অধ্যায় ২৯. নানকের সংস্কার
মার্টিন লুথার সম্ভবত তাকে পছন্দ করতেন না এবং এই অনুভূতিটাও পারস্পরিক হতো, কিন্তু শিখধর্মের প্রতিষ্ঠাতা গুরু নানকের সাথে তার অনেকক্ষেত্রেই মিল ছিল। তারা দুজনেই একই উন্মাতাল সময়ের বাসিন্দা ছিলেন। নানক জন্মগ্রহণ করেছিলেন ১৪৬৯ সালে আর লুথার ১৪৮৩ সালে নানক মারা গিয়েছিলেন ১৫৩৯ সালে আর লুথার এর সাতবছর পরে ১৫৪৬ সালে। তারা কখনোই পরস্পরের সম্বন্ধে কিছু জানতে পারেননি এবং তাদের দুজনের বাসস্থানের মধ্যে চার হাজার মাইলের ব্যবধান ছিল। নানক ছিলেন ভারতে আর লুথার ছিলেন জার্মানিতে। কিন্তু তারা দুজনেই যে-ধর্মে জন্মগ্রহণ করেছিলেন সেই ধর্মের একজন সংস্কারক হিসাবে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছিলেন। দুজনের জীবনাচরণ আর বিশ্বাসের মধ্যে বিশাল পার্থক্য থাকা সত্ত্বেও তারা আমাদের স্মরণ করিয়ে দেন, কীভাবে সত্য আর বিশুদ্ধতার অনুসন্ধানে ধর্মগুলোর মধ্যে বিভাজিত হবার প্রবণতা লক্ষ করা যায়।
একজন ‘শিখ’ হচ্ছে গুরু নানক এবং তার উত্তরসূরি নয়জন গুরুর শিষ্য অথবা অনুসারী। যদিও নানকই মূলত ছিলেন শিখবাদের প্রতিষ্ঠাতা, কিন্তু যে-বিশ্বাসের ধারণাটি তিনি গড়ে তুলতে চেয়েছিলেন সেটি ১৭০৮ সালে দশম এবং শেষ গুরুর মৃত্যু না হওয়া অবধি এর পূর্ণ রূপ পায়নি। গুরু’ হচ্ছেন একজন শিক্ষক, যিনি ঈশ্বরের অর্থ সুস্পষ্ট করে ব্যাখ্যা করতে পারেন, এবং ঈশ্বরের উপস্থিতিকে বাস্তব অনুভূত করাতে পারেন। মারা যাবার আগে গুরু নানক গুরু অঙ্গদকে দায়িত্ব দিয়েছিলেন তাকে অনুসরণ করতে। এবং ১৫৫২ সালে গুরু অঙ্গদ মারা যাবার আগে তিনি অমর দাসকে তার উত্তরসূরি হিসাবে দায়িত্ব দিয়েছিলেন। এভাবেই শিখধর্মে গুরুদের এই গুরু-শিষ্যের ধারাবাহিক উত্তরসূরি হিসাবে দায়িত্বগ্রহণ অব্যাহত ছিল যতদিন-না এই ধারাবাহিকতা ১৬৭৬ সালে এর দশম গুরু, গোবিন্দ সিং অবধি পৌঁছেছিল।
এরপর কিছু কৌতূহলোদ্দীপক ঘটনা ঘটেছিল। গুরু গোবিন্দ সিং কোনো উত্তরসূরি চিহ্নিত না করে যাবার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন। তিনি ঘোষণা করেছিলেন, এখন থেকে শিখসমাজে গুরু, যিনি ঈশ্বরের প্রতিনিধিত্ব করবেন, তিনি দুটি ভিন্ন কিন্তু সম্পর্কযুক্ত উপায়ে অস্তিত্বশীল হবেন। প্রথম, শিখদের পবিত্র গ্রন্থ হবে। ‘গুরু’, যাকে বলা হয়, ‘গুরু গ্রন্থ সাহিব’, কোনো শিখ মন্দির বা গুরদুয়ারায় (গুরু অভিমুখে দরজা) অনুসারীদের মধ্যে ঈশ্বরের উপস্থিতির প্রতীক হিসাবে এটি প্রধানতম ভূমিকাটি পালন করবে।
গুরুর উপস্থিতির দ্বিতীয় রূপটি হবে বিশ্বাসীদের একটি সমাজ, যারা শিখধর্মে দীক্ষিত হবেন, ‘গুরু খালসা পথ’ অথবা বিশুদ্ধ পথের শুরু। রিফরমেশনের সময় খ্রিস্টধর্মে আবির্ভূত হওয়া কিছু চার্চের মতো, শিখ ধর্মানুসারীরাও তাদের বিশ্বাসের তত্ত্বাবধানে যাজকদের একটি সংগঠনের প্রয়োজনীয়তার ওপর বিশ্বাস রাখেননি। বিশ্বাসীদের নিজেদের আর তাদের ঈশ্বরের মধ্যে কোনো মধ্যস্থতাকারীর আবশ্যিকতা নেই। ঈশ্বরের দৃষ্টিতে সব বিশ্বাসীরাই সমান। সুতরাং হয়তো এটি শিখদের ভারতীয় ধর্মের প্রটেস্টান্ট এবং বিশুদ্ধ পথের গুরু’দের খ্রিস্টধর্মের সংস্কারকদের প্রিয় সব বিশ্বাসীদের যাজক ভাতৃত্ব’ হিসাবে ভাবতে সহায়তা করতে পারে। শিখধর্মে অন্যকিছু দিকও আছে যেগুলো ভারতীয় প্রটেস্টান্টবাদের একটি রূপ হিসাবে ভাবা যেতে পারে। কিন্তু আসুন এখন আমরা শিখবাদের প্রথম গুরু, নানকের কাছে ফিরে যাই, কীভাবে এটির সূচনা হয়েছিল তা দেখতে।
হিন্দু ব্যবসায়ী জাতের পিতামাতার পরিবারে নানক জন্মগ্রহণ করেছিলেন উত্তর-পশ্চিম ভারতের পাঞ্জাবে। তখন দীর্ঘদিন ধরেই হিন্দুধর্ম আর সবচেয়ে প্রাধান্য বিস্তারকারী ধর্ম ছিল না। এই জায়গাটি দখল করেছিল ইসলাম। মুসলিম বণিকরা অষ্টম শতাব্দীতে প্রথম ভারতে এসেছিলেন, এবং তারা তাদের ধর্মবিশ্বাসও তাদের সাথে করে নিয়ে এসেছিলেন। চিরকালের মতোই, অতিথিপরায়ণ ভারত যে-কোনো রূপে ধর্মের বিস্তারে সহায়ক হয়েছিল এবং অন্য বহু ধর্মের একটি হিসাবে ইসলাম উপমহাদেশে তার শিকড় প্রোথিত করেছিল। তারপর দশম শতাব্দীতে পার্শ্ববর্তী দেশ আফগানিস্তান থেকে মুসলমানরা পাঞ্জাবে ঝটিকা আক্রমণ করতে শুরু করেছিলেন। সেই সময়ে ধর্মকে সবার উপরে চাপিয়ে দেবার চেয়ে বরং সম্পত্তি লুণ্ঠন করাই অবশ্য তাদের প্রধান লক্ষ্য ছিল। কিন্তু নিশ্চয়ই তারা উপমহাদেশের বহুঈশ্বরবাদ আর পৌত্তলিকতার ধর্মগুলো দেখে বিতৃষ্ণ হয়েছিলেন।
মুসলমানদের এই আগ্রাসন অব্যাহত ছিল, এবং যখন পঞ্চদশ শতাব্দীতে নানকের জন্ম হয়েছিল, তখন মুঘল সাম্রাজ্য ভারতে এর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করতে শুরু করেছিল। মুঘলদের উৎস মূলত মধ্যএশিয়ার মঙ্গোলিয়ায়, কিন্তু যখন তারা ভারতে এসে পৌঁছেছিলেন, তার আগেই তারা ইসলাম ধর্মে ধর্মান্তরিত হয়েছিলেন। যখন নানক বালক ছিলেন, তখন ভারতের সম্রাট ছিলেন একজন মুসলমান ব্যক্তি। কিন্তু হিন্দু সর্বজনীনতা এই নতুন শাসকদের খানিকটা প্রভাবিত করেছিল, আর মুঘল সাম্রাজ্যও বিভিন্ন ধর্মীয় ধারণার প্রতি সহিষ্ণু ছিল। সুতরাং আধ্যাত্মিক অনুসন্ধানে সংকল্পবদ্ধ নানকের সামনে বাছাই করার জন্য দুটি বিকল্প ধর্ম ছিল, হিন্দুধর্ম? নাকি ইসলাম?
অনুপ্রেরণার অনুসন্ধানে তিনি এই দুটি ধর্মের পবিত্র স্থানগুলো দর্শন করতে তীর্থযাত্রায় বের হবার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন। বলা হয়ে থাকে তিনি পশ্চিমে আরবে মক্কা অবধি গিয়েছিলেন। যখন তিনি পাঞ্জাবে ফিরে এসেছিলেন তার দীর্ঘ ভ্রমণ শেষে, ততদিনে তার সিদ্ধান্ত নেওয়াও শেষ হয়েছিল, যে-পথ তিনি খুঁজছেন সেটি হিন্দুধর্মও না আবার ইসলামও না। ঈশ্বরের সাথে তার একটি রহস্যময় সাক্ষাতের পর তিনি একটি ভিন্নপথের ঘোষণা দিয়েছিলেন। কিন্তু যদি আমরা পরীক্ষা করে দেখি তার ঈশ্বর কী উন্মোচন করেছিলেন, আমরা দেখতে পাব, যদিও এর নিজস্ব কিছু বৈশিষ্ট্য আছে, তবে এটি যে দুটি ধর্মকে একটিতে প্রতিস্থাপিত করতে চেয়েছে, সেই দুটি ধর্মের উপাদানও ধারণ করে আছে। মুহাম্মদ আর প্রটেস্টান্ট রিফরমেশন আন্দোলনের নেতাদের মতে, তিনি দম্ভপূর্ণ চাকচিক্যময় ধর্ম ঘৃণা করতেন। পৌত্তলিকতার ব্যবসায়ীদের প্রতি গভীর ঘৃণাসহ তিনি ছিলেন একজন একেশ্বরবাদী। তিনি দেখেছিলেন, কোনো ধর্ম কত সহজেই আধ্যাত্মিকতার লেবাস পরা প্রতারকদের একটি চক্রে পরিণত হতে পারে, যারা নিজেদের ঈশ্বরের বিক্রয়-প্রতিনিধি হিসাবে সমাজে প্রতিষ্ঠিত করেন। নানক জানতেন, সাধারণ নারী পুরুষের হৃদয়ের মধ্যে ইতিমধ্যেই ঈশ্বর বসবাস করছেন। কোনো প্রতিনিধির মাধ্যমে ঈশ্বরের কাজ করার কোনো প্রয়োজন নেই। আর সে-কারণেই নানক সেই আচারগুলো অপছন্দ করতেন, যেগুলো পালন করতে পেশাজীবী পুরোহিতদের দরকার হয়।
সেই মতাদর্শ মোতাবেক তিনি হিন্দুধর্মের চেয়ে বরং বেশি ইসলামঘেঁষা। কিন্তু পৃথিবীতে জন্ম-জন্মান্তরে পরিভ্রমণ করা আত্মার সেই মুক্তির কামনার প্রতি সহানুভূতিতে তিনি হিন্দু ছিলেন। কার্মা আর পুনর্জন্মে বিশ্বাস হিন্দু মতবাদের সবচেয়ে বৈশিষ্ট্যসূচক একটি প্রকৃতি এবং নানক সেটি গ্রহণ করেছিলেন। ঈশ্বর তাকে বলেছিলেন যে, তিনি নিজে এই নিরন্তর পুনর্জন্মের চক্র থেকে মুক্ত হয়েছেন। আর এটি ছিল তাদেরকে প্রদর্শন করার জন্যে যে, পুনর্জন্মের এই চক্র থেকে তারাও পরিত্রাণ লাভ করতে পারেন এবং তাকে সে-কারণেই তার অনুসারীদের কাছে একজন গুরু হিসাবে প্রেরণ করা হয়েছে। তার আধ্যাত্মিক অভিজ্ঞতার বিবরণ দেওয়া গল্পগুলোর একটিতে, নানকের লক্ষ্য বর্ণনা করা হয়েছে এভাবে : সর্বশক্তিমান তাকে বলেছিলেন–
‘আমি তোমাকে জন্ম, মৃত্যু আর পুনর্জন্মের চক্র থেকে মুক্ত করলাম। যে ব্যক্তি বিশ্বাসের সাথে তোমাকে দেখবে, সে মুক্তি লাভ করবে। যে ব্যক্তি তোমার উচ্চারিত শব্দগুলো শুনবে বিশ্বাসের সাথে, সে মুক্তি লাভ করবে… আমি তোমাকে মুক্তি দান করছি। নানক, এই অশুভ পৃথিবীতে ফিরে যাও, এবং নারী-পুরুষ সবাইকে শেখাও কীভাবে প্রার্থনা করতে হয়, কীভাবে বিনীত হয়ে দান করতে হয়, শুদ্ধভাবে বাঁচতে হয়। এই পৃথিবীতে কল্যাণময় কাজ করো, পাপের যুগে এটিকে উদ্ধার করো।’
এ পর্যন্ত হয়তো আমরা এমন কোনো সিদ্ধান্ত নিতে পারি, নানক আসলে যা করেছিলেন তা হচ্ছে হিন্দু আর ইসলাম ধর্ম থেকে খানিকটা অংশ নিয়ে, নতুন একটি ধর্মের মোড়কে এটি উপস্থাপন করেছিলেন। কিন্তু এরপরে তিনি যা করেছিলেন সেটি ছিল বৈপ্লবিক আর খুবই স্বতন্ত্রচক এবং এটি এখনো সেটি দাবি করতে পারে। তিনি সবাইকে একসাথে বসে খাদ্যগ্রহণ করাতে পেরেছিলেন। এটি শুনতে নতুন কিংবা গুরুত্বপূর্ণ কিছু মনে নাও হতে পারে। কিন্তু ধর্মের ইতিহাসে এটি ছিল বৈপ্লবিক। ধর্মীয় সমাজগুলোয় বিশ্বাসীদের অবশ্যই শিখতে হয়, কাদের সাথে খাদ্যগ্রহণ করতে তাদের অনুমতি আছে, আর কাদের ক্ষেত্রে এটি নিষিদ্ধ। এমনকি এর একটি কারিগরি নামও আছে : কমেনসালিটি, যার অর্থ যে গোষ্ঠীর সদস্যদের একই টেবিলে বসার অনুমতি আছে। আর কাদের সাথে বসে তারা খেতে পারবেন না সেটি বলায় অনেক শক্তি ব্যয় হয়েছে। এর কারণ বিশুদ্ধতার সেই ধারণাটি, অপবিত্র খাদ্য আর অপবিত্র মানুষ আছে এমন বিশ্বাস ধর্মীয় মনে খুব গভীরে প্রোথিত। যদি আপনি তাদের স্পর্শ করেন আপনি নিজেকে ঈশ্বরের কাছে ঘৃণ্য করে তুলবেন এবং আপনার বিশুদ্ধিকরণ তখন আবশ্যিকভাবে প্রয়োজন। এটি সবচেয়ে বেশি শক্তিশালী সেই দেশগুলোয়, যেখানে জাতপ্রথা অথবা বর্ণবৈষম্য আর বিভেদের প্রচলন আছে। হিন্দু জাতপ্রথাতেও এটি আছে, যেখানে এমনকি অস্পৃশ্য কারো ছায়া যদি ব্রাহ্মণের মধ্যাহ্নভোজনের উপর পড়ে সেটি অপবিত্র হয়ে যায় এবং সেই খাওয়া অবশ্যই ফেলে দিতে হবে।
হিন্দুধর্মই একমাত্র ধর্ম ছিল না, যেখানে এই ধরনের বৈষম্যের অনুশীলন করা হয়েছে। এটি ইহুদি ধর্মেও আছে। সেখানে অপবিত্র জাত আছে যেমন, তেমনি আছে অপবিত্র খাদ্য। যিশুর ওপর আনীত অভিযোগগুলোর একটি ছিল, তিনি এইসব ধর্মীয় প্রতিষিদ্ধতার প্রতি কোনো নজর দেননি এবং উপেক্ষা করেছিলেন। তিনি শুধুমাত্র পাপীদের সাথে কথাই বলেননি, তাদের সাথে খাদ্যও গ্রহণ করেছিলেন। যে চার্চ যিশুর পথ অনুসরণ করছে বলে দাবি করেছিল সেটিও খুব শীঘ্রই তার উদাহরণ অনুসরণ না-করার যথেষ্ট কারণও পেয়েছিল। খ্রিস্টান ধর্মে খাওয়ার নানা প্রতিষিদ্ধতা এখনো আছে। খ্রিস্টীয় উপাসনার মূল একটি বিষয় হচ্ছে একটি ধর্মীয় আচার-নির্দেশিত খাওয়া, যাকে বলা হয় ‘লর্ডস সাপার’ অথবা ‘হলি কমিউনিয়ন’ অথবা মাস’। এটির ভিত্তি ঘনিষ্ঠ অনুসারীদের সাথে তার মৃত্যুর আগের রাতে যিশুর শেষরাতের খাবার। যখন তিনি তাদের বলেছিলেন তাকে স্মরণ করে এই আচারটি অব্যাহত রাখতে। খ্রিস্টানরা এটি পালন করে আসছেন সেই সময় থেকেই। কিন্তু তারা এটি সবার সাথে খায় না। ক্যাথলিকরা এটি প্রটেস্টান্টদের সাথে খাবেন না। প্রটেস্টান্টরাও আছেন, তারা অন্য প্রটেস্টান্ট, অথবা তাদের নিজেদের বিশুদ্ধতার চক্রের বাইরের এমন কারো সাথে সেটি খাবেন না। আর বহু খ্রিস্টান বিশ্বাস করেন, যদি আপনি পাপ করে থাকেন তাহলে আপনার এটি খাবার কোনো অনুমতি পাওয়া উচিত নয়। এটি অনেকটাই খারাপ ব্যবহারের শাস্তি হিসাবে রাতে না-খেতে দিয়ে বিছানায় শুতে পাঠানোর মতো।
নানক এইসব প্রতিষিদ্ধতা প্রচণ্ড ঘৃণা করতেন। তিনি দেখেছিলেন কীভাবে এই নিয়মগুলো ঈশ্বরের নামে বিভেদের দেয়াল নির্মাণ করছে, যিনি সবাইকে সমানভাবেই ভালোবাসেন। তার সমাধানটি ছিল বিস্মকরভাবেই সাধারণ। তিনি শিখসমাজে ‘লঙ্গর’ বা সামাজিক ভোজপ্রথার সূচনা করেছিলেন। এটি সব জাতের মানুষের জন্য উন্মুক্ত ছিল এবং নানা আচার দিয়ে অলংকৃত হওয়া থেকে এটি মুক্ত ছিল, পুরোহিতরা যে-আচারগুলো মানবিক কার্যক্রমের মধ্যে জুড়ে দিতে ভালোবাসেন। খুবই সাধারণ ছিল সেই খাদ্য। কিন্তু তারা একটি পরিবারের মতোই সবাই একসাথে বসে খাদ্যগ্রহণ করতেন। একটি শিখ গুরদুয়ারায় রান্নাঘর, সেই ভবনের অন্যসব অংশের মতোই পবিত্র। খাদ্য রান্না করা হয় এবং তা সবার সাথে ভাগ করে নেওয়া হয় মানুষের সাম্যতা উদ্যাপন করতে, তাদের জাত, বিশ্বাস, বর্ণ অথবা লিঙ্গ যাই হোক না কেন। আর সে-কারণেই কম্পাসের চারটি দিকের মতো গুরদুয়ারারও চারটি দরজা থাকে, যে প্রতীকটি জানান দেয় এটি সবার জন্যে উন্মুক্ত। সব গুরুরা, যারা নানককে অনুসরণ করেছিলেন, তারা ধর্মবিশ্বাসের আবশ্যিক একটি অংশ হিসাবে এই লঙ্গরের ওপর বিশেষ গুরুত্বারোপ করেছিলেন। তৃতীয় গুরু অমর দাস, এমনকি দাবি করেছিলেন, যদি কেউ তার সাথে সাক্ষাৎ করতে চায়, একেবারে হতদরিদ্র কৃষক থেকে ভারতের সম্রাট অবধি, তাকে অবশ্যই তার সাথে সঙ্গরে একবেলা খাদ্যগ্রহণ করতে হবে।
নানকের পরে আসা নয়জন গুরুর প্রত্যেকেই তার দৃষ্টিভঙ্গিটিকে সত্যায়িত করেছিলেন, আর তাদের সময়ের বিবেচনা ও প্রয়োজনে সেই দৃষ্টিভঙ্গিটিকে সংগতিপূর্ণ করে নিয়েছিলেন। কিন্তু ধর্মটির দশম গুরু যিনি শিখবাদকে নাটকীয় একটি আত্মপরিচয় দিয়েছিলেন, যা এখনো এটিকে বৈশিষ্ট্যমণ্ডিত করে রেখেছে। মুঘলদের ভারত আপেক্ষিকভাবে সহিষ্ণু হয়তো ছিল, কিন্তু উন্মুক্ত সমাজ বলতে যা বোঝায়, তা থেকে অনেক দূরেই ছিল। এবং ইসলামি অসন্তোষের হাত থেকে শিখদের নিজেদেরকে সুরক্ষা করতে বাধ্য হতে হয়েছিল। তার ধর্মগোষ্ঠীকে রক্ষা করতে ষষ্ঠগুরু হরগোবিন্দ (১৫৯৫-১৬৪৪) একটি শিখ সেনাবাহিনী প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। কিন্তু দশম গুরু গোবিন্দ সিং (১৬৬৬–১৭০৮) শিখবাদকে এর একটি বাড়তি শক্তি আর দৃঢ়তা দিয়েছিলেন। তিনি তার অনুসারীদের সুরক্ষিত শহর প্রতিষ্ঠা করতে এবং সামরিক প্রশিক্ষণ নিতে উৎসাহিত করেছিলেন–এটি স্মরণ করিয়ে দেয় কীভাবে নতুন ধর্মগুলো সাধারণত নিজেদের রক্ষা করতে বাধ্য হতে হয় সেইসব গোষ্ঠী থেকে, যাদের তারা পরিত্যাগ করে এসেছে। শিখরা কিংবদন্তির যোদ্ধায় পরিণত হয়েছিলেন, এবং একটি সামরিক রীতি এটি আত্তীকৃত করেছিল যা এখনো তাদের চিহ্নিত করে।
শিখবাদের পাঁচটি প্রধান বৈশিষ্ট্য আছে, যাদের পঞ্চ ‘ক’ হিসাবে তথ্যনির্দেশ করা হয়। কেশ’, মানে না-কাটা চুল। শিখরা তাদের চুল বাড়তে দেয় তাদের বিশ্বাসের একটি চিহ্ন হিসাবে। শিখ পুরুষরা সেই চুল নিয়ন্ত্রণ করতে মাথায় পাগড়ি পরিধান করেন। নারীরা পাগড়ি কিংবা চাদর পরতে পারেন। কঙ্গ’ হচ্ছে একটি চিরুনি যা বিশুদ্ধতার প্রতীক, যা শিখদের লম্বাচুলে স্থায়ীভাবে লাগানো থাকে (অথবা পাগড়ির সাথে)। কারা একটি ইস্পাতের চুড়ি বা হাতবন্ধনী, যা তাদের কবজিতে থাকে, ঈশ্বরের অসীমতার প্রতীক। ‘কিরপান বা কৃপাণ’ একটি তরবারি, যা কোমরে ঝোলানো থাকে, কাঁধের থেকে নেমে আসা একটি বন্ধনী দিয়ে। এটি শিখদের শুধুমাত্র তাদের সামরিক ইতিহাসই নয়, একই সাথে ন্যায়বিচারের জন্যে তাদের যুদ্ধ করার সংকল্পটিকেও স্মরণ করিয়ে দেয়। কাচ্ছা হচ্ছে সৈন্যদের অন্তর্বাস, যা তাদের আত্মশৃঙ্খলা প্রয়োজনীয়তার কথা স্মরণ করিয়ে দেয়।
খ্রিস্টধর্ম আর ইসলামের ব্যতিক্রম শিখধর্ম ধর্মান্তরিতকরণের ধর্ম নয়। এটি ইহুদিবাদের মতোই সেই অর্থে যে, এটি যেমন তাদের বিশ্বাস, তেমনি এটি তাদের জাতিগত আত্মপরিচয়। এবং যদিও এরা নতুন দীক্ষিতদের স্বাগতম জানায়, যারা তাদের সাথে যুক্ত হতে চায়, কিন্তু তারা কাউকে ধর্মান্তরিত করার জন্য তাদের অনুসন্ধানে সাত-সমুদ্র পাড়ি দেয় না। এর কারণ সেই ধর্মগুলোর ব্যতিক্রম যারা মুক্তি পাবার লক্ষ্যে শুধুমাত্র নিজেদের ধর্মকেই একমাত্র স্বীকৃত পথ হিসাবে দাবি করে থাকে। শিখরা বিশ্বাস করেন, ঈশ্বর অবধি পৌঁছানোর জন্যে বহু পথের অস্তিত্ব আছে। এখানে তারা সেই উদারতা প্রদর্শন করে, যা ভারতীয় আধ্যাত্মিকতাকে বৈশিষ্ট্যমণ্ডিত করেছে, এবং যা সেই অসহিষ্ণুতার ব্যতিক্রম, যা সাধারণত পশ্চিমের খ্রিস্টধর্মকে চিহ্নিত করেছে। আর এটি সেই ইশারা, এখন ভারত ত্যাগ করে ব্রিটেইন-অভিমুখে যাত্রা করার সময় এসেছে, ষোড়শ শতাব্দীতে সেখানে রিফরমেশন আন্দোলনের যুদ্ধগুলো কেমন চলছিল সেটি দেখতে।