জরিপকারদের কার্রবাই
জরিপের জন্য টানা হল লকির। আর জরিপের লোকেরা গেল হদ্দ ঠিক করতে। শুরুতে জরিপের এই কাজ করান হত আংরেজ অ্যাসিস্ট্যান্টদের দিয়ে। পরে হুজুররা শোচ বিচার করে দেখলেন ওই একই কাজ অনেক কম খরচে হবে যদি কাজে বহাল করা হয় দেশি কারপরদাজদের। সাহেব অ্যাসিস্ট্যান্টদের মাহিনা মাসে ১৫০ থেকে ২০০ টাকা সেখানে এদের ২০ থেকে ২৫ টাকা ঠেকালেই চলবে। এই রকম চমকদার ইজাদ১ এখানেই থেমে থাকল না। হালফিল যিনি গভর্নর জেনারেল হয়েছেন সেই লর্ড উইলিয়াম বেনটিঙ্ক এলাহাবাদে রেভেনিউ সার্ভেয়ারদের এক সভা ডাকলেন। সভায় ঠিক হল এই আজমাইশি কাজ দেশি কারপরদাজদের হাতেই ছেড়ে দেওয়া হবে, সাহেবরা করবে স্রেফ নজরদারি। দেশি লোক-লস্করদের তালিম দিতে কিছু ওয়াক্ত লাগল ঠিকই কিন্তু আখেরে তারা কাজটা শিখে গেল। তারপর যেমন ভাবা হয়েছিল তেমন জলদি জলদি চলতে লাগল কাজ। নতুন করে যারা বহাল হয়েছিল তাদের আবার কোন কাজটা ঠিক আর কোন কাজটা ভুল তাই নিয়ে ছিল আজব আজব সব ভাবনা। তাই কেউ কেউ আবার সে সবের ফয়দা নিতে শুরু করল। টিন্ডলদের আমদানির রাস্তা বন্ধ হল। সেই জায়গা দখল করল আরও বড় সব ওস্তাদেরা। লালা সাহেব বা কম্পাসওয়ালারাই হল সেই আমদানির হকদার। আপনারা সওয়াল করাতে পারেন কী ভাবে হত আমদানি? কেন, জরিপের কম্পাসই তো হল সব থেকে সহজ রাস্তা! কাঁটা কতটা ঘুরবে আর কোন দিকে ঘুরবে তা দিয়ে ঠিক হত সবকিছু। গম্ভীর মুখ করে টিন্ডল জানতে চাইত কী হল? খালাসিদেরও ছিল একই সওয়াল। জমিদার আর গ্রামবাসীদের কৌতূহলও কিছু কম হত না। তারা ভিড় জমাতো জরিপের ঔজার (auzar) ঘিরে। শেষে টিন্ডল লালা সাহেবের কাছে জানতে চাইত, সকালে ঔজারের পুজোটা হয়েছে তো? এতে যেন আচমকাই হুঁশ ফিরত লালার। জমিদারের উপর হুকুম হত, কাঁচ ঢাকা কম্পাসের বাক্সর উপর একটা টাকা রাখ। হুকুম তামিল হলেও কাঁটা কিন্তু নড়ত না। হুকুম হত আর একটা রাখ, আরও! আরও! আখেরে টাকা দশেক জমা হলে ফিরে আসত কম্পাসওয়ালার জোশ আর গ্রামবাসী তাজ্জব হয়ে দেখত কেমন ঘুরে গেছে কম্পাসের কাঁটা। জমিদার ধরে নিত পুরোটাই লালার হাতযশ। কম্পাসের এক ঝটকায় ঠিক হয়ে যাবে গ্রামের হদ্দ বাড়বে না কমবে।
কম্পাস নিয়ে বহু মজাদার কিস্সা শোনা যায়। ঔজারটার নাকি এমন তেজ যা কিছু দেখাশোনা যায় সবকিছু পালটে দিতে পারে। দূরবিন দিয়ে কেল্লার অন্দরে উঁকি মারলে সব পরদা ফাঁস হয়ে যায়। তবেই না ফিরিঙ্গিরা এত সহজে কেল্লার দখল নিতে পারত! এই কাজে তাদের না লেগেছিল কেরামতি না কোনও হায়দারি (haidar) হাঁক পাড়তে হয়েছিল। স্রেফ দূরবিনের জোরেই কাম ফত্হে। এক লোচ্চা রাজপুত ছোকরা একবার জানতে চাইল দূরবিন দিয়ে কি ছুঁড়িদের উল্টে দেখা যাবে? আলবাত যাবে, লেকিন কিঁউ? বুঝলে না-আরে! পা উপর মানে ঘাগরা নীচে— ক্যায়া মজা! তার সেই বজ্জাতি ফন্দি চারধারে চাউর হয়ে গেল। এরপর কোনও ছুকরির সঙ্গে কম্পাসওয়ালাদের মোলাকাত হলে সে তুরন্ত বসে যেত মাটিতে, চেপে ধরত ঘাগরা। দূরবিন যেন তাকে বে-আবরু না করে।
হদ্দ জরিপের কাম খতম হলে তো আদমিরা বেরিয়ে পড়ত খেত-খামারের তফসিলে। জমিদার হাত খুলে রিশবত কবুল করলে চাষের জমি হয়ে যেত অনাবাদি বা বনজরিয়া। এমন কায়দায় তখন জমির জাত বিচার চলত যাতে মনে হয় সেই জমিতে চাষ দেওয়া নামুমকিন। সেচের পানি মেলে কী মেলে না সেটাও লেখা হত সেই একই কায়দায়। লেখা হত জমির আশপাশে না আছে ইঁদারা না আছে পানির কোনও বন্দোবস্ত। জমিদার রিশবত ইনকার করলে পালটে যেত তসবির। ঝটপট দাখিল হল উলটো রিপোর্ট। বেড়ে যেত জুমলা (jumla)। অনাবাদি বা বনজরিয়া জমির সঙ্গে চাষ জমির কোনও ফারাক থাকত না। বালি আর মাটি সব বরাবর। জমি মানেই তখন চাষযোগ্য। পানির কোনও ঘাটতি নেই। জলদি মালুম হল, এই রকম তফসিল জরিপ দিয়ে সেটেলমেন্ট অফিসারদের কোনও কাজ হবে না। শুরুতেই কবুল করা ভাল যে আসামিওয়ার (assameewar) বন্দোবস্তে কোনও দাখিলা ছিল না। তারপর হল চাষের জমি। এমন সব মাপ দাখিল হয়েছিল যাতে সরকারের সন্দেহ হল। সে সব খতম করতেই চালু হয় তারিফ লায়েক খুসরা (Khusrah) জরিপ। এটা ছিল একটা আচ্ছা খাসা চাল। আমিনদের উপর কড়া নজরদারি চালালেই তারা ঠিকঠাক কাজ করত। কী ভাবে এই কাজ হত সেটা বলা যাক। আমিনদের আগেই তালিম দেওয়া হয়েছিল। এবার তাদের লোহার শিকল নিয়ে পাঠানো হল, জমির আলাদা আলাদা মাপ আর আঁক কষার জন্য। মাপের শিকলগুলোও আবার মাঝে মাঝে সদর দপ্তরে পরখ করা হত। এইভাবে যে নকশা বানানো হল তার নাম সুজরা (shujrah)। এমন কোনও তফসিল ছিল না যা সুজরাতে দেখান হয়নি। এ ছাড়াও ছিল দাখিলা কেতাব যাকে বলা হত খুশরা (khurash)। এই কেতাবে লেখা ছিল প্রত্যেকটা জমির দাগ নম্বর, কে চাষ করে জমি, সেই জমির কী মাপ তাও আবার এলাকায় বিঘার যে মাপ চালু সেই মোতাবেক, কী দাম হতে পারে সেই জমির, চাষের পানি কোথা থেকে মেলে না হলে কী হয়। তবে জরিপকারকে এখানেও কাজ করতে হত বেঁধে দেওয়া সময়ের ভিতর, যা নামুমকিন। তা ছাড়াও ছিল পুরো সুবায় ছড়িয়ে থাকা হাজারও আমিনের উপর নজরদারি চালান। সেটেলমেন্ট অফিসার আর সার্ভেয়ারদের ভিতর বহু দিন থেকেই ছিল তানাজা (tanaza)। সার্ভেয়ার আমিনরা কী কাজ করছে তার উপর কড়া নজর রাখত সেটেলমেন্ট অফিসারেরা। আখেরে একটা সমঝোতা হয়। সেটেলমেন্ট অফিসারেরা একদল যাচাই পরখকারীকে ছেড়ে দিয়েছিল সার্ভেয়ারদের হেপাজতে যারা সরাসরি সার্ভেয়ারকে রিপোর্ট দাখিল করত। আবার এই লোকেরাই পরখ করত সেটেলমেন্ট অফিসারদের কাছে জমা হওয়া রিপোর্টও। কাজ হত বেআন্দাজি ঢঙে। জমির নকশার উপর মর্জি মাফিক টানা হত লাল দাগ আর সেই দাগানো জমির নথি পরখ করা হত। খোদ জরিপকারও একই ঢঙে কাজটা করতেন। বুঝতেই পারছেন এইভাবে খুশরার কাজ কতটাই বা পরখ করা যায়! জরিপকারদের কাছে এটা কোনও মামুলি ব্যাপার ছিল না। জরিপকারদের দপ্তরে একবার নথিপত্র দাখিল হলে যা সেটেলমেন্ট অফিসের আমিনরা যাচাই করছে দায়টা তখন তাদের। আগের দপ্তরের আর কোনও জিম্মা নেই। খুসরা আমিনরা কী ভাবে কাজ করত এবার তা নিয়ে দু-চার কথা বলি।
খুসরা জরিপ চালু হলে জমি মাপার কাজ হত দড়ি দিয়ে। দড়ি হত কোনও-না-কোনও পাকানো লতা বা চামড়ার ফালি। কারও যদি ইচ্ছে হয় এই রকম কোনও একটা দড়ি দিয়ে জমি মাপবে তা হলে তাকে তাজ্জব হতে হবে। দড়িতে-দড়িতে কত ফারাক। দড়ি শুকনো হলে একমাপ, দড়ি ভিজে থাকলে আর এক। পরখ করার তো সওয়ালই উঠত না। কোনও বড় রকমের হেরফের হলে দোষ হত দড়ির টানা-পোড়েনের। এই রকম সব অজুহাত খতম করতেই চালু হল লোহার শিকল। ঠিক হল শিকলের কতগুলো জোড় থাকবে। বিঘার চালু হিসাব মোতাবেক জমিকে ভাগ করা হল চৌখুপিতে। শিকলের জোড় হবে এই চৌখুপির আধা মাপে। বিঘার হিসাব যাই হোক না কেন চৌখুপি কিছুতেই কুড়ি লুঠ্ঠা (lutthas) বা ডান্ডার বেশি হতে পারে না। তাই শিকলের মাপ ঠিক হল দশ লুঠ্ঠা। মানে দশটা জোড়। জমিদার যেখানে রিশবত কবুল করেছে সেখানে বেড়েছে লুঠ্ঠা পিছু একটা জোড় আর ইনকার করলে একই কায়দায় কমেছে মাপ। এইভাবে এলাকার চাষজমির মাপ থোড়া বহুত বেড়ে কমে গিয়েছিল। রিশবতই যেখানে সব কিছু ঠিক করে সেখানে যাচাই-পরখ, মুহুরি-মুনশি, সার্ভে আর সেটেলমেন্ট দপ্তর কী করবে!
একবার নজরে পড়ে কোনও এক তামাম পরগনার সেচের পানির কথা নথিতে বাদ গেছে। জরিপকার আর সেটেলমেন্ট অফিসাররা চাইলেন মামলা ভাল মতো পরখ করতে। তফসিল করতে পাঠানো হল খাস আদমিদের। সুবাহ হতেই শুরু হল গ্রাম ধরে তল্লাশি। নভেম্বর মাস তাই বর্ষার কোনও সুযোগ নেই। এদিকে রবি ফসল চাষ করতে হলে পানি খুব জরুরি। পানির ধারা নজরে পড়লেও হদিশ মিলল না কোনও ইঁদারার। তাজ্জব কী বাত। পানির ধারা বরাবর চললো তল্লাশি। ধারা যেখানে খতম বা শুরু সেখানে আছে এক বিরাট বাজরার গোলা বা কুর্বি (kurbee)। দুই-তিন করে ধারার পিছু পিছু গিয়ে সেই একই নতিজা। এবার বেদম হয়ে গিয়ে হুকুম হল, হটাও বাজরা। গ্রামবাসী এগিয়ে এল তাদের ঠেকাতে। এই কাজে নওবত১ হতে পারে। তাদের জোরাজুরির মুখে বন্ধ হল না কাজ। বস্তা হটাতেই হদিশ মিলল ইঁদারার। কড়া জরিমানা হল আমিনদের। যাদের যাচাই পরখ করার জিম্মাদারি ছিল তাদের বরখাস্ত করা হল। এই কারবার দেখে সবথেকে নারাজ হয়েছিলেন সেটেলমেন্ট অফিসাররা। তাঁরা পরগনার সব জমিকে সেচের আওতায় বলে রেকর্ড করলেন আর চাপিয়ে দিলেন তার উপর দু-গুণা রাজস্ব।
১. ইজাদ: আবিষ্কার
১. নহবত: বিপজ্জনক, কঠিন পরিস্থিতি