২. অবরোধ তীব্র আকার

অবরোধ তীব্র আকার ধারণ করল। মুজাহিদরা শহরে তীর নিক্ষেপ শুরু করল। কিন্তু একটি সমস্যা দেখা দিল। তা হল কেল্লার পাঁচিল এতো উঁচু যে, তার উপর দিয়ে গিয়ে অগ্নিতীর লক্ষ্যে পৌঁছছে না। খুঁজে একটি উঁচু জায়গা পাওয়া গেলো। মুজাহিদরা সেখানে অবস্থান নিয়ে অগ্নি তীর নিক্ষেপ শুরু করল। কেউ কেউ উঁচু গাছের মগডালে উঠে সেখান থেকে অগ্নি তীর নিক্ষেপ করছে। কিন্তু কেল্লার ভিতরের মানুষের ঘরবাড়ি কেল্লার পাঁচিল থেকে দূরে। তাই অগ্নিতীর তেমন ফলপ্রসূ হচ্ছে না।

যারা গাছের মগডালে চড়ে অগ্নিতীর নিক্ষেপ করছে, তাদের একজন হঠাৎ দেখতে পেল, কেল্লার ভিতরে একদিকে সারি সারি তাঁবু দেখা যাচ্ছে। অবশ্য সে দিকে পাচিলের নিকেট কোন উঁচু স্থান নেই। কোন গাছও নেই। তবে সেদিকের তাঁবুগুলো একেবারে কেল্লার পাঁচিল পর্যন্ত বিস্তৃত। বিভিন্ন কবিলা থেকে আগত খ্রিস্টান যোদ্ধারা এখানে তাঁবু স্থাপন করে অবস্থান নিয়েছে। অবশ্য এর ব্যবস্থাপনায় ছিল এ শহরের প্রশাসনিক কাজে নিয়োজিত বন্দী মুসলমানরা। তারাই তাদের থাকার জন্য এ উন্মুক্ত প্রান্তরে ব্যবস্থা করে দিয়েছেন।

সে সাথে সাথে দৌড়ে গিয়ে এ সংবাদ সালারদের নিকট পৌঁছে দিল। বলল, যদি সেদিক থেকে অগ্নিতীর নিক্ষেপ করা হয় তাহলে তা পাঁচিলের উপর দিয়ে গিয়ে তাঁবুর উপরে পড়বে।

খালিদ ইবনে ওলীদ (রা.) ও ইয়ায ইবনে গানাম (রা.) সংবাদ পেয়ে সেই গাছের নিকট গেলেন এবং তার মগডালে চড়ে স্বচক্ষে সবকিছু পর্যবেক্ষণ করলেন। গাছ থেকে নেমে এসে খালিদ (রা.) বললেন, ইবনে গানাম! আল্লাহর শপথ করে বলছি, যদি আমরা শহরে একটা আতঙ্ক সৃষ্টি করতে পারি, শহরবাসীদের অন্তরে ভয় সঞ্চারিত করতে পারি, তাহলে মনে করবে, আমরা অর্ধেক বিজয় লাভ করে ফেলেছি।

ইয়ায ইবনে গানামের মনে আত্মবিশ্বাস পরিস্ফুট। বললেন, সিপাহ সালার! আল্লাহর দয়া ও অনুগ্রহে আমরাই বিজয় লাভ করব। ইনশাআল্লাহ্। কেউ তা রোধ করতে পারবে না। শহরে কোন সৈন্য নেই। শহরবাসীদের মাঝে চরম অস্থিরতা বিরাজমান। আমার মাথায় একটি বুদ্ধি এসেছে, আমরা তাদেরকে প্রবঞ্চনায় ফেলব যে, আমরা অবরোধ তুলে নিচ্ছি। কিন্তু হঠাৎ করেই তা করা যাবে না। প্রথমে অশ্বারোহী বাহিনীর দুচারটি দলকে সরিয়ে নেয়া হোক। তারপর আমাদের তৎপরতা বন্ধ করে দেয়া হোক। এতে শহরের লোকেরা বুঝবে, আমরা অবরোধে ব্যর্থ হয়ে ফিরে যাচ্ছি।

খালিদ ইবনে ওলীদ (রা.) তখন ঘোড়ায় সাওয়ার ছিলেন। অন্য ঘোড়ায় ছিলেন ইয়ায ইবনে গানাম (রা.)। উভয়ের ঘোড়া ধীর পদবিক্ষেপে চলছে। পাশাপাশি চলছে। খালিদ ইবনে ওলীদ (রা.) ইয়ায ইবনে গানাম (রা.)-এর কথা শুনে ঘোড়ার বাক টেনে ধরলেন। ইয়ায ইবনে গানাম (রা.)-এর পিঠ চাপড়ে বললেন, ইবনে গানাম! তুমি আমাকে বিজয়ের এক আলোক রশ্মি দেখালে। এসো, নিবিড়ে কোথাও বসি এবং কিভাবে তাদের প্রবঞ্চনা দেয়া যায় তা চিন্তা করি।

খালিদ ইবনে ওলীদ (রা.) গাছ ও উঁচু স্থানের তীরন্দাজদের ডেকে একত্রিত করলেন। তারপর তাদের নিয়ে শহরের ঐ প্রান্তে গেলেন যেখানে সারি সারি তবু স্থাপন করা হয়েছে। তারপর তাদের কেল্লার পাঁচিলের থেকে বেশ দূরে দাঁড় করালেন। এখানে পাঁচিল থেকে নিক্ষিপ্ত তীর এসে পৌঁছে না। তারপর অগ্নিতীর নিক্ষেপের নির্দেশ দিলেন। দেখলেন, তীরগুলো পাঁচিল অতিক্রম করে যায় না। তারপর তিনি কি যেন চিন্তা করলেন এবং একজন দুঃসাহসী অশ্বারোহী তীরন্দাজকে ডেকে কি যেন বললেন। অশ্বারোহী সাথে সাথে তৈরী হয়ে গেল। চোখের পলকে অশ্ব ছুটিয়ে পাঁচিলের নিকট পৌঁছেই ধাবমান অশ্বের উপর থেকে অগ্নিতীর নিক্ষেপ করতে করতে নিরাপদে চলে এল। কেল্লার উপর থেকে তার উপর অসংখ্য তীর বর্ষিত হলেও সে নিরাপদেই ফিরে এসেছে।

এভাবে কিছুক্ষণ পর পরই অশ্বারোহী তীরন্দাজ বাহিনী ছুটে গিয়ে কেল্লার ভিতর অগ্নিতীর বর্ষণ করতে লাগল। ইতিমধ্যে কয়েকজন পাঁচিল থেকে নিক্ষিপ্ত তীরের আঘাতে জখম হয়েছে। কেউ পাচিলের নিকটবর্তী হলেই তার উপর প্রবল তীর বর্ষণ শুরু হয়। ইয়ায ইবনে গানাম (রা.) অশ্বারোহীদের অগ্নিতীর বর্ষণ করতে নিষেধ করলেন। ভাবলেন, এভাবে জীবনের ঝুঁকি নেয়া ঠিক হবে না।

ইতিমধ্যে পাঁচিলের উপর থেকে রব উঠল, আগুন, আগুন। সাথে সাথে কেল্লার ভিতর থেকে ধোঁয়া কুণ্ডুলী পাকিয়ে পাকিয়ে উপরে উঠতে লাগল। সাথে সাথে তাঁবুর লোকদের ডাক-চিৎকার আহাজারী চারিদিক কাঁপিয়ে তুললো।

সারি সারি তাঁবু। সবগুলো তাঁবু পাশাপাশি। তাই এক তাবুর আগুনে প্রথমে চার তবু জ্বলে উঠল। চোখের পলকে চারদিকে আগুন ছড়িয়ে পড়ল। তাঁবুর ভিতর থেকে যারা প্রাণপণে দৌড়ে বেরিয়ে গেছে তাদের অনেকেরই কাপড় পুড়ে গেছে। গা পুড়ে গেছে। অনেকে বেরিয়ে আসতে না পেরে জ্বলে পুড়ে কয়লা হয়ে গেছে। কেল্লার পাঁচিলের উপর দাঁড়িয়ে যে সব খ্রীস্টানরা তীর নিক্ষেপ করছিল তারা ভয়ে আতঙ্কে সেখান থেকে ছুটে আগুন নিভাতে চলে গেল। পাঁচিলের বিরাট অংশ খালি হয়ে গেল।

মুজাহিদরা এই সুযোগে রশি নিয়ে এসে আংটাসহ পাঁচিলে নিক্ষেপ করল। আংটা লক্ষ্যস্থানে পৌঁছে আটকে গেল। সাথে সাথে মুজাহিদরা রশি বেয়ে পাঁচিলের উপরে উঠতে লাগল। কিন্তু ডান ও বাম দিক থেকে তাদের উপর বৃষ্টির ন্যায় তীর বর্ষিত হতে লাগল। পশ্চাতে অবস্থানরত অনেক মুজাহিদ দৌড়ে সামনে এগিয়ে এল। তারা পাঁচিলে অবস্থানরত খ্রীস্টান সৈন্যদের উপর তীর নিক্ষেপ শুরু করল। কয়েকজন খ্রীস্টান সৈন্য মুজাহিদদের তীরের আঘাতে আক্রান্ত হয়ে পাঁচিলের উপর থেকে লুটিয়ে নীচে পড়ে গেল। তারা সফল হল না। যে সব মুজাহিদ রশি বেয়ে উপরে উঠছিল তারা তীরের আঘাতে জর্জরিত হল। তারা বাধ্য হয়ে নীচে নেমে এল। এ অবস্থা দেখে বেশ কিছু মুজাহিদ শাহাদাঁতের তামান্নায় অধীর হয়ে রশির দিকে দৌড়ে যেতে চাইল। কিন্তু সালাররা তাদের পথ আগলে ধরল। অপর দিকে পাঁচিলের যে স্থানে রশি-আংটা লেগেছিল, খ্রীস্টান সৈন্যরা তা খুলে ফেলে এবং রশি নীচে পড়ে যায়।

শহরের ভিতরের ডাক-চিৎকার আর আর্তনাদে স্পষ্ট বুঝা যাচ্ছে, সেখানে কী কিয়ামত ঘটছে। খালিদ ইবনে ওলীদ (রা.) যে ভয় ও আতঙ্ক শহরের লোকদের মাঝে সৃষ্টি করতে চাচ্ছিলেন তা বাস্তবায়িত হল। তিনি তীরন্দাজ বাহিনীকে এবং যারা পাঁচিলে উঠার সুযোগ খুঁজছে তাদের পিছু হটিয়ে নিয়ে এলেন।

রাতে মুজাহিদ বাহিনীর বিশেষ প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত দল কেল্লার ফটকের নিকটবর্তী। হয়ে কুঠার দিয়ে ফটক ভাঙ্গার চেষ্টা করল। কিন্তু প্রহরীদের তীর বর্ষণের কারণে তারা ফিরে আসতে বাধ্য হল। প্রহরীরা তাদের উপর জ্বলন্ত মশাল ছুঁড়ে মারল। ফলে কয়েকজনের কাপড়ে আগুন লেগে গেল এবং শরীরের বিভিন্ন জায়গা পুড়ে গেল।

খালিদ ইবনে ওলীদ (রা.) একদিন এক হাজার অশ্বারোহী মুজাহিদের এক বাহিনীকে অবরোধ তুলে পশ্চাতে চলে যাওয়ার নির্দেশ দিলেন। তারা এমনভাবে চলে গেল যেন আর ফিরে আসবে না। এরা ঐ এক হাজার অশ্বারোহী মুজাহিদ যাদেরকে রূতাস কেল্লার পাঁচিল থেকে দেখে বিমুগ্ধ হয়ে লীজাকে বলেছিল, হয়তো মুসলমানরা নিরাশ হয়ে অবরোধ তুলে নিয়ে ধীরে ধীরে চলে যাচ্ছে।

খালিদ ইবনে ওলীদ (রা.) আরেকটি কৌশল অবলম্বন করলেন। তা হল, মুজাহিদদের সকল কর্মতৎপরতা একেবারে বন্ধ করে দিলেন। অথচ মুজাহিদরা এমন শৌর্যবীর্য ও বীরত্ব প্রদর্শন করেছে যে, কয়েজন মুজাহিদ তীব্র তীর বর্ষণের মাঝেও কুঠার নিয়ে কেল্লার ফটকের দিকে ছুটে গেছে এবং ফটক ভাঙার চেষ্টাও করেছে। কিন্তু কেল্লার পাঁচিলের উপর থেকে ক্রমাগত নিক্ষেপিত তীর ও বর্শার আঘাতে তারা অবিচল থাকতে পারেনি। ক্ষত-বিক্ষত হয়ে ফিরে এসেছে। এমন কি এক দুঃসাহসী মুজাহিদ শহীদও হয়েছেন।

খালিদ ইবনে ওলীদ (রা.)-এর নির্দেশে অবরোধের অপর পার্শ্ব থেকে আরো এক হাজার অশ্বারোহী মুজাহিদ পশ্চাতে চলে গেলেন। তারাও এমনভাবে পশ্চাতে চলে গেল যেন আর ফিরে আসবে না। তারা একটি পাহাড়ের পশ্চাতে অদৃশ্য হয়ে গেল। এদিকে খালিদ ইবনে ওলীদ (রা.) ও ইয়ায ইবনে গানাম (রা.) শহরের চতুস্পার্শ্বে টহল দিতে থাকলেন আর অন্যান্য মুজাহিদরা তাবুতে গা ঢাকা দিয়ে আছে। অনেকে গাছ বা ঝোঁপের আড়ালে লুকিয়ে রয়েছে।

কেল্লার ভিতর আন্তোনীসের যেন আনন্দের শেষ নেই। বিজয় আনন্দে তার মুখমণ্ডল উদ্ভাসিত, কিন্তু তারপরও তার বিশ্রাম নেই। কখনো সে কবীলার সর্দারদের একত্রিত করে উপদেশ বাণী বিতরণ করছে। কখনো কেল্লার পাঁচিলে গিয়ে টহলরত লোকদের উৎসাহিত উদ্বেলিত করছে। কখনো নীচে নেমে এসে সমবেত লোকদের বিজয়ের সুসংবাদ দিচ্ছে। আর বলছে, এখনো আমাদের যুদ্ধ শেষ হয়নি। এই মুসলমানদের শুধু তাড়িয়ে দিলেই হবে না। তাদের মৃত-লাশে পরিণত করতে হবে। আর যারা প্রাণে বেঁচে যাবে তাদের পশুর মত কেল্লায় এনে বন্দী করে রাখতে হবে।

আন্তোনীস যেন পাগল হয়ে গেছে। ভ্রান্ত বিজয়ের নেশায় সে দুনিয়ার সব লোভনীয় বস্তুর কথাও ভুলে গেছে। লীজাও যেন তার অন্তর থেকে হারিয়ে গেছে। লীজাও তার থেকে বিমুখ হয়ে গেছে। আগের মত আর তাকে জিজ্ঞেস করে না, কেন সে সময়মত ঘরে আসে না! তার খাওয়া দাওয়ার প্রতি যত্ন নেয়া না। ঘরে এলে মনে হয় অন্তর তার বাইরে বাইরে ঘুরছে। আন্তোনীসের স্থানে এখন রূতাস লীজার নিকট যায় আবার লীজাও সময় সুযোগে রূতাসের নিকট গমন করে।

ইউকেলিসের অবস্থা এমন যে যুদ্ধের নেশায় সে তার মায়ের কথাও ভুলে গেছে। এখন খাবার দাবারেরও তার কোন নিয়মানুবর্তিতা নেই।  ৫ ৩৯

যেদিন মুসলমানদের নিক্ষিপ্ত অগ্নি-তীরের কারণে কেল্লার মাঝে অবস্থিত বিভিন্ন কবিলা থেকে আগত লোকদের তাঁবুতে আগুন লেগে গিয়েছিল, তাঁবুর লোকদের ডাক-চিৎকারে সবাই অস্থির হয়ে পড়েছিল, সারি সারি তাঁবুতে আগুন লেগে প্রলয় কাণ্ড ঘটে গিয়েছিল, নারী পুরুষ আর শিশুরা তাঁবু থেকে বেরিয়ে আসতে ব্যর্থ হচ্ছিল, অনেকেই জ্বলে পুড়ে মরেছিল, বহু চেষ্টার পর অল্প কিছু তবু আগুন থেকে রক্ষা পেয়েছিল, সেদিন মানুষের মাঝে চরম হতাশা ও অতিষ্ঠতা দেখা গেছে। অনেকেই বলেছে, আর নয়। মুসলমানদের হাতেই শহর তুলে দাও। এভাবে জ্বলে পুড়ে মরার কোন অর্থ নেই। আজ তাবুতে আগুন লেগেছে। কাল বাড়িতে বাড়িতে আগুন লাগবে। জ্বলে পুড়ে সব শেষ হয়ে গেলে জীবনের আর অর্থ রইল কোথায়?

সেদিন আন্তোনীস, ইউকেলিস ও রূতাস সেখানে উপস্থিত ছিল। তারা অক্লান্ত পরিশ্রম করে আগুন নিভাচ্ছিল। তখন আন্তোনীস আর নিজেকে ধারণ করতে পারেনি। সমবেত মানুষের মাঝে দাঁড়িয়ে উচ্চকণ্ঠে বলতে লাগল, ভাইয়েরা আমার! স্বজাতির জন্য, আযাদির জন্য এমন একটু আধটু কুরবানী দিতেই হবে। এই মুসলমানদের কথাই ভেবে দেখ। তারা কতদূর থেকে ছুটে এসেছে। একের পর এক যুদ্ধ করছে। এতো ক্ষতির মুখোমুখি হয়েও তারা এখনো আমাদের অবরোধ করে আছে।

আন্তোনীস একটু বিরতি দিয়েই আবার বলতে লাগল, আমি তোমাদের বলে দিচ্ছি, মুসলমানরা অবরোধে অতিষ্ঠ হয়ে পড়েছে। তারা তাদের কতিপয় সৈন্যকে ইতিমধ্যে ফেরত পাঠিয়ে দিয়েছে। আমি এখন নিশ্চিত যে, শীঘ্রই মুসলমানরা অবরোধ তুলে পালিয়ে যাবে। সুতরাং এমন কথা কিছুতেই বলবে না যে, শহর মুসলমানদের হাতে তুলে দাও।

আন্তোনীস শহরবাসীদের অত্যন্ত উৎসাহিত ও উদ্বেলিত করল। তার ইঙ্গিতে ইউকেলিস একটি ঘোড়ায় আরোহন করল। সবাই তার দিকে নিষ্পলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। ইউকেলিস অত্যন্ত উচ্চ কণ্ঠে বলল, হে সধারীরা! হে ঈসা মসীহ-এর ভক্তরা! আমার দিকে তাকাও! আমার বয়স দেখ! এ বয়স কি হাসি আনন্দ ও আমোদ-স্ফুর্তির নয়? উপরন্তু আমার এক হাত অবশ। এরপরও দেখ আমি পানাহার ও সুখনিদ্রার কথা ভুলে গেছি। তোমরা দেখছো, আমি কিভাবে এক হাত নিয়ে লড়াই করছি। আমি তোমাদের সন্তানতুল্য। তোমাদের ইজ্জত সম্মান রক্ষার্থে আমি শাহী জিন্দেগী ছেড়ে দিয়ে তোমাদের মাঝে চলে এসেছি। আমি তোমাদের সহযোগিতা কামনা করছি। আমরা তোমাদের সাথে থাকব, আছি।

***

তাঁবুর আগুন যখন প্রায় নিয়ন্ত্রণে চলে এলে আন্তোনীস ও ইউকেলিস লোকদের উদ্দেশ্যে এক অগ্নিঝরা বক্তৃতা দেয়। তখনো আগুনে পোড়া লাশগুলো খুঁজে এনে একত্রিত করা হয়নি। আন্তোনীস ও ইউকেলিসের বক্তৃতায় সবাই উদ্বুদ্ধ ও উদ্বেলিত হয়। শহরে যে ভয় ও আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়েছিল তা দূর হয়ে যায়। এক অভিনব শক্তিতে যেন সবাই বলিয়ান হয়ে উঠে।

সূর্য অস্তমিত হওয়া পর্যন্ত কোথাও কোথাও আগুন জ্বললেও শীঘ্রই তা আয়ত্বে চলে আসে। যে সব লোক জ্বলন্ত তাঁবু থেকে দৌড়ে বেরিয়ে এসেছিল এবার তারা তাদের ছেলে-মেয়ে, স্ত্রী পরিজনদের তালাশ করতে থাকে। পোড়া তাবুর মাঝ থেকে খুঁজে খুঁজে বীভৎস বিকৃত লাশগুলো একের পর এক বের করে এনে একজায়গায় পাশাপাশি শুইয়ে রাখে।

সূর্য উদিত হলে শহরের লোকেরা একে একে পোড়া তাঁবুগুলোর নিকট আসতে লাগল। তারা সারিবদ্ধ বিকৃত লাশগুলো দেখতে পেল। যুবক ছেলের লাশ, যুবতী মেয়ের লাশ, বৃদ্ধ-বৃদ্ধার লাশ, কিশোর-কিশোরীর লাশ। সবাই জ্বলে পুড়ে শেষ হয়ে গেছে। কাউকে চেনার বা সনাক্ত করার কোন উপায় নেই। কিছু কিছু পুড়ে এমন হয়েছে যেন পোড়া কাষ্ঠখণ্ড।

মহিলারা সন্তানের লাশ নিয়ে বিলাপ করে করে কাঁদছে। কেউ কেউ আত্মহারা হয়ে নিজের চুল নিজেই ছিঁড়ছে। স্বজনহারা সবাই হয়রান পেরেশান। স্বজনের তালাশে ছুটাছুটি করছে। সকলের চোখে অশ্রু। চেহারায় আতঙ্কের ছাপ।

এ ভয়াবহ বীভৎস অবস্থা দেখে শহরের লোকেরা ক্ষীপ্ত ও উত্তেজিত হয়ে উঠল। আন্তোনীস ও ইউকেলিসের গত দিনের বক্তৃতার কথা তারা ভুলে গেল। এক ব্যক্তি উচ্চৈঃস্বরে বলল, কোথায় আমাদের সেই রোমান সিপাহসালার? পুড়ে মরলাম তো আমরাই। ধন-সম্পদ পুড়ে ছারখার হলো তো আমাদেরই। তাহলে কেন আমরা কেল্লা থেকে বেরিয়ে মুসলমানদের উপর আক্রমণ করছি না? এতে বাধা কোথায়?

এ লোকদের কথা শেষ হতে না হতেই বেশ কিছু মানুষ চিৎকার দিয়ে বলে উঠল, আর কেল্লায় বসে বসে মরতে চাই না। এবার প্রতিশোধ চাই। তাজা রক্ত চাই। যুদ্ধ চাই। সবার মাঝে এই গুঞ্জন ছড়িয়ে পড়ল। সবাই বলছে, সেই রোমান সিপাহসালারকে ডেকে আন। এক্ষুণি ডেকে আন।

আন্তোনীস সংবাদ পেয়ে ইউকেলিসেকে সাথে নিয়ে ছুটে এল। তাদের আসতে দেখেই লোকেরা চিৎকার শুরু করল। সবাই ক্ষুব্ধ উত্তেজিত। সবাই মারমুখী উত্তপ্ত। কেউ বলে উঠল, আরে! এই রোমান সালার তো বাদশাহ হওয়ার জন্য আমাদের নিয়ে জুয়া খেলছে!

আন্তোনীস সমবেত জনতাকে কৌশলে একটু শান্ত করল। তারপর বলল, আপনারা অধৈর্য হবেন না। ক্ষীপ্ত হবেন না। এই তো দুএক দিনের মধ্যেই অবরোধ শেষ হয়ে যাবে। মুসলমানরা তাদের বাহিনী সরিয়ে নিচ্ছে।

এক ব্যক্তি অত্যন্ত উত্তেজিত কণ্ঠে বলল, আমরা আর ধৈর্য ধারণ করতে পারব না। আর অপেক্ষা করতে পারব না। আমরা সবাই কেল্লা থেকে বেরিয়ে এখনি মুসলমানদের উপর ঝাঁপিয়ে পড়তে চাই। বীরের মত যুদ্ধ করে মরতে চাই।

আন্তোনীস রোমান বাহিনীর সালার ছিল। রূতাসও যুদ্ধে কম দক্ষ নয়। যুদ্ধের কলা-কৌশল সম্পর্কে তারা সম্যক অবহিত। তারা জানে, কেল্লায় অবরুদ্ধ থাকার পর কখন কোন পরিস্থিতিতে কেল্লার বাইরে গিয়ে শত্রুর উপর আক্রমণ করতে হয়। তাই তারা লোকদের বিভিন্নভাবে বুঝাল। কিন্তু উত্তেজিত জনতার এক কথা, এক দাবী।

এক বৃদ্ধ ব্যক্তি বলল, হে রোমান সালার! আমরা মুসলমানদের সাথে শত্রুতা রাখতে চাই না। যদি তোমরা বাইরে গিয়ে যুদ্ধ করতে না চাও তাহলে আমরাই কেল্লার দরজা খুলে দিব।

আন্তোনীসের কণ্ঠ এবার একটু কঠিন হয়ে উঠল। বলল, তুমি মূর্খ। তুমি তো মুসলমানদের জন্য কেল্লার দরজা খুলে দিবে না বরং এ দেশে ইসলাম প্রবেশের সুযোগ করে দিবে। ওরা শহরে প্রবেশ করলে সর্বপ্রথম তোমাদের ইসলাম গ্রহণ করতে বাধ্য করবে। তোমাদের শুধু ধর্মই ছাড়তে হবে না। ঘরের সুন্দরী মেয়েদের ও রূপসী স্ত্রীদের মায়াও ছাড়তে হবে। তোমরা তোমাদের জাতীয় পরিচয় নিমিষে হারিয়ে ফেলবে।

রূতাস উচ্চকণ্ঠে বলল, হে কুশধারীরা! যে মুসলমানদের জন্য তোমরা দরজা খুলে দিতে চাচ্ছো, তোমরা যাদের আনুগত্য মেনে নিতে চাচ্ছো, তাদের হিংস্রতা ও বর্বরতা দেখো যা বীভৎস বিকৃত লাশ হয়ে তোমাদের সামনে পড়ে আছে। তারা তোমাদের নিষ্পাপ দুগ্ধপোষ্য সন্তানকেও জ্বালিয়ে দিয়েছে। যদি তোমরা আজ আত্মসমর্পণ কর তাহলে যে-ই ইসলাম গ্রহণে অস্বীকার করবে তাকেই নির্মমভাবে হত্যা করবে।

এক বৃদ্ধ আগে বেড়ে বলল, হে রোমান সালার! যেখানে যুদ্ধ হয় সেখানে নির্বিচারে হত্যাকাণ্ড চলে। তুমি কি ভুলে গেছো, রোমান ও ইরানী সৈন্যরা যেদিক দিয়েই গেছে নির্বিচারে হত্যা করেছে। নিষ্পাপ শিশুদের দুহাতে হত্যা করেছে। যুবতী মেয়েদের কৌমার্য রক্তাক্ত করেছে। কিশোর-বালকদের হত্যা করেছে, বাকীদের গোলাম বানিয়ে নিয়ে গেছে। আর আমরা তো ইচ্ছে করে মুসলমানদের শত্রু বানিয়েছি। আমরা রোমানদের সমর্থন দিয়েছি, তাদের সাহায্য করেছি। অথচ রোমানরা যুদ্ধ না করে পালিয়ে গেছে। তাই মুসলমানরা

আমাদেরকে কেন দুশমন মনে করবে না? যদি নারী ও শিশুদের জন্য তোমার এতোই দরদ উথলে উঠে তাহলে আর কালক্ষেপণ নয়, এবার চল কেল্লার বাইরে। গিয়ে যুদ্ধ করি। দেখবে, শহরের শিশু-কিশোররাও যুদ্ধ করবে। হাসতে হাসতে প্রাণ বিলিয়ে দিবে।

শহরের প্রায় সকল মানুষ সেখানে সমবেত হয়েছিল। বৃদ্ধের এই কথা শোনার পর লোকেরা চিৎকার শুরু করল। বলতে লাগল, মুসলমানদের উপর আক্রমণ করে আমরা অবরোধ ভেঙে ফেলব। যখন এ চিৎকার ও হট্টগোল চলছে ঠিক তখন আরেক ব্যক্তি উচ্চকণ্ঠে চিৎকার করে বলল, ভাইয়েরা আমার! আমাদের উপর আরেকটি বিপদ এগিয়ে আসছে। শহরে খাদ্যশস্যের সংকট দেখা দিয়েছে। অল্প কিছুদিনের মধ্যেই দুর্ভিক্ষ দেখা দিবে। গৃহপালিত পশু ও ঘোড়ার খাবারের চরম সংকট। জমিজমা সব কেল্লার বাইরে। বাইরে থেকে কোনকিছু আনা সম্ভব হচ্ছে না। মানুষের আগেই এই প্রাণীগুলো মারা যাবে। তাই বলছি, অনাহারে হাড় জিরজিরে হয়ে ছটফট করতে করতে না মরে এটাই কি উত্তম নয় যে, আমরা আমাদের ধর্মের জন্য, আমাদের স্বাধীনতার জন্য, ইজ্জত সুরক্ষার জন্য যুদ্ধ শুরু করি! যুদ্ধ করতে করতে জীবন বিলিয়ে দেই!

আন্তোনীস ও রূতাসের মস্তিষ্কের টিস্যুতে টিস্যুতে শুধু যুদ্ধ আর অবরোধের চিন্তা সারাক্ষণ ঘুরপাক খাচ্ছিল। এ রঙিন স্বপ্নে সর্বদা বিভোর, বিজয় তাদের হবে। কিন্তু তারা একথা ভাবেনি যে, যুদ্ধ জয়ের বিশেষ কিছু কৌশল আছে। কিছু দাবীও আছে। যে শহরে যোদ্ধারা থাকে সেখানে খাদ্যসামগ্রী ও রসদপত্রও এতো থাকা চাই এক বৎসর বা তার চেয়ে বেশী সময় তারা তা দিয়ে স্বাচ্ছন্দে জীবন নির্বাহ করতে পারে। আলেপ্পায় কোন সৈন্য ছাউনী ছিল না। শহরের কেউ কখনো খাদ্য মজুদের প্রয়োজনও অনুভব করেনি। মুসলমানরাও সেখানে কোন সৈন্য ছাউনী তৈরি করেনি। তাই সেখানে অতিরিক্ত খাদ্যের মওজুদ নেই। এখন শহরের লোকেরা অনুভব করল যে, দ্রুত খাদ্য শস্য ফুরিয়ে যাচ্ছে। গৃহপালিত পশুর খাবারেরও তীব্র সংকট।

এ এমন এক সমস্যা যার সমাধানের কোন পথ খোলা নেই। আন্তোনীস ও রূতাস এবার একেবারে নিরব হয়ে গেল। এমন কোন সমাধান তাদের মাথায় এল না যা শুনিয়ে উত্তেজিত জনতাকে শান্ত করা সম্ভব। দিশেহারা আন্তোনীস। কিংকর্তব্যবিমূঢ় রূতাস। অবশেষে আন্তোনীস কবিলার সর্দারদেরকে ডেকে নির্জন স্থানে নিয়ে বসল। তাদের সামনে বাস্তব পরিস্থিতি তুলে ধরে বলল, এখন আমাদের বাইরে বেরিয়ে যুদ্ধ করেই অবরোধ ভেঙে ফেলতে হবে। যদি আমরা এ অপেক্ষায় থাকি, মুসলমানরা এক সময় অবরোধ তুলে চলে যাবে, তাহলে শহরের লোকেরা ক্ষুধা পিপাসায় মৃত্যুর ভয়ে নিজেরাই শহরের দরজা খুলে দিবে আর তার ফলাফল কত ভয়াবহ হবে তা সহজেই অনুমেয়।

কবিলার সর্দাররা চিন্তাভাবনা করে সিদ্ধান্ত দিল যে, এখন আক্রমণ করেই অবরোধ ভেঙে ফেলতে হবে। এ ছাড়া আর কোন উপায়ই নেই। আন্তোনীস সর্দারদের বলল, সে শহরের যুদ্ধে সক্ষম লোকদের একত্রিত করে যুদ্ধের কলা-কৌশল ও প্রয়োজনীয় বিষয় শিখিয়ে দিবে।

***

আলেপ্পা শহরের দুদিক থেকে দুটি অশ্বারোহী বাহিনী পশ্চাৎ গমনের কারণে শহরবাসীদের মাঝে কি প্রতিক্রিয়া হয়েছে তা খালিদ ইবনে ওলীদ (রা.) কিছুই জানতে পারেননি। শহরে যে খাদ্যশস্যের অভাব দেখা দিয়েছে তাও তিনি জানতে পারেননি।

একদিন খালিদ ইবনে ওলীদ (রা.) সাথী ইয়ায ইবনে গানাম (রা.)-এর সাথে পরামর্শ করে শহরের এক পার্শ্বের অবরোধ তুলে নিলেন এবং মুজাহিদদের দূরে পাঠিয়ে দিলেন।

সেদিন আন্তোনীস, রূতাস ও কবিলার সর্দাররা কেল্লার সুউচ্চ পাঁচিলে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে যখন দেখল, অবরোধকারী মুজাহিদ বাহিনী শহরের এক পার্শ্ব থেকে অবরোধ তুলে নিয়ে চলে যাচ্ছে, তখন তাদের আর আনন্দের সীমা রইল না।

আন্তোনীসের কণ্ঠে গর্ব ও অহঙ্কার ভরা আত্মবিশ্বাসের সুর ফুটে উঠল। বলল, আমরা আর বেশী অপেক্ষা করতে পারি না। কাল সকালেই এদিকের দুটি দরজা খুলে বেরিয়ে পড়ব। তারপর মুসলমানদের ধূলির সাথে মিশিয়ে তবে ফিরব।

পূর্বাকাশ আলোকিত। পৃথিবী আলোয় উদ্ভাসিত। আলো ছড়াতে ছড়াতে সূর্য কিছুটা উপরে উঠে এসেছে। অকস্মাৎ শহরের দুটি দরজা খুলে গেল। শহরের লোকেরা বাধভাঙা বন্যার পানির ন্যায় তলোয়ার বর্শা নিয়ে মার মার কাট কাট রব তুলে বেরিয়ে এল। তাদের অনেকেই অশ্বারোহী।

এমন পরিস্থিতির জন্য মুসলমানরা প্রস্তুত ছিল না। এ ধরনের হামলা প্রতিহত করার জন্য তারা সুযোগই পেল না। তবে সালারদের পক্ষ থেকে নির্দেশ ছিল, তারা যেন সর্বদা সর্বাত্মক যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত থাকে। তাই একেবারে ভেঙে পড়ল না।

আক্রমণের কৌশল আন্তোনীস অত্যন্ত দূরদর্শিতার সাথে তৈরি করেছিল। তাই এমন হল না যে একদিক থেকে আক্রমণ করল আর পিছন দিক থেকে মুজাহিদ বাহিনী এসে তাদের ঘিরে ফেলল। সে শহরের যোদ্ধাদের শিখিয়ে দিয়েছে, কেল্লা থেকে বেরিয়েই তারা দুভাগে বিভক্ত হয়ে পড়বে। ডানে ও বামে চলে যাবে। তাহলে পশ্চাৎ দিক থেকে তারা নিরাপদ থাকবে। এক দলের সালার আন্তোনীস। আরেক দলের সালার রূতাস। ইউকেলিস রূতাসের সাথে তার সহযোগী হিসাবে রইল।

অপ্রস্তুত, অসচেতন ও অলসতা ঝেড়ে ফেলে যখন মুজাহিদ বাহিনী উঠে দাঁড়াল এবং অত্যন্ত শক্ত হাতে তাদের প্রতিহত করল তখন শহরের লোকেরা বুঝতে পারল যে তারা এক কঠিন বিশাল পাথরের সাথে আঘাত খেয়েছে। এ জগদ্বল পাথর ঠেলে সামনে অগ্রসর হওয়া এক অসম্ভব কাজ।

খালিদ ইবনে ওলীদ (রা.) ভেবেছিল, যদি শহরের লোকেরা কেল্লার বাইরে এসে আক্রমণ করে তাহলে কিছু মুজাহিদ আক্রমণকারীদের পশ্চাতে চলে গিয়ে খোলা দরজা দিয়ে শহরে প্রবেশ করবে। কিন্তু এ পরিকল্পনা বাস্তবায়ন সম্ভব হয়নি। কারণ আন্তোনীস শহরের যোদ্ধাদের দুভাগে ভাগ করে পশ্চাতে যাওয়ার সুযোগ বন্ধ করে দিয়েছে।

ভীষণ যুদ্ধ শুরু হল। ক্ষুধার্ত শার্দুলের ন্যায় একে অপরের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ল। তীর, বর্শা আর তলোয়ারের যুদ্ধ শুরু হল। রণহুঙ্কারে আকাশ বাতাস কেঁপে উঠল। আন্তোনীস ও রূতাস প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত সৈন্যদের মতই শহরের যোদ্ধাদের পরিচালিত করার আপ্রাণ চেষ্টা চালাতে লাগল। কিন্তু আসলে তো তারা সৈন্য নয়। যুদ্ধের কলা-কৌশল তাদের জানা নয়। তারা এক বিশৃঙ্খল জনতার ঢল। তারা বাঁধ ভাঙা স্রোত। তাদের একটিই ইচ্ছা, মুসলমানদের নির্বিচারে হত্যা করা। কিন্তু বিশৃঙ্খলতার কারণে ফলাফল হল একেবারে বিপরীত। অধিকাংশ মুজাহিদ অশ্বারোহী হওয়ার সুবাদে নিরাপদে ও অত্যন্ত সহজে শহরের যোদ্ধাদের ধরাশায়ী করতে লাগল।

আন্তোনীস সজাগ। সতর্ক তার দৃষ্টি। সে মুসলমানদের গতি প্রকৃতি দেখে বুঝে ফেলল, মুসলমানরা কেল্লার দরজায় পৌঁছতে চাচ্ছে। শহরের যোদ্ধারা তাদের প্রতিহত করতে ব্যর্থ হচ্ছে। তারা ক্রমেই দরজার দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। এমনি পরিস্থিতিতে সে তার কর্তব্য নির্ধারিত করে ফেলল। শহরের যোদ্ধাদের নির্দেশ দিল তারা যেন কাল বিলম্ব না করে শহরে প্রবেশ করে। কিন্তু কেউ তার কথায় কান দিচ্ছে না। আন্তোনীস দেখল, সামনে কঠিন পরীক্ষা। কবিলার সর্দারদের ডেকে বলল, তারা যেন তাদের গোত্রের যোদ্ধাদের শহরে প্রবেশের নির্দেশ দেয়। সর্দারদের নির্দেশ পাওয়া মাত্র যোদ্ধারা শহরে প্রবেশ শুরু করল। 

মুজাহিদরা তাদের পশ্চাৎগমন করল। তাদের ধারণা ছিল, শহরের যোদ্ধাদের। সাথে তারাও শহরে প্রবেশ করতে পারবে। কিন্তু তারা তড়িঘড়ি করে বহু যোদ্ধাকে বাইরে রেখেই দরজা বন্ধ করে দিল। যারা বাইরে আটকা পড়েছিল তারা প্রাণপণ যুদ্ধ চালিয়ে যেতে লাগল। অপরদিকে শহরের যোদ্ধারা কেল্লার পাচিলের উপর থেকে মুজাহিদদের লক্ষ্য করে অব্যর্থ তীর ও বর্শা নিক্ষেপ করতে লাগল। মুজাহিদরা এতে ভীষণ ক্ষতির সম্মুখীন হল। ফলে তারা নিরাপদ স্থানে চলে গেল। শহরের বাইরে থাকা যোদ্ধারা এই সুযোগে সহজেই শহরে প্রবেশ করল।

কেল্লার উঁচু প্রাচীরে দাঁড়িয়ে যোদ্ধারা বাইরের হৃদয় বিদারক দৃশ্য দেখতে পেল। নিকটে দূরে বহু লাশ ছড়িয়ে আছে। চারদিকে রক্ত আর রক্ত। অনেকে আক্রান্ত হয়ে উঠে আসতে চেষ্টা করছে কিন্তু পারছে না। একটু অগ্রসর হয়েই আবার মাটিতে লুটিয়ে পড়ছে। এ দৃশ্য বিভিন্ন কবিলার খ্রিস্টান যোদ্ধাদের শরীরে আগুন ধরিয়ে দিল। তারা ঘোষণা করল, তারা আরেকটি আক্রমণ করবে। তা হবে মরণপণ আক্রমণ। অত্যন্ত ভয়ঙ্কর আক্রমণ। মুসলমানদের জীবনের তরে যুদ্ধের সাধ মিটিয়ে দিতে হবে।

এদিকে শহরের নারীরা তাদের সন্তান, ভাই, পিতা ও স্বামীদের তালাশে পাগল পারা হয়ে গেল। যারা যুদ্ধ করে ফিরে এসেছে তারা তাদের উপর যেন উপচে পড়ল। সবার চোখে অশ্রু। মুখে আহাজারী আর বিলাপ।

তাদের মাঝে লীজাও বিদ্যমান। ইউকেলিস, ইউকেলিস বলে চিৎকার করে সে ইউকেলিসকে খুঁজছে। কিন্তু ইউকেলিসকে কোথাও খুঁজে পাচ্ছে না। লীজা দৌড়ে কেল্লার পাঁচিলের উপর উঠল। দেখল, দূরে ইউকেলিস রূতাসের পার্শ্বে দাঁড়িয়ে আছে। সে দৌড়ে গিয়ে ইউকেলিসকে ঝাঁপটে ধরল। মাথা থেকে পা পর্যন্ত তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে দেখল। ইউকেলিস বলল, আম্মা! আপনি এতো অধৈর্য হবেন না। দেখুন আমি একেবারে সুস্থ। আমার জন্য আপনি এতো উতলা হচ্ছেন কেন?

ইউকেলিসের তালাশে আরেকজন অনিন্দ্য সুন্দরী যুবতী হয়রান পেরেশান হয়ে এদিক সেদিক ছুটাছুটি করছে। কিন্তু কাউকে কিছু বলছে না। সে যেন প্রায় পাগলিনী। সে ঐ খ্রিস্টান যুবতী যাকে ইউকেলিস কুস্তুনতীনের হাত থেকে রক্ষা করেছিল। এ যুবতীর সাথে ইউকেলিসের আলেপ্পা শহরে দেখা হয়েছে এবং বেশ কয়েকবার তাদের অভিসার হয়েছে। তার নাম রোজী। সেও ইউকেলিসের সন্ধানে কেল্লার প্রাচীরের উপর উঠে দেখল, দূরে ইউকেলিস লীজার কাছে দাঁড়ান। সে আর সেখানে এক মুহূর্ত দাঁড়িয়ে থাকতে পারল না। ছুটে এল ইউকেলিসের নিকটে। ইউকেলিস দেখল, তার দিকে তার প্রেয়সী এলোকেশে ছুটে আসছে। যেন উন্মাদিনী। ইউকেলিস নিজেকে তার মায়ের স্নেহপরশ থেকে মুক্ত করে দুহাতে রোজীকে জড়িয়ে ধরল।

***

শহরের বাইরে মুজাহিদরা তাদের শহীদ সঙ্গীদের লাশ তুলে নিয়ে যাচ্ছে। মহিলারা আহতদের সেবা-শুশ্রূষা করছে। এরা মুজাহিদদের স্ত্রী, মেয়ে, মা। এরা মুজাহিদদের সাথেই এসেছে। এরা অবরোধ থেকে কিছুটা দূরে এক নিরাপদ স্থানে অবস্থান করছে। এদের সাথে শারীনাও এসেছে। সে সম্রাট হিরাক্লিয়াসের কন্যা। বর্তমানে আরবের খাজরাজ বংশের মুজাহিদ হাদীদ ইবনে মুমিনের স্ত্রী। অন্যান্য নারীদের সাথে সেও অসুস্থ ও জখমীদের পানি পান করাচ্ছে। তাদের তুলে নিয়ে তাঁবুতে শুইয়ে দিয়ে ক্ষতস্থানে ঔষধ লাগিয়ে দিচ্ছে। পট্টি বেঁধে দিচ্ছে।

মুজাহিদরা ক্ষতিগ্রস্ত হলেও এমন হয়নি যার প্রতিক্রিয়ায় অবরোধ শিথিল হয়ে যাবে। জখমীদের সংখ্যা একটু বেশী। কিন্তু তাতেও অবরোধ কার্যক্রমে কোন অসুবিধা হচ্ছে না। খালিদ ইবনে ওলীদ (রা.) শহরের যেদিক থেকে অবরোধ তুলে নিয়েছিলেন সেদিকে একদল অশ্বারোহী মুজাহিদ পাঠিয়ে দিলেন। এছাড়া আর তেমন কোন কার্যক্রম পরিলক্ষিত হল না। কেল্লায় আক্রমণেরও কোন পরিকল্পনা করলেন না। বরং পূর্বের ন্যায় মুজাহিদর অবস্থান করতে থাকল।

পুনরায় আক্রমণের জন্য উভয় পক্ষের কিছুটা অবকাশের প্রয়োজন। যেন অসুস্থ ও সাধারণ জখমীরা সুস্থ হয়ে উঠে। আন্তোনীস ও রূতাস পুনরায় আক্রমণের পরিকল্পনা করছে। কবিলার সর্দারদের সাথে বারবার আলোচনা পর্যালোচনা ও পরামর্শ হচ্ছে। সর্দারদের মাধ্যমেই পরবর্তী সিদ্ধান্তের কথা যোদ্ধাদের নিকট পৌঁছে দিচ্ছে। কেল্লায় অবস্থিত খ্রিস্টানদের অবস্থা এমন হল যে, কিশোররা পর্যন্ত যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত হয়ে গেল। নারীরাও বলাবলি করতে লাগল, প্রয়োজন হলে তারাও যুদ্ধে অংশগ্রহণ করবে।

মুসলমানদের শিবিরে নিয়ম হচ্ছে, নামাযের জামাতে সিপাহসালার ইমাম হন। ফযরের নামাযের পর সিপাহসালার খালিদ ইবনে ওলীদ (রা.) অত্যন্ত সংক্ষিপ্ত ভাষণে মুজাহিদদের তাদের দায়িত্ব সম্পর্কে দুচারটি কথা বললেন। তিনি প্রায়ই একথা বলেন, আল্লাহর রাজত্বের কোন সীমা নেই। জিহাদ আল্লাহর নামে হওয়া চাই। আল্লাহই তার বিনিময় প্রদান করবেন। মাঝে মাঝে একথাও বলেন, আমল ছাড়া দুআ এবং দুআ ছাড়া আমলের অবস্থা ঐ উদ্ভিদের ন্যায় যা মাটি ভেদ করে ঝলমলে দুনিয়ায় এসেছে। কিন্তু পানি না পাওয়ার কারণে শুকিয়ে মরে গেছে।

খালিদ ইবনে ওলীদ (রা.) সরাসরি মুজাহিদদের কিছু বলতে চাইলে ফজরের নামাযের পর বা অন্য কোন নামাযের পর বলেন। তিনি মুজাহিদদের সদা প্রস্তুত থাকার নির্দেশ দিয়ে বলেছেন, যে কোন সময় যে কোন মুহূর্তে আবার আক্রমণ হতে পারে। সুতরাং আমাদের সর্বদা প্রস্তুত থাকতে হবে। তিনি এ তথ্য পেয়েছেন আহত খ্রিস্টান যোদ্ধাদের থেকে। তারা বলেছে, আবার আক্রমণের সম্ভাবনা রয়েছে। তারা আরো বলেছে, শহরে খাদ্যশস্যের দারুণ সংকট। আর কিছুদিন পরই শহরে দুর্ভিক্ষ দেখা দিবে। তিনি একথাও জেনেছেন, শহরের লোকেরা দ্রুত অবরোধ ভেঙে ফেলতে চাচ্ছে। শহরে এমন মানুষও রয়েছে যারা মুসলমানদের আনুগত্য মেনে নিতে রাজী আছে। আলেপ্পা শহরের ভিতরের অবস্থা জানার পর খালিদ ইবনে ওলীদ (রা.) ও ইয়ায ইবনে গানাম (রা.) এর জন্য ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা তৈরী করা সহজ হয়ে গেল।

এদিকে কেল্লার মাঝেও আত্মরক্ষামূলক আক্রমণের আলোচনা চলছে। আন্তোনীস ও রূতাস দুতিন দিন পর একেবারে প্রত্যূষে আক্রমণের সিদ্ধান্ত নিল। যারা জখমী হয়েছিল তাদের অনেকেই সুস্থ হয়ে উঠেছে। পূর্বের চেয়ে অনেক বেশী লোক আক্রমণে অংশগ্রহণ করবে। তারা এখন পূর্ণ প্রস্তুত। আন্তোনীসের ইচ্ছা হল, এ আক্রমণ হবে চূড়ান্ত। তাই এবার আর দুদরজায় নয়, চার দরজা দিয়ে বেরিয়ে আক্রমণ করতে হবে। কেল্লার চারদিক দিয়ে হবে এ আক্রমণ।

আন্তোনীস ও রূতাসকে না জানিয়ে ইউকেলিস এক দুর্ধর্ষ জানবাজ অশ্বারোহী বাহিনী গড়ে তুলছিল। এ বাহিনীর সবাই অসম সাহসী, বীর বিক্রম। তারা সিদ্ধান্ত করেছে, তারা মুসলমানদের সিপাহ সালারের উপর বিদ্যুৎ বেগে ঝাঁপিয়ে পড়বে। তাকে জীবিত বা মৃত শহরে তুলে নিয়ে আসবে। তারা এ সিদ্ধান্তও করেছে যে, তারা অন্য কোথাও যুদ্ধ করবে না। শুধু সেখানেই যুদ্ধ করবে যেখানে সিপাহসালার অবস্থান করছে।

যুদ্ধের আর একদিন একরাত বাকি। ইউকেলিস তার মায়ের নিকট থেকে বিদায় নিয়ে চলে গেছে। যাওয়ার আগে বলে গেছে, আমি একটি দুর্ধর্ষ জানবাজ বাহিনী তৈরী করেছি। যে বাহিনীর কথা আন্তোনীস বা রূতাস কেউ জানে না। আমার এ বাহিনী মুসলমানদের সিপাহসালারকে জীবিত বা মৃত তুলে আনবে। সে তার মাকে বলেছে, সে এখন তার সেই বিশেষ বাহিনীর নিকট যাচ্ছে। যুদ্ধে বিজয়ের পর ফিরে আসব। মায়ের নিকট দুআ নিয়ে সে চলে গেল।

আন্তোনীস দারুণ ব্যস্ত। কাজের যেন শেষ নেই। চিন্তার যেন সীমানা নেই। কখনো সে কেল্লার উঁচু পাঁচিলের উপর গিয়ে উঠে। তীক্ষ্ণ অনুসন্ধানী দৃষ্টিতে চারদিক দেখে। তারপর ছুটে এসে কবিলার সর্দারদের সাথে সাক্ষাৎ করে এবং অবস্থার পর্যালোচনা করে। যুদ্ধের চিন্তায় যেন সে পাগলপারা হয়ে গেছে।

***

দ্বিপ্রহর। আকাশে মেঘলা মেঘলা ভাব। গোটা প্রকৃতি মেঘমেদুর। এ সময়ে রূতাসকে তার খুব দরকার। আন্তোনীস কাউকে না পাঠিয়ে নিজেই তার তালাশে বেরিয়ে পড়ল। তার ধারণা, রূতাস কেল্লার পাঁচিলের কোথাও আছে। কিন্তু না। তাকে কোথাও পাওয়া গেল না। সবশেষে সে রাতাসের বাড়িতে গেল। রূতাস একাই এ বাড়িতে থাকে। তাই আন্তোনীস ডাকাডাকি না করে সোজা ভিতরে চলে গেল।

উঠানে পৌঁছে রূতাসকে ডাক দিল। এক কামরা থেকে রাতাসের আওয়াজ শুনতে পেল। সে বলছে, জ্বী! আমি কাপড় পরিবর্তন করে আসছি। আন্তোনীস ভাবল, সে তো একা থাকে। তাই তার কামরার দিকে গেল। দরজা বন্ধ। দরজার একটি কপাটে হাত রাখতেই তা খুলে গেল। তারপর আন্তোনীস কামরায় যা দেখল তাতে তার মাথার রক্ত টগবগ করে উঠল। দেখল, কামরার বিছানা থেকে লীজা উঠে যাচ্ছে। প্রায় বিবস্ত্রা। কাপড় টানতে টানতে সে দ্রুত আড়ালে চলে গেল। রূতাসকেও সে বিবস্ত্র দেখতে পেল। আন্তোনীসের মস্তিষ্কে লেলিহান আগুন। সবকিছু সে মুহূর্তে ভুলে গেল। সাথে সাথে তলোয়ার কোষমুক্ত করে চিৎকার করে রূতাসকে লক্ষ্য করে বলল, হারামজাদা! তলোয়ার নিয়ে উঠানে চলে আয়। যে বেঁচে থাকবে সেই লীজাকে পাবে।

সাথে সাথে রূতাস চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করে উন্মুক্ত তরবারী হাতে উঠানে লাফিয়ে পড়ল। আন্তোনীস আর রূতাস। উভয়ের হাতে ঝকঝকে তরবারী। তারা একে অপরের রক্ত পিপাসু। উভয়ে যেন ক্ষুধার্ত শার্দুল। বাড়ির উঠানে তরবারী নিয়ে একে অপরের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ল। তরবারীর আঘাতে আঘাতে অগ্নিস্ফুলিঙ্গ ঝরে পরতে লাগল। ইতিমধ্যে লীজা কাপড় পরে দৌড়ে উঠানে এল। দেখল, উভয়ের চোখে আগুনের গোলক। আঘাতের পর আঘাত হানছে একে অপরকে। মুহূর্তে লীজা দৌড়ে উভয়ের মাঝে এসে দাঁড়াল। ইতিমধ্যে একে অপরের উপর আবারো আঘাত করে বসেছে। কিন্তু সে আঘাত প্রতিপক্ষকে ঘায়েল না করে লীজার শরীরে লেগেছে। দুদিক থেকে দুই তরবারী লীজার পেটে বিদ্ধ হয়ে বেরিয়ে গেল। উভয়ে তলোয়ার বের করে আনার পূর্বেই চিৎকার করে লীজা মাটিতে লুটিয়ে পড়ল। উভয়ে লীজার দিকে তাকাল। তারপর আবার প্রতিপক্ষের দিকে দৃষ্টি দিল। আন্তোনীস একটু পিছিয়ে এল। সে আবার রূতাসের উপর আক্রমণ করতে প্রস্তুত হচ্ছে।

রূতাস তার তরবারী জোড়ে উঠানোর এক কোণে নিক্ষেপ করল। সশব্দে তরবারীটি গিয়ে মাটিতে পড়ল। রূতাস চিৎকার করে বলল, আন্তোনীস! সাবধান! এক নারীকে নিয়ে আমরা আমাদের কর্তব্যের কথা ভুলে গেছি। আমরা কি ঈসা মাসীহ এর সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠার প্রতিজ্ঞা করিনি? আমাকে যদি মারতে হয় মেরে ফেল। কিন্তু নিজের প্রতিজ্ঞার কথা ভুললে চলবে না। যে মারা গেছে সে এক বদকার নারী। এ নারীর কারণে আমাদের একে অপরের দুশমন হওয়া। অনুচিত।

আন্তোনীস থমকে দাঁড়াল। চমকে উঠল তার স্নায়ু। হ্যাঁ তাইতো! আন্তোনীস তার তরবারী কোষাবদ্ধ করে ফেলল। উঠানে পড়ে থাকা রূতাসের তরবারীটি তুলে তার হাতে দিল। বলল, যা ঘটেছে তা ভুলে যাও। আমরা বিজয় লাভ করতে পারলে নারীর অভাব হবে কি!

ইউকেলিস তার দুর্ধর্ষ জানবাজ বাহিনীর নিকট চলে গেছে। সে তার মাকে বলে গেছে, আক্রমণের পর বিজয়ী বেশেই সে ফিরে আসবে। কিন্তু তাকে এ সংবাদ দেয়ার কেউ ছিল না যে, তার মা রূতাসের বাড়ির উঠানে মরে পরে আছে। এদিকে আন্তোনীস ও রূতাস পূর্বের মত একজোট হয়ে গেছে। যেন তাদের মাঝে কখনো কোন দ্বন্দ্ব হয়নি।

***

এখনো প্রভাতের বিমল আলো চারদিকে ছড়িয়ে পড়েনি। উদ্ভাসিত হয়ে উঠেনি পৃথিবী। চারদিকে আবছায়া। ঠিক তখন শহরের চারদিকের চারটি দরজা খুলে গেল। দরজা দিয়ে অসংখ্য অগণিত যোদ্ধা তীব্র গতিতে বেরুতে লাগল। এ চারটি দরজা ছাড়া পঞ্চম আরেকটি দরজা খুলে গেল। সে দরজা দিয়ে ইউকেলিস তার দুর্ধর্ষ একশত অশ্বারোহী যোদ্ধাদের নিয়ে বেরিয়ে পড়ল। এ দরজা ইউকেলিসের নির্দেশে খোলা হয়েছে। আন্তোনীস শুধুমাত্র চারটি দরজা খোলার নির্দেশ দিয়েছিল আর বলেছিল, যুদ্ধ চলাকালীন সময়ে যেন দরজা বন্ধ করা না হয়।

এবার খ্রিস্টান যোদ্ধাদের যুদ্ধ পদ্ধতি ভিন্ন ধরনের। তারা ডানে বামে হামলা না করে সোজা চলে গেল। মুজাহিদরা তা প্রতিহত করতে প্রস্তুত হল। যুদ্ধ শুরু হয়ে গেল। ভীষণ যুদ্ধ হতে লাগল। এ যুদ্ধে মুজাহিদরাও ভিন্ন কৌশল গ্রহণ করেছে। তারা খ্রিস্টান যোদ্ধাদের আক্রমণ প্রতিহত করছে কিন্তু আগে বেড়ে আক্রমণ করছে না। ক্রমেই তারা পিছিয়ে যাচ্ছে। খ্রিস্টান যোদ্ধারা বুঝতে পারেনি, খালিদ ইবনে ওলীদ (রা.) কত দূরদর্শী, কতো বিজ্ঞ সিপাহসালার। মুজাহিদ বাহিনী যখন ক্রমে পিছু হঠে যাচ্ছে তখন খ্রিস্টান যোদ্ধারা মনে করেছে, মুসলমানরা পালিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করছে। তারা দ্বিগুণ উৎসাহে তাদের উপর আক্রমণ করতে করতে শহর থেকে দূরে চলে এসেছে। আন্তোনীস ও রূতাসও মুজাহিদ বাহিনীর যুদ্ধ-কৌশল বুঝতে পারেনি। তারা ধারণাও করতে পারেনি, তারা কেল্লা থেকে এতো দূরে চলে এসেছে যেখান থেকে শবেষ্টনি ভেদ করে ফিরে যাওয়া কঠিন।

শহরের উভয় পার্শ্বের খ্রিস্টান যোদ্ধারা যুদ্ধ করতে করতে যখন শহর থেকে অনেক দূরে চলে এল, ঠিক তখন শহরের আশে পাশে পাহাড় ও টিলার পশ্চাতে লুকায়িত একদল অশ্বারোহী বেরিয়ে বিদ্যুৎ বেগে শহরের দিকে ছুটে গেল। তারা শহর ও খ্রিস্টান যোদ্ধাদের মাঝামাঝি অবস্থান নিল। এরা ঐ অশ্বারোহী বাহিনী যারা অবরোধ তুলে চলে গিয়েছিল এবং পাহাড় টিলা ও ঝোঁপ ঝড়ের আড়ালে আত্মগোপন করেছিল। এদিকে আন্তোনীস ও শহরের নেতৃস্থানীয় লোকেরা প্রবঞ্চনায় পরে ভেবেছিল যে, মুসলমানরা অবরোধ তুলে নিয়েছে। অশ্বারোহী এই বাহিনী এতদিন পর্যন্ত সিপাহ সালারের ইঙ্গিতের অপেক্ষায় ছিল। আজ ইঙ্গিত পাওয়া মাত্র তারা নিখুঁতভাবে তাদের দায়িত্ব পালন করছে।

শহরের দিকে ছুটে আসা এই অশ্বারোহী মুজাহিদদের কিছু অংশ সোজা শহরে প্রবেশ করল। অন্যরা খ্রিস্টান যোদ্ধাদের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ল। এদিকে মুজাহিদ বাহিনীও থমকে দাঁড়াল। এবার তারা পিছু না হটে সামনে অগ্রসর হতে লাগল। খ্রিস্টান যোদ্ধারা চারদিক থেকে মুজাহিদ বাহিনীর দ্বারা পরিবেষ্টিত হয়ে গেল। খ্রিস্টান যোদ্ধাদের মাঝে চরম আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ল। চারদিক থেকে বাঁচাও বাঁচাও রব উঠল। কিন্তু সবদিক অন্ধকার। মুজাহিদদের তলোয়ারের আঘাতে খ্রিস্টান যোদ্ধারা লুটিয়ে পড়তে লাগল। চারদিকে রক্ত আর রক্ত। খ্রিস্টান যোদ্ধাদের লাশ আর লাশ।

যে সব মুজাহিদ শহরে প্রবেশ করেছিল তারা ছোটখাট বাধার সম্মুখীন হয়েছিল। কিন্তু তা মুহূর্ত কালের জন্য। মুজাহিদ বাহিনী প্রায় যুদ্ধ ছাড়াই শহর দখল করে নিল। তারপর ঘোষণা করে দিল, পুরুষরা যেন ঘরের বাইরে চলে আসে। মেয়েরা ঘরে থাকবে। যদি কোন পুরুষকে ঘরে লুকায়িত পাওয়া যায় তবে তাকে হত্যা করা হবে। মহিলাদের কোন ভয় নেই। কেউ তাদের দিকে অশুভ দৃষ্টিতেও তাকানোর সাহস পাবে না। কোন বৃদ্ধ, বালক ও অসুস্থের উপর অত্যাচার করা হবে না। বয়োবৃদ্ধ, অসুস্থ লোকেরাও ঘরের বাইরে আসবে না।

মুজাহিদদের এই ঘোষণা খ্রিস্টানরা বিশ্বাস করতে পারল না। তারা স্ত্রীদের, যুবতী কন্যাদের ঘরের গোপন স্থানে লুকিয়ে রেখে দুরু দুরু হৃদয়ে বাইরে বেরিয়ে এল। মহিলারা ভয়ে আতঙ্কে একেবারে জড়োসড়ো হয়ে রইল। তারা ঘরের দরজা জানালা বন্ধ করে থরথর করে কাঁপছে। কেউ জানালা দিয়ে বাইরে উঁকি দেয়ারও সাহস পাচ্ছে না। যদি বিজয়ী এই বাহিনী রোমান, ইরান বা অন্য কোন অমুসলিম জাতি হত, তাহলে এতক্ষণে লুটতরাজ শুরু হয়ে যেত। ঘরে ঘরে ঢুকে নির্বিচারে নির্দয়ভাবে হত্যালীলা চালাত। যুবতী নারীদের কৌমার্য নিয়ে উল্লাস করা হত। কোন যুবতী তাদের লোলুপতা থেকে রেহাই পেত না। কিন্তু মুজাহিদ বাহিনী কারো বাড়িতে ঢুকে উঁকি পর্যন্ত দেয়নি।

শহরের সকল মানুষ এক উন্মুক্ত প্রান্তরে সমবেত হল। এদিকে শহরের বাইরে খ্রিস্টান যোদ্ধারা একের পর এক ধরাশায়ী হয়ে চলছে। তারা সিপাহ সালার খালিদ ইবনে ওলীদ (রা.)-এর পাতানো ফাঁদে আটকা পড়ে গেছে।

ইউকেলিস তার একশত জানবাজ যোদ্ধা নিয়ে মুজাহিদ বাহিনীর সিপাহ সালারকে খুঁজে ফিরছে। চোখে তার শাহীনের দৃষ্টি। সে জানে না, মুসলমানদের সিপাহ সালার বাদশাহ হয় না, যে রণক্ষেত্র থেকে দূরে অবস্থান করে যুদ্ধ পরিচালনা করে। যুদ্ধ চলাকালে খালিদ ইবনে ওলীদ (রা.) এক স্থানে স্থির রইলেন না। তার সাথে থাকে রক্ষীবাহিনী। ইউকেলিস তাকে খুঁজতে খুঁজতে তার সঙ্গী যোদ্ধাদের নিয়ে মুজাহিদ বাহিনীর আবেষ্টনীতে চলে এল। তারা একে একে আহত হয়ে ঘোড়া থেকে লুটিয়ে পড়তে লাগল। ঘোড়ার পায়ে পদদলিত ও পিষ্ট হতে লাগল।

কে একজন চিৎকার করে বলে উঠল, রোমান সালার দুজন নিহত হয়ে গেছে। একে একে কয়েকজনে এ আওয়াজ দিল। মুহূর্তে গোটা রণাঙ্গনে এ সংবাদ ছড়িয়ে পড়ল। সাথে সাথে খ্রিস্টান যোদ্ধারা নিরাশার অন্ধকারে হাবুডুবু খেতে লাগল। যেন তারা আলো থেকে হঠাৎ নিকষ অন্ধকারে ডুবে গেছে। তারা তলোয়ার, বর্শা ও তীর-ধনুক ফেলে দিল। চিৎকার করে বলতে লাগল, আমরা যুদ্ধ চাই না। আমরা শান্তি চাই। যারা ঘোড়ার উপর সওয়ার ছিল, তারা ঘোড়া থেকে নেমে পড়ল। সবাই আত্মসমর্পণ করে অস্ত্র ফেলে দিল।

খালিদ ইবনে ওলীদ (রা.) যুদ্ধ বন্ধ করে দিলেন। নির্দেশ দিলেন, যারা আত্মসমর্পণ করেছে তারা যেন তাদের অস্ত্র ফেলে দিয়ে শহরের উন্মুক্ত প্রান্তরে শহরবাসীদের সাথে সমবেত হয়। নির্দেশ মোতাবেক খ্রিস্টান যোদ্ধারা অস্ত্র ফেলে নতশিরে শহরের উন্মুক্ত প্রান্তরে গিয়ে সমবেত হল। কিছুক্ষণ পর খালিদ ইবনে ওলীদ (রা.) ও ইয়ায ইবনে গানাম (রা.) শহরের প্রধান দরজা দিয়ে বিজয়ী বেশে প্রবেশ করলেন। এটা ছিল শামের সর্বশেষ কেল্লা। সেটিও আজ মুজাহিদ বাহিনীর পদানত হল। গোটা শাম এখন মুসলমানদের দখলে। যে উন্মুক্ত প্রান্তরে শহরের লোকেরা একত্রিত হয়েছে খালিদ ইবনে ওলীদ (রা.) সে প্রান্তরে গেলেন। চারদিকে দেখে কি যেন বুঝলেন। তারপর সংক্ষিপ্ত বক্তৃতা দিলেন :

আরব খ্রিস্টান ভাইয়েরা! আমরা যুদ্ধ করে এ শহর পদলিত করেছি। আমাদের অনেকে নিহত হয়েছে। অনেকে আহত হয়েছে। বহু বন্ধুকে হারানোর ব্যথা আমাদের মনে। তোমাদের আঘাতে তারা শহীদ হয়েছে। তাই তোমাদের সাথে ব্যবহার করা উচিত অন্যরকম। কিন্তু আমি সে পথে যাব না। আমি আমীরুল মুমিনীন হযরত উমর (রা.)-এর প্রদর্শিত পথে অগ্রসর হব। আমাদের ধর্মীয় বিধান অনুযায়ী তোমাদেরকে ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করতে বলব। আর তারপরও আমাদের অধিকার আছে, আমরা তোমাদের থেকে ক্ষতি পূরণ দাবী করব।

কিন্তু বনু তাগলিব রণক্ষেত্রে যখন অস্ত্র সমর্পণ করেছিল। তখন আমীরুল মুমিনীন নির্দেশ দিয়েছিলেন, কাউকে ইসলাম গ্রহণ করতে বাধ্য করা হবে না। তার বিনিময়ে তাদের থেকে জিযিয়া-কর নেয়া হবে। এই জিযিয়া কর প্রত্যেকের সামর্থানুযায়ী হবে। তোমরা আমাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার জন্য রোমানদের সাথে যোগ দিয়েছিলে। সেজন্য তোমাদের কঠিন শাস্তি পাওয়া উচিত। কিন্তু আমরা তোমাদের কোন শাস্তি দেব না। শহরের কোন বাড়িতে লুট তরাজ হয়েছে? কোন মুসলমান কি কারো ঘরে প্রবেশ করেছে?

সমবেত জনতার সাঝ থেকে উত্তর এল, না, না, সিপাহ সালার! গোটা শহরের কোথাও সামান্য দুর্ঘটনাও ঘটেনি।

খালিদ ইবনে ওলীদ (রা.) বললেন, আমরা তোমাদের মান-ইজ্জত, ধন-সম্পদের হিফাজতকারী। কিন্তু এরপর যদি কেউ বিন্দু পরিমাণ গাদ্দারী করো তাহলে আর ক্ষমা নয়। তাকে হত্যা করা হবে।

উল্লেখ্য যে, আলেপ্পা বাসীদের হৃদয় জুড়ে যে ভয় ও আতঙ্ক ছড়িয়ে ছিল তা নিমিষে দূর হয়ে গেল এবং খালিদ (রা.)-এর আবেগময় হৃদয়স্পর্শী অগ্নিঝরা বক্তৃতায় তখনই অনেকে ইসলাম গ্রহণ করল।

***

 সূর্য অস্তমিত হওয়ার এখনো অনেক সময় বাকি। মুজাহিদরা তাদের আহত সাথীদের ও শহীদদের লাশ রণাঙ্গন থেকে তুলে নিয়ে যাচ্ছে। মুসলিম নারীরা রণাঙ্গন জুড়ে আহতদের পানি পান করাচ্ছে। যারা হাঁটতে পারছে তাদের ধরে ধরে যেখানে চিকিৎসা করা হচ্ছে সেখানে নিয়ে যাচ্ছে। চিকিৎসা কেন্দ্রে প্রচুর আহত মুজাহিদ। একের পর এককে ব্যাণ্ডেজ করা হচ্ছে। মুসলিম নারীরা তাদের সেবা-শুশ্রূষা করছে।

রণাঙ্গনের অবস্থা আরো করুণ। ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা লাশের মাঝ থেকে ক্ষীণ করুণ কণ্ঠ ভেসে আসছে। পানি, পানি, এক ঘোট পানি, কখনো শোনা যাচ্ছে আহতের আর্তনাদ। নারীরা পানির পাত্র নিয়ে রণাঙ্গনে আহতদের পানি পান করাচ্ছে। এদিকে সেদিকে ছুটে যাচ্ছে। হঠাৎ সে এক আতহকে দেখে থমকে দাঁড়াল। বিস্মিত হতবাক হয়ে তার পাশে বসে পড়ল। এ এক আহত যুবক। চেহারায় কোন আঘাত না লাগলেও সারা শরীরে তার ক্ষতের দাগ। রক্তে রক্তে একেবারে একাকার হয়ে গেছে গোটা দেহ। উৎলে উৎলে যেন শরীর থেকে রক্ত ঝরছে।

শারীনার কণ্ঠে সন্দেহ। বলল, তুমি কি ইউকেলিস? সম্রাট হিরাক্লিয়াসের পুত্র এখানে কেন?

আহত যুবকের ওষ্ঠাধর কেঁপে উঠল। ক্ষীণ কণ্ঠে বলল, হ্যাঁ, শারীনা! আমি ইউকেলিস। আমি তোমাকে দেখে বিস্মিয়াভিভূত। তুমি এখানে এলে কিভাবে?

ইউকেলিসের কণ্ঠ অস্পষ্ট। স্পষ্ট করে বলতে চেষ্টা করছে। কিন্তু পারছে না। জীবনীশক্তি তার নিঃশেষ হয়ে যাচ্ছে।

শারীনা বলল, ইউকেলিস! চুপ থাক। এখন জীবন কাহিনী বলার বা শোনার সময় নয়। এই নাও পানি। পান কর। আমি তোমাকে তুলে এক্ষুণি মলম পট্টি লাগানোর ব্যবস্থা করব। আমার সাথে চল।

ইউকেলিস বলল, না, শারীনা! আমার জীবন প্রদীপ এখনই নিভে যাবে। একটু পরই আমি অনন্তলোকে হারিয়ে যাব। আমি এখনো কিভাবে জীবিত আছি তা ভেবে পাচ্ছি না। এখানেই আমাকে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করতে দাও।

ইউকেলিস কাঁপা কাপ হাতে শারীনার হাত ধরল। কি জানি বলতে চাচ্ছে কিন্তু পারছে না।

শারীনা ইউকেলিসকে বলল, আমি কয়েকজন মুজাহিদকে ডেকে আনছি। তারা তোমাকে শহরে নিয়ে যাবে। ইউকেলিস শারীনার হাত আরো শক্ত করে ধরল। বারবার মাথা দুলিয়ে বলছে, না, না, শারীনা! আমি মলম পট্টি লাগাব না। তাতে আমার কোন উপকার হবে না। আমি এখন জীবনের শেষ প্রান্তে পৌঁছে গেছি।

দূরে দূরে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা লাশের মাঝে আরেকজন যুবতী ইউকেলিসকে খুঁজে ফিরছে। সে রোজী। মহিলাদের জন্য বাইরে বেরুনো নিষেধ থাকা সত্ত্বেও রোজী লুকিয়ে লুকিয়ে শুধু ঘর থেকেই নয়, শহর থেকে বেরিয়ে এসেছে। এবং রণাঙ্গনে পৌঁছে তন্ন তন্ন করে ইউকেলিসকে খুঁজে ফিরছে। হয়তো কেউ তাকে বলেছে, ইউকেলিস আহত হয়ে পড়ে আছে বা নিহত হয়েছে।

উন্মাদিনীর ন্যায় রোজী আহত ও নিহতদের মাঝে ঘুরে ফিরছে। ছুটে ছুটে গিয়ে আহত আর নিহতদের চেহারা দেখছে। মাঝে মাঝে পা পিছলে পড়ে যাচ্ছে। আবার উঠে এদিক সেদিক ছুটছে। অবশেষে সে শারীনা ও ইউকেলিসের নিকট পৌঁছল। ইউকেলিসকে দেখে উন্মাদিনীর ন্যায় তাকে জড়িয়ে ধরল। তার চোখে মুখে হাত বুলাতে লাগল। সে নির্বাক।

শারীনা ইউকেলিসের এক হাত ধরে বলল, ইউকেলিস! উঠার চেষ্টা কর। আমরা দুজন তোমাকে তুলে নিতে পারব। তোমার চিকিৎসার ব্যবস্থা করব।

রোজীর কাঁপা কাপ কণ্ঠ। বলল, ইউকেলিস! উঠ।

ইউকেলিস রোজীর দিকে ফিরে তাকিয়ে বলল,রোজী! আমি তোমার অপেক্ষায় এখনো বেঁচে আছি। আমার মাকে বলবে……. এরপর আর কিছু বলতে পারল না। তার চোখের পাতা বন্ধ হয়ে এল। ওষ্ঠাধর মৃদু কেঁপে কেঁপে স্থির হয়ে গেল।

রোজী চিৎকার করে কেঁদে উঠল। ইউকেলিসের লাশ জড়িয়ে ধরে পাথর হয়ে রইল। শারীনার হৃদয় ভেঙে চুরমার হয়ে গেল। বেদনা-বিধূর শারীনা অশ্রু মুছতে মুছতে সেখান থেকে চলে গেল। রোজীকে সে জিজ্ঞেসও করল না, তুমি কে হে যুবতী! ইউকেলিসকে তুমি কিভাবে চিন?

***

 দু অপরাজেয় শক্তি। দু পরাশক্তি। রোম সাম্রাজ্য আর ইরান সাম্রাজ্য। এই দুই সাম্রাজ্যের বিরুদ্ধে একই সময়ে জিহাদ করছে আরবের মুসলিম মুজাহিদরা। মাত্র এক যুগ পূর্বে যাদের পৃথিবীর কেউ চিনত না। ধিক্কার আর লাঞ্ছনা ছিল যাদের কপালের লিখন। আত্মকলহ আর রক্তারক্তি ছিল যাদের নেশা। হাতে তৈরী মূর্তিপূজায় যারা বুঁদ হয়ে থাকত তারা আজ বিশ্বের বিরুদ্ধে লড়ে যাচ্ছে। প্রায় অর্ধেক পৃথিবী তাদের পদতলে।

ইরানের সম্রাটকে মানুষ খোদার পুত্র মনে করে। যার অস্ত্রশস্ত্র আর ধন-সম্পদের কোন পরিমাপ নেই। কিন্তু আল্লাহ্ ও আল্লাহ্র রাসূলের অনুসারীগণ যখন কালিমার দাওয়াত নিয়ে ছড়িয়ে পড়লেন, তখন তথাকথিত আল্লাহ্র পুত্র ইরান সম্রাট ইয়াযদগির্দ রাজধানী মাদায়েনে সমস্ত ধন-সম্পদ, হিরা-জওহার ফেলে প্রাণ নিয়ে পালিয়ে গেল। গোটা ইরান সাম্রাজ্য মুসলমানরা দখল করে নিল। দুনিয়ার বুক থেকে পারস্য সাম্রাজ্যের চিত্র চিরদিনের জন্য মুছে গেল। পালিয়ে ইয়াযদগির্দ তুর্কিস্থানে আশ্রয় গ্রহণ করল। সাম্রাজ্য ফিরে পাওয়ার আশায় সুযোগের সন্ধানে রইল। তার আশা ছিল, একদিন না একদিন ইরানের লোকেরা বিদ্রোহ করবে আর সেই সুযোগে সে তার সাম্রাজ্য ফিরে পাবে। মুসলমানদের নিরস্ত্র করে তবে ক্ষান্ত হবে।

বৎসরের পর বৎসর দীর্ঘ অপেক্ষার পরে হযরত ওসমান (রা.)-এর সময় সে সুযোগ পেল। খোরাসানে বিদ্রোহ হল। ইয়াযদগির্দ এ সুযোগকে সুবর্ণ মনে করে তুর্কিস্থান থেকে মারিতে পৌঁছল। বিভিন্ন কবিলার সর্দারদের সাথে যোগাযোগ করে বিদ্রোহের আগুনে তৈল ঢালল। শুরু হল প্রচণ্ড বিদ্রোহ। কিন্তু মুজাহিদ বাহিনী দ্রুত তা দমন করে ফেলল।

ইয়াযদগির্দের অনুসারীরা পালিয়ে গেল। ইয়াযদগির্দ আবার তুর্কিস্তানে ফিরে যেতে চাইল। কিন্তু ভাগ্যের লিখন কে খণ্ডাতে পারে। সে আর ফিরে যেতে পারল না। সিপাহ সালার সংবাদ পাওয়ার পর ইয়াযদগির্দকে গ্রেফতার করার নির্দেশ দিলেন।

ইয়াযদগির্দ পালিয়ে ফিরতে লাগল। মুজাহিদ বাহিনী তাকে তন্ন তন্ন করে খুঁজতে লাগল। একদিন সে এক খরস্রোতা নদীর তীরে এক পানচাক্কির কামরায় গিয়ে লুকাল। পানচাক্কির মালিক ইয়াযদগির্দকে চিনতো না কিন্তু তার বাদশাহী পোশাক ও ভয় ভয় ভাব দেখে তার নিশ্চিত বিশ্বাস হয়ে গেল যে, সে ইয়াযদগির্দ। পানচাক্কির মালিক তার কামরার দরজা বন্ধ করে মারি শহরে গিয়ে শাসককে বলল, ইয়াযদগির্দ তার কামরায় লুকিয়ে আছে। শাসক সাথে সাথে এক সালারকে ডেকে নির্দেশ দিলেন, ইয়াযদগির্দকে হত্যা করে তার শির নিয়ে এস। পানচাক্কির মালিক এ নির্দেশ শুনে আর দেরি করেনি, সাথে সাথে দৌড়ে চলে এসে নিজ হাতেই ইয়াযদগির্দকে হত্যা করে তার শির কেটে ফেলল। সালার এলে তাকে ইয়াযদগির্দ এর শির দিয়ে দিল এবং তার লাশ নদীর অথৈ পানিতে ভাসিয়ে দিল। এভাবেই পারস্য সাম্রাজ্যের অপরাজেয় শক্তির কর্ণধার সম্রাট ইয়াযদগির্দ পৃথিবীর বুক থেকে বিদায় নিল। অহংকারের চির পরাজয় ঘটল।

***

এদিকে রোম সম্রাট হিরাক্লিয়ার্সের অবস্থাও অত্যন্ত করুণ। যাকে শক্তি দেবতা মনে করা হয়, যার ভয়ে পৃথিবী থর থর করে কাঁপে। সে আজ নিরাপদ আশ্রয়ের সন্ধানে ছুটে ফিরছে। কিন্তু কোথাও আশ্রয় পাচ্ছে না। আলেপ্পা নগরী শামের শেষ কেল্লা। তাও মুজাহিদ বাহিনী দখল করে নিয়েছে।

মুজাহিদ বাহিনী যখন শামের দিকে অগ্রসর হচ্ছে এবং একের পর এক শহর দখল করে নিচ্ছে তখন সম্রাট হিরাক্লিয়াস শামের নিরাপদ শহর ইন্তাকিয়ায় আশ্রয় নিল। সিপাহসালার আবু উবায়দা (রা.) মুজাহিদ বাহিনী নিয়ে সেখানে পৌঁছলেন। ভয়ে হিরাক্লিয়াস সেখান থেকে পালিয়ে রাহা শহরে আশ্রয় নেয়। মুজাহিদ বাহিনী এবার রাহা শহরে পৌঁছে গেল। সে এবার শাম থেকে বহু দূরে দুর্গময় শহর কনস্টান্টিনোপলে আশ্রয় নিল। চিরদিনের জন্য শাম ছেড়ে পালিয়ে গেল। এভাবে পরাজয় ঘটল আরেক অহংকারী বাদশাহর।

সম্রাট হিরাক্লিয়াসের ভাগ্য প্রসন্ন যে, মুজাহিদ বাহিনী যেভাবে অগ্রসর হচ্ছিল হঠাৎ তাদের গতি থামিয়ে দেয়া হল। যদি তাদের অগ্রাভিযান অব্যাহত থাকত তাহলে ইতিহাস অন্যভাবে লেখা হত।

আমীরুল মুমিনীন হযরত উমর (রা.) ছিলেন অত্যন্ত দূরদর্শী ও বিচক্ষণ ব্যক্তি। নিকট ও দূর ভবিষ্যতে কি ঘটবে বা ঘটতে পারে তা তিনি অনুমান করতে পারতেন এবং সেভাবেই পদক্ষেপ নিতেন।

মদীনায় বসে তিনি দেখলেন, মুজাহিদ বাহিনী সুবিস্তৃত এলাকা পদানত করে ফেলেছে। শাম থেকে পালিয়ে গেছে সম্রাট হিরাক্লিয়াস। রোমানদের জুলুম অত্যাচারে নিষ্পেষিত শামের অধিবাসীরা স্বাধীনতা লাভ করেছে। সুতরাং তাদের মাঝে এখন সুশাসন কায়েম করতে হবে। ইসলামের সুমহান আদর্শ তাদের মাঝে বিকশিত করতে হবে। তা না করে যদি মুজাহিদ বাহিনী সামনেই অগ্রসর হতে থাকে তাহলে প্রচণ্ড আশংকা হচ্ছে যে, রোমান গুপ্তচরদের উস্কানীতে শামের লোকেরা চারদিক থেকে বিদ্রোহ করবে। রোমান বাহিনী আবার রুখে দাঁড়াবে। তাহলে মুজাহিদদের এ অভাবনীয় বিজয় পরাজয়েও রূপান্তরিত হয়ে যেতে পারে। তাই তিনি সিপাহ সালারের নিকট নির্দেশ পাঠালেন। আর সামনে অগ্রসর নয়। এবার বিজিত এলাকায় সুশাসন প্রতিষ্ঠার পালা। শাসন ব্যবস্থা দৃঢ় ও মজবুত করা এখন বিজিতদের প্রধান দায়িত্ব।

শাম পদানত করার পর সিপাহসালার আবু উবায়দা (রা.) নামাযের পর মুজাহিদদের লক্ষ্য করে যে সংক্ষিপ্ত বক্তৃতা দিয়েছেন তা আজো ইতিহাসের পাতায় সংরক্ষিত রয়েছে। যার প্রতিটি ছত্র আল্লাহর রাহের মুজাহিদদের চিরদিন অমূল্য পাথেয় হয়ে থাকবে। তিনি বলেছিলেন?

আল্লাহ্ কুরআনে যে সাহায্যের প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন আমরা সে প্রতিশ্রুতির উপর নির্ভর করে আমাদের দায়িত্ব পালন করেছি। আরেকটি বাতিল শক্তিকে ধূলিস্মাৎ করে ইসলামী খিলাফতের সাফল্য বিস্তৃত করেছি। আসলে ইসলামী খিলাফতের কোন সীমানা নেই। আমরা আমাদের রাজত্ব কায়েমের জন্য নয় বরং আল্লাহর রাজত্ব কায়েম করার জন্য ঘরবাড়ি ছেড়ে আল্লাহর রাহে যুদ্ধ করছি। এ ভূপৃষ্ঠ আল্লাহর। এ ভূপৃষ্ঠে আল্লাহর বিধানই চলবে। শহীদরা আল্লাহর সন্তুষ্টির আশায় আল্লাহর রাহে জীবন কুরবান করে দিয়েছে। আল্লাহ্ শহীদদেরকে নিজের নিকট আশ্রয় দেন। তবে যারা জিহাদ করে দুই হাত, পা বা দৃষ্টিশক্তি হারিয়েছে তাদের কুরবানী ও আত্মেত্যাগের কথা স্মরণ কর। তারা সারাটি জীবন বিকলাঙ্গ প্রতিবন্ধী হয়ে থাকবে। তবে সে কারো মুখাপেক্ষী নয়। আল্লাহই তার সন্তান-সন্ততি, পিতামাতা ও পরিজনের রিযিকের জিম্মা নিয়ে নিয়েছেন। রক্ত দিয়ে তারা যে জমিন আযাদ করেছে সে জমিন তাদের জন্য ফসল উৎপন্ন করবে। নিজেকে কখনো তুচ্ছ ভেবো না। তোমাদের সম্পর্ক আল্লাহর সাথে। তোমরা তো প্রত্যহ কুরআন পড়। তোমরা কি একথা পড়নি বা শোননি যে, আল্লাহ্ তোমাদের শ্রেষ্ঠ উম্মত বলে ঘোষণা করেছেন! আর তোমাদের গর্বের বিষয় হল, তিনি তোমাদেরকে বিশ্ব মানবতার কল্যাণের জন্য এবং মানুষকে অন্যায় অমঙ্গল থেকে রক্ষার জন্য নির্বাচিত করেছেন। তোমরা নিপীড়িত মানুষকে যালিম বাদশাহদের কবল থেকে উদ্ধার করবে। মানুষকে মিথ্যার অন্ধকার থেকে সত্যের আলো উদ্ভাসিত পথে নিয়ে আসবে। সুতরাং তোমরা নিজেদেরকে নিঃসঙ্গ বন্ধুহীন মনে করবে না। আল্লাহ্ সর্বদা আমাদের সাথে আছেন।

***

আলেপ্পা শহরের পতন ঘটেছে। মুজাহিদরা শহরে প্রবেশ করেছে ও করছে। শহরের চতুর্পার্শ্বে খ্রিস্টান যোদ্ধাদের লাশ ছড়িয়ে আছে। বহু দূর পর্যন্ত তাদের লাশ দেখা যাচ্ছে। মহিলারা শিশু কিশোররা শহরের বাইরে চলে এসেছে। সবার চোখে স্বজন হারানোর অশ্রু। দুঃখ বেদনার ছাপ। তাদের আহাজারি আর আর্তচিৎকারে হৃদয় কেঁপে উঠে। তারা স্বজনদের লাশ খুঁজছে। এক মহিলা চিৎকার করে বলছে, হায়! কার জন্য তোমরা যুদ্ধ করলে? কার জন্য তোমরা প্রাণ দিলে? রোমান দুই সালারই আমাদের সর্বনাশ করল। ওই দুই সালারই আমদের ধ্বংস করল।

মহিলার এই কথা এক কান দুকান হয়ে অনেকের মাঝে ছড়িয়ে পড়ল। অনেকেই তা বলাবলি করতে লাগল।

অপর এক মহিলা বলল, আরে শুধু দুই সালারই নয় তাদের সাথে ছিল এক ডাইনী। খুব সুরত ডাইনী। সে মহিলাদের যুদ্ধের জন্য উদ্বুদ্ধ করত।

আরেক মহিলার কণ্ঠ শোনা গেল। বলল, ডাইনী মহিলা এখন কোথায় লুকিয়েছে?

অন্য এক মহিলার রোষ কষায়িত কণ্ঠ শোনা গেল। বলল, তাকে জীবিত পেলে কেটে দুটুকরো করব।

এক মহিলা বলল, ঐ ডাইনী মহিলার স্বামী মারা গেছে। তার ছেলের কোন সন্ধান নেই।

আরেকজন বলল, আরে! আরেকজন সালার কি যেন নাম সেও মারা গেছে। আমি তার লাশ দেখেছি।

কয়েকজন মহিলার সমবেত ক্ষুব্ধ কণ্ঠ শোনা গেল। বলল, আরে ঐ ডাইনীকে পেলে সাত-পাঁচ ভেবনা। খঞ্জরের আঘাতে শেষ করে দাও। তাদের কারণেই আমাদের এই দশা, এই সর্বনাশ।

ধীরে ধীরে অনেক মহিলা এসে সেখানে সমবেত হয়েছে। আরেক মহিলা বলল, আরে! তোমরা সেই ডাইনীর কথা বলছো! সে তো ঐ দ্বিতীয় সালারের বাড়িতে মরে পড়ে আছে। বেশ কিছু মহিলা এবার সে দিকে ছুটল। তারা দেখল, উঠানে লীজার লাশ পড়ে আছে। রক্তে রক্তে একাকার। রক্তের ধারা নীচু জায়গা দিয়ে এদিক সেদিক চলে গেছে। মহিলারা নাকে কাপড় দিয়ে ঘৃণা আর ক্ষোভ প্রকাশ করতে করতে চলে এল। কেউ বলল, লাশ টেনে নিয়ে বাইরে ফেলে এস। আরেকজন বলল, তা করে আর লাভ কি, এখানেই পড়ে থাকুক। পঁচে গলে নিঃশেষ হয়ে যাক। বাড়িটি বিরাণ হয়ে থাক।

আহত ও জখমীদের তুলে তুলে শহরে আনা হচ্ছে। আহতদের সেবার জন্য একটি ফৌজী চিকিৎসা কেন্দ্র খোলা হয়েছে। সেখানে সবার চিকিৎসা চলছে। মুসলমান, খ্রিস্টান সবার জন্য তার দরজা উন্মুক্ত। মুসলমান নারীরা আহতদের ক্ষতস্থানে মলম পট্টি লাগিয়ে দিচ্ছে। সেবা-শুশ্রূষা করছে। শারীনা একাজে নিয়োজিত ছিল। অত্যন্ত যত্নের সাথে দীর্ঘক্ষণ এ কাজ করছে।

শহরের এক গলি দিয়ে যাওয়ার সময় শারীনা কিছু সমবেত মহিলাকে আলোচনা করতে শুনল। তারা বলছে, ঐ বাড়িতে এক রোমান সালারের স্ত্রীর লাশ পড়ে আছে। শারীনার অনুসন্ধিৎসু মনে দোলা লাগল। সে হাঁটতে হাঁটতে সেই বাড়িতে উপস্থিত হল। গিয়ে দেখল, এখনো দুচারজন মহিলা লাশটি দেখছে।

শারীনা লাশ দেখে একেবারে হতবাক। বিস্ময়ে অভিভূত হয়ে কাঁপতে লাগল। আরে! এতো লীজার লাশ! সম্রাট হিরাক্লিয়াসের স্ত্রী লীজা। সে এখানে এলো কিভাবে। তাকে হত্যা করল কে? মুসলমানরা তো কোন মহিলাকে হত্যা করে না, বরং কোন মহিলার দিকে তাকানোও তাদের নিকট মহাপাপ।

শারীনা যখন শুনেছিল যে, দুজন রোমান সালার মারা গিয়েছে। সে তখন তাদের লাশ দেখেছিল। আন্তোনীসকে সে চিনত। আন্তোনীসের লাশ দেখে সে দারুণ বিস্মিত হয়েছিল। তারপর রাতাসের লাশ দেখে তো সে একেবারে হতবুদ্ধি হয়ে গিয়েছিল। সে চিন্তা করেছিল, হয়তো সম্রাট হিরাক্লিয়াস তাদের দুজনকে আলেপ্পা নগরীতে বিদ্রোহ সৃষ্টি করার জন্য পাঠিয়েছিল। কিন্তু হিরাক্লিয়াস তার স্ত্রীকে কেন পাঠাবে? চিন্তার যোগসূত্র সব ছিন্নভিন্ন করে যাচ্ছে। কিছুই সে বুঝে উঠতে পারছে না।

যে দুচারজন মহিলা লীজার লাশের পাশে ছিল তারা চলে গেল। শারীনা একাকী লাশের পাশে দাঁড়িয়ে রইল। এক আকাশ চিন্তা তার মাথায়। সবকিছুই ঘোর অন্ধকারে আচ্ছন্ন।

হঠাৎ শারীনা একটি মিহি সুরেলা নারী কণ্ঠ শুনতে পেল। না…..না তা হতে পারে না। সবকিছু মিথ্যা। মিথ্যা। মিথ্যা।

শারীনা সচকিত হয়ে ফিরে তাকাল, দেখল, সেই খুবসুরত রূপসী যুবতীটি যাকে সে ইউকেলিসের লাশের সামনে পেয়েছিল। ইউকেলিস তাকে আদর করে রোজী নামে ডাকত। শারীনা তাকে ইউকেলিসের লাশের পাশে ক্রন্দনরত অবস্থায় রেখে চলে এসেছিল। তাকে এতটুকুও জিজ্ঞেস করনি যে, সে কে? কি তার পরিচয়? এখন হয়তো সে কারো মুখে শুনেছে যে ইউকেলিসের মায়ের লাশ অমুক স্থানে পরে আছে। তাই সে এখানে ছুটে এসেছে। সে এসে লীজার মাথা ধরে এমনভাবে নাড়া দিচ্ছে যেন কোন ঘুমন্ত মানুষকে জাগ্রত করছে। সে বলছে, মা! আপনি মরতে পারেন না। মা! আপনি বলতেন, আমাকে ইউকেলিসের বধূ বানাবেন। উঠুন মা! উঠুন! ইউকেলিসের নিকট চলুন! সে তো আপনার অপেক্ষা করছে।

শারীনার চোখ অশ্রুসজল হয়ে উঠল। হৃদয় চিরে কান্নার গমক বেরিয়ে আসতে লাগল। সে বুঝতে পারল, এই যুবতী ইউকেলিসের বিচ্ছেদ সহ্য করতে পারেনি। সে ভারসাম্য হারিয়ে আধা পাগলিনী। শারীনা তার কাঁধে হাত রেখে তাকে পাশে দাঁড় করাল। তারপর বলল, রোজী! আমি তাকে তুলে নিব। সে তো গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন হয়ে আছে। সে তোমার কি হয়?

রোজী উত্তরে বলল, সে ইউকেলিসের মা! আমার কিছু হয় না। তবে আমার সবকিছুই ইনি। আমাকে ইউকেলিসের পাশে দেখে তিনি খুব আনন্দিত ও বিমুগ্ধ হতেন। বলতেন, আমি আমার পুত্রের জন্য তোমার মত কনেকেই দীর্ঘদিন যাবৎ খুঁজছি।

এ মেয়ের দুঃখে শারীনার হৃদয় হাহাকার করে উঠে। সে ভেবেই পাচ্ছে না যে, সে কিভাবে তাকে বুঝাবে যে, ইউকেলিস মারা গেছে আর তার মাও মারা গেছে। এরা দুনিয়াতে আর ফিরে আসবে না। শারীনা তার হাত ধরে তার সাথে বিভিন্ন বিষয়ে কথা বলছে। কথার মাঝে মাঝে তাকে শান্ত্বনা দিচ্ছে, তাকে সুস্থ করে তোলার চেষ্টা করছে।

ইতিমধ্যে একজন বয়সী মহিলা ছুটে এসে উপস্থিত হল। সেও যুবতী মেয়েটিকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে থাকে। মহিলাটিকে দেখে মনে হল সে রোজীর মা। মহিলা রোজীকে মমতার সাথে বলছে, রোজী! চল! বাড়িতে ফিরে যাই।

রোজী পরিষ্কার কণ্ঠে বলছে, মা! তুমি ফিরে যাও! আমি ইউকেলিসকে ডেকে আনছি। সে তার মাকে ঘুম থেকে তুলে ঘরে নিয়ে যাবে।

শারীনা রোজীর মাকে ইশারা করল, যেন তিনি এখন রোজীকে মুক্ত থাকতে দেন। শারীনা রোজীর মাকে একটি কামরায় নিয়ে গেল। জিজ্ঞেস করল, আপনার মেয়ের কি হয়েছে?

রোজীর মা বলল, ইউকেলিসের সাথে রোজীর প্রেম ছিল। তারা একে অপরকে হৃদয় দিয়ে ভালবেসেছিল। ইউকেলিস বলেছিল, তার পিতা সম্রাট হিরাক্লিয়াস। কিন্তু তার এক ভাই নাম কুসতুমীন-সে তাকে হত্যা করতে চেয়েছিল। আন্তোনীস তাকে রক্ষা করেছে। ফলে আন্তোনীসের সাথে সে ও তার মা পালিয়ে এসেছি। ইউকেলিস রোজীকে একথাও বলেছিল, সে প্রকৃতপক্ষে আন্তোনীসের সন্তান। সম্রাট হিরাক্লিয়াসের নয়।

রোজীর মুখে শোনা সব কথা তার মা শারীনাকে বললো। শারীনা এ কথা শুনে বিস্মিত হল না যে ইউকেলিসের মা সম্রাট হিরাক্লিয়াসের স্ত্রী হলেও ইউকেলিস সম্রাটের পুত্র নয়। বরং আন্তোনীসের পুত্র। কারণ এ ধরনের ঘটনা রাজা-বাদশাদের হেরেমে প্রচুর ঘটে থাকে।

তারপর রোজীর মা বলল, আন্তোনীস মুসলমানের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে নিজেই একটি সাম্রাজ্য গড়ে তুলতে চেয়েছিল। সে তার স্বপ্নের সাম্রাজ্যকে ঈসা মাসীহের সাম্রাজ্য বলত।

রোজীর মা ও শারীনা যখন ঘরে বসে কথা বলছে ঠিক তখন তারা বাইরে রোজীর চিৎকার ধ্বনি শুনতে পেল। চিৎকার করে রোজী বলছে, ইউকেলিস ও তার মাকে হিরাক্লিয়াসই হত্যা করিয়েছে। আমি হিরাক্লিয়াসকে হত্যা করতে যাচ্ছি। তার পরই রোজীর দৌড়ে যাওয়ার পদধ্বনি শোনা গেল। সে বাড়ি থেকে বেরিয়ে গেল। কাল বিলম্ব না করে রোজীর মাও পিছনে পিছনে ছুটল। শারীনাও বেরিয়ে এল। দেখল, রোজী শহরের সদর দরজার দিকে ছুটে চলছে। তার পিছু পিছু তার মা চিৎকার করে বলছে, তাকে ধর, তাকে ধর, যেতে দিয়ো না ….. দিয়ো না……।

শহরের অবস্থা তখন এমন, একজনের দিকে অন্যের ফিরে তাকাবার সুযোগ নেই। সবাই স্বজনদের লাশ বয়ে চলেছে। কেউ কেউ রক্তাক্ত জখমীকে ধরে ধরে ঘরে নিয়ে যাচ্ছে। চারিদিকে মৃত্যুর হাহাকার। স্বজন হারানোর হৃদয় বিদারক কান্না। তাই কেউ আর রোজী ও তার মায়ের দিকে ফিরে তাকাল না।

***

আমীরুল মুমিনীন হযরত উমর ইবনে খাত্তাব (রা.)-এর নির্দেশ সবাই মেনে নিল যে, সামনে আর অগ্রসর নয়। এবার বিজিত অঞ্চলের শাসন ব্যবস্থা সুদৃঢ় করতে মনযোগী হওয়া জরুরী। কিন্তু একজন সালারের উত্তপ্ত রক্ত এখনো টগবগ করছে। তিনি আমীরুল মুমিনীনের নির্দেশ হৃষ্টচিত্তে মেনে নিতে পারলেন না।

সিপাহ সালার হযরত আবু উবায়দা (রা.) যখন আলেপ্পায় পৌঁছেছিলেন এবং সকল মুজাহিদকে একত্রিত করে আমিরুল মুমিনীন হযরত উমর (রা.)-এর সিদ্ধান্তের কথা জানিয়ে এক সংক্ষিপ্ত ও মূল্যবান ভাষণ দিয়েছিলেন, তখন সে সালার সেখানে উপস্থিত ছিলেন না। তিনি অন্যত্র ছিলেন। পরে তিনি আমীরুল মুমিনীনের নির্দেশ শুনেও চুপ থাকলেন না। তিনি এ নির্দেশের ব্যাপারে একমত হতে পারলেন না। তিনি হলেন হযরত আমর ইবনে আস (রা.)। তার দ্বিমতের কথা সিপাহসালার আবু উবায়দা (রা.)-এর কানে পৌঁছল। তিনি দুঃখ পেলেন। এর কিছুদিন পর আমর ইবনে আস (রা.)-এর সাথে দেখা হলে প্রথমে তিনি বললেন, হে আমর ইবনে আস! এমন দুঃখজনক আচরণ কেন করছো? এতে তো মুজাহিদদের মাঝে দ্বন্দ্ব সৃষ্টি হয়। বিভেদ সৃষ্টি হয়।

আমর ইবনে আস (রা.)-এর দ্ব্যর্থহীন কণ্ঠ, বললেন, রোমানদের পশ্চাদ্ভাবন করা উচিৎ ছিল। আমি রোমানদের পিছু পিছু মিশর পর্যন্ত পৌঁছতে চাই। রোমানরা এখন ছিন্নভিন্ন বিক্ষিপ্ত হয়ে ভেড়া বকরীর ন্যায় দিগ্বিদিক ছুটে পালাচ্ছে। এ সময় যদি আমরা তাদের পশ্চাদ্বাবন করে মিশরে গিয়ে পৌঁছি তাহলে মিশর খুব সহজে আমাদের দখলে চলে আসবে।

সিপাহসালার আবু উবায়দা (রা.) বললেন, ইবনে আস! তোমার কথা শুনে আমি দারুণ বিস্মিত, অত্যন্ত আশ্চাৰিত। এতো তাড়াতাড়ি তুমি ভুলে গেলে যে, বিভিন্ন গোত্রের খ্রিস্টানরা শুধুমাত্র এ কারণে শহরে শহরে বিদ্রোহ করছে যে, সেখানে মুজাহিদের সংখ্যা অনেক কম। তারা প্রশাসন সামলাতে হিমসিম খাচ্ছে। এটা তো আল্লাহর অশেষ রহমত যে, আমরা অতি সহজে বিদ্রোহ দমন করতে পেরেছি। এবার একটু চিন্তা করে দেখ, আমাদের বাহিনী এসব শহর ছেড়ে সামনে অগ্রসর হলে এই সুযোগে তারা কি বিদ্রোহ করবে না? নিশ্চয় করবে।

আমর ইবনে আস (রা.) কোন সাধারণ সালার ছিলেন না। তিনি ছিলেন অত্যন্ত দূরদর্শী, বিচক্ষণ, চৌকস ও হুঁশিয়ার। মিসরকে ইসলামী খিলাফতের অন্তর্ভুক্ত করা ছিল তার এক ইস্পাত কঠিন শপথ। মনে হত আল্লাহ্ যেন তাকে মিসর বিজয়ের জন্য সৃষ্টি করেছেন। তাই তাকে এই আকাঙ্ক্ষা ও চেতনা দান করেছিলেন।

***

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *