২. আচার (সি. ৯০০ থেকে ৮০০ বিসিই)
আনুমানিক ১২০০ সালের দিকে ভূমধ্য সাগরীয় সংকট গ্রিসে আঘাত হানে। এটা সম্ভব যে, শক্তির শেষ বিস্ফোরণে মাইসিয়ান গ্রিকরা এশিয়া মাইনরের ট্রয় নগরী ধ্বংস করে দিয়েছিল: প্রত্নতাত্ত্বিকরা খনন করে ধ্বংসের প্রমাণ বের করেছেন, তাঁদের বিশ্বাস অনুযায়ী ত্রয়োদশ শতাব্দীর দ্বিতীয় পর্যায়ে ঘটেছিল এটা। কিন্তু নিকট প্রাচ্যের রাজ্যগুলোর মতো মাইসিয়ান রাজ্যও ধসে পড়ে। চারশো বছর স্থায়ী এক অন্ধকার যুগে পা রাখে গ্রিস। চতুর্দশ শতাব্দী থেকে মাইসিয়ানরা ওই অঞ্চল নিয়ন্ত্রণ করে আসছিল। বিভিন্ন নগরের একটি বাণিজ্যিক নেটওয়ার্ক গড়ে তুলেছিল তারা, টিন ও কপারের বিনিময়ে আনাতোলিয়া ও সিরিয়ায় জলপাই রপ্তানি করত। এর আগের মিনোয়া সভ্যতার বিপরীতে (সি. ২২০০-১৩৭৫) মাইসিয়ান সমাজ ছিল আগ্রাসী ও সামরিক। ক্রিটের নোসোস থেকে শাসনকাজ পরিচালনাকারী মিনোয়ানরা কোমল, শান্তিপূর্ণ জাতি ছিল বলে মনে হয়। চমৎকার আবেগময়, দারুণ রঙে রাঙানো ফ্রেস্কোয় সাজানো তাদের প্রাসাদগুলো সুরক্ষিত ছিল না, যুদ্ধ ছিল দূরের হুমকি। কিন্তু মাইসিয়ান গ্রিকরা হালনাগাদ সামরিক প্রযুক্তির প্রদর্শনী দিয়ে সাধারণ জনগণের উপর প্রাধান্য বিস্তার করেছিল। হিট্টাইট থেকে আমদানি করা যুদ্ধ-রথ, শক্তিশালী দুর্গ আর দর্শনীয় সমাধি ছিল তাদের। একটি দক্ষ প্রশাসন গড়ে তুলেছিলেন রাজা। মাইসিনার রাজধানী থেকে মাইসিয়ানরা মেসিনা, পাইলস, অ্যাট্টিকা, বোয়েশিয়া, থেসালি, গ্রিক দ্বীপপুঞ্জ ও সাইপ্রাস শাসন করত। হিট্টাইট সূত্র মোতাবেক ত্রয়োদশ শতাব্দী নাগাদ এশিয়া মাইনরের উপকূলীয় শহরে আক্রমণ চালাতে শুরু করেছিল তারা।
এই শক্তিশালী সভ্যতাটি কার্যত রাতারাতি উধাও হয়ে যায়। মাইসিয়ান মূল ভূমির বিভিন্ন নগরী-পাইলোস, তিরাইনস ও মাইসিনা-সম্ভবত সাগরের লোকদের হাতে ধ্বংস হয়ে যায়। জনসংখ্যার কিছু অংশ আর্কাডিয়া ও সাইপ্রাসে চলে যায় এবং উত্তরের পেলোপোনেসাস মাইসিয়ানদের একটি ছিটমহলে পরিণত হয়, এর পর থেকে যারা আচিয়ান্স নামে পরিচিত হবে। কিন্তু এছাড়া, তাদের আর কোনও চিহ্ন ছিল না। মাইসিয়ানরা মিনোয়ান লিপিকে তাদের নিজস্ব ভাষায় অভিযোজন করেছিল, কিন্তু টিকে যাওয়া টেক্সটগুলো স্রেফ সাজসরঞ্জাম, রসদ আর পণ্যের তালিকা হওয়ায় তাদের সমাজ সম্পর্কে তেমন কিছু জানি না আমরা। তবে মনে হয় তা ক্রিটান ও নিকট প্রাচ্যীয় ধারায় চলত এবং অ্যাক্সিয়াল যুগে বিকশিত হওয়া গ্রিক সংস্কৃতির সঙ্গে সামান্যই সম্পর্ক ছিল তার।
গ্রিকরা আনুমানিক ২০০০ সালের দিকে এই অঞ্চলে বসতি স্থাপন শুরু করা ইন্দো-ইউরোপিয় জাতি ছিল। ভারতের আর্যদের মতো স্তেপের কোনও স্মৃতি ছিল না তাদের, তাদের পূর্ব পুরুষরা বরাবর গ্রিসেই বাস করে এসেছে বলে ধরে নিয়েছিল তারা। কিন্তু ইন্দো-ইউরোপিয় টানে কথা বলত তারা, ইন্দো-আর্যদের মতো বেশ কিছু একইরকম সংস্কৃতির অংশীদার ছিল। গ্রিক প্রথায় আগুন খুবই গুরুত্বপূর্ণ ছিল, গ্রিকরা আবার প্রবলভাবে প্রতিযোগিতামূলক মনোভাবের অধিকারী ছিল, সবকিছুকেই প্রতিযোগিতায় পরিণত করত তারা। গোড়ার দিকে গ্রিক গোত্রগুলো মিনোয়ান সমাজের প্রান্তিক অবস্থানে বসতি করেছিল, কিন্তু ১৬০০ সাল নাগাদ মূলভূখণ্ডে শক্তিশালী অবস্থান গড়ে তুলতে থাকে এবং বেশ কিছু প্রাকৃতিক দুর্যোগের পর মিনোয়ান সভ্যতার পতন শুরু হলে নিয়ন্ত্রণ হাতে তুলে নিয়ে মাইসিয়ান রাজত্ব প্রতিষ্ঠার জন্যে তৈরি হয়ে যায়।
মিনোয়ান বা মাইসিয়ান ধর্ম সম্পর্কে খুব সামান্যই জানি আমরা। প্রত্নতাত্ত্বিকদের আবিষ্কৃত ভাস্কর্য আর দেবতার নামে উৎসর্গ থেকে মনে হয় যে, মিনোয়ানরা নাচ ও মিছিল করতে ভালোবাসত; পবিত্র গাছের কাল্ট ছিল তাদের, পাহাড় চূড়ায় দেবতাদের উদ্দেশে পশু বলী দিত এবং তুরীয় পুলক সুলভ দিব্যদৃষ্টি ছিল। সোনার আংটি এবং মূর্তিতে সতর্ক ও ঋজু নারী-পুরুষকে চোখ কুঁচকে আকাশে ভাসমান দেবীর দিকে তাকিয়ে থাকতে দেখা যায়: কবরস্থান ছিল পবিত্র জায়গা। রাজা ছিলেন দেবতাদের অংশীদার: বিভিন্ন সীল মোহরে তাঁর হাতে বর্শা বা ছড়ি তুলে দেওয়া এক দেবীর সঙ্গে কথা বলতে দেখা যায়। এইসব আচারের কোনও কোনওটা গ্রিক ধর্মে টিকে থাকবে; মাইসিয়ান টেক্সট এমন সব দেবতাদের কথা উল্লেখ করেছে যারা পরে গ্রিক দেবনিচয়ে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে থাকবেন: যিউস, আথেনা, পোসাইদন ও দিওনিসাস।
কিন্তু পূর্ব ভূমধ্যসাগরীয় সভ্যতার বিপর্যয়কর পতন অপরিবর্তনীয়ভাবে উভয় সভ্যতার সাথেই গ্রিকদের যোগাযোগ রহিত করে দেয়। নিরক্ষরতা ও আপেক্ষিক বর্বরতায় ডুবে যায় গ্রিস; কেন্দ্রীয় কোনও কর্তৃত্ব ছিল না, স্থানীয় সর্দাররা বিভিন্ন এলাকা শাসন করত। প্রাসাদোপম দালানকোঠার আর অস্তিত্ব ছিল না, ছিল না ভাস্কর্য-কলা এবং চারুশিল্পের অবক্ষয় শুরু হয়েছিল। কবিরা কিছু কিছু প্রাচীন কিংবদন্তী বাঁচিয়ে রেখেছেন। মাইসিয়ান আমলকে অসাধারণ যোদ্ধাদের অনন্য এক কাল হিসাবে স্মরণ করেছেন তাঁরা। ট্রোজান যুদ্ধের সময় নিহত মহান অ্যাচিয়ান অ্যাচিলিসের কাহিনী বলেছেন। স্বর্গ-নির্দেশিত প্রতিশোধে প্রাণ হারানো মাইসিন রাজা আগামেননের নিয়তির কথা স্মরণ করেছেন। পরিচয় না জেনেই বাবাকে হত্যা করে আপন মাকে বিয়ে করা থেবসের রাজা ঈদিপাসের স্মৃতি ধরে রেখেছেন। সারা গ্রিস ঘুরে বেরিয়ে বিক্ষিপ্ত সম্প্রদায়কে অভিন্ন পরিচয় ও সাধারণ ভাষা দেওয়ার চেষ্টা করে গেছেন চারণ কবিরা।
বিপর্যয় থেকে রক্ষা পাওয়া মুষ্টিমেয় শহরগুলোর ভেতর ছিল মাইসিয়ান শক্তঘাঁটিগুলোর ভেতর বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ পূর্ব অ্যাট্টিকার অ্যাথেন্স। নগরের পতন ঘটায় জনসংখ্যা হ্রাস পেতে থাকে, কিন্তু কখনওই সম্পূর্ণভাবে পরিত্যক্ত হয়নি। একাদশ শতাব্দীর মাঝামাঝি নাগাদ অবশ্য অ্যাথেনিয় চারুশিল্পীরা বর্তমানে প্রোটো-জিওমেট্রিক স্টাইল নামে পরিচিত নকশায় অলঙ্কৃত অত্যাধুনিক মাটির পাত্র তৈরি করতে শুরু করে। এবং একই সময়ে অ্যাথেনিয়রা এশিয়া মাইনরে অভিবাসন করে নগরের আইওনিয় ভাষাকে বাঁচিয়ে রাখা এজিয়ান উপকূল বরাবর বসতি স্থাপন করে। দশম শতাব্দীতে অ্যাথেন্সের চারপাশের পল্লী এলাকায় নতুন নতুন গ্রাম গড়ে উঠতে শুরু করে এবং অ্যাট্টিকার জনসংখ্যা চারটি গোত্রে (ফিলিয়া)ভাগ হয়ে যায়, যতটা না জাতিগত তারচেয়ে বেশি ব্রিটিশ পাবলিক স্কুলের বিভিন্ন ‘হাউসের’ ধরনে প্রশাসনিক ইউনিটের মতো ছিল এগুলো। স্রোত অ্যাথেন্সের দিকে ঘুরে যাচ্ছিল। পরে এই পুনর্জাগরণকে অ্যাথেন্সের পৌরাণিক রাজা থেসিয়াসের কৃতিত্ব বলে ব্যাখ্যা করা হয়েছে। প্রতি বছর অ্যাথেন্সবাসীরা নগরের পাশে পবিত্র পাহাড় অ্যাক্রোপলিসে ধর্মীয় উৎসব পালন করার ভেতর দিয়ে থেসিয়াসের তাদের অঞ্চল একীভূত করার উৎসব উদযাপন করবে।
নবম শতাব্দীতে গ্রিক সমাজ তখনও প্রবলভাবে গ্রাম্য ছিল। হোমারের মহাকাব্যগুলোই আমাদের প্রধান উৎস, অষ্টম শতাব্দীর আগে যেগুলোর লিখিত রূপ দেওয়া হয়নি, কিন্তু বেশ কিছু প্রাচীন মৌখিক ঐতিহ্য ধরে রেখেছে। ভেড়া, গবাদি পশু আর শুয়োর দিয়ে স্থানীয় বাসিলিদের সম্পদ হিসাব করা হতো। কৃষক আর খামারিদের চেয়ে এক ভিন্ন জগতে ছিল তাদের বাস, নিজেদের তখনও যোদ্ধা মনে করত তারা। সগর্বে নিজেদের বীরত্বের কথা প্রচার করত, স্বীকৃতি আর সম্মান দাবি করত; যারপরনাই প্রতিযোগিতার মনোভাব সম্পন্ন ও ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদী ছিল তারা। সমাগ্রিকভাবে নগরের চেয়ে বরং নিজেদের, পরিবার এবং গোত্রের প্রতিই ছিল তাদের প্রথম আনুগত্য। তবে গোটা এজিয়ান জুড়ে স্বতীর্থ অভিজাতদের সঙ্গে একাত্ম বোধ করত তারা এবং তাদের সঙ্গে সহায়তায় দরাজভাবে তৈরি থাকত ও পর্যটকদের আপ্যায়ন করত।
কিন্তু অন্ধকার যুগের শেষদিকে এজিয়ানে বাণিজ্য আবার নতুন প্রাণ পায়। অস্ত্র ও বর্মের জন্যে অভিজাতদের ইস্পাতের প্রয়োজন ছিল, আর প্রতিপক্ষের মুখের উপর অপমান ছুঁড়ে দিতে প্রয়োজন ছিল বিলাস পণ্য। উত্তরাঞ্চলীয় উপকূলীয় শহরগুলোর বাসিন্দা কানানীয়রা তাদের প্রথম বাণিজ্য অংশীদার ছিল, গ্রিকরা প্রাচীন কালে পাকা রংয়ের মুক্তোর (ফোনিক্স) উপর একচেটিয়া অধিকার থাকার কারণে তাদের বলত ফোনিশিয়। প্রথম দিকে গ্রিকরা তাদের সংস্কৃতির চেয়ে ঢের বেশি উন্নত সংস্কৃতির ফোনিশিয়দের প্রতিহত করার প্রয়াস পেয়েছিল। কিন্তু নবম শতাব্দী নাগাদ যৌথভাবে কাজ শুরু করে তারা। সাইপ্রাসে ফোনিশিয়রা একটি ঘাঁটি স্থাপন করে এবং ফোনিশিয় চারুশিল্পীরা কাজ করার উদ্দেশ্যে অ্যাথেন্স, রোডস ও ক্রিটে এসে হাজির হয়। ফোনিশিয় উপনিবেশকারীরা পশ্চিম ভূমধ্যসাগরীয় এলাকা উন্মুক্ত করতে শুরু করে এবং ৮১৪ সালে উত্তর আফ্রিকার উপকূলে কার্থেজ প্রতিষ্ঠা করে। গ্রিকদের সাগরের বাণিজ্য সম্ভাবনা দেখিয়ে দিয়েছিল তারা এবং সিরিয়ায় নতুন বৈদেশিক যোগাযোগ শুরু করেছিল গ্রিকরা। নবম শতাব্দীর শেষদিকে ফোনিশিয়, সাইপ্রিয়ট আর গ্রিকরা ওরোনেত নদীর মোহনায় আল-মিনা বাণিজ্যিক কেন্দ্র প্রতিষ্ঠা করেছিল, ইস্পাত, ধাতব পণ্য ও কাপড়ের বিনিময়ে দাস আর রূপার বাণিজ্য হতো এখানে
নতুন করে জীবন ফিরে পাচ্ছিল গ্রিক, কিন্তু জনগণ রয়ে গিয়েছিল আধ্যাত্মিক শূন্যতায়। প্রাচীন মিনোয়ান মাইসিয়ান রীতিনীতির সামান্য কিছু অবশেষ রয়ে গিয়েছিল: উদাহরণস্বরূপ, অ্যাক্রোপলিসে পবিত্র জলপাই গাছ ছিল কিন্তু ত্রয়োদশ শতাব্দীর সংকট প্রাচীন ধর্মবিশ্বাসকে তছনছ করে দিয়েছিল। গ্রিকরা তাদের জগৎকে ধসে পড়তে দেখেছে, এই ধাক্কা বদলে দিয়েছিল তাদের। মিনোয়ান ফ্রেস্কোগুলো আস্থাবান ও আলোকময় ছিল; ফুটিয়ে তোলা নারী, পুরুষ আর পশুগুলো ছিল প্রত্যাশী ও আশাবাদী। ফুলে ভরা ময়দানে নাচ আর আনন্দে ভরা দেবীদের ছায়া ছিল। কিন্তু নবম শতাব্দী নাগাদ গ্রিক ধর্ম ছিল নৈরাশ্যবাদী, রহস্যময়; এর দেবদেবীরা ছিলেন বিপজ্জনক, নিষ্ঠুর, খামখেয়ালি। সময়ে গ্রিকরা চোখ ধাঁধানো ঔজ্জ্বল্যের সভ্যতা গড়ে তুলবে, কিন্তু কখনও ট্র্যাজিডির বোধ বিস্তৃত হয়নি তারা; এবং অ্যাক্সিয়াল যুগে এটাই তাদের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ধর্মীয় অবদানে পরিণত হবে। তাদের আচার-অনুষ্ঠান ও মিথ সবসময়ই ‘দৃষ্টিসীমার ঠিক বাইরে এবং সাধারণভাবে রাতে নেপথ্যে ঘটে যাওয়া ভয়ঙ্কর সব ঘটনাপ্রবাহ, অনির্বচনীয় ও নিষিদ্ধের ইঙ্গিত দেবে। যখন টাবুর লঙ্ঘনে জীবন ব্যাখ্যার অতীত ওলটপালট হয়ে যায়, এবং যখন সমাজ ও ব্যক্তিকে স্থির মস্তিস্ক রাখা সীমা হঠাৎ করে ভেঙে খানখান হয়ে যায়, তখন বিপর্যয়ের ভেতর পবিত্রকে অনুভব করেছে তারা।
গ্রিক দেবতাদের জন্মের ভীতিকর কাহিনীতে আমরা এই অন্ধকার দর্শন প্রত্যক্ষ করতে পারি। গ্রিক বিশ্বে উদার স্রষ্টা ঈশ্বরের কোনও অস্তিত্ব ছিল না আর সময়ের সূচনায় কোনও স্বর্গীয় বিধানও ছিল না, বরং ছিল কেবলই অব্যাহত ঘৃণা আর বিরোধ। বলা হয়ে থাকে, প্রথমে দুটি আদিম শক্তি ছিল: বিশৃঙ্খলা ও গাইয়া (পৃথিবী)। প্রজনন দেওয়ার বেলায় দারুণ বৈরী হওয়ায় স্বাধীনভাবে নতুন প্রজন্মের জন্ম দেন তারা। গাইয়া জন্ম দেন আকাশ-দেবতা ইউরেনাসকে (স্বর্গ)। তারপর আমাদের বিশ্বের সাগর, নদী, পাহাড় ও পর্বত। তারপর গাইয়া ও ইউরেনাস মিলিত হন, প্রথমে ছয় ছেলে ও ছয়টি মেয়ের জন্ম দেন গাইয়া। এরা ছিলেন দেবতাদের প্রথম জাতি টাইটান।
কিন্তু সন্তানদের ঘৃণা করতেন ইউরেনাস, তাদের আবার গাইয়ার জঠরে ফিরে যেতে বাধ্য করেন তিনি। শেষপর্যন্ত, যন্ত্রণার ভেতর দিয়ে সন্তানদের কাছে সাহায্য চান গাইয়া, কিন্তু কেবল কনিষ্ঠ ছেলেরই তাঁর কথামতো কাজ করার সাহস ছিল। মায়ের জঠরে জবুথুবু হয়ে কাস্তে হাতে তৈরি অবস্থায় বাবার জন্যে অপেক্ষা করতে থাকেন তিনি। পরের বার ইউরেনাস গাইয়ার সঙ্গে মিলিত হলে তাঁর জননাঙ্গ কেটে পৃথিবীর দিকে ছুঁড়ে ফেলেন তিনি। প্রধান দেবতারা প্রায়শঃই তাঁদের গতিশীল সন্তানদের হাতে উৎখাত হতেন, কিন্তু অল্প সংখ্যক মিথই অদিম সংগ্রামকে এমন বিকৃতভাবে সংরক্ষণ করেছে। ক্রোনাস এখন নতুন প্রধান দেবতা, ভাই ও বোনদের পৃথিবীর গহ্বর থেকে মুক্ত করলেন তিনি। পরস্পরের সঙ্গে মিলিত হয়ে টাইটানদের দ্বিতীয় প্রজন্মের জন্ম দিলেন তাঁরা, এদের মধ্যে ছিলেন পৃথিবীকে কাঁধে ধরে রাখা অ্যাটলাস; এবং মানুষকে দেওয়ার জন্যে স্বর্গ থেকে আগুন চুরি করে আনা প্রমিথিউস।
অতীতের বিভীষিকা থেকে শিক্ষা নেওয়ার বদলে অবশ্য বাবার মতোই স্বেচ্ছাচারী ছিলেন কোনাস। বোন রিয়াকে বিয়ে করেন তিনি, পাঁচটি সন্তান-দেবতাদের দ্বিতীয় জাতি-জন্ম দেন: হেস্তার (পবিত্র অগ্নিকুণ্ডের অভিভাবক), দিমিতার (শস্যের দেবী), হেরা (বিয়ের পৃষ্ঠপোষক), হ্যাডস (পাতাল রাজ্যের প্রভু), এবং পসাইদোন (সাগর দেবতা)। কিন্তু ক্রোনাসকে তাঁর এক সন্তান তাঁকে উচ্ছেদ করবে বলে জানানো হয়েছিল, তাই জন্মের পরপরই প্রতিটি শিশুকে গিলে ফেলেন তিনি। ষষ্ঠ সন্তান রিয়ামকে পেটে নিয়ে মরিয়া হয়ে গাইয়ার শরণাপন্ন হন মা; তারপর শিশু যিউস জন্ম নিলে তাঁকে ক্রিট দ্বীপে লুকিয়ে রাখেন গাইয়া, অন্যদিকে রিয়া একফালি কাপড়ে জড়িয়ে একটা পাথর তুলে দেন ক্রোনাসের হাতে। কোনও কিছু খেয়াল না করেই সেটা খেয়ে নেন তিনি। বড় হয়ে যিউস ভাইবোনদের উগড়ে দিতে বাধ্য করেন বাবাকে; অলিম্পাস পাহাড়ে গিয়ে বসতি গড়ে পরিবারটি। পাল্টা লড়াইয়ের চেষ্টা করেন ক্রোনাস। দশ বছর ধরে তিনি ও অন্য কয়েকজন টাইটান অলিম্পিয়ান্সে যুদ্ধ চালিয়ে যান, কিন্তু মহাবিশ্বকে টলিয়ে দেওয়া এক যুদ্ধে চূড়ান্ত বিজয় লাভ করেন যিউস এবং বাবা ও তাঁকে সমর্থনকারী টাইটানদের পৃথিবীর গহবরে এক অন্ধকার ভয়ঙ্কর এলাকা তরতরাসে কারাবন্দি করেন।
এদিকে দ্বিতীয় আদিম শক্তি বিশৃঙ্খলা তাঁর নিজস্ব ভয়ঙ্কর উত্তরসুরিদের জন্ম দিয়েছেন: ইরেবাস (পৃথিবীর গভীরতম অভ্যন্তরে ‘অন্ধকার স্থান’) এবং রাত। রাত এরপর জন্ম দেন একঝাঁক মেয়ে, যাদের ভেতর ছিলেন নিয়তি (মেইরাই), মৃত্যুর আত্মা (কেরেস) এবং তিনজন ক্রোধ (এরিনিস)।৭ এরিনিসরা বিশেষ করে ভীতিকর ছিলেন; বিতৃষ্ণা জাগানো ডাইনী, সাপে আবৃত, শিকারের গন্ধ পেতে চারপায়ে গুঁড়ি মেরে চলা কুকুরের মতো গর্জন ছাড়া প্রাণী হিসাবে এদের কল্পনা করেছে গ্রিকরা। একটি কিংবদন্তীতে আছে, ক্রোনাস ইউরেনাসের জননাঙ্গ কেটে ফেলার সময় ঝরে পড়া রক্ত থেকেই তাদের জন্ম হয়েছে। সুতরাং, তারা অলিম্পিয়ানদের চেয়েও প্রাচীন আর পারিবারিক সহিংসতা তাদের অন্তস্তলেই খোদাই করা ছিল।
অন্ধকার যুগে পৃথিবীর গভীরে বাসরত চথোনিয় শক্তি গ্রিক ধর্মে প্রাধান্য বিস্তার করে ছিল। নবম শতাব্দীতে লোকের বিশ্বাস ছিল যে, অলিম্পিয়ানরা নয় তারাই মহাবিশ্ব শাসন করেন। পরবর্তীকালের জনৈক কবি যেমন ব্যাখ্যা করেছেন, কারও নিকটজনের প্রতি সামান্য নিষ্ঠুরতাই সামাজিক শৃঙ্খলা লঙ্ঘন করে বলে ‘অন্ধকারের দেবতারা মানুষ ও দেবতার পাপের খোঁজ করেছেন এবং পাপীকে সাজা না দেওয়া পর্যন্ত তাদের ভয়ঙ্কর ক্রোধ হ্রাস পায়নি’ ইউরেনাস, ক্রোনাস এবং যিউস, এরা সবাই ভয়ঙ্কর পারিবারিক অপরাধে অপরাধী হওয়ায়, বলেছেন চথোনিয় দেবতারা, যেমন বলা হয়েছে, ছিলেন অলিম্পিয়ানদের ছায়াদিক দেখিয়েছে। সক্রিয় হয়ে উঠলে তাঁদের শক্তি স্বয়ংক্রিয়ভাবে কাজ করত এবং ঠেকানো যেত না। কোনও শিকার আক্রমণকারীকে অভিশাপ দিয়ে সজোরে চিৎকার করে ওঠামাত্র এরিনিসরা মুক্তি পেয়ে যেতেন এবং হানাদার সহিংস, ভীষণ মৃত্যুর মাধ্যমে অনুশোচনা না করা পর্যন্ত তাকে বুনো কুকুরের মতো খুঁজে বের করতেন।
গ্রিক কল্পনায় এরিনিসরা কখনওই তাদের অধিকার পুরোপুরি হারিয়ে ফেলেননি। অন্ধকার যুগের অনেক পরেও গ্রিকরা বাবা-মার হত্যাকারী ও বাচ্চাদের উপর অত্যাচার চালানো নারী-পুরুষের কাহিনী নিয়ে ব্যস্ত ছিল। অনিচ্ছাসত্ত্বে ঘটলেও এইসব অস্বাভাবিক ঘটনা ছিল নিজস্ব স্বাধীন জীবনের অধিকারী সংক্রামক শক্তি (মিয়াসমা)। অপরাধীর আত্মোৎসর্গমূলক মৃত্যুর ভেতর দিয়ে পরিশুদ্ধ না হওয়া পর্যন্ত সমাজ ক্রমাগত প্লেগ আর বিপর্যয়ে আক্রান্ত হতে থাকবে। উদাহরণ স্বরূপ, আত্রেউসের বংশের কাহিনী মাইসিনার সিংহাসনের জন্যে দুই ভাই অত্রেয়াস ও থিস্তেসের ভেতর এক ভয়ানক সংঘাতের কথা বলে। আত্রেয়াস একবার ভাই থিস্তেকে ভোজসভায় নিমন্ত্রণ জানিয়ে তাঁকে তাঁর নিজের ছেলেদের মাংস মেশানো সুস্বাদু স্ট্যু খেতে দেন। এই ভীতিকর কাণ্ড আত্রেয়াসের পুরো পরিবারের দিকে চালিত হওয়া এক সংক্রামক মিয়াসমা চালু করে দেয়। একের পর এক সহিংস ও অপ্রাকৃত মৃত্যু আরও মৃত্যু ডেকে আনা এক ভীষণ প্রতিশোধের কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে পড়ে সবাই। গ্রিক নৌবহর ট্রয়ের উপকূলে নিয়ে যেতে অনুকূল বাতাসের জন্যে মেয়ে ইফিগেনিয়াকে উৎসর্গ করতে বাধ্য হন আত্রেয়াসের ছেলে মাইসিনার রাজা আগামেনন। তাঁর স্ত্রী ক্লিতেমনেস্ত্রা ট্রোজান যুদ্ধ থেকে ফেরার পর তাঁকে হত্যা করে এর বদলা নেন এবং তাঁর ছেলে ওরেস্তেস তখন বাবার হত্যার প্রতিশোধ নিতে হত্যা করতে বাধ্য হন তাঁকে। এই বিকৃত ও তালগোল পাকানো কাহিনী গ্রিক পুরাণের অন্যতম গঠনমূলক বৈশিষ্ট্যে পরিণত হবে। আরও অনেক গ্রিক কাহিনীর মতো মানুষকে নিদারুণ অক্ষম হিসাবে তুলে ধরা হয়েছে এখানে। অষ্টম শতাব্দীতে হোমার স্পষ্টই ক্লিতেমনেস্ত্রা ও ওরেস্তেসের এমন আচরণ করা ছাড়া আর কোনও উপায় ছিল না বলে বিশ্বাস করতেন; এমনকি পৃথিবীকে তাঁরা মিয়াসমা থেকে রক্ষা করেছেন বলে তাঁদের কর্মকাণ্ডকে বীরত্বব্যাঞ্জক হিসাবে প্রশংসাও করা হয়েছে।
যত শক্তিশালীই হয়ে উঠুক না কেন গ্রিকরা কখনওই সত্যিকার অর্থে নিজেদের নিয়তি-নিয়ন্তা মনে করেনি। একেবারে পঞ্চম শতাব্দীর দিকে, গ্রিক সভ্যতা তুঙ্গে থাকার সময়েও লোকে তাদের আচরণের ক্ষেত্রে নিয়তির হাতে কিংবা এমনকি অলিম্পিয়ান দেবতাদের হাতে বাঁধা বলে বিশ্বাস ছিল এবং একবার কোনও অপরাধ ঘটে গেলে স্রেফ দূষিত পরিবেশে বাস করতে বাধ্য হওয়া নিরীহ মানুষের উপর অবর্ণনীয় দুঃখ বয়ে আনে। লোকে অলিম্পিয়ানদের কাছ থেকে কোনওরকম সাহায্য আশা করতে পারে না, যাঁরা দায়িত্বজ্ঞানহীনের মতো মানব জীবনে হস্তক্ষেপ করেন, নিজেদের প্রিয়জনদের সমর্থন করেন এবং পরিণামের দিকে দৃষ্টিপাত না করে তাঁদের কোপানলে পতিতদের ধ্বংস করে দেন। একমাত্র এরিনিসরাই যা কিছু নৈতিক উপলব্ধি দেখানো দেবতা! এমনি সহিংস আচরণে ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠেন তাঁরা, কিন্তু করুণা ও সহানুভূতির বেলায় তাঁদের ঘাটতি আছে। সুতরাং, কাহিনীর কোনও কোনও ভাষ্যে ওরেস্তেস মাকে হত্যা করতে বাধ্য হওয়ার পর তাঁর অভিশপ্ত পরিবারের উন্মুক্ত করা মিয়াসমা নিশ্চিহ্ন না হওয়া পর্যন্ত এরিনিসরা সারা পৃথিবীময় তাড়া করে ফেরেন।
গ্রিকরা সহিংসতা ও বিপর্যয়ের বিভিন্ন ইমেজে তাড়িত হয়েছে। অলিম্পিয়ানরা কেবল মানুষের প্রতিই নিষ্ঠুর ছিলেন না; পরস্পরকেও বিকলাঙ্গ ও নিপীড়ন করেছেন তাঁরা। উদাহরণ স্বরূপ, যিউসের স্ত্রী হেরা পঙ্গু ছেলে হেপিয়াস্তাসকে নিয়ে এতটাই বিতৃষ্ণ ছিলেন যে, জন্ম নেওয়ার পর তাঁকে পৃথিবীর দিকে ছুঁড়ে ফেলেছিলেন তিনি। বুনো, ক্রুদ্ধ এই দেবী তাঁর স্বামীর অসঙ্গত সম্পর্কের ফলে জন্ম নেওয়া সন্তানদের খুঁজে খুঁজে ফিরেছেন। যিউসের ছেলে দিওনিসাসকে এক মরণশীল নারী সিমিলির হাতে হত্যা করাবেন বলে টাইটানদের সঙ্গে মিলে ষড়যন্ত্র করেছেন। এবং শেষপর্যন্ত মানসিক বিকারগ্রস্ত করে তুলেছেন তাঁকে। দিওনিসাস অবশেষে সুস্থ হয়ে ওঠার আগে বছরের পর বছর পুবের দেশে দেশে পাগলের মতো ঘুরে বেরিয়েছেন। দোলনায় সাপ ছেড়ে দিয়ে যিউসের আরেক ছেলে হেরাক্লেসকেও হত্যার চেষ্টা করেছেন হেরা, পাগল করে তুলেছেন তাঁকে, যাতে তিনি তাঁর স্ত্রী ও সন্তানদের হত্যা করতে পারেন। পরিবার ছিল সমাজের ভিত্তি। আমরা দেখব, অন্যান্য সংস্কৃতিতে একে পবিত্র প্রতিষ্ঠান মনে করা হতো, যেখানে লোকে অন্যদের কাছ থেকে মূল্যবোধ ও শ্রদ্ধার শিক্ষা পেয়েছে। গ্রিসে এটা এক ভয়াল যুদ্ধক্ষেত্র ছিল। বিয়ের দেবী হেরা দেখিয়েছেন, সবচেয়ে মৌলিক সম্পর্কই খুনে, নিষ্ঠুর আবেগের জন্ম দিতে পারে। অপরাধবোধ, ত্রাস আর গভীর উদ্বেগে পরিব্যাপ্ত ছিল তাঁর কাল্ট।
অন্ধকার যুগের শেষে প্রথম যে মন্দিরটি নির্মিত হবে সেটা এশিয়া মাইনরের উপকূল থেকে দূরে সামোস দ্বীপে। এখানে তাঁর কাল্ট দেখিয়েছে, একজন রহস্যময়, অবিশ্বস্ত দেবী ছিলেন তিনি, যিনি মুহূর্তের নোটিসে জীবনের সমস্ত ভালো জিনিসগুলো নিয়ে অদৃশ্য হয়ে যেতে পারেন। প্রতি বছর তাঁর উৎসবের প্রাক্কালে তাঁর প্রতিমা-একটা আকারহীন তক্তা-রহস্যজনকভাবে উপাসনালয় থেকে উধাও হয়ে যায়। ভোরে সেটা জানাজানি হলে সামোসের সব লোক এর খোঁজে বের হয়। কাল্টের প্রতিমার খোঁজ মেলার পর একে পবিত্র করে তারা এবং ফের যাতে পালাতে না পারেন সেজন্যে উইলো লতায় বেঁধে রাখে—কিন্তু সবসময়ই পালিয়ে যান তিনি। হেরা ছিলেন জীবনের মা, সকল অস্তিত্ববানের মূল। তাঁর অদৃশ্য হওয়া গোটা প্রাকৃতিক নিয়মকেই হুমকি দেয়।
সম্ভবত মধ্যপ্রাচ্য থেকে উধাও হয়ে যাওয়া এই মিথ গ্রহণ করেছিল গ্রিকরা এবং এটা তাদের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ আচারকে অনুপ্রাণিত করবে। এইসব আচার তাদের শিখিয়েছে যে, ক্ষতির গভীরতার অভিজ্ঞতা লাভ না করলে আপনার পক্ষে জীবন ও পরমানন্দ লাভ সম্ভব হবে না। শস্য ও উর্বরতার স্বৰ্গীয় পৃষ্ঠপোষক দিমিতার ছিলেন চোখের সামনে থেকে অদৃশ্য হয়ে যাওয়া আরেকজন মাতৃদেবী। যিউসকে পারসেফোন নামে একটি সুন্দরী মেয়ে উপহার দিয়েছিলেন তিনি। যিউস তাঁর ভাই পাতাল জগতের প্রভু হ্যাডসের সঙ্গে পারসেফোনের বিয়ে দেন, যদিও তিনি জানতেন, দিমিতার কখনওই এই বিয়েতে ও মেয়েকে অপহরণে তাঁকে সাহায্য করতে রাজী হবেন না। ক্রোধ ও শোকে দিশাহারা দিমিতার অলিম্পাস ছেড়ে চলে যান, মানবজাতির উপর থেকে তাঁর সমস্ত সুবিধা তুলে নেন এবং এক প্রবীণা নারীর ছদ্মবেশে পৃথিবীর বুকেই বাস করতে থাকেন, মেয়ের খোঁজে চারদিক চষে বেড়ান। বন্ধ্যা মরুভূমিতে পরিণত হয় গোটা পৃথিবী। ভূট্টা ফলছিল না; জনগণ অনাহারে মরতে বসেছিল, তো মরণশীলদের উৎসর্গের উপর নির্ভরশীল অলিম্পিয়ানরা পারসেফোনের প্রত্যাবর্তনের ব্যবস্থা করলেন। পাতাল জগতে কিছু ডালিমের বীজ খেয়ে ফেলায় প্রতি বছর একটা অংশ সেখানে স্বামীর সঙ্গে কাটাতে হতো তাঁকে। তিনি দিমিতারের সঙ্গে মিলিত হওয়ার পর সারা পৃথিবী ফলে ভরে ওঠে, কিন্তু শীতকালে পাতালে অবস্থান করার সময় পৃথিবীকে যেন মনে হতো মৃত। জীবন ও মৃত্যু যেন ওতপ্রোতভাবে জড়িত ছিল। দিমিতার ছিলেন শস্যের দেবী, কিন্তু আবার চথোনিয় দেবীও বটেন, কারণ ভূট্টা ফলত পৃথিবীর গভীর থেকে। এভাবে মৃত্যুর দেবতা হ্যাডস ছিলেন শস্যের অভিভাবক ও প্রদানকারী এবং চির-তরুণী (কোর) পারসেফোনে ছিলেন পাতালের গৃহকত্রী।
প্রতি বছর থেসমোফোরিয়ার প্রাচীন উৎসবের সময় গ্রিকরা এই অস্বস্তিকর নাটকের পুনরাভিনয় করত।” তিন দিন ধরে সম্প্রদায়ের সমস্ত বিবাহিতা নারী তাদের স্বামীদের ছেড়ে দিমিতারের মতো বিদায় নিত। সভ্যতার আবির্ভাবের আগে অতীতের আদিম মানুষ যেমন করেছে ঠিক সেভাবে জমিনে ঘুমাত তারা। আনুষ্ঠানিকভাবে স্বামীদের বকাবাদ্যি করত এবং আচরিক অশ্লীলতার ইঙ্গিতও রয়েছে। হ্যাডস পারসেফোনকে অপহরণ করার সময় পৃথিবী যেসব শুয়োর হজম করেছিলেন সেগুলোর স্মৃতিতে মহিলারা শুয়োরছানা উৎসর্গ করত, সেগুলোর মৃতদেহ গহ্বরে ফেলে যেত পচার জন্যে। সুখসমাপ্তি বলে কিছু ছিল না এখানে: মহিলারা পারসেফোনের প্রত্যাবর্তন নিয়ে উৎসব করত না। গোটা শহর ওলট পালট হয়ে গিয়েছিল: পারিবারিক জীবন, যার উপর সমাজ নির্ভরশীল ছিল, বিঘ্নিত হয়েছিল; আর গ্রিকরা সভ্যতার বিনাশ, লিঙ্গের গভীর বৈরিতা এবং দিমিতার তাঁর আনুকূল্য প্রত্যাহার করে নেওয়ার পর বিশ্বকে হুমকি দেওয়া মহাজাগতিক বিপর্যয়ের সম্ভাবনা নিয়ে ভাবতে বাধ্য হয়েছিল।১ উৎসব শেষে মহিলারা ঘরে ফিরে যেত, ফের স্বাভাবিক হয়ে উঠত জীবনযাত্রা। কিন্তু এই প্ৰথা গ্রিকদের অবর্ণনীয়র মোকবিলায় সক্ষম করে তুলেছিল। দুর্যোগের স্মৃতি অবদমন করে রেখেছিল বলে মনে হলেও অন্ধকার যুগে পরিবারের পতন প্রত্যক্ষ করেছিল তারা। কিন্তু সেই সময়ের কোনও দমিত স্মৃতি তারা যত সাফল্যই অর্জন করুক সেটা নিমেষে উধাও হয়ে যাওয়ার এবং মৃত্যু, অবলুপ্তি আর বৈরিতা চিরন্তন, ওত পেতে থাকা বিপদ হওয়ার ব্যাপারে তাদের সজাগ করে তুলেছিল। এই আচার গ্রিকদের ভীতির ভেতর দিয়ে বাস করতে, এর মোকাবিলা করতে বাধ্য করেছে এবং তাদের দেখিয়ে দিয়েছে যে, নিরাপদে অন্য প্রান্তে আসা সম্ভব।
চারটি অঞ্চলের সবগুলোতে সূচিত অ্যাক্সিয়াল যুগের ধর্মীয় ঐতিহ্যসমূহ ভীতি ও বেদনায় প্রোথিত ছিল। সবগুলোই জোর দিয়ে বলবে যে, এই ভোগান্তি অস্বীকার না করাই আবশ্যক; প্রকৃতপক্ষে একে সম্পূর্ণ স্বীকার করে নেওয়াই আলোকনের অত্যাবশ্যকীয় পূর্বশর্ত ছিল। এমনকি অ্যাক্সিয়াল যুগ শুরু হওয়ার অনেক আগে এই প্রাথমিক কালেও গ্রিকরা এর গুরুত্ব বুঝে গিয়েছিল। নতুন আঙুর সংগ্রহের মৌসুমে অ্যান্থেস্তেরিওনের বসন্তকালীন মাসে অনুষ্ঠিত মদের দেবতা দিওনিসাসের উৎসবে এটা স্পষ্ট ছিল।১২ দিওনিসাস পুবে আঙুর চাষের রহস্য জানতে পেরেছিলেন এবং-কিংবদন্তী বলে-তা অ্যাথেন্সের লোকদের কাছে প্রকাশ করেছেন। সম্ভবত অন্ধকার যুগে সূচিত অ্যান্থেস্তেরিয়ার উৎসবের বিচিত্র আচার-অনুষ্ঠান এই কাহিনীর পুনরাভিনয় করত এবং মানুষকে অন্য মাত্রায় উন্নীত করা মদের স্বর্গীয় পরিবর্তনের ক্ষমতার উদযাপন করত, যাতে অল্প সময়ের জন্যে যেন অলিম্পিয়ান দেবতাদের স্বর্গসুখের অংশীদার হতে পারত তারা।
নতুন মদের স্বাদ চাখা আনন্দ-মুখর উপলক্ষ্য হওয়ারই কথা ছিল, কিন্তু এটা ছিল মৃত্যুর উৎসব। আচারের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট পৌরাণিক বিবরণ ব্যাখ্যা করেছে যে, অ্যাট্টিকার কৃষক ইকরিওসকে প্রথম আঙুর-লতা উপহার দিয়েছিলেন দিওনিসাস এবং তাকে আঙুর ঘরে তোলার কৌশল শিখিয়েছিলেন। কিন্তু তার বন্ধুরা মদের স্বাদ নেওয়ার পর অ্যালকোহল সোজা তাদের মস্তিষ্কে চলে যায়, নেশার ঘোরে জমিনে লুটিয়ে পড়ে তারা। এর আগে আর কখনও অন্ধকার প্রত্যক্ষ করেনি বলে গ্রামবাসীরা ধরে নিয়েছিল, ইকারিওস তাদের হত্যা করেছে। তাকে পিটিয়ে মেরে ফেলে তারা; ইকারিওসের রক্ত মদের সঙ্গে মিশে যায়। এক করুণ সঙ্গীতের শেষ অংশের মতো তার মেয়ে এরিগোন থেঁতলানো শরীর খুঁজে পাওয়ার পর গলায় দড়ি দিয়ে আত্মহত্যা করে। কেবল গ্রিকদের পক্ষেই আনন্দ- মুখর বসন্তকালীন উৎসবকে এমন একটি অনাবশ্যক ভীতিকর অনুষ্ঠানে পরিণত করা সম্ভব ছিল।
শহরের বাইরে জলাভূমিতে দিওনিসাসের মন্দিরে সূর্যাস্তের সময় শুরু হতো উৎসব। অ্যাট্টিকার দাস, নারী এবং শিশুসহ সমস্ত লোকজন একসঙ্গে মিছিল করে উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে যোগ দিতে আসত, এই সময় দেবতাদের উদ্দেশে উপহার হিসাবে মদের ধারা বইয়ে দেওয়া হতো। কিন্তু পরদিন সমস্ত মন্দির বন্ধ করে রাখা হতো এবং বিভিন্ন ঘরের দরজাগুলো পীচ দিয়ে রঙ করা হতো। সবাই বাড়িতেই থাকত এবং পরিবারের প্রত্যেক সদস্যকে অন্তত পক্ষে দুই লিটার করে মদ পান করতে হতো। ভাবগম্ভীর ভয়ঙ্কর মদপান প্রতিযোগিতা ছিল এটা। কোনও আনন্দ-উল্লাস, গান বা কথাবার্তার অবকাশ ছিল না এখানে-অ্যাথেন্সের সাধারণ উৎসবের একেবারে উল্টো রূপ। প্রত্যেক মদপানকারী নিজের টেবিলে একা বসে কবরস্থানের নিস্তব্ধতায় ভিন্ন ভিন্ন জগ থেকে পান করে চলত। কেন? স্থানীয় কিংবদন্তীর দাবি, এরিনিসের কাছ থেকে পালানোর সময় ওরেস্তেস অ্যাথেন্সে পৌঁছেছিলেন। রাজা তাঁর সঙ্গে নিয়ে আসা মিয়াসমার ভয় করেছিলেন, তবু সঙ্গে করে নিয়ে গিয়েছেন তাঁকে, ফিরিয়ে দিতে চাননি। ওরেস্তেসকে নতুন মদ খাওয়ার আমন্ত্রণ জানান তিনি, কিন্তু তাঁকে একা বসিয়ে রেখেছেন, কেউ তাঁর সঙ্গে কথা বলেনি। কিন্তু এই সতর্কতা সত্ত্বেও নগরী দূষিত হয়ে পড়ে; এবং সেই থেকে ওরেস্তেসের অপরাধের রক্ত-পাপের অংশীদার হয়ে আছে। নিজেদের অশূচি সম্পর্কে দারুণ সজাগ অ্যাথেন্সবাসীরা গম্ভীর নীরবতায় পান করছিল। এমনি অলৌকিক নীরবতা সহসা এক ভীতিকর মুখোশ- নৃত্যে ছিন্নভিন্ন হয়ে যায়। চথোনিয় মৃত্যুদূত কেরেসের মুখোশ-পরা সদস্যরা মদের পিপে ভর্তি ওয়্যাগনে চেপে রাস্তায় বেরিয়ে আসে, কর্কশ স্বরে হাসছিল তারা, জোর গলায় মুখখিস্তি করে এবং বুনো হুমকি দিয়ে জোরজবরদস্তি আপ্যায়িত হওয়ার দাবি করেছে। কিন্তু সন্ধ্যায় আবার শৃঙ্খলা ফিরে আসে। শহরের সবাই টলমল পায়ে গান গেয়ে হাসতে হাসতে শূন্য জগ হাতে ফের জলাভূমির ছোট মন্দিরে ফিরে আসে। একজন পুরোহিতিনীকে দিওনিসাসের কাছে স্ত্রী হিসাবে উৎসর্গ করা হয়, দেবতা শান্ত হন, এবং মৃত্যুর দূত মূকাভিনেতাদের হটিয়ে দেওয়া হয়।
তৃতীয় দিন আরেকটি বছর ও নতুন যাত্রার সূচনা করে। তখন অপেক্ষাকৃত হালকা ও অনেক বেশি আনন্দময় পরিবেশ বিরাজ করত। নতুন যুগ উপলক্ষ্যে সবাই সেরিয়াল খাবার খেত-বলা হয়ে থাকে-মিলিং ও বেকিংয়ের আবিষ্কারের আগে আদিম যুগে প্রথম কৃষকরা যা খেয়েছিল। ছোট ছোট মেয়েদের জন্যে দোল খাওয়ার প্রতিযোগিতাসহ প্রতিযোগিতার অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হতো। কিন্তু দোল খাওয়া মেয়েরা বেচারা এরিগোনের গলায় দড়ি দিয়ে মারা যাওয়ার স্মৃতি ফুটিয়ে তুলত বলে সেখানেও ভীতি ওত পেতে থাকত। আপনি কোনওদিন জীবনের অনিবার্য ট্র্যাজিডির কথা বিস্মিত হতে পারবেন না। গ্রিকদের সব আচারই শেষ হয় ক্যাথারসিসের (‘শুদ্ধিকরণ’) ভেতর দিয়ে। দেবতারা খুশি হয়েছেন, মিয়াসমা অদৃশ্য হয়েছে, নতুন জীবন, নতুন আশা জেগেছে। এমনকি এরিগোনের করুণ মৃত্যুর স্মৃতিও জীবনের শুরুতে উত্তেজিত হাসমুিখ বাচ্চাদের দৃশ্যের সঙ্গে মেলানো হয়েছে। অংশগ্রহণকারীরা এক ধরনের একতাসিস, ‘বাইরে পা রাখা’র অনুভূতি লাভ করত। তিন দিন ধরে স্বাভাবিক অস্তিত্ব থেকে দূরে সরে থাকতে পেরেছিল তারা, তাদের ভীতির মোকাবিলা করেছে এবং সেগুলোকে অতিক্রম করে নবায়িত জীবনে উঠে এসেছে।
এখানে কোনও অন্তদর্শন নেই, গ্রিক মননকে তাড়া করে ফেরা অন্তর্নিহিত আঘাতের বিশ্লেষণের কোনও প্রয়াস নেই। কেবল বাহ্যিক আচার-অনুষ্ঠানের ভেতর দিয়ে সামান্য ছুঁয়ে যাওয়া হয়েছে। প্রাচীন মিথ পুনরাভিনয় করে অংশগ্রহণকারীরা ব্যক্তি হিসাবে আচরণ করছিল না। তারা তাদের সাধারণ সত্তাকে এক পাশে রেখে স্বাভাবিকভাবে যা আসে তার উল্টোটি করেছে। গ্রিকরা ভোজসভা এবং আনন্দ ভালোবাসত, কিন্তু গোটা একটা দিন তারা স্বাভাবিক ঝোঁক অস্বীকার করেছে, বিষাদভরা নীরবতায় মদ খেয়েছে। অতীতের নাটক অনুকরণ করে নিজস্ব সত্তাকে পিছে ফেলে নেশা ধরানো মদে উপস্থিত থাকা দিওনিসাস দ্বারা স্পর্শিত ও পরিবর্তিত হওয়ার অনুভূতি লাভ করেছে। এই আচার ছিল বিষাদের ভেতর দিয়ে, মৃত্যু ও দূষণের ভেতর দিয়ে নবায়িত জীবনে পরিবর্তনের এক ধরনের দীক্ষা। মৃত্যুর সময় অনেকে অ্যান্থেস্তেরিয়ার কথা স্মরণ করতে পারে এবং মৃত্যু স্রেফ আরেকটি দীক্ষা মাত্ৰ।
.
পূর্ব ভূমধ্যসাগরিয় অঞ্চল আবার সজীব হয়ে উঠতে শুরু করেছিল। নবম শতাব্দীর শেষদিকে ইসরায়েল রাজ্য এই এলাকার একটি প্রধান শক্তিতে পরিণত হয়েছিল। ৯২৬ সালে কানানে আক্রমণ চালানোর সময় মিশরিয় ফারাও শিশাক কেবল জেরুসালেমে লুটতরাজ চালাননি; ইসরায়েল ও জুদাহর ১৫০ টি শহরেও ধ্বংসলীলা চালিয়েছেন এবং মেগিদো, রেহোব, বেথ-শিন এবং তানাখের প্রাচীন কানানীয় শক্তঘাঁটিগুলোও ধ্বংস করেন। কানানীয় সংস্কৃতি আর কখনওই জেগে উঠতে পারেনি। ইসরায়েল প্রাচীন কানানীয় এলাকায় প্রসারিত হয়েছিল, ধ্বংসপ্রাপ্ত শহরগুলোর অধিবাসীদের আত্মীকরণ করেছিল এবং তাদের দক্ষতাকে কাজে লাগিয়েছে।১৩ রাজা ওমরি (৮৮৫-৮৭৪) সামারিয়ায় বিশাল পাঁচ একর রাজকীয় অ্যাক্রোপলিসসহ অসাধারণ নতুন রাজধানী নির্মাণ করেছিলেন। তাঁর ছেলে আজাব (৮৭৪-৮৫৩) সেখানে একটি অনন্য সাধারণ আইভরি প্রাসাদ নির্মাণ করেন এবং ফোনেশিয়া, সাইপ্রাস ও গ্রিসের সঙ্গে বাণিজ্যিক সম্পর্ক স্থাপন করেন। এক ফোনেশিয় রাজকুমারী জেজেবেলকে বিয়ে করেন তিনি, যার নাম মন্দলোকের প্রতিশব্দে পরিণত হয়েছে।
কিংস-এর প্রথম খণ্ডে আহাবের খুবই নেতিবাচক বিবরণ দেওয়া বাইবেলিয় ইতিহাসবিদ ফোনেশিয় বালের প্রথা ইসরায়েলে আমদানি করায় জেজেবেলের প্রতি ভীত বিহ্বল হয়েছিলেন। কিন্তু সপ্তম শতাব্দীতে সম্পূর্ণ ভিন্ন এক বিশ্বে লিখছিলেন তিনি। নবম শতাব্দীতে আহাবের বিয়েকে রাজনৈতিক অভ্যুত্থান মনে করা হতো। ইসরায়েল রাজ্যের পক্ষে অঞ্চলের সঙ্গে একাত্ম হওয়ার এবং দামাস্কাস ফোনেশিয়া ও মোয়াবের বিরুদ্ধে টিকে থাকার প্রয়োজন ছিল। আহাব নতুন কিছুই করছিলেন না। সলোমোনও বিদেশী রাজাকুমারীদের কূটনৈতিক বিয়ে করেছিলেন, রাজকীয় প্রথায় তাদের দেবতাদের অন্তর্ভুক্ত করেছেন ও জেরুসালেমের বাইরে তাদের জন্যে মন্দির নির্মাণ করেছেন।১৪ কিন্তু একটি ছোট অথচ দারুণ অঙ্গিকারাবদ্ধ ইসরায়েলের জনগণের কেবল ইয়াহওয়েহরই উপাসনা করা উচিত বলে বিশ্বাস করা সম্প্রদায়ের আক্রোশ টেনে আনার মতো দুর্ভাগ্য হয়েছিল আহাবের।
আহাব ধর্মত্যাগী ছিলেন না। নিয়মিত ইয়াহওয়েহর পয়গম্বরদের সঙ্গে পরামর্শ করতেন তিনি, বালের প্রতি তাঁর স্ত্রীর ভক্তিতে খারাপ কিছু দেখেননি। শত শত বছর ধরে ইয়াহওয়েহর কাল্ট বা’লের শ্লোক ও আচারে সমৃদ্ধ হয়ে এসেছে। প্রত্নতাত্ত্বিকরা যেমন আবিষ্কার করেছেন, অধিকাংশ জনগণই ইয়াহওয়েহর পাশাপাশি অন্য দেবদেবীর পূজা করত এবং ষষ্ঠ শতাব্দী পর্যন্ত ইসরায়েলে বা’লের উপাসনা বিস্তার লাভ করেছিল।১৫ নবম শতাব্দীর দিকে ইসরায়েলিদের কেউ কেউ তাদের উপাসিত দেবতার সংখ্যা কমিয়ে আনতে শুরু করেছিল। সিরিয়া ও মেসোপটেমিয়ায় স্বর্গীয় অভিজ্ঞতা একটি একক প্রার্থীতে সীমিত করার পক্ষে খুবই জটিল ও বিহ্ববলকারী ছিল। সযত্নে শ্রেণীকৃত স্ত্রী, স্বর্গীয় সন্তান এবং ভৃত্যদের নিয়ে ঐশী সম্মেলনের কল্পচিত্র ঐশী জগৎ-কে বহুমুখী এবং তারপরেও একটি সামঞ্জস্যপূর্ণ একক হিসাবে দেখিয়েছে।১৬ স্বৰ্গীয় সম্মেলনের প্রতীকীবাদ ইসরায়েল ও জুদাহর জনগণের পক্ষে খুবই গুরুত্বপূর্ণ ছিল, কিন্তু নবম শতাব্দী নাগাদ তা আরও সংহত হয়ে আসতে শুরু করে। এক বিশাল সংসারের অধিকর্তা থাকার বদলে এল ও তাঁর সঙ্গী আশেরাহর মতো ইয়াহওয়েহ অপেক্ষাকৃত নিম্ন পর্যায়ের স্বর্গীয় সত্তাদের সভায় সভাপতিত্ব করছিলেন।১৭ তাঁরা ছিলেন তাঁর ‘স্বর্গীয় বাহিনী’, ঐশী সেনাদলের যোদ্ধা।
জাতীয় ঈশ্বর হিসাবে ইয়াহওয়েহর কোনও সমকক্ষ ছিলেন না, ছিলেন না কোনও প্রতিদ্বন্দ্বী, কোনও মুনিব। ‘পবিত্র জন’ ও ‘ঈশ্বরপুত্র’দের সমবেশে ঘেরাও হয়ে থাকতেন তিনি, যারা জাতির প্রতি তাঁর বিশ্বস্ততার তারিফ করতেন:
হে সদাপ্রভু, স্বর্গ তোমার আশ্চর্য্য ক্রিয়ার,
পবিত্রগণের সমাজে তোমার বিশ্বস্ততারও প্রশংসা করিবে।
কেননা আকাশে সদাপ্রভুর সহিত কে উপমা ধরিতে পারে?
বীর-পুত্রদের* মধ্যে কে সদাপ্রভুর তুল্য?
ঈশ্বর পবিত্রগণের সভাতে প্রবল পরাক্রমশালী,
আপনার চতুর্দিকস্থ সকলের উপরে ভয়াবহ।
হে সদাপ্রভু, বাহিনীগণের ঈশ্বর!
হে যাঃ তোমার ততুল্য বিক্ৰমী কে?
আর তোমার বিশ্বস্ততা তোমার চারিদিকে বিদ্যমান ৮
[* ঈশ্বরের পুত্রদের]
লোকে যখন, ‘অন্য দেবতাদের ভেতর আর কে আছে ইয়াহওয়েহর মতো?’ বলে চিৎকার করার সময় তারা নিশ্চিতভাবেই অন্য দেবতার অস্তিত্ব অস্বীকার করছিল না, বরং তাদের পৃষ্ঠপোষক দেবতাই পড়শীদের জাতীয় দেবতা ‘এলের অন্য পুত্রদের’ চেয়ে ঢের বেশি কার্যকর বলে ঘোষণা দিচ্ছিল। কেউই ইয়াহওয়েহর বিশ্বসত্তার সঙ্গে তাল মেলাতে পারবেন না।১৯ কিন্তু ইয়াহওয়েহ যোদ্ধা দেবতা ছিলেন। কৃষি বা উর্বরতার কোনও অভিজ্ঞতা ছিল না তাঁর এবং বহু ইসরায়েলি স্বভাবতই ভালো ফসল নিশ্চিত করার জন্যে বা’ল ও আনাতের প্রাচীন আচার পালন করত, কারণ বা’লের ছিল ভূমিকে উর্বর করে তোলা শক্তি।
অবশ্য পয়গম্বরদের একটি ছোট গোষ্ঠী কেবল ইয়াহওয়েহর উপাসনা করতে চেয়েছিলেন, তিনিই তাঁর জাতির সকল প্রয়োজন মেটাতে পারবেন বলে বিশ্বাস ছিল তাঁদের। প্রাচীন মধ্যপ্রাচ্যে পয়গম্বরত্ব একটি প্রতিষ্ঠিত আধ্যাত্মিকতা ছিল। কানান থেকে মধ্য ইউফ্রেতিসের মারি পর্যন্ত অতীন্দ্রিয়বাদী পয়গম্বররা তাঁদের দেবতাদের ‘পক্ষে কথা বলতেন’। * ইসরায়েল ও জুদাহয় পয়গম্বররা সাধারণত রাজদরবারের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ছিলেন। তাঁরা প্রায়শঃই রাজাদের সমালোচনা করেছেন এবং ইয়াহওয়েহর প্রথার শুদ্ধতা রক্ষার ব্যাপারে উদ্বিগ্ন ছিলেন বলে বাইবেলিয় সূত্রগুলো ইঙ্গিত দেয়। অবশ্য প্রাথমিককালের ইসরায়েলি পয়গম্বরদের সম্পর্কে খুব সামান্যই জানি আমরা, কারণ আমাদের প্রধান সূত্র সপ্তম শতাব্দীর বাইবেলিয় ইতিহাসবিদ যিনি তাঁর বর্ণিত ঘটনাবলীর অনেকদিন পরে লিখছিলেন। কিন্তু কিংস-এর প্রথম ও দ্বিতীয় খণ্ডে নবম শতাব্দীর পয়গম্বর এলাইযা ও তাঁর শিস্য এলিশার কিংবদন্তী প্রাচীনতর, মৌখিক ঐতিহ্যের চিহ্ন বহন করে। বিষয়বস্তু সম্পূর্ণ ঐতিহাসিক নয়, কিন্তু এই কাহিনী পণ্ডিতরা যাকে ‘কেবল ইয়াহওয়েহ আন্দোলন’ বলে থাকেন তার প্রাথমিক পটভূমি তুলে ধরতে পারে।
[* পয়গম্বর ভবিষ্যদ্বক্তা কোনও ব্যক্তি নন। শব্দটি এসেছে গ্রিক প্রফেতেস থেকে, যিনি দেবতার পক্ষে কথা বলেন।]
এইসব কাহিনী এলাইযা ও আহাবের তিক্ত সংঘাতের কথা তুলে ধরে। এগুলো জেজেবেলকে বা’লের পুরোহিতীনিদের সমর্থনে এক কুটিল নারী হিসাবে তুলে ধরেছে। ইয়াহওয়েহর পয়গম্বরদের উপর নির্যাতন চালাতেন তিনি।
এলাইযার নামের অর্থ ‘ইয়াহওয়েহই আমার ঈশ্বর!’ তিনিই কেবল ইয়াহওয়েহর উপাসনার প্রতি জোর দেওয়া ইতিহাসের প্রথম নথিভুক্ত পয়গম্বর। মধ্যপ্রাচ্যীয় ধর্মতত্ত্বে এল প্রতিটি জাতির জন্যে একজন করে দেবতাকে নিয়োগ দিয়েছিলেন। ইয়াহওয়েহ ছিলেন ইসরায়েলের পবিত্র জন; চেমোশ ছিলেন মোয়াবের পবিত্র জন; আর মিলকোম ছিলেন আম্মোনের পবিত্র জন। কিন্তু কিছু সংখ্যক পয়গম্বর মনে করতে শুরু করেছিলেন যে, রাজা রাজকীয় কাল্টে কোনও বিদেশী দেবতাকে আমদানী করে তাঁকে ইসরায়েলের পবিত্র জনের চেয়ে বেশি মর্যাদা দিলে ইয়াহওয়েহর অসম্মান হতে পারে। বা’লের অস্তিত্বে সন্দেহ প্রকাশ করেননি এলাইযা। কিন্তু তিনি ইসরায়েলের ঈশ্বর না হওয়ায় এলাইযা মনে করেছেন যে ফোনেশিয়াতেই থাকা উচিত ছিল তাঁর।
বালের পৃষ্ঠপোষকতা সত্ত্বেও ইসরায়েল মারাত্মক খরায় আক্রান্ত হলে সুযোগ পেয়ে যান এলাইযা। কার্মেল পাহাড়ে জেজেবেলের ৪৫০ জন যাজককে প্রতিযোগিতায় চ্যালেঞ্জ করেন তিনি।১ প্রথমে আগত দর্শকদের উদ্দেশ্যে লম্বা- চওড়া এক বক্তৃতা দেন। চিরকালের জন্যে ইয়াহওয়েহ এবং বা’লের ভেতর যেকোনও একজনকে বেছে নেওয়ার এটাই সময়। এরপর দুটো ষাঁড় নিয়ে আসতে বলেন তিনি-একটি ইয়াহওয়েহর জন্যে, অপরটি বা’লের জন্যে-দুটো আলাদা আলাদা বেদীতে স্থাপন করতে হবে। তিনি ও বালের পুরোহিতরা যার যার দেবতাদের আহ্বান জানাবেন এবং দেখবেন কে আগুন প্রেরণ করে বলী গ্রহণ করেন। গোটা সকাল বালের যাজকরা তাঁর নাম ধরে চিৎকার করে গেলেন, তলোয়ার ও বর্শায় নিজেদের ছিন্ন ভিন্ন করে চললেন, বেদী ঘিরে লাফিয়ে ঝাপিয়ে নাচ করলেন। কিন্তু কিছুই ঘটল না। কিন্তু যেই ইয়াহওয়েহকে আহ্বান জানালেন এলাইযা, অমনি স্বর্গ থেকে আগুন নেমে এসে ষাঁড় ও বেদী দুটোকেই গ্রাস করে নিল। লোকজন মাটিতে মুখ গুঁজে শুয়ে পড়ল: ইয়াহওয়েহই তাদের ঈশ্বর! বা’লের সকল পয়গম্বরকে কাছের উপত্যকায় হত্যার নির্দেশ দিলেন এলাইযা, তারপর কার্মেল পাহাড়ে উঠে দুই হাঁটুর মাঝখানে মাথা গুঁজে বসে গভীর প্রার্থনায় মগ্ন হয়ে ইয়াহওয়েহর কাছে খরার অবসানের মিনতি করতে লাগলেন। মুষল ধারে বৃষ্টি নেমে এলো; পশমি জোব্বা কোমরে গুঁজে পরমানন্দে আহাবের রথের সঙ্গে সঙ্গে ছুটতে শুরু করলেন এলাইযা। সাফল্যের সঙ্গে বালের ভূমিকা অধিকার করে নিয়েছেন ইয়াহওয়েহ, প্রমাণ করেছেন যে যুদ্ধের মতো ভূমির উর্বরতা রক্ষায়ও সমান পারঙ্গম তিনি।
ইসরায়েলকে একমাত্র ঈশ্বরের উপাসনা করতে হবে বলে প্রস্তাব দিয়ে ঐতিহ্যবাদী ধর্মে এক নতুন টানাপোড়েন যোগ করেছিলেন এলাইযা। বা’লকে উপেক্ষা করার জন্যে লোকের ঐশী শক্তির একটি গুরুত্বপূর্ণ মূল্যবান সম্পদ ত্যাগ করার প্রয়োজন হয়েছিল। হাজার হাজার লোক বা’লের কাল্ট বিশ্ব সম্পর্কে তাদের উপলব্ধি বাড়িয়েছে বলে আবিষ্কার করেছিল, তাদের জমিন উর্বর করেছে, বন্ধ্যাত্ব ও দুর্ভিক্ষের বিরুদ্ধে কঠিন সংগ্রামে অর্থ যুগিয়েছে। আচার পালন করার সময় পৃথিবীকে উৎপাদনশীল করে তোলা পবিত্র শক্তিতে অংশগ্রহণের বোধ জাগত তাদের। এলাইযা ইসরায়েলিদের এসবই বিসর্জন দিয়ে ইয়াহওয়েহর উপর সম্পূর্ণ বিশ্বাস স্থাপন করতে বলছিলেন, উর্বরতার বেলায় যাঁর কোনওই খ্যাতি ছিল না।২২
ঝড়ের পরে হতাশায় ভেঙে পড়ে জীবনাশঙ্কায় আক্রান্ত হন এলাইযা, জেজেবেল তাঁর পয়গম্বরদের হত্যাকাণ্ডের প্রতিশোধ নেবেন বলে ভয় হতে থাকে তাঁর। ইসরায়েল ত্যাগ করে সিনাই পাহাড়ে ইয়াহওয়েহর মন্দিরে আশ্রয় নেন তিনি, উত্তরের রাজ্যের লোকেরা একে বলত হোরের পাহাড়। এখানে এক পাহাড়ী খাঁজে আত্মগোপন করে প্রত্যাদেশের অপেক্ষা করতে থাকেন এলাইযা।২৩ অতীতে, বা’লের মতো স্বর্গীয় যোদ্ধা ইয়াহওয়েহ প্রায়শঃই প্রকৃতির তোলপাড়ে নিজেকে প্রকাশ করেছেন। তাঁর আবির্ভাবে পাহাড় প্রকম্পিত হয়েছে, গাছপালা পাক খেয়েছে, নদীনালা আর্তনাদ করেছে। কিন্তু এবার ব্যাপারটা ছিল সম্পূর্ণ ভিন্ন
আর দেখ, সদাপ্রভু সেই স্থান দিয়া গমন করিলেন; এবং সদাপ্রভুর অগ্রগামী প্রবল বায়ু পৰ্ব্বতমালা বিদীর্ণ করিল, ও শৈবাল সকল ভাঙ্গিয়া ফেলিল; কিন্তু সেই বায়ুতে সদাপ্রভু ছিলেন না। বায়ুর পরে ভূমিকম্প হইল, কিন্তু সেই ভূমিকম্পে সদাপ্রভু ছিলেন না। ভূমিকম্পের পরে অগ্নি হইল, কিন্তু সেই অগ্নিতে সদাপ্রভু ছিলেন না। অগ্নির পরে ঈষৎ শব্দকারী ক্ষুদ্র এক স্বর হইল; তাহা শুনিবামাত্র এলিয় শাল দিয়া মুখ ঢাকিলেন, এবং বাহিরে গিয়া গহ্বরের মুখে দাঁড়াইলেন।২৪
গুপ্ত উপাস্য ছিলেন ইনি, এখন আর প্রকৃতির প্রবল শক্তিতে নয়, বরং ক্ষীণ ফিসফিস শব্দ, ক্ষীণ হাওয়ার প্রায় বোধের অতীত গুঞ্জণে, সশব্দ নৈঃশব্দ্যের বৈপরীত্যে প্রকাশিত।
সবকিছু ছাড়িয়ে যাওয়া একটি মুহূর্ত ছিল এটা। ঐশী সত্তাকে প্রাকৃতিক জগতে বিরাজমান হিসাবে প্রকাশ করার বদলে ইয়াহওয়েহ পরিণত হয়েছিলেন ভিন্নে, অপরে। ইতিহাসবিদরা প্রায়শঃই অ্যাক্সিয়াল যুগের ‘অলৌকিক সাফল্যের কথা বলে থাকেন। এটি স্পষ্টতই এমনি এক ঘটনা ছিল, কিন্তু ইসরায়েলের প্রাচীন ধর্মের মতো গভীরভাবে যন্ত্রণাময় ছিল। গণহত্যার পিছে পিছে এসে বৈরিতার এক নতুন পর্যায়ের পুরোগামী ছিল সেটা। জোব্বায় আবৃত অবস্থায় গুহার বাইরে দাঁড়িয়ে আহাবের উত্তরাধিকারীদের ইয়াহওয়েহর মুখে শাস্তি দেওয়ার কথা শুনলেন এলাইযা। তাঁদের সবাইকে মরতে হবে, কেবল ‘যারা বা’লের সামনে নত হয়নি ২৫ তারাই বেঁচে থাকবে। মানুষ যে দেবতার দিকে অগ্রসর হতে যাচ্ছে তাকে সংজ্ঞায়িত করার দিকে মনোযোগ দেওয়ার সময় তারা যেসব অতিক্রম করতে যাচ্ছে সেই লোভ, ঘৃণা ও অহমবাদের দিকে মনোযোগ দেওয়ার বদলে কঠোরতা আর আগ্রাসী দেশপ্রেমের বিপদে থেকে যায়। মুক্তি ছিল অ্যাক্সিয়াল যুগের অত্যাবশ্যক মূল্যবান দিক, এবং এলাইযার কঠোর কৌশলকে পরবর্তীকালে কোনও কোনও অ্যাক্সিয়াল সাধুরা বলবেন ‘অদক্ষ’। লোকে প্রস্তুত নয় এমন আধ্যাত্মিকতার দিকে ঠেলে দেওয়া উল্টোফলদায়ী ছিল। আবিশ্যিকভাবে অনির্বচনীয় দুয়ে সম্পর্কে গোঁড়ামী কাজে আসার নয়।
বা’লের পয়গম্বরদের সঙ্গে এলাইযার প্রতিযোগিতা ইসরায়েল ও জুদাহর এক নতুন বিরোধকে চিহ্নিত করে। এই সময় থেকে প্রতিদ্বন্দ্বী উপাস্যদের তিক্ত প্রতিযোগিতা পয়গম্বরদের আধ্যাত্মিকতাকে প্রভাবিত করে চলবে। কোনও কোনও ক্ষেত্রে প্রথা আরও বেশি শান্তিপূর্ণ হয়ে ওঠে। বা’লের বড় বেশি স্মারক ছিল বলে স্বর্গীয় যোদ্ধার প্রাচীন চিত্রকল্প জনপ্রিয়তা হারায়। ইয়াহওয়েহকে নাটকীয় ঝড় হিসাবে দেখার বদলে এরপর থেকে পয়গম্বররা স্বর্গীয় সভায় ইয়াহওয়েহর দর্শন লাভ করেছেন।২৬ কিন্তু সেটাও প্রতিযোগিতামূলক ও সংঘাতপূর্ণ হয়ে উঠেছিল। হিব্রু শ্লোক দেখায় ইয়াহওয়েহ প্রাধান্য বিস্তােেরর জন্যে সভার অন্যান্য দেবতার সঙ্গে লড়াই করছেন:
ঈশ্বর ঈশ্বরের মণ্ডলীতে দণ্ডায়মান, তিনি ঈশ্বরদের মধ্যে বিচার করেন।
তোমরা কতকাল অন্যায় বিচার করিবে,
ও দুষ্ট লোকদের মুখাপেক্ষা করিবে?
দীনহীন ও পিতৃহীন লোকদের বিচার কর;
দুঃখী ও অকিঞ্চিনদের প্রতি ন্যায় ব্যবহার কর।
দীনহীন ও দরিদ্রকে নিস্তার কর;
দুষ্ট লোকদের হস্ত হইতে তাহাদিগকে উদ্ধার কর।
উহারা জানে না, বুঝে না,
উহারা অন্ধকারে যাতায়াত করে;
পৃথিবীর সমস্ত ভিত্তিমূল টলায়মান হইতেছে।
আমিই বলিয়াছি, তোমরা ঈশ্বর,
তোমরা সকলে পরাৎপরের সন্তান;
কিন্তু তোমরা মনুষ্যের ন্যায় মরিবে,
একজন অধ্যক্ষের ন্যায় পতিত হইবে।
হে ঈশ্বর, উঠ, পৃথিবীর বিচার কর;
কারণ তুমিই সমস্ত জাতিকে অধিকার করিবে।২৭
স্তোত্রগীত বোঝাতে চেয়েছে যে অতীত কালে ইয়াহওয়েহ অন্য ‘ঈশ্বর পুত্রদের’ ইলোহিম হিসাবে মেনে নিতে রাজি ছিলেন, কিন্তু এখন তারা বাতিল হয়ে গেছেন; তাঁরা মরণশীলদের মতোই হারিয়ে যাবেন। ঐশী সভার নেতৃত্ব পাওয়া ইয়াহওয়েহ তাদের প্রত্যেককে মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত করেছেন।
সামাজিক ন্যায়বিচার নিশ্চিত করার মুখ্য দায়িত্বে অবহেলার জন্যে অন্য দেবতাদের দায়ী করেছেন ইয়াহওয়েহ। এলাইযাও দরিদ্র ও নিপীড়িতদের প্রতি সমবেদনা ও সহানুভূতির প্রতি জোর দিয়েছেন। জেজেবেল জেজরিল উপত্যকার এক ভূস্বামী নাবোথকে স্রেফ আহাবের সম্পত্তির লাগোয়া একটা আঙুর বাগিচা তাঁর হাতে তুলে দিতে অস্বীকার করায় পাথর ছুঁড়ে হত্যা করলে রাজাকে ভয়ঙ্কর পরিণতি দান করেন ইয়াহওয়েহ: ‘যেস্থানে কুকুরেরা নাবোথের রক্ত চাটিয়া খাইয়াছে, সেই স্থানে কুকুরেরা তোমার রক্তও চাটিয়া খাইবে।’২৮ এই ঐশীবাণী শুনে প্রবল বিষাদে ভেঙে পড়েন আহাব; তিনি উপবাস করেন, চটের বস্তা গায়ে দিয়ে ঘুমান, তখন ইয়াহওয়েহ শান্ত হন। সামাজিক বিচারের প্রতি উদ্বেগ কোনও নতুন পরিবর্তন ছিল না, ইসরায়েল বা জুদাহর বিশেষ বৈশিষ্ট্যও নয়। দরিদ্রদের রক্ষার বিষয়টি নিকট প্রাচ্যে দীর্ঘদিন ধরেই সাধারণ নীতি ছিল ২৯ একেবারে তৃতীয় সহস্রাব্দের দিকেই মোসোপটেমিয়ার রাজারা পবিত্র দায়িত্ব হিসাবে দরিদ্র, এতিম এবং বিধবাদের প্রতি ন্যায়-বিচারের প্রতি জোর দিয়েছেন, সাহায্যের জন্যে তাদের আর্তনাদ শুনে সূর্য দেবতা শামাশ এই বিধান জারি করেছিলেন। হাম্মুরাবি বিধির ভূমিকা (১৭২৮-১৬৮৬) সর্বশক্তিমান রাজারা তাঁদের প্রজাদের নিপীড়ন না করলেই কেবল সাধারণ মানুষের মাথার উপর সূর্য হাসবে বলে ঘোষণা দিয়েছে। মিশরের রাজাদের উপরও দুস্থদের যত্ন নেওয়ার নির্দেশ ছিল, কারণ সূর্য দেবতা রা ছিলেন ‘দরিদ্রদের উযির।৩১ উগারিতে দেশে ন্যায়-বিচার আর সাম্য বজায় থাকলেই কেবল দুর্ভিক্ষ ও খরা ঠেকিয়ে রাখা সম্ভব ছিল; দুর্বলদের হেফাযতই মোতের যুদ্ধে বালের অর্জিত স্বৰ্গীয় শৃঙ্খলা টিকিয়ে রাখে।৩২ গোটা মধ্যপ্রাচ্য জুড়ে ন্যায়-বিচার ধর্মের আবিশ্যিক স্তম্ভ ছিল। বাস্তবসম্মত ভালো নীতিও ছিল এটা। আপনার বৈষম্যপূর্ণ সামাজিক নীতিমালা ঘরের ভেতরই শত্রু সৃষ্টি করলে বিদেশী ও স্বর্গীয় শক্তি জয় করে কোনও ফায়দা নেই।
উগ্র বক্তব্যের মতো দয়ার জন্যেও এলাইযা ও এলিশা, উভয়ই স্মরণযোগ্য হয়ে আছেন। বা’লের সঙ্গে এলাইযার যুদ্ধের মতোই এইসব কাহিনীকে প্রাধান্য দেওয়া হয়েছে। মধ্যপ্রাচ্যের অন্যান্য দেবতার মতো ইয়াহওয়েহ অভাবীদের কষ্টে আলোড়িত হয়েছেন এবং বাস্তব সহানুভূতিকে কাল্টিক শুদ্ধতার মতোই সমানভাবে পুরস্কৃত করেছেন। এক খরার সময় সিদনের এক দরিদ্র মহিলা তার শেষ খাবারটুকু এলাইযার সঙ্গে ভাগ করে খেলে খরা যতদিন অব্যাহত থাকবে ততদিন তার খাবারের যোগান বজায় রাখার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন ইয়াহওয়েহ। কিন্তু এইসব গল্প নতুন অ্যাক্সিয়াল যুগ আধ্যাত্মিকার সূচনা তুলে ধরে না; এই অঞ্চলের প্রাচীন ঐতিহ্যে সামাজিক ন্যায়-বিচার আগে থেকেই প্রোথিত ছিল।
ইসরায়েলের পুবে ধীরে ধীরে সম্পূর্ণ ভিন্ন ধরনের একটি সাম্রাজ্য অস্তিত্ব লাভ করছিল। ৮৭৬ সালে অসিরিয় রাজা ভূমধ্যসাগরীয় উপকূলে ফোনেশিয় শহরগুলোকে পরাস্ত করেন এবং তৃতীয় শালমানসের সিংহাসনে বসার পর ৮৫৯ সালে দামাস্কাসের হাদাদেজারের নেতৃত্বে স্থানীয় রাজাদের একটি শক্তিশালী কনফেডারেশন অসিরিয়দের পশ্চিমমুখী অগ্রযাত্রাকে রোখার প্রয়াস পায়। ৮৫৩ সালে অসিরিয়ার বিরুদ্ধে অগ্রসর হওয়ার জন্যে এক স্কোয়াড্রন রথচালক দিয়ে সহায়তা করেন আহাব, কিন্তু ওরোন্তোস নদীর তীরে কারকারের যুদ্ধে পরাজিত হন। অসিরিয়া অবশ্য তখনও পশ্চিমে সীমান্ত প্রসারিত করার মতো শক্তিশালী হয়ে ওঠেনি, এবং দামাস্কাস এলাকার শক্তিমান দেশ রয়ে যায়। সে বছর, আরও পরে, এর শক্তিকে চ্যালেঞ্জ করার প্রয়াস পান আহাব, কিন্তু সাবেক মিত্রের বিরুদ্ধে যুদ্ধে প্রাণ হারান। সেটাই ছিল ওমরি বংশের শেষ; এক প্রাসাদ ষড়যন্ত্রে এলিশা সমর্থিত প্রার্থী জেহু সিংহাসন অধিকার করে নেন এবং অসিরিয়ার সঙ্গে মৈত্রী করেন। ৮৪১ সালে অসিরিয়া দামাস্কাসকে পরাজিত করে এই অঞ্চলের প্রভুতে পরিণত হয়। আনুকূল্য পাওয়া অঙ্গরাজ্য হিসাবে ইসরায়েল শান্তি ও সমৃদ্ধির এক নতুন পর্ব উপভোগ করে।
বুক অভ জোশুয়ার চব্বিশ নম্বর অধ্যায়ে বর্ণনা করা শেচেমের কোভেন্যান্ট অনুষ্ঠান সম্ভবত এই সময়কালের।৩৫ সপ্তম শতাব্দীর ইতিহাসবিদের তাঁর বর্ণনায় অন্তর্ভুক্ত করা একটি প্রাচীনতর টেক্সট এটা এবং সম্ভবত এই উপাসনালয়ে অনুষ্ঠিত প্রাচীন কোভেন্যান্ট উৎসবের উপর ভিত্তি করে রচিত। ইসরায়েলিরা প্রথম কানানে পৌঁছানোর পর, আমাদের বলা হয়েছে, একটি আনুষ্ঠানিক চুক্তির মাধ্যমে ইয়াহওয়েহর সঙ্গে তাদের আবদ্ধ করেন জোশুয়া। ইয়াহওয়েহর জাতি হতে চাইলে তাদের অবশ্যই জর্দানের অন্য পাড়ে যেসব দেবতার উপাসনা করেছে তাদের ত্যাগ করতে হবে এবং কেবল ইয়াহওয়েহর উপাসনা করতে হবে। ইয়াহওয়েহ ও এলাকার অন্য দেবতাদের ভেতর বেছে নিতে হয়েছিল তাদের। এটা একটা কঠিন সিদ্ধান্ত – বলে, তাদের সতর্ক করে দিয়েছিলেন জোশুয়া। ইয়াহওয়েহ ছিলেন ‘সবগৌরবক্ষণে উদ্যোগী ঈশ্বর, তিনি তোমাদের অধর্ম্ম ও পাপ ক্ষমা করিবেন না…তোমরা যদি সদাপ্রভুকে ত্যাগ করিয়া বিজাতীয় দেবগণের সেবা কর, তবে পূর্ব্বে তোমাদের মঙ্গল করিলেও পশ্চাতে তিনি ফিরিয়া দাঁড়াইবেন, তোমাদের অমঙ্গল করিবেন, ও তোমাদের সংহার করিবেন।’ কিন্তু লোকে অনমনীয় ছিল। ইয়াহওয়েহ তাদের ইলোহিম ছিলেন। “তবে এখন আপনাদের মধ্যস্থিত বিজাতীয় দেবগণকে দূর করিয়া দেও, আপন আপন হৃদয় ইস্রায়েলের ঈশ্বর সদাপ্রভুর দিকে রাখ। ৩৬ নবম শতাব্দীর শেষদিকে অন্য দেবতারা তখনও প্রলুব্ধকারী ছিলেন, কিন্তু জর্দানের উল্টো পারেই অবস্থান করতে হয়েছে তাঁদের। এটা একেশ্বরবাদী টেক্সট ছিল না। অন্য দেবতার অস্তিত্ব না থাকলে লোকের এমনি সিদ্ধান্ত নেওয়ার কোনও দরকারই হতো না।৩৭ একেশ্বরবাদীতা (একজন মাত্র ঈশ্বরের উপাসনা) ছিল শাস্ত্রীয় ব্যবস্থা। ‘কেবল ইয়াহওয়েহ’ আন্দোলন ইসরায়েলিদের প্রতি কেবল ইয়াহওয়েহর উদ্দেশে বলী দিয়ে অন্য দেবতাদের কাল্টকে অগ্রাহ্য করার তাগিদ দিয়েছে। কিন্তু এই অবস্থানের জন্যে প্রয়োজন ছিল সাহস, একটি সংকীর্ণতর ঐশী উৎস এবং পরিচিত প্রিয় পবিত্রতা। মধ্যপ্রাচ্যের পৌরাণিক ও কান্টিক ঐকমত্য থেকে বিচ্ছিন্নতার এক নিঃসঙ্গ, বেদনাদায়ক যাত্রা শুরু করতে যাচ্ছিল ইসরায়েল।
.
চীনাদের এমন কোনও বেদনাদায়ক বিচ্ছেদের প্রয়োজন হয়নি, অ্যাক্সিয়াল যুগ যাদের অতীতের সঙ্গে বিচ্ছেদ ঘটাবে না, বরং ঝোউ রাজাদের অনুসৃত বিভিন্ন প্রাচীন আচারের গভীরতর উপলব্ধি থেকে বিকশিত হবে। নবম শতাব্দী চীনের পক্ষে বিরাট দুর্বলতার কাল ছিল। প্রাচীন সামন্তবাদী ব্যবস্থা ভেঙে পড়ছিল এবং চারপাশের বর্বর রাজ্যগুলোর অবিরাম হামলার মুখে ছিল ঝোউ রাজ্য। এই সময়ের ঐতিহাসিক ঘটনাপ্রবাহ সম্পর্কে তেমন বেশি কিছু জানি না আমরা, তবে অন্তত দুটি ক্ষেত্রে রাজাকে রাজধানী ছেড়ে পালাতে বাধ্য করা প্রাসাদ ষড়যন্ত্রের বিক্ষিপ্ত উল্লেখ রয়েছে। রাজা কেন্দ্রীয় সমতলে সামান্য নিয়ন্ত্রণ কায়েম করতে পেরেছিলেন এবং প্রাচীন রাজতন্ত্র কার্যত ঝোউ-এর আদর্শগত আনুগত জমিদারদের একটি কনফেডারেশন দিয়ে প্রতিস্থাপিত হলেও বাস্তবে সেটা স্বাধীনভাবে কাজ করছিল।৩৮ একমাত্র যে বিষয়টি তাদের ঐকবদ্ধ রেখেছিল সেটা হলো তাদের প্রথা। আচার-অনুষ্ঠানগুলো জায়গিরদারদের রাজাই ‘স্বর্গের পুত্র’ তিয়ানজিই হওয়ার কথা মনে করিয়ে দিত। স্বর্গীয় সর্বোচ্চ প্রভু তিয়ান শ্যাং দি থেকে চীনা জাতিকে শাসন করার অধিকার পেয়েছেন তিনি। একমাত্র তিনিই পরম ঈশ্বরের কাছে উৎসর্গ করার অনুমতি রাখেন এবং ওয়েই উপত্যকায় তাঁর রাজধানী ঝোউঝুয়াং ঝোউ নগরীসমূহের গোটা নেটওয়াকর্কের ধর্মীয় কেন্দ্ৰ। লু ছাড়া আর কোনও শহরের চীনের মৃত রাজাদের সম্মানে সম্মানজনক রাজকীয় আচার পালনের অনুমতি ছিল না, যার রাজকুমার ঝোউ-এর ডিউকের প্রত্যক্ষ বংশধর ছিলেন।
মহাপ্রান্তরের অবশিষ্টাংশে প্রতিটি দেয়াল-ঘেরা নগরী (কুয়ো) একজন রাজকুমার শাসন করতেন, রাজার কাছ থেকে জায়গির হিসাবে এর অধিকার লাভ করতেন তিনি। ঝোউ-এর রাজধানীর আদলে নির্মিত ছিল প্রতিটি শহর, শহরের ঠিক কেন্দ্রে আপন পূর্বপুরুষের মন্দিরের পাশেই ছিল রাজকুমারের আবাস। ব্যারনরা (দাই ফু) এবং মহান কর্মকর্তাবৃন্দ (কিং) রাজকুমারের সেবা করতেন, প্রশাসনে গুরুত্বপূর্ণ পদ দখল করে থাকতেন এরা ও বিশাল উৎসর্গের ভোজের সভাপতিত্ব করতেন, রাজকুমারের সামরিক অভিযানে অংশ নিতেন এবং রথ ও যোদ্ধাদের বাহিনীসহ সেনাবাহিনীর যোগান দিতেন। ব্যারন ও কর্মকর্তাদের ঠিক পরেই ছিল সাধারণ ভদ্রজন বা শি, মহান সব পরিবারের নিম্নপর্যায়ের শাখার বংশধর ছিল এরা, রথের ইউনিটে কাজ করত। বছর পরিক্রমায় শহরগুলো বিস্তার লাভ করে উল্লেখযোগ্য ক্ষুদে রাজ্যে পরিণত হচ্ছিল। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণটি ছিল সং, নিজেকে শ্যাং রাজার বংশধর দাবি করে শ্যাং ঐতিহ্য রক্ষা করে চলছিলেন এখানকার রাজকুমার; এবং ঝোউ-এর আচার-অনুষ্ঠানের আবেগময় অনুগত লু। অষ্টম শতাব্দীর শেষদিকে সমতলে এই ধরনের দশ-বারটি ক্ষুদে রাজ্য গড়ে উঠবে।
এইসব শহরেই জীবনযাত্রা ধর্ম প্রভাবিত ছিল।৩৯ ম্যান্ডেটের উত্তরাধিকার পাওয়া এবং ক্ষুদে রাজ্যগুলোর সামন্ত জমিদারদের কাছে প্রবাহিত করা জাদুকরী ক্ষমতা নিয়ে জন্ম নেওয়া স্বর্গের পুত্র রাজার সত্তাকে ঘিরে আবর্তিত হতো প্রথা। এই সময়ের অন্যান্য ধর্মীয় ব্যবস্থার মতোই চীনাদের ধর্মব্যবস্থাও আচারের (লি) ভেতর দিয়ে মানব সমাজের স্বর্গীয় পথের (দাও) সঙ্গে ঐক্যবদ্ধ থাকার বিষয়টি নিশ্চিত করা মহাবিশ্বের শৃঙ্খলা টিকিয়ে রাখার ব্যাপারে ভাবিত ছিল। রাজার পালিত আনুষ্ঠানিক কর্মকাণ্ড প্রকৃতির শক্তিগুলোকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারবে ও এইসব ঋতুর ঠিক সময়ান্তরে একটির পর অপরটির আগমন, সঠিক সময়ে বৃষ্টিপাত এবং মহাজাগতিক বিভিন্ন বস্তুকে নির্ধারিত কক্ষপথে স্থির রাখা নিশ্চিত করবে বলে মনে করা হতো। সুতরাং, পৃথিবীর বুকে পরমেশ্বরের প্রতিভূ ছিলেন বলে রাজা ছিলেন স্বর্গীয় সত্তা। চীনারা কোনওদিনই প্রাকৃতিক বিধানকে অতিক্রম করে যাওয়া ঈশ্বরে আগ্রহ বোধ করবে না। এলাইযার বিশ্ব থেকে সম্পূর্ণ ভিন্ন একজন ঈশ্বরের অভিজ্ঞতা তাদের বিভ্রান্ত করত। স্বর্গ ও মর্ত্য পরস্পর সম্পূরক: স্বর্গীয় ও সমান অংশীদার।
স্বর্গ অর্থাৎ পরমেশ্বরের মানবসুলভ চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য ছিল, তবে কখনওই সুস্পষ্ট ব্যক্তিত্ব বা লিঙ্গিয় রূপ গ্রহণ করেননি। পাহাড় চূড়া থেকে বজ্ৰকে নির্দেশ দেননি তিনি, বরং প্রতিনিধির মাধ্যমে শাসন করেছেন। স্বর্গীয় সন্তান রাজা এবং নিজের রাজ্যে স্বর্গীয় সন্তান রাজকুমারদের ভেতর দিয়ে স্বর্গীয় অনুভূতি লাভ করা হয়েছিল। পৃথিবীর কোনও মানবীয় প্রতিরূপ ছিল না, কিন্তু প্রতিটি শহরের দুটি করে পৃথিবী-বেদী ছিল: একটা প্রাসাদের দক্ষিণে পূর্বপুরুষের মন্দিরের কাছে, অন্যটি দক্ষিণের উপকণ্ঠে, ফসল তোলার বেদীর পাশে। পৃথিবী বেদীর অবস্থান দেখিয়েছে যে, ভূমি কর্ষণ ও ফসল তোলা মানুষকে প্রত্যক্ষভাবে পূর্বপুরুষের সঙ্গে যোগাযোগ করিয়ে দেয়, যারা তাদের আগে জমি চাষ করেছেন ও এভাবে স্বর্গীয় পথ প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। ফসল তোলার আগে এবং পরে পৃথিবী বেদীকে ঘিরে কৃতজ্ঞতার শ্লোক গাওয়া হতো; অতীত ও বর্তমানকে পবিত্র ধারাবাহিকতায় সংযুক্ত করা স্বর্গের পথ (দাও) ছিল ‘মনোহর’:
অঞ্চলের প্রতাপ ইহা…
প্রাচীনের স্বস্তি!
কেবল এইখানেই সকল বস্তু এইরকম নহে!
কেবল বর্তমানেই সকল বস্তু এইরকম নহে!
আমাদের প্রাচীনতম পূর্বপুরুষদের কালেও এই রকম ছিল?৪০
জমিতে হাল চষার সময় লোকে কেবল নিজস্ব ব্যক্তিগত ‘কেবল বর্তমানেই এইরকম’ সাফল্যে আগ্রহী ছিল না। তাদের প্রয়াস আদিআদর্শ মানুষ পূর্বপুরুষদের সঙ্গে এবং এভাবে অবস্থা যেমন হওয়ার কথা তার সঙ্গে তাদের ঐক্যবদ্ধ করেছে।
মানুষের শ্রম ছাড়া স্বর্গ চলতে পারে না।৪১ সুতরাং সাধারণ পার্থিব কর্মকাণ্ডগুলোই মানুষকে স্বর্গীয় প্রক্রিয়ায় অংশগ্রহণে সক্ষম করে তোলা অপ্সুদীক্ষা, পবিত্র কর্মকাণ্ড। বনজঙ্গল সাফ করার সময়, পল্লী এলাকা পবিত্ৰ করার সময় এবং পথ-ঘাট নির্মাণের সময় ঝোউ রাজারা স্বর্গে সূচিত সৃষ্টি প্রক্রিয়ার শেষ করেছেন! ধ্রুপদী ওদেতে কবি ঈশ্বরের কর্মকাণ্ড ও পৃথিবীতে মানুষের কাজকর্ম বর্ণনায় একই শব্দ ব্যবহার করেছেন। রাজা তাই এবং ওয়েন স্বর্গের অংশীদারে পরিণত হয়েছিলেন এবং এখন তাঁদের জীবিত বংশধরদের অবশ্যই পবিত্র দায়িত্ব অব্যাহত রাখতে হবে:
স্বর্গ আকাশ-ছোঁয়া পর্বন সৃষ্টি[যুউও] করিয়াছেন।
রাজা তাই ইহাকে প্রসারিত করিয়াছেন;
তিনি ইহাকে পরিষ্কার [যুউও] করিয়াছেন,
রাজা ওয়েন ইহাকে প্রশান্ত করিয়াছেন,
তিনি ঘুরিয়া [বেড়াইয়াছেন],
আর কি সমতল পথ নির্মাণ করিয়াছেন।
তাঁহাদের পুত্র ও প্রপৌত্রগণ যেন ইহা সংরক্ষণ করেন!
স্বর্গ ও মর্ত্যের ভেতর সাগরসম দূরত্ব প্রত্যক্ষ করার বদলে চীনারা কেবল ধারাবাহিকতা দেখেছে। ৩ সবচেয়ে শক্তিশালী পূর্বপুরুষরা এখন পরম পূর্বসুরি তিয়ান শ্যাং দি’র সঙ্গে রয়েছেন, কিন্তু এককালে এই পৃথিবীতেই ছিলেন তাঁরা। স্বর্গ বাণীর মাধ্যমে পৃথিবীর সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারে এবং পৃথিবীবাসী মনুষ্য সন্তানরা বিন আচারে পূর্বপুরুষ ও দেবতাদের সঙ্গে মিলে খাবার খেতে পারে।
চীনারা পৃথিবী, মহাবিশ্ব কিংবা এমনকি চৈনিক সাম্রাজ্যের কথা বলার সময় এইসব জাগতিক বিষয়গুলো পবিত্রকে অন্তর্ভুক্ত করেছে। এই পৃথিবীর স্বর্গীয় আদিআদর্শ রূপের সঙ্গে সমরূপতা বজায় রাখার ব্যাপারটা নিশ্চিত করে একে সম্পূর্ণ ঐশীতে পরিণত করার চেয়ে ‘মহাশূন্যে’ পবিত্র কিছু আবিষ্কারে তেমন একটা আগ্রহী ছিল না তারা। মহাজাগতিক ও প্রাকৃতিক প্রক্রিয়ায় প্রকাশিত স্বর্গের পথ যেকোনও স্পষ্টভাবে সংজ্ঞায়িত মহাশূন্যের উপাস্যের চেয়ে ঢের বেশি গুরুত্বপূর্ণ ছিল; দৈনন্দিন, বাস্তব পদক্ষেপে সবকিছুকে পৃথিবীর বুকে স্বর্গীয় পথের সঙ্গে মেলাতে পবিত্রতাকে অনুভব করেছে তারা। স্বর্গ ঢের বেশি মহান ছিল, কিন্তু পৃথিবী ছিল শহরের রাজনৈতিক জীবনের কেন্দ্র। পৃথিবীর বুকের সমস্ত সামন্ত সভা অনুষ্ঠিত হতো পৃথিবী বেদীতে। ঝোউ তখনও যুদ্ধবিগ্রহকে বিদ্রোহী ও দুষ্কৃতকারীদের সাজা দেওয়া ও দাও-এর শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনার উপায় হিসাবে দেখে আসছিল। যেকোনও সামরিক অভিযান সবসময়ই মাটির ঢিবি থেকে রওয়ানা হতো এবং ফেরার পর সেনাবাহিনী বিদ্রোহী বন্দীদের সেখানে উৎসর্গ করত। কোনও জায়গিরদারকে জায়গির দেওয়া হলে একজন স্বর্গীয় পুত্রে পরিণত হতেন তিনি, রাজা তখন তাঁকে পৃথিবী বেদী থেকে নেওয়া এক দলা মাটি দিতেন। সূর্য গ্রহণের সময় রাজা ও তাঁর প্রজারা আবার নিয়ম ফিরিয়ে আনার জন্যে যার যার সঠিক অবস্থানে পৃথিবী বেদীর চারপাশে সমবেত হতেন। এভাবে পৃথিবী ছিল স্বর্গের অংশীদার, যার পক্ষে নিচের প্রতিরূপদের সহায়তা ছাড়া দাও প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব ছিল না।
রাজাকে রাজকীয় ক্ষমতা দেওয়া হলে তিনি স্বর্গের প্রধান পুত্রে পরিণত হওয়ার পর এটা পৃথিবীতে ‘স্বর্গের পথ খুলে দিত’। শত্রুদের পরাস্ত করতে, অনুগত প্রজাদের আকর্ষণে এবং কর্তৃত্ব বহালে সক্ষম করে তোলা দাওদে, ‘পথের ক্ষমতা’ নামে এক জাদুকরী কর্মক্ষমতা দেওয়া হতো তাঁকে। রাজা সঠিকভাবে দাওদে ব্যবহার না করলে সেটা বৈরী হয়ে উঠত।৪৪ বলা হয়েছে, একবার এই ক্ষমতা পেলে রাজার উপস্থিতিই ফলপ্রসু হয়ে উঠত; মানুষ ও প্রাকৃতিক ঘটনাপ্রবাহ সঠিক আচরণে বাধ্য করা প্রভাব সৃষ্টি করত তো। একজন রাজার চকিত ভাবনা ত্বরিৎ কর্মকাণ্ডে অনূদিত হতো :
রাজার ভাবনা সীমাহীন-
তিনি অশ্বের কথা চিন্তা করেন আর অমনি তাহারা
শক্তিশালী হইয়া উঠে।
রাজার ভাবনা সম্পূর্ণই সঠিক-
তিনি অশ্বের কথা ভাবেন আর অমনি তাহারা
প্রবল বেগে ছুটিতে শুরু করে।৪৫
রাজার ক্ষমতা শক্তিশালী হলে পৃথিবী ফুলে ভরে ওঠে; তাতে হ্রাস ঘটলে তাঁর প্রজারা অসুস্থ হয়ে পড়ে, অকালে প্রাণ হারায়, ফসল ক্ষতিগ্রস্ত হয় এবং কূপগুলো শুকিয়ে যায়। প্রাকৃতিক বিশ্ব এবং মানব সমাজ পরস্পরের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে সম্পর্কিত ছিল।
রাজার কাজ ছিল প্রাকৃতিক জগৎ ও মানব সমাজের একই ছন্দে থাকার বিষয়টি নিশ্চিত করা। ঐতিহ্যবাহী কাহিনী অনুযায়ী সাধু রাজারা সূর্যের পথ অনুসরণ করে তাঁদের এলাকায় ঘুরে বেরিয়ে বিভিন্ন মৌসুমের নিয়মিত আবর্তন বজায় রেখেছিলেন।৪৬ এভাবে হলুদ সম্রাট হুয়াঙ দি সারা দুনিয়া হেঁটে বেড়িয়ে পর্যায়ক্রমে কম্পাসের চারটি বিন্দু সফর করেছেন। কিন্তু ইয়াও’র শক্তি এতই জোরাল ছিল যে ব্যক্তিগতভাবে ঘুরে বেড়ানোর প্রয়োজন হয়নি তাঁর; তার বদলে তাঁর পক্ষে মৌসুমগুলো জারি করার জন্যে চার মেরুতে প্রতিনিধিদল পাঠিয়েছেন। আরও একধাপ এগিয়ে গিয়েছিলেন শান। তিনি স্রেফ তাঁর রাজধানীর চারটি তোরণে অনুষ্ঠানের আয়োজন করেছেন, সেগুলোর প্রতিটি প্রধান দিকমুখী ছিল ৪৭ ঝোউ রাজাদের অবশ্য তাঁদের প্রাসাদই ত্যাগ করার প্রয়োজন পড়েনি। একটি বিশেষ দরবার তৈরি করে পুব, পশ্চিম, উত্তর বা দক্ষিণ দিকে মুখ করে প্রতিটি কোণে দাঁড়িয়ে ঋতুসমূহের সূচনা ঘটিয়েছিলেন তাঁরা। বছর সঠিক পথে চলতে শুরু করার পর প্রাকৃতিক নিয়ম অনুযায়ী রাজাকে পোশাক, সাজসরঞ্জাম এবং খাবার বদলাতে হতো। শীতকালে কালো পোশাক পরে কালো ঘোড়ায় চড়তেন তিনি, কালো বাহনে চাপতেন, বহন করতেন কালো পতাকা। এই ঋতু চালু করতে দরবারের দক্ষিণ-পশ্চিম কোণে দাঁড়াতে হতো তাঁকে এবং খেতে হতো শীতের খাবার মিলেট আর শুয়োরের মাংস। বসন্ত এগিয়ে আসার সঙ্গে সঙ্গে সবুজ পোশাক পরতেন তিনি, সবুজ পতাকা বহন করতেন, টক খাবার খেতেন এবং ভবনের উত্তর-পুব কোণে দাঁড়াতেন। শরতে তিনি পরতেন শাদা পোশাক, পশ্চিমে দাঁড়াতেন; গ্রীষ্মে তাঁর পরনে থাকত লাল পোশাক, তিনি দাঁড়াতেন দক্ষিণমুখী অবস্থানে।
পরম ক্ষমতা ছিল রাজার, কিন্তু ইচ্ছামতো কিছু করতে পারতেন না। জীবনের প্রতিটি মুহূর্তে মহাজাগতিক আদর্শের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলতে বাধ্য ছিলেন তিনি; তাঁর ব্যক্তিগত পছন্দ-অপছন্দ ছিল একেবারেই গুরুত্বহীন। নিজের মতো বিদেশ বা অভ্যন্তরীণ নীতি তৈরি করা নয়, বরং স্রেফ পথ অনুসরণ করাই ছিল তাঁর কাজ। এই প্রাচীন আদর্শ পরে চৈনিক অ্যাক্সিয়াল যুগের বহু আধ্যাত্মিকতাকে অনুপ্রাণিত করবে। রাজা তাঁর আচরিক দায়িত্ব ঠিকমতো পালন করলে, বলা হয়েছে, তাঁর শক্তি (দাও) সবকিছুকে ‘শান্ত ও অনুগত করে দিত। অন্যের এলাকায় হস্তক্ষেপ না করেই পৃথিবী, জল, গাছপালা, পশু, দেবতা, নারী, পুরুষ এবং কৃষক, সবাই সমৃদ্ধি অর্জন করত। এই স্বর্গীয় স্থিতিশীলতার অবস্থাকে বলা হতো মহাশান্তি (তাই-পিং)। কিন্তু রাজা কোনও কারণে ব্যর্থ হলে এবং তাঁর ক্ষমতা হারিয়ে গেলে দেখা দিত বিশৃঙ্খলা। ভুল সময়ে বৃষ্টিপাত হতো, নষ্ট হতো ফসল, সূর্য আর চাঁদ পথ হারাত এবং দেখা দিত সূর্যগ্রহণ বা ভূমিকম্প। তখন রাজা বুঝতে পারতেন তাঁকে শৃঙ্খলা পুনঃপ্রতিষ্ঠা করতে হবে। এক বিরাট ঢোলে আঘাত করে সমস্ত প্রজাকে সামরিক সতর্কতায় স্থাপন করে বিভিন্ন শহর থেকে রাজকুমারদের ডেকে পাঠাতেন। জায়গিরের অবস্থান অনুযায়ী পোশাক-কালো, সবুজ, লাল বা শাদা-পরে তাঁরা রাজধানীতে পৌঁছানোর পর রাজধানীর কেন্দ্রে চত্বরের সঠিক জায়গায় দাঁড়াতেন। খরা হলে রাজা প্রকাশ্যে নিজের ভুল স্বীকার করে নিতেন, স্বীকার করতেন যে তাঁর বাজে সরকার, মাঝারিমানের কর্মকর্তা আর দরবারের জাঁকজমক এর জন্যে দায়ী, দক্ষিণ উপকণ্ঠের পৃথিবী বেদীতে উৎসর্গ করতেন তিনি। মানব বিশ্বের এই জাদুকরী শৃঙ্খলা পুনঃপ্রতিষ্ঠা মহাবিশ্বে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনত, স্বর্গের পথ নতুন করে প্রতিষ্ঠা করত।
নবম শতাব্দীতে আচার আরও প্রকাশ্য হয়ে ওঠে। আদি ঝোউ আমলে এইসব রাজকীয় আচার-অনুষ্ঠান সম্ভবত একান্ত, পারিবারিক ব্যাপার ছিল, কিন্তু এখন সেসব বিরাট দর্শকদের সামনে আয়োজিত হচ্ছিল। আচরিক বিশেষজ্ঞরা (রু) সভাপতিত্ব করতেন, অনুষ্ঠান সঠিকভাবে অনুষ্ঠিত হওয়ার ব্যাপারটি নিশ্চিত করতেন তাঁরা। নতুন প্রকাশ্য শাস্ত্রীয় আচারের মানে ছিল যে লোকে পথ অনুসরণ ও বাস্তবায়ন করতে পারত। এভাবে রাজধানীর সমস্ত বাসিন্দা প্রতি বসন্তে রাজা রানির একটি নতুন বছর উদ্বোধন প্রত্যক্ষ করতে উপস্থিত হতো। সূর্য ও চাঁদের নকশা করা আলখেল্লা পরে রথে চেপে শহরের দক্ষিণে পৃথিবী বেদীতে এসে স্বর্গের উদ্দেশ্যে একটি পশু বলী দিয়ে নতুন বছরের প্রথম ধর্মীয় কর্ম সম্পাদন করতেন রাজা। স্বর্গের আদলে নিজের জীবন গড়ে তুলতেন তিনি, জনগণ রাজার অনুসৃত পথ অনুসরণ করত, তিনিই যেকোনও মৌসুমি অনুষ্ঠানে প্রথম অংশ নিতে পারতেন। তিনি জীবন্ত আদি আদর্শরূপ ছিলেন; স্বর্গের পুত্রের অনুকরণ করে লোকে তাদের নিজস্ব জীবন পথের সঙ্গে একই ছন্দে নিয়ে আসত। এভাবে রাজাকে শীতের বিশ্রামের পর প্রথম জমি কর্ষণ করতে হতো; কেবল তারপরই কৃষকরা কৃষিকাজ শুরু করতে পারত। বসন্তে তিনি যাতে মাতৃত্বের ঋতুর সূচনা করতে পারেন তাই তাঁর স্ত্রীরা আনুষ্ঠানিকভাবে নিজেদের রাজার কাছে উপস্থাপন করতেন। শরতের শেষে শীতকে স্বাগত জানাতে ও ঠাণ্ডাকে ফিরিয়ে আনতে উত্তরের উপকণ্ঠের উদ্দেশে রওয়ানা হয়ে যেতেন রাজা, সঙ্গে থাকত তাঁর মন্ত্রী ও কর্মকর্তারা। এখানে বিশ্রাম ও অন্ধকারের ঋতু শুরু হওয়ার ঘোষণা দিতেন তিনি, কৃষকদের যার যার গ্রামে ফিরে যাওয়ার নির্দেশ দিতেন। যথারীতি উৎসর্গ করে এবং প্রাসাদের তোরণ বন্ধ করে তিনিই নেতৃত্ব দিতেন। শহরবাসী ও কৃষকরা তখন তাঁর নজীর অনুসরণ করে যার যার ঘরে ফিরে যেত!
প্রাচীন চীনা ক্লাসিক থেকে রাজকীয় আচার সংক্রান্ত আমাদের তথ্যগুলো এসেছে। আমরা জানি না এইসব বিবরণ কতটা ঐতিহাসিক; এগুলো ব্যাপকভাবে ইউটোপিয় হতে পারে, কিন্তু এগুলোয় বর্ণিত আদর্শ চৈনিক কল্পনায় গভীরভাবে প্রোথিত এবং অ্যাক্সিয়াল যুগে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠবে। অন্যান্য শহরে স্বর্গের স্থানীয় পুত্র রাজকুমারা সম্ভবত একই ধরনের অনুষ্ঠানে নেতৃত্ব দিতেন। রাজদরবারের ভৃত্য ছিলেন তাঁরা, রাজার সঙ্গে একই টেবিলে খেতেন; তিনি তাঁদের যে খাবার দিতেন সেটার ভাগ নিয়ে তাঁর দাওদে-এর খানিকটা আত্মস্থ করতেন। রাজধানীতে রাজা মৃত শ্যাং ও ঝোউ বিস্তারিত নাটকীয় আচার- অনুষ্ঠানের মাধ্যমে রাজন্যদের সম্মান দেখাতেন, অন্যদিকে ক্ষুদে রাজ্যগুলোয় রাজকুমাররা শহরের পত্তনকারী পূর্বপুরুষদের বাসভবনের ঠিক পাশের পূর্বপুরুষের মন্দিরে সম্মান দেখাতেন।
শ্যাংদের মতো প্রতি পাঁচ বছর অন্তর একটি বিশেষ ‘আয়োজন’ (বিন) উৎসর্গের ব্যবস্থা করে সেখানে প্রকৃতি-দেবতা ও পূর্বপুরুষদের বিরাট ভোজসভায় আমন্ত্রণ জানাতেন ঝোউরা। উপবাস, মন্দির পরিষ্কার করা এবং কুলঙ্গী থেকে পূর্বপুরুষদের ফলক এনে প্রাসাদের উঠানে স্থাপন করার জন্যে দশদিন ধরে দরবার বিস্তারিত প্রস্তুতি নিত। ভোজের দিন রাজা ও রানিকে আলাদা আলাদাভাবে উঠোনে নিয়ে যাওয়া হতো; তারপর একেকজন পূর্বপুরুষের ভূমিকায় রাজ-পরিবারের তরুণ সদস্যদের একজন পুরোহিত কর্তৃক সম্মানের সঙ্গে স্বাগত জানিয়ে পথ দেখিয়ে নিয়ে এসে নির্ধারিত জায়গায় নিয়ে যাওয়া হতো। তাঁদের সম্মানে পশু বলী দেওয়া হতো এবং মাংস রান্নার সময় পুরোহিতরা রাস্তায় দৌড়ে দৌড়ে চিৎকার করে কোনও পথ হারানো দেবতা ভোজ থেকে বাদ পড়ে গেছেন কিনা জানতে চাইতেন, ‘আপনি কি এখানে আছেন? আপনি কি এখানে?” চমৎকার বাজনা বাজত, রাজকীয় খাবার চলত এবং প্রত্যেকে অত্যন্ত আন্তরিকতার সঙ্গে যার যার ভূমিকায় অভিনয় করে যেত। ভোজসভা শেষে-নিগূঢ়ভাবে তরুণ বংশধরদের মাঝে উপস্থিত পূর্বপুরুষদের সঙ্গে পবিত্র মিলন-শ্লোক আচারের নিখুঁত আয়োজন উদযাপন করত: ‘প্রতিটি রেওয়াজ ও আচার পালিত হয়েছে,’ গাইত অংশগ্রহণকারীরা; ‘প্রতিটি হাসি, প্রতিটি কথা ছিল জুৎসই।৫° মুখের প্রতিটি ভঙ্গি, শরীরের প্রতিটি নড়াচড়া, এবং বিনের সময় উচ্চারিত প্রতিটি শব্দ পূর্ব নির্ধারিত ছিল। অংশগ্রহণকারীরা আচারের আদর্শ জগতের সঙ্গে তাল মেলাতে তাদের ব্যক্তিত্ব পেছনে ফেলে এসেছে। ‘আমরা অনেক কঠোর পরিশ্রম করেছি,’ বলে চলত তারা, ‘যাতে আচারে কোনও ভুল না হয়।’
সবকিছুই ঠিক আর দ্রুত হয়েছে।
সবকিছুই সরাসরি ও নিশ্চিত ছিল ৫১
উৎসব ছিল স্বর্গের নিবিড় কাছাকাছি অবস্থান করা একটি পবিত্র সমাজের দিব্যদর্শন; প্রত্যেকের অনন্য ও অপ্রতিকল্পনীয় ভূমিকা ছিল, এবং প্রতিদিনের সত্তাকে পিছে ফেলে বৃহত্তর ও অধিকতর গুরুত্বপূর্ণ কিছুতে জড়িয়ে যেত তারা। আচার নাটকীয়ভাবে স্বর্গীয় দরবারের একটি অনুকৃতি নির্মাণ করত, এখানে পরমেশ্বর, প্রথম পূর্বপুরুষ (রাজা কর্তক উপস্থাপিত) শ্যাং ও ঝোউ পূর্বপুরুষ ও প্রকৃতি দেবতাদের সঙ্গে বসে থাকতেন। আত্মারা আশীর্বাদ বর্ষণ করতেন, কিন্তু পবিত্র নাটকের আচারে নিজেদেরও সমর্পণ করতেন তাঁরা। শ্যাং পূর্বপুরুষ ও দেবতাদের আনুকূল্য পেতে আচার কাজে লাগাতেন। কিন্তু নবম শতাব্দীর দিকে আচার-অনুষ্ঠানগুলোর আরও বেশি সঠিকভাবে ও সুন্দরভাবে আয়োজন করা গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠছিল। নিখুঁতভাবে আয়োজিত হলে অংশীদারদের স্বর্গীয় ঐক্যের আভাস দেওয়া জাদুকরী একটা কিছু ঘটত।৫২
শেষ শ্যাং রাজার বিরুদ্ধে রাজা ওয়েন ও উ-র অভিযানের পুনরাভিনয় তুলে ধরা একটি ছয় অঙ্কের বিস্তারিত ব্যালের ভেতর দিয়ে শেষ হতো অনুষ্ঠান। সিল্কের পোশাক পরা জেডের কুড়োলে হাতে চৌষট্টি জন নর্তক সেনাবহিনীর প্রতিনিধিত্ব করত, এদিকে স্বয়ং রাজা পূর্বপুরুষ রাজা ওয়েনের ভুমিকায় অভিনয় করতেন। প্রতিটি অঙ্কের একটি বিশেষ সঙ্গীত ও প্রতীকী নাচ ছিল, শ্লোক ক্ষমতার প্রতিষ্ঠা উদযাপন করত:
ক্ষমতা রক্ষা করা সহজ নয়,
আপনার উপস্থিতিতে তা শেষ নাও হতে পারে।
আপনার খ্যাতি দেখান, তাকে উজ্জ্বল করে তুলুন,
ইন স্বর্গ থেকে কি পেয়েছিলেন ভাবুন। মহাস্বর্গের কর্মকাণ্ড
শব্দ বা গন্ধহীন।
রাজা ওয়েনকে আপনার আদর্শে পরিণত করুন।
তাহলে সকল রাষ্ট্র আপনাকে নির্ভর করবে।৫৩
জিয়া রাজবংশের প্রতিষ্ঠাতা ইউ-র প্রতি নিবেদিত শান্তিপূর্ণ নাচের (দা জিয়া) ভেতর দিয়ে শেষ হতো ব্যালে। এটা সুশাসন ও বিশ্বজন শান্তিকে প্রতীকায়িত করত, আর ঝোউ রাজত্বে তা জাদুকরীভাবে শৃঙ্খলা ও শান্তি বয়ে আনবে বলে বিশ্বাস করা হতো।
চীনারা দক্ষতার গুরুত্ব বুঝতে পেরেছিল; এইসব জটিল নাটকের অভিনয়ের ভেতর দিয়ে তারা নিজেরা আরও মানবীয় হয়ে উঠেছে বলে মনে করত। নবম শতাব্দী নাগাদ তারা বুঝতে শুরু করেছিল যে আচারের পবির্তনকারী প্রভাব দেবতাদের লীলার চেয়ে ঢের বেশি গুরত্বপূর্ণ। কোনও একটি ভূমিকায় অভিনয় করে আমরা নিজেরা ছাড়া অন্যজনে পরিণত হই। ভিন্ন ব্যক্তিত্ব ধারণ করে আমরা ক্ষাণিকের জন্যে অন্যদের ভেতর নিজেদের হারিয়ে ফেলি। আচার অংশগ্রহণকারীদের সাধারণ জীবনের বিভ্রান্তিতে ফিরে আসার পরেও তাদের সঙ্গে রয়ে যাওয়া ছন্দ, সৌন্দর্য ও পবিত্রতার এক ধরনের দর্শন দিয়েছে। আচারের সময় নর্তক, অভিনেতা এবং সভাষদদের ভেতর নতুন কিছু সজীব হয়ে উঠত। শাস্ত্রের পুঙ্খানুপুঙ্খ অংশে সমর্পণের ভেতর দিয়ে নিজেদের বৃহত্তর নকশায় তুলে দিয়েছে তারা এবং অন্তত কিছু সময়ের জন্যে-একটি পবিত্র সম্প্রদায় গড়ে তুলেছে, যেখানে অতীত, বর্তমান, স্বর্গ আর মর্ত্য এক হয়ে গেছে।
অবশ্য, চীনারা তাদের যাত্রার সূচনায় ছিল মাত্র। তখনও তারা অনুষ্ঠানের প্রভাব নিয়ে ভাবতে শুরু করেনি। এতদিন পর্যন্ত কি করছে তার বিশ্লেষণ করার মতো আত্মসচেতনতার অভাব ছিল তাদের। কিন্তু পরে, তৃতীয় শতাব্দীতে চৈনিক অ্যাক্সিয়াল যুগের অন্যতম যুক্তিবাদী দার্শনিক যুনযি এইসব প্রাচীন আচার-অনুষ্ঠান নিয়ে ভেবেছেন এবং এগুলোর আধ্যাত্মিক গুরুত্ব বুঝতে পেরেছেন। ‘ভদ্রলোক তার ইচ্ছাকে পথ দেখাতে ঘণ্টা ও ঢোল ব্যবহার করে, হৃদয়কে চাঙা করতে বাঁশি ও জিথার বাজায়,’ ব্যাখ্যা করেছেন তিনি। যুদ্ধ-নাচে সে অস্ত্র নাচায়; শান্তির নাচে পালকের অলঙ্কার দোলায়, প্রতীকীভাবে যুদ্ধংদেহী অবস্থা থেকে ছন্দে পরিবর্তিত হয়। তার অন্তস্থঃ সত্তার উপর এইসব বাহ্যিক ভঙ্গিমার এক ধরনের প্রভাব রয়েছে: ‘সঙ্গীত সম্পাদনের ভেতর দিয়ে ইচ্ছাটুকু খাঁটি হয়ে ওঠে এবং আচারের চর্চার ভেতর দিয়ে আচরণ হয়ে ওঠে নিখুঁত, চোখ-কান আরও তীক্ষ্ণ হয়, মেজাজ ছন্দোময় ও শান্ত হয় এবং রেওয়াজ ও আচরণ সহজেই সংস্কৃত হয়।
সবার উপরে এইসব বিস্তারিত আচার অংশগ্রহণকারীদের নিজেকে ছাড়িয়ে যেতে সাহায্য করেছে। ‘পরিপক্ক ব্যক্তি,’ বলেছেন যুনযি, ‘পথ অনুসরণ করে চলতে গিয়ে আনন্দ লাভ করে; সাধারণ মানুষ আকাঙ্ক্ষা পুরণে আনন্দ পায়।’ অ্যাক্সিয়াল যুগে লোকে বুঝতে পারবে যে স্বার্থপরতার সীমার বাইরে যাওয়া সামান্য আত্মতুষ্টির চেয়ে বৃহত্তর সন্তোষ বয়ে আনে: ‘পথের চাহিদা মোতাবেক যে তার আকাঙ্ক্ষাসমূহকে দমন করে সে বিশৃঙ্খলা থেকে মুক্ত ও আনন্দমুখর থাকবে, কিন্তু আকাঙ্ক্ষার পিছে ছুটে যে পথ বিস্মৃত হয়েছে, সে বিভ্রান্তি ও নিরানন্দে পতিত হবে। ৫৪
চৈনিক অ্যাক্সিয়াল যুগে কোনও কোনও দার্শনিক আচারের দক্ষতাকে প্রত্যাখ্যান করবেন, কিন্তু অন্যরা এইসব শাস্ত্রীয় অনুষ্ঠানের উপর ভিত্তি করে গভীর আধ্যাত্মিকতা গড়ে তুলবেন। আচারে প্রতিষ্ঠা ঝোউ রাজবংশের অন্যতম বিরাট সাফল্য ছিল এবং পরবর্তী প্রজন্মগুলো এটা স্বীকার করেছে। কেবল অ্যাক্সিয়াল যুগে সমাপ্ত টেক্সট রেকর্ড রাইটস মন্তব্য করেছে যে, শ্যাং-রা সবার আগে আত্মাকে স্থান দিয়েছিলেন এবং আচার ছিল দ্বিতীয় স্থানে, কিন্তু ঝোউরা আচারকে আগে স্থান দিয়ে আত্মাকে দ্বিতীয় স্থানে নিয়ে গেছেন।৫৫ শ্যাং-রা দেবতাদের নিয়ন্ত্রণ ও ব্যবহারের লক্ষ্যে আচারকে কাজে লাগাতে চেয়েছেন, কিন্তু ঝোউরা খোদ আচারগুলোই অনেক বেশি পরিবর্তনকারী শক্তি ধারণ করে বলে স্বজ্ঞাপ্রসূতভাবে উপলব্ধি করেছিলেন।
নবম শতাব্দীর শেষদিকে ঝোউ রাজবংশের সঙ্কটাপন্ন অবস্থায় থাকার ব্যাপারট স্পষ্ট ছিল। ৮৪২ সালে রাজা লিহ উৎখাত হলে নির্বাসনে যেতে বাধ্য হন তিনি। রাজাদের বিব্রতকর ব্যর্থতা জনগণকে সংশয়বাদী করে তোলে। স্বর্গের পুত্ররা এমন অযোগ্য ও অদূরদর্শী হলে খোদ পরমেশ্বর সম্পর্কে কি বোঝা যায়? কবিরা প্রহসনমূলক ওদে লিখতে শুরু করেন: ‘মাথার উপর দি এত স্ববিরোধী, যে মর্ত্যের লোকজন ক্লান্ত,’ লিখেছেন একজন। রাজা ও তাঁদের রাজকীয় আচার আর পথকে মূর্ত করে তুলছিল না: ‘আপনি যেসব কথা উচ্চারণ করেন সেগুলো ঠিক না…বেদীতে কোনও সারবত্তা নেই ১৫৬ ৮২৮ সালে রাজা লিহ নির্বাসনে থাকা অবস্থায় মৃত্যু বরণ করলে তাঁর ছেলে ক্ষমতাসীন হন। কিন্তু পথ পুনঃপ্রতিষ্ঠা পায়নি। আচারের অনুপুঙ্খ আয়োজন সত্ত্বেও খরা দেশ পুড়িয়ে দিচ্ছিল আর পূর্বপুরুষরা সাহায্য করার জন্যে কিছুই করছিলেন না:
মহান ক্ষমতার অবসান ঘটল বলে।
সামনে তাকানো বা পেছনে ফেরার মতো কিছু নেই।
ডিউক ও অতীতের শাসকদল
আমাদের সাহায্য করছেন না।
আর বাবা, মা ও পূর্বপুরুষদের বেলায়,
কিভাবে আমাদের সঙ্গে এমন করতে পারলেন তাঁরা?৫৭
আচার-অনুষ্ঠানগুলো তখনও সুন্দরভাবে পালিত হচ্ছিল, অংশগ্রহণকারীদের উপর তখনও সেগুলোর গভীর প্রভাব ছিল, কিন্তু কয়েকজন কঠিন মনের সমালোচক তাদের জাদুকরী ফলপ্রসুতায় বিশ্বাস হারাতে শুরু করেছিল। তবু এই বেড়ে ওঠা সংকটের প্রতি সাড়া আরও আচার ভিত্তিকই হবে-কম নয়।
.
নবম শতাব্দী নাগাদ ভারতের শাস্ত্রার্যরা ভারতে অ্যাক্সিয়াল যুগের সূচনাকারী শাস্ত্রীয় সংস্কারের সূচনা করেন। উৎসর্গের বিভিন্ন আচার-অনুষ্ঠানের পদ্ধতিগত বিশ্লেষণের ধারায় অন্তস্থঃ সত্তাকে আবিষ্কার করেন তাঁরা। এই শাস্ত্রজ্ঞদের সম্পর্কে তেমন কিছু জানি না আমরা। তাঁদের নাম আমাদের জানা নেই, এই নতুন দর্শনে যাত্রার কোনও ব্যক্তিগত বিবরণও রেখে যাননি তাঁরা। আমরা শুধু এটুকু জানি যে, বৈদিক যুগের শেষদিকে প্রাধান্য বিস্তার করা পুরোহিত ব্রাহ্মণ গোত্রের অংশ ছিলেন তাঁরা।৫৮ নবম ও দশম শতাব্দী সময়কালে সংকলিত ব্রাহ্মণা নামে পরিচিত কারিগরি আচরিক টেক্সটে তাঁদের রচনা সংরক্ষিত আছে। এইসব কিছুটা নিরস নিবন্ধ থেকে যা বেরিয়ে এসেছে সেটা হলো সংস্কারকরা উৎসর্গের আচার থেকে সহিংসতা দূর করার আকাঙ্ক্ষায় প্রণোদিত হয়েছিলেন।
আর্যদের জীবন বেশি করে স্থিরতা লাভ করছিল। হামলা থেকে বরং বেশি করে কৃষিজাত পণ্যের উপর নির্ভরশীল হয়ে উঠেছিল অর্থনীতি এবং আমাদের হাতে কোনও দালিলিক প্রমাণ না থাকলেও আক্রমণ ও পাল্টা আক্রমণের বিধ্বংসী চক্রের অবসানের প্রয়োজনীয়তা সম্পর্কে ক্রমবর্ধমান হারে ঐকমত্য গড়ে উঠছিল বলে মনে হয়। প্রথাগত আচার কেবল এই ধরনকে বৈধতাই দেয়নি, বরং একে পবিত্র তাৎপর্যও দিয়েছিল। খোদ আচার-অনুষ্ঠানগুলো সত্যিকারের সংঘাতে পর্যবসিত হয়েছিল এবং একটি আগ্রাসী উৎসর্গ অনিবার্যভাবে অন্য আরেক উৎসর্গের পথে নিয়ে যেত ৫৯ শাস্ত্রজ্ঞরা উৎসর্গের আচার-অনুষ্ঠানের পদ্ধতিগত পর্যালোচনার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন, সহিংসতার কারণ হতে পারে এমন যেকোনও আচার বর্জন করেছেন তাঁরা। ক্ষত্রিয় যোদ্ধাদের কেবল পরিশুদ্ধ আচার মেনে নিতেই রাজি করাননি, বরং তাঁদের সংস্কার আধ্যাত্মিক জাগরণের দিকে চালিত করেছে।৬০
প্রথম দর্শনে মনে হয় যেন শাস্ত্রীয় বিভিন্ন পুঙ্খানুপুঙ্খ বিষয়ে সংশ্লিষ্ট প্রতীয়মান হওয়া ব্রাহ্মণা’র মতো আর কোনও টেক্সটই অ্যাক্সিয়াল যুগের চেতনা থেকে দূরবর্তী হতে পারে না। বিশেষ কোনও নৈবদ্যের জন্যে ব্যবহৃত চামচের ধরন নিয়ে নির্বোধ আলোচনা বা অগ্নিপাত্র বেদীর কাছে নিয়ে যাওয়ার সময় একজন পুরোহিত কতগুলো পদক্ষেপ নেবেন তা কিভাবে একটি ধর্মীয় বিপ্লবের সূচনা করতে পারে? কিন্তু তারপরেও একটি পরিবর্তনশীল বিশ্বে নতুন অর্থ ও মূল্য আবিষ্কারের লক্ষ্যে ব্রাহ্মণাগুলো সাহসী পদক্ষেপ নিচ্ছিল ৬১ অংশগ্রহণকারীদের কারও ক্ষতি বা কাউকে ক্ষতিগ্রস্ত করবে না, এমন একটি শাস্ত্র চাইছিলেন শাস্ত্রজ্ঞরা। ইন্দ্রের ভিত্রা হত্যাকে পুনরুজ্জীবিত করে তোলা উৎসর্গের পশুর মুণ্ডচ্ছেদ প্রাচীন উৎসর্গের আচারের ক্লাইমেক্স ছিল। কিন্তু ইন্দ্ৰ আর তখন আর্যদের ভারতের আবির্ভাবের সময়ের মতো বিরাট কোনও চরিত্র ছিলেন না। ক্রমেই তাঁর গুরুত্ব হ্রাস পাচ্ছিল। এখন সংস্কৃত আচারে যতদূর সম্ভব বেদনাহীনভাবে উৎসর্গের পশুকে উৎসর্গের এলাকার বাইরে একটা ছাপরায় শ্বাস রোধ করে হত্যা করা হচ্ছিল। ‘তুমি প্রাণ হারাওনি, ক্ষতি করতেও আসোনি,’ পশুটিকে আশ্বস্ত করতেন পুরোহিত; ‘সুপথ ধরে দেবতাদের কাছেই ফিরে যাও।৬২ এইসব টেক্সটে পশু হত্যাকে বারবার প্রায়শ্চিত্য করার মতো ‘নিষ্ঠুর’ অশুভ কাজ হিসাবে তুলে ধরা হয়েছে। অনেক সময় উৎসর্গের পশুকে আচার পরিচালনাকারী পুরোহিতকে উপহার দিয়ে ছেড়ে দেওয়া হতো। ইতিমধ্যে, এই বেশ প্রাথমিককালেই, শাস্ত্রজ্ঞরা ভারতীয় অ্যাক্সিয়াল যুগের অনিবার্য গুণে পরিণত হওয়া অহিংসা (‘ক্ষতিকর নয়’)-র নীতির দিকে এগোচ্ছিলেন।৬৩
সংস্কৃত আচার মানুষের প্রতি যেকোনও রকম হিংসার ইঙ্গিতও নিষিদ্ধ করে। আর কোনও প্রতিযোগিতা, রথের প্রতিযোগিতা, যুদ্ধের অভিনয় বা হানা চলবে না। পদ্ধতিগতভাবে এগুলোকে আচার থেকে বর্জন করে সান্ত্বনাদায়ী গীত ও প্রতীকী ভঙ্গিমা দিয়ে প্রতিস্থাপিত করা হয়। যাতে বিরোধের কোনও সম্ভাবনা না থাকে সেটা নিশ্চিত করতে পৃষ্ঠপোষক বা উৎসর্গকারী, যিনি আচারের শুরু করেছেন, তিনিই এরপর থেকে একমাত্র উপস্থিত বৈশ্য বা যোদ্ধা হবেন। কেবল একজন নিঃসঙ্গ উৎসর্গকারী ও তার স্ত্রী বাদে আগের দিনে শোরগোলম উৎসর্গের আঙিনা এখন বিরান। কোনও বৈরী শত্রু উৎসর্গে বিঘ্ন সৃষ্টি করতে পারবে না, কোনও প্রতিদ্বন্দ্বিতাকারী ছিল না, পৃষ্ঠপোষক আর কোনও অতিথিকে নিমন্ত্রণ করতে পারতেন না। পুরোহিত ও তাঁর সহকারীরা তাদের জায়গা দখল করেছিলেন, গোটা অনুষ্ঠানে পৃষ্ঠপোষককে নির্দেশনা দিতেন তাঁরা, নিয়ম মোতাবেক প্রতিটি কাজ ও মন্ত্রের যন্ত্র নিতেন। উৎসর্গের সকল আগুন, হিংস্রতা ও প্রমোদ নির্মূল করা হয়েছিল। এইসব নিরীহ আনুষ্ঠানে একমাত্র যে বিপদটি ঘটতে পারত সেটা হলো প্রক্রিয়ার ভ্রান্তি, উৎসর্গকে ‘শুদ্ধ’ করার জন্যে বিশেষ আচারের মাধ্যমে খুব সহজেই যাকে শুধরে নেওয়া যেত।
প্রাচীন সংঘাতময় অনুশীলন সংস্কৃত আচারের উপর স্পষ্ট চিহ্ন রেখে গেছে বলে শাস্ত্রজ্ঞরা কি বাতিল করেছিলেন আমরা জানি। একেবারে বেমানান পঙক্তিতেও যুদ্ধবিগ্রহের সামঞ্জস্যহীন উল্লেখ রয়েছে। সোম গাছের গুঁড়ো প্রিত্রা হত্যার ইন্দ্রের কাজের পুনরাভিনয় করে বলে ব্রাহ্মণা টেক্সট ব্যাখ্যা করেছে; এগুলো পুরোহিতদের ‘জোরাল কণ্ঠে’ সামনে পেছনে ছুঁড়ে মারা ইন্দ্রের ভয়াল বজ্রপাতের সঙ্গে নান্দনিক পালাগানের তুলনা তুলে ধরে। কোনও রথ প্রতিযোগিতার সময় একটি প্রশান্ত শ্লোক উচ্চারিত হওয়ার পরও সেটাকে ‘দেবার রথ’ বলে উল্লেখ করা হচ্ছে। ব্রাহ্মণাগুলো প্রায়শঃই ‘শত্রু’র কথা উল্লেখ করেছে, যাদের অনুপস্থিতি একটি বিব্রতকর ফারাক রেখে গেছে। চৌহদ্দীর তিনটি অগ্নিকুণ্ডের একটি এখনও ‘প্রতিপক্ষের’ অধিকারে থাকে; ঘটেইনি এমন যুদ্ধের উল্লেখ করে উচ্চারিত মন্ত্র-’ইন্দ্র আর অগ্নি আমার শত্রুদের বিচ্ছিন্ন করে দিয়েছেন!’৬৫ আদিতে যোদ্ধাবাহিনীর পুবদিকে অভিবাসন ও দেশ অধিকারকে পবিত্রতা দেওয়া যুদ্ধের উল্লেখ রয়েছে এমন যেকোনও কিছু কঠোরভাবে অগ্নিকায়ানা থেকে বাদ দেওয়া হয়েছে। প্রথমে উৎসর্গকারীকে কেবল অগ্নিপাত্র তুলে নিয়ে পুবে তিন কদম এগিয়ে গিয়ে আবার বসতে বলা হতো। কিন্তু একে বড় বেশি নির্জীব মনে হওয়ায় পরবর্তী পর্যায়ে অগ্নিপাত্রকে একটা ঠেলাগাড়িতে করে পবিত্র ভূমির অপর প্রান্তে ঠেলে দেওয়া হয়।৬৬
শাস্ত্রজ্ঞরা ঋগ বেদের পরবর্তীকালের স্তোত্রগীতি উল্লেখিত স্ৰষ্টা দেবতা প্রজাপতি সংস্কৃত আচার চালু করেছিলেন বলে দাবি করেছিলেন এবং তাদের আন্দোলনের মূল মিথে পরিণত হওয়া একটি কাহিনী বলেছেন। ৬৭ একদিন প্রজাপতি এবং মৃত্যু দেবতা যথারীতি রথ দৌড়, পাশা খেলা আর সঙ্গীত প্রতিযোগিতায় অংশ নেওয়ার ভেতর দিয়ে একসঙ্গে একটি বলী দান করেন। কিন্তু প্রজাপতির কাছে শোচনীয়ভাবে পরাজিত হন যম দেবতা। প্রথাগত ‘অস্ত্রে’ যুদ্ধ করতে অস্বীকার করেন প্রজাপতি, তার বদলে একটি নতুন আচারের কৌশল কাজে লাগান, তাতে যমকে কেবল পরাজিতই করেননি, তাঁকে গিলে ফেলেন। উৎসর্গের এলাকা থেকে মৃত্যুকে অপসারিত করা হয়েছিল, এবং সংস্কৃত আচারের পৃষ্ঠপোষকের মতো নিজেকে নিঃসঙ্গ আবিষ্কার করেছিলেন প্রজাপতি : ‘এখন আর আচরিক প্রতিযোগিতা নেই!’ বিজয়ের ঢঙে ঘোষণা দিয়েছেন শাস্ত্রজ্ঞ। এখন থেকে নতুন শাস্ত্রাচারে তাঁকে অনুসরণকারী কেউ প্রতিযোগিতায় প্রতিদ্বন্দ্বীকে পরাজিত করে বা যুদ্ধ করে বা হত্যা করে মৃত্যুকে পরাস্ত করবে না। একজন উৎসর্গকারী কেবল মৃত্যুকে আত্মস্থঃ ও নিজের মাঝে গ্রহণ করেই তাকে জয় করতে পারবে, যাতে ‘মৃত্যু তার আপন সত্তায় (আত্মা) পরিণত হয়, চমৎকার চিত্রকল্প ছিল এটা; প্রজাপতিকে দিয়ে মৃত্যুকে গ্রাস করানোর ভেতর দিয়ে শাস্ত্রজ্ঞরা বাহ্যিক জগৎ থেকে অন্তস্থঃ বলয়ের দিয়ে মনোযোগ সরিয়ে নিচ্ছিলেন। মৃত্যুকে নিজের অংশে পরিণত করে প্রজাপতি একে অন্তস্থঃ এবং এভাবে অধিকার করেছিলেন; একে আর ভয় করতে হয়নি তাঁকে। উৎসর্গকারী মানুষকেও অবশ্যই একই কাজ করতে হবে।
প্রাচীন আচারে পৃষ্ঠপোষক মৃত্যুর ভার অন্যের উপর চাপিয়ে দিতেন। উৎসর্গের ভোজের আমন্ত্রণ গ্রহণ করে অতিথিদের বলীর পশুর দায়িত্ব নিতে হতো। নতুন আচারে উৎসর্গকারী নিজেকেই তার পশুর মৃত্যুর জন্যে দায়ী করেছেন। মৃত্যুকে অন্যের উপর প্রক্ষিপ্ত করার বদলে তাকে নিজের সত্তায় ধারণ করেন তিনি এবং এভাবে উৎসর্গের পশুর সঙ্গে একাত্ম হয়ে যান। নতুন আচারে প্রতীকী মৃত্যুবরণের ভেতর দিয়ে নিজেকে দেবতাদের কাছে উৎসর্গ করবেন তিনি এবং-পশুর মতোই—’নিজেই উৎসর্গে পরিণত হয়ে,’ অমরত্বের অভিজ্ঞতা লাভ করবেন; ব্যাখ্যা করেছেন একজন শাস্ত্রজ্ঞ, ‘উৎসর্গকারী নিজেকে মৃত্যু থেকে মুক্ত করে নেন। ৬৯
ব্রাহ্মণাগুলো স্রষ্টা দেবতার চরিত্রকে পরবর্তীকালের বৈদিক শ্লোকের বিশ্ব যাতে অস্তিত্ব লাভ করতে পারে সেজন্যে নিজেকে দেবতাদের কাছে উৎসর্গ করতে দেওয়া আদিআদর্শ মানব পুরুষার সঙ্গে মিলিয়ে দিয়েছেন। প্রজাপতি/পুরুষা এভাবে একাধারে উৎসর্গকারী এবং উৎসর্গ এবং প্রতিবার উৎসর্গের প্রক্রিয়ার ভেতর দিয়ে যাওয়ার সময় পৃষ্ঠপোষক নিজেকে আদি- আচারের সঙ্গে একাত্ম করেন এবং প্রজাপতির সঙ্গে মিলে যান: ‘উৎসর্গ কেবল একটিই,’ ব্যাখ্যা করেছেন শাস্ত্রজ্ঞ, সকল উৎসর্গই সময়ের সূচনায় আদি নৈবদ্যের অনুরূপ, এবং ‘প্রজাপতি স্বয়ং উৎসর্গ। প্রজাপতি এখন অনুসরণের আদর্শে পরিণত হয়েছিলেন, ইন্দ্রের মতো ঘাতকে পরিণত হওয়ারর বদলে পৃষ্ঠপোষক হয়ে গেছেন শিকারে, আচরিক মৃত্যু বরণ করেছেন এবং অন্তত অনুষ্ঠানের মেয়াদে-দেবতাদের সময়হীন জগতে প্রবেশ করেছেন।
কিন্তু ব্রাহ্মণাগুলো জোর দিয়েছে যে, উৎসর্গকারীকে অবশ্যই কি ঘটছে বুঝতে হয়েছে। যন্ত্রের মতো কাজ করে যাওয়ার কোনও অর্থ ছিল না: প্রজাপতিরই উৎসর্গ থাকার বিষয়টি তাকে উপলব্ধি করতে হয়েছে; নতুন আচরিক কাহিনীর সঙ্গে পরিচিত হতে হয়েছে তাকে। যমের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় বন্ধুদের সম্পর্কে জ্ঞান-স্বর্গীয় ও পার্থিব বাস্তবতার মধ্যকার ‘যোগাযোগ ছিল প্রজাপতি’র ‘অস্ত্র’। বৈদিক ধর্মে সবসময় ভৌত বস্তুকে ঐশী সত্তার প্রতিরূপ হিসাবে দেখে এসেছে। কিন্তু সংস্কারকরা প্রাথমিক স্বজ্ঞামূলক এই অন্তর্দৃষ্টিকে একটি কঠোর অনুশীলনে পরিণত করেছিলেন। শাস্ত্রজ্ঞরা উৎসর্গের আচারের প্রতিটি কর্মকাণ্ড, বাস্তবায়ন বা মন্ত্রের সঙ্গে স্বর্গীয় বাস্তবতার মিল ও সম্পর্ক আবিষ্কার করতে শিখছিলেন।৭১ এটা ছিল সম্মিলিত যোগ, বিভিন্ন পর্যায়ের বাস্তবতাকে একসঙ্গে গ্রন্থিত করা।” মিল ও সাদৃশ্যতা এক ধরনের পরিচয় তুলে ধরেছে। এমনি সংযোগকারী নেটওয়ার্কে বিভিন্ন আচার সম্পূর্ণ সচেতনতার সঙ্গে সম্পাদিত হওয়ার সময় সবকিছু নতুন চেহারা ধারণ করেছে বলে মনে হতো: দেবতারা মানুষের সাথে, মানুষ পশু, গাছপালা আর হাঁড়িকুড়ির সাথে, দুর্জ্ঞেয় হতো নিকটের সঙ্গে আর দৃশ্য অদৃশ্যের সঙ্গে সম্পর্কিত হতেন।
উদাহরণ স্বরূপ, সৃষ্টির ক্ষণে তাঁর শবদেহ থেকে সময় উৎসারিত হয়েছিল বলে প্রজাপতি ছিলেন বছরের (ঋতুচক্র) প্রতিরূপ (বন্ধু); নিজেকে উৎসর্গের জন্যে সমর্পণ করতে হওয়ায় বলীর পশু ছিলেন তিনি; তাঁর শবদেহ থেকে আবির্ভূত দেবতারাও ছিলেন প্রজাপতির বন্ধু। তিনি উৎসর্গের আচার পালনের সময় পৃষ্ঠপোষক স্বয়ং আগ্নি একে জ্বালিয়ে রাখা নৈবদ্য, কারণ তিনি আসলে নিজেকেই বলী দিচ্ছেন; সেই একই কারণে তিনিই বলীর পশু। এবং তাঁর মতো প্রজাপতিও উৎসর্গ সূচনাকারী হওয়ায় তাই ছিলেন, আবার বলীর পশুও। আদি উৎসর্গের পুনরাবৃত্তি করায় প্রজাপতির সঙ্গে একাত্ম হয়ে গেছেন তিনি, তুচ্ছ মরণশীলতার জাগতিক বিশ্ব ত্যাগ করেছেন এবং প্রবেশ করেছেন স্বর্গীয় বলয়ে। সুতরাং তিনিই ঘোষণা করতে পারেন: ‘আমি স্বর্গ, দেবতাদের সাক্ষাৎ পেয়েছি; আমি অমরত্ব লাভ করেছি!’ অবশ্য এই আদিআদর্শমূলক ভাবনা সাধারণ প্রাচীন ভাবনা। তবে ভারতীয় আচারকে যা আলাদা করেছে সেটা হলো আসলে আচারের সময় মানসিক প্রয়াসে এইসব সংযোগ সৃষ্টি করা হতো। শাস্ত্রজ্ঞরা অংশগ্রহণকারীদের এই বন্ধুদের ব্যাপারে সজাগ করে তোলার প্রয়াস পেয়েছেন এবং এভাবে আরও বেশি করে আত্মসচেতন হয়ে উঠেছেন। এমনকি ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র উপাদান, যেমন আগুনের লাকড়িকেও আদিম আচারে ব্যবহৃত লাকড়ির সঙ্গে মেলাতে হতো তাদের। পুরোহিত বিশেষ ধরনের মাখন আগুনে ছুঁড়ে দেওয়ার সময় উৎসর্গ করার সময় প্রজাপতি (সোহা) যেমন করেছিলেন ঠিক সেটাই উচ্চারণ করতেন। উৎসর্গকারী ও পুরোহিতের মানসিক অনুশীলনের ভেতর দিয়ে এইসব পার্থিব বস্তু ‘নিখুঁত’ হয়ে উঠত; তুচ্ছ অস্তিত্বের নাজুক নির্দিষ্টতা হারিয়ে স্বর্গীয় বস্তুর সঙ্গে একাত্ম হয়ে যেত তারা।
সকল প্রাচীন জাতির মতো বৈদিক ভারতীয়রা আচার-অনুষ্ঠান প্রাকৃতিক বিশ্বের ক্রমাগত হ্রাস পেয়ে চলা শক্তিকে ঠিক করতে পারে, করাটা আবশ্যক বলে বিশ্বাস করত। সংস্কারকরা প্রজাপতির সৃষ্টি সম্পর্কিত আরেকটি কাহিনী বলেছেন। তাঁরা ব্যাখ্যা করেছেন, সূচনায় প্রজাপতি এই সত্য সম্পর্কে সজাগ হয়ে উঠেছিলেন যে, মহাবিশ্বে তিনি একা; উত্তরপুরুষের আকাঙ্ক্ষা করলেন তিনি, তাই কৃচ্ছ্রতা পালন করলেন-উপবাস পালন, নিঃশ্বাস বন্ধ রাখলেন এবং তাপ উৎপাদন করলেন-এবং ক্রমশঃ তাঁর সত্তা থেকে (পুরুষা) সমস্ত বাস্তবতা উৎসরিত হলো: দেবা, আসুরা, বেদ, মানবজাতি এবং প্রাকৃতিক জগৎ। কিন্তু তেমন দক্ষ জন্মদাতা ছিলেন না প্রজাপতি, তাঁর সৃষ্টি ছিল গোলমেলে। সৃষ্টবস্তুসমূহ তখনও প্রজাপতি থেকে বিচ্ছিন্ন ছিল না। তখনও সেগুলো তাঁরই অংশ ছিল, প্রয়াসের কারণে ক্লান্ত হয়ে তন্দ্রায় আচ্ছন্ন হলে সেগুলো প্রায় মারা যেতে বসেছিল।” তাঁর কাছ থেকে খসে পড়তে শুরু করে তারা, ভেঙে পড়ে, এবং প্রজাপতি তাদের হজম করে ফেলবেন, এই ভয়ে কিছু কিছু আসলে পালিয়ে যায়। জেগে ওঠার পর ভীত হয়ে ওঠেন প্রজাপতি : ‘কিভাবে সৃষ্টবস্তুগুলোক নিজের মাঝে ফিরিয়ে আনব?’ জিজ্ঞাসা করলেন তিনি। একটাই সমাধান ছিল। প্রজাপতিকে আবার একসঙ্গে মেলাতে হবে, তো অগ্নি আবার নির্মাণ করলেন তাঁকে, এক এক করে হারিয়ে যাওয়া বিক্ষিপ্ত সৃষ্টিগুলো আবার পরিচয় ফিরে পেল, আবার টেকসই হয়ে উঠল বিশ্ব। এভাবে সমরূপতার আচরিক বিধান অনুযায়ী উৎসর্গকারী অগ্নিকায়ানার সময় একটি নতুন অগ্নিকুণ্ড তৈরি করার সময় আসলে প্রজাপতিকে আবার গড়ে তোলেন এবং গোটা সৃষ্টিকেই জীবন দেন।৭৭ সংস্কারকরা প্রাচীন আত্মধ্বংসী আচারকে একটি নতুন বিশ্ব ব্যবস্থা নির্মাণকে প্রতীকায়িত করা আচারের সাহায্যে প্রতিস্থাপিত করেছেন। দেবতা ও মানুষকে অবিরাম নবায়নের একটি যৌথ প্রকল্পে একসঙ্গে কাজ করতে হয়েছে।
মানবজাতি নাজুক প্রাণী এবং প্রজাপতির মতো সহজেই ছিন্নভিন্ন হয়ে যেতে পারে, এই বিশ্বাসই আচারিক সংস্কারের মৌল বিষয় ছিল। তারা জন্মগতভাবেই ত্রুটিপূর্ণ, অসমাপ্ত, এবং কেবল আচারের পূর্ণ শক্তির ভেতর দিয়েই নিজেদের গড়ে তুলতে পারে। সোম উৎসর্গে অংশ নেওয়ার সময় পৃষ্ঠপোষক দ্বিতীয় জন্মের অনুভূতি লাভ করেন এবং প্রতীকীভাবে গর্ভধারণের বিভিন্ন পর্যায় নতুন করে তুলে ধরা এক ধরনের দীক্ষা প্রক্রিয়ার ভেতর দিয়ে আচার শুরুর আগে শাদা পোশাক ও কালো কৃষ্ণসার মৃগের চামড়া গায়ে দিয়ে (ঝিল্লি ও নাড়ী প্রতীকায়িত করা) কুঁড়ে ঘরে (জঠরকে প্রতিনিধিত্বকারী) বিশ্রাম নেন তিনি, ভ্রূণের মতো মুঠি পাকানো থাকে তাঁর হাত। দুধ খেতে দেওয়া হতো তাঁকে, কথা বলার সময় তাঁকে শিশুর মতো তোতলাতে হতো।৭৯ অবশেষে ঠিক সৃষ্টিকে অস্তিত্ব দেওয়ার জন্যে প্রজাপতি যেমন করেছিলেন সেভাবে আগুনের পাশে বসে ঘামতে হতো। সোমরস পান করে নেশাগ্রস্ত হয়ে গেলে প্রাচীন আচারের মতো সহিংস মৃত্যু বরণ না করেই দেবতাদের উদ্দেশ্যে উর্ধ্বগমনের অভিজ্ঞতা লাভ করতেন।৮° স্বর্গে বেশি সময় অবস্থান করতে পারতেন না তিনি, কিন্তু মৃত্যুর পর পর্যাপ্ত শাস্ত্রীয় পূণ্য অর্জন করতে পারলে আবার দেবতাদের বিশ্বে পুনর্জন্ম গ্রহণ করতে পারবেন।
সুতরাং আচার-অনুষ্ঠানে উৎসর্গকারী নিজের সত্তাকে (আত্মা) ঠিক প্রজাপতির মতো নতুন করে নির্মাণ করেছেন। উৎসর্গের কর্মশালায় দৈব আত্মাকে (স্বর্গীয় সত্তা) একত্রিত করতে হতো তাকে, তাঁর মৃত্যুর পরেও যা টিকে থাকবে। বন্ধুদের জ্ঞান দৃঢ়ভাবে মনে নিয়ে সঠিকভাবে আচার পালনের ভেতর দিয়ে যোদ্ধা নিজের পুরুষাকে (সত্তা) নতুন করে নির্মাণ করতে পারে। ব্রাহ্মণ পুরোহিতরা ‘বিভিন্ন উৎসর্গের মাধ্যমে সৃষ্ট ব্যক্তি, আচরিক কর্মকাণ্ড পরিচালনা করেন,’ ব্যাখ্যা দিয়েছেন শাস্ত্রজ্ঞ। ১ পরিবর্তনের এই আচার মানুষকেও নির্মাণ করেছে। একজন আর্য বালককে বেদের শিক্ষা ও উৎসর্গের প্রক্রিয়া সম্পর্কে দীক্ষিত করে তোলা উপনয়না পালন করতে হতো, নইলে কখনওই পূৰ্ণাঙ্গ সফল আত্মা গড়ে তুলতে পারবে না। কেবল বিবাহিত ব্যক্তিরাই আচার শুরু করতে পারত এবং আত্ম-নির্মাণের প্রক্রিয়ার সূচনা ঘটাতে পারত, তাই বিয়ে ছিল নারী (যারা কেবল স্বামীদের উপস্থিতিতেই উৎসর্গ অনুষ্ঠানে হাজির থাকতে পারত) ও পুরুষের পক্ষে জীবনের আরেকটি নতুন পর্ব। কারও মৃত্যুর পর মৃতদেহ পরিশ্রান্ত প্রজাপতির অনুরূপ হয়ে উঠত এবং সঠিক অন্তেষ্টিক্রিয়ার মাধ্যমে তাকে নতুন করে নির্মাণ করতে হতো।
কিন্তু এই ব্যবস্থা স্বয়ংক্রিয়ভাবে কাজ করেনি। আচরিক শাস্ত্রে বিজ্ঞ না হলে ব্যক্তি পরকালে নিখোঁজ হয়ে যেতে পারে। সে আর তখন জীবদ্দশায় সৃষ্ট ‘স্বৰ্গীয় সত্তাকে’ শনাক্ত করতে পারবে না, কিংবা তাকে কোন স্বর্গীয় বলয়ে যেতে হবে তাও বুঝতে পারবে না। ‘চিতার আগুনে বিভ্রান্ত হয়ে, ধোঁয়ায় শ্বাসরুদ্ধ অবস্থায় নিজের জগৎকেই সে চিনতে পারে না। কিন্তু যে জানে যে সত্যিই সে এই জগৎ ত্যাগ করেছে, “এটাই আমি” উচ্চারণ করা আত্মাকে জানে এবং নিজের জগৎকে শনাক্ত করতে পারে। এবং এখন আগুন তাকে স্বর্গীয় জগতে বহন করে নিয়ে যায়।৮৩ ব্রাহ্মণা টেক্সটে বারবার ‘যে জানে’ কথাটি জোরের সঙ্গে উচ্চারিত হয়েছে। পুরোহিতরা সব কাজ করতে পারতেন না। ক্ষত্রিয় ও বৈশ্য উৎসর্গকারীদেরও শাস্ত্রীয় কাহিনী সম্পর্কে ওয়াকিবহাল থাকতে হতো, কারণ কেবল জ্ঞানই আচারের শক্তিকে মুক্ত করতে পারে।
সংস্কারদের সৃষ্টি শাস্ত্রাচার নিশ্চয়ই আধ্যাত্মিকভাবে সন্তোষজনক ছিল, নইলে ব্রাহ্মণরা কখনওই যোদ্ধাদের যুদ্ধ-যুদ্ধ খেলা ত্যাগে রাজি করাতে পারতেন না। আমাদের কাছে কেবল ব্রাহ্মণদের শাদামাঠা বক্তব্য রয়েছে বলে আমাদের পক্ষে এইসব আচারের নান্দনিক, পরিবর্তনকারী শক্তি উপলব্ধি করা কঠিন। আচারের আগে উৎসর্গকারী তাকে দৈনন্দিন জীবনের চাপ সৃষ্টিকারী বিভিন্ন উদ্বেগ থেকে বিচ্ছিন্ন করে ফেলা বিশ্রামে চলে যেতেন; উপবাস, ধ্যান, এবং কৃচ্ছ্রতা সাধন, সোমরসের নেশা এবং ভজনের সৌন্দর্য, সব মিলে শাস্ত্রজ্ঞের বিরস বিমূর্ত নির্দেশনায় আবেগ সঞ্জাত অনুরণন যোগাত তাকে। শাস্ত্র জ্ঞান ছাড়া ব্রাহ্মণা পাঠ অনেকটা সঙ্গীত না শুনেই অপেরার লিবার্তো শোনার মতো অভিজ্ঞতা। আচরিক শাস্ত্রের ‘জ্ঞান’ ব্রাহ্মণদের অধিবিদ্যিক আঁচ-অনুমানের মতবাদগত স্বীকৃতি মাত্ৰ ছিল না বরং শিল্পকলা থেকে অর্জিত, প্রথার বাধ্যকারী নাটকীয়তার ভেতর দিয়ে অর্জিত অন্তদৃষ্টির মতো ছিল।
কিন্তু আচরিক সংস্কারের অন্তস্থঃ জগতের আবিষ্কার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব ছিল। উৎসর্গকারীর মানসিক অবস্থার উপর জোর দিয়ে শাস্ত্রজ্ঞরা তার মনোযোগকে অন্তরের দিকে চালিত করেছেন। প্রাচীনকালে ধর্ম সাধারণত বাহ্যিক, বহির্জগতের দিকে পরিচালিত হতো। প্রাচীন আচার-অনুষ্ঠানগুলো দেবতাদের প্রতি মনোযোগ দিয়েছে এবং বস্তুগত পণ্য, গবাদি পশু, সম্পদ ও মর্যাদা লাভ তাদের লক্ষ্য ছিল। আত্মসচেতন অন্তর্দৃষ্টির অবকাশ ছিল খুবই কম বা একেবারে শূন্য। শাস্ত্রাচার সংস্কাররা ছিলেন অগ্রগামী। উৎসর্গকে আদি কেন্দ্ৰ থেকে অন্যদিকে চালিত করেছেন তাঁরা এবং তার বদলে আত্মা, অর্থাৎ সত্তার দিকে নির্ধারিত করেছেন। কিন্তু আত্মা আসলে কি? ব্রাহ্মণাগুলো শাস্ত্র বিজ্ঞানে মগ্ন পুরোহিত সত্তার প্রকৃতি নিয়ে ভাবতে শুরু করেছিল এবং ধীরে ধীরে ‘আত্মা’ কথাটি মানব সত্তাকে অনন্য করে তোলো আবিশ্যিক অন্তস্থঃ ভিত্তিকে বোঝাতে শুরু করে।
আমরা পাশ্চাত্যবাসীরা যাকে আত্মা বলে থাকি এটা ঠিক তা নয়, কারণ এটা সম্পূর্ণ আধ্যাত্মিক ছিল না। এই অনুমানের গোড়ার দিকে কোনও কোনও ব্রাহ্মণ সত্তা বাস্তব বলে বিশ্বাস করত: অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের বিপরীতে দেহের ধড়। অন্যরা আরও গভীরে দৃষ্টি চালাতে শুরু করে। শব্দ এমন প্রবল পবিত্ৰ বাস্তবতা, তবে কি মানুষের আত্মা তার ভাষায় বাস করতে পারে? অন্যরা ভেবেছে শ্বাসপ্রশ্বাস, যেটা ছাড়া বেঁচে থাকাই অসম্ভব হতো, নিশ্চয়ই মানুষের আবিশ্যিক মর্মবস্তু গঠন করেছে, এবং উৎসর্গকারী পবিত্র অগ্নিকুণ্ডের পাশে দাঁড়িয়ে ঘামানোর সময় তার ভেতরে জেগে ওঠা এবং তাকে স্বর্গীয় শক্তিতে পূর্ণ করে তোলা তাপের (তাপস) পক্ষেও জোরাল যুক্তি খাড়া করা যেতে পারে। এই পর্যায় থেকে আরও এক কদম সামনে বেড়ে এই কথা বলাই যুক্তিসঙ্গত যে, আত্মা হলো মানুষের অন্তস্থঃ আগুন। এই সময় দীর্ঘকাল ধরে আগুনকে আর্যদের দ্বিতীয় সত্তা বলে মনে করা হয়ে আসছিল। এখন কোনও কোনও আচারবিদ সূচনায় অগ্নি একাই অমরত্বের অধিকারী ছিলেন বলে দাবি করে বসলেন। কিন্তু ‘ক্রমাগত ভজন গেয়ে ও আচরিক শ্রমের সাহায্যে’ অন্য দেবারা নিজেদের অমর আত্মায় পরিণত করার কৌশল শিখে নিয়েছিলেন। একটি অগ্নি বেদী নির্মাণ করেছেন তাঁরা এবং শাস্ত্রের পাঠশালায় এক নতুন সত্তা গড়ে তুলেছেন। ঠিক একইভাবে অগ্নি কান্টের ধ্যান করে, মন্ত্র উচ্চারণ করে এবং তাপসের শৃঙ্খলাময় অভিজ্ঞতার ভেতর দিয়ে মানুষও দেবতাসুলভ অমরত্ব অর্জন করতে পারে
সবশেষে, পরবর্তীকালে কিছু কিছু আচরিক টেক্সট এক বিপ্লবী মত প্ৰকাশ করেছে। শাস্ত্রাচারে বিশেষজ্ঞ কোনও ব্যক্তির আসলে বাহ্যিক শাস্ত্রাচারে অংশ নেওয়ার কোনও প্রয়োজনই নেই। নিঃসঙ্গ ধ্যান বাহ্যিক আচারের মতোই সমান ফলপ্রসু হতে পারে। শাস্ত্রাচার জানে এমন কেউ আচারে যোগ না দিয়েই স্বর্গে যাওয়ার পথের খোঁজ পেতে পারে।৮৫ উৎসর্গকারী প্রজাপতি হলে তার অবশ্যই প্রজাপতির সৃজনী শক্তি থাকতে হবে। সময়ের সূচনায় কোনও কিছু বা কেউ সৃষ্টি হওয়ার আগে, প্রজাপতি তাঁর নিজের অবয়ব সৃষ্টি করেছিলেন, দেবতারা, মানবজাতি ও বস্তুগত বিশ্ব স্রেফ তাঁর মানসিক তৎপরতা থেকেই সৃষ্টি করেছেন। নিশ্চিতভাবেই নিঃসঙ্গ অতীন্দ্রিয়বাদী অন্ততপক্ষে নিজের স্বর্গীয় আত্মাকে সৃষ্টি করতে পারবে না?
শাস্ত্রজ্ঞরা যুক্তি তুলে ধরেছেন যে, একবার উৎসর্গকারীর অভ্যন্তরে অন্তস্থঃ অগ্নি-আত্মা-সৃষ্টি হয়ে গেলে, সেটা তার স্থায়ী ও অবিচ্ছেদ্য অধিকারে এসে যায়। একে স্পষ্ট করে তুলতে এক নতুন আচার সৃষ্টি করেছিলেন তাঁরা। স্ফুলিঙ্গে ফুঁ দিয়ে আচারের সময় নতুন করে আগুন জ্বালানোর সময় পুরোহিত বা পৃষ্ঠপোষককে নিঃশ্বাসের সঙ্গে পবিত্র আগুনকে আপন সত্তায় গ্রহণ করতে হবে।৬ দেবারা চিরন্তন আত্মা ও অমরত্ব লাভের সময় ঠিক একাজটিই করেছিলেন। সুতরাং এই মুহূর্ত থেকেই উৎসর্গকারী দেবতাদের সমকক্ষ হয়ে যান এবং তার আর তাদের উপাসনা করার প্রয়োজন থাকে না। এভাবে যে জানে, সে আর দেবাগ্নি (‘দেবাদের উদ্দেশ্যে উৎসর্গকারী’) থাকে না, বরং আত্মাগ্নিতে, ‘আত্মউৎসর্গকারী’ পরিণত হন।৮৭ তাকে আর শাস্ত্রের বাহ্যিক অনুষ্ঠানে অংশ নিয়ে ক্রমাগত নিজের আত্মার সেবা করতে হবে না, কারণ তার অন্তস্থঃ অগ্নির আর জ্বালানীর প্রয়োজন নেই। চিরকালের জন্যে আত্মাকে অর্জন করেছে সে। এখন আত্মোৎসর্গকারীর-দেবা ও যোদ্ধা-প্রয়োজন শুধু সবসময় সত্যি উচ্চারণ করা, উভয়েরই বিশেষ গুণ। সত্যি ও বাস্তবতা অনুযায়ী আচরণ ও কথা বলে ব্রাহ্মণের শক্তি ও ক্ষমতার প্রতিমূর্তিতে পরিণত হবে সে।৮৮ ভারতের অ্যাক্সিয়াল যুগের সূচনা হয়েছিল। আমাদের আধুনিক বিশ্বে আচার-অনুষ্ঠানকে প্রায়শঃই দাসত্বমূলক সমরূপতাকে উৎসাহদানকারী বলে মনে করা হয়, কিন্তু ব্রাহ্মণ শাস্ত্রাচারবিদরা তাঁদের বিজ্ঞানকে বাহ্যিক আচার ও দেবতাদের থেকে মুক্ত করার কাজে লাগিয়েছেন এবং স্বাধীনতার একটি সম্পূর্ণ নতুন ধারণা, স্বায়ত্তশাসিত সত্তা সৃষ্টি করেছেন। আচারের অন্তস্থঃ গতিময়তা নিয়ে ধ্যান করে পুরোহিত শ্রেণীর আচার বিশেষজ্ঞরা অন্তরে দৃষ্টি চালাতে শিখেছেন। এবার আর্য যোদ্ধারা ভারতীয় বনে-জঙ্গলে যেভাবে আগ্রসর হয়েছিল তাদের মতোই কঠোর পরিশ্রম করে অন্তস্থঃ জগতে অনুসন্ধান চালাতে শুরু করবেন তাঁরা। জ্ঞান সংরক্ষণের উপর গুরুত্ব আরোপও ভারতীয় অ্যাক্সিয়াল যুগে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠবে। শাস্ত্রজ্ঞরা দাবি করছিলেন যে, প্রত্যেককেই আচার নিয়ে ধ্যান করে তারা কি করছে তার তাৎপর্য সম্পর্কে সজাগ হয়ে উঠতে হবে: এক নতুন আত্মসচেতনতা গড়ে উঠছিল। এখন থেকে ভারতের আধ্যাত্মিক অনুসন্ধান বাহ্যিক দেবতাদের দিকে নয় বরং চিরন্তান সত্তার দিকে নজর দেবে। বেশ কঠিন অনুসন্ধানে পরিণত হবে এটা, কিন্তু ব্রাহ্মণার শাস্ত্রাচার আর্যদের অমর সত্তা নির্মাণ করা সম্ভব বলে শিক্ষা দিয়েছিল। উৎসর্গের অনুষ্ঠান থেকে সহিংসতাকে বাতিল করার ভেতর দিয়ে সূচিত সংস্কার ব্রাহ্মণ ও তাদের সাধারণ পৃষ্ঠপোষকদের সম্পূর্ণ অপ্রত্যাশিত দিকে চালিত করেছিল। তখনও ভারতে একটি শক্তিশালী নৈতিক অঙ্গীকারের অভাব ছিল, যা এই গর্বিত স্বয়ং- সম্পূর্ণতাকে এক দানবীয় অহমবাদে পরিণত হওয়া থেকে রক্ষা করবে।