বউদি বলল, আজকে কফি খাবে তো?
বোকা বলল না। তোমার কাছে ক্যাম্পোজ আছে? পাঁচ মিলিগ্রাম যদি থাকে তো দেবে একটা?
কেন? তোমার এমনিতেই ইসকিমিয়া অ্যাঞ্জাইনার ট্রাবল একবার হয়েছিল। ক্যাম্পোজ ট্যাম্পোজ এরকম হুট-হাট করে খাওয়া উচিত নয়। ড. সর্বাধিকারী কি বলেছেন খেতে?
যাইনি বহুদিন ডাক্তারবাবুর কাছে।
তবে?
তুমি কেন খাও? তোমাকেও কি বলেছেন খেতে?
আমার কথা ছাড়ো ঠাকুরপো। আমি আর তুমি কী এক হলাম? মরলেই বেঁচে যাই। আমার এই জীবন কী জীবন নাকি?
কারো জীবন-ই জীবন নয়। মানে, জীবনের মতো জীবন কারোর-ই নয়। কেউ জীবনকে তার মনোমতো, পছন্দসই করে নিতে পারে; কেউ বা পারে না। নইলে, যে-জীবন এমনিতে সব মানুষ-ই পায়, ফুটপাথে-কেনা জামার-ই মতো; তবে বেশির ভাগ-ই গায়ে হয় খাটো, নয় বড়। আঁটে না তারা জীবনে। অথবা, জীবন তাদের গায়ে।
রমলা বলল, জীবনকে মনোমতো করে গড়তে আর পারলাম কোথায়? এতগুলো বছর তো সেই জীবন পাওয়ার চেষ্টা করতে করতেই কেটে গেল।
এত তাড়াতাড়ি পেতে চাও তুমি? কী-বা তোমার বয়স! রিহার্সাল দিয়ে যাও। থেমো না। জীবনে রিহার্সালটাই হচ্ছে আসল। হয়তো জীবনের সবটুকুই। যারা মনোমতো জীবনের পিপাসায় মরে, প্রতিনিয়ত রিহার্সালও দিয়ে যায়, তাদের মধ্যেও ক-জনই বা সেই জীবনকে জীবনের স্টেজে মঞ্চস্থ করতে পারে বলো? তা বলে কি চেষ্টা না করে হাত-পা গুটিয়ে বসে থাকবে?
রমলা একটু চুপ করে রইল।
তারপর দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, জানি না আমি।
দাদা কোথায়? বোকা বলল। আজও ফেরেনি বাড়িতে? খাওয়া কি কমিয়েছে একটু? ওই চিমসে দিদিমণির মধ্যে কী যে, দেখেছে বলো তো দাদা? আমি তো ভেবেই পাই না। আর মহিলারও কী লাজ-লজ্জা বলে কিছু নেই? তোমার না-হয় ছেলে-মেয়ে নেই। তার তো মেয়ে আছে একটি।
বেশি লাজ-লজ্জা থাকলে জীবনে কিছু পাওয়া হয় না ঠাকুরপো। তা ছাড়া কে যে, কার মধ্যে কী দেখে, তা কী বলা যায়? ঘাটতি আমার মধ্যেও ছিল নিশ্চয়ই কিছু।
ঘাটতি তোমার কিছুমাত্রই নেই। তোমার মতো স্ত্রী, ক-জন পায় বলো তো?
স্ত্রীর কথা, শুধুমাত্র স্বামীরাই জানে। আর স্বামীদের কথা স্ত্রীরা, বাইরে থেকে বোঝা যায় আর কতটুকু?
বলেই, রমলা দুষ্টুমির হাসি হেসে বলল; তোমার ভাষায় বললে তো বলতে হয়, তোমার দাদার জীবনটাও তার গায়ে ছোটো অথবা বড়োই হয়েছিল, তাই, সেও তার মনোমতো জীবন পাওয়ার জন্যই রিহার্সাল দিচ্ছে। এতে দোষের কী? মন তো সকলের সমান নয়। মনোমতো ব্যাপারটা যে, বড্ডই ব্যক্তিগত গোপনীয়।
বোকা বলল, জানি না। মণিদীপা মেয়েটিকে তো আমি দেখেছি। চেহারাতে বা গুণে তোমার পায়ের ন
আবার হাসল রমলা। হাসলে, ওকে খুবই সুন্দর দেখায়। বলল, কার কী যোগ্যতা আছে সেটা অবান্তর! যে যাকে চায়, অথবা না চেয়েই যে, যাকে পায়, আমাদের এই সম্বন্ধ-করা বিয়েরই মতো, সে অন্যজনের যোগ্য বা মনোমতো হয়ে উঠতে পারল কি না এটাই প্রশ্ন। এক একজনের যোগ্যতার চাহিদা এবং যোগ্যতাও এক একরকম হয় তো!
জানি না। দাদাকে আমি একটুও বুঝি না। লজ্জাশরমের মাথাও খেয়েছে। তোমার কথা কিংবা আমার কথা কি ভাবেও না একবারও?
নিজের কথা বেশি ভাবলে, অন্যর কথা ভাবার-ই যে, সময় পাওয়া যায় না। নিজের কথা বেশি করে সবসময়ই ভাবার আর এক নাম-ই হয়তো মনোমতো জীবন পাওয়া।
তুমিও তাহলে ভাবা শুরু করো এবার থেকে। দাদার কথা আর ভেবো না। তুমি যদি কাউকে বিয়ে করো বা কারো কাছে গিয়ে থাকো, তাহলে আমি কিন্তু তোমাকে সবরকম মদত-ই দেব বউদি। দাঁড়িয়ে থেকে বিয়ে দেব তোমার।
সত্যি!
এবার শব্দ করেই হাসল রমলা।
পাগল তুমি একটা! নতুন করে এখন আবার কার কাছে গিয়ে থাকব? তোমার কাছে তো আছিই ঠাকুরপো। আমার তো কোনো দুঃখ নেই। তুমিও যদি তাড়িয়ে দাও, সে-কথা আলাদা।
বাজে কথা বোলো না। দুঃখ নেই কি না তা, আমিই জানি।
তুমি কিছুই জানো না। তোমার দাদা আমার জীবনে একটা ভারী, সেকেলে ফার্নিচার হয়ে গেছে। শাল কাঠ দিয়ে তৈরি। যাতে কেউ বসে না। যাকে নড়ানোও যায় না। সে যেখানে বসে আছে, সেখানেই থাকবে বসে, বাকিজীবন। সেইসব ফার্নিচার ব্যবহারের জন্যও নয়। পুরোনো দিনের জিনিস। অনেক সুখ-দুঃখের স্মৃতি-সেন্টিমেন্ট মাখা। এইটুকুই ভূমিকা তার। তোমার দাদা হচ্ছে, আমার সেই অব্যবহারের ফার্নিচার। অব্যবহার-ই এখন অভ্যেস আমার।
আর আমি?
বোকা শুধোল, শিশুর মতো।
তুমি হচ্ছ, আমার এই দমবন্ধ জেলখানার সকালবেলার পাখি, শেষবিকেলের আলো; সবুজ বাগান, একফালি চাঁদের আলোতে করুণ হয়ে ওঠা। তুমি আমার গন্ধ-ওড়ানো নরম ফুল, আমার চান-ঘরের গান; তুমি-ই তো সব। অথচ তুমি কেউ নও-ও।
কী সুন্দর করে বললে বউদি। তুমি একজন কবি। ‘অশনি’-তে একটা কবিতা পাঠাও-না। নিজের নামেই।
রমলা হাসল। বলল পাঠাইও যদি; তবে লেখিকার নাম দেব কী জান? নাম দেব বন্দিনি।
তারপর বলল, না গো বেশ তো আছি। আমার চেয়ে যে, আরও কত বেশি দুঃখী কত মানুষকে দেখি চারপাশে, তার ঠিক নেই। অন্যলোকের ‘দুঃখ’ সকলে ঠিক বুঝতে পারে না। নিজের নিজের দুঃখকেই তাই মস্ত করে দেখে। সকলের সেসব বোঝার বা দেখার চোখ-ই নেই। আমি খুব-ই কৃতজ্ঞ ভগবানের কাছে এ-জন্যে যে, সবাকার দুঃখ নিজের করে নিতে চাই। পারি।
তুমি বিনাদোষে এমন করে, নিজেকে নষ্ট কোরো না। আমার জন্যেই বা তোমার জীবনটা নষ্ট করবে কেন? আমি তোমার কে? কতটুকু দিতে পারি তোমাকে? কোথাও চলে যাও তুমি বউদি। সিরিয়াসলি বলছি।
যাওয়ার জায়গা থাকলে যেতামও হয়তো। বাড়ি বলতেও তো কিছু নেই। দাদাদের পরিবারে গেলে, তারা তো গলগ্রহ বলেই মনে করবে। তা ছাড়া, লেখাপড়াও তো শিখিনি তেমন বেশি যে, আজকালকার দিনে ভদ্র চাকরি করে পেট চালাব। আজকাল তো বি-এ, বি এড-এ দেশ-ই ছেয়ে গেছে। আমি বিশেষ কী?
তাদের বেশির-ই ওই ডিগ্রিটুকুই আছে। তোমার মতো সত্যিকারের ‘শিক্ষা’ আছে কি?
কথা ঘুরিয়ে বলল, রমলা; তার চেয়ে, এখানে তুমি তো আছ। তোমার দাদা নাই-ই বা বুঝল, তুমি তো তাও বোঝো আমাকে। সংসারের এই তো নিয়ম ঠাকুরপো। যেখান থেকে পাওয়ার কথা সেখান থেকে, সকলে যে, পাবেই সবকিছু, তেমন ভাগ্য করে আসে কম মানুষ-ই। আবার যেখান থেকে পাওয়ার কথা ছিল না, সেখান থেকেই হয়তো পেয়ে যায়। সেটাই উপরি। হিসেবের বাইরে। হরে-দরে নিক্তি সমান হলেই হল। আমার কাছে এই-ই তো অনেক। তুমি আমাকে যতটুকু বোঝো, যতটুকু ভাবো আমার জন্যে, ততটুকুই বা, কে বুঝত বা ভাবত বলো?
আমার কিন্তু মনে হয়, এ, তোমার এক ধরনের আত্মপ্রবঞ্চনা। এত অপমানিত হয়েও তবু এখানে থাকতে ভালো লাগে তোমার? মুখ দেখাতে লজ্জা করে না? বোকা বলল।
রমলা গম্ভীর হয়ে গেল।
বলল, তুমি ছাড়া; এই মুখ আর দেখেই বা কে? কাজের লোকজন আর পথের দুখিয়া পাগলা। তুমিও যেদিন, আমাকে অপমান বা লজ্জা দেওয়ার মতো কিছু করবে, সেদিনই চলে যাব বাড়ি ছেড়ে। দরকার হলে, ঘুঘটটোলিতে গিয়েই উঠব তোমার চালাক দাদার ওপর প্রতিশোধ নিতে। এসব কথা থাক ঠাকুরপো। সুন্দর কিছু বলো, আনন্দের কিছু; ভালো লাগে না এই কথা আর।
দাদা তোমাকে যা দিতে পারত, তার অনেক কিছুই তো আমি দিতে পারি না; পারিনি। দেওয়ার উপায়ও যে, নেই কোনো বউদি।
আমি কি চেয়েছি কখনো কিছু? তোমার কাছে?
তোমার কথা নয়। আমিই পারি না। আর কখনো দিতে চাইলেও, তুমি তো নিতেও পারবে না; নেবে না, তা আমি জানি। এমন করে সারাটা জীবন কাটাবে কী করে, এই কথাটাই আমি ভেবে পাই না।
শরীরের কথা বলছ ঠাকুরপো?
রমলা, রহস্যময় হাসি হেসে বলল।
তারপর জানলার কাছে সরে গিয়ে নির্জন পথ-পাশের প্রাচীন মেহগনি গাছগুলোর দিকে চেয়ে বলল, শরীরের দাবিটা আর কতটুকু? মানুষ হয়ে জন্মেছি, মনের দাবিটাই যদি মিটিয়ে থাকো তুমি; তাই-তো যথেষ্ট। এই সুন্দর সম্পর্কের মধ্যে শরীর এসে পড়লে আমরা দু জনেই ছোটো হয়ে যেতাম দু-জনেরই কাছে। ছোটো হয়ে যেতাম তোমার দাদার কাছেও। বাইরের লোকে হয়তো মন্দ বলবে, হয়তো বলেও; কিন্তু আমরা দু-জনে তো জানি যে, আমাদের সম্পর্কটা কীরকম। নিজেদের সুখের জন্যে নিজেদের ছোটো বা ভ্রষ্ট করিনি আমরা কেউই নিজেদের। বলো? করেছি কখনো?
বোকা চুপ করেই থাকল। টেবল থেকে সিগারেটের প্যাকেট তুলে নিল।
টেবলের ওপরে রাখা টাইম-পিসটা ‘টিক-টিক-টিক-টিক’ করে কোনো অদৃশ্য তক্ষকের জিভের-ই মতো নিস্তব্ধ রাতের প্রতিটি মুহূর্তের গায়ে, নীরবে থাকা বোকা ও রমলার গায়ে; সময়ের থুথু ছিটোতে লাগল।
অনেকক্ষণ পর রমলা বলল, দু-জনে, দু-জনের বিভিন্নরকমের কষ্টর নীরব সাক্ষী হয়ে থেকে মানুষ হিসেবে অনেকের চেয়েই বেশি মাথা উঁচু করে বেঁচেছি আমরা। তুমি কি মনে করো না তা? যদি তোমার দাদার হাত থেকে সম্পত্তিগুলো সরিয়ে নিতে না পারতে, তবে তো এতদিনে পথের ভিখিরিই হয়ে যেতাম আমি। আমার সঙ্গে; বিনাদোষে তুমিও। তুমি যা করেছ আমার জন্যে, অন্য কেউই কি তা করত?
লাভ কী হল, বলো বউদি? আজকে ঝিরাটোলির সব মানুষ-ই জানে যে, দাদাকে নাকি আমিই ঠকিয়েছি। পৈত্রিক সব সম্পত্তি আমিই তাকে ঠকিয়ে নিজের নামে নিয়েছি। ‘জোচ্চোর’, ঠগবাজ’, ফোর-টোয়েন্টি’, চালু’ বলে আমাকে। বলে, নামেই বোকা; আসলে ‘চালাক দ্য গ্রেট। কাকে বলতে যাব বলো যে, কেন কী করেছি। দাদা যে, কোথায় নেমে গেছে, এইকথাটা কি হাটের মাঝে গিয়ে বলতে পারি আমি? যারা জানে; তারা জানুক। কিন্তু অনেকেই তো জানে না। এসব কী শুধু তোমার একার জন্যেই করেছি? দাদার ভালোর জন্যেও করিনি কী? ওই সম্পত্তি তার হাতে থাকলে তো হনুমান শাহুর দোকানের মদের বিলেই সব চলে যেত। মণিদীপা দিদিমণির গয়নাতেও। এসব কথা বলব কাকে বল? প্রায়-ই ভাবি বউদি, তোমার আগেই মরি যদি আমি, তবে মরে যাওয়ার পর আর তো তোমাকে কলঙ্ক থেকে বাঁচাতে পারব না। তোমার জন্যে কিছু করতেও পারব না। লোকে বলবেঃ তোমার সঙ্গে আমার নিশ্চয়ই কিছু ছিল। কোনো মহিলাকে নিজের স্ত্রী-কন্যা ছাড়া, কোনো পুরুষ মানুষ যে-সম্পত্তি দিতে পারেন বা দেন, কোনো ‘কিছু না থাকলেও এমন কথা বিশ্বাস করার মতো বড়োমন বা শিক্ষা কারোর-ই নেই যে!
রমলা আবার হাসল। এবার আরও সুন্দর দেখাল। হাসলে, এখনও টোল পড়ে ওর কমলা রঙা গালে।
বলল, কথাটা কিন্তু সত্যি বললে না, ঠাকুরপো। তোমার সঙ্গে আমার কিছু কি সত্যিই নেই? শারীরিক সম্পর্কই কি একমাত্র কিছু?
বোকা, জানলার দিকে মুখ ঘুরিয়ে নিল!
রমলার কথার জবাব দিল না।
শোনো, ঠাকুরপো। তুমিই যদি আমার আগে মরে যাও, তবে তো মরতে আমাকে এমনিই হবে। তখন কলঙ্ক লাগলেই বা কী, আর না লাগলেই বা কী। তুমি যে মস্ত বড়োমনের কত্ত ভালো পুরুষমানুষ এবং সত্যিই যে, তুমি কী পরিমাণ বোকা আজকের পৃথিবীর মানুষের তুলনায়, সে-কথা তোমার চালাক দাদা কখনো স্বীকার করুন আর নাই-ই করুন, আমি চিরদিন-ই করব। তোমার ‘বোকা’ নাম তুমি সত্যিই সার্থক করেছ। বোকা অনেক-ই দেখেছি, তোমার মতো বোকা দেখিনি আর। অথচ ব্রিলিয়ান্ট ছাত্র তোমার দাদাই। মেধাবী ছাত্র। আর তোমাকেই লোকে অশিক্ষিত, পাড়ার মস্তান, মেয়েদের সঙ্গে মেশার লোভে থিয়েটার করে বলে গালাগালি দেয়। শিক্ষা ব্যাপারটার সঙ্গে কলেজ বা ইউনিভার্সিটির ছাপের বোধ হয় কোনো যোগাযোগ-ই নেই। জানো। কেন যে-মরতে ডিগ্রিগুলো নিতে গিয়েছিলাম। শিক্ষা বা বিদ্যা কিছুই তো আসলে নেই-ই, উলটে যাদের ডিগ্রিটা নেই, তাদের নিজের চেয়ে ছোটো বলে মনে করতে ইচ্ছা হয় মাঝে মাঝেই। ‘ডিগ্রি’ই দম্ভ জন্মায়, প্রকৃত শিক্ষা নয়।
বোকা বলল, আমি তো অশিক্ষিতই। লোকে তো মিথ্যে বলে না। স্কুলের দিন থেকেই বিড়ি খাই, ক্লাস ফাঁকি দিই, বায়োস্কোপ দেখতে যাই দশমাইল সাইকেলে ডবল-ক্যারি করে। যখন নিজেকে তৈরি করার ছিল, ঠিক তখন দু-হাতে নিজেকে নষ্টই করেছি শুধু। আর এখন, যখন দু-হাত দিয়ে নিজেকে গড়ে তুলতে চাইছি মানুষ’ পরিচয়ে, তখন দেখছি দেরি হয়ে গেছে অনেক-ই। জানো বউদি, বাবা, দাদাকেই বেশি ভালোবাসতেন। স্কুল ও কলেজের পরীক্ষায় দাদা সব সময়েই ভালো রেজাল্ট করত। বাবা বলতেন, আমি একটা কুলাঙ্গার, অপদার্থ, পরিবারের কলঙ্ক আমি। তখন সত্যিই কলঙ্ক ছিলাম। এখনও মিথ্যে কলঙ্ক। আর দাদা ছিল কুলভূষণ।
একটু থেমে বলল, জান? নাটকের রিহার্সালে অল্পবয়েসি ছেলেমেয়েগুলো আমাকে নিয়ে হাসাহাসি করে প্রায় রোজ-ই। আমি যে, লেখক হতে চাই, তা নিয়েও ওরা বিদ্রূপ করে আমাকে। আজ তক্ষদাও সকলের সামনে কী অপমানটাই যে করল, কী বলব।
তক্ষ রায়? কেন? কী অপমান?
রমলার ভুরু কুঁচকে গেল। বোকাকে কেউ বোকা বললে বা অপদস্থ করলে রমলা বাঘিনি হয়ে ওঠে। সারল্য আর বোকামি যে, এখন সমার্থক হয়ে গেছে তা জানে বলেই।
তক্ষদা বলল, সক্কলের সামনেই, আমার লেখা উপন্যাস, পরের পুজোর সময়ে ছাপা হবে বলে, আমার নাকি সম্পাদকের জন্যে নানারকম খিদমদগারি করতে হবে। আরও নানা অপমানকর কথা বলল।
রমলা হাসল।
বলল, আর তুমি সে-কথা বিশ্বাস করলে? সত্যিই বোকা তো তুমি! তক্ষ রায়কে আমি জানি। মানুষটার রসিকতা অমন-ই। ওর যেকোনো কথার-ই কমপক্ষে তিনটে মানে হতে পারে। এমনকী বেশিও হতে পারে। ওঁকে বোঝ তোমার কম্মো নয়। ওই মানুষটি আসলে সবসময় নিজের সঙ্গেই নিজে কথা বলেন। নিজেকে চিরে চিরে দেখেন, ল্যাবরেটরির ইঁদুরের মতো। ওই একধরনের মানুষ!
সে কী! তুমি তক্ষ রায়কে চিনলে কী করে?
চিনব না কেন? উনি তো তোমার দাদার-ই বয়েসি। তুমি যখন, চাঁইবাসায় কাঠের ব্যবসা করতে গেলে তোমার বাবার ওপর রাগ করে, আমাদের বিয়ের ঠিক পর পর-ই; তখন তোমার দাদার সঙ্গে উনি তো প্রায়ই আমাদের বাড়িতে আসতেন। তোমার দাদার সঙ্গে কোন ডিবেটিং-এর আসরে নাকি আলাপ হয়েছিল। মানুষটির মুখটির দিকে তাকানো যায় না বটে, কিন্তু অমন বিদ্বান, রসিক মানুষ বড়ো একটা দেখিনি। ওঁর কথায় রাগ কোরো না। কোনটা যে, ওঁর রসিকতা আর কোনটা নয়; তা বুঝতে আমাদের দুজনেরই হিমসিম খেতে হত। তোমার দাদা তো আর তখন এইরকম ছিলেন না। ছিলেন তক্ষ রায়ের-ই মতো, সত্যিকারের মেধাবী, কৃতী একজন মানুষ। বড়ো দুঃখ হয় মানুষটার জন্যে। তোমরা পুরুষরা, বড়ো সহজে নষ্ট হয়ে যাও।
তক্ষদা, দারুণ; না? বউদি?
নিশ্চয়ই দারুণ। আর ভারী সুন্দর কথা বলতে পারেন ভদ্রলোক।
কথা শুনেই প্রেমে পড়ে গেছিলে নাকি?
তা প্রেমে তো কথা শুনেই পড়ে মানুষ। অথবা বাঁশি শুনে বা লেখা পড়ে। সে লেখা, চিঠিই হোক; কী অন্যকিছুই হোক। প্রেমমাত্রই কথা’রই মধ্যে জন্মায়। তবে সে-কথা যদি, শুধু কথার’-ই কথা হয় তবে অবশ্য সে-প্রেম টেকে না।
কথায় কথায় রাত বাড়ছে বউদি। ‘ক্যাম্পোজ’ দাও একটা।
না। ক্যাম্পোজ দেব না। অরুণদা কেমন করে চোখের সামনে চলে গেলেন দেখলে-না। কেবল-ইবলতেন, লোডশেডিংকে ভয় কী? লোডশেডিং হলেই দুটি ক্যাম্পোজ মুখে ফেলে দিয়ে শুয়ে পড়ো। না গরম বুঝতে পারবে; না অন্ধকার। ঘুম; গভীর ঘুম। বাহান্ন বছর বয়েসে একেবারেই ঘুমিয়ে পড়লেন একদিন ব্রিজ খেলতে খেলতে তাসের টেবিলে। এসব ওষুধ, ডাক্তারের প্রেসক্রিপশান ছাড়া অমন মুড়ি-মুড়কির মতো খেলে হার্টের ওপর সত্যিই খুব খারাপ এফেক্ট হয়।
ক্যাম্পোজ যখন দিলেই না, তখন একটু লেখাপড়াই করি। কফি করে দেবে তো এক কাপ?
আজ শুয়েই পড়োনা। মশারিটা গুঁজে দিয়ে যাই? সেই সকাল থেকে বিকেল অবধি সারাটা দিন তো রিহার্সালই দিয়ে এলে। ক্লান্তিও লাগে নাকি তোমার?
লাগে। কিন্তু ভালোও লাগে। কিছু নিয়ে, মানে কোনো সাংস্কৃতিক ব্যাপার নিয়ে তবু তো ব্যস্ত আছি। এতগুলো বছর তো বাবার এই হোলসেল স্টেশনারি ব্যবসা দেখেই কাটিয়ে দিলাম। একনম্বর খাতা, দু-নম্বর খাতা সেলস-ট্যাক্স, ইনকাম-ট্যাক্স; যত্ত ঝুট-ঝামেলা। দাদা লেখা-পড়ায় ভালো হওয়ায় এই জোয়াল কাঁধে নিতে হল না। মরলাম আমি। গায়ে তেল সাবান, শ্যাম্পু, থিন-অ্যারারুট বিস্কুট আর ডিমের গন্ধ মাখামাখি হয়ে আছে। তাও রিটেইল শপ হলেও হত। সুন্দরী মেয়েরা মাঝে মাঝে এসে বলত, আচ্ছা। চুলের কাঁটা আছে? আইব্রো পেনসিল? কত করে? পিঙ্ক লিপস্টিক, ল্যাকমের? আমাকে দিন-না? তা নয়। সব কেঁদে কেঁদো ব্যবসায়ীরা, সাব-এজেন্টরা টেম্পো আর লরি করে ‘হই হই রই রই’ করে মাল তুলে নিয়ে যাচ্ছে। সত্যি কথা বলতে কী বউদি, বয়েস হল ছত্রিশ আর কাজ হয়ে গেল কুড়ি বছর। আর এইরকম কাজ! এবারে রিটায়ার-ই করে যাব।
রমলা হাসছিল তার পাগল কিন্তু বড়ো সরল, ভালোমানুষ দেওরের দিকে তাকিয়ে। বোকাই রমলার জীবনের সব। ভাবছিল ও, এই সব কথাটার কত্তরকম হয়, না? কোনো ‘সব’, শব; কোনো সব, সর্বস্ব।
বলছি, একটা বিয়ে করো, তা কথা তো শুনবে না।
বিয়ে তো আর যাকে-তাকে করতে পারব না! চোখের সামনে তুমি সবসময়ে থেকে তো আমার ‘ইহকাল পরকাল’ সব-ই ঝরঝরে করে দিলে। তোমার মতো দ্বিতীয় কেউ কী আর আছে? তাও যদি একটা ছোটোবোনও থাকত তোমার। সব দিক দিয়েই ডুবিয়ে দিলে তুমি আমাকে। বোকা বলল, কপট রাগের সঙ্গে।
তারপর-ই টেবলের ওপর দু-পা তুলে বলল, বিয়ে-ফিয়ে নয়, আমি লেখালেখি করব। বছরে ব্যবসায় পঞ্চাশ হাজার প্রফিট করাতে যা-না আনন্দ পাই আমি, তার চেয়ে অনেক-ই বেশি আনন্দ পাই একটা ভালো গল্প লিখে। তবে এখনও বানান যে, ভুল হয়! ব্যাকরণও জানি না। ইংরিজি বা বাংলার। তবু চেষ্টা চালিয়ে যেতে দোষ কী? শেখার তো কোনো বয়েস নেই। কী বলো তুমি? এবার আমি শুধু লেখাপড়া নিয়েই থাকব। প্রথম উপন্যাস তো লিখে ফেলেছিই, এবার নাটকও লিখব একটা। নামও ঠিক করে ফেলেছি।
কী নাম?
কৌতুকের চোখে বলল রমলা।
গান্ধারী।
ওমা! কোন গান্ধারী সেঃ ঝিরাটোলির গান্ধারীই নাকি? কী ব্যাপার? সেই গিরিডিতে যার ঠাকুরদার অভ্রখনি ছিল? সে তো বয়েসে তোমার চেয়ে অনেক-ই বড়ো। পাটনাতে বিয়ে হয়েছে না?
সে নয়। তবে, সেও বটে। সব মানুষের মধ্যেই নাটকের উপাদান থাকে। সব আধুনিক মানুষ-ই পৌরাণিকও বটে। এখন কিছুই জিজ্ঞেস কোরো না নাটকটা সম্বন্ধে।
থিমটা মাথায় ঘুরছে ক-দিন থেকেই। যদি লিখে ফেলতে পারি, তবে গান্ধারীদিকে দিয়েই নায়িকার চরিত্রটি করাব। ফাটাফাটি হবে। প্রোডাকশান খরচও সেই-ই দেবে। বড়লোকের বিটি। এই দ্বাদশীর দিন তক্ষদার ‘রূপমতী’কে মানে মানে পার করি তারপর গান্ধারী’ সিরিয়াসলি শুরু করব।
এবারে বোকা তাড়াতাড়ি বলল, যাও যাও বউদি। দাদা এসে যাবে কখন। এতরাতে তোমাকে আমার ঘরে দেখলে তুলকালাম কান্ড করবে।
যার যেমন মন সে, পৃথিবীকে তেমন ‘চোখ’-এই দেখে। তুমি-আমি কী করব বলো? তবে তোমার দাদার আসার সময় হয়নি এখনও। কোনোদিন একটা, কোনোদিন দেড়টা। ওখানেই যে, থাকে না কেন তাও বুঝি না। সব-ই আমার কপাল।
বোকা ড্রয়ার খুলে একটি ইনল্যাণ্ড লেটার বের করে রমলাকে দিয়ে বলল পড়ে দ্যাখো! ছটোবোনকে সব দিয়ে বিয়ে দিলাম, কী না করলাম তার জন্যে; আর এই দ্যাখো কী ভাষায় চিঠি লিখেছে আমাকে। কে বলবে যে, আমি ওর দাদা। ওর স্বামী আর শ্বশুরবাড়িই সব। আশ্চর্য লাগে ভাবলেও।
ঘর ছেড়ে চলে যাওয়ার আগে রমলা বলল, সরমা কী লিখেছে চিঠিতে? বাপের বাড়িকে ভুলে না গেলে যে, মুশকিলও!
নাও। কালকে চিঠিটা ফেরত দিয়ো কিন্তু। ওকে একটা যোগ্য জবাব দেব। বড়োই সাহস হয়ে গেছে ওর। সবাই-ই কী পেয়েছে, আমাকে জানি না। আমি এবার থেকে সত্যিই সকলকেই শিখিয়ে দেব। যে-যে ব্যবহারের যোগ্য, তাকে ঠিক সেই ব্যবহার-ই দেব। সংসারে এক তরফা কিছুমাত্রই চিরদিন চলে না; চলতে পারে না। এবার আমিও কাঁদিয়ে দেব সবাইকে। টাইট করে ছেড়ে দেব একেবারে।
কোরো, কোরো। করতে পারলে, আমি খুবই খুশি হব। ভগবান তোমাকে কঠোর করুন। শক্ত করুন।
ফিসফিসে গলায় প্রায় স্বগতোক্তির-ই মতো কথা ক-টি বলে রমলা চলে গেল।
বউদি ঘর ছেড়ে চলে যাওয়ার সময়ে তার চোখের কোণায় যেন, একটু কৌতুকের আভাস দেখতে পেল বোকা। বউদি জানে যে, যতই লম্ফ-ঝম্প করুক, বোকা আসলে নরম মানুষ। ওকে চিরদিন-ই এমনি করেই দুঃখ পেতে হবে। বোকা ভাবছিল, এই বোকাকে নিয়ে সকলেই কি শুধু কৌতুক-ই করবে? একজন মানুষও কী ওকে সিরিয়াসলি নেবে না? ওর যা-পাওয়ার ছিল, এই জীবনে, এই পৃথিবী থেকে তা কি কারো কাছ থেকেই পাবে না? ও যে, নরম এটা সকলেই জেনে গেছে। এবার সকলকেই ও জানিয়ে দেবে যে, ও কী! দাদাকেও জানাবে, জানাবে ছোটোবোন সরমাকেও। এই সংসারে সকলেই হচ্ছে ‘শক্তর ভক্ত, নরমের যম’।
ঘরের আলোটা নিবিয়ে দিল বোকা। দিয়ে, পুরোনো লম্বা হাতলআলা বেতের ইজি চেয়ারটাতে শুয়ে পা দু-টি তুলে দিল। বারান্দার দরজাটা খোলা ছিল। পথের দু-পাশের বহুপুরোনো গাছগুলোকে দেখে মনে হচ্ছিল যেন, ঘরের বাইরেই জঙ্গল। গভীর। সামনের গাছটাতে কতগুলো চিলের বাসা আছে। ওরা গভীর রাতে নিজেদের মধ্যে কীসব কথা বলে অস্ফুটে, উঁচু ডালে নড়ে-চড়ে বসতে বসতে। দুখিয়া পাগলা, পথ-পাশের ঝুপড়ির মধ্যে থেকে রাত গম্ভীর হলেই বুক কাঁপিয়ে চিৎকার করে ওঠেঃ
হায়! হায়! ক্যা কিয়া? ঔর ক্যা মিলা?
কী করলাম? আর কী পেলাম!
এইটা বোকারো কথা। হয়তো সব মানুষেরই কথা। যে যা করে, তার বদলে যে-প্রত্যাশা থাকে তার কিছুমাত্রই ফেরত পায় না কেউই এই সংসার থেকে। জীবন এইরকম-ই।
ক-দিন আগে এক রবিবার সকালে দুখিয়াকে শুধিয়ে ছিল বোকা, রাতভর তুমি জেগে থাকো কেন? খালিপেটে থাকো বলেই কি ঘুম আসে না তোমার? বউদির কাছে যাও না খাবারের জন্যে? বউদি তো তোমার জন্যে রোজ-ই খাবার করে রাখেন।
যাই খাই। বহুজির জন্যেই তো বেঁচে আছি। আমার হাতের রেখাটা যদি, সত্যি সত্যিই সত্যি হয়, মানে, গয়ার সেই সাধুবাবা যা-লিখে দিয়ে গেছেন, আমার জনমপত্রী দেখে; তাহলে তো শেষজীবনে আমি গবর্নর হব। কেউই ঠেকাতে পারবে না। তখন তোমরা দেখো, বহুজিকে আমি কী সম্মান দিই। কিন্তু কথা সেটা নয়।
খাই-ই তো। রোজ-ই খাই। শরীরকে জ্বালায় যে-খিদে, সেই খিদে নিবৃত্তি সহজেই হয়। কিন্তু মন? মনকে যে, জ্বালায় চিন্তা। সারারাত মনকে আমি ধূপের মত জ্বালিয়ে রাখি গাঁজায় দম দিয়ে। রাতে যারা ঘুমোয়, তারা এখনও বড়ো হয়নি। হয়তো মানুষও নয়। অবোধ শিশু, মাথামোটা, টাকার গর্বে ফোলা, হুলো হুলো মানুষ; স্বামীর আদরে পরিতৃপ্ত সাধারণ নারী; অতিনিকৃষ্ট শ্রেণির পুরুষ, যারা তামসিক, তারা এবং জন্তুজানোয়ারেরাই শুধু রাতে ঘুমোয়। যাদের মস্তিষ্কর বয়েস হয়েছে একটুও, রাতভর তারা জেগে বসে থাকে; ‘চিন্তা’ করে। এই সমুদ্রে অন্যরা যখন ঘুমোয়, রাতের থির জলে-চলা নৌকোর-ই মতো নৌকোর তারাই বসে হালে। মানুষের জীবনের হাল ধরে। মানুষ কোন দিকে যাবে, কোন ঘাটে তার যাওয়ার ছিল, তা ঠিক করে দেয়, সেইসব রাত-জাগা পুরুষরাই যুগে যুগে।
বোকা, দুখিয়া পাগলাকে অনেক দিন শুধিয়েছে, হায়! হায়! ক্যা, কিয়া? ঔর ক্যা মিলা’ বলে চেঁচিয়ে ওঠো কেন, তুমি রোজ রাতদুপুরে? আমার হার্ট ভালো না। কোনদিন হার্ট অ্যাটাক হয়ে মারাই যাব তোমার জন্যে।
দুখিয়া পাগলা এই প্রশ্নের জবাবে শুধুই হাসে। ওপরের সারির গোটা আটেক আর নীচের সারির গোটা দশেক দাঁত হাওয়া হয়ে গেছে। আধ-ফোকলা মুখে হাসে পাগলা। ওর মুখে চেয়ে, বোকার মনে হয়; যেন ভগবানের-ই হাসি দেখল।
পাগলা বলে, ক্যা কিয়া? ক্যা মিলা?’ সে-কথা শুনে তুমি কী করবে ছোটোবাবু? সেসব ছোটোকথা, নোংরা কথা। নিন্দার কথা। সেসব কথা সব সংসারেই থাকে। সব গৃহীর-ই কোনো-না-কোনো সময় মনে হয়, হায়! হায়! কী করলাম। আর কী পেলাম! কিন্তু আমি তো গৃহী নই। যতদিন আমার এই অনুযোগ থাকবে সংসারের প্রতি, ততদিন আমি সাধক হতে পারব না। দুঃখটা তো এই-ই। সে যতবার-ই হরিদ্বার আর প্রয়াগ আর কেদারবদরীতে যাই-না-কেন! আর যত কোটিবার-ই তাঁর নাম করি না কেন। প্রতিরাতেই নিজেকে বলি, জানো ছোটোবাবু; বলি, আজ আর বলব না। কিন্তু শালা, ঠিক মুখ-ফসকে দাঁত-পিছলে বেরিয়ে যায়-ই। অনুযোগ নিয়ে, ক্ষোভ নিয়ে, পরিতাপ নিয়ে কেউ কখনো সাধক হতে পারে না। আমার ‘সিদ্ধি’ আটকে আছে শুধু ওইটুকুর-ই জন্যে। নইলে সিদ্ধির সাধনা, এইজন্যে মহড়া তো দিয়ে চলেছি, গত পনেরো বছর ধরেই। ঠিক চল্লিশ বছর বয়েসে সংসার ছেড়েছিলাম।
কোনটুকুর জন্যে?
ওই যে! হায়! হায়! ক্যা কিয়া? ঔর মিলা ক্যা!’ যেদিন মন বলবে, সবাই ভালো থাকো গগা। প্রত্যেকেই। আমার শত্রু-মিত্র, আমার আত্মীয়-অনাত্মীয়, পৃথিবীর সব ভোগী-ত্যাগী, গুণী-নির্গুণ, সকলকেই ক্ষমা করে দিয়েছি আমি, কারো কাছেই পাওনা নেই কিছুমাত্রই, ছুটি দাও, ছুটি দাও চিরকালের মতো, আমি যার চরণাশ্রয়ের লোভে ছুটে এসেছিলাম, সংসার স্ত্রী পুত্র ছেড়ে একদিন; তাঁর পায়েই লুটোতে দাও আমাকে…
বোকা চুপ করে চেয়েছিল ফোকলা, পাগলা, ছেঁড়া-ধুতি, আর খালি গায়ের দুখিয়ার দিকে। পথের মাঝে দুখিয়ার ঝুপড়ির সামনেই দাঁড়িয়ে অভিভূত হয়ে গেছিল ওর কথাতে। নিজের জীবন, ব্যবসা, কালচার-ফালচার, সাহিত্য-টাহিত্য এমনকী তার শিরে-সংক্রান্তি রূপমতী নাটকের কথাটা পর্যন্ত মাথা ছেড়ে উড়ে গেছিল, হঠাৎ-ই কুকুরে তাড়া-করা চড়ই পাখির ঝাঁকের মতো।
বোকার মন বলছিলঃ এইখানেই আসল আনন্দ রে বোকা। হিরে-জহরত সব ঝলমল করছে। এখনও ভাব। ভেবে দেখ। কী চাস? কিন্তু সিদ্ধি তো দূরস্থান ওর কপালে শান্তিও নেই দু-দন্ডের। ঠিক সেই সময়েই গিদারাম সিং কয়লার ব্যবসায়ী; বাজারের দিকে যাচ্ছিল তার নতুন কেনা ‘হণ্ডা মোটরবাইকে। দু-হ্যাণ্ডেলে লাল-সবুজ ক্যাটক্যাটে রঙের প্লাস্টিকের ঝুরি নামিয়েছে। জোরে ব্রেক করে ওর প্রায় গায়ের-ই ওপর দাঁড়িয়ে বলল, ক্যা বাবু? পাগলকি পাস ক্যা গাঞ্জেকে ধান্দেমে?”
বোকা উত্তর দেওয়ার আগেই ‘ভটভট’ আওয়াজ করে ঝকঝকে বাইকটা দেখিয়ে বলল, পাটনা সে, কালহি লেত্বে আয়া। কেইসা?
বোকা চকচকে চোখে বলল, ফার্স্টক্লাস।
গিদারাম দু-বার জোরালো হর্ন বাজিয়ে শোনাল ‘পিকাঁপক’ করে, তারপর-ই রুপোর মতো ঝকঝকে সাইলেন্সরটা ল্যাজের-ই মতো পেছনে ফুলিয়ে বীরদর্পে এঁকে বেঁকে কেরানি মেরে চলে গেল, বোকার মনে সম্পূর্ণ অপ্রয়োজনীয় লোভ জাগিয়ে।
বোকার মাথায় যে-উচ্চ মার্গের ভাব ক্ষণিকের জন্যে হলেও চাড়িয়ে গেছিল, একটা লাল রঙা মোটরসাইকেলে চড়ে-আসা ব্ল্যাক-ডায়মণ্ড মার্চেন্ট গিদারাম সিং তা ধূলিসাৎ করে দিয়ে গেল।
দুখিয়া পাগলার ফোকলা মুখ এক রহস্যময় হাসি খেলে গেল। বোকার মুখ লক্ষ করে। বলল, যাও যাও ছোটোবাবু, দোকান খোলো গিয়ে। তোমার হাতে অতগুলো চাবিঃ সবই কি দোকানের-ই?তোমার দোকানের?
বোকা বলেছিল, হাতের চাবির ভারী গোছাটা নেড়ে, হ্যাঁ।
ইস বেচ্চারি।
দুখিয়া পাগলা বলেছিল নিজের মনে। বিড় বিড় করে বলেছিল, শেষে পৌঁছে, দরকার হবে শুধুমাত্র একটার-ই। বোঝো তো! একথা কেউই বোঝে না। ব্যোম শংকর।
বোকাও জানে যে, চাবির বোঝা, বড়োবোঝা। ওর অবচেতনে ও সবসময়েই রিহার্সাল দেয়, একদিন ও এই চাবির বোঝা ছুঁড়ে ফেলে দুখিয়া পাগলাই হয়ে যাবে, যদি তক্ষদা নাও হতে পারে। কিন্তু অনেক-ই যে, ভারী চাবিগুলো। বাবা বয়েছেন পঞ্চাশ বছর। প্রতিদিন সকালে রামফল রিকশাওয়ালার সাইকেল-রিকশায় চেপে দোকানে গিয়ে তালাগুলো খুলেছেন। প্রতিসন্ধ্যায় আবার আগুন জ্বেলে, পুজো করে সেগুলো বন্ধ করেছেন। আজ বাবা নেই। রামফল রিকশাওয়ালাও নেই। একা বোকা চাপা পড়ে গেছে অতগুলো চাবির গোছার নীচে।
পেঁচা ডেকে উঠল একটা। বাড়ির মধ্যের লিচুগাছটাতে একটু বসেই ডানা-ঝাঁপটিয়ে উড়ে গেল।
ওর উপন্যাসের নামটা ‘ঘটোৎকচ’ শুনে নাটকের মহড়া দেওয়া ছেলে-মেয়েরা হাসাহাসি করছিল। ওরা জানে না, ওর বুক নিংড়ে লিখেছে ও সেই উপন্যাসটি। আসলে তা ওর জীবন নিয়েই লেখা। মহাভারতে কুরু ও পান্ডবদের মহারথীদের-ই জয়-জয়কার। ঘটোৎকচ নামেও যেমন হাস্যোদ্দীপক, তার জীবনও তেমন-ই। বেচারি উল্লেখযোগ্য কেউই নয়। বোকা যে, আসলে বোকাই একথাটাই কেউ বিশ্বাস করল না, অথচ প্রদ্যুম্ন সবসময়ই নিজেকে বুদ্ধিমান, সপ্রতিভ, আঁতেল, সাহিত্য-কাব্য-নাটক জগতের একজন পথিকৃৎ বলে মনে করে অথচ সকলেই তাকে নিয়ে হাসাহাসি করে। বলে, মাল নেই ভেতরে কিছু, শুধুই মিডিয়ার জোরে দাপিয়ে বেড়াচ্ছে। প্রদ্যুম্ন সে-কথা জানে। আর জানে বলেই আরও বেশি আঁতেলপনা করে। আসলে বোকার আর প্রদ্যুম্নর দুঃখটা একই ধরনের। একজন বোকা হওয়া সত্ত্বেও লোকে তাকে ‘ধূর্ত ভাবে, অন্যজন বুদ্ধিমান ও গুণী হওয়া সত্ত্বেও লোকে তাকে আমল-ই দেয় না।
পান্ডবদের দ্বিতীয় ভাই ভীমের ঔরসে আর হিড়িম্বা রাক্ষসীর গর্ভে ঘটোৎকচের জন্ম। জন্ম থেকেই সে, এক মহাবলী রাক্ষস। রাক্ষসীরা গর্ভবতী হওয়ামাত্রই প্রসব করে, খেয়েই বমি করার মতো; তাই হিড়িম্বা রাক্ষসীর ছেলে ঘটোৎকচ জন্মানোর ক্ষণ থেকেই যুবক। বেচারার না ছিল শৈশব; না কৈশোর। আজকালকার বাচ্চাদের মতোই। ঘট’ মানে হাতির মাথা, আর ‘উৎকচ’ মানে হচ্ছে টেকো। হাতির মতো টেকো মাথা নিয়েই বেচারি জন্মায়, তাই-ই তার নাম ঘটোৎকচ। যেহেতু একজন পান্ডবের ঔরসে তার জন্ম, অতএব সে, পান্ডবদের দাসানুদাস। জন্মের পরমুহূর্তেই, তাকে প্রয়োজনে স্মরণ করামাত্রই সে, উপস্থিত হবে তাদের খিদমদগারিতে শামিল হতে এই প্রতিজ্ঞা করে সে উধাও হয়ে যায়। রাক্ষসীর অমন কুদর্শন ছেলেকে তো আর কেউ নাড়ু খাওয়ার জন্যে স্মরণ করে না; করে ছাই ফেলতে ভাঙা কুলো’র দরকার হলে। দ্রৌপদী যখন বদরিকা-পথে চলতে চলতে ক্লান্ত হয়ে পড়েন, তখন ভীম তাকে স্মরণ করামাত্র ঘটোৎকচ উদয় হল। ভীম বললেন, দ্রৌপদীকে কাঁধে করে পৌঁছে দিতে বদ্রিকাশ্রমে, অতএব বেচারা তাই-ই করল। তারপর কৌরবদের সঙ্গে যখন, পান্ডবদের যুদ্ধ বাধল তখন আবার ডাক পড়ল ঘটোৎকচের। প্রলয়ংকরী যুদ্ধ করে কুরুসেনা সে লন্ডভন্ড করে দিল। কৌরবদের মধ্যে আতঙ্ক উঠল। যুদ্ধের চোদ্দোদিনের মাথায় ঘটোৎকচের সঙ্গে কিছুতেই পেরে না উঠে কৌরবদের হাতজোড়-করা অনুরোধে কর্ণ, অর্জুনকে মারার জন্যে ইন্দ্রর সাপ্লাই-করা যে, স্পেশ্যাল ‘বৈজয়ন্তী’ রকেট স্টকে রেখেছিলেন তাই ঝেড়ে দিলেন বেচারি ঘটোৎকচের ওপর। ক্যাসাব্ল্যাঙ্কার মতো মরল ঘটোৎকচ। এমনকী মরবার মুহূর্তেও মেরে মরল। যখন সে, মৃত্যুযন্ত্রণায় কাতর তখন তার নিজের শরীরকে প্রকান্ড বেলুনের মতো ফুলিয়ে ইয়াব্বড় করে মরে যখন পড়ল, তখন কৌরবদের সৈন্যদলের সৈন্যদের ওপর-ই ঢলে পড়ল। মৃত শরীরের চাপেই পিঁপড়ের মতো চেপটে মারা গেল অসংখ্য কুরুসৈন্য। এতেও হল না। ঘটোৎকচের ছেলে, বেচারা অঞ্জনপর্বাকে পর্যন্ত সেই যুদ্ধে শামিল করালেন মহান পান্ডবেরা। অপরাধ? ভীমবাবু হিড়িম্বা রাক্ষসীকে একবার আদর করেছিলেন। সে আদরে ভীমবাবুর যেন, কোনোই সুখ ছিল না, ভাগ ছিল না। বেচারা অঞ্জনপৰ্বাও মারা গেল অশ্বত্থামার হাতে।
পান্ডবরাও সৎ, ধার্মিক, মহান। কৌরবেরাও মস্ত বীর। তাদের সকলের নাম থাকল, সোনার অক্ষরে আর বেচারি অঞ্জনপৰ্বা আর তার বাবা ঘটোৎকচকে সকলেই বেমালুম ভুলে গেল, বোকাকে যেমন ভুলে গেছে তার ব্রিলিয়ান্ট দাদা আর একমাত্র বোন সরমা। এও জাতপাতের-ই ব্যাপার। ভারতবর্ষে জাতপাত নতুন কিছু নয়। যারাই সদবংশজাত, যারাই ধনী; যারাই ক্ষমতাবান তারাই চিরদিন ঘটোৎকচদের দিয়ে ক্রীতদাসের মতো তাদের নিজেদের নানা উদ্দেশ্যসাধন করিয়ে নিয়েছে। না দিয়েছে তাদের মান, না পিতৃপরিচয়, না ধনসম্পত্তি, না একটু ভালোবাসা। তারা শুধুমাত্র ‘নীচকুলসদ্ভূত’ বলেই তাদের শোষণ করেছে, ব্যবহার করেছে নির্দয়ভাবে।
‘ঘটোৎকচ’ উপন্যাসে বোকা শুধু তার নিজের জীবনের দুঃখই ফুটিয়ে তোলেনি, ব্লো-আপ করেছে, হাটে হাঁড়ি ভেঙেছে উচ্চকুলের এইসব নীচ মানুষদের। ঘরে-বাইরে এই নীরব বিদ্রোহকে মূর্ত করে তোলার মহড়া দিয়ে চলেছে বোকা বহুদিন থেকেই। এই মিথ্যে, মিথ্যাচারের মধ্য দিয়ে অর্জন করা মান-সম্মান শৌর্য-বীর্যকে ও ছিঁড়েখুঁড়ে দিতে চায় ওর একা হাতেই।
পারবে কি? ওর এই সংগোপনের, ব্যক্তিমানসের নাটক, জীবনের নাটক কোনোদিনও কি এদেশের শিক্ষিত উচ্চকুলের মানুষদের সামনে মঞ্চস্থ করতে পারবে বোকা?
.
নে, নে। আজ তাড়াতাড়ি চা খেয়েনে সবাই। অনেক গেজিয়েছিস। এবার শুরু করা যাক। আজ তক্ষদা আসবেন কিন্তু রিহার্সাল দেখতে। মহালয়ার আর পনেরো দিনও বাকি নেই। সিরিয়াস হ সকলে।
বোকাদা বলল।
কখন?
রুন শুধোল। তক্ষদা কখন আসবে?
এই, এগারোটা নাগাদ। আজ বিশুর মা আমাদের জন্যে, বিরিয়ানি পোলাও পাঠাবেন ক্লাবের বাবুর্চিকে দিয়ে রাঁধিয়ে। ভালো করে রিহার্সাল দে। কারো পার্ট ভুল হলে সে, বিরিয়ানি পাবে না। দুপুরে না খেয়েই থাকতে হবে। ঠিক আছে? মনে করবি স্টেজ রিহার্সাল। প্রম্পটাররা, তোমরা এমন করে প্রম্পট করবে যেন, অডিটোরিয়াম থেকে একটুও শোনা না যায়। ওককে। স্টার্ট নাউ।
শ্যামলের বেগুন-ভাতে-ভাই আর মানিকের চিচিঙ্গার মতো দেখতে মেয়েলি গলার দাদা, প্রম্পটার। দু-দিকের উইংসের আড়াল থেকে দু-জনে প্রম্পট করছে। একজনের গলা ভ্যাভ্যাতে। অন্যজনের গলা এমন ‘চি চি করে যে, এই পোড়োবাড়ির কার্নিশে-বসা পায়রাগুলো পর্যন্ত ভয় পেয়ে ডানা ধড়মড়িয়ে উড়ে যায়।
বোকাদা বলল, তৃতীয় অঙ্ক। রীতি, রুন, বিশু, সূর্য, গোপেন, চামেলি সব ক্যারেকটারস রেডি? থ্রি, টু, ওয়ান স্টার্ট। প্রথম দৃশ্য। তৃতীয় অঙ্ক। বাজবাহাদুর এবং রূপমতী। লোকেশান, মার রূপমতী মেহাল।
রূপমতী–সুলতান! কিছুদিন থেকেই আপনাকে বড়ো ছটফট করতে দেখছি। আমার গান কি আর ভালো লাগে না আপনার?
বাজবাহাদুর–সে-জন্যে নয়, সেজন্যে নয়।
একটু চুপ করে থেকে, রূপমতী মেহালের ছাদে পায়চারি করতে করতে নীচের ঘন জঙ্গলাবৃত নিমারের উপত্যকার দিকে চেয়ে ডায়ালগ বলতে যাবে বিশু, ঠিক সেই সময়েই বোকাদা চেঁচিয়ে উঠলঃ
হাত পেছনে, হাত পেছনে।
অ্যাঁ?
চমকে উঠল বিশু।
সুলতান বাজবাহাদুর যখন-ই চিন্তা করেন তখন-ই দু-খানি হাত পেছনে রেখে, ডান হাত দিয়ে বাঁ-হাতের কবজি ধরে রাখেন। মনে থাকে যেন। ভুল না হয়। আবার কর পায়চারি!
আরে! একটু সুলতান সুলতান ভাব আন।
বলেই, বোকাদা বলল, এই রমেশদা! কোথায় গেলেন রমেশদা? মিউজিক! মিউজিক! আজকে একেবারে স্টেজ রিহার্সালের মতো হবে। সিরিয়াসলি এখনও না করলে হবে কী করে? পুজোর আর দেরি ক-দিন?
রমেশবাবু সবে জম্পেশ করে পানটা মুখে দিয়েছিলেন। কিছুটা জর্দা হাঁ-করা মুখে ফেলে দিয়ে টুলটা টেনে এসরাজ কাঁধে উইংসের পাশে গিয়ে বসে পড়লেন।
স্টার্ট এগেইন। সরি ফর দ্যা ইন্টারাপশান।
বোকাদা বলল।
বাজবাহাদুর–গানও যেদিন ভালো লাগবে না রূপমতী, বিশেষ করে তোমার গান; সেদিন বাঁচা আর মরাতে তফাত থাকবে কি কোনো?
রূপমতী-তবে? সুলতান সবসময়ে কোন চিন্তা আপনাকে এমন অন্যমনস্ক করে রাখে আজকাল?
বাজবাহাদুর–রাজা বা সুলতান এমন, কি কখনো কেউ ছিলেন মালোয়ার ইতিহাসে, যাঁর চিন্তা ছিল না কোনো? মাঝে মাঝেই অন্যমনস্ক হতেন না যিনি? এই তখত বড়োই অসুখের, বড়োই অস্বস্তির এবং ক্ষণকালের আসন রূপমতী। এই আসনকে যে, নিজের মস্তজোর, শঠতা, নিষ্ঠুরতা এবং বিশ্বাসঘাতকতা নিয়ে অনুক্ষণ কুবেরের ধনের-ই মতো আগলে বসে না থাকতে পারে, তাকে আসনচ্যুত হতেই হয়। এই তখত-এ অধিকার থাকে না তার আর। কিন্তু আমি চেয়েছিলাম, চেয়েছিলাম…
এমন সময় ঘোড়ার খুরের আওয়াজ শোনা যাবে; চারজন অশ্বারোহী আসবার আওয়াজ। দূর থেকে। রূপমতী মেহালের দিকে।
বাজবাহাদুর ওইদিকে চেয়ে হঠাৎ-ই কথা থামিয়ে দেবেন। রূপমতী ওই দূরাগত অশ্বারোহীদের দিকে যেন, চেয়ে থাকবেন কিছুক্ষণ। এখনও দূরে আছে অনেক-ই। সুলতানের ডাকহরকরা, ভালো করে লক্ষ করে, যেন, তাদের ধ্বজা দেখেই বুঝলেন। বুঝেই অন্যমনস্ক হয়ে যাবেন রূপমতী। রূপমতী মেহালের নীচে অমলতাস গাছেরা ফুলের স্তবকে স্তবকে ভরে গেছে। সামান্য প্রভাতি হাওয়ায় একটু একটু দুলছে, সেই স্তবকগুলি।
রূপমতী-কী সুন্দর, না?
বাজবাহাদুর–কী?
রূপমতী–এই ফুলগুলি। এই সকাল, নিমারের আদিগন্ত এই উপত্যকা, দূরের নর্মদা নদী, পুণ্যতোয়া, উত্তরবাহিনী। অথচ আপনার সময়ই নেই এসব দেখবার। এমনকী, গানও শোনবার।
দুড়দাড় করে সরু সিঁড়ি বেয়ে ঘোড়া থেকে একলাফে নেমে একজন অশ্বারোহী ছাদে উঠে এল। অন্যরা দাঁড়িয়ে রইল। কুর্নিশ করল সবাই বাজবাহাদুরকে। হ্রেষারব এবং অস্থির ঘোড়াদের পা ঠোকার আওয়াজে মন্থর প্রভাতি হাওয়া অবিন্যস্ত হয়ে উঠল। অশ্বারোহী এসে পাকানো এবং হলুদ রেশমি সুতোয় বাঁধা বার্তা তুলে দিল সুলতানের হাতে, মাথা ঝুঁকিয়ে। বলল, হোশাঙ্গাবাদ থেকে সেনাপতি লজ্জন খাঁ পাঠিয়েছেন।
বাজবাহাদুর বার্তাটি খুলে পড়লেন। জ্ব-যুগল কুঞ্চিত হল তাঁর। বললেন, সেনাপতি একরাম খাঁকে দেখা করতে বলো আমার সঙ্গে বড়া মসজিদে। এক্ষুনি। আমি যাচ্ছি।
অশ্বারোহী চলে গেল, আবারও দুড়দাড় করে সিঁড়ি দিয়ে নেমে।
রূপমতী–কী খবর সুলতান? খারাপ কিছু?
বাজবাহাদুর–খবর খুবই খারাপ। দিল্লি থেকে মোগল সম্রাট আকবর, সেনাপতি আধম খাঁকে পাঠিয়েছেন মালোয়া দখল করার জন্যে। তাঁর বিরাট বাহিনী এগিয়ে আসছে ক্রমশই। লজ্জন খাঁ খবর পাঠিয়েছেন হোশাঙ্গাবাদ থেকে যে, সারাংপুরে আধম খাঁকে রুখতে না পারলে মাণ্ডু বাঁচানো যাবে না কোনোক্রমেই। তাকে তো ‘ধার’ পেরিয়ে মাণ্ডুতে উঠে আসতে দেওয়া যায় না!
একটু চুপ করে থেকে অন্যকিছু মুখ ফিরিয়ে বললেনঃ হেস্তনেস্ত যা হবার, তা ধারের সমতলেই হোক। আমার মা আর আমার রূপমতীর গায়ে যেন, আঁচড়টিও না লাগে।
রূপমতী–সর্বনাশ! বড়োই খারাপ খবর এ, সুলতান। আধম খাঁর বাহিনী যে, বিরাট। সম্রাট আকবর তো ছেলেখেলা করার জন্যে সেনাবাহিনী পাঠান না। আপনি যদি হেরে যান, তাহলে কী হবে আমার?
বাজবাহাদুর-হারার কথা বোলো না আমাকে রূপমতী। বোলো না, হারার কথা। রূপমতী-না, না। হারার কথা আমি ভাববও না একবারও। সুলতানের জীবনে যুদ্ধ তো মাঝে মাঝে আসবেই। তাকে ভয় করলে চলবে কেন? জিততে আপনাকে হবেই। মানুষ গায়ের জোরে যুদ্ধ জেতে না, জেতে ‘মনের জোরে। মনের সাহসটাই আসল সাহস, সুলতান। ভয় পাবেন না।
বাজবাহাদুর–ভয়? ভয়ের কথা কী করে উচ্চারণ করলে তুমি, রূপমতী? তুমিও কি আমাকে ভীরু বলে জানো?
রূপমতী–তা জানি না। কিন্তু সুলতান, এই কথা কি মিথ্যে? আমার কথা নয়, সকলেই বলে যে, নবাব মালিক বায়জাদ, যখন তখতে বসলেন, নিজের নাম বদলে যখন হলেন, সুলতান বাজবাহাদুর, তখন থেকেই দেখা গেছে যে, তাঁর মধ্যে শেরশাহর দুর্ধর্ষ সেনাপতি, তাঁর পিতা শুজ্জাত খাঁর বীরের রক্তর আভাস নাকি ছিল না। আমাকে মার্জনা করবেন সুলতান। আপনি কি আপনার পিতার সন্তান নন সুলতান? গোণ্ডায়ানার হিন্দু রানি, রানি দুর্গাবতীর কাছে যুদ্ধে লজ্জাকরভাবে পরাজিত হওয়ার পর থেকেই নাকি আপনার মধ্যে যোদ্ধাসত্তাটি মরে যায়? তারপর থেকেই সুরা, গান আর রূপমতীর মধ্যেই আপনি ডুবে যান। আমার গায়েও তো কম বাজে না এ-কলঙ্ক! আমাকে পেয়েই নাকি সব হারিয়েছেন আপনি! আমিই নাকি আপনার অধঃপতনের মূলে? একজন পুরুষকে ঘরমুখো, এমনকী ভীতু করে তুললাম, শুধু এই দুর্নামটুকুই কি আমার প্রাপ্য ছিল সুলতান? আমি নিজে তো ভীতু নই। এ ছাড়া আর কিছুই কি পাওয়ার ছিল না আমার? আর কোনো প্রশস্তি?
পূর্ণদৃষ্টিতে বাজবাহাদুর একবার তাকালেন রূপমতীর দু-চোখে। কাছে এগিয়ে এলেন। অনেকক্ষণ নীরবে তাঁর দু-চোখের তারায় কী যেন, খুঁজতে লাগলেন। নবাবের দু-চোখ যেন, বলতে লাগল, তুমিও? তুমিও রূপমতী? তারপর-ই চোখের দৃষ্টি কঠোর হয়ে এল নবাবের। এবং পরমুহূর্তেই উদাস।
বাজবাহাদুর–সুলতান হুমায়ু, মলোয়া ছেড়ে চলে যাওয়ার পর-ই, খলজি বংশের কর্মচারী মানু খাঁ একদিকে নর্মদা আর অন্যদিকে ভিলসা শহর অবধি মালোঁয়ার ভূখন্ড সব-ই অধিকার করে নিয়েছিলেন এবং এই মাণ্ডুতেই নিজেকে অধিষ্ঠিত করেছিলেন কাদির শা নাম নিয়ে পনেরো-শো ছত্রিশ খ্রিস্টাব্দে। দিল্লির শের শা এসে তাদের তাড়িয়ে দিলেন। গদিতে বসলেন আমার বাবা শুজ্জাত খাঁ পনেরো-শো চুয়ান্নতে।
রূপমতী–এসব কথা বলছেন কেন সুলতান? এর কিছুই তো অজানা নয় আমার। আমি…
বাজবাহাদুর–বলছি, কারণ তোমার কথার উত্তর এককথায় দেওয়া যায় না। একথা ঠিক-ই, যে, আমি রানি দুর্গাবতীর কাছে হেরে গেছিলাম যুদ্ধে। নবাব হওয়ার পর। বাজবাহাদুর হেরে গেছিল। জীবনে হারকে মেনে নিয়েছিল। কিন্তু, কে জানে? হয়তো জিততেও পারতাম। যুদ্ধে হার এবং জিত দুই-ই থাকে। যুদ্ধ হলেই একপক্ষের জিত হয়, অন্যপক্ষের হার। জানি আমি যে, হয়তো ভবিষ্যতের ইতিহাসে লেখা থাকবে–হেরো বাজবাহাদুর যুদ্ধে হেরে গান-বাজনা আর রূপমতীকে নিয়ে তার রূপেই আর তার গানেই নষ্ট হয়ে গেল, ভ্রষ্ট করে দিল মাঁলোয়ার নবাবি তখত। কিন্তু ইতিহাসে কতটুকুই বা লেখা থাকে রূপমতী? শুধুমাত্র সন, তারিখ আর ঘটনার-ই যারা কারবারি, তাদের মধ্যে বেশির-ই তো দেখার চোখ, অনুভূতির গভীরতা এবং কল্পনার শক্তি থাকে না।
রূপমতী–আপনি বড়োই উত্তেজিত হয়ে পড়েছেন সুলতান। যাঁকে কিছুদিনের মধ্যেই জীবন-মরণের যুদ্ধে লিপ্ত হতে হবে তাঁর পক্ষে এমন মানসিকতা আদৌ স্বাস্থ্যকর নয়।
বাজবাহাদুর–রূপমতী, সব-ই জানি আমি। তবু যে, প্রশ্ন তুমি তুলেছ তার জবাব আমাকে দিতে দাও। পরে সময় আর নাও পেতে পারি। তা ছাড়া, এই প্রশ্নের জবাব শুধু তোমাকেই যে, দিচ্ছি তাও নয়, আমার নিজের বুকের মধ্যেও এই প্রশ্ন বহুবছর চিৎকার করে উঠেছে। মাথার মধ্যে শিরা-উপশিরায় ঝংকার তুলেছে। আমার ভেতরের সেই–আমিকেও শুনতে দাও এই প্রশ্নের উত্তর।
রূপমতী–-বলুন সুলতান। আসুন, তার আগে আমরা পুবের আলসেতে গিয়ে বসি। আপনাকে কি কোনো পানীয় দেবে সুলতান? আয়েষা!
বাজবাহাদুর–না। না। চলো। তুমি শোনো রূপমতী, আমি কী বলি না বলি। শুনে রাখো। যদি কেউ এ-কথা তোমার কাছ থেকেও শোনে, তাহলেও জানবে যে, সব সুলতান-ই একধাতু দিয়ে গড়া হয় না। যুদ্ধের পর যুদ্ধে শৌর্য-বীর্য দেখানোই কোনো সুলতানের অস্তিত্বের একমাত্র বহিঃপ্রকাশ নয়।
রূপমতী–বসুন সুলতান। এইখানে বসুন, আসন পেতে দিলাম।
বাজবাহাদুর–হ্যাঁ। বসছি। আমার তাড়া নেই কোনো। অনন্তকাল অপেক্ষা করে আছে। আমার জন্যে, আমার অনন্ত জীবন, রূপমতী!
রূপমতী–বলুন, কী বলবেন আমাকে জাঁহাপনা?
বাজবাহাদুর–জানি না। কী করে যে বলব! জানো রূপমতী, আমি সম্পূর্ণই অন্য ধরনের, এক নতুন যুগের, নতুন জগতের সুলতান হতে চেয়েছিলাম। পৃথিবীর ইতিহাস পড়লে তুমি দেখবে, অনেক নবাব, জাঁহাপনা, সুলতান-ই রাজ্য শাসন করেছেন, ক্রমাগত যুদ্ধ করে, প্রতিপক্ষকে হত্যা করে অথবা যাবজ্জীবন বন্দি করে রেখে। অন্য রাজ্যের নৃপতিদের রাজ্য কেড়ে নিয়ে। সেই রক্ত-ঝরানো স্বাচ্ছল্যর অর্থ দিয়ে, কেউ কেউ প্রজার মঙ্গল করেও নাম কিনেছেন। কেউ আবার অত স্বচ্ছল হওয়া সত্ত্বেও প্রজাদের নিপীড়ন-ই করেছেন। সবাই তো রাজা ভোজ বা রাজা মুঞ্জ-এর মতো হন না। কেউ গান-বাজনা, সাহিত্য, অথবা স্থাপত্য যাতে মূল্য পায়, যাতে সেই সুলতানের আমলেই সেইসব গুণ এবং শিল্প যথার্থ প্রস্ফুটিত হয় তাও দেখেছেন…
রূপমতী–সেটা কি খারাপ সুলতান?
বাজবাহাদুর–শেষ হয়নি কথা আমার। শেষ করতে দাও, রূপমতী। ওঁরা যা-কিছুই করেছেন, সবকিছুই করেছেন নিজেদের যশের-ই জন্যে। ইতিহাসে নিজের নাম সোনার অক্ষরে লেখা থাকে যাতে, শুধুমাত্র সেইজন্যেই। সাহিত্যকে, গান-বাজনাকে, স্থাপত্যকে ভালো তাঁরা বাসেননি। নিজেদের ছাড়া আর কাউকেই, কোনোকিছুকেই ‘দামি’ করেননি আসলে। মাইনে করা ঐতিহাসিকদের দিয়ে, তাঁদের জাগির দিয়ে, ধন-দৌলত দিয়ে কিনে নিয়ে, নিজের নামে জয়ধ্বনি দিইয়েছেন। এই-ই ঘটেছে যুগের পর যুগ। ঐতিহাসিকেরা যে, রূপোপজীবিনীদের চেয়ে, কিছু কম বিকিয়েছেন নিজেদের কিছুমাত্র, মালোয়ার তো বটেই; সমস্ত ভারতবর্ষের ইতিহাসও তা বলে না।
রূপমতী–সে তো নতুন কিছু নয়, সুলতান। সে তো চিরদিন-ই হয়ে এসেছে এবং ভবিষ্যতেও হবে। ইতিহাসমাত্র বিশ্বাসযোগ্য তো এই কারণেই হয় না। ইতিহাসে চিরদিনই মিথ্যের বেসাতি।
বাজবাহাদুর–যে সুলতান, ঐতিহাসিককে চাকর বানাতে পারেননি বা চাননি, তাঁর সম্বন্ধে ভালোকথা বেশি কি লেখা আছে ইতিহাসে?
রূপমতী–তা নাই-ই বা থাকল। কিন্তু সৎ, সত্য ইতিহাস-ই তো একমাত্র প্রণিধানযোগ্য ইতিহাস। যে-সুলতান বা জাঁহাপনার সব-ই গুণ, দোষ কিছুমাত্রই নেই; তিনি তো মানুষ হিসেবেও অবিশ্বাস্য। তাই-না? মাইনে করা ঐতিহাসিকরা মিথ্যে কথা লিখে গেলেও তাতে সবকিছু তো সত্যি হয়ে ওঠে না। সত্যি-ইতিহাস জানার যাঁদের জিজ্ঞাসা আছে, আগ্রহ আছে, তাঁরা সত্যকে ঠিক-ই খুঁড়ে বের করেন। সময় হয়তো লাগে ঠিক-ই; কিন্তু সত্য চাপা থাকে না জাঁহাপনা।
বাজবাহাদুর–যা বলতে চাইছিলাম তা থেকে অনেক-ই সরে এলাম আমি রূপমতী। যেমন, জীবনে যা করতে চেয়েছিলাম; তা থেকেও। সময় হাতে বেশি নেই। আমাকে বলতে দাও। আমি চেয়েছিলাম, এমনই এক সুলতান হতে, এই সুন্দর মাণ্ডুর ব্যতিক্রমী সুলতান; যিনি কোনো রাজ্য জয় করবেন না কোনো অন্য রাজার। জয় করবেন সংগীতজগতের সমস্ত রাজ্য; জাগির; জানবেন, সেই আশ্চর্য জগতের ঝংকৃত অলিগলিকে, আবিষ্কার করবেন নারী ও পুরুষের প্রেমকে নতুনতর, শান্ত স্নিগ্ধ আলোয়। কী বলো তুমি? এও কি এক ধরনের রাজত্ব নয়? সাম্রাজ্য নয়? এই সাম্রাজ্যের গভীরে যাওয়ার চেষ্টাও কি রাজকার্য নয়? ‘রাজকার্য’ মানে কি শুধুই মৃত্যুদন্ড? কারাগার? যুদ্ধ? রক্তপাত? নারী ও শিশুর ক্রন্দন?
রূপমতী–রাজ্যই যদি না থাকে সুলতান, তবে কোনোরকম রাজকার্যই যে, করার অধিকার থাকবে না আপনার। এটাও তো ভাবতে হবে। রাজত্বর সঙ্গে যুদ্ধ যে, ওতপ্রোতভাবে জড়িয়েই থাকে। যে-সুলতান বলেন, যুদ্ধ আমি করব না’, গদি যে– তাঁর জন্যে কোনোদিনও নয়। এই তখত-এ বসার জন্যে আপনি নিজেও কি নিজের অন্য দুই ভাইয়ের সঙ্গে যুদ্ধে লিপ্ত হননি সুলতান? তাঁদের অভিশাপ এবং আর্তনাদ কি কলঙ্কিত করেনি আপনাকেও? এই তখতও তো আপনার পিতা শুজ্জাত খাঁ আপনাকে একা দিয়ে যাননি। ইতিহাস তো তাই-ই বলে।
বাজবাহাদুর–আঃ! তুমি বুঝছ না, রূপমতী। বড়ো পুরোনো কথা টেনে আনছ। পুরোনো কথা! যুদ্ধ আমি করেছিলাম, সে তো প্রাথমিক যুদ্ধই, ক্ষমতাতে আসীন হওয়ার-ই যুদ্ধ সে। যা নইলে, আমি সুলতান হতাম না মাঁলোয়ার; মাণ্ডুর।
রূপমতী–(হেসে) সুলতানদের জীবনে প্রাথমিক যুদ্ধ বলে কোনো কথা নেই। যুদ্ধই তাঁদের জীবনের সবচেয়ে বড়োসঙ্গী। তাঁদের জীবন মানেই নিত্যযুদ্ধ। প্রাথমিক অথবা শেষযুদ্ধ বলে কিছুই নেই। এবার বরং গান ছেড়ে, ভোগ ছেড়ে, রূপমতীর কোল ছেড়ে ঘোড়ায় উঠুন জাঁহাপনা? যে-পুরুষ যুদ্ধ করতে ভয় পান, কোনো নারীই তাঁর জন্যে নয়। অবশ্য নারীর শরীর পেতে নবাব বাদশাহের বাধা কিছুই নেই। তেমন তেমন নারীর, মনের কথাই শুধু বলছি আমি। সাহসী হোন সুলতান; অন্যদের-ই মতো!
বাজবাহাদুর–তুমি খুব সাহসী, না রূপমতী? তুমি একা একা বাঘ মারো, ঘোড়ায় শিকার করতে যাও, খুব-ই সাহসী, সন্দেহ নেই।
বলেই, বাজবাহাদুর উঠে দাঁড়িয়ে করতালি দিয়ে, তাঁর ঘোড়া আনতে বললেন, রূপমতী মেহালের নীচে।
রূপমতী–আজ কী সুন্দর দেখাচ্ছে সবকিছু, না, জাঁহাপনা? আপনাকেও। চারদিকের এই প্রভাতি প্রকৃতিকে। আঃ! কত ফুল। কত্ত পাখি চারদিকে। জৌনপুরিতে গান ধরব একটা? এই গম্ভীর রাগ এই মুহূর্তে আমার মনকে আচ্ছন্ন করে ফেলেছে। ধরি? সুলতান?
বাজবাহাদুর–না। আমি মসজিদে যাব। সেনাপতি একরাম খাঁ অপেক্ষা করছেন সেখানে, আমার জন্যে। চলি আমি, রূপমতী। সন্ধেবেলায় জেহাজ-মেহালে বরং দেখা হবে। আজ গভীর রাতে মালকোশ শুনব তোমার গলায়। জানি না, আর কতদিন শুনতে পাব তোমার গান! এ-পৃথিবীতে গান, প্রেম সব-ই বাহুল্যর জিনিস; উপছে-পড়া ‘ধন’ এসব। ক-জনে এর কদর জানে বলো?
এবারে একটা গুঞ্জরন উঠল চারধার থেকে।
তৃতীয় অঙ্কর প্রথম দৃশ্য শেষ হল।
বোকাদা চেঁচিয়ে বলল। ফাইন। যদিও ইন্দুভমেন্টের অনেক স্কোপ আছে। রীতি, তোর কি কোনো রাগ আছে বিশের ওপর?
রীতি হাসল, যেমন করে হাসে।
বলল, আমার নেই। রূপমতীর থাকতে পারে বাজবাহাদুরের ওপর।
বোকাদা বলল, কোথায়? শ্যামলদা কোথায়? আরে, শিঙাড়াটা না-হয় পরেই খেতে! তোমাদের নিয়ে পারি না সত্যিই! টেপরেকর্ডারে ঘোড়ার খুরের আওয়াজ অমন ফাটা-বাঁয়ার আওয়াজের মতো থপ থপ’ করছে কেন গো? যখন ডাকহরকরারা এল, তখনও তো শোনা গেল না কিছুই? তারাও তো ঘোড়া চড়েই এল। নাকি? আর বাজবাহাদুরের ঘোড়ার পায়ে কি পোঁটলা বাঁধা ছিল? কী শ্যামলদা? ব্যাপারটা কী? খুলে বলো তো একটু। এ কী চিত্তির!
আররে। মান্তু সিং-এর ঘোড়াটাই যে, ঠ্যাং ভেঙেছে! সেই তিন ঠ্যাঙের-ই ল্যাগ ব্যাগে আওয়াজ তুলেছিলাম টেপে। ছ্যাঃ ছ্যাঃ। এখন দেখছি, ওতে চলবে না। এই মরাদের ঝিরাটোলিতে তো জ্যান্ত ঘোড়াও আর নেই। শালা এমন-ই জায়গা, চারাগাছ ঘোড়া পর্যন্ত জোটে না! থ্যাটার হয় ককনো একানে? প্রোডাকশানের শ্যামল বলল।
গাধায় হবে না?
সূর্য বলল, ভলান্টিয়ারি করে।
বোকাদা বলল, হলেও হতে পারে। তোক দিয়ে যখন, সেনাপতি আধম খাঁর রোল করানো যাচ্ছে তখন, গাধা দিয়ে ঘোড়ার কাজ চালাতে পারা তো বাচ্চোকা খেল।
বলেই বলল, ইডিয়ট।
দেকেচো! উপায়-ই বা কী? ভালো বলতে গেলাম আর…। ‘ইডিয়ট ফিডিয়ট’ বলবে না। বলছি…কেচাইন করে দেব কেস।
গোপেন বলল, অ্যাই বোকাদা! গুড আইডিয়া! ভোপালি সার্কাস এসেছে। ওখানে গিয়ে ঘোড়ার পায়ের শব্দ রেকর্ড করে আনো। ওদের ফাস্ট ক্লাস চারটে ঘোড়া আছে। টগবগায় সবসময়ে।
তাহলে তাই-ই করো। যার যার দায়িত্ব, সে সে পালন করো। যেমন করে পারো। সকলের পেছনেই আমি ধামা ধরতে পারি না আর।
ফ্রাস্ট্রেটেড গলায় বলল, বোকাদা।
তারপরেই রমেশবাবুর দিকে ফিরে বলল, রমেশদা! ফাস্ট ক্লাস! তুমি একাই ক্যান্টার করে দিলে। চমৎকার ফুটেছে সিনটার মুড। তোমার এসরাজ-এর যেন, প্রাণ’ আছে। তুমি একটি রিয়্যাল জিনিয়াস মাইরি।
বোকাদার চকিত উল্লাসে সকলেই খুশি হল।
তক্ষদা আসছে। তক্ষদা।
কে যেন বলল, ফিস ফিস করে। গুঞ্জরন উঠল একটা।
রীতি দেখল। স্কুটারটা শিমুল গাছের গোড়ায় রেখে তক্ষ রায় আসছে।
মানুষটার মুখের দিকে চাওয়া যায় না। এত কুৎসিত মুখ সে, জীবনে দেখেনি! অথচ লম্বা, সুগঠিত পেটা শরীর। চমৎকার গলার স্বর। কত বিষয়ে যে-‘জ্ঞান’ রাখে মানুষটা? আর কথা শুনলে তো যেকোনো মেয়েই প্রেমে পড়বে। সত্যিই চমৎকার কথা বলেন। অথচ মুখটাই…রীতির চেয়ে বয়সে বছর বারোর বড়োই হবেন তিনি। তক্ষ রায়কে এই ভ্রাতৃসংঘের ছেলে-মেয়েরা অনেকেই ‘তক্ষক’ বলেই ডাকে আড়ালে। চামেলি একদিন বলেছিল, কাঁঠাল গাছের তক্ষকও সুন্দর দেখতে তক্ষদার চেয়ে।
হেসেছিল, সকলে মিলে চামেলির রসিকতায়।
বুকপকেট থেকে চার্মস-এর প্যাকেট উঁচু হয়ে আছে। একটা সাদা ফ্রেডপেরির টেনিস গেঞ্জি আর জিনের ট্রাউজার। কোমরে চামড়ার মোটা বেল্ট। নিকেলের বাকলস।
কতদূর?
মুখ থেকে খুঁয়ো ছেড়ে বললেন, তক্ষ রায়।
এই তো তৃতীয় অঙ্ক হল এক্ষুনি। প্রথম দৃশ্য। তুমি কিন্তু ঘাবড়িয়ে না তক্ষদা। আমরা ঠিক তুলে দেব। এরপরের সিনটা তুমি নিজেই দেখে বলো কেমন হচ্ছে।
বোকাদা বলল।
না। আমার আর ভাবনার কী আছে?
বাঃ। ভাবনা নেই? প্রেস, রেডিয়ো, টি. ভি.?
আমি কাউকেই আসতে বলব না। তা ছাড়া, আমি বললেই কী তারা আসবে? আমার তেমন জানাশোনা কেউই নেই কোথাও।
সে কী?
মাথায় হাত দিয়ে বসে পড়ল প্রায় বোকাদা।
তক্ষদা অবাক গলায় বলল, কেন? সেরকম কথা ছিল নাকি? আমি তো জানতাম না।
ছিল না?
ছিল?
তাহলে তোমার এই গোলমেলে নাটক করতেই বা যাব কেন আমরা? ‘চলচ্চিত্তচঞ্চরী’, বা ‘ব্যাপিকা-বিদায়’ বা ‘গণশার বিয়ে করতাম। ঝিরাটোলির পাবলিক নিতও! বাপের জন্মে ঝিরাটোলির পাবলিক এমন নাটক দেখেছে, মানে তোমার রূপমতীর মতো? ইট-পাটকেল না, পড়ে শেষে।
তক্ষ রায় অনেকক্ষণ বোকাদার মুখে একদৃষ্টে চেয়ে রইলেন। তারপর চেয়ারে বসে পড়ে বললেন, এখনও সময় আছে অনেক। তোমরা এই নাটক ড্রপ করে দাও।
না, না। আমরা এইটেই করব। কীসব পুরোনো মান্ধাতার আমলের নাটক বার বার। পচে গেছে।
চারদিক থেকে গুঞ্জরন উঠল ছেলে-মেয়েদের।
বোকাদা একটু অস্বস্তিতেই পড়ল। চারদিকে তাকিয়ে কিছু আর বলল না।
সিগারেটটা মাটির কুলহার-এ গুঁজে দিয়ে তক্ষ রায় বোকাদাকে বললেন, তোমার জন্যে ভালো খবর আছে বোকা। কী খাওয়াবে বল?
কী? কী ক্কী খবর? বল?
উত্তেজিত দেখাল খুব-ই বোকাদাকে। পৃথিবীর সব সুলতান এবং বোকা এবং চালাকরাই নিজেকে যত ভালোবাসে, তেমন অন্য কাউকেই বাসে না। উত্তেজনা অকারণের নয়।
তোমার ‘ঘটোৎকচ’ উপন্যাসটি ছাপা হচ্ছে আগামী বৈশাখে। বৈশাখী সংখ্যায়। তবে একটা কাজ করতে হবে তোমায়।
ক্কী-খি…? ক্কী খি?
সম্পাদককে একটা সংবর্ধনা দিতে হবে।
সংবর্ধনা? কোথায়?
যেখানেই থোক। এই শীতেই। একটি ভালো কাশ্মিরী মলিদা এবং একহাজার টাকার একটি তোড়া দেবে ফুলের তোড়ার সঙ্গে।
আমার নিজের নামেই কি দেব? লোকে জানবে না? ছ্যাঃ!
ছ্যাঃ ছ্যাঃ কোরো না বোকা। লজ্জা, মান, ভয়, তিন থাকতে নয়।
তা নয়। কে দেবে? বোকাদা চিন্তান্বিত গলায় বলল।
ইডিয়ট। ভ্রাতৃসংঘ-ই দেবে। ভ্রাতৃসংঘ না দিলে, কোনো একটা নাম বানিয়ে নেবে, দেবে আসলে তুমিই। কিন্তু সংস্থার নাম দেবে ‘আগমনি’, সনাতনি’, সুনয়নী’, অথবা বিনোদিনী। ঠেকাচ্ছেটা কে? সংবর্ধনাই তো এখনকার ফ্যাশান। ক্রেজ অফ দ্য ডে।
টা, টা–টাকা? টাক্কা কে দেবে?
যার লেখা ছাপা হবে, সে-ই। নিয়ম তো তাই-ই।
মানে? সে কী? কত টাকা পাব লিখে?
কম নয়। তা প্রায় দেড় হাজার। এই বাজারে মন্দ কী? তাও সাহিত্যকম্মো করে।
কম্মো ফতে! তবে তো সে-টাকার সবটাই চলে যাবে।
বেশি। এখন এই-ই রেট যাচ্ছে ঝিরাটোলির ওই সম্পাদকের। যদি লেখা উতরে যায়, কখনো নামি-দামি লেখক হয়ে উঠতে পারো তখন পুষিয়ে নিয়ে চালাকের মতো। সব-ই ইনভেস্টমেন্টের ব্যাপার। বুঝলে-না। লগ্নি করলে, তবেই না সুদে আসবে।
তখন কিছুই দিতে হবে না? মানে, ফিউচারে?
বিপদগ্রস্ত বোকাদা বলল।
বাঃ কী বলছ তুমি? যে-মানুষের কৃতজ্ঞতাবোধ নেই সেও কি মানুষ? তখনও দেবে বই কী। তবে, মাঝেমধ্যে সম্পাদকের যখন যা-দরকার হবে তাই-ই আর কী?
বিশু বলল, এ যে, কনট্রাক্টরি ব্যবসার চেয়েও এককাঠি ওপরে গেল দেখছি, তোমাদের সাহিত্যের লাইন! শালা কী দিনকাল।
বোকাদা বলল, চুপ কর তো। বড়োবেশি কথা বলিস তোরা। কিন্তু টাকা? টাকাটা কে দেবে?
ফিনান্সিয়ার জোগাড় করো।
‘হায়ার-পারচেজ’ কোম্পানির সঙ্গে যোগাযোগ করব? যারা গাড়ি, ট্রাক এইসব কিনতে টাকা দেয়? দেবে কি তারা?
ওরা বোধ হয় এখনও ধার দেওয়া শুরু করেনি হবু-সাহিত্যিকদের। তবে যেভাবে দিনকে দিন এই ব্যবসা বাড়ছে তাতে শিগগিরই দেওয়া আরম্ভ করবে বলেই মনে হয়। সাহিত্য তো আর প্রাইভেট এন্টারপ্রাইজ নেই, রীতিমত ইণ্ডাস্ট্রিই হয়ে উঠেছে।
কী সাংঘাতিক!
বোকাদা বলল।
কী?
এই সিস্টেম।
ওঃ। আমি ভেবেছিলাম তুমি তোমার উপন্যাস ‘ঘটোৎকচ’-এর কথাই বলছ। না বোকা, কোনোই উপায় নেই। যদি ওই কাগজে লিখতেই চাও, তবে বড়োবাবু ছোটোবাবুদের সঙ্গে শামিল হও। দলে ভিড়ে যাও। টাকা খরচ করো। চামচেগিরি করো; তোমার হবে। এমন করে, কত অপোগন্ড বড়ো লেখক হয়ে গেল আমার নিজের চোখের সামনে। নাথিং সাকসিডস লাইক সাকসেস। বুঝলে বোকা! ‘ঘটোৎকচ’কে মেডিয়া এবং তোমার দল ‘জ্ঞানপীঠ পুরস্কার তো সামান্য কথা, নোবেল প্রাইজ পর্যন্ত পাইয়ে দিতে পারে। এখন ভালো লেখালেখির দিন আর নেই। ওসব গৌণ হয়ে গেছে। মুখ্য হচ্ছে জানাশোনা; কানেকশানস। মেডিয়া।
তা, তুমি করলে না কেন? তক্ষদা? নাম?
আমি? আমার নামের মোহ’ নেই বলে। আমি, আমি বলে। মাথা নীচু করে জীবনে, যা কিছুই পেতে হয়, বা চামচেগিরি করে; তাতে আমার একটুও প্রয়োজন নেই বলে। এই প্রান্তরে, এই তক্ষ রায় হচ্ছে, লাস্ট অফ দ্যা মোহিকানস। বুঝলে-না!
ইডিয়ট।
ফস করে বলে ফেলল বোকাদা।
সকলেই তাকাল তক্ষদার দিকে।
বোকাদা সঙ্গে সঙ্গেই তক্ষদার পায়ে হাত দিয়ে বলল, মা-মাইরি বলছি। শালা মুখ ফসকে ইডিয়টটা বেরিয়ে গেল। বলতে চাইনি।
.
তক্ষ রায়ের মুখে একটি স্মিতহাসি ফুটে উঠল। রাগ নয় কিন্তু। রুন-এর দিকে চেয়ে বললেন, তোদের চা-টা সব শেষ বুঝি? কী রে? খাওয়া-না একভাঁড়।
তারপর-ই বোকাদার দিকে ফিরে বলল, ইডিয়টকে ইডিয়ট বলেছিস তারজন্যে এত অ্যাপলোজি কীসের? আমি জানি যে, আমি ইডিয়ট। একমাত্র ইডিয়টরাই জানে ‘ইডিয়সি’র আনন্দ। একজন কবিকে কোট করে বলতে ইচ্ছে হয় আমি ‘মূর্খ বড়ো, সামাজিক নয়।” আমার কিছু হবে না; জানি আমি। না নাম; না প্রাইজ। তবু, আমি, আমি’-ই থাকতে চাই।