২. অতীতের ডি-এল-ও আজকের আর-এল-ও

অতীতের ডি-এল-ও আজকের আর-এল-ও সত্যি এক বিচিত্র অফিস। হাজার-হাজার লাখ-লাখ চিঠিপত্র-পার্শেল-প্যাকেটের ঠিকানা উদ্ধার করতে না পারায় পোস্ট অফিস থেকে পাঠিয়ে দেওয়া হয় এই দপ্তরে।…রাম লখন সিং, ৫২ লরী, ক্লীব ইসষ্ট্রিট, কলকাতা। হিন্দীতে লেখা এই ঠিকানা দেখে পোস্ট অফিসের সর্টাররা কোন কিছু বুঝতে না পারলেও আর-এল-ও অফিসে নতুন করে ঠিকানা লিখে দেওয়া হয়-রাম লখন সিং, বামার লরী, ক্লাইভ স্ট্রিট ( নেতাজী সুভাষ রোড ), কলকাতা।

ক্রশ স্ট্রীটের ঠিকানার বহু চিঠিতেই লেখা থাকে -X স্ট্রীট। অথবা অনেক ছেলেছোকরার দল বন্ধুবান্ধবকে শুধু নম্বর দিয়ে ঠিকানা লিখে পাঠায়–

নাম-4, 1, 21, 4/20, 15, 16, 14, 15
      গ্রাম–2, 1, 18, 11, 21, 1, 1, 15, 10, 15,
        পোঃ- 19, 1, 21, 18, 4।
        উড়িষ্যা।

আর-এল-ও অফিস চোখের নিমেষে ঠিকানাটি করে লিখে দেয়–

DAUD TONPO
        Vill–BARKULA GOJO
        P.O.–SARDA
        Dist-SUNDARGARH ( ORISSA)

কোন কোন চিঠিতে আবার লেখা থাকে -চাকাই ব্রিস্ট। আর এল-ও লিখে দেয় –চক্র বেড়িয়া… গ্রামগঞ্জ থেকে একটু ইংরেজী জানা অনেকেই লেখে ছাম মার্কেট স্ট্রীট। আসলে ওটা শ্যামবাজার স্ট্রীট।

নানা রকমে গাইড আর কর্মীদের তীব্র সাধারণ জ্ঞানের দ্বারাই অধিকাংশ পথভ্রষ্ট চিঠিপত্তব সঠিক জায়গায় পৌঁছে যায়। তবে সব সময় কখনই নয়।

এই আর-এল-ও অফিস নিয়ে শৈলেনদার সঙ্গে গল্প করতে আমার খুব ভাল লাগে। লাগবে না কেন? আমরা জানি, পোষ্ট কার্ড–ইনল্যাণ্ড খামে চিঠি লিখে আমরা ডাকবাক্সে ফেলি। তারপর? দুদিন আগে বা পরে সে চিঠি পৌঁছে যায় সঠিক ঠিকানায়। প্রয়োজনে উত্তর এসে যায় যথা সময়ে। কার কোন চিঠি হারিয়ে গেল তা নিয়ে আমাদের মাথাব্যথা কী?

আমাদের মাথাব্যথা না থাকলেও আর-এল-ও অফিসের মানুষদের মাথাব্যথা আছে বৈকি। তা না হলে শক্তি চৌধুরী কী মার অপারেশনের আগে পৌঁছতে পারতেন? যদি ঠিকানা উদ্ধার করতে না পারেন, তাহলে আপনারা কী করেন? আমি শৈলেনদাকে প্রশ্ন করি।

প্রয়োজনে আমরা চিঠি খুলি পড়ি। যদি ঐ চিঠি পড়ে ঠিকানা উদ্ধার করা সম্ভব হয়, তাহলে তো ভালই কিন্তু যদি তা না হয়, তাহলে যিনি চিঠি লিখেছেন, তাকেই ফেরৎ পাঠিয়ে দিই।

যদি তার ঠিকানা থাকে, তবেই তো?

সে তো একশবার।

তার মানে অনেক মানুষের অনেক চিঠিও আপনানের পড়তে হয়?

তা হয় বৈকি!

কথাটা বলেই শৈলেনদা একটু আনমনা হয়ে গেলেন। দূরের আকাশের কত অসংখ্য ছোট-বড় খ্যাত-অখ্যাত তারকা দেখে একটা চাপা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন, যারা আমাকে চেনে না, জানে না, জীবনে কোনদিন দেখেনি ও দেখবে না, তাদের কতজনেরই কত কি জানলাম!

…স্নেহের খোকা, আমি জানি এই চিঠি পেয়ে তুই অবাক হয়ে যাবি। কোনদিন কাউকে চিঠিপত্র লিখি না, দরকারও হয় না। যার বাপের বাড়ি, শ্বশুর বাড়ি পাশাপাশি গ্রামে, যার ভাইবোনের। পর্যন্ত আশেপাশের গ্রামেই থাকে, সে কাকে চিঠি লিখবে? এর আগে কবে কাকে চিঠি লিখেছি, তা মনেও পড়েনা। তবু তোকে চিঠিলিখছি। লিখতে বাধ্য হচ্ছি। না লিখে উপায় নেই। বেশ কিছুদিন ধরেই ভাবছি তোকে চিঠি লিখব কিন্তু নানা কারণে তা সম্ভব হয়নি। সারা দিনরাত্তির সংসারের হাজার কাজ নিয়ে এত ব্যস্ত থাকি যে সত্যি সময় পাই না! তাছাড়া তোর অফিসের নাম-ধাম-ঠিকানা কিছুই জানা ছিল না। সবাইকে বলতেও পারি না। শেষ পর্যন্ত অনেক কষ্ট করে তোর অফিসের নাম জেনে এই চিঠি লিখছি। আশা করি দুএকদিন দেরী হলেও এ চিঠি তোর হাতে পৌঁছবে।

আজ তিন বছর তুই দেশ ছাড়া। এর মধ্যে একদিনের জন্যও দেশে আসিসনি। কোনদিন আসবি কিনা তাও জানি না। মাঝে মাঝে মনে হয়, তুই জীবনে এদিকে না এলেই ভাল হয় কিন্তু তোকে আর দেখতে পাব না ভাবলেও আমার মাথা ঘুরে যায়, চোখে জল আসে। তোকে একবার দেখার জন্য মন বড়ই আকুলি-বিকুলি করে কিন্তু তা কী করে সম্ভব? কে আমাকে নিয়ে যাবে? বা যেতে দেবে? আমি যে দাসী, কপর্দক শূন্য। সর্বোপরি আমি যে বাল্যবিধবা। এ সংসারে যার স্বামী-পুত্র নেই, অর্থ নেই, যাকে শ্বশুর-ভাসুরের দাসীবৃত্তি করে এক টুকরো কাপড় আর দুমুঠো অন্নের সংস্থান করতে হয় তার আবার ব্যক্তিগত ইচ্ছা।

এইত কদিন আগেকার কথা। হঠাৎ শ্বশুরমশাই আমাকে বললেন, হ্যাঁগো ছোট বৌমা, তোমার একটা গরদের কাপড় আছে না?

হ্যাঁ, খোকা মাস্টারী করে আমাকে যে গরদের কাপড়টা দিয়েছিল…

আছে কিনা তাই বল। খোকা-খুকীর কথা তো আমি জানতে চাইনি।

বারান্দায় বসে পান-দোক্তা চিবুতে চিবুতে শাশুড়ী-ঠাকরুণ বাঁকা চোখে একবার ছোট বৌকে দেখে নিয়ে স্বামীকে বললেন, আঃ! তুমি চটছ কেন? খোকা ছাড়া ছোট বউয়ের আপনজন কে আছে?

এবার উনি একটা চাপা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন, যার জন্য আমরা গ্রামে মুখ দেখাতে পারি না, সেই খোকার কথা আমাদের শুনতেই হবে।

শ্বশুরমশাই গিন্নীর কথার কোন জবাব না দিয়ে শুধু বললেন, তুমি তো ঐ কাপড়টা ব্যবহার কর না। তাই বলছিলাম, এবার থেকে ঐ কাপড়টা পরে আমি নারায়ণ পূজা করবো।

যক্ষের ধনের মত আমি ঐ কাপড়টা রোজ রাত্তিরে একবার বুকের মধ্যে জড়িয়ে ধরে মনে করতাম, তোকেই যেন জড়িয়ে ধরেছি। যাই হোক কাপড়টা দেবার পর আমি আর কিছুতেই চোখের জল আট কাতে পারলাম না। ব্যস! ঐ চোখের জল দেখেই শাশুড়ী দপ করে জ্বলে উঠলেন, ওরে বাপু গ্রামের লোক এমনি এমনি বদনাম দেয় না। নিজের পেটের ছেলে না হলে এত দরদ আসে কোথা থেকে।

খোকা, সত্যি বলছি ঐ কয়েক ফেঁটা চোখের জল ফেলার জন্য আমাকে যে কি অপমান সহ্য করতে হয়েছিল, তা শুধু ভগবানই জানেন। মনের দুঃখে আমি পুরো দুটো দিন মুখে একটা দানা পর্যন্ত দিইনি, দিতে প্রবৃত্তি হয়নি। পরে মেজ পিসী আমাকে টেনে নিয়ে জোর করে খাইয়ে দিয়ে বলল, ওরে হতভাগী, না খেয়ে থাকবি কোন্ দুঃখে রে? এ বাড়ির জমিজমায় কী তোর স্বামীর ভাগ ছিল না? দশটা না, পাঁচটা না, তোর একটা পেটের খাবারও কী সে ভাগ থেকে হয় না?

ঐ মেজ পিসীর জন্য আমি এখনও বেঁচে আছি কিন্তু আজ তোকে আমি জানতে বাধ্য হচ্ছি, মেজ ভাসুরের যা মতিগতি তাতে আমি কতদিন বেঁচে থাকতে পারব, তা ঠিক বলতে পারি না। তোকে আমি পেটে ধরিনি ঠিকই কিন্তু তোর মা তোর জন্মের পর পরই ধনুষ্টঙ্কারে মারা যাবার পর তাকে কোলে তুলে নিয়েই আমি সদ্য বৈধব্যের যন্ত্রণ। ভুলেছিলাম। এ বিশ্ব-সংসারে তুই-ই আমার একমাত্র আপনজন। শুধু তোর কাছেই আমার সব দুঃখের কথা বলতে পারি বলেই জানাচ্ছি, মেজ ভাসুর বিপত্নীক হবার পর থেকেই আমার সম্পর্কে বড় বেশি আগ্রহী হয়ে উঠেছেন কিন্তু ওর ঐ অহেতুক আগ্রহ দেখে আমার ভীষণ ভয় হয়। হাজার হোক তুই আমার প্রাণপ্রিয় সন্তান। তাছাড়া তুই বড় হয়েছিস। তোকে বেশি কি আর লিখব। শুধু জেনে রাখ, আমি জীবনে কোন অন্যায় করিনি এবং করব না। আমার পরম শ্রদ্ধেয় মেজ ভাসুর মশাই যদি সম্মান ও সৌজন্যের সীমা লঙ্ঘন করেন, তাহলে আমি তা নীরবে মেনে নিতে পারব না। শুধু এইটুকু জেনে রাখ, তোর মা কোন কলঙ্ক নিয়ে এ পৃথিবীতে একদিনের জন্য ও বাঁচবে না।…

শৈলেনদা অনেকক্ষণ চুপ করে থাকার পর বললেন, চিঠিটা পড়ে মাথা ঘুরে গেল কিন্তু কিভাবে ঐ ভদ্রমহিলার খোকার কাছে চিঠিটা পৌঁছে দেবার ব্যবস্থা করব, তা ভেবে পেলাম না।

কেন? ঠিকানা ছিল না?

ঠিকানা ঠিক থাকলে কী চিঠি আমাদের কাছে আসে? মনে মনে বলি, তাইত।

উনি একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন, তবুও আমরা অনেকে মিলে অনেক চেষ্টা করেও ওকে চিঠিটা পোঁছে দিতে পারলাম না।

চিঠিটা কী ফেরত পাঠালেন?

না, সে ঠিকানাও চিঠিতে ছিল না। চিঠিটা জিয়াগঞ্জে পোস্ট করা হয়েছিল কিন্তু আর কিছু জানা গেল না।

আমি চুপ করে থাকি কিন্তু চোখের সামনে এক অসহায় বিধবার বেদনার্ত মুখের ছবি ফুটে ওঠে।

অনেকক্ষণ চুপ করে থাকার পর শৈলেনদা বললেন, দশ-পনর দিন পর হঠাৎ খবরের কাগজে দেখি, জিয়াগঞ্জের কাছেই গঙ্গার জলে এক মধ্যবয়সী বিধবার মৃতদেহ পাওয়া গেছে।

যা আশঙ্কা ছিল, তাই সত্যে পরিণত হল। হিংস্র দানবের লালসার শিকার হল আরও একটি বিধবা কিন্তু তাতে সমাজ-সংসারের কি আসে-যায়?

জানো বাচ্চু, ঐ ভদ্রমহিলার সঙ্গে আমাদের কোন সম্পর্ক না থাকলেও খবরের কাগজে ঐ রিপোর্ট পড়ার পর আমরা যেন পরমাত্মীয় বিয়োগের ব্যথা অনুভব করেছিলাম।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *