উনত্রিশ
দারোয়ানকে ম্যানেজ করে সুবাসকে নিজের ঘরে আনতে কোনও অসুবিধে হল না অনিমেষের। হস্টেলের সবার খাওয়া হয়ে গেছে। রাত বেশি হওয়ায় দু’-একটা ছাড়া প্রায় সব ঘরের আলো নিভে গেছে। অনিমেষ খাবার ঘর থেকে ঢাকা দেওয়া নিজের খাবারটা ওপরে নিয়ে এল। রুটিগুলো এরই মধ্যে শক্ত হয়ে গেছে, ঝোলে সেই বিদিকিচ্ছিরি গন্ধ। জোর করে সুবাসকে রাজি করিয়ে ওই খাবার ভাগ করে খেয়ে অনিমেষ বলল, ‘আপনি খাটে শুয়ে পড়ুন, আমি নীচে শুচ্ছি।’
‘তোমার তক্তাপোশটায় দিব্যি দু’জনে কুলিয়ে যাবে, ব্যস্ত হয়ো না।’ সুবাস একটা চারমিনারের প্যাকেট বের করে বলল, ‘আচ্ছা অনিমেষ, আমরা দু’জনেই তুমি বলব এরকম পরিস্থিতি আগে হয়েছিল না? আপনি বলাটা বন্ধ করো ওতে দূরত্ব বেড়ে যায়।’
চারধার নিঃশব্দ, ট্রামলাইন ঘুমিয়ে পড়লে কলকাতা যুবতী বিধবার মতো মাথা নিচু করে থাকে খানিকক্ষণ। আশেপাশের বাড়িগুলোর আলো নিভে গেলে দূরে একটা চারতলার ঘরের জানলার কাচ ঝকঝক করছে। অনিমেষ চেয়ারে বসে সেদিকে তাকিয়েছিল। এতক্ষণ সে সুবাসদাকে কোনও প্রশ্ন করেনি। এত রাতে হঠাৎ কী বিপদ হল তা জানতে কৌতূহল হচ্ছে কিন্তু নিজে থেকে না বললে প্রশ্ন করতে খারাপ লাগছিল।
হঠাৎ সুবাস বলল, ‘তোমার কোনও অস্বস্তি হচ্ছে না তো?’
‘কেন?’
‘এই যে হঠাৎ এসে জুড়ে বসলাম!’
‘যাঃ, তা কেন হবে।’
‘তোমার বন্ধুরা, আমি বিমানদের কথা বলছি, তারা কৈফিয়ত চাইবেই।’
‘কেন? এটা আমার ব্যক্তিগত ব্যাপার। তা ছাড়া এখন আর কৈফিয়ত দিতে আমি বাধ্য নই।’ কথাটা বলে অনিমেষ সুবাসের দিকে তাকিয়ে হাসল।
‘কেন?’
‘আমার আর ভাল লাগছে না। আসলে আমি পার্টির কাজকর্ম আর মানতে পারছি না। এত স্বার্থান্বেষী মানুষ পার্টির ওপরতলায় ছেয়ে গেছে যে এই দলের কাছ থেকে নতুন কিছু আশা করা যাবে না। প্রতিমুহূর্তে বিবেকের সঙ্গে লড়াই করার চাইতে নিষ্ক্রিয় হয়ে থাকা অনেক ভাল।’ অনিমেষ বলল।
সুবাস ওকে ভাল করে দেখল। তারপর বলল, ‘আলো নিভিয়ে শুয়ে পড়ো, অনেক রাত হয়েছে।’
আলোচনাটাকে হঠাৎ এভাবে থামিয়ে দেওয়ায় অনিমেষ অবাক হল। সুবাস কি ওর কথা বিশ্বাস করছে না?
ঘরের আলো নেভালেও একটা পাতলা আলো অন্ধকারে মাখামাখি হয়ে থাকে। অনিমেষ সুবাসের পাশে চুপচাপ শুয়েছিল। সে বুঝতে পারছিল তার ঘুম আসবে না। এতকাল একা শুয়ে শুয়ে এমন একটা অভ্যেস তৈরি হয়ে গেছে যে এখন পাশে কেউ শুয়ে থাকলেই অস্বস্তি হয়। শুয়ে শুয়ে সে সুবাসের ব্যাপারটা চিন্তা করছিল। পার্টির সক্রিয় কর্মী হিসেবে সুবাস খাদ্য-আন্দোলন করেছে, অ্যাকশনে নেমেছে। এরকম একটা মুহূর্তে ও তাকে শিয়ালদার গলি থেকে গুলিবিদ্ধ অবস্থায় তুলে নিয়ে গিয়েছিল। তারপর পার্টির হয়ে বীরভূমের গ্রামে গ্রামে ঘুরে সংগঠনের কাজ করেছে দীর্ঘদিন। সুবাসই তাকে বিমানদের সঙ্গে আলাপ করিয়ে দিয়েছে। আবার এই সুবাসকেই পার্টি থেকে দলবিরোধী কাজের জন্য তাড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। সুবাসের সঙ্গে দেখা হয়েছিল বলে বিমানরা তার প্রতি অসন্তুষ্ট হয়েছিল। দল থেকে বেরিয়ে সুবাসদা এখন কী করছে! কিছু কিছু কথা আবছা আবছা তার কানে আসছে। সেগুলো বিশ্বাস করতে কষ্ট হয়। সুবাস কি সেই দলে আছে? আর আজ রাত্রে যেভাবে সুবাস তার কাছে এসে আশ্রয় নিল তাতে বোঝা যায় কেউ বা কারা তার ক্ষতি করতে চাইছে এবং এই মুহূর্তে সুবাসকে পালিয়ে থাকতে হচ্ছে। কেন? কথাগুলো মনের মধ্যে বুদবুদের মতো উঠছে অথচ এক হাতের মধ্যে শুয়ে সুবাস, তাকে জিজ্ঞাসা করা যাচ্ছে না। কেউ যদি নিজে থেকে উন্মোচন না-করে তা হলে খোঁচাতে সংকোচ হয়। সুবাস যে ঘুমিয়ে পড়েছে এটা বুঝতে কোনও অসুবিধে হচ্ছে না এখন। অনিমেষ ঘুমুতে পারছিল না।
এখন পার্টির মধ্যে হাজারটা ফাটল। পাশাপাশি কংগ্রেসও স্বাভাবিক অবস্থায় নেই। বর্তমান সরকারের খাদ্যনীতি একদল মানুষকে বেদম চটিয়েছে। লেভি ব্যবস্থার শিকার হয়েছে জোতদারেরা যারা এতকাল কংগ্রেসের খুঁটি ছিল। বর্তমান মুখ্যমন্ত্রী বৃহত্তর কলকাতায় রেশন ব্যবস্থা চালু করেছেন লেভির মাধ্যমে রেকর্ড পরিমাণ খাদ্যশস্য সংগ্রহ করে। আর এর ফলে সারা বাংলার জোতদারেরা ক্ষিপ্ত হয়ে উঠেছে। বামপন্থীরা বিক্ষিপ্ত আন্দোলন শুরু করেছিল কয়েকটা জায়গায়। কৃষ্ণনগর এবং বর্ধমানে দুটো তাজা ছেলে পুলিশের গুলিতে প্রাণ হারিয়ে সারা বাংলার মানুষের মনে কংগ্রেস সম্পর্কে অস্বস্তি এনে দিয়েছে। কেন্দ্রে প্রধানমন্ত্রীর অকাল মৃত্যুতে কংগ্রেস যে দ্বিধায় পড়েছিল তা এখনও কাটেনি। নেহরু পরিবারকে আবার আঁকড়ে ধরা হয়েছে। দেশের প্রধানমন্ত্রী এখন একজন মহিলা যাঁকে মন্ত্রীসভার বয়স্ক সদস্যরা একদা স্নেহ করতেন বা বাধ্য হতেন স্নেহ করতে। কংগ্রেসের বর্তমান অন্তর্দ্বন্দ্ব যত তাড়াতাড়ি জনসাধারণ জানতে পারে তার ছিটেফোঁটাও মার্ক্সবাদী পার্টি সম্পর্কে জানা যায় না। মেদিনীপুরের বিখ্যাত কংগ্রেসি নেতা আজ কংগ্রেস থেকে বিতাড়িত। তাঁকে ঘিরে জোতদাররা সংগঠিত হচ্ছে আগামী নির্বাচনে লড়বার জন্য। নতুন নামকরণে তিনি কংগ্রেসের গন্ধ ছাড়তে পারেননি। তাঁর একমাত্র লক্ষ্য কংগ্রেসকে ক্ষমতাচ্যুত করে প্রকৃত কংগ্রেসি দল প্রতিষ্ঠা করা। তাঁর সঙ্গে বিরোধীদের সুবিধাবাদী অংশ হাত মেলাচ্ছে। তা সত্ত্বেও কোনও গোঁড়া পার্টি-ক্যাডার স্বপ্নেও ভাবতে পারে না আগামী নির্বাচনে কংগ্রেস পরাজিত হবে। তবু লড়ে যাওয়া, গণতন্ত্রে লড়ে যেতে হয়। একটা পার্টির অস্তিত্ব প্রমাণ করার সুবর্ণ সুযোগ হল নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করা। পার্লামেন্ট হল শুয়োরের খোঁয়াড়— কথাটা মনে পড়তেই অনিমেষ হেসে ফেলল। সারা দেশ উৎসুক হয়ে আছে ওই খোঁয়াড়ে ঢুকে কাদা পাঁকে মুখ গুঁজে পড়ে থাকতে। এই পরিস্থিতিতে সুবাসরা কী ভাবছে? কী করতে চাইছে ওরা?
কখন ঘুমিয়ে পড়েছিল অনিমেষ তা জানে না। উঠে দেখল সুবাস চেয়ারে বসে আছে, বাইরে এখনও তেমন রোদ ওঠেনি। সুবাস হাসল, ‘ঘুম হল?’
অনিমেষ চট করে উঠে বসে দেখল সুবাস যাওয়ার জন্য তৈরি। সে আচমকা জিজ্ঞাসা করল, ‘আপনি এখন কী করছেন?’
‘কী করছি মানে?’
‘রাজনীতির কথা বলছি।’
‘রাজনীতি কথাটা আবর্জনার চেয়ে নিকৃষ্ট হয়ে গেছে, ওতে সারও হয় না।’
‘আপনি কি আমাকে স্পষ্ট কিছু বলতে চাইছেন না?’
‘তুমি কিন্তু এখনও আপনি ছাড়তে পারলে না।’
‘ঠিক আছে, সুবাসদা। আমি একটা রাস্তা খুঁজতে চাই। এভাবে ভাল লাগছে না। পার্টির সঙ্গে কাজ করা আমার পোষাবে না। ভেবেছিলাম এখন পড়াশুনা করব, ওসব মাথায় রাখব না। কিন্তু—।’
সুবাস কিছুক্ষণ চিন্তা করল। তারপর একটা সিগারেট ধরিয়ে বলল, ‘তোমার যা অবস্থা তা আমাদের অনেকেরই। একসময় আমি ডেডিকেটেড ছিলাম, কমিউনিস্ট পার্টির কর্মী হিসেবে আমি একমুখী ছিলাম। কিন্তু সংসদীয় গণতন্ত্রের দোহাই দিয়ে এই দেশের পার্টির কর্তারা এক ধরনের গজকচ্ছপ কমিউনিজম জন্ম দিচ্ছেন। তোমার সঙ্গে একদিন চায়ের দোকানে এ ব্যাপারে কথা বলেছিলাম। হ্যাঁ, আমরা অন্যরকম চিন্তাভাবনা করেছি, কাজ শুরু হয়ে গেছে। আমরা বিশ্বাস করি ভারতবর্ষের স্বাধীনতা চিনের পথেই সম্ভব। আমরা সেটা অর্জন করতে চাই। এই মেরুদণ্ডহীন মানুষগুলো কিন্তু আমাদের হাতে স্বাধীনতা তুলে দেবে না। আমাদের আদায় করতে হবে। আমরা মনে করি বন্দুকের নলই হল মানুষের প্রকৃত শক্তির উৎস। অনিমেষ, আমরা একটা আগুন জ্বালতে চাই। যে আগুনে আমাদের নকল চামড়ার খোলস পুড়ে ছাই হয়ে যাবে, একটা নতুন ভারতবর্ষ নিজের পায়ে দাঁড়াবে শ্রেণিহীন সমাজব্যবস্থা নিয়ে।’
অনিমেষ জিজ্ঞাসা করল, ‘এটা কি এখনই সম্ভব?’
সুবাস বলল, ‘এ সম্পর্কে মাও সে তুং-এর দেওয়া একটা চমৎকার উপমা মনে পড়ছে। আমরা এক থালা ভাত কি একবারে খেতে পারি? থালার ভাত তো ধীরে ধীরে গ্রাস করে করে খেতে হয়। তাই না?’
অনিমেষ ভেতরে ভেতরে অত্যন্ত উত্তেজিত হয়ে পড়ছিল। সে উজ্জ্বল মুখে সুবাসের দিকে তাকিয়ে বলল, ‘সুবাসদা, আমাকে একটু বিশদ করে বলুন।’
সুবাস বলল, ‘এখন আমার সময় নেই ভাই, আটটার মধ্যে আমাকে একটা জায়গায় পৌঁছাতে হবে। তুমি এক কাজ করো, আমি তোমাকে একটা কাগজ দিয়ে যাচ্ছি। পড়লেই মোটামুটি বুঝতে পারবে আমরা কী চাইছি। যদি কোথাও অস্পষ্টতা থাকে আলোচনা করতে পারো।’
সুবাস ব্যাগ থেকে কিছু কাগজপত্র বের করে তার থেকে একটা লিফলেট জাতীয় জিনিস তুলে অনিমেষের হাতে দিল।
অনিমেষ সেটার ওপর চোখ রাখতেই সুবাস উঠে দাঁড়াল, ‘বিমানদের সঙ্গে তোমার সম্পর্ক ছিন্ন করেছ?’
মাথা নাড়ল অনিমেষ, ‘না। মানে মৌখিকভাবে কিছু হয়নি।’
সুবাস বলল, ‘আমি জানতাম তোমাকে সরে আসতেই হবে। সিদ্ধান্ত নেবার পর আশা করব তুমি সম্পর্ক রাখবে না। তাতে ভুল বোঝাবুঝি বাড়ে। আর একটা কথা, এখন থেকে যা করবে সাবধানে করবে। এই কাগজটা প্রকাশ্যে রাখার দরকার নেই।’
অনিমেষ বলল, ‘আপনি কি আজ সন্ধেবেলায় আসছেন? মানে এখানে থাকবেন তো?’
সুবাস বলল, ‘না ভাই, আমাকে আজই বর্ধমান যেতে হবে।’
অনিমেষ একটু ভাবল, ‘তা হলে আপনার সঙ্গে আমার কবে দেখা হচ্ছে?’
দরজায় দাঁড়িয়ে সুবাস বলল, ‘তুমি নিজের মন পরিষ্কার করো, আমি সময় হলেই যোগাযোগ করব।’
ঝড়ের মতো নেমে গেল সুবাস। অনিমেষ চুপচাপ বসে থাকল বেশ কিছুক্ষণ। তারপর উঠে দরজাটা বন্ধ করে দিয়ে এসে আবার বিছানায় শরীর এলিয়ে দিল। লিফলেটটা কয়েকটা পাতার—
‘ভারতবর্ষের বর্তমান কমিউনিস্ট পার্টিগুলো বৈপ্লবিক পরিবর্তনের অতীত প্রতিশ্রুতিগুলো বিস্মৃত হয়ে ঔপনিবেশিক সংসদীয় কাঠামোয় নিজেদের মানানসই করে নিয়ে রাজ্য সরকার পাওয়ার জন্য বেশি মন দিয়েছেন। এর প্রতিক্রিয়া হয়েছে তরুণ কমিউনিস্টদের মধ্যে। আমরা ভারতবর্ষের অতীত বিপ্লবী পর্বের (তেভাগা সংগ্রাম ও তেলেঙ্গানার সশস্ত্র আন্দোলন) উৎস থেকে প্রেরণা নিয়ে নতুনভাবে বিপ্লব পরিচালনা করতে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ। যেহেতু তৃতীয় বিশ্বে জনগণের মধ্যে সবচেয়ে শোষিত ও পীড়িত অংশ কৃষক সমাজ এবং যেহেতু এ অঞ্চলে অতীতে সমাজ পরিবর্তনের আন্দোলনে এই কৃষক সাধারণেরই ছিল সর্বাধিক অগ্রণী ভূমিকা, তাই আমাদের এই নতুন বিপ্লবে এই অবহেলিত শ্রেণির পাশে দাঁড়াব আমরা।
‘তৃতীয় বিশ্বে বিপ্লবের কেন্দ্রস্থল গ্রাম— এই তত্ত্বকে আরও একধাপ এগিয়ে লিনপিয়াও সিদ্ধান্তে এসেছিলেন য়ুরোপ ও আমেরিকা শহরের মতো, আর আফ্রিকা, এশিয়া ও লাতিন আমেরিকা এই পৃথিবীর গ্রামাঞ্চল। গ্রাম দিয়ে শহর ঘেরার তত্ত্ব প্রয়োগ করে তিনি গণমুক্তির সংগ্রামকে জোরদার করতে যে আহ্বান জানিয়েছেন আমরা সর্বান্তঃকরণে তা সমর্থন করি।
‘আমাদের দেশের ইতিহাস হচ্ছে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদ ও সামন্তবাদী শোষণের বিরুদ্ধে ভারতবর্ষের বীর কৃষকশ্রেণির বিরামহীন সংগ্রামের ইতিহাস। ভারতবর্ষের মোট জনসংখ্যার শতকরা পঁচাত্তর ভাগই হলেন কৃষক। এবং এঁরাই সবচেয়ে বেশি শোষিত। তাই সশস্ত্র কৃষক গেরিলাদল সংগঠিত করে গ্রামে গ্রামে অঞ্চলভিত্তিক ক্ষমতা দখল করতে হবে। গত দুই শতকে কৃষক আন্দোলনের অনুপ্রেরণা আমরা কাজে লাগাব। সাঁওতাল বিদ্রোহের নেতা-সিধু-কানু এই কৃষক বিদ্রোহের পূর্বসূরি।
‘সংগঠন পর্যায় সম্পূর্ণ হলে কৃষক গেরিলার দল সশস্ত্র সংগ্রামের ছোট ছোট ঘাঁটিগুলোকে বিস্তৃত করে জনযুদ্ধের প্রচণ্ড ঢেউ সৃষ্টি করতে পারবেন, গড়ে তুলবেন গণফৌজ, যে গণফৌজ দ্বারা গ্রামাঞ্চলে চার পাহাড়ের প্রতিক্রিয়াশীল শাসককে উচ্ছেদ করবে, শহরগুলোকে ঘিরে ফেলে দখল করে নেওয়া হবে এবং সমগ্র দেশে গণতান্ত্রিক একনায়কত্ব কায়েম করে দৃঢ়তার সঙ্গে তাকে সর্বহারার একনায়কত্ব ও সমাজতন্ত্রের দিকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া হবে।
‘শহরের মধ্যবিত্ত শ্রেণি চিরকালই সুবিধেবাদী। পৃথিবীর সব দেশেই সেটা দেখা যায়। শহরের এই শ্রেণির কর্মীদের শ্রেণিচ্যুত হয়ে ভূমিহীন ও গরিব কৃষকের পাশে গিয়ে লড়াই করতে আহ্বান জানানো হচ্ছে।’
অনিমেষ বাকি লিফলেটটা শেষ করল। একবার নয়, বেশ কয়েকবার সে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে আগাগোড়া পড়ে নিল। পড়তে পড়তে ও শরীরের শিরায় শিরায় যেন নতুন পায়ের শব্দ পাচ্ছিল। একটা নতুন ভারতবর্ষ সৃষ্টি করার পরিকল্পনা শুরু হয়ে গেছে। এতদিন যে বিক্ষিপ্ত মানসিকতায় একই ঘোলাজলে সে পাক খাচ্ছিল তা থেকে ছিটকে বেরিয়ে এল সে। তার অজ্ঞাতে আরও কিছু মানুষ যে একই রকম চিন্তাভাবনা করছে এবং পরিষ্কার একটা পথের সন্ধান করে নিচ্ছে তা সে এতদিন জানতই না।
এই ক্লীব সমাজব্যবস্থা এবং মেরুদণ্ডহীন লোভী রাষ্ট্রব্যবস্থাকে চুরমার করে দেওয়ার জন্য একটা সংগঠিত শক্তি দরকার। গ্রামের কৃষকদের সংগঠিত করেই সেটা সম্ভব। ওই স্বার্থপর মানুষগুলো যাঁরা বিভিন্ন পার্টির চূড়োয় কায়েম হয়ে আছেন দিনের পর দিন, তাঁদের ছুড়ে ফেলে না-দিতে পারলে এই দেশে কখনওই মানুষের স্বাধীনতা আসবে না। উনিশশো সাতচল্লিশ আমাদের মুক্তির বছর নয়। সুবাসদারা যে পথে যাচ্ছেন মনে হচ্ছে সেটাই আসল মুক্তির পথ। কিছু পেতে হলে অবশ্যই দিতে হয়। অধিকার কেউ হাতে তুলে দেয় না। বিদেশি রাষ্ট্র যখন মাথার ওপর জুতো চাপিয়ে দেয় তখন তার বিরুদ্ধে লড়াই করে মুক্তি পাওয়া অনেক সহজ। প্রতিপক্ষকে চিহ্নিত করতে একটুও অসুবিধে হয় না। কিন্তু এ লড়াই নিজেদের সঙ্গে নিজেদের লড়াই। শোষকের বিরুদ্ধে শোষিতের সংগ্রাম।
অনিমেষের হঠাৎ মনে হল প্রাকবিপ্লব চিনের সঙ্গে ভারতবর্ষের বর্তমান শাসনব্যবস্থার হুবহু মিল আছে। লিফলেটে মাও সে তুং-এর লং মার্চের কথা বলা আছে। অনিমেষ আগেও সেই সংগ্রামী যাত্রার কাহিনি পড়েছে। কুও মিনতাং-এর নেতারা যখন ধারণা করেছেন চিনের মাটি থেকে কমিউনিস্টরা মুছে যাচ্ছে তখন উনিশশো চৌত্রিশ সালের ষোলোই অক্টোবর নব্বই হাজার লোকের মুক্তিফৌজ রাতের অন্ধকারে শুরু করেছিল সেই মহাযাত্রা। পনেরো বছর বাদে উনিশশো উনপঞ্চাশে যা চিনকে মুক্ত করে নতুন ইতিহাস সৃষ্টি করল। নব্বুই হাজার কৃষক শ্রমিককে সংগঠিত করেছিলেন মাও সে তুং। মার্চ হত রাতের বেলায়। মুক্তিবাহিনী দু’ভাগে ভাগ হয়ে দক্ষিণ ও পশ্চিম দিকে চলতে শুরু করল। যাত্রার চতুর্থ দিনে তারা আচমকা আক্রমণ করে চিয়াং কাইশেকের বাহিনীকে হঠিয়ে দিয়ে পথ পরিষ্কার করে নিল। মুক্তিফৌজের প্রধান বাহিনীর সঙ্গী ছিল যুবক, বৃদ্ধ, নারী, শিশুরা। ছিল খচ্চরের পিঠে চাপানো কারখানার মেশিন, অস্ত্রশস্ত্র, সাংসারিক জিনিস। প্রচুর ক্ষতি স্বীকার করতে হয়েছে মুক্তিবাহিনীকে। গতি ধীর হওয়ায় চিয়াং কাইশেক বারংবার আঘাত হেনে চলেছেন ওদের ওপর। দু’দিক থেকে মিছিলকে তাঁর সৈন্যরা আক্রমণ করছে আর মাথার ওপরে মার্কিন সাহায্যপ্রাপ্ত বিমান থেকে বোমা বর্ষণ চলছে। কিন্তু কিছুতেই দমল না মুক্তিবাহিনী। মানুষ যখন উদ্বুদ্ধ হয় দেশপ্রেমে তখন কোনও প্রতিরোধ তার সামনে মাথা তুলতে পারে না। দেশের এ-পিঠ থেকে ও-পিঠ মিছিলটা এগোচ্ছে। কোনও বক্তৃতা দিয়ে মানুষকে বোঝানো বা শিক্ষিত করার চেয়ে জনসাধারণকে একত্রিত করার, উদ্বুদ্ধ করার এমন কার্যকরী উপায় কেউ ভাবতে পারেনি। এ মিছিল আমাদের মুক্তির, এই বোধ মানুষকে উৎসাহিত করেছিল। নইলে তাতু নদীর ওপর সেদিন অমন ঘটনা ঘটতে পারত না।
নদীটার ওপর মাত্র একটাই সেতু এবং সেটা কাঠের। গণফৌজকে ওই নদী পেরিয়ে যেতে হবে। মিছিল যখন নদীর কাছাকাছি এসে পড়ল তখন চিয়াং কাইশেকের সৈন্যরা মেশিনগান সাজিয়ে বসে গেছে নদীর অন্য পারে। এদিকে চিয়াং-এর অপর বাহিনী ইঁদুরকলে মিছিলকে ঠেসে ধরবার জন্যে পেছন থেকে ধাওয়া করে এল। সেচুয়ানের পার্বত্যঅঞ্চলে এই ভীষণ নদীটির ওপর পুরনো আমলের ভাঙাচোরা কাঠের ঝুলনপুল পার হতে হবে গণফৌজকে। অপর পারে যে মেশিনগানগুলো প্রস্তুত সে খবরও এসেছে।
প্রথম দল এগিয়ে চলল দৃঢ় পদক্ষেপে। সেতুর মাঝামাঝি আসতেই শুরু হয়ে গেল গুলিবর্ষণ। চোখের নিমেষে মানুষগুলো নিশ্চিহ্ন হয়ে গেল, লাল হল তাতু নদীর জল। পরের দল বন্দুক ছুড়তে ছুড়তে এগোল ওই ছোট সেতুর ওপর দিয়ে কিন্তু মেশিনগান তাদের আলতো করে তুলে নিল এবারও। এবার গণফৌজ আরও মরিয়া হয়ে উঠল। মৃত্যু যেখানে অবশ্যম্ভাবী সেখানে মৃত্যুকে ব্যবহার করা যাক জীবনকে অর্জন করতে। এবার কোনও ছোট দল নয়, গণফৌজ নেমে পড়ল সার দিয়ে। মেশিনগানের আঘাতে মানুষ মরছে কিন্তু তার জায়গা নিয়ে পরের জন সেতুর ওপর আরও একটু এগিয়ে আসছে। তার মৃতদেহ যেখানে পড়ছে তা থেকে পরবর্তী মুক্তিসেনা আরও কয়েক পা মিছিলকে এগিয়ে দিচ্ছে। এবার চিয়াং-এর বাহিনী নতুন অস্ত্র প্রয়োগ করল। ফ্লেম থ্রোয়ার ছুড়ে ওরা ঝুলনপুলের কাঠে আগুন ধরিয়ে দিল। দাউদাউ করে জ্বলছে সেতু। মাঝপথেই পুড়ে নদীতে পড়ে গেল প্রথম সারির মানুষগুলো। কিন্তু পিছু হটল না চিনের মুক্তিফৌজ, সেই লকলকে আগুনের সামনে দাঁড়িয়ে তারা এক অমানুষিক কাণ্ড করল। জ্বলন্ত পুলের ওপর দিয়ে অবিশ্রান্ত গুলিবর্ষণে টুপটাপ নদীর বুকে ঝরে যেতে যেতে প্রথম দলটা সেতু পার হল। চোখের সামনে ঝাঁকে ঝাঁকে জ্বলন্ত শরীর ছুটে আসছে দেখে চিয়াং-এর সৈন্যরা হতভম্ব। কতখানি আবেগ মানুষের বুকে পাহাড় হলে এইভাবে আত্মাহুতি দেওয়া যায় তার সন্ধান ওরা জানত না। এই অতিমানবিক ঘটনা দেখে চিয়াংবাহিনীর সৈন্যরা ভয় পেল। তারা মেশিনগান ছেড়ে পালাতে লাগল এবার। দগ্ধ যারা তারা লুটিয়ে পড়ল মাটিতে। কিন্তু অর্ধদগ্ধ শ্রান্ত মুক্তিসেনারা এবার ওই পরিত্যক্ত মেশিনগানগুলোর দখল নিল। এ পাশে আর কোনও বাধা নেই। অবশিষ্ট বাহিনীকে চিয়াং-এরই মেশিনগানের গুলির ছাতির আড়ালে নিরাপদ রেখে ওরা নদী পার করিয়ে নিয়ে এল।
পথে বাধা ছিল অনেক। হিংস্র চিনবিরোধী পার্বত্য উপজাতিদের গুপ্ত আক্রমণের ভয়, সুবিশাল চোরা গহ্বরসংকুল তৃণভূমি অতিক্রম করার সমস্যা। মুক্তিফৌজ ওই পথ পেরিয়ে এল মাও সে তুং-এর নেতৃত্বে। ষোলো হাজার ফুট উঁচু পাহাড়ের বরফ ডিঙিয়ে দু’হাজার মাইলের সেই ভয়ংকর তৃণভূমি মাড়িয়ে হিংস্র উপজাতিদের সঙ্গে বন্ধুত্ব করে উনিশশো পঁয়ত্রিশ সালের বিশে অক্টোবর গিয়ে পৌঁছাল পাও আন্-এ। সৃষ্টি হল মুক্ত অঞ্চল। কোনসি প্রদেশের ইয়েনান হল সাতচল্লিশ সাল পর্যন্ত মুক্তিবাহিনীর রাজধানী। নব্বই হাজার মানুষ নিয়ে শুরু করা যাত্রা তখন তিরিশ হাজারে এসে ঠেকেছে কিন্তু সাফল্য তখন করায়ত্ত। তারপর সেই মুক্ত অঞ্চল ক্রমশ বিস্তৃত হতে লাগল। কিন্তু সেখানেও সমস্যা জমেছিল অনেক।
চিয়াং কাইশেকের শিক্ষিত সৈন্যরা মুক্ত এলাকা দখল করতে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ। তারা আক্রমণ করছে মুক্তিসেনাদের। পার্টির নেতৃত্বে আর যাঁরা ছিলেন তাঁরা পিছু হটতে চাইলেন না। ভাবাবেগে বললেন, ‘এত কষ্টে তৈরি করা এই মুক্ত অঞ্চলের এক ইঞ্চি জমিই বা আমরা ছাড়ব কেন? ঘরদুয়োর, জিনিসপত্র শত্রুকে দিয়ে পালিয়ে যাব? সব এলাকাতেই প্রতিরোধ করতে হবে।’ মাও সে তুং-কে তাঁরা বললেন, ‘জঙ্গলে পাহাড়ে মার্ক্সবাদ বিকাশলাভ করে না।’
মাও সে তুং এই মতকে মানলেন না। শত্রুপক্ষ যখন অনেক আধুনিক অস্ত্রে শক্তিশালী তখন মুখোমুখি লড়াই করা ঠিক নয়। বিনা বাধায় শত্রুকে মুক্তাঞ্চলে ঢুকতে দাও। তারপর আমাদের এলাকার মাঝামাঝি এসে যখন ওই বিরাট বাহিনী ছাউনি গেড়ে বসবে তখন হঠাৎ আক্রমণ করে তাদের ছত্রভঙ্গ করব। সেই ছত্রভঙ্গ সেনাবাহিনীকে তারপর আলাদা আলাদা আক্রমণ করে নিশ্চিহ্ন করতে হবে।
ফল পাওয়া গেল হাতে হাতে। গেরিলাযুদ্ধের এই কৌশল বিপ্লবকে আর এক ধাপ এগিয়ে দিল। মার্ক্সবাদের প্রধান কর্মক্ষেত্র ইউরোপ থেকে এত দূরে এশিয়ার একটা দেশের পাহাড়ে জঙ্গলে মার্ক্সবাদ-লেনিনবাদের নির্দিষ্ট প্রয়োগে মাও সে তুং একটি জাতির জন্মান্তর সৃষ্টি করলেন।
লিফলেটের শেষ কথা— এই সংগ্রাম আমাদের একমাত্র পথনির্দেশিকা হোক।
অনিমেষ এখন চোখ বন্ধ করলেই সেই জ্বলন্ত ঝুলনপুলের ওপর ছুটে যাওয়া অগ্নিপুরুষদের দেখতে পাচ্ছিল। এই পথ, একমাত্র পথ।