২. আগুনের মতো ভাষণ হলো শেখ সাহেবের

৭ তারিখে আগুনের মতো ভাষণ হলো শেখ সাহেবের। তার সেই বিখ্যাত চার দফা পূর্বশর্তের অপূর্ব ভাষণ :

‘…আমি যদি তোমাদের কাছে না
থাকি তোমাদের উপর আমার আদেশ
রইল, ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে তোল, তোমাদের
যা কিছু আছে তাই নিয়ে প্রস্তুত হও, রক্ত
যখন দিতে শিখেছি আরো দেব। বাংলাকে
মুক্ত করে ছাড়ব ইনশাল্লাহু…’

কাউকে ভয় দেখাতে হলো না, জোর করতে হলো না বন্ধ হয়ে গেল স্কুল-কলেজ কোর্ট-কাছারি। সরকাপ্পি বেসরকারি সমস্ত অফিসেই। তালা ঝুলল। শুধুমাত্র শেখ সাহেবের অহিংস অসহযোগ আন্দোলনের ডাকে। সবাই বুঝতে পারছে ঝড় আসছে। বহুদিনের সঞ্চিত সমুদ্রের বিশাল জলরাশি ফুলে উঠছে। বাঁধ দিয়ে এ ঠেকানো যাবে না।

এদিকে সময় আর কাটে না। সময় কাটানোর জন্যেই একটা উপন্যাস লিখতে শুরু করলাম। অসফল প্রেমের ওপর ভিত্তি করে নিতান্তই সহজ-সরল উপন্যাস। মহৎ আদর্শ কিছু নেই, সমাজনীতি রাষ্ট্রনীতির কোনো সমস্যাও নেই। লিখতে লিখতে দেখলাম পরিচিত সব চরিত্র কলমে উঠে আসছে। উপন্যাসে বাবার চরিত্র হয়ে উঠল আমার আব্বার চরিত্রেরই অনুলিপি। নায়কতো নিজেই, নায়িকারাও খুব একটা কল্পনার নয় সময় কাটতে লাগল হু হু করে। ছোটোবোনের নামে দু-একটা কবিতাও লিখে পাঠালাম দৈনিক পাকিস্তানে। ছাপাও হলো। অসমাপ্ত পরীক্ষা, দেশের পরিস্থিতি সমস্তই আমার মন থেকে মুছে গেল। ঘাড় গোজ করে অনবরত লিখে চলেছি। এক-একটা পরিচ্ছেদ শেষ হয়, সবাইকে পড়ে শুনাই। চলবে, মন্দ নয় এই জাতীয় মন্তব্যে উৎসাহেও ভাটা পড়ে না।

আব্বাও কিছুটা বিশ্রাম পেলেন। মফস্বলে মফস্বলে ঘোরাটা বন্ধ হলো। কাজের মধ্যে সকালে ঘুম থেকে উঠে খবর শোনা, অফিসের কাগজপত্র দেখতে দেখতে চা খাওয়া, মাঝে মাঝে Court-এ যাওয়া, দুপুরের দিকে অল্পকিছু খেয়ে একটু ঘুম। বিকেলে বারান্দায় চেয়ার পাতা হতো। প্রাত্যহিক বৈকালিক আসরের নিয়মিত সদস্য ছিলেন ডাক্তার সাহেব, কোর্ট ইন্সপেকটর সাহেব, SDPRO সাহেব। ঘনঘন চা পাঠানো হতো। আব্বা মেজাজি মানুষ, মেজাজে থাকলে ভালো গল্প। করতে পারতেন, গল্প করতে ভালোও বাসতেন। তাঁর আসল উৎসাহ ছিল occultstudy-তে কাজেই সবরকম রাজনৈতিক আলোচনা শেষ হতো ভূত, প্রেত, জ্বিন, পামিস্ট্রি আর এসট্রোনমিতে এসে। এই আসরে রাজনৈতিক নেতারাও আসতেন। ন্যাপ মনোনীত প্রাদেশিক পরিষদের প্রার্থী আলী হায়দার খান (পরবর্তীকালে বোন সুফিয়া হায়দারের স্বামী) তাদের মধ্যে অন্যতম। সে আব্বার বিশেষ প্রিয়পাত্র ছিল। অনেক ব্যাপারেই আব্বা তার ওপর নির্ভর করতেন। আব্বার রাতটা কাটত SDO সাহেবের (নাম মহিবুল্লাহ শাহ। বাড়ি সম্ভবত বেলুচিস্তান) বাসায়। ভদ্রলোকের বাড়ি সিন্ধু। আব্বার সঙ্গে তার কোনোই মিল ছিল না। না চরিত্রে, না বয়সে বা স্বভাবে কিন্তু মিল ছিল আত্মিক। ‘সিন্ধ থেকে চিঠি লিখেছে ছোটো ভাই আপনি যদি আসতেন তবে পড়ে শুনাতাম।’ ‘বহুদিন চিঠি পত্র পাই না, মন বড় খারাপ, আপনি যদি আসেন তবে মনটা একটু হালকা হয়।’ ‘সুন্দরবন দেখতে যাব আমরা কয়েকজন পশ্চিম পাকিস্তানি বন্ধুও এসেছেন, আপনি যদি সঙ্গে আসেন।’ এই জাতীয় Telephone আসত প্রায়ই।

বেচারা একা একা থাকে; রবীন্দ্র সংগীতের এক পাঁজা রেকর্ড দিয়ে আসলেন আব্বা। রবীন্দ্রসংগীতের অর্থ বুঝতে পারছেন না নিজেই গানগুলোর ভাবো অনুবাদ করে দিলেন। পিরোজপুরে ভালো দুধ পাওয়া যাচ্ছে না, বাসা থেকে একসের একসের দুধ পাঠাতে লাগলেন।

আগেই বলেছি আমাদের সময় খুব ভালো কাটছিল। অবশ্য এর অর্থ এই নয় যে, খুব হইচই করে দিন কাটছিল! স্বাভাবিক যেমন কাটে তেমনি। সন্ধ্যার পর বেড়াতে যেতাম সবাই মিলে। বাসার ডানপাশ দিয়ে যে-রাস্তাটা হুলারহাট পর্যন্ত গিয়েছে সেই রাস্তা ধরে হাঁটতাম। টি.বি. হসপিটাল, টাউন কমিটি পেরিয়েও অনেক দূর যাওয়া হতো দুপাশেই বিস্তীর্ণ মাঠ, দূরে রেখার মতো অস্পষ্ট গ্রাম, অসংখ্য নারিকেলের শাখা বাতাস লেগে কাঁপছে, অপূর্ব লাগত। এক রাতের কথা খুব মনে পড়ে। আটটার দিকে বেড়াতে বেরিয়েছি, হিন্দুপাড়ার ভিতর দিয়ে রাস্তাটা গিয়েছে। চাঁদ উঠেছে; খুব নরম জোছনা। হাঁটছি। হঠাৎ শুনতে পেলাম হিন্দুপাড়ায় গান হচ্ছে। উঠোনে পাটি বিছিয়ে বসেছে সবাই–

‘সেদিন দুজনে দুলেছিনু বনে
ফুল ডোরে বাঁধা ঝুলনা।’

চমৎকার লাগছিল। আম্মা তাড়া দিচ্ছিলেন—‘কি দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে গান শোনা। কিন্তু শেফুর খুব ভালো লাগছিল তার জোরাজুরিতেই সম্পূর্ণ গানটি শুনলাম। এরপর যত রাতে ঐ বাড়ির পাশ দিয়ে গিয়েছি ততবার মনে মনে গান শুনব প্রতীক্ষা করেছি। আর শোনা যায়নি।

যখন বেড়ানো শেষ করে ফিরে আসতাম দূর থেকেই আমাদের বাসাটা নজরে পড়ত। পুরানো আমলের নকশাকাটা হলুদ দালান ভেতরে টিউব লাইটের নীল আলো জ্বলছে। সামনের পুকুরে একটা নীলচে পরিষ্কার প্রতিবিম্ব পড়েছে। নিজেরা বলাবলি করতাম পিরোজপুরের তাজমহল যমুনার জলে প্রতিবিম্বিত হয়েছে।

মাঝে মাঝে হতো নৌকা ভ্রমণ। প্রকাণ্ড সরকারি নৌকায় শুয়ে বসে বেড়ানো। গান বাজছে টেপ রেকর্ডে কিংবা গাইছে শেফু, শিখু। মাঝিরা চায়ের জল চড়িয়েছে। নৌকা চলছে মন্থর গতিতে। নদীর জল আয়নার মতো ঝক ঝক করছে, দূরে ছবির মতো সুন্দর সবুজ গ্রাম, সন্ধ্যা নামছে ধীরে ধীরে, নদীর পানি গাঢ় হলুদবর্ণ ধারণ করেছে, গাছের পাতা শেষের রোদ লেগে সোনার মতো জ্বলছে। মনটা উদাস হয়ে উঠত।

গল্পের আসরগুলো হতো ভারি মজার। প্রধান বক্তা আমি, তারপরই বলতেন আম্মা। আব্বা এই আসরে প্রায়ই থাকতেন না। যেদিন থাকতেন সেদিন বলতেন শুধু তিনিই, আমাদের শোনার পালা। কয়েকটি গল্প ছিল তার খুবই প্রিয়। এগুলো সবসময়ই বলতেন। তার বলার কায়দায় কোনোদিন সেগুলো পুরোনো মনে হতো না। একটি গল্প এই ধরনের

আমি তখন কলকাতায় কেশব দাস স্ট্রিটের এক মেসে থাকি। সঙ্গে আছেন দুদু মিয়া (সম্পর্কে নানা)। একদিন এক বইয়ে পড়লাম কালো মশারিতে খুব সুনিদ্রা হয়। কই পাই কালো মশারি? রং করে সেই সমস্যার সমাধান হলো। একদিন বিকেলে মেসে এসে দেখি মশারিও নেই, দুদু মিয়াও নেই। বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যা। সন্ধ্যা গড়িয়ে রাত। দুদু মিয়ার দেখা নেই। পরে শুনলাম সে গিয়েছে হক সাহেবকে কালো নিশান দেখাতে। কালো নিশান এত তাড়াতাড়ি করে কোথায় পাবে। মশারিটাই নিয়ে গিয়ে ধরা পড়েছে পুলিশের হাতে।

আব্বার গল্পের আসরে মাত্র দু-জন গল্প বলার সুযোগ পেত। একজন স্বেচ্ছায় বলতেন, অন্য জনকে নিয়ে জোর করে বলানো হতো। তারা হলো আম্মা আর ছোটো ভাই শাহীন। শাহীনের গল্প ছিল দুটো, আব্বা এই গল্পগুলো বারবার শুনতেন এবং প্রতিবারই সমান আনন্দ পেতেন। আমাদের কাছে একঘেয়ে লাগলেও আব্বার আনন্দ দেখে আমাদের ভালো লাগত। শাহীনের গল্পটি এই :

“আমার বন্ধু আজাদের খুব বুদ্ধি। ক্লাসে তাকে স্যার জিজ্ঞেস করেছেন, ‘আযাদ কাল আসনি কেন?’ আযাদ উত্তরে একটা মস্ত গল্প শুরু করল—‘স্যার আমি পরশু বিকেলে আব্বার সঙ্গে গিয়েছিলাম মেলায় সেখানে শহীদের আব্বা একটা দোকান দিয়েছে। ঐযে স্যার ঐ কোণার দিকে। হলুদ শার্ট সে হলোশহীদ। আমার আব্বা। সেই দোকান থেকে আমাকে একটা মোটর গাড়ি কিনে দিয়েছেন। শাহীন দেখেছে সেই গাড়ি। ঐযে কোণার দিকে ও হলো শাহীন। তারপর স্যার সার্কাসের ভেতরই মউত কা কুয়া দেখলাম। মউত কা কুয়া হলো একটা কুয়া যার ভিতরে মোটর সাইকেল চালায়। ঐটা দেখে বাসায় আমি একটা মউত কা কুয়া বানিয়েছিলাম কাল সারাদিন সেইখানে আমার মোটরগাড়ি চালিয়েছিলাম। তাই আসতে পারি নাই।”

আম্মাও খুব ভালো গল্প করতে পারতেন। তাছাড়া চমৎকার অনুকরণও করতে পারতেন। তাঁর গল্প অবশ্য অধিকাংশই স্মৃতিচারণ। নিজের কথা, নিজের গ্রামের বন্ধুদের কথা, আমাদের ছোটোবেলার কথা, চমৎকার লাগে শুনে। তাঁর একটি চমৎকার স্মৃতি কথা লিখছি এইখানে, যাতে তাঁর স্মৃতির মিষ্টি দিকটা সুন্দর ফুটেছে।

“নতুন বিয়ে হয়েছে তখন। বাবার বাড়িতে বেড়াতে এসেছি। অনেকদিন তোর আব্বার কোনো খবর নেই। মনটা কিছু বিক্ষিপ্ত। রাত তিনটার দিকে তোর নানু ডেকে তুললেন, ‘জামাই এসেছে।’ তোর আব্বা তখন এই প্রথম বারের মতো একটা গ্রামোফোন কিনে এনেছে। তাকে ঘিরে ফজলু, নজরুল (বড় মামা এবং মেজো মামা) এরা। হঠাৎ গান বেজে উঠল। আমার জীবনে প্রথম শোনা গ্রামোফোনের গান। আর সেকি চমৎকার গান–

‘..কোনো এক গাঁয়ের বধুর কথা তোমায়
শুনাই শোনো
রূপকথা নয় সে নয়…’

গভীর রাত, সবাই নিঝঝুম হয়ে গান শুনছে। কি যে ভাল লাগলো আমার।”

গল্পের আসরে আমার ভূমিকাটা প্রায়ই পড়ুয়ার। হাসির গল্প পড়ে শুনাননা। পড়ানোর বিরক্তিকর কাজটা আনন্দেই করতাম যখন দেখতাম এতে অন্যদের খারাপ লাগছে না।

একদিকে চলছে অসহযোগ আন্দোলন, অন্যদিকে আমাদের গতানুগতিক জীবনধারা। হাসি গান আর গল্পে ঠাসা সুখী জীবন।

এর মধ্যেই বাসায় একদিন জিন আনা হলো। ব্যাপারটা অবিশ্বাস্য বিজ্ঞানের দৃষ্টিতে কিছুতেই বিশ্বাস করা চলে না। তবু সম্পূর্ণ হেসে উড়িয়ে দিতেও কিছু বাধা আছে। উদ্যোক্তা হলেন C.G. সাহেব। যে লোক জিন আনবে তাকে বরিশাল থেকে খবর পাঠিয়ে আনাননা হলো। আব্বার উৎসাহই সবচে বেশি। ঘর পরিষ্কার করে, গোলাপজলে ধুয়ে, দরজা-জানালা বন্ধ করে ভদ্রলোক আসন করে বসলেন বাতি নিভানো হলো। আমরা ভয়ে কাঠ হয়ে অপেক্ষা করছি। ভদ্রলোক কোরান আবৃত্তি করতে লাগলেন। আর সত্যি সত্যি জ্বিন এলো শেষ পর্যন্ত। কথা বার্তাও হলো। প্রথম ভাবলাম হয়ত ভেন্ট্রিলোকুইজম– যার সাধ্য এক জায়গা থেকে এমনভাবে কথা বলা যায়, যাতে মনে হয় ভিন্ন দিক থেকে কথা ভেসে আসছে। কিন্তু তবু রহস্য থেকেই যায় কারণ প্রায় সবসময়ই ভদ্রলোকের কোরান আবৃত্তি আর জিনের কথা বার্তা একই সঙ্গে শোনা যাচ্ছিল। তাছাড়া এই জিনই o.c সাহেবের বাসায় রাগ হয়ে আড়াইমণি চালের বস্তা নিমিষের মধ্যে ছুঁড়ে ফেলেছিল এবং o.c সাহেবকে বলেছিল যে তার হৃৎপিণ্ড একটু লম্বাটে ও ডিফেকটিভ (সঠিক তথ্য সেরকম প্রমাণ নেই)। বড়ো ডাক্তার দিয়ে পরীক্ষা Euctrocardiograph করে o.c সাহেব সত্যি তার হৃৎপিণ্ডের এই দোষ জানতে পেরেছিলেন।

জিনের সঙ্গে আমাদের নিম্নলিখিত কথাবার্তা হলো :

আব্বা : আসসালামু আলায়কুম

জিন : অলায়কুম আসসালাম

আব্বা : জনাব, দেশের বর্তমান অবস্থা দেখে আমরা সবাই খুব বিচলিত। শেষ পর্যন্ত কী হবে বলবেন দয়া করে?

জিন : আমরা তো অতি সাধারণ জীব, ভবিষ্যৎ বলার ক্ষমতা আমাদের নাই। অতি সামান্য যা ক্ষমতা আছে তাতে বুঝি জয় হবে। আপনাদেরই। তবে সামনে বড়ো বিপদ, দেশের এবং অন্যান্য সবার। মহাবিপদ। হাত তুলে দোয়া করি।

(দোয়া চলল)

আমি : আপনারা কোথায় থাকেন বলবেন কি?

জিন : কোহকাফ নগর।

আমি : মানুষ যে চাঁদে গিয়েছে তা বিশ্বাস করেন?

জিন : কিছুক্ষণ চুপচাপ। গিয়েছে নাকি?

আব্বা : জিনদের সম্বন্ধে আমার অনেক কিছু জানতে ইচ্ছা হয়, আপনি জানাবেন কি?

জিন : এই সম্বন্ধে পরে আলাপ করব। আপনি নির্জনে আমার কথা চিন্তা করবেন। আমি আসব।

দেশের রাজনৈতিক পট আবার পরিবর্তিত হলো। সমস্ত ক্ষমতা জনগণের নির্বাচিত দেশবরেণ্য নেতা শেখ মুজিবের হাতে। দৌড়ে এল ইয়াহিয়া। সকাল-বিকাল শেখ সাহেবের সঙ্গে সুদীর্ঘ মিটিং। আশার আলো দেখতে পেল সবাই। ইয়াহিয়া-শেখ মুজিব আলোচনার অগ্রগতি খবরের কাগজে হেডিং বেরুল। দু-জনের হাসিহাসি মুখের ছবিও ছাপা হলো বিভিন্ন কাগজে।

আব্বা ভিতরে ভিতরে অস্থির হয়ে উঠছিলেন। সারাটা দিন কাটাতেন খবর শুনে। অনিশ্চয়তা তার বুকে পাথরের মতো চেপে বসছে। কাজ ছাড়া যে-মানুষ একদণ্ড থাকতে পারে না তার জন্য কর্মশূন্য এমন জটিল পরিস্থিতি অস্বস্তিকরই বটে।

এমনি অস্বাভাবিক পরিবেশেই আমার প্রথম উপন্যাস ‘নন্দিত লোকে’র শেষপর্ব লিখে শেষ করলাম। আম্মার পড়া হলে আব্বা চেয়ে নিলেন পড়তে। আমি দুরুদুরু বক্ষে অপেক্ষা করছি আব্বার মন্তব্য শুনতে। এবার উপন্যাসের কাহিনি চুম্বকটা বলছি–

সাধারণ মধ্যবিত্ত পরিবারের কাহিনি। স্নেহপ্রবণ আত্মকেন্দ্রিক বড়ো মেয়ে। বিয়ের বয়স হয়েছে অনেকদিন কিন্তু টাকা, রূপ আর মনমতো পাত্রের অভাবে বিয়ে হয়নি। আবেগপ্রবণ নায়ক। ছোট দুই বোন চঞ্চল প্রজাপতি, হাসি খুশি। বাবা নিরীহ মানুষ, হৃদয়ে তার অফুরন্ত স্নেহ অথচ তার খোঁজ রাখে না কেউ। বড়োলোকের খেয়ালি মেয়ে কিটকিকে ভালো লাগল নায়কের। ভালো লাগাটা একতরফা নায়কেরই। কিটকির সহজ ভদ্রতাকে ভালোবাসা ভেবে ভুল করল সে। শেষ অঙ্কে দেখা গেল বড়ো মেয়ে তার নিঃসঙ্গ দিন কাটাচ্ছে। ছেলেটি বিয়ে করেছে সহজ সাধারণ একটি মেয়েকে। বাবাও আজ সঙ্গীহীন। অথচ পৃথিবী তেমনি চলছে, চাঁদের নরোম জোছনা তেমনি ছড়িয়ে পড়ছে পৃথিবীতে। অঝোর ধারায় নেমেছে বৃষ্টি। উপন্যাসের পাত্র-পাত্রীরা আজ নির্লিপ্ত স্মৃতিচারণে ব্যস্ত। সমস্ত পেয়েও আজ যেন কেউ কিছু পায়নি।

করুণ রসপ্রধান উপন্যাস। যেখানে রুনুর চরিত্রটা খুব দরদ দিয়েই লিখেছি। রুনু নায়কের ছোটোবোন। বাস্তব উপাদান নিয়ে এটা তৈরি করেছি বলে বেশ বাস্তবানুগও বটে। নিজের ধারণা খুব ভালোই হয়েছে। আগ্রহ নিয়ে অপেক্ষা করছি আব্বা কী বলেন। দেখলাম তিনি খুব উৎসাহ নিয়েই পড়ছেন। দুপুরে উপন্যাস হাতে অফিসে চলে গেলেন। পড়া শেষ হলে বললেন না কিছুই, শুধু শেফুকে জিজ্ঞেস করলেন, তোর দাদা ভাইয়ের বইটা পড়েছিস?

রাতে শুয়ে আমাকে ডাকলেন। বললেন, তোর উপন্যাস খুব মন দিয়েই পড়েছি। দুই এক জায়গায় একটু অসংলগ্ন হয়েছে… বলে দু একটা টেকনিকেল ত্রুটি দেখিয়ে দিলেন, তারপর বললেন, ‘বেশ হইছেরে, আমার খুব ভালো লেগেছে, রুনুর ডাইরির অংশটা পড়তে পড়তে চোখে পানি এসে যায়। আমারও একটা উপন্যাস লেখার বহুদিনের সখ। তবে আমার ধৈর্য থাকে না আর সময়ই-বা কই!’

রাতে শুয়ে শুয়ে আব্বার কথাই ভাবছিলাম। সম্পূর্ণ নিজের পরিকল্পনায় তার একটা বই ছাপাব এবং সেটি ছাপায়, প্রচ্ছদে সব দিক থেকেই হবে অনবদ্য। অবশ্য এই ভাবনার পিছনে একটু কারণও ছিল। আব্বা তার সামান্য সঞ্চয় থেকেই একটি বই ছাপিয়েছিলেন। সেটি সেই কারণেই ছাপায়, প্রচ্ছদে, কাগজে খুব নিকৃষ্ট মানের হয়ে তার মনোবেদনার কারণ হয়েছিল। রচনা ভালো হওয়া সত্ত্বেও তা কারো দৃষ্টি আকর্ষণ করতে পারেনি।

রহুল মামা বেড়াতে আসলেন এই সময়টাতে। হইচই আর আমোদ চরমে উঠল। সোনায় সোহাগার মতো নানাও এসে হাজির। তাদের আগমন উপলক্ষে পারিবারিক দেয়াল পত্রিকা সুনিলিত সাগরিত’ (পারিবারিক পত্রিকা, কারো জন্ম বা বিয়ে উপলক্ষে প্রকাশিত হয়। নামটি হুমায়ূন আহমেদের দেওয়া।) এর বিশেষ সাক্ষী বের করল এর সম্পাদিকা মমতাজ আহমেদ শিখু। সেও বহুদিন কুমিল্লায় থেকে এসেছে। কাজেই তার উৎসাহ প্রায় বল্গা ছাড়া। আমাদের খাঁটি আনন্দে কিছুটা ভেজাল মিশল। মামা কোনো এক অজ্ঞাত কারণে রাগ করে খুলনা চলে গেলেন তার ভাইয়ের কাছে। আব্বা বললেন, ‘সবুর করো দেখবে দুদিন পর রহুল সেখান থেকে রাগ করে আবার এখানে এসে পড়বে।’  

নানাও চলে গেলেন খুলনা; খুশি মনেই গেলেন। এদিকে ঝামেলা প্রায় মিটে গেছে। VOA থেকে বলা হলো শেখ মুজিব আর ইয়াহিয়ার ভেতর একটা আপোষ হয়েছে। ক্ষমতা হস্তান্তরে রাজি হয়েছেন। ইয়াহিয়া। আমার মন খারাপ হয়ে গেল আবার পরীক্ষা দিতে হবে ভেবে। শেফু, শিখু, ইকবালও মুখ কালো করে ঘুরতে লাগল সব ঠিক হয়ে যাবে আবার হোস্টেলের নিরানন্দ একঘেঁয়ে জীবন।

(২য় পর্ব সমাপ্ত)

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *