আকাঙ্ক্ষার পূরণে আশাভঙ্গের এই রহস্যের মূল খুঁজলেই চাষের জমির স্বত্ব নিয়ে চাষি ও জমিদারের ঝগড়ার প্রকৃত স্বরূপ বোঝা যাবে; এবং বোঝা যাবে, এই বিবাদের মীমাংসায়, সে মীমাংসা সম্পূর্ণ চাষির অনুকূলে হলেও, কোন চাষির ও দেশের বেশি কিছু উপকার সম্ভব নয়। চাষের জমির মালিকি স্বত্বের ভাগ-বাটোয়ারার যে-সব প্রশ্ন নিয়ে আলোচনা করেছি সেগুলি অতীত কালের বাতিল প্রশ্ন। যথাকলে তার সদুত্তরের ফল কি হাত সে ঐতিহাসিক আলোচনা আজ নিম্ফল। চাষের জমি নিয়ে বর্তমানের প্রশ্ন অন্য প্রশ্ন। প্ৰাচীন প্রশ্নের মীমাংসা তার কোনও উত্তর নয়।
আঠারো শতকের শেষ ও উনিশ শতকের আরম্ভ, বাংলাদেশে যখন ইংরেজের শাসন ও আইন কায়েম হচ্ছে, সে হল ইংল্যান্ডে ধনতান্ত্রিক যুগপরিবর্তনের কাল। পূর্বকালের ধনতন্ত্র আবর্তিত হত। জমির উৎপন্ন ফসলকে কেন্দ্র করে। এই ফসলের যত বড় অংশের উপর যার যতখানি প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ মালিকত্ব সে ছিল তত বড় ধনী। সুতরাং, প্রাচীন ঐতিহাসিক কারণে যে অভিজাত ‘সম্প্রদায় ছিল জমির মালিক, সেই সম্প্রদায় ছিল দেশের ধনী সম্প্রদায়। এবং এই সম্প্রদায়ের স্বার্থসিদ্ধিই ছিল রাষ্ট্রব্যবস্থার প্রধান লক্ষ্য, কারণ তারাই ছিল রাষ্ট্রের কর্ণধার। দেশে যে প্রয়োজনীয় শিল্পদ্রব্য উৎপন্ন হত তা হত শিল্পীর নিজের বাড়িতে, শিষ্যসকরোদদের সহায়তায়। আর, তার ক্ৰয়-বিক্রয় সচরাচর আবদ্ধ থাকত আশপাশের ছোট গণ্ডির মধ্যে। যে-সব বিশেষ শিল্পদ্রব্য তৈরি হত অল্প জায়গায়, কিন্তু যার চাহিদা থাকত দেশময় বা দেশের বাইরেও, ব্যবসায়ী মহাজনেরা শিল্পীদের বাড়ি বাড়ি তা সংগ্ৰহ করে সে চাহিদা মেটোত, এবং সে-ব্যবসায়ের মুনাফায় তারাই ছিল অভিজাত সম্প্রদায়ের পর দেশের ধনী লোক। এই সময় ইংল্যান্ডের করিতকর্মী লোক আবিষ্কার করল যে, শিল্পীদের বাড়ি বাড়ি শিল্পদ্রব্য সংগ্ৰহ না করে যদি অনেক শিল্পীকে এক জায়গায় এনে তাদের মজুরি দিয়ে জিনিস তৈরি করিয়ে নেওয়া যায়, তবে অল্প খরচে ও অল্প সময়ে জিনিস তৈয়ারি হয়। অনেক বেশি, এবং তা বেচে লাভ হয় আরও বেশি। ইংল্যান্ডের বহু জায়গায় ওয়ার্কশপ গড়ে উঠল, সেখানে পূর্বের দেশময়-ছড়ানো স্বাধীন শিল্পীরা এক জায়গায় জমায়েত হয়ে অন্যের কাছ থেকে মজুরি নিয়ে ফরমায়েশমতো জিনিস তৈরি করে দিতে লাগল। যাঁরা ছিল শিল্পী, craftsman, তাঁরা হল মজুরির চাকরি, workman; যাঁরা ছিল দ্রব্যসংগ্রহ ও কেনাবেচার মহাজন, merchant, তাঁরা হল শিল্পীর শ্রমের মজুরিদাতা মালিক, industrialist এর নাম industrial revolution। হাতের কাজ কলে করা, কল চালাতে স্টিম ইঞ্জিন লাগানো, এগুলি industrial revolution-এর গোড়ার কথা নয়। ওগুলি নুতন শিল্পোৎপাদন-ব্যবস্থাকে সহস্ৰগুণ ফলপ্ৰসূ করেছে, এবং সে ব্যবস্থায় মালিকদের মুনাফা বাড়িয়েছে তার চেয়ে বেশিগুণ; এবং এই নূতন শিল্পব্যবস্থার ফলেই কল ও ইঞ্জিন কাজে লাগানো সম্ভব হয়েছিল। কিন্তু industrial revolution-এর গোড়ার কথা হচ্ছে, শিল্পীদের মজুর করে একসঙ্গে খাটিয়ে তাদের কাজের নিট লাভ অল্প লোকে বেঁটে নেওয়া। কলা ও ইঞ্জিন কাজে লাগানোর পূর্বেই industrial revolution আরম্ভ হয়েছিল। কল ও ইঞ্জিনের আবিষ্কার অনেকটাই ওই revolution-এর ফল, তার কারণ নয়।
এই নুতন শিল্পব্যবস্থায় ইংল্যান্ডের শিল্পনেতাদের হাতে যে অর্থ জমা হতে লাগল তাতে তারাই হয়ে উঠল। সে দেশের প্রধান ধনী সম্প্রদায়। তাদের ধনের পরিমাণ জমিসর্বস্ব প্রাচীন অভিজাত সম্প্রদায়ের ধনকে ছাড়িয়ে যেতে লাগল। তার ফলে রাষ্ট্রে ও সমাজে এ সম্প্রদায়ের প্রতিষ্ঠা অভিজাত সম্প্রদায়ের প্রতিষ্ঠাকে ছাড়িয়ে না গেলেও, ইংল্যান্ডে। আজও তা যায়নি, তাদের স্বার্থসিদ্ধির অনুকুল ব্যবস্থা প্রণয়ন রাষ্ট্রের একটা প্রধান কাজ হল এবং তার অনুকুল মনোভাবের সৃষ্টি ও প্রচার ইংরেজ ধনবিজ্ঞানী ও সমাজবিজ্ঞানীরা উৎসাহের সঙ্গে করতে লাগলেন। কার্ল মার্কসের কথায়, সমাজের তৎকালীন এই সবচেয়ে প্ৰগতিশীল ধনোৎপাদক বুর্জোয়া সম্প্রদায়ের প্রয়োজনকে আর্থিক ও সামাজিক উন্নতির চিরন্তন মূলসূত্র বলে পণ্ডিতেরা বিশ্বাস করাতে ও বিশ্বাস করতে লাগলেন। এক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় প্রয়োজন ছিল নূতন প্রথায় শিল্পসৃষ্টির জন্য যা কিছু উপকরণ তার উপর শিল্পনেতাদের অবাধ অধিকার। এ উৰ্দ্ধকরণ দু-রকমের; মানুষের শ্রম ও সে-শ্রম প্রয়োগের জন্য জমি ও জিনিস। মানুষের শ্রমকে ইচ্ছামতো আয়ত্তে আনার যে-কৌশল আবিষ্কার হল তার নাম freedom of contract, চুক্তিতে আবদ্ধ হবার অবাধ স্বাধীনতা। এবং, সে স্বাধীনতার প্রয়োগে একবার চুক্তিতে বদ্ধ হলে সে চুক্তি যাতে ভঙ্গ না হয় সে জন্য রাষ্ট্রীয় শাসন। এর নাম sanctity of contract, চুক্তির পবিত্রতা, অর্থাৎ চুক্তিভঙ্গ পাপের আইনের দণ্ডে প্ৰায়শ্চিত্ত। শিল্পনেতারা সংখ্যায় অল্প এবং পকেট ভরতি থাকায় পেটে ক্ষুধার জ্বালা নেই। তাদের পক্ষে দল বেঁধে শ্রমিকদের দাবি পেটভ্যতার সীমানায় ঠেকিয়ে রাখা খুব কঠিন নয়। শ্রমিকেরা সংখ্যায় বহু, এবং পূর্ব আমলের কুটিরশিল্প নূতন আমলের ফ্যাক্টরিশিল্পে ধ্বংস হওয়ায় বেকার, পেটে ক্ষুধার জ্বালা। সুতরাং, স্বাধীন ইচ্ছার প্রয়োগে শিল্পনেতাদের শর্তেই রাজি হওয়া ছাড়া তাদের অন্য গতি ছিল না। গত শতাব্দীর শেষ দিকে যখন শ্রমিকেরা দল বাঁধতে শিখে নিজেদের শ্রম বিক্রির শর্তের দাবি উপস্থিত করতে আরম্ভ করল তখন সে স্বাধীন ইচ্ছার প্রয়োগকে দলবদ্ধ গুন্ডামি নাম দিয়ে ইংল্যান্ডের আইন-আদালত ঠেকিয়ে রাখার চেষ্টা করেছিল। কিন্তু চেষ্টা সম্পূর্ণ সফল হয়নি। দলবদ্ধ শ্রমিকদের চাপে এ স্বাধীনতাকে অনেকটা স্বীকার করতে হয়েছে। এবং চুক্তির স্বাধীনতা ও পবিত্রতা, freedom ও sanctity, বহু রকমে খৰ্ব করে অনেক আইন-কানুন গড়তে হয়েছে যার সবটাই শ্রমিকদের হিতে নয়। দু’পক্ষের স্বাধীন চুক্তির লড়াই এখন চলছে। যে পক্ষই জয়ী হোক চুক্তির স্বাধীনতার জয় হবে না। কিন্তু এ অনেক পরের কথা। আঠারো শতকের শেষে ও উনিশ শতকের আরম্ভে ইংল্যান্ডে অবাধ চুক্তিবাদের ছিল জয়জয়কার, কারণ তার সুফলভাগী ছিল নূতন ধনশ্ৰষ্টা সম্প্রদায়, এবং সে ধনের পরিমাণ পূর্ব পূর্ব কালের তুলনায় এত বেশি যে, তার চমক কাটিয়ে তার সৃষ্টিকৌশলের গলদের দিকে দৃষ্টি পড়ার তখনও সময় নয়।
শিল্পীসৃষ্টির অন্য উপকরণ, জমি ও জিনিসে অবাধ অধিকারের যে-তত্ত্ব আবিষ্কার হল তার মূলকথা হচ্ছে কোনও বস্তু থেকে সবচেয়ে বেশি কাজ আদায়ের উপায়–কোনও লোককে সে-বস্তু যাদৃচ্ছিা ব্যবহারের ক্ষমতা দেওয়া। এই ক্ষমতা পেলেই সে লোক ওই বস্তু থেকে যাতে সবচেয়ে লাভ হয় সে-চেষ্টায় প্রাণপাত করবে, না পেলে করবে না। এ-তত্ত্বের নাম magic of property, মালিকত্বের মহামায়া–যার প্রভাবে মালিক পাথরে ফুল ফোটায়, মরুভূমিতে ফসল ফলায়। সুতরাং দেশের জমি ও জিনিস দেশের সবচেয়ে বেশি হিতে লাগাতে হলে তার কৌশল হচ্ছে ওদের মালিকি স্বত্ব দেশের কতক লোকের মধ্যে বেঁটে দেওয়া, এবং মালিকদের ইচ্ছামতো ব্যবহারের পথে যথাসম্ভব কম বাধা দেওয়া। তা হলেই প্ৰতি মালিক তার মালিকি স্বত্বের জমি ও জিনিসকে নিজের সবচেয়ে হিতকর কাজে লাগাতে চেষ্টা ও পরিশ্রমের ত্রুটি করবে না। এবং তাদের হিতের যোগফল সমাজের হিত, কারণ সমাজ ব্যক্তিরই সমষ্টি।
কি অবাধ চুক্তিবাদ, কি মালিকত্বের মায়াবাদ কোনওটির প্রয়োগই কেবল শিল্পনেতাদের প্রয়োজনে বদ্ধ থাকল না। ওদের মেনে নেওয়া হয়েছিল উন্নতিশীল সমাজের আর্থিক উর্ধগতির দুটি অপরিহার্য মূলসূত্র বলে। সুতরাং যেখানেই ধনতান্ত্রিক ব্যবস্থা সেখানেই ওদের প্রয়োগ হতে লাগল। অভিজাত সম্প্রদায় ছিলেন দেশের জমির মালিক। তাদের অধীনে চাষিরা চাষ করত, অপর লোক অন্য রকমে জমিকে কাজে লাগাত। এই চাষিদের ও অন্য লোকদের জমিতে অনেক রকম স্বত্ব স্বীকৃত হয়ে আসছিল যাদের উৎপত্তি মালিকের সঙ্গে চুক্তিতে নয়, পূর্ব প্রচলিত প্রথায়। মালিক ইচ্ছা করলেই সে সব স্বত্ব রদ কি বদল করতে পারতেন না। জমির মালিকের জমিকে যাদৃচ্ছিা ব্যবহারের ক্ষমতার মধ্যে এ সব স্বত্ব খাপ খায় না। এবং চুক্তিবাদের মূলতত্ত্বের সঙ্গেও এদের বিরোধ; সে-তত্ত্ব হচ্ছে উন্নতিশীল সমাজে মানুষের সঙ্গে মানুষের আর্থিক সম্বন্ধের বুনিয়াদ হয় চুক্তি, আর স্থিতিশীল সমাজেই তা হয় চুক্তিনিরপেক্ষ প্রথা। সুতরাং অন্য সব লোকের স্বত্বের খাতিরে জমির ব্যবহারে মালিকের যে-সব বাধা ছিল উর্ধর্বগতি সমাজের অনুপযোগী প্রাচীন ফিউডাল ব্যবস্থা বলে তাদের দূর করা হল। নিজের যাতে সবচেয়ে লাভ হয় জমিকে তেমন ব্যবহারে লাগাতে মালিকের কোনও বাধা থাকল না। ইংল্যান্ডে চাষের জমির মালিক অনেকে দেখলেন যে, জমি থেকে চাষিদের বিদায় করে যদি সেখানে ভেড়া পোষা যায়। তবে পশম বেচে লাভ হয় অনেক বেশি। সুতরাং চাষের খেত ভেড়া চরানোর মাঠ হল। উৎখাত চাষিরা পেটের দায়ে শিল্পনেতাদের দরজায় ভিড় করে জমা হতে লাগল মজুরি বেচার জন্য। এবং, শ্রমিকের সংখ্যাবাহুল্যে শিল্পনেতারা খুব কম দামেই শ্রম কিনতে লাগলেন। এই স্বল্প মূল্যের শ্রমে তৈরি শিল্পদ্রব্য, মায় পশমের কাপড়, প্রতিদ্বন্দ্বহীন পৃথিবীর বাজারে বিক্রি হয়ে মুনাফা আসতে লাগল বেশ মোটা রকম। ওই মুনাফার এক অংশের বদলে বিদেশ থেকে ইংল্যান্ডে শস্য আমদানি হতে লাগল, তার পরিমাণ ভেড়া-চরানো চাষের খেতের শস্যের চেয়ে অনেক বেশি, তা দামেও দেশে-উৎপন্ন শস্যের চেয়ে অনেক সস্তা। উন্নতির চাকা যে জোরে ঘুরছে, তাতে কারও সন্দেহ থাকল না। আজ যখন ইংল্যান্ডের শিল্পদ্রব্যকে পৃথিবীর বাজারে নানা দেশের শিল্পদ্রব্যের সঙ্গে ঠোকাঠুকি করতে হয়, যুদ্ধের সময় শত্রুপক্ষ দেশে খাদ্য আমদানির পথে মারাত্মক বাধা জন্মায়, তখন বাধ্য হযে চাষি-বনাম–ভেড়া নীতির অনেক পরিবর্তন করতে হচ্ছে। দেশের চাষকে সুবিধা ও উৎসাহ দেবার জন্য চাষের জমিতে চাষির এমন অনেক স্বত্ব স্বীকার করতে হচ্ছে যা মালিকের স্বাধীন ইচ্ছা-পরিচালনার বাধা। কিন্তু এ সব আজকের দিনের কথা। শিল্পবিপ্লবের আদিকালে ও-নীতির বিরুদ্ধে যাঁরা কিছু কথা বলেছিল তাঁরা ধনবিজ্ঞানী পণ্ডিত নয়, কবি কি ভাবুক গোছের মানুষ, অর্থাৎ ‘হৃদয়তাপের ভাপে ভরা ফানুস’। স্বভাবতই তাদের কথায় কেউ কান দেয়নি।