পাঁচদিন পর ফজল খবর পায় প্রতিপক্ষ ঘর পোড়ানোর এজাহার দিতে পারেনি, কারণ তাদের মিথ্যা কারসাজি বড় দারোগার জেরার চোটে ধরা পড়ে গিয়েছিল।
গত কয়েকদিন বড় উদ্বেগ ও উৎকণ্ঠার মধ্যে কাটিয়েছে ফজল ও তার দলের লোকজন। মস্ত বড় একটা বিপদ কেটে যাওয়ায় তারা স্বস্তির নিশ্বাস ফেলে, আনন্দে উল্লসিত হয়। কারো মুখে গালাগালির তুবড়ি ছোটে জঙ্গুরুল্লার উদ্দেশে। দিঘিরপাড় ছিল ফজলের চিত্তবিনোদনের একমাত্র স্থান। সেখানে দেখা হতো তার খেলার সাথী আর স্কুলের বন্ধুদের সাথে, পেত নানা ঘটনার, বিভিন্ন জন-স্বজনের খবরাখবর। বন্ধু-বান্ধবদের সাথে গল্প গুজব করে মনটাকে তাজা করে, হাট-সওদা নিয়ে সে বাড়ি ফিরত। অন্যদিন না হলেও হাটের দিন সেখানে না গিয়ে সে থাকতে পারত না। অথচ গত আট-নয় মাসের মধ্যে সে একদিনও সেখানে যায় নি, যাওয়ার সুযোগ পায়নি।
বিপদ কেটে যাওয়ার পর থেকেই তার মনটা ছটফট করতে থাকে দিঘিরপাড় যাওয়ার জন্য। কিন্তু জঙ্গুরুল্লার দল কখন যে হামলা করে, ঠিক নেই কিছু।
দুদিন পরে দিঘিরপাড়ের হাট। এ দুদিনের ভেতর জঙ্গুরুল্লার সম্ভাব্য হামলার সংবাদ সংগ্রহ করতেই হবে তাকে।
সংবাদ পেয়েও যায় ফজল। প্রতিপক্ষের প্রস্তুতির কোনো আলামত পাওয়া যায়নি। সে আরো খবর পায়, চালের দর বেড়ে যাওয়ায় চরের গরিব চাষীদের মধ্যে হাহাকার পড়ে গেছে। তারা সাহায্যের জন্য যাচ্ছে জঙ্গুরুল্লার কাছে। সাহায্য করার নামে জঙ্গুরুল্লা তাদের দাদন দিচ্ছে। আমন ধান উঠলেই পাঁচ টাকা মন দরে তাকে ধান দিতে হবে দাদনের বিনিময়ে।
.
আজ দিঘিরপাড়ের হাট। প্রয়োজনীয় সওদাপাতির ফর্দ তৈরি করে চান্দু ও বক্করকে ডেকে নিয়ে সে ডিঙিতে উঠে।
চান্দু পাছায় আর বক্কর গলুইয়ে বসে বৈঠা টানছে।
এই চান্দু, আমার হাতে বৈঠা দে। ফজল বলে। অনেকদিন নৌকা বাইনা। মাঝে মইদ্যে না বাইলে নৌকা বাওয়া ভুইল্যা যাইমু।
এইখান দিয়াতো উজান। এট্টু পরেই ভাটির জাগায় গিয়া আপনের আতে–।
আরে না, তুই এখনি দে। ভাটি পানিতে তো বেশি টনতে অয় না। হাইল ধইরা বইস্যা থাকলেই অয়।
চান্দুর হাত থেকে বৈঠা নিয়ে জোরে জোরে টানতে থাকে ফজল।
কিছুদূর গিয়েই সে বাঁ দিকের খাড়িতে ঢুকিয়ে দেয় ডিঙিটা।
ঐ দিগে যান কই? চান্দু বলে। ঐডা দিয়া গেলে তো বহুত ঘোরন লাগব। দাত্রার খড়ি দিয়া যান।
একটু ঘুইর্যাই যাই। নলতার খাড়িতে শুনছি কুমির আছে। খাঁড়ির পশ্চিম দিগের চরে দুইডা কুমির বোলে রউদ পোয়াইতে আছিল।
আমরা তো কোনো দিন হুনি নাই। বক্করের কথার ভেতর ঘোলাটে সন্দেহ।
আরে সব খবর কি সবার কানে আসে। তোরা পশ্চিম দিগের চরটার দিগে চউখ রাখিস।
এহন তো শীতকাল না। আর রউদের তেজও খুব। কুমির কি এহন এই ঠান্ডা রউদে বইয়া রইছে?
তবুও চউখ রাখিস তোরা। দ্যাখ্যা যাইতেও পারে। যদি দ্যাখ্যা যায় রে! দ্যাখা গেলে কি করমু জানস?
কি করবেন? চান্দু জিজ্ঞেস করে।
ফান্দে আটকাইমু। কুমিরের ফান্দা ক্যামনে পাতে, তোরা দ্যাখছস কোনো দিন?
উঁহু দেহি নাই।
যেইখান দিয়া কুমির রউদ পোয়াইতে উপরে ওডে, সেইখানে তিন কাঁটাওলা বড় বড় অনেকগুলা গ্যারাফি বড়শি শন সুতার মোটা দড়িতে বাইন্দা লাইন কইর্যা পাততে অয়। দড়িগুলারে মাটির তল দিয়া দূরে উপরের দিগে নিয়া শক্ত খুঁড়ার লগে বাইন্দা রাখতে অয়। তারপর যখন কুমির রউদ পোয়াইতে চরের উপরে ওড়ে, তখন উলটাদিক তন দাবড় দিলে কুমির হরহর কইর্যা বড়শির উপর দিয়া দৌড় মারে পানির দিগে। ব্যস কুমিরের ঠ্যাঙ্গে, প্যাডে বড়শি গাইথ্যা যায়। আমি কুট্টিকালে দেখছি, বাজান একবার ফান্দা পাতছিল। একটা বড় আর একটা বাচ্চা কুমির বড়শিতে গাঁথছিল। বড়ডার ঠ্যাংঙ্গে আর ছোড্ডার প্যাডে।
চান্দু ও বক্করের চোখ যখন পশ্চিম দিকের বালুচর, লটাবন, আর কাশবনে কুমিরের সন্ধানে ব্যস্ত তখন ফজলের চোখ জরিপ করছে সামনে পুবদিকের একটা বাড়ি। কলাগাছ ঘেরা বাড়িটা এখনো অনেক দূরে।
তার মনে আবার সেই গানের গুঞ্জরন শুরু হয়।
হলুদ শাড়ি-পরা এক তরুণী কলসি কাঁখে নদীর ঘাটে আসছে। দূর থেকে তাকে চেনা
গেলেও ফজল বুঝতে পারে, সে রূপজান ছাড়া আর কেউ নয়।
ফজল জোরে জোরে বৈঠায় টান মারে। কিন্তু ডিঙিটা অনেক দূরে থাকতেই তরুণীটি কলসিতে পানি ভরে বাড়ি চলে যায়। অদৃশ্য হয়ে যায় কলাগাছের আবডালে।
ইস্! আর কিছুক্ষণ আগে যদি সে রওনা দিত! ফজল নিজের ওপর বিরক্ত হয়। আর দশটা মিনিট আগে রওনা দিলেই ঐ বাড়ির ঘাটের কাছে পৌঁছতে পারত সে। দেখা হয়ে যেত রূপজানের সাথে।
কিন্তু দেখা হলেই বা কি করত ফজল? কি বলত রূপজানকে? রূপজানই বা তাকে কি বলত? ফজল বুঝতে পারে–শুধু চোখে চোখে কথা বলা যেত। চাতক-চোখের পিপাসা কি তাতে কমত, না বাড়ত?
ঠিকমত হাল না ধরায় ডিঙিটা হঠাৎ ঘুরে যাচ্ছিল। ফজল সংবিৎ ফিরে পেয়ে বৈঠার টানে ডিঙিটা সোজা করে। হাল ঠিক রেখে বেয়ে যায় সামনের দিকে।
তোরা কুমিরের সন্ধান পাইছসনিরে? ফজলের মনে কৌতুক, কিন্তু গলার স্বরে কপট গাম্ভীর্য।
না, এহন কি আর দ্যাহা যাইব। বক্কর বলে।
একটা হাঁস আইন্যা কিনারে বাইন্দা ধুইলে কেমন অয়? হাঁসের প্যাক-প্যাক শোনলে কুমিরগুলা ভাইস্যা ওঠব খাওনের লেইগ্যা।
ফজল আর বৈঠা টানছে না এখন। শুধু হাল ধরে বসে থাকে। তার আশা প্রবল বাসনা হয়ে রূপজানের প্রতীক্ষা করে। কিন্তু সে আর নদীর ঘাটে আসে না।
ডিঙিটা রূপজানদের ঘাট ছাড়িয়ে এগিয়ে যাচ্ছে। ফজল বৈঠা না টানলে কি হবে। আগা গলুইয়ে বসে বক্করতো টেনেই চলেছে তার বৈঠা। তাকে তো আর বৈঠা টানতে মানা করা যায় না।
ফজল কিছুক্ষণ পর পর ঘাড় ফিরিয়ে পেছনে দিকে তাকায়। তাকাতে গিয়ে তার ঘাড়ে ব্যথা ধরে যায়। কিন্তু রূপজানকে আর ঘাটে আসতে দেখা যায় না।
.
দিঘিরপাড় পৌঁছতেই পরিচিত লোজন, বন্ধু-বান্ধব ফজলকে স্বাগত জানায়। কেউ কেউ তাকে আবেগভরে বুকে জড়িয়ে ধরে। তার বিরুদ্ধে মিথ্যা ডাকাতি মামলার এজাহার দিয়ে তাকে হাজতে পাঠানো, জোর করে তালাকনামায় তার টিপ নেয়া, খুনের চরের দখল বেদখল-পুনর্দখলের ঘটনাবলি, তার বিরুদ্ধে ঘর-পোড়ানো মামলা সাজানোর কারসাজি সবই তারা শুনেছে। শুনে তাদের মনে সমবেদনা ও সহানুভূতি জেগেছে। কে একজন বলে, পা-না-ধোয়া জঙ্গুরুল্লা বড় বাইড়া গেছিল। মানুষেরে মানুষ বুইল্লা গিয়ান করে নাই। এইবার ফজল মিয়া ওর মিরদিনা ভাইঙ্গা দিছে। ঘোলাপানি খাওয়াইয়া ঠাণ্ডা করছে।
দিঘিরপাড়ে চর আর আসুলির জেদাজেদির হা-ডু-ডু খেলার দিন দুই দলের সমর্থকদের মধ্যে ছিল উত্তেজনা-উৎকণ্ঠা। তার খেলা দেখে সেদিন তারা চমকৃত হয়েছিল। বহুলোক, বিশেষ করে চরের কিশোর-তরুণ-যুবকের দল তার ভক্ত। সবাই তাকে ঘিরে দাঁড়ায়। কুচক্রী জঙ্গুরুল্লার হাত থেকে খুনের চর উদ্ধার করার জন্য সবাই তার ওপর খুশি। তারা তার বাহাদুরির প্রশংসা করে। উত্তরের প্রত্যাশা না করে নানা প্রশ্ন করে।
আক্কেল হালদার বাইরে কোথাও গিয়েছিল। এসে ফজলের পরিচয় পেয়ে তাকে বুকে জড়িয়ে ধরে, সমাদরের সাথে তার গদিতে নিয়ে যায়। থালা ভরে হরেক রকম মিষ্টি এনে তাকে আপ্যায়ন করে। খেলার তারিখ দিয়ে কেন সে অনুপস্থিত ছিল তার বৃত্তান্ত সে ফজলকে বলে : দক্ষিণপাড় থেকে পাঁচজন নামকরা খেলোয়াড় নিয়ে নৌকা করে ফিরছিল আক্কেল হালদার। পথে তারা গাঙডাকাতের হাতে পড়ে। ডাকাতের ছোরার আঘাতে সে নিজে ও তিনজন খেলোয়াড় আহত হয়।
বিকেল হয়ে গেছে। ফজল চান্দুকে নিয়ে প্রয়োজনীয় সওদাপাতি কিনে নৌকাঘাটায় আসে।
তাদের ডিঙির কাছে দাঁড়িয়ে বক্করের সাথে কথা বলছে একটা লোক। তার মুখে খোঁচাখোঁচা দাড়ি। চুল উষ্কখুষ্ক। বিমর্ষ মলিন মুখ। চোখে অসহায় দৃষ্টি। ফজলকে দেখেই লোকটা ডান হাত কপালে ঠেকায়, আস্সালামালেকুম মিয়াভাই, আমারে চিনছেন নি?
কে? তুমি হেকমত না?
হ, মিয়াভাই। কেমুন আছেন?
ভালোই আছি। তুমি কেমন আছ? কইতন আইলা?
আমাগ থাকন আর না থাকন হমান কথা। এহন তো আইলাম হাটেরতন। থাকি অনেক দূরে।
কই যাইবা?
বাড়ি যাইমু। বাড়ির কাছের একটা নাও-ও পাইলাম না। আমারে এট্টু লইয়া যাইবেন আপনাগ নায়?
তোমার বাড়িতে অনেক দক্ষিণে। আমরা তো ঐ দিগ দিয়া যাইমু না।
বেশি দূর যাওন লাগব না। আমারে ধলছত্রের কোণায় নামাইয়া দিলে যাইতে পারমু।
আইচ্ছা ওঠ নায়।
ফজল ও চান্দু নৌকায় ওঠে। তাদের পেছনে ওঠে হেকমত।
এই চান্দু, এই বক্কর, নাও ছাইড়া দে তাড়াতাড়ি। ফজল তাগিদ দেয়। আইজ বাড়িত যাইতে রাইত অইয়া যাইব।
হ, উজান বাইয়া যাইতে দেরি তো অইবই। চান্দু বলে।
উজান স্রোত ভেঙে ছলচ্ছল শব্দ করে ডিঙিটা এগিয়ে চলে।
মিয়াভাই, আইজ হাটে আপনের খুব তারিফ হোনলাম। হেকমত বলে। মাইনষে কইতে আছিল–অ্যাকটা মর্দের মতো মর্দ। বাপের ব্যাডা। জঙ্গুরুল্লা ওনার বাপ-দাদার সম্পত্তি খাবলা দিয়া গিল্যা ফালাইছিল। কিন্তু ওরে ঐ সম্পত্তি আর অজম করতে দেয় নাই। প্যাডের মইদ্যেরতন টাইন্যা বাইর করছে।
কেউ কোনো কথা বলে না অনেকক্ষণ।
নীরবতা ভেঙে এক সময়ে ফজল জিজ্ঞেস করে, তুমি কি করো এখন?
কী আর করমু। হগলেই তো জানে আমি কী করি। আপনেওতো জানেন। জানেন না?
হ, শুনছিলাম। কিন্তু এই কাম ছাইড়া দিতে পারো না? হালাল রুজি কইর্যা খাওনা ক্যান?
হালাল রুজি করনের কি আর উপায় আছে? আমি এক মহাজনের কাছে বান্দা।
মহাজন! কিসের আবার মহাজন?
থইলতদার। কাপড়ে-চোপড়ে ভর্দ লোক, গেরামের সর্মানী লোক। তারেই আমরা কই মহাজন। বড় দাপটের মহাজন?
তার কাছে বান্দা ক্যান্?
সে অনেক বিত্তান্ত। আমাগ মালপত্র সে সামলাইয়া রাখে। বেইচ্যা যা পায় আমাগ কিছু দ্যায় আর বেবাক ওনার প্যাডে যায়। একবার ধরা পইড়া অনেকদিন হাজতে আছিলাম। উনি বলে ছয়শ ট্যাহা খরচ করছিল আমারে ছাড়াইয়া আনতে। আপনের কাছে গোপন করমু না। হেরপর কত কত চুরি করলাম, কত কত মাল-মাত্তা আইন্যা দিলাম। কিন্তু ঐ ট্যাহা বলে শোদই অয় না। দুই-দুই বার পলাইছিলাম। দুইবারই তার পোষা গুণ্ডা দিয়া ধইর্যা নিছে। নিয়া হেইযে কী যন্ত্রণা দিছে কি কইমু আপনেরে। পিঠমোড়া বান দিয়া শরীলে বিছা ছাইড়া দিছে, শুয়াসম্বল ডইল্যা দিছে, পিডের উপরে বিড়ি নিবাইছে। এই দ্যাহেন।
হেকমত গেঞ্জি খুলে পিঠ দেখায় ফজলকে। সারা পিঠে কালো কালো পোড়া দাগ।
এই দিগে বাড়িত গিয়াও শান্তি নাই। চকিদার-দফাদার খবর পাইলেই দৌড়াইয়া আহে। কয়-ফলনা মারানির পুত, অমুক বাড়িত চুরি করছস। চল থানায়। আমি চর অঞ্চলে এহন চুরি করি না। অথচ কোনোহানে চুরি অইলেই মাইনষে কয়–আর কে করব? হেকমইত্যার কাম। হের লেইগ্যা বাড়িতেও যাইতে ইচ্ছা করে না। মহাজনও বাড়িত যাইতে দ্যায় না। যদি ফির্যা না যাই। চুরির খোঁজ-খবর আননের নাম কইর্যা মিছা কতা কইয়া অনেকদিন পরপর বাড়িত যাই। অ্যাকদিনের বেশি থাকি না।
হেকমত কোমরে লুঙ্গির প্যাঁচে গোঁজা একটা পুটলি বের করতে করতে বলে, আমার শরীলের অবস্থাও ভালো না। শুলবেদনায় বড় কষ্ট পাই। বেদনা উঠলেই প্যাডেরে ঘুস দিতে অয়।
হেকমত পাঁচ আঙ্গুলের মাথা দিয়ে পুঁটলি থেকে এক খাবলা সোডা তুলে বলে, এইডা অইল ঘুস। প্যাডেরে ঘুস না দিলে ছাড়াছাড়ি নাই। এক্কেরে কাবিজ কইর্যা ফালায়।
সে সোডা মুখে দিয়ে নদী থেকে আঁজলা ভরে পানি খায়।
ফজল নিবিষ্ট মনে শুনছিল হেকমতের সব কথা। যে হেকমতের কথা মনে এলে ঘৃণায় তার সমস্ত শরীর কুঁচকে উঠত, সেই হেকমতের জন্য তার বুক ব্যথায় ভরে ওঠে, তার হৃদয়ে দরদ ও সহানুভূতি জাগে। সে বেদনা-বিহ্বল দৃষ্টিতে চেয়ে থাকে হেকমতের দিকে। কথা বলতে পারে না।
অনেকক্ষণ পরে সে জিজ্ঞেস করে, তোমার মহাজন কোথায় থাকে? কী নাম তার?
নাম দিয়া কি করবেন? উদ্দার করতে পারবেন আমারে?
দেখি পারি কি না।
কিন্তুক বাড়িত্ আইয়া করমু কি? অ্যাক নল জমিও তো নাই। পারবেন আমারে কিছু জমি দিতে?
তুমি যদি ভালো অইয়া যাও, তয় আমি কথা দিলাম, এই পদ্মার উপরে বইস্যা কথা দিলাম, তোমারে আমি জমি দিমু। এইবার কও কী নাম তোমার মহাজনের।
আইজ থাউক, মিয়াভাই। দুই-অ্যাক দিনের মইদ্যে আপনের বাড়িত গিয়া কানে কানে কইয়া আইমু।
তোমার থলির মইদ্যে কী?
কয় সের চাউল। চাউল এত মাংগা অইয়া গেল ক্যান, মিয়াভাই? ট্যাহায় তিন সের। তা-ও আবার চাউলের মইদ্যে ধান আর আখালি।
ধলছত্রের কাছে আইয়া পড়ছি। বক্কর বলে। আপনে কোহানে নামবেন?
ঐ সামনের ঢোনে নামাইয়া দ্যান।
আন্দারের মইদ্যে যাইতে পরবা তো? ফজল জিজ্ঞেস করে।
হেকমত হেসে উঠে বলে, আমরাতো আন্দারেরই মানুষ। রাইতের আন্দারই আমাগ পথ দ্যাহায়।
হেকমতকে নামিয়ে দিয়ে ডিঙিটা খুনের চরের দিকে এগিয়ে যায়। ফজল তাকিয়ে থাকে পেছনের দিকে, যেদিন দিয়ে যেতে যেতে হেকমত মিশে যায় রাতের অন্ধকারে।
.
৩০.
চার-পাঁচ দিন আগে কাজের সন্ধানে চরদিঘলি গিয়েছিল জরিনা। সেখানেই সে খবর পায়, জঙ্গুরুল্লার দলকে বিতাড়িত করে এরফান মাতব্বরের দল খুনের চর আবার দখল করেছে।
জরিনার মন নেচে ওঠে আনন্দে। তবে কি ফজল জেল থেকে খালাস পেয়ে এসেছে? জরিনার মনে হয়, সে খালাস পেয়ে এসেছে। সে না হলে চর দখলের এত সাহস আর কার হবে?
কয়েকদিন ধরে জরিনা কাজের সন্ধান করছে। খেয়া নৌকায় পার হয়ে সে ঘুরছে এ চর থেকে সে চর। কিন্তু কোথাও কাজ পায়নি। অধিকাংশ গেরস্তের ঘরে খোরাকির ধান নেই। কেউ বেশি দামের আশায় রাখি’ করা পাট বেচে, কেউ নিদানের পুঁজি ভেঙে ধান-চাল কিনছে। অনেকেই হাঁস-মুরগি, খাসি-বকরি বিক্রি করে চাল কিনে খাচ্ছে। চালতো নয় যেন রূপার দানা। চারদিন কামলা খেটে এক টাকা পাওয়া যায়। সেই এক টাকা বেরিয়ে যায় তিন সের চাল কিনতে। যাদের ঘরে পুরো বছরের খোরাকির ধান আছে, তারাও টিপে টিপে হিসেব করে চলছে আজকাল। তাদের বউ-ঝিরাই এখন পেঁকিতে পাড় দিয়ে ধান ভানছে। ধান-ভানুনিদের আর প্রয়োজন হয় না তাদের। বেহুদা খরচের দিন আর নেই।
কাজ পাবে না জেনেও জরিনা আজ ভোরেই আবার বেরিয়েছিল। গিয়েছিল বিদগাঁও। বাড়ি বাড়ি ঘুরেও সে কাজ পায়নি। প্রায় সকলের মুখে ঐ এক কথা, ধান পাইমু কই? এহন তো চাউল কিন্যা খাইতে আছি। তোমারে কাম দিমু কেম্বায়?
বিদগাঁও থেকে ধু-ধু দেখা যায় খুনের চর। সেখানে বড় বড় কয়েকটা টিনের ঘরও দেখা যায়। একজনকে জিজ্ঞেস করে জরিনা জেনে নেয়, ফজল মাতব্বর ভাটিকান্দি ছেড়ে খুনের চরে বাড়ি করেছে।
ঠিকই অনুমান করছিল জরিনা, ফজল জেল থেকে খালাস পেয়ে এসেছে। সে-ই আবার দখল করেছে খুনের চর।
জরিনা বিদগাঁর উত্তর-পশ্চিম দিকে গিয়ে দাঁড়ায়। নদীর কিনারায় বসে থাকা এক জোড়া মানিকজোড় ভয় পেয়ে উড়ে যায়।
জরিনা পলকহীন চোখে চেয়ে থাকে খুনের চরের দিকে। সেদিকে কোনো খেয়া নৌকা যায় না। খেয়া থাকলে একবার ঘুরে আসতে পারত সে। ফজলের মা এখনো আদর করে তাকে বসতে দেয়। এখনো তাকে বউ বলে ডাকে। ভালো-মন্দ কিছু তৈরি থাকলে খেতে দেয়। অনেক দুর বলে সে-ই যেতে পারে না। এরফান মাতব্বরের মৃত্যুর খবর পেয়ে গিয়েছিল সে। তারপর আর একবারও যাওয়া হয় নি।
মানিকজোড় দুটো সোজা খুনের চরের দিকে উড়ে যাচ্ছে।
আহা রে! তার যদি পাখা থাকতো পাখির মতো!
হঠাৎ জরিনার মনে হয়, আল্লার দুনিয়ায় পাখিই সর্বশ্রেষ্ঠ জীব। সবচেয়ে সুন্দর প্রাণী। পাখি হাঁটতে পারে, উড়তেও পারে। কে বলে সব সৃষ্টির সেরা সৃষ্টি মানুষ। মানুষ পাখির মতো উড়তে তো পারেই না, দৌড় দিয়ে ইঁদুরের সাথেও পারে না।
জরিনা বাড়ির দিকে রওনা হয়। খালি হাতে সে যখন বাড়ি ফিরে আসে তখন বিকেল হয়ে গেছে। শাশুড়ি উঠানে হোগলার ওপর শুয়ে আছে। তার মাথার পাশে পড়ে আছে একটা ছোট কথা। তার ওপর সুই আর সুতা। সে কাঁথা সেলাই করছিল।
জরিনার ঠোঁটের কোণে কৌতুকের হাসি ফুটে ওঠার সাথে সাথেই আবার মিলিয়ে যায়। একটা নিঃশব্দ বেদনা ঘা দেয় তার বুকে। একটা বংশধরের জন্য শাশুড়ির কত যে আকুতি! তার বিয়ের পর থেকেই নাজুবিবি অধীর প্রতীক্ষায় দিন গুনছে। তার বহু দিনের আশা পূর্ণ হবে এবার। কিন্তু সে যদি জানত তার আশার বাসায় কোন পাখির ডিম!
জরিনার পায়ের শব্দ পেয়ে নাজুবিবি ধড়মড়িয়ে উঠে বসে। তার দিকে তাকিয়ে সে কিছুটা ক্ষোভের সাথে বলে, দিন কাবার কইর্যা এহন ফিরছস আবাগীর বেডি! নিজের প্যাটা বুঝিন তাজা কইর্যা আইছস?
কী যে কন আম্মাজান! এই আকালের দিনে কে কার লেইগ্যা রাইন্দা থোয়? উম্মা মেশানো জবাব দেয় জরিনা। সে বুঝতে পারে, খিদের জ্বালায় মেজাজ ঠিক নেই শাশুড়ির। খিদেয় পেট জ্বলছে তারও, মাথা ঘুরছে, ঝাঁপসা দেখছে চোখে।
কিন্তু ঘরে যে একটা দানাও নেই!
জরিনার কথায় রাগের আভাস পেয়ে নাজুবিবি একটু দমে যায়। সে আবার সুই-সুতা নিয়ে কাঁথা সেলাই করতে বসে যায়। জরিনা বেশ কিছুক্ষণ চুপ করে আছে দেখে সে বুঝতে পারে জরিনার রাগ পড়েনি। শেষে সে-ই যেচে কথা বলে, ও মা, মাগো, রাগ অইছস? তুই রাগ অইলে আমি কই যাইমু? যেইডারে প্যাডে রাখলাম, বুকের দুধ খাওয়াইলাম, হেইডা তো গেছে অদস্থালে। হেইডায় না দেখল–র কষ্ট, না বুঝল বউর দুষ্ক। তোরে তো প্যাডে রাহি নাই, বুকের দুধ খাওয়াই নাই। তুই তো আমারে ফালাইয়া যাইতে পারস নাই। তুই কাম কইর্যা খাওয়াইতে আছস। তুই না থাকলে কোন দিন মইর্যা মাডির লগে মিশ্যা যাইতাম। নিজের মা-ও এতহানি করত না। তুই আমার মা-জননী। আমার কতায় রাগ অইস না, মা। প্যাডের জ্বালায় কি কইতে কি কইয়া ফালাইছি।
নাজুবিবির কৃতজ্ঞতাবোধ আছে। তাকে স্নেহময়ী মায়ের মতোই মনে হয় জরিনার। তাই এ নিঃসহায় শাশুড়িকে তার দেখতেই হয়। সে নিজেও নিঃসঙ্গ, নিঃসহায়। শাশুড়ির ওপর মাঝে মাঝে তার রাগ হয়। কিন্তু অসহায় বুড়ির জন্য তার হৃদয়ে যে মমতা সঞ্চিত হয়ে আছে, তার স্পর্শে সে রাগ পানি হয়ে যায় কিছুক্ষণের মধ্যেই।
ও মা, মাগো, কতা কস না ক্যান? নাজুবিবি কাতর কণ্ঠে আবার বলে।
কী কইমু? আইজও কাম পাই নাই। না খাইয়া থাকতে অইব আইজ।
হঠাৎ জরিনার মনে পড়ে, একটা ডিব্বার ভেতর কিছু খুদ আছে। মুরগির বাচ্চার জন্য সে রেখে দিয়েছিল। কিন্তু বাচ্চা ফুটবে আর কার উমে? মোরগ-মুরগি যে একটাও নেই! খোপসহ সব ক’টা সে বিক্রি করে দিয়েছে অভাবের তাড়নায়।
জরিনা ঘরে গিয়ে ডিব্বাটা বের করে আনে। পোয়াখানেক খুদ আছে তাতে। কিন্তু ছাতকুরা পড়ে সেগুলো কালচে হয়ে গেছে।
ডিব্বা খোলার শব্দ পেয়ে উৎসুক দৃষ্টিতে সেদিকে তাকায় নাজুবিবি। ব্যগ্রতার সঙ্গে সে জিজ্ঞেস করে, কিছু পাইছস, মা?
হ, দুগ্গা খুদ আছে। জাউ রাইন্দা ফালাই।
হ, যা রান্দনের ত্বরাত্বরি রাইন্দা ফ্যা। প্যাডের মইদ্যে খাবল খাবল শুরু অইয়া গেছে।
জরিনা খুদ কটা ধুয়ে চুলো ধরায়। ঘরের চাল থেকে সে গোটা কয়েক লাউয়ের ডগা কেটে নেয়, গাছ থেকে ছিঁড়ে নেয় কয়েকটা কাঁচা লঙ্কা। তাড়াতাড়ি রান্না শেষ করে সন্ধ্যার আগেই খেয়ে নিতে হবে। বেশ কিছুদিন ধরে কেরোসিন পাওয়া যাচ্ছে না। তাই কোনো বাড়িতেই বাতি জ্বলে না আজকাল। সন্ধ্যার পর হাত-পা গুটিয়ে বসে থাকা, নয়তো বিছানায় গড়াগড়ি দিতে দিতে ঘুমিয়ে পড়া–এ ছাড়া অন্ধকারে আর কিছুই করার উপায় নেই।
খাওয়া শেষ করে থালা-বাসন মাজা শেষ না হতেই বেলা ডুবে যায়। দোর-মুখে দাঁড়িয়ে দেশলাই জ্বালে জরিনা। কুপির শুকনো সলতেয় আগুন দিয়ে সে ঘরে সঁঝ-বাতি দেয়। সন্ধ্যার পরই কৃষ্ণপক্ষের অন্ধকার জমাট বাঁধতে শুরু করে।
মাগরেবের নামাজ পড়ে বউ ও শাশুড়ি হোগলার বিছানায় বসে থাকে। কিন্তু অন্ধকারে কতক্ষণ আর বসে থাকা যায়। আবার মশার উৎপাত শুরু হয়েছে।
মশা গাঙ পাড়ি দিয়া আহে ক্যামনে? বিস্মিত প্রশ্ন নাজুবিবির। আগেতো চর-চঞ্চালে এত মশা আছিল না!
মশা আহে মাইনষের লগে লগে। জরিনা বলে। পয়লা পরথম দুই-চাই আহে গায়ে বইস্যা, নায়ে চইড়া। হেরপর চরেই পয়দা অয় হাজারে হাজার।
না গো মা, মশার জ্বালায় আর বইস্যা থাকন যায় না। তুই ত্বরাতৃরি মশারি টাঙাইয়া দে, হুইয়া পড়ি।
মশারির দুই কোনা টাঙানোই ছিল। অন্ধকারে হাতড়ে জরিনা বাকি দুই কোনা টাঙিয়ে ফেলে। তারপর কপাটে খিল লাগিয়ে সে মশারির ভেতর ঢোকে।
চাউলের খবর কি, অ্যা মা? দাম কি কমছে?
না, দাম আর কমব না। বসে বসেই জবাব দেয় জরিনা। যুদু যদ্দিন আছে, দাম বাড়তেই থাকব। কয়দিন আগে আছিল ট্যাহায় চাইর সের। আইজ হুনলাম তিন সের ভাও।
যুদ্দূর লগে চাউলের কোন এমুন দোস্তালি! চাউল ভইর্যা কি কামান দাগায় নি?
হ কামানই দাগায়। জরিনা হাসতে হাসতে বলে। কামান ফুডাইতে যদি চাউল লাগত আর চাউল ভইরা একটা কামান যদি মারত আমাগ বাড়ি, হে অইলে কী মজাই না অইত!
হ, হে অইলে চাউল টোকাইয়া খাইয়া বাঁচতে পারতাম।
হোনেন, চাউলের কাহাত পড়ছে ক্যান্। যুদু অইলে অ্যাক দ্যাশের চাউল অন্য দেশে যাইতে পারে না। আগে দ্যাখছেন না পেগু চাউল? আমাগ দেশে চাউলের আকাল পড়লে বর্শা মুলুকতন ঐ চাউল আইতো।
হ, খালি দেখমু ক্যান্, খাইছিও। ঐ চাউল ভাত অয় গাবের দানার মতন মোড়া মোডা।
এ পেগু চাউল আর আইতে পারব না।
ক্যান?
বর্মা মুলুক হুনছি জাপান দখল করছে।
জরিনা শাশুড়ির পাশে অন্য একটা বালিশে মাথা রেখে শুয়ে পড়ে।
এই যুদ্দু কি আর থামব না! কী তাশা শুরু করছে মরার যুদু। চাউল মাংগা, কেরাসিন পাওয়া যায় না।
হুনছি, কয়দিন পর চাউলও পাওয়া যাইব না।
তয়তো মানুষ মইর্যা সাফ অইয়া যাইব!
হ বাঁচনের আর আশা ভস্সা দেহি না।
আমাগ কি অইব? আরেকজন আইতে আছে। তারে ক্যামনে বাচইমু।
জরিনা কোনো কথা বলে না।
অ্যা মা, চুপ কইর্যা আছস ক্যান্? কতা কস না ক্যান?
কতা কইতে আর ভাল্লাগেনা।
তয় ঘুমাইয়া থাক। আমিও দেহি ঘুমাইতে পারি নি। নাজুবিবি চোখ বুজে ঘুমুবার চেষ্টা করে।
শরীর ভারী হওয়ার পর থেকেই একটা দুশ্চিন্তা জরিনার মনে বাসা বেঁধেছে। একা থাকলে, বিশেষ করে অন্ধকারে শুয়ে থাকলে দুশ্চিন্তাটা সজারুর কাঁটার মতো খাড়া হয়ে ওঠে। বিধতে থাকে তার হাড়-পাঁজরায়। শাশুড়ি তো আসমানের চাঁদ ধরবার জন্য ‘ডিলকি’ দিয়ে রয়েছে। কিন্তু আর একজন? তার ছেলে? সে-তো জানে, অমাবস্যা রাতে চাঁদ উঠতেই পারে না।
জরিনা কি করবে ভেবে পায় না। এ বিপদের কথা শুধুমাত্র একজনকেই বলা যায়। সে-ই দিতে পারে পরামর্শ। কিন্তু পরামর্শ দিয়ার আছেই বা কি? তবুও তার কাছে ভেঙে বললে সে হয়তো একটা কিছু বুদ্ধি দিতে পারে। এই সময়ে, এই মুহূর্তে যদি শোনা যেত হট্টিটির ডাক।
বাড়িডা দেহি আন্দার! বাড়ির মানুষ কি মইরা গেছে নি?
হেকমতের গলা। জরিনা আঁতকে ওঠে। কাঁটা দিয়ে ওঠে তার সারা শরীর। তার মেরুদণ্ড বেয়ে নেমে যায় একটা ঠাণ্ডা কাঁপুনি। সে পায়ের কাছ থেকে কথাটা টেনে নিয়ে শরীরটা ঢেকে দেয়।
খট-খট-খ। কাঠের দরজায় ঘা দিচ্ছে হেকমত।
নাজুবিবি কাশি দিয়ে গলা সাফ করে বলে, ক্যাডারে? হেকমত আইছস নি?
হ, তোমরা হাউজ্যা বেলায় বাত্তি নিবাইয়া হুইয়া পড়ছ!
কি করমু? বাত্তিতে তেল নাই। নাজুবিবি উঠে অন্ধকারে হাতড়াতে হাতড়াতে গিয়ে কপাট খুলে দেয়।
কে, মা? তুমি উঠছ ক্যান্, আরেকজন কই?
হুইয়া রইছে। ও মা, ঘুমাইয়া পড়ছস নি?
জরিনা চোখ বুজে ঘুমের ভান করে পড়ে থাকে।
ওঠতে কওনা ক্যান্? বাত্তি জ্বালাইতে কও। দরজার বাইরে দাঁড়িয়ে হেকমত বলে।
বাত্তি জ্বালাইব ক্যামনে? কইলাম তো কুপিতে তেল নাই।
তেল নাই!
না, কেরাসিন যে পাওয়া যায় না!
কিন্তুক রান তো লাগব। চাউল আনছি।
আর কি আনছস?
আর কিছু তো আনি নাই। তয় খাবি কি দিয়া?
ক্যান, ঘরে নাই কিছু? আণ্ডা তো আছে দুই-একটা।
নারে বাজান, অণ্ডা আইব কইত্তন? মোরগ-মুরগি তো বেবাক বেইচ্যা খাইছি।
ডাইল নাই?
ডাইলও বুঝিন নাই। অ বউ, ডাইল আছে নি?
না। ডাইল তো অনেক দিন ধইর্যা নাই। পয়সা পাইমু কই? জরিনা শুয়ে শুয়েই জবাব দেয়।
এহনও হুইয়া রইছে! ওডে না ক্যান্? চাউলের মইদ্যে ধান আর আখালি। এগুলারে বাছতে অইব।
আন্দারে ক্যামনে বাছমু?
ক্যান্! আন্দারে চুলের জঙ্গল আতাইয়া উকুন বাছতে পারে, আর চাউলের আখালি বাছতে পারব না! দিনের বেলা হলে হেকমতের মুখ ভ্যাঙচানো দেখতে পেত জরিনা।
হ পারমু। নাজুবিবি বলে। কিন্তু ভাত খাবি কি দিয়া? কদুর ডোগা সিদ্দ কইর্যা দিলে খাইতে পারবি?
দুৎ, দুৎ! খালি কদুর ডোগা কি খাওন যায়! ওরে উঠতে কও দেহি। আঁকিজালডা নামাইয়া দিতে কও। দুইডা খেও দিয়া আহি।
জালতো নাই। জরিনা বলে।
নাই! বাড়িত আইয়া খালি হুনতে আছি নাই আর নাই। হেকমত রেগে ওঠে। জাল গেল কই?
দফাদারে লইয়া গেছে। অ্যাকদিনের লেইগ্যা কইয়া নিছিল। অ্যাক মাস পার অইয়া গেছে। এহনও দিয়া যায় নাই।
হায়রে আল্লাহ! কিয়ের লেইগ্যা বাড়িত আইলাম?
একটু থেমে হেকমত বলে, মাছ রাহনের জালিডা আছে তো? না হেইডাও নাই?
হেইডা আছে।
বাইর কইর্যা দে জলদি। দেহি, আতাইয়া কয়ডা গইদ্যা বাইল্যা ধরতে পারি নি।
এই আন্দার রাইতে ক্যামনে যাবি, বাজান?
আমাগ আন্দারে চলনের আদত আছে। আন্দারে কি আমাগ আটকাইতে পারে? আর একটু পর চানও ওড্ব। দুই রাইত আগেইতো গেছে পূন্নিমা।
জরিনা অন্ধের মতো হাতড়াতে মাছ রাখার জালটা খুঁজে পায়।
এই যে ধরুক। জরিনা হাত বাড়িয়ে জালটা হেকমতের হাতে দেয়।
জালের সাথে লাগানো লম্বা সুতলির অন্য প্রান্ত কোমরের তাগায় বাঁধতে বাঁধতে হেকমত বলে, আমি গেলাম। চাউল বাইচ্ছা ভাত চড়াইয়া দে।
ত্বরাত্বরিই আইয়া পড়িস, বাজান। নাজুবিবি বলে।
কোনো কথা না বলে আবছায়ার মতো সরতে সরতে হেকমত আঁধারে মিশে যায়। থলে থেকে কুলায় অল্প অল্প করে চাল ঢেলে অন্ধকারে ধান আর কাকর বাছতে শুরু করে বউ আর শাশুড়ি।
ধানের খুইর মইদ্যে কি আখাইল ভইর্যা থুইছিল নি আল্লায়? নাজুবিবি বলে।
জরিনা অন্য কিছু ভাবছিল। শাশুড়ির কথার শেষটুকু শুধু তার কানে যায়। সে বলে, আম্মাজান কি কইলেন?
কইলাম, আল্লায় কি ধানের খুইর মইদ্যে আখালি ভইরা থুইছিল? হেইয়া না অইলে চাউলের লগে আখালি আইল কইত্তন?
আল্লায় ভরব ক্যান? চাউলের দাম তো বেশি। হের লেইগ্যা ধান আর আখালি মিশাইয়া ওজন বাড়াইছে।
দ্যাখ, মানুষ কেমুন জানোয়ার অইয়া গেছে।
এক জানোয়ার কি আরেক জানোয়াররে এম্বায় ঠকাইতে পারে?
উঁহু নাতো! ঠিকই ধরছস। জানোয়ারের মইদ্যে ঠকাঠকির কারবার তো নাই! মানুষ তো দ্যাখতে আছি জানোয়ারেরও অধম অইয়া গেছে।
আমার বাজান কইত, ভালো মানুষ হগল জানোয়ারের থিকা ভালো। আর খারাপ মানুষ খারাপ জানোয়ারের থিকাও খারাপ।
হ, কতাডা ঠিকই কইত তোর বাজান। নে মা, ত্বরাত্বরি আত চালা। ও আবার আইয়া পড়ব।
জরিনা হাত চালাতে চালাতে আবার অন্যমনস্ক হয়ে যায়। তার আজ মহাবিপদ। রাত পোহালে কি হবে? রাতের অন্ধকারে তাকে দেখতে পায়নি হেকমত। কিন্তু রাত পোহালেই তাকে দেখে সব বুঝতে পারবে সে।
ও বউ, ও মা, ও আইলেই কুন্তু সুখবরডা দিতে অইব। ও হুনলে যা খুশি অইব!
দুশ্চিন্তার অথই দরিয়ায় ডুবে আছে জরিনা। শাশুড়ির কথা সে শুনতে পায় না।
ও বউ, চুপ মাইরা রইছস ক্যান? নাজুবিবি হাত দিয়ে ঠেলা দেয় জরিনার হাতে। কী কইছি, হোনছস? ওরে সুখবর দিলে ও যা খুশি অইব!
জরিনার দুশ্চিন্তা আরো বেড়ে যায়। সে বলে, না, এত হবিরে কওনের দরকার নাই। চান ওঠলে দ্যাখতেই পাইব।
উঁহু ওরে কইতেই অইব। তুই এহন আর চেঁকির কাম করতে পারবি না। তোরে আর ঐ কাম করতে দিমু না। ওরে কইমু বেশি কইর্যা ট্যাহা দিয়া যাইতে।
কত ট্যাহাই দ্যায় আপনের পোলা! মনে করছেন ট্যাহার থলি বুঝিন লইয়া আইছে।
নাজুবিবি লজ্জিত হয়। সে কথা বলার উৎসাহ হারিয়ে ফেলে।
জরিনা আবার বলে, আপনের কওনের কোনো দরকার নাই। যা কওনের আমিই কইমু। আপনে গিয়া হুইয়া থাকেন। চাউল আর বাছন লাগব না। আমি রাইন্দা-বাইড়া আপনেরে ডাক দিমু।
আবারও খাইতে ডাক দিবিনি? খাইছি তো অ্যাকবার।
ঐ খাওন কি প্যাড ভরছে? আবারও খাইবেন আপনের পোলার লগে।
আইচ্ছা, আমি তয় হুইয়া থাকি গিয়া। ভাত-সালুন রান্দা অইলে আমারে ডাক দিস।
নাজুবিবি ঘরে গিয়ে শুয়ে পড়ে। জরিনা চুলা ধরিয়ে তার ওপর পানি সমেত ভাতের পাতিল বসিয়ে দেয়। চুলার ভেতর ঘাস-পাতা জ্বলছে। সামান্য সে আলো তার কাছে ভয়ঙ্কর বলে মনে হয়। সে দুজনের ভাতের চাল মেপে, সেগুলো তাড়াতাড়ি কলসির পানিতে ধুয়ে ঢেলে দেয় পাতিলের মধ্যে।
চুলার কাছে আলোয় বসে থাকতে তার কেমন ভয় ভয় লাগে। সে ঘরে গিয়ে একটা ছেঁড়া শাড়ি নিয়ে আসে। সেটাকে ভালো করে গায়ে জড়িয়ে সে আবার বসে চুলার ধারে। এবার সে অনেকটা স্বস্তি বোধ করে।
জরিনা ভাবে, হেকমতকে কোনো রকমে খাইয়ে তাড়াতাড়ি বিদায় করা যেত!
এই রাতের অন্ধকারেই তাকে যে করে তোক বিদায় করতে হবে। সঙ্কল্পের দৃঢ়তায় তার চোলায় শক্ত হয়, মুষ্টিবদ্ধ হয় দুটি হাত।
কৃষ্ণ তৃতীয়ার চাঁদ পূর্বদিগন্ত ছেড়ে অনেকটা ওপরে উঠে গেছে। ফিকে হয়ে এসেছে অন্ধকার।
জরিনা হঠাৎ চিৎকার দিয়ে ওঠে, কে, কে, কেডা অইখানে? কতা কয় না ক্যান?
কে, কেডাগো? ও বউ। নাজুবিবি চমকে উঠে জিজ্ঞেস করে।
জরিনা মশারির কাছে গিয়ে নিচু গলায় শাশুড়িকে বলে, টচলাইট জ্বালাইয়া কারা যেন আইতে আছিল। আমি কে কে করছি পর টচ নিবাইয়া দিছে। চইল্যা গেছে না হুতি দিয়া আছে কইতে পারি না। টচের আলোতে দ্যাখলাম তিন-চার জোড়া ঠ্যাঙ। ঠ্যাঙ্গে বুটজুতা। আবছা মতন পাগড়িও দ্যাখলাম মাতায়।
তয় কি পুলিস?
পুলিস ছাড়া আর পাগড়ি মাতায় দিব কে? আপনের পোলা বাড়িত্ আইছে, এই খবর পাইছে। মনে অয় ধরতে আইছে।
ও আল্লাহ্, কী অইব এহন! শান্তিতে দুইডা ভাতও খাইতে দিব না।
এহনরি আইল না। আইলে কাইশ্যা বনে পলাইয়া থাকতে কইমু। রান্দা অইলে আমি গিয়া খাওয়াইয়া আই।
হ, এইডাই ভালো বুদ্ধির কাম। ওইখানতনই চইল্যা যাইতে কইয়া দিস।
হ কইয়া দিমু।
ভাত রান্না হয়ে গেছে অনেকক্ষণ। নাজুবিবি লবণ আর কাঁচা লঙ্কা দিয়ে গরম গরম ভাত খেয়ে হেকমতের জন্য কিছুক্ষণ হা-হুঁতাশ করে আবার গিয়ে শুয়ে পড়ে।
হেকমত এখনো আসছে না কেন, বুঝতে পারে না জরিনা। সত্যিই কি পুলিস এসে গেছে খবর পেয়ে? ওত পেতে আছে কোথাও? তাই দেখেই কি পালিয়ে গেছে হেকমত?
সে আর আসবে না আজ-জরিনার মনে এ বিশ্বাস চাড়া দিয়ে উঠতেই তার দুশ্চিন্তা কেটে যায়, বন্য খুশিতে নেচে ওঠে মন।
ঈষৎ ক্ষয়ে যাওয়া গোলাকার চাঁদটা এখন ঠিক মাথার ওপর। রাত দুপুর পার হয়ে গেছে। নাজুবিবি এক ঘুম দিয়ে উঠে বাইরে আসে। চার দিকে তাকায়। জোছনার ঘোলাটে আলোয় দূরের গাছ-পালা বাড়ি-ঘর অস্পষ্ট দেখা যায়। সে ডাকে, ও বউ, ও মা, কই তুমি?
জরিনা রসুইঘরের বেড়ার সাথে হেলান দিয়ে ঝিমুচ্ছিল। শাশুড়ির ডাকে ধড়মড়িয়ে উঠে সে বলে, এই তো আম্মাজান, আপনের পোলাতো এহনো আইল না।
ওর কি অইল, আল্লা মালুম। মনে অয় পুলিস দেইখ্যা পলাইয়া গেছে।
একটু থেমে সে আবার বলে, ও মা, ওরে পুলিসে ধইরা লইয়া যায় নাই তো? তোর কি মনে অয়?
কিছুই তো বোঝতে পারলাম না।
আইচ্ছা, গাঙ্গে তো কুমির থাকে।
হঠাৎ নাজুবিবি ডুকরে কেঁদে ওঠে। ইনিয়ে-বিনিয়ে রুদ্ধ কণ্ঠে বিলাপ করতে শুরু করে, ও আমার বাজান রে। তোরে না জানি কুমিরে খাইয়া ফালাইছেরে। ও আমার বাজান রে, এ-এ!
নাজুবিবির কান্নায় শেষ রাত্রির নিস্তব্ধতা খান খান হয়ে যায়। জরিনার বুকটাও হঠাৎ বোবা বেদনায় মোচড় দিয়ে ওঠে। বুকটায় তোলপাড় তুলে একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে আসে। তার দুচোখ থেকে অশ্রু ঝরে দরদর ধারায়।
.
৩১.
খুনের চরের মারামারিতে হেরে যাওয়ায় জঙ্গুরুল্লার সম্মানের হানি হয়েছে অনেক। ফজলের বিরুদ্ধে ঘর পোড়ানো মামলার কারসাজি বানচাল হয়ে যাওয়ায় আরো খোয়া গেছে তার মান সম। সে খেলা হয়ে গেছে, মিথ্যাচারী বলে প্রমাণিত হয়েছে আইনের মানুষদের কাছে। স্রোতের তোড়ে তলা ক্ষয়ে যাওয়া নদীর পাড়ের মতো তার প্রভাব-প্রতিপত্তির ভিত ক্ষয়ে গেছে। তার নামের শেষের স্বনির্বাচিত সম্মানসূচক পদবি আর কারো মুখে উচ্চারিত হয় না আজকাল। বরং সহাস্যে উচ্চারিত হয় তার নামের আগের বিশেষণটি।
জঙ্গুরুল্লা তার কীর্তিধর পা দুটোকে পরিচর্যার জন্যই শুধু একটা চাকর রেখেছে। সে লোকজনের সামনে কাছারি ঘরে গিয়ে বসলেও চাকরটি গিয়ে তার পা টিপতে শুরু করে। লোকজনকে সে বোঝাতে চায় তার পায়ের মূল্য। এ পা সোনা দিয়ে মুড়ে রাখবার ক্ষমতা আছে তার। ফরমাশ দিয়ে এক জোড়া সোনার জুতা বানিয়ে পরলে কেমন হয়? জঙ্গুরুল্লা মাঝে মাঝে ভাবে। তা হলে সোনা-পাইয়া’বা ও রকম সুন্দর একটা বিশেষণ তার নামের আগে যুক্ত হয়ে যাবে।
জঙ্গুরুল্লা চেয়ারে বসে পদসেবার জন্য পা দুটো চাকরের কোলের ওপর রেখে আজকাল প্রায়ই চিন্তার অলিগলিতে বিচরণ করে। ভাবে ভবিষ্যৎ কার্যক্রমের কথা :
…খুনের চরটা আবার দখল করতে হবে। মাসখানেক পরে তার কোলশরিকদের রোপা আমন ধান পাকবে। তার আগেই ওটা দখল করতে হবে। ব্যর্থ হলে তার হারানো প্রভাব প্রতিপত্তি আর ফিরে আসবে না। পীরবাবার খানকাশরিফ আর বাড়ির কাজ তাড়াতাড়ি শেষ করতে হবে। পীরবাবা এলে নতুন বাড়িতে তার বসবাসের সুব্যবস্থা করতে হবে। আরশেদ মোল্লার সাথে কথা বলে শুভ দিন ধার্য করে শুভ কাজটা সম্পন্ন করতে হবে। কিন্তু আরশেদ মোল্লাকেই তো পাওয়া যাচ্ছে না। খুনের চর থেকে চুবানি খেয়ে সে যে কোথায় চলে গেছে, তা কেউ বলতে পারে না। বাড়িতে সে নাকি কিছু বলে যায়নি। জামাইর হাতের চুবানি খেয়ে লজ্জায় আত্মহত্যা করেনি তো? আত্মহত্যা করলেও অসুবিধে নেই। ওর বিধবাকে আরো সহজে পথে আনা যাবে। আর কিছুদিন পরেই আসতে শুরু করবে দাদনের ধান। ঐ ধান মজুদ করার জন্য গুদাম তৈরি করতে হবে। দুটো টিনের ঘর কেনা হয়েছে। ওগুলোর টিন দিয়ে তৈরি করতে হবে গুদাম। বড় দারোগা বড় কড়া লোক। সে তার ওপর বড় খাপ্প। তাকে কিছুতেই বশ করা গেল না। তাকে যদি অন্য থানায় বদলি করানো যেত। থানার দারোগা হাতে না থাকলে কোনো কিছুতেই সুবিধে করা যায় না, কোনো কাজে সফল হওয়া যায় না।
জঙ্গুরুল্লার সব চিন্তার বড় চিন্তা কি ভাবে ফজলকে জব্দ করা যায়। তার সব কাজের বড় কাজ–কোন্ ফিকিরে ওকে আবার জেলে ঢোকানো যায়।
হঠাৎই একটা সুযোগ পেয়ে যায় সে। সুযোগ নয়, সে এক মহাসুযোগ। এ যেন রূপকথার মোহরভরা কলসি। হাঁটতে হাঁটতে তার ঘরে এসে হাজির।
পীরবাবা ভাগ্যকূল এসেছেন–খবর পায় জহুরুন্না। তাকে আবার কোন মুরিদ দখল করে ফেলে তার কি কোনো ঠিক আছে? এটাও চর দখলের মতোই দুরূহ কাজ।
খবর পাওয়ার পরেই দিনই মোরগের বাকের সময় সে পানসি নিয়ে ভাগ্যকূল রওনা হয়। পানসি বাওয়ার জন্য তিনজন বাঁধা আছে–একজন হালী ও দু’জন দাঁড়ী। এছাড়াও অতিরিক্ত দু’জন দাড়ী সে সাথে নেয়। যাওয়ার সময় উজান ঠেলে যেতে হবে। বছরের এ সময়ে বাতাস কম। তাই পাল না-ও খাটতে পারে। হয়তো সবটা পথ দাঁড় বেয়ে, গুন টেনে যেতে হবে।
পানসিতে উঠেই জঙ্গুরুল্লা ওজু করে ফজরের নামাজ পড়ে। নামাজের শেষে হাত উঠিয়ে সে দীর্ঘ সময় ধরে মোনাজাত করে। মোনাজাতের মধ্যে সে আল্লার কাছে অনেক কিছু প্রার্থনা করে। অনেক কিছুর মধ্যে দুটো ব্যাপারে সে বারবার পরম দয়ালু আল্লার সাহায্য প্রার্থনা করে, …ইয়া আল্লাহ, এরফান মাতব্বরের পোলা ফজলরে শায়েস্তা করার বুদ্ধি দ্যাও, শক্তি দ্যাও, সুযোগ দ্যাও। ইয়া আল্লাহ, থানার বড় দারোগা আমার উপরে বড় রাগ, বড় খাপ্পা। ইয়া আল্লাহ, তারে অন্য থানায় বদলি কইর্যা দ্যাও। রাব্বানা আতেনা ফিদ্দুনিয়া হাসানাতাও ওয়াফিল আখেরাতে হাসানাতাও ওয়াকেনা আজাব আনার। আমিন।
জঙ্গুরুল্লা খাস খোপ থেকে বেরিয়ে ছই-এর সাথে হেলান দিয়ে দাঁড়ায়।
ফরসা হয়ে গেছে চারদিক। রক্তরাঙা গোলাকার সূর্য দিগ্বলয় ছাড়িয়ে উঠে গেছে। শিশির ভেজা ধানের শিষ আর কাশফুল মাথা নুইয়ে ভোরের সূর্যকে প্রণাম করছে, স্বাগত জানাচ্ছে। ঝিরঝিরে বাতাসের স্পর্শে শিহরিত রূপালি পানি কুলকুল শব্দে বয়ে যাচ্ছে। উজান ঠেলে, ভাটি বেয়ে বিভিন্ন মোকামের ছোট বড় নানা গড়নের খালি বা মালবোঝাই নৌকা চলাচল করছে। দুটো গাধাবোট টেনে নিয়ে একটা লঞ্চ উত্তরের বড় নদী দিয়ে পুবদিকে যাচ্ছে।
জঙ্গুরুল্লার পানসি গুনগাঁর খাড়িতে ঢোকে। কেরামত হাল ধরে আছে। বাকি চারজন টানছে দাঁড়। কুলোকেরগাও বাঁয়ে রেখে, ডাইনগাও ডানে রেখে পানসিটা উত্তর-পশ্চিম কোনাকুনি বড় নদীর দিকে এগিয়ে যাচ্ছে।
জঙ্গুরুল্লা ডান দিকে তাকায়। ডাইনগাঁয়ে ভাঙন শুরু হয়েছে। সে আবার বাঁ দিকে তাকায়। কুলোকেরগাও বড় হচ্ছে পলি পড়ে।
সামনে ডানদিকে বেশ কিছু দূরে দুটো চিল শূন্যের ওপর মারামারি খামচাখামচি করতে করতে নিচে পড়ে যাচ্ছে। ও দুটো পানিতেই পড়ে যাবে মনে হয়। কিন্তু গায়ে পানি লাগার আগেই একটা চিল রণে ভঙ্গ দিয়ে উড়ে পালায়। তার পিছু ধাওয়া করে অন্যটা। কিছুদুর পর্যন্ত তাড়া করে বিজয়ী চিলটা ফিরে যায় পাড়ের কাছের সেই জায়গাটায়।
কেরামতের চোখের সামনেই ঘটছে চিলের মারামারি। সে উৎসুক দৃষ্টিতে লক্ষ্য করছে চিল দুটোর গতিবিধি।
চিলটা পানির ওপর তীক্ষ্ণ লোলুপ দৃষ্টি ফেলে চক্কর দিচ্ছে আর ছো মারার জন্য তাওয়াচ্ছে। মনে হয় এখনি ছোঁ মারবে। হটে যাওয়া চিলটা ওখানেই যাচ্ছে আবার। বিজয়ী চিলটা আবার ওটাকে দূরে তাড়িয়ে দিয়ে ফিরে যায় সে জায়গায়।
কেরামত ঠিক বুঝতে পারে না, নদীতে এত জায়গা থাকতে দুটো চিলেরই রোখ ঐ এক জায়গায় কেন? মাছের খনি আছে নাকি ওখানে?
জায়গাটার কাছাকাছি পশ্চিম দিক দিয়ে এখন যাচ্ছে পানসিটা।
চিলটা ছোঁ মারে হঠাৎ। নখরে বিধিয়ে কী নিয়ে উঠছে ওটা? আরে, একটা জাল যে! জালের একটা মাছওতো বিধে আছে নখরে!
হুজুর দ্যাহেন দ্যাহেন চাইয়া দ্যাহেন চিলের কাণ্ড! বিস্মিত কেরামত এক নিশ্বাসে বলে।
জঙ্গুরুল্লা দেখে, একটা চিল জালের মাছ নখরে বিধিয়ে জালসহ ওপর দিকে পাখা ঝাঁপটিয়ে উঠবার চেষ্টা করছে। জালের এক প্রান্তে বাধা সুতলির কিছুটা ওপরে উঠে গেছে জালের সাথে। সুতলির আর এক প্রান্ত নিশ্চয়ই পানির নিচে কোনো কিছুর সাথে বাঁধা আছে–ভাবে জঙ্গুরুল্লা। তাই জালটা ওপরে টেনে তুলতে পারছে না চিলটা। জালের ভেতর কয়েকটা মাছও দেখা যাচ্ছে। বিতাড়িত চিলটা এদিকে আসছে আবার। ওটা জালের মাছের ওপর থাবা দেয়ার উপক্রম করতেই দখলদার চিলটা জালসহ মাছ ছেড়ে দিয়ে ওটার পেছনে ধাওয়া করে। জালটা ধপ করে পানিতে পড়ে যায়।
এই কেরা, নাও ভিড়া জলদি। জালডা কিয়ের লগে বান্দা আছে, দ্যাখন লাগব।
কেরামত ও দাড়ীরা সবাই বিস্মিত দৃষ্টিতে জঙ্গুরুল্লার দিকে তাকায়।
আরে চাইয়া রইছস ক্যান? ত্বরাতৃরি কর।
কেরামত নৌকা ঘুরিয়ে কিনারায় জালটার কাছে নিয়ে যায়।
স্রোতের টানে জালটা ডুবে যাচ্ছে, আবার ওটার এক প্রান্ত ভেসে উঠছে কিছুক্ষণ পরপর। কয়েকটা মরা পেট-ফোলা মাছ চিৎ হয়ে আছে জালের মধ্যে।
এই কেরা, কিনারে নাও বাইন্দা রাখ। ভালো জাগায় বান্দিস। পাড় ভাইঙা যেন না পড়ে।
কেরামত পাড়া গেড়ে নৌকা বাঁধে কিনারায় ।
এই কেরামত, পানিতে নাম। জালের সুতলি ধইর্যা ডুব দেয়। দ্যাখ জালডা কিয়ের লগে বান্দা।
কেরামত গামছা পরে পানিতে নেমে বলে, এই ফেকু, তুইও আয়। একলা ডর করে।
কিয়ের ডর, অ্যা ব্যাডা! এহন ভাটা লাগছে। বেশি নিচে যাওন লাগব না।
ফেকুও গামছা পরে পানিতে নামে। জালের সুতলি ধরে দুজনেই ডুব দেয়। একটু পরে গোতলাগুতলি করে দু’জনই ভেসে ওঠে। ভীত সন্ত্রস্ত কণ্ঠে কেরামত বলে, একটা মানুষ!
জঙ্গুরুল্লা এটাই অনুমান করেছিল। সে বিস্মিত কণ্ঠে বলে, মানুষ! কেরে মানুষটা? মাথাডা উড়াইয়া দ্যাখ দেখি।
আমার ডর লাগে। কেরামত বলে।
দুও ব্যাডা। কিয়ের আবার ডর?
নৌকার বাকি তিনজন তাজু, মেছের ও দূরবক্সকে নাম ধরে ডেকে বলে, তোরা তিনজনও পানিতে নাম। বেবাকে মিল্যা মাথাডা উপরে উড়া। কিন্তু সাবধান। লাশটা যেমুন অবস্থায় আছে তেমুনই রাইখ্যা দিতে অইব। বেশি লাড়াচাড়া দিলে স্রোতে টাইন্যা লইয়া যাইব গা।
দাঁড়ী তিনজন পানিতে নামে।
মাথাডা কুনখানে আছে আগে আতাইয়া ঠিক কইর্যা ল।
কোমর-পানিতে দাঁড়িয়ে তারা আলগোছে লাশের মাথাটা উঁচু করে।
আরে! এইডা দেহি হেকমইত্যা চোরা! তিন-চারজন এক সাথে কলবল করে ওঠে।
হেকমইত্যা চোরা! ওর বাড়ি কই? জঙ্গুরুল্লা জিজ্ঞেস করে।
এইতো কাছেই পুবদিগে, নয়াকান্দি। নূরবক্স বলে।
ওর বাড়িতে কে আছে?
আছে ওর মা আর বউ। আর কেও নাই। কাইল বিয়ালে ওরে দিঘিরপাড় দেখছিলাম। ফজল মাতবরের লগে তার নায় উইট্টা বাড়িত গেল।
জঙ্গুরুল্লার মনে হঠাৎ খুশির বান ডাকে। আনন্দের আতিশয্যে তার মুখ দিয়ে কথা বেরোয় না। সে কিছুক্ষণ চুপ করে থাকে। আর মনে মনে আল্লার শোকরগুজারি করে। আজই ভোরে মাত্র কিছুক্ষণ আগে আল্লার সাহায্য প্রার্থনা করে সে মোনাজাত করেছিল। যে ওজু করে সে মোনাজাত করেছিল সে ওজু নষ্ট হওয়ার আগেই তার মোনাজাত কবুল হয়েছে পরম দয়ালু আল্লার দরবারে। এত তাড়াতাড়ি এত তনগদ আল্লা তার মকসেদ পুরা করবে সে তা ভাবতেই পারেনি।
জঙ্গুরুল্লা তার মনের উল্লাস মনেই চেপে রেখে বলে, এই নূরবক্স, তুই ঠিক দ্যাখছস তো? ঐ নায় আর কে কে আছিল?
আর আছিল নাগরার চরের চান্দু। আর একজনরে চিনি নাই।
ওগ আর কে কে দ্যাখছে?
ঐ সময় দিঘিরপাড় নৌকা ঘাডে যারা আছিল, অনেকেই দ্যাখছে।
তোরা বোঝতে পারছস ঘটনাডা কি?
সবাই তার মুখের দিকে তাকায়।
ঘটনাডাতো আয়নার মতন পরিষ্কার। খুন কইর্যা ঐখানে ফালাইয়া গেছে।
খুন! কারা খুন করছে। বিস্মিত প্রশ্ন সকলের।
হেইডাও বুঝলি না? নূরবক্স কি কইল? কারা ওরে নায়ে কইর্যা লইয়া গেছিল?
ওরা পানি থেকে নৌকায় উঠতেই জঙ্গুরুল্লা বলে, আরে তোরা উইট্যা গেলিনি। এই ফেকু, তুই আবার পানিতে নাম। জালডা মনে অয় কোমরে বান্দা আছে। জাল খুইল্যা আন। মাছগুলা ফালাইয়া দে।
ফেকু ডুব দেয়। জালের সুতলি ধরে ধরে নিচে যায়। কিন্তু সুতলিটা যেখানে গিঠ দিয়ে বাঁধা সেখানে তার হাত যায় না। গিঠটা উপুড়-হয়ে-পড়ে-থাকা লাশটার পেটের দিকে তাগার সাথে। ভয়েই সে আর ওদিকে হাত বাড়ায় না। সে ওপরে উঠে দম নিয়ে আবার ডুব দেয়। দাঁত দিয়ে সুতলিটা কেটে সে জালটা তুলে নিয়ে আসে। মাছগুলোকে জঙ্গুরুল্লার নির্দেশ মতো সে স্রোতে ভাসিয়ে দেয়।
জঙ্গুরুল্লা চারদিকে তাকায়। দূর দিয়ে দু-একটা নৌকা যেতে দেখা যায়। ধারে কাছে কেউ নেই। একটু পরেই লোকজনের ভিড় জমে যাবে।
ও তাজু, ও ফেকু, তোরা পাড়ে নাইম্যা থাক। জঙ্গুরুল্লা নির্দেশ দেয়। তোরা পাহারা দিবি। আরেকটু পরে খবর পাইয়া মানুষজন আইস্যা ভিড় জমাইব। খবরদার, কাউরে পানি নামতে দিবি না। আমরা থানায় খবর দিতে যাইতে আছি। পুলিস আইয়া লাশ উডাইব।
গলা খাদে নামিয়ে সে আবার বলে, তোরা শোন, চিলের কথা, জালের কথা কিন্তু কারো কাছে কইবি না, খবরদার!
তাজু ও ফেকু নৌকা থেকে কিছু মুড়ি ও বাতাসা নিয়ে নেমে যায়। পানসিটা রওনা হয় হেকমতের বাড়ির দিকে। পথ চিনিয়ে নিয়ে যায় দূরবক্স।
রাত না পোহাতেই জরিনাকে নিয়ে নাজুবিবি হেকমতের খোঁজে এলাকার চৌকিদারের কাছে গিয়েছিল। কিন্তু চৌকিদার কোনো খোঁজই দিতে পারেনি। ফিরে এসে ঘরে ঢুকতেই হঠাৎ গলা খাকারি শুনে তারা হকচকিয়ে যায়।
কে আছে বাড়িতে? অপরিচিত ভারী গলায় জিজ্ঞেস করছে কেউ।
এইতো আমরা আছি। কেডা জিগায়? নাজুবিবি পাল্টা প্রশ্ন করে।
নূরবক্স পা চালিয়ে নাজুবিবির কাছে যায়। নিচু গলায় সে জঙ্গুরুল্লার পরিচয় দেয়।
ও, পা-না-ধোয়া…
চুপ, চুপ! নূরবক্স মুখে আঙুল দিয়ে সতর্ক করে দেয় নাজুবিবিকে। কও চদরী সাব।
আহেন চদরী সাব। নাজুবিবি সাদর আহ্বান জানায়।
জঙ্গুরুল্লা এসে উঠানে দাঁড়ায়।
জরিনা পিড়ি এনে শাশুড়ির হাতে দেয়। সে ওটা পেতে দিয়ে বলে, গরিবের বাড়ি হাতির পাড়া। বহেন চদরী সাব।
না বসনের সময় নাই। তুমিই হেকমতের মা?
হ, হেকমতের কোনো খবর লইয়া আইছেন?
হ।
কি খবর? জলদি কইর্যা কন। আমরা তো চিন্তায় জারাজারা অইয়া গেছি।
খবর শোনার পরের পরিস্থিতিটা আঁচ করতে পারে জঙ্গুরুল্লা। সে বলে, খবর পরে অইব। তুমি আর তোমার পুতের বউ চলো আমাগ লগে নৌকায়। থানায় যাইতে অইব।
থানায়! ওরে কি থানায় বাইন্দা লইয়া গেছে?
পরেই শুনতে পাইবা। এহন তোমরা তৈরি অইয়া লও জলদি।
তাড়াতাড়ি তৈরি হয়ে নাজুবিবি ও জরিনা জঙ্গুরুল্লার পানসিতে উঠে বসে।
সরু একটা সেঁতা দিয়ে কিছুদূর ভাটিয়ে পানসিটা গুনগার খাড়িতে গিয়ে পড়ে। জঙ্গুরুল্লার নির্দেশে ডানদিকে মোড় নিতেই বাঁদিকে লোকজনের ভিড় দেখা যায়।
দুঃসংবাদটা আর চেপে রাখা ঠিক নয় ভেবে জঙ্গুরুল্লা বলে, হেকমতের মা, তোমরা মনেরে শক্ত করো। যা অইয়া গেছে তার লেইগ্যা কান্দাকাডি করলে আর ফায়দা অইব না।
ক্যান, কি অইছে? আমার হেকমত বাঁইচ্যা নাই? ও আমার বাজানরে। নাজুবিবি ডুকরে কেঁদে ওঠে।
শোন, কাইন্দ না। তোমার পোলারে মাইর্যা পানির মইদ্যে ঔজাইয়া থুইয়া গেছে।
নাজুবিবি এবার গলা ছেড়ে বিলাপ করতে শুরু করে দেয়, ও আমার হেকমতরে বাজা। তোরে কোন নির্বইংশায় মাইরা থুইয়া গেছে রে, বা’জানরে আ-মা–র।…
জরিনা স্তব্ধ হয়ে গেছে। সে ফুকরে কাঁদতে পারে না। মাথায় লম্বা ঘোমটা না থাকলে দেখা যেত তার দুগাল বেয়ে অশ্রুর ধারা গড়িয়ে তার গলা ও বুক ভিজিয়ে দিচ্ছে।
শোন হেকমতের মা, আর কাইন্দা কি করবা? কাইন্দা কি আর পুত পাইবা? নাজুবিবির বিলাপ মাঝে মাঝে থামে। আর থামার সাথে সাথেই এক সাথে অনেক অশ্রু ঝরঝর করে ঝরে পড়ে। কিছুক্ষণ পর বুকের ভেতরটা আবার মোচড় দিয়ে ওঠে। বুকের ব্যথা অসহ্য হতেই সে আবার শুরু করে দেয় বিলাপ।
জঙ্গুরুল্লা তার বিলাপের বিরতির অপেক্ষায় থাকে। তার বিলাপ থামতেই জঙ্গুরুল্লা বলে, কে মারছে আমরা জাইন্যা ফালাইছি। সাক্ষীও পাইছি।
ও আমার বেসাতরে, আমা-আ-র। তোরে না যেন কে না যে মাইরা থুইয়া গেছেরে, তার কইলজা ভরতা কইর্যা খাইমুরে বাজা-আ-ন আমা-আ-র। বংশের চেরাগ প্যাডে থুইয়া ক্যামনে চইল্যা গেলি, বাজানরে আমা-আ-র।…
পানসিটা ঘটনাস্থলে এসে থামে। লোকজন নৌকার মাথির কাছে এসে ভিড় করে। তারা নানা প্রশ্ন করে জঙ্গুরুল্লাকে। কারো প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে শুধু বলে, নয়াকান্দির হেকমতরে খুন কইর্যা ঐখানে পানির মইদ্যে জাইয়া থুইয়া গেছে।
কে? কে? কে খুন করছে? এক সাথে অনেক লোকের প্রশ্ন।
হেইডা পুলিসে বাইর করব। তোমরা কিন্তু পানিতে নাইম্যা না। লাশে আত দিও না। পুলিস আইয়া লাশ উডাইব। আমরা থানায় যাইতে আছি। তোমরা দুইজন দাঁড় টানার মানুষ দিতে পারবানি? ত্বরাত্বরি যাওন লাগব। উচিত পয়সা দিমু, খাওন দিমু। আবার বকশিশও দিমু।
ভিড়ের মাঝ থেকে চার-পাঁচজন হাত উঁচিয়ে নৌকায় কাজ করার ইচ্ছে প্রকাশ করে। তাদের মাঝ থেকে দু’জনকে বেছে নেয় জঙ্গুরুল্লা।
সে নাজুবিবির দিকে ফিরে বলে, ও হেকমতের মা, ঐ যে দেইখ্যা লও। তোমার পোলারে মাইর্যা ঐ খানে গুঁজাইয়া থুইছে। পুলিস আইয়া না উড়াইলে দ্যাখতে পাইবা না।
নাজুবিবি বিলাপ করতে করতে দাঁড়ায়। তার হাত ধরে দাঁড়ায় জরিনাও। পানির নিচে যেখানে লাশ রয়েছে সেদিকে তাকিয়ে নাজুবিবি আরো জোরে বিলাপ করতে শুরু করে।
আর দেরি করা ঠিক নয়। জঙ্গুরুল্লার নির্দেশে পানসি দিঘিরপাড়ের দিকে রওনা হয়। সেখান থেকে আরো সাক্ষী যোগাড় করে যেতে হবে থানায়।
ভাটি পানি, তার ওপর চার দাড়ের টান। পানসিটা ছুটে চলে।
হেকমতের মা ও বউকে তার খাস খোপে বসিয়ে জঙ্গুরুল্লা তালিম দেয়, থানায় গিয়ে কি বলতে হবে।
অল্প সময়ের মধ্যেই তারা দিঘিরপাড় নৌকাঘাটায় গিয়ে পৌঁছে। খাস খোপ থেকে বেরুবার আগে জঙ্গুরুল্লা নাজুবিবি ও জরিনাকে আর একবার সাবধান করে দেয়, কি কইছি, কানে গেছে তো? যেম্বায় যেম্বায় কইয়া দিছি, হেষায় হেম্বায় কইবা। আমিতো ওয়াদা করছিই, ঠিকঠিক মতন কাম ফতে অইলে কুড়ি নল জমি দিমু তোমাগ। কুড়ি নলে অনেক জমি, পরায় এগারো বিঘা। তোমরা ঠ্যাঙ্গের উপরে ঠ্যাঙ দিয়া রাজার হালে থাকতে পারবা। আর যদি উল্ট-পান্ডা কও, বোঝলানি, তয় আর তোমায় আড়ি আঁকখানও বিচরাইয়া পাওয়া যাইব না, কইয়া দিলাম।
জঙ্গুরুল্লা পানসি থেকে নামে। ঘাটের পুবদিকে একটা লঞ্চ দেখা যায়। ওটার পাশেই রয়েছে একটা পানসি। ঘাটের এক পান-বিড়ির দোকানদারকে জিজ্ঞেস করে সে জানতে পারে, ঐ ‘কুত্তা জাহাজে’ জেলার পুলিস সাব গতকাল দিঘিরপাড় এসেছেন। মূলচরের এক বাড়িতে কয়েক দিন আগে ডাকাতি হয়েছে। ডাকাতদের হাতে তিনজন খুনও হয়েছে। সেই মামলার তদন্তের তদারক করতে এসেছেন জেলার পুলিস সাব। থানার বড় দারোগাও এসেছেন।
এটাও আল্লার মেহেরবানি বলে মনে করে জঙ্গুরুল্লা। থানা পর্যন্ত তাকে আর কষ্ট করে যেতে হবে না।
জঙ্গুরুল্লা ঘাটমাঝির সাথে কথা বলে। সে-ও মাতব্বরের সাথে ডিঙিতে চড়ে হেকমতকে যেতে দেখেছে গতকাল বিকেল বেলা। খোঁজ করে এরকম আরো দু’জন সাক্ষী পাওয়া যায়।
ব্যস। আর দরকার নেই। জঙ্গুরুল্লা তিনজন সাক্ষীর নাম, পিতার নাম ও ঠিকানা একজনকে দিয়ে লিখিয়ে নেয়।
.
গতকাল দুপুরের পর থেকেই তদন্তের তদারক শুরু করেছেন জেলার পুলিস সুপারিনটেনডেন্ট। মামলার দু’জন প্রধান সাক্ষীকে গতকাল পাওয়া যায়নি। আজ ভোরেই তাদের জবানবন্দি শুনে তিনি তার তদারকের কাজ শেষ করেন।
বেলা প্রায় দশটা। সশস্ত্র পুলিস-প্রহরী-বেষ্টিত পুলিস সুপার এবং তার পেছনে বড় দারোগা ও স্থানীয় কিছু গণ্যমান্য লোক লঞ্চের দিকে আসছেন। তারা লঞ্চের কাছে আসতেই নাজুবিবি হাত জোড় করে কান্না-জড়ানো কণ্ঠে বলে, হুজুর আমি ইনসাফ চাই। আমার পোলারে খুন কইর্যা ফালাইছে।
সে আর কিছু না বলে বিলাপ করতে শুরু করে দেয়। বড় দারোগা এগিয়ে এসে নাজুবিবিকে বলেন, এই বুড়ি সরো, সরো, সরে দাঁড়াও সামনে থেকে। আমিই তোমার নালিশ শুনব একটু পরে।
পুলিস সুপার বাধা দিয়ে বলেন, ওয়াজেদ, লেট হার স্পীক। ও বুড়ি, কি হয়েছে বলো।
নাজুবিবি কাঁদতে কাঁদতে কি বলছে সবটা বুঝতে পারেন না পুলিস সুপার। জঙ্গুরুল্লা নাজুবিবির পাশেই ছিল জরিনাকে নিয়ে। সে নাজুবিবির হয়ে কথা বলতেই পুলিস সুপার বলেন, হু আর ইউ? আপনি কে?
আমার নাম জঙ্গুরুল্লা চৌধুরী। আমি চরের মাতব্বর।
আচ্ছা, বলুন কি হয়েছে।
জঙ্গুরুল্লা ঘটনার বিবরণ দিতে শুরু করে।
জঙ্গুরুল্লার কাছ থেকে কিছুটা শুনেই পুলিস সুপার বুঝতে পারেন–হেকমত নামের একটা লোককে ফজল নামের কোনো লোক বাড়ি থেকে ডেকে নিয়ে হত্যা করেছে এবং তার লাশ পানির নিচে লুকিয়ে রেখে গেছে। তিনি বড় দারোগাকে ডাকেন, ওয়াজেদ, দিস ইজ আ কেস অব কাপ্যাল হোমিসাইড। তুমি এদের নিয়ে লঞ্চে ওঠো। লঞ্চের কেবিনে বসেই এজাহার নেবে। আমি কেসটা সুপারভাইস করে ওখান থেকেই চলে যাব। তোমার নৌকা লঞ্চের সাথে বেঁধে দাও।
মাঝিকে তার পানসিটা লঞ্চের সাথে বাঁধবার নির্দেশ দিয়ে নাজুবিবি ও জরিনাকে নিয়ে বড় দারোগা লঞ্চে ওঠেন।
জঙ্গুরুল্লা হাতের ইশারায় কেরামতকে ঘটনাস্থলে যাওয়ার নির্দেশ দিয়ে নিজে তিনজন সাক্ষী নিয়ে লঞ্চে ওঠে। তাদের দেখে বড় দারোগা ভ্রু কুঁচকে জিজ্ঞেস কনে, এরা কারা?
ওরা সাক্ষী।
বড় দারোগা জঙ্গুরুল্লার কার্যকলাপ সম্বন্ধে ভালো করেই জানেন। এ ব্যাপারটায় তার উৎসাহ-উদ্যোগ দেখে তার সন্দেহ জাগে। তিনি বলেন, ওদের আমার পানসিটায় উঠিয়ে দিন। আর আপনি সারেং এর কাছে গিয়ে বসুন। তাকে আপনিই পথ দেখিয়ে নিয়ে যাবেন।
শিকলে-বাঁধা উত্তেজিত কুকুরের মতো। ঘঁউ-ঘঁউ-ঘঁউৎ’ শব্দে সিটি বাজিয়ে লঞ্চ রওনা হয়।
এজাহার নেয়ার আগে বড় দারোগা লঞ্চের দু’নম্বর কেবিনে বসে প্রথমে নাজুবিবি ও পরে জরিনাকে আলাদা করে জিজ্ঞাসাবাদ করেন। ঘটনার বর্ণনায় মৃত হেকমতের মা যে বিবরণ দিচ্ছে, তার সাথে একেবারেই মিল খাচ্ছে না মৃতের স্ত্রীর বিবরণ। তিনি পুলিস সুপারের কেবিনে গিয়ে বলেন, স্যার আসল ঘটনাটা কী, বুঝতে পারছি না। শাশুড়ি বলছে এক রকম আর বউ বলছে আর এক রকম। দু’রকম ঘটনা পাচ্ছি।
কি রকম?
মা বলছে–গতকাল সন্ধ্যার কিছু পরে সের কয়েক চাল নিয়ে হেকমত বাড়ি যায়। তার কিছুক্ষণ পরই এরফান মাতব্বরের ছেলে ফজল মাতব্বর ও আরো দু’জন হেকমতকে ডেকে নিয়ে যায়। ছেলের জন্য ভাত রান্না করে সে আর তার ছেলের বউ সারারাত জেগে প্রতীক্ষা করে। কিন্তু সে আর ঘরে ফেরেনি। ভোরে লোকজনের কাছে খবর পায়, গুনগার খাড়ির মধ্যে হেকমতের লাশ পড়ে আছে। আর বউ বলছে–হেকমত গতকাল সন্ধ্যার কিছু পরে সের তিনেক কাকর-মেশানো চাল নিয়ে বাড়ি আসে। ঘরে ভাতের সাথে খাওয়ার কিছু না থাকায় সে একটা মাছ রাখার জাল নিয়ে শুধু হাতে গর্তের বেলে মাছ ধরার জন্য নদীতে যায়। বউ আর শাশুড়ি চালের কাঁকর বেছে ভাত রান্না করে বসে থাকে সারা রাত। কিন্তু হেকমত আর ঘরে ফিরে আসে না। ভোরে জঙ্গুরুল্লা এসে বউ আর শাশুড়িকে তার পানসিতে তুলে গুনগার খাড়িতে নিয়ে যায়। সেখানে সে একটা জায়গা দেখিয়ে বলে, হেকমতকে কারা খুন করে ঐ জায়গায় লুকিয়ে রেখেছে।
হেকমতকে কে মার্ডার করেছে সে সম্বন্ধে কিছু বলছে বউটা?
না স্যার। সে জানে না, এমন কি সন্দেহও করে না, কে তার স্বামীকে মার্ডার করেছে।
ঐ যে চৌধুরী, কি চৌধুরী যেন নাম?
জঙ্গুরুল্লা চৌধুরী। কিন্তু লোকে বলে, পা-না-ধোয়া জঙ্গুরুল্লা।
পা-না-ধোয়া জঙ্গুরুল্লা! সেটা আবার কি রকম নাম?
চৌধুরী খেতাব নিজে নিয়েছে। আগে নাকি সে অন্যের জমিতে কামলা খাটত। সে সময়ে এক বিয়ের মজলিসে পা না-ধুয়ে ফরাসের ওপর গিয়ে বসেছিল। আর তাতে পায়ের ছাপ পড়েছিল ফরাসে। সেই থেকে তার নাম হয়েছে পা-না-ধোয়া জঙ্গুরুল্লা।
ভেরী ইনটারেস্টিং। পা-না-ধোয়া লঞ্চে এসেছে তো?
হ্যাঁ স্যার। লোকটা মিথ্যা মামলা সাজাতে ওস্তাদ।
ডাকো তাকে।
জঙ্গুরুল্লা এসে পুলিস সুপার জিজ্ঞেস করেন, কি মিয়া চৌধুরী, মামলাটা সাজিয়ে এনেছেন, তাই না?
না হুজুর, সাজাইয়া আনমু ক্যান!
শাশুড়ি বলছে–হেকমতকে ফজল মাতব্বর ঘর থেকে ডেকে নিয়ে মার্ডার করেছে। আর বউ বলেছে, সে হাতিয়ে মাছ ধরতে গিয়েছিল। সে বলতে পারে না, কে তার স্বামীকে মার্ডার করেছে।
তালিম দেয়ার সময় বউটা চুপচাপ ছিল। এত সাবধান করা সত্ত্বেও, এত ভয় দেখানো সত্ত্বেও সে তার নিজের ইচ্ছে মতো যা-তা আবোল-তাবোল বলেছে। জঙ্গুরুল্লার ভেতরটা জ্বলে ওঠে রাগে। মনের আক্রোশে মনেই চেপে সে বলে, হুজুর, ঐ ফজল আছিল বউডার পরথম সোয়ামি। তার লগে এখনো ওর পিরিত আছে। ওর লগে যুক্তি কইরাই ফজল হেকমতরে খুন করছে।
অ্যাঁ তাই?
হ, হুজুর, ঐ মাগিডারেও অ্যারেস্ট করন লাগব। ফজলের নৌকায় কাইল হেকমতরে দ্যাখা গেছে। সাক্ষীও আছে।
কোথায় সাক্ষী?
হুজুর, এইখানেই আছে। ডাক দিমু তাগো?
হ্যাঁ, তাদের ডেকে নিয়ে আসুন।
সারেংকে পথের নির্দেশ দিয়ে ঘাট-মাঝি ও আরো দু’জন সাক্ষীকে জঙ্গুরুল্লা এনে হাজির করে।
এক এক করে সাক্ষীদের জিজ্ঞাসাবাদ করেন পুলিস সুপার নিজে। তিনজন সাক্ষীই বলে, তারা ফজল, চান্দু ও বক্করের সাথে হেকমতকে নৌকায় করে বাড়ির দিকে যেতে দেখেছে। তারা আরো বলেহেকমত সিঁদকাটা দাগি চোর। সে যে দাগি চোর তা থানার রেকর্ডে আছে বলে বড় দারোগাও জানান।
পুলিস সুপারের মনে আর কোনো সন্দেহ নেই। তিনি পরিষ্কার বুঝতে পারেন, বাড়ি যাওয়ার জন্য হেকমত দিঘিরপাড় থেকে ফজলদের নৌকায় ওঠে। পথের কাঁটা সরাবার এটাই সুযোগ মনে করে ফজল ওকে চুরির বা অন্য কিছুর প্রলোভন দেখায়। হেকমত রাজি হয়ে চাল রেখে আসার জন্য বাড়ি যায়। ওর ফিরে আসতে দেরি দেখে ফজল ওর বাড়ি গিয়ে ওকে ডেকে নিয়ে আসে। তরপরই এ হত্যা। তিনি বড় দারোগাকে নাজুবিবির কথা মতো এজাহার নেয়ার আদেশ দেন।
.
লঞ্চ ঘটনাস্থলে পৌঁছে। পুলিস সুপার ও বড় দারোগা কেবিন থেকে বেরিয়ে দেখেন, পাড়ে বহু লোকরে ভিড়। এ-চর ও-চর থেকে বহুলোক হেঁটে, নৌকা করে জমায়েত হয়েছে।
ভিড়ের মাঝ থেকে কয়েকজন বলে ওঠে, উই যে পাও দ্যাহা যায়।
এখন পুরো ভাটা। লাশের দুটো পায়ের পাতা জেগে উঠেছে।
ঐ হানে ধানখেতের মইদ্যে একটা কালা গঞ্জি পইড়া রইছে। আঙুল দিয়ে দেখিয়ে বলে কয়েকজন।
বড় দারোগা দু’জন সেপাই নিয়ে পাড়ে নামেন। জঙ্গুরুল্লাও নামে তাদের সাথে । ধানখেতের এক ধানছোপের ওপর পাওয়া যায় দলামুচড়ি করা একটা কালো গেঞ্জি। ওটার প্যাঁচ ছাড়িয়ে কাগজের একটা ছোট পুটলিও পাওয়া যায়। পুটলির ভেতর কিছু সাদা গুড়ো।
বড় দারোগা গুঁড়োর কিছুটা দুই আঙুলে তুলে ডলা দিয়ে চেনবার চেষ্টা করছেন জিনিসটা কি। তার চেনার আগেই ভিড়ের মাঝ থেকে কয়েকজন বলে, ওগুলা খাওইন্যা সোড়া। শূলবেদনার লেইগ্যা হেকমত খাইত।
ওগুলো দেখে পুলিস সুপারের ঠোঁটের কোণে কৌতুকের মৃদু হাসি ফুটে ওঠে। তিনি তার কথায় রসান দিয়ে বলেন, খুবই ভালো আলামত। খুনিদের তো বেশ বিবেক-বিবেচনা আছে হে। কি বলো ওয়াজেদ?
জ্বী স্যার। গেঞ্জি আর সোডা ভিজে নষ্ট হতে দেয়নি খুনিরা। কষ্ট করে গেঞ্জিটা খুলে যত্ন করে রেখে দিয়েছে। কৌতুকের হাসি তারও মুখে।
এ বিবেক-বিবেচনার জন্য খুনিদের পুরস্কার পাওয়া উচিত, কি বলো?
জ্বী স্যার, অবিশ্যি পাওয়া উচিত।
বড় দারোগার নির্দেশে দু’জন কনস্টেবল ও একজন মাঝি পানিতে নামে। কোমর সমান পানি। পা, বুক ও পেটের তলায় হাত দিয়ে তারা লাশটা ওপরে তুলবার চেষ্টা করে। পা থেকে বুক পর্যন্ত সহজেই ওপরেই উঠছে। কিন্তু মাথার দিকটা বেশি উঠছে না। হাত দিয়ে হাতড়াতে হাতড়াতে তারা বুঝতে পারে, একটা হাত পাড়ের মাটির ভেতর ঢুকে আছে। পানিতে জাবড়ি দিয়ে একজন পা ধরে ও দু’জন হাত ধরে জোরে টান দিতেই হাতটা গর্ত থেকে বেরিয়ে আসে। লাশটা ওপর দিকে তুলতেই দেখা যায়, ওর দৃঢ়মুষ্টির ভেতর একটা পেট-গলে-যাওয়া মরা বেলে মাছ।
খুন অইছে ক্যাড়া কয়? ব্যাডাতো গদে আত দিছিল। ভিড়ের মাঝ থেকে একজন বলে।
আরে হ খুনই অইছে। আজরাইলে খুন করছে। আর একজন বলে।
হ ঠিকই, গদের মইদ্যেরতন আজরাইলে আত টাইন্যা ধইর্যা রাখছিল। অন্য একজন বলে।
আহারে, বাইল্যা মাছ ধরতে আইয়া ক্যামনে মানুষটা মইর্যা গেল। কার মরণ যে ক্যামনে লেইখ্যা থুইছে আল্লায়, কেও কইতে পারে না। আফসোস করে আরো একজন বলে।
পুলিস সুপার বড় দারোগাকে নিয়ে পানসিতে নেমে কাছে থেকে লাশ ওঠানো দেখছিলেন। লোকজনের কথাবার্তা তার কানে যায়। তিনি মনে মনে বলেন, লোকগুলো ঠিকই বলছে, সঠিক রায়ই দিয়েছে।
লাশটাকে তুলে পানসির আগা-গলুইয়ে পাটাতনের ওপর রাখা হয়।
দু’জন পুলিস অফিসারই তন্নতন্ন করে দেখেন লাশের কোথাও আঘাতের চিহ্ন আছে কিনা। কিন্তু আঘাতের কোনো চিহ্ন পাওয়া যায় না।
হঠাৎ কোমরের তাগায় বাঁধা এক টুকরো সুতলি দেখতে পান বড় দারোগা।
স্যার এই দ্যাখেন। এইটের সাথে বাঁধা ছিল মাছ রাখার জালটা। বউটা ঠিকই বলেছিল, মাছ রাখার জাল নিয়ে হেকমত হাতিয়ে বেলে মাছ ধরতে গিয়েছিল।
ইয়েস, ইউ আর রাইট। বেলে মাছের জন্য লোকটা গর্তে হাত দিয়েছিল। পানি আর বাতাসের চাপে ‘চোড় হয়ে যাওয়ায় সে আর হাতটা টেনে বার করতে পারেনি। ভেরি ভেরি আনফরচুনেট! মনে হয়, ও যখন জোর করে হাত বার করার চেষ্টা করছিল তখন মুঠোর চাপে মাছটার পেট গলে যায়। মরা মাছটা ডেথক্লাচ-এর ভেতর আটকে থাকে ডিউ টু ক্যাডাভেরিক স্প্যাজম্।
জ্বী স্যার। মেডিক্যাল জুরিসপ্রুডেন্স-এ পড়েছি।
বড় দারোগা নিচুস্বরে আবার বলেন, স্যার এইবার জালটা উদ্ধারের চেষ্টা করতে হয়। মনে হয় সুতলিটা কেটে জালটা কেউ নিয়ে নিয়েছে বা ফেলে দিয়েছে।
হ্যাঁ, তাই মনে হয়। ডাকো চৌধুরীকে। তাকে এবার জিজ্ঞাসাবাদ শুরু করো।
চৌধুরী গেলেন কোথায়? বড় দারোগা হাঁক দেন। এদিকে আসুন জলদি।
সবাই এদিক-ওদিক তাকায়।
আরে! পা-না-ধোয়া চৌধুরী গেল কোথায়? বড় দারোগা চারদিকে তাকান।
ভিড়ের লোকজন এতক্ষণে বুঝতে পারে, বড় দারোগা কোন লোকের খোঁজ করছেন। তারা সবাই জঙ্গুরুল্লার খোঁজ করে। কিন্তু তাকে আর ধারে-কাছে কোথাও খুঁজে পাওয়া যায় না।
ভিড়ের ভেতর থেকে দু-একজন গালাগাল দিয়ে বলে, হালার ভাই হালায় পলাইছে।
ততক্ষণে জঙ্গুরুল্লার পানসি এসে পৌঁছে। বড় দারোগা পানসি তল্লাশি করে ডওরার এক খোপ থেকে মাছ রাখার জালটা উদ্ধার করেন।
পুলিস সুপার বলেন, এটা পরিষ্কার ইউ.ডি.কেস। অস্বাভাবিক মৃত্যু হয়েছে লোকটার। তুমি সুরতহাল রিপোর্ট তৈরি করে। কিন্তু পোস্ট মর্টেম না করে মাটি দেয়া যাবে না। পা না-ধোয়া চৌধুরীকে ২১১ ধারায় প্রসিকিউট করার ব্যবস্থা করো। এ কেসের জন্যই লাশাটার ময়না তদন্ত হওয়া দরকার। নয় তো লাশটা মাটি দেয়ার অর্ডার দিয়ে যেতে পারতাম। তুমি লাশটা সাবডিভিশনাল হসপিটালে পাঠাবার ব্যবস্থা করো।
একটু থেমে তিনি আবার বলেন, চৌধুরীর মাঝি-মাল্লা আর ঐ বুড়িকে ভালো করে জিজ্ঞাসাবাদ করো। ওদের ধমক দিয়েই জঙ্গুরুল্লার সব কারসাজি বেরিয়ে পড়বে।
পুলিস সুপার লঞ্চে ওঠেন।
লঞ্চটা ‘ঘঁউ-ঘঁউ-ঘঁউৎ’ সিটি বাজিয়ে ঘটনাস্থল ত্যাগ করে।
.
৩২.
খুনের চর থেকে অপমানের বোঝা মাথায় নিয়ে বাড়ি ফিরেই বিছানা নিয়েছিল আরশেদ মোল্লা। অপমানের গ্লানির চেয়ে ভবিষ্যতের ভাবনা তাকে আরো বেশি মুসড়ে দিয়েছিল।
বেচকচরে বিঘা সাতেক জমি ছিল তার। গত বর্ষার আগের বর্ষায় বিঘা তিনেক পদ্মার জঠরে বিলীন হয়ে গেছে। বাকি চার বিঘা নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে গত বর্ষায়। খুনের চরে জঙ্গুরুল্লা তাকে কুড়ি নল–প্রায় এগারো বিঘা জমি দিয়েছিল। অনেক আশা নিয়ে সে রুয়েছিল কনকতারা ধান। সেই চরও বেদখল হয়ে গেছে। বসতভিটা ছাড়া আর এক কড়া জমিও তার নেই। এদিকে চালের দাম দিন দিন বেড়েই চলেছে। বউ-ছেলে-মেয়ে নিয়ে সে যে কোথায় যাবে, কি করবে, কি খাবে তার কুল-কিনারা করতে পারছিল না, বাঁচবার কোনো পথই খুঁজে পাচ্ছিল না সে।
সোনাইবিবিই শেষে তাকে একটা পথের সন্ধান দেয়। তার সাবেক মনিব ল্যাম্বার্ট সায়েব হয়তো এখনো আছেন নারায়ণগঞ্জে। তাঁর কাছে গেলে তিনি হয়তো তাঁর কুঠিরে বা পাটের গুদামে কোনো একটা কাজে লাগিয়ে দিতে পারেন।
আশা-নিরাশায় দ্বিধাগ্রস্ত মন নিয়ে আরশেদ মোল্লা নারায়ণগঞ্জ চলে গেছে আজ দশ দিন। এখনো সে ফিরে আসছে না কেন বুঝতে পারে না সোনাইবিবি।
সন্দেহের দোলায় দুলছে তারও মন। সায়েব কি তাদের এ দুর্দিনে মুখ ফিরিয়ে থাকবেন? কোনো সাহায্যই কি করবেন না?
সায়েব ও মেমসায়েব দু’জনই তাকে খুব স্নেহ করতেন। মালীর মেয়ে বলে এতটুকু ঘৃণা বা অবজ্ঞা করতেন না। তাঁদের চোখের সামনেই সে বড় হয়ে উঠছিল। খঞ্জন পাখির মতো সে লাফিয়ে বেড়াত সারা বাড়ি। দোলনায় দোল খেত। তাদের পোষা ময়নার সাথে কথা বলত। ফুল-পাতা ছিঁড়ে ফুলদানি সাজাত। কলের গান বাজাত। তার বিয়েতে তাঁরা অনেক টাকা খরচ করেছিলেন। বরকে যৌতুক দিয়েছিলেন নগদ দু’হাজার টাকা।
সোনাইবিবির স্পষ্ট মনে আছে, চাঁদ রায়-কেদার রায়ের কীর্তি রাজবাড়ির মঠ যেদিন পদ্মার উদরে বিলীন হয়ে যায়, তার ঠিক চারদিন আগে আরশেদ মোল্লা তাকে বিয়ে করে নিয়ে এসেছিল বেহেরপাড়া। তার চোখের সামনেই সে মঠটা কাত হয়ে নদীতে পড়তে দেখেছে। পড়ার সাথে সাথে বিশাল উত্তাল ঢেউ উঠেছিল। মঠবাসী হাজার হাজার পাখি উড়ছিল আর আর্তচিৎকার করছিল।
তার বছর তিনেক পর তার মা চন্দ্রভানের মৃত্যুর খবর পেয়ে সে স্বামীর সাথে নারায়ণগঞ্জ গিয়েছিল। সেখানে গিয়ে শুনতে পায় ল্যাম্বার্টদের একমাত্র সন্তান স্টিফেন বাপ মায়ের সাথে রাগ করে উড়োজাহাজে চাকরি নিয়েছিল। উড়োজাহাজ চালিয়ে সাগর পাড়ি দেয়ার সময় সে সাগরে ডুবে মারা গেছে। একটা অব্যক্ত বেদনায় সোনাভানের বুকের ভেতরটা মোচড় দিয়ে উঠেছিল।
দুবছরের রূপজানকে কোলে নিয়ে সোনাভান মেমসায়েবের সাথে দেখা করতে গিয়েছিল। তিনি শিশুটির দিকে পলকহীন দৃষ্টিতে চেয়েছিলেন কিছুক্ষণ। তারপর ওকে সস্নেহে কোলে তুলে নিয়েছিলেন। তক্ষুনি ড্রাইভার পাঠিয়ে ওর জন্য দোকান থেকে দামি কাপড় ও খেলনা আনিয়েছিলেন। ওর মুখে শরীরে পাউডার লাগিয়ে দিয়েছিলেন। নিজের চিরুনি দিয়ে চুল আঁচড়ে দিয়েছিলেন। নতুন ফ্রক পরিয়ে তাকে কোলে নিয়ে গিয়েছিলেন সায়েবের ঘরে। অনেকক্ষণ পর ফিরে এসে বলেছিলেন, মা, সোনাই, তোর মেইয়াটা আমাকে দিয়া দে। আমি পালবো। আমার তো আর কেউ নাইরে, মা!
সোনাভান চুপ করে ছিল। শোকার্ত মায়ের অন্তরের আকুতিকে সে মুখের ওপর ‘না’ বলে রূঢ় আঘাত হানতে পারেনি। মেমসায়েব তার মুখ দেখে ঠিকই বুঝেছিলেন, তার মৌনতা সম্মতির বিপরীত লক্ষণ। তাই এ সম্বন্ধে আর কিছু না বলে তিনি শুধু বলেছিলেন, তোর সোয়ামিরে লইয়া কাল ভোরে আমার সঙ্গে দেখা করিস।
সোনাভান আশঙ্কা করেছিল, আগামীকালও এই একই প্রস্তাব আসতে পারে। প্রস্তাবের সাথে আসতে পারে অনেক টাকার প্রলোভনও। আরশেদ মোল্লা যে রকম টাকার লোভী, সে কিছুতেই এ সযোগ পায়ে ঠেলে দেবে বলে তার মনে হয়নি। তাই সে স্বামীর কাছে কিছুই বলেনি। তাকে তাড়া দিয়ে সেদিনই রাতের স্টিমারে রওনা দিয়ে পরের দিন তারা রাজবাড়ি স্টেশনে এসে নেমেছিল।
মেমসায়েব তার এ অবাধ্য আচরণে নিশ্চয়ই খুব রুষ্ট হয়েছিলেন, বুঝতে পেরেছিল সোনাভান। তার মনে পুষে রাখা সে রাগ কি এতদিনেও মরে যায়নি।
তারও সাত-আট বছর পর আর একবার সে স্বামীকে নিয়ে নারায়ণগঞ্জ গিয়েছিল তার বাপের মৃত্যুর সময়। সেবার সে রূপজানকে সাথে নিয়ে যায়নি। এমন কি সায়েবের কুঠিতেও যায়নি। যেমন চুপিচুপি গিয়েছিল তেমনি চুপিচুপি তারা আবার ফিরে এসেছিল। তার মনে সব সময় একটা ভয় ছিল–মেমসায়েব হয় তো রূপজানকে নিজের কাছে রাখার জন্য জোরাজুরি করবেন।
তারপর অনেক বছর পেরিয়ে গেছে। সেদিনের সোনাভান বয়সের ভারে এখন সোনাইবিবি হয়েছে। সে হিসেব করে দেখে রূপজানকে নিয়ে মেম সায়েবের কাছ থেকে চলে আসার পর ষোল বছর পার হয়ে গেছে। সায়েব-মেম বেঁচে আছেন, না মরে গেছেন, নারায়ণগঞ্জে আছেন, না বিলেত চলে গেছেন–কোনো খবরই তারা রাখে না।
স্বামীর ফিরে আসতে দেরি দেখে সোনাইবিবিরি মনে হয়, সায়েব ও মেম দু’জনই বা তাদের একজন অন্তত বেঁচে আছেন এবং নারায়ণগঞ্জেই আছেন। তাঁদের কেউ না থাকলে আরশেদ মোল্লার এত দেরি হওয়ার কথা নয়। সে তাড়াতাড়িই বাড়ি ফিরে আসত।
এদিকে জঙ্গুরুল্লা রোজ দু’বার সকালে ও বিকেলে তোক পাঠিয়ে খবর নিচ্ছে, আরশেদ মোল্লা ফিরে এসেছে কিনা। প্রথম দিন কোরবান ঢালী এসেছিল চার-পাঁচজন লোক নিয়ে। তাদের সে কি হম্বি-তম্বি। তারা আরশেদ মোল্লাকে না পেয়ে জঙ্গুরুল্লার হুকুমে তার মেয়েকে নিয়ে যেতে চেয়েছিল। কিন্তু সোনাইবিবি ঘোমটার আড়াল থেকে কথার আঘাত মেরে তাদের এমন ধুনে দিয়েছিল যে তারা মা-বোনদের মর্যাদাহানিকর কোনো কথা বলতে আর সাহস পায়নি তারপর।
জঙ্গুরুল্লার লোক রোজই জানতে চায়, আরশেদ মোল্লা কোথায় গেছে। একমাত্র সোনাইবিবিই জানে সে কোথায় গেছে। কিন্তু সে একই কথা বলে তাদের বিদেয় করে, কই গেছে বাড়িতে কিছু কইয়া যায় নাই।
দুদিন আগে এদের কাছেই সোনাইবিবি শুনেছে–জঙ্গুরুল্লা ভাগ্যকূল গেছে। সেখান থেকে পীরবাবাকে নিয়ে সে দু-এক দিনের মধ্যেই ফিরে আসবে। পীরবাবা এসে গেলেই রূপজানের সাথে তার বিয়ের শুভকাজটা সম্পন্ন করার জন্য জঙ্গুরুল্লা ব্যতিব্যস্ত হয়ে উঠবে।
কিন্তু পীরবাবার জাদু-টোনায় কোনো কাজই যে হয়নি, কোনো আছরই যে পড়েনি রূপজানের ওপর! পীরের কথা সে শুনতেই পারে না। ফজল জেল থেকে ছাড়া পেয়ে বাড়ি এসেছে এবং খুনের চর আবার দখল করেছে শুনে সে যে কী খুশি হয়েছে, তা তার চলনে বলনে স্পষ্ট বোঝা যায়। সে আজকাল বিনা সাধাসাধিতেই খায়-দায়-ঘুমায়, মাথা আঁচড়ায়, সাজগোজ করে।
.
বারো দিন পর বাড়ি ফিরে আসে আরশেদ মোল্লা। আসে সারা মুখে খুশির জোছনা মেখে। সায়েব-মেম দুজনেই বেঁচে আছেন এবং ভালো আছেন, কিন্তু বেশ বুড়িয়ে গেছেন। সে নারায়ণগঞ্জে গিয়ে শোনে, সায়েব-মেম দুজনেই কলকাতা গেছেন। তাদের আসার অপেক্ষায় ছিল বলেই তার বাড়ি ফিরতে এত দেরি হয়েছে। কুঠিতে আগেকার বাবুর্চি-খানসামারাই কাজ করছে এখনো। তাদের সাথেই সে ছিল এ কদিন। নিতাইগঞ্জের দুটো গুদাম ছাড়া ল্যাম্ব্যার্ট জুট কোম্পানীর সবগুলো গুদাম এখন মিলিটারির দখলে। তারা সেগুলোর মধ্যে যুদ্ধের রসদ মজুদ করেছে। সোডা-ওয়াটার কারখানাটা দেড় বছর ধরে বন্ধ। ম্যানেজার নাকি অনেক টাকা মেরে নিয়ে উধাও হয়েছে।
আমারে দেইখ্যা, সায়েব-মেম পরথর চিনতেই পারে নাই। আরশেদ মোল্লা বলে।
চিনব ক্যামনে? সোনাইবিবি বলে। তহনতো ওনার দাড়ি আছিল না। দাড়ির লেইগ্যা চিনতে পারে নাই।
হ ঠিকই। নাম বললাম পর তারা এত খুশি অইছে যে কি কইমু! জানো, আমাগ বিচরাইতে সায়েব মানুষ পাডাইছিল বেহেরপাড়া। তারা ফিরত গিয়া সায়েবরে কইছে, বেহেরপাড়া নামে একটা গেরাম আছিল। হেই গেরাম এহন পদ্মার প্যাডের মইদ্যে। গেরামের মানুষ কে যে কুনখানে গেছে কেউ কইতে পারে না।
হ, ঠিক অইত, বেহেরপাড়ারতন গেলাম চাঁচরতলা, হেইখানতন চাকমখোলা। তারপর আইলাম এই নলতা। এতবার গাঙ্গে ভাঙলে মাইনষে বিচরাইয়া পাইব ক্যামনে?
তারা রূপুর কথা বারবার জিগাইছে। রূপু কত বড় অইছে। যহন বললাম, ওর বিয়া দিয়া দিছি, তহন দুইজনের কী রাগ! মেমসাহ কয়–আমারে এই খবরও দিলি না, নিমকহারাম। কার লগে বিয়া দিছস? যহন কইলাম, বড় একজন মাতবরের পোলার লগে বিয়া দিছি। জামাই নিজেই এহন মাতবর, তহন রাগটা এট্টু কমছে। মেমসাব আরো কইছে– বিয়ার খবর পাইলে ওর বিয়ার খরচ-পাত্তি সোনা-গয়না আমিই দিতাম। রূপুরে আর জামাইরে বেড়াইতে যাইতে কইছে। ওগ যাওনের ভাড়া দুইশ ট্যাহা দিয়া দিছে। ওরা গেলে মনে অয় অনেক ট্যাহা-পয়সা দিব, সোনা-গয়না দিব।
ইস। মাইনষের কী লোভ। কিন্তুক মিথ্যা কতা কইয়া আইছে ক্যান? মাইয়ার তালাক লইছে, হেই কতা ক্যান্ কয় নাই?
হোন রূপুর মা, তোমারে তো কই নাই। রূপুরে মাতবর বাড়ি দিয়া আইমু–এই ওয়াদা কইর্যা আইছিলাম খুনের চর ছাইড়া দিয়া আহনের সময়। তুমি কাইল ওরে লইয়া যাইও মাতবর বাড়ি। বিয়াই বাইচ্যা থাকলে আমিই যাইতাম।
কিন্তুক তালাক লওয়া মাইয়া ক্যামনে আবার দিয়া আইমু?
হোন, জোর কইর্যা তালাক নিছিলাম। ঐ তালাক জায়েজ অয় নাই। আমি মুনশি মৌলবিগ জিগাইছিলাম।
কিন্তু পা-না-ধোয়া গোঁয়ারডা কি এমনে এমনে ছাইড়া দিব! হে পীরবাবারে আনতে গেছে। লইয়াও আইছে মনে অয়। দিনের মইদ্যে দুইবার ওনার খবর লইতে আছে তার মানুষজন। আরেটু পরেই আবার আইয়া পড়ব।
হোন, আমি ঘরের মইদ্যে পলাইয়া থাকমু। ওরা আইলে কইও উনি এহনো আহে নাই। তারপর কাইল রাইত থাকতে তুমি রূপুরে সাথে লইয়া দিয়া আইও মাতবর বাড়ি। তুমি ফির্যা আইলে ঘরে তালা দিয়া আমরা কাইলই চইল্যা যাইমু নারায়ণগঞ্জ। জঙ্গুরুল্লা আর আমাগ কিছু করতে পারব না।
নারায়ণগঞ্জ যাইব, কিন্তুক কাম-কাইজের কতাত কিছু হুনলাম না।
কাম ঠিক অইয়া গেছে। ঐ সোডা-ওয়াটার কারখানা আমারে চালু করতে কইছে সায়েব। উনিই টাকা-পয়সা দিব। এহন ঢাকা-নারায়ণগঞ্জ বিদেশী সৈন্যে ভইরা গেছে। তাগো সরাব খাইতে সোডার পানি লাগে, সায়েব কইছে সোডারপানি এহন খুব চলব। সায়েব কইছে লাভের অর্ধেক আমার। আমাগ থাকনের লেইগ্যা ঘরও ঠিক কইরা দিছে। যাওনের খরচ দিছে তিনশ ট্যাহা। আরো দুইশ দিছে রূপু আর জামাইর যাওনের খরচ।
তয় আর দেরি করণের কাম নাই। ঐ দিগে খবর হুনছে? মোখে কাঁপোড় বাইন্দা তিনডা ব্যাডা হেকমইত্যা চোরার বউরে বাড়িরতন জোর কইরা ধইর্যা লইয়া গেছে। বউডার আর কোনো খোঁজ-খবর নাই। মাইনষে কয় জঙ্গুরুল্লার লোক বউডারে কাইট্যা গাঙ্গে ফালাইয়া দিছে।
ক্যাঁ?
ও, উনিতে হুইন্যা যায় নাই! হেকমইত্যা চোরা আতাইয়া বাইল্যা মাছ ধরতে গেছিল। গদে আত দিয়া আত আর টাইন্যা বাইর করতে পারে নাই। মইর্যা রইছিল পানি তলে। জঙ্গুরুল্লা ঐ লাশ দ্যাহাইয়া খুনের মামলা দিতে চাইছিল ফজলের বিরুদ্ধে। কিন্তু বউডা সত্য কতা কইছে। জঙ্গুরুল্লার কতা মতন দারোগা-পুলিসের কাছে সাক্ষী দেয় নাই বুইল্যা মামলা টিকাইতে পারে নাই। এই রাগে।
এই কয়দিনের মইদ্যে এত কিছু অইয়া গেছে! হোন রূপুর মা, আর দেরি করণ যাইব । রূপুরে মাতবর বাড়ি দিয়া কাইলই আমরা নারায়ণগঞ্জ চাইল্যা যাইমু।
হ, কাইলই যাওন লাগব। উনি এহন আফারে উইট্যা পলাইয়া থাকুক গিয়া।
.
সন্ধ্যার একটু পরেই সাতজন গাট্টাগোট্টা লোক নিঃশব্দে গিয়ে হাজির হয় আরশেদ মোল্লার বাড়ি। তাদের মাথার ফেটা ভুরু পর্যন্ত নামানো। চোখ বাদ দিয়ে সারা মুখ গামছা দিয়া বাঁধা। একজনের মুখমণ্ডল গামছার বদলে সাদা রূমাল দিয়ে বাঁধা। তাদের তিনজনের হাতে ঢাল-শড়কি, দুজনের হাতে ঢাল-রামদা আর দুজনের হাতে লাঠি ও টর্চলাইট। তারা পা টিপে টিপে উত্তর ভিটি ঘরের সামনের দরজার কাছে গিয়ে হাতিয়ারগুলো ঘরের পিড়ার নিচে নামিয়ে রাখে আলগোছে।
ঘরের দরজা বন্ধ। লাল গামছায় মুখ-বাঁধা দলের একজন ডাক দেয়, মোল্লার পো ঘরে আছেন নি?
ক্যাডা? ভেতর থেকে সাড়া দেয় সোনাইবিবি।
জঙ্গুরুল্লা চদরী সাব আমাগ পাইছে।
উনিতো এহনো বাড়িত আহে নাই।
কই গেছে?
কই গেছে, কিছু কইয়া যায় নাই।
হোনেন, আমাগ পাইছে আপনেগ নেওনের লেইগ্যা। পীরবাবা আইয়া পড়ছে। আইজ বোলে ভালো দিন আছে। আইজই কলমা পড়ান লাগব।
উনিতো বাড়ি নাই।
উনি বাড়ি নাই, আপনে তো আছেন। আমাগ কইয়া দিছে, মোল্লার পো না থাকলে আপনেরে লইয়া যাইতে। মাইয়া লইয়া, পোলাপান লইয়া চলেন শিগগির।
না, আমরা যাইতে পারমু না।
হোনেন চাচি, আমরা হুকুমের গোলাম। আমাগ কইছে ভালোয় ভালোয় না গেলে ধইর্যা উকাইয়া লইয়া যাইতে।
গোলামের ঘরের গোলামরা কয় কি। তোগ ঘরে কি মা-বইন নাই?
দ্যাহেন, গালাগালি দিয়েন না। ভালো অইব না।
এক শত্ বার দিমু। তোগ মা-বইনের নিয়া নিকা দে পীরের লগে। আরেক জনের বিয়াতো বউরে ক্যামনে আবার বিয়া দিতে চায় পা-না-ধোয়া শয়তান।
আরেকজন তো তালাক দিয়া দিছে।
না, জোর কইর্যা তালাক লইছে। ঐডা তালাক অয় নাই।
আমরা কিছু হুনতে চাই না। মাইয়া বাইর কইর্যা দ্যান। আপনেও চলেন পোলাপান লইয়া। পীরবাবা বিয়ার পাগড়ি মাতায় দিয়া বইয়া রইছে।
না, আমরা যাইমু না।
শিগগির দরজা খোলেন। নাইলে লাইথ্যাইয়া দরজা ভাইঙ্গা ফালাইমু।
লাল গামছাধারীর নির্দেশে নিজ নিজ হাতিয়ার হাতে নেয় সবাই।
পশ্চিম ভিটি ঘরের বাতি নিবে যায় হঠাৎ
সবুজ গামছাধারী একজন দরজায় লাথি মেরে দরজা খুলে ফেলে। কয়েকটি ছোট ছেলে-মেয়ে কেঁদে ওঠে ভয়ে।
একজন টর্চ হাতে আর একজন রামদা হাতে ঘরে ঢোকে। টর্চ মেরে তারা রূপজানের খোঁজ করে।
সোনাইবিবি বলে, মাইয়া নাই। জামাই আইয়া লইয়া গেছে।
মিছা কথা কওনের আর জায়গা পাওনা বেডি!
মিছা কতা কিরে। রামদা দেখেও সে ঘাবড়ায় না এতটুকু। তার ঘোমটার ভেতর থেকে গালাগালের ভিমরুল ছুটে আসে। কিন্তু লোকগুলো তা গ্রাহ্যের মধ্যেই নেয় না। তারা টর্চ মেরে চৌকির তলা, ধানের ডোল ইত্যাদি খুঁজতে থাকে।
হৈ-চৈ শুনে ডাকাত পড়েছে মনে করে আশপাশের লোক এগিয়ে আসছে এদিকে। যারা বাইরে দাঁড়িয়ে ছিল তারা চারদিকে টর্চের আলো ফেলে। একজন চিৎকার দিয়ে বলে, খবরদার! এই দিগে আইলে গুলি মাইরা দিমু। যার যার বাড়ি যাও। দরজা বন্দ কইর্যা হুইয়া পড় গিয়া।
আফারে উঠবার ফাঁকা জায়গা দিয়ে টর্চের আলো ফেলতেই আরশেদ মোল্লা বুঝতে পারে, আর লুকিয়ে থাকা সম্ভব নয়। সে আফার থেকে বলে, খবরদার মাইয়া লোকের গায় আত দিও না। আমি আইতে আছি।
সে নিচে নেমে বলে, মাইয়া বাড়িত নাই। জামাই আইয়া লইয়া গেছে। আইছেন যহন বিচরাইয়া দ্যাহেন।
সবুজ গামছাধারী টর্চ মেরে তন্নতন্ন করে খোঁজে। আফারে উঠে তালাশ করে, কিন্তু রূপজানকে পাওয়া যায় না।
বাইরে থেকে লাল গামছাধারী বলে, আরে তোরা আইয়া পড়। কুনখানে আছে বোঝতে পারছি।
তারা পশ্চিমভিটি ঘর ঘিরে ফেলে। ঘরের দুটো দরজাই ভেতর থেকে বন্ধ। ঘরে কে আছে, দরজা খোলো।
কেউ দরজা খুলছে না দেখে লাল গামছাধারী দমাদম লাথি মারে দরজার ওপর। অর্গল ভেঙ্গে দরজা খুলে যায় আর অমনি ভেতর থেকে শিশি, বোতল, খোঁড়া, বাটি ছুটে আসে লোকগুলোর দিকে। তারা ঢাল দিয়ে সেগুলো ফিরিয়ে আত্মরক্ষা করে। টর্চের আলোয় দেখা যায় রূপজান মরিয়া হয়ে হাতের কাছে যা পাচ্ছে তাই ছুঁড়ে মারছে।
আরে বোবা মিয়াভাই, ধরেন শিগগির। লাল গামছাধারী বলে। আমাগো মাথা ভাইঙ্গা ফালাইব।
মুখে সাদা রুমাল-বাঁধা লোকটা ঢাল দিয়ে নিজেকে বাঁচিয়ে এগিয়ে যায়।
রূপজান চিৎকার দিয়ে ওঠে, খবরদার আউগ্গাই না। দাও দ্যাখছস, জবাই কইরা ফালাইমু।
বোবা লোকটি এগিয়ে যায়। অন্য একজন লাঠির বাড়ি দিয়ে রূপজানের হাত থেকে দাটা ফেলে দেয়। সে এবার পেছনের দরজা খুলে নদীর দিকে দৌড় দেয়।
টর্চের আলো অনুসরণ করছে রূপজানকে। সাতজনই এবার তার পেছনে ধাওয়া করে।
শাড়ির আঁচলে পা আটকে রূপজান মাটিতে পড়ে যায়। তার ওপর টর্চের আলো ফেলে। সবুজ গামছাধারী বলে, ও বোবা মিয়াভাই, ধরেন জলদি। আমাগ তো আবার ধরন মানা।
বোবা লোকটি রূপজানকে ধরে ফেলে।
অ্যাই গোলামের ঘরের গোলাম, খবরদার আমার গায়ে আত দিস না।
আরে বাবা মিয়াভাই, পাতালি কোলে কইর্যা উড়াইয়া ফালান।
বোবা লোকটা রূপজানকে পাজাকোলা করে নদীর দিকে এগিয়ে যায়।
রূপজান হাত-পা ছুঁড়ছে, গালাগাল দিচ্ছে, আর দুহাত দিয়ে খামচে দিচ্ছে বোবা লোকটার শরীর। সেদিকে ভ্রূক্ষেপ না করে সে এগিয়েই যাচ্ছে। যেতে যেতে সে আঁ-আঁ আঁ শব্দ করে মাথা নেড়ে কিছু একটা ইশারা দেয়।
ইশারার ভাষা বুঝতে পেরে লাল গামছাধারী বলে, আপনেরা নায় উইট্যা বহেন। আমি আরশেদ মোল্লারে দাওয়াত দিয়া আহি।
রূপজানকে কোলে নিয়ে যোবা লোকটা নৌকায় ওঠে। কিন্তু রূপজানের আর সড়া পাওয়া যাচ্ছে না এখন। সে মূৰ্ছিত হয়ে পড়েছে।
লোকটা তাকে শুইয়ে দেয় পাটাতনের ওপর। স্খলিত আঁচল টেনে শরীর ঢেকে দেয়।
কিছুক্ষণ পর লাল গামছাধারী ফিরে এলে দুটো ডিঙি তাদের নিয়ে রওনা হয়।
অন্ধকারের মধ্যে কে একজন বলে ওঠে, অ্যাই তোরা এইবার মোখের কাপড় খুইল্যা ফ্যাল। আন্ধারে আর কেও দ্যাখব না। তারা তো ঢাল নিতে চাস নাই। ঢাল না নিলে আইজ উপায় আছিল না।
হ, শিশি-বোতল যেমনে উদ্দ মারতে আছিল, মাথা একজনেরও আস্ত থাকত না। আর একজন বলে।
হ মাথা ফাঁইট্টা চৌচির অইয়া যাইত। অন্য একজন বলে ।
অন্ধকার কেটে ডিঙি দুটো এগিয়ে যায়। বোবা লোকটা সস্নেহে হাত বুলায় রূপজানের গালে, কপালে, মাথায়।
অল্প সময়ের মধ্যেই ডিঙি দুটো গন্তব্যস্থানে পৌঁছে যায়। বোবা লোকটা রূপজানকে কোলে নিয়ে নৌকা থেকে নেমে এগিয়ে যায় একটি বাড়ির দিকে। ঘরের কাছে গিয়ে বোবাটা হঠাৎ কথা বলে ওঠে, ও মা, কই তুমি? শিগগির দরজা খোেল। তোমার গয়নার মানুষটারে লইয়া আইছি।
বরুবিবি দরজা খুলে দেয়। ফজল রূপজানকে শুইয়ে দেয় চৌকির বিছানায়।
আরে, এক্কেরে মাইরা লইয়া আইছস দেহি। ভীত কণ্ঠ বরুবিবির।
ও কিছু না। বেশ অইয়া গেছে। মোখে পানির ছিডা দ্যাও।
ও আমিনা, জলদি পানি আন, দাঁত লাইগ্যা গেছে। ও আমার সোনার চানরে, তোর কি অইলরে!
কোনো চিন্তা কইর্যা না। আমরা অ্যাকটা ফুলের টোকাও দেই নাই। ও-ই আমাগ মারছে।
ক্যান, আইতে চায় নাই?
জঙ্গুরুল্লার বাড়ি যাইতে চায় নাই। আমরাতো পা-না-ধোয়ার বাড়ি লইয়া যাইতে চাইছিলাম।
নূরুর দিকে ফিরে সে বলে, কয়েকটা লটার ডাণ্ডি লইয়া আয় গরুর বাথান তন।
নূরু বেরিয়ে গেলে গলা খাদে নামিয়ে সে আমিনাকে বলে, তুই লটা হেঁইচ্যা রস বাইর কর। ঘায়ে লাগইতে অইব। তোর ভাবিসাব আমারে খামচাইয়া কিছু রাখে নাই।
বেশ কিছুক্ষণ পর রূপজানের জ্ঞান ফিরে আসে। চোখ খুলেই তার মাথার কাছে উবু হয়ে বসা বরুবিবিকে দেখে সে ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে থাকে কিছুক্ষণ। তারপর মাথা উঠিয়ে দু’হাত বাড়িয়ে সে জড়িয়ে ধরে শাশুড়িকে।
.
রাত অনেক হয়েছে। ফজলের শিথিল বাহুবন্ধন থেকে মুক্ত হয়ে রূপজান বিছানা ছেড়ে ওঠে। বেশ-বাস ঠিক করে। হারিকেনের আলো বাড়িয়ে দেয়।
আমি বাইরে গেলাম। রূপজান বলে। দরজা কিন্তুক খোলা রইল।
যাও, আমি চাইয়া রইছি। ফজল বলে। গাঙ্গের ঘাটে কিন্তু যাইও না, জিনে ধইর্যা লইয়া যাইব।
কিছুক্ষণ পর রূপজান ফিরে এসে দেখে, ফজল চিত হয়ে শুয়ে আছে।
ঐ তাকের উপরে দ্যাখো বাটির মইদ্যে লটার রস আছে। ফজল বলে। ঐ রস ঘায়ে লাগাইয়া দ্যাও দেখি।
রূপজান বকের পালক ভিজিয়ে ফজলের হাত ও গলার নখের আঁচড়গুলোয় রস লাগাতে লাগাতে বলে, ইস! খামচি লাইগ্যা কি অইছে! তোমারে যদি চিনতে পারতাম, তয় কি এমুন কইর্যা খামচাইতাম!
খামচিতো আমারে দ্যাও নাই। খামচি দিছ জঙ্গুরুল্লার মানুষরে। তোমার খামচি খাইতে তখন এমুন মজা লাগতে আছিল, কি কইমু তোমারে। তোমার গালাগালিগুলাও বড়ই মিঠা লাগতে আছিল।
খামচি বোলে আবার মজা লাগে! গালাগালি বোলে আবার মিঠা লাগে!
হ, আমিতো তখন জঙ্গুরুল্লার মানুষ। তখন মনে অইতে আছিল, আরো জোরে খামচি দ্যায় না ক্যান, কামড় দ্যায় না ক্যান? আরে গালাগালি দ্যায় না ক্যান?
একটু থেমে ফজল আবার বলে, জোরজবরদস্তি কইর্যা তালাক নেওনের সময় তোমার বাপ, জঙ্গুরুল্লা, পুলিসের হাওয়ালদার আর ঐ সাক্ষী হারামজাদারা কইছিল–তুমি আমার ঘর করতে রাজি না। সেই কথা যাচাই করণের লেইগ্যা জঙ্গুরুল্লার মানুষ সাইজ্যা গেছিলাম। তুমি যদি বুইড়্যা পীরের লগে বিয়া বইতে রাজি অইয়া আমাগ নায় উঠতা, তয় কি করতাম জানো?
কি করতা?
মাঝ গাঙ্গে নিয়া ঝুপপুত কইর্যা ফালাইয়া দিতাম পানিতে।
রূপজান ফজলের বুকের ওপর ঢলে পড়ে। ফজল তার দুই সবল বাহু দিয়ে তাকে অপার স্নেহে, পরম প্রীতিতে জড়িয়ে ধরে বলে, আমরা জোড়াবান্দা কইতর-কইতরি। এই দুনিয়া জাহানের কেও আমাগো জোড়া ভাঙতে পারব না, কোনো দিন পারব না।
অসাধারণ
এতদিন কেন এই উপন্যাসের সন্ধান পাই নি, ভেবেই অবাক হচ্ছি। শেষটার জন্যই অপেক্ষা করে ছিলাম।