায়িত্ব আমি নিতে পারি। আপনার রুচিতে না বাধলে আপনি সসম্ভ্রমে সেখান থেকে যাতে ঘুরে আসতে পারেন তার ব্যবস্থা করতে পারি। কিন্তু তার আগে আমাকে জানতে হবে কেন আপনি যেতে চাইছেন?

যাঁকে আপনি শ্রেষ্ঠ শিল্পীর সম্মান দিচ্ছেন তিনি কেন আড়ালে রইলেন চিরকাল জানার আগ্রহ হচ্ছে। তাঁর স্বামীর কাছে আমি ঋণী। সেটাও ধরুন একটা কারণ।

কিন্তু যিনি ঈশ্বরের সামনে নৃত্য পরিবেশন না করে সাধারণ মানুষের মনোরঞ্জন করতেন তার কাছে যেতে তো আপনার আপত্তি হওয়া উচিত।

নিশ্চয়ই। কিন্তু কী কারণে সেটা তিনি করতেন তা জানার জন্যে যাওয়া দরকার।

.

কিছু সময় বাদে তিনটি গাড়ি উপকণ্ঠ ছেড়ে শহরে চলে এল। প্রথমটিতে সেই রঈস মানুষ একা, বাকি দুটোতে আশা এবং তার সঙ্গীদের দলে আরও দুজন সুদেহী পুরুষ। বোঝা যায় এদের প্রয়োজন ঝামেলা থেকে বাঁচার কারণে। আশা এবং কমলা পেছনের আসনে বসেছিল। কমলা শেষ পর্যন্ত ভীরু গলায় না বলে পারেনি, বাঈজী পাড়ায় না গেলে চলত না। ওই মাতাল লোকটি নেশার ঘোরে কী বলতে কী বলল আর তাই তুমি বিশ্বাস করছ?

আশা কোনো উত্তর দেননি। এবং সেই প্রথম কৌতূহল ছাপিয়ে আর একটি অনুভূতির অস্তিত্ব আবিষ্কার করলেন। যে মানুষটা ক্রমশ তার কাছে গুরুত্বহীন হয়ে পড়েছিল হঠাৎ এক ধাক্কায় তার ভূমিকা পাল্টে গেল। যদি তাঁর স্ত্রী ভরতনাট্যমে বিশেষ পারদর্শিনী হন তাহলে সেই শিক্ষক কী শুধু পাগলামির ভান করে নিজেকে আড়াল করে রেখেছিলেন, গুপ্ত সম্পদ কাউকে দান করতে তাঁর প্রবল অনীহা ছিল? এবং এই ভাবনা থেকেই মনে ঈর্ষার জন্ম নিল। আশার জেদ বেড়ে গেল মহিলাকে দেখতেই হবে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *