অভিযান
কোম্পানির সূত্রপাত হল ঠিক কবে সেই সময়টা নির্ণয় করা যায় না। ভারত নিয়ে ইংরেজদের কৌতূহলের শুরু প্রায় মধ্যযুগ থেকে। মোটামুটি বলা যায় যে আনুষ্ঠানিকভাবে গোড়াপত্তনের (১৬০০) দশ বছর আগে থেকে শুরু করে দশ বছর পরের সময়টা ভারত মহাসাগরে বাণিজ্যজাহাজ পাঠানোর উদ্যোগ গড়ে ওঠার যুগ। এবারে সেই গড়ে ওঠার যুগ নিয়ে আলোচনা হবে, আর আমরা দেখব কেন সেই যুগে মোগল দরবারের সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্ক বাড়ানোর দরকার হয়।
রাল্ফ ফিচ
১৫৮৩ সালের ১২ ফেব্রুয়ারি একদল ইংরেজ ফলমুথ থেকে টাইগার নামের জাহাজে চেপে পশ্চিম এশিয়া অভিমুখে যাত্রা করে। দলের সদস্যদের মধ্যে ছিলেন তিন বণিক, জন নিউবেরি, জন এন্ড্রেড ও রাল্ফ ফিচ, জহুরি উইলিয়াম লীডস, এবং চিত্রশিল্পী জেমস স্টোরি। নিউবেরি পর্যটকও বটে, দু’বছর আগে স্থলপথে হরমুজ যাত্রা করেন এবং ফেরার পথে কিছুটা আরবি ভাষা শিখে আসেন। ফিচ চামড়ার কারবারি, সম্ভবত দলের সবথেকে বয়স্ক সদস্য। ৩১ বছর বয়েসি এন্ড্রেডের ব্যাবসা মধ্যপ্রাচ্যের রেশমি কাপড়ের। নিউবেরি, ফিচ ও এন্ড্রেড আবার ইংল্যান্ডের লেভান্ট কোম্পানির দু’জন মালিকের বন্ধুস্থানীয়। এই দুই ব্যক্তিই অভিযানের খরচ জোগান। লেভান্ট কোম্পানির কনস্টান্টিনোপল অফিস কয়েক বছর ধরে ভারত থেকে আমদানি সুতির কাপড়, চিনের রেশমি কাপড় ও ইন্দোনেশিয়ার মশলা কিনে চলেছে। অভিযানের উদ্দেশ্য এইসব পণ্যের উৎস সন্ধান
ভূমধ্যসাগর পার হয়ে জাহাজ পৌঁছল সিরিয়ার ত্রিপোলি শহরে। সেখান থেকে হেঁটে লেবাননের পাহাড় পেরিয়ে আলেপ্পো, ও ইউফ্রেটিস নদী বেয়ে আল-ফালুজায়। এইখানে এন্ড্রেড মশলার ব্যাবসা শুরু করবার উদ্দেশ্যে থেকে গেলেন। দলের বাকিরা পৌঁছল হরমুজ বন্দরে। হরমুজ বন্দর পার্সিয়ার সাম্রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত, কিন্তু আসলে পর্তুগিজরাই এই বন্দরের শাসক বলা চলে। এই সময়ে সাফাভিদ ইরানের সম্রাট অপেক্ষাকৃত দুর্বল রাজা মুহম্মদ শাহ খোদাবান্দা। পর্তুগিজদের সঙ্গে যুঝবার ক্ষমতা তাঁর ছিল না। হরমুজ বন্দরের দখল ভারত মহাসাগরীয় ব্যাবসা নিয়ন্ত্রণের নীতিতে পর্তুগিজদের কাছে খুব জরুরি ছিল। এদের বন্ধু ভেনিস ও জেনোয়ার বণিকরা ইংরেজদের এই অঞ্চলে ঢুকতে দিতে চায়নি। কিছু দিন আগে স্পেনের রাজা ও এক পর্তুগিজ সম্ভ্রান্ত ব্যক্তির সঙ্গে পর্তুগিজ সিংহাসন দখলের যে লড়াই হয় তাতে ভেনিসের বণিকরা স্পেনের পক্ষ সমর্থন করে আর ইংল্যান্ডের রানি বিরোধী পক্ষ। কাজেই যাত্রীরা হরমুজ পৌঁছতেই গুপ্তচর সন্দেহে তাঁদের গ্রেপ্তার করা হল। পর্তুগিজ প্রধান বিচারক ইংল্যান্ডের রানির রেফারেন্স চিঠি দেখলেন, চিঠি ভারত ও চিনের সম্রাটকে উদ্দেশ করে লেখা। কিন্তু ফল হল না।
যাত্রীদের এক জাহাজে চাপিয়ে পাঠিয়ে দেওয়া হল গোয়ায়, সেখানে শাসক ডন ফ্রান্সিসকো দে মাস্কারেনাস এঁদের বিচার করবেন। তেরো দিন গোয়ায় বন্দি থাকার পরে জেমস স্টোরি জেসুইট হয়ে যাবার সিদ্ধান্ত নিলেন (‘ভয় পেয়ে’, সঙ্গীদের মন্তব্য) এবং ছাড়াও পেলেন। দলের বাকি সদস্যদের মুক্তির ব্যবস্থা হল গোয়ার এক ইংরেজ জেসুইট পাদরি টমাস স্টিভেনসের মধ্যস্থতায়। কিন্তু জেসুইটরা এদের চাপে রাখল ধর্মান্তরণ করার ব্যাপারে, এবং দলের লোকেদের বিশ্বাস হল যে আবার বন্দি হওয়ার সম্ভাবনা আছে। গন্ডগোল বাধবার আগেই গোপনে দল গোয়া থেকে পালাল, সেটা ১৫৮৪ সালের শীতকাল।
পশ্চিমঘাট পাহাড় পেরিয়ে যাত্রীরা এল বেলগাঁওতে, সেখান থেকে বিজাপুর, মোগল সাম্রাজ্যের মধ্যে বুরহানপুর ও মান্ডু। উজ্জয়িনী শহর ছাড়াতেই যাত্রীরা দেখতে পেল সামনে বহুসংখ্যক সৈন্যসামন্ত ও জমকালো মিছিল— সম্রাট আকবর চলেছেন আগ্রা অভিমুখে। পরের বছরের প্রথম দিকে যাত্রীরা আগ্রায় পৌঁছল। পরবর্তী বর্ণনা থেকে মনে হয় আগ্রার দরবারে এঁদের সঙ্গে ভাল ব্যবহার করা হয়, তা না হলে হয়তো এখান থেকেই দলের লোকজনদের ইংল্যান্ডে ফিরে যেতে হত। তবে রানির চিঠি মোগলসম্রাটের হাতে দেওয়া হয়েছিল কি না, এবং সে চিঠি পড়ে আকবর কী বলেছিলেন, তা জানা যায় না। মনে রাখা দরকার যে আকবরের দরবারেও জেসুইটদের প্রতিপত্তি ছিল।
এবার দল ভাগ হয়ে গেল। ফিচ ব্যবস্থাদি করে নদীপথে বাংলা অভিমুখে যাত্রা করবেন ঠিক হল। নিউবেরি স্থলপথে ইংল্যান্ড ফিরে গিয়ে জাহাজ নিয়ে ফের আসবেন বাংলায় ও ফিচকে তুলে দেশে ফিরে যাবেন। নিউবেরি এই ব্যবস্থা অনুযায়ী রওনা দিলেন বটে, কিন্তু তাঁর আর কোনও খোঁজ পাওয়া যায়নি। লীডস মোগল দরবারে চাকরি নিয়ে ভারতেই থেকে গেলেন। বাকিরা চললেন বেনগালা অভিমুখে, যে কিংবদন্তির দেশ থেকে আমদানি আশ্চর্য সুন্দর মসলিন কাপড় পশ্চিম এশিয়ার বাজারে চড়া দামে বিক্রি হত।
ফিচ আগ্রা থেকে গেলেন কাশী, কাশী থেকে সপ্তগ্রাম, মধ্যযুগের বাংলার প্রধান বন্দর, এবং সপ্তগ্রাম থেকে বিপজ্জনক নদীপথে সুন্দরবন পেরিয়ে বাকলা। ফিচ এই যাত্রার বর্ণনায় কোনও রাস্তার উল্লেখ করেননি, নৌকা বদলেরও উল্লেখ করেননি, তার থেকে মনে হয় সেকালের বাকলা ছিল কোনও বড় নদীর কূলে অবস্থিত বন্দর-শহর, সম্ভবত মেঘনা বা মেঘনার উপনদী তেঁতুলিয়ার ধারে। মোগল রাজকর্মচারী আবুল ফজলের লিখিত আইন-ই-আকবরী বই থেকে জানা যায় যে ফিচ এই অঞ্চলে পৌঁছনোর কয়েক বছর পরেই এক অতিকায় সামুদ্রিক ঢেউ এসে বাকলা শহর, পরগনা ও প্রায় দু’লক্ষ প্রাণ ধ্বংস করে। বাকলা এর পরেও আবার গড়ে ওঠে এক মোগল জমিদারি হয়ে, তবে সম্ভবত অনেক ছোট আকারে ও আরও নিরাপদ অঞ্চলে। তবে এই বিপর্যয়ের পরে বন্দর হিসেবে বাকলার গুরুত্ব প্রায় শেষ হয়ে যায়। ফিচের সময়ে মনে হয় এই অঞ্চলে সামুদ্রিক বাণিজ্য হত আরও বেশি।
প্রাচীন বাকলা থেকে ফিচ গেলেন শ্রীপুর ও সোনারগাঁও, নিম্নবঙ্গের দুটি মাঝারি আকৃতির রাজ্য, এবং সেখান থেকে বর্মার পেগু শহরে। আগাগোড়া তাঁর বর্ণনায় লেখা হল প্রত্যেক বন্দরে আমদানি-রপ্তানি দ্রব্যের বিশদ ফিরিস্তি, কোচিনের গোলমরিচ থেকে শুরু করে মলুক্কার লবঙ্গ, পেগুর চুনি, গোলকোন্ডার হিরে, বাংলার বস্ত্র পর্যন্ত। এখানকার ‘অপর্যাপ্ত সুতির কাপড়…প্রচুর ধান… সারা ভারত, এমনকী সিংহল, পেগু, মালাক্কা, সুমাত্রা পর্যন্ত রপ্তানি হয়।’ পেগু থেকে ফিচ জাহাজে ইংল্যান্ডে ফিরে আসতে পেরেছিলেন, ১৫৯১ সালের ২৯ এপ্রিল জাহাজ তাঁকে দেশে পৌঁছে দেয়।
কয়েক বছর বাদে যখন এই ভ্রমণের বৃত্তান্ত বই হয়ে বেরোল, টাইগার জাহাজের একজন সামান্য সদস্য মাস্টার রাল্ফ ফিচ রাতারাতি বিখ্যাত হয়ে গেলেন। বইয়ে বর্ণিত অনেক ভৌগোলিক তথ্য ফিচ অন্যান্য পর্যটকদের লেখা থেকে ধার করেছিলেন, বিশেষ করে ভেনিসিয়ান বণিক সেসার ফেদেরিকির লেখা থেকে। কিন্তু বইয়ে একটু-আধটু নকল থাকলেও ফিচ ছিলেন নিঃসন্দেহে ভারতে প্রথম ইংরেজ পর্যটক যিনি তাঁর ভ্রমণকাহিনি বই আকারে লেখেন। দেশে ফেরার দশ বছর পরে শেক্সপিয়ারের ‘ম্যাকবেথ’ নাটকের তিন ডাইনির একজন জানাল, ‘ওর [এক নাবিকের স্ত্রীর] স্বামী টাইগার জাহাজের ক্যাপ্টেন, আলেপ্পোয় চলে গেছে,’ পরোক্ষ উল্লেখ এমন এক সামুদ্রিক অভিযানের যা তখন প্রায় কিংবদন্তি। অভিযান থেকে প্ৰত্যক্ষ ব্যবসায়িক লাভ কিছু হয়নি, কিন্তু মোগল ভারত ও টিউডার ইংল্যান্ডের দরবারের মধ্যে ব্যাবসার কারণে যোগাযোগ স্থাপন করার ধারণাটা এখন থেকেই তৈরি হল। এই কাজে আরও এগোতে হলে একটা সংগঠন দরকার।
জেমস ল্যাঙ্কাস্টার
ফিচের প্রত্যাবর্তনের তিন সপ্তাহ আগে লন্ডনের বণিকরা মিলে সে যুগের সবথেকে প্রসিদ্ধ ব্যবসায়ী-জাহাজি জেমস ল্যাঙ্কাস্টারের নেতৃত্বে একটা অভিযান পাঠায়। এই দূরদৃষ্ট অভিযানের দুটো প্রধান জাহাজ উত্তমাশা অন্তরীপের কাছে প্রবল ঢেউয়ের আঘাতে ডুবে যায়, ও তৃতীয়ের উপরে বাজ পড়ে। বাকি জাহাজগুলি কোনওমতে মালাক্কা প্রণালীতে এসে পৌঁছয়, জাঞ্জিবারে উঠিয়ে নেওয়া এক গুজরাটি নাবিকের সহযোগিতায়। পেনাঙ্গের কাছে রেশম ও মশলায় ঠাসা একটি পর্তুগিজ জাহাজ আক্রমণ করে লুঠপাট চালালে অভিযান কিছুটা সার্থকতা পেল।
ফেরার পথে জনমানবশূন্য সেন্ট হেলেনা দ্বীপপুঞ্জের একটা দ্বীপে জাহাজিরা দেখা পায় এক ইংরেজ নাবিকের। এক বছর আগে, সে মরে যাবে আন্দাজ করে সঙ্গীরা তাকে এই দ্বীপে ফেলে রেখে চলে গিয়েছিল। সে যাত্রা বেঁচে গেলেও, উদ্ধার পাবার অল্প পরেই লোকটি মারা যায়। কথিত, স্বদেশের লোকদের দেখা পাবার আনন্দে শক পেয়ে মারা যায়। মরবার আগে সে ল্যাঙ্কাস্টারের দলের লোকেদের এক অত্যন্ত মূল্যবান উপহার দিয়ে যায়, বুভুক্ষু যাত্রীরা পেল চল্লিশটি ছাগল। এই নাবিকের অভিজ্ঞতা সে যুগে খুব বিরল ছিল না। ১৭১৯ সালে প্রকাশিত ড্যানিয়েল ডিফোর লেখা রবিনসন ক্রুসো উপন্যাসের প্রেরণা এ রকমই একজন নাবিক, আলেক্সান্ডার সেলকার্ক। সাম্প্রতিক গবেষণায় দেখা গেছে ডিফোর অনুপ্রেরণা সম্ভবত অনেক জন নাবিকের স্মৃতিচারণ থেকে এসেছে। তাদের অন্তত একজন ‘আবুবকর’ নামে পরিচিত আরবলেখকের এক কাহিনির নায়ক।
ল্যাঙ্কাস্টারের নৌবহর এবার ওয়েস্ট ইন্ডিজের দিকে যাত্রা করল। ব্রাজিলের উপকূলে ফের জাহাজ ডুবল। অবশেষে ১৫৯৪ সালে এক ফরাসি জাহাজে চেপে কিছু সঙ্গীসাথি সহ ল্যাঙ্কাস্টার দেশে ফিরলেন। ফিরলেন প্রায় খালি হাতে। তবে একটা ভাল খবর ছিল। এ দিকের সমুদ্রে পর্তুগিজদের নৌবল ভয় পাওয়ার মতো কিছু নয়।
জাহাজি হিসেবে ল্যাঙ্কাস্টার তাঁর এলেম প্রমাণ করে দিলেন। পূর্ব এবং পশ্চিম, আটলান্টিক এবং ভারত মহাসাগর দুই সমুদ্রে জাহাজ চালানোর অভিজ্ঞতা সে যুগে আর কারও ছিল না। জন্ম যদিও ইংল্যান্ডে, ল্যাঙ্কাস্টার বড় হয়েছিলেন পর্তুগিজদের মধ্যে, মাতৃভাষার মতোই পর্তুগিজ বলতে পারতেন। এই দুই যোগ্যতা থাকায় পরের বছরে ব্রাজিল যাত্রার যে আয়োজন করা হয় তারও নেতৃত্বে ছিলেন ল্যাঙ্কাস্টার। এই অভিযানের উদ্দেশ্য ছিল পর্তুগিজদের ক্ষতিসাধন করা। সেই উদ্দেশ্য কিছুটা সফল হলেও অভিযান হারাল সে যুগের সবথেকে দক্ষ জাহাজি কমান্ডারদের একজনকে। এই সব দুর্ঘটনার জেরে পুবদিকে অভিযান পাঠাবার আয়োজন কিছু দিন পিছিয়ে দিতে হয়।
১৫৯৯ সালে আবার লন্ডনের ব্যবসায়ীরা সেই প্রসঙ্গ আলোচনার জন্যে সভার আয়োজন করল।
ফাউন্ডার্স হল
১৫৯৯ সালের ২৪ সেপ্টেম্বর ব্যবসায়ী, ব্যাঙ্কার, জাহাজি ও মাতব্বর নাগরিকরা জড়ো হল সিটি অফ লন্ডনের ফাউন্ডার্স হলে ভারত মহাসাগরে জাহাজ পাঠানোর বিষয়ে কথাবার্তা বলার জন্যে। জাহাজি-তথা-পর্যটকদের মধ্যে উপস্থিত ছিলেন ল্যাঙ্কাস্টার, ফিচ, জন ডেভিস, হেনরি মিডলটন, এবং ক্যাভেন্ডিশ ও ড্রেকের অভিযানের প্রধান সদস্য কয়েক জন। এঁরা সবাই মিলে বণিক-ব্যাঙ্কার সম্প্রদায়ের উপস্থিত সদস্যদের বোঝাতে সক্ষম হলেন যে এই উদ্যোগে টাকা ঢালা দূরদর্শিতার কাজ হবে। নাগরিকদের মধ্যে রিচার্ড স্টেপার, লেভান্ট কোম্পানির প্রতিষ্ঠাতাদের একজন, আর ফিচের সঙ্গী এন্ড্রেডও প্রস্তাবের সপক্ষে বললেন। এক অর্থে বলা যায় যে ভারত মহাসাগরে বাণিজ্যের জন্যে যে কোম্পানি তৈরি হতে চলেছিল সেটা লেভান্ট কোম্পানিরই উত্তরাধিকারী। জাহাজিরা আরও বললেন যে পুবদিকে পর্তুগিজ উপনিবেশ ও ঘাঁটিগুলি সামরিক দিক দিয়ে দুর্বল।
পরের কয়েক দিনে ৭০,০০০ পাউন্ড চাঁদা উঠল। ডিরেক্টর নির্বাচন হল। দুটো কমিটি তৈরি হল— একটা জাহাজ সংক্রান্ত ব্যবস্থাদি পরিচালনা করবে, আর একটা রানির কাছে চার্টারের জন্যে আর্জির খসড়া তৈরি করবে। নতুন কোম্পানি প্রতিষ্ঠার অনুমতি ও সেই সংক্রান্ত আরও সুযোগসুবিধা চেয়ে ২১৫ জনের স্বাক্ষরসংবলিত দরখাস্ত রানির কাছে জমা পড়ল। চার্টারের প্রস্তাব যে সহজে দরবারে গৃহীত হবে এমন আশা ছিল না। রানি নিজে যদিও এই উদ্যোগের সমর্থক ছিলেন, পার্লামেন্টের ভিতরে ক্যাথলিকদের শুভানুধ্যায়ী গোষ্ঠী স্প্যানিশরাজের সঙ্গে ঝগড়া বাধার সম্ভাবনা পরিত্যাগ করাই শ্রেয় মনে করত। এই বিসংবাদের একটা বেশ আধুনিক ধাঁচের ফল হল। আরও তথ্য সংগ্রহের জন্যে একটা তদন্ত কমিটি তৈরি হল। কমিটি নাবিকদের ইন্টারভিউ করে দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া সম্বন্ধে অনেক তথ্য জড়ো করল। অজস্র অখ্যাত এবং বেশ কিছু প্রায় আজগুবি রাজা ও রাজ্যের তালিকা নিয়ে অল্পবিস্তর এলোমেলো আলোচনা করে কমিটি সিদ্ধান্তে এল, ‘আমরা প্রমাণ করতে সক্ষম হয়েছি যে এই বিস্তীর্ণ অঞ্চলে, যেখানে সম্পদের প্রাচুর্যের কোনও তুলনা হয় না, সেখানে পর্তুগিজ আর স্প্যানিয়ার্ডদের অধীনে কোনও দুর্গও নেই, নৌবহরও নেই।’ এই রিপোর্টের পরে আর কথা রইল না।
১৬০০ সালের শেষ দিনে রানি আনুষ্ঠানিক ভাবে আবেদনকারীদের চার্টার প্রদান করলেন, প্রথম অভিযানের তোড়জোড় তখন প্রায় শেষ। তখন পর্যন্ত আবেদনকারী গোষ্ঠীর সাময়িক নাম ছিল ‘সোসাইটি অফ অ্যাডভেঞ্চারার্স টু দি ইস্ট ইন্ডিজ়’। সরকারি লাইসেন্স পেয়ে এঁদের ব্যাবসা শুরু করার সময়ে পোশাকি নাম হল ‘দি কোম্পানি অফ মার্চেন্টস অফ লন্ডন ট্রেডিং টু দি ইস্ট ইন্ডিজ়’, ডাকনাম— ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি।
রাজকীয় চার্টার থেকে এই বণিকরা কী প্রত্যাশা করে থাকতে পারে? চার্টারের সুবাদে যে কর্পোরেট সংস্থার সৃষ্টি হল তার অধিকারের মধ্যে রয়েছে ব্যাবসার জন্যে দরকার হলে স্থাবর সম্পত্তির মালিকানা প্রতিষ্ঠা করার, ও নিজেদের পরিচালনার জন্যে দরকারি আইন তৈরি করার অধিকার। একটা বিশাল ভৌগোলিক অঞ্চলে কোম্পানি একচেটিয়া ব্যাবসার দাবিদার হল, অর্থাৎ ইংল্যান্ডের নাগরিকদের এই অঞ্চলে ব্যাবসা করার অধিকার রইল না, যদি না কোম্পানি তাদের ব্যাবসার অনুমতি দেয়। কার্যত কোম্পানির শেয়ারহোল্ডার বা মালিকরা তাদের হয়ে ব্যাবসা করার জন্যে আত্মীয়, শিক্ষানবিশ, এজেন্ট (ফ্যাক্টর) ইত্যািদ নিয়োগ করত। কোম্পানির আইনি অধিকারগুলির মধ্যে খুব জরুরি ছিল সোনা-রুপো ব্যাবসার উদ্দেশ্যে দেশের বাইরে নিয়ে যাওয়ার অধিকার। তবে এই অধিকার পেতে হলে প্রতিশ্রুতি দিতে হবে যে যত সোনা পাচার হবে সমান পরিমাণ সোনা যেন আবার রাজকোষে ফিরে আসে। ব্যাবসার লাভ কীভাবে দরবার ও কোম্পানির মধ্যে বাঁটোয়ারা হওয়ার কথা ছিল সেটা স্পষ্ট জানা যায় না। তবে যে-কোনও বাজেয়াপ্ত মাল সমান ভাগ হবে সেটা চার্টারে লেখা ছিল। চার্টার নির্দিষ্ট সময় অন্তর পুনর্বিবেচনা করা হবে। চার্টারে উল্লিখিত ভৌগোলিক এলাকা পৃথিবীর প্রায় অর্ধেকটা জুড়ে, উত্তমাশা অন্তরীপ থেকে শুরু করে ম্যাগেলান প্রণালী পর্যন্ত বিস্তৃত ১০,০০০ মাইল উন্মুক্ত সমুদ্র, যার বেশিটা সম্বন্ধেই ইউরোপিয়ানদের প্রত্যক্ষ-পরোক্ষ কোনও রকম জ্ঞান নেই।
ফাউন্ডার্স হলের সভায় উপস্থিত সব ব্যবসায়ীরা কিন্তু এই নতুন সংস্থাকে স্বাগত জানায়নি। সংগঠন তৈরি করার ব্যাপারে আগ্রহ থাকলেও একচেটিয়া ব্যাবসার অধিকারে তাদের সায় ছিল না। এদেরই একজন এডওয়ার্ড মিচেলবর্ন দরবারে প্রতিপত্তিশালী ও প্রথম অভিযানের অধিনায়ক পদের ক্যান্ডিডেট। গোলমাল আসন্ন বুঝতে পেরে কোম্পানির মাথারা জোরের সঙ্গে নিজেদের অবস্থান দরবারকে জানাল, ‘ভদ্রলোকদের’ চেয়ে ‘আমাদের মতো গুণমানের লোকেদের’ দিয়ে এই কাজ আরও ভাল করে হবে। শেষ পর্যন্ত তাদের মত বজায় থাকলেও মিচেলবর্নের সঙ্গে যে শত্রুতা শুরু হল তার জের অনেক দূর অবধি গড়ায়। একচেটিয়া ব্যাবসার বিরোধিতাও এই ঘটনা থেকেই দানা বাঁধতে থাকে।
রেড ড্রাগন
ল্যাঙ্কাস্টার ‘গভর্নর’ ও ‘জেনারেল’ দুটো জাঁকালো উপাধিতে ভূষিত হয়ে কোম্পানির প্রথম অভিযানের কর্তার পদ নিলেন। প্রথম অভিযানে মোট পাঁচটা জাহাজ রওনা দেবে। সবথেকে বড় জাহাজ রেড ড্রাগন, ৬০০ টন ওজনের। ২০২ জন নাবিক-যাত্রী নিয়ে যাবে, যাত্রীদের মধ্যে ক্যাপ্টেন স্বয়ং রয়েছেন। প্রধান জাহাজটা বেশ মজবুত এবং সুরক্ষিত, হয়তো ক্রান্তীয় সমুদ্রে যাত্রার জন্যে একটু বেশি বড়। বাকি চারটে জাহাজ হেক্টর, অ্যাসেনশন, স্যুসান ও একটা রসদবাহী ছোট জাহাজ। রেড ড্রাগন বাদ দিলে জাহাজগুলি ছোট আকারের, ২৪০ থেকে ৩০০ টন ওজন। দলে মোট ৩০০ মতো লোকজন।
প্রায় টানা কুড়ি মাস সমুদ্রবক্ষে থাকতে হতে পারে এ রকম ধরে নিয়ে ৬,৬০০ পাউন্ড মূল্যের খাবারদাবার বোঝাই করা হয়েছে। ৪,৫০০ পাউন্ড মূল্যের লোহা, টিন, ব্রডক্লথ বা উলের ঠাসবুনন কাপড় ইত্যাদি সঙ্গে যাচ্ছে। এগুলি বিদেশি রাজাদের উপহার দিয়ে ব্যাবসায় সুবিধা করা হবে এ রকম প্রত্যাশা। এ ছাড়া রানির অনুমতি অনুসারে ৩০,০০০ পাউন্ড মূল্যের সোনা- রুপো প্রথম চারটি অভিযানে পাঠানো যেতে পারে, এই সোনা বা রুপো পণ্যের বিনিময় মাধ্যম হিসেবে ব্যবহার হবে।
প্রথম দিকের এই উদ্যোগগুলিতে প্রত্যাশিত লাভের হার নির্ণয় করা কঠিন কাজ ছিল এবং নাবিকদের মাইনের ব্যাপারটাও একটু ধোঁয়াটে ছিল। প্রধান অফিসারদের প্রাপ্য লাভের উপরে ‘বিল অফ অ্যাডভেঞ্চার’ নামে একটা কমিশন। উদাহরণ পাইলট-মেজর স্যান্ড্রিজের জন ডেভিস, সেই সময়ে সবথেকে নামকরা জাহাজি। ইনি মাইনে পাবেন তিন উপায়ে। ডেভিসের নির্দিষ্ট বেতন অভিযান পিছু মাত্র ১০০ পাউন্ড। কিন্তু অভিযান যদি ১০০ পার্সেন্ট লাভ করে তা হলে ডেভিসের প্রাপ্য ৫০০ পাউন্ড, ২০০ পার্সেন্ট লাভ হলে ১০০০ পাউন্ড, ইত্যাদি। এ ছাড়াও, ডেভিস এবং অন্যান্য অনেক অফিসারদের অনুমতি ছিল একটা বিশেষ পরিমাণ টাকা বিনিয়োগ করে ব্যাবসা করার। এ ক্ষেত্রে সেটা ২০০ পাউন্ড। তার উপরে যা লাভ হবে তার সবটাই ডেভিসের। নাবিক-তথা-সৈন্য ছাড়াও জাহাজের যাত্রীদের মধ্যে ছিল একদল ‘ফ্যাক্টর’, যারা কোম্পানির হয়ে জিনিস কেনাবেচা করবে। তাদের কমিশনকেও বলা হত ‘অ্যাডভেঞ্চার’। কথাটার আক্ষরিক অর্থ ছিল অনিশ্চিত পরিণামের ব্যক্তিগত উদ্যোগ।
কী উপায়ে লাভ করা যেতে পারে সে বিষয়ে নিয়মকানুন পরিষ্কার নয়। লুঠপাট ও ব্যাবসার মধ্যে পার্থক্য সামান্যই। প্রত্যেক নাবিককে প্রস্তুত থাকতে হবে দরকার হলে যুদ্ধ লড়বার জন্যে। যদিও অযথা লড়াইয়ে লেগে যাওয়া শ্রেয় নয়, কিন্তু অপেক্ষাকৃত অরক্ষিত মালবাহী জাহাজ আটকে বা নাবিকদের মারধর করে মাল দখল করায় কোনও দোষ নেই।
১৬০১ সালের ফেব্রুয়ারি মাসের এক সকালে উলিচ ডক থেকে পাঁচটা জাহাজ ছাড়ল। মোটামুটি নির্বিঘ্নে যখন জাহাজগুলি উত্তমাশা অন্তরীপে পৌঁছল তখন স্কার্ভির প্রকোপে নাবিকদের দুর্দশা চরমে এবং পাঁচটা জাহাজ চালানোর মতো লোকবল নেই। ধুঁকতে ধুঁকতে ভারত মহাসাগরে প্রবেশ করে জাহাজ ভাল হাওয়া পেয়ে দ্রুত এগোতে লাগল, কিন্তু ব্যাবসা সম্ভাবনা এখনও দূর অস্ত। অন্তরীপ থেকে ল্যাঙ্কাস্টার সোজা চললেন সুমাত্রার আচে অভিমুখে। ইন্দোনেশিয়ার যেসব দ্বীপে মরিচ বেশি পরিমাণে উৎপাদন হত সেসব দ্বীপের রাজারা ব্যাবসার খাতিরে ইউরোপিয়ানদের সম্মান করত, যদিও ইংরেজ এই তল্লাটে এর আগে দেখা যায়নি। আচের সুলতান ল্যাঙ্কাস্টারকে খাতির করে হাতির পিঠে চাপিয়ে প্রাসাদে নিয়ে গেলেন। ভোজসভার আয়োজন হল, গয়না পরা সুন্দরী মেয়েরা নাচগান করে বিদেশিদের মনোরঞ্জন করল। সব ভাল, কিন্তু মশলা কোথায়? ইংরেজরা বাজারে খোঁজাখুঁজি করে একটু-আধটু মশলা পেল বটে কিন্তু চড়া দামে। শোনা গেল বাজারের মশলার সিংহভাগ পর্তুগিজ ও ডাচরা বায়না করে রেখে দিয়েছে। এ রকম পরিস্থিতিতে ব্যাবসা চালাতে হলে একটা স্থায়ী গুদাম দরকার, যেখানে একটু একটু করে মশলা জমিয়ে একবারে অনেকটা দেশে পাচার করা যায়। আবার প্রতিযোগীদের আক্রমণ থেকে সেই গুদাম রক্ষা করার জন্যে সৈন্যসামন্তও চাই। কিন্তু এ রকম গুদাম তৈরি করার অনুমতি কি পাওয়া যাবে? এর আগে পর্তুগিজদের তরফ থেকে আসা এ রকম প্রস্তাব রাজা উড়িয়ে দিয়েছেন। তবে সমস্যার একটা সমাধান সম্ভব।
কয়েক দিনের আলাপে ল্যাঙ্কাস্টার সুলতানের বেশ বন্ধু হয়ে উঠেছিলেন। এবার তিনি রাজার কাছে অনুমতি চাইলেন আচের জলে পর্তুগিজ জাহাজ দেখলে কি দু’-একটা গোলাগুলি ছোড়া যেতে পারে? রাজা এক শর্তে রাজি হলেন, মারপিট শেষ হলে যেন ইংরেজরা তাঁর হারেমের জন্যে একটি পর্তুগিজ মেয়ে সংগ্রহ করে দেয়। কয়েক দিন ওত পেতে থাকার পরে দেখা পাওয়া গেল এক অতিকায় জাহাজের, মালবোঝাই ৯০০ টন ওজনের জাহাজ ধীরে ধীরে পশ্চিম দিকে চলেছে। কিছুক্ষণ যুদ্ধের পরেই জাহাজ পাকড়াও করা গেল, এবং জাহাজের পেটে স্তূপীকৃত গোলমরিচ ও লবঙ্গ বাজেয়াপ্ত হল। এক সকালের প্রচেষ্টায় ল্যাঙ্কাস্টারের ভাগ্য ফিরে গেল। এবার রাজার কাছে বিদায় নেবার পালা। সেটাও যথোচিত ধুমধাম ও দুঃখপ্রকাশের সঙ্গে সম্পন্ন হল। দুঃখের বিষয়, নাবিক-সৈন্যদের রুক্ষ জগতে রাজার উপযুক্ত কোনও পর্তুগিজ মেয়ে খুঁজে পাওয়া যায়নি।
ল্যাঙ্কাস্টার এবার উত্তরে সুন্ডা প্রণালীর দিকে চললেন, সেদিকে পশ্চিম জাভার সুলতানের রাজ্য। সেখানে অবস্থিত বন্দর ব্যান্টামে ব্যাবসা করার অনুমতি পাওয়া গেল। অন্য সব জায়গার মতোই এখানেও সেই অনুমতির কোনও দাম ছিল না যদি না গুদাম পাহারা দেওয়ার জন্যে বেশ শক্তিশালী একটা নৌবহর বসিয়ে রাখা যায়। ইংল্যান্ডে প্রত্যাবর্তন হয়তো জাহাজডুবি দিয়েই শেষ হত, কারণ অন্তরীপের কাছে প্রচণ্ড ঝড়ে জাহাজের ভয়ানক ক্ষতি হয়। ভাঙাচোরা জাহাজ ফেলে পালানোর প্রস্তাব ল্যাঙ্কাস্টার অগ্রাহ্য করলেন এবং কোনওমতে ঝোড়ো হাওয়া পিছনে ফেলে আটলান্টিকে ঢুকলেন। ১৬০৩ সালের সেপ্টেম্বর মাসে নাবিকরা ইংল্যান্ডে ফিরল। ফিরেই খবর শুনল রানি এলিজাবেথ তাদের অনুপস্থিতিতে মারা গেছেন। এক গোলমরিচই বিক্রি হল দশ লক্ষ পাউন্ড দামে, অন্যান্য জিনিসপত্রের কথা ছেড়ে দেওয়া যেতে পারে। ল্যাঙ্কাস্টার হিরো হয়ে ফিরলেন, আর কোম্পানির গৌরবময় সূচনা হল।
প্রথম অভিযান থেকে ফিরে আসার কয়েক মাসের মধ্যেই প্রতিযোগী মিচেলবর্ন দরবারকে রাজি করিয়ে ফেললেন চিন ও জাপানগামী জাহাজের জন্যে অনুমতি ও বিশেষ সুবিধা পাওয়ার ব্যাপারে। সেই অভিযান সফল হয়নি। ডাচদের সঙ্গে মারামারি ছাড়াও জাপানি সেনা-দস্যুদের আক্রমণে বিরাট ক্ষয়ক্ষতি হয়, পূর্বোল্লিখিত জন ডেভিস সেই আক্রমণে প্রাণ হারান। কিন্তু মিচেলবর্ন একটা ধারা তৈরি করে দিলেন। পূর্বসমুদ্রে কোম্পানি আর কোনও দিন নিশ্চিন্তে ব্যাবসা করতে পারবে না। কোম্পানি যাদের পরে নাম দিয়েছিল ‘ইন্টারলোপার’ বা অনধিকার প্রবেশকারী, তাদের পথিকৃৎ হয়ে ইতিহাসখ্যাত হলেন মিচেলবন।
একটি নতুন ব্যবসায়িক মডেল
পরবর্তী পনেরো বছরে গোলমরিচের উদ্দেশে আরও পনেরোটা অভিযান বেরোয়। অভিযানের উদ্যোগ পর্ব মোটামুটি একটা নিয়মে চলতে শুরু করে। ঝুঁকি কমে আসে, ব্যাবসার সুযোগসুবিধা কোথায় বেশি পাওয়া যেতে পারে সে ব্যাপারে জ্ঞান আরও বাড়ে, আর লুঠপাটের ঘটনা কমে যায়। প্ৰথম দিকে কোম্পানি জাহাজ কিনে ব্যাবসার কাজে চালাত, কিন্তু দেখা গেল জাহাজ নষ্ট হওয়ার ঝুঁকি এত বেশি যে জাহাজ কেনা পোষাচ্ছে না। তখন ডেটফোর্ডে কারখানা ইজারা নিয়ে জাহাজ নির্মাণ শুরু হল। প্রথম দিকের কিছু অভিযানে জাহাজডুবির কারণ সাব্যস্ত হয়েছিল জাহাজের স্বল্প বহর, সেই অনুযায়ী আরও বড় জাহাজ তৈরি হতে থাকল। সবথেকে বড় জাহাজ, যার সাদামাটা নাম ‘বাণিজ্যের বৃদ্ধি’, ১০০০ টন ওজনের। নির্মাণের সাল ১৬০৯। পরে অবশ্য দেখা গেল নিজেরাই কারখানা চালালে ওভারহেড বেশি হয়ে যাচ্ছে, তাই ১৬৩০-এর দশকে ডেটফোর্ড বিক্রি করে দিয়ে কোম্পানি জাহাজ ভাড়া নেওয়া শুরু করে। ততদিনে জাহাজের উৎপাদন অনেক বেড়েছে।
প্রথম অভিযানের সময়ে যাঁরা নেতৃত্ব দিয়েছেন, সেই দলের প্রমুখ লোকজন এখন কোম্পানি পরিচালনা করছেন, যেমন ল্যাঙ্কাস্টার। ফলে কোম্পানির ডিরেক্টরদের মধ্যে একটা গোষ্ঠী গড়ে উঠেছে যাঁদের এশিয়া নিয়ে যথাযথ ধারণা ও সাক্ষাৎ অভিজ্ঞতা আছে। কোম্পানির সংবিধান বা ম্যানেজমেন্ট নিয়ে বিশেষ প্রশ্ন ওঠেনি। ব্যবসায়ী ও লন্ডনের অল্ডারম্যান টমাস স্মিথ ১৬২১ সাল পর্যন্ত প্রধান ডিরেক্টর পদে কাজ চালিয়ে গেছেন। অভিজ্ঞ নাবিক, অর্থাৎ যাদের মধ্যে থেকে জাহাজের ক্যাপ্টেন বেছে নেওয়া যেতে পারে, তাদের সংখ্যাও আগের থেকে অনেক বেড়েছে। আগের প্রজন্মের অনেকে জাহাজের চাকরিতে যোগ দিয়েছে মাইনেপত্র ব্যাপারে কিছুটা অনিশ্চয়তা নিয়ে। কিন্তু ১৬১০-এর দশকে যারা জাহাজি হত তাদের মজুরি ও লভ্যাংশ সম্বন্ধে পাকা ধারণা গড়ে উঠেছে। জাহাজিদের সংখ্যা দ্রুত বেড়েছে, এবং নতুনদের একটা ক্রমবর্ধমান অংশ একাধিক সমুদ্রের ভাষা, অর্থাৎ ডাচ, স্প্যানিশ, আরবি বা পর্তুগিজ, শিখে কাজে যোগ দিচ্ছে। আটলান্টিকের জাহাজি জগৎ থেকে অনেক নামকরা নাবিক ও সেনাধ্যক্ষ এসে যোগ দিয়েছে ভারত মহাসাগরের জগতে। জাহাজগুলিতে ধর্মাচরণ, চিকিৎসা, এমনকী শেক্সপিয়ারের নাটক অভিনয় করার ব্যবস্থা করা হয়েছে। সবথেকে বড় কথা, পুরো উদ্যোগটাই দারুণ লাভজনক। প্ৰথম অভিযান থেকে শেয়ারহোল্ডাররা ডিভিডেন্ড পেয়েছিল ৩০০ পার্সেন্ট, ১৬১৬ সাল পর্যন্ত প্রত্যেক বছরে ডিভিডেন্ডের হার ২০০ পার্সেন্ট ছাড়িয়ে যায়।
তা হলেও প্রথম পনেরো বছর নির্বিঘ্নে কাটেনি। প্রতিকূলতা এসেছে তিন দিক থেকে। এক নম্বর পুঁজি। গোলমরিচের ব্যাবসা অত্যন্ত ঝুঁকিসাপেক্ষ। একটা ব্যর্থ অভিযান কোম্পানিকে দেউলে করে দিতে পারে। টাকা মার যাবে এই ভয়ে অনেক শেয়ারের মালিক তাদের দেয় অর্থের সবটা একবারে দিত না। ফলে প্রত্যেক অভিযানের আগে কোম্পানিকে ঘুরে ঘুরে চাঁদা আদায় করতে হত। দ্বিতীয় সমস্যা বাজার। সাধারণ লোকেদের মধ্যে মরিচের ক্রেতা কম, ক্রেতারা সবাই ধনী পরিবার। প্লেগে ভুগে এদের কয়েক জনের মৃত্যু হলে মরিচের বাজার পড়ে যাওয়ার সম্ভাবনা। তিন নম্বর সমস্যা এসেছিল পৃথক অভিযানের নিয়ম থেকে। পুঁজির স্থিতিশীলতা ছিল না বলেই শেয়ারহোল্ডাররা অনেকগুলি দলে ভাগ হয়ে গিয়েছিল, এক একটা দল এক একটা অভিযানের খরচখরচার দায়িত্ব নিত। বলাবাহুল্য, এই ব্যবস্থার ফলে ডিভিডেন্ড বণ্টনের সময়ে ঝগড়া বেধে যাবার সম্ভাবনা থাকত। কোম্পানি প্রতিষ্ঠানটার প্রতি আনুগত্য প্রায় কোনও গোষ্ঠীরই ছিল না। তা ছাড়া বিদেশে কূটনৈতিক যোগাযোগ বাড়ানো, যেটা সংহতি ও সাধারণ উদ্দেশ্য ছাড়া গড়ে তোলা সম্ভব নয়, সে ব্যাপারেও কোম্পানির কর্মকর্তারা খুব সফল হতে পারেনি। বিদেশে ব্যাবসা গড়ে তোলার দায়িত্ব মোটামুটি পুরোটাই জাহাজিদের উপরে পড়েছে। আর তার কারণে পুরো উদ্যোগের উপরে একটা বিশৃঙ্খলার ভাব এসেছে।
তিনটে সমস্যার সমাধান একসঙ্গে করা যাবে এই উদ্দেশ্যে ১৬১২ সালে কোম্পানিকে যৌথ সংস্থা ঘোষণা করা হল। ৪২৯,০০০ পাউন্ড পরিমাণ মূলধন জোগাড় হল, যা সে যুগে ব্যাবসার ক্ষেত্রে বিপুল টাকা। ফলে ছোটখাটো আঘাতে দেউলে হয়ে যাবার সম্ভাবনা অনেক কমে এল। এখন থেকে সব পলিসি ঘোষণা করবে শুধু উচ্চপদস্থ অফিসার, গভর্নর ও ডেপুটি গভর্নররা। বিদেশে ব্যাবসার স্থায়ী ভিত্তি গড়ে তোলার যে রাজনৈতিক দিকটা, তা নিয়ে জোরদার আলোচনা শুরু হল।
যৌথ মূলধন সংস্থা হয়ে ঘরের কিছু সমস্যা মিটল বটে, কিন্তু বিদেশে এই কয়েক বছরের মধ্যেই জটিল চ্যালেঞ্জ গড়ে উঠেছে। এ পর্যন্ত সবকটা অভিযানই ইন্দোনেশিয়ার মশলা লক্ষ্য করে আয়োজিত হয়েছে। দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার সমুদ্রে পর্তুগিজ বিরোধের মোকাবিলা করা গেছে। কিন্তু ডাচরা এই বাণিজ্যে অনেক বেশি জড়িয়ে, এবং তারা আরও সুসংগঠিত প্রতিদ্বন্দ্বী।
ডাচ কোম্পানি
ডাচ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির জন্ম হয় ইংরেজ কোম্পানির দু’বছর পরে। এই সংস্থা ইংরেজ কোম্পানির থেকে একটু অন্যরকম। এটি তৈরি হয় জাহাজিদের একটা কার্টেল থেকে। জাহাজে স্বত্ব আছে এমন বণিকরা প্রথম মূলধন জড়ো করে এক ম্যানেজমেন্টের আওতায় তাদের কাজকর্ম নিয়ে আসবে ঠিক করে, উদ্দেশ্য ইংরেজ কোম্পানির সঙ্গে পাল্লা দেওয়া। কোম্পানি গঠন প্রক্রিয়া হল্যান্ডে ইংল্যান্ডের তুলনায় কিছুটা আলাদা ছিল। এখানে, প্রদেশগুলি একসঙ্গে জুটে যাবার পরে রাজশক্তি অপেক্ষাকৃত দুর্বল হয়ে পড়ে। ১৫৯৫ ও ১৫৯৯ সালের মধ্যে আমস্টার্ডাম ও রটারডামের বণিকরা যে যতগুলো পারে জাহাজ ভাড়া করে বা কিনে মশলার ব্যবসায়ে ভিড়ে গেছে। ইংরেজদের মতোই এরাও পর্তুগিজদের এড়িয়ে চলতে চেয়েছে, ও সেই উদ্দেশ্যে কিছু ডাচ জাহাজ আরও নিরাপদ কিন্তু লম্বা রাস্তা ধরেছিল। ম্যাগেলান প্রণালী ও দক্ষিণ প্রশান্ত মহাসাগর ঘুরে ইউরোপ থেকে ইন্দোনেশিয়া পৌঁছয় এই পথ। ফলে ইন্দোনেশিয়ার সামুদ্রিক বাণিজ্যের পরিবেশ ও খুঁটিনাটি নিয়ে তাদের জ্ঞান ইংরেজদের থেকে অনেক বেশি। ইংরেজ কোম্পানি পশ্চিম প্রশান্ত মহাসাগরে ডাচদের বিরোধিতার উত্তর দিতে পারেনি। কাজেই তাদের মশলা সংগ্রহ করার জন্যে অন্য উপায় খুঁজতে হল।
যত ইউরোপিয়ান বণিকরা মশলার ব্যাবসায় জড়িত ছিল, সকলেই বুঝত যে এই ব্যাবসা দীর্ঘস্থায়ী করার জন্যে ভারতে একটা আড়ত দরকার। তার প্রধান কারণ, ভারতে তৈরি সুতির কাপড় দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার সব বাজারে বিক্রি হয়। আর দ্বিতীয় কারণ, মশলা-বোঝাই জাহাজদের ভারতে কয়েক মাস দাঁড়াতে হত রসদ সংগ্রহ আর জাহাজ মেরামতের জন্যে। কাজেই, ভারতের বাজারের সঙ্গে ইন্দোনেশিয়ার বাজারের প্রত্যক্ষ যোগ থাকাটা একটা বিরাট সুবিধা। ইংরেজদের দৃষ্টিতে, ব্যান্টামের একটা পার্টনার দরকার। সুরাটের অবস্থান ছিল সব দিক দিয়ে সুবিধাজনক। বন্দর হিসেবে নিরাপদ ও যথেষ্ট বড়, জাহাজ মেরামতের বিশেষ সুবিধা আছে, আর পশ্চিম এশিয়ার সঙ্গে এই বন্দরের ব্যাবসা এত বেশি যে এখানে টাকাপয়সার দাম কম। সমস্যা হল যে সুরাট মোগল সাম্রাজ্যের অঙ্গ, সম্রাটের অনুমতি ছাড়া এখানে ঢোকা যাবে না।