২. অদৃশ্য হওয়া

২. অদৃশ্য হওয়া

কল্পনা যখন মূল কেন্দ্রবিন্দুর বাইরে, তখন শুধু চোখের ওপর নির্ভর করে থাকা যায় না।

—মার্ক টোয়েন

স্টার ট্রেক ৪ : দ্য ভয়েজ হোম-এ এন্টারপ্রাইজের ক্রুরা একবার ক্লিনগন ব্যাটল ক্রুজার ছিনতাই করে। সেটি ফেডারেশন স্টার ফ্লিটের স্টারশিপের মতো ছিল না। ক্লিনগন সাম্রাজ্যের ওই স্টারশিপে লুকানো ছিল অদৃশ্য করার এক যন্ত্র। আলো বা রাডার থেকে তাদের অদৃশ্য করে রাখত যন্ত্রটি। এর কারণে স্টারশিপের পেছনে ক্লিনগনের শিপ ফেডারেশন চুপি চুপি এসে পাল্টা আঘাত ছাড়াই অ্যামবুশ করতে পারত। ফেডারেশন অব প্ল্যানেটের বিরুদ্ধে ক্লিনগন সাম্রাজ্য আসলে কৌশলগত সুবিধা পায় অদৃশ্য হওয়ার এ যন্ত্রটির কারণে।

প্রশ্ন হলো, এ রকম যন্ত্র বানানো কি আসলে সম্ভব? অদৃশ্য হওয়ার বিষয়টি অনেক দিন ধরে কল্পবিজ্ঞান ও ফ্যান্টাসিতে বিস্ময়কর এক বিষয় হিসেবে দেখা হচ্ছে। দ্য ইনভিজিবল ম্যানবইয়ের পাতা থেকে শুরু করে এটি হ্যারি পটারের বইয়ের জাদুকরি অদৃশ্য হওয়ার চাদর কিংবা দ্য লর্ড অব দ্য রিংস-এর আংটি পর্যন্ত বিস্তৃত। তবু অন্তত এক শতাব্দী ধরে পদার্থবিদেরা অদৃশ্য হওয়ার এমন চাদর থাকার সম্ভাবনা নাকচ করে দেন। মোটাদাগে একে অসম্ভব বলেন তাঁরা। কারণ, এগুলো আলোকবিদ্যার সূত্র মানে না। তা ছাড়া পদার্থের জানা কোনো ধর্মের সঙ্গেও খাপ খায় না এটা।

তবে এই অসম্ভব ব্যাপারটি এখন হয়তো সম্ভব হয়ে উঠতে পারে। মেটাম্যাটেরিয়ালের নতুন বিকাশ গুরুত্বপূর্ণ সংস্কার করতে বাধ্য করছে আলোকবিদ্যার পাঠ্যবইগুলো। এ রকম পদার্থের কার্যকর প্রোটোটাইপ বানানো হয়েছে গবেষণাগারে। আবার দৃশ্যমান কোনো কিছু অদৃশ্য করার ব্যাপারে ব্যাপক আগ্রহ দেখা দিয়েছে গণমাধ্যমে, শিল্পে ও সেনাবাহিনীতে।

ইতিহাসে অদৃশ্যতা

প্রাচীন পৌরাণিক কাহিনিতে অদৃশ্যতা সম্ভবত অন্যতম পুরোনো এক ধারণা। লিখিত ইতিহাস আসার পর দেখা যায়, গা-ছমছমে রাতে নিঃসঙ্গ মানুষ মৃত কারও অদৃশ্য আত্মায় ভয় পেত। অনেক আগে মৃত ব্যক্তির আত্মা অন্ধকারে চুপি চুপি ঘুরে বেড়ায় বলে বিশ্বাস করত তারা। গ্রিক নায়ক পারসিয়াস বদমাশ মেডুসাকে হত্যা করেছিল অদৃশ্য হওয়ার এক হেলমেট মাথায় পরে। বিভিন্ন দেশের সেনাপ্রধানরা অনেক দিন ধরে অদৃশ্য হওয়ার একখানি চাদর হাতে পাওয়ার স্বপ্ন দেখছেন। অদৃশ্য হয়ে সহজে শত্রুপক্ষের ভেতর ঢুকে অতর্কিতে ধরাশায়ী করা যাবে শত্রুপক্ষকে। আবার অপরাধীরাও অদৃশ্য হয়ে শ্বাসরুদ্ধকর উপায়ে ডাকাতিও করে বসতে পারবে।

প্লেটোর নীতিশাস্ত্র ও নৈতিকতায় অদৃশ্যতার একটি প্রধান ভূমিকা রয়েছে। তার দর্শনশাস্ত্রের মাস্টারপিস দ্য রিপাবলিক-এ প্লেটো গাইজেসের রিংয়ের মিথের কথা বর্ণনা করেছেন। লিডিয়ার দরিদ্র কিন্তু একজন সৎ রাখাল ছিল গাইজেস। একদিন এক গোপন গুহায় ঢুকে একটা সমাধি দেখতে পায় সে। সমাধিতে এক শবদেহের হাতে সে সোনার তৈরি একটি আংটি দেখতে পায়। গাইজেস আবিষ্কার করে, তাকে অদৃশ্য করার জাদুকরি ক্ষমতা আছে সোনার আংটিটির। শিগগিরই আংটি থেকে পাওয়া ক্ষমতায় উন্মত্ত হয়ে ওঠে ওই দরিদ্র রাখাল। দেশের রাজপ্রাসাদে গিয়ে নিজের ক্ষমতা ব্যবহার করে রানিকে বশ করে ফেলে গাইজেস। এরপর রানির সহায়তা নিয়ে সে রাজাকে হত্যা করে এবং নিজেই হয়ে ওঠে লিডিয়ার পরবর্তী রাজা।

এখানে প্লেটো যে নৈতিকতা তুলে ধরতে চেয়েছেন, সেটি হলো, কোনো মানুষই চুরি ও হত্যা করার সুযোগ পেলে প্রলোভন দমন করতে পারে না। সব মানুষই দুর্নীতিপরায়ণ। নৈতিকতা হলো একটি সামাজিক কাঠামো, যা বাইরে থেকে আরোপ করা হয়। কোনো মানুষ তার সাধুতা ও সততার সুনাম রক্ষা করতে হয়তো জনসমক্ষে নৈতিক আচরণ করতে পারে। কিন্তু কখনো অদৃশ্য হওয়ার ক্ষমতা পেলে ওই ক্ষমতা ব্যবহার করে অবাধ্য হয়ে উঠতে পারে মানুষটি। (অনেকের বিশ্বাস, এই নৈতিক গল্প থেকেই জে আর আর টোলকিন তাঁর লর্ড অব দ্য রিংস ট্রিলজির অনুপ্রেরণা পেয়েছিলেন। এ ট্রিলজিতেও একটি আংটির দেখা পাওয়া যায়। আংটিটি যে লোক হাতে পরে নিমেষে সে অদৃশ্য হয়ে যায় এবং তারপর পরিণত হয় বদমাশে।)

অদৃশ্য হওয়ার ব্যাপারটি কল্পবিজ্ঞানেও বেশ সাধারণ একটা কৌশল হিসেবে ব্যবহার করা হয়। ১৯৩০-এর দশকের ফ্ল্যাশ গর্ডন সিরিজে, মিং দ্য মার্সিলেজের ফায়ারিং স্কোয়াড থেকে পালিয়ে যেতে ফ্ল্যাশ অদৃশ্য হয়ে যেত। হ্যারি পটার উপন্যাস ও মুভিতে একটা বিশেষ চাদর পরার কারণে হগওয়ার্ট ক্যাসলে কারও কাছে ধরা না পড়ে ইচ্ছেমতো ঘুরে বেড়াতে পারত হ্যারি।

এই পৌরাণিক ব্যাপারটির অনেকটাই এইচ জি ওয়েলস তাঁর দ্য ইনভিজিবল ম্যান শিরোনামের ক্ল্যাসিক উপন্যাসে একটা দৃঢ় রূপ দিয়েছেন। এতে দেখা যায়, এক মেডিকেল ছাত্র দুর্ঘটনাক্রমে চতুর্থ মাত্রার ক্ষমতা আবিষ্কার করে ফেলে এবং তার মাধ্যমে অদৃশ্য হয়ে যায়। দুর্ভাগ্য, সে এই বিস্ময়কর ক্ষমতা ব্যবহার করেছিল নিজের ব্যক্তিগত লাভের জন্য। ছোট ছোট বেশ কিছু অপরাধ দিয়ে শুরু করেছিল সে। ক্রমেই সে মরিয়া হয়ে ওঠে এরপর পুলিশের হাত থেকে পালাতে গিয়ে মারা যায়।

ম্যাক্সওয়েলের সমীকরণ ও আলোর রহস্য

উনিশ শতকের প্রভাবশালী বিজ্ঞানীদের অন্যতম ছিলেন স্কটিশ পদার্থবিদ জেমস ক্লার্ক ম্যাক্সওয়েল। তাঁর গবেষণার আগ পর্যন্ত অপটিকস বা আলোকবিদ্যার সূত্র সম্পর্কে পদার্থবিদেরা সুস্থির কোনো উপলব্ধিতে পৌছাতে পারেননি। এক অর্থে ম্যাক্সওয়েল ছিলেন মাইকেল ফ্যারাডের ঠিক উল্টো। পরীক্ষামূলক গবেষণায় ফ্যারাডের সহজাত প্রবৃত্তি অতুলনীয় ছিলেন, কিন্তু কোনো আনুষ্ঠানিক প্রশিক্ষণ ছিল না তাঁর। তেমনি ফ্যারাডের সমসাময়িক ম্যাক্সওয়েল ছিলেন উচ্চতর গণিতে সিদ্ধহস্ত। দুই শতক আগে নিউটন যেখানে তাঁর গবেষণা চালিয়ে গেছেন সেই কেমব্রিজে গাণিতিক পদার্থবিদ্যার শিক্ষার্থী হিসেবে বিখ্যাত হয়ে ওঠেন ম্যাক্সওয়েল।

নিউটন ক্যালকুলাস আবিষ্কার করেছিলেন। ক্যালকুলাসকে ডিফারেনশিয়াল ইকুয়েশনের ভাষায় প্রকাশ করা হয়। স্থান ও কালে কোনো বস্তু মসৃণভাবে যেসব ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র পরিবর্তনগুলোর মধ্য দিয়ে যায়, তা বর্ণনা করে ডিফারেনশিয়াল ইকুয়েশন বা অন্তরক সমীকরণ। মহাসাগরে তরঙ্গের গতি থেকে শুরু করে তরল পদার্থ, গ্যাস ও কামান গোলার গতি—সবকিছুই ডিফারেনশিয়াল ইকুয়েশনের ভাষায় প্রকাশ করা যায়। ফ্যারাডের বৈপ্লবিক আবিষ্কার আর তাঁর বলক্ষেত্রগুলোকে নির্দিষ্ট ডিফারেনশিয়াল ইকুয়েশন দিয়ে প্রকাশ করার লক্ষ্য ঠিক করেন ম্যাক্সওয়েল।

ফ্যারাডে আবিষ্কার করেছিলেন, বৈদ্যুতিক ক্ষেত্রকে চৌম্বক ক্ষেত্রে ও চৌম্বক ক্ষেত্রকে বৈদ্যুতিক ক্ষেত্রে রূপান্তরিত করা যায়। এই আবিষ্কার দিয়েই কাজ শুরু করেন ম্যাক্সওয়েল। ফ্যারাডের চিত্রায়িত বলক্ষেত্রগুলোকে তিনি ডিয়ারেনশিয়াল সমীকরণের ভাষায় নতুন করে লেখেন। এতে জন্ম নিল আধুনিক বিজ্ঞানের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ একগুচ্ছ সমীকরণ। সেগুলো ছিল ভয়ংকরদর্শন আটটি ডিফারেনশিয়াল সমীকরণ [ম্যাক্সওয়েল শুরুতে আটটি সমীকরণে বিদ্যুৎ-চুম্বকীয় ধর্মগুলো প্রকাশ করেন। পরে এ সমীকরণগুলো চারটিতে নামিয়ে আনা হয়।- অনুবাদক] সমীকরণগুলো দেখে গ্র্যাজুয়েট স্কুলে বিদ্যুৎ-চুম্বকীয় বিষয় নিয়ে পড়তে আসা বিশ্বের সব পদার্থবিদ ও প্রকৌশলীর ঘাম ছুটে যেতে বাধ্য।

এরপর ম্যাক্সওয়েল নিজেকে ভাগ্যনির্ধারণী এক প্রশ্ন করলেন : চুম্বকীয় ক্ষেত্রকে বৈদ্যুতিক ক্ষেত্রে আর বৈদ্যুতিক ক্ষেত্রকে যদি চুম্বকীয় ক্ষেত্রে পরিণত করা যায়, তাহলে তারা অনবরত একটি থেকে আরেকটিতে অসীম প্যাটার্নে রূপান্তরিত হতে থাকলে কী ঘটবে? ম্যাক্সওয়েল দেখতে পেলেন, তাহলে এই বিদ্যুৎ-চুম্বকীয় ক্ষেত্রগুলো একটি তরঙ্গের জন্ম দেবে। সেটা অনেকটা মহাসাগরের তরঙ্গের মতো। ভীষণ অবাক হয়ে তিনি আবিষ্কার করলেন, তাঁর গণনায় এই তরঙ্গের গতিবেগ পাওয়া যাচ্ছে ঠিক আলোর গতিবেগের সমান! ১৮৬৪ সালে এই কঠিন সত্য আবিষ্কার করার পর তিনি ভবিষ্যদ্বাণী করে লিখলেন : ‘এই গতিবেগ আলোর খুবই কাছাকাছি। তাই দেখা যাচ্ছে, আলো নিজেও যে একটি বিদ্যুৎ-চুম্বকীয় তরঙ্গ, সে সিদ্ধান্তে আসার পেছনে যথেষ্ট জোরালো যুক্তি আছে।’

সম্ভবত মানবেতিহাসে অন্যতম বড় আবিষ্কার এটা। এর মাধ্যমে প্রথমবারের মতো আলোর গোপনীয়তা উন্মোচিত হলো। ম্যাক্সওয়েল শিগগিরই বুঝতে পারলেন, সূর্য ওঠার সময়ের উজ্জ্বলতা থেকে শুরু করে সূর্য ডুবে যাওয়ার সময়ের আলোকচ্ছটা, রংধনুর মোহনীয় রং আর আকাশের গায়ে লেগে থাকা নক্ষত্রগুলো—সবকিছুকেই ব্যাখ্যা করা সম্ভব সামান্য এক টুকরো কাগজে তাঁর সেই অবহেলাভরে লেখা তরঙ্গ দিয়ে। এখন আমরা বুঝতে পারি, রাডার থেকে টিভি, ইনফ্রা রেড বা অবলোহিত আলো, দৃশ্যমান আলো, আলট্রাভায়োলেট বা অতিবেগুনি আলো, এক্স-রে, মাইক্রোওয়েভ ও গামারশ্মি—সবকিছুই আসলে ম্যাক্সওয়েলের তরঙ্গ ছাড়া আর কিছুই নয়। এগুলো আসলে ফ্যারাডের বলক্ষেত্রগুলোর কম্পন।

ম্যাক্সওয়েলের সমীকরণের গুরুত্ব নিয়ে একবার আইনস্টাইন মন্তব্য করেন, ‘নিউটনের পর থেকে পদার্থবিজ্ঞান যেসব অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হয়েছে, তার মধ্যে এগুলো হলো সবচেয়ে গভীর ও সবচেয়ে কার্যকরী।’

(দুঃখের ব্যাপার, উনিশ শতকের অন্যতম সেরা পদার্থবিজ্ঞানী ম্যাক্সওয়েল পাকস্থলীর ক্যানসারে মারা যান, মাত্র ৪৮ বছর বয়সে। সম্ভবত একই রোগে তাঁর মা-ও একই বয়সে মারা গিয়েছিলেন। দীর্ঘ জীবন পেলে সম্ভবত তিনি আবিষ্কার করতে পারতেন তাঁর সমীকরণগুলো স্থান-কালের বিকৃতি স্বীকার করে। এটা সরাসরি আইনস্টাইনের আপেক্ষিক তত্ত্বে নিয়ে যায়। ভাবতেও শিহরণ জাগে, ম্যাক্সওয়েল দীর্ঘ জীবন পেলে রিলেটিভি বা আপেক্ষিকতা হয়তো মার্কিন গৃহযুদ্ধের কালেই আবিষ্কার করে ফেলতে পারতেন।)

ম্যাক্সওয়েলের আলো তত্ত্ব ও পারমাণবিক তত্ত্ব আলোকবিদ্যা ও অদৃশ্যতার সহজ ব্যাখ্যা দেয়। কঠিন পদার্থে পরমাণুগুলো শক্তভাবে পরস্পরের সঙ্গে আটকে থাকে। অন্যদিকে তরল বা গ্যাসের অণুগুলো সে তুলনায় অনেক দূরে দূরে থাকে। বেশির ভাগ কঠিন পদার্থ অস্বচ্ছ। কারণ, তাদের ঘনবদ্ধ পরমাণুর ভেতর দিয়ে আলো চলাচল করতে পারে না। এই ঘনবদ্ধ পরমাণুগুলো ইটের দেয়ালের মতো আচরণ করে। বিপরীতে, অনেক তরল ও গ্যাসীয় পদার্থ স্বচ্ছ। কারণ তাদের পরমাণুগুলোর মাঝখানের ফাঁকা জায়গা দিয়ে আলো খুব সহজে চলাচল করতে পারে। এসব পদার্থের পরমাণুগুলোর মাঝখানের ফাঁকা জায়গার আকার দৃশ্যমান আলোক তরঙ্গের চেয়ে বেশি। যেমন পানি, অ্যালকোহল, অ্যামোনিয়া, অ্যাসিটোন, হাইড্রোজেন পারঅক্সাইড, গ্যাসোলিন ও অন্যান্য তরল পদার্থ স্বচ্ছ। একইভাবে অক্সিজেন, হাইড্রোজেন, নাইট্রোজেন, কার্বন ডাই-অক্সাইড, মিথেনের মতো অন্যান্য গ্যাসও স্বচ্ছ।

তবে এ নিয়মের কিছু গুরুত্বপূর্ণ ব্যতিক্রমও আছে। অনেক ক্রিস্টাল বা স্ফটিক একই সঙ্গে কঠিন ও স্বচ্ছ। স্ফটিকের পরমাণুগুলো নিখুঁত নকশাকার কাঠামোয় সাজানো থাকে, সুষমভাবে সারিবদ্ধ থাকে। আবার তাদের মাঝখানে থাকে সুষম জায়গা। তারপরও এর ভেতরে অনেকগুলো পথ থাকে। স্ফটিকময় এই নকশার মধ্য দিয়ে আলোকরশ্মি চলাচল করতে পারে সে জন্য। সে কারণে কঠিন পদার্থের মতো স্ফটিকের পরমাণুরা পরস্পরের সঙ্গে শক্তভাবে আটকে থাকলেও তার ভেতর দিকে আলো সহজে চলাচল করতে পারে।

এই বিশেষ অবস্থায় একটি কঠিন বস্তুও স্বচ্ছ হতে পারে, যদি তার পরমাণুগুলো এলোমেলোভাবে সাজানো থাকে। নির্দিষ্ট পদার্থকে উচ্চ তাপমাত্রায় উত্তপ্ত করে তারপর দ্রুত ঠান্ডা করে এটা করা সম্ভব। যেমন কাচ কঠিন পদার্থ হলেও এর অনেক ধর্ম তরলের মতো। কারণ এর পরমাণুগুলো এলোমেলোভাবে সাজানো। নির্দিষ্ট মিছরি বা ক্যান্ডিও স্বচ্ছ বানানো যায়, এই পদ্ধতি অনুসরণ করে।

কাজেই সহজেই বোঝা যাচ্ছে, অদৃশ্যতা এমন এক ধর্ম, যা ম্যাক্সওয়েলের সমীকরণের মধ্য দিয়ে পারমাণবিক পর্যায় থেকে আসে। তাই সাধারণ অর্থে এটি নকল করা অসম্ভব না হলেও খুব কঠিন। হ্যারি পটারকে অদৃশ্য করার জন্য তাকে প্রথমে তরল পদার্থে রূপান্তরিত করতে হবে। পরে সেদ্ধ করে বাষ্পে পরিণত করে স্ফটিকে রূপান্তরিত করতে হবে তাকে। আবারও উত্তপ্ত করার পর ঠান্ডা করতে হবে হ্যারি পটারকে। এই সবকিছুই কোনো জাদুকরের পক্ষেও করে ওঠা খুব কঠিন।

কোনো দেশের সেনাবাহিনী এখনো অদৃশ্য করা সম্ভব বিমান তৈরি করতে পারেনি। তবে এর চেয়েও ভালো কিছু বানানোর চেষ্টা করছে তারা। যেমন তারা স্টিলথ প্রযুক্তি বানাচ্ছে। এটি রাডারের কাছে বিমানকে অদৃশ্য করে তোলে। স্টিলথ প্রযুক্তির ভিত্তি হলো ম্যাক্সওয়েলের সমীকরণের ওপর নির্ভর করে বানানো বেশ কিছু কৌশল। স্টিলথ যুদ্ধবিমান মানুষের চোখে ঠিকই দেখা যায়, কিন্তু শত্রুপক্ষের রাডার স্ক্রিনে এর রাডার ইমেজ মাত্র বড়সড় একটা পাখির সমান। (স্টিলথ প্রযুক্তিতে আসলে একগুচ্ছ কৌশল জগাখিচুড়ি পাকিয়ে আছে। এতে যুদ্ধবিমানের উপাদান পরিবর্তন করে, তার মধ্যে ইস্পাতের পরিমাণ কমিয়ে তার বদলে প্লাস্টিক ও রেজিন ব্যবহার করা হয়। এক্সজস্ট পাইপ নতুনভাবে সাজিয়ে এবং আরও কিছু কাজ করা হয়। এতে শত্রুপক্ষের রাডার রশ্মি এই বিমানের গায়ে আঘাত করলে তা সব দিকে বিক্ষিপ্ত হয় বা ছড়িয়ে পড়ে। কাজেই ওই আলোকরশ্মি আর শত্রুর রাডারের পর্দায় ফিরে যেতে পারে না। তবে স্টিলথ প্রযুক্তি দিয়ে বানানো কোনো যুদ্ধবিমান পুরোপুরি অদৃশ্য নয়। বরং এটি রাডার থেকে যতটুকু রশ্মি আসে তার যান্ত্রিকভাবে যতটুকু সম্ভব দিক পরিবর্তন করে দেয় ও বিক্ষিপ্ত করে। )

মেটাম্যাটেরিয়াল ও অদৃশ্যতা

অদৃশ্যতা-সংক্রান্ত সবচেয়ে প্রতিশ্রুতিশীল নতুন উন্নয়নটি সম্ভবত মেটাম্যাটেরিয়াল নামে নতুন ধরনের অদ্ভুত একটি পদার্থ। পদার্থটি ভবিষ্যতে বস্তুকে সত্যি সত্যি অদৃশ্য করে তুলতে পারবে। মজার ব্যাপার হলো, একসময় মনে করা হতো, মেটাম্যাটেরিয়াল তৈরি করা অসম্ভব। কারণ, এটি আলোকবিদ্যার সূত্র মানে না। তবে ২০০৬ সালে যুক্তরাষ্ট্রের নর্থ ক্যারোলাইনায় ডারহামের ডিউক ইউনিভার্সিটি এবং লন্ডনের ইম্পেরিয়াল কলেজের গবেষকেরা সফলভাবে প্রচলিত জ্ঞানকে বুড়ো আঙুল দেখান। মেটাম্যাটেরিয়াল ব্যবহার করে মাইক্রোওয়েভ বিকিরণের কাছে একটি বস্তুকে অদৃশ্য করে তুলতে সক্ষম হন তাঁরা। বলতে দ্বিধা নেই, তাঁদের সামনে এখনো অনেক বাধা রয়েছে। কিন্তু তারপরও ইতিহাসে প্রথমবার সাধারণ কোনো বস্তুকে অদৃশ্য করার নীলনকশা এখন আমাদের হাতের মুঠোয় চলে এসেছে। (যুক্তরাষ্ট্রের পেন্টাগনের ডিফেন্স অ্যাডভান্সড রিসার্চ প্রজেক্ট এজেন্সি বা ডার্পা (DARPA) এই গবেষণায় অর্থ জোগান দিচ্ছে।)

মাইক্রোসফটের সাবেক প্রধান টেকনোলজি অফিসার নাথান মরিভোল্ড বলেছেন, ‘মেটাম্যাটেরিয়ালের বৈপ্লবিক সম্ভাবনা আলোকবিদ্যাকে পুরোপুরি ও ইলেকট্রনিকসের প্রায় পুরো চেহারা পাল্টে দেবে। এসব মেটাম্যাটেরিয়াল যেসব কাণ্ডকারখানা করে দেখাতে পারে, তা কয়েক দশক আগেও অলৌকিক মনে করা হতো।’

প্রশ্ন হলো, মেটাম্যাটেরিয়াল জিনিসটা আসলে কী? এগুলো এমন পদাৰ্থ, যাদের মতো আলোক ধর্ম প্রকৃতিতে আর কোথাও দেখা যায় না। মেটাম্যাটেরিয়াল কোনো বস্তুর ভেতরে অতিক্ষুদ্র অংশ দৃঢ়ভাবে স্থাপন করে এমনভাবে বানানো হয়, যেখানে বিদ্যুৎ-চুম্বকীয় তরঙ্গ অপ্রতিরোধ্য উপায়ে বাঁকিয়ে দিতে পারে। ডিউক ইউনিভার্সিটির বিজ্ঞানীরা ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র ইলেকট্রিক্যাল সার্কিট তামার পাতের মধ্যে এমন দৃঢ়ভাবে স্থাপন করেছেন। সেগুলো সমতল সজ্জায়, সমকেন্দ্রীয় বৃত্ত তৈরি করেছে (বৈদ্যুতিক ওভেনের কয়েলের সঙ্গে এর কিছুটা মিল আছে)। ফলাফল হিসেবে পাওয়া গেছে সিরামিক, টেফলন, যৌগিক ফাইবার ও ধাতব পদার্থের সূক্ষ্ম মিশ্রণ। তামার মধ্যে এই ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র পদার্থ বসানোর কারণে মাইক্রোওয়েভ রেডিয়েশন নির্দিষ্ট পথে বাঁকানো এবং অন্য পথে নিয়ে যাওয়া সম্ভব হয়েছে। কোনো পাথরের চাঁইয়ের কাছে নদীর প্রবাহের কথা একবার ভাবুন। বোল্ডার বা পাইয়ের চাঁইয়ের চারপাশে পানির প্রবাহ দ্রুত বেঁকে যায় বলেই পাথরের চাঁই সবেগে স্রোতে ভেসে যায়। একইভাবে মেটাম্যাটেরিয়াল অনবরত মাইক্রোওয়েভের পথ বদলে ও বাঁকিয়ে দেয়, তাতে তারা একটা সিলিন্ডারের চারপাশে প্রবাহিত হয়। তাই এই সিলিন্ডারের ভেতরে সবকিছুই মাইক্রোওয়েভের কাছে অদৃশ্য থেকে যায়। মেটাম্যাটেরিয়াল যদি আলোর সবগুলো প্রতিফলন ও ছায়া সরিয়ে দিতে পারে, তাহলে সেটি এ রকম কোনো বিকিরণ থেকে কোনো বস্তুকে পুরোপুরি অদৃশ্য করে ফেলতে পারবে।

তামার উপাদানে মুড়িয়ে ১০টি ফাইবার গ্লাসের রিং দিয়ে বানানো একটি যন্ত্রে সফলভাবে এই নীতির পরীক্ষা চালিয়ে দেখেছেন বিজ্ঞানীরা। যন্ত্রটির ভেতরে মাইক্রোওয়েভের কাছে প্রায় অদৃশ্য ছিল তামার রিংটি, শুধু অতিসামান্য ছায়া দেখা গিয়েছিল।

মেটাম্যাটেরিয়ালের মূলে আছে তাদের প্রতিসরণাঙ্ক সুচারুভবে বশ করার সক্ষমতা। স্বচ্ছ কোনো মাধ্যমে যাওয়ার সময় আলো বেঁকে যাওয়ার ঘটনাকে বলে প্রতিসরণ। আপনার হাত যদি পানিতে ডোবান কিংবা চশমার লেন্সের ভেতরে দিয়ে দেখেন, তাহলে দেখা যাবে, পানি ও চশমা সাধারণ আলোর গতিপথ বিকৃত ও বাঁকিয়ে দিয়েছে।

চশমার কাচে বা পানিতে আলো বেঁকে যাওয়ার কারণ ঘন মাধ্যমের (যেমন স্বচ্ছ মাধ্যম) ভেতর ঢুকলে আলোর গতি কমে। প্রকৃত শূন্যস্থানে আলোর গতি সব সময় একই থাকে। কিন্তু কাচ বা পানির মধ্যে চলার সময় কোটি কোটি পরমাণুর ভেতর দিয়ে যেতে হয় আলোকে। তাতে কমে যায় আলোর গতি। (আলোর গতিকে এসব মাধ্যমের মধ্যে আলোর ধীর গতি দিয়ে ভাগ করলে প্রতিসরণাঙ্ক বা রিফ্র্যাকশন ইনডেক্স পাওয়া যায়। আলোর গতি কাচের ভেতর ধীর হয়ে যায়, তাই এর প্রতিসরণাঙ্ক সব সময়ই ১.০-এর চেয়ে বেশি হবে)। যেমন শূন্যস্থানের প্রতিসরণাঙ্ক ১.০০, বাতাসের প্রতিসরণাঙ্ক ১.০০০৩, কাচের প্রতিসরণাঙ্ক ১.৫ আর হীরার ২.৪। সাধারণত যে মাধ্যম যত বেশি ঘন, আলোর গতিপথকে বাঁকানোর ক্ষমতা তার তত বেশি। তাই তার প্রতিসরণাঙ্কও তত বেশি হয়।

প্রতিসরণাঙ্কের একই ধরনের উদাহরণ মরীচিকা। উত্তপ্ত দিনে রাস্তায় গাড়ি চালাতে চালাতে সোজা দিগন্তের দিকে তাকালে মনে হবে রাস্তাটি ঝিকিমিকি করছে। এর ফলে চোখের সামনে পানির ঝকঝকে হ্রদ আছে বলে এক বিভ্রম সৃষ্টি হয়। আবার মরুভূমিতে মাঝে মাঝে দিগন্ত বরাবর দূরবর্তী শহরের প্রান্তরেখা ও পাহাড় দেখতে পায় অনেকে। উত্তপ্ত বাতাস পাকা রাস্তা বা মরুভূমি থেকে ওপরের দিকে উঠে যাওয়ার কারণে সেখানকার বাতাস সাধারণ বাতাসের তুলনায় হালকা হয়ে যায়। ফলে সেখানকার বাতাসের প্রতিসরণাঙ্ক কমে যায় চারপাশের ঠান্ডা বাতাসের তুলনায়। তাতে দূরের বস্তু থেকে আসা আলো রাস্তায় আপনার চোখে প্রতিসরিত হয়ে এমন বিভ্রান্তি সৃষ্টি করে যেন, আপনি দূরের কোনো বস্তু দেখতে পাচ্ছেন।

সাধারণত প্রতিসরণাঙ্ক ধ্রুবক। সরু আলোকরশ্মি কাচের ভেতর দিয়ে যাওয়ার সময় বেঁকে যায়। এরপর আবার সোজা পথে চলতে থাকে তা। কিন্তু এক মুহূর্তের জন্য ভেবে নিন, আপনি ইচ্ছেমতো প্রতিসরণাঙ্ক নিয়ন্ত্রণ করতে পারেন। কাজেই আপনি কাচের মধ্য দিয়ে তাকে প্রতিটি বিন্দুতে বারবার পরিবর্তন করতে লাগলেন। আলো এই নতুন বস্তুতে চলার সময় বেঁকে যাবে। তারপর আবারও নতুন পথে বাঁকতেই থাকবে। এতে ওই পদার্থটির মধ্যে আলোর জন্য সাপের মতো এঁকেবেঁকে চলা একটি পথের সৃষ্টি হবে।

কোনো মেটাম্যাটেরিয়ালের মধ্যে আলোর প্রতিসরণাঙ্ক নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হলে (যাতে আলো কোনো বস্তুর চারপাশে চলাচল করে) বস্তুটি চোখের সামনে থেকে স্রেফ অদৃশ্য হয়ে যেত। এটা করার জন্য ওই মেটাম্যাটেরিয়ালের প্রতিসরণাঙ্ক হতে হবে ঋণাত্মক। কিন্তু আলোকবিদ্যার প্রতিটি পাঠ্যবইয়ে এটি করা অসম্ভব বলে মনে করা হয়। (তাত্ত্বিকভাবে মেটাম্যাটেরিয়ালের কথা একটি গবেষণাপত্রে প্রথম বলেন রুশ বিজ্ঞানী ভিক্টর ভেসেল্যাগো, ১৯৬৭ সালে। ওই গবেষণাপত্রে তিনি আলোর অদ্ভুত কিছু ধর্মের প্রমাণ দেখান। যেমন ঋণাত্মক প্রতিসরণাঙ্ক, বিপরীত ডপলার ইফেক্ট। আপাতদৃষ্টিতে মেটাম্যাটেরিয়াল এতই উদ্ভট ও অযৌক্তিক যে এটি বানানো একসময় অসম্ভব বলে মনে করা হতো। কিন্তু গত কয়েক বছরে গবেষণাগারে সত্যিকার অর্থেই মেটাম্যাটেরিয়াল বানানো সম্ভব হয়েছে। এর মাধ্যমে আলোকবিদ্যার সব পাঠ্যবই নতুন করে লিখতে বাধ্য করছে অনিচ্ছুক বিপ্লবী পদার্থবিদদের।

মেটাম্যাটেরিয়ালের গবেষকেরা অনবরত সাংবাদিকদের জ্বালাতনের শিকার হচ্ছেন। অদৃশ্য হওয়ার চাদর বা আলখেল্লা কবে, কখন বাজারে পাওয়া যাবে, তা নিয়ে রীতিমতো কৌতূহলী তাঁরা। এর উত্তর হলো : শিগগিরই এ রকম কিছু ঘটার কোনো সম্ভাবনা নেই।

ডিউক ইউনিভার্সিটির ডেভিড স্মিথ বলেন, “রিপোর্টাররা বারবার ফোন করে যেকোনো একটা সংখ্যা জানতে চান। অর্থাৎ মাসের সংখ্যা, নয়তো বছরের সংখ্যা। তাঁরা এমনভাবে দাবি জানান যে শেষ পর্যন্ত আপনি বলতে বাধ্য হবেন, হয়তো ১৫ বছরের মধ্যে। এরপর খবরের কাগজে শিরোনামে পরিণত হবেন আপনি, ঠিক? হ্যারি পটারের চাদর আসছে ১৫ বছরের মধ্যে।’ এ কারণে তিনি এখন কোনো নির্দিষ্ট সময়সীমা বেঁধে দিতে নারাজ। হ্যারি পটার বা স্টার ট্রেক-ভক্তদের হয়তো আরও কিছুদিন অপেক্ষা করতে হবে। বেশির ভাগ পদার্থবিদ হয়তো একমত হবেন যে পদার্থবিজ্ঞানের সূত্র ব্যবহার করে একদিন অদৃশ্য হওয়ার চাদর সত্যিই বানানো সম্ভব। তবে মাইক্রোওয়েভ বিকিরণের পরিবর্তে এ প্রযুক্তি দৃশ্যমান আলোর ক্ষেত্রে না বাড়ানো পর্যন্ত ভয়ানক প্রযুক্তিগত বাধাগুলো থেকেই যাবে।

সাধারণভাবে মেটাম্যাটেরিয়ালের ভেতরে বসানো অভ্যন্তরীণ কাঠামো অবশ্যই ওই বিকিরণের তরঙ্গদৈর্ঘ্যের চেয়ে ছোট হতে হবে। যেমন ধরা যাক, মাইক্রোওয়েভের তরঙ্গদৈর্ঘ্য হতে পারে প্রায় ৩ সেন্টিমিটার। তাই কোনো মেটাম্যাটেরিয়াল মাইক্রোওয়েভের গতিপথ বাঁকাতে চাইলে তার ভেতরে বসানো অংশের আকার ৩ সেন্টিমিটারের চেয়ে ছোট হতে হবে। নীল আলোর তরঙ্গদৈর্ঘ্য ৫০০ ন্যানোমিটার। সে জন্য কোনো বস্তু নীল আলোয় অদৃশ্য করতে চাইলে মেটাম্যাটেরিয়ালের ভেতরে বসানো কাঠামোগুলোর আকার হতে হবে মাত্র ৫০ ন্যানোমিটার লম্বা। ন্যানোমিটার পারমাণবিক পরিসরের মাপ, সে জন্য ন্যানো প্রযুক্তি প্রয়োজন। (১ ন্যানোমিটার হলো ১ মিটারের ১ বিলিয়ন বা ১০০ কোটি ভাগের ১ ভাগ। ১ ন্যানোমিটারে মোটামুটি পাঁচটি

পরমাণু অনায়াসে এঁটে যায়।) সত্যিকার অদৃশ্য হওয়ার যন্ত্র বানাতে এটিই সম্ভবত আমাদের জন্য এখন সবচেয়ে বড় সমস্যা। কোনো মেটাম্যাটেরিয়ালের ভেতরে থাকা আলাদা আলাদা পরমাণু আলোকরশ্মিকে বাঁকিয়ে এমন করে দিতে হবে যেন তা সাপের গতিপথের মতো আঁকাবাঁকা হয়।

দৃশ্যমান আলোর মেটাম্যাটেরিয়াল

এখন প্রতিযোগিতা চলছে।

গবেষণাগারে মেটাম্যাটেরিয়াল বানানোর ঘোষণার পরপরই হঠাৎ ব্যাপক হুড়োহুড়ি দেখা দেয় এ ক্ষেত্রটিতে। সে কারণে এখন প্রায় কয়েক মাস পরপর নতুন চিন্তাভাবনা আর বিস্ময়কর সফলতার খবর পাওয়া যাচ্ছে। এখন আমাদের গন্তব্য স্পষ্ট। সেটি হলো, ন্যানোটেকনোলজি ব্যবহার করে এমন মেটাম্যাটেরিয়াল বানাতে হবে, যা শুধু মাইক্রোওয়েভ নয়, দৃশ্যমান আলোও বাঁকিয়ে দিতে পারবে। সে জন্য অনেকগুলো উপায়ের প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে। এর মধ্যে কয়েকটি বেশ আশাজাগানিয়া।

একটি প্রস্তাব হলো, সাধারণ প্রযুক্তির ব্যবহার। অর্থাৎ সেমিকন্ডাক্টর ইন্ডাস্ট্রি থেকে আমাদের আগে থেকে জানা থাকা প্রযুক্তি ধার করে নতুন মেটাম্যাটেরিয়াল বানানো। ফটোলিথোগ্রাফি নামে একটি পদ্ধতি ক্ষুদ্রাকৃতির কম্পিউটার বানানোর মূলমন্ত্র। এর মাধ্যমে কম্পিউটার-বিপ্লব সম্ভব হয়েছে। এই প্রযুক্তির কারণে সিলিকনের চাকতির মধ্যে অতি ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র কয়েক লাখ ট্রানজিস্টর বসাতে পারেন প্রকৌশলীরা। অবাক করা ব্যাপার হলো, এই সিলিকন চাকতির আকার আপনার বুড়ো আঙুলের চেয়ে বড় নয়।

কম্পিউটারের ক্ষমতা প্রতি আঠারো মাসে দ্বিগুণ হয় (একে বলে মুরের সূত্র)। এমন হওয়ার কারণ সিলিকন চিপে অতি ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র উপাদান খোদাই করতে অতিবেগুনি বিকিরণ ব্যবহার করা হয়। রঙিন টি-শার্ট বানাতে স্টেনসিল বা ছিদ্রময় পাতা ব্যবহার পদ্ধতির সঙ্গে এর বেশ মিল আছে। (কম্পিউটার ইঞ্জিনিয়াররা পাতলা ওয়েফার বা চাকতি দিয়ে কাজ শুরু করেন। এরপর এর ওপর বিভিন্ন বস্তুর অতি পাতলা কোটিং ব্যবহার করা হয়। চাকতির ওপর পরে প্লাস্টিকের মাস্ক দেওয়া হয়, যা টেমপ্লেট বা মানদণ্ডের মতো কাজ করে। এতে বৈদ্যুতিক তার, ট্রানজিস্টর ও কম্পিউটারের অন্য সব উপাদানের জটিল আউটলাইন দেওয়া থাকে। এটিই এসব সার্কিটের মূল কঙ্কাল হিসেবে কাজ করে। এরপর অতিবেগুনি রশ্মির মধ্যে রাখা হয় চাকতিগুলোকে। এ আলোর তরঙ্গদৈর্ঘ্য খুব ছোট। আলোসংবেদী চাকতির ওপর নকশা মুদ্রিত করে অতিবেগুনি রশ্মি। চাকতিটিতে পরে ব্যবহার করা হয় বিশেষ গ্যাস ও অ্যাসিড। এভাবে চাকতির যে অংশে অতিবেগুনি রশ্মি পড়ে, সেখানে জটিল সার্কিটের নকশা খোদাই হয়ে যায়। এ পদ্ধতিতে এমন চাকতিও বানানো যায়, যার মধ্যে কয়েক লাখ অতি ক্ষুদ্র খাঁজ কাটা থাকে। এই খাঁজগুলো আসলে ট্রানজিস্টরের আউটলাইন।) বর্তমানে এই খোদাই পদ্ধতিতে সবচেয়ে ছোট যে বস্তু বানানো সম্ভব, তার আকার প্রায় ৩০ ন্যানোমিটার (বা আড়াআড়িভাবে প্রায় ১৫০ পরমাণুর সমান)।

একদল বিজ্ঞানী দৃশ্যমান আলোতে কার্যকর মেটাম্যাটেরিয়াল বানাতে প্রথমবারের মতো সিলিকন চাকতি খোদাই প্রযুক্তি ব্যবহার করেন। এতে অদৃশ্যতার উপায়ের খোঁজে অর্জিত হয় এক মাইলফলক। ২০০৭ সালে ইতিহাসে প্রথমবারের মতো লাল আলোতে কাজ করতে পারা এক রকম মেটাম্যাটেরিয়াল তৈরির ঘোষণা দেন জার্মান বিজ্ঞানীরা এবং মার্কিন ডিপার্টমেন্ট অব এনার্জি। কাজেই দেখা যাচ্ছে, বেশ স্বল্পকালের মধ্যে তথাকথিত অসম্ভব কাজটি করা সম্ভব হয়েছে।

জার্মানির কার্লশ্রু বিশ্ববিদ্যালয়ের স্টিফান লিনডেন, মার্টিন ওয়েগনার ও গানার ডলিংয়ের সঙ্গে আইওয়ার আমেস ল্যাবরেটরির পদার্থবিদ কোস্টাস সোকুলসি আরেক ধরনের মেটাম্যাটেরিয়াল তৈরি করেছেন, লাল আলোতে যার সূচক -০.৬। লাল আলোর তরঙ্গদৈর্ঘ্য ৭৮০ ন্যানোমিটার। (এর আগে মেটাম্যাটেরিয়ালের আলোর বিকিরণ বাঁকানোর বিশ্ব রেকর্ড ছিল ১৪০০ ন্যানোমিটার। তার অবস্থান ছিল দৃশ্যমান আলোর পরিসরের বাইরের অবলোহিত বা ইনফ্রারেড আলোতে।)

কাচের পাত নিয়ে কাজ শুরু করেন এই বিজ্ঞানীরা। এতে ছিল সিলভার, ম্যাগনেশিয়াম ফ্লুরাইডের পাতলা স্তর। তারপর আরেক প্রস্থ সিলভারের স্তর ব্যবহার করে আক্ষরিক অর্থে ফ্লুরাইডের স্যান্ডউইচ বানান তাঁরা। এতে এর ঘনত্ব দাঁড়ায় মাত্র ১০০ ন্যানোমিটার। প্রচলিত খোদাই কৌশল ব্যবহার করে তাঁরা ওই স্যান্ডউইচের স্তরে অনেকগুলো মাইক্রোস্কোপিক আকারের বর্গাকার গর্ত তৈরি করেন। ফলে যে গ্রিড প্যাটার্ন তৈরি হয়, তা দেখতে অনেকটা মাছ ধরার জালের মতো। (গর্তগুলো ১০০ ন্যানোমিটার প্রশস্ত, যা লাল আলোর চেয়ে অনেক ছোট।) এবার তারা লাল আলো এ বস্তুর ভেতর চালিয়ে তার প্রতিসরণাঙ্ক মাপেন। এর পরিমাণ পাওয়া গেল -০.৬।

এ প্রযুক্তির বেশ কিছু ব্যবহারিক দিক আগাম বলতে পারে পদার্থবিদদের এই দল। এ ব্যাপারে ড. সোকুলসি বলেন, মেটাম্যাটেরিয়াল ‘হয়তো একদিন এমন সমতল সুপারলেন্স উন্নয়নের পথ দেখাবে, যা দৃশ্যমান বর্ণালিতেও কার্যকর হবে। এ রকম লেন্স প্রচলিত প্রযুক্তির চেয়ে আরও বেশি রেজল্যুশন দিতে পারবে। তাতে আলোর কোনো তরঙ্গদৈর্ঘ্যের চেয়েও অনেক ছোট বস্তুর বিশদ দৃশ্য ধারণ করতে পারবে এটি।’ সুপারলেন্সের তাৎক্ষণিক ব্যবহারিক দিক হলো মাইক্রোস্কোপিক বা অতিক্ষুদ্র বস্তুর ছবির অতুলনীয় স্পষ্টতা। যেমন জীবিত মানুষের দেহের কোষের ভেতর, কিংবা গর্ভে থাকা শিশুর রোগ নির্ণয়ে। আবার মনে মনে এটাও ভেবে নেওয়া যায়, এর মাধ্যমে বেখাপ্পা এক্স-রে ক্রিস্টালোগ্রাফির চেয়ে অনেক গুণ ভালোভাবে ডিএনএ অণুর উপাদানের ছবি তোলা সম্ভব হবে।

বিজ্ঞানীরা এ পর্যন্ত লাল আলোর ঋণাত্মক প্রতিসরণাঙ্ক হাতেনাতে করে দেখাতে পেরেছেন। তাঁদের পরবর্তী পদক্ষেপ হতে পারে, এই প্রযুক্তি ব্যবহার করে এমন কোনো মেটাম্যাটেরিয়াল বানানো, যেটি লাল আলোকে এতই বাঁকিয়ে ফেলতে পারবে যে তা কোনো বস্তুর চারপাশে পুরোপুরি ঘুরপাক খাবে। তাতে ওই আলোতে আমাদের চোখে স্রেফ অদৃশ্য হয়ে যাবে বস্তুটি

এই ধারাবাহিকতার পাশাপাশি ভবিষ্যতে ফোটনিক ক্রিস্টাল ক্ষেত্রেও উন্নয়ন হতে পারে। ফোটনিক ক্রিস্টালের লক্ষ্য এমন চিপ বানানো, যা বিদ্যুৎ নয়, শুধু আলো ব্যবহার করে বিভিন্ন তথ্য প্রক্রিয়াজাত করবে। এতেও ন্যানো প্রযুক্তি কাজে লাগিয়ে চাকতির ওপর অতি ক্ষুদ্র উপাদান খোদাই করতে হয়। অনেকটা ভিন্ন ভিন্ন উপাদানের প্রতিসরণাঙ্ক পরিবর্তন হওয়ার মতো। বিদ্যুৎ ব্যবহৃত ট্রানজিস্টরের চেয়ে আলো ব্যবহার করা ট্রানজিস্টরের অনেক সুবিধা। যেমন ফোটনিক ক্রিস্টালের কারণে এতে খুব অল্প তাপ নষ্ট হবে। (সিলিকন চিপ এতই তাপ তৈরি করে যে তা দিয়ে একটা ডিম ভাজি করা যাবে। তাই তাদের অনবরত ঠান্ডা রাখতে হয়, নইলে অকার্যকর হয়ে যায়, যা বেশ ব্যয়বহুল।) অবাক হওয়ার কিছু নেই, মেটাম্যাটেরিয়ালের জন্য ফোটনিক ক্রিস্টাল সায়েন্স আদর্শগতভাবে বেশ উপযুক্ত। কারণ, দুটো প্রযুক্তিই ন্যানোস্কেলে আলোর প্রতিসরণাঙ্ক নিপুণভাবে কাজে লাগানোর সঙ্গে সম্পর্কিত।

প্লাজমোনিকসের মাধ্যমে অদৃশ্যতা

ঘটনা মাত্রা ছাড়িয়ে না গেলেও ২০০৭ সালের মাঝামাঝিতে বিজ্ঞানীদের আরেকটি দল মেটাম্যাটেরিয়াল তৈরির ঘোষণা দেয়। এতে তারা সম্পূর্ণ ভিন্ন প্রযুক্তি ব্যবহার করে দৃশ্যমান আলোকে বাঁকিয়ে দেয়। প্রযুক্তিটিকে বলা হচ্ছে প্লাজমোনিকস। ক্যালিফোর্নিয়া ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজির পদার্থবিদ হেনরি লেজেক, জেনিফার ডায়োন এবং হ্যারি অ্যাটওয়াটার এমন ধরনের মেটাম্যাটেরিয়াল বানানোর ঘোষণা দেন, যেটি দৃশ্যমান আলো বর্ণালির কঠিনতর নীল-সবুজ এলাকার জন্য ঋণাত্মক প্রতিসরণাঙ্ক পাওয়া যায়।

প্লাজমোনিকসের লক্ষ্য হলো আলোকে নিষ্পেষণ করা, যাতে কোনো বস্তুকে ন্যানোস্কেলে, বিশেষ করে ধাতব পদার্থের পৃষ্ঠতলে নিপুণভাবে কাজে লাগানো যায়। ধাতব পদার্থ বিদ্যুৎ পরিবহন করার কারণ হলো ধাতব পরমাণুগুলোতে ইলেকট্রন বেশ আলগাভাবে আটকে থাকে। তাই ধাতবপৃষ্ঠের ওপর দিকে মুক্তভাবে চলাচল করতে পারে তারা। বাসাবাড়িতে তারের মধ্য দিয়ে যে বিদ্যুৎ প্রবাহিত হয়, তা আসলে ধাতবপৃষ্ঠের ওপর দিয়ে আলগাভাবে আটকে থাকা ইলেকট্রনের মৃসণ গতিতে চলাফেরার কারণে ঘটছে। তবে নির্দিষ্ট কিছু অবস্থায়, আলোকরশ্মি যখন ধাতবপৃষ্ঠের সঙ্গে সংঘর্ষের মুখে পড়ে, তখন ইলেকট্রনগুলো ওই আলোর সঙ্গে একত্রে কেঁপে উঠে ধাতবপৃষ্ঠের ওপর তরঙ্গের মতো ইলেকট্রনের গতি তৈরি করে (যাকে বলা হয় প্লাজমোনস)। এই তরঙ্গের মতো গতি ওই আসল আলোকরশ্মির সঙ্গে একত্রে কম্পিত হয়। গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার হলো, এই প্লাজমোনসকে পিষে ফেলা সম্ভব, যাতে তাদের কম্পাঙ্ক ওই আলোকরশ্মির মতো একই রকম হয় (তাতে তারা যাতে একই তথ্য বহন করতে পারে), কিন্তু তরঙ্গদৈর্ঘ্য অনেক কম হয়। তাত্ত্বিকভাবে, পিষে ফেলা তরঙ্গগুলোকে ন্যানোওয়্যারে ঠেসে ভরা সম্ভব। ফটোনিক ক্রিস্টালের মতোই প্লাজমোনিকসেরও চূড়ান্ত লক্ষ্য, বিদ্যুতের বদলে আলো ব্যবহার করে গণনা করতে সক্ষম কম্পিউটার চিপ বানানো।

ক্যাল টেকের গবেষক দল মেটাম্যাটেরিয়াল বানিয়েছে দুই স্তরের সিলভারের মাঝখানে সিলিকন-নাইট্রোজেন ইনসুলেটর ব্যবহার করে (যার পুরুত্ব মাত্র ৫০ ন্যানোমিটার)। এটি কিছুটা ওয়েভগাইডের মতো কাজ করে, যা প্লাজমোনিকস ওয়েভের দিক পরিচালনা করতে পারে। এই যন্ত্রে লেজার আলো ঢোকে ও বের হয় মেটাম্যাটেরিয়ালের মধ্যে কেটে বানানো দুটি চির দিয়ে। কোণগুলো বিশ্লেষণ করে লেজার আলো মেটাম্যাটেরিয়ালের ভেতর দিয়ে অতিক্রম করার সময় বেঁকে যায়। তখন যাচাই করে দেখা যায়, এই আলো ঋণাত্মক প্রতিসরণাঙ্কে বেঁকে গেছে।

মেটাম্যাটেরিয়ালের ভবিষ্যৎ

মেটাম্যাটেরিয়ালের উন্নতি ভবিষ্যতে দ্রুতগতিতে ঘটবে সহজ একটি কারণে। কারণটি হলো এরই মধ্যে বিদ্যুতের বদলে আলোকরশ্মি ব্যবহার করা ট্রানজিস্টর তৈরিতে সবার আগ্রহ বাড়তে শুরু করেছে। ফলে সিলিকন চিপের বদলে অন্য কিছু বানানোর জন্য ফোটনিক ক্রিস্টাল ও প্লাজমোনিকস গবেষণা চলতেই থাকবে। আর এই দুটি গবেষণার পিঠে সওয়ার হয়ে সামনের দিকে এগিয়ে যাবে অদৃশ্যতা নিয়ে গবেষণাও। এরই মধ্যে সিলিকন প্রযুক্তির বদলে অন্য কোনো প্রযুক্তির খোঁজে কয়েক শ মিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ হয়েছে। বলার অপেক্ষা রাখে না, এসব গবেষণা থেকে লাভবান হবে আসলে মেটাম্যাটেরিয়াল গবেষণা।

কয়েক মাস পরপর বড় রকমের সফলতা পাওয়া যাচ্ছে ক্ষেত্রটিতে। তাই পদার্থবিদেরা কয়েক দশকের মধ্যে গবেষণাগার থেকে অদৃশ্য ঢাল বা চাদর বের করে এনে কিছু বাস্তব কাজে লাগানোর সম্ভাবনা দেখবেন, তাতে অবাক হওয়ার কিছু নেই। যেমন পরের কয়েক বছরের মধ্যে তাঁরা এমন মেটাম্যাটেরিয়াল বানানোর ব্যাপারে আত্মবিশ্বাসী, যেটি বস্তুকে দৃশ্যমান আলোর একটি কম্পাঙ্কে অন্তত দুটি মাত্রায় পুরোপুরি অদৃশ্য করে দিতে পারবে। এটি করতে অতি ক্ষুদ্র ন্যানো ইমপ্ল্যান্টগুলোকে সুষমভাবে বসানো যাবে না। তার বদলে তাদের এমন সূক্ষ্মভাবে বসাতে হবে, যাতে আলো ওই বস্তুটির চারপাশে মসৃণভাবে বেঁকে যেতে পারে।

এরপর বিজ্ঞানীদের এমন কোনো মেটাম্যাটেরিয়াল বানাতে হবে, যা আলোকে শুধু সমতল দুটি মাত্রার তলে নয়, তিনটি মাত্রায় বাঁকিয়ে দিতে পারবে। সমতল সিলিকন চাকতি বানানোর জন্য ফটোলিথোগ্রাফি উপযুক্ত পদ্ধতি। কিন্তু ত্রিমাত্রিক মেটাম্যাটেরিয়ালের জন্য চাকতিগুলোকে আরও জটিলভাবে সাজানোর প্রয়োজন পড়বে।

পরের ধাপে বিজ্ঞানীদের শুধু একটি নয়, অনেকগুলো কম্পাঙ্কের আলো বাঁকিয়ে দিতে পারা মেটাম্যাটেরিয়াল বানাতে হবে। সে জন্য যেসব সমস্যা বা বাধা রয়েছে, তার সমাধানও করতে হবে তাদের। সম্ভবত এ কাজটি তাদের জন্য সবচেয়ে কঠিন। কারণ, এখন পর্যন্ত কেবল যেকোনো একটি নির্দিষ্ট কম্পাঙ্কের আলোকে বাঁকিয়ে দিতে পারা অতি ক্ষুদ্র ইমপ্ল্যান্ট বানানো গেছে। বিজ্ঞানীরা হয়তো স্তরের ওপর ভিত্তি করে মেটাম্যাটেরিয়াল বানাতে পারবেন, যেখানে প্রতিটি স্তর একটি নির্দিষ্ট কম্পাঙ্কের আলোকে বাঁকাতে পারবে। এই সমস্যার সমাধান এখনো স্পষ্ট নয়।

যা-ই হোক, অদৃশ্য হওয়ার ঢাল বা চাদর বানানো কখনো সম্ভব হলে, সেটি বেশ ভারী একটা যন্ত্র হবে। হ্যারি পটারের অদৃশ্য হওয়ার চাদর পাতলা, নমনীয় কাপড় দিয়ে বানানো। আর এর ভেতরে কেউ ঢুকলে অদৃশ্য হয়ে যায় সে। সেটি সম্ভব করতে কাপড়টি বারবার নড়াচড়া করার জন্য এর ভেতরের প্রতিসরণাঙ্ক জটিল প্রক্রিয়ায় অনবরত পরিবর্তন করতে হবে। কিন্তু বাস্তবে সেটি করা অসম্ভব। আবার অন্তত প্রাথমিকভাবে হলেও সত্যিকারের অদৃশ্য হওয়ার চাদর বানাতে হবে কঠিন সিলিন্ডার দিয়ে। এভাবে সিলিন্ডারের ভেতরের প্রতিসরণাঙ্ক স্থির থাকবে। (এর চেয়ে আরও উন্নত সংস্করণ ক্রমান্বয়ে মেটাম্যাটেরিয়ালের সঙ্গে একীভূত করা হতে পারে। বেশ নমনীয় হবে সেটি। আবার একে ভাঁজ করা হলেও মেটাম্যাটেরিয়ালের মাধ্যমে আলোর প্রবাহকে সঠিক পথে নিয়ে যেতে পারবে। চাদরের ভেতরে থাকা কারও জন্য নড়াচড়া করা অনেক সহজ হয়ে উঠবে এই উপায়ে। )

অনেকেই অদৃশ্য ঢাল বা চাদরের একটি ত্রুটি দেখান। ত্রুটিটি হলো এর ভেতরে যে থাকবে, সে নিজে দৃশ্যমান না হয়ে বাইরের কিছু দেখতে পাবে না। মনে করুন, হ্যারি পটার তার চোখ দুটো ছাড়া পুরোপুরি অদৃশ্য হয়ে গেল। তার চোখ দুটো বাতাসে ভাসমান বলে মনে হবে। তাই অদৃশ্য চাদরের আই হোল দুটো বাইরে থেকে দেখা যাবে। হ্যারি পটার যদি পুরোপুরি অদৃশ্য হয়, তাহলে অদৃশ্য চাদরের ভেতরে অন্ধের মতো বসে থাকতে হবে তাকে। (এ সমস্যার সম্ভাব্য সমাধান হতে পারে, দুটো অতি ক্ষুদ্র কাচের প্লেট আই হোলের কাছে বসিয়ে দেওয়া। কাচের প্লেট দুটো রশ্মি বিভাজক হিসেবে কাজ করবে। মানে এটি প্লেটে আসা আলোর অতি ক্ষুদ্র অংশ ভেঙে দিয়ে ওই আলোকে চোখে পাঠাবে। এতে অদৃশ্য চাদরে ধাক্কা খাওয়া অধিকাংশ আলো তার চারপাশে প্রবাহিত হয়ে ওই মানুষটিকে অদৃশ্য করে রাখবে। তবে আলোর ক্ষুদ্র একটি অংশ গতিপথ পাল্টে চোখের দিকে যাবে।)

ভয়াবহ সব সমস্যা থাকার পরও আগামী দশকেই অদৃশ্য ঢালের মতো কিছু একটা বানাতে পারার ব্যাপারে বেশ আশাবাদী বিজ্ঞানী ও প্রকৌশলীরা।

অদৃশ্যতা ও ন্যানোটেকনোলজি

আগেই বলেছি, অদৃশ্যতা তৈরির প্রধান উপায় হয়ে উঠতে পারে ন্যানোটেকনোলজি। মানে ১ মিটারের ১০০ কোটি ভাগের ১ ভাগের মধ্যে পারমাণবিক আকারের কাঠামোকে নিপুণভাবে কাজে লাগানোর ক্ষমতার মাধ্যমে।

ন্যানোটেকনোলজির জন্ম ১৯৫৯ সালে আমেরিকান ফিজিক্যাল সোসাইটিতে নোবেলজয়ী রিচার্ড ফাইনম্যানের বিখ্যাত এক বক্তৃতার মাধ্যমে। তাঁর বক্তৃতার লঘু শিরোনাম ছিল ‘দেয়ারস প্লেন্টি অব রুম অ্যাট দ্য বটম’। পদার্থবিদ্যার সেকালে জানা সূত্রমতে, সবচেয়ে ক্ষুদ্র যন্ত্রের চেহারা কেমন হতে পারে, বক্তৃতায় তা অনুমান করেন তিনি। তিনি বুঝতে পেরেছিলেন, পারমাণবিক দূরত্বে না পৌঁছানো পর্যন্ত যন্ত্র ধীরে ধীরে ক্ষুদ্র থেকে ক্ষুদ্রতর হতে থাকবে। এরপর পরমাণুকে হয়তো ব্যবহার করা হবে যন্ত্র তৈরিতে। সবশেষে তিনি বলেন, পুলি, লিভার ও চাকার মতো পারমাণবিক যন্ত্র পদার্থবিদ্যার সূত্রের মধ্যেই তৈরি সম্ভব, যদিও সেগুলো বানানো চরম কঠিন

এরপর ন্যানো প্রযুক্তি মুখ থুবড়ে পড়ে থাকে বেশ কয়েক বছর। কারণ, পরমাণু আলাদাভাবে নিয়ন্ত্রণ করা সেকালের প্রযুক্তি দিয়ে অসম্ভব ছিল। ১৯৮১ সালে স্ক্যানিং টানেলিং মাইক্রোস্কোপ আবিষ্কৃত হলে বেশ বড় সফলতা পান পদার্থবিজ্ঞানীরা। সে কারণে পদার্থবিদ জার্ড বিননিগ ও হেইনরিখ রোহরার নোবেল পুরস্কার জেতেন সেবার। তাঁরা তখন জুরিখের আইবিএম ল্যাবে কাজ করতেন।

এরপর হঠাৎ করে রসায়ন বইয়ের মতো আলাদা আলাদা পরমাণু সারির বিস্ময়কর ছবি দেখতে সক্ষম হলেন পদার্থবিদেরা। অথচ একসময় পারমাণবিক তত্ত্বের সমালোচকেরা এটা করা অসম্ভব বলে মনে করত। কোনো ক্রিস্টাল কিংবা ধাতুর মধ্যে সারিবদ্ধ থাকা পরমাণুর চমৎকার ছবি তোলাও এখন সম্ভব। বিজ্ঞানীদের ব্যবহৃত রাসায়নিক সূত্রে একটি অণুতে একগুচ্ছ পরমাণু জটিলভাবে জড়াজড়ি করে থাকে। খালি চোখে সেগুলোও দেখা সম্ভব এখন। আবার স্ক্যানিং টানেলিং মাইক্রোস্কোপ ব্যবহার করে পরমাণুদের আলাদাভাবে নিয়ন্ত্রণ করাও সম্ভব হচ্ছে। সত্যি বলতে, IBM অক্ষরগুলো আলাদা পরমাণুর মাধ্যমে বানানো গেছে, যা বিজ্ঞানজগতে বেশ আলোড়ন তোলে। এখন ভিন্ন ভিন্ন পরমাণুকে নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব। এমনকি এদের নিয়ে ইচ্ছেমতো দেখা ও খেলা যায়। তাই বিজ্ঞানীরাও এখন আর চোখ বন্ধ করে বসে নেই।

কৌশলগতভাবে স্ক্যানিং টানেলিং মাইক্রোস্কোপ বেশ সহজ ব্যাপার। ফোনোগ্রাফের সুচ দিয়ে কোনো ডিস্ককে যেভাবে স্ক্যান করা হয়, সেই পদ্ধতির মতো এখানেও একটি ধারালো যন্ত্র ব্যবহার করা হয়। যে পদার্থটি বিশ্লেষণ করতে হবে, তার ওপর ধীরে ধীরে নেওয়া হয় ধারালো এ যন্ত্রটি। (এর ডগাটি এতই ধারালো থাকে যে, সেখানে মাত্র একটি পরমাণু থাকে।) ক্ষুদ্র এক বৈদ্যুতিক চার্জ ওই যন্ত্রে থাকে। যন্ত্রটি থেকে বৈদ্যুতিক প্রবাহ পদার্থটির ভেতর দিয়ে নিচের তলে যেতে থাকে। ক্ষুদ্র যন্ত্রটি কোনো নির্দিষ্ট পরমাণুর ওপর গেলে যন্ত্রটির বৈদ্যুতিক প্রবাহের পরিমাণ বদলে যায়। পরিবর্তনটি রেকর্ড করা হয়। পরমাণুর ওপর যন্ত্র যাওয়ার সময়ে বিদ্যুতের প্রবাহ ওপরে ওঠে এবং পরে নিচে নামে। তাতে পরমাণুটির রূপরেখা বেশ ভালোভাবে শনাক্ত করা যায়। যন্ত্রটিকে অনেকবার ভিন্ন ভিন্ন পরমাণুর ওপর নিয়ে গিয়ে বিদ্যুতের ওঠানামা করিয়ে অনেকগুলো নির্দিষ্ট পরমাণুর চমৎকার একটি চিত্রের গঠন তৈরি করা যায়।

(কোয়ান্টাম মেকানিকসের একটি অদ্ভুত সূত্রের কারণে স্ক্যানিং টানেলিং মাইক্রোস্কোপ বানানো সম্ভব হয়েছে। সাধারণত ওই ক্ষুদ্র যন্ত্র থেকে নিচের পৃষ্ঠে ওই পদার্থের মধ্যে স্থানান্তর করার মতো যথেষ্ট শক্তি ইলেকট্রনের নেই। কিন্তু অনিশ্চয়তার নীতির কারণে সামান্য একটি সম্ভাবনা থাকে যে বিদ্যুৎপ্রবাহের মধ্যে ইলেকট্রনগুলো সুড়ঙ্গ পথে বা বাধা অতিক্রম করে ঢুকে যাবে। অবশ্য নিউনোনিয়ান তত্ত্বে নিষিদ্ধ হলেও ঠিক এটিই ঘটে। এতে ক্ষুদ্র যন্ত্রটির মধ্য দিয়ে যে বিদ্যুৎ প্রবাহিত হয়, তা ওই পদার্থের মধ্যে স্পর্শকাতর হয়ে অতি ক্ষুদ্র কোয়ান্টাম প্রভাব তৈরি করে। কোয়ান্টাম তত্ত্বের এই প্রভাব সম্পর্কে পরে আরও বিস্তারিত আলোচনা করা হবে।)

ভিন্ন ভিন্ন পরমাণু নড়াচড়ার করে পরমাণুগুলো থেকে সহজ কোনো যন্ত্ৰ তৈরির বেলাতেও ক্ষুদ্র যন্ত্রটি বেশ স্পর্শকাতর। এই প্রযুক্তি এখন এতই উন্নত হয়েছে যে, একগুচ্ছ পরমাণুকে কম্পিউটারের পর্দায় দেখানো যায়। তারপর শুধু কম্পিউটারের কারসর নাড়িয়ে যেদিকে খুশি আনা যায় পরমাণুদের। এভাবে অসংখ্য পরমাণু লেগো ব্লক খেলার মতো করে নিপুণভাবে নিয়ন্ত্রণ করা যায়। পাশাপাশি বর্ণমালার বিভিন্ন অক্ষর বানানো যায় আলাদা পরমাণু ব্যবহার করে। এমনকি চাইলে বানানো যাবে পারমাণবিক কোনো খেলনা। যেমন আলাদা পরমাণু দিয়ে অ্যাবাকাসও বানানো যাবে। পরমাণুগুলো পৃষ্ঠতলের ওপর উলম্ব স্লটে সাজানো থাকে। ইচ্ছে করলে উলম্ব স্লটগুলোর ভেতরে কার্বন বাকিবল ঢোকানো যাবে (বাকিবল দেখতে ফুটবলের মতো, তবে আলাদা কার্বন পরমাণু দিয়ে তৈরি)। কার্বনের এ বল এরপর প্রতিটি স্লটে ওপর ও নিচে নাড়ানো যাবে। এভাবে একটি পারমাণবিক অ্যাবাকাস বানানো যায়।

আবার ইলেকট্রন বিম ব্যবহার করে পারমাণবিক যন্ত্রে খোদাই করাও সম্ভব। যেমন কর্নেল বিশ্ববিদ্যালয়ের বিজ্ঞানীরা বিশ্বের সবচেয়ে ছোট্ট আকারের গিটার বানিয়েছেন। এটি মানুষের চুলের চেয়ে ২০ শতাংশ ছোট। সিলিকন স্ফটিক দিয়ে খোদাই করা হয়েছে গিটারটি। এর ছয়টি তারের প্রতিটির পুরুত্ব ১০০ পরমাণু। পারমাণবিক বলের মাইক্রোস্কোপ ব্যবহার করে তারগুলোকে বাজানোও যায়। (গিটারটি সুরও বাজাতে পারে। তবে এই সুর যে ফ্রিকোয়েন্সি বা কম্পাঙ্কে বাজে, তা মানুষের শ্রবণশক্তির সীমার ওপরে।)

বর্তমানের ন্যানোটেক দিয়ে বানানো অধিকাংশ যন্ত্রই নিছক খেলনা ছাড়া আর কিছু নয়। গিয়ার, বল বিয়ারিংসহ এর চেয়ে জটিল যন্ত্র এখনো বানানো হয়নি। তবে আত্মবিশ্বাসী অনেক প্রকৌশলীর ধারণা, এমন সময় আসবে যখন আমরা প্রকৃত অর্থেই পারমাণবিক যন্ত্র বানাতে পারব। (প্রকৃতিতে অবশ্য পারমাণবিক যন্ত্র পাওয়া যায়। কোষ পানিতে মুক্তভাবে ভেসে থাকতে পারে। কারণ, তারা অতি ক্ষুদ্র লোম আন্দোলিত করতে পারে। এই লোম ও কোষের মধ্যকার সংযোগ পরীক্ষা করলে দেখা যায়, এটা এমন এক পারমাণবিক যন্ত্র, যা লোমগুলোকে সব দিকে চলাফেরা করতে দেয়। তাই ন্যানো প্রযুক্তির উন্নয়নের একটি উপায় হলো প্রকৃতিকে অনুকরণ করা। কারণ, প্রকৃতি কয়েক কোটি বছর আগেই দক্ষতার সঙ্গে অ্যাটমিক মেশিন বা পারমাণবিক যন্ত্র বানানোর কৌশল রপ্ত করেছে।)

হলোগ্রাম ও অদৃশ্যতা

কেউ অদৃশ্য হতে চাইলে আরেকটি উপায় আছে। প্রথমে তার পেছনের দৃশ্যপটের ছবি তুলতে হবে। এরপর পেছনের দৃশ্যপটের ছবিটি সরাসরি তার গায়ের পোশাকের ওপর কিংবা সামনে থাকা কোনো পর্দার ওপর ফেলতে হবে। এতে সামনে থেকে দেখে মনে হবে, লোকটি যেন স্বচ্ছ হয়ে গেছে। সে কারণে লোকটির গায়ের ভেতর দিয়ে অন্য পাশে চলে গেছে আলোকরশ্মি।

জাপানের টোকিও বিশ্ববিদ্যালয়ের তাচি ল্যাবরেটরির নাওকি কাওয়াকামি গবেষণা করছেন অদৃশ্য হওয়ার এ পদ্ধতি নিয়ে। পদ্ধতিটিকে বলা হচ্ছে অপটিক্যাল ক্যামোফ্লেজ। তিনি বলেন, ‘এটা ব্যবহার করে পাইলটরা ককপিটের মেঝে দিয়ে নিচের রানওয়ে দেখতে পাবেন কিংবা গাড়ির চালকেরা গাড়ি পার্ক করতে বাইরের কাঠামোর মধ্য দিয়ে জায়গা দেখার চেষ্টা করতে পারবেন। কাওয়াকামির চাদর অতি ক্ষুদ্র আলো প্রতিফলক পুঁতি দিয়ে আচ্ছাদিত, যা কাজ করে একদম চলচ্চিত্রের পর্দার মতো। একটি ভিডিও ক্যামেরা চাদরের পেছনের দৃশ্য ধারণ করে। ভিডিও প্রজেক্টরের মাধ্যমে ওই চাদরের ওপর ধারণকৃত ইমেজ ফেললে মনে হয় যেন ওই লোকটিকে ভেদ করে আলো চলে গেছে।

অপটিক্যাল ক্যামোফ্লেজ চাদরের প্রোটোটাইপ আসলে এখনো গবেষণাগারের গণ্ডিতেই রয়ে গেছে। সিনেমা পর্দার মতো এই চাদর পরে থাকা কোনো ব্যক্তির দিকে সরাসরি তাকালে, দেখে মনে হবে স্রেফ অদৃশ্য হয়ে গেছেন ওই ব্যক্তি। কারণ, তখন লোকটির পেছনের দৃশ্যই শুধু দেখতে পাওয়া যাবে। কিন্তু আপনার চোখজোড়া নড়াচড়া করলেও চাদরের ওপরের দৃশ্যের কোনো হেরফের হবে না। এটি দেখে মুহূর্তেই বুঝে ফেলা যাবে, ওটা আসলে মেকি। কাজেই ত্রিমাত্রিক ছবির বিভ্রান্তি তৈরি করতে হলে আরও বাস্তবসম্মত অপটিক্যাল ক্যামোফ্লেজের প্রয়োজন। আর সে জন্য প্রয়োজন হলোগ্রাম।

হলোগ্রাম হলো লেজার দিয়ে নির্মিত থ্রিডি বা ত্রিমাত্রিক ছবি ( স্টার ওয়ারস-এ প্রিন্সেস লিয়ার থ্রিডি ইমেজের মতো)। কোনো ব্যক্তিকে অদৃশ্য করা যাবে যদি বিশেষ হলোগ্রাম ক্যামেরা দিয়ে পেছনের দৃশ্যপটের ছবি তোলা হয়। এই হলোগ্রাফিক ছবি এরপর ফেলতে হবে ওই ব্যক্তির সামনে বিশেষ হলোগ্রাফিক পর্দায়। তাহলে তার সামনে দাঁড়ানো কেউ হলোগ্রাফিক দৃশ্যগুলো দেখতে পাবে। সেখানে শুধু তার পেছনের দৃশ্যপট দেখা যাবে, লোকটিকে দেখা যাবে না। ফলে মনে হবে লোকটি অদৃশ্য হয়ে গেছে। ওই ব্যক্তির জায়গায় নিখুঁতভাবে পেছনের দৃশ্যপটের থ্রিডি ইমেজ দেখা যাবে। এখন চোখ নাড়ালেও ধরতে পারবেন না যে আপনি মেকি কিছু দেখছেন।

এসব থ্রিডি ইমেজ তৈরি করা সম্ভব, কারণ, লেজার লাইট পরস্পরের সঙ্গে সংযুক্ত থাকে। লেজার আলোর সব কটি তরঙ্গ একটি সুষম একতায় কম্পিত হয়। হলোগ্রাম এ রকম পরস্পর সংযুক্ত লেজার বিমকে দুই ভাগে বিভক্ত করে তৈরি করা হয়। এ বিমের অর্ধেক ফটোগ্রাফিক ফিল্মের ওপর দ্যুতি ছড়ায়। আর অন্য অর্ধাংশ একটি বস্তুকে আলোকিত করে, ঠিকরে ওঠে, তারপর ওই একই ফটোগ্রাফিক ফিল্মের ওপর দ্যুতি ছড়ায়। ফিল্মের ওপর এই দুই বিমের ব্যতিচার ঘটালে একটি ব্যতিচার প্যাটার্ন তৈরি হয়, যা আসল থ্রিডি তরঙ্গের সব তথ্য এনকোড করে। এ ফিল্ম ডেভেলপ করা হলে তা দেখতে মাকড়সার জালের মতো তালগোল পাকানো জটিল রেখার মতো দেখায়। কিন্তু ফিল্মটির ওপর লেজার বিমের দ্যুতি ফেলা হলে হঠাৎ ম্যাজিকের মতো আসল বস্তুর রেপ্লিকা দেখা যায়।

হলোগ্রাফিক অদৃশ্যতার প্রযুক্তিগত সমস্যাগুলো ভয়াবহ। এর একটি চ্যালেঞ্জ হলো, প্রতি সেকেন্ডে ৩০টি ফ্রেম নিতে সক্ষম কোনো হলোগ্রাফিক ক্যামেরা বানানো। আরেকটি সমস্যা হলো, সবগুলো তথ্য সংরক্ষণ ও প্রক্রিয়াজত করা। সর্বশেষটি হলো, ইমেজকে একটি পর্দায় প্রক্ষেপ করা, যাতে ইমেজটি দেখতে বাস্তবসম্মত বলে মনে হয়।

চতুর্থ মাত্রার মাধ্যমে অদৃশ্যতা

অদৃশ্য হওয়ার ক্ষেত্রে এর চেয়েও নিখুঁত উপায়টির কথাও এখানে বলা উচিত। এ উপায়ের কথা বলেছিলেন এইচ জি ওয়েলস তাঁর দ্য ইনভিজিবল ম্যান উপন্যাসে। সেটি করা হয়েছিল চতুর্থ মাত্রার শক্তি কাজে লাগিয়ে। (এই বইয়ে পরে আমি উচ্চতর মাত্রার অস্তিত্ব নিয়ে আরও বিশদ আলোচনা করব।)

আমরা কি আমাদের ত্রিমাত্রিক মহাবিশ্ব ছেড়ে কোনো চতুর্থ মাত্রার সুবিধাজনক দিক থেকে এর ওপর ঝুলে আছি? ত্রিমাত্রিক প্রজাপতি যেভাবে দ্বিমাত্রিক কাগজের পাতার ওপর ঝুলে থাকে, অনেকটা সে রকম। তাহলে মহাবিশ্বে আমাদের নিচে যারা আছে, তাদের কাছ থেকে আমরা অদৃশ্য রয়ে যাব। এ ধারণাটির সমস্যা হলো, উচ্চতর কোনো মাত্রার অস্তিত্ব থাকার কোনো প্রমাণ এখনো পাওয়া যায়নি। আবার তাত্ত্বিকভাবে উচ্চতর মাত্রায় ভ্রমণের জন্য এমন শক্তির প্রয়োজন, যা আমাদের প্রচলিত প্রযুক্তির পক্ষে অর্জন করা সম্ভব নয়। কাজেই টেকসই অদৃশ্যতা অর্জনের উপায় হিসেবে এ পদ্ধতি এখনো আমাদের জ্ঞান ও ক্ষমতার বাইরে। অনেক প্রচেষ্টায় অদৃশ্য হওয়ার উপায় অর্জনের পথে আমরা এত দূর এগিয়ে এসেছি। সে কারণে স্পষ্টতই এটি প্রথম শ্রেণির অসম্ভাব্যতার মধ্যে পড়ে। বলা বাহুল্য, পরবর্তী কয়েক দশকে কিংবা অন্তত এই শতাব্দীতে একধরনের অদৃশ্যতা হয়তো আমাদের কাছে একদম সাধারণ ব্যাপার হয়ে দাঁড়াবে।

তথ্যনির্দেশ

মার্কিন গৃহযুদ্ধ : যুক্তরাষ্ট্রে ১৮৬১ থেকে ১৮৬৫ সালে সংঘটিত উত্তর ও দক্ষিণ অঙ্গরাজ্যগুলোর মধ্যকার যুক্ত আমেরিকান গৃহযুদ্ধ নামে পরিচিত। কৃষ্ণদের দাস হিসেবে রাখা হবে কি না, বহুদিন ধরে চলমান সেই বিতর্কের জেরে এ গৃহযুদ্ধ শুরু হয়। আব্রাহাম লিংকন মার্কিন প্রেসিডেন্ট হিসেবে ক্ষমতায় আসার কিছুদিন পরই এই যুদ্ধ শুরু হয়েছিল।

আপেক্ষিক তত্ত্ব : আইনস্টাইনের একটি তত্ত্ব। ১৯০৫ সালে এক গবেষণাপত্রে তত্ত্বটি প্রকাশ করেন তিনি। বিজ্ঞানের নিয়মকানুন সব পর্যবেক্ষকের জন্যই একই হবে, তাদের গতিশীলতার ওপর এই নিয়মকানুন নির্ভরশীল নয়—এ ধারণার ওপর ভিত্তি করে তত্ত্বটি গড়ে উঠেছে। চতুর্থমাত্রিক স্থান-কালের বক্রতার ভিত্তিতে এটি মহাকর্ষ ব্যাখ্যা করে।

ডিএনএ : ডিঅক্সিরাইবোনিউক্লিক অ্যাসিড, যা ফসফেট, একটি শর্করা ও চারটি ক্ষার (অ্যাডেনিন, গুয়ানিন, থায়ামিন ও সাইটোসিন) নিয়ে গঠিত। ডিএনএর দুটি সূত্রক একটি ডাবল হেলিক্স কাঠামো গঠন করে, যা প্যাচানো সিঁড়ির মতো। কোষের সব তথ্য ডিএনএতে লিপিবদ্ধ থাকে। এ তথ্যের মাধ্যমে তারা নিজেদের প্রতিলিপি তৈরি করতে পারে। এটি বংশগতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে।

মুরের সূত্র : এ সূত্রমতে, প্রতি আঠারো মাসে কম্পিউটারের ক্ষমতা আগের তুলনায় দ্বিগুণ হয়ে যাবে। কিন্তু এ ঘটনা অনির্দিষ্টকালের জন্য চলতে পারে না।

ডপলার প্রভাব : শব্দতরঙ্গ বা আলোকতরঙ্গের উৎস যদি কোনো পর্যবেক্ষকের সাপেক্ষে চলমান হয় তাহলে ওই তরঙ্গের কম্পাঙ্ক ও তরঙ্গদৈর্ঘ্যের বিচ্যুতি ঘটে। এই প্রভাব ব্যবহার করে মহাবিশ্ব যে প্রসারিত হচ্ছে, তার প্রমাণ পাওয়া গিয়েছিল।

বৈদ্যুতিক আধান বা চার্জ : এ ধর্মের কারণে একটি কণা একই ধর্মের বা বিপরীত ধর্মের অন্য কণাকে বিকর্ষণ বা আকর্ষণ করে।

তরঙ্গদৈর্ঘ্য : একটি তরঙ্গের ক্ষেত্রে তার দুটি পাশাপাশি শীর্ষবিন্দু বা দুটি নিম্নবিন্দুর মধ্যবর্তী দূরত্ব।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *