২৯. পৃথিবীর মানুষ ও আকাশের চাঁদ
আমাদের জীবনে উপভোগ করার জন্যে যে কয়টি জিনিস আছে তার তালিকায় চাঁদ নিশ্চয়ই একেবারে প্রথম দিকে। আমি নিশ্চিত পৃথিবীতে একজন মানুষকেও খুঁজে পাওয়া যাবে না যে কখনো না কখনো চাঁদকে দেখে মুগ্ধ হয় নি। আমার নিজের 1971 সালের একটি দিনের কথা মনে আছে, সেই ভয়াবহ দিনটিতে আমাদের পুরো পরিবার তাড়া খাওয়া পশুর মতো জীবন নিয়ে পালিয়ে বেড়াচ্ছিলাম, তার মাঝে হঠাৎ করে আকাশের দিকে তাকিয়ে আমি চমকে উঠেছিলাম। সন্ধেবেলা আকাশ আলো করে পূর্ণিমার চাঁদ উঠেছে, সেই ভয়ঙ্কর সৌন্দর্যের কথা আমি আজও ভুলতে পারি না।
মজার কথা হচ্ছে এই চাঁদের অত্যন্ত সহজ কিছু বিষয় কিন্তু অনেক সাধারণ মানুষই ভালো করে লক্ষ করে নি। যারা মুসলমান তারা চাঁদ দেখে রোজা রাখে, চাঁদ দেখে ঈদ করে কিন্তু কেন নূতন একটা সরু চাঁদ আস্তে আস্তে পূর্ণিমার ভরা চাঁদ হয়ে ওঠে আবার পূর্ণিমার ভরা চাঁদটা কেমন করে অমাবস্যার অন্ধকারে ডুবে যায় তাদের অনেকেই সেটা জানে না। কেউ যদি এটুকু পড়ে খানিকটা অপরাধ বোধে ভুগতে থাকে তাহলে তাদের সান্ত্বনা দিয়ে বলতে পারি, এটা নিয়ে লজ্জা পাবার কিছু নেই। পৃথিবীতে অন্তত একটি দেশ রয়েছে যে দেশটি রাষ্ট্রীয়ভাবে এই তথ্যটুকু জানে না সেটা তাদের জাতীয় পতাকার মাধ্যমে স্বীকার করে নিয়েছে! সেটি কোন দেশ এবং কীভাবে রাষ্ট্রীয়ভাবে তাদের অজ্ঞানতা প্রকাশ করে বসে রয়েছে সেটা বলার আগে আমরা চাঁদের সহজ কয়েকটা বিষয় জেনে নেই।
আমরা সবাই লক্ষ করেছি প্রতিদিন সূর্য পূর্ব দিকে উঠে আকাশ পাড়ি দিয়ে পশ্চিম দিকে অস্ত যায়। কারণটা খুব সহজ–সূর্য মোটেও ঘুরপাক খাচ্ছে না, সে তার জায়গায় স্থির, পৃথিবীটাই তার অক্ষের উপর ঘুরছে তাই মনে হচ্ছে সূর্যটা বুঝি পূর্ব দিকে উঠে পশ্চিম দিকে অস্ত যাচ্ছে। যারা আকাশের দিকে তাকাতে ভালোবাসে তারা নিশ্চয়ই লক্ষ্য করেছে চাঁদও পূর্ব দিকে ওঠে এবং পশ্চিম দিকে অস্ত যায় এবং সেই একই কারণে। সূর্যের সাথে চাঁদের একটা পার্থক্য আছে, সূর্যের পূর্ণিমা-অমাবস্যা নেই, সেটা সবসময়ই উজ্জ্বল কিন্তু চাঁদের পূর্ণিমা অমাবস্যা আছে, সেটা কখনো উজ্জ্বল থালার মতো কখনো ভাঙা কলসির মতো আবার কখনো কাস্তের মতো (উপমাগুলো আমার নয়–কবিদের!)।
এই ব্যাপারটা ঘটে কারণ চাঁদ সূর্যের মতো স্থির নয়, চাঁদ আসলে পৃথিবীকে ঘিরে ঘুরছে। আমাদের দিনের হিসেবে পৃথিবীকে পুরো এক ভাগ ঘুরে আসতে চাঁদের সময় লাগে 29.5 দিন। কেউ যদি ব্যাপারটা মেনে নেয় তাহলেই সে বুঝতে পারবে কেন চাঁদটা বাড়ে-কমে। 29.1 নং ছবিতে পৃথিবীকে ঘিরে চাঁদের কক্ষপথকে দেখানো হয়েছে–(ছবিটি সঠিক স্কেলে আঁকা হয় নি, যদি সঠিক স্কেলে আঁকা হতো তাহলে পৃথিবী থেকে চাঁদের দূরত্ব হতো 60টি পৃথিবীর ব্যাসার্ধের সমান!)। প্রতি 29.5 দিনে একবার করে চাঁদ পৃথিবীকে ঘিরে তার কক্ষপথে যেতে যেতে যখন পৃথিবী আর সূর্যের মাঝখানে এসে হাজির হয় তখন যে অংশটুকু পৃথিবীর দিকে মুখ করে থাকে সেই অংশটি থাকে ছায়া ঢাকা অন্ধকার। আমরা এটাকে বলি অমাবস্যা, তাই (রাতের বেলাও) চাঁদকে আমরা প্রায় দেখতেই পাই না, ছায়া ঢাকা অংশটা পৃথিবীর দিকে মুখ করে আছে, আমরা কেমন করে দেখব? আবার চাঁদ তার কক্ষপথ ধরে যখন পৃথিবীর অন্য পাশে হাজির হয় তখন চাঁদের আলোকিত অংশটা পৃথিবীর দিকে মুখ করে থাকে, আমরা তাই পুরো চাঁদটাকে দেখতে পাই, সেটাকে আমরা বলি পূর্ণিমা। পূর্ণিমার নরম আলো দেখে আমরা সবাই কখনো না কখনো মুগ্ধ হয়েছি এবং আমি নিশ্চিত অনেকেই মনে করে চাঁদের শরীর থেকে সূর্যের আলো বেশ ভালোই প্রতিফলিত হয়–মজার কথা হচ্ছে ব্যাপারটা মোটেও সত্যি নয়। চাঁদের প্রতিফলন ক্ষমতা খুবই কম, এটা একটা কয়লার মতো, সূর্যের আলোর মাত্র 7% প্রতিফলিত করতে পারে! চাঁদ যদি কয়লার মতো কালো না হয়ে আরেকটু উজ্জ্বল হতো, তাহলে পূর্ণিমার আলোতেই আমাদের চোখ ধাঁধিয়ে যেতে পারত।
যারা এই লেখাটি একটু মনোযোগ দিয়ে পড়ছে নিশ্চিতভাবেই তাদের মনের ভেতর দুটো প্রশ্ন দানা বেঁধেছে। সেটি হচ্ছে অমাবস্যার সময় সত্যি সত্যি যদি 29.1 নং ছবির মতো চাঁদটা পৃথিবীর আর সূর্যের মাঝখানে থাকে তাহলে চাঁদ নিশ্চয়ই সূর্যের আলোটাকে আটকে দেবে এবং ঠিক একই কারণে পূর্ণিমার সময় নিশ্চয়ই পৃথিবীটাই সূর্যের আলোটাকে আটকে দিয়ে চাঁদটাকে অন্ধকার করে ফেলবে। কথা বলতে কী আসলেই এই ব্যাপারগুলো ঘটে এবং এই প্রক্রিয়া দুটোর নাম হচ্ছে সূর্যগ্রহণ এবং চন্দ্রগ্রহণ। যারা সূর্যগ্রহণ-চন্দ্রগ্রহণ লক্ষ করে থাকে তারা সবাই জানে সূর্যগ্রহণ হয় অমাবস্যায় এবং চন্দ্রগ্রহণ হয় পূর্ণিমায় ।
যারা এখন পর্যন্ত এই লেখাটা খুব মনোযোগ দিয়ে পড়ে এসেছে তারা নিশ্চয়ই এখন বলবে, তাই যদি সত্যি হবে তাহলে প্রতি অমাবস্যায় কেন সূর্যগ্রহণ হয় না আর প্রতি পূর্ণিমায় কেন চন্দ্রগ্রহণ হয় না? এর কারণ চাঁদের কক্ষপথটা আসলে পৃথিবী আর সূর্যের সাথে এক সমতলে নয়, এটা তার সাথে 5° কোণ করে রেখেছে (29.2 নং ছবি) তাই প্রতি অমাবস্যায় এটা ঠিক পৃথিবী আর সূর্যের মাঝখানে আসতে পারে না আবার প্রতি পূর্ণিমায় চাঁদটি ঠিক সূর্য আর পৃথিবীর সাথে এক সরলরেখায় থাকতে পারে না। মাঝে মাঝে থাকে আর ঠিক তখন সূর্য বা চন্দ্রগ্রহণ হয়। যখন এই গ্রহণ হয় তখন সারা পৃথিবী থেকে সেটা সমানভাবে দেখা যায় না। 2009 সালের জুলাই মাসের 22 তারিখে যে সূর্যগ্রহণ হয়েছে বাংলাদেশ থেকে সেটা পরিপূর্ণভাবে দেখা গেছে।
নূতন চাঁদ বলতে আমরা কী বোঝাই এতক্ষণে সেটাও নিশ্চয়ই সবার কাছে স্পষ্ট হয়ে গেছে। খাঁটি অমাবস্যায় চাঁদটা থাকে সূর্যের ঠিক বিপরীতে। চাঁদটা যখন একটু সরে আসে এবং পৃথিবী থেকে আমরা চাঁদের আলোকিত অংশের একটা কিনারাকে দেখতে পাই আমরা সেটাকেই বলি নূতন চাঁদ। নূতন চাঁদ ওঠার কয়েকদিনের ভেতরেই চাঁদ আরো সরে আসে এবং পৃথিবী থেকে আমরা চাঁদের আলোকিত অংশের আরো অংশ বিশেষ দেখতে শুরু করি। আমরা সেটাকে বলি শুক্লপক্ষ। পূর্ণিমার পর আবার উল্টো ব্যাপার ঘটতে শুরু করে, চাঁদের আলোকিত অংশটা আবার আমাদের আড়ালে চলে যেতে থাকে, আমরা সেটাকে বলি কৃষ্ণপক্ষ। যারা আকাশের চাঁদ দেখতে ভালোবাসেন তারা চাঁদের কোন অংশ আলোকিত সেটা দেখেই বলে দিতে পারবেন কখন শুক্লপক্ষ কখন কৃষ্ণপক্ষ। আমি নিজে সেটি করি দুটো অক্ষর দিয়ে। শুক্লপক্ষে যেহেতু চাঁদ উজ্জ্বল থেকে উজ্জ্বলতর হয় তার জন্যে bright। শব্দের প্রথম অক্ষর b ব্যবহার করি, শুক্লপক্ষে চাঁদ থাকে b-এর বাঁকা অংশের মতো (29.3 নং ছবি)। আবার কৃষ্ণপক্ষে চাঁদ ধীরে ধীরে অন্ধকার হতে থাকে তার জন্যে ইংরেজি শব্দ dark-এর প্রথম অক্ষর d ব্যবহার করা যায়। এই সময় চাঁদ থাকে b-এর বাঁকা অংশের মতো!
যারা আকাশের চাঁদ উপভোগ করেন তাদের পেটের ভেতরে এতক্ষণে আরেকটা প্রশ্ন দানা বেঁধে ওঠার কথা। সেটা হচ্ছে পূর্ণিমার চাঁদ যখন দিগন্ত থেকে প্রথম উদিত হয় তখন সেটা থাকে বিশাল, সেটা যখন মাথার উপরে উঠে যায় তখন সেটা কেন এত ছোট হয়ে যায়? এই অত্যন্ত যৌক্তিক প্রশ্নের উত্তরটি একটু বিচিত্র, সেটি হচ্ছে আসলে এটি সত্যি নয়। চাঁদ যখন প্রথম ওঠে এবং যখন মাথার উপর উঠে তার আকারের পরিবর্তন হয় না–পুরোটাই আমাদের দৃষ্টিবিভ্রম! আমি জানি এটা মেনে নেয়া কঠিন কিন্তু কেউ যদি আমার কথা বিশ্বাস না করে তাহলে যন্ত্রপাতি দিয়ে মেপে দেখতে পারে–ক্যামেরা দিয়ে ছবি তুলে দেখতে পারে, সে আবিষ্কার করবে কথাটি সত্যি।
চাঁদ নিয়ে তথ্যের কোনো শেষ নেই, কাজেই চমকপ্রদ তথ্যটা দিয়ে শেষ করা যাক। যারা 29.1 নং ছবিটি দেখেছে তারা নিশ্চয়ই প্রশ্ন করতে পারে চাঁদটা যেহেতু পৃথিবীকে ঘিরে ঘুরছে তাই নিশ্চয়ই একেক সময় চাঁদের একেক অংশ পৃথিবীর দিকে মুখ করে আছে। তাই আমরা যদি নিয়মিতভাবে চাঁদকে লক্ষ করি তাহলে আগে হোক পরে হোক, একটু একটু করে হলেও আমরা নিশ্চয়ই পুরো চাঁদটাকেই দেখতে পারব। কিন্তু মজার ব্যাপার হলো সেটা সত্যি নয়। চাঁদ যখন পৃথিবীকে ঘিরে ঘুরে সে সবসময়েই তার একটা নির্দিষ্ট অংশ পৃথিবীর দিকে মুখ করে রাখে। আমরা শুধু সেই অংশটাই দেখতে পাই অন্য অংশটা কখনোই দেখি না। চন্দ্রে অভিযান করে মহাকাশযান পাঠিয়ে প্রথম চাঁদের উল্টো পিঠের ছবি তুলে আনা হয়েছিল। (আমরা চাঁদের যে অংশটা দেখি সেখানে “কলংক” অনেক বেশি–চাঁদের কালো অংশকে কেন কলংক বলা হয় আমার কাছে তার সদুত্তর নেই!)। এখানে একটা বিষয় উল্লেখ করা দরকার, কেউ যেন মনে না করে পৃথিবীর সাথে চাঁদের এই ব্যবহার খুব বিচিত্র কিছু। যখন দুটি গ্রহ বা উপগ্রহ একটা আরেকটাকে ঘিরে ঘুরতে থাকে, ধীরে ধীরে তারা প্রায়ই এরকম একটা অবস্থানে চলে যায়, জ্যোতির্বিজ্ঞানে এরকম আরো অনেক উদাহরণ আছে।
লেখার শুরুতে আমরা বলেছিলাম পৃথিবীতে অন্তত একটি দেশ আছে যে দেশটি চাঁদ সম্পর্কে তাদের অজ্ঞতা রাষ্ট্রীয়ভাবে প্রচার করে আসছে–সেই দেশটির নাম পাকিস্তান। তাদের জাতীয় পতাকায় সরু চাঁদের পাশে একটি তারা আঁকা আছে (29.4 নং ছবি)। আমরা এতক্ষণে জেনে গেছি চাঁদ কখনো সরু হয়ে যায় না, তার পুরো আলোকিত অংশের খানিকটা দেখি বলে সরু মনে হয়–পুরো চাঁদটা কিন্তু সেখানে আছে। পুরো চাঁদ যদি থাকে তাহলে তার মাঝখানে একটা তারা দেখার কোনো উপায় নেই! পাকিস্তানের জাতীয় পতাকায় যেভাবে চাঁদ-তারা আঁকা আছে সেভাবে তারাটা দেখতে হলে চাঁদের ঠিক মাঝখানে বিশাল এক ফুটো করে রাখতে হবে যেন সেই ফুটো দিয়ে পিছনের তারাকে দেখা যায়।
পৃথিবীর বিজ্ঞানমনস্ক দেশ যখন তাদের জাতীয় পতাকায় চাঁদ তারা বসিয়েছে তখন কিন্তু তারাটাকে ঠিক জায়গায় বসানোর জন্যে সেটাকে বসিয়েছে চাঁদের বৃত্তাকারের বাইরে তুরস্কের জাতীয় পতাকাটা দেখলেই সেটা বোঝা যায়!
পাকিস্তানের জাতীয় পতাকাতে আরো একটা সমস্যা রয়েছে–সেখানে যে চাঁদটি রয়েছে সেটি কী উজ্জ্বলতর হওয়ার প্রতীক্ষায় থাকা নূতন চাঁদ, নাকী অমাবস্যার অন্ধকারে ডুবে যাবার আগের মুহূর্তের ক্ষয়িষ্ণু চাঁদ? অবিশ্বাস্য হলেও সত্যি এটা নূতন চাঁদ নয়–এটা ক্ষয়িষ্ণু চাঁদ!
ভাগ্যিস 1971 সালে স্বাধীনতা যুদ্ধে পাকিস্তানকে পরাজিত করে আমরা বাংলাদেশ স্বাধীন করে নূতন জাতীয় পতাকা পেয়েছিলাম, তা না হলে এই অবৈজ্ঞানিক পতাকার দায়ভার আমাদের বয়ে বেড়াতে হতো!