২৯. শাদা-কালো

শাদা-কালো

ভালো, নয়তো মন্দ–এক রকম ঢালাওভাবে আমরা অনেক সময় সব কিছুর মূল্যায়ন করি। কিন্তু পৃথিবীতে বেশির ভাগ জিনিশই হয় ভালো, নয় মন্দ নয়। বেশির ভাগ জিনিশেরই কিছুটা ভালো, কিছুটা মন্দ। কারো ভালোর পরিমাণ বেশি, কারো বা মন্দের। কারো উভয়ই প্ৰায় সমান। একেবারে নির্ভেজাল কুচকুচে কালো, অথবা একেবারে খাটি ঝকঝকে শাদা বলে কিছু নেই। বেশির ভাগটাই শাদা আর কালোর মাঝখানে— ধূসর, যা ঠিক শাদাও নয়, কালোও নয়। চাঁদও পুরো রুপোলি নয়, তারও কলঙ্ক আছে। আমরা তো পাপীতাপী–বেশির ভাগটাই আমাদের কালো, কিন্তু মহামানবদের দিকে একটু ভালো করে তাকালেও দেখতে পাবেন, তাদেরও সীমাবদ্ধতা ছিলো। তাদের চরিত্রেও ছিলো কালিমার দাগ। সেটা যারা দেখতে পায়। না, তারা সেই মহামানবদের ভক্ত নয়, অন্ধ ভক্ত।

বাঙালিদের চরিত্রের একটা প্ৰধান বৈশিষ্ট্য হলো এই অন্ধত্ব। তাঁরা সব ব্যাপারেই খুব জোরালো মনোভাব পোষণ করেন। যাকে ভালো বলেন, তাঁর সবকিছু ভালো। তার চোদো পুরুষ ভালো। যাকে খারাপ বলেন, তারও চোদ্দো পুরুষ খারাপ। কেবল তাই নয়, তারা যাকে খারাপ বলে মনে করেন, আপনারও তাকে খারাপ বলে মেনে নিতে হবে। যতোক্ষণ আপনি তা না-নিচ্ছেন, ততোক্ষণ তারা আপনার “ভ্রান্তধারণা” ভাঙানোর জন্যে জোর চেষ্টা চালিয়ে যাবেন। একটা উদাহরণ দিতে পারি। অতীতে যাঁরা বাঙালিদের শাসন করেছেন এবং যাঁদের সামনে তাঁরা শতাব্দীর পর শতাব্দী মোশায়েবি করেছেন, সেই শাসকদের নিন্দায় তাঁরা এখন পঞ্চমুখ। এমনভাবে তাঁরা নিন্দা করবেন যে, অতীতের সব খারাপ জিনিশের, সব অমঙ্গলের জন্যেই তাঁরা দায়ী। কেবল তাই নয়, তাদের যে অসংখ্য দোষ ছাড়া কোনো গুণ ছিলো না, সে বিষয়ে বাঙালিরা একেবারে একমত হবেন। বস্তুত, তাদের মধ্যে উদারতার মনোভাব খুব দুর্বল।

আমাদের সাহিত্যেও এই মনোভাব জোরালোভাবে প্ৰকাশ পেয়েছে। শরৎচন্দ্রের এক নায়ক আছে, যে জমিদার-নন্দন। চেহারা কার্তিকের মতো। পাড়ায় একবার মাস্তানরা এসেছিলো, সে একাই লাঠি দিয়ে তাদের লোপাট করে তাড়িয়ে দিয়েছে। খুব ভালো ছাত্র সে। আবার সে কলেজের ফুটবল-দলের ক্যাপ্টেন। ক্রিকেট দলেরও ক্যাপ্টেন। গান গায় চমৎকার। এখানে শেষ হলেও হতো। কিন্তু শরৎচন্দ্রের কল্পনাশক্তি দুর্বল ছিলো না। তাঁর নায়ক সেতারও বাজায় ভালো। অর্থাৎ সে নায়ক বলে তার সবই উৎকৃষ্ট। সবটাই তার শাদা। অপর পক্ষে, আমাদের ভিলেনরা কেবল নায়কের প্রতিপক্ষ নয়। তারা ভয়ানক গুণ্ডা। চরিত্রহীন। বর্বর। এমন কি, তাদের চেহারাও কুৎসিত। এই যে মনোভাব, তা আধুনিক নয়, নিরপক্ষ নয়, একপেশে; কিন্তু এই মনোভাবই প্রাচীন কাল থেকে আমাদের সংস্কৃতিতে প্রবলভাবে চলে এসেছে। সে জন্যেই রাবণ কেবল রামের প্রতিপক্ষ নন, তিনি দশ মাথাওয়ালা রাক্ষস। রামের সব ভালো, রাবণের সব খারাপ।

বছর বারো আগে আমি শেখ মুজিবকে নিয়ে একটি ছোট্টো লেখা লিখেছিলাম। তাতে বলেছিলাম যে, তিনি ছিলেন বাংলাদেশের জন্মদাতা। এবং নেতা হিশেবে তাঁর এমন ক্যারিজমা ছিলো যে, তিনি বাংলাদেশকে জন্ম দিয়ে তাকে ঠিকমতো লালনপালন করে বড়ো করেও তুলতে পারতেন। কিন্তু দুৰ্ভাগ্যক্রমে কিছু বাংলাদেশবিরোধী এবং বিদ্রোহী সেপাই-এর হাতে তিনি নিহত হন বলে সে কাজ সম্পন্ন করতে পারেননি। আমি সেই সঙ্গে এও লিখেছিলাম যে, শেখ মুজিব প্রশাসক হিশেবে ব্যর্থ হয়েছিলেন। তিনি যতো বড়ো নেতা ছিলেন, ততো বড়ো প্রশাসক ছিলেন না। আলোচনার শেষে তাঁর দেহাবশেষ রেসকোর্সে নিয়ে আসা উচিত বলে আমি লিখেছিলাম, “আপনি কবে সোহরাওয়ার্দি উদ্যানে আসবেন, সেই দিনের অপেক্ষায় আছি।”

আমার ধারণা, আমার সে লেখায় শেখ মুজিবের প্রতি আমার গভীর শ্রদ্ধাই আমি প্রকাশ করেছিলাম, যদিও তাতে আদৌ কোনো চাটুকারিতা ছিলো না। বরং, আমার বিবেচনায়, তাতে ছিলো শেখ মুজিবের নিরপেক্ষ মূল্যায়ন। কিন্তু আমার সেই লেখা পড়ে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের এক ছাত্র–তার মানে সম্ভবত আমার ছাত্রের ছাত্রআমাকে একটা চিঠি লেখেন। তাতে তিনি লিখেছিলেন, আমার মতো দুমুখো চামচার কোনো প্রয়োজন নেই। শেখ হাসিনার নেতৃত্বে বাংলার ঘরে ঘরে লাখ লাখ মুজিবসেনা তৈরি হচ্ছে।

আমার ওপর এই ছাত্রের রাগের কারণ, আমি কেন শেখ মুজিবের সবটাই ভালো বলতে পারিনি। তিনি যেহেতু জাতির পিতা, সুতরাং তাঁর কোনো সীমাবদ্ধতা, তাঁর কোনো খুঁত থাকবে কী করে? তিনি হবেন, সকল কালিমা-মুক্ত। দেবতার মতো। এই মনোভাবকেই আমি বলি শাদা-কালোর মনোভাব।

আরও একটা দৃষ্টান্ত দিতে পারি। আমার নিজের পরিবার থেকে। আমার বাবা একটা স্কুল প্রতিষ্ঠা করেন এবং প্রধান শিক্ষক হিশেবে তাকে সবচেয়ে সফল গ্রামের স্কুলে পরিণত করেন। ১৯৬০-এর দশকে। ফি বছর সে স্কুলের ছাত্রছাত্রীদের নাম থাকতো মেধা তালিকায়। কিন্তু আমার বাবাকে তাঁর বাবা লেখাপড়া শেখাতে চাননি এবং বাড়ি থেকে বের করে দিয়েছিলেন বলে তাঁকে নিজে কষ্ট করে মানুষ হতে হয়েছিলো। তিনি গর্ব করে বলতেন, তিনি দোকানদারের সহকারী হিশেবে কাজ করেছেন। অন্যের নারকেল পেড়ে দিয়ে জীবিকা উপার্জন করেছেন এবং স্কুলের বেতন দিয়েছেন। অর্থাৎ দু বেলা খাওয়া, পরা এবং লেখাপড়ার জন্যে রীতিমতো সংগ্ৰাম করেছিলেন। তারপর নিজে শিক্ষিত হয়ে, তিনি শিক্ষার আলো ছড়িয়ে দেন সমগ্র এলাকায়। সংক্ষেপে, তিনি চাষী পরিবারের সন্তান হলেও নিজের চেষ্টায় লেখাপড়া শিখেছিলেন এবং অন্যদের শিখিয়েছিলেন। তিনি স্বগঠিত মানুষ। তাঁর এ রকমের পরিচিতি দিয়ে আমি একটি প্রবন্ধ লিখি তাঁর প্রতিষ্ঠিত স্কুলের ছাত্রছাত্রীদের জন্যে। যাতে তারা তার কথা জানতে পারে। বড়ো হওয়ার জন্যে উৎসাহ পায়। কিন্তু তাতে আমার একেবারে আপনজনেরা দারুণ ক্ষুদ্ধ এবং ক্রুদ্ধ হন। আমার প্রতি। কারণ, আমার বাবাকে আমি খান বাহাদুর হিশেবে চিত্রিত করলাম না কেন? তিনি যখন অতো সফল মানুষ, তখন তার চোদ্দো পুরুষ সফল হবে না কেন?

বেশির ভাগ বাঙালির মনোভাবই এ রকম। ভালো হলে তার কোনো সীমা থাকবে না। আবার খারাপ হলেও তা সীমা ছাড়িয়ে যাবে। যেমন, কেউ একটা বিষয় ভালো করে জানে না–এ কথা বোঝানোর জন্যে তারা বলেন: “ও কী জানে!” কেউ অগ্ৰীতিকর কিছু করে থাকলে, তার সম্পর্কে বলেন: “ওর মতো বদমাশ হয় না।” (আসলে অতো ভদ্র ভাষায় নয়, একটা গাল দিয়ে বলেন। সেটা স্ত্রীর ভ্রাতাসূচক হতে পারে; এমন কি, কারো পিতৃপরিচয় ঠিক নেই, তেমন ইঙ্গিতপূর্ণও হতে পারে।) কেউ ভালো মানুষ বোঝাতে হলে, তারা বলেন, “তাঁর মতো ভালো মানুষ হয় না।” অথবা “অমুক ব্যক্তি দেবতার মতো।” (দেবতাদের যে-গল্প পড়ি, তাতে তাদের মতো হলে, তাকে ভালো মানুষ বলা যায়। কিনা, সেটা বিবেচনা করার বিষয়। উল্টো, মনে হয় দেবতাদেরই ভালো মানুষের মতো হওয়া উচিত ) মোট কথা, বাঙালিদের চোখে সব কিছুই হয় উত্তম, নয়তো অধম। মাঝারি বলে কিছু নেই।

অষ্টাদশ শতাব্দীতে কর্তাভজা নামে একটি সম্প্রদায় বঙ্গদেশের একটা অঞ্চলে খুব জনপ্রিয় হয়েছিলো। এখন সেই সম্প্রদায় প্রায় লুপ্ত হয়েছে, কিন্তু নানা নামে আমরা এখনও কর্তর ভজনা করি, কর্তার ইচ্ছায় কীর্তন করি। যিনি যখন ক্ষমতায় থাকেন, তখন তারই পদসেবা করি। তাঁর অন্ধ প্ৰশংসায় কেবল পঞ্চমুখ নয়, রাবণের মতো দশমুখ হই। তাঁর আগে যিনি ক্ষমতায় ছিলেন তিনি তখন নিকষ-কালো ভিলেনে পরিণত হন। সাধারণ সৌজন্যও দেখাই না তাঁর প্রতি। বস্তুত, কর্তাদের সম্পর্কে আমাদের প্রশংসা এবং বিনয় প্রায় অতলান্তি সমুদ্রের মতো। কর্তা মা-বাপ, আর আমরা সবাই …-এর বাচ্চা।

বাঙালিদের গোষ্ঠীকেন্দ্ৰিক মনোভাবেও এই শাদা-কালোর মনোভাবকে আরও জোরদার করেছে। বেশির ভাগ বাঙালির কাছে আত্মীয়রা ধোয়া তুলসি পাতার মতো, শতকরা এক শো ভাগ পূত-পবিত্র, শাদার শাদা। অপর পক্ষে, আত্মীয়ের প্রতিপক্ষে যে-অনাত্মীয় আছেন, তাঁর মতো খারাপ মানুষ ভূভারতে নেই। কিন্তু আমি আত্মীয় বলে কাউকে খোলা চেক দিতে রাজি না, পারিও না। কারণ, আমার বিবেচনায়, আমার আত্মীয়দের কেউ কেউ ভালো, বেশির ভাগ মাঝারি। আর দু-একজন নিকৃষ্ট মানুষ। দুপায়ে হাঁটলেও অন্য জন্তুদের সঙ্গে এই শেষ শ্রেণীর বিশেষ কোনো পার্থক্য নেই। এভাবে দেখলে জগৎ এবং জীবনকে মোটামুটি নির্মোহ দৃষ্টিতে দেখা সম্ভব। রবীন্দ্রসঙ্গীত হয়েছে বলে তার মধ্যে কোনো খাদ থাকতেই পারে না; আর আবু জাফর গান রচনা করে থাকলে–ও আবার কী লিখবে–আগে থেকে এ ধারণা করা ঠিক নয়। বস্তুত, জগৎ এবং জীবনকে নির্মোহ দৃষ্টি দিয়ে সঠিকভাবে দেখতে হলে ঐ মাঝারি–ঐ ধূসর রঙটা ভালো করে দেখার ক্ষমতা দরকার। আমাদের চরিত্রেই সেই ক্ষমতারই অভাব।

(যুগান্তর, ২০০৬)

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *