হরিশ মুখুজ্যে একজন, যাকে বলে, নিজেই নিজেকে গড়া মনুষ্য। সমাজসংসার থেকে তিনি কখনো কোনো সাহায্য বা দয়া পাননি, কখনো কারুর মুখাপেক্ষীও হননি। কুলীন বংশের সন্তান, তাঁর পিতার মোট তিনটি পত্নী এবং হরিশ পিত্ৰালয়ে বাস করার সুযোগ থেকে জন্ম থেকেই বঞ্চিত। তাঁর পিতা পুত্রোৎপাদন করেই তাঁর মাকে ধন্য করেছেন, সেই পুত্রের জন্য কোনো দায় তিনি নিজে কখনো বহন করেননি।
মামাবাড়িতে নাদরে অবহেলায় মানুষ হয়েছে হরিশ। মামারাও দরিদ্র, ভাগিনেয়র পড়াশুনোর জন্য পয়সা খরচ করতে তাঁরা পরাঙ্মুখ। এবং যেহেতু তাঁরা নিজেরাও কুলীন, সুতরাং তাঁদের নিজেদেরও তো সন্তানাদি কম নয়! বিদ্যালয়ে বিনা বেতনের ছাত্র হয়ে কিছুদিন পড়াশুনো করলো হরিশ, তারপর বিদ্যালয়ের পাঠ অসমাপ্ত রেখেই এক সময় তাকে বিদায় নিতে হলো। মামারা ইতিমধ্যেই তাদের নিজের ভার নিজেদের বুঝে নিতে বলেছেন। হরিশের ওপরে একটি ভাই আছে, কিন্তু সে একটি অপদাৰ্থ। কোনোরকম জীবিকার পথ না পেয়ে সে ইতিমধ্যেই একটি বিবাহ করে ফেলেছে। কুলিন-সন্তানের পক্ষে এটাই সহজতম কাজ।
সংসার প্রতিপালনের জন্য হরিশকে চোদ্দ বছর বয়েসেই চাকুরির সন্ধানে বেরিয়ে পড়তে হলো। কিন্তু যে-বালক একটিও পাশ করেনি, তাকে কে কাজ দেবে? ইংরেজের কেরানি উৎপাদনের জন্য প্রবর্তিত শিক্ষা প্ৰণালীর কুফল ইতিমধ্যেই ফলতে শুরু করেছে। অনেক পাশ করা যুবকই চাকুরির জন্য হন্যে হয়ে ঘোরে, কিন্তু সকলের উপযোগী চাকুরি নেই। বাড়তে থাকে বেকারের সংখ্যা।
হরিশ নিরুদ্যম না হয়ে ডাকঘরের সামনে দোয়াত-কলম নিয়ে বসতে লাগলো নিয়মিত। সামান্য দক্ষিণার বিনিময়ে লোকের মানি-অডার ফর্ম পূরণ করে কিংবা দরখাস্ত বা চিঠিপত্র লিখে দেয়। তার হস্তাক্ষর সুন্দর, ইংরেজি বানান নির্ভুল। এই জন্য সে কিছু কিছু কাজ পায়। কয়েক বছর এইভাবে কাটাবার পর এক নিলামওয়ালার নজর পড়লো হরিশের ওপর। ছেলেটি চিঠিপত্র খুব ভালো লেখে। সেইজন্য নিলামওয়ালা হরিশকে ডাকঘরের দরজা থেকে তুলে নিয়ে গিয়ে নিজের অফিসে কাজ দিল। মাস মাহিনা দশ টাকা।
কৈশোর বয়স থেকেই হরিশের বুকের মধ্যে প্রবল অভিমান ও ক্ষোভ জমে আছে। তার মনে হলো, এই সমাজ যেন ষড়যন্ত্র করে তাকে একজন দশ টাকা বেতনের কেরানি বানিয়ে রাখতে চায়। কিন্তু সে কিছুতেই এই ব্যবস্থা মেনে নেবে না। বংশ মর্যাদা কিংবা বিত্ত কোনোটাই তার নেই, শুধু রয়েছে ব্ৰাহ্মণত্বের অহংকার। সে বুঝলো এখনো বিদ্যার কদর আছে, এ যুগ ইংরেজি বিদ্যার যুগ, উত্তমরূপে ইংরেজি আয়ত্ত করতে পারলে সাহেবদের কাছে সমাদর পাওয়া যায়। বিদ্যাচর্চাই ব্ৰাহ্মণের বৃত্তি, সুতরাং শুদূর-কায়েতদের তুলনায় সে-ই বা পিছিয়ে থাকবে কেন?
হরিশ নিজের উদ্যমে বিদ্যাচর্চার জন্য কোমর বেঁধে লাগলো। সারাদিন আপিসের পরিশ্রমের পর সে চলে যায় পাবলিক লাইব্রেরিতে। হাতের কাছে যে-বই পায়, সেই বই-ই পড়ে ফেলে। খানকয়েক এডিনবরা ক্রনিকল পড়ে থাকে সামনের তাকে, সেগুলিই রোজ এসে পড়ে পড়ে মুখস্ত করা শুরু করলে সে। কবিতা মুখস্ত করার বদলে সংবাদপত্র মুখস্ত করলে দ্রুত ভাষা শিক্ষা করা যায়। বাড়িতে গিয়ে শুয়ে শুয়ে হরিশ বিড় বিড় করে, সেইদিন অধীত সংবাদপত্রের বিভিন্ন অনুচ্ছেদ আবৃত্তি করে।
ইংরেজি ভাষায় কিছুটা দক্ষতা অর্জনের পর হরিশ পড়তে শুরু করলে ইতিহাস, অর্থনীতি, দর্শন বিষয়ক গ্রন্থ। এই সদ্য যুবকের আর কোনো বাসনা নেই, আহার পরিচ্ছদ বিষয়ে হুঁশ নেই, একমাত্র নেশা বই পড়া।
দশ টাকা বেতনে আর কিছুতেই সংসারে ব্যয় সংকুলান হয় না। আবার সেই টাকা থেকেই কখনো কখনো হরিশ লোভ সংবরণ করতে না পেরে দু-একখানা পুস্তক ক্রয় করে ফেলে। নিলামওয়ালাকে একদিন হরিশ অনুরোধ জানালো কিছু বেতন বৃদ্ধি করার জন্যে। নিলামওয়ালা সে প্রস্তাবে তো কৰ্ণপাত করলোই না, উল্টে দু-একটা কটু কথা বলে ফেললো। সেদিনই এক কথায় কর্মত্যাগ করে বেরিয়ে এলো হরিশ।
আবার ডাকঘরের সামনে বসে দু-এক পয়সার বিনিময়ে দরখাস্ত ইত্যাদি লেখা। সেই সঙ্গে সঙ্গে পাবলিক লাইব্রেরিতে গিয়ে গ্ৰন্থপাঠ চলতে লাগলো সমান উদ্যমে। শিক্ষার ব্যাপারে তার কোনো গুরু নেই, সে নিজেই নিজের শিক্ষক। তার প্রধান সম্বল তার জেদ। এদিকে গৃহে ঘোর অশান্তি, অনিয়মিত উপার্জনে সংসার একেবারে পর্যুদস্ত। বয়স বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে তাঁর জননীর শুচিবাতিক বাড়ছে এবং আরও বেশী মুখরা হচ্ছেন। ভ্ৰাতৃজায়াটিও তেমন শান্ত প্রকৃতির নয়, সেইজন্য শাশুড়ি-বধূর ঝগড়ায় বাড়িতে আর কাক-চিল বসতে পারে না।
ডাকঘরের সামনে আসন পেতে দোয়াত-কলম নিয়ে বসে থাকতে থাকতে সদ্য যুবক হরিশের মনে হয়, এই সমাজ তাকে পায়ের তলায় চেপে রাখার চেষ্টা করছে। হৃদয়বৃত্তি প্রসারের তো সুযোগ দেবেই না, বরং প্রতিদিনই অনাহারে থাকার আশঙ্কা। তবু সে দাঁতে দাঁত চেপে বলে, পারবে না, কিছুতেই পারবে না। সে এই সমাজকে একহাত দেখে নেবার জন্য প্ৰতিদিন তীব্র শপথ গ্ৰহণ করে মনে মনে।
এক একদিন দ্বিপ্রহরে কোনো খাদ্য জোটে না, তবু অপরান্তে পাবলিক লাইব্রেরিতে সে যাওয়া বন্ধ করে না। গ্রন্থপাঠের ক্ষুধা তার দিন দিন বধিত হচ্ছে। প্রবল আত্মাভিমানের জন্য সে আর চাকুরিরদ উমেদারিতে লোকের দ্বারে দ্বারে ঘুরবে না ঠিক করেছে। এই সময় একদিন সংবাদপত্রে একটি বিজ্ঞপ্তি চোখে পড়লো তার। মিলিটারি অডিটর জেনারেলের আপিসে একজন কমীর পদ খালি হয়েছে। সে পদে নিয়োগের জন্য প্রার্থীদের মধ্য থেকে একজনকে বাছাই করা হবে। লিখিত পরীক্ষার ভিত্তিতে। মাহিনাও ভদ্রগোছের, মাসে পঁচিশ টাকা। হরিশ সেই পরীক্ষায় বসলো এবং প্রথম স্থান অধিকার করলো।
চাকুরিতে প্রতিষ্ঠিত হবার পর অনেকখানি স্থিতি এলো হরিশের জীবনে। এর পর সাধারণ মধ্যবিত্তদের জীবন যেভাবে চলে সেভাবেই হরিশের জীবন চালিত হবার কথা ছিল। কিন্তু হরিশ সে ধাতুতে গড়াই নয়। মায়ের অনুরোধে বিবাহ করতে হলো তাকে, কিন্তু সেই পত্নীর মৃত্যু হলো অবিলম্বে। অল্প দিনের মধ্যেই দ্বিতীয়বার দার পরিগ্রহ করলো। কিন্তু এ বিবাহও সুখের হলো না। পিতৃস্নেহ বঞ্চিত হরিশ বাল্যকাল থেকেই মাতৃভক্ত। কিন্তু তার মায়ের সঙ্গে বনিবনাও হলো না তার স্ত্রীর। তার মা পুত্রের বিবাহ দেবার জন্যও ব্যগ্র ছিলেন, আবার বিবাহিত পুত্রকেও বধূর কাছ থেকে সরিয়ে তিনি নিজে একলা আগলে রাখতে চান। বাঙালী পরিবারের সেই চিরকালীন শাশুড়ি-বধূর বিবাদ হরিশের বাড়িতে একেবারে সংহার মূর্তি ধারণ করলো। হরিশ মাকে কটু কথা বলতে পারে না আবার স্ত্রীকেও সান্ত্বনা দেবার কোনো উপায় নেই। আস্তে আস্তে সে সংসার সম্পর্কে উদাসীন হয়ে যেতে লাগলো।
তখন কিছুদিন ধর্মের দিকে ঝুঁকলো হরিশ। ঈশ্বরের প্রতি তার অগাধ বিশ্বাস। তার মতন এক সহায়সম্বলহীন বালকের প্রতি ঈশ্বর নজর রেখেছেন, তাই সে নিজের পায়ে দাঁড়াতে পেরেছে। নতুন আপিসে যোগ দেবার এক বৎসরের মধ্যেই পদোন্নতি হয়েছে তার। বেতন হয়েছে দ্বিগুণ, ঈশ্বরের দয়া ছাড়া কি এমন সম্ভব! মাত্র উনিশ বৎসর বয়েসী কজন যুবক এত টাকা মাহিনীর চাকুরি করে? প্রিন্স দ্বারকানাথের বিদ্রোহী পুত্র দেবেন্দ্ৰবাবু একেশ্বরবাদী ব্ৰাহ্মধর্ম প্রচার শুরু করলে হরিশ আকৃষ্ট হল সেদিকে। জননীর প্রবল আপত্তি অগ্রাহ্য করেও সে ব্ৰাহ্মধর্মে দীক্ষিত হলো এবং তার বাসস্থান এলাকা ভবানীপুরে ব্রাহ্মসমাজের একটি শাখা স্থাপন করে প্রবল উৎসাহ প্রচার করতে লাগলো এই নতুন ধর্মের বাণী।
কিন্তু শুধু ধর্মের কাছে আশ্রয় নিয়েই তার মন শান্ত হলো না। তার আরও কিছু চাই। ইতিমধ্যে সে আর একদিকে পরীক্ষা চালাতে লাগলো। তার নিজের যত্নে শেখা। ইংরেজি ভাষায় জ্ঞান ঠিক কতখানি হয়েছে, সেটা তার জানা দরকার। তার যে স্কুল-কলেজের কোনো ডিগ্রি নেই, সে চিন্তা প্রায়ই তাকে পীড়া দেয়। সে কিছু কিছু ইংরেজি রচনা পাঠাতে লাগলো পত্র পত্রিকায় ছদ্মনামে। সেগুলি সবই ছাপা হলো অনায়াসে। কাশীপ্রসাদ ঘোষের হিন্দু ইণ্টেলিজেন্সার পত্রিকায় ছাপা হলো তার বেশ কয়েকটি রচনা। বাবু কাশীপ্রসাদ বিখ্যাত ইংরেশ নবীশ, তবু হাজার হোক তিনি একজন নোটিব। এবার হরিশ তার রচনা প্রেরণ করলো সাহেবদের বিখ্যাত পত্রিকা ইংলিশম্যান-এ। সেই পত্রিকার সম্পাদক মিঃ কব হ্যারি সেই রচনা শুধু যে সাগ্রহে প্রকাশ করলেন। তাই নয়, তিনি অনুসন্ধান করলেন এই অজ্ঞাতনামা লেখকটি কে, যার লেখনী এত ক্ষুরধার, যার ইংরেজি ভাষাজ্ঞান একেবারে সাচ্চা ইংরেজদের মতন। এবার হরিশের আত্মবিশ্বাস দৃঢ় ভিত্তির ওপর প্রতিষ্ঠিত হলো। সমাজে আর কেউ তাকে অগ্রাহ্য করতে পারবে না!
বিলাত থেকে প্ৰকাশিত ইংরেজি ভাষার পত্র-পত্রিকা এবং ইংরেজি গ্ৰন্থরাজি গোগ্রাসে গেলার ফলে একদিকে যেমন সে ব্রিটিশ জাতির ইতিহাস, তাদের সামাজিক রীতিনীতি ও রাজ্যশাসন প্ৰণালী সম্পর্কে অনেক কিছু জেনে গেল, সেই রকম অন্যদিকেও তার এক নতুন জ্ঞানের উন্মেষ হলো। প্ৰায় বাল্যকাল থেকেই সে ইংরেজি সভ্যতার অনুরাগী। কিন্তু তাদের সম্পর্কে অনেকখানি জ্ঞান আহরণের পর সে এই সভ্যতার কিছু বৈপরীত্যেরও হদিশ পেল। ইংরেজরা স্বাধীনতা নামক বস্তুটিকে অতিশয় শ্রদ্ধা করে, স্বদেশে ইংরেজ তার সন্তানদের স্বাধীনচেতা এবং স্বাধীনতার প্রহরী হবার শিক্ষা দেয়, কিন্তু সেই ইংরেজই অন্য জাতির স্বাধীনতার কোনো তোয়াক্কা করে না। ইংরেজদের রচনা পড়েই হরিশের মনে আস্তে আস্তে স্বাধীনতার বোধ জাগতে লাগলো। সে চতুর্দিকে মুখ ঘুরিয়ে দেখে বুঝতে পারলো, তার দেশবাসীর মধ্যে এই বোধের এত অভাব! সেইজন্যই বুঝি ইংরেজ আজ ভারতবাসীকে মানুষ বলেই গণ্য করে না। ইংরেজ এ দেশ জয় করেছে বটে, কিন্তু এ দেশ শাসন করার ব্যাপারে কোনো ভারতীয়ের কোনো মতামত ধর্তব্যের মধ্যেই আনে না। এমনটি তো মুঘল আমলেও হয়নি! হরিশ ঠিক করলো, ইংরেজের কাছ থেকে দেশের জন্য যতখানি সুযোগ-সুবিধা আদায় করা যায়। সেজন্য সে কলম ধারণ করবে। কিছুদিন পরে সাংবাদিক হিসেবে বেশ খ্যাতি অর্জনের পর তার হাতে এসে গেল হিন্দু পেট্রিয়ট নামে একটি পত্রিকার পুরোপুরি সম্পাদনার ভার। এবার তার লেখনী থেকে আগুন ঝরতে লাগলো।
এখন হরিশ মুখুজ্যে দেশের কেউকেটাদের মধ্যে স্থান পেয়েছেন, এক ডাকে সকলে তাঁকে চেনে। স্বয়ং লর্ড ক্যানিং পেয়াদা পাঠিয়ে হিন্দু পেট্রিয়টের কপি অগ্রিম সংগ্রহ করে নিয়ে যান। সমাজের প্রধান ব্যক্তির হরিশকে স্কন্ধে তুলে নাচতে পারলে যেন বর্তে যান। সমাজের একেবারে নিম্নতলা থেকে হরিশকে এক পা এক পা করে এই শীর্ষস্থানে উঠতে হয়নি, তাঁর উত্তরণ লফে লফে। সেই একই অফিসে তিনি এখন চারশত টাকা বেতনে অতি উচ্চপদে অধিষ্ঠিত। হিন্দু পেট্রিয়ট চালাবার জন্য তিনি নিজে অকাতরে অর্থ ব্যয় করেন। ব্রিটিশ ইণ্ডিয়া অ্যাসোসিয়েশন, যেখানে শুধু জমিদার এবং অতি ধনাঢ্য এবং অতি খ্যাতিমান মানুষরাই সভ্য, সেখানে হরিশকেও সভ্য পদে বরণ করে নেওয়া হয়েছে এবং হরিশ সেখানে কিছু রাজনৈতিক কাজকর্ম শুরু করে দিয়েছেন। ইতিমধ্যে তিনি মনোযোগ দিয়ে অধ্যয়ন করেছেন আইন।
সিপাহী যুদ্ধ চলাকালীন হরিশের পত্রিকা একদিকে যেমন সিপাহীদের দুষ্কর্মের সমালোচনা করেছে, সেইরকমই প্রতিশোধ স্পৃহায় ইংরেজরা যখন উন্মত্ত হয়ে উঠলো, তখন তাদের সংযত হবার জন্য হরিশ যুক্তিতর্কের জাল বিস্তার করেছেন নিপুণভাবে। সেই সময় লেখনী চালনার জন্য তিনি আহার নিদ্রারও সময় পাননি।
সিপাহী যুদ্ধ নিবৃত্ত হবার পর হরিশের মধ্যে আর একটা পরিবর্তন এলো। ইংরেজের হাতে এই দেশ যে কতখানি অসহায়, তা যেন তিনি নতুনভাবে অনুভব করলেন। ইংরেজ দু-চারটি ভারতীয়ের সঙ্গে হৃদ্যতাপূর্ণ ব্যবহার করতে পারে। কিন্তু আবার যে-কোনো সময়ে সমগ্ৰ ভারতীয় জাতিকে অবমাননা করতে কিংবা যে-কোনো প্রকার শাস্তি দিতে তাদের কোনো দ্বিধা নেই। সাধারণ মানুষের কোনো নিরাপত্তা নেই। ইংরেজের হাতে।
সিপাহীদের বিদ্রোহ এক হিসেবে ব্যর্থ হলো না। সিপাহীরা যুদ্ধে হেরে গেল বটে, কিন্তু এই উপলক্ষে অনেক মানুষের মনে জেগে উঠলো দেশাত্মবোধ।
হরিশ ধনী সমাজের নয়নের মণি হয়ে উঠলেও তাদের সঙ্গ তাঁর বেশীদিন ভালো লাগলো না। তিনি যে অতি দরিদ্র পরিবারের সন্তান, এ কথা তিনি কিছুতেই ভুলতে পারেন না। তাঁর যখন অর্থ ছিল না, গ্ৰতিপত্তি ছিল না, তখন কেউ তো তাঁর দিকে ফিরেও চায়নি। এখন ধনীরা তাঁদের গৃহে খানাপিনার জন্য হরিশকে ডাকেন। কিন্তু হরিশ। তখনো তাঁদের কঠোর কথা শুনিয়ে দিতে দ্বিধা করেন। না। একমাত্র নবীনকুমার সিংহের সঙ্গেই তাঁর বেশ সৌহাদ্য জন্মে গেল। বয়সের যথেষ্ট ব্যবধান থাকা সত্ত্বেও তাঁরা পরস্পরকে তুমি সম্বোধন করেন।
ধনীদের থেকে মুখ ফিরিয়ে হরিশ মনোযোগ দিলেন দেশের সাধারণ মানুষের দিকে। সিপাহী বিদ্রোহ প্রশমিত হবার ঠিক পরেই হরিশ ঘুরে এলেন নদীয়ার যশোহরের কয়েকটি স্থান। পল্লীবাসীদের দুঃখ-দুৰ্দশা তিনি দেখে এলেন স্বচক্ষে। নানাপ্রকার নিপীড়ন, নিযাতন তো আছেই, ইদানীং কয়েক বৎসর ধরে নীলকরদের অত্যাচারে গ্রামের কৃষকদের মধ্যে একেবারে হাহাকার পড়ে গেছে। তাদের কথা কেউ জানে না। সেই সব অসহায় মানুষদের আর্তনাদ শহরে এসে পৌঁছয় না। হরিশ ঠিক করলেন, এবার থেকে এইসব মানুষদের কথা তিনি লিখবেন। কলম হাতে নিয়ে তিনি নীলকর সাহেবদের সঙ্গে দ্বন্দ্বযুদ্ধে অবতীর্ণ হলেন।
সারাদিন আপিসে পরিশ্রমের সঙ্গে তিনি তাঁর দায়িত্ব পালন করেন, তারপর সন্ধ্যাকালে এসে বসেন তাঁর পত্রিকার দফতরে। একই তিনি পৃষ্ঠার পর পৃষ্ঠা লিখে ভরিয়ে দেন।
নবীনকুমার একদিন এলো হরিশের পত্রিকা কার্যালয়ে। বিক্রমোর্কশী অভিনয়ের সাফল্যের পর সে আবার নতুন কিছু করতে চায়। এ বিষয়ে সে পরামর্শ চায় হরিশের। কিন্তু সম্প্রতি হরিশ বিদ্যোৎসাহিনী সভায় আসা বন্ধ করেছেন।
নবীনকুমারকে দেখে হরিশ বললেন, বসে। আগে লেখাগুলো শেষ করে নেই, তারপর তোমার সঙ্গে কিতা কইব।
নবীনকুমার চুপ করে বসে দেখতে লাগলো। এবং তার বিস্ময় বর্ধিত হতে লাগলো। উত্তরোত্তর। একটি ছোট টেবিল ও একটি কেরাসিন কাষ্ঠের চেয়ারে হরিশ বসেন। ঐ রকমই। আর তিনটি চেয়ার ও একটি আলমারি এই নিয়ে হরিশের বিখ্যাত হিন্দু পেট্রিয়টের দফতর। নিচের তলায় ছাপাখানা। হরিশের টেবিলের ওপর একটি সেজ বাতি জ্বলছে। তার পাশে একটি গেলাস ও একটি বড় ব্র্যাণ্ডির বোতল। হরিশ গভীর মনোনিবেশের সঙ্গে লিখে চলেছেন আর মধ্যে মধ্যে অন্যদিকে চোখ না ফিরিয়েই তিনি বোতল থেকে ব্র্যাণ্ডি ঢেলে এক চুমুকে নিঃশেষ করছেন। নবীনকুমার এত দ্রুত হাতে লিখতে আর দেখেনি কখনো কারুকে। মুক্তার মতন হস্তাক্ষর, একটি কাটাকুটিও করছেন না হরিশ, ইংরেজি বাক্যগুলি যেন তাঁর মস্তিষ্ক থেকে অনর্গল বেরিয়ে আসছে।
এক সময় একটু লেখা থামিয়ে হরিশ বললেন, অঃ, একটা তো ভারি ভুল হয়ে গ্যাচে! তোমায় কোনো আপ্যায়ন করা হয়নি, ভাই নবীন। তা আর একটা গেলাস আনাই, তুমি ব্র্যাণ্ডি খাবে তো!
নবীনকুমার বললো, মাপ করো, আমি সুরাপান করি না।
হরিশ আর বাক্যব্যয় না করে নিজ গেলাসে আবার পানীয় নিয়ে গলায় ঢাললেন। নবীনকুমার বললো, বন্ধু, তুমি যে এমন করে খাচ্চো-কিছুদিন আগেই পেটের ব্যামোয় কষ্ট পাচ্চিলে!
হরিশ তাচ্ছিল্যের সঙ্গে বাঁ হাতটা নেড়ে বললেন, পিসীমাদের মতন লেকচার ঝেড়ো না! আমি কেন মদ খাই, তা আমি জানি! তুমি খেতে চাও না, খেয়ে না। আমায় মদ্যপান কে শিকিয়োচেন জানো? স্বয়ং রামগোপাল ঘোষ। তিনি কত বড় মানুষ তুমি জানো! ব্যস আর বেশী কতা কয়ো না! আবার লেখা শুরু করলেন হরিশ। তাঁর লেখা শেষ হবার আগেই পুরো ব্র্যাণ্ডির বোতলটি শেষ হলো। শেষের দিকে হাত কাঁপতে লাগলো হরিশের। ছাপাখানার এক কর্মচারীকে ডেকে কপি সব বুঝিয়ে দিয়ে তিনি উঠে দাঁড়ালেন। তারপর জড়িত স্বরে নবীনকুমারকে জিজ্ঞেস করলেন, এবার তোমার কী বৃত্তান্ত বলো!
নবীনকুমার বললো, বন্ধু, তুমি আর আজকাল আমাদের বিদ্যোৎসাহিনী সভাতে যাও না!
হরিশ বললেন, আর যাবোও না-তোমরা ধনীর দুলাল, তোমরা ঐ সভায় ব্যক্তিমে মেরে কিংবা থিয়েটার করে দেশোদ্ধার করো, ওতে আর আমি নেই। আমি যদি দেশের গরিব দুঃখীর কিছুমাত্র উবগার কক্তে পারি, তাতেই আমার জীবন ধন্য হবে। আমি গরিবের ছেলে, এখন যদি অন্য গরিবদের ভুলে যাই, তা হলে আমি নিমকহারাম! চলো, আর এখেনে ভাল্লাগাচে না! চলো—
নবীনকুমার বললো, বাড়ি যাবে তো? চলো।
হরিশ বললেন, বাড়ি? আমার আবার বাড়ি আচে নাকি? সে তো এক তপ্ত কটাহ, তার মধ্যে টগবগ করে তেল ফুটচে। তুমি সেখেনে আমায় পাটাতে চাও! কেন?
নবীনকুমার বললো, তা হলে এখন কোতায় যাবে, বন্ধু? তোমার শরীর ভালো নয়তো—
হরিশের মুখে এক অদ্ভুত হাস্য ফুটে উঠলো। ঢুলুঢুলু নেত্ৰে তিনি নবীনকুমারের মুখের দিকে একটুক্ষণ চেয়ে থেকে বললেন, আমি যাবো এখুন রামবাগানে, হরিমতি নামে একটা ভালো মেয়েমানুষ এয়েচে, টাটকা তাজা, চমৎকার নাচে! চলো, তুমিও আমার সঙ্গে যাবে নাকি? চলো, চলো, এখুন তুমি সাবালগ হয়েচো, চলো—।
নবীনকুমার হাত ছাড়িয়ে নিয়ে বললো, ছিঃ। আমায় তুমি মাপ করো, বন্ধু!
হরিশ বললেন, কী? কি বললে আমায়? অ্যাঁ? জানো, প্রতিভাবান পুরুষরা যদি ঠিক আশ মিটিয়ে যোষিৎ সংসৰ্গ না কত্তে পারে, তা হলে তাদের বুদ্ধিতে মরচে পড়ে যায়? চলো না, একবার আমার সঙ্গে গিয়েই দেকো না—।
নবীনকুমার বললো, না!