1 of 2

২৯. জাপানিরা আসছে

জাপানিরা আসছে, জাপানিরা আসছে এই রব উঠে গিয়েছিল চতুর্দিকে। মালয়, সিঙ্গাপুরে জাপানিরা যে কী বীভৎস অত্যাচার চালাচ্ছে ব্রিটিশ সংবাদপত্রগুলিতে তার রগরগে বর্ণনায় সাধারণ মানুষের মনে দারুণ আতঙ্ক। অবশেষে সত্যিই একদিন। জাপানিরা এল। রাতের অন্ধকারে কয়েকখানা জাপ বোমারু বিমান উড়ে এসে দুটো মাঝারি সাইজের বোমা ফেলে চলে গেল। সেই বোমা বর্ষণের মধ্যে কোনও রকম। উদ্দেশ্য বা পরিকল্পনা আছে বলেও মনে হয় না–এমনিই যেন খেলাচ্ছলে একটু রঙ্গ করে যাওয়া।

বোমাদুটো পড়ল হাতিবাগান বাজারে এবং দর্জিপাড়ার ভড় লেনের একটি বাড়িতে। কলকাতার এত ভালো ভালো জায়গা থাকতে ওই রকম সাদামাটা জায়গায় বোমা ফেলার কী মানে হয় কেউ বুঝল না। অনেকে বলাবলি করতে লাগল, টার্গেট ভুল হয়েছে। কিন্তু দুর্ধর্ষ জাপ বৈমানিকরা এমন কাঁচা ভুল করবে, তা-ও ঠিক বিশ্বাস করা যায় না। বোমাবর্ষণে হতাহত অতি সামান্য। হাতিবাগান বাজারের কাছাকাছি তখন একটি মোষের খাটাল ছিল। গুটি পঞ্চাশেক মোষের মাঝখানে আচমকা বোমা পড়ায় তাদের অসম্ভব বিমূঢ় চিৎকার শোনা গেছে বহু দূর থেকে। বোমার আওয়াজের চেয়েও অতগুলি মুমূর্ষ মহিষের কাতরানির আওয়াজ স্থানীয় লোকদের মনে গেঁথে গিয়েছিল অনেক দিনের জন্য।

কলকাতায় এর আগে থেকেই সাইরেন বাজে। সকালে, দুপুরে, সন্ধ্যায়–কোনও সময়-অসময় নেই। সাইরেন বাজলেই বাড়ির সব লোক দুদ্দাড় করে এসে একতলার ঘরে কিংবা সিঁড়ির নীচে এসে জমায়েত হয়। কেউ কেউ গয়নার বাক্স নিয়ে আসে– অল ক্লিয়ার নাবাজা পর্যন্ত প্রাণ ও গয়নার বাক্স হাতের মুঠোয়। রাস্তায় রাস্তায় তৈরি হয়ে গেছে ব্যাফল ওয়াল বা বিফল প্রাচীর। শ্যামপুকুরের মাঠে ট্রেঞ্চ কাটা হয়েছে। এইসব প্রস্তুতিই মানুষের মনে ভীতি জাগায়–যুদ্ধ চলবে এক বিদেশি শক্তির সঙ্গে আর এক বিদেশি শক্তির–ভারতবাসীর পক্ষে এই যুদ্ধে প্রাণ দেওয়ার মধ্যেও কোনও গৌরব নেই। সত্যি সত্যি বোমা পড়ার পর কলকাতার লোক দলে দলে পালাতে শুরু করল।

সারা দিন ধরে ট্যাক্সি, রিকশা, ঘোড়াগাড়ি, ঠেলাগাড়ি বোঝাই মানুষজন যাচ্ছে। শিয়ালদা আর হাওড়া স্টেশনের দিকে। হাওড়া স্টেশনের দিকেই বেশি ভিড়। যানবাহনের রেট হল আকাশছোঁয়া। মৃত্যুভয় পাওয়া মানুষ যে কত স্বার্থপর ও নীচ হয়, তা বোঝা যায় এই সময়। ঠেলাঠেলি, মারামারি, রুণ, শিশু, বৃদ্ধ কিংবা মহিলার প্রতি কোনও দাক্ষিণ্য নেই-সবাই আগে যেতে চায়–এ-ওর ঘাড়ের ওপর দিয়ে, এ-ওকে মাড়িয়ে আগে যাবে। প্রতিদিন ভিড়ের চাপে দু-এক জন মারা যায়।

সিরাজদ্দৌল্লার কলকাতা আক্রমণের পর, জাপানিদের আক্রমণ আশঙ্কায় এই দ্বিতীয় বার কলকাতার নাগরিকদের শহর থেকে পলায়ন। কলকাতায় সাধারণত বাইরে থেকে অনবরত লোকজন আসে, কলকাতার লোক দলবেঁধে কখনও এমন ভাবে শহর ছাড়ে না–তাই এ-দৃশ্য অনেকের কাছেই অভূতপূর্ব। শহর ছেড়ে যারা গেল, তারাও অন্য শহরে আশ্রয় নেবার বদলে ছড়িয়ে পড়ল গ্রাম দেশে। বিদেশি সৈন্য এসে গেলে শহরের বদলে গ্রামাঞ্চলই অপেক্ষাকৃত নিরাপদ। বহু গ্রামে এই প্রথম দেখা গেল হাতে ঘড়ি ও পকেটে ফাউন্টেন পেন-গোঁজা বাবুদের। বেণী-ঝোলানো তরুণীরা হিলতোলা জুতো পরে হাঁটে কঁচা রাস্তায়। অনেক গ্রামে এই প্রথম শোনা গেল কলের গান। পেঁয়ো নদীর পাশে বসে সপ্রতিভ চেহারায় শহুরে যুবক গেয়ে ওঠে পঙ্কজ মল্লিকের সুরে মুক্তি সিনেমার গান, দিনের শেষে ঘুমের দেশে ঘোমটা-পরা ওই ছায়া ভুলাল রে, ভুলাল মোর প্রাণ!’ কলকাতার প্রাচীন বাসিন্দারা তাদের তিন-চার পুরুষ আগে যে-গ্রাম থেকে এসেছিল, সেই গ্রামে গিয়ে আশ্রয় নিল। বাঙালরা ফিরে গেল বাঙালদের দেশে।

ও-দিকে তখন লন্ডনে প্রতিদিন বোমাবর্ষণে ধ্বংস হচ্ছে পাড়ার পর পাড়া। চার্চিল তবু নাগরিকদের শান্ত থাকতে বলছেন। সেই সময় শোনা গিয়েছিল তার বিখ্যাত সাহসোক্তি, ‘উই শ্যাল ফাঁইট ইন দা হাউজেজ, উই শ্যাল ফাঁইট ইন দ্য স্ট্রিটস। জোসেফ স্ট্যালিনের ছেলে নাৎসিদের হাতে ধরা পড়ে হিটলারের কনসেনট্রেশান ক্যাম্পে নির্যাতিত হচ্ছে– এই খবর রটে গেল। ছেলেকে মুক্ত করার প্রসঙ্গ উত্থাপিত হলে স্ট্যালিন বললেন, আমার হাজার হাজার লক্ষ লক্ষ ছেলে রাশিয়ার জন্য লড়াই করছে–এখন একটা ছেলের জন্য চিন্তা করার সময় নেই। এদিকে আমেরিকার সরকার এবং ব্রিটেনের লেবার পার্টির চাপে ভারতের নেতাদের সঙ্গে একটা কিছু বোঝাঁপড়ার জন্য ক্রিপস মিশন এসেছে দিল্লিতে। ভারতীয় নেতারা দর কষাকষি করছেন যুদ্ধ শেষ হলে কতটুকু ক্ষমতা হস্তান্তরিত হবে। জাপানিদের জয় সম্পর্কে অনেকটা বোধহয় নিশ্চিন্ত হয়েই গান্ধীজি ব্রিটিশ মিশনের উদ্দেশে মন্তব্য করলেন, “একটা ফেল পড়া ব্যাঙ্কের পোস্ট ডেটেড চেক নিয়ে কী লাভ?” আর সুভাষবাবু বিদেশে বন্দি ভারতীয় সৈন্য ও প্রবাসী ভারতীয়দের নিয়ে একটা সৈন্যবাহিনী গড়ে তুলছেন।

রেণুদের বাড়ি হাতিবাগানের খুব কাছে। বোমা পড়ার পরদিনই সকালে বাদল সেখানে ছুটে গেল। হাতিবাগানের ধারে কাছে যাওয়া যায় না এত অসংখ্য মানুষের ভিড়–তা ছাড়া পুলিশ ঘিরে আছে সম্পূর্ণ বাজারটা। রেণুদের বাড়ির সবাই ছাদে উঠে দেখছে, বাদলও চলে এল ছাদে। উত্তেজনা আর গল্পের শেষ নেই। বোমা পড়ার সময় সবাই ঘুমিয়ে ছিল, প্রচণ্ড শব্দে জেগে উঠে প্রথমটায় কেউ কিছু বুঝতে পারেনি। সারা বাড়ি কেঁপে উঠেছিল, সবাই প্রথমে ভেবেছিল ভূমিকম্প। একমাত্র সুপ্রকাশই দাবি করছে যে সে বোমা পড়া স্বচক্ষে দেখেছে।

সুপ্রকাশ বোধহয় একশো বার বলেছে এই গল্প–তবু তার ক্লান্তি নেই। ঘুম আসছিল না বলে সুপ্রকাশ তখন পঁড়িয়ে ছিল বারান্দায়। অল্প অল্প মেঘলা আকাশ, বেশ ঠান্ডা হাওয়া দিচ্ছিল। সুপ্রকাশ গুণ গুণ করে গান গাইছিল–এমন সময় প্লেনের শব্দ পাওয়া গেল। সাইরেন বাজেনি বলে সুপ্রকাশের কোনও সন্দেহ হয়নি। সে মনে করেছে মিত্র। বাহিনীর প্লেন। দু’খানা প্লেন পাশাপাশি, খুব নিচু হয়ে এল, তার পরেই বিদ্যুৎ চমকাবার মতন আকাশে চড়াৎ করে উঠল নীল আলো। সে রকম অসম্ভব উজ্জ্বল নীল আলো কেউ কখনও দেখেনি, ঠিক যেন নীল আগুন। কিছু না বুঝেই সুপ্রকাশ মাটিতে শুয়ে পড়েছে, তার পরেই শব্দ–পর পর দুটো। মোষের চিৎকার শুনে তার মনে হয়েছিল, পৃথিবী ফুটো হয়ে নরকের একটা টুকরো ওপরে উঠে এসেছে।

সুপ্রকাশের কাহিনী বড়রা সকলে পুরোপুরি বিশ্বাস করেনি, বিশেষত নীল আলোর ব্যাপারে অনেকেই সন্দেহ প্রকাশ করল। বোমা নীচে পড়ে ফাটবার আগেই আলো জ্বলবে কী করে? তবে এ ব্যাপারে সকলেরই অভিজ্ঞতা শূন্য বলেই কারওর আপত্তিই তেমন জোরালো নয়।

বিষ্ণু বাদলকে বলল, সপ্লিন্টার দেখেছিস?

বাদল অবাক হয়ে বলল, কী? দেখিনি তো?

বিষ্ণু তাকে সাধারণ ব্লেডের দ্বিগুণ সাইজের দু’খানা চকচকে ইস্পাতের ফলা দেখাল। তাদের ছাদে এসে পড়েছে কাল। আশেপাশের অনেক বাড়িতেই এ রকম পাওয়া গেছে। বোমার মধ্যে এ রকম জিনিস থাকে, বিশ্বাসই করা যায় না।

বিষ্ণু বলল, তুই কামানের মুখে নানকিং’ পড়িসনি? তাইতে সপ্লিন্টারের কথা আছে। এই জন্যই তো বমবিংয়ের সময় মাটিতে মুখ চেপে শুয়ে পড়তে হয়-নইলে অনেকেই এইগুলো লেগেই মারা যায়।

বাদলের আপশোস হল, তাদের বাড়িটা বিবেকানন্দ রোডে না হয়ে হাতিবাগানের কাছে কেন হল না। সে কিছুই টের পেল না বোমা পড়ার। তাদের বাড়ির কাছে এ রকম হলে সে নিশ্চয়ই সুপ্রকাশদার মতন জেগে থেকে সবকিছু দেখত।

বড়দের মুখে চিন্তায় ছায়া। বাড়ির বাচ্চারা বোমা পড়ার ঘটনায় দারুণ উৎসাহিত। তারা এরোপ্লেন সেজে সারা বাড়ি ছোটাছুটি করছে আর মুখ দিয়ে আওয়াজ করছে বুম্ বু। বিষ্ণু বাঁ হাতের বুড়ো আঙুল ডান হাতের তর্জনি দিয়ে আঁকড়ে বন্দুক বানিয়ে গুলি ছুড়ছে ক্র্যাক, ক্র্যাক, ক্র্যাক।

রেণু লাফাতে লাফাতে এসে বাদলকে বলল, এই জানিস, কালকে আমরা চলে যাচ্ছি।

বাদল জিজ্ঞেস করল, কোথায়? মসলানন্দপুরে। সেখানে দিদিমা আছে। বিষ্ণু হেসে ফেলে বলল, এই, আবার মসলানন্দ বলছিস! রেণুটা এখনও ভালো করে কথা বলতে শিখল না। ঠিক করে বল, মছলন্দপুর।

বাদল বলল, সে আবার কোথায়?

ওখানে রেণুদের মামার বাড়ির দেশ। রেণুরা কাল চলে যাবে।

রেণু বলল, ওখানে নদী আছে, পুকুর আছে, দাদা পুকুরে মাছ ধরবে, গোরু আছে—

রেণুর চোখেমুখে দারুণ খুশি। আজকাল আর রেণু অসুখে ভোগে না, স্বাস্থ্য বেশ ভালো হয়েছে, গড়গড় করে বাংলা পড়তে পারে।

বাদল বলল, বিষ্ণু, তোরা ওখানে যাবি না?

আমরা যাব অন্য জায়গায়। আমরা রবিবার দিন চলে যাব ভাগলপুরে-ওখানে আমাদের একটা বাড়ি আছে।

বিষ্ণুদের বাড়ি আছে বিভিন্ন জায়গায়। ওদের কোনও অসুবিধে নেই। এই ভয়ের মধ্যে কলকাতায় থাকতে যাবে কেন। বাদলের মনটা খারাপ হয়ে গেল। রেণু, বিষ্ণু–এরা সবাই চলে গেলে সে একা একা কী করবে? সূর্যদাও তো নেই।

বিষ্ণু বলল, জীমূতরাও যাবে আমাদের সঙ্গে। বেশ মজা হবে। ভাগলপুরের কাছেই পাহাড় আছে।

রেণু বলল, মসলানন্দপুর ভাগলপুরের চেয়েও অনেক ভালো। আমরা বেশি ভালো জায়গায় যাচ্ছি।

বাদল বিষ্ণুকে বলল, এই, তোদের সঙ্গে আমাকে নিয়ে যাবি?

বিষ্ণু রেগে গিয়ে বলল, বাজে কথা বলিস না! নিয়ে গেলেও তো তুই যাবি না। সেবার দার্জিলিং যাবার কথা এত করে বললুম, তোর মা তো যেতে দিলেন না কিছুতেই।

বাদল একটুক্ষণ অন্যমনস্ক হয়ে গেল। বাবাকে রাজি করানো সত্যিই শক্ত। তাকে একলা একলাই এখানে থাকতে হবে। কলকাতায় তার আর কোনও বন্ধু রইল না। জাপানিরা এসে পড়ে তাকে বন্দি করে নিয়ে গেলে বেশ হয়।

মনখারাপ ভাবটা কাটাবার জন্য বাদল বলল, যা না তোরা চলে যা। তোরা তো যুদ্ধ। দেখতে পাবি না। আমি সব দেখব।

রেণু বলল, মাথায় বোমা পড়ে বেশ অক্কা পাবি!

অত সহজ নয়। একতলার ঘরে থাকব। জাপানিরা এসে পড়লে একটু একটু জানলা খুলে–জাপানিদের হাতে যখন সাহেবরা মার খাবে–তখন যা মজা লাগবে!

সাহেবরা তো বড় বড় আর জাপানিরা তো ছোট ছোট–ওরা মারতে পারবে?

কলকাতায় তখন মার্কিন সৈন্যদেরও দেখা যায়। ইংরেজদের থেকে এদের চেহারায় আলাদা বৈশিষ্ট্য চোখ এড়ায় না। এরা প্রত্যেকেই লম্বা-চওড়া জোয়ান, মুখের রং লালচে ধরনের। অনেক সময় এরা খালি গায়েও ঘুরে বেড়ায় কলকাতায় আগে কখনও সাহেবদের এ রকম খালি গায়ে ঘুরতে দেখা যায়নি। ভিখিরি দেখলে এরা দরাজ হাতে ছড়িয়ে দেয় মুঠো মুঠো খুচরো পয়সা। পঙ্গপালের মতন ভিখিরিরা এদের হেঁকে ধরে ‘আমরিকি রাজাসাব, আমরিকি রাজাসাব’ বলে চাচায়। কখনও কখনও এইসব আমেরিকান সৈন্যরা কোনও বাচ্চা ভিখিরিকে আদর করে কোলেও তুলে নেয়। আশ্চর্য জাত এরা।

বিস্ময়ের ওপর বিস্ময়, এই আমেরিকানদের মধ্যে আছে কিছু কিছু নিগ্রো সৈন্য। সেই দৈত্যাকার নিগ্রোদের দেখলে রাস্তার ছেলেমেয়েরা হাঁ করে চেয়ে থাকে। একসময় হাবসি খোঁজারা ভারতবর্ষে রাজত্ব পর্যন্ত করে গেছে কিন্তু তার কোনও স্মৃতি নেই। সবার চোখেই নিগ্রোদের বিচিত্র নতুন মানুষ বলে মনে হয়।

বাদল বাড়ি ফিরে শুনল, তাদের বাড়িতেও কলকাতা-ত্যাগ বিষয়ে আলোচনা হচ্ছে। বড়বাবু এর একেবারে বিপক্ষে। তাঁর মতে, সাধারণ মানুষ এ রকম প্যানিক সৃষ্টি করে কিন্তু এখনও সে রকম ভয় পাবার মতন কিছু ঘটেনি।

চিররঞ্জন কিন্তু বেশ উদ্বিগ্ন। তিনি বললেন, কিন্তু কলকাতায় যে ভাবে জিনিসপত্রের দাম বাড়ছে, তাতে এখানে আর থাকা যাবে কী করে? আজ বাজারে দেখলাম, সাধারণ ভেড়ির ট্যাংরা–তাও একটাকা বারোআনা সের? ট্যাংরামাছও কি যুদ্ধে যাচ্ছে নাকি?

বড়বাবু বললেন, রোসো, রোসো–আরও কিছু লোক কলকাতা ছেড়ে চলে যাক– তারপর জিনিসপত্রের দাম আবার সস্তা হবে। তখন আমরা আরাম করে থাকব।

শিগগিরই নাকি কনসক্রিপশান হবে, সেটা শুনেছেন?

তাতে তোমার আমার ভয়টা কী? আমাদের মতন বুড়োদের তো আর নেবে না। তোমার ছেলেও ছোট।

সূর্য?

সূয্যিকে ওরা পাচ্ছে কোথায়? সূয্যি ইংরেজের হয়ে লড়াই করার বদলে বরং আত্মহত্যা করবে। ও বড় জেদি ছেলে।

চিররঞ্জন একটুক্ষণ চুপ করে রইলেন। তারপর বললেন, আপনি টের পেয়েছেন যে সূর্য টেররিস্টদের দলে গিয়ে ভিড়েছে? আমিও একটু একটু আন্দাজ করেছিলাম।

ও নিজে আমাকে বলেছে। ও তো মিথ্যে কথা বলায় তেমন পারদর্শী নয়–একদিন একটু জেরা করতেই বেরিয়ে পড়েছে।

ও কোথায় আছে আপনি জানেন?

না জানাই তো ভালো। পুলিশ আমাকে ধরে বেশি চাপ দিলে যদি বলে ফেলি? না জানলে বলতেও পারব না।

বড়বাবু আপনি এ রকম নিশ্চিন্ত থাকেন কী করে? আপনার একটা মাত্র ছেলে—

আমিও আমার মায়ের একটা মাত্র ছেলে ছিলাম। আমাকে নিয়ে কেউ কখনও মাথা ঘামায়নি।

চিররঞ্জন দোনামনা করলেও হিমানী কিন্তু কলকাতা ছাড়তে একেবারে বদ্ধপরিকর। হিমানী অবিলম্বে বাপেরবাড়ি চলে যেতে চান–এবং চিররঞ্জনকে সঙ্গে নিয়ে। তার বাবাও বার বার চিঠি লিখছেন। হিমানীর বাপেরবাড়ি বেশ সঙ্গতিপন্ন, সেখানে গিয়ে আশ্রয় নেবার কোনও অসুবিধে নেই।

চিররঞ্জন আমতা আমতা করে বললেন, বড়বাবু কোথাও যেতে চাইছেন না–ওঁকে ফেলে আমি চলে যাই কী করে?

হিমানী বললেন, উনি একলা মানুষ, ওঁর কোনও চিন্তা নেই। ওঁর জন্য তোমাকে ভাবতে হবে না।

দাদাও তো থেকে যাচ্ছেন। বউদিকে পাঠিয়ে দিচ্ছেন শুধু।

তোমার দাদাকে ব্যবসা দেখতে হবে। তোমার কী দেখার আছে? বাবা লিখছেন, ওখানে গেলে তোমার কাজকর্মের একটা কিছু ব্যবস্থা হয়ে যাবে।

তা বলে শ্বশুরবাড়িতে গিয়ে কদ্দিন থাকব!

এটাই বা তোমার কোন নিজের বাড়ি?

চিররঞ্জন মাথা চুলকোতে চুলকোতে বললেন, আচ্ছা দেখি। আরও দু-চার দিন যাক না।

হিমানী তখন থেকেই জিনিসপত্তর বাঁধাছাদা শুরু করলেন।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *