নির্বাচিত কলাম – নারী এবং খাদ্য-বস্তু
পদার্থ তিন প্রকার, কঠিন, তরল ও বায়বীয়। নারীরও কিন্তু প্রকার আছে। নারী চার প্রকার। শঙ্খিনী, পদ্মিনী, চিত্ৰিণী, হস্তিনী। এই প্রকারগুলো নারী-শরীরের আকৃতির ওপর ভিত্তি করে রাখা। নারীর আকৃতি বহু মূল্যবান একটি বিষয়। পুরুষেরা একেকটি আকৃতি নিয়ে নানারকম ব্যাখ্যা তৈরি করেছেন। শরীর দ্বারা নারী যত পরিচিত, অন্য আর কিছু দ্বারা নয়। মানুষের অর্থাৎ পুরুষের স্বায়ুতন্ত্র যখন প্রথম কাজ করতে শুরু করে সম্ভবত তখন থেকেই নারীকে অতি সুস্বাদু একপ্রকার ফলের মত ব্যবহার করবার ইচ্ছে জাগে। তাকে যেন তেঁতুলের মত চোষা যায়, পেয়ারার মত কামড় দেওয়া যায়, আনারসের রসের মত চুমুক দেওয়া যায়। নারী যদি চর্ব্য, চোষ্য, লেহ্য, পেয় না হল—তবে আর নারী কেন ?
নাট্যকার এস.এম. সোলায়মানের একটি নাটকে এক মৌলবাদী নারীকে কলার সঙ্গে তুলনা করেছে। কলা যখন খোসা দ্বারা আবৃত থাকে, তখন সে সুন্দর, খোসা খুলে গেলে কলার মত নারীও বেপর্দা হয়।
ভিয়েতনামের এক কবি হে চুয়ান হুয়োং নারীকে কাঁঠালের সঙ্গে তুলনা করেছেন। বলেছেন, কাঁঠালের রস যেমন মিষ্টি নারীও তেমনি মিষ্টি। কিন্তু তাকে খেতে গেলে হাতে যে আঠা লাগে তা এত বিশ্রী যে তা খেতে যাবার আগে সাবধান থাকতে হয়। পুরুষেরা তাদের পছন্দমত নাম দিয়েছে নারীর। নাম দিয়েছে রম্ভোরূ—যার অর্থ কদলীবৃক্ষের ন্যায় সুপুষ্ট ও সুন্দর উরু বিশিষ্ট রমণী। নাম দিয়েছে পীনোস্তনী—অর্থাৎ সুউচ্চ স্তনবিশিষ্ট নারী। নাম দিয়েছে বরারোহা—যার অর্থ সুডৌল ও সুস্পষ্ট নিতম্ব বিশিষ্ট সুন্দরী। সুগঠিত নিতম্বধারীর আরেক নাম সুশ্রোণী। নাম দেওয়ার ধরন দেখলে আমাদের অনুমান করতে অসুবিধা হয় না মূলত যৌন সম্ভোগের বস্তুরূপেই নারীর পরিচয়। তাকে তার স্তন, নিতম্ব, উরু দ্বারা পরিমাপ করা হয় এবং নামকরণ করা হয়। নারীর বর্ণনাত্মক সম্বোধনগুলোর অধিকাংশই দেহের অনুষঙ্গ বহন করে।
‘পুর’ শব্দটির অর্থ গৃহ। গৃহের সঙ্গে নারীর সম্পর্ক এত ঘনিষ্ঠ করা হয়েছে যে নারীর বিভিন্ন নামে ‘পুর’-এর আধিক্য দেখি–যেমন, অন্তঃপুরিকা, পুরনারী, পুরলক্ষ্মী, পুরাঙ্গনা, পুরস্ত্রী, পৌরস্ত্রী, পুরমহিলা, পুরবালা, পুরবাসিনী, অন্তঃপুরবাসিনী, পৌরাঙ্গনা, পুরন্ধি (পতি-পুত্রবতী স্ত্রী)।
‘It’s a man’s world, woman’s place in the home’—এটা খুব পুরনো কথা। পুরনো জিনিস আজকাল আর খাটে না, চারদিকে নতুনের জয়জয়কার। কিন্তু নারী সম্পর্কিত আদিবচনগুলো দিন দিন শান্ দিচ্ছে শব্দে।
গৃহের সঙ্গে সঙ্গতি রেখে নারীর আরও একটি নাম দেওয়া হয়েছে—গৃহিণী। কবি ফরহাদ মজহার বলেন, তারা গৃহে গৃহে আসবাবপত্রের মত শোভা পায় বলে তাদের নাম গৃহিণী। (দ্রষ্টব্য : আমাকে তুমি দাঁড় করিয়ে দিয়েছে বিপ্লবের সামনে)। নারীর সঙ্গে রমণের সম্পর্কও খুব গভীর, পুরুষেরা নারীকে যৌন সামগ্ৰী হিসেবে অধিক বিবেচনা করে, তাই নিদ্বিধায় তার নাম দেওয়া হয়েছে রমণী।
মহিলার সঙ্গে মহল, অঙ্গনার সঙ্গে অঙ্গন (আঙ্গিনা)-এর সম্পর্ক বড় নিবিড় বলে ভাবা হয়। তাই মহিলা বা অঙ্গনার সীমানা মহল এবং অঙ্গন পর্যন্তই বেঁধে দেওয়া হয়। বসবাস এবং বিচরণের সীমাবদ্ধতা নিয়েও নারীর নামকরণের কৌতুক চলে।
নারীদেহ শুধু মানুষ কেন স্বয়ং আল্লাহ তায়ালা কোরানে বর্ণনা করেছেন—তাহদের জন্য থাকিবে পানপত্র, কুঁজা ও প্রস্রবণ-নিঃসৃত সুরাপূর্ণ পেয়ালা; তাহদের পছন্দমত ফলমূল, তাহদের ঈঙ্গিত পাখির মাংস; আর তাহদের জন্য থাকিবে আয়তলোচনা হুর, সুরক্ষিত মুক্তাসদৃশ (সূরা ওয়কি’আ ১৮/২১/২২/২৩)।
তাহারা যেন প্রবাল ও পদ্মরাগ (সূরা রাহমান ৫৮)। স্বর্গের নারীদের চোখ বড় ও সুন্দর—তারা আয়তলোচনা। তারা সুরক্ষিত, মানুষ এবং জীন পূর্বে তাদের স্পর্শ করেনি, তারা মুক্তার মত গৌরবর্ণ। প্রবাল, পদ্মরাগ, মুক্ত মূল্যবান রত্নবিশেষ। নারীকে এইসব ধাতুর সঙ্গে তুলনা করা হয়েছে। নারীকে সুরা, ফলমূল ও মাংসের কাতারে উপস্থিত করা হয়েছে। শুধু স্বর্গে কেন, মর্ত্যের নারীকেও রত্ন উপাধি থেকে নিস্তার দেওয়া হয়নি। পুরুষ বড় আহ্লাদ করে নারীকে রমণীরত্ন, নারীরত্ব, স্ত্রীরত্ব ইত্যাদি নানা নামে ভূষিত করেছে। রত্ন হচ্ছে মূল্যবান বস্তু, নারীও এ জগতের ভোগ্যবস্তু হিসেবে বড় মূল্যবান।
পুরুষ শব্দের সঙ্গে যে শব্দের ব্যবহার হয় তা শক্তি ও শৌর্যের প্রতীক। যেমন—পুরুষোত্তম, পুরুষসিংহ, নরশার্দুল, নরপুঙ্গব, পুরুষপুঙ্গব, পুরুষপ্রধান, পুরুষপুণ্ডরীক, নরকেশরী ইত্যাদি। উল্লিখিত সম্বোধনে সিংহ, শার্দুল (বাঘ), পুঙ্গব (ষাড়), কেশরী (সিংহ), শ্রেষ্ঠ, প্রধান ইত্যাদি শব্দ দ্বারা বোঝানো হয় পুরুষ পরাক্রমশালী, বীর্যবান। ওদিকে অবলা অর্থ বলহীনা, অবলা অর্থ নারী। এই সম্বোধনে স্পষ্ট হয় নারী দুর্বল।
পরস্পরের সহযোগিতায় অবস্থানকারী মনুষ্য সংঘকে সমাজ বলে। আবার প্রাণীর দলকেও বলা যায়, যেমন পশুসমাজ, পক্ষিসমাজ। মানবজাতি ও মানবসমাজের মত স্ত্রীজাতি, নারীজাতি, মহিলাসমাজ, নারীসমাজ, নারী সম্প্রদায় ইত্যাদিও বহুল ব্যবহৃত শব্দ। এই ব্যবহারের একটিই কারণ তাকে পৃথক করা। জাতি বলতে বুঝি জন্ম, উৎপত্তি। মানুষের ভ্রূণ থেকে যদি নারীর জন্ম হয়ে থাকে তবে সে কেন স্ত্রীজাতি ও নারীজাতি বলে মানবজাতির বাইরে পৃথক একটি জাতি হিসেবে পরিচিত হবে ? যেন স্ত্রীরা মানবের বাইরে, যেন নারী আদপে মানুষ নয়। সে আলাদা জাতি, আলাদা সমাজ ।
অভিধান থেকে যদি এই বিভেদ মোচন করা না যায় তবে মানুষের সংস্কার থেকে কেন যাবে, রক্তমাংস থেকে কেন যাবে ? এইসব বৈষম্য জলজান্ত রেখে যে নারী দাবি তোলে নারী স্বাধীনতার, তার মত নিবোধ আর কে আছে! আভিধানিক শৃঙ্খল থেকে মুক্তি কে দেবে তাকে, যদি না সে নিজে এসব অশ্লীল অভিধানকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করবার সাহস অর্জন করে।