সেদিন সন্ধ্যাবেলায় লখাই দাওয়ায় বসে রয়েছে যেন গুহাভ্যন্তরে এক পাথরের মানব রাত্রি আসার অভিশাপে স্তব্ধ ও শঙ্কিত।
তিন বছরের হীরালাল উলঙ্গ হয়ে একলা আপন মনে খেলা করছে উঠোনে।
শ্যাম আর মধু গেছে ফরাসডাঙায় বীজধান আনতে। কালী কাজে ব্যস্ত।
এমন সময় একটা মূর্তি উঠোনে এসে থমকে দাঁড়াল হীরালালের কাছে। হীরালাল হঠাৎ লোকটার হাত ধরে বলে উঠল, জ্যাঠা? পরমুহূর্তেই হাত ছেড়ে দিয়ে অবাক হয়ে লোকটার চোখের দিকে তাকিয়ে রইল। জ্যাঠা তো নয়।
লোকটা নির্বাক, স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল হীরালালের দিকে।
লখাইয়ের হঠাৎ নজরে পড়তেই সে বলল, কে গো ওভেনে?
মূর্তি নীরব, নিশ্চল।
কে? কথা বলে না কেন? বলে লখাই উঠে দাওয়া থেকে নেমেই থমকে দাঁড়িয়ে পড়ল।
নারান্!…উভয়ে তারা চোখে চোখ রেখে দাঁড়াল। এক বিচিত্র উত্তেজনায় উভয়েই সটান হয়ে উঠল। দুজনেরই বয়স হয়েছে, পাক ধরেছে চুলে।
হীরালাল একবার লখাই ও নারানের দিকে অবাক হয়ে তাকাতে লাগল। লখাইয়ের মনে গাইছে নারান হীরালালকে কিছু করবে হয় তো। হয় তো গলা টিপে ধরবে এখুনি হীরালালের।
নারান একবার এদিকে ওদিক তাকিয়ে আবার দেখল লখাইয়ের দিকে, তারপর হীরালালের দিকে। স্থির অপলক চোখ, ভাজাচোরা, মুখটা যেন একটা মাটির ভালা।
লখাই কল, লারান।
বলো।
এসো।
না।
তুমি কলে কাজ করো?
করি।
সে কাজ কি ভাল? সে তত গোলামি।
গোলাম নয় কে? কলের গোলাম বাই হবে।
কেন?
সারা দেশে কল বসবে ইংরেজের।
আমি মলেও সে কাজ করব না।
তবু তুমি ইংরেজের পেরজা।
এবার স্তব্ধ হয়ে গেল লখাই।
নারান একটু চুপ থেকে হঠাৎ বলল, সুধে আছ খুব?
সুখ? যেন আছে কিনা সে কথা স্মরণ করতে লখাই তন্ময় হয়ে তাকিয়ে রইল অপলক চোখে।
নারান হঠাৎ জিজ্ঞেস করল, তা হলে মরে গেছে।
লখাই চমকে উঠল। কে?
দেখল নিরুত্তর নারান তোবড়া মুখে ঘোলাটে চোখে ঘরের দরজার দিকে তাকিয়ে আছে। লখাই ফিরে দেখল সেখানে কেউ নেই। বলল, কাঞ্চীবউয়ের কথা বলছ?
নারান তেমনি অপলক কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে চমকে দৃষ্টি ফিরিয়ে একবার হীরালালকে দেখে বেরিয়ে গেল। বিশেষ কোনও ভাবান্তর হল না তার মুখের।
লখাই তাড়াতাড়ি এগিয়ে গিয়ে ডাকল, নারান, যেয়ো না, এসো।
দূরে একটা ঝোপের আড়াল থেকে ভেসে এল হাওয়ায়—না, আর লয়।
পরদিন সকালবেলা সুদীর্ঘ বড় সড়কটার একটা ভাঙা জায়গা গাঁয়ের সুবিধার জন্যই লখাই গঙ্গার ধার থেকে মাটি কেটে এনে ভরাট করছিল। হীরালাল তার সঙ্গে তার ছোট ছোট হাতে মাটি ঘেঁটে মনের খেয়ালে গড়ছিল সব পুতুলের কিম্ভুতকিমাকারমূর্তি।
এমন সময় দক্ষিণ দিক থেকে ধুলো উড়িয়ে ঘর ঘর করে ছুটে আসতে লাগল একটা একা। লখাই সরে যাওয়ার জন্য উঠতেই দেখতে পেল এক্কার সওয়ারি দুটো গোরা সাহেব।
হঠাৎ চোখজোড়া জ্বলে উঠল লখাইয়ের, চোয়াল দুটো শক্তহয়ে উঠল। সে সরল না। যেমন বসে মাটি দিচ্ছিল, তেমনি উত্তরে মুখ করে বসে রইল।
হীরালাল বাপকে যেতে না দেখে রাস্তার মাঝখানে দাঁড়িয়ে অবাক বিস্ময়ে তাকিয়ে রইল গাড়িটার দিকে।
ঘোড়ার দ্রুত ক্ষুরাঘাতের শব্দ ক্রমাগত এগিয়ে এল। এগিয়ে আসতে লাগল চাকার ঘরঘরানি। তারপর একটা তীব্র চিৎকার ভেসে এল, এও, হট যাও, হট যাও।
কিন্তু লখাই কী এক অন্ধ রাগে ও গ্লানিতে শক্ত হয়ে বসে রইল। সমস্ত রক্ত তার মাথায় উঠে উসেছে। মুঠি পাকানো হাতে পিষে যাচ্ছে মাটি। কিন্তু প্রাণ পণ করেছে উঠবে না এ সড়ক থেকে।
হীরালালও অদ্ভুতভাবে তেমনি দাঁড়িয়ে রইল।
তীব্রবেগে থামতে গিয়ে একবার হোঁচট খেয়ে ঘোড়াটা খানিকটা পিছনে এসে দাঁড়িয়ে পড়ল, একেবারে হীরালালের একহাত সামনে। চাকজোড়া খানিকটা মোড় বেঁকে আর্তনাদ করে থেমে গেল। একাকার হয়ে গেল ধুলোয় জায়গাটা।
মাথার উপরে চাবুকের শিষ তুলে গোরা দুটো চেঁচাতে চেঁচাতে নেমে এল, এও ব্লডি সোয়াইন।
ব্ল্যাক বাফেলো! ক্যায়া করটা যায় টুম?
কাম হোতা হ্যায়। বলে লখাই ফিরতেই সাহেব দুটো এক বিচিত্র শব্দ করে চমকে উঠল। এ সেই গাড়লিয়ার আখড়ার দুই গোরা, তেলেনিপাড়ার রবার্টস ও ওয়ালিক। তারা দেখল, এ সেই মন্দিরের ক্রুদ্ধ ধর্মান্ধ।
ওয়ালিক বিস্মিত হয়ে বলে উঠল, টুমার নাম লখাই আছে? গাড়ুলিয়াতে টুমি হামাডের—
হ্যাঁ।
হীরালালকে দেখিয়ে বলল, টুমার লেড়কা?
কোনও জবাব না দিয়ে হীরালালকে কোলে তুলে নিল লখাই।
রবার্টসন কী সব বিড়বিড় করছিল লখাইয়ের দিকে তাকিয়ে। তাকে থামিয়ে ওয়ালিক খুব নরম গলায় বলল লখাইকে, টুমি হামাডের কাম করিবে?
না।
বহুট টাকা মিলবে।
লখাই জ্বলন্ত চোখে তাকিয়ে বলল, আপনা টাকা লেকে তুম বিলাত চলা যাও।
কথা শুনে রবার্টসন হাঁ হয়ে গেল, গোল হয়ে উঠল তার চোখ।
ওয়ালিক মোলায়েম হেসে বলল, না না না, আমার টাকা সারা দুনিয়ায় খাটবে।
লখাইয়ের মনে পড়ল কালকের নারানের কথা—তুমিও ইংরেজের পেরজা।
নিরন্তর অসহ্য যন্ত্রণায় ও ক্রোধে শাবল আর মাটি বওয়া চুপড়িটা নিয়ে সরে গেল সে।
উত্তর দিকের পথ আঙুল দিয়ে নির্দেশ করে বলল, যাও, চলা যাও।
ওয়ালিক যেন মুগ্ধ হয়েছে লখাইয়ের সাহসে এবং এও সে বুঝেছে ইচ্ছাকৃতভাবেই গাড়িথামিয়েছে লখাই। বলল, হমারা কাম করনেসে বহুট ইনাম মিলেগা!
লখাই লেলিহান শিখার মতো খাড়া হয়ে আবার থেমে গেল। বলল, আপনা রাস্তা দেখো।
ওয়ালিকের মুখ লাল হয়ে উঠল। তবু হাসবার চেষ্টা করে রবার্টসনকে নিয়ে গাড়িতে উঠে চাবুকের শব্দ করল। গাড়ি চলে গেল।
লখাই আস্তে আস্তে তার কাঁচা মাটি দিয়ে বোজানো জায়গাটা দেখল। ঘোড়র পায়ের ও চাকার দাগ বসে গেছে। আবার সে শাবলটা দিয়ে জায়গাটা পিটিয়ে সে দাগ নিশ্চিহ্ন করে দিল। তারপর উঠে দাঁড়াতেই তার ঠোঁট দুটো বেঁকে উঠে চোখের কোণে বড় বড় ফোঁটায় জল জমে উঠল। সে জল পড়ল টপটপ করে সড়কের উপর। তার চোখের সামনে সব ঝাপসা হয়ে কেঁপে কেঁপে উঠল। হীরালাল অবাক হয়ে তাকিয়ে রইল বাপের দিকে।
.
পরদিন একটু বেলায় সারদা এসেছে লখাইকে নিয়ে যেতে আখড়ায়। শেষ সেবা করে সে বিদায় চায়, বেরিয়ে পড়তে চায় বৃন্দাবনের পথে। জীবনের বাকি কটা দিন সে সেখানেই কাটাতে চায়।
এমন সময় ড়ুমড়ুম করে ঢোলক বেজে উঠল। কীসের ঢোল শোহরত। সড়কের উপর ভিড় করল এসে বহু নরনারী। লখাইও এসে দাঁড়াল।
ঢুলীর সঙ্গে পরগনার জমিদারের এক গোমস্তা, হতে একখানি কাগজ। তিনি চেঁচিয়ে বললেন, হালিশহর পরগনার জমিদারের এইরূপ আদেশ হইতেছে যে, পরগনার গঙ্গার ধারের কোনও জমি বিলি বন্দোবস্ত দেওয়া হইবেক না এবং বর্তমান সমস্ত বাসস্থান ও বন্দোবস্ত দেওয়া গঙ্গার ধারের জমি কোম্পানিকে বিক্রি করিতে সকলে বাধ্য থাকিবেক। এইখানে সমস্ত জমিতে চটকল বসিবেক, কোম্পানির এইরূপ আদেশ আছেন।
.
একটা হইচই হাহাকার পড়ে গেল। তা হলে এতদিনের গ্রাম জনপদ ভিটা মাটি সব ছেড়ে চলে যেতে হবে? নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবে এইসব প্রাচীন ইমারত, আগুরিপাড়া, দুলোপাড়া, বাগদীপাড়া, সমস্ত জগদ্দল? কেন কেন কেন?
মানুষগুলো যেন আদেশের সঙ্গে সঙ্গেই উচ্ছেদ হয়ে গেছ এমনি এক অসহায় শঙ্কিত চোখে পরস্পরের দিকে তাকিয়ে রইল।
লখাই বাড়ি এসে দাওয়ার বাঁশটা ধরে দাঁড়াল। হাতে শক্তি নেই, পায়ে শক্তি নেই, শক্তি নেই মাড়িতে। রক্ত যেন সব জল হয়ে গেছে। …জগৎ যেন অন্ধকার।
সারদা এসে তার হাত ধরে বলল, অমন পাগলের মতো তাকিয়ে আছ কেন? কী হয়েছে?
এক বিচিত্র অর্থহীন দৃষ্টিতে সে প্রৌঢ়া সারদার দিকে তাকাল। না, সে যৌবন নেই, সে দিন নেই, সে রং নেই। সব ভেঙে যাচ্ছে, তাই মাটি কাঁপছে। তার কানে এসে বাজছে সেই ঘোড়ার। পদধ্বনি, চাকার ঘরঘর শব্দ। তার চোখের উপর ভেসে উঠল গ্রামছাড়া, বহুদিনের ভিটাছাড়া দীর্ঘ এক বাস্তুহারা দল চলেছে ভিটার সন্ধানে। চিৎকার করছে, কাঁদছে, কলরব করছে।
আর সেই হাজার বছরের গড়ে তোলা ও পরিত্যক্ত জনপদ ভেঙে উঠছে মস্ত বড় বড় ইমারত। দীর্ঘ পাড় জুড়ে তার পাথুরে দুর্গের মতো ব্যাপ্তি। তার মধ্যে যন্ত্রের গর্জন গুমগুম করে ধরিত্রীর অঙ্গ পীড়ন করছে। বিশাল কালো চিমনি দৈত্যের মতো দাঁড়িয়ে আছে সগর্বে, সন্ধানী সতর্ক প্রহরীর মতো। ফোট গ্লস্টারের চিমনির মতো গর্জন করে উঠছেগোঁ গোঁ করে। লোহা পাথর পাট ধুলো রেল…এক দানবীয় শব্দে হাহা করে ছুটে এসে গ্রাস করছে সেনপাড়া। জগদ্দল পাথরের মতো দুলে বাগদী ডোমপাড়া পদদলিত করে এক বিচিত্র বিশাল যন্ত্র দাঁড়াচ্ছে মাথা তুলে। তারপর, আরও আরও…সমস্ত জগৎটাই যেন ছেয়ে ফেলছে কেবলি চটকল…চটকল…চটকল। আর সব ছাপিয়ে সেই ইমারতের আকাশের উপরে চটকল দেবতার চাবুকের শিষ হিসহিস করে উঠছে ক্ষিপ্ত বিষাক্ত গোখরোর মতো।
কেবল তার পায়ের কাছে হীরালাল তার সেই কাঠের হাতুড়িটা দিয়ে বহু কষ্টে সংগ্রহ করা একটা পেরেক পুঁতছে মাটিতে আর লখাইয়ের পা-টা ঠেলতে ঠেলতে বলছে–সল, সল… ছিলিন্দারতা খালা ক’লে দিই!