২৯. তিনি চিকিৎসা ছেড়ে দিয়েছিলেন

আর না বলে আরও একবার তিনি চিকিৎসা ছেড়ে দিয়েছিলেন। বনবিহারীর মৃত্যুর পর। তখন ভেবেছিলেন আর কেন? পূৰ্ণাহুতি তো হয়ে গেল! কেউ ডাকতে এলে বলতেন ভেবে নিয়ো মশায় মরে গেছে। শোক-দুঃখ কতটা তা ঠিক আজও বলতে পারেন না; তিনি চিকিৎসক, মহাশয় বংশের শিক্ষা, ভাবনা তার মধ্যে, মৃত্যু অনিবার্য এ কথাও তিনি জানেন এবং শোকও। চিরস্থায়ী নয় এও জানেন। জীবনের চারিদিকে ছটা রসের ছড়াছড়ি; আকাশে বাতাসে ধরিত্রীর অঙ্গে ছয় ঋতুর খেলা; পৃথিবীর মাটির কণায় কণায় যেমন উত্তাপ এবং জলের তৃষ্ণা, জীবের জীবনেও তেমনি দেহের কোষে কোষে রঙ ও রসের কামনা ও না হলেও সে বাঁচে না। মানুষের। মনে মনে আনন্দের ক্ষুধা। শোক থাকবে কেন, থাকবে কোথায়? শোকের জন্য নয়, আক্ষেপে ক্ষোভেও নয়, অন্য কারণে ছেড়েছিলেন। প্রথম কারণ জীবনের সব কল্পনা ভেঙে চুরমার হয়ে গেল।

বনবিহারীর মৃত্যুর পরই বনবিহারীর স্ত্রী একমাত্র শিশুপুত্রটিকে নিয়ে চলে গেল পিত্রালয়ে। গেল প্রথমটায় কিছুদিন পর ফিরবে বলে। বনুর স্ত্রী মা-বাপের একমাত্র সন্তান, বিষয়ের। উত্তরাধিকারিণী। মা-বাপ নিয়ে গেলেন সমাদরের সুখে বৈধব্যের দুঃখ প্রশমিত করে দেবেন। বলে। কিন্তু সেখানে গিয়ে কিছুদিন পরই লিখে পাঠালেন—মনো এবং খোকা এখানেই থাক। আমাদের তো আর কেহ নাই; ওই একমাত্র সম্বল। আপনাদের মেয়েরা আছে, দৌহিত্রেরা আছে। আমাদের কে আছে? অবশ্য ক্রিয়াকর্মে যাইবে। আপনাদের দেখিতে ইচ্ছা হইলে যখন খুশি আসিয়া দেখিয়া যাইবেন। ইহা ছাড়াও মনোর ওখানে যাইতে দারুণ আশঙ্কা! তাহার ভয়–ওখানে থাকিলে খোকনও বঁচিবে না। কিছু মনে করিবেন না, সে বলে—সেখানে রোগ হইলে আরোগ্যের কথা ভুলিয়া মৃত্যুদিন গণনা করা হয়, সেখানে আয়ু থাকিতেও মানুষ মরিয়া যায়।

এ ছাড়া আতর-বউ সম্পর্কে অভিযোগ ছিল। স্তার কঠোর তিরস্কার কাহারও পক্ষেই সহ্য করা সম্ভবপর নয়। ইত্যাদি।

সুতরাং আর অর্থ, প্রতিষ্ঠা অর্জন কেন, কিসের জন্য?

দ্বিতীয় কারণ, মনকে সঁপে দিতে চেয়েছিলেন কুলধৰ্ম ও পিতৃনির্দেশ অনুযায়ী পরমানন্দ মাধবের পায়ে। কিন্তু সেও পারেন নি। তার পরিবর্তে ভাবতেন নিজের জীবনের কথা আর ভাবতেন মৃত্যুর কথা। পরলোকতত্ত্ব চিকিৎসাতত্ত্ব সব তত্ত্ব দিয়ে এই অনাবিষ্কৃত মহাতত্ত্বকে বুঝবার চেষ্টা করতেন। কত রকম মনে হয়েছে। আরোগ্য-নিকেতনের পাশের ঘরখানায় চুপ করে বসে থাকতেন। বাড়ির ভিতরে ইনিয়েবিনিয়ে কাঁদত আতর-বউ। গভীর রাত্রে উঠে গিয়ে বনুর ঘরে বারান্দায় ঘুরে বেড়াত। কখনও চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকত। প্রত্যাশা করত এত অতৃপ্তি এত বাঁচবার কামনা নিয়ে যে বনু মরেছে, মরবার সময় বাঁচাও বাঁচাও বলে কেঁদেছে, সে কি। গভীর রাত্রের নির্জনতার অবসরে ছায়াশরীর নিয়ে সবকিছুকে ছোঁবার জন্য, পাবার জন্য আসবে না? তিনি নিজেও মধ্যে মধ্যে উত্তপ্ত মস্তিষ্কে ভাবতেন—দেখা যদি দেয় বনু তবে প্রশ্ন করবেন মৃত্যু কী? মৃত্যু কেমন? কী রূপ? কেমন স্পর্শ? কেমন স্বাদ? বনু কাদল। ভুবন রায় ধীরভাবে হিসেব নিকেশ চোকালেন। গণেশ বায়েন পরমানন্দে জীবন-মহোৎসব করলে। এই বিচিত্ররূপিণী বহুরূপার আসল পরিচয়টি কী?

দীর্ঘ পাঁচ বছর তাঁর জীবনে আর কেউ ছিল না, কিছু ছিল না। নিজের নাড়ি পরীক্ষা করতেন। কিন্তু কোনো কূলকিনারা পান নি। মধ্যে মধ্যে গ্রামের কারুর জীবন-মৃত্যুর যুদ্ধে আত্মীয়েরা এসে ডাকত—একবার! একবার চলুন!

গিয়েছেন। চিন্তার মধ্যে যাকে ধরতে পারেন নি, তে পারেন নি, যার ধ্বনি শোনেন নি, নাড়ি ধরে তার স্পষ্ট অস্তিত্ব অনুভব করেছেন। তখন মনে হত, তাকে জানতে হলে তার এই পথ।

তারপর একদিন গেলেন তীর্থভ্রমণে। মৃত্যুর কোনো সন্ধান না পেয়ে আবার খুঁজতে গেলেন, পরমানন্দ মাধবকে। গয়ায় বনুকে নিজ হাতে পিণ্ড দিয়ে সরাসরি গেলেন বৃন্দাবন। বৃন্দাবনে বনুর আত্মার জন্য শান্তি প্রার্থনা করে মন্দিরপ্রাঙ্গণে একখানি মার্বেল পাথর বসিয়ে দিলেন। অন্য একখানা মার্বেল পাথর দেখে কথাটা মনে হয়েছিল। অনেক পাথরের মধ্যে চোখে পড়ল। প্রথমটা চমকে উঠেছিলেন তিনি।

কাঁদী-নিবাসী ভূপেন্দ্র সিংহের আত্মার
শান্তির জন্য–
হে গোবিন্দ দয়া কর, চরণে স্থান দাও।
মঞ্জরী দাসী।

তীর্থ থেকে ফিরে নবগ্রাম স্টেশনে নামলেন; দেখা হল কিশোরের সঙ্গে। কিশোর তখন প্রদীগুললাট যুবা। পাঁচ বৎসরই কিশোরকে দেখেন নি মশায়। তিনি নিজেকে আবদ্ধ রেখেছিলেন। ঘরে, কিশোরকে আবদ্ধ রেখেছিল গভর্নমেন্ট, রাজা।

কিশোর সবিস্ময়ে বলেছিল—মশায়!

তিনিও সবিস্ময়ে বলেছিলেন–কিশোর।

–এই নামছেন আপনি?

–হ্যাঁ। কিন্তু তুমি ছাড়া পেলে কবে? ওঃ, কত বড় হয়ে গিয়েছ তুমি!

হেসে কিশোর বলেছিল—তা হয়েছি। আর ক্ষীর চাঁচি ছানা চুরি করে খাই না।

—সে বুঝতে পারছি। মশায় বলেছিলেন হেসে অবসর কোথায়? রুচিই বা থাকবে কী করে? এখন প্ৰভু কংসারির সঙ্গে ধনুৰ্যজ্ঞে নিমন্ত্রণ রাখবার পথে সঙ্গীর সাজে সেজেছ যে!

কিশোর একটু লজ্জিত হয়েছিল এমন মহৎ পরিচয়ের ব্যাখ্যায়। পরশ্ন ণে সে লজ্জাকে সরিয়ে ফেলে সহজভাবে বলেছিল—আপনাকে যে কত মনে মনে ডাকছি এ কদিন কী বলব? আপনি এসেছেন—বালাম।

—কেন কিশোর কিসে তোমাকে এমন মরণের ভয়ে অভিভূত করেছিল? মরণের ভয় তো তোমার থাকবার নয়।

–কলেরা আরম্ভ হয়েছে মশায়। নিজের মৃত্যুকে ভয়ের কথা তো নয়; মানুষের মৃত্যু দেখে মানুষের ভয় দেখে ভয় পাচ্ছি। জানেন তো, ডাক্তারেরা কলেরা কেসে যেতে চান না, গেলে ফি ডবল। চারুবাবুর ফি ছ টাকা—আট টাকা। চক্রধারীর ফি চার টাকা। আমি হোমিওপ্যাথিক একটু-আধটু দি, কিন্তু ভাল তো জানি না। আপনি এলেন এবার বাঁচলাম। আমাদের ছেলেবেলায় যখন কলেরা হয়েছিল তখন আপনিই গরিব-দুঃখীদের দেখেছিলেন। আজও যে আপনি না হলে উপায় নেই মশায়।

তিনি সঙ্গে সঙ্গেই উত্তর দিতে পারেন নি। আকাশের দিকে তাকিয়ে চুপ করে ছিলেন। কিছুক্ষণ। সেই পুরনো কালের–উনিশশো পাঁচ সালের মহামারীর কথা মনে পড়েছিল। সেই অন্ধ বধির পিঙ্গলকেশিনী দুই হাত বাড়িয়ে এগিয়ে আসছে; মহাকালের ডমরুতে বেজেছে তাণ্ডব বাদ্যতারই তালে তালে উন্মত্ত নৃত্যে আত্মহারা হয়ে ছুটে চলেছে সব মৃত্যুভয়ভীত মানুষ, আগুনলাগা বনের পশুপক্ষীর মত আর্ত কলরব করে ছুটে পালাচ্ছে। ছুটে পালাচ্ছে—পিছনের লেলিহান শিখা বাতাসের ঝাপটায় মুহূর্তে নুয়ে দীর্ঘায়ত হয়ে তাকে গ্রাস করছে—আকাশে পাখি উড়ে পালাচ্ছে—আগুনের শিখা লকলক জিহ্ব প্রসারিত করে তাকে আকর্ষণ করছে—পাখির পাখা পঙ্গু হয়ে যাচ্ছে–অসহায়ের মত পুড়ছে আগুনের মধ্যে। মহামারীর স্মৃতি তার ঠিক তেমনি।

কিশোর বলেছিল—মশায়!

–কিশোর!

–আপনি চলুন, চলুন আপনি।

–আমি পারব? আমার কি আর সে শক্তি, সে উৎসাহ আছে কিশোর?

কিশোর বলেছিল—এই কথা আপনি বলছেন? মশায়ের বংশের মশায় আপনি।

কিশোরের কথা মনে পড়েছিল বাবার কথা। গুরু রঙলালের কথাও মনে হয়েছিল। পরমুহূর্তেই তিনি বলেছিলেন—বেশ, যাব। তুমি ডাক দিলে—নিলাম সে ডাক।

সেইবার কলেরার সময় ইনট্রাভেনাস স্যালাইন ইনজেকশন দেখেছিলেন। কিছুদিনের মধ্যেই কলকাতা থেকে মেডিক্যাল ভলান্টিয়ার্স এসে উপস্থিত হয়েছিল। একদল সোনার চাঁদ ছেলে। ডিস্ট্রিক্ট বোর্ড থেকে এল লোকজন। স্যানিটারি ইন্সপেক্টার। আর একদল এল, কী নাম যেন তাদের? কোদালি ব্রিগেড! কোদাল ঘাড়ে করে এল শিক্ষিত যুবকেরা।

শুকনো পুকুরের তলায় কুয়ো কেটে তারা জল বের করলে। তাই তো! কথাটা তো কারুর মনে হয় নি! স্যানিটারি ইন্সপেক্টারেরা পুকুরে পুকুরে ব্লিচিং পাউডার গুলে দিয়ে জলকে শোধন করলে। অ্যান্টি-কলেরা ভ্যাকসিন ইনজেকশন দিলে। কলেরার টিকে!

সব থেকে বিস্মিত হয়েছিলেন স্যালাইন ইনজেকশন দেখে।

অবিনাশ বাউরির বউ–সত্যকারের সুন্দরী স্বাস্থ্যবতী মেয়ে, সকালে সে এসে ভদ্রপাড়ার বাসন মেজে ঘরদোর পরিষ্কার করে ঝিয়ের কাজ করে গেল তাঁর চোখের সামনে। দুপুরে শুনলেন তার কলেরা হয়েছে। বিকেলে গিয়ে দেখলেন সেই স্বাস্থ্যবতী সুন্দরী মেয়েটার সর্বাঙ্গে কে যেন কালি মাখিয়ে দিয়েছে; একগোছা ঝাঁটার মত কঙ্কালসার দেহের সকল রস কে যেন নিঙড়ে বের করে দিয়েছে। দেখে শিউরে উঠলেন তিনি। মৃত্যুর ছায়া পড়েছে সর্বাঙ্গে। নাড়ি নাই, হাতের তালু পায়ের তলা বিবৰ্ণ পাণ্ডুর, হাত-পা কনুই পর্যন্ত হিমশীতল।

তরুণ দুটি ডাক্তার তখন তাদের দলে এসে যোগ দিয়েছে। চোখে তাদের স্বপ্ন, বুকে তাদের অসম্ভব প্রত্যাশা, ওই কিশোরের জাতের ছেলে। তারা বললে—স্যালাইন দেব একে। বের করলে স্যালাইনের বাক্স।

এ রোগী বাঁচে না এ কথা মশায় জানতেন, কিন্তু বাধা দেন নি। দাঁড়িয়ে দেখলেন, লক্ষ্য করে গেলেন। নিপুণ ক্ষিপ্ৰ হাতে সাবধানতার সঙ্গে ওরা কাজ করে গেল। শিরা কাটলে, এক মুখ বন্ধ করলে—অন্য মুখে স্যালাইনের নলের মুখটা ঢুকিয়ে দিলে। একজন কাচের নলটুকুর দিকে চেয়ে রইল। বুদ্বুদেব মধ্য দিয়ে বায়ু না যায়। সতর্ক দৃষ্টিতে লক্ষ্য করছে।

বুদ্বুদে বায়ু গেলেই সঙ্গে সঙ্গে মৃত্যু। চারিদিকে দূরে দাঁড়িয়ে বিস্ময়াভিভূত জনতা। জীবন মশায়ের দৃষ্টিতে কৌতূহল—আনন্দ। অদ্ভুত! অদ্ভুত! মেয়েটার দেহ থেকে মৃত্যুছায়া অপসারিত হয়ে যাচ্ছে, কালি মুছে গিয়ে তার গৌরবর্ণ ফুটে উঠছে। রস শুষে-নেওয়া শুষ্ক দেহ রস-সঞ্চারে আবার নিটোল পরিপুষ্ট কোমল হয়ে উঠছে; জীবনের লাবণ্য ফিরে আসছে। অদ্ভুত, এ অদ্ভুত! যুগান্তর, সত্যই এ যুগান্তর! মৃত্যু ফিরে গেল?

সে বড় কঠিন! যায় না। বৃদ্ধ জীবনমশায় হাসলেন আজ।

মনে পড়ছে যে!

ইনজেকশন শেষ হল—মেয়েটি হাসিমুখে সলজ্জভাবে মাথার ঘোমটা টেনে দিয়ে নিজেই পাশ ফিরে শুলে। ডাক্তারেরা যন্ত্রপাতি গুটিয়ে নিয়ে ব্লিচিং পাউডার মেশানো জলে হাত ধুচ্ছে, এই সময় হঠাৎ জলভরা পাত্র ভেঙে যেমন জল ছড়িয়ে পড়ে ঠিক তেমনিভাবেই মুহূর্তের মধ্যেই একরাশি জল ছড়িয়ে পড়ল, মলের আকারে নির্গত হয়ে গেল। এবং মুহূর্তে মেয়েটা আবার হয়ে গেল সেই মৃত্যুছায়াচ্ছন্ন, কালিবর্ণ, কঙ্কালের মত শুষ্ক। অবিনাশ বাউরির স্ত্রী মারাই গেল। কিন্তু জীবনমশায় সেদিন মনে মনে মৃত্যুর সঙ্গে মানুষের সাধনাকেও প্রণাম জানিয়েছিলেন। মৃত্যুকে জয় করা যাবে না, কিন্তু মানুষ অকালমৃত্যুকে জয় করবে। নিশ্চয় করবে। ধন্য আবিষ্কার। ইউরোপের মহাপণ্ডিতদের প্রণাম করেছিলেন। হা-আজ বেদজ্ঞ তোমরাই। এই কথাই বলেছিলেন।

আজ পেনিসিলিনের ক্রিয়া দেখে এবং প্রদ্যোতের উদ্যম দেখে ঠিক সেই কথাই বলছেন। তোমরা ধন্য।

সেদিন তার জীবনের দ্বিতীয় পর্যায় আরম্ভ হয়েছিল। মনে পড়ছে, সংকল্প ছিল কলেরার আক্রমণ ক্ষান্ত হলেই আবার তিনি ঘরে ঢুকে বসবেন। কিন্তু তা পারেন নি। বিচিত্রভাবে শুরু হয়ে গেল। ডাক্তারদের সঙ্গে কলেরা-সংক্রামিত পাড়া ঘুরে রোগী দেখে ফিরে এসে কিশোরদের বাড়িতে বসতেন, হাত-পা ধুতেন—ব্লিচিং পাউডারে মাড়িয়ে জুতার তলা বিশুদ্ধ করে নিতেন—ততক্ষণে দুজন চারজন এসে জুটে যেত; জ্বরে আমাশয়ে পুরনো অজীর্ণ ব্যাধিতে ভুগছে। এমনি রোগী সব।

—একবার হাতটা দেখুন।

জীবনমশায় প্রথম প্রথম বলতেন—এই এদের দেখাও।

–না। আপনি দেখুন।

ডাক্তার দুটি বড় ভাল ছেলে ছিল, তারা বলতদেখুন ডাক্তারবাবু, আপনাকেই দেখাতে চায় ওরা।

মশায় দেখতেন। শুধু বলতেন—এই ন দিন না-হয় এগার দিনে জ্বর ছাড়বে। ওষুধ দিতেন না।

তারপর একদিন ঈশানপুরে পরান কাহার তাঁকে টেনে নামালে।

সংসারে কত বিচিত্ৰ ঘটনাই ঘটে!

সে এক দুরন্ত কালবৈশাখীর ঝড়ের অপরা। ঈশানপুরে কলেরার আক্রমণের খবর পেয়ে কিশোর এবং তরুণ ডাক্তার স্বেচ্ছাসেবকদের সঙ্গে গিয়েছিলেন ঈশানপুরে। গ্রামে ঢোকবার মুখে হঠাৎ ঝড়। বজ্ৰাঘাত। বর্ষণ। সবশেষে শিলাবৃষ্টি। আশ্রয় নিয়েছিলেন গ্রামের প্রান্তের প্রথম ঘরখানিতে।

একখানা মাত্র ঘরকোলে একটা পিড়ে, মানে ঢাকা রোয়াক, মেটে রোয়াক। পাশে আর-একখানা ছিটে বেড়ার হাত তিনেক মাত্র উঁচু ঘর। রোয়াকেও স্থান ছিল না। সেখানটা ঘিরে তখন অ্যাঁতুড়ঘর হয়েছে। ঘরের ভিতর থেকে ক্ষীণকণ্ঠে কেউ বলছিল—কোথায় পাড়াবা বাবা? বাইরের পিঁড়েতে ঘিরে আমার পরিবারের সন্তান হয়েছে। ভিতরে আমি রোগা মানুষ শুয়ে আছি। তিনটে শুয়োর আছে, পাঁচ-ছটা হস আছে। আপনারা বরং একপাশে কোনোরকমে দাঁড়াও।

তাই দাঁড়িয়েছিলেন; মসীবর্ণ মেঘ থেকে শিল ঝরছিল অজস্র ধারে; বিচিত্র সে দৃশ্য। লাখে লাখে শূন্য মণ্ডলটা পরিব্যাপ্ত করে ঝরঝর ধারে ঝরছিল। সবুজ পৃথিবী সাদা হয়ে যাচ্ছিল। অনেক কাল এমন শিলাবৃষ্টি হয় নি। মশায়েরা ভাবছিলেন মাঠে আজ কতজন, কত জীবজন্তু জখম হবে, মরবে। আবার পৃথিবী বাচল, শান্ত হল, শীতল হল।

কিশোর কর্মী হলেও কবি মানুষ, ছেলেবেলা থেকে পদ্য লেখে। কিশোর মুখে মুখে পদ্য তৈরি করেছিল তার একটা চরণ আজও মনে আছে :

ক্ষ্যাপার মাথায় খেয়াল চেপেছে
নাচন দিয়েছে জুড়ে।

এরই মধ্যে ঘরের দরজার ফাঁক থেকে ক্ষীণ ক্লান্ত কণ্ঠে কে অসীম বিস্ময়ের সঙ্গে প্রশ্ন করেছিল—মশায়, বাবা! আপনি?

দরজাটা খুলে গিয়েছিল। বসে বসেই নিজেকে হেঁচড়ে টেনে কোনোরকমে বেরিয়ে এসেছিল এক কঙ্কালসার মানুষ। যুবা না পৌঢ় না বৃদ্ধ তা বুঝতে পারা যায় নি। শুধু চুল কালো দেখে সন্দেহ হয়েছিল—রোগেই জীর্ণ, বৃদ্ধ নয়।

—কে রে?

লোকটা হাউহাউ করে কেঁদে উঠে বলেছিল—আমার যে নড়বার ক্ষ্যামতা নাই মশায়। আমাকে চিনতে পারছেন বাবা?

–কে? ঠিক চিনতে তো পারছি না বাবা! কী হয়েছে তোমার?

–আমি হাটকুড়ড়া কাহারের বেটা পরান। আপনকার গেরামে আপনার পেজা হাটকুড়ো। হাটকুড়োর ছেলে পরান।

তারই গ্রামের—তারই পুকুরপাড়ের প্রজাই বটে হাটকুড়ো। পান, শূরবীর পরান। বছর কয়েক আগে প্রেমে পড়ে পরান বাপ মা জাতি জ্ঞাতি সব ছেড়ে প্ৰেমাস্পদা একটি ভিন্নজাতীয় মেয়েকে নিয়ে গ্রাম ত্যাগ করেছিল।

সেই পরানের এই কঙ্কালসার মূর্তি দেখে শিউরে উঠেছিলেন মশায়।—তোর এমন চেহারা হয়েছে? কী অসুখ রে?

–রক্ত উঠছে মুখ দিয়ে বাবা। বমি হয়।

–রক্ত উঠছে! টিবি? নতুন ডাক্তারেরা শিউরে উঠেছিলেন।

—আজ্ঞে লবগেরামের ডাক্তারখানার ডাক্তার বলছে—রাজব্যাধি যক্ষ্মা! জবাব দিয়েছে। বলেই সে আবার ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠে মশায়ের মুখের দিকে তাকিয়ে বলেছিল—তবে এইবার আমি বাঁচব। ভগবান আপনাকে ডেকে এনেছেন ঘরে। আমার কপাল। আপনি একবার দেখ বাবা। আমাকে বাঁচাও। ফুরির আর কেউ নাই বাবা।

ফুরি পরানের প্রণয়াস্পদা, তার প্রিয়তমা। যার জন্য সে সব ছেড়েছে। তাকে ও ছেড়ে গেলে তার আর কেউ থাকবে না বলেই পরানের ধারণা। কিন্তু ফুরি আবার বিয়ে করবে। ফুরিও তাঁর গ্রামের মেয়ে, তার কথাও তিনি জানেন, ফুরি লাস্যময়ী স্বৈরিণী। তার জন্য বহুজনেই মোহগ্রস্ত হয়েছিল, কিন্তু পরানের মত তাকে গলায় বেঁধে ঝাঁপ কেউ দেয় নি। সকরুণ হাসিই এসেছিল তাঁর ঠোঁটের রেখায়। কিন্তু সে হাসি স্তব্ধ হয়ে মিলিয়ে গেল মুহূর্তে।

ফুরিও এসে দাঁড়িয়েছিল তার অ্যাঁতুড়ঘরের দরজায়।—মশায়! বাবা! আমার কেউ নাই বাবা। তাকে দেখে তিনি অবাক হয়ে গিয়েছিলেন। এই সেই ফুরি? সে স্বৈরিণীর কোনো চিহ্ন অবশেষ নাই মেয়েটার মধ্যে। সদ্য সন্তানপ্রসবের পর সে ঈষৎ শীর্ণ পাণ্ডুর; কিন্তু রূপের অভাব হয় নি। লাবণ্য রয়েছে, স্বাস্থ্য রয়েছে, চিকুণতা রয়েছে। চোখের দৃষ্টিতে গঠনে ফুরির একটি মাধুর্য ছিল সে মাধুর্যও রয়েছে, নাই শুধু লাস্যচাপল্য, যার ফলে ওকে আর চেনাই যায় না ফুরি বলে। ঠোঁটের পাশে গালে ওটা কী? তিল? ওটা তো মশায় কখনও দেখেন নি। তিনি অবশ্য ফুরিকে পথে চলে যেতেই দেখেছেন, দূর থেকেই দেখেছেন, তার মত মানুষের সামনে ফুরির মত মেয়েরা বড় একটা আসত না। তাকে দেখলে সমে পাশে সরে দাঁড়াত। তিলটা ঠিক বনবিহারীর স্ত্রী—তাঁর বউমার ঠোঁটের পাশের তিলের মত অবিকল।

ওঃ, বনবিহারীর স্ত্রীর তার পুত্রবধূর ধনী বাপ আছে, মা আছে। এ মেয়েটার সত্যিই আর কেউ নাই। বাপ-মা মরেছে। এবং ওর মনের ভিতর যে স্বৈরিণী লীলাভরে এক প্ৰিয়তমকে ছেড়ে তাকে ভুলে গিয়ে আর-একজনকে প্রিয়তম বলে গ্রহণ করতে পারত সে স্বৈরিণীও মরে গেছে। পরান মরে গেলে ওর আর কেউ থাকবে না-এ বিষয়ে আর তার সন্দেহ রইল না।

তিনি দাওয়ায় উঠে পরানের হাত ধরে নাড়ি পরীক্ষা করতে বসেছিলেন।

 

সেই হল তার নূতন করে নাড়ি ধরা, চিকিৎসা করতে বসা।

পরানকে তিনি বাঁচিয়েছিলেন।

যক্ষ্মা বা টি-বি পরানের হয় নি। পুরনো ম্যালেরিয়া এবং রক্তপিত্ত দুইয়ে জড়িয়ে জট পাকিয়েছিল। চারুবাবু, চক্রধারী রক্তবমি এবং জ্বর, দুটো উপসর্গ দেখেই সাংঘাতিক ধরনের গ্যালপিং থাইসিস বলে ধরেছিল। একালে দেশে যক্ষ্মার ব্যাপক প্রসার হয়েছে তাতে সন্দেহ নেই কিন্তু সাধারণ ডাক্তারেরা রক্ত এবং জ্বর দুটোকে একসঙ্গে দেখেই টি-বি বলে ধরে নিয়েছিল। বিশেষজ্ঞ দেশে ছিল না, পরানেরও দূর শহরে গিয়ে দেখাবার সাধ্য ছিল না।

মশায় তার চিকিৎসার ভার নিয়েছিলেন। নিজেই আসতেন দেখতে। নিজে হাতে ওষুধ তৈরি করে দিতেন। পরান ভাল হল, তিনি হয়ে উঠলেন ধন্বন্তরি। নূতন করে জীবনের আকাশে সৌভাগ্যের সূর্য উদয় হল তার। মাস কয়েক পর পরান সুস্থ দেহে বল পেয়ে কোদাল ঘাড়ে মজুর খাটতে বের হলে লোকের আর বিস্ময়ের সীমা ছিল না।

এরপরই একদিন পরানের এখনকার গ্রাম ঘাট-রামপুরের চি য়াদের বাড়ি থেকে ড়ুলি এসে নেমেছিল আরোগ্য-নিকেতনের সামনে।

বৃদ্ধ সৈয়দ আবু তাহের সাহেব পুরনো আমলের কাশ্মিরি কাজ-করা শালের টুপি, সাদা পায়জামা শেরোয়ানী পরে ড়ুলির বেহারাদের কাঁধে ভর দিয়ে এসে ওই রানা আজ যে চেয়ারখানায় বসেছে ওইখানাতেই বসে বলেছিলেন আপনার কাছে এলাম মশায়, আপনি পরান কাহারের এত বড় ব্যামোটা সারিয়ে দিলেন। আমারে আরাম করে দ্যান আপনি। আপনারে ঘরে ডাক না দিয়া নিজে আপনার ঘরে এসেছি। আপনারে ধরবার জন্য এসেছি। আমারে আরাম করে দ্যান কবিরাজ।

বাঁ হাত দিয়ে মশায়ের হাতখানি চেপে ধরেছিলেন। কথা শুনেই বুঝেছিলেন মশায় মিয়া সাহেবের ব্যাধি কী? কথাগুলি জড়িয়ে যাচ্ছিল। মিয়া সাহেবের পক্ষাঘাতের সূত্রপাত হয়েছে, ডান হাতখানি কোলের উপর পড়েছে, ডান দিকের ঠোঁট বেঁকে গিয়েছে, ডান হাতখানি কোলের উপর পড়ে আছে। ডান পা-খানাও তাই।

মশায় ম্লান হেসে বলেছিলেন—এ বয়সে এ ব্যাধির মালিক পরমেশ্বর মিয়া সাহেব। ওই চোখ ওই হাত ওই অঙ্গটা তাঁর সেবাতেই নিযুক্ত আছে ভাবুন। আমার কাছে এর ইলাজ নাই। সে কিসমতও নাই।

একটু চুপ করে থেকে মিয়া সাহেব বলেছিলেন বলেছেন তো ভাল মশায়! মশায়ঘরের ছাওয়ালের মতই বাত বলেছেন। কিন্তু কী জানেন—শেষ বয়সে নিজেই বাঁধিয়েছি ফ্যাসাদ, মামলাতে পড়েছি। তাঁর সেবাতে ডান অঙ্গটা দিয়া নিশ্চিন্দি হতে পারছি কই! কিছু করতি পারেন না আপনি?

মশায় বিস্মিত হয়ে বলেছিলেন—আপনার সঙ্গে মামলা কে করছে? সে কী?

রামপুরের মিয়ারা এ অঞ্চলের মুসলমান সমাজের ধর্মগুরু। তাঁদের সম্পত্তি সমস্তই নানকার অর্থাৎ নিষ্কর। এবং নিঝঞ্ঝাট। তার সুদীর্ঘ জীবনে তিনি কখনও রামপুরের মিয়াদের আদালতের সীমানায় যাতায়াতের কথা শোনেন নি। তারা কাউকে খাজনা দেন না, খাজনা পান বহুজনের কাছে; কিন্তু তাদের বংশের প্রথা হল—সুদও নাই, তামাদিও নাই। সে প্রথা তাদের প্রজারাও মানে। পঞ্চাশ বছর পরও লোকে খাজনা দিয়ে গেছে। তার সঙ্গে মামলা। করলে কে?

মিয়া বলেছিলেন—কে করবে মশায়! করছে নিজের ব্যাটা-জামাই। ঘরের ভেঁকি কুমির হল মশায়—তাই তো বাঁচবার লাগি এসেছি আপনার কাছে। ডান অঙ্গটা না থাকলে লড়ি, ঠেকাই কী করে?

—কাজটা যে আপনি ভাল করেন নি মিয়া সাহেব; উচিত হয় নি আপনার। মশায় সম্ভ্রমের সঙ্গেই বলেছিলেন কথাটা।

মিয়া সাহেব বছর পাঁচেক আগে নতুন বিবাহ করেছেন। উপযুক্ত ছেলে তিনটিমেয়ে জামাই নাতি নাতনী, বৃদ্ধা দুই পত্নী থাকতে হঠাৎ বিবাহ করে বসেছেন এক তরুণীকে। এবং সে তরুণীটি মিয়া বংশের ঘরের যোগ্য বংশের কন্যা নয়। স্ত্রী-পুত্রদের পৃথক করে দিয়ে সম্পত্তি ভাগ করে দিয়ে পৃথক সংসার পেতেছেন। একটি সন্তানও হয়েছে। এখন ছেলেরা শরিক হয়ে মামলা বাঁধিয়েছে। এদিকে মিয়া সাহেবের দক্ষিণ অঙ্গ পঙ্গু হয়ে পড়েছে।

মিয়া সাহেব একটা দীর্ঘনিশ্বাস ফেলে বলেছিলেন, হাঁ, ইকালে কাজটা নিন্দার বটে, তবে মশায় আপনিও সিকালের লোক, আমিও তাই। আমাদের কালের মানুষের কাছে কি পঞ্চান্ন ষাট বয়সটা একটা বয়স?

একটু চুপ করে থেকে আবার বলেছিলেন-কারেই বা বলি ই কথা! আপন-বয়সী ইয়ারবন্ধু ছাড়া বলিই বা কী করে! মশায়, প্রথম যখন কাঁচা উমর আমারষোল-সতের বছর উমর,–তখুন—সেই কাঁচা নজরে মহব্বত হয়েছিল এক চাষীর কন্যের সঙ্গে। আমার দিল দেওয়ানা হয়ে গেছিল তার তরে। ধরেছিলাম-উয়াকেই শাদি করব। বাপ রেগে আগুন হলেন। আপনি তো জানেন আমাদের বংশে বাদী কি রক্ষিত রাখা নিষেধ আছে। নইলে না হয় তাই রেখে দিতেন। আমি গো ধরলাম। বাবা শেষমেশ আমাকে লুকায়ে সেই কন্যের শাদি দিয়া পাঠায়ে দিলেন—এক্কেরে দুটো জেলার পারে। আমাদেরই এক মহলে, পত্তনিদারের এলাকায়। মশায়, এতকাল পরে হঠাৎ একদিন নজরে পড়ল—এক কন্যে; ঠিক তেমুনি চেহারা–যেন সেই কন্যে নতুন জোয়ানি নিয়ে ফিরে এসেছে। লোকে অবিশ্যি তা দেখে না। তা দেখবে কী করে বলেন? আমার অ্যাঁখ দিয়া তো দেখে না! তাই ভাই, মেয়েটাকে নিকা না করে পারলাম না।

মশায় একটু হেসেছিলেন।

মিয়া সাহেব বলেছিলেন আপনিও হাসছেন গো মশায়? তবে আপনারে বলি আমি শুনেন। ই শান্দি করে আমি সুখী হয়েছি। হ্যাঁ। মনে হয়েছে কি দুনিয়াতে যা পাবার সব আমি পেয়েছি। হাঁ। দুঃখ শুধু আয়ু ফুরায়ে আসছে; দেহখানা পঙ্গু হয়ে গেল; মেয়েটাকে দুনিয়ার মার থেকে বাঁচাতে পারছি না।

তাঁর চোখমুখের সে দীপ্তি দেখে মশায় বিস্মিত হয়ে গিয়েছিলেন। বৃদ্ধের চোখ দুটো জ্বলজ্বল করে জ্বলে উঠেছিল। মনে হয়েছিল তার সমস্ত অন্তরটা যেন প্ৰবল আবেগে ওই দুটো চোখের জানালায় এসে দাঁড়িয়েছে, বলছে দেখ, সত্য না মিথ্যা—দেখ!

মিয়া সাহেব বলেছিলেন—মশায়, আমি বলি কি, আপনি আমারে দেখেন—তারপর আমার নসিব। বুঝলেন না?

কম্পিত ডান হাতখানা তোলবার চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়ে বাঁ হাতের আঙুল কপালে ঠেকিয়ে বলেছিলেন ইটাকে লঙ্ন করবার ক্ষমতা কারুর নাই। সে যা হয় হবে। ইয়ার লেগে এত ভাবছেন কেন আপনি মশায়? যিনি যক্ষ্মার মতুন ব্যামো ভাল করতি পারেন তিনি যদি এই একটা সামান্য ব্যাধি সারাবারে না পারেন—তবে দোষটা আপনারে কেউ দিবে না, দিবে আমার নসিবের লিখনকে।

মশায় সেকথা শুনেও যেন বুঝতে পারেন নি।

তিনি চলে গিয়েছিলেন দূর অতীতকালে। অন্তরের মধ্যে কোথায় লুকানো গোপন আগুনের অ্যাঁচ অনুভব করছিলেন; অতি ক্ষীণ ধোঁয়ার গন্ধ পাচ্ছিলেন যেন; চোখ যেন জ্বালা করছিল। সত্য সত্যই তার চোখে জল এসেছিল। মনে পড়েছিল মঞ্জরীর কথা।

মিয়ার চোখ এড়ায় নি। তিনি বলেছিলেন ইয়ারই তরে আপনার বংশকে বলে মশায়ের বংশ, ইয়ারই তরে লোকে আপনারে চায়। রোগীর দুঃখ-দরদে যে হাকিমের চোখে জল আসে–সেই ধন্বন্তরি গো!

মশায় মুহূর্তে সংবিৎ ফিরে পেয়েছিলেন; চোখ মুছে মনে মনে ইষ্টদেবতাকে স্মরণ করেছিলেন। মিয়া সাহেবের চিকিৎসার ভারও নিয়েছিলেন তাঁকেই স্মরণ করে। বলেছিলেন তাই হবে মিয়া সাহেব। চিকিৎসা আমি করব। আপনার ভাগ্য আর ভগবানের দয়া। আমার যতটুকু সাধ্য। কই দেখি আগে আপনার হাতখানি।

নিজেই তুলে নিয়েছিলেন তাঁর হাতখানি।

সেই হয়েছিল আবার শুরু।

প্রবাদ রটেছিল—পাঁচ বৎসর ঘরে বসে মশায় বাকসিদ্ধ হয়েছেন। মশায় যার নাড়ি ধরে বলেন-বাঁচবে, মরণ তার শিয়রে এসে দাঁড়িয়ে থাকলেও ফিরে যায়। আর যাকে বলেন বাঁচবে না—সেখানে আপনপুরে মরণের টনক নড়ে; সে মুহূর্তে এসে রোগীর শিয়রে দাঁড়ায়।

বৃদ্ধ মিয়া সাহেবের হাত ধরেই তিনি চমকে উঠেছিলেন। মৃত্যুলক্ষণ তিনি স্পষ্ট অনুভব করেছিলেন। ধীরভাবে ধ্যানস্থের মত অনুভব করে তিনি দীর্ঘনিশ্বাস ফেলে বলেছিলেন বিষয় নিয়ে মামলায় আপনি বিব্রত বলছিলেন। মামলা আপনি মিটিয়ে ফেলুন মিয়া সাহেব। মামলা চালাবার সময় আপনার হবে না। একশো আশি দিন। ছ মাস।

—ছ মাস? মামলা মিটায়ে ফেলব?

–আমি তাই পেলাম।

পাঁচ মাসের শেষ দিনে মিয়া সাহেব দেহ রেখেছিলেন। মশায়ের নিজেরও যেন বিস্ময় মনে হয়েছিল। এত স্পষ্ট এবং এমন অঙ্কফলের মত ধারণা এর আগে ঠিক হত না। যে পিঙ্গলকেশীকে ঘরে বসে চিন্তা করে, ধ্যান করে বিন্দুমাত্র আভাসেও পান নি, তাকে তার চিকিৎসাসাধনার মধ্যে বিচিত্রভাবে অনুভব করছেন। নাড়ির স্পন্দনের মধ্যে, লক্ষণের মধ্যে, রোগীর গায়ের গন্ধের মধ্যে, তার উপসর্গের মধ্যে, গাত্রবর্ণের মধ্যে, এমনকি আঙুলের প্রান্তভাগের লক্ষণের মধ্যে সেই পিঙ্গলকেশীর অস্তিত্ব অনুভব করতে পারছেন। মধ্যে মধ্যে আরও বিচিত্র অনুভূতি তাঁর হয় এবং হয়েছে। আজই অতসীর ছেলের কাছে বসে বার বার অনুভব করেছেন। তার অশরীরী অস্তিত্ব দরজার মুখ থেকে পা-পা করে এগিয়ে আসছে মনে হয়েছে। আবার পিছিয়ে চলে যাওয়াও স্পষ্ট অনুভব করেছেন। রিপুপ্রভাবমুক্ত নিস্পাপ শিশু বলেই সে ওষুধের ক্রিয়া মেনে ফিরে গেল। কিন্তু প্রদ্যোত বীর সাহসী যোদ্ধা। বীরের মত যুদ্ধ করেছে। অস্ত্রও তেমনি অদ্ভুত শক্তিশালী। অদ্ভুত!

নিজের জীবনে আক্ষেপ থেকে গেল, ডাক্তারি পড়া তাঁর হয় নি। হলে—এ বয়সেও এ অস্ত্র নিয়ে ব্যাধির সঙ্গে সগ্রাম করতেন তিনি। হয় নি এক সর্বনাশীর জন্য।

একটা দীর্ঘনিশ্বাস ফেলে নিজেকেই নিজে বললেন–থাক, আর না।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *