মিসেস বিশ্বাসের ফ্ল্যাটের কাছে হাজির হলেন নটবরবাবু। রমা এবং ঝনমা নিজের দই মেয়েকে মিসেস বিবাস ব্যবসায় নামিয়েছেন শুনে সোমনাথ আর অবিশ্বাস করছে না।
মিসেস বিশ্বাসের ফ্ল্যাটে যাবার জন্য সিড়ি দিয়ে উঠতে উঠতে নটবরবাবু বললেন, “মেয়েমানুষ সম্পর্কে সেন্টিমেন্ট-ফেট বাংলা নভেল নাটকেই পড়বেন। আসলে ফিল্ডে কিছুই দেখতে পাবেন না। টাকা দিয়ে মায়ের কাছ থেকে মেয়েকে, ভায়ের কাছ থেকে বোনকে, স্বামীর কাছ থেকে বউকে, বাপের কাছ থেকে বেটীকে কতবার নিয়ে এসেছি টাকার অ্যামাউন্ট ছাড়া অন্য কোনো বিষয়ে গাজেনদের একটও উদ্বিগ্ন হতে দেখিনি। লাস্ট দশ বছরে বাঙালীরা অনেক প্রাকটিক্যাল হয়ে উঠেছে জাতটার পক্ষে এটাই একমাত্র আশার কথা।”
নটবর মিত্তির অমায়িক হাসিতে মুখ ভরিয়ে মিসেস বিশ্বাসকে জিজ্ঞেস করলেন “কেমন আছেন? অনেকদিন আসতে পারিনি। ক্যালকাটার বাইরে যেতে হয়েছিল।”
“পাঁচজনের আশীর্বাদে” যে ভালোই চলে যাচ্ছে তা মিসেস বিশ্বাস জানিয়ে দিলেন। বললেন, “পুরানো ফ্ল্যাট নতুন করে সাজাতে প্রায় টেন থাউজেন্ড খরচা হয়ে গেলো।”
“এর থেকে নতুন কোনো ফ্ল্যাট ভাড়া নিলে অনেক সস্তা হতো। কিন্তু এই ঠিকানাটা দিল্লী, বম্বে, ম্যাড্রাসের অনেক ভালো ভালো পার্টির জানা হয়ে গেছে। কলকাতায় ট্যুরে এলেই তাঁরা এখানে চলে আসেন। ঠিকানা পাল্টালেই গোড়ার দিকে বিজনেস কমে যাবে।”
ঝকঝকে তকতকে হলঘরটার দিকে তাকিয়ে খুশী হলেন নটবরবাবু। “এ যে একেবারে ইন্দ্রপরী বানিয়ে তুলেছেন!” নটবর মিত্তির প্রশংসা করলেন। “চারটে-পাঁচটা ছোট-ছোট চোর করেছেন, মনে হচ্ছে।”
“জায়গা তো আর বাড়ছে না, কিন্তু মাঝে মাঝে অতিথি বেড়ে যায়। তাই এরই মধ্যে সাজিয়ে-গুজিয়ে বসতে হলো।” ঠোঁট উল্টিয়ে মিসেস বিশ্বাস বললেন, “যা জিনিসের দাম! কিন্তু প্রত্যেক চেম্বারে ডানলপিলোর তোশক দিলুম। নামকরা সব লোক সারাদিনের খাটনির পর পায়ের ধূলো দেন, ওঁদের যাতে কোনো কষ্ট না হয় তা দেখা আমার কর্তব্য। ভগবান যদি মুখ তোলেন, সামনের মাসে দু’খানা চেম্বারে এয়ারকুলার বসাবো।”
“কাকে খোঁজ করছেন? রুমুকে না ঝুমুকে?” মিসেস বিশ্বাস জিজ্ঞেস করলেন। তারপর শান্তভাবে বললেন, “ঝুমু কাস্টমারের সঙ্গে রয়েছে। একটু বসুন না, মিনিট পনেরোর মধ্যে ফ্রি হয়ে যাবে।”
নটবর মিত্তির ঘড়ির দিকে তাকালেন। মিসেস বিশ্বাস একগাল হেসে বললেন, “ঝুমু আপনার ওপর খুব সন্তুষ্ট। সেবার এই গ্রেট ইন্ডিয়ান হোটেলে জাপানী গেস্ট দিলেন—ভারি চমৎকার লোক। ঝুমুকে একটা ডিজিটাল টাইমপিস উপহার দিয়েছে—এখানে পাওয়া যায় না। ঝমটাও চালাক। ছোট ভাই আছে, এই বলে সায়েবের কাছ থেকে একটা দামী ফাউনটেন পেনও নিয়ে এসেছে। অথচ জাপানী সায়েব পুরো দাম দিয়েছে একটি পয়সাও কাটেনি।”
“মেয়ে আপনার হীরের টুকরো–সায়েবকে সন্তুষ্ট করেছে, তাই পেয়েছে,” নটবরবাবু বললেন।
মিসেস বিশ্বাস মুখ বেকালেন। “সন্তুষ্ট তো অনেককেই করে। কিন্তু হাত তুলে কেউ তো দিতে চায় না। রুমুর অবস্থা দেখুন না।”
“আপনার বড় মেয়ে তো? কী হলো তার?” নটবরবাবু উদ্বেগ প্রকাশ করলেন।
“বলবেন না। আপনাদের মিস্টার কেদিয়া–পয়লা নম্বর শয়তান একটা। রুমুকে হংকং-এ বেড়াতে নিয়ে যাবার লোভ দেখালেন। এখানে বেশ কয়েকবার এসেছেন। রুমু এবং ঝুমু দুজনের সঙ্গেই ঘণ্টাখানেক করে সময় কাটিয়ে গেছেন। তারপর রুমুর সঙ্গে ভাব বাড়লো! একবার ন’টার শোতে রুমুকে সিনেমা দেখিয়ে এনেছেন। আমাকে দেখলেই গলে যেতেন। ওঁর মাথায় যে এতো দুষ্টমি কী করে বুঝবো? ভদ্রলোক আমাকে বললেন, “বিজনেসের কাজে হংকং যাচ্ছি। রুমুকে দু হপ্তার জন্য ছেড়ে দিন। মেয়ের রোজগারও হবে ফরেন ঘোরাও হবে। হাজার টাকায় রফা হলো। ওখানকার সব খরচা—প্লেন ভাড়া হোটেল ভাড়া উনি দেবেন। আমি তো বোকা—রুমুটা আমার থেকেও বোকা। হতভাগাটার শয়তানী বেচারা বুঝতে পারেনি। বিদেশে যাবার লোভে কচি মেয়েটা লাফালাফি করতে লাগলো। কাজকর্ম বন্ধ রেখে পাসপোর্টের জন্য ছোটাছটি আরম্ভ করলো। কেন মিথ্যে বলবো, কেদিয়ার ট্রাভেল এজেন্ট পাসপোর্টের ব্যাপারে সাহায্য করেছিল। আমি ভাবলাম, আহা, জানাশোনা ছেলের সঙ্গে বিদেশ ভ্রমণের একটা সুযোগ যখন এসেছে, তখন মেয়েটা সাধ-আহ্লাদ মিটিয়ে অসকে। ক’দিন আমার কাজকর্মের ক্ষতি হয় হোক।”
“হাজার হোক মায়ের প্রাণ তো।” নিজের টাকে হাত বুলিয়ে নটবরবাবু ফোড়ন দিলেন।
নাটকীয় কায়দায় সজল চোখে মিসেস বিশ্বাস এবার বললেন, “মেয়েটাকে আমার চোখের সামনে থেকে নিয়ে গিয়ে যা অত্যাচার করেছে না—বেচারার কিছু অবশিষ্ট রাখেনি।”
“কেদিয়া একটা নামকরা শয়তান,” নটবরবাবু খবর দিলেন।
“শয়তান বলে শয়তান! মেয়ের মুখে যদি সব কথা শোনেন আপনার চোখে জল এসে যাবে। আমাকে বুঝিয়ে গেলো, কেদিয়ার সঙ্গে সঙ্গে থাকবে। আমি কোথায় ভাবলাম, দুজনে স্বামী-স্ত্রীর মতো ঘুরে বেড়াবে। তা না, হোটেলে তুলে বন্ধু-বান্ধব ইয়ার জুটিয়ে সে এক সর্বনাশা অবস্থা! মোটামোটা টাকা নিজের পকেটে পরে অসহায় মেয়েটাকে আধঘণ্টা অন্তর ভাড়া খাটিয়েছে। মেয়েটা পালিয়ে আসবার পথ পায় না। ভাগ্যে রিটার্ন টিকিট কাটা ছিল।”
একটু থেমে মিসেস বিশ্বাস বললেন, “আপনি শুনে অবাক হবেন, নিজের রোজগার থেকে রুমুকে একটা পয়সাও ঠেকায়নি। উল্টে বলেছে তুমি তো ফরনে এসেছো!”
“রুমু কোথায়?” নটবর মিটার জিজ্ঞেস করলেন।
“ডাক্তারের কাছে গেছে। চেহারা দেখলে আপনি চিনতে পারবেন না। আমার কী ক্ষতি বুঝুন। এই অবস্থায় কাজে লাগিয়ে মেয়েটাকে তো মেরে ফেলতে পারি না। ভাগ্যে একটা বদলি সিন্ধি মেয়ে পেয়ে গেলাম। লীলা সামতানী—সকালবেলায় একটা স্কুলে পড়ায়। এখন পাশের ঘরে কাস্টমারের সঙ্গে রয়েছে।”
মিসেস বিশ্বাসের কথা শেষ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে লীলা চেম্বার থেকে বেরিয়ে এলো। পিছনে আঠারো-উনিশ বছরের এক ছোকরা। নিশ্চয় ছাত্র, কারণ হাতে কলেজের বই রয়েছে। মিশনারি কলেজের নামলেখা একটা খাতাও দেখা যাচ্ছে। লীলা বললো, “মিস্টার পোদ্দার আর একটা ডেট চাইছেন।” ব্যাগ থেকে ডাইরি বার করে, চোখে চশমা লাগিয়ে মিসেস বিশ্বাস বললেন, “ইট ইজ এ প্লেজার। কবে আসবেন বলুন?” তারিখ ও সময় ঠিক করে মিসেস বিশ্বাস ডাইরিতে লিখে রাখলেন। বললেন, “ঠিক সময়ে আসবেন কিন্তু ভাই—দেরি করলে আমাদের প্রোগ্রাম আপসেট হয়ে যায়।”
পোদ্দার চলে যেতেই মিসেস বিশ্বাস আবার ডাইরি দেখলেন। তারপর বললেন, “লীলা, তুমি একটু কফি খেয়ে বিশ্রাম নাও। আবদুলকে বলো, তোমার ঘরে বিছানার চাদর এবং তোয়ালে পাল্টে দিতে। মিনিট পঁচিশের মধ্যে মিস্টার নাগরাজন আসবেন। উনি আবার দেরি করতে পারবেন না। এখান থেকে সোজা এয়ারপোর্ট চলে যাবেন।”
লীলা ভিতরে চলে যেতেই মিসেস বিশ্বাস বললেন, “টাকা নিই বটে—কিন্তু সার্ভিসও দিই। প্রত্যেক কাস্টমারের জন্যে আমার এখানে ফ্রেস বেডশিট এবং তোয়ালের ব্যবস্থা। অ্যাটাচড বাথরুমে নতুন সাবান। প্রত্যেক ঘরে ট্যালকম পাউডার, লোশন, অডিকোলন, ডেটল। যত খুশী কফি খাও—একটি পয়সা দিতে হবে না।”
নটবর মিত্রকে ঘড়ির দিকে তাকাতে দেখে মিসেস বিশ্বাস বললেন, “ঝুমুটার এখনও হলো না? দাঁড়ান, ফুটো দিয়ে দেখে আসি। মেয়েটার ঐ দোষ। খদ্দেরকে ঝটপট খুশী করে তাড়াতাড়ি বাড়ি পাঠিয়ে দিতে পারে না। ভাবছে, সবাই জাপানী সায়েব। বেশি সময় আদর পেলে, খুশী হয়ে ওকে মুক্তোর মালা দিয়ে যাবে! এসব ব্যাপারে লীলা চালাক। নতুন লাইনে এলেও কায়দাটা শিখে নিয়েছে। পোন্দার একঘণ্টা থাকবে বলে এসেছিল, কিন্তু কুড়ি মিনিটের মধ্যে সন্তুষ্ট হয়ে চলে গেলো। অথচ লীলার অনেক আগে ঝুমু খদ্দের নিয়ে দরজা বন্ধ করেছে।”
ফুটো দিয়ে মেয়ের লেটেস্ট অবস্থা দেখে হেলেদুলে ফিরে এলেন মিসেস বিশ্বাস। বললেন, “আর দেরি হবে না। টোকা দিয়ে এসেছি। তারপর বললেন, “আপনাদের পাঁচজনের আশীর্বাদে ঝুমুর চেহারাটা বেশ হয়েছে। যে দ্যাখে সেই সন্তুষ্ট হয়। টোকিও থেকে আপনার জাপানী সায়েব তো আবার বন্ধু পাঠিয়েছিলেন। হোটেলে মালপত্র রেখে সায়েব নিজে খোঁজখবর করে এখানে এসেছিলেন। ভলো ছবি তোলেন। খুব ইচ্ছে ছিল জামাকাপড় খুলিয়ে ঝুমুর একটা রঙীন ছবি তোলেন। পাঁচশ’ টাকা ফী দিতে চাইলেন! আমি রাজী হলাম না।”
নটবর এবার সুযোগ নিলেন। বললেন, “আমার এই ফ্রেন্ডের সঙ্গে আলাপ করিয়ে দিতাম ঝুমুর। ওকে ঘণ্টা দুয়েকের জন্যে একটু গ্রেট ইন্ডিয়ানে নিয়ে যেতে চাই।”
মুখ বেকালেন মিসেস বিশ্বাস। তারপর সোমনাথকে বললেন, “হোটেলে কেন বাছা? আমার এখানেই বসো না। মিস্টার জয়গোয়াল চলে গেলেই ঝুমু ফ্রি হয়ে যাবে। আমার চেম্বারভাড়া হোটেলের অর্ধেক।”
হাঁ-হাঁ করে উঠলেন নটবরবাবু “উনি নন, ওঁর এক পাটি।”
মিসেস বিশ্বাস বললেন, “তাঁকেও নিয়ে আসন এখানে। আমার লোকজন কম। মেয়েদের বাইরে পাঠালে বড্ড সময় নষ্ট হয়। তাছাড়া এখন কাজের চাপ খুব, মিস্টার মিত্তির! হোল নাইট বুকিং-এর জন্যে হাতে-পায়ে ধরছে।”
অনেক অনুরোধ করলেন নটবরবাবু। কিন্তু মিসেস বিবাস রাজী হলেন না। বললেন, “ঝুমু তো রইলো। আপনার সায়েবকে বুঝিয়ে-সুঝিয়ে এখানে নিয়ে আসুন। ঝুমুকে স্পেশাল আদর-যত্ন করতে বলে দেবো। দেখবেন আপনার সায়েব কীরকম সন্তুষ্ট হন। ওদের দুজনকে কাজে বসিয়ে দিয়ে আমরা তিনজন চা খেতে খেতে গল্প করবো।”
রাস্তায় বেরিয়ে সোমনাথ দেখলো নটবর মিটার দুটো হাতেই ঘষি পাকাচ্ছেন। সোমনাথের কাছে ছোট হয়ে গিয়েছেন মনে করছেন। অথচ সোমনাথ সেরকম ভাবছেই না। সামনের পানের দোকান থেকে সোমনাথ দুটো অ্যাসপ্রো কিনে খেয়ে ফেললো। বুঝিয়ে-সুঝিয়ে সে মনকে তৈরি করে ফেলেছে। কিন্তু দেহটা কথা শুনছে না। একটু বমি করলে শরীরটা বোধহয় শান্ত হতো।
নটবরবাবু বললেন, “আপনার কপালটাই পোড়া। নটবর মিত্তির যা চাইছে, তা দিতে পারছে না আপনাকে। আর দেশটারই বা হলো কি! মেয়েমানুষের ডিমান্ড হুড়হুড় করে বেড়ে যাচ্ছে। ছ’মাস আগে এই মিসেস বিশ্বাস দুপুরবেলায় মেয়ে নিয়ে আমার অফিসে দেখা করেছেন—পার্টির জন্যে হাতে ধরেছেন। কতবার বলেছেন, শুধু তো খদ্দের আনছেন। একদিন নিজে রুমু কিংবা ঝুমুর সঙ্গে বসুন–কোনো খরচ খরচা লাগবে না। কিন্তু মশাই, নটবর মিত্তির এসব থেকে একশ’ গজ দূরে থাকে। নিজে যেন এসবের মধ্যে ঢুকে পড়বেন না—তাহলে কিন্তু সর্বনাশ হবে ওই বিশ, বোসের মতন।”
কোনো কথা শুনলেন না নটবর। সোমনাথকে নিয়ে পাক স্ট্রীটের কোয়ালিটিতে বসে কফি খেলেন। ওখান থেকে বেরিয়েই অলিম্পিয়া বার-এর সামনে বুড়ো চরণদাসের সঙ্গে দেখা হয়ে গেলো।
“চরণ না?” নটবর জিজ্ঞেস করলেন।
“আজ্ঞে, হ্যাঁ হুজুর,” বহুদিন পরে নটবরকে দেখে খুশী হয়েছেন চরণদাস।
“তোমার বোডিং—এ না পুলিশ হামলা হয়েছিল?” নটবর অনেক কিছু খবর রাখেন।
“শুধু পুলিশ হামলা! আমাকে আসামীর কাঠগড়ায় তুলেছিল।” চরণ দুঃখ করলো। “কোনোরকমে ছাড়া পেয়ে বেরিয়ে এসেছি।”
চরণের বয়স হবে পঞ্চাশের বেশি। শুকনো দড়ি-পাকানো চেহারা। কিন্তু দেখুলেই বোঝা যায় নিরীহ প্রকৃতির মানুষ। সোমনাথকে নটবর বললেন, “চরণ এখানকার এক বোডিং-এ বেয়ারা ছিল—মেয়ে সাপ্লাই করে টু-পাইস কামাতো।”
“এখন কী করছো চরণ?” নটবর মিত্তির জিজ্ঞেস করলেন।
আগেকার দিন নেই হুজুর। এখন টুকটাক অর্ডার সাপ্লাই করছি। আমাদের ম্যানেজারবাবু করমচন্দানী জেল থেকে বেরিয়ে একটা স্কুল করেছেন। টেলিফোন অপ্রেটিং শেখবার নাম করে কিছু মেয়ে আসে—খুব জানাশোনা পার্টির খবর পেয়েছেন, কোনোরকমে চলে যায়।”
নটবর জিজ্ঞেস করলেন, “আচ্ছা চরণ, চাহিদার তুলনায় মেয়ের সাপ্লাই কি কমে গিয়েছে?”
“মোটেই না, হুজুর। গেরস্ত ঘর থেকে আজকাল অজস্র মেয়ে আসছে। কিন্তু তাদের আমরা জায়গা দিতে পারি না। এসব পাড়ায় জায়গার বড় অভাব।”
নটবর মিত্তির হাঁফ ছেড়ে বাঁচলেন। বললেন, “চরণ, তুমি তো আমার বহুদিনের বন্ধু। এখনই একটি ভালো মেয়ে দিতে পারো?”
চরণ বললো, “কেন পারবো না হুজুর? এখনই চলুন, তিনটে মেয়ে দেখিয়ে দিচ্ছি।”
“একেবারে টপ ক্লাস হওয়া চাই। রাস্তার জিনিস তুলে নেবার জন্যে তোমার সাহায্য চাইছি না,” নটবর বললেন।
চরণদাস এবার ব্যাপারটার গুরত্ব বুঝলো। বললো, “তাহলে হুজুর, একটু অপেক্ষা করতে হবে। মিনিট পনেরো পরেই একটি ভালো বাঙালী মেয়ে আসবে। তবে মেয়েটি খুব দূরে যেতে ভয় পায়। গেরস্ত ঘরের মেয়ে তো, লুকিয়ে আসে।”
“রাখো রাখো—সবাই গেরস্ত,” ব্যঙ্গ করলেন নটবর।
চরণদাস উত্তর দিলো, “এই ভর সন্ধ্যেবেলায় আপনাকে মিথ্যে বলবো না, হুজুর।”
“চরণদাস, ভেট হিসেবে দেবার মতো জিনিস তো?” নটবর মিত্তির খোলাখুলি জিজ্ঞেস করলেন।
“একদম নির্ভয়ে নিয়ে যেতে পারেন। রাঙতায় মুড়ে বড়দিনের ডালিতে সাজিয়ে দেবার মতো মেয়ে, স্যর!” চরণদাস বেশ জোরের সঙ্গে বললো।
চরণদাসের ঘাড়ে সোমনাথকে চাপিয়ে নটবর এবার পালালেন। বললেন, “ঊষা জৈনকে এখন না তুললেই নয়। মাগীর যা দেমাক, হয়তো দেরি করলে অর্ডার ক্যানসেল করে দেবে—সঙ্গে আসবেই না। আপনি ভাববেন না সোমনাথবাবু, বার বার তিনবার। এবার সব ঠিক হয়ে যাবে।”
সোমনাথকে নিশ্চল পাথরের মতো স্তব্ধ হয়ে থাকতে দেখে নটবর বললেন, “ভয় কী? একটু পরেই তো গ্রেট ইন্ডিয়ানে দেখা হচ্ছে। তেমন দরকার হলে আমি নিজে গোয়েঙ্কার সঙ্গে আপনার হয়ে কথা বলবো।”
“বাই-বাই,” করে নটবর মিত্তির বেরিয়ে গেলেন। আর দাঁতে দাঁত চেপে সোমনাথ এবার চরণদাসের সঙ্গে রাসেল স্ট্রীট ধরে উত্তর দিকে হাঁটতে লাগলো। দুটো অ্যাসপ্রো ট্যাবলেটেও শরীরের যন্ত্রণা কমেনি—কিন্তু অনেক চেষ্টায় মনকে পুরোপুরি নিজের তাঁবেতে এনেছে সোমনাথ।
কী আশ্চর্য! দ্বৈপায়ন ব্যানার্জির ভদ্র সভ্য সুশিক্ষিত ছোটছেলে এই অন্ধকারে মেয়েমানুষের জন্যে হন্যে হয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে—অথচ তার কনসেন্স তাকে যন্ত্রণা দিচ্ছে না। সোমনাথ এখন বেপরোয়া। জলে যখন নেমেছেই, তখন এর চুড়ান্ত না দেখে আজ সে ফিরবে না। জন-অরণ্যে সে অনেকবার হেরেছে—কিন্তু শেষ রাউন্ডে সে জিতবেই।
অন্ধকারের অবগুণ্ঠন নেমে এসেছে নগর কলকাতার ওপর। রাত্রি গভীর নয়—কিন্তু সোমনাথের মনে হচ্ছে গহন অরণ্যের ধার দিয়ে যেতে যেতে হঠাৎ সূর্য অস্ত গিয়ে সর্বত্র এক বিপজ্জনক অন্ধকার নেমে এসেছে। চরণদাস বললো, “নটবরবাবু এ-লাইনের নামকরা লোক। ওঁকে ঠকিয়ে অর্ডার সাপ্লাই বিজনেসে আমি টিকতে পারবো না। আপনি নিশ্চিত থাকুন, আপনাকে খারাপ জিনিস দেবো না কিছুতেই।”
এই বৃদ্ধকে কে বোঝাবে, মানুষ কখনও খারাপ হয় না, সোমনাথ নিজের মনে বললো। চরণদাস তার সহযাত্রীর মনের খবর রাখলো না। বললো, “গভরমেন্টের কী অন্যায় দেখুন তো? চাকরি দিতে পারবি না অথচ বোডিং—এ আট-দশটি মেয়ে এবং আমরা তিন-চারজন করে খাচ্ছিলাম তা সহ্য হলো না।”
চরণদাস বলে চললো, “বন্ধ করতে তো পারলে না, বাবা। শুধু কচিকচি মেয়েগুলোকে কষ্ট দেওয়া। জানেন, কতদূর থেকে সব আসে—গড়িয়া, নাকতলা, টালিগঞ্জ, বৈষ্ণবঘাটা। আর একদল আসে বারাসত, দত্তপুকুর, হাবড়া এবং গোবরডাঙ্গা থেকে। বোর্ডিং—এ অনেক বসার জায়গা ছিল। মেয়েগুলোর কষ্ট হতো না। এখন এই টেলিফোন স্কুলে কয়েকখানা ভাঙা চেয়ার ছাড়া কিছুই নেই। কখন পার্টি এসে তুলে নিয়ে যাবে এই আশায় মেয়েগুলোকে তীর্থ কাকের মতো বসে থাকতে হয়।”
চরণদাসের বকা স্বভাব। নীরব শ্রোতা পেয়ে সে বলে যাচ্ছে, “যেসব মেয়ের চক্ষু লজ্জা নেই, তারা নাচের স্কুলে চলে যাচ্ছে। বলরুম নাচ শেখানো হয় বলে ওরা বিজ্ঞাপন দেয়—অনেক উটকো লোক আসে, কিছু, চাপা থাকে না। আমাদের টেলিফোন স্কুলে সুবিধে এখনও তেমন কেউ জানে না, ভদ্রঘরের মেয়েদের পক্ষে বাড়িতে বলতেও ভালো। সাতদিন ‘অপ্রেটর ট্রেনিং’-এর পরই ডেলি রোজ-এর কাজুয়েল চাকরি। বাপ-মা খুব চেপে ধরলে আমাদের মেয়েরা বলে, বদলী অপ্রেটরদের বিকেল তিনটে-দশটার চাকরিটাই সহজে পাওয়া যায়। কারণ এ-সময়ে অফিসের মাস-মাইনের মেয়েরা কাজ করতে চায় না। বাপেরা অনেক সময় আমাদের এখানে ফোন করে। আমরা বলি, লিভ ভেকাসিতে কাজ করতে করতেই আপনার মেয়ে হঠাৎ ‘পার্মেন্ট’ চাকরি পেয়ে যাবে।”
চরণদাস এবার একটা পুরানো বাড়িতে কে পড়লো। দুটো মেয়ে টেলিফোন স্কুলে এখনও বসে আছে। একজন অ্যাংলো ইন্ডিয়ান—বোধহয় দেহে কিছু নিগ্রো রক্ত আছে। উগ্র এবং অসভ্য বেশবাস করেছে মেয়েটি। আরেক জন সিন্ধি—হাল ফ্যাশানের লুঙ্গী পরেছে। সোমনাথকে দেখে দুজন মেয়েই চাপা উত্তেজনায় দুবার মুখ বাড়িয়ে দেখে গেলো। চরণদাস বললো, “আপনি মিত্তির সায়েবের লোক—এসব জিনিস আপনাকে দেওয়া চলবে না। এরা ভারি অসভ্য—একেবারে বাজারের বেশ্যা। একটু বসুন—আপনার জিনিস এখনই এসে পড়বে।”
ফিক করে হাসলো চরণদাস। “আপনি ভাবছেন, তিনটে থেকে ডিউটি অথচ এখনও আসেনি কেন?”
চরণদাস নিজেই উত্তর দিলো, “একেবারে নতুন দিন কয়েক হলো লাইনে জয়েন করেছে। গেরস্ত চাকরির জন্যে হন্যে হয়ে ঘরে ঘরে, কিছু না পেয়ে এ-লাইনে এসেছে। বিকেলের দিকে তো আমাদের খদ্দেরের কাজের চাপ থাকে না। আমাকে বলে গেছে একবার হাসপাতালে যাবে কীসের খোঁজ করতে।”
চরণদাস বললো, “খুব ভালো মেয়েমানুষ পাবেন স্যর। যিনি ভেট নেবেন, দেখবেন, তিনি কীরকম খুশী হন। অনেকদিন তো এ-লাইনে হয়ে গেলো। ছোটবেলা থেকে দেখছি, এ-লাইনে নতুন জিনিসের খুব কদর। আমাদের বোর্ডিং-এ গেরস্ত ঘর থেকে আনকোরা মেয়ে এলেই খদ্দেরের মধ্যে হৈ-হৈ পড়ে যেতো। এক-একবার দেখেছি, লাইন পড়ে যেতো। এক খদ্দের ড়ুকেছে—আরও দুজন খদ্দের সোফায় বসে সিগ্রেট টানছে। নতুন রিফিউজি মেয়েগুলো পাঁচমিনিট বিশ্রাম নেবার সময় পেতো না।” একটা বিড়ি ধরালো চরণদাস। বললো, “আপনাকে যে মেয়ে দেবো একেবারে ফ্রেশ জিনিস। ভয় পর্যন্ত ভাঙেনি। সাড়ে নটার পর এক মিনিটও বসবে না। আমাকে আবার বালিগঞ্জের মোড় পর্যন্ত এগিয়ে দিয়ে আসতে হয়। আমার বাড়ি অবশ্য একই রাস্তায় পড়ে—দুটো-একটা টাকাও পাওয়া যায়।”
মেয়েটি আসতেই চরণদাস সব ব্যবস্থা করে দিলো। বললো, “পাঁচটা মিনিট সময় দিন, স্যর। একটু ড্রেস করে নিক। আমাদের এখানে সব ব্যবস্থা আছে।”
পাঁচমিনিটের মধ্যেই মেয়েটি তৈরি হয়ে নিলো। চরণদাস এবার সোমনাথকে জিজ্ঞেস করলো, “শাড়ির রংটা পছন্দ হয়েছে তো না হলে বলুন। আমাদের এখানে স্পেশাল শাড়ি আছে—খদ্দেরের পছন্দ অনুযায়ী অনেক সময় মেয়েরা জামা-কাপড় পাল্টে নেয়!”
ঘড়ির দিকে তাকিয়ে সোমনাথ দেখলো আর একটুও সময় নেই। মেয়েটিকে গাড়িতে তুলে দিয়ে চরণদাস এবার সোমনাথকে লম্বা সেলাম দিলো। সোমনাথ পকেট থেকে দশটা টাকা বার করে চরণদাসের হাতে দিলো। বেজায় খুশী চরণদাস। বললো, “আপনারা যাচ্ছেন কোথায়?”
“গ্রেট ইন্ডিয়ান হোটেলে,” সোমনাথ উত্তর দিলো। নিজের শান্ত কণ্ঠস্বরে সোমনাথ নিজেই অবাক হয়ে গেলো। এই অবস্থাতেও তার গলা কেঁপে উঠলো না। মেয়েটাকে গাড়ির মধ্যে তুলে নিতে একটুও লজ্জা হলো না। কেন লজ্জা হবে?” রক্তচক্ষু এক সোমনাথ আর-এক শান্ত সুসভ্য সোমনাথকে জিজ্ঞেস করলো। তিন বছর যখন তিলে তিলে যন্ত্রণা সহ্য করেছি, তখন তো কেউ একবারও খবর করেনি, আমার কী হবে? আমি কেমন আছি?”
মেয়েটি একেবারে নতুন। এখনও গ্রেট ইন্ডিয়ান হোটেল চেনে না! জিজ্ঞেস করলো, “অনেক দুরে নাকি?”
মেয়েটিকে বেশ ভীতু মনে হচ্ছে সোমনাথের। এদেশের লাখ লাখ বোকা ছেলেমেয়ের মতোই সদাশঙ্কিত হয়ে আছে। নিজের নাম বললো, “শিউলি দাস। আপনার কাছে একটা অনুরোধ আছে,” শিউলির গলায় কাতর অনুনয়।
“দয়া করে বেশি দেরি করবেন না। দশটার মধ্যে বাড়ি না ফিরলে আমার মা অজ্ঞান হয়ে যাবেন।”
জনবিরল মেয়ো রোড ধরে গাড়িতে যেতে যেতে শিউলি জিজ্ঞেস করলো, “আপনার নাম?” শিউলি যখন নিজের নাম জানিয়েছে, তখন সোমনাথের নাম জানবার অধিকার তার নিশ্চয়ই আছে। কিন্তু সোমনাথ কেমন ইতস্তত বোধ করছে—জীবনে এই প্রথম নিজের পরিচয়টা লজ্জার উদ্রেক করছে। প্রশ্নটার পুরো উত্তর দিলো না সে। গম্ভীরভাবে বললো, “ব্যানার্জি।” মেয়েটা সত্যিই আনকোরা, কারণ ব্যানার্জির আগে কী আছে জানতে চাইলো না। চাইলেও অবশ্য সোমনাথ প্রস্তুত হয়েছিল একটা মিথ্যে উত্তর দিতো।
চিন্তজালে জড়িয়ে পড়েছে সোমনাথ। যে-নগরীকে একদা গহন অরণ্য মনে হয়েছিল সেই অরণ্যের নিরীহ সদাসন্ত্রস্ত মেষশাবক সোমনাথ সহসা শক্তিমান সিংহশিশুতে রুপান্তরিত হয়েছে। নিরীহ এক হরিণীকে কেমন অবলীলাক্রমে সে চরম সর্বনাশের জন্য নিয়ে চলেছে।
গ্রেট ইন্ডিয়ান হোটেলের অভিজ্ঞ দারোয়ানজীও শিউলিকে দেখে কিছু সন্দেহ করলেন। দারোয়ানজীর দোষ কী? এই প্রথম দেখছেন শিউলিকে।