1 of 2

২৯. খবরের কাগজের জন্য একটা প্রবন্ধ

খবরের কাগজের জন্য একটা প্রবন্ধ কালই দিতে হবে, তাই মামুন লিখতে বসেছেন সন্ধেবেলা। কয়েকদিন আগে সন্তোষকুমার ঘোষের সঙ্গে দেখা হয়েছিল একটা পাটিতে, মামুন মাসখানেক কোনো লেখা দেননি বলে তিনি ভর্ৎসনা করেছেন। তিনি মামুনের কাছে বাহান্ন সালের ভাষা আন্দোলনের পটভূমিকার ওপর একটা বড় লেখা চান। ভদ্রলোকের ইতিহাস ও ভূগোল জ্ঞানের পরিচয় পেয়ে মুগ্ধ হয়ে যান মামুন। কোনো বইপত্র না দেখেই তিনি বহু ঐতিহাসিক ঘটনার নিখুঁত সাল তারিখ মুখে মুখে বলে যান গড়গড় করে। ওঁর জন্ম পূর্ব বাংলায়। এখনও সেখানকার প্রতিটি মহকুমা এবং রাস্তাঘাটের এমন বর্ণনা দেন যেন কয়েকদিন আগেই সেখান থেকে ঘুরে এসেছেন! মামুনের আগের লেখাটিতে তিনি দুটি ভুল বার করেছিলেন, সামান্য খুঁটিনাটির ভুল, তবু ভুল তো বটে।

থিয়েটার রোডের অস্থায়ী মুজিবনগরে এখন ঢাকার কিছু কিছু বই ও পত্র-পত্রিকা পাওয়া যায়। মামুন আজ দু’খানা বই নিয়ে এসেছেন, লিখতে লিখতে মামুন বই খুলে মিলিয়ে নিচ্ছেন রেফারেন্স। কিন্তু লেখায় পুরোপুরি মন দিতে পারছেন না তিনি।

ঘরে চেয়ার-টেবিল নেই, মামাকে বিছানায় উপুড় হয়ে শুয়ে লিখতে হয়। পাশের খাটে রেডিও শুনছে মঞ্জু আর হেনা। সন্ধের পর রেডিও শোনা ছাড়া ওদের আর তো কোনো সময় কাটাবার আকর্ষণ নেই, তাই মামুন ওদের রেডিও বন্ধ করতে বলতে পারেন না। মঞ্জু এক একদিন ঢাকায় ফেরার জন্য উতলা হয়ে ওঠে, অথচ ফেরার কোনো উপায়ও যে নেই, তাও বোঝে। এরমধ্যে মামুনকে মিথ্যে করেই বলতে হয়েছে যে ঢাকা থেকে সদ্য আগত দু’জনের মুখে তিনি মঞ্জুর স্বামী বাবুল চৌধুরীর খবর পেয়েছেন, বাবুল ভালো আছে।

মঞ্জু আর হেনা রেডিওর কাঁটা ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে একবার কলকাতার আকাশবাণী আর একবার স্বাধীনবাংলা বেতার কেন্দ্রর অনুষ্ঠান শোনে। আকাশবাণীতে দেবদুলাল বন্দ্যোপাধ্যায় নামে এক ভদ্রলোকের খবর পড়া ওদের প্রতিদিন শোনা চাই-ই। ভদ্রলোকের কণ্ঠস্বরে এমন আবেগ ফুটে ওঠে যে কখনো রক্ত চনমন করে ওঠে, কখনো চোখে জল এসে যায়। মঞ্জুর ছেলে এই ভদ্রলোকের গলা নকল করার চেষ্টা করে।

একটা গান শুনে মামুন অন্যমনস্ক হয়ে গেলেন। আবদুল গাফফার চৌধুরীর লেখা সেই অতি পরিচিত গান, একুশে ফেব্রুয়ারি। হঠাৎ মামুন চমকে উঠলেন, আরে, এই গানটা তো তাঁর কাজে লাগবে! গানটির সব কথা তাঁর মুখস্থ নেই। কিন্তু ভাষা আন্দোলনবিষয়ক লেখাটিতে এই গানটি ব্যবহার করা দরকার।

গানটির শেষ অংশ গাওয়া হচ্ছে, মামুন দ্রুত হাতে লিখে নিতে লাগলেন।

ওদের ঘৃণ্য পদাঘাত এই সারা বাংলার বুকে
ওরা এদেশের নয়
দেশের ভাগ্য ওরা করে বিক্রয়
ওরা মানুষের অন্ন, বস্ত্র, শান্তি নিয়েছে কাড়ি
একুশে ফেব্রুয়ারি, একুশে ফেব্রুয়ারি।

তুমি আজ জাগো, তুমি আজ জাগো একুশে ফেব্রুয়ারি
আজো জালিমের কারাগারে মরে বীর ছেলে বীর নারী
আমার শহীদ ভাইয়ের আত্মা ডাকে
জাগো মানুষের সুপ্ত শক্তি হাটে মাঠে ঘাটে বাঁকে
দারুণ ক্রোধের আগুনে আবার জ্বলিছে ফেব্রুয়ারি
একুশে ফেব্রুয়ারি, একুশে ফেব্রুয়ারি
আমি কি ভুলিতে পারি…

মামুনের মনে পড়লো, গাফফার যখন সেকেণ্ড ইয়ারের ছাত্র, সেই সময় ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের বেড়ে একটি বুলেটবিদ্ধ তরুণের শিয়রে বসে সে এই কবিতাটা লিখেছিল। কতদিন আগেকার কথা, পাকিস্তানের বয়েস তখন মাত্র পাঁচ বছর, সেই সময়ই বাঙালী মুসলমান তরুণসমাজের মনে হয়েছিল, ‘ওরা এ দেশের নয়। মামুন তখন জেলে ছিলেন, শাসকশ্রেণীর প্রতি একটা তিক্ততার বোধ তাঁরও ওষ্ঠে লেগেছিল, কিন্তু পাকিস্তানকে ভাঙার কথা তিনি তখন স্বপ্নেও ভাবেননি। এখন পাকিস্তানকে কে ভাঙতে চাইছে, শেখ মুজিব, বাঙালী উগ্রপন্থী তরুণেরা, না পশ্চিমের অত্যাচারী সামরিক শাসকেরা?

হেনা হঠাৎ চেঁচিয়ে উঠলো, আলু, চরমপত্র! চরমপত্র!

এই অনুষ্ঠানটা মামুনও বাদ দিতে চান না। তিনি কাগজপত্রের ওপর বই চাপা দিয়ে একটা সিগারেট ধরালেন। এই অভিনব অনুষ্ঠানটির তুলনা নেই। চরমপত্র যিনি পড়েন তাঁর নামটি গোপন রাখা হয়, কিন্তু প্রথমদিন শুনেই হেনা-মঞ্জুরা চিনতে পেরেছিল। এম আর আখতার মুকুলের সঙ্গে তাঁরা দেশ ছাড়ার সময় অনেকটা পথ একসঙ্গে এসেছিলেন। এখানেও পার্ক সাকসে বালু হক্কাক লেনে ‘জয় বাংলা পত্রিকা অফিসে মুকুলের সঙ্গে মামুনের দেখা হয়েছে। কয়েকবার। এই দুঃসময়েও তিনি আড্ডায়, হাসি-গল্পে অনেককে মাতিয়ে রাখেন।

“…যা ভাবছিলাম, তাই-ই হইছে, মুক্তিবাহিনীর বিচ্চুগুলার আকা, গাবুর, কেচকা আর গাজুরিয়া মাইর একটুক কইর‍্যা কড়া হইয়া উঠতাছে আর খেইলটা জমছে। এর মাইদ্দে টিক্কা-নিয়াজীর হেই জিনিস খারাপ হইয়া গেছে গা! তাগো তিনটা ডিভিশানের বেস্ট সোলজাররা বাংলাদেশের কেঁদোর মাইদ্দে ঘুমাইয়া পড়ছে। এইদিকে নদার্ন রেনজারস, গিলগিট স্কাউট, লাহোর রেনজারস, পশ্চিম পাকিস্তানী আমর্ড পুলিশ জাগোই ময়দানে নামাইতাছে, তারাই আছাড় খাইতাছে। আইজ কাইল এইগুলা আছাড় খাইলে আর কান্দে না। লগে লগে আগরী দমড়া ছাইড়া দেয়। বাংলাদেশের দখলীকৃত এলাকায় হানাদার সোলজাররা ট্রেনে চাপলে ডিনামাইট, রাস্তায় গেলে মাইন, টাউনে ঘুরলে হ্যান্ড গ্রেনেড আর দরিয়াতে নামলেই খালি চুবানি খাইতে হয়! এইরকম একটা অবস্থায় পড়ায় চাইর মাস যুদ্ধ হওনের পর টিক্কা-নিয়াজী জমা-খরচের হিসাব কইর‍্যা ভিমরী খাইছে। এলায় করি কী?…

খালি কলসের আওয়াজ বেশী। ঠং ঠং কইর‍্যা আওয়াজ হইলো। বাংলাদেশের কেঁদোর মাইদ্দে আড়াই ডিভিশান সোলজার নষ্ট করনের পর ইয়াহিয়া সাব এলায় অতৃকা ইন্ডিয়ার লগে যুদ্ধ করনের ধমক দেখাইছেন। বেড়া এক খান। হেতনে কইছে ইন্ডিয়া যদি বাংলাদেশের কোনো এলাকার দখলী লইতে চায়, তয় যুদ্ধ ঘোষণা কইরা দিমু। হগল দনিয়ারে কইয়া দিতাছি, আমি ইন্ডিয়ার লগে যুদ্ধ করমু। আর আমি একলা নাইক্যা, আমার লগে মামু আছে। চাচা রইছে।

“কেমন বুঝতাছেন? হেতনে জ্ঞান পাগল হইছে…।”

হেনা জিজ্ঞেস করলো, আলু, গাজুরিয়া মাইর’ কী? মামুন হাসলেন। মুকুল সাহেব এমন এমন সব শব্দ ব্যবহার করেন, যার অর্থ তিনিও জানেন না। কিন্তু শুনতে বেশ মজা লাগে। এই চরমপত্র’ শুনলে খানিকটা ভরসাও পাওয়া যায়, মনে। হয়, মুক্তিবাহিনী কোথাও থেমে নেই। একদিন না একদিন তাদের জয় হবেই।

কিন্তু সেই জয় কত দূরে?

মামুন আবার লেখায় মন দিলেন। রেডিওতে এরপর আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালোবাসি’ গানটা শুরু হতেই তাতে গলা মেলালো মঞ্জু।

একটু পরে দরজায় টক টক শব্দ হলো। দরজা বন্ধ নয়, ভেজানো। সুখু গিয়ে দৌড়ে খুলে। দিল। বাইরে থেকে একজন বললো, মামুনভাই, আসতে পারি? আমি শওকত?

মামুন ব্যস্ত হয়ে বললেন, কে? শওকত ওসমান সাহেব? আসেন, আসেন!

লোকটি মুখ বাড়িয়ে বললো, না, আমি মীর শওকত আলী। আপনার ঠিকানা লইলাম কামরুল হাসান সাহেবের কাছ থিকা!

মামুন এবারে চিনলেন। তিনি যখন দিনকাল পত্রিকার সম্পাদক ছিলেন তখন এই মীর শওকত আলী ছিল তাঁর প্রাইভেট সেক্রেটারি। মামুনের চাকরি যাবার পর শওকতও চাকরি ছেড়ে দেয়, তারপর সে চলে গিয়েছিল চিটাগাঙ। ছেলেটিকে মনে রাখবার আর একটি কারণ, সে চমৎকার গান গাইতো।

দেশের যে-কোনো মানুষকে দেখলেই খুশি হবার কথা, কিন্তু মামুন এখন ততটা উৎসাহিত হতে পারলেন না। লেখাটা শেষ হবে কী করে? লেখার মাঝখানে কেউ এসে পড়লে বিরক্তি গোপন করাটাই মুশকিল হয়ে পড়ে।  

খুব পরিচিত ছাড়া অন্য কারকে মামুন বাড়িতে আসতেও বলেন না। একটাই মোটে ঘর, বাইরের লোকরা এসে বসলে মেয়েরা যায় কোথায়? মেয়েদের আব্রু রক্ষা করার একটা ব্যাপার আছে। অনেক সময়, সে রকম কোনো অতিথি এলে মঞ্জু আর হেনা গিয়ে রান্নাঘরে বসে থাকে। রান্নাঘরটা ঘুপচি অন্ধকার মতন, সেখানে কি বেশীক্ষণ বসে থাকা যায়? মঞ্জুর আবার খুব মাকড়সার ভয়! এক একজন অতিথি এমন বে-আক্কেলে হয় যে ঘণ্টার পর ঘণ্টা কেটে গেলেও উঠতে চায় না।

মামুন অপ্রসন্ন ভাবে বললেন, আসো শওকত। কী ব্যাপার কও!

শওকত বললো, মামুনভাই, আমার সাথে একজন ভদ্রলোক আসছেন, আমি তো রাস্তাঘাট চিনি না, এনার নাম পলাশ ভাদুড়ী।

মামুন এবারে খাট থেকে নামলেন। শওকতের সঙ্গে একজন সুদর্শন হিন্দু যুবক এসেছে, এর প্রতি অগ্রাহ্যের ভাব দেখানো যায় না।

মামুন আপ্যায়ন করে বললেন, আসুন, আসুন, ভেতরে আসুন, না, না, জুতা খুলতে হবে না, চেয়ার-টেয়ার কিছু নাই, এই খাটেই বসুন!

মঞ্জু আর হেনা রেডিও বন্ধ করে দেয়ালের দিকে মুখ করে বসেছে। মামুন তাদের দিকে তাকিয়ে বললেন, ওরে হেনা-মঞ্জু, বাসায় মেহমান এসেছে, একটু চা খাওয়াবি না?

অর্থাৎ মঞ্জু-হেনাকে রান্না ঘরে যাওয়ার ইঙ্গিত করলেন মামুন।

শওকত বললো, মামুনভাই, আমি মাত্র তিনদিন আগে আসছি বর্ডার পার হইয়া।

সে যে মাত্র তিনদিন আগে ওপার থেকে এসেছে, সেটাই তার বড় পরিচয়। নতুন কেউ এলেই সবাই তাকে হেঁকে ধরে টাটকা খবর শোনার জন্য। প্রেমের বিরহের চেয়ে দেশত্যাগীদের বিরহও কিছুমাত্র কম তীব্র নয়। বাধ্য হয়ে যারা ভারতে আশ্রয় নিয়ে আছে তারা বাংলাদেশের অভ্যন্তরের খবর জানার জন্য ব্যাকুল। গত সপ্তাহে মঞ্জুর নামে একটি ছেলে আত্মহত্যা করেছে। কারণটি ঠিক জানা না গেলেও অনেকে বলাবলি করছে যে দেশে ফেরার বিষয়ে অনিশ্চয়তার টেনশান সে আর সহ্য করতে পারছিল না।

মামুন অবশ্য তেমন আগ্রহ দেখালেন না, তাঁর লেখাটার চিন্তাই মাথায় ঘুরছে, তিনি বললেন, আগে বসো।

শওকত আর পলাশ ভাদুড়ী প্রায় সমবয়েসী। পলাশ প্যান্ট ও হাওয়াই শার্ট পরা, মুখে ফ্রেঞ্চকাট দাড়ি, চোখ ও ওষ্ঠে কৌতুকমাখা হাসি।

সে হাত জোড় করে নমস্কার জানিয়ে বললো, মামুন সাহেব, আমায় চিনতে পারেননি নিশ্চয়ই? আমি কিন্তু জানতুম না যে আপনারা এখানে থাকেন। শওকত যে ঠিকানা লেখা কাগজটা দেখালো, তাতে সৈয়দ মোজাম্মেল হকের নাম লেখা। আপনার পুরো নাম আমার জানাও ছিল না।

মামুন যুবকটির মুখের দিকে ভালো করে তাকালেন। অপরিচিত হিন্দু নাম সব সময় মনে। থাকে না। এই যুবকটিকে তিনি আগে কখনো দেখেছেন বলেও মনে পড়লো না।

হেনা আর মঞ্জুকে দরজা দিয়ে বাইরে বেরুতে গেলে এদের খাটের পাশ দিয়েই যেতে হবে। পলাশ প্রথমে হেনাকে দেখে বললো, মামুন সাহেব, এই আপনার মেয়ে না? ইস, কত বড় হয়ে গেছে!

তারপর সে মঞ্জুর দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলো, কেমন আছো, মঞ্জু?

মঞ্জু গভীর বিস্ময়ের সঙ্গে এক পলকের জন্য দেখলো পলাশকে। তারপর প্রায় ছুটে বেরিয়ে গেল ঘর থেকে।

পলাশ হেসে বললো, মঞ্জুও আমায় চিনতে পারে নি। মামুন সাহেব, আপনাকে মনে করিয়ে দিই, আমি আমার এক বন্ধু শহীদের সঙ্গে একবার ঢাকায় গিয়েছিলুম, সিকস্টি ফাইভের আগে—

মামুনের মস্তিষ্কে একটা বিদ্যুৎ চমক হলো। সেই পলাশ আর শহীদ! যে-দু’জন যুবককে দেখে মঞ্জু প্রথম কৈশোর ছাড়িয়ে যৌবনে উত্তীর্ণ হয়েছিল, যাদের জন্য মঞ্জু দিনের পর দিন কেঁদেছে।

তিনি বললেন, ও, তুমি সেই পলাশ, সুরঞ্জন ভাদুড়ীর ছেলে? চেহারার অনেক পরিবর্তন হয়েছে, এরকম দাড়িও আগে ছিল না বোধহয়! শহীদ কোথায়?

পলাশ বললো, শহীদ নর্থবেঙ্গলে ওদের চা বাগানে আছে। সামনের সপ্তাহে এসে পড়বে! আমরা কেউ খবরই পাইনি যে আপনারা এখানে আছেন। আমি কালই শহীদকে টেলিফোনে জানাবো। আপনার দিদির বাড়িতে কত মজা করেছি, কত গান বাজনা হয়েছিল।

মামুন বললেন, হাঁ, হ্যাঁ, মনে আছে। দ্যাখো দেখি কী কাণ্ড, মঞ্জু তোমাকে চিনতেই পারে নি! দাঁড়াও।

মামুন তাড়াতালি মঞ্জুকে ডেকে আনতে গেলেন।

তাঁর আরও একটা কথা মনে পড়লো। পলাশ আর শহীদ, এই দু’জনের কোনো একজনের প্রেমে পড়েছিল মঞ্জু। ঠিক কার যে প্রেমে পড়েছিল, তা মঞ্জু খুলে বলেনি, মামুনও নিশ্চিতভাবে বুঝতে পারেননি। ধরেই নেওয়া হয়েছিল যে শহীদের প্রতিই মঞ্জুর দুর্বলতা, শহীদের সঙ্গে মঞ্জুর বিয়ের প্রস্তাবও উঠেছিল, শহীদ রাজি হয়নি। তা হলে কি তখন পলাশকেই ভালোবেসেছিল মঞ্জু? অল্প বয়েসের ব্যাপার, ওতে গুরুত্ব দেবার কিছু নেই, কিন্তু মেয়েরা কি প্রথম প্রেমের কথা ভুলে যেতে পারে?

রান্নাঘরে গিয়ে মামুন মঞ্জুর হাত ধরে রঙ্গ করে বললেন, কী রে মঞ্জু,ঐ ছেলেটিকে চিনতে পারলি না? এক সময় ওদের সাথে কলকাতায় আসবি বলে বায়না তুলে কেঁদে ভাসিয়েছিলি! ওর নাম পলাশ।

মঞ্জু চমকালো না। সে চিনতে পেরেছে ঠিকই। কিন্তু মামুন ধরে টানাটানি করলেও সে ও ঘরে গিয়ে পলাশের সঙ্গে কথা বলতে রাজি নয়। লজ্জায় তার মুখখানা লাল হয়ে গেছে। মামুন প্রায় তাকে একপ্রকার জোর করেই নিয়ে এলেন।

পলাশ খুব স্বাভাবিক ভাবেই বললো, কী মঞ্জু, তোমার বিয়ে হয়ে গেছে বলে আমাদের আর চিনতে পারছে না? এই বুঝি তোমার ছেলে? কী সুন্দর দেখতে হয়েছে ছেলেকে।

শওকত বললো, পলাশদাদা খুব নাম করা গায়ক। আমার সাথে পরশুদিনই একটা ফাংশানে আলাপ হইলো। দ্যাশে থাকতেও ওনার রেকর্ড শুনেছি।

পলাশ বললো, মঞ্জুও তো চমৎকার গান জানে। মঞ্জু, তোমার কোনো রেকর্ড বেরোয় নি!

মঞ্জু মাথা নিচু করে নোখ দিয়ে মেঝে খুঁটতে লাগলো। মামুন বললো, বিয়ের পর ও তো গানের চর্চা একেবারে ছেড়েই দিল!

শওকত বললো, আমরা সিঁড়ি দিয়া ওঠার সময় এই ঘরে গান শুনতে পাইছিলাম। কে গাইছিল?

পলাশ বললো, এখানে বাংলাদেশের জন্য প্রায়ই তো ফাংশন হচ্ছে এখানে সেখানে। সেখানে মঞ্জু গান গাইছে না কেন? আজই তো একটা ফাংশান আছে, এই কাছেই, পার্ক সার্কাস ময়দানে, আমার প্রোগ্রাম আছে সাড়ে আটটায়। চলো, যাবে?

মঞ্জু দু’দিকে মাথা নেড়ে দৌড়ে চলে গেল চা আনতে। মামুন শওকতের দিকে তাকালেন, এবার তিনি শওকতের কথা শুনতে চান।

শওকত চিটাগাঙ শহরে হাঙ্গামা শুরু হবার পর পালিয়ে গিয়েছিল কুমিল্লায়, গ্রামে গিয়েও সুস্থির ভাবে থাকতে পারেনি, তারপর আগরতলা বর্ডার দিয়ে সে ইন্ডিয়ায় ঢুকেছে। শওকতের কাহিনীর মধ্যে অভিনবত্ব কিছু নেই, সকলেরই প্রায় একইরকম অভিজ্ঞতা, গ্রামে আগুন মিলিটারির অত্যাচার, চোখের সামনে প্রিয়জনের মৃত্যু।

কিন্তু শওকত শুধু এসব শোনাবার জন্যই আসেনি। এক জায়গায় থেমে গিয়ে সে হঠাৎ বললো, মামুনভাই, আগরতলায় আলতাফের সাথে দেখা হয়েছিল আমার। সে তো এখন মুক্তিফৌজের কমাণ্ডার।

মামুন অনেকখানি চমকে উঠলেন। আলতাফ? কোন আলতাফ?

শওকত বললো, আমাদের অফিসের সেই জেনারেল ম্যানেজার আলতাফ হাজব্যান্ড বাবুল চৌধুরীর বড় ভাই!

মামুন আবার ভুরু তুললেন। সেই আলতাফ? অল্প বয়েসে যে বিপ্লবের আদর্শে গলা ফাটাতো, একবার মাত্র জেল খেটেই যে পালিয়েছিল জার্মানিতে, ফিরে এসেছিল একটি সুখী, বিলাসী, হ্যাঁপি গো লাকি চরিত্র হয়ে, হোটেলের ব্যবসায় আর পত্রিকার ব্যবসায় যে হয়ে উঠেছিল তার মামা হোসেন সাহেবের এক নম্বর খোসামুদে, আইয়ুব খাঁর আমলে যে ছিল পাকিস্তানী সরকারের স্তাবক, সেই আলতাফ যোগ দিয়েছে মুক্তিবাহিনীতে? মামুন কানাঘুষো শুনেছিলেন যে আলতাফ পালিয়ে গেছে করাচীতে, কিংবা সে আবার জার্মানিতে ফিরে গেছে, তার বদলে মুক্তিবাহিনীর কঠোর পরিশ্রম ও বিপদসঙ্কুল জীবন সে স্বেচ্ছায় বেছে নিয়েছে? শেখ মুজিবের ভক্ত ছিল না সে কোনোদিনও, এখন সে শেখ মুজিবের নামে শপথ নিতে দ্বিধা করেনি!

মামুনের বিস্ময় দেখে শওকত বললো,আলতাফের বেশ নাম হয়েছে, দুই তিনটা দুঃসাহসিক অপারেশানে সে সাকসেসফুল হয়ে ফিরে এসেছে, সবাই বললো।

তারপর কাঁধের ঝোলাটার মধ্যে হাত ঢুকিয়ে দিয়ে সে বললো, আমার উপরে একটা দায়িত্ব দিয়েছিল আলতাফ, সেইজন্যই আমি কলকাতায় এসেই আপনার খোঁজ করেছি। একটা চিঠি পৌঁছায়ে দিতে বলেছে আপনার হাতে, খুব জরুরি আর সিক্রেট।

খামটির মুখ বন্ধ, মামুন দ্রুত ছিঁড়ে ফেললেন সেটা। মঞ্জু আর হেনা চা এনেছে, পলাশ আর শওকত কথা বলছে তাদের সঙ্গে, মামুন চিঠিখানা পড়তে গিয়ে কেঁপে উঠলেন। সংক্ষিপ্ত বারো-চোদ্দ লাইনের চিঠি, সেটাই তিনি পড়ে যেতে লাগলেন একাধিকবার।

চিঠি দেখে মঞ্জু উৎসুক ভাবে তাকাতেই অকম্পিত গলায় মামুন বললেন, টপ সিক্রেট, মুজিবনগর সরকারকে একটা খবর দিতে হবে, কাল সকালেই যাবো।

চিঠিখানা ভাজ করে তিনি রাখলেন পাঞ্জাবির পকেটে।

শওকত বললো, আমার রেসপনসিবিলিটি শেষ। পলাশদাদা, আপনার ফাংশানের দেরি হয়ে যাচ্ছে না তো? কয়টা বাজে? আমার ঘড়িটা বেচে দিতে হয়েছে আসার পথে।

পলাশ নিজের হাতঘড়ি দেখে বললো, এখনো মিনিট কুড়ি দেরি আছে। মঞ্জু, যাবে না। আমাদের সঙ্গে? শওকতকে দিয়েও গান গাওয়াবো!

হেনা বললো, চলো, চলো, আব্ব, আমরা যাবো? যাই না!

শওকত বললো, মামুনভাই, আপনেও চলেন।

মঞ্জু হেনারা বাড়ির মধ্যেই অধিকাংশ সময় আবদ্ধ থাকে, বাইরে যাবার যে-কোনো প্রস্তাব পেলেই লাফিয়ে ওঠে। কিন্তু মঙ পলাশকে দেখে এখনও লজ্জা কাটিয়ে উঠতে পারছে না। তার ফর্সা মুখোনিতে লালচে আভা। শুধু পলাশ-শওকতের সঙ্গে বাড়ির বাইরে যেতে মঞ্জু রাজি হচ্ছে না। মামুন নিজে সঙ্গে গেলে নিশ্চয়ই আপত্তি করবে না।

কিন্তু মামুন যাবে কী করে? লেখাটা শেষ করতে হবে না?

তবু মামুনের মনে হলো, এখন মঞ্জুর একটু বেড়িয়ে আসা খুবই দরকার। কিছুক্ষণ মঞ্জু তাঁর চোখের আড়ালে থাকলে তিনি স্বস্তি বোধ করবেন।

মামুন বললেন, আমি তো যেতে পারবো না। আমার কাজ আছে। তোরা যা তবে। মঞ্জু, একটু তৈরি হয়ে নে।

মঞ্জু বুকে চিবুক ঠেকিয়ে বললো, হেনা যাক তাইলে। আমি যাবো না।

পলাশ বললো, আরে চলো! ঠিক আছে, তোমাকে গান গাইতে বলবো না, তুমি শুনবে। একবার তোমাদের দেখা পেয়েছি, আর কি সহজে ছাড়ছি? শহীদকেও আনিয়ে নিচ্ছি। কলকাতায়। তুমি কি কলকাতায় পদানশীন হয়ে থাকবে ভাবছো নাকি?

শওকত বললো, আমি আগে কলকাতায় আসি নাই। বড় মজার জায়গা। রাত্তির দশটা পর্যন্ত ফাংশান হয়, লোকজন বসে বসে শোনে।

পলাশ বললো, রাত দশটা কেন, অনেক ক্লাসিকাল গানবাজনার জলসা সারা রাত চলে। এখন গরমকাল বলে ঐসব একটু কম।

মামুন বললেন, আমরা ঢাকায় তো কারফিউ আর মারশাল ল-তে ভুগছি অনেকদিন ধরে, সন্ধ্যার পর কোনো অ্যাকটিভিটি থাকতো না। এখানে তো সেরকম কোনো ভয় নাই।

পলাশ বললো, আছে, এখানেও এখন নকশালদের ব্যাপারে লোকে ভয় পায়। কোথায় কখন বোমাবাজি শুরু হবে তার ঠিক নেই। তবুও লোকে গান বাজনা শুনতে আসে। মঞ্জু, আর দেরি করলে কিন্তু আমাদের দৌড় লাগাতে হবে।

মামুন বেশী বেশী উৎসাহ দেখিয়ে মঞ্জুকে তাড়া দিয়ে বললেন, দেরি করিস না। দেরি করিস না, তৈরি হয়ে নে! সবসময় কি আর আমি তোদর নিয়ে যেতে পারবো!

মঞ্জু হঠাৎ শওকতকে জিজ্ঞেস করলো, আপনার সাথে আলতাফ ভাইয়ার দেখা হয়েছিল, উনি তার ছোট ভাইয়ের কথা কিছু বলেন নাই?

শওকত মামুনের দিকে এক পলক তাকিয়ে আবার চোখ ফিরিয়ে নিয়ে বললো, না, বলেন নাই কিছু! তিনি ঢাকাতেই আছেন শুনেছি।

পলাশ মঞ্জুকে বললো, আর সাজগোজ করতে হবে না। যেমন আছে তেমনি এসো আর করো না সাজ! এরপর সত্যি দেরি হয়ে যাবে!

মঞ্জুর আর কোনো আপত্তি টিকলো না। সুখুকেও সঙ্গে নিয়ে গেল ওরা। মামুন দরজার কাছে দাঁড়িয়ে ওদের বিদায় দিলেন।

এখন নিরিবিলিতে লেখাটা শেষ করার সুবর্ণ সুযোগ। তবু মামুন খাটে ফিরে না গিয়ে চুপ করে দাঁড়িয়ে রইলেন। এতসব ঝাটের মধ্যে কি লেখা হয়? মাথাটা একেবারে গোলমাল হয়ে গেছে।

নির্বাসিত মামুনের একটা দিনও বোধহয় শান্তিতে যায় না। আজ পলাশ এলো, মঞ্জুর কুমারী জীবনের একটা বিশেষ স্মৃতি ঝিলিক দিয়ে যাবার কথা। পলাশকে দেখে যতখানি উচ্ছাস দেখানো উচিত ছিল, ততটা দেখাতে পারেননি মামুন। বাবুল চৌধুরী সঙ্গে আসেনি, এই ক’মাসে তার কাছ থেকে কোনো খবরও আসেনি, মঞ্জু তাঁর সঙ্গে রয়েছে বলে মামুনের একটা অতিরিক্ত দায়িত্ববোধ আছে। এখন পলাশ-শহীদদের সঙ্গে মঞ্জুর নতুন করে মেলামেশা করতে দেওয়াটা ঠিক হবে কিনা, তা মামুন বুঝতে পারছেন না। তবু তিনি জোর করেই যে মঞ্জুকে পলাশদের সঙ্গে এখন পাঠালেন, তার কারণ মামুনের ভালো অভিনয় ক্ষমতা নেই। শওকত এসেছে ভগ্নদূত হয়ে।

পকেট থেকে তিনি চিঠিটা আবার বার করে পড়লেন। আলতাফ লিখেছে তার ছোট ভাই সম্পর্কে। গত মাস দেড়েক ধরে বাবুল চৌধুরীর কোনো খোঁজ নেই। শেষ খবর পাওয়া গিয়েছিল যে সে আর্মির গুলিতে গুরুতর আহত হয়েছিল। তাদের বাড়ি থেকে আর্মির লোকজন সিরাজুলের স্ত্রী মনিরাকে ধরে নিয়ে গেছে। তাদের প্রতিবেশিনী জাহানারা বেগমও বাবুলের আর কোনো সন্ধান জানেন না। যতদূর মনে হয়, বাবুল চৌধুরীকে আর্মি ব্যারাকেই আটকে রাখা হয়েছে। অথবা সে ইন্ডিয়ায় পালিয়ে যেতে সক্ষম হয়েছে কি না, সে সংবাদ মামুনই ভালো জানবেন।

মামুন অস্ফুট ভাবে বললেন, আর্মি ব্যারাক!

আর্মি ব্যারাকে যাদের ধরে নিয়ে যাওয়া হয়, তারা আর কেউ ফেরে না। এরকম শত শত ঘটনা শোনা গেছে। আর বাবুল যদি ইন্ডিয়ায় পালিয়ে আসে, তা হলে কলকাতা ছাড়া আর কোথায় যাবে? ইন্ডিয়ার প্রতি বরাবর একটা অশ্রদ্ধার ভাব ছিল বাবুলের। তবু যদি সে কলকাতায় আসতো, নিজের স্ত্রী-পুত্রের খোঁজ করতে না? শওকত যে-ভাবে মামুনের ঠিকানা যোগাড় করেছে, সে ভাবে বাবুলও এই বাসায় চলে আসতে পারতো।

মঞ্জুকে কী বলবেন মামুন? তিনি চিঠিখানা কুচি কুচি করে ছিড়লেন, তারপর উড়িয়ে দিলেন। জানলা দিয়ে। একটা দীর্ঘশ্বাস চেপে রাখার জন্য তাঁর বুক ব্যথা করছে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *