দ্বিতীয় অধ্যায় (অনুভবের গভীরতা)
মাতৃত্বের নেশা
৭
বৃষ্টিবিঘ্নিত অন্ধকারাচ্ছন্ন বিদঘুঁটে একটি রাত। যদিও শুষ্ক মৌসুম। কিন্তু আবহাওয়া কি আর ধরাবাঁধা মৌসুম বুঝে? মাঝেমধ্যে সে-ও বিদ্রোহ করে ওঠে। সেদিন বাইরে প্রচণ্ড বৃষ্টির সাথে বাতাসের তীব্রতা এতটাই বেশি ছিল যে, তিনতলা ভবনের ভেতর থেকেও মনে হচ্ছে এই বুঝি মাথার ওপর কিছু একটা আছড়ে পড়ল।
সৈকত বাড়ি ফিরতেও আজ খুব লেট করছে। অবশ্য অফিসের চাপে প্রায়ই এমন লেট হয়। একা নিস্তব্ধ বাড়ি তার উপর এমন মুহূর্মুহু ঝটিকা বৃষ্টির শোঁ শোঁ আওয়াজ বেশ ভীতিকর অবস্থার সৃষ্টি করেছে।
নীলিমা অন্তঃসত্ত্বা। বড্ড সরলমনা একটি মেয়ে। মৃত্যুভয়কে সাদরে আলিঙ্গন করে মাতৃত্বের স্বাদ পেতে দীর্ঘদিন যাবত বেশ মুখিয়ে আছে। সন্তানের কোমল পরশে একটু তৃপ্ত হবার মাদকীয় নেশায় বুঁদ হয়ে আছে। এটাকে একপ্রকার নেশা বলা যায়। মাতৃত্বের নেশা। বড় শৈল্পিক ও অকৃত্তিম নেশা এটা। নারীত্বের এক অবিচ্ছেদ্য অংশ-এ নেশা।
এ কী! মাথাটা ছট করে কেমন যেন ঝিমঝিম করছে। সবকিছু কেমন ঘোলাটে দেখাচ্ছে। অমনি ধপাস করে বিছানায় পড়ে গেল নীলিমা। কোনরকম বালিশটি মাথার নিচে গুঁজে দিতেই হাত-পা কেমন অবস হতে শুরু করল। পুরো দেহটা বড় ভঙ্গুর হয়ে গেল মুহূর্তেই।
পুরো তিনতলা ভবনটি যেন নীলিমার মাথার ওপর ভেঙ্গে পড়ার উপক্রম। ভয়ে মেয়েটি কেঁদে ফেলল। এরপর কান্না বিজড়িত কণ্ঠে বিড়বিড় করে বলল, আমি এখনই মরতে চাই না। আমার কলিজা চেরা ধনকে একনজর দেখার আগে আমি মরতে চাই না। কেবল একটিবার দেখা হলে আমার আর কোনপ্রকার আপত্তি থাকবে না। আমায় রহম করো আল্লাহ।
এই বলতে বলতেই আচমকা চৈতন্যহীন হয়ে পড়ল নীলিমা। একদম চুপসে গেল।
ডিম লাইটের মৃদু আলোতে নীলিমার নিষ্প্রভ মুখাবয়ব বিন্দু বিন্দু ঘামের কারণে চিকচিক করছে। কিছুক্ষণ পর জ্ঞান ফিরলে বাকরুদ্ধ হয়ে ক্ষানিক পরপরই খুব শক্ত করে ঠোঁট কামড়ে ধরে বিছানার চাদরটি খুব করে খামচে ধরছে। পুরো চাদরটিকে মুড়িয়ে ফেলেছে মুহূর্তের মধ্যেই।
মনে হচ্ছে যুদ্ধবিধ্বস্ত ধ্বংসস্তূপ থেকে কোন এক অবলা প্রাণ নিজেকে শেষ রক্ষার তাগিদে কোন নিরাপদ আশ্রয় খুঁজতে দিগ্বিদিক হয়ে পথ খুঁজছে। কিন্তু নিরূপায় হয়ে বিছানার চাদরটিকেই আঁকড়ে ধরে আশার ঝাণ্ডা পুনরায় বসন্তের মুক্তাকাশে পতপত করে উড়াতে চাচ্ছে।
এভাবে প্রায় আধাঘণ্টা পর্যন্ত অতিবাহিত হলো। অব্যক্ত যন্ত্রণায় নীলিমার ক্ষীণ দেহের প্রতিটি হাড় যেন গলে যাচ্ছে। মাংশপেশীগুলো চড়চড় করে চিরে ছিন্নবিচ্ছিন্ন হয়ে যাচ্ছে। চোখদু’টি বোধহয় এবার উঠেই চলে আসবে। কলিজাটা বুঝি মুখ দিয়েই বেড়িয়ে পড়বে। হৃৎপিণ্ডটা বোধহয় শেষবারের মত নিজেকে প্রবলভাবে প্রকম্পিত করে নিচ্ছে। ফুসফুসদ্বয় এই বুঝি নিঃশ্বাসকে আটকে দিতে চাচ্ছে। শ্বাস নিতে অত্যধিক কষ্ট হচ্ছে।
‘আচ্ছা! আমার এমন লাগছে কেন?’ নিজেকে উদ্দেশ্য করে নিলীমার স্ফীত উক্তি।
অমনি বাইরে প্রবল বর্ষণের তর্জন-গর্জনকে ম্লান করে দিয়ে বিকট এক চিৎকারে আকাশ-বাতাস তুমুল আলোড়িত হয়ে উঠল। বড় নিষ্পাপ সে আওয়াজ। বহু কাঙ্ক্ষিত সে চিৎকার। ক্রমাগত চিৎকারে মেঘও যেন ভয় পেয়ে থমকে যাবার উপক্রম।
কিন্তু নীলিমা হঠাৎ আঁকড়ে ধরে রাখা বিছানার চাদরটি ছেড়ে দিল কেন? অব্যক্ত চাঁপা যন্ত্রণায় গোঙ্গানির শব্দ হুট করেই শুণ্যে মিলিয়ে গেলো কেন? সে কী! ডিম লাইটটিও দেখছি নিজেকে নিভিয়ে নিয়ে নীলিমাকে অন্ধকারাচ্ছন্ন করে দিল! এমন হচ্ছে কেন সবকিছু? ওর ভয় হয় না বুঝি? এমনিতেই মেয়েটি অন্ধকারকে খুব ভয় পায়।
এমনসময় কলিং বেল বেজে উঠল- টিং…টুং…
ভেতর থেকে কেবল সদ্যজাত শিশুর কান্নার আওয়াজ ছাড়া কিছু শোনা যাচ্ছে না। আচমকাই আনন্দের একপশলা ঝুমবৃষ্টি যেন হৃদয়টা প্রশান্ত করে দিল। কিন্তু দরজা খুলছে না কেন?
‘নীলিমা! এই নীলিমা…!’
মিনিট পাঁচেক ডাকাডাকি করেও কোন সাড়া না পেয়ে পাশের ক্লিনিক থেকে একজন নার্স ও সাথে একজন মিস্ত্রী ডেকে এনে প্রবল উত্তেজনায় দরজা ভেঙে ফেলল। নার্স দ্রুত ভেতরে ঢুকে সবকিছু ম্যানেজ করে বাচ্চাটিকে সৈকতের হাতে তুলে দিল। সদ্য ভূমিষ্ঠ হওয়া নিজের কন্যাসন্তানকে পেয়ে বড় আপ্লুত হয়ে পড়ল সৈকত। ওকে চুমু খেতে খেতে নীলিমাকে ডেকে বলল, ‘ওগো দেখো! কী মায়াময় চেহারা! ঠিক যেন মায়ার এক রাজ্য দখলে নিয়েই আমাদের কোলে এসেছে। এই শোনো! ওর নাম কিন্তু আমি ‘মায়া’ রেখে দিলাম…!
আনন্দের অতিসজ্জে সৈকত একা একাই কিছুক্ষণ বিড়বিড় করে এবার থেমে গেল। তাকিয়ে দেখে, নীলিমা বালিশ থেকে মাথা নামিয়ে মুখটা মায়ার দিকে ফিরিয়ে ঠোঁট দু’টিতে কিঞ্চিৎ হাসি এঁটে অপলক তাকিয়ে আছে।
‘কিন্তু নীলিমা এভাবে করে তাকিয়ে আছে কেন? আর আমার কথার উত্তর দিচ্ছে না কেন?’ প্রশ্নটি সৈকতের হৃদয়ে মুহূর্তেই ঝড় তুলে দিল। চোখদুটি ছানাবড়া হয়ে গেল!
মায়াকে রেখে নীলিমার গালে ছুঁয়ে দিতেই মুখটা অন্যদিকে ঘুরে পড়ে গেল।
-এসব কী হচ্ছে? নীলিমা এমন করছো কেন? নীলিমা! এই নীলিমা…!
এই বলতে বলতেই বিকট এক চিৎকারে নীলিমার উপর আছড়ে পড়ল সৈকত। নীলিমার চোখদু’টি আঙ্গুল দিয়ে মেলে ধরে বলল, ‘এই নীলিমা! দেখো দেখো! তোমার মায়া কেমন করে তাকিয়ে আছে তোমার দিকে। আর তুমি ওকে ফিরেই দেখছো না। এই নীলিমা! নীলিমা! এই পাগলী! এই…!’
এই বলে নীলিমাকে বুকের পাঁজরের সাথে শেষবারের মতো খুব করে চেপে ধরেছে। এই মুহূর্তে সৈকতের কলিজাটা যেন পাঁজর ভেদ করে বেরিয়ে আসতে চাইছে। উপচে পড়া শুভ্র নোনা রক্তে ভেতর-বাহির ছুপছুপ হয়ে গেছে…
আচ্ছা! এ দেশের সৈকতরা কি নীলিমাদের এই ব্যথা অনুভব করতে পারে না? নিজের অস্তিত্বকে বিসর্জন দিয়ে তাদেরকে বাবা হবার স্বাদ এনে দেওয়ায় একটু কৃতজ্ঞ কি হতে পারে না? এই কঠিন মুহূর্তে তাদের পাশে থেকে মাথায় একটুখানি হাত বুলিয়ে দেওয়ার কি সময় তাদের হয় না?
দীর্ঘক্ষণ পর আদিব থামল। গল্প বলার সাথে সাথে কিছু সময়ের জন্য নিজেই যেন সৈকত হয়ে গিয়েছিল। এতক্ষণে চোখজোড়া আর্দ্র হয়ে এসেছে। ভেতরে এক আকাশ মেঘ জমেছে।
হাসান বলল, ‘এমন করে না বললেও পারতিস। আমি জানি, একটি মেয়ে এই সময়ে কতটা কষ্ট সহ্য করে।’ হাসান এই বলে আদিবের অলক্ষ্যে চোখ মুছে নিল।
আদিব আনমনা হয়ে কোথাও তাকিয়ে আছে। কিছুক্ষণ পরপর অনুভূতির ঢোক গিলছে। যাতে কষ্টগুলো চোখ বেয়ে নিচে নেমে যায়। ঠিক এমনসময় টুপ করে একটি ফোঁটা গাল বেয়ে গড়িয়ে পড়ল। আলতো ছোঁয়ায় সেটা মুছে নিয়ে হাসানের উদ্দেশ্যে বলল, ‘হাসান, জানা আর অনুভব করার মাঝে বিস্তর ব্যবধান।’
হাসান খুব কঠিন মনের মানুষ হলেও নীলিমার আত্মত্যাগ ওর চোখকে শিক্ত করেছে। কিছুটা হলেও কাঠিন্য ভেদ করতে পেরেছে। সেটাকে আরও তরান্বিত করতে আদিব আবারও বলতে শুরু করল, ‘হাসান, বল তো, নীলিমা তখন ঘামছিল কেন?’
হাসানের নিরবতায় আদিবই এর উত্তর বলতে লাগল।
‘শোন, আমরা সাধারণত জানি যে, শারীরিকভাবে কেউ আঘাতপ্রাপ্ত হলে সে ব্যথায় কুঁকিয়ে ওঠে, কাতরাতে থাকে। কিন্তু ঘর্মাক্ত হয় না। ঘর্মাক্ত হয় ভয়ের কারণে। হ্যাঁ, ভয়। মুহূর্তেই দপ করে পুরো শরীর ঘেমে নেয়ে ওঠে।
বেশ কিছুদিন আগে একবার নামাজের মধ্যে ঠিক সালাম ফিরানোর আগমুহূর্তে হুট করেই আমার পুরোটা শরীর ঘেমে একদম ভিজে হয়ে গেল। নিজেও বুঝতে পারিনি ঘটনা কী। সালাম ফিরিয়ে নিশ্চিত হলাম যে, মাত্রই বড়সড় ভূমিকম্প হয়ে গেল। ততক্ষণে গলা সহ পুরো কণ্ঠনালী শুকিয়ে গিয়েছিল। কপাল থেকে ঘাম টপকে পড়ছিল তখনও। হ্যাঁ, এই ঘামের কারণ হলো ভয়।
যখন স্কুলে SSC টেষ্ট এক্সামের রেজাল্ট দিবে তার ঠিক আগমুহূর্তে আমার সাদা শার্টটি ঘেমে একদম শরীরের সাথে মিশে গিয়েছিল। মনে হচ্ছিল যে, হাতের তালু যেন মাত্রই টিউবওয়েল থেকে ধুয়ে এলাম, আর আঙ্গুল বেয়ে টপটপ করে সেই পানির ফোঁটা পড়ছে। সেইসাথে মাথার চুলগুলোও ভিজে তালুর সাথে লেপ্টে গেছে। এতটা ঘর্মাক্ত হবার কারণ হলো এক অজ্ঞাত শঙ্কা! সব সাবজেক্টে পাশ করব তো? যদি ফেল আসে তবে মুখ দেখাব কীভাবে? এই শঙ্কায় জিহ্বাটাও শুকিয়ে যাচ্ছিল। আমার চেয়ে ভালো ভালো স্টুডেন্টদেরকে কয়েক সাবজেক্টে ফেইল করার কারণে কান্নারত দেখতে দেখতে হাপিয়ে উঠছিলাম। অবশেষে শুকরিয়া যে, বিশেষ বিবেচনা ছাড়া সবগুলো সাবজেক্টে বেশ ভালোভাবেই পাশ করেছিলাম।
তো একজন মায়ের যখন প্রসব বেদনা শুরু হয় তখন অব্যক্ত যন্ত্রণার কারণে সে কুঁকিয়ে ওঠে, কিন্তু সেইসাথে তার কপালে গুঁড়িগুড়ি বৃষ্টির ফোঁটার ন্যায় ঘামের আধিক্য হয় কেন? যেমনটা নীলিমার হয়েছিল!
মুহূর্তেই ব্যথার প্রচণ্ডতায় তার বাকশক্তিটুকুও স্তব্ধ হয়ে যায়। ঘামে শরীরের কাপড় সব ভিজে যায়। কপালের ঘামগুলো নাক বেয়ে, গাল বেয়ে পড়তে থাকে। জিহ্বাটা যেন পুরোটাই বেরিয়ে আসতে চায়। কলিজাটা সহ যেন ছিঁড়ে আসতে চায়। অনেকে সেন্সলেসও হয়ে যায়…
এই ব্যথাটাকে অনেক ডাক্তাররাই ২০টি হাড় একসাথে ফ্র্যাকচার হওয়া অর্থাৎ ভেঙ্গে যাওয়ার ব্যথার সাথে তুলনা করেছেন। তবে এই ব্যথার প্রকৃত ভয়াবহতা কেবল সেই মা ছাড়া পৃথিবীর দ্বিতীয় কারো পক্ষে অনুভব করা কোনভাবেই সম্ভব নয়।
এই হলো ব্যথার অবস্থা। আর ঘামের কারণটা একবার বলেছি যে, এটা হয় ভয়ের কারণে। এই বুঝি আমার প্রাণপ্রিয় পাগলটাকে হারিয়ে চিরদিনের জন্য অচেনা পথ ধরলাম, আর বুঝি প্রিয় মানুষটাকে বুকে জড়িয়ে একটু কান্না করার ভাগ্য হবে না, আর বুঝি ওর সাথে দুষ্টু মিষ্টি ঝগড়া করার সুযোগ মিলবে না, আর বুঝি ওর আদুরে ডাকটুকু শুনতে পারব না, আর মনেহয় ওকে নিজ হাতের রান্না করা খাবারটুকু খায়িয়ে দিতে পারব না, আমার কলিজা চেরা সন্তানের চাঁদমুখখানি দেখার সৌভাগ্য বুঝি আর হবে না…
এসব ভেবে ভেবে প্রচণ্ডরকম ভয় ও শঙ্কা ওর কলিজা নিঙড়ে কপাল ও শরীর থেকে ঘাম বের করে মুহূর্তেই শরীরটাকে ছুপছুপে করে দেয়।
এসময় মেয়েটি তার পাশে এমন কাউকে চায়, যে তার কপালের ঘাম মুছে দিয়ে কপালটাতে আলতো করে ঠোঁট ছুঁইয়ে ফিসফিস করে বলবে, ‘এই পাগলী! তোমার কিচ্ছু হবে না, এইতো আমি আছি তোমার পাশে। আজীবন তোমাকে আমার বুকের খাঁচায় বন্দি করে রাখব। কোথাও হারাতে দেব না। প্রতিরাতে তোমার হাতের খাবার আমার মুখে তুলে নেব। কী? পারবে না আজীবন খাইয়ে দিতে?
এই বলে মাথায় হাত বুলাতে থাকবে আর মেয়েটি দু’চোখের পানি ছেড়ে দিয়ে তাতে সম্মতি জানাবে…
জানিস হাসান! মাত্র এইটুকুন কেয়ারিং মেয়েটির ২০টি হাড় একসাথে ফ্র্যাকচার হওয়ার চেয়েও অধিক এই ব্যথার কথা মুহূর্তেই ভুলিয়ে দিয়ে, অনাগত হাজারও শঙ্কা মুছে দিয়ে অনাবিল এক প্রশান্তি ওর হৃদয়টাকে শিক্ত করে দেয়। বিশ্বাস কর হাসান, এমন সব মুহূর্তে মেয়েদের চোখে যে অশ্রু দেখা যায়, ওটা অশ্রু নয়, সুখ; যা অমৃত।’
আদিবের কথা শুনে হাসান কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে রইল! তেপান্তর ঘুরেও কিছু বলার মত ভাষা খুঁজে পাচ্ছে না। শেষমেশ বলল, ‘আচ্ছা আদিব! অনুভূতির এতটা গভীরে গিয়ে কী করে ভাবতে পারিস?’
আদিব মৃদু হাসলো। হাসানের কাঁধে হাত রেখে বলল, ‘তোর প্রশ্নের উত্তর আমার জানা নেই। তবে আমার স্ত্রীকে আমি খুব কাছ থেকে দেখি। ও যখন আনমনে কোনো কাজ করে, আমি ওকে পরখ করি। যখন বাচ্চাকে নিয়ে হন্তদন্ত হয়ে ছুটে বেড়ায়, ওকে সামলাতে পাগলপ্রায় হয়ে যায়, আমি ওর প্রতিক্রিয়া দেখি। কখনও অকারণে ওর উপর রাগ করে ফেললে আমি ওর ধৈর্যের সুদৃঢ় প্রাচীর দেখি। সারাদিনের ক্লান্তি নিয়ে বাচ্চাকে ঘুম পাড়িয়ে যখন চোখবুজে শ্বাস নেয়, আমি তখন ওর প্রতিটি শ্বাসপ্রশ্বাসের গভীরতা মাপি। এভাবেই ওর প্রতিটি অভিব্যক্তিকে হৃদয় দিয়ে অনুভব করার চেষ্টা করি। আবার মাঝেমাঝে ওর স্থানে নিজেকে কল্পনা করে বেশ হাপিয়ে উঠি। ভাবি, এতসব কী করে পারে এরা! কোনো সদুত্তর পাই না। তখন অজান্তেই শ্রদ্ধা আর কৃতজ্ঞতায় মাথা নুইয়ে আসে। ভালোবাসার অশ্রুতে চোখ ভরে আসে।’
হাসান যেন কিছু সময়ের জন্য কোনো দূর অজানায় কল্পনার জগতে হারিয়ে গেল। যেখানে অবিচার তো দূরে থাক, সদাচারের প্রতিযোগিতা হয়। হাসানের ভাবনায় ছেদ ফেলে আদিব পুনরায় বলল, ‘আমার স্ত্রী যখন প্রথমবার অন্তঃসত্ত্বা হয়, তখন একদিন ওর বড় বোনের সাথে ফোনে কথা বলছিল। আমি ওর পাশেই ছিলাম। তখন ওপাশ থেকে আসা একটি কথা আমাকে ছুঁয়ে গেল। কথাটি ছিল- ‘প্রতিটি মেয়ের এই বিশেষ অবস্থাটি স্বামীদের নিজচোখে দেখা জরুরি।’
এটি একটি সাবলীল ‘কথা’। কিন্তু কত বিস্তর তার ব্যাখ্যা! কথাটি শোনামাত্রই ভাবনার সীমাহীন জগতে হারিয়ে গিয়েছিলাম। এরপর ভাবলাম, সত্যিই, নিজচোখে এসবকিছু দেখলে হৃদয়হীন স্বামীও স্ত্রীর প্রতি কিছুটা হলেও সহৃদয় না হয়ে পারবে না।
আচ্ছা! একজন মায়ের তখন আসলে কেমন অনুভূত হয়? অভ্যন্তরীণ ব্যাপক পরিবর্তনের প্রভাবে তার অস্থিরতার মাত্রা ঠিক কতটা গম্ভীর হয়? অনাগত শঙ্কায়
তার ভেতরে কতটুকু ভয়ের সঞ্চার হয়? জানতে ইচ্ছে হয়। খুব ইচ্ছে হয়, খুব।
জানি, কোনো স্বামীর পক্ষেই এটা আঁচ করা সম্ভব নয়। কিন্তু এই পুরোটা সময় যদি স্বামী তার স্ত্রীর পাশে থাকে তাহলে কিছুটা হলেও অনুধাবন করতে পারবে।
সেটা যদি সম্ভব না-ও হয়, অন্তত প্রতিটি মা যখন শেষ সময়ে পর্দার আড়ালে একটুকরো চাঁদের আশায় নিজেকে উৎসর্গ করতে উদ্যত হয়- তখনকার সেই আর্তচিৎকার আর কলিজা চেরা আর্তনাদ প্রতিটি স্বামী যদি নিজকানে শুনতে পেত! তাহলে জীবন বাকি থাকতে তার স্ত্রীর প্রতি জুলুম তো দূরে থাক, আড়দৃষ্টিও দিতে পারতো না।
আমি প্রায়ই একটি অলীক স্বপ্ন দেখি। দেশের সর্বত্র যদি এই শেষ সময়ে স্বামীদের পাশে থাকার নিয়মটি বাধ্যতামূলক হয়ে যেত! আর সকলেই এটাকে যথাযথ গুরুত্ব দিত! তাহলে নারীসত্তা নতুন করে বাঁচতে শিখতো। সুখের রাজ্যে নিজে রানী হয়ে স্বামীকে মহারাজার মুকুট পরাতো।’
‘ভাইজান, মালা নিবেন?’
এক পথশিশুর ডাক শুনে আদিব কথা থামাল। হাসান বলল, ‘কীসের মালা এটা?’
শিশুটি হাতের মালাগুলো উঁচিয়ে ধরে টানাটানা স্বরে বলল, ‘এইগুলা হইল বকু…ল মালা। বকু…ল ফুলের মালা।’
আদিব পকেট থেকে একশ’ টাকার একটা নোট বের করে বলল, ‘সোনামণি দুইটা দাও তো আমাকে।’
ও দু’টি মালা আদিবের হাতে দিয়ে বলল, ‘মিয়া ভাই ভাংতি তো নাই। ‘
‘ভাংতি লাগবে না। রেখে দাও। বাকিটা দিয়ে লাভ ক্যান্ডি কিনে খেও।’
শিশুটি যা একটা হাসি দিল না! যেন আসমানের চাঁদ পেয়ে গেছে! কিছু মানুষ অনেক অল্পতেই আকাশসম সুখ পায়। আচ্ছা সুখ এত সস্তা কেন? আবার সস্তাই যদি হবে, তাহলে কোটি টাকা দিয়েও তাকে ছোঁয়া যায় না কেন?
আদিব প্রশ্নগুলো বাতাসে ছড়িয়ে একটি মালা হাসানের হাতে দিয়ে বলল, ‘এটা আজ ভাবির খোঁপায় পরিয়ে দিবি। কী! দিবি তো?’
‘আজ যদি খোঁপা করে চুল না বাঁধে?’ একদিন না হয় নিজহাতে খোঁপাটাও বেঁধে দিলি।’
‘যাহ! এসব পারব না।’
আদিব পকেট থেকে একটি লাভ ক্যান্ডি বের করে হাতে ধরিয়ে দিয়ে বলল,
‘নে, এটা খেতে খেতে চেষ্টা করবি। দেখবি পেরে গেছিস।’
লাভ ক্যান্ডিটি হাতে নিয়ে হাসান হাসলো। মুচকি হাসি।
মিয়া ভাই
৮
এক
‘এই ফাহিম, তুষারকে ফোন লাগা তো।’
‘ভাইয়া তো মোবাইল বাসায় রেখে একটু শপিং-এ গেছে।’
‘আসবে কখন?’
‘রাত হবে আসতে আসতে।’
‘এসময় ও শপিং-এ? ব্যাটারে পাইলে না! ওরে ছাড়া খেলা জমবো?’
‘কোন খেলা ভাইয়া?’
‘আজ একটা ক্লাবের সাথে ম্যাচ ছিল। ওকে ছাড়া টিমের ব্যাটিং লাইন-আপ এক্কেবারে নড়বড়ে। কী করি এখন! ধ্যাত।’
রাসেল কথাটি বলেই একটি নুড়িপাথরে লাথি মারতে মারতে চোখের আড়ালে চলে গেল। ফাহিম একটি চায়ের দোকানে বসে ছিল। রাসেলের চলে যাওয়ার পর দোকানি মিয়া ভাই আগ্রহভরে জিজ্ঞেস করল, ‘তুষার আইজ খেইল বাদ দিয়া শপিং-এ কেন রে ছোট? খেইলের লিগা তো ও দুনিয়া ছাড়তে রাজি, তবু খেইল ছাড়তে নারাজ।’
মিয়া ভাইর কথা শুনে ফাহিম মুচকি হাসল।
‘কিও মিয়া। হাসো কেরে?’
‘আগামীকাল ভাইয়ার ফাইনাল ম্যাচ তো, তাই সেটার গোছগাছ করতেই শপিং-এ যাওয়া।’
মিয়া ভাই পিটপিট করে ওর দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে গলা খাকাড়ি দিয়ে বলল, ‘কিরাম কিরাম জানি ঠেকে! ব্যাপারখানা কী উঁ? আর ফাইনাল ম্যাচেরই বা রহস্যডা কী!’
‘আপনি ব্যাচেলর মানুষ ওসব বুঝবেন না। এগুলো প্রাপ্তবয়স্ক কথাবার্তা।’ ফাহিম মাথা নাড়াতে নাড়াতে বলল।
মিয়া ভাই এখন একদলা ডায়লগ দুম করে ছুঁড়ে মারবে ফাহিমের দিকে। ভাবসাব তেমনই। শেষে চোখমুখ পাকিয়ে বলল, ‘আমারে কী তুমার নাবাল্লেক নাবাল্লেক লাগে? মাইয়া রেডি করো, মুহূর্তই কেল্লা ফতে কইরা দিমু। হুহ।’
ফাহিম খিকখিক করে হেসে উঠল। এরপর বলল, ‘মিয়া ভাইয়ের শখ তো কম না দেখা যায়! তো এতদিন ধরে কী করছো? বয়স তো আর কম হলো না।’
মিয়া ভাই চা বানাতে মন দিল। চামচে টিংটিং শব্দ তুলে বলল, ‘ছোটমিয়া চা খাও। নেও।’
‘চা দিবা! দাও। দোয়া দিলাম, তোমার ফাইনাল ম্যাচটাও যেন দ্রুতই হয়ে যায়।
মিয়া ভাই মাথা উঠিয়ে ফাহিমের দিকে তাকিয়ে ভ্রু নাচিয়ে জিজ্ঞেস করল, ‘তুষার মিয়ার বিয়া বুজি?’
ফাহিম হাসতে হাসতে মাথা নাড়ল- ‘হুম’।
‘এই তাইলে বড়মিয়ার ফাইনাল ম্যাচ! হা হা হা…! অনেক ভালা। খুশি হইলাম শুইনা। তো চলনে যাইবা কবে?’
‘কাল সকালেই।’
‘যাউক, বেচারার খেইলের নেশা তো যাইব! না গেলেও বউয়ের নেশায় ঐসব বেশিদিন টিকবার পারব না। বউয়ের প্যারা আশি টাকা তোলা। হা হা হা…!’
‘তোমারটা কতদূর মিয়া ভাই?’
ছোট্ট করে দু’টো ঢোক গিলে লুঙ্গিতে হাত মুছতে মুছতে বলল, ‘আমাগো লাহান গরিবের কপালে বউ নাই রে।’
‘বউ নাই মানে! শিক্ষিত ছেলে অনেক আছে, কিন্তু তোমার মতো নম্র, ভদ্র ও সরল একটা ছেলে আশপাশের দুই গ্রামেও নেই। তুমি রাজি থাকলে তোমার ব্যাপারটা আমি দেখতে পারি।’
ফাহিমের কথা শুনে সামনে ঝুলে থাকা পলিব্যাগের ভেতর থেকে একটি কেক বের করে বাড়িয়ে দিয়ে বলল, ‘খালি চা কি খাওন যায়? লও এই কেকটা লও।’
‘এখন আর কিছু খাব না মিয়া ভাই। তুমি শুধু একটু দু’আ কোরো।’
মিয়া ভাইয়ের লাজুক ভাব ও উৎসুক চোখদু’টো দেখলে মনে হবে যেন, একটু পরই তাতে জ্যোৎস্না জাগবে, অমাবস্যার ঘোর কেটে মধুচন্দ্রিমার আগমন ঘটবে। কিন্তু তবুও কেমন যেন অস্পষ্ট জিজ্ঞাসা নিয়ে ফাহিমের দিকে অপলক তাকিয়ে আছে বেচারা। ফাহিম আশ্বস্ত করে বলল, ‘টাকা-পঁয়শা নিয়ে তোমার ভাবতে হবে না। তুমি যে ঘরে থাকো, সে ঘরেই ভাবিকে রেখো। তোমার বিছানার একপাশে তাকে শুতে দিও। তোমার ডাল-ভাতটুকুই ভাবির সাথে ভাগাভাগি করে খেও। বাড়তি কোনো ঝামেলার দরকার নেই। পারবে না?’ফরিদের চোখদু’টো ইদানীং বোড্ড বেয়াড়াপনা করছে। কথা শুনতে চায় না। হুটহাট কারণে-অকারণেই ভিজে আসে। তবে বর্ষায় না। এটা ওর একটা বদস্বভাব বলা যায়।
আমগাছ তলার ছোট্ট এই চায়ের দোকানটিই ওর একমাত্র সম্বল। গরীবের জন্য আজকাল বিয়ের নাম মুখে নেওয়ার পাপ- এই ধারণাই ওর মন-মগজে। গরীব হলেও ২-৪ লাখ টাকা মহর ও ২-৩ ভরি স্বর্ণ ছাড়া যেন আজকালকার বিয়ে শুদ্ধ হয় না। কয়েকটি মেয়ে দেখেছিল অবশ্য। সেটাও প্রায় ১০-১২ বছর আগে। ওর মা- বাবা বেঁচে থাকতে। তাদের মৃত্যুর পর ছোটবোন দু’টোকে নিয়ে বেঁচে থাকার লড়াইয়ে এই দোকানটিই ওর রসদ যুগিয়ে যাচ্ছে।
ফরিদের বয়স এখন চল্লিশ ছুঁইছুঁই। ফরিদ শুধু ওর ছোট্ট দু’টি বোনেরই মিয়া ভাই নয়, ও এই পাড়ার মিয়া ভাই। পাড়ার ছেলেরা সবাই ওকে মিয়া ভাই বলে ডাকে।
‘কী এত ভাবছো মিয়া ভাই?’
ফরিদ অপ্রস্তুত হয়ে মুখটা ঘুরিয়ে নিল। লুঙ্গির কোণার দিকটা দিয়ে চোখ পরিষ্কারের ছুঁতোয় নিজেকে সামলে নিয়ে বলল, ‘ফাহিম, এমুন একখান কতা আমার মায় মইরা যাওনের পর পয়লা এই তোমার মুখেই শুনলাম। মায়ের মেলা শখ আছিল পোলার বউয়ের মুখোন দেইখা যাওনের। কিন্তু…।’
এরপর একটি দীর্ঘশ্বাস নিয়ে বলল, ‘কিন্তু টেকার লিগা একখান বউ আমার মায়রে আমি আইনা দিতে পারি নাই। মায় একখান মাইয়া দেখছিল, ২ লাখ টেকা মহর আর ২ ভরি স্বর্ণ চাইছিল হেরা। দিবার পারি নাই দেইখা আমারে মাইয়াও দেয় নাই। কই থেইকা দিমু? টেকার লিগা তো মায়ের চিকিৎসাও করাইতে পারি নাই। এর কয়দিন পরেই মা আমার চইলা গেল। বউয়ের মুখ আর দেখা অইল না মায়ের।’
একথা বলতেই ফরিদ হেরে গেল। দীর্ঘকাল ধরে বুকে জমে থাকা ঘন মেঘের প্রবল বর্ষণে আচমকা ডুকরে কেঁদে উঠল। বড় বিভৎস দেখাচ্ছিল ফরিদকে ক্ষানিকটা ভয়ঙ্করও
ছেলেদের কান্নাটা ঠিক কেমন যেন। কোনো রাগ-ঢাক নেই। একেবারে এবড়ো-থেবড়ো কান্না। আসলে এরা নিয়মিত কাঁদে না বলে, বস্তুত অল্পতেই কাঁদতে পারে না বলে কাঁদার আদব-কায়দা খুব একটা রপ্ত নেই। তাই ঝুপ করে যখন কান্না জুড়ে দেয়, তখন সবকিছু কেমন যেন এলোমেলো করে ফেলে। অনেকটা উন্মাদ হয়ে যায়।
ফাহিম আর বসে থাকতে পারল না। উঠে এসে ফরিদকে শান্ত করতে চাচ্ছে। কিন্তু তাতে যেন ফরিদের ভেতরটা আরও ফেটে যাচ্ছিল। এবং ফাহিমের ওপর একটু রাগও হচ্ছিল। মায়ের চলে যাবার সাথে সাথে ফরিদের বিয়ের ইচ্ছেটাও মরে গেছে। আজ এতদিন পর ফাহিম বিয়ের কথা উঠিয়ে এবং সেটার দায়িত্ব নিয়ে কেন ফরিদকে কাঁদিয়ে দিল? কেন? রাগ তো একটু হওয়াই উচিত। না?!
মিনিট দশেক পর একটু স্থির হলে ফাহিম বলল, ‘মিয়াঁভাই, তোমার কাস্টমার এসেছে।’
ফরিদ তড়িঘড়ি করে নিজেকে সামলে নিয়ে কাস্টমারের দিকে মন দিল। ফাহিম বলল, ‘মিয়া ভাই আমি আজ আসি? সকালেই চলনে যেতে হবে। কিছু গোছগাছ বাকি আছে।’
ফরিদ মাথা নাড়িয়ে সায় দিল।
ফাহিম কয়েক কদম এগিয়ে আবার পেছন ফিরে বলল, ‘মিয়া ভাই! কাল আমাদের সাথে তুমিও যাবা। আমি মেনেজ করব সব। তৈরি হয়ে থেকো।’ এই বলে ফরিদের কিছু বুঝে উঠার আগেই ফাহিম চলে গেল।
দুই
‘এই ভাইয়া! তোর ইন্টারনাল প্রিপারেশন শেষ হলে এদিকে আয়। এক্সটার্নাল দিকটা আমি দেখে দিচ্ছি।’
তুবার কথা শুনে তুষার ক্ষানিকটা লজ্জা পেয়ে বলল, ‘আমি পারব রে। তোরা তৈরি হয়ে নে।
‘পারব মানে? আমার ভাবির জন্য আমার ভাইকে আমি সাজাব, এতে নাক গলাস না। আসতে বলেছি আয়, কুইক।’ এই বলে একটি তুড়ি বাজিয়ে সোফায় বসে মেকাপ বক্সটা খুলতে লাগল।
একটু পর তুষার আসলে ওকে সোফায় বসিয়ে মুখটা উঁচু করে গালদু’টো চিপে ধরে চুল আঁচড়ে দিচ্ছে। তুষার চোখ পাকিয়ে আধো বুলিতে বলল, ‘কী রে! গাল ভেঙে ঠোঁট বেড়িয়ে যাবে তো! আস্তে ধর। আমি বড় হয়েছি। দেখছিস না বিয়ে করতে যাচ্ছি!’
তুবা কিছু না বলে অপলক তাকিয়ে আছে ওর দিকে। ‘কী রে! কী দেখছিস?’
‘নাহ কিছু না। আচ্ছা ভাইয়া শোন, বিয়ের পর নাকি ভাইয়ারা বোনদেরকে ভুলে যায়। সত্যি নাকি রে?’
তুষার অপ্রস্তুত হয়ে তাকিয়ে রইল তুবার দিকে। দেখল, ওর ঠোঁটজোড়া কেন যেন কেঁপে উঠল। চোখজোড়া কেমন জ্বলে উঠল। কণ্ঠটা ভারী হয়ে আসল। ‘বল না রে, সত্যিই কি ভুলে যায়?’
তুষারের চোখ ভিজে গেল। টুপ করে কয়েকটি ফোঁটা গড়িয়ে পড়তেই তুবার হাত এসে তা মুছে দিল। এরপর অস্ফুটে বলল, ‘কোনো আপত্তি নেই ভাইয়া। তবু সুখে থাকিস। ভাবিকে কষ্ট দিস না। বেচারি সব ছেড়ে তোর কাছে চলে আসবে। তুই কষ্ট দিলে ওকে কে দেখবে আর? আমার কোনো সমস্যা হবে না। আমার আম্মু আছে, আব্বু আছে, আর ফাহিম তো আছেই।’
এই বলে একটা দৌঁড় দিয়ে ওর রুমে ঢুকে দপ করে দরজা আটকে দিল। বিছানায় ঝাঁপিয়ে পড়ে ফুঁপিয়ে কান্না জুড়ে দিল।
তুষারের ৬ বছরের ছোট তুবা। এবার অনার্স অ্যাডমিশন নিল। তুষার নিল মাস্টার্সের অ্যাডমিশন। আর ফাহিম অনার্স থার্ড ইয়ারে। প্রত্যেকেই জাহাঙ্গীর নগর বিশ্ববিদ্যালয়ের স্টুডেন্ট। তিনভাই-বোন একই ভার্সিটিতে চান্স পাওয়াটা বেশ ভাগ্যের ব্যাপার।
তুষার কিছুক্ষণের জন্য নিজেকে হারিয়ে ফেলল। বেশ কিছুক্ষণ সোফায় বসে থেকে ওয়াশরুমে গিয়ে ফ্রেশ হয়ে আসল।
এদিকে সবাই তৈরি হয়ে গেছে। গাড়িও সাজানো হয়ে গেছে। ফাহিমের দায়িত্বে ছিল এটা। একটা প্রাইভেটকার আর দুইটা মাইক্রোবাস আনা হয়েছে। প্রাইভেটকারটা বরের জন্য। ফাহিম ওটা মিয়া ভাইকে সাথে নিয়ে মনের মতো করে সাজিয়েছে।
সামনে গাদা ফুলের মালা, গোলাপ-কলি আর পাশে রজনীগন্ধার ভিড়ে গাড়িটিকেই যেন বর বর লাগছে। মিয়া ভাইয়ের হাতের ছোঁয়ায় গাড়িটি জীবন্ত হয়ে উঠেছে। চোখ ফেরানো দায়!
এসব সেরে ফাহিম এসে হাঁক ছেড়ে বলল, ‘ক’টা বাজে এখন, হিসেব আছে? সবাই গিয়ে গাড়িতে ওঠো।
বাড়িতে আজ অনেক মানুষ। তুষারের দুই চাচ্চু ও তার পরিবার, তিন মামা ও তার পরিবার এবং বন্ধুদের মধ্যেও জন পাঁচেক আছে। সব মিলিয়ে প্রায় ৩০-৩৫ জন হবে। সবাই গিয়ে গাড়িতে বসতে লাগল।
বরের গাড়িতে তুষার ও ফাহিম পেছনে আর ওর আব্বু সামনে বসছে। বাকিরা সবাই মাইক্রোতে। তুষারের হঠাৎ চোখ পড়ল তুবার দিকে। বাইরে দাঁড়িয়ে আছে।
‘এই তুবা! উঠছিস না কেন?’ গাড়ির গ্লাস নামিয়ে জিজ্ঞেস করল তুষার।
তুবা চুপচাপ দাঁড়িয়েই রইল। সবাই যার যার মতো টুকরো আলাপে মেতে রইল। তুষার গাড়ি থেকে নেমে এসে ওর হাত ধরে উঠিয়ে দিতে গেলে তুবা থমকে দাঁড়িয়ে বলল, ‘ভাইয়া শোন, বিয়ের পর তো ভাবিকে নিয়েই ঘুরবি। শেষবারের মত তোর পাশে বসিয়ে নিবি আমাকে? ভাবি আসলে আর চাইব না। নে না শেষবারের মতো।
তুষার ঠোঁট কামড়ে আকাশে তাকাল। কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে চোখ নামিয়ে দেখল, তুবা ঠিক ওর চোখের দিকে তাকিয়ে আছে। চোখজোড়া লাল হয়ে গেছে তুবার। মনে হচ্ছে তাতে মুক্তাদানা টলমল করছে। এখনই উপচে পড়বে। কিন্তু তুষারের এখন কাঁদা চলবে না। ভেতরটা হু হু করে ফুঁপিয়ে উঠলেও তুবাকে বুঝতে দিল না। ওর চোখের নিচে আঙুল ছুঁইয়ে বলল, ‘একদম কাঁদবি না।
একটা কথা মনে রাখিস– মানুষ সারাদিন সূর্যের আলোতে কাজ সমাধা করলেও রাতের জ্যোৎস্নার প্রয়োজন তার ফুরিয়ে যায় না। বরং দিনের ব্যস্ততার ক্লান্তি মুছতে জ্যোৎস্নাকেই সে খুঁজে বেড়ায়। কিন্তু সেই জ্যোৎস্না বিলানো চাঁদটিই মাঝেমাঝে অমাবস্যায় হারিয়ে যায়। কী রে! স্বামীকে পেয়ে এভাবে আবার হারিয়ে যাবি না তো?’ তুবার কথা বলার শক্তি নেই। মনে হচ্ছে কিছু একটা এসে যেন গলাটা চেপে ধরেছে। বেশ ব্যথা অনুভূত হচ্ছে। চোখ বন্ধ হয়ে আছে। সামাজিকতাকে মেনে নেওয়ার প্রস্তুতি নিতে চোখদু’টো অঝোরে কাজল ধোয়া পানি ঝরাচ্ছে।
তুষার কিছু না বলে গাড়ির দিকে এগিয়ে ফাহিমকে বলল, ‘ফাহিম, তুই একটু ঐ গাড়িতে গিয়ে বস। তুবা বসবে এখানে।
ফাহিম কিছু না বলে নেমে গিয়ে মাইক্রোতে ড্রাইভারের পাশে গিয়ে বসল।
তুবাকে হাতে ধরে নিয়ে এসে ভেতরে বসিয়ে দরজা লক করে দিল। এরপর তুষার পেছন দিয়ে ঘুরে এসে গাড়ির ডানপাশের সিটে বসে দরজা লক করে বলল, ‘ড্রাইভার, বিসমিল্লাহ বলো।’ গাড়ি চলতে শুরু করল…
তুষার সামনে তাকিয়ে আছে। তুবা বাঁ-পাশের গ্লাসটা খুলে বাইরের দ্রুতগামী বিল্ডিংগুলো দেখছে। মনে হচ্ছে যেন ছটছট করে বিল্ডিংগুলো পেছনে চলে যাচ্ছে। উঁচু-নিচু ঝাঁকিতে তুবা মাঝেমাঝে হালকা লাফিয়ে উঠছে। একপর্যায়ে গ্লাস বন্ধ করে সিটে হেলান দিয়ে তুষারের দিকে তাকিয়ে দেখে- তুষার একদৃষ্টে তুবার দিকে তাকিয়ে আছে। তুবা অপ্রস্তুত হয়ে জিজ্ঞেস করল, ‘কী রে? কী দেখছিস?’
‘মায়া দেখছি।’
‘মানে?’
‘আচ্ছা তুবা! মেয়েদের মধ্যে এত মায়া কেন রে?’
তুবা দৃষ্টি অন্যদিকে ঘুরিয়ে অস্ফুটে বলল, ‘এই মায়ার জন্যই তো মেয়েদের এত কষ্ট। এই জিনিসটা না থাকলে মেয়েদের আর কষ্টই থাকতো না।’
‘যদি তা-ই হতো, তাহলে পৃথিবীতে এত বৈচিত্র্য থাকতো না। অসার এক জগতে কেবল মৃত্যুর প্রয়োজনে বেঁচে থাকতাম আমরা। এই মায়াই নির্জীব পৃথিবীকে সজীব রেখেছে, নিষ্প্রাণ সত্তাকে প্রাণবন্ত করেছে। পৃথিবী তোদের কাছে ঋণী।’
‘হয়েছে হয়েছে, আর আদিখ্যেতা দেখাতে হবে না। ভাবির জন্য স্পেশাল কিছু নিয়েছিস?’
তুবার ধমক শুনে তুষার একটু নড়েচড়ে বসে বলল, ‘না তো! স্পেশাল আবার কী নেব?’
‘সেটাও বলে দিতে হবে? খুব তো মেয়েদের গুন-কীর্তণ করলি, তো মেয়েরা যে সবসময় ছোট হোক, কিন্তু স্পেশাল কিছু আশা করে এটা জানিস না?’
তুষার ড্যাবড্যাবে চোখে তাকিয়ে আছে তুবার দিকে। তুবা ভ্রু নাচিয়ে বলল, ‘কী? কিছুই বুঝিস না?’
তুষারের মুখ থেকে কথা বের হচ্ছে না। তুবার কথা যেন ওর মাথার ওপর দিয়ে যাচ্ছে।
এরপর তুবা ওর পার্স থেকে দু’টি লাভ ক্যান্ডি বের করে বলল, ‘ভাবিকে এই লাভ ক্যান্ডি দু’টা দিবি। শত দামি জিনিসের ভিড়ে মেয়েরা এই ছোট ছোট জিনিসগুলোকে খুব পছন্দ করে। পূর্ণ ভালোবাসার সাথে দেওয়া এই তুচ্ছ জিনিসটিই তার কাছে অনেক স্পেশাল কিছু হয়ে যায়। তোরা ছেলেরা এসব বুঝবি না। মাঝে মাঝে এমন ছোটখাটো কিছু কিনে দিস ভাবিকে। খুব খুশি হবে। লাখ টাকায়ও সেই খুশি কিনতে পাবি না।’
এই বলে তুষারের হাতে ক্যান্ডি দু’টি গুঁজে দিল। তুষার হাতের ক্যান্ডি দু’টি নিয়ে দেখতে লাগল, আর তুবার কথাগুলো ভাবতে লাগল। সত্যিই কি মেয়েরা এমন? এত অল্পতেই তাদেরকে খুশি করা যায়? কেমন যেন লাগছে ব্যাপারটা।
তুবা ওর ভাব বুঝতে পেরে বলল, ‘সব মেয়ের কথা জানি না, তবে ভালো মেয়েরা এমনই হয়। তাদেরকে খুশি করতে খুব বেশিকিছু লাগে না। ভালো একটা মন থাকলে কাগজের খেলনা ফুল দিয়েও তাদেরকে খুশি করা যায়।’
বড় বোন যেন তার ছোট ভাইকে শেখাচ্ছে। ভাবসাব এমনই। তুষার বলল, ‘বেশ পাকনা হয়ে গেছিস দেখছি! ক’টা দিন ওয়েট কর। কোনো চকলেটওয়ালা দেখে ধরিয়ে দেব। ‘
‘তা নিয়ে তোর এত চিন্তা করতে হবে না। আব্বুই যথেষ্ট।’ তুবা এই বলে দাঁত কিড়মিড়িয়ে কষিয়ে একটা ভেংচি কেটে সামনে তাকাল।
তুষার ফিক করে হেসে বলল, ‘তার মানে চকলেটওয়ালায় রাজি? হেহ হে…! তো তোর চকলেটওয়ালার কাছ থেকে আমার জন্য আরও এক প্যাকেট লাভ ক্যান্ডি রাখিস। ভয় পাস না, ওটা টাকা দিয়েই নেব।’
তুবা ফুঁসছে। ফণা তুলছে। তুষারের দিকে তাকিয়ে থেকে-থেকে ফোঁসফাস করে উঠছে। আজ বরযাত্রীতে রওয়ানা না করলে এক্ষুণি তুষারের চুলের একটা দফারফা করে ছাড়তো। তুষার হাবভাব বুঝতে পেরে পকেট থেকে ফোন বের করে হুদাই কানে দিয়ে বাইরে দৃষ্টি ফিরাল। মুখে চিকন হাসি…
তিন
‘এই মিলি! কই হলো? ওদের আসার সময় হয়ে গেল তো!’
‘জি আন্টি, এই তো শেষ।’ মিলি এই বলে সারার গালে একটা চিমটি দিয়ে বলল, ‘প্রথম দেখাতেই জামাই বাবু যদি ফিট না হয়েছে না! দেখে নিস। এই তোরা লবণ-পানি রেডি রাখিস। মাথায় ঢালতে হবে। শত হলেও এ বাড়ির জামাই বলে কথা। বেশিক্ষণ ফিট হয়ে পড়ে থাকতে দেওয়া যাবে না। বোন আমার একা একা ভয় পাবে। হিহিহি…।’
হাফসা, শাকেরা, শামিমা, মার্জিয়া, আফিয়া সবকটা মিলে সারাকে ধরে চিমটাতে শুরু করল। সারা মুখ তুলে বলল, ‘ঐ লাগছে তো। আর তোদের মতো এত ভীতু না আমি হুহ। ‘
‘হয়েছে হয়েছে। সময় হলেই দেখা যাবে। এই লবণ-পানি একটু বেশি করে রাখিস। ওর মাথায়ও ঢালতে হতে পারে।’ সবগুলো খিটখিটিয়ে হেসে উঠল।
‘কী রে হলো?’
‘জি আন্টি এই শেষ, আসছি। এই চল চল, ওকে মনভরে একটু শ্বাস নিতে দে। বর আসলে ভয়ে না আবার শ্বাস নেয়া ভুলে যায়, অ্যাডভান্স কিছু শ্বাস নিয়ে রাখ সারা। রাতে কাজে লাগবে।
সারা হাত উঠিয়ে কিল রেডি করতেই হুড়মুড়িয়ে উঠে বেরিয়ে গেল ওরা।
দুপুর গড়িয়ে যাচ্ছে। বেলা ৩টা ছুঁইছুঁই। এখনও কোনো সাড়াশব্দ নেই। এদিকে ভারী কাপড়ের গরমে সারার অবস্থা বে-শামাল। ফ্যান থাকার পরও ঘেমে- নেয়ে একাকার। আম্মুকে ডেকে বলল, ‘আম্মু, শাড়িটা একটু খুলে রাখি? খুব অস্থির লাগছে।’
সারার আম্মুর কড়া আওয়াজ, ‘না! যেকোনো সময় ওরা চলে আসবে। তখন তাড়াহুড়ো করা যাবে না। ফ্যানের নিচে স্থির হয়ে বসো।’ মুখ ভার করে চুপসে রইল সারা।
সারার বাবা পায়চারি করছে। কপালের বিন্দু বিন্দু ঘাম টেনশনের বার্তা দিচ্ছে। এরমধ্যে সারার আম্মু ডেকে বলল, ‘এই আরেকবার কল করে দেখো তো ধরে কি না!’
‘এই নিয়ে কম করে হলেও ১০ বার কল দিয়েছি। একবারও রিসিভ করেনি।’
‘আজ ঠিক আসবে তো?’
‘আসবে মানে? বের হওয়ার পর মাঝ পথেও আমার সাথে কথা হয়েছে। এতক্ষণ তো লাগার কথা না। বুঝতে পারছি না কিছু।’
‘কী রেখে কী করি! এদিকে অন্য সবাই ক্ষুধায় অস্থির। তারা না আসলে খেতেও পারছে না কেউ। সারা তো সেই কাল রাতে খেয়েছে এখন পর্যন্ত আর কিছু খাওয়াতে পারলাম না।
সে কী! এক কাজ করো, বাকিদেরকে খাবার দিয়ে দিতে বলো, আর তুমি গিয়ে ওকে আদালা করে খাইয়ে দাও এখনই।’
‘আচ্ছা বলে দিচ্ছি। কিন্তু ওকে তো খাবার কথা বললেই বলে ক্ষুধা নেই। আমি আছি মহা জ্বালায়। একদিকে মেয়ের জ্বালা, অন্যদিকে মেয়ের বাপের জ্বালা, আবার আজ মেহমানরাও যা শুরু করল। আর পারি না…।’
নাজমা বেগম একরাশ অস্বস্তি নিয়ে ভেতরে গিয়ে বিছানায় গা এলিয়ে দিল। গতরাতে একফোঁটাও ঘুম হয়নি। রাত জেগে রান্নাবান্না ও গোছগাছ করা নিয়ে বেশ ধকল গেছে। আসলাম সাহেবও বেশ ক্লান্ত। সারার আম্মু ভেতরে চলে গেলে তিনি ওয়াশরুমে ঢুকে পড়লেন। এই সুযোগে চট করে গোসলটা সেরে নিলে মন্দ হয় না।
গোসল সেরে বের হয়ে ফোন হাতে নিয়ে দেখে মিসড কল! তুষারের বাবার কল। দ্রুত কলব্যাক করতেই তুষারের বাবা জনাব ইরফান সাহেব ক্ষীণ কণ্ঠে বললেন, ‘আসলাম সাহেব, আমরা চলে এসেছি। আর সর্বোচ্চ ৩০ মিনিট লাগবে।’
আসলাম সাহেব ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখলেন- ৪টা বেজে গেছে। একটু বিরক্তি মিশিয়ে বললেন, আরও ৩০ মিনিট?’
‘একটু ধৈর্য ধরুন প্লিজ, এই তো এসে গেছি। ‘
আসলাম সাহেব টুপ করে ফোনটা কেটে দিলেন। সারার আম্মুকে ডেকে বললেন, ‘এই কই গেলে! উনারা কাছাকাছি চলে এসেছে। উঠে ফ্রেস হও। সারাকে তৈরি থাকতে বলো।’
নাজমা বেগম তড়িঘড়ি করে উঠে বসলেন। মাত্র চোখটা লেগে আসছিল। কাঁচা ঘুমের চোখ পোড়ানি বেশ কষ্টের। তবুও উঠে গেলেন। ফ্রেস হয়ে সারার রুমে গিয়ে দেখে সারাও বালিশে হেলান দিয়ে ঘুমিয়ে গেছে।
‘এই সারা! ওঠো আম্মু। মেহমান চলে আসবে এখনই। উঠে ফ্রেস হয়ে নাও।’
কিছুক্ষণ পর সারা আড়মোড়া ভেঙে ওয়াশরুম থেকে ফ্রেস হয়ে এসে আসরের নামায পড়ার জন্য জায়নামাজ বিছাতেই বাইরে হৈ-হুঁল্লোড় শুনতে পেল। বোধহয় মেহমানরা চলে এসেছে। ওদিকে কান না দিয়ে সারা নামায পড়ে নিয়ে খাটের এক কোণে চুপচাপ বসে রইল।
মাইক্রোবাস দু’টো গেইটের সামনেই রাখা। আসলাম সাহেব মেহমানদেরকে প্যান্ডেলে নিয়ে বসিয়ে দিতে দিতে মেহমানদের একজনকে জিজ্ঞেস করলেন, ‘কী ব্যাপার? বেয়াই সাহেবকে দেখছি না যে!’
তুষারের আম্মু এগিয়ে এসে বললেন, ‘বেয়াই সাহেব, খাবার-দাবার শেষে কিছু জরুরি কথা আছে। এরপর কাজী সাহেবের সাথে কাজটা শেষ করব। তুষারের আব্বু একটু কাজে আটকে গেছে। ওর চাচারা আছে। অসুবিধার কিছু নেই।’
তুষারের আম্মুর কথা শুনে আসলাম সাহেব আর কথা বাড়ালেন না। ‘আচ্ছা ঠিক আছে। এই পর্ব শেষ হোক।’
সবকিছু শেষ করতে করতে সন্ধ্যা হয়ে গেছে। চলে যাওয়ার মুহূর্তে। নাজমা বেগম হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়ল। মাথায় পানি ঢেলে তাকে শুইয়ে রাখা হয়েছে। মেয়েকে বিদায় দিতে হবে। কিন্তু আসলাম সাহেব অসুস্থ স্ত্রীকে আর ডাকতে চাইলেন না। মিলিকে ডেকে বললেন, ‘এই মিলি, সারাকে নিয়ে এসো।’
মিলি, হাফসা, শাকেরা, শামীমা, মার্জিয়া ও আফিয়া সবাই মিলে সারাকে নিয়ে আসল। সারা অঝোরে কাঁদছে। হাঁটতে পারছিল না। মিলি খুব শক্ত করে ধরে রেখেছে ওকে। আসলাম সাহেব একবার সারার দিকে তাকিয়ে চোখ ফিরিয়ে নিলেন। এমন মুহূর্তে মেয়ের দিকে কোনো বাবা তাকিয়ে থাকতে পারার কথা না। আসলাম সাহেবও পারলেন না। তার চোখজোড়া লাল টকটকে হয়ে আছে। খাবারের পর থেকে এ পর্যন্ত কম করে হলেও ১০ বার ওয়াশরুমে গিয়ে চোখে পানির ঝাঁপটা দিয়েছেন। মনে হচ্ছিল যেন চোখে রক্ত জমে গেছে। স্থির হয়ে সারাকে বললেন, ‘সারা, কাদিস না মা। এক মা-বাবার ঘর ছেড়ে আরেক মা-বাবার ঘরেই যাচ্ছিস। আশাকরি কোনো পার্থক্য পাবি না। দেখে নিস!’
সারা ওর আব্বুর হাতটি বুকের সাথে খুব শক্ত করে জড়িয়ে ধরল। কাঁদতে কাঁদতে কেমন যেন অসাড় হয়ে গেল। মুখে কোনো কথা বের হচ্ছে না। মিনিট খানেক পর আসলাম সাহেব সারাকে ধরে নিজ হাতে গাড়িতে তুলে দিলেন। বরকে উদ্দেশ্য করে বললেন, ‘বাবা! আমার বুকের কলিজাটা দিয়ে দিচ্ছি। ঠিক বুকের মাঝখানেই রেখ। পাগলীটা আমার অন্যকোথাও বাঁচতে পারবে না।’
কেউ আর কোনো কথা বলল না। রাজ্যের নিরবতা নেমে এসেছে। মিলি, হাফসা, শাকেরা, শামীমা, মার্জিয়া ও আফিয়া যারা ওর সেই বাল্যকালের সাথী, ওরাও একপাশে দাঁড়িয়ে ওড়না দিয়ে মুখ চেপে রেখেছে। কিন্তু তাতে ফুপানো আওয়াজকে আর চেপে রাখতে পারেনি। ডুকরে কাঁদছে পাগলীগুলো।
ড্রাইভার গেইট লক করে গাড়ি স্টার্ট দিতেই সবাই একটু সরে এল। আসলাম সাহেব ঠোঁট কামড়ে ধরে নির্বাক দাঁড়িয়ে রইলেন। গাড়ি চোখের আড়াল হতেই টুপ করে বসে পড়লেন। এবার দু’হাতে মুখটা চেপে ধরে গলা ছেড়ে বাচ্চাদের মতো হু হু করে কেঁদে উঠলেন…
চার
জ্যোৎস্না রাত। জানালার ফাঁক গলিয়ে চাঁদের নির্মল আলো ঠিকরে পড়ছে সারার গায়ে। একটি কপাট খুলে দিয়ে উন্মুক্ত চাঁদের মাঝে সারা হারিয়ে গেল। ঝিঁঝিঁপোকার ডাকে একটু ভয় অবশ্য লাগছিল। কিন্তু শূন্য দেহে ভয় কোনো প্রভাব ফেলতে পারে না। কারণ, সারা এখানে থাকলেও তার মনটা এখন চাঁদে। এখানে কেবল অসাড় দেহটি ঘোমটা ফেলে বসে আছে।
আচমকা একটি খচখচ শব্দ শুনে সারা নড়েচড়ে বসল। জানালার বাইরের দিকে নিচ থেকে আসছে শব্দটা। বিড়াল-টিড়াল হবে হয়ত। সারা আলতো করে জানালাটি লাগিয়ে দিয়ে ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখে ঠিক রাত ১টা! সারা কিছু বুঝে উঠতে পারছে না। চোখ পোড়ানি আর ঝিমুনির কারণে আর বসে থাকা যাচ্ছে না। কতক্ষণই বা পারা যায়! উনি প্রথম দিনেই এত দেরি করে আসছে! কোনো সমস্যা হয়নি তো? নাকি আমাকে পছন্দ হয়নি! না অন্য কোনো পছন্দ ছিল! তাহলে আগে বললেই পারতো। এখন কেন এমনটা করছে? কিছুটা রাগ হচ্ছে সারার। সাথে বিরক্তি মিশ্রিত ভয়ও।
সারার এসব সাত-পাঁচ ভাবনায় ছেঁদ ফেলে হঠাৎ দরজায় কড়া নাড়ার শব্দ। সারা আঁতকে উঠল। ভয় আর আকাঙ্ক্ষার তীব্রতায় হার্টের কয়েকটি বিট মিস হবার উপক্রম! গলা শুকিয়ে আসছে। ঘুমপরী যেন ফুড়ুৎ করে অজানায় হারিয়ে গেছে। দুরুদুরু বুকে আস্তে করে দরজাটা খুলে দিয়েই টুপ করে বিছানায় বসে ঘুমটা টেনে দিল সারা।
মেয়েলি কণ্ঠে সালাম শুনে সারা ঘুমটা তুলে তাকিয়ে দেখে- একটি প্রস্ফুটিত গোলাপ। সম্ভবত এবাড়ির মেয়ে হবে।
‘আসোলামু আলাইকুম ভাবি।’
‘ওয়া আলাইকুমুসসালাম’ বলে সারা নিশ্চুপ। সালামের জবাব দিয়ে অপলক তাকিয়ে আছে মেয়েটির প্রতি। তুবা মৃদু হেসে বলল, ‘ভাবি, এতরাতে এখানে আসার জন্য সরি।’
‘না না ঠিক আছে। বসুন।’
তুবা সারার পাশে গিয়ে বসল। সারার ঘোমটা পুরোটা নামিয়ে কিছুক্ষণ ওর চোখের দিকে তাকিয়ে রইল। লাল টকটকে হয়ে আছে মেয়েটার চোখ। ক্লান্তি আর ঘুমের স্পষ্ট ছাপ চোখে-মুখে। তবুও যেন চোখ ফেরানো দায়।
এমন চাঁদমুখ থাকলে জ্যোৎস্না বিলাস করতে আমার ভাইয়ার আর আকাশের চাঁদ লাগবে না।’ অস্ফুটে বলে উঠল তুবা।
সারা খানিকটা লজ্জা পেল। মুচকি হেসে দিয়ে বলল, ‘চাঁদ যে এ বাড়িতে আরও একটি আছে, অন্য কারো জ্যোৎস্না বিলাসের রানী হবার অপেক্ষায়, সে খবর রেখেছেন কি?!’ এই বলে সারা তুবার প্রতি একদৃষ্টিতে তাকিয়েই রইল। তুবা লজ্জায় চোখ নামিয়ে নিল
একটু পর দেখল, তুবার লজ্জাবনত চোখের কাজল ধুয়ে গড়িয়ে পড়ছে। ঠোঁটজোড়া মৃদু কাঁপছে।
‘কী ব্যাপার আপু!’
‘ভাবি, কিছু কথা বলি? রাগ করবেন না তো?’
‘আরে না! কী বলছেন এসব! বলুন না!’
তুবা স্থির কণ্ঠে বলল, ‘ভাবি, আমার ভাইয়াটা না অনে…ক ভালো। অবশ্য আপনিও অনেক ভালো। কিন্তু ভালো হলে কী হবে, ভাইয়াটা বেশ বোকা। আচ্ছা ভাবি, ভাইয়াকে তো আপনি দেখেননি তাই না?’
‘ঠিক দেখিনি। তবে ছবি দেখেছি।’
‘কেমন লেগেছে? পছন্দ হয়েছে?’
এবার সারা কিছুটা লজ্জা পেল। কিন্তু কিঞ্চিৎ শঙ্কাও ডানা বাধল। ভাবছে- আমাকে তার পছন্দ হয়েছে তো! নাকি অন্যকোনো পছন্দ ছিল? আবারও সেই সাত-পাঁচের ঝামেলা।
তুবা বলল, ‘আচ্ছা ভাবি! আমি চলে যাবার পর ভাইয়া যদি ভুত হয়ে আপনার সামনে আসে, তাহলে কি ভয় পাবেন?’
কথাটি সারার মাথার ওপর দিয়ে গেল। কিন্তু হা করে তাকিয়ে থাকা ছাড়া আর কিছু বলল না।
‘ভাবি,
একদম ভয় পাবেন না। ভুত হলেও সে আপনাকে অনেক ভালোবাসবে। তাকে কষ্ট দিয়েন না ভাবি। বুঝিয়ে-সুঝিয়ে যা বলবেন সব শুনবে। তার সাথে কখনও ঝগড়া করবেন না। ভাইয়ার মতো ভুতটা অত সুন্দর না হলেও এর সুন্দর একটা মন আছে। আশাকরি সেই মনে আপনার স্বপ্নের প্রাসাদ দারুণ শোভা পাবে।
আচ্ছা আমি এখন আসি। রাত হয়েছে অনেক। আর হ্যাঁ, আমার নাম তুবা। আপনার একমাত্র ননদিনী। আসি ভাবি, আসোলামু আলাইকুম।’ অদ্ভুতুড়ে এই
কথাগুলো বলে মুখে হাত রেখে ভেতর থেকে আসতে চাওয়া জলচ্ছাস চেপে ধরে একদৌড়ে দিয়ে বেরিয়ে গেল তুবা।
সারা কিছু বুঝে উঠতে পারছে না। কীসব বলে গেল মেয়েটা! ভাইয়া! ভুত! ভয় পাব না! সুন্দর মন! স্বপ্নের প্রাসাদ! মাথা গুলিয়ে যাচ্ছিল সারার। অমনি পুরুষালী কণ্ঠে গলা খাকাড়ির শব্দ। দরজা খোলাই আছে। সারা তড়িঘড়ি করে ঘোমটা তুলে নিল। আঁচ করল, কেউ একজন ঘরে প্রবেশ করেছে। সালাম দিয়ে ওয়্যারড্রবের উপর পাগড়িটা রাখছে। ঘোমটার নিচ দিয়ে হাঁটু পর্যন্ত দেখা যাচ্ছে। সাদা পাজামার সাথে সোনালী পাঞ্জাবি পরেছে। সারা চোখ ফিরিয়ে নিয়ে লজ্জায় এটুকু হয়ে গেছে।
তুষার এসে সারার পাসে বসে পড়ল। সারার শ্বাস ভারী হতে লাগল। নিশ্বাস উত্তপ্ত হতে লাগল। মিনিট পাঁচেক দু’জনই চুপচাপ রইল। উভয়েই একে অপরের ঘোর ভাঙার অপেক্ষায়। শেষমেশ ভার কণ্ঠে তুষার জিজ্ঞেস করল, ‘অনেক কষ্ট হয়েছে তাই না? সরি।’
সারা অস্ফুটে বলল, ‘আরে না! কী বলছেন! ঠিক আছি আমি।’
তুষার ঘড়ি দেখে বলল, ‘দেড়টা বেজে গেছে। নিশ্চয়ই অনেক কষ্ট পেয়েছেন এতক্ষণ। আর মনে মনে খুব বকেছেন আমায় তাই না?’
বকবই তো! কেন বকব না! সেই গতকালকের পর থেকে আর কিছু খেতে পারিনি। ঠিকমতো ঘুমাতেও পারিনি। তার উপর আজ সারাটা দিন এত ভারী কাপড়-চোপড় পরে থেকে সিদ্ধ হয়ে গেছি, মোটের ওপর বাবার বাড়ি থেকে বিদায় নিয়ে মানুষিক দিক থেকে এমনিই আধমরা হয়ে আছি, এরপর এত রাতে এসে আবার জিজ্ঞেস করছেন- মনেমনে খুব বকেছেন আমায় তাই না? বুঝাব মজা। ক’টা দিন যাক। হুহ।
কথাগুলো এভাবে হরহর করে উগড়ে দিতে পারলে ভেতরে একটু শান্তি লাগত সারার। কিন্তু তা আর হলো না। মনের কথা মনেই হজম করতে হল।
‘কী ব্যাপার? কিছু বলছেন না যে!’
তুষারের প্রশ্নে সারা অপ্রস্তুত হয়ে বলল, ‘কী যে বলেন। আমি একদম বকিনি।’
‘উঁহু, মেয়েদের সব কথা বিশ্বাস করতে নেই।’
আড়চোখ করে তুষারকে একটু দেখার চেষ্টা করল সারা। মন চাচ্ছে… কিন্তু না। প্রথমদিনেই কোনো অ্যাকশনে যাওয়া যাবে না। সময় আসুক। ঠোঁট কামড়ে নিজেকে বুঝ দিল সারা।
‘আপনাকে কিছু কথা বলব। জানি না কীভাবে নেবেন।’
কী রে বাবা! সত্যি সত্যি ভুতের পাল্লায় পড়লাম নাকি। না ভুতের রাজ্যেই এসে পৌঁছলাম! একটু আগে এর বোন এসে কীসব বলে গেল কিছুই বুঝলাম না। এখন আবার উনি নিজেই… সারার মনে আবারও সেই সাত-পাঁচের উটকো ঝামেলা।
মৃদুস্বরে বলল, ‘জি বলুন। অসুবিধা নেই। ‘
তুষার একটু সোজা হয়ে বসে বলল, ‘দেখুন তো আমাকে চিনতে পারেন কি না!’
সারা পিটপিট করে তাকাতে চেষ্টা করছে। পারছে না দেখে তুষার বলল, ‘ঘোমটা নামিয়ে নিন না!’
সারা একটু সোজা হয়ে ঘোমটাটা আলতো করে পেছনে নিতেই যেন দপ করে জ্বলে উঠল! এ কী! কে আপনি?! আর আপনি এখানেই বা কেন?
-তুবা আপু! এই তুবা আপু!
তুষারকে দেখামাত্রই ভড়কে গিয়ে ভয়ে তুবাকে ডাকতে লাগল সারা।
সারার আঁতকে ওঠা দেখে তুষারও ক্ষানিকটা ভয় পেয়ে গেছে। সাথে সাথে রাজ্যের জড়তা-সংকোচ যেন মুষড়ে ফেলল ওকে। ঠিক কী বলবে এখন সারাকে? শেষমেশ ঝট করে বলে ফেলল, ‘আমি ফাহিম, তুষার আমার বড় ভাইয়ার নাম।’
একথা শুনে সারার পুরো গায়ে যেন তড়িৎ খেলে গেল!
‘আপনি ছোটভাই হয়ে এইভাবে বড়ভাইয়ের বাসরঘরে… উফ! বেরোন! এক্ষুণি বেরোন! না হয় আমি চিৎকার করব এখনই!’ সোজা দাঁড়িয়ে গিয়ে ঝাঁঝালো কণ্ঠে হাত নাড়াতে নাড়াতে বলল সারা।
ফাহিম ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেল। আড়ষ্ট হয়ে দুম করে বলে দিল- ‘দেখুন, একটু স্থির হোন। আমিই আপনার স্বামী।’
এটা কী হলো! সারার মুখাবয়ব যেন মুহূর্তেই বিধ্বস্ত হয়ে গেল। দপ করে বসে পড়ল। হাত-পা যেন অবশ হয়ে আসছে ওর। দম যেন আটকে যেতে চাচ্ছে। ফাহিম বুঝতে পেরে বলল, ‘প্লিজ আপনি একটু স্থির হোন, আমার কথাগুলো শুনুন একটু।’
বিয়ের আগে তুষারের কেবল ছবি দেখেছিল সারা। সরাসরি দেখা বা কথা কোনোটারই সুযোগ হয়ে উঠেনি। কিন্তু এখন এসব কী শুনছে সারা! ছবিতে একপলক দেখেই যার মাঝে হারিয়ে গিয়েছিল, যার বুকে মাথা রাখার নেশায় এতক্ষণ বিভোর হয়েছিল এখন কি না তার ছোটভাই…! এটা কীভাবে সম্ভব! আর এটা কী করেই বা ঘটা সম্ভব! সারা নিথর হয়ে বসে রইল। ওর কাজল ধোয়া চোখের পানি চিবুক পর্যন্ত নেমে আসল। আর কথা বলার শক্তি পাচ্ছে না মেয়েটি মাথা আলতো কাত করে ফাহিমের দিকে একপলক তাকিয়েই ফুঁপিয়ে কান্না জুড়ে দিল। কোলে মাথা নুইয়ে যেন আষাঢ়ের বাদল নামিয়ে নিল।
ফাহিম ইস্পাত-দৃঢ় হয়ে বসে রইল। মিনিট দশেক পর অস্ফুটে বলল, ‘একটু বসুন। আগে আমার কথাগুলো একটু শুনুন।
সারা মাথা তুলে বসল। ফাহিমের দিকে তাকাতেই ফাহিম বলল, ‘প্লিজ!’
সারা হাটু ভাঁজ করে হাত দিয়ে পেঁচিয়ে ধরে তার ওপর মাথাটি রেখে রাজ্যের নিরবতায় হারিয়ে গেল।
ফাহিম বলতে শুরু করল।
আজ সকালে স্বাভাবিক বরযাত্রীর মতো আমরাও রওয়ানা হয়েছিলাম। আব্বু, আম্মু, চাচ্চু ও মামারা সহ প্রায় ৩০-৩৫ জনের মতো ছোট্ট একটি বরযাত্রী। তুবা ভাইয়ার জন্য বড্ড পাগল। ওদের দু’জনের মাঝে সারাক্ষণ যেমন লেগেই থাকে, তেমনি কেউ কাউকে ছাড়া দূরে থাকতে পারে না। তো আজ রওয়ানা হবার সময় ও ওদের ঝগড়া বাদ পড়েনি। শেষমেশ আব্বু, তুবা আর ভাইয়া বরের গাড়িতে, আর আমরা বাকিরা মাইক্রোবাসে।
যথারীতি গাড়ি চলছিল। ভাইয়াদের গাড়িটা আমাদের সামনে ছিল। কিছুক্ষণ পর হঠাৎ গাড়িটা চোখের আড়াল হয়ে গেল। ভাবলাম আমরা পেছনে পড়ে গেছি। তাই ড্রাইভারকে একটু দ্রুত চালাতে বললাম। হঠাৎ আব্বুর ফোন! রিসিভ করতেই বেশ জোরেসোরে ডাকাডাকির শব্দ শুনলাম। কাঁপা স্বরে আব্বু বলল, ‘ফাহিমরে…, গাড়ি ঘুরিয়ে সোজা জাবেদা মেমোরিয়াল হাসপাতালে চলে আয়।’
‘আব্বু কী হয়েছে! হাসপাতালে কেন? আব্বু!’ আব্বু ওটুকু বলেই ফোন রেখে দিয়েছেন।
এরপর আর কালবিলম্ব না করে দ্রুত গাড়ি থামিয়ে পেছনের গাড়িটিকেও থামালাম। কিছুক্ষণের মধ্যেই সবাই হাসপাতালে পৌঁছে গেলাম। আব্বুকে আবার কল করতেই রিসিভ করে আব্বু বলল, ‘তোমার আম্মুকে নিয়ে তুমি একা ভেতরে আসো। বাকিদের কিছু বলার দরকার নেই। বাইরে বসতে বলো।’
সেভাবেই করলাম। সবাইকে গাড়িতে বসিয়ে রেখেই আম্মুকে নিয়ে ভেতরে গেলাম। নার্স এসে আমাদেরকে সোজা অপারেশন থিয়েটারের দিকে নিয়ে গেল। গিয়ে দেখি আব্বু আর তুবা বাইরে বসা। তুবা আমাকে দেখেই আমার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ল। ওকে কোনোরকম ধরে বসিয়ে আব্বুর দিকে তাকালাম।
‘কী হয়েছে আব্বু?’
আব্বুর মুখে কথা বের হচ্ছে না। রুমালে মুখ চেপে রেখে থমথমে স্বরে বলল, বসো ফাহিম। বসো এখানে। তোমার ভাইয়া বোধহয় আমাদের সাথে অভিমান করেছে। জানি না আর আমাদের সামনে আসবে কি না! এই বলেই দু’হাতে মুখ ঢেকে নিয়ে ফুঁপিয়ে কান্না জুড়ে দিল। আর তুবা! ও এতক্ষণে সেন্সলেস হবার উপক্রম। ওর অবস্থা দেখে নার্স একজন ওর সাথেই আছে।
আমি কেমন যেন অসার হয়ে গেলাম। অনুভূতিশূণ্য হয়ে গেলাম। সবকিছুতে কেমন যেন ঘোর লেগে ছিল। স্থির কণ্ঠে নার্সকে জিজ্ঞেস করলাম- আপা কী হয়েছে একটু বলবেন?
নার্স বলল, আপনার ভাইয়া অ্যাক্সিডেন্ট করেছে। অবস্থা খুবই আশঙ্কাজনক। মাথায় প্রচণ্ড আঘাত পেয়েছে।
নার্সের কথাটি আমার কলিজাটা খপ করে ধরে বসল! মুহূর্তের মধ্যে শরীরে কম্পন শুরু হয়ে গেল। গলা শুকিয়ে আসতে লাগল। চোখদুটি আকস্মিক চাপ সামলাতে না পেরে চাপা ব্যথায় যেন ঝুঁকিয়ে উঠল। বান্ধ হয়ে আসছিল। পৃথিবীটা ঝাপসা দেখাচ্ছিল। কণ্ঠ কে যেন চিপে ধরতে চাচ্ছিল।
কিছুক্ষণ পর লম্বা কয়েকটি শ্বাস নিয়ে নার্সকে কিছু বলতে যাব অমনি সার্জন বেরিয়ে আসলেন। এসে আব্বুকে ডেকে নিয়ে ওপাশের রুমে বসালেন। আমি নার্স থেকে মনোযোগ সরিয়ে আব্বুর দিকে তাকিয়ে রইলাম। হাত-পা খুব কাঁপছিল তখন আমার।
একটু পর হঠাৎ আম্মুর কথা মনে হতেই তাকিয়ে দেখি নার্সের মুখ থেকে অ্যাক্সিডেন্টের কথা শুনেই আম্মু সেন্সলেস হয়ে গেছেন। নার্সকে বললাম, আপা ওকে রেখে আম্মুকে দেখুন একটু। প্লিজ!
নার্স আপা দ্রুত স্ট্রেচার এনে আম্মুকে ভেতরে নিয়ে গেলেন।
এদিকে আমার পুরো শরীর ঘেমে-নেয়ে জবুথবু অবস্থা। নিশ্বাসে যেন জলন্ত স্ফুলিঙ্গ ছড়িয়ে পড়ছে। আব্বুর দিকে কয়েক কদম আগালাম। সে কী! আব্বুর বেশুরা কান্নার আওয়াজ!
দ্রুত রুমে ঢুকে গেলাম। ডাক্তারকে সরাসরি বললাম, স্যার, আমি পেসেন্টের ছোটভাই। কী অবস্থা ভাইয়ার?
ডাক্তার আমার দিকে তাকিয়ে উনার চশমাটি খুলে পাশে রাখলেন। রুমালে আলতো করে চোখ মুছে নিয়ে অস্ফুটে বললেন, দেখুন, আমরা আমাদের সর্বোচ্চটা দিয়ে চেষ্টা করেছি। কিন্তু নিয়তি আমাদেরকে হারিয়ে দিয়েছে। আই এম সরি।
আমি লক্ষ করলাম, সরি শব্দটি তার মুখ থেকে বেরুতে চাচ্ছিল না। ঠোঁটের আগায় কয়েক সেকেন্ড আটকে ছিল শব্দটি। আব্বু টেবিলে মাথা রেখে বাচ্চাদের মতো কেঁদে যাচ্ছেন।
হুট করে আমি নিজেও কেন যেন অভদ্রের মতো কেঁদে উঠলাম। ঠিক গুছিয়ে রাখতে পারছিলাম না নিজেকে। ভাইয়ার পাগড়িটা আব্বুর হাতে ছিল। ওতে কোনো দাগ লাগেনি। গাড়িতে খুলে রেখেছিল ওটা। আমি ফ্লোরে বসে পড়লাম। বেশ কিছুক্ষণ পর আধো কণ্ঠে বললাম, স্যার, ভাইয়াকে একটু দেখা যাবে?
ডাক্তার আমার পিঠে হাত বুলিয়ে বললেন, যদিও আমি নিজেই মানতে পারছি না। তবুও বলতে বাধ্য হচ্ছি- আমি আবারও সরি। কারণ পেসেন্টের মাথার স্কাল্প ফেটে গেছে। সেইসাথে চেহারাও নষ্ট হয়ে গেছে। আপনার ভাইয়া গাড়ির ডান পাশে বসেছিল। হঠাৎ দোকান থেকে ঠাণ্ডা কিছু কিনতে গাড়ি থামাতে বলে। ড্রাইভার গাড়ি থামালে যে-ই না আপনার ভাইয়া নেমে দাঁড়াল অমনি পেছন থেকে একটি দ্রুতগামী বাস এসে এক ধাক্কায়… আর সেই ধাক্কাটা সরাসরি মাথায় লেগেছিল। আমাদের এখানে আসার কিছুক্ষণ পরই তার হার্টবিট পাচ্ছিলাম না। তবুও কেন যেন নিজেকে মানাতে পারিনি। তার রক্তাক্ত শেরওয়ানি আমাকে মানতে দিচ্ছিল না। অহেতুক কিছুক্ষণ চেষ্টা করে নিজেকে সান্তনা দিতে চাচ্ছিলাম। শেষমেশ আর পারলাম না আমরা…। এই বলতেই দ্বিতীয়বারের মত স্যারের চোখ ভিজে আসল।
এরপর বলল, আপনাদের প্রতি একটা অনুরোধ থাকবে, লাশটি কাউকে দেখতে দেবেন না। নিজেরাও কেউ দেখবেন না। এতে যে দেখবে তার ক্ষতি হতে পারে। শক সইতে না পেরে স্ট্রোক করে বসতে পারে। এমন অনেক এক্সপেরিয়েন্স আছে আমাদের। এমনকিছু ঘটে গেলে তখন আমরা নিজেরাও আর স্থির থাকতে পারি না। আমরাও যে মানুষ। আর দশটা মানুষের মতো আমরাও রক্তমাংসের গড়া। প্লিজ, যে করেই হোক, এই রিকোয়েস্টটি রাখবেন।
আব্বু একটু স্থির হয়ে ঘড়ি দেখছেন। ৩টা ছুঁইছুঁই। পকেট থেকে ফোন বের করে দেখলেন আপনার বাবার অনেকগুলো মিসড কল। কলব্যাক করে বললেন, বেয়াই সাহেব আমরা কিছুক্ষণের মধ্যেই আসছি। একটু ধৈর্য্য ধরুন প্লিজ। এই বলে ফোন রেখে দিলেন।
আব্বুর কথা শুনে আমার মাথায় যেন আকাশ ভেঙে পড়ল! আব্বুকে বললাম, আব্বু! কিছুক্ষণ পর যাচ্ছেন মানে? আর তাদেরকে কিছু জানালেন না যে?!
কিছুদিন হলো আব্বুর দাড়িতে পাক ধরেছে। সাদাকালো দাড়িগুলো ভিজে গেছে একদম। দাড়ি-মুখ মুছে নিয়ে এবার স্থির হলেন। মুহূর্তের মধ্যে একেবারে শান্ত হয়ে গেলেন। ডাক্তারকে লাশ দিয়ে দেওয়ার ব্যবস্থা করতে বলে আমাকে নিয়ে ওয়েটিংরুমে চলে গেলেন। এতক্ষণে আম্মু আর তুবাও নার্সের মাধ্যমে ভাইয়ার খবর পেয়ে গেছে। অল্প শোকে কাতর, অধিক শোকে পাথর। তারা দু’জন এখন সেই পাথর হয়ে বসে আছে। চোখের পলক ফেলাও যেন ভুলে গেছে। ফ্যাকাসে চেহারা নিয়ে অপলক তাকিয়ে আছে কোথাও।
আব্বু ওখানে গিয়ে আম্মুকে বললেন, তুমি ফাহিমকে নিয়ে ওখানে চলে যাও। আর বাকিদেরকে এসবকিছু বলার প্রয়োজন নেই। যা বলার, পরে আমি বলব।
আম্মু চোখ ফিরিয়ে স্থির তাকিয়ে রইল আব্বুর দিকে। আম্মুকে স্থির হতে বলে আব্বু বলল, এই যে তুষারের পাগড়িটি আমার হাতে। এটাকে ফাহিমের মাথায় পরিয়ে দিলাম। যাও, পুত্রবধূকে বাড়ি নিয়ে আসো। এদিকটা আমি দেখছি।
এই বলে আব্বু পাগড়িটি আমার মাথায় পরিয়ে দিয়ে বললেন, বাবা! এই সংবাদ মেয়েটা শুনলে সহ্য করতে পারবে না। ওকে কিছু বুঝতে দিস না। সবকিছু হয়ে গেলে নিজের মতো করে বুঝিয়ে বলিস। আমি ওকে নিজের মেয়ে বানিয়ে নিলাম। আর আমার মেয়েকে আমি শোকের সাগরে ভাসিয়ে ফেলে রাখতে পারি না। আমার মেয়ে আমার বাড়িতেই আসবে। আমার মেয়ে আমার ছেলের বধূ হয়েই আসবে।
আব্বুর কথা শুনে আমার পায়ের নিচ থেকে যেন মাটি সরে গেল!
আমি এক-পা পিছিয়ে গিয়ে বললাম, আব্বু! এটা কী করে সম্ভব!
আব্বু দৃঢ় কণ্ঠে বললেন, আমি বলেছি, তাই সম্ভব। অসম্ভবের কিছু তো দেখছি না। আমার লাজ রাখিস ফাহিম। এই বলে আব্বু আম্মুর হাত ধরে গাড়িতে তুলে দিলেন। সাথে আমাকেও। আব্বুকে কিছু বলার মত কোনো শব্দ আমি খুঁজে পাচ্ছিলাম না। আম্মুও কোনোদিন আব্বুর কথার অমত করেনি। আজও তার ব্যতিক্রম হলো না। স্বামীর আদেশের সামনে ছেলের শোক যেন ম্লান হয়ে গেল।
আব্বু একটু শক্ত করে আম্মুকে বললেন, ওখানে গিয়ে বেয়াই আর বেয়াইন ছাড়া আর কাউকে কিছু জানাবে না। আর আমার সিদ্ধান্তটাও স্পষ্ট জানিয়ে দেবে। আশাকরি অমত করবে না। আর বলে দেবে, আমার ছেলে দু’টা একই মুদ্রার এপিঠ-ওপিঠ। তার মেয়েকে অসুখী রাখবে না এটা হলফ করে বলে দিতে পারি। যাও, সবকিছু গুছিয়ে মেয়েটাকে নিয়ে আসো। আর বৌমাকে বোলো, এটা ওর শ্বশুরবাড়ি নয়, এটা ওর নিজের নতুন বাড়ি।
আম্মু কয়েকটি উষ্ণ ফোঁটা বিসর্জন দিয়ে স্বামীর আদেশকে শীরোধার্য মেনে নিয়ে গাড়িতে উঠে পড়লেন। গাড়ি চলতে শুরু করল…
এরপর সেখানে পৌঁছে আপনার আব্বু-আম্মুকে বিস্তারিত বলার পর তাদের পায়ের তলা থেকেও যখন মাটি সরে যাচ্ছিল ঠিক তখনই আম্মু আমাকে সামনে এনে তাদের পা মাটিতে স্থির করে দিলেন। মিশ্র অনুভূতির চাপ তারা সাময়িক সইতে না পেরে উদ্ভ্রান্ত হয়ে পড়েন। আপনার আম্মু তো রীতিমতো অসুস্থ হয়ে পড়েন। কিছুক্ষণ পর আপনার আব্বু সবকিছু মেনে নিয়ে, আনুষ্ঠানিকতা সেরে আমাদেরকে বিদায় দিলেন।
আর হ্যাঁ! একটা মানুষের কথা বলা হয়নি। সে হলো আমাদের মিয়া ভাই। সবাই তাকে মিয়া ভাই বলে ডাকে। ভাইয়ার পাগড়িটি আমার মাথায় পরিয়ে দেওয়ার পরামর্শটি সে-ই আমার আব্বুকে দিয়েছে। আব্বু প্রথমে মানতে চায়নি। পরে অনেক বুঝিয়ে-সুঝিয়ে আব্বুকে রাজি করিয়ে চুপচাপ তিনি গাড়িতে উঠে বসে যান। এবার ভাবছি, কিছুদিনের মধ্যেই আপনি আর আমি মিলে মিয়া ভাইয়ের জন্য একটা দফারফা করব। কী! পাত্রী খোঁজায় আপনাকে পাশে পাব তো?
কান্নার কারণে মেয়েটির শ্বাস বন্ধ হবার যোগাড়! মাথা তুলছে না। ফাহিম মাথায় হাত রেখে বলল, ‘প্লিজ, একটু রিল্যাক্স হোন। সব ঠিক হয়ে যাবে।’
কিছুক্ষণ পর সারা মাথা তুলল। এরপর ফাহিম আবার জিজ্ঞেস করল, ‘মিয়া ভাইয়ের ব্যাপারে কিছু বললেন না যে?!’ সারা চোখ-মুখ মুছে নিয়ে অস্ফুটে বলল, ‘জি অবশ্যই। তার প্রতি যে আমরা ঋণী! ‘
দীর্ঘক্ষণ পর ফাহিম একটু তৃপ্তির শ্বাস নিল। এরপর সারা বলল, ‘আচ্ছা আপনার ভাইয়ার কোনো ছবি আছে আপনার কাছে? একটু দেখতে দেবেন? জাস্ট একটু! একবার!’
ফাহিম পকেট থেকে ফোন বের করে বরযাত্রী রওয়ানা হবার আগে তোলা ছবিটি বের করে দিল। ফোনটা হাতে নিয়ে ছবিটির দিকে উদ্ভ্রান্তের মতো কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইল সারা।
কিছুক্ষণ পর ঝাপসা চোখে আর কিছু দেখতে না পেয়ে ফোনটা রেখে ফাহিমকে বলল, আপনার হাতটি একটু ছুঁই?
ফাহিম নিশ্চুপ হয়ে অপলক তাকিয়ে রইল সারার দিকে। ফাহিমের নিরবতা সারাকে অনুমতি দিলে ফাহিমের ডান হাতটি নিয়ে তাতে একটি চুমু খেয়ে বুকের সাথে জড়িয়ে নিয়ে হাউমাউ করে কান্না জুড়ে দিল মেয়েটি। আষাঢ়ের মেঘের গর্জন সবাই শুনেছে। কিন্তু নববধূর এমন মিশ্র অনুভূতির বিরল কান্না সেদিন ফাহিম ছাড়া আর কেউ দেখেনি। ফাহিম যেন অসাড় হয়ে গেল। জবান আড়ষ্ট হয়ে গেল। নিরব চোখের পানি ছাড়া ওর আর কোনো প্রত্যুত্তর নেই।
বেশ কিছুক্ষণ পর মাথা তুলে সারা বলল, ‘আজ কেন যেন মনে হচ্ছে, আমি একেবারে নিঃস্ব। আবার এ-ও মনে হচ্ছে, আমার জীবন ধন্য। এমন বিভ্রম হচ্ছে কেন?’
ফাহিম নির্বাক। সারা ফের বলে উঠল, ‘আচ্ছা আমি যদি আজ রাতটির জন্য আপনার হাতটি আর না ছাড়ি তাতে কি আপনার কষ্ট হবে?’
ফাহিম অপর হাতটি সারার মাথায় রেখে স্থির কণ্ঠে বলল, ‘বরং ছেড়ে দিলেই কষ্ট হবে।’