ষষ্ঠ পরিচ্ছেদ
১৮৮৪, ২১শে সেপ্টেম্বর
চৈতন্যলীলাদর্শন — গৌরপ্রেমে মাতোয়ারা শ্রীরামকৃষ্ণ
জগন্নাথ মিশ্রের ঘরে অতিথি আসিয়াছেন। বালক নিমাই সদানন্দে সমবয়স্যদের সহিত গান গাহিয়া বেড়াইতেছেন:
কাঁহা মেরা বৃন্দাবন, কাঁহা যশোদা মাই।
কাঁহা মেরা নন্দ পিতা, কাঁহা বলাই ভাই ৷৷
কাঁহা মেরি ধবলী শ্যামলী, কাঁহা মেরি মোহন মুরলী।
শ্রীদাম সুদাম রাখালগণ কাঁহা মে পাই ৷৷
কাঁহা মেরি যমুনাতট, কাঁহা মেরি বংশীবট।
কাঁহা গোপনারী মেরি, কাঁহা হামারা রাই ৷৷
অতিথি চক্ষু বুজিয়া ভগবানকে অন্ন নিবেদন করিতেছেন। নিমাই দৌড়িয়া গিয়া সেই অন্ন ভক্ষণ করিতেছেন। অতিথি ভগবান বলিয়া তাঁহাকে জানিতে পারিলেন ও দশাবতারের স্তব করিয়া প্রসন্ন করিতেছেন। মিশ্র ও শচীর কাছে বিদায় লইবার সময় তিনি আবার গান করিয়া স্তব করিতেছেন —
জয় নিত্যানন্দ গৌরচন্দ্র জয় ভবতারণ।
অনাথত্রাণ জীবপ্রাণ ভীতভয়বারণ ৷৷
যুগে যুগে রঙ্গ, নব লীলা নব রঙ্গ,
নব তরঙ্গ নব প্রসঙ্গ ধরাভার ধারণ।
তাপহারী প্রেমবারি, বিতর রাসরসবিহারী,
দীনআশ-কলুষনাশ দুষ্ট-ত্রাসকারণ।
স্তব শুনিতে শুনিতে ঠাকুর আবার ভাবে বিভোর হইতেছেন।
নবদ্বীপের গঙ্গাতীর — গঙ্গাস্নানের পর ব্রাহ্মণেরা, মেয়ে পুরুষ ঘাটে বসিয়া পূজা করিতেছেন। নিমাই নৈবেদ্য কাড়িয়া খাইতেছেন। একজন ব্রাহ্মণ ভারী রেগে গেলেন, আর বললেন, আরে বেল্লিক! বিষ্ণুপূজার নৈবিদ্যি কেড়ে নিচ্ছিস — সর্বনাশ হবে তোর! নিমাই তবুও কেড়ে নিলেন, আর পলায়ন করিতে উদ্যত হইলেন। অনেক মেয়েরা ছেলেটিকে বড় ভালবাসে। নিমাই চলে যাচ্ছে দেখে তাদের প্রাণে সইল না। তারা উচ্চৈঃস্বরে ডাকিতে লাগিল, নিমাই, ফিরে আয়; নিমাই ফিরে আয়। নিমাই শুনিলেন না।
একজন নিমাইকে ফিরাইবার মহামন্ত্র জানিতেন। তিনি “হরিবোল হরিবোল” বলিতে লাগিলেন। অমনি নিমাই ‘হরিবোল’ ‘হরিবোল’ বলিতে বলিতে ফিরিলেন।
মণি ঠাকুরের কাছে বসিয়া আছেন। বলিতেছেন, আহা!
ঠাকুর আর স্থির থাকিতে পারিলেন না। ‘আহা’ বলিতে বলিতে মণির দিকে তাকাইয়া প্রেমাশ্রু বির্সজন করিতেছেন।
শ্রীরামকৃষ্ণ (বাবুরাম ও মাস্টারকে) — দেখ, যদি আমার ভাব কি সমাধি হয়, তোমরা গোলমাল করো না। ঐহিকেরা ঢঙ মনে করবে।
নিমাই-এর উপনয়ন। নিমাই সন্ন্যাসী সাজিয়াছেন। শচী ও প্রতিবাসিনিগণ চতুর্দিকে দাঁড়াইয়া। নিমাই গান গাইয়া ভিক্ষা করিতেছেন:
দে গো ভিক্ষা দে।
আমি নূতন যোগী ফিরি কেঁদে কেঁদে।
ওগো ব্রজবাসী তোদের ভালবাসি,
ওগো তাইতো আসি, দেখ মা উপবাসী।
দেখ মা দ্বারে যোগী বলে ‘রাধে রাধে’।
বেলা গেল যেতে হবে ফিরে,
একাকী থাকি মা যমুনাতীরে
আঁখিনীরে মিশে নীরে,
চলে ধীরে ধীরে ধারা মৃদু নাদে।
সকলে চলিয়া গেলেন। নিমাই একাকী আছেন। দেবগণ ব্রাহ্মণ-ব্রাহ্মণী বেশে তাঁহাকে স্তব করিতেছেন।
পুরুষগণ — চন্দ্রকিরণ অঙ্গে, নমো বামনরূপধারী।
স্ত্রীগণ — গোপীগণ মনোমোহন, মঞ্জুকুঞ্জচারী।
নিমাই — জয় রাধে শ্রীরাধে।
পুরুষগণ — ব্রজবালক সঙ্গ, মদন মান ভঙ্গ।
স্ত্রীগণ — উন্মাদিনী ব্রজকামিনী, উন্মাদ তরঙ্গ।
পুরুষগণ — দৈত্যছলন, নারায়ণ, সুরগণভয়হারী।
স্ত্রীগণ — ব্রজবিহারী গোপনারী-মান-ভিখারী।
নিমাই — জয় রাধে শ্রীরাধে।
ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ এই গান শুনিতে শুনিতে সমাধিস্থ হইলেন। যবনিকা পতন হইল। কনসার্ট বাজিতেছে।
[“সংসারী লোক দুদিক রাখতে বলে” — গঙ্গাদাস ও শ্রীবাস ]
অদ্বৈতের বাটীর সম্মুখে শ্রীবাসাদি কথা কহিতেছেন। মুকুন্দ মধুর কণ্ঠে গান গাইতেছেন:
আর ঘুমাইও না মন। মায়াঘোরে কতদিন রবে অচেতন।
কে তুমি কি হেতু এলে, আপনারে ভুলে গেলে
চাহরে নয়ন মেলে ত্যজ কুস্বপন ৷৷
রয়েছো অনিত্য ধ্যানে নিত্যানন্দ হের প্রাণে,
তম পরিহরি হের তরুণ তপন ৷৷
মুকুন্দ বড় সুকণ্ঠ। শ্রীরামকৃষ্ণ মণির নিকট প্রশংসা করিতেছেন।
নিমাই বাটীতে আছেন। শ্রীবাস দেখা করিতে আসিয়াছেন। আগে শচির সঙ্গে দেখা হইল। শচী কাঁদিতে লাগিলেন। বলিলেন, পুত্র আমার গৃহধর্মে মন দেয় না।
‘যে অবধি গেছে বিশ্বরূপ,
প্রাণ মম কাঁপে নিরন্তর, পাছে হয় নিমাই সন্ন্যাসী।’
এমন সময় নিমাই আসিতেছেন। শচী শ্রীবাসকে বলিতেছেন —
‘আহা দেখ দেখ পাগলের প্রায়,
আঁখিনীরে বুক ভেসে যায়, বল বল এ ভাব কেমনে যাবে?’
নিমাই শ্রীবাসকে দেখিয়া তাঁহার পায়ে জড়াইয়া কাঁদিতেছেন — আর বলিতেছেন —
কই প্রভু কই মম কৃষ্ণভক্তি হলো,
অধম জনম বৃথা কেটে গেল।
বল প্রভু, কৃষ্ণ কই, কৃষ্ণ কোথা পাব,
দেহ পদধূলি বনমালী যেন পাই।
শ্রীরামকৃষ্ণ মাস্টারের দিকে তাকাইয়া কথা কহিতে যাইতেছেন, কিন্তু পারিতেছেন না। গদগদ স্বর! গণ্ডদেশ নয়নজলে ভাসিয়া গেল। একদৃষ্টে দেখিতেছেন, নিমাই শ্রীবাসের পা জড়াইয়া রহিয়াছেন। আর বলিতেছেন, ‘কই প্রভু কৃষ্ণভক্তি তো হল না।’
এদিকে নিমাই পড়ুয়াদের আর পড়াইতে পারিতেছেন না। গঙ্গাদাসের কাছে নিমাই পড়িয়াছিলেন। তিনি নিমাইকে বুঝাইতে আসিয়াছেন। শ্রীবাসকে বলিলেন — শ্রীবাস ঠাকুর, আমরাও ব্রাহ্মণ, বিষ্ণুপূজা করে থাকি, আপনারা মিলে দেখছি সংসারটা ছারখার করলেন।
শ্রীরামকৃষ্ণ (মাস্টারকে) — এ সংসারীর শিক্ষা — এও কর, ওও কর। সংসারী যখন শিক্ষা দেয়, তখন দুদিক রাখতে বলে।
মাস্টার — আজ্ঞা, হাঁ।
গঙ্গাদাস নিমাইকে আবার বুঝাইতেছেন — ‘ওহে নিমাই, তোমার তো শাস্ত্রজ্ঞান হয়েছে? তুমি আমার সঙ্গে তর্ক কর। সংসারধর্ম অপেক্ষা কোন্ ধর্ম প্রধান, আমায় বোঝাও। তুমি গৃহী, গৃহীর মতো আচার না করে অন্য আচার কেন কর?’
শ্রীরামকৃষ্ণ (মাস্টারকে) — দেখলে? দুইদিক রাখতে বলছে!
মাস্টার — আজ্ঞা, হাঁ।
নিমাই বলিলেন, আমি ইচ্ছা করে সংসারধর্ম উপেক্ষা করি নাই; আমার বরং ইচ্ছা যাতে সব বজায় থাকে। কিন্তু —
প্রভু কোন্ হেতু কিছু নাহি জানি,
প্রাণ টানে কি করি কি করি,
ভাবি কুলে রই, কুলে আর রহিতে না পারি,
প্রাণ ধায় বুঝালে না ফেরে,
সদা চায় ঝাঁপ দিতে অকুল পাথারে।
শ্রীরামকৃষ্ণ — আহা!