২৯
শরীর ভাল না থাকায় পৃথু কারখানা থেকে সেদিন তাড়াতাড়ি ফিরে আসছিল। বড় রাস্তা থেকে ওদের বাড়ির রাস্তায় ঢোকার মুখে একটি শালবন আছে। বসন্তের শেষে শালফুলের গন্ধে ম’ ম’ করে রাস্তাটি। তখন ঝরা পাতারা ঝরনা বইয়েছে। হাওয়ার তোড়ে পাথুরে জমিতে চাপান-উতোর দিতে দিতে হাডুডু খেলছে। ধুলো উড়ছে। লাল ধুলো। মিষ্টি, শীত-শীত গন্ধ তাদের গায়ে।
শালবনের ভিতরে একটি গভীর কুয়ো আছে। কবে, কারা, এই জায়গায় কুঁয়ো খুঁড়েছিল কে জানে? বাঁধানো কুঁয়ো। সেই কুঁয়ো থেকে পায়ে চলা পথ চলে গেছে পুনপুনিয়ার জঙ্গলের গভীরে। বাসিয়া বস্তি পড়ে, কাছেই। গোঁন্দদের পুরনো বস্তি। বস্তির পেছনে শালবন। তারও পেছনে একটা কাছিমপেঠা নামগোত্রহীন পাহাড় পিঠ উঁচিয়ে শীতের দুপুরে বিনিপয়সার রোদ পোয়াচ্ছে। গরিব বড়লোক, নামী অনামী : রোদ সকলেরই। বাসিয়া বস্তি থেকে সকাল—বিকেলে মেয়েরা এই কুঁয়োতে আসে। রোদ চড়া হলে অনেকে চান করে। কুয়োপাড়ে কাপড় কাচে। অনেক জল পড়ে এবং বয়ে যায় বলে কুয়োর চারপাশে লিটপিটিয়া আর পুটুসের ঝাড় গজিয়েছে। গরমের দিনে বিকেলবেলায় সাপ আর তৃষ্ণার্ত মোরগা-মুরগি, তিতির, ছাতারে সব চলকে-পড়া জলের কাছে চোরের মতো এসে জল খেয়ে যায়।
ওই শালবনের পাশে পাশেই পথটা এসেছে প্রায় দু-তিন-ফার্লং। শালবনের মাঝামাঝি আসতে কে যেন হঠাৎ চেঁচিয়ে উঠল শালবনের গভীর থেকে। বোধহয়, কুঁয়োর দেওয়ালের ভিতর মুখ ডুবিয়েই ডাকল সে। গমগম করে উঠল সমস্ত জঙ্গল সেই অনুরণিত ডাকে। প্রতিধ্বনি ফিরে গেল সাড়া-দেওয়া পাহারাদারের হাঁকের মতো।
থমকে দাঁড়িয়ে গেল পৃথু। চিৎকারটা কিসের? কে করল এবং কেন করল তা বোঝার চেষ্টা করল। স্বরটি খুবই চেনা মনে হল।
আবারও চিৎকার হল বা—বা। আবারও গমগম করে উঠল প্রাচীন শালবন। ভয় পেয়ে এক ঝাঁক টিয়া উড়ে গেল বনের মাঝখান থেকে ডানা শনশন করে।
অবাক হয়ে চেয়ে রইল সেদিকে পৃথু। ভাল করে নজর করে দেখল টুসু! তারই ছেলে।
কিছু বুঝতে না পেরে পায়ে পায়ে এগিয়ে যেতে লাগল পৃথু সেদিকে।
এই হঠাৎ “বাবা” ডাকটা তার বুকের মধ্যে কী সব জমে থাকা জিনিস হঠাৎ করে গলিয়ে দিল। সেই সব গভীর অজানা, অনাস্বাদিত বোধ তারও বুকে যে বিশ্বাসঘাতকের মতো লুকিয়ে ছিল তা ও কখনও জানেনি। হঠাৎ করে সহস্র হাতে ছুরি মারল তারা পৃথুর বুকে। রক্ত নয়, ওই একটি ডাকে, আচমকা ডাকে অপত্য-স্নেহ হঠাৎ উৎসারে ফোয়ারার মতো ফিনকি দিয়ে ছুটল দিকে দিকে।
ও যে কারও বাবা, “বাবা” বলে ডাকার যে কেউ আছে তাকে, এ সংসারে এ কথা সে ভুলেই গেছিল। পৃথু ঘোষ। “অদ্ভুত বাজে লোক” একটা।
টুসু একটি সাদা শর্টস পরেছে। গায়ে সাদা-কালো স্ট্রাইপের একটি ফুল-হাতা জামা। তার উপর কালো স্লিপ-ওভার। শালবনের মধ্যে আলো ছায়ার সতরঞ্জিতে দাঁড়িয়ে আছে তার আট বছরের ছেলে, সাদা পাথরে বাঁধানো কুঁয়োর পাশে। ধবধবে ফর্সা তার গায়ের রঙ। রুষার মতো কাটাকাটা নাক মুখ ঠোঁট চিবুক। উজ্জ্বল কালো দুটি চোখ। মাথাভর্তি কুচকুচে কালো চুল। আজকালকার ফ্যাশানানুযায়ী কপালের মাঝখান অবধি নামিয়ে গোল করে চুল কেটে দিয়েছে তার মা।
ওদিকে এগোতে এগোতে এক দারুণ মুগ্ধ চমকে চমকে উঠল পৃথু। তার ছেলে! তারই ছেলে? কী সুন্দর হয়েছে দেখতে টুসুটাকে! মিলিও সুন্দরী। কিন্তু শিশুকাল থেকেই মেয়েরা অন্যরকম সুন্দর। ছেলেরাও যে এত সুন্দর হয়, নিজের ছেলেকে দেখেই যেন আজ প্রথম জানল পৃথু।
আবার ডাকল টুসু, কুঁয়োর ভিতর মুখ নামিয়ে। এইবারে পৃথু বুঝল যে, ডাকটা, তার বাবার নাম ধরে ডাকটা নিছক ডাক নয়; কান্না। বাবা—আ—আ—আ—আ—বলে কাঁদছে টুসু।
টুসু কাঁদছে!
কেন?
অসুস্থ শরীর নিয়েই দৌড়ে যেতে লাগল পৃথু ওদিকে।
মুখে বলল, টু—সু—উ!
ডাকটা, শীতের বিবাগী রুখু শালবনের মধ্যে পৃথুর পিতৃত্বই যেন নতুন করে জারি করতে লাগল। খুব ভয় হল। ভয় হল, ছেলেটা কুয়োর মধ্যে পড়ে না যায়! ভয় হল, এই হাওয়াকে। এই ঝরা-পাতার দৌড়োদৌড়িকে। ভয় হল, শীতের দুপুরের এই আশ্চর্য হিমেল স্তব্ধতাকে।
দ্রুত পায়ে দৌড়ে যেতে লাগল পৃথু কুঁয়োর দিকে।
কুয়োর কাছে পৌঁছে পৃথু দেখল, টুসুর দু চোখে জল।
পৃথুকে কাছে আসতে দেখেই টুসু দৌড়ে এসে ওর কোমর জড়িয়ে ধরে দু’পায়ের মধ্যে মুখ রেখে ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠল।
কী! কী! কী হল টুসু? কী হয়েছে তোমার?
টুসু উত্তর না দিয়ে কাঁদতে লাগল।
পৃথু ছেলেকে কোলে টেনে এনে কুয়োর বাঁধানো পাড়ে বসল ওকে নিয়ে। থরথর করে হাঁটু কেঁপে উঠল তার। কোনওদিন কুর্চি এমন করে দৌড়ে ওর বুকে এলে ওর কেমন লাগত ও জানে না। অনেকদিনই স্বপ্নে কল্পনা করেছে, একদিন কুর্চি দৌড়ে আসবেই তার বুকে। পশ্চিমী দেশের মেয়েদেরই মতো। ভালবাসা, যাদের কাছে গোপন রোগের মতো গোপনীয় কোনও ব্যাপার নয়; ভালবাসা যেখানে জীবন এবং যৌবনের সুস্থ, স্বাভাবিক প্রকাশ।
কিন্তু এই মুহূর্তে পৃথুর মতো আর কেউই জানে না যে, কুর্চি তার বুকে দৌড়ে এলে হয়তো অন্যরকম লাগত। তা যে রকম ভালই লাগুক না কেন; এমন ভাল লাগত না কখনওই।
কুর্চি তো পৃথুর ভালবাসারই জন! আর টুসু তো পৃথু নিজেই। পৃথুই তো টুসু। তার কৈশোরের স্বপ্ন, প্রথম যৌবনের সব অবুঝ অনাবিল পবিত্র ভালোলাগা দিয়ে টুসুকে তো ওই-ই তৈরি করেছিল রুষার সাহচর্যে। মিলিকেও। টুসু যে ওরই এক টুকরো। মানুষ নিজের চেয়েও ভাল কাউকে কি বাসতে পারে? টুসুর চেয়ে ভাল পৃথু কী করে বাসবে কুর্চিকে?
টুসুর কান্না থামলে, ওর মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে পৃথু বলল, কী হয়েছে টুসু? কাঁদছিলি কেন রে? এখানে কী করছিলি তুই?
আমি কুয়োতে লাফিয়ে পড়তাম! তোমাকে দেখে…
আতঙ্কে ও ভয়ে হৃৎপিণ্ড স্তব্ধ হয়ে গেল মাটিতে দাঁড়িয়ে বাঘ-মারা সাহসী পৃথু ঘোষের!
কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বলল, কেন? কুয়োয় লাফিয়ে পড়ে কী করতিস? মাছ ধরতিস?
না। মরে যেতাম!
স্তব্ধ হয়ে গেল পৃথু।
কেন?
আমার বাঁচতে ইচ্ছে করে না।
কেন? সে কিরে? কী…কী বলছিস তুই…?
পৃথু লক্ষ্য করল ওর গলার স্বর চড়ে যাচ্ছে। বুঝতে পারল যে, ও নিজেই নিজের উপর ভীষণ রেগে যাচ্ছে। সামলাতেও পারছে না নিজেকে।
কেন?
আমি লাইফ-সায়েন্স-এ খারাপ মার্কস পেয়েছি।
তাতে কি হয়েছে? আন্টি কি বকেছেন তোমাকে?
হ্যাঁ।
কী বলেছেন?
বলেছেন, উ্য আর নট ফিট বী ইওর ফাদারস সান। ইওর মাদারস সান, আইদার!
একটা প্রচণ্ড হাসি পৃথুর ভিতর থেকে ঠেলে উঠে আসতে লাগল ওই দুঃখের ভিতরেও। হোঃ হোঃ করে হাসতে লাগল পৃথু—টুসুকে দু’হাঁটু দিয়ে চেপে ধরে।
টুসু অবাক হয়ে চেয়ে রইল তার বাবার মুখে।
হাসি থামলে, পৃথু বলল : তুই আমার যোগ্য নোস? এই কথা বলেছেন আন্টি? আমি কে রে বেটা? মেরা বেটা। আমি না একটা “অদ্ভুত বাজে লোক।” বিচ্ছিরি বাজে টাইপ। তুই তো নিজেই সবসময় বলিস। তোর মাও তো বলেন। তবে, তুই কেন আন্টিকে এ কথা বলে দিলি না।
আন্টিকে ওসব বলা ব্যাড ম্যানার্স। তাছাড়া…তুমি তো আর আসলে বাজে নও। তুমি তো ভালই। সকলে বলে। মাও তো সব সময় বলে। তুমি জানো না তা?
কী যে বলবে ভেবে পেল না পৃথু। ছেলের চোখের আয়নাতে নিজের হারিয়ে যাওয়া মুখ খুঁজে পেল। আজকালকার ছেলেমেয়েরা ওদের সময়কার মতো বোকা নয়। ওদের প্রত্যেকের আই-কিউই অন্যরকম। মুগ্ধ বিস্ময়ে তাকিয়ে ছিল পৃথু নিজের ছেলের দিকে। এমন গুছিয়ে যে কথা বলতে পারে তার ছোট্ট ছেলে সে-সম্বন্ধে কোন ধারণাই ছিল না পৃথুর।
তা খারাপ নম্বর পেলি কেন? ভাল করে পড়িসনি বুঝি?
না।
কেন? না কেন?
আমার লাইফ-সায়েন্স পড়তে ভালই লাগে না।
কী করতে ভাল লাগে তাহলে?
তোমার মতো জঙ্গলে জঙ্গলে ঘুরতে। কাঠবিড়ালিদের পেছনে দৌড়তে, বসন্তবৌরি পাখির বাসা খুঁজতে, শামুকের চলা দেখতে; এই-ই সব।
মাথায় হাত দিল, পৃথু। হাত না দিয়ে।
লাইফ-সায়ান্স কাকে বলে জানে না পৃথু। ওদের ছেলেবেলায় এসব ভারী-ভারী নামের বিষয়ই ছিল না। কিন্তু টুসুর যা ভাললাগা তা তো জীবন-সম্বন্ধীয় ব্যাপারই। অথচ…! সবই, গোলমাল হয়ে যাচ্ছে। তাদের ছেলেমেয়েগুলো বোধহয় তাদের চোখের সামনেই সব নষ্টই হয়ে যাচ্ছে। টাটকা প্রাণগুলো। শৈশব নষ্ট করে শিশুকে পণ্ডিত করতে চাইছে এই শিক্ষা পদ্ধতি। শিক্ষার বাইরের ভারে চাপা পড়ে মরছে শৈশব; মরছে কৈশোর। বড় অভাগা-অভাগী এই শিশুরা।
ভাল্লাগে না আমার। কবিতা পড়তে ভাল লাগে শুধু। ছবি আঁকতেও।
সর্বনাশ!
নিরুচ্চারে বলল, পৃথু।
পৃথু নিজেই এই সকল নিস্পাপ শিশুর চরম সর্বনাশ বয়ে এনেছে তার নিজের রক্তে। সেই অভিশপ্ত রক্তবীজই সঞ্জীবিত হয়ে গেছে টুসুর মধ্যে। কবিতা; আত্মহত্যার প্রবণতা। ছিঃ। ছিঃ। শুধু বিয়ে করাই নয়, ছেলেমেয়ের বাবা হওয়াও সত্যিই উচিত হয়নি ওর। ঠিকই বলে রুষা।
রুষা ঠিকই বলে। পৃথু একটা…
বাড়ি যাওনি স্কুল থেকে? বই-পত্র কোথায়? অজাইব সিং নিয়ে আসেনি তোমাকে?
হ্যাঁ। বাড়ি গেছিলাম। কিন্তু অজাইব সিং নিয়ে আসেনি।
মা-র সঙ্গে দেখা করেছিলে স্কুলে আসার সময়? মা ছিলেন না স্কুলে?
মা আজ স্কুলে যায়ইনি। আমার জ্বর-জ্বর লাগছিল বলে মালহোত্রা আন্টিকে বলে আমি আগেই চলে এসেছি। অজাইব সিং যাওয়ার আগেই।
কেন? শরীর খারাপ হয়েছে না কি মায়ের? মা স্কুলে যায়নি কেন?
না তো! শরীর তো খারাপ হয়নি। কেন যায়নি, তা জানি না।
তবে?
জানি না। বাড়ি ফিরতেই, মা খুব বকল আমাকে। মা, আমাকে মারল বাবা। বলল,—বলতেই, দু চোখ জলে ভরে এল টুসুর।
কী বলল?
বলল, বকা ছেলে। চালচুলোর ঠিক নেই। ঠিক বাবার মতো হচ্ছে। এখন তোমাকে স্কুল থেকে একা একা চলে আসতে কে বলেছে? বলেই, আমাকে বের করে দিল।
তোকে মা এই দুপুরে বাড়ি থেকে বের করে দিল? এমন তো কোনওদিনও করে না। মাও তো তোকে ভালবাসে। খুবই। তোর মা, তোদের আমি যতটুকু ভালবাসি তার চেয়ে অনেকই বেশি ভালবাসে। তবে? মেরীর কাছে থাকলি না কেন তুই? দুখীও কি ছিল না। লছ্মার সিং? নিজের ঘরে শুয়ে থাকলি না কেন? জ্বর হয়েছে, সে কথা মাকে বলিসইনি বুঝি?
মা তো বলতে দিল না। মা-ই এসে বাইরের দরজা খুলল। আমাকে দেখেই ভীষণ রেগে ওইসব বলল আর মারল। আন্টি নিশ্চয়ই মাকে ফোন করে আমার রেজাল্টের কথা বলে দিয়েছে। না হলে…
তুই বাড়িতে ঢুকলিই না?
না। মা বই-খাতা সব কেড়ে নিয়ে বলল বিকানিয়া থেকে একপাউন্ড সবুজ উল কিনে আনতে। যে উল দিয়ে মা আমার সোয়েটার বুনছে। বলেই, দরজা বন্ধ করে দিল। বড় রাস্তার মোড়ে গিয়ে আমার মনে হল পয়সাও দেয়নি মা আমাকে। ভীষণ কান্না পেল আমার। ফেরার সময় ওই জঙ্গলে ঢুকে গেলাম। মা খারাপ হয়ে গেছে, বাবা। মা আমাকে এমন বকেনি, মারেনি কখনও।
আবার কেঁদে ফেলল টুসু।
তারপরই বলল, একটা শেয়াল ছিল, জান বাবা; কুয়োটার কাছে। আমাকে দেখেই পালাল। কুয়োটার কাছে এসে আমার ভীষণই কান্না পেতে লাগল। আমি লাফিয়েই পড়তাম। এমন সময় দেখি, তুমি আসছ। তোমার নেভি-ব্লু ব্লেজারটার বোতামগুলোতে রোদ পড়ে ঝকমক করছিল। সেই ঝকমকি দেখে তাকিয়ে দেখি, তুমি! তুমিও কেন এলে আজকে এখন? এখন তো তুমি আসো না, কারখানা থেকে কোনওদিনও।
আমারও জ্বর-জ্বর হয়েছে রে টুসু। ভাগ্যিস! চল আজ আমি আর তুই আমার ঘরে জড়াজড়ি করে শুয়ে থাকব। কম্বলের নীচে। তুই যখন ছোট্ট ছিলি তখন যেমন শুতিস। মনে আছে?
হুঁ। টুসু বলল, বাবা! বিকেলে চিঁড়েভাজা খাব?
কী দিয়ে? বাদাম, ধনেপাতা, ফুলকপি, পেঁয়াজ, এইই সব…
একশবার খাবি। এখন চল তো।
বেটা আমার খাদ্যরসিক হয়েছে। কপালে দুঃখ আছে। এও রক্তরই ব্যাপার। জিন। ভাবল, পৃথু।
বাবা আর ছেলে রাস্তার কাছে আসতেই দেখল গাড়ির চাকায় ধুলো উড়িয়ে অজাইব সিং আসছে।
ওদের অসময়ে এবং একসঙ্গে দেখে অবাক হয়েই ব্রেক কষে দাঁড় করাল গাড়িকে অজাইব সিং। দরজা খুলে দিল পেছনের। গাড়ি থেকে নেমে, সেলাম করে।
কাঁহা গ্যায়া থা?
পৃথু শুধোল।
মান্দলা হুজৌর?
কাহে?
মছলী লানেকা লিয়ে।
ক্যা মছলী লায়া?
কুছো নেহী মিলা হ্যায় হুজৌর। বড়ী দের করকে নিকলা থা হিয়াঁসে।
কাহে?
মেমসাব দেরহি করকে ভেজিন।
হুঁ।
ওদের বাংলো এখনও বেশ কিছুটা দূর। পৃথু হঠাৎ দেখল, ভিনোদ ইঁদুরকারের কালো রঙা অ্যাম্বাসাডরটা গেট থেকে বেরিয়ে ধুলো উড়িয়ে জোরে চলে গেল।
টুসু বলল, ভিনোদ আংকল। তাইই তো। ওই গাড়িটাকেই তো দেখেছিলাম স্কুল থেকে ফিরে। আমাদের গাড়ির মতোই রঙ। বুঝতেই পারিনি। এতগুলো গাড়ি না ভিনোদ অ্যাংকল-এর! মনেই থাকে না।
বাবা আর ছেলে নেমে গেলে, মেমসাহেবের সঙ্গে দেখা করে এসে, অজাইব সিং গাড়িটা গেটের বাইরে এনে বড় গাছতলায় লাগাল। তারপর ক্যাসেট প্লেয়ারটা চালিয়ে দিল।
“ঝুমকা গীড়ারে, ব্যারিলিকি বাজারমে ঝুমকা গীড়ারে।
হাম দোনোকা ঘাবড়ার মে ঝুমকা গীড়া রে।”
পৃথু আর টুসু পৃথুর ঘরে গেল। রুষা বাথরুম থেকে এল মুখে চোখে জল দিয়ে। পৃথুর ঘরে টুসুকে দেখে অবাক হল খুবই।
উল? উল কোথায়?
পয়সাই তো দাওনি ওকে। আনবে কী করে?
আমার নাম বললেই দিত। রুষা ঘোষকে কে না চেনে হাটচান্দ্রাতে? যে-কোনও দোকানি তাকে হাজার দু হাজার ধার দেবে অমনিতেই!
ওর জ্বর হয়েছে। জ্বর নিয়ে স্কুল থেকে তাড়াতাড়ি ফিরে এল আর মার্কস খারাপ হয়েছে বলে ওকে তুমি মেরে বের করে দিলে।
মার্ক্স! কিসের মার্ক্স?
তোমাকে সুস্মি ফোন করেনি?
সুস্মি! না তো কী ব্যাপার?
না কিচ্ছু না।
ইদুরকার এসেছিল কেন?
রুষার চোখ দুটি হঠাৎ উজ্জ্বল হয়ে উঠল। বলল, এমনিই এসেছিল। জাস্ট ড্রপড ইন। কেন? জবাবদিহি করতে হবে নাকি?
না। আমি ভাবলাম ওর ব্যবসাতে কোনও ঝামেলা-টামেলা হল বুঝি।
তারপর বলল, শোনো। তোমার সঙ্গে কথা আছে। একটু তোমার ঘরে চলো। টুসু, তুই আমার ঘরে শুয়ে থাক।
কি শুয়ে থাকবে? অসময়ে। যাও আগে জামাকাপড় ছাড়ো, জুতো-মোজা জায়গায় রাখো; চান করো। বাড়ির পোষাক পরো, তারপর ওসব ন্যাকামি কোরো। জ্বরে একেবারে অজ্ঞান হয়ে গেলেন ছেলে!
টুসু একবার তাকাল তার বাবার দিকে। তারপর চলে গেল জুতো ছাড়ার জায়গাতে। রুষার ঘরে ঢুকেই একটা বিজাতীয় গন্ধ পেল নাকে। পাইপের টোব্যাকোর।
নাক কুঁচকে বলল, ভিনোদ?
হ্যাঁ। ওরও তো জ্বর। কী যে হয়েছে? সকলেরই জ্বর-জারি। আমারও তো সকাল থেকেই জ্বর-জ্বর। এদিকে কোথাও এসেছিল ভিনোদ। বলল, আজ সকালেই জবলপুর থেকে রওয়ানা হয়ে আসছে। অনেক মাইল গাড়ি চালিয়ে এসেছে। রাস্তার অবস্থাও নাকি খারাপ। আমি থাকব না জানত। এসেছিল, লছমার সিংকে বা মেরীকে বলে একটা ওমলেট খেয়ে যাবে! সঙ্গে ভডকা ছিল ওর গাড়িতে। আইস বক্স ও আইসও। আমাকে দেখে তো অবাক। আমিই বললাম, বিছানাতে রিল্যাক্স করো। ওমলেট বানিয়ে আনছি। এখানেই শুয়ে ভডকা খেল দুটো।
ওমলেট তুমি নিজেই বানালে? বাঃ ভিনোদ খুব লাকি তো! তা জ্বর বেশি হয়নি তো?
পৃথু শুধোল, রুষার চোখে তাকিয়ে।
থতমত খেয়ে গেল রুষা। বলল না, বেশি না, মানে খুব বেশি না। তবে, কিছুতেই থার্মোমিটার নিল না। কপালে হাত দিয়ে দেখলাম, এই একশো-ট্যাকশো হবে। কী জ্বর কে জানে?
পৃথু বলল, সত্যি! কতরকম জ্বর-জারিই না হচ্ছে আজকাল! আর তোমার জ্বর? কাম জ্বর-টর নয় তো?
ফ্যাকাশে হয়ে গেল রুষার মুখ।
বলল, সবসময় ইয়ার্কি ভাল লাগে না।
শোনো। পৃথু বলল।
ওর গলায় এমন কিছু ছিল যে, রুষা ভীষণ ভয় পেয়ে আস্তে আস্তে চোখ রাখল পৃথুর চোখে।
তুমি বকে-মেরে টুসুকে বের করে দেওয়ার পর বাসিয়াতে যাবার সেগুনবনের কুঁয়োতে লাফ দিয়ে পড়ে আত্মহত্যা করতে যাচ্ছিল টুসু। আমি জ্বর নিয়ে আজ তাড়াতাড়ি না ফিরলে ওই পথ দিয়ে…
কী ক্কি…কী বলছ তুমি?
যে ভয়টা চোখ তোলার সময় রুষার মুখে মাখামাখি হয়েছিল তার চেয়ে অনেক বড় একটা ভয় তার সমস্ত মুখ ফ্যাকাসে করে দিল। চাপা আর্তনাদ করে রুষা বলে উঠল, টুসু! উঃ…
হ্যাঁ। এরকম আর কোরো না ভবিষ্যতে। ও আমার কাছেই থাকবে বলেছে দুপুরটা। এই ভিক্ষাটা মঞ্জুর করো আমার। বহু বছর তোমার কাছে চাইনি কিছুই।
রুষা উত্তর না দিয়ে বাথরুমের দিকে দৌড়ে গেল। টুসু চান করছিল সেখানে। শীত, গ্রীষ্ম, বর্ষা সব ঋতুতেই বিকেলে গরল জলে চান করে ছেলে আর মেয়ে, স্কুল থেকে ফিরেই। রুষার এই-ই অর্ডার।
কে জানে, ছেলেটার জ্বর বাড়বে কি, না জ্বরের মধ্যে চান করে! পৃথুর কিছুই বলার নেই। এই সংসারে তার ভূমিকা নীরব দর্শকের।
কী দয়া হল কে জানে? পৃথুর ঘরে আজকে টুসুর শোওয়ার অনুমতি মিলল। পৃথুর চেয়েও বেশি অবাক হল টুসু।
বাইরে রোদের তেজ পড়ে আসছিল। বুলবুলি ডাকছিল পেয়ারার ডালে। লাটখাম্বাতে জল তুলছিল খাণ্ডেলওয়াল সাহেবের বাড়ির চাকর। ধাঙড় বস্তির দিক থেকে উঁচুগলায় দুজন মেয়ের ঝগড়া কানে আসছিল। চিলের মতোই তীক্ষ তাদের স্বর। মেয়েরা যখন ঝগড়া করে তাদের ভীষণ খারাপ দেখায়, তাদের গলার স্বর শকুনের মতো হয়ে যায়। তখন বুকের মধ্যে কষ্ট হয় পৃথুর।
বুকের মধ্যে টুসুকে নিয়ে শুয়েছিল পৃথু। টুসুর মুখে একটা মিষ্টি মিষ্টি গন্ধ। বোধহয় বেবী-জনসন ক্রিমের। এখনও বাচ্চা। ছেলেটা দূরে থাকে, কাছে আসে না বলে এই শিশুর উপরই কত রাগ আর অভিমান করে থাকে পৃথু। দুজনের মধ্যে কে যে বেশি বাচ্চা ও নিজেই বোঝে না। রুষা ঠিকই বলে। দোষ নেই কোনও রুষার। পৃথুটা একটা অদ্ভুত বাজে লোক। বিচ্ছিরি বাজে টাইপ।
আকাশে ঘুড়ি উড়ছিল। সতরঞ্জ একটা। আর একটা চাঁদিয়াল। সেদিকে চেয়ে থাকতে থাকতে ছেলেবেলার কথা মনে পড়ে গেল ওর।
টুসু বলল, আমাকে একটা ঘুড়ি আর লাটাই কিনে দেবে বাবা?
দেব।
মা বকবে।
কেন?
মা বলে, ছোটলোকের ছেলেরা ঘুড়ি ওড়ায়।
আর ভদ্রলোকের ছেলেরা?
বিলিয়ার্ড খেলে, ভিডিও গেমস, টেনিস, এইই সব।
পৃথু ভাবল, তোর বাবাটা একটা ছোটলোক, তুই বেটা ভদ্রলোক হবি কী করে? তোর মা যতই চেষ্টা করুক। জিন-এর কাছে হেরে যাবে। ক্রোমোসোম। হিঃ হিঃ। বুকের আরও কাছে টেনে আনল ও টুসুকে। একেবারে বুকের কাছে। মনে মনে বলল, বাপকা বেটা সিপাহিকা ঘোড়া, কুছ নেই তো থোড়া থোড়া।
তোর ঘুড়ি ওড়াতে ভাল লাগে টুসু?
হ্যাঁ। খুব ভাল লাগে।
কীরকম ভাল লাগে? ভাল লাগে কেন রে?
সাচমুচ, দিল খুশ হো যাতা হ্যায়।
টুসু বলল, সাদা-সবুজ চেক চেক কম্বলের তলা থেকে উজ্জ্বল চোখ দুটি বের করে।
ভীষণই কষ্ট হল পৃথুর। টুসুর কথা শুনে। টুসুর জন্যে নয়। ওর নিজেরই জন্যে। যদি ও টুসুর জগতে ফিরে যেতে পারত আর একবার। যদি পড়ন্ত রোদে-রাঙা আকাশে একটি আট-আনা দামের সতরঞ্জ ঘুড়ি উড়িয়েই সাচমুচ দিল খুশ করতে পারত। একেবারে অনাবিল, অকলুষ খুশি। যে-খুশির দাবিদার থাকত না আকাশের পাখিও। কী মজাই না হত তাহলে।
আর কোনওদিন এমন কোরো না কিন্তু টুসু। বুঝেছ। খুব অন্যায় করেছ তুমি।
কী বাবা?
আজ সেগুনবনের কুয়োর কাছে গিয়ে কী সব বোকা-বোকা ভাবনা ভাবছিলে না? বোকারা ওরকম করে। যারা ইডিয়ট। তুমি কি ইডিয়ট?
না।
তবে? আমাকে ছুঁয়ে কথা দাও যে কখখনো, কখখনো ওরকম করবে না?
না।
না, কি?
না, মানে হ্যাঁ। আজকে চিঁড়ে ভাজা খাব তো বাবা? মা যদি বকে?
আমি এক্ষুনি গিয়ে মাকে বলে আসছি। বকলেই হল?
এখন না, একটু পরে যেও। বাবা। ঘুম থেকে উঠে রুমাল দিয়ে বল-পাকিয়ে লোফালুফি খেলবে? ছেলেবেলার মতো?
ছেলেবেলার মতো। তুই কি মস্ত বড় হয়ে গেছিস না কি?
বাঃ হইনি? এখনও না হলে আর কবে বড় হব? এবার তো উঠব ক্লাস ফোর-এ। আমি কবে তোমার মতো বড় হব বাবা?
মনে মনে বলল, পৃথু, বড় হোস নারে টুসু। কোনওদিনও বড় হোস না। এই দেবলোকের শৈশব ছেড়ে নারকীয় যৌবনে কখনও প্রবেশ করিস না তুই। তুই পাখি, কি কাঁচপোকা, কি প্রজাপতির মতো চিরদিন নবীন থাক, চিকন থাক। বড় হোস না বাছা আমার। বড় হোস না কখনওই।
মুখে বলল, আমিও তো ছোট এখনও। কোনওদিনও বড় হোস না টুসু। চিরদিনই ছোট থাকিস। বড়দের কোনও মজা নেই। তারা তোর মতো কাঠবিড়ালির পেছনে দৌড়ায় না, শামুক কী করে চলে তা দাঁড়িয়ে দেখার মতো নষ্ট করার সময় তাদের থাকে না, বসন্ত-বৌরি পাখির বাসাতেও তারা যায় না কখনও, ঘুড়ি ওড়ায় না। তুই ছোটই থাকিস। আমার মতো ছোট। চিরদিন।
মিছিমিছি বলছ তুমি। তুমি বড় না হলে অফিস যাও কেন? তোমাকে সবাই ঘোষ সাহেব বলে ডাকে কেন? তুমি তো অনেক বড়। টাকা রোজগার করো, বেয়ারারা, মেরী, লছমার সিং, অজাইব সিং এসব কি ছোটদের থাকে? মিছিমিছি বলছ তুমি।
ওরে পাগলা, টাকা রোজগার করলে বুঝি আর ছোট থাকা যায় না?
না। বড় হলে ছোট হবে কী করে? তুমিই তো পাগলা! না হলে, তোমাকে সকলেই পাগলা-ঘোষ বলবে কেন?
ঠিক আছে। আরেকদিন এই সব নিয়ে আলোচনা করব তোমার সঙ্গে। আজকে তুমি ঘুমিয়ে পড়। মাথা ব্যথা নেই তো এখন?
না। শুধু জ্বর। গায়ে, হাতে পায়ে ভীষণ ব্যথা বাবা। আমার না ভীষণ টায়ার্ড লাগে আজকাল।
টায়ার্ড লাগে? মাকে বলেছিলি কি কখনও?
না।
কেন?
মা বলে, পড়া ফাঁকি দেওয়ার জন্যে বলছি। আমি কিন্তু তবুও ফার্স্ট আসব ক্লাসে তুমি দেখো। মা বলে, আমাকে ফার্স্ট আসতেই হবে, যে করেই হোক। নইলে মায়ের প্রেসটিজ থাকবে না। তুমি নাকি কোনওদিনও সেকেন্ড হওনি বাবা?
আমি? কে বলেছে?
মা।
মিথ্যে কথা। আমি একেবারে বাজে ছেলে ছিলাম পড়াশুনায়। তোকে আশীর্বাদ করছে তোর খারাপ বাবা, বাজে বাবা, পাগলা বাবা, তুই যেন মানুষ হোস। ফার্স্ট নাই বা হলি!
হব ফার্স্ট।
কী করে? লাইফ-সায়ান্সে তো তুমি খারাপ করেছ?
পৃথু ছেলেকে মুখে বলল, তার মাথায় নিরুক্ত আশীবাদের হাত রেখে।
করলে কী হয়। অন্য সব সাবজেক্টে আমি সকলের চেয়ে অনেক বেশি পাই যে।
কোন সাবজেক্টে তুমি সবচেয়ে ভাল?
ইংরিজিতে।
বড় হয়ে তুমি কী হবে? কী হতে চাও?
তোমার মতো কবি হব। লিখব। হ্যাঁ বাবা? তোমার মতো অনেক কলম কাগজ সামনে নিয়ে বসে থাকব সবসময়।
হার্ট-ফেইল করার উপক্রম হল পৃথুর। ধড়মড়িয়ে উঠে পড়ে বলল, না, ন-না, আমি কবি, তা তোমাকে কে বলল? আমি তো এঞ্জিনীয়র।
মা বলেছে।
মা? মা কী বলেছে? আমি কি এঞ্জিনীয়র নই? খাটের উপর উঠে বসল ও উত্তেজিত হয়ে।
মা প্রায়ই বলে আমাকে আর দিদিকে।
কী বলে রে? আর? দিদিকেও বলে?
হ্যাঁ। দুজনকেই। বলে, এঞ্জিনীয়র, ডাক্তার, উকিল, চাটার্ড অ্যাকাউন্ট্যান্ট তো হওয়া সোজা, তোমার বাবার মতো কবি হবে, লেখক হবে, ভাল মানুষ হবে।
ভাল মানুষ। আমি? তোর মা বলে? রুষা? কী বলছিস তুই?
হ্যাঁ বাবা। মা তো সবসময়ই বলে আমাকে আর দিদিকে।
পৃথু নিজেকে তো চেনে নাইই অন্যদেরও কাউকেও চেনে না কি? তার স্ত্রী, তার ছেলে মেয়ে?
পুরোপুরি হতাশ হয়ে আবার ও ছেলের পাশে শুয়ে পড়ে। এবার সেইই যাবে বাসিয়ার দিকের সেগুনবনের কুয়োতলায়। তার মাথার গোলমালটা এবারে আর ঠেকিয়ে রাখা গেল না। পিস্তলটা এবারে আনিয়ে নিতে হবে জবলপুরের অনন্ত বিশ্বাসের দোকান থেকে। রুষা। মাই গুডনেস। এক বাড়িতে, এক ঘরে, এক খাটে থেকেও একজন মানুষকে কতই কম চেনে। ঠিকই বলে দিগা পাঁড়ে। “বিধিহু ন নারি গতি জানী।” বিধাতারও নারীর গতিপ্রকতি জানা নেই।
বেচারি রুষা। বেচারি। পৃথু ভাবে। পৃথুকে এত ভাল ভাবে সে? ছিঃ ছিঃ। আসলে যে পৃথু লেখে, যে কবি, সে যে অন্য লোক। সত্যিই যে লেখে, সে তো অন্য লোকই। সে তো পৃথু নয়! ওই পৃথু, রুষার স্বামী, অথবা মিলি-টুসুর বাবা তো সে নয়। সে যে…।
কার কবিতা যেন? কেবলই যে কবিতাই মনে পড়ে! সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের। মনে পড়েছে। কবিতা যখন হঠাৎ হঠাৎ মনে পড়ে যায় তখন পঙক্তিগুলি দূরদেশের পরিযায়ী পাখিদেরই মতো দ্রুতবেগে ফিরে আসতে থাকে মস্তিষ্কর ভিতরে শীতল বিস্মৃতির সাইবেরিয়া থেকে স্মৃতির চিলকার উষ্ণতায়, জৈব, জীবন্ত, কোষে কোষে বসন্তে—ফেটে-যাওয়া শিমুল বীজের আলতো-হাওয়ায় ভাসতে-থাকা পেঁজা তুলোরই মতো!
“যে লেগে, সে আমি নয়।
কেন যে আমায় দোষী কর!
যে লেখে সে আমি নয়
যে লেখে সে আমি নয়,
সে এখন নীরার সংশ্রবে আছে পাহাড়-শিখরে
চৌকোশ বাক্যের সঙ্গে হাওয়াকেও
হারিয়ে দেয় দুরন্তপনায়
কাঙাল হতেও তার লজ্জা নেই
এবং ধ্বংসের জন্য তার এত উন্মত্ততা
দূতাবাস কর্মীকেও খুন করতে ভয় পায় না
সে কখনো আমার মতন বসে থাকে
টেবিলে মুখ গুঁজে?”
রুষা! ও রুষা! তুমি কি ক্ষমা করবে আমায়? আমি আমার আমিময় জীবনে কেবল আমাকে নিয়েই ব্যতিব্যস্ত ছিলাম সারাক্ষণ। তুমি যে আছ, এমন করে, ভরে আছ আমার সমস্ত আমিত্ব; এক মুহুর্তের জন্যেও মনে হয়নি তা আমার। ছিঃ। আমি কী খারাপ? কী খারাপ আমি!
মনে পড়েছে। এ-কবিতাই বা কার? সফল কবিরা মিলে এই ব্যর্থ, মস্তিষ্কবিকৃত কবিকে একেবারে পাগলই করে দেবে।
“পাহাড়, সমুদ্র, নারী এই সব জ্যামিতিক ছকের পিছনে
সর্বস্বান্ত হওয়া যায় ঘুরে ঘুরে ঘুরে,
জল বা দুধের মতো জানা যায় নাকো”।
“………………………………………………………………………………………………………………………..
পূর্ণেন্দু পত্রীর।
ও গো আমার কবিরা। তোমরা যে সব অমৃতর পুত্র।
জানে না, পৃথু সত্যিই জানে না, রুষা তার ছেলেমেয়ের কাছে তাকে কবি বা লেখক বলে পরিচিত করায় কেন? তাহলে কি রুষা ওকে বুঝেছে? কনফ্যুসিয়াসের কটি কথায় পৃথুর যে গভীর বিশ্বাস, তা কি রুষাকেও স্পর্শ করেছে? বিশ্বাস যদি গভীর হয়, তাহলে তা ছোঁয়াচে হতে যে বাধ্য। তাই-ই হয়তো…
কনফ্যুসিয়াস লিখেছিলেন, যে মানুষ উত্তম সে বোঝে কোনটা ভাল। আর অধম যে, সে বোঝে কোনটা বিক্রি হবে। যে উত্তম, সে নিজের আত্মাকে; তার সত্তাকে ভালবাসে। আর অধম ভালবাসে তার সম্পত্তিকে। যে উত্তম, সে তার ভুলের জন্যে কী কী মাশুল গুনেছে তাই-ই মনে করে রাখে সবসময়, আর যে অধম সে মনে করে রাখে কী কী উপহার আর পুরস্কার কার কার কাছ থেকে সে পেয়েছিল।
রুষা বসেছিল বারান্দায়। আজ তার মন বড়ই খারাপ। সে সত্যিই নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। ভিনোদ তাকে নষ্ট করে দিচ্ছে। শরীরের মধ্যে যে এত গভীর সব আনন্দ লুকোনো ছিল তা পৃথুর সঙ্গে এতবছর ঘর করেও সে জানেনি কখনও। আনন্দে প্রায় পাগলই হয়ে উঠেছিল আজকে। নিজেকে এমন করে হারিয়ে ফেলেনি ও কখনও এর আগে। ঠিক সেই সময়ই হঠাৎ টুসু এসে বেল টিপেছিল। অনেক প্ল্যান করে, বাড়ি সুদ্ধ সবাইকে বাইরে পাঠিয়ে নিজে স্কুলে না গিয়ে, উত্তেজনা আর ভয়ে আধমরা হয়ে গিয়ে ভিনোদকে আসতে বলেছিল। সেই সময়েই হঠাৎ টুসু। এবং পৃথুও। পৃথুও তো আগে আসতে পারত টুসুর চেয়ে। তাহলে কী হত? ভাবতে পারে না রুষা। ভয়ে ওর হাত-পা ঠাণ্ডা হয়ে যাচ্ছে। আর আজ টুসু যা করতে যাচ্ছিল।
নাঃ আর ভাবতে পারে না রুষা। বড় কষ্ট। বড়ই কষ্ট রুষার।
পৃথু মানুষটা বড় ভাল। ভারী সোজা সরল। শিশুর মতো। আজকাল ওরকম মানুষ হয় না। এরকম মানুষ অচল এ সমাজে। কোনও কথা লুকোতে পারে না, যা মনে হয় বলে ফেলে। এমনকী লুকোতে পারে না কুর্চি সম্বন্ধে ওর দুর্বলতাটুকুও। সহজেই ধরা পড়ে যায় রুষার কাছে। যদিও ব্যাপারটা সম্ভবত পুরোই মানসিক। তাই-ই ওকে ঠকাতে বিবেকে লাগে বড়। কিন্তু এটা ঠকানো? রুষার জীবন মানে কি পৃথু-মিলি-টুসু, স্কুল, ক্লাব, মহিলা সমিতি—বাড়ি। ব্যসস। এটুকুই? ওর নিজস্ব জীবন বলে কি থাকতে নেই কিছু? সব জায়গাতেই ও তো একাই যায়, অথবা ছেলেমেয়ে নিয়ে। পৃথু কোথাওই যায় না তার সঙ্গে। এতদিনেও যে ভিনোদের মতো বহু মানুষ তার জীবনে আসেনি সেও তো একটা বড় কথা। সেটাই দুর্ঘটনা একটা। ওর নিজস্ব চাওয়া, নিজস্ব বন্ধু, নিজস্ব জগৎ বলতে কি কিছুই থাকতে নেই? বিয়ে, মানে কি একটা কয়েদখানা? একবার এ জীবনে ঢুকলে সব কিছু নিঃশেষে দিয়ে ফেলে উদবৃত্ত বলতে কি কিছুমাত্রই থাকে না আর কারও হাতেই? যা অন্য কাউকে, নিজের পছন্দসই, কোনও মানুষের হাতে তুলে দেওয়া যায়? টুকরো-টুকরো, কোনও একজন পুরুষ কি কোনও একজন নারীর শরীর মনের সব চাহিদা মেটাতে পারে? রুষা কি একাই ভ্ৰষ্টা? নষ্টা? ওর খুব ইচ্ছে করে জানতে, ও যা ভাবে তা ওর শিক্ষার, ওর সমাজের লক্ষ লক্ষ অন্য বিবাহিতা মেয়েরাও ভাবে কি না? শরীর হয়তো সকলে চায় না, বা চাইলেও পায় না; মনে মনেও কি স্বামী ছাড়া আর কাউকেই চাইতে ইচ্ছা করে না? দিতে ইচ্ছে করে নিজেকে? আর মনই যদি দিতে পারে কাউকে, শরীরটা দিতে বাধা কোথায়? তার শরীরে এমন বিশেষ কি আছে যা অন্য একজন নারীর শরীরে নেই। তফাৎ যা, তা তো মনেরই, ব্যক্তিত্বর, রুচির। মনই যদি মিলল মনের সঙ্গে, ব্যক্তিত্ব মিলল ব্যক্তিত্বর সঙ্গে, রুচিও হয়তো মিলল রুচির সঙ্গে, সেখানে শরীরের দামটা কতটুকু? তবে পুরুষরাই সবাই-ই বোধহয় ভিনোদেরই মতো। যা দামি তার দাম না বুঝে, যা সস্তা সেই শরীরটাকেই দামি বলে মনে করে, দামিকে তাচ্ছিল্য করে।
আজ টুসুর ব্যাপারটা এবং ফাঁকা বাড়িতে ভরদুপুরে ভিনোদ আসার খবর জানার পরও পৃথুর এই নিরুত্তাপ ব্যবহার তাকে বড়ই ধাক্কা দিয়েছে। মানুষটা কি বোঝে সবই? মুখে কিছুই বলে না কি ইচ্ছে করেই? ছিঃ ছিঃ। এমন উপেক্ষার চেয়ে ও বরং ঝগড়া করতে পারত, হঠাৎ রেগে গিয়ে চড়ও মারতে পারত একটা। তাহলেও জানত রুষা যে,পৃথুর কাছে তার এখনও কিছু দাম আছে। কিন্তু পৃথুর অদ্ভুত ঠাণ্ডা এই দ্বেষহীন, ঈষাহীন ব্যবহার ওকে ভিতরে ভিতরে ভীষণ এক যন্ত্রণা দেয়। প্রতিকারহীন যন্ত্রণা। দুর্বল করে দেয় ওকে। বাধা না থাকলে তাকে প্রতিহত করার প্রশ্নই ওঠে না। কী যে করবে ও ভেবেই পায় না।
যে আগুন ভিনোদ জ্বালিয়েছে ওর শরীরে, সে আগুন ক্রমশই জোর হতে থাকবে। পৃথু-মিলি-টুসু একদিকে। একদিকে তার এতদিনের জীবন-অভ্যেস। আর অন্যদিকে ভিনোদ।
কী যে করে রুষা। বেচ্চারি রুষা।
নিজেই বলল, নিজেকে।
টুসুর গাটা বেশ গরম হয়েছে।
ওকে বুকের কাছে টেনে নিল পৃথু। ভাবল, অজাইব সিংকে পাঠাবে ঝিংকু ডাক্তারকে আনতে। কিন্তু রুষার ভাল লাগে না ঝিংকুকে। ও বলে, ‘বড় বেশি গসিপিং টাইপ’। কখনও “গসিপিং টাইপ” উকিল বা ডাক্তারের কাছে যেতে নেই। যারা গোপনীয়তা রাখতে না জানে তাদের…
হয়তো ঠিকই বলে রুষা। ও কোম্পানির ডাক্তারকেই আনাবে। ডঃ পোপটলাল। পোপটলাল শরীর বোঝে, শাস্ত্র বোঝে, ডিগ্রির বোঝায় তাঁর লেটারহেড ন্যুজ্ব। কিন্তু মন বোঝে না। যে-ডাক্তার মন বোঝে না, তার ডাক্তারী করা বৃথা। শিকারির মতো ডাক্তারেরও একটা সিক্সথ সেন্স-এর ব্যাপার আছে। থাকা উচিত।
টুসু ওর ডান হাতটা জড়িয়ে ধরে শুয়ে আছে। আকাশের ঘুড়ি-ওড়া দেখতে দেখতে ঘুমিয়ে পড়েছে ও জ্বরের মধ্যে।
চাঁদিয়াল ঘুড়িটা কেটে গেছে অনেকক্ষণ, ভেসে গেছে। শীতের দুপুরের নীল আকাশে তা দেখে, দুঃখ পেয়েছিল ও।
বেচারি টুসু এখনও জানে না, মানুষ হয়ে যখন জন্ম নিয়েছে এই সংসারে, তখন সারা জীবন কত অসংখ্য ঘুড়িই যে কেটে যাবে ওর চোখের সামনে। কত সুন্দর স্বপ্নের সব ঘুড়ি, সাধের ঘুড়ি, প্রেমের ঘুড়ি, হয়তো সততা এবং বিশ্বস্ততার ঘুড়িও। কোনও ঘুড়ির সুতো থাকবে তার নিজের হাতে, কোনওটায় নিজে মাঞ্জা দেবে কিন্তু প্রায়ই সবসময়ই অপরপক্ষের ক্ষুরধার মাঞ্জার ভার এবং ধারে কচ করে কেটে যাবে তার সব ঘুড়ি। বেচারি তো শধু লাইফ-সায়ন্সেই খারাপ নম্বর পেয়েছে। তবুও, প্রথম হবে স্কুলের পরীক্ষাতে। স্কুল কলেজের পরীক্ষা তো ছেলেখেলা। পৃথু মনে মনে বলল, ওরে আমার ছোট্ট, বোকা ছেলে, তোমাকে এসব ছেলেখেলাতে যে পাশ করতেই হবে। এসব তো চৌকাঠ। এখনও তো আসল পরীক্ষাই বাকি। জীবনের পরীক্ষা। প্রত্যেকটি দিন, প্রত্যেকটি সম্পর্কই তো এক একটি পরীক্ষা। “দ্যা ব্যাটল অফ লাইফ’। দ্যাট ব্যাটল ইজ ইয়েট টু বীগিন। আজ তোর লাইফ-সায়ান্সই ভাল লাগছে না শুধু। জীবনে পৌঁছে দেখতে পাবি বাবা যে, তোর কিছুই ভাল লাগছে না। জীবিকার জন্যে শতকরা নিরানব্বুই জন মানুষ যা করে, তা করতে ভাল লাগে না তাদের কারওই। তবুও করতে হবে। সকাল থেকে রাত, দিন থেকে মাস, মাস থেকে বছর; যৌবন থেকে মৃত্যুদিন অবধি। কী করবি বাবা! নিঃশ্বাস ফেলবি, প্রশ্বাস নিবি; কিন্তু বাঁচা কাকে বলে তা জানতে পারার আগেই মরে যাবি।
কখনও বা হয়তো ভাববি, ভাল চাকরি করা আর ভালভাবে বেঁচে থাকা বুঝি সমার্থক। কখনও বা ভাববি, গাড়ি চড়া, কোম্পানির ডিরেক্টর হওয়া, সমাজে পরিচিত হওয়াই বুঝি বাঁচারই সমার্থক। আবার কখনও বা ভাববি নাম, যশ, খ্যাতি, স্ট্যাচু, নিজের নামে রাস্তা এসবও প্রচণ্ডভাবে বাঁচার সমার্থক।
না রে টুসু, আমার সোনা ছেলে; সে সবও নয়। বেঁচে থাকার মানে একজন মানুষের ব্যক্তিগত অভিধানে এক একরকম। তাই-ই তো মানুষ আমরা। বিধাতার হাতে-গড়া শ্রেষ্ঠ জীব!
তোর মাকে একদিন আদর করেছিলাম। কোনও দেবদুর্লভ সুগন্ধিক্ষণে তোর আরম্ভ হওয়া শুরু হয়েছিল। তখন তুই ছিলি তোর মায়ের চোখের তারায়, তার স্বপ্নে, আমার কাজের অবকাশের ফাঁকটুকু ভরে। অথবা বনপথে, একলা-চলার ভাবনায়। তৈরি হওয়ার প্রক্রিয়াটা আরম্ভ করাটুকুই শুধু তোর বাবা-মায়ের হাতে ছিল রে। শুধু ওইটুকুই। এত বড় পৃথিবীতে কোটি কোটি কোটি মানুষের মধ্যে তুই কেমন মানুষ হবি না হবি, তা শুধুমাত্র তোরই ব্যাপার। একমাত্রই তোরই ব্যাপার। আজকের দুটি নরম হাত, যে দুটি হাতে তুই আমার ডান হাত আঁকড়ে ধরে ঘুমিয়ে আছিস, ভাবছিস; তোর বাঘ-মারা বাবা তোকে চিরদিন এই পৃথিবীর সব ঝড়-ঝক্কা থেকে বাঁচতে পারবে, আজকের তোর সেই দুটি নরম হাত দিয়েই, তোর মস্তিষ্ক দিয়ে, তোর বিবেক, তোর স্বাতন্ত্র্য দিয়ে তৈরি করতে হবে তিল তিল করে নিজেকে। সব শিক্ষারই দুটি দিক থাকেরে টুসু বাবা। কোনও স্কুল, কোনও কলেজ, কোনও বিশ্ববিদ্যালয়ই তোকে “শিক্ষিত করতে পারবে না, যদি না তোর মধ্যে যে অদৃশ্য কিন্তু প্রচণ্ডভাবে সক্রিয় শিক্ষা-প্রতিষ্ঠান আছে, তাকে তুই কাজে না-লাগাস। পৃথিবীতে, সত্যিকারের বড় যাঁরা হন, তোর বাবার মতো ইউলেস নন-এনটিটি মানুষ নন, যাঁরা যথার্থই বড়; তাঁরা সবাই-ই এই ভিতরের শিক্ষার জোরেই এতখানি পথ পেরিয়ে এসেছেন অন্যদের পিছনে ফেলে পেরিয়ে আসেন। একা একা যে-কোনও দৌড়েই যে প্রথম হয়; সে একাই আগে থাকে। তার সামনে বা পাশে কেউই নয়।
ঘুমিয়ে নে বাবা। আরামে ঘুমিয়ে নে। সারাটা জীবন জাগতে হবে তোকে! মানুষের মতো মানুষ হতে হলে, ঘুমের সঙ্গে, আরামের সঙ্গে, সাধারণের সঙ্গে তোকে আড়ি করতেই হবে। দলে বলে কেউ কখনও বড় হয়নি রে। পৃথিবীর মানুষের ইতিহাস অন্তত তাই-ই বলে। অনেক রাতজাগা আর অনেক হাঁটার জন্যে তৈরি হ বাবা। তোর বাবা যা পারেনি, পারল না এ জীবনে, তুই যেন তা পারিস। এই-ই আশীবাদ করি তোকে, আমি; তোর অপদার্থ বাবা!