২. অভিজিৎ

২। অভিজিৎ

বেশিদিন বেঁচে থাকলে মানুষকে ভারী একা হয়ে যেতে হয়। সমান বয়সের মানুষ খুঁজে পাওয়া যায় না। আর যদিবা খুঁজে পাওয়া যায় তো যোগাযোগ হয় না।

আমার দাদুকে দেখে সেইটে খুব স্পষ্টভাবে বুঝলাম আমি।

আমার ঠাকুমা অবশ্য দীর্ঘদিন বেঁচে দাদুকে সঙ্গ দিয়ে গেছেন। তবু শেষ অবধি বয়সের কমপিটিশনে তিনি পেরে ওঠেননি। বছর পাঁচ-ছয় আগে আশি বছর পার হওয়ার বেশ কিছুদিন পর তাঁর মৃত্যু হয়। দাদু নব্বই পেরিয়েছেন। খুব বহাল তবিয়তে আছেন বলা যায় না কিন্তু আছেন।

আমাদের বাড়িটা খুবই খাঁ খাঁ করে আজকাল! বাসযোগ্য দুখানা ঘর আছে। পাকা ভিত, ইটের দেওয়াল, ওপরে টিনের চাল। আর উঠোনের দুদিকে আর-দুটো মাটির ঘর। ঠিকমতো লেপা পোঁছা এবং মেরামতি না হলে মাটির ঘর টিকিয়ে রাখা যায় না। এখানে-সেখানে খোঁদল দেখা দেয়, মেঝেয় বড় বড় গর্ত হতে থাকে, রোদে জলে ক্রমাগত সংকোচন-প্রসারণের ফলে ফাটল ধরে। আমাদের মেটে ঘর দুখানার দুর্দশা চোখে দেখলে কষ্ট হয়। ওরই একখানা ঘরে আমি চব্বিশ বছর আগে ভূমিষ্ঠ হই।

পাকা ঘর দুখানা নিয়ে দাদুর বাস। যত রাজ্যের বাজে জিনিসে ঘরদুটো ঠাসা। পুরনো কৌটো, শিশি, খবরের কাগজ, ভাঙা একখানা সাইকেল, কিছু ঘুণে ধরা তক্তা, অকাজের বাঁশের খুঁটি। দাদু কিছুই ফেলে দেননি। বরাবরই তার সঞ্চয়ের দিকে ঝোঁক। তবু সঞ্চয়ের মতো বাড়তি কিছুই তিনি হাতের কাছে পাননি কোনওদিন। যা পেরেছেন রেখেছেন। বাড়িতে মোট এগারোটা নারকোল গাছে সারা বছর অফুরন্ত ফলন। কে খাবে? দাদু নারকোল বেচে দেন। বাঁধা লোক আছে। সে এসে নারকোল ছাড়িয়ে নিয়ে যায়। ছোবড়াগুলো দাদু বস্তা-বোঝাই করে সঞ্চয়ের ঘরে তুলে রাখেন। তার খুব ইচ্ছে রেলে বোঝাই করে আমরা ছোবড়াগুলো কলকাতায় নিয়ে যাই। নারকেলের ছোবড়া নিশ্চয়ই গৃহস্থের কোনও-না-কোনও কাজে লাগে। এ বাড়িতেই একসময়ে ছোবড়ার কত কদর ছিল। গোয়ালে সাঁজাল দেওয়া হত, সন্ধেবেলায় ধূপ জ্বালানো হত, দড়িদড়াও তৈরি হয়েছে একসময়ে। ওই একই মানসিকতার দরুন দাদু গত ত্রিশ বছর ধরে তার যাবতীয় পুরনো জুতো জমিয়ে রেখেছেন। অব্যবহার্য রকমের ঘেঁড়া, বেঁকে যাওয়া সেইসব জুতো কোনওদিনই কারও কাজে আসবে না। তবু আছে।

স্মৃতি তার সঙ্গে বড় লুকোচুরি খেলে আজকাল। সেও এই বয়সেরই গুণে। আর যেটা হয়, কেমন যেন আপনজনদের প্রতি ঠিক আগেকার মতো বুকছেঁড়া টান ভালবাসা থাকে না। বয়সের ইঁদুর এসে মায়ামোহের সুতোগুলো কুটকুট করে কেটে দিয়ে যায়। গাঁয়ের বাড়িতে দাদু এখন একা। নির্ভেজাল একা। তবু তার কোনও হাহাকার নেই। ছেলেমেয়ে বা নাতি-নাতনিদের কেউ এলে খুব যে খুশি হন তা নয়। এলে আসুক। গেলে যাক।

এক মাঝবয়সি মেয়েছেলে আসে রোজ। ঝটপাট দেয়। বিছানা তোলে, পেচ্ছাপের কৌটো ধুয়ে দেয়। সে-ই রান্না করে দিয়ে যায় একবেলা। দুপুরে তার যুবতী মেয়ে এসে বাসন মাজে। সন্ধেবেলা দাদু নিজেই উঠোনে কাঠকুটো জ্বেলে দুধ গরম করে নেন। খই দুধ খেয়ে শুয়ে থাকেন। বেশ অভ্যস্ত হয়ে গেছেন এইভাবে।

নকশাল আন্দোলনের সময় আমাকে একবার পালিয়ে আসতে হয়েছিল দাদুর কাছে। তখন থেকেই আমি তাঁর জীবনযাপনের ধারাটা ভাল করে জানতে থাকি।

সেবার আমাকে দাদুর কাছে বেশ কিছুদিন থাকতে হয়েছিল। ঠাকুমা তখনও বেঁচে ছিলেন। অনেকদিন আমি কলকাতায় ফিরছি না দেখে দাদু আমাকে নানারকম প্রশ্ন করতেন। আমি পরীক্ষায় ফেল করিনি তো? কোনও মেয়ের সঙ্গে লটঘট করে আসিনি তো? ঠাকুমা ধমক দিতেন, নাতিটা এসেছে, অত খতেন কীসের?

আমি দাদুকে আন্দোলনের সোজা কথাটা বোঝাতে চেষ্টা করেছিলাম। কেন আন্দোলনটা হচ্ছে বা কেন হওয়া দরকার। দাদু সেসব বোঝেননি। আসলে সমাজ বা রাষ্ট্রজীবনের সঙ্গে তিনি আর ওতপ্রোত জড়িত নন। কোথায় একটা পার্থক্য ঘটেই গেছে। যেন জেটির থেকে তফাত হওয়া স্টিমার। দেশ কাল আত্মীয়তা সময় সবই এক অস্পষ্টতায় মাখা।

যদিও এই বাড়িতেই আমার জন্ম এবং এই গ্রামটাই আমার জন্মভূমি, তবু প্রকৃত প্রস্তাবে এটা আমাদের দেশ নয়। এই বাড়ি ছিল গণি মিয়ার। আমরা ঢাকা জেলার লোক। দেশভাগের পর আমাদের ঢাকার গাঁয়ের বাড়ির সঙ্গে গণি মিয়ার এই বাড়ি দাদু বদল করে নেন। পাড়াগাঁয়ে বসতি স্থাপনে দাদুর ছেলেমেয়েদের আপত্তি ছিল। কিন্তু দাদু শহরে যেতে চাননি। ভূমি এবং আশ্রয়ের সংজ্ঞা তার কাছে আলাদা। তিনি পরিষ্কার বলে দিলেন, এটা তোমাদের দেশের বাড়ি হিসেবে রইল। তোমরা পালে-পার্বণে আসবে।

সেই সিদ্ধান্ত সঠিক হয়েছিল কি না বলতে পারি না। ছেলেমেয়েরা একে একে বড় হল এবং একে একে চলে গেল। পালে-পার্বণেও বড় একটা কেউ আসে না। দাদু আজ একা বটে, কিন্তু খুব অসুখী তো নন।

জায়গাটা গ্রামের মতো হলেও শহর থেকে খুব দূরে নয়। শহরের স্টেশনে ট্রেন থেকে নেমে মাত্র দুমাইলের মতো বাসে বা রিকশায় আসতে হয়। তারপর কিছুটা হাঁটাপথ। রাস্তাটা যে খুব ক্লান্তিকর তা নয়। অন্তত বছরে এক-আধবার আসতে খারাপ লাগে না। শহরের ভিড়ভাট্টা ছেড়ে প্রকৃতির নির্জনতায় পা দিলে, খারাপ লাগবেই বা কেন?

তবে প্রকৃতি ক্রমে নিকেশ হয়ে আসছে। বাস যেখানে থামে সেই বড় রাস্তায় আগে দোকানপাট তেমন ছিল না। আজকাল হয়েছে। এক-আধটা নয়। সারি সারি বেড়া আর টিনের ঘরে হরেক পসরা। বসতিও বাড়ছে। নির্জনতা সরে যাচ্ছে। গ্রামকে ত্রাণ করতে এগিয়ে আসছে শহরের থাবা। হাঁটা পথটুকু আগে এত নির্জন ছিল যে, দিনের বেলাতেও গা ছমছম করত। এখন কঁচা রাস্তাটা পাকা হয়েছে। পাকা বাড়ি উঠেছে কয়েকটা। একটা ইস্কুল এবং দুটো সরকারি দফতর বসে গেছে। সুতরাং পুরনো দিনের তুলনায় বেশ জমজমাট অবস্থা বলতে হবে।

আমাদের কিছু চাষের জমি ছিল। নতুন ধান উঠলে বাড়িতে উৎসব লেগে যেত। কিন্তু ক্রমে ফসলের খেত নিয়ে বড় গণ্ডগোল দেখা দেয়। ধানকাটা নিয়ে মারপিট, জোর করে ফসল কাটা বা চুরি এমন একটা অশান্তির কারণ হয়ে দাঁড়াল যা দাদুর পক্ষে সামাল দেওয়া মুশকিল। কাজেই উনি জমি বেচে দিলেন। মোট তিন বিঘা জমি নিয়ে আমাদের বাড়ি। এখন ওই তিন বিঘাই সম্বল। কিছু মরশুমি সবজির চাষ হয় মাত্র। শুনতে পাচ্ছি আমাদের ওই তিন বিঘা জমি কেনার জন্যও লোক ঘোরাঘুরি করছে। শহর খুব এগিয়ে আসছে।

আমি পৌঁছলাম ঠিক দুপুরবেলা। তখন দাদুর দুপুরের খাওয়া হয়ে গেছে। মেঘলা আকাশের নীচে একটা গাঢ় ছায়া পড়ে আছে চারধারে। হাওয়া নেই। এখানে-সেখানে জল জমে আছে। রাস্তা থেকে বাড়িতে ঢুকবার পথটায় ভীষণ কাদা। জোড়া জোড়া ইট পাতা হয়েছিল সেই কবে। আজও বর্ষায় বাড়ি ঢুকতে সেই পুরনো ইটে পা ফেলে যেতে হয়। সাবধানে ইটের ওপর পা ফেলে টাল সামলাতে সামলাতে বাড়িতে ঢুকবার সময় দেখলাম দাদু সামনের দাওয়ায় কাঠের চেয়ারটায় বসে খুব সন্দিহান চোখে আমাকে দেখছেন।

প্রথমেই জিজ্ঞেস করলেন, খেয়ে এসেছ তো?

তার উদ্বেগের কারণটা বুঝি। রান্নার লোক চলে গেছে। বাড়িতে মেয়েছেলে কেউ নেই যে বেঁধে দেবে। এ সময়ে উটকো লোক এলে তার ঝামেলা।

বললাম, পারুলদের বাড়িতে খেয়ে নেব।

নিশ্চিন্ত হয়ে মুখের হরতুকিটা এ গাল থেকে ও গালে নিলেন। কারও কথা জিজ্ঞেস করলেন না, কলকাতার খবর জানতে চাইলেন না। যেনবা সেসবের আর প্রয়োজন নেই। তিনি নিরুদ্বেগ ও নির্বিকার থাকতে চান। শুধু জিজ্ঞেস করলেন, কদিন থাকবে?

আমি বললাম, দেখি।

 কুয়োর জলে অঢেল স্নান করে আমি পারুলদের বাড়ি খেতে গেলাম।

আগে থেকে খবর দেওয়ার কোনও দরকার হয় না পারুলদের বাড়িতে। কিছু মুখ ফুটে বলতেও হয় না। অসময়ে গিয়ে হাজির হলেই আপনা থেকেই সব টরেটক্কা হয়ে যায়।

বলাই বাহুল্য পারুল আমার বাল্যসখী এবং প্রেমিকা। আমার বাল্যকাল তো বেশি দূরে ফেলে আসিনি। আমার বয়স মাত্র চব্বিশ। পারুলেরও ওরকমই।

প্রেম কীরকম তা আমি জানি না। পারুলের সঙ্গে আমার সত্যিই প্রেম ছিল কি না তা আজ সুনির্দিষ্টভাবে বলা যায় না। অনেক তর্ক, অনেক বিচার এসে পড়ে। আমি তেমনভাবে কোনওদিন ওর অঙ্গ স্পর্শ করিনি, চুমু খাইনি, ভালবাসার একটি কথাও বলিনি! ইচ্ছেও হয়নি কখনও। তবে প্রেম বলি কী করে? যখন ওর বিয়ে হয়ে যায় তখন খুব ফাঁকা ঠেকেছিল কয়েকদিন। শুধু সেটুকুই কি প্রেম?

প্রথম কবে দুজনের দেখা তা বলতে পারব না। বোধহয় তখন দুজনেই হামা দিই, বিছানায় হিসি করি এবং পরস্পরের সামনে উদোম হতে লজ্জা বোধ করি না। আমরা এক দঙ্গল ছেলেপুলে ঝক বেঁধে এক সঙ্গে বড় হয়েছি। তার ভিতর থেকে আমি আর পারুল কী করে যে আলাদা দুজন হয়ে উঠি সেও স্পষ্ট মনে নেই। তবে খুব শুদ্ধ ও সুন্দর ছিল আমাদের সম্পর্ক। আমি ওদের বাড়ি গেলে পারুল খুশি হত, ও এলে আমি। নিঃশব্দে দুটি হৃদয়ের স্রোত পাশাপাশি বইছিল। জল একটু চলকালেই হয়ে যেত একাকার।

স্কুলের গণ্ডি ডিঙিয়েই আমি কলকাতায় দৌড়ালাম। পারুল রয়ে গেল। আমার কাছে আজও পারুলের বিস্তর চিঠি জমে আছে। ভুল বানান, খারাপ হাতের লেখা, তবু নিজের হৃদয়কে সে প্রকাশ করত ঠিকই। লিখত কলকাতা বুঝি খুব ভাল? আর আমি খারাপ? যেন কলকাতার সঙ্গেই ছিল তার অসম লড়াই।

ঠাকুমা মারা যাওয়ার পর তার শ্রাদ্ধে যখন আমরা আসি তখনই শেষবারের মতো কুমারী পারুলের সঙ্গে দেখা।

একদিন আমতলায় খড়ের গাদির পিছনে নিরিবিলি কথা হল।

পারুল বলল, আমি তোমার ওপর রাগ করেছি।

 কেন?

করেছি ইচ্ছে হয়েছে। আসতে চাও না কেন এখানে?

এখানে এসে কী হবে? আমি পড়ছি যে কলকাতায়।

আর কত পড়বে?

অনেক পড়া।

আমি বুঝি কেবল হাঁ করে বসে থাকব?

আমি কী করব বলল তো?

এত লম্বা হয়েছ কেন? তোমাকে চেনাই যায় না।

লম্বা হওয়ারই তো কথা।

 তা বলে এতটা ভাল নয়। ভীষণ অন্যরকম হয়ে গেছ।

মানুষ তো বয়স হলে বদলে যায়।

আমি বদলেছি?

 খুব।

কীরকম বদলেছি?

তুমিও লম্বা হয়েছ।

সুন্দর হইনি তো?

বাঃ, তুমি তো দেখতে ভালই।

তোমার চেহারাটা খুব চালাক-চালাক হয়ে গেছে কেন বলো তো!

তবে কি বোকা-বোকা হওয়ার কথা ছিল?

তা নয়। বলে একটু লজ্জা পেল পারুল। যুবতী বয়সের একটা চটক প্রায় সব মেয়েরই থাকে। পারুলেরও আছে। কিন্তু তা বলে পারুলকে সুন্দর বললে ভুল হবে। যদি কলকাতায় না হয়ে এই গ্রামেই থাকর্তামা  তাহলে পারুলকে আরও অনেক বেশি সুন্দর মনে হত। কিন্তু আমি যে শহরে নিত্যদিন বহু সত্যিকারের সুন্দর মেয়ে দেখি।

অবশ্য শুধু সৌন্দর্যটাই কোনও বড় কথা নয়। পারুল বড় ভাল মেয়ে। শান্ত, ধীর, লাজুক, বুদ্ধিমতী। তার হৃদয়টি নরম। আজকাল মনে হয়, তার সঙ্গে বিয়ে হলে আমি সুখীই হতাম। কিন্তু আমাকে বিয়ের জন্য আরও কিছুকাল অপেক্ষা করতে হবে, যদি আদপেই করি। পারুল ততদিন অপেক্ষা করতে পারত না। তার বয়স হয়ে যাচ্ছিল।

তবু আশা করেছিল পারুল। খুব আশা করেছিল। কিন্তু আমি কোনও অসম্ভব প্রস্তাব তো করতে পারি না। আমাদের পরিবারের অর্থনৈতিক অবস্থা খুব ভাল নয়। আমার তখন মাত্র আঠারো-উনিশ বছর বয়স। স্বপ্ন দেখার পক্ষে সুন্দর বয়স, কিন্তু দায়িত্ব নেওয়ার মতো বয়স সেটা নয়। তার ওপর বর্ণ আলাদা। সেটা নিয়েও কিছু ঝামেলা হতে পারত। শহরে বাস করার ফলে আমার বাস্তব বুদ্ধি কিছু বেড়ে থাকবে।

পারুলদের অবস্থা বেশ ভাল। ওরা জাতে গোপ। বংশগত বৃত্তি ওরা কখনও ছাড়েনি। বাড়ির পিছন দিকে সেই আমতলার ধারেই মস্ত উঠোন ঘিরে টানা গোশালা। অন্তত কুড়ি-পঁচিশটা গোরু মোষ। দুধ বিক্রি তো আছেই, উপরন্তু শহরের বাজারে এবং রেল স্টেশনে রমরম করে চলছে দুটো মিষ্টির দোকান। আমাদের মতো ওরাও এসেছিল তখনকার পূর্ব-পাকিস্তান থেকে। কিছু কষ্টেও পড়েছিল বটে, কিন্তু সামলে গেছে। এখনও ওদের বাড়িতে ঢুকলে সচ্ছলতার সুস্পষ্ট আভাস পাওয়া যায়। মস্ত জমি নিয়ে বসত। অন্তত গোটা তিনেক একতলা এবং দোতলা কোঠাবাড়ি। একান্নবর্তী পরিবার অবশ্য ভাঙছে ভিতরে ভিতরে। তবে বাইরে থেকে অতটা বোঝা যায় না।

পারুলের মাকে আমি ফুলমাসি বলে ডাকি। ফরসা গোলগাল আহ্লাদি চেহারা। একটু বেঁটে।

 খবর পেয়েই বেরিয়ে এসে বললেন, আয়। কালও তোদের কথা ভাবছিলাম।

 কী ভাবছিলে?

এমনি ভাবছিলাম না। রাতে একটা বিশ্রী স্বপ্ন দেখলাম তোর মাকে নিয়ে। শানুদি ভাল আছে তো?

আছে। স্বপ্নের কোনও মানে হয় না কিন্তু।

 সে হয়তো হয় না। তবে মনটা কেমন করে যেন।

পারুল কি শ্বশুরবাড়ি?

তাছাড়া আর কোথায়?

বারফট্টাই নেই বলে এদের ঘরে আসবাবপত্র বেশি থাকে না। যা আছে তাও তেমন চেকনাইদার নয়। সাদামাটা সাবেকি খাট, চৌকি, চেয়ার, আলমারি, দেয়াল-আয়না, সস্তা বুক র‍্যাক।

পারুলের সঙ্গে আমার সম্পর্কটা দুবাড়ির সকলেই জানত। ফুলমাসির সমর্থনও ছিল। সম্ভাব্য জামাই হিসেবে উনি আমাকে একটু বাড়াবাড়ি রকমের যত্নআত্তি করতেন। সেই অভ্যাসটা আজও যায়নি। ঘণ্টাখানেকের মধ্যেই বেশ বড় রকমের আয়োজন করে ফেললেন।

আমি মৃদু হেসে বললাম, ফুলমাসি, যাদের ভাল করে খাওয়া জোটে না তাদের ভাল খাইয়ে অভ্যাস খারাপ করে দেওয়াটা খুব অন্যায়।

খুব পাকা হয়েছিস, অ্যাঁ? পেট ভরে খা তো।

পেট ভরে খাব না কেন? আমার তো চক্ষুলজ্জার বালাই নেই। তবে ভাল ভাত বা তেঁতুল পান্তা দিলেও পেট ভরেই খেতাম, এত আয়োজন করার দরকার ছিল না।

আচ্ছা, এর পর পান্তাই দেব। এখন খা। তুই নাকি শিবপ্রসাদ হাই স্কুলে চাকরি পেয়েছিস?

কে বললে?

 পারুলের বাবা বলছিল।

গণেশকাকা? গণেশকাকাই তো আমাকে চিঠি লিখে আনিয়েছে। শিবপ্রসাদ হাই স্কুলে লোক নেবে খবর দিয়ে।

তুই ওর চিঠি পেয়ে এসেছিস? দেখ কাণ্ড! আমাকে বলল অভির চাকরি হয়েই গেছে।

না গো মাসি। শহরে নেমেই আগে স্টেশনের কাছের দোকানটায় গিয়ে গণেশকাকার সঙ্গে দেখা করেছি। শুনলাম দুজন লোক নেবে, অ্যাপলিক্যান্ট ছ’শরও বেশি।

বলিস কী?

গণেশকাকা আমাকে চিঠি লিখে আনিয়ে এখন ভারী অস্বস্তিতে পড়েছেন।

তোর কি তাহলে হবে না?

হওয়ার কথা তো নয়। তবে গণেশকাকা একজনকে মুরুব্বি ধরেছেন। অ্যাসিস্ট্যান্ট হেডমিসট্রেস। অসীমা না কী যেন নাম।

ও, সেই শুঁটকি! ওকে ধরলে কি কাজ হবে? ওর বরটা বরং করে দিতে পারে।

ও বাবা, আমি অত ধরাধরিতে নেই।

তা সে তুই কেন ধরতে যাবি! যে তোকে আনিয়েছে সেই ধরবে।

শুঁটকির বরটা কে?

ফুলমাসি মুখটা সামান্য ঘুরিয়ে নিয়ে বলেন, বর আসলে নয়। বিয়ের কথা চলছে। লোকটা ভাল নয়। আগের বউটাকে গলা টিপে মেরেছে।

তবে তো শাহেনশা লোক।

লোক খারাপ, তবে চাকরিটা করে দিতে পারে।

কলকাতা ছেড়ে আসার ইচ্ছে আমার খুব একটা নেই। সেখানে কর্মহীন দিন আমার অকাজে কাটে বটে, কিন্তু বোজ মনে হয়, চারদিকে এই যে এক অন্তহীন শহর, এত অফিসবাড়ি, এত দোকানপাট, এত ব্যাবসা বাণিজ্য, হয়তো একদিন এ শহর দুম করে একটা সিংহদুয়ার খুলে দেবে সৌভাগ্যের। কলকাতায় কত ভিখিরি রাজা বনে গেছে। কলকাতায় থাকলে এই সুখস্বপ্নটা দেখতে পারি। কিন্তু মফস্বল শহরে স্বপ্নের কোনও সুযোগ নেই। মনমরা, চোখবোজা হয়ে পড়ে আছে লক্ষ্মীছাড়া এইসব শহর। এদের রসকষ সব টেনে নিয়েছে কলকাতা। এগুলো শুধু বকলমে শহর। মানুষ আর বসতি বাড়ছে বটে, কিন্তু বাড়ছে না অর্থনীতি। তাই এখানে মাস্টারির চাকরিতে আমার তেমন আগ্রহ নেই। হলে ভাল, না হলে ফের স্বপ্ন দেখার শহরে ফিরে যাব।

আমি তাই ফুলমাসিকে বললাম, অত কিছু করতে হবে না। লোকটাকে নিশ্চয়ই আরও অনেক ক্যান্ডিডেট ধরাধরি করছে। তারা হয়তো স্থানীয় লোক। চাকরি তাদেরই কারও হয়ে যাবে। আমাকে দেবে না। খামোকা এর জন্য একটা বাজে লোককে ধরাধরি করতে গিয়ে গণেশকাকা নিজের প্রেস্টিজ নষ্ট করবেন কে?

বাজে লোক তো ঠিকই। কিন্তু ভাল লোকই বা পাচ্ছিস কোথায়! সব জায়গায় খারাপ লোগুলোই মাথার ওপর বসে আছে।

সেই জন্যই আমাদের হচ্ছে না। হবেও না।

নাই যদি হয় তবে পারুলের বাবাকে আমি খুব বকব। খামোকা তোকে ভরসা দিয়ে টেনে আনল কেন?

সে তো তুমি সবকিছুর জন্যই সবসময়ে গণেশকাকাকে বকো। তোমাদের কোনও গাই এঁড়ে বিয়োলেও নাকি গণেশকাকার দোষ হয়।

ফুলমাসি একটু হেসে করুণ গলায় বললেন, তা আমি আর কাকে বকব? আর কেউ তো আমার বকুনিকে পাত্তা দেয় না।

সব ব্যাটাকে ছেড়ে দিয়ে বেঁড়ে ব্যাটাকে ধর। তাই না? মেয়েদের একটা দোষ কী জানো ফুলমাসি? যত রাগ আর ঝাল ঝাড়বার জন্য তারা স্বামী বেচারাকে ঠিক করে রাখে। আমার মাকেও তো দেখেছি। একবার কোনও বান্ধবীর সঙ্গে সিনেমায় গিয়ে ঝড় বৃষ্টিতে মা আটকে পড়েছিল। ফিরতে খুব ঝঞ্ঝাট পোয়াতে হল। বাড়িতে পা দিয়েই বাবাকে নিয়ে পড়ল, সব তোমার দোষ। আমরা তো অবাক। ঝড় বৃষ্টি বাবা নামায়নি, সিনেমাতেও বাবা সঙ্গে যায়নি, তবে বাবার দোষ মা কী করে বের করবে! আমরা খুব ইন্টারেস্ট নিয়ে ঝগড়া শুনতে লাগলাম। আশ্চর্য কী জানো? মা কিন্তু ঠিক মিলিয়ে দিল। গোঁজামিল অবশ্য, কিন্তু ওই ঝড়-বৃষ্টি, দেরি হওয়া সব কিছুর দায়ভাগ বাবার কাঁধে চাপান দিয়েও ছিল। বাবাও তেমন উচ্চবাচ্য করল না।

ফুলমাসি মৃদু মৃদু হাসছিলেন। বললেন, আর পুরুষরাই ছেড়ে কথা কয় কিনা। রামকৃষ্ণ ঠাকুর নাকি মাঝে মাঝে ফোঁস করার কথা বলেছেন। তা সেইটে বেদবাক্য বলে মেনে নিয়ে আজকাল সর্বদাই কেবল ফোঁস ফোঁস করে যাচ্ছেন।

হাসাহাসি দিয়ে খাওয়াটা শেষ হল।

আজকাল হাসি বড় একটা আসতে চায় না। চব্বিশ বছর বয়সেই আমি কি একটু বেশি গোমড়ামুখো হয়ে গেছি?

বাড়ি ফিরতেই দাদু জিজ্ঞেস করলেন, খেলে?

হ্যাঁ।

কী রান্না করেছিল?

ইলিশ মাছ।

 দাদুর স্তিমিত চোখ একটু চকচক করে উঠল, ইলিশ ওঠে বুঝি বাজারে?

তা আমি কী করে বলব? ওঠে নিশ্চয়ই, নইলে ওরা পেল কোথা থেকে?

দাদু মাথা নেড়ে বললেন, এখানকার বাজারে ওঠে না। গণেশ শহর থেকে আনে।

 কেন, তুমি খাবে? খেলে বোলো, এনে দেব।

না, এখানকার ইলিশ খেতে মাটি-মাটি লাগে। দেশের ইলিশের মতো স্বাদ না। ইলিশের ডিমভাজা করেছিল নাকি?

না।

ইলিশের ডিমভাজা একটা অপূর্ব জিনিস। মুখের হরতুকিটা এ গাল ও গাল করতে করতে দাদু মনে মনে বহু বছরের পথ উজিয়ে ফিরে যাচ্ছেন দেশে। ভজালী নৌকোর পালে আজ হাওয়া লেগেছে। চোখদুটো কেমন ঘোলাটে, আনমনা।

দুপুরে আমার ঘুম হয় না। পশ্চিমের ঘরের চৌকিতে শুয়ে বুক বরাবর জানলা দিয়ে বাইরের মেঘলা আকাশের দিকে হাঁ করে চেয়েছিলাম।

একটা নারকেল গাছ ঝুপসি মাথা নিঝুম দাঁড়িয়ে আছে। ভারী একা দেখাচ্ছে তাকে। কালো মেঘের একটা ঘনঘোর স্তর থমথমিয়ে উঠছে দিগন্তে। নিজেকে ভারী দুঃখী, ভারী কাতর বলে মনে হয়।

বাইরে একটা সাইকেল এসে থামল। শব্দ পেলাম। দাদুর সঙ্গে কে একজন কথা বলছে। আস্তে বললেও শোনা যাচ্ছিল।

আগন্তুক বলল, কিছু ঠিক করলেন নাকি দাদা?

কী আর ঠিক করব বলো।

পনেরো হাজার নগদ আগাম দিয়ে দিচ্ছি। লেখাপড়া থাকবে। আপনি যতদিন বাঁচবেন এই ঘর দুখানা, উঠোন আর কুয়োতলায় আমরা হাত দেব না। আপনি মরার পর আমরা পুরোটা দখল নেব।

দাদু একটু চটে উঠে বললেন, রোজ এসে আমাকে মরার কথা বলো কেন?

 লোকটা বোধহয় একটু থতমত খেয়ে বলে, আজ্ঞে না। মরার কথা ঠিক বলি না। থাকুন না বেঁচে যতদিন খুশি। তবে মরতে তো একদিন সকালেই হবে। তখনকার কথা বলছিলাম আর কী।

তোমার হাবভাব দেখে মনে হয় যেন তাড়াতাড়ি মরার জন্য হুড়ো দিচ্ছ।

কী যে বলেন দাদা! এই বয়সেও আপনার চমৎকার স্বাস্থ্য। অনেকদিন বাঁচবেন।

 এ জমি নিয়ে তোমরা করবে কী?

আজ্ঞে সে পারিজাতবাবু জানেন। করবেন কিছুমিছু। এক লপ্তে একটু বেশি জমি তো পাওয়া মুশকিল।

দাদু বললেন, আমি শুনেছি এদিকে নাকি সরকারের তরফ থেকে কী সব উন্নতি-টুন্নতি হবে। তাই এখন আর কেউ জমি বেচছে না। দাম বাড়ার আশায় চেপে বসে আছে।

লোকটা ব্যস্ত হয়ে বলল, সে এদিকে না। রাস্তার ওধারটায় শুনেছি সরকারের কী সব করার প্ল্যান আছে।

দাদু এই বয়সেও কূটনৈতিক বুদ্ধি হারাননি। বললেন, তা ওদিকটা হলে কি আর এদিকটাও বাকি থাকবে?

তা বলতে পারি না। তবে দু-চার হাজার টাকা বেশি দাম দিতে বোধহয় পারিজাতবাবু পিছোবেন না। কিন্তু আপনি তো দরই বলছেন না।

দাঁড়াও, আগে বেচব কি না ভেবে দেখি।

সে তো অনেকদিন ধরে বলছি আপনাকে। একটু ভেবে ঠিক করে ফেলুন।

দাদু বোধহয় হরতুকির টুকরোটাকে আবার অন্য গালে নিলেন। তারপর বললেন, ব্যাপার কী জানো, এ জমিটুকু বেচে দিলে আমার ছেলেগুলো আর নাতি-নাতনিদের আর দেশের বাড়ি বলে কিছু থাকবে না।

সে তো এমনিতেও নেই। তারা সব কলকাতায় বসে ঠ্যাং নাচাচ্ছে, আর আপনি বুড়ো মানুষ একলাটি পড়ে আছেন এখানে। আপনি চোখ বুজলে তো এখানে ভূতের নেত্য হবে।

দাদু হতাশ গলায় বললেন, না, তুমি দেখছি আমাকে না মেরেই ছাড়বে না। লোকটা তাড়াতাড়ি বলল, মরার কথা বলিনি, বাস্তব অবস্থাটা বোঝাতে চাইছিলাম।

দাদু বললেন, বাস্তব অবস্থাটা আমিও কি আর বুঝি না? এ বাড়িতে আর কেউ না থাক গাছপালাগুলো তো আছে। সেগুলোর মায়াই কি কম! চট করে বেহাত হতে দিই কী করে?

গাছপালায় কেউ হাত দেবে না। যেমন আছে তেমনই থাকবে না হয়।

সে তুমি এখন বলছ। জমি রেজিষ্ট্রি হয়ে গেলেই অন্যরকম। যে টাকা ফেলে জমি কিনছে সে কি আর বুড়ো মানুষের মুখ চেয়ে হাত গুটিয়ে বসে থাকবে? পারিজাত অত ভাল মানুষ নয়।

আচ্ছা, বায়নানামাটা অন্তত করে রাখতে দিন।

তুমি বরং সামনের শুক্কুরবার এসো।

 কতবার তো ঘুরে আসতে বললেন। আমিও এসে ঘুরে ঘুরে যাচ্ছি। শুক্রবার কিন্তু দাদা কথা দিতে হবে।

এত তাড়া কীসের বলো তো! একটু রয়ে বয়ে যোক না।

লোকটা বলল, দেরি করলে আবার সব কেটে যাবে যে। জমি আপনার নামে। কিন্তু আপনার অবর্তমানে আপনার তিন ছেলে আর দুই মেয়ে ওয়ারিশান। তখন আবার সকলে এককাট্টা না হলে জমি হস্তান্তর হবে না। ঝামেলাও বিস্তর।

দাদু এবার একটু ঘেঁকিয়ে উঠে বললেন, শুক্কুরবার অবধি আমি বর্তমানই থাকব।

লোকটা শশব্যস্ত বলল, না, না, সে তো ঠিকই। তাহলে ওই পাকা কথা বলে ধরে নিচ্ছি। শুকুরবার না হয় বায়নার টাকাটাও নিয়ে আসব।

আবার সাইকেলের শব্দ পেয়ে আমি ঘাড় উঁচু করে লোকটাকে দেখার চেষ্টা করলাম। মুখটা দেখা গেল না। তবে বেশ দশাসই চেহারা।

উঠে দাদুর কাছে এসে বসলাম সামনের বারান্দায়।

 লোকটা কেন এসেছিল দাদু? বাড়িটা কি তুমি বেচে দেবে?

দাদু একটু বিব্রতভাবে বললেন, না বেচেই বা কী হবে?

আমার এখানে একটা চাকরি হওয়ার কথা চলছে। যদি হয় তবে আমার ইচ্ছে ছিল এ বাড়িতে থেকেই চাকরি করি।

চাকরি? কীসের চাকরি?

 মাস্টারি।

ও বলে দাদু কিছুক্ষণ চুপ করে থাকেন। তারপর আমার দিকে চেয়ে বলেন, সত্যিই থাকবি নাকি?

যদি চাকরি পাই।

দাদু যেন কথাটায় বেশি ভরসা পেলেন না। বললেন, রোজই লোক আসে। তবে আমি কাউকে কথা দিইনি।

বিকেলে পারুলদের বাড়ি থেকে একটা সাইকেল চেয়ে নিয়ে শহরে রওনা হলাম। আজ বিকেলেই অসীমা দিদিমণির সঙ্গে দেখা করার কথা। গণেশকাকা নিয়ে যাবেন।

পথে ঝিরঝিরে একটু বৃষ্টি হয়ে গেল! ভিজলাম। আকাশ জমাট মেঘে থম ধরে আছে। রাত্রে প্রচণ্ড বৃষ্টি হতে পারে।

গণেশকাকার দোকানে সাইকেল রেখে দুজনে রিকশা নিলাম। যেতে যেতেই জিজ্ঞেস করলাম, আমাদের গাঁয়ের ওদিকে স্যাটেলাইট টাউনশিপ হচ্ছে বলে কিছু শুনেছেন?

গণেশকাকা বললেন, কত কিছুই তো হবোহবো হয়। দেখা যাক শেষ অবধি। তবে শুনেছি হচ্ছে।

আজ একজন লোক আমাদের বাড়িটা দিবার জন্য এসেছিল।

 কে বল তো!

তা জানি না। শুনলাম পারিজাতবাবুর লোক।

গণেশকাকা সরল সোজা মানুষ। নামটা শুনেই জিব কেটে বললেন, ও বাবা, সেই তো স্কুলের সেক্রেটারি।

শুনে বুকটা হঠাৎ দমে গেল। বললাম, নোকটা কেমন?

ভাল তো কেউ বলে না। তবে টাকা আছে, ক্ষমতা আছে। আজকাল ওসব যার আছে সেই ভাল।

এ লোকটাই কি তার বউকে খুন করেছিল?

 লোকে তো তাই বলে। তোকে কে বলল?

ফুলমাসি।

গণেশকাকা একটু চুপ করে থেকে বলল, পারিজাত অনেকদিন ধরেই তোদের বাড়ি কিনতে চাইছে। তোর দাদু অবশ্য রাজি হয়নি।

আমার মনটা খারাপ লাগছিল। স্কুলের চাকরিটা আমার হবে না জানি। তবু তো আশার বিরুদ্ধেও মানুষ আশা করে। এখন পারিজাতবাবু যদি জানতে পারেন যে জমিটা আমাদের এবং আমরা বেচতে রাজি নই তবে হয়তো চটে যাবেন, আর আমার চাকরিটাও হবে না।

বিচিত্র এই কার্যকারণের কথা ভাবতে ভাবতে আমি বললাম, অসীমা দিদিমণির কি চাকরির ব্যাপারে সত্যিই হাত আছে?

দেখাই যাক না।

পারিজাতবাবু লোকটা কে? আগে নাম শুনিনি তো!

এখানকার লোক নয়। উড়ে এসে জুড়ে বসেছে।

অসীমা দিদিমণির জন্য তাদের বাইরের ঘরে আমাদের অনেকক্ষণ বসে থাকতে হল। উনি এখনও ফেরেননি। আমার হাই উঠছিল। গণেশকাকা কেমন যেন শ্রদ্ধার সঙ্গে জবুথবু হয়ে বসেছিলেন। যেন এইসব শিক্ষিতজনের ঘরবাড়ি আসবাবপত্রকেও সমীহ করতে হয়।

গণেশকাকাকে আমি কাকা ডাকি, অথচ তার বউকে মাসি। কেন ডাকি তা নিয়ে অনেকক্ষণ ভাবলাম। কোনও সূত্র পেলাম না। ছেলেবেলা থেকেই ডেকে আসছি, এইমাত্র। পারুলের সঙ্গে আমার বিয়ে হলে অবশ্য সম্পর্ক এবং ডাক পালটে যেত। ফুলমাসিকে মা বলে ডাকতে অসুবিধে হত না, কিন্তু গণেশকাকাকে গাল ভরে বাবা ডাকতে পারতাম না নিশ্চয়ই। পারুলের শ্বশুরবাড়ি এই শহরেই। আমি কখনও যাইনি। কালেভদ্রে দেশের বাড়িতে এলেও আমি পারুলের শ্বশুরবাড়িতে যাই না ভয়ে। যদি ওরা কিছু মনে করে?

এইসব ভাবতে ভাবতেই অসীমা দিদিমণি ঘরে ঢুকলেন। তটস্থ গণেশকাকা উঠে হাত কচলাতে লাগলেন। মুখে একটু নীরব হেঁ-হেঁ ভাব।

অসীমা দিদিমণির মতো এরকম বিষণ্ণ চেহারার মহিলা আমি খুব কম দেখেছি। চেহারাটা রুক্ষ এবং শুকনো। কিন্তু সেটা বড় কথা নয়। ওঁর চোখমুখ যেন গম্ভীর হতাশা, গভীর ক্লান্তি এবং ব্যর্থতার গ্লানিতে মাখা। একটুও হাসির চিহ্ন নেই কোথাও। আমার পরিচয় পেয়ে গভীর দৃষ্টিতে কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইলেন আমার দিকে। কিন্তু মনে হচ্ছিল, আমাকে নয়, উনি মনের মধ্যে অন্য কোনও দৃশ্য দেখছেন।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *