২৯. কলকাতা থেকে ফেরার পর

রাহগুজর সৈল-এ হদিস হ্যয় বেবুনিয়াদ দহর্‌।
ইস খাবেবেমেঁ নহ করনা ফি তুম্ তামীরকা।
(ভিত্তিহীন এই জগতে তো কেবল এলোমেলো ঘটনার পরম্পরা,
এই ভাঙনের মধ্যে কিছু গড়ে তুলবার ভাবনা রেখো না মনে।)

কলকাতা থেকে ফেরার পর সতেরোটা বছর আমার কোনও না কোনওভাবে কয়েদখানাতেই কেটে গেল, মান্টোভাই। সব সময় মীরসাবের কথা মনে পড়ত। একটা অন্ধকার কুঠুরিতে তাঁকে হাত -পা বেঁধে বন্দি করে রাখা হয়েছে। আর মীরসাব বিড়বিড় করে বলে চলেছেন :

পত্তা পত্তা বুতা বুতা হাল হামারা জানে হ্যায়
জানে না জানে, গুল্ হি না জানে, বাগ তো সারে জানে হ্যায়।

হ্যাঁ, মান্টোভাই, ফুলেরা বড় নিষ্ঠুর, ওরা কারুর খোঁজ রাখে না, নিজের খুশবুতেই মাতাল হয়ে থাকে। কেন বলুন তো? দু-একদিনের জন্ম বলে? বড় তাড়াতাড়ি ঝরে যায় বলে? আমরাও তো ঝরে যাই, হয়তো ফুলের চেয়ে কিছু বেশীদিন দুনিয়াতে থাকি, তবু আমরা তো ফুলের কাছে গিয়ে দাঁড়াই, তাকে আদর করি, ফুল কিন্তু আমাদের দিকে ফিরেও তাকায় না। ফুলজন্ম পেতে ইচ্ছে করে না আপনার, মান্টোভাই? সারা রাত একা একা নিজের সৌরভ নিয়ে ফুটে থাকা, তারপর ভোরবেলা ঝরে যাও। আহা, খোদার কী অপূর্ব সৃষ্টি-এই ফুলজন্ম-যেন একটা স্বর জেগে উঠেই অন্য স্বরের ভিতর হারিয়ে গেল। কেমন জানেন এই ফুলজন্ম? যেন মিঞা তানসেনের গলা থেকে সুরের একটা দানা গড়িয়ে পড়ল -জন্ম-মৃত্যু সব একাকার ওই দানার। ভিতরে, কিন্তু সারা জীবনেও তাঁকে আপনি ভুলতে পারবেন না। বুড়ো হয়ে যখন পিছন দিকে তাকিয়ে দেখছি, চহরবাগের সে বেগম ফলক আরাকে সুরের একটা দানা বলেই মনে হত আমার, হয়তো কোনও তবায়েফের গলা থেকে গড়িয়ে পড়েছিল, তারপর হারিয়ে গেছে, শুধু মৃত নক্ষত্রের মতো তার আলো জেগে আছে। আর সেই ফুলজন্মের দিকে তাকিয়ে তাকিয়ে থাকতে থাকতে আমি জরাগ্রস্থ হয়ে গেলুম।

হোশ ও সব্র্‌ ও খয়র ও দীন ও হবাস ও দিল ও তাব
উসকে এক আনেমেঁ কেয়া কেয়া নহ্ গয়া মৎ পুছো।

সে এসেছিল শুধু একবার, মান্টোভাই। তার এই আসাতেই আমার কী কী চলে গেল জানতে চাইবেন না। আমার শান্তি ও ধৈর্য, শক্তি ও স্বাস্থ্য, যৌবন ও উদ্যম, আরও কত কীই যে চলে গেল। সে আমাকে কী দিয়ে গেল? জুনুন। মধ্যরাত্রি চিরে হারিয়ে যাওয়া পুকার। ওই দেখুন, সেই পুকার বয়ে নিয়ে যাচ্ছে মির্জা গালিবের একটা এতিম শেরকে :

ইশক সে তবিয়ৎ নে জিস্ত কা মজা পায়া
দর্দ কি দাবা পায়ি, দর্দ-ই লাদওয়া পায়া।

হ্যাঁ, ভাইজানেরা, জীবনের কত আনন্দকেই তো নিয়ে এসেছিল ভালবাসা, কত যন্ত্রণার দাওয়াই পেয়েছিলুম, কিন্তু এমন এক যন্ত্রণা সে রেখে গেল, হায় খোদা, তার কোন দাওয়াই তোমার কাছেও নেই। কেন নেই? খোদা খুদ এক দর্দ হয়। যত বয়স বেড়েছে, মান্টোভাই, আমার মনে হয়েছে, আল্লাই আসলে আদিম বেদনা। আশ শহিদ। বেদনা ছাড়া কেই বা আমাদের জীবনের সাক্ষী হতে পারে বলুন?

না, না, উশখুশ করবেন না, ভাইজানেরা, আমার মনে আছে ফ্রেজারসাবের খুনের বৃত্তান্তটা আপনাদের বলতে হবে। আসলে কী জানেন, নিজের জীবনের কথা আর বলতে ইচ্ছে করে না, নিজেকে যত মুছে দেওয়া যায়, ততই শান্তি। একসময় যে গজল লেখা ছেড়ে দিয়েছিলুম, তা দুঃখ দারিদ্রের চাপে নয়, কে আমার লেখা পড়বে, তা ভেবেও নয়; মনে হয়েছিল, এবার নিজের সঙ্গেই কথা বলার সময়; হ্যাঁ মান্টোভাই, বিশ্বাস করুন, আমি নিজের হাতে আমার শিল্পকে হত্যা করেছিলুম শুধু বেদনার পায়ে কদমবুশি করার জন্য। আমি বিশ্বাস করি, মান্টোভাই, শিল্পিকে তার জীবনের সেই মুহূর্তটি খুঁজে নিতে হবে, যখন সে তার শিল্পকে হত্যা করবে। আসলে এই দুনিয়াতে সে কেন এসেছে? না, কিছু সৃষ্টি করার জন্য নয়। আল্লার পর আর কারুর কিছু সৃষ্টি করার নেই। আমরা তার সৃষ্টিকে নকল করতে পারি মাত্র। আমরা শুধু পারি, জীবনকে ছুঁয়ে থাকতে। খোদার এই দানের তুলনা নেই, মান্টোভাই। কলকাতা থেকে ফেরার পথে এক বৃষ্টির দিনে আমি একটা নিঃসঙ্গ টিলা দেখেছিলুম। সবুজ প্রান্তরের মাঝে দাঁড়িয়েছিল টিলাটি, আর তার পায়ের কাছে ছড়িয়ে আছে শ্যাওলা-ঢাকা অনেক সমাধি। আমি কেঁদে ফেলেছিলুম। জীবন এত নিঃসঙ্গ, এত সুন্দর, এত বর্ষার আদরে স্নাত। গভীর রাতে এক সুফি সাধক কাঁদতে কাঁদতে বলেছিলেন, এই দুনিয়ার বন্ধ কফিনের ভিতরে কত ভুল আর অজ্ঞানতা নিয়েই না আমরা বেঁচে আছি, শুনতে পাচ্ছ তোমরা? মৃত্যু এসে যখন কফিনের ডালা খুলবে, ডানাওয়ালা উড়ে যাবে অনন্তের পথে, আর যাদের ডানা নেই, তারা কফিনেই আটকে থাকবে। দোস্ত, কফিনের ডালা খোলার আগেই এমন কিছু করো যাতে পাখি হতে পারো, ডানা গজাও, হাত দুটোকে যত তাড়াতাড়ি পারো ডানা বানিয়ে ফ্যালো। সব শুনেছি মান্টোভাই, তবু আমার ডানা গজাল না, একদিন মুখ থুবড়ে মরে পড়ে রইলুম শাহজাহানাবাদের খণ্ডহরে।

উতলা হবেন না, ভাইজানেরা এই বুড়োকে একটু নিজের মতো করে কথা বলেতে দিন। কথা দিচ্ছি, কোনও কিস্সাই বাদ পড়বে না। তো এক রাতে ফ্রেজারসাব খুন হয়ে গেলেন। কাশ্মীরি গেটের কাছে গুলি করে মারা হল হয়েছিল তাঁকে। খবরটা শুনে আমি পাথর হয়ে। গিয়েছিলুম। ফ্রেজারসাব দিল্লির রেসিডেন্ট ছিলেন ঠিকই, কিন্তু তার সঙ্গে আমার দোস্তিরই সম্পর্ক ছিল বলতে পারেন। গোরাদের মধ্যে আলাদা ধাতের মানুষ ছিলেন। যাদের সঙ্গে চাকরি করতেন, তাদের একেবারেই পছন্দ করতেন না। আমাদের দেশটাকে জানতে চেয়েছিলেন, নিয়মকানুনের তোয়াক্কা করতেন না। তাঁর কিতাবখানা থেকে কত বই এনে পড়েছি। সেখানে বসে কত যে গল্প হয়েছে ফ্রেজারসাবের সঙ্গে। তিনিই আমাকে প্রথম সুফি সাধক জামি-র এক আশ্চর্য কথা শুনিয়েছিলেন মান্টোভাই। কথাটা বলি, ভাইজানেরা? জামি বলেছিলেন, মানুষ কে? সেই নূরের প্রতিফলন। আর এই দুনিয়া? অনন্ত সমুদ্রের একটা ঢেউ। নূর থেকে কি প্রতিফলন আলাদা করা যায়? সমুদ্র থেকে ঢেউকে আলাদা করা যায়? শুনে রাখো, এই প্রতিফলন ও ঢেউই নূর আর সমুন্দর। ফ্রেজারসাবের সঙ্গে দোস্তির আর একটা কারণও ছিল। সম্পত্তির ব্যাপারের মামলায় শামসউদ্দিনের বৈমাত্রেয় ভাই আমিনুদ্দিন ও জিয়াউদ্দিনকে সাহায্য করতেন তিনি। আর আমি তো শামসউদ্দিনের চোখের বিষ ছিলুম।

ফ্রেজারসাবকে হত্যার অপরাধে সহিস করিম খানকে গ্রেফতার করা হল। করিম খান ছিল। শামসউদ্দিনের কর্মচারী। দিল্লির ম্যাজিস্ট্রেটের সঙ্গে আমার দোস্তি ছিল। মাথায় ঋণের দায়, দিনের বেলা হাভেলি থেকে বেরুতে পারতুম না। ফ্রেফতারের ভয়ে, রাতে প্যাঁচার মত উড়ে যেতুম ম্যাজিস্ট্রেটসাবের বাড়িতে। ফ্রেজারসাবের খুনের বিষয় নিয়েও কথাবার্তা হত। শামসউদ্দিনের সম্পর্কে আমি কখনও কিছু বলিনি। কিন্তু তদন্তে জানা গেল, শামসউদ্দিনই ফ্রেজারসাবকে খুন করার জন্য করিম খানকে কাজে লাগিয়েছিল। শাহজাহানাবাদের রাস্তায় প্রকাশ্যে দুজনের ফাঁসি হয়েছিল। আমি ফাঁসি দেখতে যাইনি; শুনেছি ফাঁসি দেখার জন্য ভিড় উপচে পড়েছিল। মানুষের নিষ্ঠুরতার সীমা নেই, মান্টোভাই। সেই প্রথম বুঝলাম, ইংরেজও একইরকম বর্বর। কী জানি, হয়তো সভ্যতার ইতিহাসই আরেকরকম ভাবে বর্বরতার ইতিহাস।

এরপরই শাহজাহানাবাদে শুরু হল আমার সম্পর্কে গালিগালাজ। আমিই নাকি শামসউদ্দিনকে ফাঁসিতে চড়ানোর জন্য দায়ী। কেউ বুঝল না, যে বীজ তুমি জমিতে বুনবে, তার ফসলই তো তোমাকে তুলতেই হবে। এমনকী উমরাও বেগমও একদিন এসে আমাকে জিজ্ঞেস করল, মির্জাসাব, আপনিই শামসউদ্দিনের ভাইয়ের কথা ম্যাজিস্ট্রেটকে বলেছেন?

-তুমি বিশ্বাস করো বেগম?

-মহল্লার পর মহল্লা সবাই এক কথা বলছে।

-সবাই বললেই সত্যি?

-আমি জানি

-কী?

-আপনি এ-কাজ করতে পারেন না।

-তবু আমাকে জিজ্ঞেস করতে এলে?

-গোস্তাকি মাফ করবেন।

-শামসউদ্দিন আমার যতবড় শত্রু হোক, আমি তার মওত চাইতে পারি?

-আমি ভুল করেছি মির্জাসাব।

-বেগম, অনেক মানুষের কথার মধ্যে সত্যি থাকে না। সত্য শুধু একজনের, একা মানুষের। অনেক মানুষের মতামত মানেই তা মিথ্যে।

-আমাকে মাফ করুন, মির্জাসাব।

আমি উমরাও বেগমের হাত ধরে বসে রইলুম। এ যেন নতুন করে ভালবাসা। তার ভিতরে মরে যাও আসাদ। তোমার পথ অন্য দিকে। আকাশ হও, কুঠার দিয়ে কারাগারের দেওয়াল ভাঙো। পালাও। রং-রঙের ভিতরে জন্ম নাও, এখনই। মরো, আর চুপ করে থাকো। নীরবতা মানেই তুমি মরে গেছ। পুরনো জীবনে তুমি শুধু নীরবতা থেকে দৌড়ে পালিয়েছ। দেখো, নির্বাক চাঁদ এবার আকাশে ফুটে উঠেছে।

ভাইজানেরা, আমিই শামসউদ্দিনের খুনি, এই ছাপ্পা লেগে গেল আমার গায়ে। বেশ কয়েক বছর শামসউদ্দিনের সমাধি হয়ে উঠেছিল দিল্লির মানুষদের তীর্থযাত্রার জায়গা। আর সিপাহি বিদ্রোহের সময় অনেক ব্রিটিশের সমাধি অটুট থাকলেও ফ্রেজারসাবের সমাধি খুঁড়িয়ে দেওয়া হয়েছিল। মানুষ আসলে ব্যাক্তিকে তার নিজস্বতাকে দেখে না -কোনও না কোন জাত দিয়ে বিচার করে।

ইংরেজরাও এভাবেই আমাদের মুসলমানদের সবসময় সন্দেহের চোখে দেখেছে, আর হিন্দুদের দেখেছে অন্য চোখে। কেন জানেন? রেনেসাঁসের ধ্বজা তো তুলে ধরেছিল হিন্দুরা কলকাতার বাঙালি হিন্দুরা। মান্টোভাই এরা বেশির ভাগ সব সুদখোর মহাজন ছাড়া আর কিছু নয়। সিরাজউদ্দিনসাব তো কলকাতা থেকে আমাকে অনেক চিঠি লিখেছে, আমিও উত্তর দিতুম, তো তাঁর চিঠি পড়তে পড়তে আমি বুঝেছিলুম, কলকাতা আসলে একটা দো-আঁশলা শহর; রাজধানী বলে কথা, শিক্ষা-সংস্কৃতি, সবকিছুরই জোয়ার বয়ে যাচ্ছে, কিন্তু নিধুবাবুর গানের প্রাণ আর সেখানে নেই।

প্রাণ শাহজাহানাবাদেও ছিল না। কোনক্রমে খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে চলা দরবার। ইংরেজরা সব গ্রাস করে নিচ্ছে। মান্টোভাই, ওরা তো হাঙরের মতো খায়। কালু একদিন এক ফকিরকে নিয়ে। হাজির হল দিবানখানায়। ফকিরসাব অনেকক্ষণ আমার দিকে তাকিয়ে থাকলেন।

-কী দেখছেন? আমি জিজ্ঞেস করলুম।

-সামনে খুব খারাপ সময়, মিঞা।

-আর কত খারাপ সময় আমার জীবনে আসবে?

-আপনার কথা বলছি না।

-তা হলে।

শাহজাহানাবাদ কারবালা হয়ে যাবে, মিঞা।

আমি হেসে বললুম, আমার ভেতরে সেই কারবালা দেখতে পেলেন না কি?

-ঠিক তাই। আমি আপনার ভিতরে পুরো শাহজাহানাবাদকে দেখতে পেলাম মিঞা। এ শহরের সব পুরোনো হাভেলি, মসজিদ ভেঙে পড়ছে। রাস্তায় রাস্তায় ফাঁসিতে ঝুলিয়ে দেওয়া হয়েছে লোকদের। বেগমরা সব ছেঁড়া কাপড় পরে ঘুরে বেড়াচ্ছে। ছাগলের পেট থেকে জন্ম হচ্ছে সাপের বাচ্চার। আমি হা-হা করে হেসে উঠি। – এসব কবে হবে ফকিরসাব?

-হবে, হবে। আপনি তা দেখেও যাবেন, মিঞা।

-আর আমার কী হবে?

-আপনি তখন ইনসানে কামিল হয়ে যাবেন।

-হাসালেন ফকিরসাব। আমার মধ্যে ইনসানিয়াতই নেই।

ইনসানিয়াত নিয়ে কেউ পয়দা হয় না, মিঞা। আগুনে পুড়তে পুড়তে তবেই না হকিকায় পৌঁছবেন। আসুন একটা কিস্সা বলি।

কাল্লু যেন লাফিয়ে ওঠে। -হ্যাঁ, হ্যাঁ কিস্যা হোক বাবা। কালু ফকিরের গা ঘেঁসে বসে।

-শিষ্যদের দীনের কথা বলতে বলতে শাল আবদুল্লা একদিন ভরে পড়লেন। তার চোখ লাল, ঘন ঘন মাথা নাড়ছেন, তার সঙ্গে খিচুনি,। পরদিন ইবন সালিম জিজ্ঞেস করলেন, কী হয়েছিল আপনার মুর্শিদসাব? আবদুল্লা হেসে বললেন, তুমি যা ভাবছ তা নয়। কোনও শক্তি আমার। মধ্যে প্রবেশ করছিল না। বরং ওটা আমার দুর্বলতা। অন্য এক শিষ্য জিজ্ঞেস করলেন, এটা যদি দুর্বলতা হয়, তা হলে শক্তি কী? আবদুল্লা কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বললেন, শক্তি যখন ভেতরে প্রবেশ করে, শরীর মন তখন একেবারে শান্ত হয়ে যায়। কিছু বুঝলেন, মিঞা? সেই মানুষই হচ্ছে ইনসানে কামিল।

-বাবা- কাল্লু ফকিরসাবের পা চেপে ধরে।

-বোলো বেটা।

-আউর এক কিস্সা শুনাইয়ে বাবা।

কাল্লু ফকিরসাবের সঙ্গে কিস্সায় মজে গেল; আমি গিয়ে ঢুকলুম আমার কুঠুরিতে, শয়তানের সেই কামরা। তবে কি জানেন, মান্টোভাই, স্বেচ্ছাবন্দিত্বের দিনগুলিতে নিজের জন্যই কিছু কাজও করে উঠতে পারলুম। উর্দু দিবানকে নতুন করে গুছিয়ে তুললুম। কত গজলই যে বাদ দিয়েছি। নতুন করে পড়তে গিয়ে দেখলুম, অনেক গজলই দিবানে রাখা যায় না। ফজল-ই হক সাহেব ঠিকই বলেছিলেন, অনেক গজলেই ফারসি প্রভাব ছিল, সহজে বোঝা যায় না। আর আমি এতদিনে বুঝতে পেরেছি, যে গজল হিসাবে তার শিল্প মূল্য নেই। আসলে কী জানেন মান্টোভাই, কম বয়েসে গয়না, সাজপোশাকের দিকে বড় ঝোঁক থাকে মানুষের; নিজেকে দেখানোর জন্য সে অনেক জবরজং করে সাজে। কিন্তু সৌন্দর্য যতদিন না ভিতর থেকে ফুটছে, ততদিন শান্তি কোথায় বলুন? আমার ফারসি রচনা সংকলনের কাজও করে উঠতে পারলুম এই সময়েই। পাঁচ খণ্ডের সংকলন তৈরি হল। পাঁচ নম্বর খণ্ডে রেখেছিলুম বন্ধুদের কাছে লেখা আমার চিঠিপত্র। নাম দিয়েছিলুম পৰ্জ আহঙ্গ। সে সব চিঠি পড়লে খুবই মজা পেতেন। আর একটা ব্যাপার কি জানেন? নিজের লেখা ফারসি গদ্য পড়ে আমিই চমকে উঠতুম; নিজের পিঠ চাপড়ে দিয়ে বলতুম, মাশাল্লা, কেয়া লিখা মিঞা, বহুৎ খুব। হাসছেন কেন মান্টোভাই? আপনি কখনও এভাবে নিজের পিঠ চাপড়াননি? কোনও কোনও গল্প লিখে মনে হয় নি, আর ভাই, এ চিজ আমার ভিতরে কোথায় ছিল? ভিতরে ভিতরে এতদিন ধরে একে আমি বহন। করেছি? এতে দোষের কী আছে, মান্টোভাই? শিল্পী নিজেকে এইটুকু দিতে পারবে না? নিজের প্রতি এই সামান্য মুগ্ধতা তো সারাজীবন বাঁচিয়ে রাখতে হয়।

আলিফ বেগকে লেখা আমার লেখা খ-এর কথা বলি, ভাইজানেরা, শুনে মজা পাবেন। বেশি বয়েসে আলিফ সাবের এক ছেলে হয়েছিল। আমাকে চিঠি লিখে অনুরোধ করলেন, মিঞা, আমার ছেলের জন্য একটা নাম বেছে দিন। তো আমি তাঁকে লিখে পাঠালুম, আপনার ছেলের নামের জন্য আমাকে একটুও ভাবতে হল না, এক ফোঁটা সময় খরচ হল না। নামটা মাথায় খেলে যেতেই আমি একটা কবিতাও লিখে ফেললুম।

বৃদ্ধ বয়েসে আলিফের এক
অপরূপ পুত্র জন্মেছে।
তার নাম দিলাম হজ্জা
এ তো সকলেই জানে।
বয়সকালে সব আলিফ হাই হয়।

তাই হয় না কি না, বলুন ভাইজানেরা? আলিফ একটা সোজা দাগ আর হজ্জা কুঁকড়ে যাওয়া দাগ। বয়স হলে সব মানুষই কুঁকড়ে হমজা হয়ে যায়।

এভাবেই আমার শয়তানের কামরায় বসে চিঠি লিখে, মজা করে দিনগুলোকে কোনওমতে পার করে দিচ্ছিলুম। এরই মধ্যে আবার এই ইংরেজ পাওনাদার, লোকটার নাম ম্যাকফারসন, কোর্ট থেকে অর্ডার বার করল, আমাকে আড়াইশো টাকা ফেরত দিতে হবে। এমন নসিব আমার, সেইসময় একদিন হঠাৎ বাড়ি থেকে বেরিয়েছিলুম আর সঙ্গে সঙ্গে ইংরেজের সেপাই এসে আমাকে গ্রেফতার করল। জেলেই যেতে হত; লোহারুর নবাব, আমার দোস্ত আমিনুদ্দিন ভাই এসে বাঁচালেন। আমার হয়ে চারশো টাকা দিয়ে তিনি ব্যাপারটা ফয়সালা করলেন। একে কি মানুষের মতো বাঁচা বলে, ভাইজানেরা? কতদিন একটা কুঠুরিতে নিজেকে আটকে রাখা যায়? আর বাইরে এলেই আপনার জন্য অপেক্ষা করে আছে কয়েদখানা। তবু হাসতে হাসতে নিজেকে বলেছি:

রঞ্জ সে খু গর হুয়া ইনসাঁ তো মিট যাতা হ্যয় রঞ্জ
মুশকিলেঁ ইতনি পড়ীঁ মুঝ পর কে আসাঁ হো গঁয়ে
(দুঃখে অভ্যেস হয়ে গেলে দুঃখ ঘুচে যায়
কষ্ট এত পেলাম যে সহজ হয়ে গেল।)

.

শামসউদ্দিনের ফাঁসির পর ফিরোজপুর-ঝিরকার নবাবি বাজেয়াপ্ত হয়েছিল। আমি পেনশন পেতাম ইংরেজ বাহাদুরের কাছ থেকে। বাষট্টি টাকা আট আনা-ই। ওই আট আনা আমার আর পেছন ছাড়লো না, মান্টোভাই। আমার নসিবে সব কিছু আট আনাতে ধার্য; ষোলো আনা কোনও দিন পেলাম না। এত দুর্দশার মধ্যেও কিছু কিছু মানুষের সান্নিধ্য আমাকে বাঁচিয়ে। রেখেছিল। ফজল-ই-হক সাব দিল্লি থেকে চলে যাওয়ার পর আমার বুকের ভেতর যেন একটা ইমারতই ভেঙে পড়ল। তাঁর মতো বুজুর্গ আদমি সারা শাহজাহানাবাদে আর কজন ছিল বলুন? যেমন তার পাণ্ডিত্য, তেমনই মানুষকে অনুভব করতে জানতেন। যে-পদে তিনি চাকরি করতেন, তাঁর মতো যোগ্যতার মানুষের জন্য সে পদ নয়। তবু চাকরি চালিয়ে যাচ্ছিলেন। কিন্তু ইংরেজরা অপমান করার সুযোগ পেলে তো ছাড়ে না। সুযোগেরও দরকার হয় না, ওরা সবসময় আমাদের দিকে অনেক ওপর থেকে তাকায়; ভাবে পিঁপড়ে বা পোকামাকড় দেখছে। তাই পায়ে দলে যেতে এক মুহূর্ত ভাবে না। সেভাবেই অপমান করা হল ফজল-ই-হক সাহেবকে। তিনি তো ইমানদার মানুষ; ইস্তাফা দিলেন। তবে বসে থাকার মানুষ তো আর নন। নবাব ফৈজ মহম্মদ খান পাঁচশ টাকা মাসোহারা দিয়ে তাঁকে নিজের রাজ্যে নিয়ে গেলেন। আমি পড়ে রইলুম ভগ্নহৃদয় নিয়ে। এও জানি, ফজল-ই-হক সাহেবও অনেক কান্না বুকে। নিয়েই দিল্লিকে বিদায় জানিয়েছিলেন। এমনকী জাঁহাপনা বাহাদুর শাহ নিজের গায়ের শাল খুলে তাঁকে পরিয়ে দিয়ে চোখ মুছতে মুছতে বলেছিলেন, আপনি যখন আলবিদা বলবেন, আমি জানি, আমার কিছু করার নেই। কিন্তু আমাকে যখন খুদা হাফিজ বলতে হবে, তখন খোদাই শুধু জানবেন, এই শব্দ দুটো উচ্চারণ করতে আমি কত যন্ত্রণা পেয়েছি। মান্টোভাই, আমার প্রিয় দোস্ত, আমার গজলের সমঝদার অপমান মাথায় নিয়ে শাহজাহানবাদ ছেড়ে চলে গেলেন।

তবে আর একজন মানুষ আমার জীবনে এলেন। খোদা কি আমাকে একবারে পথে বসিয়ে দিতে পারেন? নবাব মুস্তাফা খান শইফতাকে বন্ধু হিসেবে পেলুম। আমার চেয়ে ন বছরের ছোট। শাহজাহানাবাদের মানুষ। তার পূর্বপুরুষরা এসেছিল আফগানিস্থান থেকে। আরবি ফারসিতে চৌকস। গজলও খুব ভাল লিখতেন। এক সময় সুরা আর নারীই ছিল শইফতা সাবের জীবনের দুই বাহার। রামজু তবায়েফের সঙ্গে খুবই আশনাই ছিল তাঁর। রামজু কিন্তু যে সে তবায়েফ ছিল না। যেমন টাকাপয়সা ছিল, তেমনই পড়াশোনা।

শইফতা সাব যে কত ভাবে আমাকে সাহায্য করেছেন, তা হিসাব করে বলা যাবে না, ভাইজানেরা। আর আমার জীবনের সবচেয়ে অন্ধকার সময়ে একমাত্র তিনিই আমার পাশে ছিলেন। খোদা কসম, তাঁকে আমার সত্যিই কবিতার আত্মা মনে হত, যার গায়ে এই দুনিয়ার কোনও কলঙ্কদাগ লাগেনি। এরই মধ্যে আগ্রায় আম্মিজান মারা গেলেন, ভাই ইউসুফ একেবারে উন্মাদ। আমি আর পেরে উঠছিলুম না। তাই আবারও নিজেকে নিয়ে বাজি ধরলুম। জুয়ার আড্ডা খুললুম আমার শয়তানের কামরায়। জুয়া তো আগেও খেলেছি, একবার সে জন্য একশো টাকা জরিমানাও দিতে হয়েছিল, কিন্তু এবার আমি স্থির নিশ্চিত, জুয়া থেকেই নসিব ফেরাতে হবে আমাকে। তখন অবশ্য দিল্লিতে জুয়া খেলা বন্ধ করার জন্য খুব কড়াকড়ি। আমি ভাবলুম, বড় বড় ইংরেজরা আমার দোস্ত, আমাকে ধরবে কে? এই ভাবনাই আমার কাল হয়েছিল, মান্টোভাই। দিনে দিনে জুয়ার আসর সরগরম হয়ে উঠল। হাতেও মাঝে মাঝে টাকা। আসছে। আমি নিজেকে মনে মনে বলি : হম্ কো মালুম হ্যয় জন্নৎ কী হকীকৎ লেকিন
দিল কে খুশ রখনে কো গালিব য়ে খয়াল আচ্ছা হ্যায়
(স্বর্গের খবরাখবর আমার জানা আছে, কিন্তু
মনকে আনন্দে রাখতে গালিব, এমন খেয়াল মন্দ নয়।)

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *