আর্য-সংস্কৃতির প্রভাব
প্রবাদ আছে, ভারতবর্ষের প্রথম রাজা হলেন স্বয়ম্ভু মনু (স্বয়ং উৎপন্ন মনু) মনুর জন্ম পিতামহ ব্রহ্মা থেকে। মনু ছিলেন উভলিঙ্গ। তাঁর শরীরের স্ত্রী অংশে দুটি পুত্র ও তিনটি কন্যা জন্মাল। আবার এদের থেকে এলো আরো অনেক মনু। তার মধ্যে পৃথু একজন, তিনি হলেন জগতের প্রথম প্রকৃত স্বীকৃত রাজা। তার নাম থেকেই পৃথিবী নামের উৎপত্তি। তিনি বন কেটে বসত গড়লেন, চাষ করে শস্য ফলালেন, গো-পালন শুরু করলেন, ব্যবসা-বাণিজ্যের পত্তন করলেন। এইভাবে মানুষের স্থিতিশীল জীবনযাত্রা আরম্ভ হয়। এইসব মানুষের মধ্যে দশম মনু সবচেয়ে বিখ্যাত। তাঁর শাসনকালেই পৃথিবীতে সেই বিধ্বংসী প্লাবন আসে যাতে সমস্ত সৃষ্টি ডুবে যায় এবং প্রাণে বাঁচেন কেবল তিনিই। ভগবান বিষ্ণু আগেই মনুকে প্লাবন সম্পর্কে সতর্ক করে দিয়েছিলেন। তাই মনু একটা নৌকো তৈরি করে নিজের পরিবার ও সাতজন প্রাচীন ঋষিকে নিয়ে তার ওপর আশ্রয় নিলেন। বিষ্ণু নিজে একটি বিরাট মাছের রূপ ধারণ করলেন। মাছের সঙ্গে নৌকো বেঁধে দেওয়া হলো, আর মৎস্যরূপী বিষ্ণু প্লাবনের জল সাঁতরে নৌকো টেনে নিয়ে এলেন এক পর্বতচূড়ায়। প্লাবনের জল নেমে যাওয়া পর্যন্ত সবাই ওখানে নিরাপদে রইলেন। সমগ্র মানবজাতির উৎপত্তি হলো মনুর পরিবার থেকে। মনুর নয় পুত্র— বড়টি উভলিঙ্গ, তার দুই নাম— ইল ও ইলা। এই পুত্র থেকেই উদ্ভব হয় দুই প্রধান রাজবংশের ইল থেকে সূর্যবংশ ও ইলা থেকে চন্দ্রবংশ।
পুরাণ ও অন্যান্য ব্রাহ্মণ্য শাস্ত্রে এই কাহিনীই পাওয়া যায়। প্লাবন এসেছিল বহু হাজার বছর আগে। পুরাণ অনুযায়ী মনুর বংশতালিকা মহাকাব্যের যুগ পর্যন্ত বিস্তৃত। অর্থাৎ রামায়ণ ও মহাভারতের নায়করা মনুরই বংশধর। তারপর ঐতিহাসিক যুগের সূচনার পরেও পুরাণে এই রাজবংশের বৃত্তান্ত পাওয়া যায়। (প্রথাগতভাবে ধরে নেওয়া হয়, মহাভারতের যুদ্ধ হয়েছিল ৩১০২ খ্রিস্টপূর্বাব্দে।) রাজবংশের বিবরণে কোনো ফাঁক নেই এবং বোঝা যায় অনেক সাবধানে ও ভেবেচিন্তেই এই পরম্পরা রচিত হয়েছে। ভারতবর্ষের ইতিহাসের আদিযুগের আলোচনার ব্যাপারে যদি প্রাচীন সাহিত্যই একমাত্র সূত্র হতো, তাহলে আলোচনা স্বভাবতই সীমাবদ্ধ হতো। কিন্তু অষ্টাদশ শতাব্দীর শেষে ও ঊনবিংশ শতাব্দীর প্রথম দিকে আর এক ধরনের ঐতিহাসিক উপাদানের সন্ধান পাওয়া গেল এবং দেখা গেল তার সঙ্গে প্রাচীন উপাদানের গড়মিল হচ্ছে। ভাষাবিজ্ঞানের প্রসারের মধ্য দিয়ে এইসব নতুন সাক্ষ্যপ্রমাণ পাওয়া যায়। ইউরোপ ও অন্যান্য জায়গায় ঊনবিংশ শতাব্দীতে ভাষাবিজ্ঞান-চর্চার রীতিমতো উন্নতি ঘটেছিল। ভারতে ইউরোপীয় পণ্ডিতেরা আশ্চর্য হয়ে লক্ষ্য করলেন যে, সংস্কৃতভাষার গঠন ও ধরনের সঙ্গে গ্রীক ও ল্যাটিনের রীতিমতো মিল রয়েছে। এ থেকে উৎপত্তি হয় এক থিয়োরি : ইন্দো-ইউরোপীয় জাতির এক মূল ভাষা ছিল, যা আর্যভাষাভাষী উপজাতির পূর্বপুরুষরাও ব্যবহার করতেন। ইন্দো-ইউরোপীয়রা নির্গত হয়েছিলেন ক্যাস্পিয়ান সাগর ও দক্ষিণ রাশিয়ার স্টেপ অঞ্চল থেকে। তারপর এঁরা বিভিন্ন উপজাতিতে বিভক্ত হয়ে দূরদূরান্তে ছড়িয়ে পড়লেন পশুচারণ ভূমির খোঁজে। তাঁরা এলেন গ্রীস ও এশিয়া মাইনরে, ইরান ভারতবর্ষে। তখন এদের বলা হলো আর্য। বৈদিক সাহিত্য ভারতীয় আর্যদের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট। আরো খুঁটিয়ে দেখে স্থির হলো যে, মোটামুটি খ্রিস্টপূর্ব দ্বিতীয় সহস্রাব্দের কোনো সময়ে আর্যদের আগমনের সময় থেকেই ভারত-ইতিহাসের শুরু।
কিন্তু অতীতের এই সযত্ন অঙ্কিত ছবি আবার সংশোধন করতে হলো বিংশ শতাব্দীতে এসে। ১৯২১-২২ সালে প্রত্নতাত্ত্বিকরা প্রাক্-আর্য সভ্যতা বা সিন্ধু- সভ্যতার সন্ধান পেলেন উত্তর-পশ্চিম ভারতে। তার দুই নগরকেন্দ্র, মহেঞ্জোদাড়ো ও হরপ্পা। এই আবিষ্কারের পর থেকে বোঝা গেল, ইতিহাসের প্রাচীন বিবরণটি নেহাতই পৌরাণিক। হরপ্পা সভ্যতার তারিখ হলো আনুমানিক ৩০০০ থেকে ১৫০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দ। মনুর বংশধর ও হরপ্পা সভ্যতার একই সঙ্গে অস্তিত্বের কথা বিশ্বাস করা কঠিন। কেননা, দুই সংস্কৃতির ধারা একেবারে বিপরীতমুখী।
সুতরাং প্রাচীনকাল সম্পর্কে দুভাবে জানা যায়। ঐতিহাসিক সূত্র, যার ভিত্তি প্রত্নতাত্ত্বিক উপাদান ও বৈদিক সাহিত্য। অপরটি পুরুষানুক্রমিক ঐতিহ্যগত সূত্র— যার ভিত্তি হলো পুরাণ। পুরাণের রচনাকাল কিন্তু বেদের পরে। প্রাচীন ইতিহাসের ধারাবাহিক কালানুক্রম হবে এইরকম— খ্রিস্টপূর্ব দ্বিতীয় সহস্রাব্দে সিন্ধু-সভ্যতার পতন শুরু হয়ে গেছে। ১৫০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দে উত্তর-পশ্চিম ভারতে আর্যদের আগমনের সময় সিন্ধু-সভ্যতা লুপ্তপ্রায়। আর্য বা ইন্দো-এরিয়ানরা ইন্দো-ইউরোপীয়দের বংশধর। এরা কিছুকাল ব্যাকট্রিয়া ও উত্তর-ইরানীয় মালভূমিতে বসবাস করছিল। কিন্তু ১৫০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দ নাগাদ তারা হিন্দুকুশ পর্বতমালার গিরিপথ দিয়ে উত্তর-ভারতে আসে। এরা ছিল মূলত গো-পালক জাতি। তাই পশুচারণ ভূমির সন্ধানে প্রথমে এরা পাঞ্জাবের সমভূমিতে ছড়িয়ে পড়ে তারপর জঙ্গল পরিষ্কার করে ছোট ছোট গোষ্ঠীতে বসতি স্থাপন করে। আগেকার সিন্ধু-সভ্যতার লোকদের* মতো এদেরও অর্থনীতি ক্রমে ক্রমে কৃষিভিত্তিক হয়ে উঠল। এই সময়েই ঋগ্বেদের* (প্রাচীনতম বৈদিক সাহিত্য) শ্লোকগুলো স্মৃতিবদ্ধ ও সংগ্রহ করা শুরু হয়।
[* আর্য-সংস্কৃতি সম্পর্কে যথেষ্ট প্রত্নতাত্ত্বিক প্রমাণ এখনো পাওয়া যায়নি। ধূসর রঙ করা মৃৎপাত্রের সংস্কৃতির সঙ্গে একটা সম্ভাব্য-সম্পর্কের কথা মনে হয়। ধূসর রঙ করা মৃৎপাত্র পাওয়া গেছে গাঙ্গেয় উপত্যকার পশ্চিমদিকে এবং এগুলো ১১০০ থেকে ৫০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দের। সবচেয়ে প্রাচীনটি হলো ১০২৫ খ্রিস্টপূর্বাব্দ বা তার ১১০ বছর কমবেশি সময়কার। আলিগড়ের আত্রানজী খেরা থেকে পাওয়া এই জিনিসগুলোর প্রাচীনত্ব নির্ণীত হয়েছে কার্বন-১৪ পরীক্ষার সাহায্যে। এই সংস্কৃতির লোকেরা ছিল কৃষিজীবী এবং ঘোড়া ও আরো কয়েকটি পশুপালন করত। এরা ডালপালা দিয়ে তৈরি ঘরে বাস করত। দেওয়ালে রঙ মাখানো জ্যাবড়া ছবি থাকত। এরা তামা এবং কয়েক জায়গায় লোহারও ব্যবহার জানত। বৈদিক সূত্রে যে ধরনের সভ্যতার বিবরণ পাওয়া যায়, তার সঙ্গে এই বিবরণের বেশ মিল আছে।
* ঋগ্বেদে আছে ১০২৮টি শ্লোক এবং সেগুলো বিভিন্ন আর্য-দেবতাদের উদ্দেশ্যে রচিত। বিভিন্ন পুরোহিত পরিবারই শ্লোকগুলোর রচয়িতা। এতে ঘটনাবলির ক্রমিক বিবরণ নেই, কিন্তু আর্যদের জীবনধারার বিভিন্ন দিকের পরিচয় পাওয়া যায়। এগুলোর ঐতিহাসিক সত্যতা সম্পর্কে মোটামুটি নিশ্চিন্ত হওয়া চলে, কেননা এতে যে যুগের বর্ণনা আছে রচনাকালও সেই যুগেরই। ]
পুরাণে বর্ণিত কাহিনীগুলো সংগৃহীত হয়েছিল অনেক শতাব্দী পরে (৫০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দ থেকে ৫০০ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে।) সেজন্যই এখানে লিপিবদ্ধ বিভিন্ন ঘটনার মধ্যে সামঞ্জস্যের অভাব দেখা যায়। কোনো কোনো ঐতিহাসিক ঘটনার উল্লেখ আছে বলে এগুলো সম্পূর্ণভাবে পৌরাণিক বলে আখ্যা দেওয়া যায় না। ‘মনু’ নামটি থেকে মানব (অর্থাৎ মানবজাতি) শব্দের উৎপত্তি। রাজা পৃথুর বনজঙ্গল পরিষ্কার করে চাষ-আবাদের পত্তনের কাহিনীর মধ্যে গঙ্গা-যমুনা অঞ্চলে প্রথমদিকের আর্যদের বসতি স্থাপনের ইঙ্গিত পাওয়া যায়। প্লাবনের কাহিনীর কথা পড়লে তার সঙ্গে ব্যাবিলোনীয় উপকথার মিল মনে পড়ে। হিব্রুরাও তাদের নোয়ার নৌকোর কাহিনী রচনা করেছেন এই উপকথা থেকেই। এ কাহিনীর ভারতীয় ভাষ্য প্রসঙ্গে মনে হয়, আর্যরা যখন ইরানর সমভূমি ছেড়ে চলে আসেনি তখন ব্যাবিলোনীয়দের কাছে এই প্লাবনের কাহিনী শুনে থাকতে পারে। অথবা হয়তো ব্যাবিলোনীয়দের কাছ থেকে সিন্ধু-সভ্যতার লোকেরা কিংবদন্তীরূপে কাহিনীটির সঙ্গে পরিচিতি হয়েছিল এবং পরে তাদের কাছ থেকে পরবর্তী সভ্যতার লোকেরা কাহিনীটি গ্রহণ করে। আর একটি সম্ভাবনা হলো, মেসোপটেমিয়ার প্লাবনের অস্পষ্ট স্মৃতির সঙ্গে সিন্ধুনদের বারংবার প্লাবনের কথা মিশ্রিত হয়ে ব্যাবিলনের কাহিনী ভারতীয় প্রেক্ষাপটে নতুন করে রচিত হয়। পুরাণসমূহ শেষবারের মতো সংশোধিত ও সম্পাদিত হচ্ছিল, তখনকার ভারতীয় রাজারা নিজেদের সূর্যবংশ ও চন্দ্রবংশের বংশধর বলে দাবি করতেন। সুতরাং এসবের সঙ্গে প্রাচীনতম নৃপতিদের যোগাযোগ প্রমাণ করার চেষ্টাই স্বাভাবিক।
আমাদের ইতিহাসের প্রাচীনতম সাহিত্যিক সূত্র হলো ঋগ্বেদ। এর কিছু কিছু অংশ রচিত হয়েছিল ১০০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দের পূর্বে। অবশিষ্ট বৈদিক সাহিত্য— সামবেদ, যজুর্বেদ ও অথর্ববেদ-এর পরবর্তী কালের রচনা। আর্য জীবনধারা ও সামাজিক প্রতিষ্ঠান সম্পর্কে ঐতিহাসিক বিবরণ রচিত হয়েছে এগুলোর ওপর নির্ভর করে। দুই মহাকাব্য, রামায়ণ ও মহাভারতে বর্ণিত ঘটনাবলির সময়কাল হলো ১০০০ থেকে ৭০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দ। কিন্তু যেহেতু আমরা যে অংশগুলো পড়ি তা খ্রিস্টোত্তর প্রথম সহস্রাব্দের প্রথমার্ধে লিপিবদ্ধ হয়েছে, সেজন্যে বর্ণিত সময় সম্পর্কে বিবরণগুলো নির্ভরযোগ্য, এমন আশা করা চলে না। মহাকাব্যে বর্ণিত ঘটনাগুলোকে ঐতিহাসিকতার মর্যাদা দিতে হলে এগুলোকে সমর্থন করার মতো আরো সাক্ষ্যপ্রমাণই চাই।*
[* এই সময়কার ধ্বংসাবশেষের খননকার্যের ফলে কিছু কিছু সাক্ষ্যপ্রমাণ পাওয়া সম্ভবও হচ্ছে। যেমন, মহাভারতে বর্ণিত পাণ্ডব ও কৌরব রাজাদের রাজধানী হস্তিনাপুরের ধ্বংসাবশেষের খননকার্য হয়েছে কিছুকাল আগে। দেখা গেল, এর কিছু অংশ ৮০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দের গঙ্গার বন্যায় ধুয়ে ভেসে গেছে। পুরাণেও এর উল্লেখ করে বলা হয়েছে, কুরুক্ষেত্র যুদ্ধের পর হস্তিনাপুরের রাজাপদের সপ্তম বংশধরের রাজত্বকালে এই বন্যা এসেছিল। সেই অনুযায়ী কুরুক্ষেত্র যুদ্ধের মোটামুটি সময় হলো ৯০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দ। প্রসঙ্গত উল্লেখযোগ্য : হস্তিনাপুরে ধূসর রঙ করা। মৃৎপাত্রের সংস্কৃতির শেষচিহ্ন পাওয়া গেছে যে স্তরে, বন্যার চিহ্নও ঐ একই স্তরে দেখা গেছে।]
যে আকারে মহাভারত আমাদের হাতে পৌঁছেছে তাকে পৃথিবীর দীর্ঘতম কাব্য বলা যায়। ভূমির অধিকার নিয়ে কৌরব ও পাণ্ডবদের যে কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধ, তা নিয়েই মহাকাব্যের বিস্তার। দিল্লির উত্তরের উর্বর ও গুরুত্বপূর্ণ অঞ্চলটি হলো এর ঘটনাস্থল। কৌরবরা হলো ধৃতরাষ্ট্রের একশত পুত্র। তাঁদের রাজধানী হস্তিনাপুরে। পাণ্ডবেরা পাঁচভাই ছিলেন পাণ্ডুর সন্তান। এঁরা কৌরবদের খুড়তুত ভাই। ধৃতরাষ্ট্র অন্ধ বলে রাজ্যশাসনে অনধিকারী ছিলেন। তাই পাণ্ডবরাই কুরু সিংহাসনের উত্তরাধিকারী হলেন। ক্ষুব্ধ কৌরবরা ষড়যন্ত্র করে পাণ্ডবদের দেশ থেকে বিতাড়িত করলেন। সংঘর্ষ এড়াবার আশায় ধৃতরাষ্ট্র রাজ্য দুভাগ করে একভাগ পাণ্ডবদের দিয়ে দিলেন। তাঁরা দিল্লির কাছাকাছি ইন্দ্ৰপ্ৰস্থ থেকে রাজ্যশাসন করতে লাগলেন। কিন্তু কৌরবরা এই ব্যবস্থায় সন্তুষ্ট না হয়ে পাণ্ডবদের দ্যূতক্রীড়ায় আহ্বান জানালেন! পাণ্ডবরা হেরে গিয়ে তাঁদের ভাগের রাজ্যটি হারালেন। তবু একটা আপস সমাধানে ঠিক হলো যে, পাণ্ডবরা তেরো বছরের জন্যে দেশত্যাগী হলে তারপর রাজা ফিরে পাবেন। পাণ্ডবরা ফিরে এসে রাজ্য দাবি করলে কৌরবরা তখন আর তাতে রাজি হলেন না। তখন পাণ্ডবরা যুদ্ধ ঘোষণা করলেন। কুরুক্ষেত্রের সমভূমিতে আঠারো দিন ব্যাপী এই যুদ্ধ কৌরবদের বিনাশ ঘটল। তারপর পাণ্ডবরা অনেকদিন শান্তিতে রাজ্য শাসন করে তাঁদের এক পৌত্রকে রাজ্যভার দিয়ে সিংহাসন ত্যাগ করে হিমালয়ে মহাপ্রস্থান করলেন।
মূলত মহাভারত হয়তো স্থানীয় একটি সংঘর্ষের বিবরণ মাত্র ছিল। কিন্তু এ কাহিনী চারণ কবিদের কল্পনাকে উদ্দীপ্ত করে এবং মহাভারতের পরিণত আকারে আমরা দেখি এর উত্তরণ ঘটেছে একটি বিশাল যুদ্ধে, যাতে অংশগ্রহণ করে ভারতের সমস্ত জাতি উপজাতি। যদিও মহাভারতের রচনাকার হিসেবে এক ব্রাহ্মণ কবি ব্যাসের নাম করা হয়, প্রকৃতপক্ষে মহাভারত কোনো একজন লোকের রচনা নয়। শুধু যুদ্ধের কাহিনী নয়, তার সঙ্গে এসেছে আরো নানা কাহিনী (তার অনেকগুলোর সঙ্গে মূল কাহিনীর কোনো সম্পর্কই নেই) এবং নানান প্রক্ষিপ্ত অংশ— যেগুলো নিজস্ব কারণেই গুরুত্বপূর্ণ।
রামায়ণ মহাভারতের চেয়ে আয়তনে ছোট এবং তাতে অন্যান্য বিক্ষিপ্ত ঘটনার সমাবেশও কম। এর মূল রচয়িতা হিসেবে কবি বাল্মীকির নাম করা হয়। রামায়ণে বর্ণিত ঘটনাবলির সময়কাল সম্ভবত আরো পরে, কেননা এর ঘটনাস্থল মহাভারতের ঘটনাস্থল থেকে আরো পূর্বদিকে উত্তর প্রদেশের পূর্ব অংশে।
কোশল রাজ্যের উত্তরাধিকারী রাম বিবাহ করেন বিদেহ রাজকুমারী সীতাকে। রামের বিমাতার ইচ্ছে ছিল নিজের ছেলেকে সিংহাসনে বসানো। কৌশলে তিনি রাম, সীতা ও আর এক ভাই লক্ষ্মণকে চোদ্দ বছরের জন্যে নির্বাসনে পাঠিয়ে দিলেন। এরা তিনজনে উপদ্বীপভাগের বনাঞ্চলে চলে গিয়ে ঋষিদের মতো থাকতে লাগলেন। কিন্তু লঙ্কার (শ্রীলঙ্কার) রাক্ষসরাজা রাবণ সীতাকে হরণ করে নিয়ে গেলেন। তখন রাম বানরদের নেতা হনুমানের সাহায্যে এক সেনাদল গঠন করলেন। রাবণের সঙ্গে ভীষণ যুদ্ধের পর রাবণ ও তাঁর সেনাদলের বিনাশ হলো ও সীতা উদ্ধার পেলেন। নিজেকে নিষ্পাপ প্রমাণ করার জন্যে সীতাকে অগ্নিপরীক্ষা দিতে হলো। অবশেষে রামের সঙ্গে তাঁর পুনর্মিলন ঘটল। চোদ্দ বছর শেষ হলে রাম, সীতা ও লক্ষ্মণ কোশল রাজ্যে ফিরে এলেন। বিপুল সংবর্ধনার মধ্যে রামের রাজ্যাভিষেক হলো। তাঁর রাজত্বকাল কাটল সমৃদ্ধি আর ন্যায়বিচারের মধ্য দিয়ে। এখনো রামরাজ্য’ বলতে এক আদর্শ রাজ্যের কল্পনা করা হয়। উপদ্বীপ অঞ্চল অতিক্রম করে রামের শ্রীলঙ্কা বিজয়ের কাহিনী হলো আসলে আর্যদের উপদ্বীপ অঞ্চলে ক্রম প্রবেশের বর্ণনা। আর্যদের দক্ষিণমুখী যাত্রার ঐতিহাসিক সময় ধরা হয় প্রায় ৮০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দ। সুতরাং প্রকৃত রামায়ণের রচনাকাল তার অন্তত পঞ্চাশ বা একশো বছর পরে। রচনাকালকে আরো প্রাচীন বলেও মনে করা যেতে পারে, যদি রাম ও রাবণের যুদ্ধকে আসলে গাঙ্গেয় উপত্যকার কৃষিজীবী ও বিন্ধ্য অঞ্চলের আদিবাসী শিকারী ও খাদ্য সংগ্রহকারী এই দুই মানবগোষ্ঠীর মধ্যে সংঘর্ষের বিবরণ বলে ধরে নেওয়া হয়। পরবর্তীকালের কোনো সংকলয়িতা হয়তো এই ঘটনাকে আরো দক্ষিণে স্থানান্তরিত করে তার সঙ্গে শ্রীলঙ্কার উল্লেখ জুড়ে দিয়েছেন।
ঋগ্বেদের সময়কার আর্যদের ভৌগোলিক জ্ঞানের পরিচয় মেলে বিভিন্ন নদীর উদ্দেশ্যে রচিত শ্লোকের মধ্যে। মনে হয় ঋগ্বেদের সময়ে আর্যরা পাঞ্জাবে ও দিল্লির দিকে ছড়িয়ে পড়েছিল, কিন্তু পূর্বাভিমুখী যাত্রা তখনো শুরু হয়নি। পরবর্তী বৈদিক সূত্রগুলো সম্ভবত মহাকাব্য দুটিতে বর্ণিত ঘটনাবলির সমসাময়িক। এর মধ্যে ভারতবর্ষের ভূগোল সম্পর্কে আরো বিস্তৃত জ্ঞানের পরিচয় আছে। তাতে দুটি সমুদ্র, হিমালয় ও বিন্ধ্য পর্বতমালা এবং সমগ্র গাঙ্গেয় সমভূমির উল্লেখ দেখা যায়।
এখনকার তুলনায় তখনকার কালে আবহাওয়া ছিল আরো বৃষ্টিবহুল। বর্তমানের বিস্তৃত সমভূমিতে ও মরু অঞ্চলে তখন ছিল বনভূমি। প্রথম কয়েকশো বছরে আর্যদের বিস্তার ঘটেছিল ধীরগতিতে। পাথর, ব্রোঞ্জ ও তামার কুঠারের সাহায্যে জঙ্গল পরিষ্কার চলছিল। প্রায় ৮০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দ পর্যন্ত লোহার ব্যবহার ঘটেনি। হস্তিনাপুরের খননকার্য থেকে মনে হয়, ৭০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দের সময় লৌহবস্তুর ব্যবহার ছিল। লোহার উন্নত ধরনের হাতিয়ার দিয়ে তাদের প্রভাব বিস্তারের গতি বাড়তে লাগল। এতে জমির কাজের ওপর চাপ কমে গেল এবং আধ্যাত্মিক ও দার্শনিক চিন্তার অবসর পাওয়া গেল। ৭০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দ ও তার পরবর্তীকালে ব্রাহ্মণ ও উপনিষদ রচনাই তার প্রমাণ।
ঋগ্বেদের সময়ের বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠীর উল্লেখ পাওয়া যায় শ্লোকগুলোর মধ্যে। দশ রাজার যুদ্ধের বর্ণনায় এবং অন্যান্য বৃত্তান্তে উপজাতিগুলোর সংঘর্ষের উল্লেখ আছে। পশ্চিম পাঞ্জাব অঞ্চলে ভারত-উপজাতিদের রাজা ছিলেন সুদাস। তাঁর প্রধান পুরোহিত বিশ্বামিত্র যুদ্ধাভিযান করে রাজ্যবিস্তারে সাহায্য করেন। কিন্তু রাজা চাইলেন বিশ্বামিত্রকে সরিয়ে অধিক শাস্ত্রজ্ঞ বশিষ্ঠকে পুরোহিতের পদ দিতে। ক্রুদ্ধ বিশ্বামিত্র দশটি উপজাতিকে সম্মিলিত করে রাজা সুদাসকে আক্রমণ করলেন। কিন্তু জয় হলো রাজা সুদাসেরই। গবাদি পশু অপহরণ ও ভূমি সংক্রান্ত বিরোধ থেকে প্রায়ই উপজাতিগুলোর মধ্যে যুদ্ধ-বিগ্রহের সূত্রপাত হতো।
কিন্তু উপজাতিগুলোর মধ্যেই যুদ্ধ সীমাবদ্ধ ছিল না। উত্তর ভারতের অনার্য অধিবাসীদের সঙ্গে আর্যদের বিরোধ চলছিল। আর্যরা এই শত্রুদের অত্যন্ত হীনচোখে দেখত। এবং এদের ‘পনি’ ও ‘দাস’ বলে অভিহিত করত। গরু ছিল আর্যদের প্রধান সম্পদ আর পনিরা ছিল গবাদি পশু অপহারক। সেজন্যে প্রায়ই উপদ্রব লেগে থাকত। উপরন্তু পনিরা অদ্ভুত সব দেবতার উপাসনা করত। দাসদের সঙ্গে যুদ্ধ ছিল আরো দীর্ঘায়িত, কারণ তারা এ ভূখণ্ডের আরো স্থায়ী বাসিন্দা। তবে যুদ্ধে আর্যরাই যে বিজয়ী হয়েছিল তা পরিষ্কার। কেননা, পরে ‘দাস’ শব্দের অর্থ হয়ে দাঁড়াল গোলাম। গায়ের কালো রঙ ও নাক-মুখের ভোঁতাভাবের দরুণ দাসদের নিচুশ্রেণি বলে ধরা হতো। আর্যদের গায়ের রঙ ছিল ফরসা ও নাক-চোখ তীক্ষ্ণ। উপরন্তু দাসদের ভাষা ছিল ভিন্ন (তাদের ভাষার কিছু কিছু শব্দ আর্যদের বৈদিক সংস্কৃত ভাষাতেও ঢুকে পড়ে। এছাড়া আগন্তুকদের তুলনায় দাসদের জীবনযাপনের রীতিও ভিন্ন ছিল। আর্যদের আগমন ছিল কারো কারো মতে একটি পশ্চাদাভিমুখী ঘটনা, কেননা হরপ্পার নগর-সভ্যতা আর্যদের সভ্যতা থেকে অনেক উন্নত ছিল। ফলে উত্তর-ভারতে পুনর্বার যাযাবর ও কৃষিভিত্তিক ব্যবস্থার পত্তন ঘটে এবং বিবর্তনের ফলে নতুন করে দ্বিতীয়বার নগরকেন্দ্রিক সভ্যতা স্থাপিত হয়।
আর্যরা যখন এসেছিল তখন তারা ছিল অর্ধ-যাযাবর গো-পালক। গো- পালনই ছিল তাদের প্রধান জীবিকা। গো-ধন দিয়েই মূল্য নিরুপিত হতো এবং সম্পত্তি হিসেবে গবাদি পশুই সবচেয়ে মহার্ঘ ছিল। গরুর উল্লেখ তখনকার ভাষার অঙ্গ হয়ে দাঁড়ায়। এইভাবে ‘গোবিষ্ঠি’ শব্দটির প্রাথমিক অর্থ যদিও ছিল গো-ধন অনুসন্ধান, কালক্রমে অর্থ হয়ে দাঁড়াল— যুদ্ধ করা। অর্থাৎ, গোরুচুরি নিয়ে প্রায়ই উপজাতিগুলো পরস্পরের সঙ্গে সংঘর্ষ হতো। গরুকে সম্ভবত লোকেরা তাদের সম্প্রদায়ের প্রতীকী প্রাণী হিসেবে গণ্য করে ভক্তি করত। বিশেষ কয়েকটি অনুষ্ঠানে গোমাংস খাওয়া মঙ্গলজনক বলে ধরা হলেও অন্য সময়ে গোমাংস খাওয়া নিষিদ্ধ বিবেচিত হতো। গো-ধনের অর্থনৈতিক মূল্য গো- ভক্তির প্রগাঢ়তা বাড়াতেও সাহায্য করেছিল। পরবর্তীকালে গরুকে পবিত্র বলে পূজা করার আপাতযুক্তিহীন মনোভাবের জন্ম হয়েছিল বোধহয় এইভাবেই। আর্যরা আর যেসব জন্তু-জানোয়ার পালন করত, তার মধ্যে প্রধান ছিল ঘোড়া। যাতায়াতের জন্যে ঘোড়ার প্রয়োজন হতো। যুদ্ধে ঘোড়াই ছিল গতির উৎস। উপরন্তু দেবতা ও মানুষের রথ টানত এই ঘোড়াই। বন্য জন্তুর মধ্যে বাঘের চেয়ে সিংহের সঙ্গেই আগে পরিচয় হয়েছিল। হাতি সম্বন্ধে কৌতূহল-মিশ্রিত বিস্ময় ছিল। একে বর্ণনা করা হতো হস্তরিশিষ্ট জন্তু বলে— ‘মৃগহস্তিন’, অর্থাৎ হাতির শুঁড়ের উল্লেখ করা হয়েছে হাত বলে। সাপকে অমঙ্গলের চিহ্ন বলে মনে করা হতো, যেমন অধিকাংশ আদিম জাতিই মনে করত। অবশ্য সাপের সঙ্গে শক্তিরও একটা সমৃদ্ধ স্থাপিত হয়েছিল সম্ভবত সাপের উপাসক শক্তিশালী ‘নাগ’ উপজাতিদের সঙ্গে সংঘর্ষের পর।
উপজাতিগুলো স্থায়ীভাবে এক জায়গায় বসবাস শুরু করায় জীবিকা-রীতিতে কিছুটা পরিবর্তন এল। গো-পালনের বদলে এরা এবার চাষবাসে মন দিল। বিশেষত, লোহার ব্যবহার জানবার পর জঙ্গল পরিষ্কারের কাজ অনেক সহজ হয়ে গিয়েছিল। এর মধ্যে আগুনেরও কিছুটা ভূমিকা ছিল এবং কিছু-কিছু জঙ্গল যে আগুন দিয়েও পুড়িয়ে ফেলা হয় তাতে সন্দেহ নেই। অবশ্য আর্যদের জীবনে কাঠ এত প্রয়োজনীয় উপাদান ছিল বলে মনে হয় আগুন দেওয়ার চেয়ে কাঠ কেটেই বন পরিষ্কার করা হতো বেশি। প্রথমে জমি ছিল গ্রামের সকলের সম্মিলিত সম্পত্তি। তারপরে উপজাতি গোষ্ঠীগুলোর নিজস্ব বাঁধন আলগা হয়ে গেলে পরিবারগুলোর মধ্যে জমি ভাগ হয়ে গেল। এভাবেই উৎপত্তি হলো ব্যক্তিগত সম্পত্তির। অতপর শুরু হলো মালিকানা, জমিবিরোধ ও উত্তরাধিকার নিয়ে সমস্যা। কৃষিকাজে মনোনিবেশ করার পর নতুন নতুন জীবিকারও সৃষ্টি হলো। সূত্রধরদের সমাজে বিশেষ সম্মান দেওয়া হতো, কেননা তারা যে কেবল রথই তৈরি করত তাই নয়, লাঙলও তৈরি করতে জানত। বন থেকে অনায়াসে কাঠ পাওয়া যেত বলে সূত্রধরের জীবিকা বেশ লাভজনক হয়ে ওঠে। সুতরাং এই পেশার সামাজিক মর্যাদাও ছিল উঁচু। গ্রামীণ সমাজের অন্যান্য প্রয়োজনীয় লোকেরা ছিল ধাতুশিল্পীরা, তারা তামা, ব্রোঞ্জ ও লোহা নিয়ে কাজ করত। আর ছিল মৃৎশিল্পী, তন্তুজীবী, নলখাগড়া ও বেতের জিনিস তৈরির কারিগরের দল।
চাষবাস থেকে এলো ব্যবসা-বাণিজ্য। গাঙ্গেয় সমভূমির পূর্বদিক বরাবর জঙ্গল পরিষ্কারের সঙ্গে সঙ্গে নদীপথই প্রধান বাণিজ্যের রাস্তা হয়ে দাঁড়াল। নদী- তীরবর্তী বসতিগুলো ছিল পণ্য বিক্রয়ের বাজার, ধনবান ভূমিজীবীরা অন্যান্য লোক নিয়োগ করত তাদের জমিতে চাষ করার জন্যে। অবসর ও সম্পদের দাক্ষিণ্যে তারাই হলো বণিক সম্প্রদায়। সুতরাং সমাজের ভূম্যধিকারী শ্রেণি থেকেই এলো ব্যবসায়ী শ্রেণি। প্রথমদিকে ব্যবসা ছিল আঞ্চলিক এবং আর্যরা তখনো সুদূরপ্রসারী বাণিজ্যের কথা ভাবেনি। অথচ ঋগ্বেদে যে জাহাজ ও সমুদ্রযাত্রার উল্লেখ আছে তাও নিশ্চয় সম্পূর্ণভাবে কাল্পনিক নয়। পারস্য উপসাগরীয় অঞ্চলে পশ্চিম এশীয় সামুদ্রিক বাণিজ্য কেন্দ্রগুলো হরপ্পা সভ্যতার সময় থেকেই ভারতের সঙ্গে বাণিজ্যে লিপ্ত ছিল। তবে হয়তো এই বাণিজ্য প্রধানত উপকূলবর্তী অঞ্চলেই সীমাবদ্ধ ছিল বলে আর্য অর্থনীতিতে কোনো উল্লেখযোগ্য প্রভাব বিস্তার করতে পারেনি। আর্যদের অপেক্ষাকৃত অনুন্নত কারিগরিবিদ্যার দরুণ বাণিজ্য সীমিত ছিল নিকটবর্তী অঞ্চলেই। বিনিময় প্রথার সাহায্যেই ব্যবসা চলত তখন। বড় বড় কেনাবেচার ব্যাপারে গরুকেই মূল্যমান ধরা হতো। এর ফলে ব্যবসার পরিধি বিস্তার ছিল কঠিন। মূল্যমান হিসেবে ‘নিষ্ক’ শব্দটিরও প্রয়োগ দেখা যায়। পরবর্তীকালে একটি স্বর্ণমুদ্রাকেও এই নামে অভিহিত করা হতো। কিন্তু প্রথম যুগে সম্ভবত এই শব্দটি কেবলই সোনার বিশেষ একটি মাপ বোঝাত।
শাসন পরিচালনার উৎপত্তি সম্বন্ধে প্রচলিত কথা ও কাহিনী থেকে আর্যদের রাজনৈতিক সংগঠনের উন্মেষের সন্ধান পাওয়া যায়। দেবতা ও অসুরদের মধ্যে যুদ্ধে দেবতাদের পরাজয়ের আশঙ্কা দেখা দেওয়ায় তারা নিজেরা একত্র হয়ে নেতা হিসেবে একজন রাজা নির্বাচন করল। ফলে শেষপর্যন্ত জয় হলো দেবতাদেরই। এইরকম আরো নানা প্রচলিত কাহিনী থেকে রাজা সম্পর্কিত ধারণায় উৎপত্তির সূত্র পাওয়া যায়। উপজাতিগুলো ছিল গোষ্ঠীপতি দ্বারা শাসিত। গোষ্ঠীপতি গোড়ায় কেবল উপজাতির নেতাই ছিলেন। কিন্তু ক্রমশ যখন প্রতিরক্ষার প্রয়োজন বাড়ল, গোষ্ঠীর মধ্যে সবচেয়ে যে যুদ্ধপটু ও প্রতিরক্ষায় দক্ষ তাকেই গোষ্ঠীর নেতা নির্বাচন করা হলো। ক্রমে ক্রমে নেতারা রাজাদের মতো বিভিন্ন অধিকার ও সুযোগ-সুবিধা নিজেদের জন্যে গ্রহণ করল। রাজশক্তির দ্রুত বিস্তারকে অবশ্য সীমাবদ্ধ রাখা হলো দুটি উপজাতীয় সমাবেশের সাহায্যে— ‘সভা’ ও ‘সমিতি’। এ দুটির সঠিক কাজ যে কি ছিল তা জানা যায়নি। সম্ভবত ‘সভা’ ছিল উপজাতীয় বয়োবৃদ্ধদের সমাবেশ ও ‘সমিতি’তে গোষ্ঠীর সমস্ত লোকেরাই সমবেত হতো। যেসব উপজাতিদের কোনো নির্বাচিত রাজা ছিল না, এই সমাবেশগুলোই শাসন নির্বাহ করত। এইরকম সভা-শাসিত উপজাতিদের সংখ্যাও কিন্তু কম ছিল না। রাজ্যগুলোর ভৌগোলিক পরিধি ছিল স্বভাবতই সীমিত, কেননা তখনো পর্যন্ত রাজারা আসলে বিশেষ ক্ষমতাপ্রাপ্ত গোষ্ঠীনেতা মাত্র।
প্রথমযুগে, বৈদিক রাজারা ছিলেন প্রধানত সামরিক নেতা। যুদ্ধে দক্ষতা ও গোষ্ঠীর রক্ষাকার্যে সাফল্যের ওপরই তাঁর রাজা থাকা না-থাকা নির্ভর করত। তিনি স্বেচ্ছায় দেওয়া উপহার গ্রহণ করতেন। কিন্তু জমির ওপর তাঁর কোনো অধিকার ছিল না এবং নিয়মিত কোনো করও তিনি পেতেন না। যুদ্ধ বা গো-হরণ থেকে যা পাওয়া যেত তার একটা অংশ তাঁর প্রাপ্য ছিল। ধর্মীয় ব্যাপারে তাঁর ভূমিকা ছিল সামান্যই, কেননা পুরোহিতদের নির্দিষ্ট ক্রিয়াকলাপও ছিল। কিন্তু রাজার ওপর ক্রমশ দেবত্ব আরোপ করায় এ অবস্থার পরিবর্তন ঘটল। পরবর্তী যুগের কাহিনী থেকে জানা যায়, সে সময়ে বিশ্বাস ছিল যুদ্ধজয়ের জন্যে দেবতারাই রাজা নির্বাচন করতেন। এবং নির্বাচিত রাজা কিছু বিশিষ্ট ভগবদ্দত্ত গুণের অধিকারী বলে গণ্য হতেন। এইভাবে নশ্বর মানুষের ওপর স্বর্গীয় গুণ ও লক্ষণ আরোপিত হলো। মানুষ ও দেবতার যোগসূত্র ছিলেন পুরোহিতরা। তাঁরা রাজাদের ওপর দেবত্ব আরোপের জন্য বিশেষ পশুবলির বিধান দিলেন। রাজাদের ওপর দেবত্ব আরোপের সঙ্গে সঙ্গে পুরোহিতদেরও একটা বিশেষ স্থান ও ভূমিকা নির্দিষ্ট হয়ে গেল। রাজা ও পুরোহিতদের পারস্পরিক নির্ভরতা শুরু হলো এভাবেই। এবার ঝোঁক দেখা গেল রাজার পদকে বংশানুক্রমিক করে তোলার, ‘সভা’ ও ‘সমিতি’র ভূমিকারও স্বাভাবিক পরিবর্তন এল। রাজার স্বেচ্ছাচার এই সমাবেশ দুটি সংযত করতে পারলেও রাজাই হলেন প্রকৃত শাসনকর্তা।
একটা প্রাথমিক শাসনব্যবস্থার সূত্রপাত ঘটল। রাজাই অবশ্য তার মূল কেন্দ্র। উপজাতীয় রাজ্যে (রাষ্ট্রে) থাকত বিভিন্ন উপজাতি (জন), উপজাতিগোষ্ঠী (বিশ) এবং গ্রাম। এর কেন্দ্র ছিল পরিবার (কুল) এবং পরিবারের প্রাচীনতম পুরুষ ব্যক্তিই ছিলেন পরিবারের প্রধান (কুলপা)। গ্রামের প্রধান ব্যক্তিরা ও গোষ্ঠীর প্রবীণরা রাজাকে সাহায্য করতেন। রাজার দুজন ঘনিষ্ঠ সহায়ক ছিলেন, পুরোহিত ও সেনানী অর্থাৎ প্রধান সেনাপতি। পুরোহিত ধর্মীয় কাজ ছাড়াও জ্যোতিষী ও পরামর্শদাতার কাজও করতেন। গুপ্তচর, সংবাদ-সংগ্রাহক এবং দূত— এদের সকলকে নিয়ে ছিল রাজার অনুচরদের বৃত্ত। পরবর্তীকালে রাজার সহায়কগোষ্ঠী আর একটু বিস্তৃত হয়েছিল। তাঁদের মধ্যে ছিলেন রথচালক, কোষাধ্যক্ষ, গৃহস্থালির তত্ত্বাবধায়ক ও দ্যুতক্রীড়ার ব্যবস্থাপক। রাজা এবং প্রজা উভয়েরই জুয়াখেলায় রীতিমতো আগ্রহ ছিল।
আর্যরা যখন প্রথম ভারতে আসে, তাদের মধ্যে তিনটি সামাজিক শ্রেণি ছিল— যোদ্ধা বা অভিজাত শ্রেণি, পুরোহিত ও সাধারণ মানুষ। জাতিভেদ সম্পর্কে তেমন কোনো সচেতনতার পরিচয় পাওয়া যায়নি। একজন লিখে গেছেন, ‘আমি একজন কবি, আমার বাবা চিকিৎসক, আর মার কাজ হলো শস্যদানা পেষণ।’ পেশা পুরুষানুক্রমিক ছিল না এবং তিন সামাজিক শ্রেণির মধ্যে বিবাহ ছিল অবাধ। এক পঙ্ক্তিতে বসে ভোজনও নিষিদ্ধ ছিল না। সামাজিক ও অর্থনৈতিক সংগঠনে সুবিধার জন্যেই এই শ্রেণিবিভাগ। বর্ণভেদ (শ্রেণিভেদ নয়) প্রথম দেখা দিল যখন আর্যরা দাসদের নিজেদের সামাজিক গণ্ডির বাইরে গণ্য করতে শুরু করল। দাসদের সম্পর্কে আর্যদের একটা ভয় ছিল এবং তাছাড়া দাসদের সঙ্গে মিশ্রণ ঘটলে আর্যদের নিজস্ব সত্তার অবসান ঘটবে, এ আশঙ্কাও ছিল। দাসদের গায়ের রঙ কালো ও তাদের সংস্কৃতি ভিন্ন হওয়ায় প্রভেদটা হলো প্রধানতই বর্ণগত। সংস্কৃত ভাষার বর্ণ শব্দটির অর্থ হলো রঙ। এই যুগে বর্ণভেদের ব্যাপারে গায়ের রঙের ওপর বেশ জোর দেওয়া হয়েছিল। ভবিষ্যতে উত্তর-ভারতীয় আর্য-সংস্কৃতিতে এই ধারণা অঙ্গীভূত হয়ে পড়ল। সুতরাং প্রথমে প্রভেদ ছিল আর্য ও অনার্যদের মধ্যে। আর্যরা ছিল দ্বিজ (প্ৰথম জন্মের পরও তাদের দ্বিতীয় জন্ম হতো উপনয়নের সময়)। আর্যদের মধ্যে ছিল ক্ষত্রিয়* (যোদ্ধা ও অভিজাত সম্প্রদায়), ব্রাহ্মণ (পুরোহিত) ও বৈশ্য (কৃষিজীবী), চতুর্থ বর্ণ ছিল শূদ্র, অর্থাৎ দাস ও আর্য-দাস মিশ্র সম্প্রদায়।
[* প্রথমদিকের লেখায় যোদ্ধা ও অভিজাতদের ‘রাজন্য’ বলে উল্লেখ করা হয়েছে। ক্ষত্রিয় শব্দের ব্যবহার শুরু হয় আরো পরবর্তীকালে। বিভ্রান্তি এড়ানোর জন্যে এখানে কেবল ‘ক্ষত্রিয়’ শব্দটি ব্যবহৃত হবে।]
কার্যত বর্ণভেদ সমাজকে অবিভাজ্য চার অংশে মোটেই ভাগ করেনি। ব্রাহ্মণরা প্রথম তিনটি বর্ণের মধ্যে বিভিন্ন পেশার লোকদের সুবিন্যস্ত করার চেষ্টা করেন। বিভিন্ন পেশার মধ্যে মিলন ও সমন্বয় অনিবার্য ছিল এবং এর মধ্য দিয়েই বিভিন্ন বর্ণের মিশ্রণ শুরু হয়। কিন্তু চতুর্থ বর্ণটির ভিত্তি ছিল সম্ভবত জাতি এবং পেশা (পরবর্তীকালেও এইভাবেই উদ্ভব হয়েছিল জাতিচ্যুতদের। তাদের এতই নিচু হিসেবে দেখা হতো যে কয়েক শতাব্দী পরে তাদের স্পর্শকেও অপবিত্র বলে গণ্য করা হলো) কোনো পেশার বর্ণগত মর্যাদা দীর্ঘদিন পরে পরিবর্তিতও হতো। ক্রমে ক্রমে আর্য-বৈশ্যরা ব্যবসায়ী ও জমির মালিক হয়ে উঠল। অপরদিকে শূদ্ররা কিছুটা মর্যাদা পেয়ে হয়ে দাঁড়ালো কৃষিজীবী (ক্রীতদাস হিসেবে নয়)। দাসদের ওপর আর্যদের কর্তৃত্ববিস্তার তখন সম্পূর্ণ। ওদিকে শূদ্ররা কৃষিজীবীর সম্মান পেলেও তাদের দ্বিজত্ব দেওয়া হলো না। সেজন্যে বৈদিক ধর্মীয় অনুষ্ঠানেও তাদের অংশগ্রহণের অধিকার জন্মাল না। ফলে তারা তাদের নিজস্ব দেবতার পূজা শুরু করল। এই ধরনের সামাজিক বিভাগের ফলে পরবর্তী শতাব্দীগুলোতে নতুন নতুন জাতিগোষ্ঠীকে গ্রহণ করতে অসুবিধা হয় না। নতুবা যারা এলো তাদের আলাদা একটি উপবর্ণে চিহ্নিত করা হতো। সেভাবেই সবাই বৃহত্তর বর্ণবিভাগের অন্তর্গত হয়ে পড়ত। বর্ণবিভাগের মধ্যে নতুন উপবর্ণের মর্যাদা নির্ভর করত তার পেশার ওপর, কখনো বা সামাজিক স্তরের ওপর।
বর্ণপ্রথার পেছনে আরো কারণ ছিল। শূদ্ররা যেভাবে কৃষিজীবীতে রূপান্তরিত হয়েছিল সেটাও এই কারণগুলোর মধ্যেই নিহিত আছে। যাযাবর পশুচারণের জীবন থেকে স্থিতিশীল কৃষিভিত্তিক অর্থনীতিতে পরিবর্তনের পর শ্রমবিভাগ আর্যসমাজের একটি বৈশিষ্ট্য হয়ে উঠল। বনাঞ্চল পরিষ্কার করে নতুন নতুন জনবসতি স্থাপনের মধ্য দিয়ে একটি ব্যবসায়ী সম্প্রদায়ের জন্ম হলো। তারা জিনিসপত্র সরবরাহ ও বিনিময় করত। স্বাভাবিকভাবেই কৃষিজীবী ও ব্যবসায়ীদের মধ্যে কাজকর্মের ভাগাভাগি হয়ে গেল। কৃষিজীবীরা বন পরিষ্কার করে নতুন চাষের জমি তৈরি করত, আর ব্যবসায়ীরা বিভিন্ন জনবসতির মধ্যে অর্থনৈতিক সম্পর্ক স্থাপন করত। ব্যবসায়ীরা আসত অবস্থাপন্ন ভূস্বামীদের মধ্য থেকে, কারণ তারাই টাকাকড়ির লেনদেন ভালো বুঝত। পুরোহিতরা বরাবরই আলাদা একটা সম্প্রদায়। যোদ্ধাদের নেতা ছিলেন রাজা। এদের ধারণা ছিল, প্রতিরক্ষার ব্যবস্থা করাই তাদের একমাত্র কাজ এবং এর ওপরই তাদের গোষ্ঠীর ভালোমন্দ নির্ভর করছে। ক্ষমতার শীর্ষবিন্দুতে ছিলেন রাজা। তারপরই বর্ণপ্রথার উপরের শ্রেণিতে স্থান পেল যোদ্ধারা (ক্ষত্রিয়), তার পরের স্থান পুরোহিতদের (ব্রাহ্মণ)। এরপর সমৃদ্ধ ভূস্বামী ও ব্যবসায়ীরা (বৈশ্য) ও অবশেষে কৃষিজীবী (শূদ্র)।
সমাজের এই বিভাগের গুরুত্ব ও উচ্চবর্ণের অসীম ক্ষমতার তাৎপর্য সম্পর্কে পুরোহিতরা সহজেই সচেতন হয়ে উঠেছিল। তারা কৌশলে বর্ণবিভাগের উচ্চতম স্থানটি আদায় করে নিল। যেহেতু তারাই কেবল রাজার ওপর দেবত্ব আরোপ (রাজার পক্ষে তা এতদিনে আবশ্যিক হয়ে উঠেছিল) করতে পারে, তাই সর্বোচ্চ ক্ষমতার অধিকারী তারাই হয়ে উঠল। বর্ণবিভাগকে তারা এবার ধর্মীয় স্বীকৃতি দিল। বর্ণবিভাগের পৌরাণিক উৎপত্তি সম্পর্কে ঋগ্বেদের শেষের দিকে একটি স্তোত্র পাওয়া যায় :
যখন দেবতারা বলিদানের জন্যে উৎসর্গ হিসেবে মানুষকে বেছে নিলেন…. যখন তাঁরা মানুষকে বিভক্ত করলেন, কতখণ্ড হয়েছিল মানুষের শরীর? কি নাম দেওয়া হলো তার মুখকে, তার বাহুকে, তার জঙ্ঘা ও পদযুগলকে? ব্রাহ্মণ হলো তার মুখ, বাহু দিয়ে এলো যোদ্ধা। বৈশ্য হলো তার জঙ্ঘা, পদযুগল থেকে এলো শূদ্র। উৎসর্গের দ্বারা দেবতারা সৃষ্টির উদ্দেশ্যে যজ্ঞ করলেন, এভাবেই প্রথম ধর্মের সূচনা হলো। এর পর দেবতারা দ্যুলোকে গমন করলেন, এখানেই শাশ্বত আত্মা এবং দেবতাগণ বিরাজ করেন।
বংশানুক্রমিকতা এসে যাওয়ার ফলে বর্ণভেদ প্রথা প্রবল স্থায়ী হয়ে দাঁড়াল। সমবেত ভোজন সম্পর্কে যে আদিম নিষেধ প্রচলিত ছিল তা এখন বর্ণভেদ প্রথা- সম্পর্কীয় একটি নিয়মে এসে দাঁড়ালো। এর থেকে এলো বিয়ে নিয়ে নানা বাধা- নিষেধ এবং নিজস্ব বর্ণের ভেতরে ও বাইরে বৈবাহিক সম্পর্ক স্থাপন বিষয়ক নিয়মকানুন। বর্ণভেদ প্রথার ভিত্তি ও প্রচলন কেবল চারটি প্রধান বিভাগের ওপর নির্ভরশীল ছিল না। আসল ছিল পেশাগত বিভাগ অনুসারে অসংখ্য উপবর্ণের অস্তিত্ব। শেষ পর্যন্ত উপবর্ণই (জাতি বা আক্ষরিক অর্থে জন্ম) হিন্দুসমাজের প্রাত্যহিক জীবনধারায় মূল বর্ণবিভাগের চেয়ে বেশি প্রভাব বিস্তার করল। বর্ণ সেখানে একটা তত্ত্বনির্ভর মূল কাঠামো মাত্র। উপবর্ণের পারস্পরিক সম্পর্কের ভিত্তি ছিল কর্মবিভাগ ও অর্থনৈতিক নির্ভরতা। বর্ণবিভাগ যখন বংশানুক্রমিক হয়ে উঠল এবং পেশার ও উপবর্ণের পারস্পরিক সম্পর্ক স্থাপিত হয়ে গেল, কোনো উপবর্ণভুক্ত লোকের পক্ষে উচ্চতর বর্ণে প্রবেশ করা অসম্ভব হয়ে দাঁড়াল। সম্পূর্ণ উপবর্ণটির পক্ষে হয়তো উঁচুদিকে ওঠা সম্ভব ছিল, যদি উপবর্ণের সমস্ত লোক স্থান ও পেশা পরিবর্তন করত। ব্যক্তিবিশেষের পক্ষে এই প্রথার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানানোর একমাত্র পথ ছিল বর্ণভেদ প্রথায় অবিশ্বাসী কোনো সম্প্রদায়ে যোগ দেওয়া। এই ধরনের সম্প্রদায়ের উদ্ভব শুরু হলো খ্রিস্টপূর্ব ষষ্ঠ শতাব্দীর পর থেকে।*
[* বর্ণভিত্তিক সমাজের বিবর্তন ঘটেছিল স্বভাবতই খুব ধীরে ধীরে। সহজ করার জন্যে, পুরো ব্যাপারটা এখানে খুব স্বল্প পরিসরে বোঝানো হয়েছে।]
সমাজের ক্ষুদ্রতম বিভাগ ছিল পরিবার। কয়েকটি পরিবার নিয়ে হতো গ্রাম। সম্ভবত, প্রথম দিককার গ্রামের পরিবারগুলো পরস্পরের আত্মীয় ছিল। বৃহদাকার পরিবারে তিনপুরুষের লোকজন একই সঙ্গে বাস করত। বাল্যবিবাহের প্রচলন ছিল না, এবং জীবনসঙ্গী বা সঙ্গিনী বেছে নেবার যথেষ্ট স্বাধীনতা ছিল। বরপণ ও কন্যাপণ দুই-ই চালু ছিল। আর্য পরিবারে ছেলের জন্ম বিশেষভাবে কাম্য ছিল, কেননা বহু গুরুত্বপূর্ণ অনুষ্ঠানে পুত্রের উপস্থিতির প্রয়োজন ছিল। মেয়েরা মোটামুটি স্বাধীন ছিল। কিন্তু আশ্চর্যের কথা এই, প্রাচীন গ্রীকরা যেমন দেবীদের ক্ষমতা ও শক্তির আকর হিসেবে কল্পনা করেছিল, ভারতীয় আর্যরা তা কখনো করেনি। আর্যদেবীরা ছিলেন শান্ত প্রকৃতির ও ঘরোয়া। স্বামীর মৃত্যুর পর বিধবা স্ত্রীরা প্রতীক আত্মোৎসর্গের অনুষ্ঠান করত। এই অনুষ্ঠান কেবল অভিজাতদের মধ্যেই সীমাবদ্ধ কিনা, তা জানা যায় না। পরের যুগে স্বামীর চিতায় বিধবাদের আত্মোৎসর্গের প্রথা এসেছিল সম্ভবত এই অনুষ্ঠানের সূত্র ধরেই। বৈদিক যুগে সতীপ্রথা যে নিতান্তই প্রতীকী ছিল তার প্রমাণ হলো বৈদিক সাহিত্যে বিধবাদের পুনর্বিবাহের উল্লেখ। এই বিয়ে হতো সাধারণত স্বামীর ভাইয়ের সঙ্গে। পুরুষ ও মেয়েদের বহুবিবাহ অজানা না হলেও একবিবাহই ছিল সাধারণ প্রচলিত রীতি। নিকট আত্মীয়দের মধ্যে বিবাহের ব্যাপারে কড়া বিধিনিষেধ ছিল। নিকট আত্মীয়দের মধ্যে যৌন-সম্পর্কের ব্যাপারে আর্যদের আতঙ্কিত মনোভাব ছিল (যদিও দেবতাদের মধ্যে তেমন সম্পর্কের উল্লেখ পাওয়া যায়)। বলা হয় বিশ্বের আদিযুগীয় দুই যমজ থেকেই সমগ্র মানবজাতীর উৎপত্তি। কিন্তু মৃত্যুর দেবতা যমকে যখন তার বোন যমী প্রেম নিবেদন করেন, যম তাকে প্রত্যাখ্যান করলেন। মৃত্যুর দেবতার সঙ্গে অনাচারের কাহিনী জড়িত থাকায় মনে হয় যে, এই প্ৰথা সম্পর্কে মনোভাব ছিল মৃত্যুভয়ের সমতুল্য।
পরিবারের লোকজন তাদের গৃহপালিত পশুদের সঙ্গে একই গৃহের মধ্যে বাস করত। পরিবারের অনির্বাণ অগ্নিকুণ্ডটিকে শ্রদ্ধার সঙ্গে দেখা হতো। কাঠের কাঠামোর উপর বাড়ি তৈরি হতো। চারকোণে চারটি থাম ও তার উপর আড়াআড়ি বরগার চারিদিক ঘিরে ঘরের দেওয়াল তৈরি হতো। নলখাগড়ার দেওয়ালের ভিতর ভরে দেওয়া হতো খড়। বাঁশের লম্বা লম্বা টুকরোর উপর খড় বিছিয়ে দিয়ে তৈরি হতো ঘরের ছাদ। পরবর্তী শতাব্দীতে আবহাওয়া অনেক শুকনো হয়ে গেলে মাটির দেওয়াল দিয়ে ঘর তৈরি শুরু হয়। প্রধান খাদ্যদ্রব্য ছিল দুধ, ঘি, শাকসব্জি, ফল ও যব। কোনো ধর্মীয় উৎসব বা অতিথি সমাগমের সময় খাদ্য-তালিকার পরিবর্তন হতো। ষাঁড়, ছাগল ও ভেড়ার মাংস, আর মাদকদ্রব্য হিসেবে সূরা বা মধুর ব্যবস্থা থাকত।
লোকের পোশাক-পরিচ্ছদ সাদাসিধে ছিল। অধিকাংশ লোকই কেবল দেহের নিম্নাংশের জন্যেই পোশাক ব্যবহার করত। কিংবা, ঢিলে আলখাল্লা। কিন্তু নানান গড়নের গয়নার খুব প্রচলন ছিল। লোকে গয়না ভালোও বাসত। অবসর কাটত, নাচ, গান, বাজনা ও জুয়াখেলার মধ্য দিয়ে। আরো উৎসাহীরা রথের দৌড়ের ব্যবস্থা করত। বিভিন্ন ধরনের বাদ্যযন্ত্রের উল্লেখ থেকেই আর্যদের গান-বাজনা সম্পর্কে আগ্রহের কথাটা বোঝা যায়। ঢোল, বীণা ও বাঁশির ব্যবহার ছিল খুব। পরে এলো করতাল ও তারের বাজনা। সামবেদ গানের জন্য শব্দ, সুর ও মাত্রা সম্পর্কে যা নির্দেশ পাওয়া যায়, তা সংগীত সম্পর্কে বিশেষ জ্ঞানেরই পরিচয় দেয়। সপ্তসুরের কথাও আর্যরা জানত। জুয়াখেলা বেশ জনপ্রিয় ছিল। জুয়াড়ীরা হেরে গিয়ে কপাল চাপড়াত, কিন্তু খেলা ছাড়ত না। বৈদিক শ্লোকগুলো থেকে পাশার বিষয়ে ও খেলার নিয়মকানুন সম্পর্কে অনেক কথা জানা যায়। রথের দৌড় ছিল বিশেষ মর্যাদাসম্পন্ন ব্যাপার এবং বিভিন্ন রাজকীয় অনুষ্ঠানের অঙ্গ হিসেবেও রথের দৌড়ের ব্যবস্থা ছিল। হালকাভাবে তৈরি দু’ঘোড়ায়-টানা এই রথগুলোতে ছ’জন মানুষ বসতে পারত এবং এর চাকাগুলো ছিল শলাকাবিশিষ্ট।
হরপ্পার লোকেদের নিজস্ব বর্ণমালা থাকলেও আর্যরা কিন্তু বহুদিন পর্যন্ত লিখতে জানত না। সম্ভবত ৭০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দের আগে বর্ণমালা আবিষ্কার হয়নি, কেননা লেখার ব্যবহার সম্বন্ধে উল্লেখ পাওয়া যায় মাত্র ৫০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দ থেকে। ভারতে লেখার প্রথম যেসব নমুনা পাওয়া গেছে (৩০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দের সময়, সম্রাট অশোকেয় শিলালিপি), তা দেখে মনে হয়, এই লিপি আসিরীয়দের দ্বারা প্রভাবিত ছিল। বৈদিক যুগের প্রথমদিকে শিক্ষা ছিল মৌখিক। সে যুগের একটি চমৎকার বর্ণনা পাওয়া যায়— বর্ষার সময়ে ব্যাঙরা যেমন একত্র হয়ে একে অপরের ডাকে প্রতিধ্বনি তুলে ডাকতে থাকে, ছাত্ররা তেমনি শিক্ষকের কণ্ঠস্বরের প্রতিধ্বনি তুলে নিজেরাও আবৃত্তি করে। মুখস্থ করার কিছু-কিছু নির্দিষ্ট নিয়ম ছিল। বৈদিক যুগের পরের দিকে ছাত্রদের ব্রহ্মচর্যপালন আবশ্যিক হয়ে গেল। শহর থেকে দূরে গুরুর কাছে গিয়ে ছাত্ররা কয়েক বছর থাকত; উচ্চশ্রেণীর লোকদের মধ্যেই শিক্ষা সীমাবদ্ধ ছিল। যদিও বলা হলো, সমস্ত ‘দ্বিজ’ বর্ণভুক্ত লোকরাই বেদ পড়তে পারে, প্রকৃতপক্ষে কেবল ব্রাহ্মণরাই বেদশিক্ষার অধিকারী ছিল। অঙ্ক, ব্যাকরণ ও ছন্দশাস্ত্র পাঠ্যবিষয়ের অন্তর্ভুক্ত ছিল। ঋগ্বেদের কিছু- কিছু শ্লোকে আনুষ্ঠানিক নৃত্য ও কথোপকথন আবৃত্তির উল্লেখ আছে। একে নাটকের আদিম রূপ হিসেবে ধরা যায়। চারণকবিদের কাহিনী, যার থেকে মহাকাব্য রচনার সূচনা হয়, তাও নাটকেররূপে উপস্থিত করার সুযোগ ছিল।
কোনো নির্দিষ্ট আইনবিষয়ক সংস্থা এসময়ে ছিল না। প্রথাই ছিল আইন। রাজা ও প্রধান পুরোহিত সম্ভবত সমাজের কিছু-কিছু বয়োবৃদ্ধ লোকদের সাহায্যে বিচারের কাজ করতেন। বিভিন্ন ধরনের চুরি, বিশেষত গোরুচুরিই ছিল প্রধান অপরাধ। নরহত্যার ক্ষেত্রে নিয়ম ছিল হত্যাকারী নিহত ব্যক্তির পরিজনকে ক্ষতিপূরণ হিসেবে মূল্য ধরে দেবে (যে প্রথাকে অ্যাংলো-স্যাক্সনরা বলত ‘ওয়েরগেল্ড’— wergeld) এবং সাধারণত একশো গরু দিয়ে এই ক্ষতি পূরণ করা হতো। মৃত্যুদণ্ডের চিন্তা আরো পরে এসেছে। বিশেষ পরীক্ষার সাহায্যেও বিচার সম্পন্ন করা হতো। যেমন, উত্তপ্ত কুঠারে জিভ ঠেকিয়ে অভিযুক্ত ব্যক্তিকে তার নির্দোষিতা প্রমাণ করতে বলা হতো। বৈদিক যুগের পরের দিকে জমির অধিকারগত বিরোধ ও উত্তরাধিকার সমস্যারও উল্লেখ পাওয়া যায়। জ্যেষ্ঠ সন্তানের উত্তরাধিকার লাভের নিয়মের উল্লেখও পাওয়া যায়। কিন্তু সে প্রথা বেশিদিন চলেনি। এই সময়েই বিচার-ব্যবস্থার মধ্যে বর্ণভেদ প্রথার ছায়াপাত ঘটল— উচ্চবর্ণের অপরাধীরা লঘুদণ্ডে দণ্ডিত হতো।
বর্ণভেদ প্রথার মতো ধর্মীয় উপাসনাও আরম্ভে আর্য ও অনার্য— দুই ভিন্ন আচার অনুসরণ করে। দুয়েরই কিছু-কিছু চিহ্ন এখনকার হিন্দুধর্মে দেখতে পাওয়া যায়। কোনো কোনো নিয়ম নিজস্ব আকারে টিকে গেছে, অন্যগুলো মিলে মিশে গেছে। হরপ্পার লোকের উর্বরা সমৃদ্ধির প্রতীক হিসেবে উপাসনা করত— মাতৃদেবীর, ষাঁড় বা শৃঙ্গবিশিষ্ট দেবতার এবং বিশেষ কয়েকটি পবিত্র গাছের। হিন্দুধর্মে এখনো এসবের পুজো হয়। বেদভিত্তিক বাহ্মণ্য উপাসনার পদ্ধতি ছিল আরো বিমূর্ত। ফলে অল্পলোকই তাতে আকৃষ্ট হতো। ভারতীয় সংস্কৃতির দার্শনিক ও তাত্ত্বিক উপলব্ধিতে যদিও এই পদ্ধতির প্রভাব পড়েছিল, কার্যত অধিকাংশ লোকই সাদামাটা পার্থিব পদ্ধতিতেই পুজো করতে চাইত। ঋগ্বেদের শ্লোকের মধ্যে আর্যদের ধর্মচর্চার আদিরূপের উল্লেখ পাওয়া যায়। ঋগ্বেদের ধর্ম পরবর্তী যুগের হিন্দু-ধর্মকে নানাভাবে প্রভাবান্বিত করলেও দুটির পার্থক্য কিন্তু সুস্পষ্ট।
আর্যদের সর্বপ্রথম ধর্মীয় ধারণা ছিল আদিম সর্বপ্রাণবাদী, অর্থাৎ তাদের চারদিকের যে-সমস্ত প্রাণী বা শক্তিকে তারা বুঝতে পারত না বা নিয়ন্ত্রণও করতে পারত না, তাদের ওপর দেবত্ব আরোপ করে পুরুষ বা স্ত্রী দেবতা হিসেবে গণ্য করা হতো। ইন্দ্র ছিলেন আর্যকল্পনায় শ্রেষ্ঠ পুরুষ— শক্তির দেবতা, যুদ্ধে অজেয়, অসুর-বিধ্বংসী এবং প্রয়োজনমতো জনপদ বিনাশে উদ্যত। বজ্র ও বৃষ্টির দেবতা ইন্দ্রকে আর্যদের কাছে অপরাহত সমস্ত শক্তির বিজেতা বলে মনে করা হতো। আগুনের দেবতা অগ্নি* সম্পর্কেও নানা প্রশস্তি করা হয়েছে। দৈনন্দিন জীবনে প্রতিগৃহে অগ্নির স্থান ছিল খুব উচ্চে। বিবাহ অনুষ্ঠানে অগ্নিদেবতাকে সাক্ষী রাখা হতো। আজ পর্যন্ত হিন্দুধর্মে সেই প্রথা চলে আসছে। পঞ্চভূতের মধ্যে অগ্নিকে পবিত্রতম মনে করে যথোচিত শ্রদ্ধা প্রদর্শন করা হতো। দেবতা ও মানুষের মধ্যে আগুনই ছিল যোগসূত্র। প্রাচীনতম দেবতাদের প্রারম্ভিক কল্পনা খুঁজে পাওয়া যায় ইন্দো-ইউরোপীয় অতীতে। ইন্দো-ইউরোপীয়দের মুখ্য দেবতা ছিলেন ‘দ্যৌস’ (জিউস), কিন্তু বৈদিক দেব-দেবীদের মধ্যে তাঁর স্থান অতটা উঁচু ছিল না। অন্য উপাস্য দেবতা ছিলেন সূর্য, সবিতৃ (এই সৌরদেবতার উদ্দেশ্যেই গায়ত্ৰীমন্ত্র নিবেদিত), সোম (সোমরস নামক উত্তেজক পানীয়ের দেবতা) এবং বরুণ (ইউরেনাস এঁর সঙ্গে তুলনীয়), যেন এক জ্যোতিষ্মান্ দেবতা যিনি স্বর্গে দৃপ্তরূপে বিরাজিত। মৃত্যুর দেবতা যমেরও একটা বিশেষ স্থান ছিল। এছাড়া সৌরজগতে আরো বহু আকার ও প্রকৃতির দিব্যজীব বাস করত- গন্ধর্ব, অন্তরা, মরুৎ ইত্যাদি! যখন খুশি এদের সংখ্যা বাড়িয়ে ফেলাও যেত। ধর্মীয় অনুষ্ঠানের একটি গৌণ অংশ ছিল মানুষের দৈবশক্তির বাস, তাকে উদ্দেশ্য করেও স্তোত্ররচনা হতো, যেমন বলির বেদী। তাছাড়া সোমরসের গাছ ছেঁচবার পাথর, লাঙল, যুদ্ধাস্ত্র, ডঙ্কা, হামান, নুড়ি ইত্যাদি উদ্দেশ্যেও স্তোত্র ছিল।
[* অগ্নি শব্দটির সঙ্গে সাদৃশ্য পাওয়া যায় ল্যাটিন শব্দ ‘ইগনিয়াস’-এর সঙ্গে। এর অর্থও আগুন।]
আর্যদের ধর্মীয় আচারের প্রধান অঙ্গ ছিল বলিদান। গৃহপূজায় বলির উপচার হতো ছোটখাটো; কিন্তু মাঝে মাঝে বৃহৎ বলিদানের আয়োজন হতো এবং তাতে শুধু গ্রামের লোকই নয়, গোটা উপজাতির লোকই অংশ নিত। যুদ্ধ-বিগ্রহের জন্যে দেবতাদের আশীর্বাদ ছিল প্রয়োজনীয় আর আর্যদের বিশ্বাস ছিল বলি দিয়ে অর্চনা করলেই দেবতারা খুশি হয়ে অনুগ্রহ করবেন। দেবতারা অদৃশ্যরূপে যুদ্ধে অংশ নিতেন বলে বিশ্বাস ছিল। বলিদান ছিল একটি গম্ভীর ও গুরুত্বপূর্ণ অনুষ্ঠান। কিন্তু বলিদানের পরে যে অবাধ আনন্দ-উৎসব, ভোজ ও সোমরস পান চলত, তার মধ্যে সামাজিক বাধানিষেধ থেকে মুক্তি পেয়ে মানুষ উচ্ছল প্রাণশক্তি প্রকাশের একটা পথ খুঁজে পেত।
আদিমকালে বলিদান সংক্রান্ত যেসব অনুষ্ঠান প্রচলিত ছিল, তার ওপর ভিত্তি করেই আর্যদের বলিদানের রীতিনীতির উদ্ভব হয়েছিল। আচার-অনুষ্ঠানের মধ্যে পুরোহিতদের ভূমিকা ছিল প্রধান। তা থেকেই ‘ব্রাহ্মণ’ কথাটি এসেছে। অর্থাৎ যে ব্যক্তি ব্রহ্মের মতোই রহস্যময় ও অলৌকিক শক্তির অধিকারী, সেই ব্রাহ্মণ। (কোনো কোনো লেখক এর সঙ্গে আদিম মানুষের ‘মানা’ সম্বন্ধে ধারণার যোগ খুঁজে পান।) আর একটি স্বীকৃত ধারণা ছিল, ঈশ্বর পুরোহিত ও উপাচার কয়েক মুহূর্তের জন্যে অভিন্নতা অর্জন করে। স্বভাবতই বলিদানের অনুষ্ঠান পুরোহিতের ও রাজার প্রতিপত্তি বাড়িয়ে তুলেছিল, কেননা পুরোহিতের সাহায্য ছাড়া বলিদান সম্ভব ছিল না এবং রাজার ধনসম্পদ ও বলিদানের পক্ষে অপরিহার্য ছিল। বলিদানের অনুষ্ঠান থেকে প্রসঙ্গত অন্য কয়েকটি বিষয়ে চর্চার আরম্ভ হয়। বলিদানের জায়গায় বিভিন্ন উপকরণ রাখবার সঠিক ক্ষেত্র নির্ণয়ের জন্যে বিস্তারিত আঙ্কিক হিসেবের দরকার হতো। এ থেকে অঙ্কের চর্চা বাড়ল। আবার ঘনঘন বলিদানের জন্যে পশুর দৈহিক গঠনতন্ত্র সম্পর্কে রীতিমতো জ্ঞানার্জনে সুবিধা হলো। তার ফলে বহুদিন পর্যন্ত শারীরবৃত্তি বা রোগ-নিরূপণ বিদ্যার চেয়ে দৈহিক গঠনতন্ত্র সম্পর্কিত জ্ঞান অনেক বেশি অগ্রসর ছিল।
মহাকাশ ও পৃথিবী সম্পর্কে আর্যদের জ্ঞান ও ধারণা ছিল সীমাবদ্ধ। যেমন— সৌরমণ্ডলের মধ্যে কোথাও একটা বিরাট ত্যাগ ও বলিদানের ফলস্বরূপ পৃথিবীর উৎপত্তি এবং আরো নিয়মিত বলিদানের মধ্যেই পৃথিবীকে লালন করতে হবে, এই ছিল বিশ্বাস। কিন্তু এ বিশ্বাসও সম্পূর্ণভাবে স্বীকৃত হয়নি কারণ বৈদিকযুগের শেষভাগে রচিত সৃষ্টিস্তোত্রে বিশ্বসংসারের জন্ম সম্বন্ধে সংশয় দেখা যায় এবং অসীম শূন্যতার মধ্য থেকে সৃষ্টির উৎপত্তির ইঙ্গিত পাওয়া যায় :
শূন্যতা অথবা অস্তিত্ব কিছুই তখন ছিল না, বায়ু ছিল না— তার অন্তরালে অন্তরীক্ষ ছিল না। কে উহা আচ্ছাদিত করে কোথায় কার কাছে রাখে? অসীম অগাধ বারিধি ছিল কি, যার গভীরতা অনন্ত? কে জানে, কে বলতে পারে কোথা থেকে কবে সৃষ্টির উৎপত্তি? দেবতারাও এসেছেন সৃষ্টির পরে, তাই কোথা থেকে সৃষ্টির শুরু তা সবার অজানা।[২]
[২. ঋগ্বেদ, দশম, ১২৯। অনুবাদ : এ. এল. ব্যাশাম, দি ওয়াণ্ডার দ্যাট ওয়াজ ইন্ডিয়া। পৃ. ২৪৭-৪৮]
মৃতদেহ কবরও দেওয়া হতো, দাহও করা হতো। তবে প্রথমদিকে কবর দেওয়াই ছিল প্রথা। ইউরোপীয় ব্রোঞ্জ-যুগের কবরের মতো। দেখা যায়, উঁচু ঢিবির চারদিকে বেড়া দিয়ে ঘিরে দেওয়া হয়েছে আর একটি বড় দণ্ড উঁচু করে পুঁতে দেওয়া হয়েছে। পবিত্রতার সঙ্গে আগুনের একটা সম্পর্ক স্থাপিত হবার পর কবরের চেয়ে মৃতদেহ দাহই বেশি জনপ্রিয় হয়ে উঠল।* ক্রমশ কবর দেওয়ার প্রথা প্রায় উঠেই গেল।
[* দাহ করার প্রথা কার্যত অনেক সুবিধাজনক ও স্বাস্থ্যসম্মত হলেও ঐতিহাসিকদের দৃষ্টিভঙ্গি থেকে এই প্রথার প্রবর্তন তেমন সুখের ব্যাপার নয়। কবর এবং কবরের অলংকরণ ইত্যাদি ঐতিহাসিক উপাদান হিসেবে অত্যন্ত উপযোগী। মিশরীয় ও চীনদের মতো ভারতীয়রাও যদি তাদের মৃতদেহ কবর দিত তাহলে ভারতের ইতিহাস সম্বন্ধে আমাদের জ্ঞান আরো নিখুঁত ও সম্পূর্ণ হতে পারত।]
মৃত্যুর পরবর্তী জীবন সম্পর্কে তাদের ধারণা অনুযায়ী, পরলোক পাপীরা শাস্তি আর পুণ্যবানরা পুরস্কার লাভ করত। পাপীদের স্থান হতো নরকে – সেটা ছিল বরুণ দেবের রাজত্ব। এর সঙ্গে গ্রীকদের ‘হেডিস’-এর তুলনা করা যায়। যারা পুরস্কার পাবার তারা যেত পিতৃলোকে (যার সঙ্গে তুলনীয় গ্রীকদের কল্পিত ইলিসিয়াম)। শেষদিকের কোনো কোনো স্তোত্রে metempsychosis— অর্থাৎ উদ্ভিদরূপে মানুষের পুনর্জন্মের উল্লেখ পাওয়া যায়। কিন্তু আত্মার মানবদেহে পুনর্জন্ম সম্বন্ধে ধারণা তখনো তেমন স্পষ্ট হয়নি। শেষপর্যন্ত জন্মান্তরবাদ যখন প্রচলিত হলো তখন স্বভাবতই তার থেকে আর একটি ধারণার উৎপত্তি হয় : পূর্বজন্মের কর্মফল অনুসারে আত্মারা পরে জন্মে সুখ বা দুঃখ ভোগ করে। এ থেকে এলো কর্মবাদ, যা পরের হিন্দুধর্মের সমস্ত ভাবনাচিন্তাকে প্রভাবিত করেছে। কর্মবাদের সাহায্যে জাতিভেদ প্রথারও একটা দার্শনিক ব্যাখ্যা গড়ে উঠল। উচ্চ বা নিম্নবর্ণের জন্ম নির্ভর করত পূর্ববর্তী জন্মের কর্মফলের ওপর। এর ফলে মানুষ জন্মান্তরে সামাজিক উন্নতির আশা করতে শিখল। কর্মবাদ সম্পর্কিত নিয়মকানুন ক্রমশ ধর্মের বৃহত্তর ধারণার মধ্যে নিহিত হলো। ‘ধর্ম’ শব্দটি অন্যভাষায় অনুবাদ করা প্রায় অসম্ভব। এর অর্থ হলো স্বাভাবিক ও প্রাকৃতিক নিয়মের পালন— অন্তত বৰ্তমান প্রসঙ্গে এই অর্থই সবচেয়ে উপযোগী হবে। সমাজের স্বাভাবিক নিয়ম দাঁড়ালো বিভিন্ন সামাজিক স্তরগুলো অক্ষত রাখা— অর্থাৎ জাতিভেদের নিয়মগুলো মেনে চলা।
সৃষ্টিস্তাত্রে যে সংশয় ব্যক্ত হয়েছে তা সে যুগের জ্ঞানপিপাসা ও আধ্যাত্মিক জিজ্ঞাসার একটি উদাহরণমাত্র। এর একটা পরিণতি হলো বৈরাগা। কিছু-কিছু অন্বেষক একা বা ছোট ছোট দল বেঁধে সমাজ থেকে দূরে কঠোর তপশ্যায় জীবনযাপন করতে লাগলেন। এই সংসার-বৈরাগ্যের পিছনে হয়তো দুটির মধ্যে একটি উদ্দেশ্য ছিল— কৃচ্ছ্রসাধন ও যৌগিক ক্রিয়ার মধ্য দিয়ে অলৌকিক ক্ষমতা অর্জন, অথবা লোকালয় থেকে সরে গিয়ে সমাজের সঙ্গে মানিয়ে চলার দায়মুক্ত হওয়া। দ্বিতীয় সম্ভাবনার উদাহরণস্বরূপ দেখা যায় কোনো কোনো যোগীর বৈদিক উপাসনা-পদ্ধতিকে অস্বীকার— অথবা কোনো কোনো সন্ন্যাসীগোষ্ঠীর অদ্ভূত নিজস্ব আচার-অনুষ্ঠান (যেমন নগ্নতাবাদ)।
সমাজ থেকে দূরে সরে যাবার আরো কারণ ছিল। খ্রিস্টপূর্ব সপ্তম শতাব্দীর মধ্যেই আর্য-সমাজের পুরনো গঠন অনেক বদলে গিয়েছিল। উপজাতি সমাজের জায়গায় ততদিনে এসে গেছে স্থায়ী প্রজাতন্ত্র এবং ক্ষমতাকাঙ্ক্ষী রাজাদের যুগ। এই রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে মাৎস্যন্যায়ের জন্ম হয়, যখন অপ্রতিহত প্রতিযোগিতার আবহাওয়ায় শক্তিশালীরা দুর্বলদের ইচ্ছেমতো গ্রাস করে নেয়। শাস্ত্রে মাৎস্য-ন্যায়ের সংজ্ঞা হলো ‘বিশৃঙ্খলার সময় যখন বড় মাছ ছোট মাছকে গিলে ফেলে’। গ্রামের জমি ভাগ হয়ে কয়েকজন লোকের ব্যক্তিগত সম্পত্তিতে দাঁড়িয়ে গেল, অথবা স্থানীয় শাসকের আয়ত্তাধীন হয়ে গেল। এইভাবে জমির সমবেত অধিকার ক্রমশ কমে এলো। গঙ্গানদীতে নৌ-চলাচল বাড়বার সঙ্গে সঙ্গে বাণিজ্যিক প্রতিযোগিতাও বেড়ে উঠল। ধীরে ধীরে একটা অনিশ্চয়তা ও নিরাপত্তার অভাবের আবহাওয়া দেখা দিল— যা থেকে অনুভূতিশীল মানুষরা মুক্তি খুঁজতে লাগলেন।
ঋষি বা তপস্বীরা অবশ্য বনে বা পাহাড়েই জীবন কাটিয়ে দেননি। তাঁদের মধ্যে কেউ কেউ সমাজে ফিরে এসে প্রচলিত সামাজিক ও ধর্মীয় প্রথাগুলো সম্পর্কে প্রশ্ন তুললেন। ব্রাহ্মণরা সম্ভবত এর মধ্যে তাঁদের নিজেদের প্রতিপত্তি বজায় রাখা সম্বন্ধে বিপদের আশঙ্কা করলেন। তখন ব্রাহ্মণরা মানুষের জীবনকে চারটি কালানুক্রমিক ভাগে বিভক্ত করার বিধান দিলেন। একেক ভাগকে আশ্রম বলা হতো। প্রথমে ছাত্রজীবনে ব্রহ্মচর্যাশ্রম, তারপর গৃহীজীবন, তারপরে সমাজ থেকে দূরে সাত্ত্বিক জীবনযাপন এবং অবশেষে ভ্রাম্যমাণ সন্ন্যাসীর জীবন। সামাজিক দায়িত্ব শেষ করে তবেই মানুষ সন্ন্যাস গ্রহণ করতে পারবে, এই ছিল আদর্শ। তবে বলা বাহুল্য, অর্থনৈতিক কারণে এ ব্যবস্থা প্রযোজ্য ছিল কেবল উচ্চবর্ণের মানুষের মধ্যেই। তার মধ্যেও নীতি হিসেবে স্বীকৃতিলাভ করলেও কার্যত এ ব্যবস্থার তেমন প্রয়োগ কখনোই হয়নি। একটা ব্যাপার অবশ্য ব্রাহ্মণরা মেনে নিলেন, বেদের মধ্যে যে অতীন্দ্রিয়বাদী অংশ— আরণ্যক ও উপনিষদ— তার মধ্যে এইসব ঋষিদের কিছু-কিছু উপদেশ সন্নিবিষ্ট করা হলো।
সন্ন্যাসীজীবন সব সময়ই পলায়নী মনোভাবের পরিচায়ক মনে করলে ভুল হবে। উপনিষদ পড়লেই বোঝা যায়, এই ঋষিদের মধ্যে অনেকেই জীবনের কিছু-কিছু মূল প্রশ্নের উত্তর অনুসন্ধানের চেষ্টা করেছিলেন। কোথা থেকে এসেছিল এই জগৎ সংসার? একি নক্ষত্রজগতের কোনো সঙ্গমের ফলে সৃষ্টি? তাপ থেকে? তপশ্চর্যা থেকে? আত্মা বলে কি কিছু আছে? আত্মা তাহলে কী? মানব-আত্মার সঙ্গে জগৎ-আত্মার কি তাহলে সম্পর্ক?
‘বটবৃক্ষ থেকে আমাকে একটি ফল এনে দাও।’
‘তাত, এই যে একটি ফল এনেছি।’
‘ভেঙে দেখ।’
‘ভেঙেছি।’
‘কি দেখতে পাচ্ছ?’
‘খুব ছোট ছোট বীজ।’
‘তার একটা ভাঙো।’
‘ভেঙেছি।’
‘এবার কি দেখতে পাচ্ছ?’
‘কিছুই না তাত।’
‘পিতা বললেন, ‘পুত্র, ইন্দ্রিয় দিয়ে তুমি যা অনুভব করতে পারছ না, তাই হলো প্রকৃত সত্তা। আর তার মধ্যেই লুকিয়ে আছে এই বিরাট বটবৃক্ষ। বিশ্বাস করো পুত্র, ঐ মূলসত্তার মধ্যেই নিহিত রয়েছে সমস্ত সত্তা। এই হলো চরম সত্য, এই হলো আত্মন্।’[৩]
সাধারণ লোকে মনে করে, বৈদিক যুগ ছিল অতীতের সুবর্ণযুগ। সে যুগে বুঝি দেবতারাও এসে দাঁড়াতেন মানুষের পাশে। যখন মানুষ সত্য ও ন্যায়ের জন্য বীরের মতো লড়াই করত। কিন্তু এই সময়কার ঐতিহাসিক বিবরণ লিখতে গেলে বহু অনিশ্চয়তা ও ফাঁক এসে পড়ে। একমাত্র প্রত্নতাত্ত্বিক সাক্ষ্যপ্রমাণের- সাহায্যেই আরো সঠিক তথ্য উদ্ধার সম্ভব। তবে বৈদিক সভ্যতার সবচেয়ে বড় দান হলো সামাজিক প্রতিষ্ঠান ও ধর্মের ক্ষেত্রে। ভারতীয়, বিশেষত হিন্দু জীবনধারার বহু আচার-অনুষ্ঠানের উৎস অনুসন্ধান করা যাবে আর্যদের যুগে।* আর্যরা যে কেবল সংস্কৃতভাষা, বর্ণভিত্তিক সমাজ ও ধর্মীয় বলিদানের ধারণা, উপনিষদের দর্শনের ব্যাপারেই তাদের অবদান রেখে গেছে তা নয়, তারা বিস্তৃত বনাঞ্চল পরিষ্কার করে কৃষির প্রসারে প্রত্যক্ষভাবে জড়িত ছিল। সবথেকে বড় কথা হলো, গ্রহণ ও বর্জনের মধ্য দিয়ে এইসব ধারণার বিবর্তন হয়ে ক্রমশ নতুন চিন্তাধারা ও রীতিনীতির সূচনা হতে থাকে।
[* এই উৎস সম্পর্কে বিশ্বাস এত প্রবল ছিল, এমনকি গত শতাব্দীতেও ধর্মীয় সংস্কারকরা তাঁদের বক্তব্যকে গ্রহণযোগ্য প্রমাণ করতে গিয়ে বেদের উদ্ধৃতির সাহায্য নিয়েছেন।]
শীঘ্রই সংস্কৃতভাষা শিক্ষিত উচ্চবর্ণের মানুষদের ভাষা হয়ে দাঁড়াল। এই উপমহাদেশে পরবর্তী বহু শতাব্দী ধরেই সংস্কৃতভাষা এই শ্রেণির লোকেদের মতে যোগসূত্রের ভূমিকা গ্রহণ করেছিল। কিন্তু সংস্কৃতের ব্যবহার উচ্চবর্ণের লোকেদের সমাজের অবশিষ্টাংশ থেকে পৃথক করে দেয়। সমাজের অন্য স্তরের লোকেেদর গুরুত্ব কিছু কম ছিল না, এবং তারা অন্যান্য ভাষা সুনিপুণভাবে ব্যবহার করত, সেজন্যে ক্রমে ক্রমে সংস্কৃতের আধিপত্য কমে যায়।
বর্ণাশ্রম প্রথাকে পরিত্যাগ করার বারংবার চেষ্টা সত্ত্বেও দু’হাজার বছর ধরে এই প্রথা ভারতবর্ষে চলে আসছে। রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানের গঠনকে এই প্রথা বহুভাবে প্রভাবান্বিত করেছে। দৈনন্দিন জীবনে বিভিন্ন উপবর্ণের পারস্পরিক সম্পর্ক ছিল গ্রামজীবনের গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। অতএব আঞ্চলিক বর্ণভিত্তিক সম্পর্ক ও আনুগত্য রাজনৈতিক সম্পর্ক ও আনুগত্যকে দূরে সরিয়ে রেখেছিল। কেন্দ্ৰীয় রাজনৈতিক কর্তৃত্বও এইজন্যে কোনোদিন প্রবল হতে পারেনি।
পরবর্তীকালের সামাজিক আন্দোলনের মূলবিষয় ছিল বর্ণাশ্রম ও বৈদিক বলিদান প্রথার বিরোধিতা। উপনিষদের দর্শন থেকে জন্ম নিয়েছিল পরবর্তীকালের অনেক নতুন দার্শনিক চিন্তাধারা। গাঙ্গেয় উপত্যকায় বনাঞ্চল বিনাশের ফলে এলো কৃষিভিত্তিক সমাজ। তা থেকে এলো শক্তিশালী রাজ্য। রাজ্যগুলোর আয়ের উৎস ছিল কৃষি। উত্তর-ভারতের ইতিহাসে এই ধারা বয়ে চলল অনেক শতাব্দী ধরে।
এইসব ঘটনাপ্রবাহের তলে তলে চলেছিল আর্য-পূর্ব ও আর্য-সংস্কৃতির বিরামহীন সংঘাত। যদিও প্রথমটি কখনো জয়ী হতে না পারলেও আর্য-সংস্কৃতির রূপকে পরিবর্তন ও পরিমার্জনে সাহায্য করেছিল ঠিকই। যে ভারতবর্ষকে আজ আমরা চিনি তার ক্রমবিকাশ শুরু হয়েছিল আর্যদের আগমন ও তাদের নতুন সংস্কৃতির প্রেরণাবলে। কিন্তু এছাড়াও আরো অনেক শক্তি ও সংস্কৃতির ঘাত- প্রতিঘাতে ভারত-ইতিহাসের গতি প্রভাবিত হয়েছে।
***
১. ঋগ্বেদ, দশম, ৯০। অনুবাদ : এ. এ. ব্যাশাম, দি ওয়াণ্ডার দ্যাট ওয়াজ ইন্ডিয়া। পৃ ২৪০-৪১
২. ঋগ্বেদ, দশম, ১২৯। অনুবাদ : এ. এল. ব্যাশাম, দি ওয়াণ্ডার দ্যাট ওয়াজ ইন্ডিয়া। পৃ. ২৪৭-৪৮
৩. ছান্দোগ্যোপনিষদ, ষষ্ঠ, ১৩। অনুবাদ : এ. এল. ব্যাশাম, দি ওয়াণ্ডার দ্যাট ওয়াজ ইন্ডিয়া। পৃ. ২৫০-৫১