২৯ সেপ্টেম্বর বুধবার ১৯৭১
আজ থেকে ঠিক তিরিশ দিন আগে তারা আমার রুমীকে নিয়ে গেছে। এই তিরিশ দিনের মধ্যে একবারও কারো কাছ থেকে ছিটেফোটা একটু খবরও পেলাম না রুমী সম্বন্ধে।
খবর নেই অন্যদেরও। পাগলাপীর যদিও সব সময় প্রবল বেগে আশ্বাস দিয়ে যাচ্ছেন যে তারা সবাই বেঁচে আছে, তবুও আলতাফ, বদি, জুয়েল, বাকের, বাশার, হাফিজ, মামুন, মজিদ, শামসুল হক, জাহাঙ্গীর–কারো সম্বন্ধেই এক ফোটা খবরও কেউ কোনভাবে পাচ্ছে না।
সুফিয়া কামাল আপার বাসায় এসেছি। ঝিনু বলেছিল উনি আমাকে দেখবার জন্য অস্থির হয়ে আছেন।
সুফিয়া কামাল আপা শব্দ করে কাঁদতে পারেননা। বড়বড় নিশ্বাস ফেলতে ফেলতে যেভাবে কথা বলেন, মনে হয় ওঁর বুকের হাড়-পঁজর সব ভেঙে যাচ্ছে। এর চেয়ে যদি চেঁচিয়ে কাঁদতে পারতেন, বুঝি কষ্ট কম পেতেন। আমাকে জড়িয়ে ধরে উনি একনাগাড়ে বলে যাচ্ছেন : এই তো মাত্র গেল বছর–আমরা বরিশালে রিলিফে যাব, কুমী এসে বলল, খালা আপনি একটু আম্মাকেবলুন, আম্মা তো যেতে দিচ্ছেনা–আমি তোকে বললাম, তুই বললি, আপা আপনার সঙ্গে যাবে, তাতে আমার আপত্তি কিসের? ওতো আপনারও ছেলে–হায়রে-আমারও ছেলে! কি মায়াতেই যে বেঁধেছিল। যখনি আসত, চুপিচুপি পেছন থেকে গলা জড়িয়ে ধরে গালে একটা চুমো দিত মেলাঘর থেকে ফিরেই আমার কাছে এসেছিল। লুলু টুলুর সব খবর আমাকে বলে গেল–আর এই যে আলতাফ–আহা, হীরের টুকরো ছেলে–আমিই তো ঝিনুর সঙ্গে ওর বিয়ের সম্বন্ধ করেছিলাম সেও আমার বুকে শেল হেনে কোথায় গেল–আলভী আহারে, আলভী যখন এল আমার কাছে–তার সারা গায়ে রক্ত–রোগা দুবলা ছেলে কি মারটাই না মেরেছে–আমার ভালোবাসার ধনগুলোকে জালেমরা এমনভাবে ধ্বংস করে দিচ্ছে—
আমি আপার মাথাটা বুকে চেপে বললাম, আপা, চুপ করুন, একটু শান্ত হোন–।
আমি তো শান্তই আছিরে ভাই, দেখছিস না কেমন বুকে পাথর বেঁধে রয়েছি। রান্না করছি, সংসার দেখছি, খাচ্ছি, ঘুমোচ্ছি। এর চেয়ে আর কত শান্ত হয়ে থাকব?
আলভী কবে এসেছিল আপনার কাছে?
যেদিন ছাড়া পায়, সেইদিন রাতেই। রানা নিয়ে এসেছিল। রানাকে চিনিস? লুৎফর রহমানের ছেলে লুৎফর রহমান–ঐ যে কবি গোলাম মোস্তফা সাহেবের ছোট জামাই—
চিনি। উনিই তো নুহেল, আলভীদের এসেম্বলি হাউসের সামনের রাস্তা থেকে তুলে আনেন।
সুফিয়া কামাল আপা সপ্রশ্ন দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলেন। বললাম, নুহেলরা চার ভাই আর আলভী যেদিন ছাড়া পায়, সেদিন এম.পি.এ. হোস্টেলের গেট থেকে মেইন রোড পর্যন্ত ওরা হেঁটে এসেছিল। তারপর এসেম্বলি হাউসের সামনে যে মাটির ঢিপির মত আছে, সেইখানে ওরা পাঁচজন বসেছিল। ওদের শরীর এত খারাপ ছিল যে আর হাঁটতে পারছিল না। সেই সময় ঐ রাস্তা দিয়ে লুৎফর রহমান সাহেব গাড়ি চালিয়ে যাচ্ছিলেন। উনি দেখতে পেয়ে ওদের পাঁচজনকে গাড়িতে তুলে বাসায় নিয়ে আসেন। নুহেলদের মুখে শুনেছি এ কথা। ওদের সঙ্গে তো এখন রোজই দেখা হয় পাগলাপীরের আস্তানায়। আলভী এখন কেমন আছে? আর দেখা হয়েছে আপনার সঙ্গে?
হ্যাঁ, আরো দুবার এসেছিল। ও বোধ হয় এতদিনে আবার মেলাঘর চলে গেছে। ওর তো হাঁটবার মত অবস্থা ছিল না। ওর কিছু আর্টিস্ট বন্ধু–দেলোয়ার, কবীর–তারা তাদের বাসাতে লুকিয়ে রেখে ওর চিকিৎসা করিয়েছে। আমি আলভীর সঙ্গে গিয়াসের যোগাযোগ করে দিয়েছি। গিয়াসের ছোটভাই ডাঃরশীদউদ্দিন–সে ওপারে চলে যেতে চায়। আলভী তাকে সঙ্গে নিয়ে যাবে ঠিক হয়েছে। অ্যাদ্দিনে চলেও গেছে। মনে হয়।