কাৎলাহার বিলের পশ্চিমপাড়ে গিরিরডাঙার মাঝিরা এলোমেলো সারিতে দাঁড়িয়ে বিলে ঝপঝপ করে জাল ফেললে কালাম মাঝির বাড়ির কাছে ফকিরের ঘাট থেকে দক্ষিণে বুলু মাঝির বাড়ির ঘাট পর্যন্ত তোলপাড় ওঠে। বেশিরভাগ জেলেই নিয়ে এসেছে প্যালা জাল; ভালকা বাঁশের ত্রিভুজের মাঝখানে এই জাল দিয়ে ধরা যায় বড়ো জোর ছোটো মাছ। কিন্তু এমনভাবে সবাই জাল ফেলে যে মনে হয় রুই কাতল মৃগেল ছাড়া অন্য মাছ ধরায় তাদের রুচি নাই। আর তৌড়া জালওয়ালাদের ভাব দেখে মনে হয়, বিলের মধ্যে কুমির থাকলে তাও আজ রেহাই পাবে না। এমন কি দুইজন নিয়ে এসেছে বেড় জালের। দুটো তিনটে করে টুকরা; এই জাল খাটাতে না পারলে কী হয়, এর চিকন ফাঁক দিয়ে মাছ পালাতে পারবে না এই ভরসায় তারা টুকরাগুলিকে জোড়া দেয় তাড়াতাড়ি করে। কেউ কেউ এনেছে পলো। ছোটো ছেলেদের হাতে হাতে বড়শি। মাছের চার না দিয়েই পানিতে ফাত্তা ফেলে তারা দাঁড়িয়ে থাকে। কিন্তু এতো হৈচৈয়ের মধ্যে ঠায় দাঁড়িয়ে থাকতে না পেরে তারা এদিক ছোটে ওদিক ছোটে। তাদের বড়শিতে মাছ পড়ার। সম্ভাবনা সম্পূর্ণ লোপ পায়।
এতো হট্টগোলে শীতের শেষ দুপুর আটকে থাকে বিলের দুই পাড়ের গাছে গাছে। তমিজের নিয়ে-আসা কৈ জাল ঘাড়ে ফেলে তমিজের বাপ আস্তে আস্তে চলতে থাকে উত্তরের দিকে। এই শীতে কৈ জাল দিয়ে হবেটা কী? তমিজটা একেবারে চাষাই হয়ে গেলো, কখন কোন জাল ফেলতে হয় তাও ভুলে গেছে। কার কাছ থেকে এটা নিয়ে এসে ফেলে দিলো বাপের ঘাড়ে!
বিলের মাঝামাঝি থেকে দক্ষিণ পর্যন্ত পানি তবু কিছু আছে। কিন্তু এক বাঙালির রোগা স্রোত ছাড়া উত্তরে পানি বেশ কম। ডাঙা উঠতে শুরু করেছে এই দিকটাতেই। কোনো কোনো জায়গায় মণ্ডলের কামলারা একটা চাষ দিয়ে কাউন ছিটিয়ে গেছে।
তা নিচের দিকে তমিজের বাপের নজর নাই, চোখের ওপর হাত রেখে সে তাকিয়ে থাকে উত্তর সিথানে পাকুড়গাছের মগডালের খোজে। গাছটা এখান থেকে নজরে না পড়লেও তার একমাত্র বাসিন্দার গলায় ঝোলানো শিকলের আওয়াজ বাজে হালকা বোলে, এতে দানা বাঁধে চেরাগ আলির গলা :
মুনসির আওয়াজ যেন আতসের শ্বাস।
দিল কাঁপে যাহাদের দুনিয়াতে বাসা।।
আগুনের নিশ্বাসে গায়ে আঁচ লাগে, তমিজের বাপ তবু আরো এগোয়। তার দেখাদেখি ও তার পিছে পিছে হলেও উত্তরে এগুতে থাকে মাঝির দল। বিলের উত্তরে মানুষের আনাগোনা হয়ই না, সেদিকে মাছ পাওয়ার সম্ভাবনা বেশি।
তবে কুদুস মৌলবি দাঁড়িয়ে রয়েছে দক্ষিণের কাছে, বুলুর ঘাটে। মাঝিপাড়ার জুম্মাঘরে আজান পড়তে তাই দেরি হয়। বিকালবেলা আসতে আসতে বেশি বিকাল। হয়ে যাচ্ছে। গোলাপি রঙের রোদে কুদুস মৌলবির সাদাকালো দাড়ি ছুঁচলো হয়ে উঠছিলো, কিন্তু আসরের আজান দেওয়ার ওকত যাই যাই করছে বলে সে একটু কাবু হয় এবং কাছাকাছি কেরামতকে দেখে বলে, তোমার কথা শুন্যা মাঝিরা তো ঝাঁপ দিয়া পড়লো, এখন মণ্ডল সবগুলার কোমরে দড়ি না বান্দে। রফাদানি জামাতের মানুষ, এই একটা সুযোগ পাবি।
বিলের ওপর মণ্ডলবাড়ির শিমুলগাছের বকেদের মন্থর ডানা ওড়ে, ডানা থেকে ঝরতে থাকে পাতলা ছায়া। ছায়ায় ছায়ায় তারা বিকাল নামায় বিলের পানিতে। বড়ো বড়ো চোখজোড়া খোলা পেয়ে শীতের বিকালের ছায়া এক ফাকে ঢুকে পড়ে কেরামতের মাথার ভেতরে; বকের ডানার ঝাপ্টায় ঝাপ্টায় তার মাথার অন্ধকারেও ঢেউ খেলে এবং ফলে খাড়া হয়ে ওঠে তার কুচকুচে কালো ঝাঁকড়া চুল তার কথাতেই কি মাঝিরা ঝাঁপ দিলো বিলে মাছ ধরতে? এদের কোমরে দড়ি পড়লে সে-ই কি আর বাদ পড়বে? তাকেই তো আগে ধরবে। পুলিসের খাতায় তার নাম তো আছেই, গোলমেলে। জয়পুর আর পাঁচবিবি আর আক্কেলপুর থেকে সরে এসেছে বলে পুলিস হয়তো তাকে। ঘটাচ্ছে না, আবার মাঝিদের এই হাঙ্গামার অছিলায় নতুন করে উৎপাত শুরু না করে। তা হলে?—তা হলে সে কি পায়ে পায়ে দক্ষিণদিক দিয়ে ঘুরে নিজগিরিরডাঙায় শ্বশুরবাড়ি চলে যাবে নাকি? কিন্তু উত্তরদিকের মাঝিদের কোলাহল তার পা ঘুরিয়ে নেয় সেদিকেই। তাদের কলরবেই তার গতরে তাপ লাগে : তার সাদামাটা কথাতেই মাঝিরা ছুটে এসেছে বিলের পানিতে! কিন্তু এখন তা হলে মাঝিরা তার দিকে মোটে খেয়াল করছে না কেন? তার চারপাশে এখন তো কেউ নাই। এমন কি কুন্স মৌলধিও চলে গেলো আজান দিতে। তমিজের বাপই কি এদের টেনে নিয়ে যাচ্ছে উত্তরের দিকে? তাকেই,কি এরা সর্দার বলে মানে? এক ফকিরের সঙ্গে কিছুদিন থেকে আর তার নাতনিকে বিয়ে করেই সে কি এলাকার নেতা হয়ে গেলো নাকি? না-কি মণ্ডলের কাঠের বোলওয়ালা খড়মের বাড়িই তমিজের বাপের মাথার মুকুট? মাছের নকশা-আঁকা লোহার লাঠির কথা সে যে বলে, তাই কি খড়মের বাড়ি হয়ে পড়েছিলো তার মাথায়? না-কি খড়মই তার মাথায় পড়ে লোহার পান্টির আদল নিলো?তমিজের বাপের মাথার আঘাতের সঙ্গে মুকুটের উপমা জুটে গেলেও কেরামত আলি এটাকে তার পদ্যের কোথাও জুত করে বসাতে পারে না। কিছুক্ষণ একটু একা থাকায় মাঝিদের নিয়ে লেখা তার পদ্যের সবটাই এখন মনে পড়ছে, কিন্তু মানুষের মাথায় খড়মের বাড়িকে মুকুটের উপমা দিয়ে কোথাও বসিয়ে দেওয়াটা কিছুতেই সম্ভব হচ্ছে না। এদিকে মাঝির দঙ্গল ক্রমেই দূরে সরে যাচ্ছে, পাতলা অন্ধকার ও হালকা কুয়াশায় তাদের ঝাপসা দেখায়। কেরামতের বুক ছমছম করে, সে তাড়াতাড়ি হাঁটা দেয় উত্তরের দিকে।
সাটি মাছে পাড় দেয়, বেলে মাছ এলে দেয়; হায়রে, সাটি মাছে পাড় দেয়, বেলে মাছ এলে দেয়।—ধরা পড়ে শুধু ছোটো মাছ। সাটি মাছ আর বেলে মাছের কৌলিন্য নাই, সুতরাং এইসব মাছ যাদের জালে ধরা পড়ে তাদের শুনতে হয় বালকদের এই প্রচলিত কৌতুকটা। মেলার আগের দিন মণ্ডলকে খাজনা দিয়ে বিল ঘেঁকে মাছ ধরে। নিয়ে গেলো যমুনার মাঝিরা। এদিকে পানিও কমে গেছে, বিলের ঠিক মাখঝানেও গলা পানির বেশি নাই। সাটি আর বেলে, পুঁটি আর মৌরলা, ছোটো ছোটো চাদা আর বাশপাতা মাছই কেবল পাওয়া যাচ্ছে। মাঝিদের দাপাদাপিতে বিলের পানি কাদাকাদা হয়ে ওঠে, কাদা আরো কাদাটে হয় বকের ডানা থেকে ঝড়ে-পড়া ছায়ায়। এই ছায়ার ইশারাতেই কি-না কে জানে সন্ধ্যা নামে কুয়াশায় ভর করে। এর ওপর কৃষ্ণপক্ষের চাঁদের ভূতুড়ে আলোয় গোটা বিল অচেনা ঠেকলেও কিংবা হয়তো অচেনা ঠেকে বলেই মাঝিদের মাছ ধরার তাগিদ বেড়ে যায় শতগুণ। মাছের ঝাঁক ঠাউরে মাঝিরা পলো দিয়ে চেপে চেপে ধরে বকের ডানার ছায়া। ছায়ায় এরকম চাপ পড়লে কেদের ডানায় সুড়সুড়ি লাগে এবং তারা সরে সরে যায়। রুই কালা কি পাঙাস কি বাঘাড় পালিয়ে গেলো সাব্যস্ত করে মাঝিরা বকাবকি করে, চুদির ভায়েরা, খানকির বাচ্চারা, তোরা হামাগোরে হাতে আসবু না? শালারা মণ্ডলের কোলের মদ্যে বস্যা গোয়া মারা দিবার পারিস, আর হামাগোরে সাথে আসবার চাস না, না? এরকম বকা খেয়ে কালাহারের মাছেরা গিরিরডাঙার মাঝিদের সঙ্গে তাদের পুরনো কুটুম্বিতা ফিরে পায় এবং ছোটোখাটো কিছু রুই কালা মৃগেলের বাচ্চা ঝাঁপ দিয়ে উঠে পড়ে কারো কারো জালের আঁচলে।
মগরেবের আজান দিয়ে মাত্র তিন চারজন বুড়া মুসল্লির নামাজের ইমামতি করে ফিরে এসেছে কুদুস মৌলবি। কেরামতের পাশে হাঁটতে হাঁটতে মাঝিদের দিকে তাকিয়ে সে জানায়, মণ্ডল আর তার বেটা বলে মানুষ লিয়া আসিচ্ছে। তোমরা এখন ওঠো তো। মাছ যা উঠিছে লিয়া বাড়িমুখে ঘাটা ধরো।
বিল থেকে ওঠা দূরের কথা, মৌলবির দিকে তাকিয়ে কে চিৎকার করে জবাব দেয়, আপনে দোয়া করেন হুজুর, দোয়া পড়েন। মণ্ডলের বাপ আসুক। বিল কি মণ্ডলের? না শালার বাপের! এই বীরত্বে তেজি হয়ে আরেকজন সংকল্প করে, শালারা আসুক। ব্যামাক কয়টা পলো আমান ঢুকায়া দিমু শালাগোরে গোয়ার মধ্যে।
উত্তরে সরতে সরতে তমিজের বাপের একটু কাছাকাছিই এসে পড়ছিলো সবাই। উত্তর দিক থেকে কোনো ইশারা পেয়েই কি-না কে জানে, ভাঙা গলায় তমিজের বাপ সবাইকে ডাকে, আরো এ্যানা আসো গো তোমরা।
তার কথা কারো কানে যায় না, তবে বুধা মাঝি চিৎকার করে তাকে জানায়, ও নানা, উদিনকার বাঘাড় মনে হয় এটিই আছে গো, এটি এখনো মেলা পানি ঠাহর করিচ্ছি। এতে তমিজের বাপ সাড়া না দিলেও তমিজ কিন্তু বেড় জালটা খাটাবার আয়োজন করে এবং সবাইকে আশ্বাস দেয়, মণ্ডল ঘরের মধ্যে সান্ধাছে গো, আজ আত্রে আর বার হবি না।
এইসব কলরব কিন্তু তমিজের বাপের কানে কিছুই ঢোকে না, পাকুড়গাছ থেকে তখন গুলিতে-ফুটো গলার ভেতর থেকে আসতে শুরু করেছে মুনসির নিজের স্বর :
মজনু হাঁকিয়া কয় ওহে সাগরেদ।
দরগাশরিফে ওরস করিল নিষেধ।।
নাসারা কোম্পানি বেয়াদব বেতমিজ।
মাজারে খাজনা ধরে বেদিনি ইবলিস।।
মুনসির গান নিশ্চয়ই আর কারো কানে যায় নি, তাই আবিতনের বাপ কেরামতকে বলে, ক্যা, গো, মণ্ডলের বেটা কাদেরের হুকুমে তুমি সেদিন গোলাবাড়ি হাটোত সভার মধ্যে গান করলা, আর এটি একটা শোলোকও কবার পারো না?
কেরামত তখন দেখছিলো তমিজের বাপের মুখ, ঝাপসা চাঁদের ভূতুড়ে আলোয়। তার মুখের রেখা কেমন উল্টেপাল্টে যাচ্ছে। বুড়া আবার মুনসির ঐসব গায়েবি গান শুরু করে, এই ভাবনায় কেরামত তার দুদিন আগে বাঁধা গানটি গাইতে শুরু করে উঁচা গলায়,
মণ্ডলে করিল কবজা মাঝির কাৎলাহার।
কাঙাল মাঝিপাড়ায় ওঠে করুণ হাহাকার।।
চিৎকার করে ওঠে মাঝিরা, হামরা কবিয়াল পায়া গেছি গো! করো গো, গান করো। তবে তার শোলোকের সব কথা অনুমোদন করে না তমিজ, কাঙাল কারা গো? মণ্ডলেক হামরা কাঙাল করা ছাড়মু।
খাতা না দেখেও শোলোকের সব চরণের মিল তখন কেরামতের মনে পড়ে গেছে, মাঝিদের জালের আওয়াজ আর হর্ষধ্বনি আর তমিজের প্রতিবাদে তেজ বাড়ে তার ঠোঁটজোড়ায় :
মণ্ডলে খড়ম মারে বিধ মাঝির মাথে।
দুস্কে শশধর অস্ত যান সাথে সাথে।।
গিরিরডাঙা গ্রামে সূর্য না হন উদয়।
বিলে পদ্ম না ফুটিয়া কুড়িমাঝে রয়।।
মুনসির গানের এই অন্যরকম প্রতিধ্বনি শুনে তমিজের বাপ একটু অবাক হয় : কেরামতের মতো এক ফাতরা কিসিমের কবিয়ালের গলায় মুনসির প্রতিধ্বনি ওঠে কীভাবে? কেরামতের শোলোক শেষ হতে না হতে পাকুড়গাছ থেকে ফের জানানো হয়,
মহাস্থানে শায়িত শাহ সুলতান হুজুর।
মাহি সওয়ার নামে তিনি দুনিয়ায় মশহুর।
তানারে বেইজ্জত করে নাসারা কোম্পানি।
লাজে দুঙ্কে শুকাইল করতোয়ার পানি।।
কেরামতের ঠোঁটে আসতে আসতে মুনসির গলা একটু খাদে নামে বলে তমিজের বাপ মুনসির সন্তোষ কিংবা রাগ সম্বন্ধে কিছু বুঝতে পারে না, কোনো যন্ত্র ছাড়াই কেরামত গায় :
মাঝি বিনা বিল আর জল বিনা মাছ।
পুত্রহীন মাতৃকোল পুষ্প বিনা গাছ।।
আওরতে না পায় যদি মরদের চুম।
যতো জেওর দাও তারে রাতে নাহি ঘুম।।
মাঝিরা উল্লাসে চিৎকার করে, কী শোলোক কল্যা গো, আহা! কেউ কেউ তার শেষ দুটি চরণ ভুলভাল আওড়ায়। তমিজ চেঁচিয়ে বলে, ও বাজান, এটি আসো গো, বেড় জালটা খাটাই। তোমার বাঘাড় হামরা তোমার হাতোত তুল্যা দিমু। বাঘাড় তো ফিরিয়ে নিয়েছে মুনসি নিজে, সেই মাছ নিয়ে তমিজের এরকম লালচ তমিজের বাপের পছন্দ হয় না। বরং ছেলের সংকল্পকে স্পর্ধা বিবেচনা করে সে একটু ভয়ই পায়।
মাঝিদের সঙ্গে পুরনো কুটুম্বিতার সুত্রে তো বটেই, কেরামতের গানের টানে, এমন কি তমিজের বাপের কান দিয়ে মুনসির শোলোকের আঁচেও হতে পারে, ছোটো রুই, মেজো শোল, সেজো মাগুর পানিতে লাফায় এবং পানি থেকে জাল থেকে ডাঙায় লাফিয়ে লাফিয়ে একই সঙ্গে লুকোচুরি ও গোল্লাছুট খেলায় মেতে ওঠে। মাছের বাচ্চারা ডাঙায় পড়তেই মাঝিদের বাচ্চারা ছুটতে থাকে তাদের পেছনে। এইসব দেখতে দেখতে তমিজের বাপ শোনে মুনসির শোলোক,
মাদারি নামিল জঙ্গে হস্তে তলোয়ার।
কোম্পানি সিপাহি মরে কাতারে কাতার।।
গোরা টেলর হস্তে ধরে কামান বন্দুক।
মাদারিরে দেখি তার সিন্য ধুকধুক।।
মুনসির গানের প্রতিধ্বনি বাজে কেরামতের গলায়। তমিজের বাপ শোনে আর ভাবে, হায়রে, কোনকালের সব পাওনা-গান, গড়াতে গড়াতে এই ফাতরা মানুষটার পাল্লায় পড়ে সেটার কী চেহারা হয়েছে :
বিলে না পরশ যদি পায় মাঝি অঙ্গ।
জল শুকাইয়া যায়, না থাকে তরঙ্গ।।
কেরামতে বলে শুন শুন দিয়া মন।
কাৎলাহারে জল কান্দে আয় মাঝিগণ।।
হঠাৎ করে তমিজের বাপ মাঝির বাচ্চাদের দিকে চিল্কার করে ওঠে, ওটি যাস না, ওটি যাস না! তার নিচু স্বরের কথা শোনে কে? ব্যাপারটা কী?-কারো একটা জাল থেকে ছিটকে পড়েছে একটি কিশোর কালা, সের খানেকের কম হবে না। বিলের এই বাকে বিলের ভেতরেই গলা বাড়ানো নতুন-জাগা ডাঙার ওপর দুষ্টু মাছ মুখ গুঁজে দিয়েছে বালির ভেতর। বালকেরা ছুটছে সেদিকে, কুদ্স মৌলবি তার পেছনে ছুটতে ছুটতে বলে, আরে এই ছোঁড়া, ওটি যাস না। দলদলার মধ্যে পড়বু। তা কে শোনে কার কথা? মৌলবিকে অগ্রাহ্য করে আবিতনের বাপের নাতি, মানে বুলুর বেটা, এদের মধ্যে সে-ই একটু ডাঙর, সবাইকে গায়ের ধাক্কায় সরিয়ে লাফিয়ে পড়ে ধরে ফেললো কালার লেজটা। কিন্তু মাছের বাচ্চা নিজের লেজ তো লেজ, বুলুর বেটার হাতটাও টেনে নেয় বালির ভেতর। আসলে কিন্তু হাত ডোবার আগেই হাঁটু ভেঙে বসা পা দুটো তার কোমর পর্যন্ত ড়ুবে গেলেও হাতটা সে বালি থেকে বার করে নি! কুদুস মৌলবি চাঁচায়, আরে চ্যাঙড়াটা মরে, তোমরা কেউ দেখো না? বলতে বলতে ছুটতে থাকে কাদার ভেতর দিয়ে। আবার এই দেখতে দেখতেই তমিজের বাপ শোনে পাকুড়গাছের শোলোক :
মজনু হাঁকিয়া কয় ভবানী সন্ন্যাসী।
গোরাগণে ধরো আর দাও সবে ফাঁসি।।
গিরিবৃন্দ অসি ধরে ভবানী হুংকারে।
গোরাগণে পাঠাঁইয়া দেয় যমদ্বারে।।
বুলুর বেটাকে সামলাবার জন্যে উঁচু পাড় থেকে নামতে গিয়েও মুনসির শোলাকের খেই হারাবার ভয়ে তমিজের বাপ থমকে দাঁড়িয়েছিলো। তাকে ফের থামতে হয়। কেরামতের মুখে মুনসির নষ্ট প্রতিধ্বনি শুনতে :
কেরামতে ডাকে মাঝি জলে ফেলো জাল।
মাছ ধরো মণ্ডলেরে করো হে নাকাল।।
এবার কেরামতের দিকে কারো খেয়াল নাই, সবাই ছুটছে বিলের ভেতর জেগে ওঠা চোরাবালির ডাঙায়। বালির ভেতর ড়ুবন্ত বুলুর বেটার মাথা সই করে কে একজন ছুঁড়ে দেয় কৈ জাল। তমিজের বাপের ঘাড় থেকেই সেটা নেওয়া হয়েছে। তার মাথাটা আটকে যায় জালের ভেতর। সবাই তাকে ডাকে আফাজ, ভয় করিস না বাপ। বালুর মদ্যে সাঁতার কাট, সাঁতার কাট। নাক উপরের দিকে তুল্যা রাখ। কিন্তু টান দিলে জালটা আর ফেরত আসে না, বালির টানে কিংবা বালির ভেতরে ওঁৎ পেতে থাকা গজারের দাঁতে জালের সুতা ছিড়ে যায় পটপট করে। থামো, জাল আর টানো না বলতে বলতে তৌড়া জালের হাতে রাখার দড়ির মাথায় বড়ো একটা গোল মালা তৈরি করে জালের দিকটা ধরে ছুঁড়ে দেয় তমিজ। এতে আটকে পড়ে আফাজের মাথা। হয়তো আফাজ আগেই মারা গেছে বালির ভেতরে, কিংবা এই দড়ির গোবরাতেও তার মরণ হতে পারে, প্রাণপণ টানে তাকে তুলে আনা হয় ডাঙার ওপর।
আবিতনের বাপের বিলাপে কাৎলাহার বিলের আর আর আওয়াজ সব স্থগিত থাকে, দুই পাড় নিয়ে সমস্ত বিল জবুথবু হয়ে জড়ো হয় আফাজের লাশ ঘিরে।
গফুর কলুর সঙ্গে নিকা বসার পর আবিতন তো বাপের বাড়ির ছায়া মাড়াতে পারে, আবার মাঝিরাও ঐ বাড়ি থেকে একটু সরে সরেই থাকে। প্রথম স্বামীর বেটার সঙ্গে আবিতনও দেখা করার সুযোগ পায় না। অনুমতি দেয় না মাঝিপাড়া, আর গফুর কলু ছেলেটিকে সহ্যই করতে পারে না আফাজের কাজ জুটলো মণ্ডলের বাড়ি, দিনরাত তাই তাকে থাকতে হয়েছে সেখানেই। আবিতনের মা কখনো কখনো ভালো মাছটা তরকারিটা পিঠাটা হলে মাঠ থেকে কী বিলের ধার থেকে আফাজকে ডেকে খাওয়ায়, আবিতনের সঙ্গে চুপচাপ কোথাও তাকে দেখা করিয়ে দেওয়ার সুযোগও খোজে। তা আজ তার এমনি কপাল, আফাজ নিজেই গিয়েছিলো নানীর কাছে। মনে হয় ভাত খেতেই গিয়েছিল। তা মাঝিপাড়ার এইসব হৈ চৈয়ের মধ্যে নানীর দেওয়া ভাত আর খেতে পারে নি। এমন কি মণ্ডলবাড়িতে কামে না গিয়ে নানার পিছে পিছে সে চলে আসে কাৎলাহার বিলে। নানার তৌড়া জালটাও নিয়ে এসেছে ঘাড়ে করে।খুব এলোমেলোভাবে এই বৃত্তান্ত বলতে বলতে আবিতনের বাপ গপ্পের খেই হারিয়ে ফেলে আর কাঁদে।
বিলের ধারে চোরাবালি থেকে কয়েক হাত দক্ষিণে নিজের নিজের খলুইতে মাছ গুছিয়ে নিতে নিতে সবাই বসে লাশ ঘিরে। কুদুস মৌলবি মসজিদে একজনকে খাটিয়া আনতে পাঠিয়ে আয়াৎ পড়তে আরম্ভ করলে আফাজের মৃত্যু প্রকট হয়ে ওঠে, কেউ কেউ ফোঁপাতে শুরু করে, আবিতনের বাপ হামলে কেঁদে ওঠে। কোরানের আয়াত, ফেঁাপানো ও হামলানো কান্নার এলোমেলো বিন্যাস ভেঙে পড়ে একটি মোটা ও খসখসে স্বরের হুঙ্কারে, মাছ চুরি করিস? শালা ডাইঙার বাচ্চারা আসিছিস মাছ মারবার?
তমিজের বাপ তাকায় বিলের উত্তর সিথানে। মুনসিই না শোলোক দিয়ে, শোলোকের ভোলা প্রতিধ্বনি দিয়ে সবাইকে লাগিয়ে দিলো বিলের দখল নিতে, আবার সে-ই কিনা এখন এসেছে তাদের শাস্তি দিতে।-মুনসির এ কী ব্যবহার?—এই সময় কৃষ্ণপক্ষের চাঁদ তার গতর থেকে ঘোলা আলো চেঁছে ফেলে মোটা সাদা রেখায় ফোকাস ফেলে মাঝিদের ওপর। সেই আলোয় ভর করে দক্ষিণ থেকে আসে উত্তরের প্রতিধ্বনি, জাউরারা সব তোরা মাছ ধরবার আসিস কার হুকুমে রে? তমিজের বাপ তার মাথাটা দোলায় একবার বিলের দিকে, একবার ডাঙার দিকে। মাথায় তার কামকাতর কুমারীর শিহরণ : মুনসির মাছের নকশা আঁকা লোহার পান্টির ঘা খাওয়ার লোভে ও ঘা খাওয়ার ভয়ে তার গোটা শরীর থরথর করে কাঁপে।
তিন ব্যাটারির টর্চের আলো প্রথমেই সরাসরি পড়ে তমিজের মুখে এবং আবদুল কাদের যতোটা পারে অবাক হয়ে বলে, তমিজ? তমিজ, তুই?
শালা নিমকহারাম, জাউরা শালা নিমকহারামের একশেষ। ওর নিমকহারাম বাপটাকও তো দেখিচ্ছি। ঐ বুড়া না ফকিন্তি ধরিছিলো? কিসের ফকিরান্তি! শালা জাউরাটা মাছ চুরি করিচ্ছে অনেক দিন থ্যাকা। বুধে বুধে সাত, বিদ আর শুক্কুরবার, নয়দিনও হয় নাই, শুওরের বাচ্চা একটা বাঘাড় চুরি করবার যায় ধরা পড়লো। আবার আজ আসিছে ব্যামাক মাঝিগোরে লিয়া। শরাফত মণ্ডল তমিজের বাপকে ছেড়ে এবার ধরে তমিজকে, কুত্তার বাচ্চা, এই জন্যে তোক জমি বর্গা দিছিলাম? জমির ধান তো চুরি করলুই, প্যাট তোর তাও ভরে না, না? এখন হামার জমির ধানের ভাত খাবার সখ হছে হামার বিলের মাছ দিয়া?
আবদুল আজিজ এসে পড়ে এবং আফাজের মৃত্যুই তার প্রধান মনোযোগ পায়। যারা মসজিদে গিয়েছিলো খাটিয়া আনতে, পথে আজিজকে তারা সব জানিয়েছে। আজিজ এসে নতুন করে সব জেনে নেয় এবং গম্ভীর হয়ে রায় দেয়, মার্ডার কেস।
স্ত্রীর প্রথম স্বামীর ছেলের ওপর গফুর কলু কখনোই সন্তুষ্ট নয়, এখন শ্বশুরকে সামনে দেখে সেই ছেলের জন্যে তার ভালোবাসা উথলে ওঠে, এই ছোলটাকে তোমরা কতো কষ্ট দিলা, মায়ের সাথে বেটাক দেখাও করবার দাও নাই। এখন বেটির ওপরে কোদ্দ করা তার বেটাক তোমরা চুবায়া মারো দলদার বালুর মধ্যে। তোমরা কী মানুষের পয়দা গো? এখন ফাঁসিত উঠ্যা বোঝো, বিশ্বাস বন্ধ হয়া মরা কতো সুখের!
বিল চুরির ব্যাপারটা গৌণ হয়ে যাচ্ছে দেখে শরাফত বিরক্ত হয়। এবার সে হুকুম করে তার সঙ্গের লোকদের, হুরমতুল্লা, কালুর বাপ, গফুর, তোমরা ইগলানেক বান্দো। কাল বেনবেলাত থানাত চালান দেওয়া হবি।
থানার কথায় মাঝিরা কিন্তু তেমন ভয় পায় না, কালাম মাঝির ছেলেই তো পুলিসের লোক। থানা তাদের কী বাল ছিড়বে? সবাই এদিক ওদিক তাকায়, কিন্তু কালাম মাঝি কোথাও নাই। কে যেন বুধাকে জিগ্যেস করে, ক্যা রে তোর মামুক দেখিচ্ছি না।
মামু তো আসে নাই। আফসারের সাথে কুটি ব্যান গেলো। বুধার জবাবে কেউ কেউ আশ্বস্ত হয়, কালাম ওর ছেলেকে টেলিগ্রাম করতে গেছে, ভোরবেলার আগেই তহসেন চলে আসবে পুলিস ফোর্স নিয়ে। কিন্তু কুস মৌলবি জানায়, কালাম মিয়া তার ভাইসতাক লিয়া গেছে সাবগ্রাম। আজ সাবগ্রামের হাট লয়? তখন সবার মনে পড়ে, জুম্মাঘর থেকে বেরিয়ে কালাম মাঝি কি তার ভাস্তে ওদের সঙ্গে আর আসে নি।
তমিজ কোনোদিকে না তাকিয়ে বলে, অতো সাটাসাটি কিসক? কালাহারের বিল তো মাঝিগোরে বিল। মাঝিরা মাছ ধরবি না?
মণ্ডল এতোটাই রেগে যায় যে, তার হুকুম বেরোয় বাঁকাচোরা হয়ে, হুরমতুল্লা। কী কলাম? বান্দো, শালাক বন্দো।
শরাফতের আদেশ পালন করতে এগিয়ে হুরমতুল্লা কাঁপে, এতোটাই কাঁপে যে নিজের পা দুটোকে মাটির ওপর ঠেকিয়ে রাখাটাই তার মুশকিল হয়ে পড়ে। তার অবস্থা দেখে হামিদ সাকিদার কোনো দড়ি ছাড়াই ধরতে আসে তমিজকে। আবদুল কাদের বাধা দেয়, থাক, তারপর গলা নামিয়ে তমিজকে বলে, তুই এটা করলি কী? মাঝিপাড়ার কেননা নালিশ ধাকলে গোলাবাড়ি লীগ অফিসে কলেই তো একটা মিটমাট হবার পারে। তুই এখন বিল ডাকাতির আসামী, আবার খুনের মোকর্দমাও হবি তোর নামে। ভোটের আগে কি ঝামেলা শুরু করলি?
এসব যাত্রার ডায়ালগ শুনে শরাফত ধৈর্য হারায়, প্যাচাল পাড়ো না কাদের। মাঝির বাচ্চা মরিছে মাঝির দোষে। পাপ বাপোকও ছাড়ে না। এখন সোয়াগের কথা থোও তো। হামার বিলের মাছ ডাকাতি করিছে, কী করা লাগে না লাগে হামিই বুঝমু।
এখন সব কয়টা বান্দো, কাল থানাত চালান দেওয়া হবি।
কাদের তমিজের সঙ্গে নিচু স্বরে কথা বলা অব্যাহত রাখলে আজিজও বিরক্ত হয়। গতকাল গোরুর গাড়ি করে ইট নিয়ে আসার সময় মাঝিদের এসব শয়তানি সে আঁচ করেছিলো। আজ ছেলের কবর বাঁধানো নিয়ে ব্যস্ত ছিলো মিস্ত্রি খাটাতে। নিজে দাঁড়িয়ে থেকে কাজ করালো বলে হুঁটসিমেন্ট বেঁচে গেছে মেলা। সেগুলো সিজিলমিছিল করে আসতে তার একটু দেরি হলো। সরকারি চাকরি করে, আঁটঘাট না বেঁধে, আইনকানুন হিসাব না করে সহজে মুখ খোলার বান্দা সে নয়। এখন সরেজমিন দেখে সিদ্ধান্তে আসে, শয়তানের গোড়া এই শালা তমিজ। এর নামে কয়েকটা কেস দেওয়া যায়। এক খুনের দায়েই তো ফাঁসিতে ঝুলবে। যাক, আইন হাতে নেওয়ার দরকার নাই। আপাতত তমিজ শালা যেন পালাবার না পারে।
কেরামত আলিকে দেখে আবদুল কাদের নতুন করে অবাক হয়, তুমি তো আচ্ছা নিমকহারাম গো! সেদিন অতো বড়ো মিটিঙে অভোলা নেতার সামনে তোমার গান করার সুযোগ করে দিলাম। এখন তুমি মাঝিদের উস্কানি দিয়ে বেড়াও! কাজিয়া ফ্যাসাদ বাধীননা কী তোমার পেশা নাকি?
কুদ্দুস মৌলবি ভয়ে ভয়ে তাগাদা দেয়, লাশ লিয়া চলো। লাশ ওঠাও।
স্ত্রীর পক্ষ থেকে গফুর কলু আফাজের মৃত্যুর একটা বিহিত করতে চায়, তমিজের বাপ, তমিজ, বুধা, আবিতনের বাপ, কালাম মাঝি লোগলির নামেই থানায় ডাইরি করা লাগে। মাঝিপাড়ার ব্যামাক মানুষই আসামী হবি।
থানার ব্যাপারটা আবদুল কাদের এখন স্থগিত রাখতে চায়।মাঝিপাড়ায় ভোট একেবারে কম নয়। গফুর এখন লাশ লিয়া তোর বাড়িত যা। তোর বৌ তার বেটাক একটা নজর দেখবি না?
কিন্তু কলুর ঘরে আফাজের লাশ নিয়ে গেলে মাঝিরা ফ্যাসাদ বাধাতে পারে। শরাফত মণ্ডল তাই হুকুম দেয়, না লাশ আবিতনের বাপই লিয়া যাক। এতোক্ষণে সে শোক প্রকাশ করে মৃত বালকটির জন্যে, আহা! ছোঁড়াটা সবসময় চোখের সামনে সামনে থাকতো। কাল সকালে আর তাকে গোরুর পেট তোলার জন্যে বকাঝকা করা যাবে না। চাঁদরের খুঁটে শরাফত চোখের কোণ মোছে, নোনতা গলায় সে আক্ষেপ করে, মাসুম বাচ্চাটার উপরে দিয়া তোরা আল্লার কাছে গুনাগারি দিলু। তোদের গুনার তো আর শ্যাষ নাই। আল্লার গজব পড়লো তো সাথে সাথেই, দেখলুই তো। আল্লার বিচার আল্লা করিছে, এখন হবি হাকিমের বিচার।
আবদুল কাদের কেরামতকে আড়ালে নিয়ে গেলো, তোমার নামে পুলিসের ওয়ারেন্ট আছে না? সবই তো জানি। পাকিস্তান নিয়া গান লিখতে বললাম, লেখলা না। এখন জেলের ভাত খাও। কেরামত তবু গম্ভীর হয়ে থাকলে কাদের আরেকটু নরম হয়, কাল একবার আসো। দেখি, ইসমাইল ভাই কী কয়।
জলকাদামাখা আফাজের লাশ নিয়ে মাঝিরা রওয়ানা হলে কুদ্স মৌলবির মুখে কলেমা শাহাদতের ক্রমাগত আবৃত্তি অপঘাতে মৃত্যুটি ছাড়া চারপাশের সব কিছুকে মুছে ফেলে।
বিলের পানি ওদিকে থিতু হয়, এই সুযোেগে কুয়াশা নিবিড় আলিঙ্গনে শুয়ে পড়ে বিলের ওপর। পাকুড়তলার ওপাশে ঝোপঝাড় থেকে মুনসির পোষা শেয়ালের পাল মুনসির পক্ষ থেকে, বিলের পক্ষ থেকে এবং নিজেদের পক্ষ থেকেও হুক্কা হুয়া ডাক। ছেড়ে মাঝিদের বিদায় জানালে এই আওয়াজ ধাক্কা মারে তাদের পাছায় পাছায়। এতোক্ষণে তাদের ভারী শীত করে। তাদের ঘাড়ের জাল ভিজে, পরনের ভবন ভিজে, গায়ের পিরান ভিজে এবং খাটিয়ার লাশও ভিজে জবজবে। শবযাত্রা এগোয়, শেয়ালদের বিদায় ধ্বনির আঁটো বাঁধনও ঢিলে হতে থাকে। বিলের সঙ্গে মিলনে,-ধর্ষণেই বলা যায়, নিয়োজিত কুয়াশায় ভিজে, মাঝিদের গায়ের হিমে জমে ও তাদের চোখের পানিতে গলে গিয়ে শেয়ালের ডাক গড়িয়ে পড়ে একটানা বিলাপে। এতে মেঘের মতো ঘুম নামে তমিজের বাপের চোখ জুড়ে। মাঝিপাড়ার কুপির কালচে লাল আলোগুলো ঝাপসা হয়ে একাকার হয়ে যায় কোনো কোনো রান্নাঘর কি উঠানের বিচালির ধোঁয়ার আড়ালে। শেয়ালের টানা ডাক কিন্তু হারিয়ে যায় না, বরং মিশে যায় আবির্তনের মায়ের ঘর থেকে আসা বিলাপের ভেতর। একটানা আওয়াজ ও একাকার আলোতে তমিজের বাপের ঘুম গাঢ় হয়। ঘুমের মধ্যে সে হাঁটে কখনো লাশের পেছনে, কখনো সামনে। তার টলোমলো পায়ের দিকে কারো কোনো খেয়াল নাই। কাৎলাহারের জীবদের খাদে-নামা বিদায় ধ্বনি হঠাৎ ফেটে পড়ে আবিতনের মায়ের হামলানো কান্নায়। এতেও তমিজের বাপের ঘুমে চিড় ধরে না। বরং ডাঙায় লাফিয়ে-পড়া মাছ ধরতে না গিয়েও সে ড়ুবে যেতে থাকে চোরাবালির ভেতর। তবে তার পা নিচে না ঢুকে পড়তে থাকে। সামনের দিকে। তমিজের বাপের কদমে কোনো প্রশ্ন নাই, নালিশ নাই। তার নীরব পদধ্বনিতে বাজে অস্পষ্ট অভিমান : তাদের ডেকে নিয়ে, উস্কানি দিয়ে নিজের কাছে টেনে মাঝিদের দুধের বাচ্চাটিকে মুনসি কেড়ে নিলো কোন বিবেচনায়? কোন আক্কেলে? কী পাষাণ হিয়া গো মুনসির!-অভিমানে চোখে তার পানি জমে ছুঁয়ে ছুঁয়ে, চোখ ভরে যায় নোনা পানিতে। কিন্তু চোখ দুটোই বন্ধ থাকায় পানি নিচে গড়ায় না। চোখের বন্ধ পাতার তাপে সেই নোনতা পানি ঘন হতে থাকে পাতলা শ্লেষ্ময়। এই শ্লেষ্মই জমে জমে সকালবেলা ফুটে উঠবে পিঁচুটি হয়ে।