বিয়ের প্রথম কিছুদিন ঘোরের মধ্যে কেটে যায়। অনেকগুলি ঘটনা একসঙ্গে ঘটে এবং খুব দ্রুত ঘটে। অনেকটা স্বপ্নদৃশ্যের মতো। নিজের জীবনেই ঘটছে অথচ যেন নিজের জীবনে ঘটছে না। এটা যেন অন্য কারো জীবন।
বিয়ের রাতটি নিয়ে শাহানাকে অনেক রকম দুশ্চিন্তা ছিল। না জানি কী হয়, না জানি কী ঘটে। বাসর রাত নিয়ে কত রকম গল্প সে বন্ধুদের কাছ থেকে শুনেছে। কিছু কিছু ভারি মিষ্টি। বারবার শুনতে ইচ্ছে করে। গল্পের বইয়েও এই রাতের কত সুন্দর সুন্দর বর্ণনা আছে। অপরাজিতায় কী সুন্দর বর্ণনা। অপুর সঙ্গে তার স্ত্রীর প্রথম দেখা। ছোট-ছোট কথা বলছে দু জনে। কত দ্রুত বন্ধুত্ব হচ্ছে দু জনের মধ্যে। আবার সম্পূৰ্ণ অন্য ধরনের গল্পও আছে। নারীজীবনের চরম অবমাননার গল্প। গ্লানি ও পরাজয়ের গল্প। সেখানে ভালোবাসা নেই, অন্য কিছু আছে।
শাহানার বেলায় এর কোনোটাই হল না। জহির এল রাত একটার দিকে। তার মুখ দেখে মনে হল সে খুব বিরক্ত। জহিরের বড়ো বোনের গলা শোনা যাচ্ছে। খুব চেঁচিয়ে কী-যেন বলছে, অন্য সবাই তাকে সামলাতে চেষ্টা করছে। বড়ো রকমের ঝগড়া হচ্ছে। শাহানার এক বার ইচ্ছে হল জিজ্ঞেস করে কী নিয়ে ঝগড়া। সে অবশ্যি জিজ্ঞেস করল না। খাটে হেলান দিয়ে বসে রইল। তার ঘুম পাচ্ছিল। আবার একই সঙ্গে মাথায় যন্ত্রণা হচ্ছিল। ভোঁতা ধরনের ব্যথা। সারা দুপুর ঘুমুলে যেমন ব্যথা হয়, তেমন।
জহির নিজে কিছু বলল না। লাগোয়া বাথরুমে ঢুকে হাও–মুখ ধুতে লাগল। এই সময় বাইরের হৈচৈ আরো বেড়ে গেল, মোটা পুরুষালি গলায় কে একজন বলছে, এসব আমি টলারেট করব না। যথেষ্ট টিলারেট করেছি। তার পরপরই ঝনঝনি করে কী যেন ভাঙল। জহির বাথরুম থেকে বের হয়ে এসেছে। সে অসহায় ভঙ্গিতে মাথা ঝাঁকাল। কিছু বলবে না বলবে না করেও শাহানা বলল, কী হয়েছে?
একটা পুরোনো পারিবারিক ঝগড়া। উৎসব-টুৎসবের দিনে এই ঝগড়াগুলি মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে। আজ এসব শুনে দরকার নেই। পরে শুনবে! তুমি থাক কিছুক্ষণ একা একা, আমি এক্ষুণি সব মিটিয়ে দিয়ে আসছি। সরি এবাউট ইট।
অপেক্ষা করতে— করতে কখন যে শাহানা ঘুমিয়ে পড়েছিল, সে নিজেই জানে না। জহির তাকে আর জাগায় নি। বিয়ের প্রথম রাতটি সে ঘুমিয়ে পার করে দিল। নিজকে কেমন যেন অপরাধী মনে হচ্ছিল। ভোরবেলা জেগে উঠে দেখে, জহির পাশের ইজিচেয়ারে বসে। অম্বুমজনিত কারণে তার চোখ ঈষৎ রক্তগত। জহির বলল, ঘুম ভালো হয়েছে শাহানা?
শাহানা জবাব দিল না।
তুমি এত তৃপ্তি করে ঘুমুচ্ছিলে যে জাগাতে মন চাইল না।
শাহানার খুব ইচ্ছে করল জিজ্ঞেস করে, আপনি ঘুমুন নি? জিজ্ঞেস করতে পারল না। লাজ লাগল।
জহিরের বড়ো বোনের নাম আসমানী। কাল রাতে যে-মেয়ে এত কাণ্ড করেছে, আজ ভোরে তাকে দেখে তা কে বলবে? খুব হাসিখুশি যেন কিছুই হয় নি। শাহানায় হাত ধরে বাড়ি দেখাচ্ছে হড়বড় করে কত কথা বলছে–
কত বড়ো বারান্দা, দেখলে শাহানা? ফুটবল খেলা যায়, তাই না? অনেকেই বলেন এত বড়ে বারান্দা একটা ওয়েস্টেজ। আমার তা মনে হয়। না। ছোট বারন্দার বাড়িগুলিতে আমার দম বন্ধ হয়ে আসে। তোমার আসে না?
না। আমার জীবন কেটেছে ছোট বারান্দার বাড়িতে।
এখানে কিছুদিন থাকলে আর ছোট বারান্দার বাড়িতে থাকতে পারবে না। নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে আসবে। এস শাহানা, লাইব্রেরিঘরটা তোমাকে দেখাই। তোমার তো আবার গল্পের বইয়ের খুব নেশা।
কে বলল আপনাকে?
কেউ বলে নি। এক বার তোমাদের বাসায় গিয়ে দেখি বই পড়ছ। আর চোখে আঁচল দিচ্ছ।
শাহানা কিছু বলুল না। আসমানী হাসতে-হাসতে বলল, গল্প উপন্যাসের নায়ক-নায়িকাদের সুখদুঃখে যারা কাতর, তারা সাধারণত নিজেদের সুখদুঃখের ব্যাপারে উদাসীন হয়। এ-রকম হয়ে না। নিজের সুখ নিজে আদায় করে নেবে। বুঝতে পারছি?
পারছি।
জহির অবশ্যি খুবই ভালো ছেলে, সুখ তুমি পাবে। যথেষ্টই পাবে। এ নিয়ে তোমার সঙ্গে এক লক্ষ টাকা বাজি রাখতে পারি। রাখবে বাজি?
শাহানা হেসে ফেলল। আসমানী প্রসঙ্গ পাল্টে বলল, কাল রাতে বড়ো রকমের একটা ঝগড়া হয়েছে, তুমি কিছু-কিছু বোধহয় শুনেছ। জহির কি কিছু বলেছে?
না।
সত্যি বলে নি?
না। আমি ঘুমিয়ে পড়েছিলাম।
ও, আচ্ছা! তুমি কি শুনতে চাও?
জ্বি-না, আমি শুনতে চাই না।
আসমানী অবাক চোখে খানিকক্ষণ তাকিয়ে থেকে সহজ স্বরে বলল, শুনতে না চাইলেও তুমি শুনবে। অন্য কারো কাছ থেকে শোনার চাইতে আমার কাছ থেকে শোন। ঝামেলাটা বাড়ি নিয়ে। এই বাড়ি আমি চাই, কিন্তু বাবা আমাকে দিতে রাজি না। ঢাকায় বাবার আরো দুটি বাড়ি আছে, সে দুটি বাবা জহিরকে দিয়ে দিক। তা দেবে না। বাবা আমার কোনো কথাই শুনতে চাচ্ছে না। জহির যখন তাঁর ছেলে, আমিও তেমনি তাঁর মেয়ে। আমি তো নদীর পানিতে ভেসে আসি নি। তাই না। শাহানা?
তা তো ঠিকই।
শোন শাহানা, তোমার কাছে অনুরোধ-পারিবারিক এই ঝামেলায় তুমি নিরপেক্ষ থাকবে, এবং আমার মন খুব ছোট, এইসব ভাববে না। আমার মন ছোট না। তবে আমি অধিকার ছেড়ে দেবার মেয়েও না। আই উইল ফাইট টু দি লাষ্টি। এস, তোমাকে বাগানটা দেখাই। খুব সুন্দর বাগান।
বাগান সত্যিই খুব সুন্দর। দুটি গোলাপঝাড় বাগান আলো করে আছে। শাহানা মুগ্ধকণ্ঠে বলল, বাহ কী সুন্দরা আসমানী চাপা গলায় বলল, এই বাগানের প্রতিটি গোলাপচারা আমার লাগান। কোনটিতে কবে ফুল ফুটিল, সব আমার ডাইরিতে লেখা আছে। এ বাড়িতে কারো বাগানের শখ ছিল না। এই শখ আমার। চল ছাদে যাই, দেখবে কত ধরনের অর্কিড আছে। কত কষ্ট করে একেকটা জোগাড় করেছি। এক বার অর্কিড আনতে গিয়ে দুটি খারাপ লোকের পাল্লায় পড়েছিলাম। ভাগ্যগুণে বেঁচে গেছি।
আসমানী ছোট্ট একটি নিঃশ্বাস ফেলল। শাহনার খুব ভালো লাগল মেয়েটিকে। কথা বলার কী সহজ-স্বাভাবিক ভঙ্গি!
হাত ধরে-ধরে হাঁটছে। যেন কত দিনকার পুরানো বন্ধু। অথচ এই মেয়েই কী কর্কশ গলায় কাল রাতে ঝগড়া করছিলা! আজও হয়তো করবে। এক জন মানুষের অনেকগুলি চেহারা থাকে। একটি চেহারার সঙ্গে অন্য চেহারার কিছুমাত্র মিল থাকে না।
শাহানা প্রাণপণ চেষ্টা করতে লাগল নতুন বাড়িতে নতুন পরিবেশে নিজেকে মানিয়ে নিতে। স্রোতের মতো লোকজন আসছে। সবার সঙ্গেই হাসিমুখে কথা বলতে হচ্ছে। আশ্চর্যের ব্যাপার, যারা আসছে সবাই বিত্তবান। কেউ বিলেত ঘুরে এসেছে। কেউ এই সামারে আমেরিকা যাবে। এক জন শাহানাকে বলল, শাহানা যদি শপিং-এর জন্যে কোলকাতা যেতে চায় তাহলে যেন তাকে খবর দেয়। সেও সঙ্গে যাবে। কোলকাতা যাওয়া তো নয়, যেন বায়তুল মুকাররামে বাজার করতে যাওয়া। শাহানা ধাঁধায় পড়ে গেল। বিরক্ত ও বিব্রত বোধ করতে লাগল। সবচে বিরক্ত করল দাড়ি-গোঁফওয়ালা এক প্রৌঢ়। সে শাহানাকে ডাকছে আন্টি করে এবং বেশ উঁচুস্বরেই বলছে তার নেক্সট ছবিতে আন্টিকে একটা রোল করতেই হবে। এ-রকম সুন্দর একটা চেহারা, অথচ বাংলাদেশের লোক সেটা দেখবে না, তা হতেই পারে না। যদি হয়, তাহলে সেটা হবে ক্রাইম। ক্ষমার অযোগ্য একটা অপরাধ। কী কুৎসিত লোকটির বলার ভঙ্গি, অথচ কেউ রাগ করছে না। বরং মজা পেয়ে হাসছে। খুশি-খুশি গলায় বলছে।–দাও একটা রোল শাহানাকে। মনে হয় ভালোই করবে। যেভাবে ব্লাশ করছে, তাতে ভার্জিন ভিলেজ গার্ল হিসেবে চমৎকার হওয়ারই কথা।
কোথায় ছিল শাহানা, আর আজ সে কাঁথায়? পরিবেশের সঙ্গে সঙ্গে মনও বোধহয় বদলে যায়। এত ভালোবাসত গল্পের বই, অথচ এখন বই নিয়ে বসার কথা মনেই হয় না। তবুও অচিন ব্লাগিনী নামের একটা বই সে বের করেছে। পড়ছে, কিন্তু মন লাগছে না। আগে একটি বই পড়া শুরু করলেই মনে হত গল্পের নায়িকা আসলে সে। এসব তার জীবনের ঘটনা। এখন মনে হচ্ছে না। উপন্যাসের নায়িকার জীবন এবং তার জীবন আলাদা। এত তাড়াতাড়ি মানুষ এত বদলে যায়? এই বাড়িতে কত মানুষ, অথচ কেউ তার পরিবর্তন লক্ষ করছে না কেন? যে-মানুষটি সবচে কাছের হওয়া উচিত, সে-ই কেমন দূরে দূরে আছে। কী একটা মামলা নিয়ে ব্যস্ত। তাকে নাকি চিটাগাং যেতে হবে। না গেলেই নয়। গত রাতে সে খুব আগ্রহ নিয়ে মামলার কথা বলল–
বুঝলে শাহানা, মামলাটা সম্পত্তি নিয়ে। হাজি নুরুল ইসলাম নামে এক বিরাট ধনী ব্যক্তি চিটাগাং-এ থাকেন। জন্মসূত্রে বাড়ি হচ্ছে ঢাকার বিক্রমপুর। ভদ্রলোক অত্যন্ত ধাৰ্মিক। এতিমখানা, স্কুল, কলেজ, মসজিদে বহু টাকা দেন। শুধু তাই না, তিনি একজন আদর্শ স্বামী, আদর্শ বাবা। ভদ্রলোক মারা যাবার পর একটা সমস্যা দেখা গেল। চিটাগাংয়ের খারাপ পাড়ার এক ফ্লেয়ে তাঁর সম্পত্তির বিরাট এক অংশ দাবি করে মামলা রুজু করে দিল। ভদ্রলোক নাকি তাকে দানপত্র করে দিয়ে গেছেন। কাগজপত্র আছে। কেলেঙ্কারি অবস্থা! কেমন ইন্টারেস্টিং না?
হ্যাঁ।
তুমি কিন্তু তেমন ইন্টারেস্ট পাও নি। কেমন করে বুঝলাম বল তো?
শাহানা চুপ করে রইল। জহির হাসতে-হাসতে বলল, তুমি জানতে চাও নি আমি কোন পক্ষের হয়ে মামলায় নেমেছি। তা থেকেই বুঝলাম।
জহির শব্দ করে হাসতে লাগল। কাউকে হাসতে দেখলেই হাসতে ইচ্ছে করে। শাহানাও হেসে ফেলল। জহির অবাক হওয়ার মতো ভঙ্গি করে বলল, তুমি আবার হাসতেও জান নাকি? অবাক করলে তো! আমি এক মেয়েকে জানতাম, সে কিছুতেই হাসত না। যত হাসির কথা বলা হোক, সে গম্ভীর হয়ে থাকত। শেষটায় রহস্য জানা গেল।
কী রহস্য?
হাসলে মেয়েটাকে খুব বাজে দেখাত।
সত্যি?
হ্যাঁ, কাউকে কাউকে বাজে দেখায়। আচ্ছা শোন শাহানা, একটা কাজ করলুব্ধ হয়? তুমিও আমার সঙ্গে চিটাগাং চল।
আমি?
হাঁ, তুমি। চিটাগাং-এর কাজ শেষ করে তোমাকে নিয়ে নেপাল থেকে ঘুরে আসব। এই সময়টা নেপালে যাবার জন্যে ভালো নয়। তবু খারাপ লাগবে না, আমি কয়েক বার গিয়েছি। যাবে?
যাব।
তোমাদের বাসায় এখন কিছু জানানোর দরকার নেই। নেপাল পৌঁছে সবার নামে একটা করে ভিউকার্ড পাঠিয়ে দেবে। আইডিয়াটা কেমন? ভালো না?
হ্যাঁ, ভালো।
এমন শুকনো মুখে বলছি কেন? হাসিমুখে বল।
শাহানা হাসল। জহিরের সঙ্গে কথা বলতে তার বেশ ভালোই লাগছে। কে জানে, এই লোকটির সঙ্গে তাঁর জীবন হয়তো খুব খারাপ কাটবে না।