পঞ্চম পরিচ্ছেদ
১৮৮৪, ২১শে সেপ্টেম্বর
নাট্যালয়ে চৈতন্যলীলা — শ্রীরামকৃষ্ণ সমাধিস্থ
[মাস্টার, বাবুরাম, নিত্যানন্দবংশের ভক্ত, মহেন্দ্র মুখুজ্জে, গিরিশ ]
ঠাকুরের গাড়ি বিডন স্ট্রীটে স্টার থিয়েটারের সম্মুখে আসিয়া উপস্থিত। রাত প্রায় সাড়ে আটটা। সঙ্গে মাস্টার, বাবুরাম, মহেন্দ্র মুখুজ্জে ও আরও দু-একটি ভক্ত। টিকিট কিনিবার বন্দোবস্ত হইতেছে। নাট্যালয়ের ম্যানেজার শ্রীযুক্ত গিরিশ ঘোষ কয়েকজন কর্মচারী সঙ্গে ঠাকুরের গাড়ির কাছে আসিয়াছেন অভিবাদন করিয়া তাঁহাকে সাদরে উপরে লইয়া গেলেন। গিরিশ পরমহংশদেবের নাম শুনিয়াছেন। তিনি চৈতন্যলীলা অভিনয় দর্শন করিতে আসিয়াছেন, শুনিয়া পরম আহ্লাদিত হইয়াছেন। ঠাকুরকে দক্ষিণ-পশ্চিমের বক্সে বসানো হইল। ঠাকুরের পার্শ্বে মাস্টার বসিলেন। পশ্চাতে বাবুরাম, আরও দু-একটি ভক্ত।
নাট্যালয় আলোকাকীর্ণ। নিচে অনেক লোক। ঠাকুরের বামদিকে ড্রপসিন দেখা যাইতেছে। অনেকগুলি বক্সে লোক হইয়াছে। এক-একজন বেহারা নিযুক্ত, বক্সের পশ্চাতে দাঁড়াইয়া হাওয়া করিতেছে। ঠাকুরকে হাওয়া করিতে গিরিশ বেহারা নিযুক্ত করিয়া গেলেন।
ঠাকুর নাট্যালয় দেখিয়া বালকের ন্যায় আনন্দিত হইয়াছেন।
শ্রীরামকৃষ্ণ (মাস্টারের প্রতি, সহাস্যে) — বাঃ, এখান বেশ! এসে বেশ হল। অনেক লোক একসঙ্গে হলে উদ্দীপন হয়। তখন ঠিক দেখতে পাই, তিনিই সব হয়েছেন।
মাস্টার — আজ্ঞা, হাঁ।
শ্রীরামকৃষ্ণ — এখানে কত নেবে?
মাস্টার — আজ্ঞা, কিছু নেবে না। আপনি এসেছেন ওদের খুব আহ্লাদ।
শ্রীরামকৃষ্ণ — সব মার মাহাত্ম্য!
ড্রপসিন উঠিয়া গেল। এককালে দর্শকবৃন্দের দৃষ্টি রঙ্গমঞ্চের উপর পড়িল। প্রথমে, পাপ আর ছয় রিপুর সভা। তারপর বনপথে বিবেক, বৈরাগ্য ও ভক্তির কথাবার্তা।
ভক্তি বলিতেছেন, গৌরাঙ্গ নদীয়ায় জন্মগ্রহণ করিয়াছেন। তাই বিদ্যাধরীগণ আর মুনিঋষিগণ ছদ্মবেশে দর্শন করিতে আসিতেছেন।
ধন্য ধরা নদীয়ায় এলো গোরা।
দেখ, দেখ না বিমানে বিদ্যাধরীগণে, আসিতেছে হরি দরশনে।
দেখ, প্রেমানন্দে হইয়া বিভোল, মুনি ঋষি আসিছে সকল।
বিদ্যাধরীগণ আর মুনিঋষিরা গৌরাঙ্গকে ভগবানে অবতারজ্ঞানে স্তব করিতেছেন। ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ তাঁহাদের দেখিয়া ভাবে বিভোর হইতেছেন। মাস্টারকে বলিতেছেন, আহা! কেমন দেখো!
বিদ্যাধরীগণ ও মুনিঋষিগণ গান করিয়া স্তব করিতেছেন:
পুরুষগণ — কেশব কুরু করুণা দীনে, কুঞ্জকাননচারী।
স্ত্রীগণ — মাধব মনোমোহন মুহন মুরলীধারী।
সকলে — হরিবোল, হরিবোল, হরিবোল, মন আমার ।
পুরুষগণ — ব্রজকিশোর কালীয়হর কাতর-ভয়-ভঞ্জন।
স্ত্রীগণ — নয়ন বাঁকা, বাঁকা শিখিপাখা, রাধিকা হৃদিরঞ্জন।
পুরুষগণ — গোবর্ধনধারণ, বনকুসুমভূষণ, দামোদের কংসদর্পহারী।
স্ত্রীগণ — শ্যাম রাসরসবিহারী।
সকলে — হরিবোল, হরিবোল, হরিবোল, মন আমার।
বিদ্যাধরীগণ যখন গাইলেন —
নয়ন বাঁকা, বাঁকা শিখিপাখা, রাধিকা-হৃদিরঞ্জন’
তখন ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ গভীর-সমাধি-মধ্যে মগ্ন হইলেন। কনসার্ট (ঐকতানবাদ্য) হইতেছে। ঠাকুরের কোন হুঁশ নাই।