২৯. ধনতান্ত্রিক কৃষি মালিকের উৎপত্তি

উনত্রিংশ অধ্যায়–ধনতান্ত্রিক কৃষি মালিকের উৎপত্তি

আইনের আশ্রয়-চ্যুত একটি সর্বহারা শ্রেণীর বলপূর্বক উৎপত্তি-সাধন, রক্তাক্ত শৃংখলার শাসনে তাদের মজুরি-শ্রমিকে রূপান্তর-সাধন, শ্রমের শোষণ-মাত্রা বৃদ্ধি করে মূলধন-সঞ্চয়নকে ত্বরান্বিত করার জন্য রাষ্ট্র কর্তৃক পুলিশ প্রয়োগের মত কলংকজনক ব্যবস্থা অবলম্বনের বিষয় আমরা আলোচনা করেছি। এখন প্রশ্ন থেকে যায় : ধনিকেরা প্রথমে কোথা থেকে এল? কেননা কৃষি-জনসংখ্যার উচ্ছেদ-সাধনের ফলে বিরাট বিরাট ভূম্যধিকারী ছাড়া আর কারো তত উদ্ভব ঘটেনা। অবশ্য, প্রশ্নটা যত দূর পর্যন্ত কৃষি-মালিকের (ফার্মার’-এর) উদ্ভবের সঙ্গে জড়িত, ততটা পর্যন্ত আমরা, বলতে গেলে, সে ব্যাপারে হাত দিতে পারি, কারণ সেটা ছিল এমন একটা মন্থর প্রক্রিয়া, শত শত বছর ধরে ঘটেছিল যার বিকাশ। যেমন ভূমিদাসেরা, তেমন স্বাধীন ছোট মালিকেরাও জমির অধিকার ভোগ করত ভিন্ন ভিন্ন শর্তে এবং, সেই কারণেই, মুক্ত হয়েছেন অত্যন্ত ভিন্ন ভিন্ন অর্থ নৈতিক অবস্থায়। ইংল্যাণ্ডে কৃষি-মালিকের আদি রূপ হল ‘বেইলিফ’, যে নিজেই ছিল একজন ভূমিদাস। তার অবস্থান ছিল রোমের পুরনো ‘ভিল্লিকাস’-এর মত, তবে তুলনামূলক ভাবে সীমাবদ্ধ কর্মপরিধিতে। চতুর্দশ শতকের দ্বিতীয় ভাগে তার স্থান গ্রহণ করে এমন একজন কৃষিমালিক, জমিদার যাকে সরবরাহ করে বীজ, পশু ও উপকরণাদি। চাষীর (পেজান্ট’-এর) অবস্থা থেকে তার অবস্থা খুব আলাদা ছিল না। কেবল সে আরো বেশ মজুরি-শ্রম শোষণ করত। অচিরেই সে হয়ে ওঠে একজন মেটায়ের, আধা-কৃষিমালিক। সে আগাম দিত। প্রয়োজনীয় কৃষি-উপকরণাদির একটা অংশ, জমিদার আগাম দিত বাকিটা। তার। পরে চুক্তি অনুযায়ী তারা দুজনে ফসল ভাগাভাগি করে নিত। ইংল্যাণ্ডে এই রূপটি দ্রুত অন্তর্হিত হয়ে যায় এবং তার স্থান গ্রহণ করে নিয়মিত কৃষি-মালিক, সে মজুরি শ্রমিক নিযুক্ত করে নিজেই তার মূলধনকে দিয়ে প্রজনন করায়, এবং উত্ত-উৎপাদনের একটা অংশ জমিদারকে দেয় খাজনা হিসাবে—টাকা বা জিনিসের অঙ্কে। যত দিন পর্যন্ত, পঞ্চদশ শতাব্দীতে, স্বাধীন চাষী এবং খামার-মজুর নিজের জন্য এবং মজুরির জন্য কাজ করে, তাদের নিজস্ব শ্রমের সাহায্যে নিজেদেরকে সমৃদ্ধ করত, ততদিন পর্যন্ত কৃষি-মালিক এবং তার উৎপাদনের ক্ষেত্র দুইই ছিল মোটামুটি অবস্থায়।. পঞ্চাশ শতাব্দীর শেষ তৃতীয়াংশে যার শুরু হল এবং চলল প্রায় গোটা ষোড়শ শতাৰী ধরে ( অবশ্য, তার শেষ দশকটি বাদে ), সেই কৃষি-বিপ্লব এক দিকে যেমন দ্রুতবেগে তাকে ধনী করল, তেমন দ্রুত সাধারণ কৃষি-জনসংখ্যাকে করল দরিদ্র।[১]

সর্বজনিক জমির জোর-দখলের সাহায্যে সে প্রায় বিনাখরচেই তার গবাদি পশুর সংখ্যা বিপুলভাবে বাড়িয়ে নিতে সক্ষম হল আর এই পশুগুলি থেকেই আবার সে লাভ করল তার জমি-চাষের জন্য প্রয়োজনীয় সারের প্রচুর সরবরাহ। ষোড়শ শতাব্দীতে এর সঙ্গে যুক্ত হল অতি গুরুত্বপূর্ণ আরো একটি উপাদান। সেই সময়ে কৃষি-জমির জন্য চুক্তি হত দীর্ঘকালের মেয়াদে প্রায়ই ১৯ বছরের মেয়াদে। মূল্যবান ধাতুসমূহের, এবং, স্বভাবতই টাকার, মুল্যের উত্তরোতর অবচয় কৃষি-মালিকদের হাতে তুলে দিল সোনার ফসল। উল্লিখিত সমস্ত কিছু ছাড়াও, এর ফলে মজুরি হ্রাস পেল। মজুরির একটা অংশ এখন খামারের মুনাফার সঙ্গে যুক্ত হল। শস্য, পশম, মাস—এক কথায়, কৃষিজাত সমস্ত দ্রব্যের দামের ক্রমাগত উর্ধ্বগতির ফলে, তার নিজের কোনো চেষ্টা ছাড়াই, তার আর্থিক মূলধন স্ফীত হল, অন্য দিকে, সে যে খাজনা দিত তা (টাকার পুরনো মূল্য অনুযায়ী গোনা হত বলে) কমে গেল।[২]

এইভাবে একদিকে শ্রমিকের স্বার্থের বিনিময়ে, অন্য দিকে জমিদারের স্বার্থের বিনিময়ে তারা ধনী হয়ে উঠল। সুতরাং, ষোড়শ শতকের শেষে ইংল্যাণ্ডে যে ধনতান্ত্রিক কৃষি-মালিকদের একটি শ্রেণী গড়ে উঠেছিল, তাতে আশ্চর্যের কিছু নেই যে-শ্রেণীটি তৎকালীন পরিস্থিতির বিচারে নিশ্চয়ই ছিল ধনী।[৩]

————

১. হ্যারিসন তার “ডেস্ক্রিপশন অব ইংল্যাণ্ডে”-এ বলেন, যদি দৈবাৎ পুরনো খাজনার চার পাউণ্ড চল্লিশে উন্নীত হয়, তার মেয়াদের শেষ দিকে, যদি তার কাছে ছয় বা সাত বছরের খাজনা পড়ে না থাকে, পঞ্চাশ বা একশ পাউণ্ড, তবু কৃষি-মালিক ভাববে তার লাভ কম।’

২. ষোড়শ শতাব্দীতে সমাজের বিভিন্ন শ্রেণীর উপরে টাকার মূল্যের অবচয়ের geta spasyo ugaj ‘A compendious or Briefe Examination of Certayne Ordinary Complaints of Divers of our Countrymen in these our our Days.w. S. Gentleman. এই বইটির সংলাপী রূপের দরুন অনেক কাল লোকে একে শেকস্পিয়ারের উপরে আরোপ করত—এমনকি ১৭৫১ সালেও যখন লেখকের নাম প্রকাশিত হয়, তখনও। লেখকের নাম উইলিয়ম স্ট্যাফোর্ড। এক জায়গায় নাইট’ এই ভাবে যুক্তি দেয়।

“Knight: you my neighbour, the husbandman, you Maister Mercer, and you Goodman Cooper, with other artificers, may save yourselves metely well. For as much as all things are dearer than they were, so much do you arise in the pryce of your wares and occupations that ye sell agayne. But we have nothing to sell whereby we might advace ye price there of to countervaile those things we must buy agayne.” অন্যত্র ‘নাইট ডাক্তারকে জিজ্ঞাসা করে। “I pray you, what be those sorts that ye meane. And first, of those that ye thinke should have no losse thereby?-Doctor : I menn all those that live by buying and selling, for as they buy deare, they sell thereafter. Knight : What is the next sort that ye say would win by it? Doctor : Marry, all such as have takings of fearmes in their owne manurance ( cultivation ) at the old rent, for where they pay after the olde rate they sell after the newe-that is, they paye for theire lande good cheape, and sell all things growing thereof deare. Knight: What sorte is that which, ye sayde should have greater losse bereby, than these men had profit y Doctor : It is all noblemen, gentlemen, and all other that live either by a stinted rent or stypend, or do not manure ( cultivation ) the ground or doe occupy no buying and selling.”

৩. ফ্রান্সে মধ্যযুগের গোড়ার দিকে সামন্ত প্রভুদের তহসিলদারেরা অচিরেই হয়ে উঠল একজন ‘কেউ-কেটা; জোর করে টাকা আদায়, লোক-ঠকানো ইত্যাদির দৌলতে সে প্রতারণার পথে ধনিকে পরিণত হল। এই তহসিলদারেরা নিজেরাই কখনো। কখনো ছিল অভিজাত-বংশীয়। “Cest li compte que messire Jacques de Thoraine, chevalier chastelain sor Besancon reut es-Seigneur tenant les comptes a Dijon pour monseigneur le duc et comte de Bourgoi ene, des rentes appartenant a la dite ehastellenie, depuis xxve jour de decembre MCCCLIX jusqu’au Xxviiie jonr de decembre MCCCLX.” (Alexis Monteil : “Traite de Materiaux Manuscrits etc, pp. 234, 235) ইতিমধ্যেই এটা পরিষ্কার হয়ে গিয়েছে যে সমাজ জীবনের সকল ক্ষেত্রেই মধ্যস্থ ব্যক্তি করায়ত্ত করত সিংহভাগ। অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে অর্থসংস্থানকারী (ফিনান্সিয়ার’ ), শেয়ারবাজারের ফটকা-কারবারী, সওদাগর, দোকানদার প্রভৃতিরাই মাখনটা খায়; আইন-বিষয়ক ব্যাপারে উকিলরা মক্কেলদের দোহন করে; রাজনৈতিক ব্যাপারে ভোটদাতাদের চেয়ে তাদের প্রতিনিধিরা, সার্বভৌমের তুলনায় মন্ত্রীরা বেশি গুরুত্ব ভোগ করে; ধর্মে ‘পাণ্ডারা ঈশ্বরকে পিছনে ঠেলে দেয় এবং পুরোহিতেরা আবার পাণ্ডাদের ঠেলে ফেলে দেয়—পুরোহিতেরা যারা হল আদর্শ মেষপালক এবং তার মেষযুথের অন্তর্বর্তী অবশ্যম্ভাবী মধ্যস্থতাকারী। যেমন ইংল্যাণ্ডে, তেমন ফ্রান্সেও বিরাট সামন্ততান্ত্রিক জমিদারিগুলি অসংখ্য বাস্তুভিটায় বিভক্ত হল কিন্তু এমন অবস্থায় যা জনসাধারণের পক্ষে বহুগুণ বেশি প্রতিকুল। চতুর্দশ শতকে ‘জোত’ বা ‘টেরিয়ার’-এর উদ্ভব ঘটল। সেগুলির সংখ্যা দ্রুত বেড়ে দাড়াল ১,৩০,০০০-এর অনেক বেশি। তারা খাজনা দিত জমির ফলনের ১২ থেকে ১ পর্যন্ত—টাকায় বা জিনিসের মাধ্যমে। ঐ জোতগুলি মূল্য বা আয়তন অনুযায়ী ছিল ‘ফিয়েফ’, ‘সাব-ফিয়েফ’ ইত্যাদি; অনেকগুলির জমির পরিমাণ ছিল কয়েক একর মাত্র। কিন্তু জমির বাসিন্দাদের উপরে এই জোত-মালিকদের কিছু পরিমাণে এখতিয়ারগত অধিকার ছিল; চার রকমের স্তর ছিল। কৃষি-জনসংখ্যার উপরে এই সব ক্ষুদে স্বৈরাচারীদের অত্যাচার অনুমেয়। মতেইল বলেন, ফ্রান্সে তখন ছিলেন ১,৬০,০০০ জজ, যেখানে আজ শান্তিরক্ষী-বিচারক’ সহ ৪,০০০ ট্রাইব্যুনালই যথেষ্ট।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *