কিছুদিন আগে সান্যালমশাই কনট্রাক্টরের কাজ দেখতে গিয়েছিলেন। অনসূয়া ও সদানন্দ সঙ্গে ছিলো। কথাটা কোন সূত্রে উত্থাপিত হয়েছে কেউই লক্ষ্য করেনি, একসময়ে শোনা গেলো সান্যালমশাই বলছেন, এখন আমার মনে হচ্ছে পুরোপুরি জীবনটাকে প্ল্যানে ফেলা অসম্ভব ব্যাপার। বাইরের ঘটনাও পরিবর্তন সূচনা করে।
সদানন্দ চিন্তা করলো : বাইরের ঘটনা যদি কিছু ঘটে থাকে তবে তা এ বাড়িতে সুমিতির আসা। একথা যদি কেউ বলে, পরিবর্তনগুলি তাকে উপলক্ষ্য করে হচ্ছে তাহলে তার কথাকে হেসে উড়িয়ে দেওয়া যায় না। নিঃশব্দে এসে একটি মেয়ে কোনোরকম আত্মপ্রচার না করে তার রুচির ছাপই যেন সর্বত্র রাখছে।
অনসূয়া বললেন, পুরুষমাত্রেই আয়োজন ও আড়ম্বরপ্রয়াসী। কিছুকাল বিশ্রাম করে নিলে এই মাত্র, নতুবা তোমাকে আমি চিনি। ছড়িয়ে না পড়ে, আত্মবিস্তার না করে তুমি পারো না।
সান্যালমশাই বললেন, কথাটা তুমি ঠিকই বলছে। সমিতির সন্তানের মধ্যে আমারই আত্মপ্রতিষ্ঠার আশা অঙ্কুরিত হয়ে আছে। এমন সুযোগ যে আসবে তোমার ছেলের দিকে চেয়ে আমি ভরসা পাইনি।
সদানন্দ চিন্তা করলো : এই কথাগুলি সান্যালমশাইয়ের আত্মগোপনের চেষ্টা নাও হতে পারে। এবং এটা খুবই স্বাভাবিক কারণ হিসাবে তুলে ধরা যায় যে নৃপনারায়ণের রাজনীতিবৃত্তি গৃহস্থ সান্যালমশাইয়ের সমস্ত উৎসাহ নিভিয়ে দিয়েছিলো। আর এদিক দিয়ে সুকৃতির ঘটনাও উল্লেখ করা যায়।
সে বললো, আপনি বললেন সেটা একটা অত্যন্ত প্রবল কিন্তু সাধারণ অনুভব। এরই জন্য উত্তরাধিকার ব্যবস্থা অযৌক্তিক হওয়া সত্ত্বেও মানুষ সেটা আঁকড়ে ধরে আছে। আর এ বিষয়ে সুমিতি মা বোধ হয় আপনাকে সাহায্য করবেন। খোঁজ করছিলেন আমাদের স্কুলে মেয়েদের গরদ, তসর এসবের সুতো কাটা শিখানো যায় কিনা। সেক্ষেত্রে অবশ্য মুর্শিদাবাদ থেকে ওসব কাজ জানে এমন দু’এক ঘরকে এনে এখানে প্রজা করতে হয়।
সান্যালমশাই বললেন, তাও যদি না থাকবে তবে এই ষাটের দিকে অগ্রসর জীবনে কী অবলম্বন করবো। ধর্মে মতি নেই। তৃতীয় শ্রেণীর দার্শনিক হওয়ার চাইতে প্রথম সারির বাঁচিয়ে হওয়া ভালো। একে কি শান্তিনিকেতনের প্রভাব বলবে?না বলাই ভালো। হোক না এটা সুমিতির নিজের চিন্তা। সব দিক ভেবে দেখোনা হয়।
শাদা ঝকঝকে বাংলোটি যে আধুনিকতার চূড়ান্ত হবে তাতে আর সন্দেহ নেই। যারা সান্যালমশাইকে চেনে দীর্ঘকাল ধরে তাদের পক্ষে এর গঠনটাও বিস্ময়জনক বোধ হবে। সহসা যদি সান্যালমশাইকে মর্নিংসুটে দেখা যায় কতকটা তেমনি বিস্ময়ের। এ বিস্ময়বোধকে দূর করতে হলে কল্পনা করতে হয় এটা তার একটি শুভ্র সুন্দর রসিকতা। কথা হলো সদানন্দ পর্দার, সোফার ঢাকনা ইত্যাদির কাপড়ের অর্ডার দিতে সদরে যাবে।
সান্যালমশাই বললেন, রূপু বাংলোটার নামকরণ করেছে সুমিত। তার ইচ্ছা পুকুর থেকে কেটে নিয়ে গিয়ে বাংলোর পাশে আঁকাবাঁকা একটা ঝিল করে দিতে হবে। তাতে থাকবে কাঠের সাঁকো।
অনসূয়া বললেন, ছেলে কি ‘শেষের কবিতা পড়ছে?
তার প্রতি অন্যায় করা হবে যদি তোমরা এতে শেষের কবিতার ছাপই শুধু দেখতে পাও। বরং সে আমাকে বলেছে উত্তরদিকে হওয়া সত্ত্বেও বাংলোর নাম ‘উত্তরায়ণ’রাখেনি সে, ঠাকুর জমিদাররা রেখেছেন বলে।
সদানন্দ হাসলো। সে বললো, বংশের ধারা অক্ষুণ্ণ রেখেছে।
তা তুমি মিথ্যা বলেনি। ঠিক কী রকম ছিলো আমার পূর্বপুরুষরা তার বিশ্লেষণ করার মত ঐতিহাসিক বুদ্ধি আমার নেই। তাহলেও কখনো কখনো আমার মনে হয়েছে বাংলাদেশ যখন একটি বিশেষ দিকে দ্রুত ধাবমান হয়েছিলো তখন যারা সে-গতিতে বাধা দিয়েছে, বাংলাদেশের অন্য অনেক পরিবারের মধ্যে তাদের দলেই ছিলো আমাদের পরিবার। একথা তুমি বলতে পারো, সদানন্দ, আমরা অগ্রসরদের দলে থাকার অনেক সুযোগ নষ্ট করেছি। মানুষ নিজেদের অন্যায়ের সমর্থনেও যুক্তি খুঁজে বার করে। তেমনি মনোভঙ্গিতে ব্যাপারটা চিন্তা করতে গিয়ে আমার মনে হয়েছে, রাজা রামমোহনের সময় থেকে এই যে আমরা বাধা হিসাবে কাজ করলাম এর ফল বোধহয় সবটুকু খারাপ হয়নি।
এ যেন দূরস্থিত কাউকে নিয়ে আলাপকরা। সদানন্দ বললো, আপনাদের মতো শক্তিগুলিই বিদ্যাসাগরকে বাধা দিয়েছিলো, ব্রাহ্মদের ব্যঙ্গ করেছিলো।
শুধু একটা দিকই দেখো না। দুর্গোৎসবকে এবং রামপ্রসাদীকে ধরে রেখেছি। বাংলাদেশ হাওয়াই দ্বীপে পরিণত হয়নি কিংবা মেক্সিকোতে।
সান্যালমশাই প্রফুল্ল হাসিতে আবার বললেন, বিদ্যাসাগরকে বাধা দিতে পেরেছিলাম, কেশব সেনকে প্রতিরোধ করতে সশিষ্য রামকৃষ্ণকে পাওয়া গিয়েছিলো, কিন্তু রূপের কাছেই হার মানলাম। ভদ্রলোক দেহের স্বাভাবিক হিসাবে যত অগ্রসর হলেন জরার দিকে তত কি সুন্দরতর হলেন? আমার মনে হয়, সদানন্দ, শ্রীচৈতন্যও রবীন্দ্রনাথের মতোই রূপবান ছিলেন। চৈতন্যর পর সেজন্য রবীন্দ্রনাথই আমাদের আবদ্ধ বিলগুলিতে নতুন জল এনে দিলেন, নতুন পলিমাটি। রূপের প্লাবনে ভেসে যাওয়াই বোধহয় আমাদের জাত্যগুণ।
অনসূয়া বললেন, এটা খুব খাঁটি কথা বলেছে। এইজন্যেই পদ্মও তোমাদের জীবনের চূড়ান্ত বিস্ময়। তাকে ভালোবেসে, ভক্তি করে চূড়ান্ত আঘাত পাচ্ছো তবু নিজেকে গুটিয়ে নিতে পারছে না। বর্তমানেও দেখতে পাচ্ছি সাময়িকভাবে পদ্মার অনুগ্রহ পেয়ে প্রফুল্ল হয়ে উঠেছে তোমার চেতনা।
পদ্মার তীরে অনেক ঘটনায় পদ্মা নিজে এসে নায়িকা হয়। কখনো বা তার কোনো কাজ থেকে সাধারণ মানুষের সোজা জীবনযাত্রা প্রভাবিত হয়। তাদের শ্লথদীর্ঘপথ অতিবাহিত করার ভঙ্গিতে গতি এসে ঘা দিতে থাকে। দু-এক মাসে দু-এক বছরের পথ এগিয়ে কিংবা পিছিয়ে যায় মানুষ। মাটি এখানে ধ্রুব নয়।
পদ্মা পাঁচ-সাত বৎসর এদিক থেকে ওদিকে ঝুঁকেছিলো। কিন্তু হঠাৎ আবার যেন নাচের ঢঙেই এদিকের দর্শকের দিকে ফিরে তাকালো। ইন্দ্রর দিকে এগিয়ে যেতে যেতে যেন বরুণের দিকে আঁচলের ঢেউ তুলে এগিয়ে এলো। তার ফলে দাদপুর ভেঙে গেলো। দাদপুরের অনেক মানুষের আশা-ভরসা সেই নর্তকীর পায়ের কাছে ছুঁড়ে ফেলা ফুলের মতো নিষ্পিষ্ট হলো। কিন্তু এদিকে পয়স্তি, সিকস্তি হলো। আর তার ক্ষণেকের দৃষ্টিপাতের মতো যে বান এসেছিলো গত বর্ষায় তাতে ভয়ংকর সৌন্দর্যের সামীপে যেমন হয়, দর্শকদের বুকের মধ্যে ধক করে উঠেছিলো, পয়স্তি-সিকস্তি ধুয়েমুছেকপাল ভাঙার দ’হয়ে যাবে এমন আশঙ্কা ছিলো, কিন্তু দেখা গেলো এক-কোমর পলি রেখে গেছে। নর্তকীর দৃষ্টির প্রসাদই নয়, যেন তার আলিঙ্গন। বুড়ো জোয়ান হয়ে উঠবে এমন লক্ষণ দেখা দিলো।
সান্যালদের প্রায় সকলেরই কিছু কিছু জমি চাষযোগ্য হয়েছে। কিন্তু লক্ষ্মীমানের লক্ষ্মী। সান্যালমশাইয়ের প্রায় তিনশো বিঘা খাস জমি সোনা ফলার মতো উর্বর হয়েছে। আর তা তিনি গ্রামের চাষীদের মধ্যে মুঠিমুঠি করে বিতরণ করছেন। এমন ঘটনা বিশ বছরে একবার হয় কি না-হয়। ছিদাম এবং ইয়াজের মতো অপরিপক্ক চাষীরা অকারণে জোরে জোরে পা ফেলে বেড়াচ্ছে।
জমি বিলোনোর তারিখটাকে নায়েব কয়েকটা দিন পিছিয়ে এনে সুমিতির ছেলের অন্নপ্রাশনের তিথিটার গায়ে লাগিয়ে দিয়েছে, আর সেই সুযোগ পেয়ে রামচন্দ্র দুশো বছর আগেকার একটা দিনকে যেন উদঘাটিত করে দিলো।
কী দেওয়া যায়, কী দিলে সান্যালমশাইয়ের মান রক্ষা হয় এ নিয়ে আলাপ করতে করতে দু-একজন কৃষক বলেছিলো, ট্যাকা-কড়ি নাই।
ট্যাকা না থাকলিও কড়ি তো আছে।
ওই একই কথা।
ট্যাকা না পারো, কড়ি দ্যাও।
এইভাবে কথার সূত্রপাত। ছিদাম বলেছিলো, বেশ, তাইলে একমুঠ ধান আর একটা লক্ষ্মীর কড়ি দেবো।
তাইলে আমরাও তাই দেবো। তার বেশি না।
বাকিটুকু রামচন্দ্রর পরিকল্পনা।
নায়েবমশাই বিব্রত বোধ করলো। তার কৌশল করে জমি বিলোনোর তারিখ ঠিক করা কোনো কাজেই এলো না। প্রজারা কেউ টাকা আনলো না। চৈতন্য সাহার দোকান থেকে এবং দিঘা থেকে কড়ি এবং নিজেদের ভাড়ার থেকে মুঠি-পরিমাণ ধান সঙ্গে নিয়ে তারা উপস্থিত। হলো। তাসত্ত্বেও নায়েবমশাইকে আমলাদের সঙ্গে উপস্থিত থেকে প্রজাদের ভোজের তদ্বির করতে হলো।
কিছুক্ষণের জন্য সুমিতিকে সোনার টায়রা পরা ছেলে কোলে করে দরদালানে বিছানো সাচ্চা জরির কাজ করা মখমলের জাজিমের উপর দিয়ে হেঁটে যেতে হয়েছিলো, প্রজাদের দিকে মুখ তুলে চাইতে হয়েছিলো–সেখানে নামকরা প্রজারা ধান আর কড়ি দিলো তার ছেলেকে।
খবরটা শুনে সান্যালমশাইও বিস্মিত হলেন। কিন্তু সকলে এ-বিষয়টিকে এভাবে গ্রহণ করতে পারলো না। গ্রামের কয়েকজন জোতদার এবং সান্যালদের অন্যান্য তরফের দু-একজন সান্যালমশাইয়ের কাছে আপত্তি জানাতে এলো এবং তারা ভূমিকাতে বললো, এ-বিষয়ে তারা সানিকদিয়ারের হাজিসাহেবের মতও জানাচ্ছে। তাদের আপত্তি শুনে সান্যালমশাই হেসে বললেন, আমি দোষ স্বীকার করছি। এদিকটা আমি বিবেচনা করে দেখিনি। আমি নিজের লাভ-লোকসানই খতিয়ে রেখেছিলাম। ব্যবস্থাটা আমার বিলমহলে বহুদিন আগেই চালু করতে বাধ্য হয়েছিলাম। আর সবকিছুর উপরে, জমি পত্তনি দিলে খাজনা যা পেতাম, এক-তৃতীয়াংশ ফসলেও এখানকার বাজার দামে তার চাইতে বেশি পাবো। তবে এই নিয়ম চিরকাল বহাল থাকবে এমন কথা নয়।
জোতদাররা চলে গেলে সদানন্দ এলো।
আড়ালে দাঁড়িয়ে শুনছিলে?
তা শুনলাম। এরকমভাবে নিজের মহত্ত্বকে ধুলোয় লুটিয়ে দিতে প্রথম শ্রেণীর রসিক ছাড়া আর কেউ পারে না।
সান্যালমশাই বললেন, কথা শুনে মনে হয় আমার কাছে কিছু চাইবার আছে তোমার।
না, তা নয়। হিসেবটা আমি কষে দেখিয়েছিলাম বটে যে এক-তৃতীয়াংশ ফসলের মূল্য খাজনার চাইতে বেশি। কিন্তু পত্তনি বন্দোবস্তের নগদ সেলামি যে হিসেবে ধরিনি এটা নিশ্চয়ই আপনার চোখে পড়েছিলো।
কিন্তু, সদানন্দ, এখন যে আমি ঠাকুর্দা হয়েছি। দূরদৃষ্টি ক্ষীণ হওয়ারই কথা।
সান্যালমশাই সেখান থেকে উঠে অন্দরের বসবার ঘরে গিয়ে বসলেন। দাসী গিয়ে খবর দিলো সুমিতিকে, কিন্তু সুমিতির ছেলে তখন ঘুমুচ্ছে। সুমিতি নিজে এলো।
ও যে ঘুমুচ্ছে।
থাক, থাক। ঘুমোক। তোমাকে যে কাজের ভারটা দিয়েছিলাম, হয়েছে?
পছন্দ করে রেখেছি। এনে দেবব ডিজাইনের বইটা?
বিকেলে দিয়ো। কিন্তু কথা কি জানো, মেহগনি কাঠের চালান আনিয়ে নেওয়া কঠিন বলে বোধ হচ্ছে খোঁজখবর নেওয়ার পর। আজকাল ওটা তেমন চালু নয়। বাগানে অবশ্য দুটি গাছ রয়েছে। কিন্তু সীজ করিয়ে নিতে ছ মাস কমপক্ষে।
ঠিক এই কথাগুলির উত্তর দেওয়াই সব চাইতে কঠিন সুমিতির পক্ষে। ডিজাইন পছন্দ করার ব্যাপারে এত অসুবিধা হয়নি। এমন কথা তার কানে এসেছে যেনতুন বাংলোটাতার রুচি অনুসারে নির্মিত হবে। সান্যালমশাই যখন তাকে আসবাবের ডিজাইনের বইটি দিয়ে পছন্দ করতে বললেন তখন তার মনে হলো সে প্রস্তাবে রাজী না হলে হয় অত্যন্ত বেহায়া কিংবা দর্শনীয় ভাবে লজ্জাশীলা হতে হয়। এবং এই দুইরকম অগ্রসরণই তার কাছে দুঃসহ বোধ হয়েছিলো। অবশেষে সে একটা পথ খুঁজে পেলো। সান্যালমশাই যখন বইটা উল্টেপাল্টে দেখাচ্ছিলেন সুমিতি সান্যালমশাইয়ের কেঁকগুলি অনুমান করে নিতে পারলো, এবং সে স্থির করলো সান্যালমশাই জিজ্ঞাসা করলে তার নিজের পছন্দগুলিই সে দেখিয়ে দেবে।
ছ মাস যদি সীজ করতে দরকার হয়, তাই হবে। আমাদের এমন তাড়াতাড়ি কী?সুমিতি একটি নিটোল হাসি ফুটিয়ে তুলো।
ভেবে দেখি। তোমার সিল্কের সুতোর কাটুনিদের কথা শুনেছি। দেখছি।
সুমিতি বেশ লজ্জায় পড়লো। কিন্তু এরপরে কি ‘সে কিছু নয়’ বলা যাবে?
.
এক সন্ধ্যায় অনসূয়া বললেন, এখন কাজ নেই হাতে। তোমার কাছে বসে সেতার বাজাবো?
সান্যালমশাই বললেন, তাই বাজাও।
অনুসূয়া দাসীকে বলেই এসেছিলেন। সে সেতার রেখে গেলো।
পুঁথিঘরের একটি জানলার ঠিক নিচে লাইম গাছটার পুষ্পিত পল্লবগুলি দেখা যাচ্ছে। গাছটার বয়স হয়েছে বলেই হোক কিংবা বিদেশী গাছ, ক্রমশ অন্তর্নিহিত প্রাণশক্তি ক্ষয়িত হয়েছে বলেই হোক, এখন আর তেমন অজস্র ফুল ফোটে না। তবু একটা সুঘ্রাণ আসছে। সেই জানলার পাশে আজ বিকেল থেকে গালিচা পাতা আছে। সান্যালমশাইকে পথ দেখিয়ে নিয়ে এসে সেই গালিচায় অনসূয়া বসলেন। তাকিয়ায় হেলান দিয়ে সান্যালমশাই আধশোয়া অবস্থায় মনকে পরিপূর্ণ রূপে ছেড়ে দেওয়ার জন্য প্রস্তুত হলেন।
সুশিক্ষার সুযোগ এবং রেয়াজ করার অবসর থাকলে সুরুচিসম্পন্ন মনের পক্ষে একটি রাগিণীকে মূর্ত করে তোলা কঠিন নয়। বাজনা থামার পরও কিছুকাল নীরবে সেই সুঘ্রাণে তন্ময় হয়ে রইলেন দুজনে।
অনসূয়া যেন কিছু পরিমাণে লজ্জিত হলেন। তিনি বললেন, যে অন্যকে সুখী করার চেষ্টায়, বাজাতে বসেছিলো সে নিজেও সুখী হলো, এই তো বলছো তুমি?
সান্যালমশাই মধুর করে হাসলেন, আর তার সঙ্গে সঙ্গে আমার মনে হচ্ছে মুদ্রাদোষের মতো এটা একটা প্রবণতা দেখা দিয়েছে আমার সব কিছুকেই বিশ্লেষণ করে নীরস করে দেওয়ার।
অন্য কেউ নিজের সম্বন্ধে যখন বলে তখন তার বক্তব্যে সবটুকু আস্থা রাখা কঠিন। বিশেষ করে কেউ যখন আত্মদোষ বর্ণনা করে তখন ধরে নেওয়া যায় সেটা প্রকাশিত হওয়ার আগে। তার মন সেই আত্মগ্লানির কাহিনী সংশোধন করে দিয়েছে, সংসার রাজনীতি তার বক্তব্যকে সেন্সর করেছে। কিন্তু অনসূয়ার কাছে সান্যালমশাইয়ের কথা স্বতন্ত্র। এই লোকটির বৃহত্ত্বের সঙ্গে এ পরিবারের সকলেই পরিচিত কিন্তু তার ঈর্ষা, দ্বেষ, ঘৃণার কথাগুলি শুধু তিনিই জানেন। শুধু তাই নয়, দৃষ্টিভঙ্গির যে চিৎ ক্ষুদ্রতা সান্যালমশাই বুদ্ধির সাহায্যে জয় করার চেষ্টা করেন, অন্তরের যে ক্ষণ-প্রকাশিত কাপুরুষতাকে জয় করার চেষ্টা করেন ব্যবহারের দৃঢ়তা দিয়ে, সে সবই কোনো-না-কোনোসময়ে সান্যালমশাই তাঁর কাছে অকপটে ব্যক্ত করেছেন। পৃথিবীতে সবকিছু ব্যক্ত করার পরও একটি জায়গায় এসে মানুষ থেমে যায়–যে সংগুপ্ত কামনাগুলিকে জাগ্রত মন অস্বীকার করে, ভয় পায়, সেগুলি নিয়ে আলোচনা করা যায় না। অনসূয়ার ধারণা, সেই অরণ্যচারী আদিম স্বপ্নের সান্যালমশাইকেও তিনি কিছু চেনেন, তাঁর সঙ্গে কোনো কোনো সময়ে সমপ্রাণও হয়েছেন। যদিও হঠাৎ একসময়ে নতুন কোনো আত্মপ্রকাশ করা সান্যালমশাইয়ের পক্ষে অসম্ভব বা অভূতপূর্ব নয়।
অনসূয়া বললেন, এই প্রবণতাকে তুমি কাটিয়ে ওঠার চেষ্টা করছে?
সান্যালমশাই দাবা খেলেন না অর্থাৎ এ বিষয়ে তার নেশা নেই। কিন্তু সেবার মন্মথ রায় এলে তার আপত্তি টেকেনি। সান্যালমশাইয়ের সেই ভঙ্গিটি যা দাবা খেলার সময়ে হয়েছিলো সেটা, সুতরাং, দুর্লভ। অনসূয়ার মনে হলো সান্যালমশাইয়ের এই অত্যন্ত শীতল মনোভঙ্গি যেন তেমনি কিছু।
তাওয়াদার তামাক পুড়ছিলো। সেদিকে মন দিয়ে সান্যালমশাই বললেন, তোমার বিয়ের আগে এ বাড়িটা কী রকম ছিলো এই যেন মনে পড়ছে আমার। বাড়ি গমগম করা বলতে যা বোঝায় সেটা তখনো খুব ছিলো না। বাড়ির পিছন দিকের অংশে তখন অনেক আত্মীয় বাস করতেন, এখনো করেন। কিন্তু তখনকার সেই আশ্রিতদের মধ্যে বলিষ্ঠ কর্মক্ষম পুরুষও ছিলো। এখন বোধহয় মানুষের আত্মসম্মান-জ্ঞান এ ধরনের জীবনকে স্বীকার করে না। নাকি, হিরণ জ্যাঠার আপিসের খরচও সেসময়ে কাছারি থেকে ব্যবস্থা করা হতো, তেমনটা হওয়ার সম্ভাবনা আজকাল নেই বলে তাদের মতো লোকরা আর আশ্রয় চান না।
অনসূয়ার মনে পড়লো এ বাড়িতে এসে তিনি প্রথম দিকে যাদের পেয়েছিলেন সেই সব আত্মীয়াদের মধ্যে দু-একজন তার অন্তরঙ্গ হয়ে উঠেছিলো। এখন তারা নেই। যারা আছে তারা সুমিতির সখ্যলাভ করেনি। অনসূয়া স্থির করলেন সান্যালমশাই বোধহয় এমন নিঃসঙ্গতার অনুভব থেকেই সেকালের কথা বলছেন। রায়দের যারা অবশিষ্ট আছে গ্রামে কিংবা সান্যাল বংশেরই যারা আছে তাদের কেউই সান্যালমশাইয়ের দোসর নয়।
সান্যালমশাই ইদানীং যেন নতুন সঙ্গী পেয়ে সোৎসাহে পথ চলার ভঙ্গিতে এগিয়ে যাচ্ছেন। তার বাড়িঘর সাজাবার উৎসাহে অন্তত তাই মনে হয়। অনসূয়া এখন ভাবলেন সেই অগ্রগতি কি তবে ত্বক-গভীর?
কয়েকদিন আগে সদানন্দ কোথাও যাচ্ছিলো, অনসূয়ার কাছে নিয়মতান্ত্রিক অনুমতি নিতে এসেছিলো।
অনসূয়া জিজ্ঞাসা করলেন, কোথায় যাচ্ছো?
বিলমহলের জন্যে আর একটা মোটরপাম্প আনতে।
সেই জল ঘেঁচে জমি দখলের ব্যাপার বুঝি?
হ্যাঁ। আজকাল জলকরের মুনাফা কিছু নেই। বিলের প্রায় আধখানা জলাজমি।
সদানন্দ চলে গেলে অনসূয়া তার এক পুরনো চিন্তাধারাকে অবলম্বন করেছিলেন : সুকৃতির সম্বন্ধে এ বাড়ির সকলেরই যে একটা আন্তরিক দুঃখবোধ আছে সেটাই হয়তো নৃপনারায়ণকে সুমিতির দিকে আকর্ষণ করেছিলো। পুরুষদের বেলায় এমন হয়। কেউ কেউ কোনো বিধবার দুঃখে বিচলিত হয়ে তাকে বিবাহও করেছে। সান্যালমশাইয়ের কর্মকাণ্ডের সূচনায় রয়েছে পুকুরঘাটের পুনঃপ্রাণপ্রতিষ্ঠা, যেখানে একদিন সুকৃতিকে হারাতে হয়েছিলো। সান্যালমশাইয়ের শান্তি অনুসন্ধানের পিছনে তাহলে ছিলো উদাস বিষণ্ণতা। আর তাহলে ভালোই হয়েছে সুকৃতির পরে সুমিতির আসা। কিন্তু এখন সান্যালমশাইয়ের বসবার ভঙ্গিটিতে নিঃসঙ্গতার ছাপই দেখতে পেলেন অনসূয়া।
তিনি চিন্তা করলেন, তাহলে এসবই কি আন্তরিক নয়?
সৃজনধর্মীদের স্বভাবই এই, কোনো একটি বিষয়কে উপলক্ষ্য করে তারা উপলক্ষ্যকে ছাড়িয়ে যায়। নিজের অন্তরগত সেই প্রেরণাটি যতক্ষণ না সার্থক হয়ে উঠছে ততক্ষণই তারা কর্মব্যস্ততায় উজ্জ্বল। কিন্তু তারপর?
সান্যালমশাই নিজের নিঃসঙ্গতার কথা চিন্তা করছিলেন না। অনসূয়া আসবার আগে এবং তার পরের অবস্থাটা যেন তুলনা করছিলেন। তিনি বললেন, তুমিও, অনসূয়া, সুকৃতি-সুমিতির মতো শহর থেকে এসেছিলে এই পাট-ধানের হিন্টারল্যান্ডে। এই কথাটাকে বাংলায় ভর’ বলা যেতে পারে। তুমি সঙ্গে করে এনেছিলে সংগীত। সেটা একটা বিদ্রোহ। কিন্তু মানুষের ন্যায়-নীতিবোধ কি রকম হাস্যকর দ্যাখো। অর্গান বাজিয়ে অতুলপ্রসাদের গান করা তোমার মর্যাদায় কোথাও আটকাবে এরকম একটা আবহাওয়া ছিলো বাড়ির। এটা যেন ব্রাহ্মিকা খোপর মতোই তোমার পক্ষে বর্জনীয়। যেন গানকে অবলম্বন করে তোমার কণ্ঠস্বর কেউ শুনবে এটা উচিত নয়। কিন্তু সেতার বাজানো যেন অন্য কোনো ব্যাপার। তুমি শুনলে অবাক হবে, একসময়ে এ নিয়ে আমি খুব চিন্তা করতাম। তখন আমার এরকম একটা বালকোচিত ধারণা হয়েছিলো, সরস্বতীর হাতে বাদ্যযন্ত্র থাকে বলেই যেন আমাদের প্রাচীন আবহাওয়া তোমার সেতারে আপত্তি জানায়নি।
হয়তো তাই, বলে অনসূয়া ভাবলেন, এই পরিবারের বিশিষ্ট প্রথাগুলিকে গ্রহণ এবং পরিবর্জনের মাধ্যমেই তার নিজের বর্তমান চরিত্র গড়ে উঠেছে। তারপর থেকে কি তিনি একটি মূল্যবান কিন্ত কঠিন পাথরের মতো আলোক প্রতিফলন করছেন? কিন্তু একথা মনে পড়ছে কেন সান্যালমশাইয়ের!
অনসূয়া চলে যাওয়ার কিছুপরে রূপু এলো একটা বইয়ের খোঁজে। সে যখন বই নিয়ে চলে যাচ্ছে সান্যালমশাই বললেন, হ্যাঁরে, রূপু, তোর বউদি গানবাজনা ভালোবাসেন না?
কথাটা আকস্মিক, কোনোদিন রূপুর মনে জাগেনি। সে বললো, জানি না।
সান্যালমশাই বললেন, হয়তো ভালোবাসেন কিন্তু এখানে হাতের কাছে কিছু পাচ্ছেন না। তুই খোঁজ নিয়ে যা প্রয়োজন সদানন্দকে বলে আনিয়ে নেওয়ার ব্যবস্থা করিস।
রূপু চলে গেলে সান্যালমশাইয়ের মনে হলো সুমিতির ব্যাপারটায় নতুনত্ব আছে। একে যদি কেউ সখ করে বিপ্লব বলতে চায় তা বলতে পারে। কিন্তু সেও হয়তো নিজের কিছু বর্জন করতে চাইবে যেমন অনসূয়া গানকে করেছিলেন। ভেবে দেখতে গেলে অনসূয়াও বিপ্লব এনেছিলেন। তার নিজস্ব ধর্মমতের বলিষ্ঠতা প্রচারিত হওয়ার আগে তার স্বকীয়তা প্রচারিত হয়েছিলো। কালীপূজোয় বলির ব্যবস্থা বন্ধ হয়েছিলো তার কান্নায়। এমনি কিছু সুমিতির ক্ষেত্রেও হবে। একটুপরে কথাটা তার মনে হলো : এটা লক্ষণীয়, ধর্মমতকে নিয়েই প্রথম নিজেদের স্বকীয়তা। প্রকাশ করেছে দুজনেই। বিবাহটা ধর্ম বৈকি।
.
নিজের বয়সের কথা প্রকাশ্যে চিন্তা করতেও অনসূয়ার লজ্জা করে। কিন্তু কোনো কোনো দিন মানুষ অনভ্যস্ত কাজ করতে আরম্ভ করে।
ড্রেসিং টেবলের বড়ো আয়নাটার সম্মুখে দাঁড়িয়ে চিরুনির কয়েকটি টান দিতে না দিতে কপালের উপরে কয়েক পাক কোঁকড়ানো চুল আজ থেকে বিশ বছর আগে যেমন প্রতি সন্ধ্যাতেই থাকতো তেমনি করে দুলে উঠলো। পরনের যে শাড়িটা কাজকর্ম শেষ করে ঘরে এসে পরেছিলেন সেটাও তিনি পাল্টালেন। ঘাসের চটিটা বদলে লাল মখমলের একটা চটি পছন্দ করে পরলেন।
সান্যালমশাই ঘরে ছিলেন। হাতের বইটি মুড়ে রেখে তিনি বিছানায় উঠে বসলেন। এসো।
অমন করে চেয়ে থেকো না।
‘অনেকদিন পরে দেখছি বলেই বোধহয় এমন লাগছে। সান্যালমশাই অনসূয়ার হাত দুখানি নিজের হাতে তুলে নিয়ে কিছুক্ষণ পরে বললেন, এই হৃষ্টতাবোধই আমাকে নতুন নতুন কাজে উৎসাহ দেয়।
অনসূয়া বললেন, যদি কিছু পেয়ে থাকো সে তোমার আকর্ষণের শক্তিতেই পেয়েছে।
রাত্রি যখন আরো গম্ভীর হলো অনসূয়া বললেন, এমনি যদি কখনো কখনো আসি, বলল নির্লজ্জ বলবে না?
কিছু বলার মতো ভাষা থাকে না। সান্যালমশাই বললেন।
ভোররাতের কিছু আগে নিজের ঘরে ফিরে এসে অনসূয়া বিছানায় গা রাখতেই ঘুমে তার চোখ জড়িয়ে আসতে লাগলো। ততক্ষণে তার নিজের বিছানা খোলা জানলার বাতাস পেয়ে পেয়ে শীতল হয়েছিলো।
পরদিন সকালে দাসী এসে ডাকলো, বেলা হয়েছে, মা, উঠুন।
সান্যালমশাই তাকে নিলাজ না-ও বলতে পারেন, কিন্তু যা শুধু এই রাত্রিটির বৈশিষ্ট্য সেটা যেন সত্যিকারের চাইতে গভীর এবং বিস্তৃত বলে সমস্ত দিন মনে হতে থাকলো অনসূয়ার। একথাও দু-একবার স্মরণে এলো, হাতের চুড়িগুলি খুলে একজোড়া রতনচূড় পরেছিলেন তিনি সেতার শুরু করে।
ওদের জীবন যেনতুন খাতে প্রবাহিত হতে চায় তা হোক, তা বলে মস্তিষ্কের সাহায্যে চলতে গিয়ে ফুরিয়ে যাচ্ছি বলে, সঙ্গহীন হয়েছি বলে যে আশঙ্কা হয়েছিলো তার, সান্যালমশাইয়ের নিঃসঙ্গতার ক্লান্তিতে যেভাবে ব্যথিত হয়েছিলেন তিনি, তা সবের লক্ষণ দিনের আলোয় উদ্ভাসিত হাতের মুঠোয় রাখা এই সংসারের কোথাও খুঁজে পাওয়ার কথা নয়, পেলেনও না।