২৯
রুমী সকালবেলা উঠে এক কাপ ব্লাক কফি খায় ৷ হাতে থাকে টাটকা দৈনিক পত্রিকা ৷ ইত্তেফাকই তার বেশি প্রিয় ৷ তবে সঙ্গে দৈনিক পাকিস্তানটাও সে পড়ে থাকে ৷ আজকে পত্রিকা পড়তে গিয়ে সে উত্তেজিত হয়ে চিৎকার করতে থাকে ৷ ‘আম্মা, আম্মা…’
জাহানারা ইমাম এগিয়ে আসেন ৷ ‘কী হলো রুমী!’
‘দ্যাখো সিকান্দার আবু জাফরের কী কবিতা বের হয়েছে পেপারে ৷’ রুমী গলা চড়িয়ে আবৃত্তি করতে শুরু করেছে:
অনেক মাপের অনেক জুতোর দামে
তোমার হাতে দিয়েছি ফুল হৃদয় সুরভিত
যে-ফুল খুঁজে পায়নি তোমার চিত্তরসের ছোঁয়া
পেয়েছে শুধু কঠিন জুতোর তলা ৷
আজকে যখন তাদের স্মৃতি অসম্মানের বিষে
তিক্ত প্রাণে শ্বাপদ নখের জ্বালা,
কাজ কি চোখের প্রসন্নতায়
লুকিয়ে রেখে প্রেতের অট্টহাসি!
আমার কাঁধেই দিলাম তুলে
আমার যত বোঝা :
তুমি আমার বাতাস থেকে
মোছো তোমার ধুলো
তুমি বাংলা ছাড়ো ৷
জাহানারা ইমাম ছেলের মুখের দিকে তাকিয়ে থাকেন ৷ রুমী আবৃত্তিটা ভালোই করে ৷ করবেই ৷ সে তো ডিবেটে চ্যাম্পিয়ন ৷ কলেজের কালচারাল উইকে অনেকগুলো পুরস্কার পেয়েছে ৷ আবৃত্তি শুনতে শুনতে, বিশেষ করে যখন রুমী বলে উঠছে তুমি বাংলা ছাড়ো, জাহানারা ইমামের সমস্তটা শরীর কাঁটা দিয়ে ওঠে ৷
আবৃত্তি শেষ হলে তিনি বলেন, ‘রুমী, আজকে তাড়াতাড়ি নাশতা করে নে ৷ তোরা তো রেসকোর্সের জনসভায় যাবি ৷ সুবহানও যাবে জেদ ধরেছে ৷ এর আগের দিন ‘না’ করেছি ৷ আজকে তো বাবা আর ‘না’ করা যায় না ৷ আজকে শেখ সাহেব নিশ্চয় ইম্পর্ট্যান্ট কিছু বলবেন ৷’
রুমী বলে, ‘ওকে ওকে ৷ আই অ্যাম গোয়িং টু হ্যাভ মাই ব্রেকফাস্ট ৷ বাট, আজকের পেপারটা পড়ে একটু বোঝা দরকার, শেখ মুজিব আজকে কী বলবেন, কিছু আঁচ অনুমান করা যায় কি না ৷’
টগর পড়ে জগন্নাথ কলেজে ৷ সে আজাদের আরেক খালাতো ভাই ৷ জায়েদেরও খালাতো ভাই সে ৷ আজাদদের মগবাজারের বাসায় থেকে সে জগন্নাথ কলেজে ইন্টারমিডিয়েট ক্লাসে পড়ছে ৷ তার বাবার ব্যবসা পটুয়াখালীতে ৷ সেখানে সে পড়েছে স্কুলে ৷ সেখানে সে যুক্ত ছিল ছাত্র ইউনিয়ন মতিয়া গ্রুপের সঙ্গে ৷
আজাদ দাদা বয়সে তার চেয়ে অনেক বড় ৷ তার বন্ধুবান্ধবরাও আলাদা ৷ কাজেই টগরের সঙ্গে আজাদের সারা দিন দেখা হয় কেবল বাসাতেই ৷ সকালে বা গভীর রাতে ৷
আজ ৭ই মার্চ ১৯৭১ ৷
টগর সকাল থেকেই উত্তেজিত ৷ আজ রেসকোর্স ময়দানে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ভাষণ দেবেন ৷ ১লা মার্চই বঙ্গবন্ধু হোটেল পূর্বাণীতে ঘোষণা দিয়ে রেখেছেন, বাংলার মানুষের আত্মনিয়ন্ত্রণ কর্মসূচির ঘোষণা তিনি দেবেন ৭ই মার্চ, জনসভা করে, রেসকোর্স ময়দানে ৷ এরই মধ্যে দেশের পরিস্থিতি সম্পূর্ণ পাল্টে গেছে ৷ পুরোটা দেশ যেন এক উত্তাল বিক্ষুব্ধ সমুদ্র, সব রাজপথ আজ যেন মিছিল, প্রতিটা মানুষ আজ মিছিলম্যান, প্রতিটা কন্ঠ আজ যেন স্লোগান ৷ মিছিল, মিটিং, প্রতিবাদ, ব্যারিকেড, কারফিউ-জারি, কারফিউ ভঙ্গ, গুলি ৷ রোজ রাজপথে গুলি খেয়ে মারা যাচ্ছে মানুষ ৷
এ অবস্থায় গতকাল প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান ভাষণ দিয়েছেন ৷ তাতে নতুন কোনো কথা নাই ৷ ২ শে মার্চ জাতীয় পরিষদের অধিবেশন আহ্বান করেছেন ৷ আর বলে দিয়েছেন, ‘আমি এখনও পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট আছি, পাকিস্তান সশস্ত্র বাহিনীর সর্বাধিনায়ক আছি ৷ আমি যতক্ষণ আছি, পাকিস্তানের পুরোপুরি অখণ্ডতা বজায় রাখার চেষ্টা আমি করবই ৷ আমি জেনেশুনেই পূর্ব পাকিস্তান কর্তৃপক্ষকে নির্দেশ দিয়েছি যেন আইন অমান্যকারীদের লুট, হত্যা ও অগি্নসংযোগ করার জন্যে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা অবলম্বন করা হয় ৷’
তাঁর এই ধমক শুনে কি বঙ্গবন্ধু পিছিয়ে যাবেন ? নাকি আজ রেসকোর্সের ভাষণে তিনি বাংলার স্বাধীনতা ঘোষণা করবেন ? সর্বত্র এই আলোচনা ৷
তরুণ টগর যে এত কিছু বোঝে তা নয় ৷ সে শুধু বোঝে আজ রেসকোর্স ময়দানে যেতে হবে ৷
আজাদ বেরিয়ে গেছে দুপুরবেলাতেই ৷ তার সঙ্গে আছে তার বন্ধুরা ৷ আশরাফুল হক, জুয়েল, হ্যারিস, ইব্রাহিম সাবের প্রমুখ ৷ কে আছে এই ঢাকায়, যার যৌবন আছে, কিন্তু যে আজকের জনসভায় যাবে না ? আজকে সবাই উঠে গেছে রাজনীতির ঊর্ধে, দলের পরিচয়ের ঊর্ধে, রেসকোর্স ময়দানে সবাই যাচ্ছে দেশের টানে ৷
জুয়েল বলে, ‘আশরাফুল যখন বউ ছাইড়া আসতে পারছে, তখন সবাই আজকা মিটিংয়ে যাইব ৷ আইজকা আর মিটিংয়ে জায়গা পাওয়া যাইব না ৷’
ইব্রাহিম সাবের বলে, ‘আমার কিন্তু আজকে শেখ সাহেব কী বলেন, এইটা বড় ইন্টারেস্ট না ৷ আমার বড় ইন্টারেস্ট আরেকটা ৷ আমি চোখ-কান খোলা রাখব আর একজন নেতার দিকে ৷ বল তো কে ?’
আশরাফুল বলে, ‘কে ?’
ইব্রাহিম সাবের বলে, ‘নাজিম কামরান চৌধুরী ৷’
আজাদ, জুয়েল, হ্যারিস সবাই হো হো করে হেসে ওঠে ৷
আশরাফুল মুখে কৌতূহল ফুটিয়ে তুলে বলে, ‘ক্যান ?’
ইব্রাহিম সাবের বলে, আমাদের বন্ধু নাজিম কামরান চৌধুরী, ডাকসুর ডাকসাইটে নেতা, যিনি কিনা ঊনসত্তরের গণঅভু্যত্থান থাইকাই গণআন্দোলন সমর্থন করতেছেন, তিনি তার সিলেটি বচনে কেমন ভাষণ দেন, এটাই আমার প্রিন্সিপ্যাল অ্যাট্রাক্শন ৷
হ্যারিস বলে, ‘আমার মনে হয় না নাজিম ভাই আজকে ভাষণ দেবেন ৷ আজকে শুধু বঙ্গবন্ধু একাই বলবেন ৷ আর কোনো বক্তারই আজকে কোনো চান্স নাই ৷’
ইব্রাহিম সাবের বলে, ‘দেখি গিয়া ৷’
তারা হাঁটছে ৷ মার্চের আকাশ ঘন নীল ৷ রোদটা গায়ে মিষ্টিই লাগছে ৷ একটু একটু করে বইছে বসন্তের বিখ্যাত বাতাস ৷
জুয়েল বলে, ‘এই, দেখছস, বাতাসটা কত মজা লাগতেছে ৷ কপালের ঘামের মধ্যে বাতাস লাগলে মনে হইতেছে, বউ আঁচল দিয়া বাতাস করতেছে ৷ আশরাফুল, ক তো দেখি এই বাতাসের নাম কী ?’
আশরাফুল বলে, ‘বাতাসের আবার নাম কী ?’
জুয়েল বলে, ‘আছে ৷ এই বাতাসটার নাম হইল ছমিরন বিবি ৷’
আজাদ বলে, ‘যাহ্ ৷’
জুয়েল বলে, ‘আমরা কই ছমিরন বিবি ৷ আর বইয়ের ভাষায় সমীরণ ৷ মৃদুমন্দ সমীরণ ৷ হালায় মৃদুটা না হয় বুঝলাম, মন্দটা বুঝলাম না ? ছমিরন বিবির মনে হয় ক্যারেক্টার লুজ ৷’
আজাদরা হাঁটে ৷ মগবাজার থেকে রেসকোর্স ময়দান, বেশি দূর নয় ৷ আর পুরোটা ঢাকা যেন আজ ছুটে চলেছে রেসকোর্সের দিকে ৷ কত দূরদূরান্ত থেকে আসছে এইসব মানুষ-কে জানো ? সবার হাতে লাঠি, কারো কারো হাতে রড ৷ ওই যে টঙ্গী থেকে আসছে শ্রমিকদের মিছিল ৷
‘হায় হায় দ্যাখো দ্যাখো’-হ্যারিস আঙুল তুলে দেখায়, একটা শাদাছড়ি মিছিল যাচ্ছে ৷ সবাই অন্ধ ৷ অন্ধরাও যাচ্ছে আজ মিছিলে ৷
জায়েদ রওনা দিয়েছিল একটু বেলা করে ৷ মগবাজার থেকে রমনা পর্যন্ত এসে সে আর এগোতে পারে না ৷ কাকরাইল মোড় পর্যন্ত গিজগিজ করছে মানুষ ৷ সে ভিড়ের মধ্যে তার ছোট্ট শরীরটা সুইয়ের মতো গলিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করে ৷ কিন্তু সমস্যা করছে পায়ের স্পঞ্জের স্যান্ডেলগুলো ৷ লোকের পায়ের পাড়া পড়ে স্যান্ডেলের গোড়ায়, স্বাধীনমতো এগোনো যায় না ৷ দুরো শালার স্যান্ডেল ৷ সে পা থেকে স্যান্ডেল দুটো খুলে হাতে নেয় ৷ তারপর তার এগোতে সুবিধা হয় বটে, কিন্তু পাবলিকের গায়ে স্যান্ডেলের ছোঁয়া লাগতে থাকে ৷ না, এটা অন্যায় হবে ৷ এরা সবাই জয় বাংলার লোক ৷ এদের গায়ে স্যান্ডেলের স্পর্শ লাগলে এদের অকল্যাণ হতে পারে ৷ সে স্যান্ডেল দুটো বিসর্জন দেয় জনতার ভিড়ে ৷
আকাশে হঠাৎই হেলিকপ্টার উড়তে দেখা যায় ৷ জনতা ক্ষণিকের জন্যে গুঞ্জরণ করে ওঠে ৷ তারা সবাই তাকিয়ে আছে আকাশের দিকে ৷ ব্যাপার কী ? হেলিকপ্টার কেন ? বোমা ফেলবে নাকি ? নাকি বাঙালিকে ভয় দেখাচ্ছে ? বাঙালি ভয় পাওয়ার পাত্র নাকি ?
জাহানারা ইমাম তার বাড়ির ছাদে উঠেছেন রেডিও নিয়ে ৷ একটু আগেও রেডিওতে আমার সোনার বাংলা গান হচ্ছিল ৷ এখন কোনো সাড়াশব্দ নাই ৷ ব্যাপার কী ? তার স্বামী শরীফ ইমাম, তার দুই ছেলে রুমী আর জামী, বাড়ির কাজের লোক সবাই গেছে শেখ মুজিবের জনসভায় ৷ তিনি ভেবেছিলেন রেডিওতে এই ভাষণ সরাসরি প্রচার করা হবে যখন, তিনি রেডিওতেই শুনবেন ৷ এখন দেখি কোনো আওয়াজ হচ্ছে না ৷ ব্যাপার কী ? ছাদে উঠে তিনি দেখতে পান হেলিকপ্টারের চক্কর ৷ তার বুকটা একটু কেঁপে ওঠে ৷
টগর লম্বায় তেমন বেশি নয় ৷ এমন গাদাগাদি ভিড়ের মধ্যে দাঁড়িয়ে সে মঞ্চটা দেখতে পাচ্ছে না ৷ সে এখন করেটা কী ? বঙ্গবন্ধুকে তার এক নজর দেখা চাই-ই চাই ৷ ওই তো একটা গাছ দেখা যায়, তাতে একজন দুজন ছেলে-ছোকরা উঠে পড়েছে ৷ সেও তো এই কাজটা পারে ৷ গাছে ওঠার ব্যাপারে তার দক্ষতা সে পটুয়াখালীর দিনগুলোতে প্রমাণ করেছে ৷ সে তাড়াতাড়ি গাছের নিচে চলে যায় ৷ একটা কৃষ্ণচূড়াগাছ ৷ গোড়াটা বেশ লকলকে, ডালপালাহীন ৷ চড়াটা সহজ হবে না ৷ সুপারিগাছে ওঠার মতো করে বেয়ে বেয়ে উঠতে হবে ৷ তাই সই ৷ টগর গাছে উঠতে লেগে যায় ৷ গাছের একটা সুবিধাজনক জায়গায় সে পৌঁছয় ৷ একটা ডালের ওপরে পা, একটা ডালের ওপরে তার পশ্চাদ্দেশ ঠেকিয়ে সামনে আরেকটা ডালকে সে হাতে ধরার জন্যে পেয়ে যায় ৷ এই জায়গায় এসে তার নিজেকে খুবই সৌভাগ্যবান আর বুদ্ধিমান বলে মনে হয় ৷ সে পুরোটা মাঠ, গাছের পাতার আড়ালে পড়া কিছু কিছু অংশ ছাড়া, বেশ আরামেই দেখতে পাচ্ছে ৷ ওই যে নৌকার মতো করে বানানো মঞ্চটা ৷ চারদিকে কলরেডির মাইক্রোফোন ৷ হায়, কত মানুষ এসেছে! মানুষ ছাড়া তো আর কিছুই দেখা যায় না ৷ ওই দ্যাখো, কত কত মহিলাও এসেছেন ৷ সবার হাতে লাঠি, অনেকের হাতে সবুজের পটে লাল সূর্যের ভেতরে সোনালি মানচিত্র-খচিত স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা ৷
আর ওই দ্যাখো, গাছটার একটু ওপরের দিকে একটা পাখির বাসাও দেখা যাচ্ছে ৷ বসন্তকালে পাখিরা বুঝি ঘর বাঁধে! ভালো করে তাকিয়ে টগর বোঝার চেষ্টা করে ভেতরে ডিম আছে কি নাই ৷
বাঙালির একটা সমস্যা আছে ৷ একজনকে সে যা করতে দেখে, সে নিজেও তা-ই করে বসে ৷ তার দেখাদেখি আরো আরো মানুষ এই কৃষ্ণচূড়াগাছটায় ওঠার চেষ্টা করছে ৷ ‘ভাই, করেন কী ?’ টগর চিৎকার করে বলে, ‘এই ভাই, কৃষ্ণচূড়ার ডাল খুব নরম ৷ এত লোক উইঠেন না ৷ ভাইঙ্গা যাইব ৷’
কিন্তু মাইকের গগনবিদারী আওয়াজ, জনসমুদ্রের কল্লোলের তলায় তার একাকী কন্ঠ কোথায় মিলিয়ে যায় ৷
লোকেরা গাছ পেয়ে উঠতেই থাকে ৷
তারপর যা হওয়ার তা-ই হয় ৷ এক সময় তাকে নিয়ে গাছের একটা ডাল চড়চড় শব্দ করে ভাঙতে থাকে ৷ টগরের সুবিধা ছিল, সে আরেকটা ডাল ধরে ছিল ৷ সে সেই ডাল দু হাতে ধরে বাদুড়ের মতো ঝুলতে থাকে ৷ এবার সে আরেকটা ডালে পা রাখতে যাবে, কিন্তু তার আগে দেখতে পায় তার হাতে ধরা ডালটায় তার মতো আরো আরো মনুষ্য-বাদুড় ঝুলে আছে, আর এই চিকন ডালটাও সেই ভর সহ্য করতে না পেরে চড়চড় শব্দ করতে শুরু করেছে ৷ টগর বুকে সাহস সঞ্চয় করে ৷ ডালটা ধীরে ধীরে নিচে নেমে যাচ্ছে ৷ মাটির সঙ্গে তার দূরত্ব আসছে কমে ৷ সে একটা লাফ দেবার কথা ভাবে ৷ তাকে লাফ দিতে হয় না, শুধু হাতের মুঠো আপনা-আপনিই আলগা হয়ে এলে সে নিচে পড়ে যায় ৷ ভাগ্যি নিচে ঘাস ছিল ৷ আর ততক্ষণে নিচে দাঁড়িয়ে থাকা জনতা পরিমড়ি করে চারপাশে ঝাপ্টা তুলে সরে গিয়েছে ৷ টগরের পা মাটিতে পড়ে ৷ আর টাল সামলাতে না পেরে সে সামনের দিকে উপুড় হয়ে পড়ে যায় ৷ এটাও তার জন্যে বিপরীতে হিত হয় ৷ সেকেন্ডখানেক পরই গাছের ডালটা এসে তার পায়ের ওপর পড়ে ৷ পা বলেই ব্যথাটা সহ্য করা যায় ৷ মাথা হলে সইত কি না, আল্লাহ জানে ৷ টগর উঠে বসে ৷ তাকে সাহায্য করতে দুজন হাত বাড়িয়ে দেয় ৷ একজনের হাত ধরে উঠতে গিয়ে তার চোখ পড়ে মাটিতে পড়ে থাকা একটা পাখির বাসার দিকে ৷ আহা, বাসাটা মাটিতে পড়ে গেছে ৷ ভেতরে ডিম দেখা যাচ্ছে ৷ মানুষের পায়ের চাপে না ডিম নষ্ট হয়ে যায় ৷ টগর পাখির বাসাটা কুড়িয়ে বুকের কাছে আলতো করে ধরে রাখে ৷ ভিড়টা একটু কমলে সে বাসাটাকে আবার গাছের ওপরের দিকের ডালে রেখে আসবে ৷ বঙ্গবন্ধু বক্তৃতা দিতে দাঁড়িয়েছেন ৷ মুহূর্তে সমস্ত জনসমুদ্র উৎকর্ণ হয়ে ওঠে ৷
বঙ্গবন্ধু জমাট জলের মেঘের মতো মায়া আর বজ্রমাখা কন্ঠে বলে ওঠেন : আজ দুঃখ ভারাক্রান্ত মন নিয়ে আপনাদের সামনে হাজির হয়েছি ৷ আপনারা সবই জানেন, সবই বোঝেন ৷
নিজের পায়ের ব্যথা ভুলে গিয়ে টগর হা করে গিলছে বঙ্গবন্ধুর ভাষণ ৷ সে সমস্ত ইন্দ্রিয় কেন্দ্রীভূত করে শুনতে চাইছে স্বাধীনতা শব্দটা ৷ ২৩ বছরে বাঙালির ওপর পরিচালিত পাকিস্তানিদের শোষণ নিপীড়নের বিরুদ্ধে বাঙালির সংগ্রামের কাহিনী বর্ণনা করে শেখ মুজিব বলেন, আর যদি একটা গুলি চলে, আর যদি আমার মানুষকে হত্যা করা হয়, তোমাদের প্রতি আমার অনুরোধ রইল, প্রত্যেক ঘরে ঘরে দুর্গ করে তোলো ৷ তোমাদের যার যা কিছু আছে, তাই নিয়ে শত্রুর মোকাবেলা করতে হবে…
রক্ত যখন দিয়েছি, রক্ত আরো দেব ৷ এ দেশের মানুষকে মুক্ত করে ছাড়ব ইনশাল্লাহ ৷ এবারের সংগ্রাম, আমাদের মুক্তির সংগ্রাম ৷ এবারের সংগ্রাম, স্বাধীনতার সংগ্রাম ৷
তখন টগর যেন আর কিছুতেই নিজের মধ্যে থাকে না ৷ স্বাধীনতা শব্দটা ধ্বনিত-প্রতিধ্বনিত হয়ে তাকে আকাশে তুলে ধরে, সমস্তটা জনসমুদ্র একেবারে গর্জন করে উঠেছে, তার ঢেউয়ের মাথায় চড়ে টগর যেন ভাসছে আর ভাসছে… তখন আশ্চর্য হয়ে টগর লক্ষ করে, তার হাতে ধরে রাখা পাখির বাসায় ডিম দুটো ফেটে যায়, দুটো বাচ্চা বেরিয়ে আসে, আর দুটো খয়েরি রঙের পাখি বিমানের মতো নেমে আসে আকাশ থেকে, পা দুটো নামিয়ে তারা ছোঁ মেরে তুলে নিয়ে যায় শাবক দুটোকে, আর আকাশে উড়ে গিয়ে চক্কর দিতে দিতে তারা চিৎকার করে ডেকে ওঠে স্বাধীনতা স্বাধীনতা বলে, তখন আরো আরো পাখি উড়ে ওঠে আকাশে, বিচিত্র সব পাখি, তারা একটা যেন আরেকটাকে ডেকে বলছে স্বাধীনতা স্বাধীনতা, টগরের সমস্ত পৃথিবীজুড়ে তখন আর কোনো শব্দ নাই, কেবল স্বাধীনতা ছাড়া…
জাহানারা ইমাম চিন্তিত ৷ রেডিওতে শেখ মুজিবের ভাষণ সরাসির প্রচারিত হওয়ার কথা ছিল, হলো না কেন ? কী বললেন শেখ সাহেব ? তিনি বাসায় একা একা পায়চারি করছেন ৷ আর তার সঙ্গে আছে কিটি, বিদেশিনী তরুণ-অতিথি ৷
ডোরবেল বেজে ওঠে ৷
জাহানারা দরজা খোলেন ৷ স্বামী শরীফ ইমাম, আর তাঁর বন্ধু ফখরুদ্দিন এসেছেন ৷ খানিক পরে আসে গৃহপরিচারক সুবহান ৷ আর সবার শেষে আসে রুমী আর জামী ৷
রুমী দরজা থেকেই নাটকীয় কায়দায় বলতে শুরু করে, ‘এবারের সংগ্রাম, আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম, স্বাধীনতার সংগ্রাম ৷’
ফখরুদ্দিন বলেন, ‘ভাবি, চা খাওয়ান ৷’ সুবহান চা বানাতে রান্নাঘরে যায় ৷
তারপর শুরু হয় হিসাব-নিকাশ ৷ আজকে কত লোক হয়েছে ? ২০ লাখ নাকি ৩০ লাখ ?
এক সময় রুমী মাথা নাড়তে থাকে ৷ সে বলে, ‘আরে আজকে একটা বড় সুযোগ শেখ সাহেব মিস করলেন ৷ তাঁর উচিত ছিল আজকেই স্বাধীনতা ডিক্লেয়ার করে দেওয়া ৷’
ফখরুদ্দিন সাহেব বলেন, ‘চ্যাংড়া-প্যাংড়ারা কী রকম হঠকারী কথা বলে শুনছেন ৷ আজকে এইখানে স্বাধীনতা ডিক্লেয়ার করলে তো পাকিস্তানি মিলিটারি এখনই ঝাঁপিয়ে পড়ত ৷ সারা দুনিয়াকে বলত, দ্যাখো, ওরা রাষ্ট্রদ্রোহী, ওরা বিচ্ছিন্নতাবাদী ৷ বরং আমি মনে করি, শেখ সাহেবের ভাষণটা এর চেয়ে ভালো করে আর দেওয়া যেত না ৷ তিনি গেরিলা যুদ্ধের প্রস্তুতি নিতে বলেছেন ৷ যার যা আছে, তাই নিয়ে শত্রুর বিরুদ্ধে লড়তে হবে… না যেন কী বললেন না ৷ আর শেষ করলেন কী দিয়ে… এবারের সংগ্রাম মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম ৷ স্বাধীনতাও ডিক্লেয়ার করা হলো, আবার দায়দায়িত্ব সব পশ্চিমাদের ঘাড়ে চাপানো হলো ৷ মাথা গরম করে তো কিছু হবে না ৷ ডিপ্লোম্যাটিক হতে হবে…’
রুমী ঠিক যেন এই যুক্তি মেনে নিতে পারছে না ৷ সুবহান ততক্ষণে চা দিয়ে গেছে ৷
জামী এল পাশের ঘর থেকে ৷ তার কাছে নতুন খবর ৷ ‘জানো মা, আজ বিকালের প্লেনে জেনারেল টিক্কা খান এসেছে গভর্নর হয়ে ৷’
সবাই খবরটার তাৎপর্য বোঝার চেষ্টা করছে ৷ এক সপ্তাহের মধ্যে দুবার গভর্নর বদল হলো ৷ ব্যাপার কী ?
আজাদ বাসায় ফিরে আসে গভীর রাতে ৷ বন্ধুবান্ধবের সঙ্গে আড্ডা দিয়ে তারপর ৷
কাপড় পাল্টাতে পাল্টাতে বলে, ‘কই, বাশার কই ৷ তোমাদের কী খবর বলো তো ৷ আজকে মিটিংয়ে কত লোক হয়েছিল ?’
বাশার তখন একমনে একটা বই পড়ছিল ৷ বলল, ‘একটা সোর্স বলছে তিরিশ লাখ ৷ আমার বিশ্বাস হয় না ৷’
টগরকে সামনে পেয়ে আজাদ জিজ্ঞেস করে, ‘কিরে তুই যাস নাই মিটিংয়ে ?’
‘গেছলাম ৷’
‘কই ছিলি ?’
‘গাছের উপরে উঠছিলাম ৷ ডাল ভাইঙ্গা নিচে পড়ছি ৷ তখন ব্যথা বুঝি নাই ৷ অহন তো হেভি ব্যথা করতেছে ৷’
‘পা ভাঙ্গিস নাই তো ?’
‘না ৷’
‘আয়োডেন লাগা ৷’
‘লাগাইছি ৷’
‘দাদা’-জায়েদ উঁকি দেয় ৷
আজাদ বলে, ‘কিরে জায়েদ, তুই যাস নাই মিটিংয়ে ?’
জায়েদ বলে, ‘রমনা পার্ক পর্যন্ত যাইতে পারছিলাম ৷ মাইনষের গুঁতায় আর যাইতে পারি নাই ৷’
মা আসেন এ ঘরে ৷ তার চোখেমুখে ঘুম ৷ তিনি শাড়ির আঁচল ঠিক করতে করতে বলেন, ‘আজাদ এসেছিস ৷ ভাত খাবি না ?’
‘না মা ৷ ক্যাফে ডি তাজে খেয়েছি ৷ তুমি আবার উঠলা কেন ?’
‘দিনকাল ভালো না ৷ তোরা বাইরে থাকলে কি আর আমার ঘুম হয় ৷ এই, রেডিওতে না শেখ সাহেবের ভাষণ প্রচার করার কথা ছিল, করল না কেন ?’
আজাদ বলে, ‘বুঝতে পারলাম না ৷ বাশার, তোমাদের খবর কী বলো তো, রেডিও বন্ধ কেন ?’
বাশার বলে, ‘ভাষণ রিলে করার জন্যে রেডিওর লোকেরা রেডিই ছিল ৷ কিন্তু মার্শাল ল অথরিটি অর্ডার দিয়েছে ভাষণ প্রচার করা যাবে না ৷ এ জন্যে রেডিওর লোকেরা স্ট্রাইক করে সব প্রোগ্রামই বন্ধ করে দিয়েছে ৷’
মা বলেন, ‘তা-ই হবে ৷ তাই তো বলি রেডিওতে কোনো সাড়াশব্দ নাই কেন ? আজাদ, তাড়াতাড়ি হাতমুখ ধুয়ে শুয়ে পড় ৷ যা ৷’
পরদিন সকালবেলা ৷ রোদ এসে পড়েছে জানালার পর্দায়, পর্দার ফাঁক দিয়ে ঘরের মেঝেতে ৷ আজাদ আর আবুল বাশার আজকে তাড়াতাড়িই ঘুম থেকে উঠেছে প্রধানত গতকালকের উত্তেজনাবশত ৷ কালকের এত এত ঘটনা ঘটে গেল দেশে, আজকের পত্রিকাগুলো সেগুলো নিয়ে কে কী লিখেছে, সেটা দেখা দরকার ৷
তবে আবুল বাশার মর্নিং নিউজ পত্রিকাটা হাতে নিয়েই প্রথমে খুঁজতে থাকে নিজের লেখা নিউজটা ৷ বহু কষ্টে সেটা খুঁজে পায় ৷ তার তৈরি করা খবরের ট্রিটমেন্ট দেখে ভুরু কুঁচকে ফেলে সে ৷ বিড়বিড় করে বলে, ‘থ্রি সি নিউজ করায়া নিয়া সিঙ্গেল কলাম ছাপানোর কী মানে ?’
আজাদের হাতে ইত্তেফাক ৷ তার সামনে চায়ের কাপ ৷ চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে আজাদ বলে, ‘শোনো, কালকে রেসকোর্সের পাবলিক মিটিং ছাড়া আর কিছু দুনিয়ায় ঘটে নাই ৷ তুমি যে নিউজ করেছ, এটা যে সিঙ্গেল কলাম দিয়েছে, এটাই বেশি ৷ এই দ্যাখো বাঙালি জেগে আছে, রেডিও সেন্টারে অলরেডি বোমা ছোড়া সারা ৷ দাঁড়াও তো রেডিওটা ছাড়ি ৷ আজকে কী অবস্থা, দেখা দরকার ৷’
রেডিওর নব ঘোরাতেই ঢাকা সেন্টার শোনা যায় ৷ খুলেছে তাহলে ৷ একটু পরে ঘোষণা, ‘বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের ভাষণ প্রচার করা হবে আজ সকাল সাড়ে ৮টায় ৷’
আজাদ বিছানার কাছে গিয়ে বালিশের নিচ থেকে ঘড়িটা বের করে ৷ আরে, সাড়ে ৮টা তো প্রায় বাজেই ৷ ‘মা, মা’-সে চিৎকার করে ওঠে ৷ ‘মা, মা…’
রান্নাঘর থেকে মায়ের কন্ঠ শোনা যায়, ‘কী, বল ৷’
‘এদিকে আসো ৷ রেডিওতে শেখ সাহেবের ভাষণটা বাজাবে এখন ৷ শুনবা না ?’
‘হাত বন্ধ তো ৷ কচি, কচি, এদিকে আয় তো মা ৷ চচ্চড়িটা তুই একটু দেখ ৷ যেন তলায় না লেগে যায় ৷ নাড়া দিবি ৷’
কচি বলে, ‘তুমি কই যাও ?’
‘শেখ মুজিবরের ভাষণ নাকি হবে ৷ আজাদ ডাকে…’
‘আমি শুনব না ?’
‘তুইও শুনবি ?’
‘শুনব তো ৷’
‘আচ্ছা তাহলে চচ্চড়িটা নামিয়েই রাখি ৷’
আজাদের মা হাত ধুয়ে আঁচলে মুছতে মুছতে আজাদদের ঘরে আসেন ৷ ততক্ষণে ভাষণ শুরু হয়ে গেছে ৷ আজাদ ভলিউম বাড়িয়ে দেয় ৷ জায়েদ, টগর, টিসুও এসে দাঁড়ায় ঘরের ভেতরে ৷ বঙ্গবন্ধু বলে চলেন, ‘আর যদি একটা গুলি চলে, আর যদি আমার মানুষকে হত্যা করা হয়, তোমাদের প্রতি আমার অনুরোধ রইল, প্রত্যেক ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে তোলো ৷ তোমাদের যা কিছু আছে, তাই নিয়ে শত্রুর মোকাবেলা করতে হবে… এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম…’ স্বাধীনতা কথাটা শোনার সঙ্গে সঙ্গে আবারও টগরের মাথার ওপর দিয়ে হাজার হাজার পাখি উড়তে শুরু করে, যেন ডিম ভেঙে বেরিয়ে আসছে তারা, হাজারে হাজারে, আকাশ ঢেকে দিচ্ছে, আর স্বাধীনতা এই কলতানে মুখর করে তুলছে জগৎটাকে ৷